শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট

বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন ১৭ই সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক ঘটনায় পরিণতি লাভ করে। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, আন্দোলন বা হৈ চৈ প্রসূত মনোভাবই ছিল শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল কারণ। পেশাদার ছাত্র নেতৃবৃন্দ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের মত উত্তম রিপোর্টের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হইয়া উঠিলে অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতিতে এই রিপোর্ট বাতিল ঘোষিত হয় ও ১৯৬৩ সালে পরীক্ষার্থী ছাত্রদের বিনা পরীক্ষায় বি.এ, বি.কম, বি.এস.সি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এই ধরনের উদ্ভট সিদ্ধান্তের বিস্ময়কর দিকটি হচ্ছে পাঠ্য বিষয় কি হইবে, তাহার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক ছাত্র-শিক্ষকগণ নয়। যেন রোগীই ডাক্তারকে প্রেসিক্রিপশন অর্থাৎ ঔষধ ও পথ্য বাতলাইয়া দিতেছে, কি হাস্যকর পরিস্থিতির শিকার আমরা! যাহা হউক, ১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্র বিক্ষোভকালে পুলিশের গুলীতে কয়েকটি তাজা তরুণকে প্রাণ দিতে হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর আহ্বানে গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে ৭ই অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তানে “প্রতিবাদ দিবস” পালিত হয়।

সংবিধানের গণতন্ত্রায়ন

কারামুক্তির পর জনাব সোহরাওয়ার্দী প্রারম্ভেই “নয় নেতা’র বিবৃতির সহিত একাত্মতা ঘোষণা করেন। তবে সেই সাথে বাস্তবতার আলোকে ১৯৬২-র সাংবিধানিক গণতন্ত্রায়নের (Democratisation of the Constitution) সুনির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পন্থাও তিনি দেশবাসীর নিকট পেশ করেন। ইহা নিঃসন্দেহে সোহরাওয়ার্দীর অশেষ বিচক্ষণতা ও বাস্তব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নিদর্শন ছিল; কেননা প্রেসিডেন্ট আইউব খানের প্রতি সংবিধান বাতিল করিয়া নির্বাচিত গণপরিষদ দ্বারা নূতন সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে নেতার আহ্বান মোট বাস্তবসম্মত ছিল না। জনাব সোহরাওয়ার্দীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নিম্নলিখিত স্বাক্ষরদানকারীগণ কর্তৃক সংবিধান গণতন্ত্রায়নের সংকল্প ঘোষিত হয়ঃ

মাওলানা আবুল আলা মওদুদী, মাওলানা তোফায়েল মোহাম্মদ, জামায়াতে ইসলামী; মাহমুদ আলী কাসুরী, সি.আর, আসলাম, ন্যাপ; কর্নেল আবুল হোসেন, রিপাবলিকান পার্টি, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবর রহমান, আব্দুস সালাম খান, খাজা খায়ের উদ্দিন, মোশতাক আহমদ গুরমানী, সাবেক গভর্নর পশ্চিম পাকিস্তানের; মৌলভী গোলাম মোহাম্মদ, মেজর ইসহাক, চৌধুরী ফজল ইলাহী, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, মাহমুদ আলী, মোহাম্মদ সোলায়মান, সৈয়দ আজিজুল হক, ইউসুফ আলী চৌধুরী, সর্দার মাহমুদ খান, রাজা গোলাম নবী, মাহমুদুল হক ওসমানী, জয়েন উদ্দিন, আখতার উদ্দিন খান, মনজরুল হক, হায়দর বক্স জাতোই, শেখ আবদুল মজিদ সিন্ধী, আলী বকস খান তালপুর, ইউসুফ খাটক, গোলাম মোস্তফা ভুরঘুরি, সর্দার বাহাদুর খান, ফজলুর রহমান, আবুল কাসেম, মিঞা মোমতাজ দওলাতানা, গোলাম জিলানী খান, মোহাম্মদ হোসেন চাট্টা, জাতীয় পরিষদ সদস্য; মুহাম্মদ ইউসুফ খাটক, জাতীয় পরিষদ সদস্য; সর্দার এম, আইয়ুব, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য; আহমদ সৈয়দ কিরমানী, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, সর্দার মোহম্মদ জাফরুল্লাহ, জেড, এইচ, লারী, জৈন নোরানী, সৈয়দ ইবনে হাসান,, এম, এইচ, এ, গাজদার, আগা গোলাম নবী পাঠান, কাজী ফয়েজুল্লাহ, হাজ মাওলা বক্স খসরু, গোলাম মোহাম্মদ খান, গোলাম আলী তালপুর, জাতীয় পরিষদ সদস্য, কাজী ফয়েজ মোহম্মদ, রসুল বক্স তালপুর, মোহাম্মদ হানিফ সিদ্দিকী, এম, এ, গুরু, আলী গহর খুরু।

আজম খানের পদত্যাগ

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সাথে মতবিরোধ দেখা দেয়ায় লেঃ জেঃ আজম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ হইতে ইস্তফা দেন। তদস্থলে জনাব গোলাম ফারুক এপ্রিল মাসে (১৯৬২) গভর্নর হয়ে আসেন। কিছুকাল পর স্বাস্থ্যগত কারণে গভর্নর গোলাম ফারুক পদত্যাগ করিলে প্রেসিডেন্ট আইউব ২৮-১০-৬২ ইং তারিখে তাহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মোনায়েম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করেন।

ভাসানীর অনশন

বন্দি জননেতা মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের বন্যাকবলিত দুর্গতদের জন্য ২৫ কোটি টাকা খয়রাতি সাহায্য, পাটের ন্যায্যমূল্য, মোহাজেরদের পুনর্বাসন ও ক্রুগ মিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থার দাবিতে ২৬শে অক্টোবর (১৯৬২) হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করেন। তাহার স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা দিলে ২৭শে অক্টোবর তাঁহাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সর্বজনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নূরুল আমিন, আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, পীর মোহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া), সৈয়দ আজিজুল হক, শেখ মুজিবর রহমান, মাহমুদ আলী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ ২৯শে অক্টোবর অনশনরত মাওলানা ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দেশের ও দশের স্বার্থে অনশন ভঙ্গ করিতে তাহাকে অনুরোধ জানান এবং বিবৃতিতে মাওলানা ভাসানীকে মুক্তি দানের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান। অবশেষে প্রবল অপ্রতিরোধ্য গণদাবির মুখে সরকার ৩রা নভেম্বর (১৯৬২) মাওলানা ভাসানীর উপর হইতে সকল প্রকার বাধা-নিষেধ ও অন্তরীণাদেশ প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হন।

রাজবন্দি মুক্তি

জনগণের চাপে জুন, জুলাই ও আগস্ট মসে (১৯৬২) বেশ কিছু সংখ্যক বিনাবিচারে আটক রাজবন্দিকে মুক্তি দান করা হয়। ১৩ই আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নিরাপত্তা আইন সংশোধন করিয়া নিরাপত্তা বন্দিদের আটক পর্যালোচনা করিবার জন্য হাইকোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে একটি রিভিউ বোর্ড গঠনের আইন পাস করা হয়। এই সময়ে প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলীয় সদস্যদের একান্ত চাপ প্রয়োগে ক্রোধান্বিত অর্থমন্ত্রী হাফিজুর রহমান সদর্পে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, অভ্যস্ত বা পাশব অপরাধী ব্যতীত অন্য সকলকে মুক্তি দেওয়া হইয়াছে। (Released all except the hardened criminals)। এককালে ইংরেজ শাসকের তাবেদার হাফিজুর রহমানের মুখে এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য আমাকে কারান্তরালে শুধু হতভম্বই করিয়াছে। এই প্রকার অপ্রত্যাশিত মন্তব্য শাসক মহলের বিকৃত মনোভাবপ্রসূত। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর এই ধরনের অসহিষ্ণ ও অন্যায় আচরণ এবং বক্তব্য যে রাষ্ট্রের স্বাচ্ছন্দ্য গতির সমূহ ক্ষতি করিয়াছে, তাহা বলাই বাহুল্য।

চীন-ভারত সীমান্তঃ ক্রুশ্চেভের ভূমিকা

গণচীন গোড়া হইতেই চীন-ভারত সীমান্ত “ম্যাকমোহন লাইন” মানিয়া নিতে অস্বীকৃতি জানাইয়া আসিতেছিল। উক্ত বিষয়ে মতান্তর ১৯৫৯ সাল হইতে ক্রমাগতভাবে তিক্ততার রূপ পরিগ্রহ করে এবং ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ মধুর সম্পর্ক ১৯৬২ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর উভয় দেশের মধ্যে সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে জোরদার করার জন্য সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহায়তাদানে অতি উৎসাহ প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে সোভিয়েট রাশিয়া চীনের সমমতাদশী হওয়া সত্বেও ভারতের মত আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবির যৌক্তিকতাকে উপেক্ষা করিতে পারে নাই। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, মানব সভ্যতা বিধ্বংসী আণবিক অস্ত্রের মারাত্মক শক্তি সম্পর্কে সচেতন নিকিতা ক্রুশ্চেভ মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই “সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও ধনতান্ত্রিক বিশ্বের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান” নীতি অত্যন্ত নিষ্ঠার সহিত পালনে সচেষ্ট ছিলেন। ক্রুশ্চেভ কর্তৃক বিশ্ব যুদ্ধ সূত্রপাতের সামান্যতম কারণকেও উৎসাহ অটল ছিল, ১৯৫১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া গণচীনকে অদূরদর্শী পদক্ষেপে উৎসাহ দেওয়া হইতে বিরত ছিল। মাওসেতুং যখন “সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা গোষ্ঠীকে কাগুজে বাঘ” (Paper Tiger) ও অন্যান্য অসার ভাষার কথা মালায় তুচ্ছ করিয়া সভ্যতা বিধ্বংসী আণবিক যুদ্ধের পটভূমিকা সৃষ্টির প্রচেষ্টায় লিপ্ত, ক্রুশ্চেভ তখন তাকে কাগুজে বাঘদের আণবিক দাঁত আছে, (Paper tiger have nuclear teeth) কথাটা স্মরণ করাইয়া দিতে ইতঃস্তত করেন নাই। মানব সভ্যতার মহা সংকটময় মুহূর্তে ক্রুশ্চেভের মত ব্যক্তি সোভিয়েট রাশিয়া তথা বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন বিধায় আণবিক যুদ্ধ অতি সতর্কতার সহিত এড়ানো সম্ভব হইয়াছে। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারের সহিত ক্যাম্প ডেভিড মিলিত হইয়া শান্তির আবহাওয়া সৃষ্টি করেন। আগামী দিনের ইতিহাসবেত্তা গণ ক্রুশ্চেভের এই পদক্ষেপের যথার্থতা লিপিবদ্ধ করিতে কার্পণ্য করেন না বলিয়া আমার বিশ্বাস। অবশ্য ইহার ফলে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়। বলাই বাহুল্য যে, মানবজাতি ও সভ্যতা সংরক্ষণ ও অগ্রযাত্রার একান্ত প্রয়োজনেই কমিউনিস্ট বিশ্বের এই দ্বিধাবিভক্তি ছিল এক ঐতিহাসিক অপরিহার্যতা (Historical imperative) ক্রুশ্চেভের বাস্তব বুদ্ধির আরেকটি নিদর্শন ১৯৬২ সালের ২৮শে অক্টোবর কিউবা থেকে আণবিক যুদ্ধাস্ত্র প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা। এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র দুর্বলতাপ্রসূত- এই ঢালাও মন্তব্য কেবলমাত্র মানবপ্রেম বিবর্জিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে করা সম্ভব। পক্ষান্তরে ইহা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তথা সভ্যতা বিধ্বংসী আণবিক সংঘর্ষ পরিহারে ক্রুশ্চেভের অনন্য ভূমিকা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখে। সবাই স্বীকার করিবেন, স্টালিন শাসনের হত্যা ও নিধনের ভাষাকে ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত নাগরিকদের জীবনে, নিরাপত্তার ভাষায় রূপান্তরিত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করিয়া গিয়াছেন। মানবাধিকারের ইতিহাস যে নিরপেক্ষ মূল্যায়নে তাহার নাম যথাযথ মর্যাদার সহিত উচ্চারিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। স্মার্তব্য যে, ক্রুশ্চেভ ১৯৫৮ সালের ২৭শে মার্চ সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ক্ষমতার কোন্দলে পড়িয়া ১৯৬৪ সালের ১৪ অক্টোবর তাঁহার পদত্যাগ করিতে হয়। গণচীন সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক আন্তর্জাতিক সীমান্ত ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম ১৯৬২ র ১লা নভেম্বর দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পাটির জাতীয় কাউন্সিল ৬০-৩০ ভোটে দ্ব্যর্থহীনভাবে “ভারত আক্রমণ” ঘোষণা করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পত্তিত জওয়াহের লাল নেহেরু ইতিমধ্যে (২০শে নভেম্বর ১৯৬২ ইং) মার্কিন শক্তিদ্বয়ের সমীপে সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং এর আগে ২২শে অক্টোবর (১৯৬২) জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আজাদী রক্ষার অগ্নি পরীক্ষায় দলমত-নির্বিশেষে সকল ভারতীয় নাগরিকের সাহায্য-সহায়তা কামনা করেন। চীন-ভারত যুদ্ধে নেফা এলাকায় অর্থাৎ ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বিপর্যয়বরণ ও ছত্রভঙ্গ হওয়ার মত সংকটময় পরিস্থিতিতে ২৬শে অক্টোবর (১৯৬২) সমগ্র ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ইহার পর পরই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ে এবং জ্যোতিবসু ও নামুদ্রিপদের নেতৃত্বে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসিষ্ট) নাম ধারণ করে। দেশ ও দেশের মাটির প্রতি এই ধরনের আনুগত্য নিবেদন এতকাল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট বিশ্বে অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয় ছিল। স্বীকৃত কমিউনিস্ট প্রভুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টির জন্য অবশ্য করণীয়। ইহাই কমিউনিস্ট আন্দোলনের নিয়ম-আইন ও ভিত্তি। গোঁড়া ধর্মান্ধ ও কমিউনিস্টদের মধ্যে মূলতঃ চারিত্রিক কোন প্রভেদ নাই। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান এস,এ, ডাংগের সুযোগ্য নেতৃত্ব এইভাবেই কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক নূতন ধারা সংযোজিত করে। ইহাই উত্তরকালে ফুলে ফুলে বিকশিত হয়ে “এককেন্দ্রিক” কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভিন্ন দেশের মাটির নানান বাস্তব পারিপার্শ্বিকতাকে স্বীকার করার মত আবহাওয়া সৃষ্টি করিয়াছে এবং পরিণতিতে “বহু কেন্দ্রিক” কমিউনিস্ট আন্দোলন দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছে। ফলে উন্মোচিত হয়েছে কমিউনিস্ট বিশ্বে এক নব দিগন্ত। অবশ্য উল্লেখ্য যে, কমিউনিস্ট বিশ্বের শিরোমণি সোভিয়েত রাশিয়া মতভেদ সত্ত্বেও প্রকাশ্যে গণচীনের রাজ্য আক্রমণের ভুমিকাকে সমালোচনা করে নাই বা মতদ্বৈততা প্রকাশ করে নাই। অন্ধ অনুসরণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। তাই এই কথা স্বীকার করিতে হবে, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সভ্যতার অগ্রযাত্রায় এইভাবেই এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করিয়াছে। আমি মনে-প্রাণেই বিশ্বাস করি যে, তর্ক-বিতর্কের গর্ভেই আবিষ্কৃত হইবে মানব সভ্যতার অগ্রাভিযানে সুপ্ত দিক-দর্শন। তাই মুক্তবুদ্ধির অনুসারী হিসাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এই সাহসিক পদক্ষেপ মুক্ত মনেই অভিনন্দন জানাতে সেইদিন আমার এতটুকু কুণ্ঠা জাগে নাই।

কারামুক্তি

আগেই বলিয়াছি, নিরাপত্তা বন্দিদের মুক্তি বিবেচনার নিমিত্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৩ই আগস্ট প্রাদেশিক পরিষদে সংশোধনী বিধি অনুযায়ী পর্যালোচনা বোর্ড (Review Board) গঠন করেন। পর্যালোচনা বোর্ডে ব্যক্তিগত হাজিরা দেওয়ার প্রয়োজনে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবর রহমান ও তার পত্নী প্রচুর খাদ্যদ্রব্যসহ আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। তাঁহাদের সহৃদয়তা আমি মুগ্ধ হইলাম। ইতিপূর্বে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালেই শেখ সাহেব আমাকে ১৯৬২’র সংবিধান (আইউব সংবিধান)-এর কপি রাজশাহীতে জনাব সোহরাওয়ার্দী ও আতাউর রহমানের উপস্থিতিতে পাঠাইয়াছিলেন। সে সময় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় শেখ মুজিব বলেন যে, আমাদের নেতা অলি আহাদ রাজশাহীর কারাগারে বন্দি অবিলম্বে তার মুক্তি চাই। সে দিনের মুজিব ভাইয়ের এই কথায় কারাগারে আমার সম্পর্কে অনেকের উৎসাহ জাগে, কারাগারে আমার সম্মান অনেক বৃদ্ধি পোলো। মুজিব ভাই ও ভাবীর রাজনৈতিক মতবাদ ও কর্মধারার সহিত আমার প্রভূত গড়মিল থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে আমার প্রতি তাহাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য আমাকে চিরকাল তাঁহাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। যাঁহারা রাজনৈতিক মত-বিরোধকে সামাজিক সম্পর্কোচ্ছেদের সোপান হিসাবে ব্যবহার করেন, এই ঘটনার উল্লেখে আশা করি তাহাদের চক্ষু উন্মিলিত হইবে, তাহারা অতঃপর ইহার অন্তর্নিহিত মূল্য ও তাৎপর্য অনুধাবনে সচেষ্ট হইবেন।

যাহা হউক, পর্যালোচনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার ও সদস্য ছিলেন স্বরাষ্ট্র বিভাগীয় সেক্রেটারি আলী হাসান (সি,এসপি)। পর্যালোচনাকালে বোর্ডের চেয়ারম্যানের সহিত শুভেচ্ছা বিনিময়ান্তে তাঁহার উদ্দেশ্যে বলি যে, “My Lord, My Submission shall be against the heady & power drunk executives & if the detaining authority Home Secretary All Hassan talks, I shall immediately withdraw.”

অর্থাৎ “ক্ষমতা মদমত্ত আমলাদের বিরুদ্ধেই আমার বক্তব্য উপস্থাপিত করিব। এই অবস্থায় আমাকে আটককারী স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারি আলী হাসান যদি একটি কথাও উচ্চারণ করেন, তাহা হইলে আমি তৎক্ষণাৎ অংশগ্রহণ করা হইতে বিরত থাকিব।” যাহা হউক, বিচারপতি সাত্তারই সর্বক্ষণ একাকী বিভিন্ন প্রশ্ন আমার সহিত আলাপ-আলোচনা চালাইয়া যান। অতঃপ ডিসেম্বর (১৯৬২) বৃস্পতিবার আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে মুক্তি লাভ করি।

রাজনৈতিক দলিলাদি বিনষ্ট

সামরিক শাসন প্রবর্তনের কিছুকাল পর আমি একটি ট্রাংক ভর্তি রাজনৈতিক বিভিন্ন দলিলপত্র আমার অগ্রজতুল্য শ্রদ্ধেয় আবদুর রউফ সাহেবের বাসায় জমা রাখি। পরিতাপের বিষয়, কারামুক্তির পর ট্রাংকটি আনিতে গিয়া অবগত হই যে, পুলিশী হামলার অনর্থক চিন্তায় ভীত-সন্ত্রস্ত রউফ ভাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে কাগজপত্রগুলি অগ্নি সংযোগে বিনষ্ট করিয়া ফেলিয়াছেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রামে গ্রেফতার হওয়ার পর আমার অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ডঃ আবদুল করিমের বাসায় কয়েকবার খানা তল্লাশি করা হইয়াছিল। তাই, তাহার বাসায় রক্ষিত রাজনৈতিক দলিলপত্রগুলিও এক আত্মীয়ের বাসায় স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উল্লিখিত এই আত্মীয়টিও সামরিক আইনের ভয়ে শংকিত হইয়া এইসব কাগজপত্রও অগ্নিদাহ করেন। তবে আমার স্নেহময়ী বড় বোন রওশন আখতার তাহার নিকট রক্ষিত আমার কাগজপত্রগুলি যক্ষের ধনের ন্যায় আঁকড়াইয়া রাখেন এবং কারামুক্তির পর আমাকে সকল কাগজপত্র বুঝাইয়া দেন; ইহার ফলেই আজ আমার পক্ষে দলিল নির্ভর ঘটনারাজি বর্ণনা সম্ভব হইতেছে। আপার স্বামী জনাব মতিউর রহমান সাহেব ছিলেন চট্টগ্রাম বন বিভাগের ডেপুটি কনজারভেটর অব ফরেষ্টস।

কারা মুক্তির পর

কারামুক্তির পর শেখ মুজিবর রহমানের সহিত আমার রাজনৈতিক বিস্তারিত আলাপ আলোচনা হয়। আমরা উভয়ই জেনারেল আইয়ুব খানের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নীতিগত, কৌশলগত ও সাংগঠনিকগত দিক লইয়া আলোচনা করি। এই সময়ে মফঃস্বল সফরান্তে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের নির্দিষ্ট দিবসে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে অভ্যর্থনা জানাইবার জন্য শেখ মুজিবর রহমান ও আমি ঢাকা ফুলবাড়িয়া ষ্টেশনে যাই। ট্রেন হইতে অবতরণ করিয়াই জনাব সোহরাওয়ার্দী উপস্থিত সকলের সহিত শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আমার দিকে তাকাইয়া তরল হাস্যে মন্তব্য করেন, “তোমাকে ছাড়িয়া গভর্নর মোনায়েম খান ঠিক করেন নাই।” তদুত্তরে আমিও হাস্যরসের অবতারণা করিয়া বলি “স্যার, আপনাকেও মুক্তি দিয়ে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ভাল করেন নাই। কেননা আপনি তো গণতন্ত্রের দাবিতে গোটা দেশের জনগণকে ক্ষেপাইয়া তুলিয়াছেন।” ইহার পর ষ্টেশনের বারান্দায় দাঁড়াইয়া তিনি উচ্চস্বরে অভিযোগ জানাইলেন, “মার্কিনীরা আমার জন্য গাড়ি পাঠায় নাই কেন? কি করিয়া যাইবো”—- কথা বলিবার সাথে সাথে দুষ্ট ও মিষ্টি হাসি দিয়া আমার দিকে তাকাইলেন। বুঝিলাম, লক্ষ্য আমি। উত্তরে আমি বলিলাম, স্যার, সোভিয়েত রাশিয়ার কর্ণধার নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও কিউবার একনায়ক ফিডেল কেষ্ট্রোকে সামাল দিতে গিয়া প্রেসিডেন্ট কেনেডির প্রাণ ওষ্ঠাগত, তাই আপনার গাড়ীর কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। এইভাবে তরল পরিহাস্যোচ্ছলে আমার মনের কোনে পুঞ্জীভূত সঙ্কোচ কাটাইয়া উঠিবার ব্যাপারে তিনি আমাকে সংগোপনে সহায়তা করিতেছিলেন। মনে পড়ে, আওয়ামী লীগের কর্মী থাকাকালে ১৯৫৫ সালে জনাব সোহরাওয়ার্দীকে করাচির পথে আমরা তেজগাঁও বিমান বন্দরে বিদায় জানাই গিয়াছিলাম। জনাব সোহরাওয়ার্দী আমার সাংগঠনিক সফর সূচি জানিতে চাহেন ও আর্থিক অনটনের কাহিনী শুনিয়া চট্টগ্রামের জনাব আমীর হোসেন দোভাষকে “অলি আহাদকে টাকা দিও।” “I can say every pie will be rightly spent. He is honest to the pie”. আরো উল্লেখ্য যে, ১৯৬৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন সাহেবের কাকরাইলের বাসায় জনাব সোহরাওয়ার্দী ব্যারিষ্টার ডঃ কামাল হোসেনের নিকট যে উচ্ছসিত প্রশংসার ভাষায় আমার পরিচিতি তুলিয়া ধরিয়াছিলেন, তাহাতে আমি নিজেই লজ্জিত হইয়া পড়ি। উপরের দুইটি ঘটনা সোহরাওয়ার্দীর বিরাট মনের পরিচয় বহন করে। ইহা কেবল সোহরাওয়ার্দীর পক্ষেই সম্ভব ছিল; কেননা, তিনি ছিলেন পরশ্রীকাতর বাংগালী চরিত্রের ব্যতিক্রম।

এইস্থলে অন্য একটি ঘটনা উল্লেখের লোভ সম্বরণ করিতে পারিতেছি না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা অপরাহ্ন চারটায়। ঢাকায় অবস্থানরত নেতা সোহরাওয়ার্দীকে সভায় সময়মত (Punctually) উপস্থিত হইতে পুনঃপুনঃ স্মরণ করাইয়া আমি ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান তাহার নিকট হইতে পূর্বাহ্নে বিদায় গ্রহণ করি। স্মরণ করাইবার কারণ, বাংগালী নেতাদের সময়জ্ঞান নাই। আর আমার নিজের গর্ব আছে, আমি ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলি। যদিও নেতা যথাসময়ে সভায় হাজির হইবেন বলিয়া কথা দিয়াছিলেন, তবুও চিরাচরিত অভ্যাসবশতঃ তাহার সেই কথায় বিশেষ আস্থা স্থাপন করি নাই; অথচ আমি নিজেও নির্ধারিত সময় অপরাহ্ন চার ঘটিকায় আওয়ামী লীগ সদর দফতর ৫৬ নং সিম্পসন রোডে যাই নাই। কিন্তু জনাব সোহরাওয়ার্দী নির্ধারিত চার ঘটিকায় সভায় যোগ দিতে অফিসে আসেন। আমরা কেহই তখন উপস্থিত হই নাই। সার্কস্কিন স্যুট পরিহিত সোহরাওয়ার্দী অফিস পিয়ন শামসুর ময়লা দড়ির খাটিয়ায় দিব্যি দিবা-নিন্দ্রায় আত্মসমর্পণ করিলেন। বেশ কিছু পরে উপস্থিত হইয়া শেখ মুজিবর রহমান ও আমি অফিস বারান্দায় ফুলস্যুট পরিহিত ঘুমন্ত সোহরাওয়ার্দীকে দেখিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। পিয়নের ময়লা খাটিয়ায় এইভাবে অবলীলায় নিদ্রা যাওয়া একমাত্র কর্মবীর সোহরাওয়ার্দী পক্ষেই সম্ভব। মানুষের আর্থিক সংকটে সোহরাওয়ার্দী হাইকোর্ট মামলায় সদ্য উপার্জিত অর্থের শেষ কপর্দক পর্যন্ত এক মুঠায় বিলাইয়া দিয়া পরক্ষণেই স্বীয় চলিবার টাকার জন্য ঋণ করিতে দ্বিধা করেন নাই। বাংগালী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীবৃন্দ সোহরাওয়ার্দী উপার্জিত টাকা কীভাবে লুট করিয়াছে, তাহাও দেখিয়াছি।

সোহরাওয়াদী কর্মীদের সহিত আদর্শিক সম্বন্ধের চাইতে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর বেশি গুরুত্ব দিতেন; তাই কর্মীর সহিত সম্পর্কোচ্ছেদে তিনি বিচলিত হইতেন ও মনে আঘাত পাইতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা বৃহৎ শক্তির সহিত সামরিক জোটে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব ও বিশ্বশান্তি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করিয়া আমি সোহওরায়াদী অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধাচরণ করিলে তিনি এতই আঘাত পান যে, ঢাকার জগন্নাথ হলে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের বারান্দায় আমার প্রথম দর্শনেই মন্তব্য করেন।

“You have stabbed me in the back” অর্থাৎ “তুমি পিছন হইতে আমাকে ছুরিকাঘাত করিয়াছ।” ব্যথায় আমার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়া গেল। কিছুতেই বুঝাইতে পারি নাই যে, ইহা আমার সৎ আদর্শিক মতভেদ, সংগঠন কর্তৃক গৃহীত ও অনুসৃত নীতিরই আমি প্রতিধ্বনি করিয়াছি মাত্র। বিষয়টি সোহরাওয়ার্দী আবেগজনিত দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন; তাই এই ব্যাপারে তিনি ভাবাবেগপ্রসূত মন্তব্য করিয়াছেন। আদর্শও বড়, ব্যক্তি সম্পর্কও বড়, কোনটি কোন চরিত্রে প্রাধান্য লাভ করিবে, তাহা দৃষ্টিভঙ্গীর উপর নির্ভরশীল।

ঢাকা ফুলবাড়িয়া ষ্টেশন হইতে আমরা জনাব সোহরাওয়ার্দীর সহিত দৈনিক ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেনের কাকরাইলস্থ বাসভবনে গমন করি। জনাব সোহরাওয়ার্দী তথায় অবস্থান করিতেন। প্রেসিডেন্ট আইউবের ব্যক্তি শাসন বিরোধী গণআন্দোলনের প্রকৃতি ও গতিধারার উপর আলোকপাত করিবার উদ্দেশ্যে তাহার সহিত পুনরায় দেখা করিবার নির্দেশ দিয়া জনাব সোহরাওয়ার্দী আমাকে বিদায় দিলেন। নির্ধারিত সময়ে তাহার সহিত দেখা করিলে তিনি স্বীয় উদ্যোগে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দান করিয়া মন্তব্য করেন যে, রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবন ও পৃথক পৃথক রাজনৈতিক সভা সমিতি অনুষ্ঠান বিভিন্ন দলের মধ্যে ক্রমশঃ অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করিবে ও স্ব স্ব সংগঠনকে নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণে রাখিতে ব্যর্থ হইবে। ফলে ঘটনার বিবর্তনে জেনারেল আইয়ুব খানের একনায়কত্ব বিরোধী সংগ্রাম পারস্পরিক অবাঞ্ছিত কলহ-বিবাদে পর্যবসিত হইবে। ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির এক অংশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করিয়া দিয়াছে। অন্তরীণ হইতে মুক্তি পাওয়ার পর মওলানা ভাসানীও সহযোগিতা করিতেছেন না। কেহ কেহ সংবিধান বাতিলের দাবি তুলিয়াছেন। বলপূর্বক আইউব খানকে উৎখাত ব্যতীত ইহা সম্ভব নহে। সুতরাং সবল ও অপ্রতিরোধ্য জনমতের চাপের দ্বারা সংবিধান গণতন্ত্রায়ন সম্ভব করিয়া তুলিতে হইবে। এই প্রসঙ্গে ১৯৬২-র সংবিধান মোতাবেক অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাকে রাজনৈতিক ভুল বলিয়া সোহরাওয়ার্দী মত প্রকাশ করেন।

ইউনাইটেড অপজিশন পার্টি

জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত সদস্যগণ (বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ) জনাব মশিউর রহমানকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করিয়া ইউনাইটেড অপজিশন পার্টি গঠন করেন। অবশ্য জনাব রমিজউদ্দিন আহমদ, জনাব নাসরুল্লাহ খান স্ব স্ব গ্রুপের নেতা ছিলে। ইউনাইটেড অপজিশন পার্টি ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) জাতীয় পরিষদে একযোগে কাজ করিবার নিমিত্ত Combined Opposition party গঠন করে। সর্দার বাহাদুর খান, জনাব মশিউর রহমান, জনাব কামরুজ্জামান কমবাইন্ড অপজিশন পার্টির যথাক্রমে লীডার, ডেপুটি লীডার ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জাতীয় পরিষদের অভ্যন্তরে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।

পরিতাপের বিষয়, সর্বজনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী (বগুড়া), আবদুস সবুর খান, আবদুল মোনায়েম খান, অহিদুজ্জামান প্রমুখ ওয়াদা ভঙ্গ করিয়া প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সরকারে মন্ত্রী পদ গ্রহণ করেন। ফলে, সামরিক শাসকের একনায়কত্ব বাদ বিরোধী আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়।

শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে আলোচনার পর পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলীর সঙ্গে সংগঠনের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে সন্তোষ গমন করি। আমরা সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর একমত হওয়া সত্ত্বেও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনাব সোহরাওয়ার্দী ও তাঁহার যৌথনেতৃত্বে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের প্রস্তাব মওলানা ভাসানী প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁহার অস্বীকৃতি আমি সহজভাবে মানিয়া লইতে পারি নাই। কারণ আমার মনে পড়ে, ১৯৫৮ সালের মে মাসে করাচিতে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির সভা চলাকালে মওলানা সাহেব মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে না। তাঁহার এই উক্তি ছিল প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার সহিত যোগাযোগপ্রসূত। সুতরাং বর্তমানে তাহার সোহরাওয়ার্দী বিদ্বেষী মনোভাবই উক্ত যোগাযোগ বা আঁতাতেরই জের বলিয়া মনে করার কারণ ছিল। নেতাদের এইরূপ মনোভাবই দেশ ও জাতির সর্বনাশের কারণ হয়। মওলানা ভাসানী অবশ্য এই বৈঠকেই ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে জনাব মাহমুদ আলী ও হাজী মোহাম্মদ দানেশকে নিজ সংগঠনের প্রতিনিধি মনোনয়ন করেন।

জাতীয় পরিষদ অভ্যন্তরে ও বাহিরে প্রবল জনমতের চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট আইউব খান জনাব সোহরাওয়ার্দীর সহিত আলোচনা করিবার জন্যে তাহার উপদেষ্টা লেঃ জেঃ ডব্লিউ, এ, বাকীকে প্রেরণ করেন। করাচির নিজস্ব বাস ভবনে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা বৈঠকে লেঃজেঃ বাকি এক প্রশ্নের জবাবে জনাব সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করেন যে, ধারাবাহিক সংশোধনী দ্বারা সংবিধান সংশোধন করা হলে ১৯৬২ সালের এই সংবিধান মূল চরিত্রই হারাইয়া ফেলিবে এবং সংশোধিত সংবিধানটি ১৯৫৬ সালের সংবিধানের রূপ গ্রহণ করিবে। জেনারেল বাকীর নিকট হইতে এই বৈঠকে আলোচনার রিপোর্ট লাভের পর আইউব খান দ্বিতীয়বার আলোচনার উৎসাহ হারাইয়া ফেলেন।

স্বাধীন বাংলার আওয়াজ

কারামুক্তির পর অত্যন্ত সতর্কতার সহিত লক্ষ্য করেছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-যুব সমাজে ও রাজনৈতিক অংগনে স্বাধীন বাংলার আওয়াজ একটি সোচ্চার আওয়াজে পরিণত হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকলাপে উদ্বিগ্ন পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিন ২৭শে নভেম্বর (১৯৬২) রাত্রিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় মন্তব্য করেন, “During the last five years that I have been in Dacca people from all sections of East pakistan have called on me mostly my friends, colleagues and co-workers & it has pained me to learn that a whispering campaign among a large section of people is going on contemplating secession… Unfortunately this idea is also finding support amongst every small section of west pakistan. The other day at a dinner party a very high official from west Pakistan told me what is the harm if we have confederation”?

অর্থাৎ পাঁচ বৎসরকাল ঢাকায় অবস্থানকালে বিভিন্ন স্তরের লোকজন যাহার অধিকাংশই আমার বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মী আমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন, তাহাদের নিকট হইতে আমি জানিতে পারিয়া ব্যথিত হয়েছি যে, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্ন হবার ব্যাপারে কানাঘুষা চলিতেছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ এই মতের সমর্থক। সম্প্রতি এক নৈশভোজে পশ্চিম পাকিস্তানের একজন অতি উচ্চপদস্থ কর্মচারী আমাকে বলেন যে, কনফেডারেশন গঠন করিলে ক্ষতি কি?”

১৯৬৩ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত মার্কিন সাহায্য হইতে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ পূর্বাহ্নেই নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইবে। ইহার ফলে পূর্ব পাকিস্তানীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চাইতে অধিকতর সহানুভূতিশীল মনে করিবার ইন্ধন পাইয়া গেল। সুকৌশলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানি জনতাকে উস্কানি দান করাই ছিল উপরোক্ত মন্তব্যের লক্ষ্য। প্রেসিডেন্ট আইউব এই সময়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব চীন-সোভিয়েটের সহিত ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোটের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কেন্দ্রীয় সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্যই মার্কিন সরকার নানাভাবে প্রচেষ্টা চালাইতে থাকে। এই প্রচেষ্টায় শেখ মুজিবর রহমান দাবার গুটি থেকে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করেন নাই। শক্তিশালী দোসর হিসাবে তাহার সহিত যোগ দেয় দৈনিক ইত্তেফাক। পক্ষান্তরে আইয়ুব সরকার কর্তৃক পুনঃ পুনঃ লাঞ্ছিত হওয়া সত্ত্বেও শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সংহতি, একাত্মতা ও অখণ্ডত্ব রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। কোন প্রকার প্রলোভন বা প্ররোচনা তাহাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিচলিত করিতে পারে নাই।

১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দিদ্বয় আবদুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদি অবগত হই। ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাঁহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন।

এমনি বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক শূন্যতায় “৯ নেতার” ঐতিহাসিক বিবৃতির সূত্র ধরিয়া জনাব সোহরাওয়ার্দী ১৯৬২’র সংবিধান ‘গণতন্ত্রায়নের’ আওয়াজ তোলেন এবং পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতা, কর্মী এবং জনতাকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করিবার গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেন; কিন্তু বিধিবাম! অচিরেই সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ হইয়া পড়েন এবং চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লণ্ডন গমন করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দী লণ্ডন গমনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের রাজনৈতিক তৎপরতা স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দ তখনও কিছুটা সক্রিয় ছিলেন যেমন, জুলাই মাসে (১৯৬৩) চট্টগ্রাম জেলা বন্যাকবলিত হইয়া পড়িলে তাঁহারা সাহায্য ও পুনর্বাসন কাজে কিছুটা তৎপরতা দেখান।

টাঙ্গাইল-বাসাইল উপ নির্বাচন

টাঙ্গাইল-বাসাইল উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবার প্রয়াসে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, সাবেক আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও অপুনরুজ্জীবিত মুসলিম লীগ অংশ এবং মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), নেজামে ইসলাম পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর ২৩শে আগস্ট (১৯৬৩)-এর সম্মিলিত বৈঠকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসন্ন উপনির্বাচন সুষ্ঠুভাবে তত্ত্বাবধানের জন্য আমাকে আহ্বায়ক নিয়োগ করিয়া সাত সদস্যবিশিষ্ট এক “নির্বাচন সমন্বয় কমিটি” গঠন করে এবং উপরে বর্ণিত রাজনৈতিক সংস্থাগুলি সম্মিলিত বিরোধী দল নামে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেয়। টাঙ্গাইল-বাসাইল প্রাদেশিক পরিষদ উপনির্বাচনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পরিচালিত মুসলিম লীগ (কনভেনশন) প্রার্থী ছিলেন করটিয়ার জনাব বায়েজিদ খান পন্নী ও সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন টাঙ্গাইলের খোদা বকস। সরকারি প্রার্থী প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করিয়া মৌলিক গণতন্ত্রীদের (নির্বাচনী কলেজ) ভোটে নির্বাচিত হন। পূর্বাহ্নে বিচক্ষণ সোহরাওয়ার্দী লন্ডনের রোগশয্যা হইতে সতর্কবানী উচ্চারণ করিয়া সংবাদপত্রে এই মর্মে বিবৃতি দিয়াছিলেন যে, “Going will be heavy” অর্থাৎ যাত্রাপথ হইবে বন্ধুর। এই সময়ের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের নামে যে বিপুল অর্থ মৌলিক গণতন্ত্রী অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদের দেওয়া হইয়াছিল ইহার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাহাদের পকেটস্থ হইয়া পড়ে। এই অবস্থায় সরকার মনোনীত প্রার্থী সব মৌলিক গণতন্ত্রীর ভোটে নির্বাচিত হওয়া স্বাভাবিক এবং হয়েছে তাই।

এন,ডি, এফ-এর দুর্বলতা

স্বাস্থ্যগত কারণে জনাব সোহরাওয়ার্দীর বিদেশ অবস্থানকালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে মাওলানা ভাসানী নিজের সংগ্রাম ঐতিহ্য ও আদর্শবাদ ত্যাগ করিয়া প্রাসাদ কুচক্রীদের কবলে পতিত হন। এই ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমটির সদস্য দ্বয় জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ও আহমাদুল কবীর। লাহোরের ব্যারিষ্টার মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরীর বাসভবনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মিলিটারী সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার পীরজাদার সহিত তাহাদের গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। উহাতে আইউব-ভাসানীর গোপন আঁতাতের ভিত রচিত হয়। কিসের বিনিময়ে উক্ত দুই ভদ্রলোক এবং মাওলানা ভাসানী জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে এইভাবে ছুরিকাঘাত করিয়াছিলেন ভবিষ্যৎ ইতিহাস সে বিষয়ে সাক্ষী দিবে। আইউব-ভাসানী দূতদের গোপন মিলনের প্রত্যক্ষ ফসল ১৯৬৩ সালের ২২শে জুন রাওয়ালপিন্ডিতে আইউব-ভাসানী সাক্ষাংকার। বলাই বাহুল্য যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে সংগ্রাম নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যেই এই দুই উদ্যোক্তা ভাসানী-আইউব সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পরিষদে বিরোধী দলীয় সোচ্চার কণ্ঠ জনাব মশিউর রহমান প্রেসিডেন্ট আইউব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিমকের মর্যাদা রক্ষার জন্য পর্দার অন্তরালে নাটের গুরুর ভূমিকা পালন করিতে থাকেন। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পরবর্তী রাজনৈতিক ভুমিকার ক্রমবিকাশ উপরোক্ত তিক্ত সত্যের ফলশ্রুতি মাত্র। উত্তরকালে জনাব মশিউর রহমান গর্বের সহিত একই দালালীর ভুমিকা অবৈধ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ও অবৈধ প্রেসিডেন্ট সেনাপতি লেঃ জেঃ জিয়াউর রহমানের কালে পালন করিয়াছিলেন।

ভাসানী-আইউব সাক্ষাৎকারের অব্যবহিত পরই ৩০ ও ৩১ আগস্ট এবং ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী সংগঠন পুনরুজ্জীবনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন এবং চক্রান্তকারীরা তাহাকে জোর সমর্থন জানান। কিন্তু পূর্বাহ্নে ২৮ ও ২৯শে আগস্ট ৩/৮, লিয়াকত এভিনিউ (জনসন রোড) ঢাকায়, দুই দিবসব্যাপী বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক কমিটি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে জোরদার করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিল। তাই কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় আমি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবনের তীব্র বিরোধীতা করি। সভায় শেষ পর্যন্ত আমাদের বক্তব্যই গৃহীত হয় এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে শক্তিশালী করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঐক্যের এই পথকে বিঘ্নিত করিবার প্রয়াসেই মাওলানা ভাসানী পল্টনে আহূত জনসভায় এক জোরালো বক্তৃতা দিলেন এবং এই বক্তৃতা মঞ্চ হইতে পার্টির অভিমত না নিয়াই এককভাবে ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করিলেন।

১৯৬৩ সালের ১লা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে মাওলানা ভাসানী নয়া চীনের প্রজাতন্ত্র দিবসে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্য ছিলেনঃ সর্বজনাব মশিউর রহমান, সদস্য জাতীয় পরিষদ; আখতার উদ্দিন আহমদ, সদস্য জাতীয় পরিষদ; ডঃ জাবেদ ইকবাল, শওকত আলী, বার-এট-ল, কায়সার আহমদ, পি,এফ, এস (পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস) ও জেনারেল হাবীবউল্লাহ। চীন সফর হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াই মাওলানা ভাসানী তাঁহার ঘোষিত আইন অমান্য আন্দোলন বাতিল ঘোষণা করেন এবং আইউব সরকারের প্রতি সমর্থন দানের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাইতে থাকেন। ইহাই ব্যক্তিপূজা রাজনীতির অভিশাপ।

সোহরাওয়ার্দীর তিরোধান

শেখ মুজিবর রহমান করাচি-পিণ্ডিতে সরকারি উচ্চ মহলের দোসর পুঁজিপতি শ্রেণির একটি বিশেষ অংশের অবাঞ্ছিত প্রভাবে আইউব বিরোধী ঐক্য সংস্থা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে জোরদার করিবার প্রয়াস পরিত্যাগ করেন। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব লইয়া তিনি জনাব সোহরাওয়ার্দী সমীপে লন্ডন পর্যন্ত গমন করেন। বিচক্ষণ সোহরাওয়ার্দী অন্তর্দৃষ্টি বলেই শেখ মুজিবর রহমানের প্রস্তাবের আড়ালে করাচি-পিণ্ডি কুচক্রী মহলের কুৎসিৎ চেহারাগুলি অবলোকন করিতে পারিয়াছিলেন। তাই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একনিষ্ঠ সোহরাওয়ার্দী তাঁহার রোগ শয্যাপার্শ্বে দণ্ডায়মান শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে শক্তিশালী করিবার ব্যাপারে তাহাকে নির্দেশ দান করেন। ইহা সহজেই অনুমেয় যে, শেখ মুজিবর রহমান নির্দেশটি হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিতে পারেন নাই। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে, ইহার কিছুকাল পরে হৃদরোগে আক্রান্ত জাতির কাণ্ডারী ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতের কন্টিনেন্টাল হোটেলে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী বিবর্জিত পরিবেশে পরলোকগমন করেন। ৭ই ডিসেম্বর সকাল ১১-৫০ মিঃ সোহরাওয়ার্দীর মৃতদেহসহ বিমান করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। করাচির শোকাকুল জনতা কর্তৃক অনুষ্ঠিত জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা আবদুস সাত্তার নিয়াজী। দাফনের জন্য পরের দিন অর্থাৎ ৮ই ডিসেম্বর সকাল ১০-১৭ মিঃ শবাধারবাহী বিমানটি ঢাকা (তেজগাঁও) বিমান বন্দরে অবতরণ করিলে লক্ষ লক্ষ শোকাভিভূত ও বিগলিত জনতা এক অবিস্মরণীয় মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা করে। ইহা কেবল উপলব্ধি করা যায়, বর্ণনা করা যায় না। “সোহরাওয়ার্দী নাই” কঠিন সত্য গ্রহণ করিয়াই ঢাকার রেসকোর্সে পীর মোহসেন উদ্দিন আহমেদের ইমামতিতে জনসমুদ্র জানাযা নামাজ আদায় করে এবং অপরাহ্ন ২-৩০ মিঃ ঢাকা হাইকোর্টের পার্শ্ববর্তী জমিনে তাঁহার দাফন করা হয়। পরিতাপের বিষয়, তাহার নশ্বর দেহকে ঢাকার মাটিতে শায়িত রাখিয়া তাহার উত্তরসূরীগণ তাঁহার গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাকে অবমাননা করিতে বিন্দুমাত্রও বিবেক দংশনবোধ করে নাই। গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলিয়া অভিহিত সোহরাওয়ার্দীর প্রতি ব্যঙ্গ আর কাহাকে বলে!

একনায়কত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জনাব সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একমাত্র নির্ভরশীল কাণ্ডারী। সোহরাওয়ার্দী জনগণকে ক্ষমতার মূল উৎস মনে করিতেন। তাই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁহার রাজনীতির মূলমন্ত্র। রাষ্ট্রীয় বা জীবন-দর্শনে বিভিন্ন বিষয়ে তাহার দৃষ্টিভঙ্গী ও আমাদের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গীতে পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য ছিল; তবে, তাহার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অন্তঃশক্তিপ্রসূত এবং কখনই উহা ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তপ্রসূত ছিল না।

রাজনৈতিক শূন্যতা

সোহরাওয়ার্দীর তিরোধান জাতিকে সম্বিতহারা করিয়াছে; কিন্তু বাঁচিয়েছে আইউব মুজিব চক্রান্তের রাজনীতিকে। শেখ মুজিব কালবিলম্ব না করিয়া স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করিলেন এবং অদৃশ্য হস্তের অংগুলী হেলনে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমালেন। তাঁর পশ্চিম পাকিস্তান সফরের উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। উল্লেখ্য যে, পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা খাজা মোহাম্মদ সফদার ২১শে জানুয়ারি এক যুক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের সংবাদ প্রকাশ করেন। ইহার আগে ২৬, ২৭ ও ২৮শে জানুয়ারি (১৯৬৩) করাচি বৈঠকে দশ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। উক্ত বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবের দায়ে মে মাসে (১৯৬৩) ঐ সদস্যদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী মামলা দায়ের করা হয়। এইভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট যখন জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত, ঠিক তখনই শেখ মুজিবর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান গমন করেন এবং আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার উৎসাহ দেন। ফল যাহা হইবার তাতাই হইল; পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হইল। ঢাকা ফিরিয়া ২৫শে জানুয়ারি (১৯৬৪) স্বীয় বাসভবনে (৬৭৭, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা, সড়ক নম্বর ৩২) শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সম্পাদকবৃন্দ এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দের এক যুক্তসভা আহ্বান করেন এবং উক্ত সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে নভেম্বর মাসে (১৯৬৩) অনুষ্ঠিত অনুরূপ সভায় আওয়ামী লীগকে পুনজ্জীবনের দাবি উঠিয়াছিল। কিন্তু আগেই বলিয়া, জনাব সোহরাওয়ার্দী লন্ডনে উপস্থিত শেখ মুজিবকে স্পষ্টভাবে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত না করার নির্দেশ দিয়াছিলেন। ব্যর্থ মনোরথ শেখ মুজিবর রহমান লণ্ডন হইতে ফিরিয়া সোহরাওয়ার্দীর বক্তব্য নেতৃবৃন্দকে জানাইবার জন্য ৭ই ডিসেম্বর (১৯৬৩) জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে (৫০০-এ, ধানমণ্ডি আ/এ, সড়ক নং- ৭) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করেন; কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক ইন্তেকাল কারণে এই সভা মুলতবী হয়ে যায়।

আমি ও আবদুস সামাদ কারান্তরালে আটক থাকাকালেই পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক কমিটি আওয়ামী লীগের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াই ২৮ ও ২৯শে ফেব্রুয়ারি ও ১লা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে দল পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এইভাবেই কৃষক শ্রমিক পার্টি ব্যতীত অন্য সকল রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবত করে জাতীয় সেই সংকটকালে নেতৃবৃন্দ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেই দুর্বল করেন। কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আইউব যাহা চাহিয়াছিলেন- এইভাবেই নেতৃবর্গের অবিমৃষ্যকারিতা অর্থাৎ নিজ নিজ দল পুনরুজ্জীবনের আইউবের সেই আকাংখাই পূর্ণ হইয়াছিল এবং পরিণতিতে আইউবের প্রভুত্বব্যঞ্জক শাসন ব্যবস্থা হইয়াছিল আরও দৃঢ়।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

কলিকাতায় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হইলে ঢাকায় উহার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দাঙ্গা প্রতিরোধকল্পে ঢাকার সর্বস্তরের নাগরিকই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র,কর্মী, আইন পরিষদ সদস্য, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিকদের এক যৌথ সভায় “দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি” গঠন করা হয়। গভর্নর মোনায়েম খান ও কনভেনশন মুসলিম লীগ “দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’র তাৎপরতাকে সুনজরে দেখেন নাই। দাঙ্গা কবলিতদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে প্রশাসনিক যন্ত্রের কর্মশিথিলতা আমাদিগকে মর্মাহত করিতে এবং কোন কোন স্থলে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সহিত তর্কবিতর্ক ও বচসা এড়ান যাইত না। গরীব হিন্দু কুমারদের বসতি এলাকা রায়েরবাজার দাংগায় বিধ্বস্ত হইয়াছিল। আমি, জনাব আবদুস সামাদ এবং ওজিউদ্দিন আহমদ চৌধুরী ওই এলাকায় সাহায্য ও পুনর্বাসন কাজে ব্যাপৃত থাকাকালে উগ্র মেজাজী প্রশাসনিক কর্মকর্তার সহিত কথা কাটাকাটি হয়। ক্ষমতা প্রদর্শনের নেশায় উন্মত্ত উক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তার অভিলাষেই ২৭শে জানুয়ারি (১৯৬৪) প্রাদেশিক সার্কিট হাউসে অবস্থানরত আমার প্রাণ প্রতিম অনুজ মোহাম্মদ আমিরুজ্জামান, সি,এস,পি’র কামরা হইতে নিরাপত্তা আইনে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে প্রবেশ করিবার পর জনাব আবদুস সামাদের গ্রেফতারের খবর পাই। যাহা হউক, আমরা উভয়েই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ সেলের বাসিন্দা হইলাম। আমাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২৮শে জানুয়ারি কুমিল্লা জেলা হইতে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব সুলতান আহমেদ প্রাদেশিক পরিষদে মুলতবি প্রস্তাব আনয়ন করেন।

আমি ও আবদুস সামাদ দল পুনরুজ্জীবনের ঘোর বিরোধী ছিলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত যতটা নীতিভিত্তিক ছিল, ততটা বাস্তবধর্মী ছিল না। কর্মী বাহিনীর সমর্থন বিবর্জিত নীতি বা আদর্শের বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা সফল হয় না। বৈঠকী রাজনীতিতে অভ্যস্ত ও অন্যের কর্মক্ষমতায় বিবৃতি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতারা মরহুম সোহরাওয়ার্দীর গতিশীল নেতৃত্বে সৃষ্ট সম্ভাবনাময় গণ আন্দোলনের প্রতি প্রকারান্তরে বিশ্বাসঘাতকতাই করেন এবং দেশের ভবিষ্যতকে অনিবার্য সর্বনাশের দিকে ঠেলিয়া দেন।

আব্বার ইন্তেকাল

১৯৬৪ সালের ২৯শে জুলাই শ্রদ্ধেয় আব্বাজান ইন্তেকাল করেন। আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। আব্বাজানের অন্তিম শয্যায় তাহার পার্শ্বে উপস্থিত থাকিবার অনুমতি গভর্নর মোনায়েম খান সরকার দেন নাই। বিদেশী ইংরেজ সরকার আমলেও প্রিয়জনের রোগ এবং মৃত্যুশয্যা পার্শ্বে উপস্থিত থাকার জন্য প্যারলে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হইত। করাচি থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক “ডন” পাঠে মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক ঘটনাটি জানিতে পারি। কি দুর্বহ যাতনা, কি দুঃসহ বেদনা, ভাষায় তাহা ব্যক্ত করা যায় না। শুধুমাত্র ভুক্তভোগীই তাহা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে পারে। জেল জীবনের ঐ কঠিন মুহূর্তগুলিতে নিরাপত্তা বন্দি শেখ ফজলুল হক (মনি) আমার পাশে পাশেই থাকিত ও আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিত। স্নেহভাজন মনির কোমল হৃদয়ের আন্তরিকতা আমার স্মৃতিকোটরে চিরসজীব থাকিবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ

১৯৬৪ সালের ২২শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠিতব্য কনভোকেশন উপলক্ষে সম্ভাব্য গোলযোগ সৃষ্টির বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে শেখ ফজলুল হক মনিকে সরকার নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করেন। কনভোকেশনে গোলযোগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিম্নোক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে বর্ণিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যথাঃ শেখ ফজলুল হক (মনি)ও আসমত আলী এম, এ,- ডিগ্ৰী বাতিল; কে, এম, ওবায়দুর রহমান, এ,কে, বদরুল হক, রাশেদ খান মেনন ও সত্তগাত আলম- পাঁচ বৎসরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার, হায়াৎ হোসেন, আনোয়ারুল হক চৌধুরী, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আনোয়ার আলী হায়দার খান, শহীদুল হক- ৩ বৎসরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, গিয়াসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মনসুর উদ্দিন আহমদ, জাকি আহমদ, আবদুল করিম, সৈয়দ মতিউর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক মিঞা, সিরাজুল আলম খান, কাজী মোজাম্মেল ইসলাম, আতিকুর রহমান, হমায়ুন কবীর, কামালউদ্দিন সিকদার ও ফেরদৌস আহমদ কোরেশী- দুই বৎসরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার।

উল্লেখ্য যে, জাকী আহমদ ও আহমদ ফারুকের রীট আবেদনক্রমে ঢাকা হাইকোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ নাকচ ঘোষরা করিয়াছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এন,এস,এফ) সমগ্র দেশে গভর্নর মোনায়েম খানের লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে কাজ করিত ও শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র নামধারী এন,এস, এফ গুণ্ডাবাহিনী সর্বপ্রকার অনাচার ও অসৎ কর্মের হোতা ছিল (যেমন ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ৪ খলিফা নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহাজাহান সিরাজ, আ,স,ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বাধীন ছাত্র লীগ)। ১৯৬৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ডঃ আবু নসর মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলায় ঢাকা হাইকোর্টে জিতিলে অদৃশ্য হস্তের ইংগিতে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন গুণ্ডারা ঐদিনই তাকে নির্মমভাবে প্রহার করে। ইহার অব্যবহিত পর পরই বিষাক্ত পরিবেশ হইতে মুক্তিলাভ মানসে সম্মানীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক দেশ ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সভায় ইহারই প্রতিবাদ করার অপরাধে ড আবদুল মতিন চৌধুরী ইকবাল হল প্রভোষ্ট পদ থেকে অপসারিত হন। ঘটনার বিবর্তনের কি নির্মম পরিহাস যে, আবদুল মতিন চৌধুরী ১৯৭৩-৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অরাজকতা, নৈরাজ্য, মারামারি, কাটাকাটি, চরিত্রহীনতা, কথায় কথায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে। শিক্ষার পরিবেশকে দেওয়া হয় চিরবিদায়, ছাত্র-শিক্ষক ভুলিয়া যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় তপোবন বিশেষ। নিরীহ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র সম্প্রদায় মুষ্টিমেয় অস্ত্রধারীর অশুভ শিকারে পরিণত হইয়া পড়ে। তাহাদের “ছাত্র নং অধ্যয়নং তপঃ” প্রয়াস অংকুরেই বিনষ্ট হয়।

দাংগা প্রতিরোধের দায়ে মামলা

“দাংগা প্রতিরোধ কমিটি কর্তৃক দাংগা প্রতিরোধের আহ্বান জানাইয়া “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও” শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন ছাপানো ও বিলানো হয়। ১৯৬০ সালের প্রেস পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের ২ ধারার ‘গ উপধারার নির্দেশ মোতাবেক বিজ্ঞাপনে প্রকাশক ও মুদ্রাকরের নাম ছিল না। তাই বর্ণিত অর্ডিন্যান্সের ৫০, ৫২(১) (২) মোতাবেক ১৯৬৪ সালের ৩০শে এপ্রিল সর্বজনাব হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, ডঃ আলীম আল-রাজী, তফাজ্জল হোসেন, সম্পাদক দৈনিক ইত্তেফাক, জহুর হোসেন চৌধুরী, সম্পাদক দৈনিক সংবাদ, মাহমুদ আলী, মাহবুবুল হক, অলি আহাদ, কে, এম, ওবায়দুর রহমান, আলী আকসাদ ও অন্যান্যের বিরুদ্ধে ঢাকা (দক্ষিণ) মহকুমা প্রশাসকের এজলাশে গভর্নর মোনায়েম খান সরকার মামলা রুজু করেন। দীর্ঘ পাঁচ বৎসরকাল এই মামলা লইয়া টানাটানির পর ১৯৬৯ সালের ৫ই এপ্রিল সরকার মামলা প্রত্যাহার করে। এইভাবেই রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি করা হয়।

কারামুক্তি

জনাব সামাদ আমার বহু পূর্বেই কারামুক্তির ব্যবস্থা করিয়া আমাদের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। এমতাবস্থায় জনাব মাহমুদ আলী আমার মুক্তি দাবি করিয়া ঢাকা হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের করেন। বিচারপতি, এ,এম, চৌধুরী ও বিচারপতি আবদুল্লাহ সমবায়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে শুনানীর প্রারম্ভেই সরকার পক্ষীয় কৌসুলী সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আদালতকে জানান যে, সরকার আমাকে মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত নিয়াছেন, তাই পূর্বাহ্নে প্রাথমিক শুনানীতেই আমার পক্ষে প্রদত্ত রুল খারিজ হয়ে যায় এবং আমি ১৪ সেপ্টেম্বর মুক্তি লাভ করি। ঐদিনই আমার প্রাণপ্রতিম অনুজ মোহাম্মদ আমীরুজ্জামানের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। পাত্রী জনাব নুরুল আমিনের কন্যা হাসিনা।

‘৬৫-এর নির্বাচন

১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিবস ধার্য হয়। ইহার পর মার্চে জাতীয় পরিষদ নির্বাচন ও এপ্রিলে প্রাদিশেক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান স্থির হয়। আইউবী সংবিধানে প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান ছিল না। পক্ষান্তরে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার জনগণ কর্তৃক নির্বাচকমণ্ডলী পাঁচ বৎসরের জন্য নির্বাচিত হইবে এবং এই নির্বাচক মণ্ডলী প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যবর্গকে নির্বাচিত করিবে। নির্বাচক মণ্ডলীই ইউনিয়ন কাউন্সিল পরিচালনার দয়িত্প্রাপ্ত হইবে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যগণ সাধারণতঃ “মৌলিক গণতন্ত্রী” নামে অভিহিত। সরকারি ওয়ার্কস প্রোগ্রামের অর্থ ইউনিয়ন কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্যয় করিবার পরিকল্পনা এবং দেয় অর্থের অডিট ব্যবস্থা সরকারি খেয়ালীপনার উপর নির্ভরশীল থাকায় ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যবর্গ তথা নির্বাচক মণ্ডলী দ্বারা সরকার মনোনীত প্রার্থীগণ স্বাভাবিকভাবেই অধিক ভোটে নির্বাচিত হবার সুযোগপ্রাপ্ত হন।

মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী প্রতিনিধিবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার সংকল্পে ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে ২০শে জুলাই (১৯৬৪) চার দিবসব্যাপী বৈঠকে দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে সম্মিলিত বিরোধী দল (Combined Opposition Parties) গঠন করেন। এবং ২৪শে জুলাই (১৯৬৪) এতদৃমর্মে সাধারণ্যে ঘোষণা প্রকাশ করেন। ১৭ ও ১৮ই সেপ্টেম্বর করাচি বৈঠকে এই সম্মিলিত বিরোধী দল পাকিস্তানের রাষ্ট্রস্রষ্টা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সহোদরা মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনীত করেন। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট উক্ত মনোনয়নকে স্বাগত জানায় ও সমর্থন করিবার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। মোহতারেমার মনোনয়ন সমগ্র দেশে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সঞ্চার করিল। মোহতারেমার জনসভাগুলি স্বতস্ফূর্ত জনসমুদ্রে পরিণত হইতে লাগিল। ঢাকা হইতে চট্টগ্রাম গমনকালে পথে পথে স্টেশনে স্টেশনে উদ্বেলিত লক্ষ লক্ষ জনতার সম্বর্ধনার দৃশ্য শাসককুলের হৃদকম্প সৃষ্টি করে। কিন্তু নির্বাচনে যা হইবার তাহাই হয়, নির্বাচক মণ্ডলীর দ্বারা জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ ও আইউব খান যথাক্রমে ১৮৪২৪+১০২৪৪ ও ২১০১২+২৮৯২১ ভোট পান। মার্চ মাসে (১৯৬৫) অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও এপ্রিল মাসে (১৯৬৫) অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সরকারি মুসলিম লীগ (কনভেনশন) মনোনীত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রার্থী জয়লাভ করেন। যাহা হউক, পূর্ব পাকিস্তান হইতে সর্বজনাব নূরুল আমিন, শাহ আজিজুর রহমান, মশিউর রহমান, মাহমুদ আলী ও আবুল কাসেম প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নির্বাচিত হন। নির্বাচিত সংস্থা (অযোগ্য) আদেশ ১৯৫৯ (Elective bodies disqualification order 1959) মোতাবেক ছয় মাসের অধিক নিরাপত্তা বা নিবর্তনমূলক আইনে কারাবাস হইলে ৫ বৎসরের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া আইনতঃ নিষিদ্ধ ছিল। সে কারণেই আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে পারি নাই। কেননা ১৯৬৪ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর মুক্তির আগেকার সাড়ে সাত মাসের কারাবাস ছাড়াও ১৯৫৯ হইতে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আমাকে জেলে বিনাবিচারে আটক থাকিতে হইয়াছিল। সে হিসাবে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আমার জন্য নির্বাচন নিষিদ্ধ ছিল।

জাতীয় পরিষদে সম্মিলিতভাবে কাজ করিবার নিমিত্ত বিরোধীদল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (National Democratic Front) সম্মিলিত বিরোধী দল (Combined Opposition Party) গঠন করেন এবং জনাব নূরুল আমিন, শাহ আজিজুর রহমান ও কামরুজ্জামান যথাক্রমে উহার নেতা, উপনেতা ও সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষ

কাশ্মীর বিরোধ উপলক্ষে ১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। যাহা হউক, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট-এর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও নিরাপত্তা পরিষদের সময় মত হস্তেক্ষেপের ফলে নিরাপত্তা পরিষদের ২০শে সেপ্টেম্বর গৃহীত নির্দেশ মোতাবেক ২২/২৩শে সেপ্টেম্বর ভোররাত্রি ৩ ঘটিকায় যুদ্ধ বিরতি আদেশ কার্যকর হয়। ইতিমধ্যে ১৯শে সেপ্টেম্বর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলেক্সী কোসিগিন সরাসরি আলোচনার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খানকে মস্কো আমন্ত্রণ জানান।

প্রকাশ, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহায়তায় বেসরকারি মোজাহেদ বাহিনী ১লা সেপ্টেম্বর ভারত কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর রাজ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মাধ্যমে কাশ্মীরের ব্যাপক মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করাই ছিল ইহার উদ্দেশ্য। ইহার পরিণতিতে পাকিস্তানের উপর ভারত হামলা চালায়। এই ঘটনার আর একটু নেপথ্য পটভুমি রহিয়াছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও জেনারেল আইয়ুব খানের ধারণা হয় যে, মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহর জনসমর্থন তাহার চেয়ে অনেক বেশী। সুতরাং সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করিবার নেশায় কাশ্মীর পাকিস্তান ভুক্ত করিবার প্রচেষ্টায় তিনি লিপ্ত হন। জনসমর্থনহীন শাসকরা আভ্যন্তরীণ সংকট উতরাইবার জন্য এবং সঙ্কট হইতে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরাইবার উদ্দেশ্যে এই ধরনের সর্বনাশা ঝুঁকি গ্রহণে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। আইউব সরকারের অতি উৎসাহী পদক্ষেপে স্পষ্টতঃ পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। তাই মহাচীন জেনেভায় ভারতীয় ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতদ্বয়কে স্পষ্টভাষায় সতর্ক করিয়া দেয় যে, যদি পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হয় বা পাকিস্তানের কোন বড় শহরের পতন ঘটে তাহা হইলে নিরপেক্ষ নীতি বর্জন করিয়া চীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে বাধ্য হইবে। চীনের এই সতর্কবাণী নিঃসন্দেহে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও জাতিসংঘের মোড়লদিগকে প্রভাবান্বিত করিয়াছিল।

ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের পটভূমিকায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অমীমাংসিত সমস্যাবলী সমাধানের সন্ধানে ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়াসে বৃহৎ শক্তি দ্বয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট রাশিয়া উদ্যোগ গ্রহণ করে। আগেই বলিয়াছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খানকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য সোভিয়েট ভূমিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তদানুযায়ী ভারত-পাকিস্তান সরকার প্রধানদ্বয় ৪ঠা জানুয়ারি হইতে ১০ জানুয়ারি (১৯৬৬) অবধি তাসখন্দে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মিলিত হন এবং সফল আলোচনার পর ১০ জানুয়ারি এক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করেন। ইহাই তাসখন্দ ঘোষণাপত্র নামে পরিচিত। তাসখন্দেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পরলোকগমন করেন। বিশ্বের জন্য ইহা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। ইতিপূর্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের আমন্ত্রণক্রমে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমন করিয়াছিলেন। আলোচনায় ইন্দো-পাকিস্তানের অমীমাংসিত সমস্যাবলী শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের ইঙ্গিত সম্বলিত এক যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয় ১৬ই ডিসেম্বর।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো “তাসখন্দ ঘোষণাপত্রের” ঘোর বিরোধী ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী জনমত মোটামুটিভাবে “তাসখন্দ ঘোষণাপত্রের প্রতিকূলে ছিল”- জনমতের প্রতিধ্বনি করিযা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকবৃন্দ তাসখন্দ ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতা জনাব নুরুল আমিনও লাহোর সম্মেলনকে লক্ষ্য করিয়া ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেন এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও শাসনতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনের আহ্বান জানান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান লাহোর সম্মেলনে যোগ দেন এবং পাকিস্তানের সাংবিধানিক সমাধানকল্পে কতিপয় প্রস্তাব উত্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এই প্রস্তাবগুলো পরবর্তীকালে বিখ্যাত ছয় দফা কর্মসূচী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

ছয় দফা

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ অবসানের পর ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্যবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহিত এক বৈঠকে মিলিত হন। পাক-ভারত যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় রাজধানী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। এখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ফলে এই দেশ রক্ষার দায়িত্বভার পড়িয়াছিল গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উপর। ইত্যকার তথ্য ও বক্তব্য মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, চাকুরীজীবী সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। বলা আবশ্যক যে, ১৯৪৭ সাল হইতে নানা কারণে পূর্ব পশ্চিম পাকস্তান তথা বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালির মধ্যে মানসিক দূরত্ব জন্ম নিয়াছিল এবং তাহাই উভয় অংশের মধ্যে সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছিল বিচ্ছিন্নতার আবহাওয়া। তদুপরি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যকরী ক্ষমতার কোন অবকাশ ১৯৬২ সালের সংবিধানে না থাকায়, বাঙ্গালি মনে যে ক্ষোভ জমা হইয়াছিল, তাহারই অভিব্যক্তি ঘটে নিম্নে প্রদত্ত ‘সাত দফা’ রচনায়। প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক আহূত বৈঠকে ইংরেজিতে লিখিত দফাগুলি উত্থাপন করার জন্য রচয়িতাদের পক্ষ হইতে জনাব খায়রুল কবীর পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে প্রদান করেন। সেইদিন আমি ঘটনাচক্রে নুরুল আমিন সাহেবের সহিত তাহার বাসভবনে পূর্ব হইতেই আলোচনায় রত ছিলাম। সেই দিন উক্ত কপিটি আমি নূরুল আমিন সাহেবের নিকট হইতে ভবিষ্যৎ রেফারেন্সের জন্য লইয়া আসি। সেই আলোচনা বৈঠকে খাবরুল কবীর সাহেব হইতে আমি অবগত হই যে, তাঁহারা আমন্ত্রিত সব নেতাকে ইহার কপি দিয়েছে। এই কপিতে বর্ণিত ষষ্ঠ দফার নিম্নাংশ ও সাত নং দফা বাদ দিয়া যাহা অবশিষ্ট থাকে তাহাই শেখ মুজিবর রহমানের ছয় দফা। এবং পরবর্তীকালে তিনিই এই ছয় দফার প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, সেদিন নূরুল আমিন সাহেবের বাসভবনে আমি জনাব খায়রুল কবীরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম ইহা কাহার রচনা? জওয়াবে তিনি বলেন যে, সর্ব মহলের প্রায় ৫০ ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে ইহা রচনা করিয়াছেন। সেদিন এই ব্যাপারে আমার মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নাই। কিন্তু পরবর্তীকালে ছয় দফা আন্দোলনের ঘটনাবলীতে আমার নিকট প্রতীয়মান হইয়াছিল যে, ইহার নেপথ্যে (ক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, (খ) আন্তর্জাতিক ইহুদী কারসাজি তো ছিলই, (গ) ভারত সরকারের গোপন হস্তও উহাতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা প্রদান করিয়াছিল। আগেই উল্লেখ করিয়াছি যে, শেখ মুজিব লাহোর কনফারেন্সে ছয় দফা উত্থাপনের ব্যর্থ প্রয়াস পান।

১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া শেখ মুজিবর রহমান তাহার লাহোর সম্মেলন ত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং লাহোর সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বিবেচনার্থে দেয় তাহার ছয় দফা সাংবাদিকদের নিকট প্রকাশ করেন। ১৯শে মার্চ (১৯৬৬ ইং) পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ৬ দফাকে সাংগঠনিক কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করে এবং ২০শে মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় অনুমোদিত হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শেখ মুজিব প্রদত্ত ৬ দফা সংবাদ পত্রে প্রকাশ না করিতে সর্ব জনাব আবুল মুনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান ও মানিক মিয়া একমত হন এবং সে মতে মানিক মিয়া তার পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে তা প্রকাশ করেননি। প্রকাশ করেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুর তাঁর সম্পাদিত দৈনিক আওয়াজে।

যাহা হউক, আমি এখানে জনাব খায়রুল কবীর প্রদত্ত ও জনাব নূরুল আমিনের নিকট হইতে প্রাপ্ত সাত দফা’ এবং শেখ মুজিবর রহমান প্রদত্ত ‘ছয় দফা’র পূর্ণ চিত্র পাঠকবর্গের খেদমতে পেশ করিতেছি:

শেখ মুজিবর রহমান প্রদত্ত ৬ দফা

In view of the experiences gathered during the 17 days war with India some rethinking for East pakistan from the constitutional point of view is necessary, keeping in view the practical aspects of administration the welfare of the people of this province. It is evident that the people of East Pakistan’s determination to keep the country as a whole saved the two parts of Pakistan from disintegration which could have taken place during this period of extraordinary emergency.

The main object of this brief note is to make an earnest effort to continue to keep the two parts of pakistan united as one political entity. With this object, the following suggestions are made:

1. The constitution and working form of government should be a federation of Pakistan in its real sense of the term. Although Pakistan was styled as a federal Republic till today name of the constitution so far provided for a practical form of federal government.

2. Federal Government shall have only two subjects, defence and foreign affairs.

3. Regarding currency either of the following two suggestion:

A. Two separate freely convertible currency may be introduced.

OR

B. One currency for the whole country may be maintained. In this case effective constitutional provisions are to be made in stoping flight of capital from East to West Pakistan. Separate banking reserve is also to be made for East Pakistan (ii) Separate fiscal and monetary policy is to be maintained for East Pakistan.

4. TAXATION

All taxes and duties shall be provided. The federal government will have not taxation authority except a levy on provincial taxes for meeting their required expenditure in consultation with the province or state.The consolidated Federal fund should come out of a levy of a certain uniform percentage of all state taxes.

5. FOREIGN TRADE

(i) Separate external trade account for each of the province is to be maintained.

(ii) Foreign Exchange earned out of external trade will be at the disposal of the state.

(iii) The federal foreign exchange requirements will be met by the province on the basis of a uniform percentage rate of the earnings of the each provinces or state.

(v) Commodities from one province or state to other will move free of any taxation or tariff restrictions by the process or state.

(v) Province or state would be allowed to place trade representative abroad and negotiate trade deals in the interest of the province or the state irrespective of federal foreign relations.

6. Province or state should have the authority to raise and maintain under its own control para-military or territorial forces to protect the territorial integrity as well as the constitution.

অর্থাৎঃ ভারতের সহিত ১৭ দিনব্যাপী যুদ্ধের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে এবং এই প্রদেশের জনগণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার কার্যকরী বিষয়াদির প্রতি খেয়াল রাখিয়া শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ হইতে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে কিছু কিছু পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন অনুভূত হইতেছে। ইহা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, দেশকে অখণ্ড রাখিবার প্রয়াসে পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের সংকল্প দুই অংশকেই খণ্ড বিখণ্ড হইয়া যাওয়া হইতে রক্ষা করিয়াছে যাহা এই “বিশেষ ইমারজেন্সীর” সময় ঘটিতে পারিত। এই সংক্ষিপ্ত খসড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পাকিস্তানের দুই অংশকে একটি অখণ্ড রাজনৈতিক সত্তা গ্রথিত করিবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। এই উদ্দেশ্যেই নিম্নেবর্ণিত সুপারিশগুলি করা হইলঃ

১। শাসনতন্ত্র ও সরকারের কার্যকরী পদ্ধতি গঠিত হইবে সত্যিকার “ফেডারেশন অব পাকিস্তান” কাঠামোর ভিত্তিতে। যদিও পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রিপাবলিক হিসাবে আখ্যায়িত করা হইয়াছিল তথাপি অদ্যাবধি যতগুলি শাসনতন্ত্র প্রণীত হইয়াছিল তাহার কোনটিতেই ফেডারেল পদ্ধতির সরকারের বাস্তব রূপায়নের ব্যবস্থা করা হয় নাই।

২। ফেডারেল সরকারের হাতে কেবল দুইটি বিষয় থাকিবে যথা- দেশরক্ষা এবং বৈদেশিক বিষয়।

৩। মুদ্রা বিষয়ে নিম্নোক্ত যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা যাইতে পারে।

ক) দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করা যেতে পারে। অথবা

খ) সমগ্র দেশের জন্য একটি মুদ্রা চালু করা যাইতে পারে। এই ক্ষেত্রে এমন কার্যকর শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকিতে হইবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভের ব্যবস্থাও করিতে হইবে।

গ) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক ও মুদ্রানীতি গ্রহণ করিতে হইবে।

ট্যাক্সেশন

সকল ট্যাক্স ও ডিউটি আদায়ের ব্যবস্থা থাকিবে। ফেডারেশন সরকারের ট্যাক্স আদায় করিবার কোন অধিকার থাকিবে না, তবে কেবলমাত্র প্রদেশের বা স্টেটের সহিত আলাচনা সাপেক্ষে খরচপত্রাদি বহন করিবার জন্য প্রাদেশিক ট্যাক্সের উপর লেভি বসাইতে পারিবে। এইভাবে সকল স্টেট ব্যাংকের উপর সমহারে লেভীর দ্বারা অর্জিত অর্থে ফেডারেল ফান্ড গঠিত হইবে।

বৈদেশিক বাণিজ্য

(ক) প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক বৈদেশিক বাণিজ্য একাউন্টের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

(খ) বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্টেটের হাতে থাকিবে।

 (গ) প্রতিটি প্রদেশ বা স্টেটের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি সমহার প্রদানের মাধ্যমে ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন মিটানো হইবে।

(ঘ) এক প্রদেশ অথবা স্টেট হইতে অন্য প্রদেশ বা স্টেটে জিনিসপত্রের আদান প্রদনে কোন ট্যাক্স বা ট্যারিফ নিষেধাজ্ঞা থাকিবে না।

(ঙ) বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং নিজেদের স্বার্থে বাণিজ্যিক আলোচনা করিবার অধিকার প্রদেশ বা স্টেটের থাকিবে। এই অধিকার ফেডারেল সরকারের নীতির বিষয়ে নিরপেক্ষ হইবে।

৬। রাষ্ট্রীয় অখণ্ড ও শাসনতন্ত্র রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন স্থানীয় বাহিনী বা প্যারা মিলিশিয়া গড়িয়া তোলার অধিকার প্রদেশ বা স্টেটের থাকা উচিত।

খায়রুল কবীর প্রদত্ত ৭ দফা

In view of the experiences gathered during the 17 days war with India some rethinking about constitutional framework of the country is necessary, keeping in view the practical aspects of administration the welfare of the people. It is evident that the determination of the people of East Pakistan to keep the country as a single whole saved the two parts of pakistan from disintegration which could have taken place during the period of extraordinary emergency.

The main object of this brief note is to make an earnest effort to continue to keep the two parts of Pakistan united as one political entity. With this object in view the following suggestions are made:

1. The constitution should provide for a federation of pakistan in its true sense on the basis of Lahore Resolution, and parliamentary Form fo Government with supremacy of Legislatures elected on the basis of adult franchise and direct Voting.

2. Federal Government shall deal with two subjects, defence and foreign affairs, all other residuary subjects shall vest in the federating states.

3. Regarding currency either of the following two suggestions may be accepted:

A. Two separate freely convertible currencies may be introduced.

or

B. One currency for the whole country may be maintained. In this case effective constitutional provisions are to be made in stoping flight of capital from East to West Pakistan. Separate banking reserve is also to be made for East Pakistan. Separate fiscal and monetary policy is to be adapted for East Pakistan.

4. TAXATION

The federated states shall have exclusive authority to levy all taxes and duties. The federal government will have no tax levying authority, but will have a share on state taxes for meeting their required expenditure. The consolidate federal fund should come out of levy of a certain percentage of all state taxes.

5. FOREIGN TRADE

(i) Separate external trade account for each of the federating state is to be maintained.

(ii) The federal foreign exchange requirements will be made by the states on the of equal percentage rate or a rate to be agreed upon.

(iii) The foreign Exchange earned out of external trade will be at the disposal of the state.

(iv) Indigenous Commodities will move between state free of any taxation or tariff restrictions.

(v) State should be allowed by constitutional provisions to place trade representatives abroad and negotiate trade deals in the interest of the states.

6. States should have the authority under the constitution to raise and maintain under its own control paramilitary or territorial forces to protect the territorial integrity as well as the constitutional.

In case all the above points are provided for the constitution, the present system of appointment of Governor of the province or the state by the President may continue but in case the constitutional changes suggested above are not agreed to by the President, the Provincial Governor shall be elected by an Electoral college on the basis of adult Franchise or a direct election by a restricted adult Franchise basis. In this case the Governor shall only be removed by an impeachment of the legislature.

7. For the election to the legislators at this stage. Universal adult Franchise may not be introduced but restricted adult franchise on the basis of educational or tax qualification should be introduced. Such elected legislature should be Vested with more authority in regard to control of finance for both the Federal and provincial governments.

It may take some time to implement all the suggestions mentioned above but for an immediate political settlement between the people and the present rulers acceptance of these on principal and a public declaration of such acceptance in the greater interest of the country’s integrity and prosperity.

অর্থাৎ ও ভারতের সহিত ১৭ দিনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে এবং জনসাধারণের কল্যাণের লক্ষ্যে প্রশাসনের কার্যকর বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখিয়া দেশে সাংবিধানিক কাঠামো সম্পর্কে কিছু পুনর্বিন্যাসের চিন্তা প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়াছে। ইহা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, দেশকে অখণ্ড রাখার প্রয়াসে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সংকল্প দুই অংশকে খণ্ড-বিখণ্ড হইয়া যাওয়ার পরিণতি হইতে রক্ষা করিযাছে যাহা এই “বিশেষ ইমারজেন্সী” সময় ঘটিতে পারিত। এই সংক্ষিপ্ত খসড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পাকিস্তানের দুই অংশকে একটি অখণ্ড রাজনৈতিক সত্ত্বায় গ্রথিত করিবার আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। এই উদ্দেশ্যেই নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলি করা হইলঃ

১। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র সত্যিকার অর্থে ফেডারেশন অব পাকিস্তানের ব্যবস্থা থাকিতে হইবে, এবং সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ও প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত আইন সভার শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিতকরণ পূর্বক সরকার পদ্ধতি হইবে পার্লামেন্টারি।

২। ফেডারেল সরকার দুইটি বিষয় দেশ রক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করিবে, অবশিষ্ট বিষয়গুলি ফেডারেটিং ইউনিটগুলির কাছে ন্যস্ত থাকে।

৩। মুদ্রা সংক্রান্ত নিম্নোক্ত যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা যাইতে পারে।

ক) দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিয়োগ মুদ্রা চালু করা যেতে পারে।

অথবা

খ) সমগ্র দেশের জন্য একটি মুদ্রা চালু করা যাইতে পারে, এই ক্ষেত্রে এমন কার্যকর শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকিতে হইবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভের ব্যবস্থা করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি ও মুদ্রানীতি গ্রহণ করিতে হইবে।

৪। ট্যাক্সেশন

সকল প্রকার ট্যাক্স ও কর আদায়ের একক কর্তৃত্ব ফেডারেটিং স্টেটগুলির থাকিবে। ফেডারেল সরকারের ট্যাক্স আদায়ের কোন কর্তৃত্ব থাকিবে না; কিন্তু তাহাদের খরচ মিটাইবার জন্য ফেডারেটিং স্টেটগুলির প্রাপ্য ট্যাক্সের উপর একটি অংশ তাহাদের থাকিবে। সব কয়টি ফেডারেটিং ইউনিটের লেভির একটি বিশেষ শতকরা হিসাবে আদায়কৃত অর্থে ফেডারেল তহবিল গঠিত হইবে।

বৈদেশিক বাণিজ্য

(ক) প্রতিটি ফেডারেটিং ইউনিটের জন্য পৃথক বৈদেশিক বাণিজ্য একাউন্টের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

(খ) ইউনিটগুলির সমহারের অথবা কোন গৃহীত হারে প্রদত্ত লেভির ভিত্তিতে ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন মিটান হইবে।

(গ) বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ফেডারেটিং ইউনিটগুলির হাতে থাকিবে।

(ঘ) দেশজ পণ্য এক ইউনিট হইতে অন্য ইউনিটে আদান-প্রদানে কোন ট্যাক্স বা ট্যারিফ নিষেধাজ্ঞা থাকিবে না।

(ঙ) শাসনতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা থাকিতে হইবে যাহাতে সে বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি নিয়োগ করিতে এবং স্টেটগুলির স্বার্থে বাণিজ্যিক আলোচনা করিতে পারে।

৬। শাসনতন্ত্র মোতাবেক রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও শাসনতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য স্বীয় কর্তৃত্বাধীন স্থানীয় বাহিনী বা প্যারামিলিশিয়া গড়িয়া তোলার অধিকার স্টেটগুলির থাকা উচিত। যদি উপরোক্ত বিষয়গুলি শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত হয়, তাহা হইলে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রদেশ বা স্টেটের গভর্নর নিয়োগের পদ্ধতি চলিতে পারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যদি এইগুলিতে সম্মত না হন, তাহা হইলে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ইলেকটোরাল কলেজ কর্তৃক অথবা প্রাপ্ত বয়স্কদের একটি বিশেষ সংখ্যার প্রত্যক্ষ ভোটে গভর্নর নির্বাচিত হইবেন। এমতাবস্থায় কেবল আইনসভা ইমপিচমেন্ট এর মাধ্যমে গভর্নরকে অপসারিত করিতে পারিবে।

৭। বর্তমান অবস্থায় আইনসভার নির্বাচনে প্রাপ্ত বয়স্কের সার্বজনীন ভোটাধিকারের নীতি হয়ত প্রবর্তন করা যাবে না কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ট্যাক্স প্রদানের ক্ষমতার ভিত্তিতে নির্মিত প্রাপ্ত বয়স্কদের একটি সীমিত সংখ্যার ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এই আইনসভা নির্বাচিত হওয়া উচিত। এই নির্বাচিত আইন সভার ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের অধিকতর ক্ষমতা ন্যস্ত থাকিতে হইবে।

উপরে বর্ণিত প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নে কিছু সময় প্রয়োজন হইতে পারে কিন্তু বর্তমান শাসকদের জনগণের আশু রাজনৈতিক মীমাংসার প্রয়োজনে এই প্রস্তাবসমূহ নীতিগত স্বীকৃতি এবং এই স্বীকৃতি জনসমাজে ঘোষণা দেশের অখণ্ডতা ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।

উপরের চিত্র হইতেই স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, ছয় দফা সাত দফারই খন্ডিত অনুলিপি মাত্র।

ইহাই ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ সাধারণ নির্বাচনের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে নিম্নলিখিতভাবে প্রকাশ করা হয়ঃ

১। “সরকারের ধরন হবে ফেডারেল এবং পার্লামেন্টারি। এতে ফেডারেল আইন এবং ফেডারেশনের অন্তর্গত ইউনিট আইন সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ এবং সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। ফেডারেল আইন সভার প্রতিনিধিত্ব হইবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে।”

২। “ফেডারেল সরকারের হাতে থাকিবে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় এবং নীচে ৩ নং দফার শর্তাধীনে মুদ্রা।”

৩। “দেশের দুইটি অংশের জন্যে দুইটি পৃথক এবং সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যাংকগুলি এক অঞ্চল হইতে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর করিবে এবং মূলধন পাচার বন্ধের ব্যবস্থা করিবে।

৪। “রাজস্ব সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব এবং ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির হাতে থাকিবে। দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র দফতর পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব ফেডারেল সরকারকে দেওয়া হইবে। শাসনতন্ত্রে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে নির্ধারিত হারের ভিত্তিতে উক্ত আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ফেডারেল সরকারের তহবিলে জমা হইবে। করনীতির উপর অঙ্গরাষ্ট্রগুলির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভিলক্ষ্য সঙ্গে সঙ্গতি রাখিয়া ফেডারেল সরকার। রাজস্বের প্রয়োজন মিটাবার নিশ্চয়তা বিধানের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।”

৫। ফেডারেশনের অন্তর্গত অঙ্গরাষ্ট্রগুলির নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেকটি ইউনিটের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব রাখিবার শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকিবে। শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুযায়ী ধার্য হারের ভিত্তিতে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলো ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মিটাইবে। ফেডারেল সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পররাষ্ট্র নীতির কাঠামোর মধ্য হইতে আঞ্চলিক সরকারগুলিকে বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে আলোচনা ও চুক্তির ক্ষমতা শাসনতন্ত্রে দেওয়া হইবে।”

৬। “কার্যকরভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিশিয়া রাখিবার ক্ষমতা দেওয়া হইবে।”

এখানে আরও উলেখযোগ্য যে, ছয়দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের এই পরিকল্পনাটি মূলতঃ নৃতন কিছু নয়। ইহা ১৯৫০ সালের ৫ই নভেম্বর ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাজাতীয় সম্মেলনে (Grand National Conference) গৃহীত সাংবিধানিক সুপারিশাবলীর অভিন্নরূপ।

আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ছয় দফাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীয় সাংগঠনিক কর্মসূচী হিসাবে অনুমোদন দান করে ও ১৩ই ফেব্রুয়ারি স্বীয় বাসভবনে আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ সাহেব ছয় দফা আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ্যে প্রকাশ করেন। ১৮ ও ১৯শে মার্চ ঢাকা ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয় দফাকে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করে। শেখ মুজিবর রহমান উক্ত অধিবেশনেই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এইদিকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ (কনভেনশন) অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খান ছয় দফাকে রাষ্ট্রের সংহতির পরিপন্থী কর্মসূচী বলিয়া ঘোষণা করেন এবং প্রয়োজনবোধে ছয় দফা আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করা হইবে বলিয়াও সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। ২০শে মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান তাহার ভাষণে বলেন, “কোন হুমকিই ছয় দফা আন্দোলন প্রতিরোধ করিতে পারিবে না।”

এন ডি এফ-এর ৭ দফা

এই সময় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পরিহার করিয়া একনায়কত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য আমি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে থাকি। আইউব খান ৮ই মার্চ জাতীয় পরিষদে প্রদত্ত বক্তব্যে ফেডারেল ও পার্লামেন্টারি সরকার পদ্ধতির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। ইহারই প্রতিবাদে পাক-ভারত যুদ্ধোত্তর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সমস্যাবলী সাংবিধানিক সমাধানকল্পে আমরা জাতীয় ফ্রন্টের এক অংশ জনাব আতাউর রহমান খানের মাধ্যমে ১০ই মার্চ (১৯৬৬) এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করি এবং দেশবাসীর বিবেচনার জন্য সাত দফা পরিকল্পনা প্রকাশ করি। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট বহু বাক-বিতন্ডার পর ৩০শে এপ্রিল (১৯৬৬) জনাব নূরুল আমিনের ইস্কাটনস্থ বাসভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে স্বয়ং নূরুল আমিন, মাহমুদ আলী (সিলেট), আবদুস সামাদ (সিলেট), ইউসুফ আলী চৌধুরী ও সৈয়দ আজিজুল হকের তীব্র বিরোধিতার মুখে এই সাত দফাকে অনুমোদন করেন। নিম্নে সাত দফা পরিকল্পনা দেওয়া হইলঃ

(a) Constitutional arrangements should be remodelled and the country reverted to federal system both in theory and practice. Parliamentary form of Government should be reintroduced vesting all powers in the parliament which should be directly elected by adult franchise. The two Regions must have full Regional Autonomy with DEFENCE, FOREIGN AFFAIRS (POLITICAL) CURRENCY (MINTING) in the centre.

(b) The federal structure should include a sub-federation of former provinces of Sindh, Baluchistan, N.W.F.P. and West Punjab with such territorial readjustment as may reconstitute the area now West pakistan into four cultural and linguistic units.

The question of one unit needs to be re-examined in consultation with the people of West pakistan particularly of the affected provinces of that area.

(c) On account of sheer distance between East & West Pakistan there is total immobility of labour and capital between them so that Economic forces generated in one wing hardly produce any effect on the other. Pakistan therefore, is IPSO FACTO a two Economy State, although the pattern of economy is the same. As such the economy of the country should be remodeled.

(d) Effective steps should be taken to remove disparity between two wings within a period of ten years.

(e) In order to ensure economic security of the people through equitable distribution of wealth, the economic structure of the country with heavy concentration of wealth in a few hands to the utter destitution of the masses, has to be recast, in the shortest possible time into a mixed economy under which the people shall as of right, have access to the economic advantages of socialism.

(f) The 17-day armed conflict with India with all communication cut off left East Pakistan severely isolated from the west wing.The theory of East pakistan’s dependence on West Pakistan for Defence measures does not hold good and therefore defence of each wing has to be adequately organised in the wing itself based and organised on local resources.

(g) Our foreign policy should be independent without any bias or leaning towards either of the power Blocs. With malice towards none and friendship for all, our diplomatic policy should be conducted with greater maturity and greater sense of responsibility. Our past activities in this field have been anything but satisfactory. All misunderstanding between ourselves and other countries abroad should be removed and co-operation with them in the Economic field strengthened.

ক) শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস সাধন করিতে হইবে এবং দেশে ফেডারেল পদ্ধতির তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক প্রবর্তন নিশ্চিত করিতে হইবে। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত পার্লামেন্টের নিকট সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা পূর্বক পার্লামেন্টারি পদ্ধতি সরকার চালু করিতে হইবে। দুই অঞ্চলে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন থাকিতে হইবে এবং দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি (রাজনৈতিক) এবং মুদ্রা (মুদ্রণ) কেন্দ্রের হাতে থাকিবে।

খ) সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব এই সাবেক প্রদেশগুলির সমবায়ে গঠিত একটি সাব-ফেডারেশন ফেডারেল কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হইবে। আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে উল্লিখিত সাব-ফেডারেশন এমনভাবে গঠন করিতে হইবে যাহাতে বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তান চারটি সংস্কৃতি ও ভাষাগত অঞ্চলে পুনর্গঠিত হইতে পারে।

গ) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্বের দরুন দুই অঞ্চলের মধ্যে শ্রম ও মূলধনের বিনিময় একেবারেই অনুপস্থিত, ফলে এক অঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যক্রম অন্য অঞ্চলে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিতে পারে না। সুতরাং পাকিস্তান বস্তুতপক্ষে ‘দুই অর্থনৈতিক দেশ’ যদিও অর্থনীতির প্যাটার্ন একই প্রকার। এই কারণেই দেশের অর্থনীতি ঢালিয়া সাজাইতে হইবে।

ঘ) দশ বৎসরের মধ্যে দুই অঞ্চলের বৈষম্য দূর করিতে হইবে।

ঙ) সম্পদের সুষম বন্টনের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে জনগণের নিদারুণ দুর্দশার বিনিময়ে গুটিকতক হাতে বিপুল সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি মিশ্র অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করিতে হইবে; এই মিশ্র অর্থনীতির অধীনে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করিবার অধিকার জনগণের থাকিবে।

চ) ভারতের সহিত ১৭ দিনের সশস্ত্র যুদ্ধকালীন সময়ে সমস্ত যোগাযোগ বিপর্যস্ত হইয়া যাওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমাঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেশরক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীলতার তত্ত্ব কার্যকর নয়; সুতরাং প্রতিটি অঞ্চলের দেশরক্ষা স্থানীয় সম্পদের উপর ভিত্তি করিয়া সেই অঞ্চলে সম্পূর্ণভাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি স্বাধীন হইতে হইবে। কোন বৃহৎ শক্তি শিবিরের প্রতি এই নীতির কোন পক্ষপাত থাকিবে না। কাহারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতির উপর ভিত্তি করিয়া অধিকতর বিচক্ষণতা ও দায়িত্বশীলতার সাথে আমাদের কুটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হইতে হইবে। বিদেশী রাষ্ট্র এবং আমাদের মধ্যে সকল ভুল বুঝাবুঝি দূর করিতে হইবে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদের দৃঢ় সহযোগিতা নিশ্চিত করিতে হইবে।

ইতিপূর্বে প্রফেসর মিজানুর রহমান শেলী সম্পাদিত ইংরেজি মাসিক The Concept of Pakistan ৬ই জানুয়ারি-১৯৬৫ দুই অর্থনীতির উপর প্রফেসর রেহমান সোবহানের সারগর্ভ প্রবন্ধটি ছাপায় প্রবন্ধটি নিম্নরূপঃ

THE CONCEPT OF PAKISTAN

Edited by Mizanur Rahman Shelley Vol. I, No. 6, January 1965

Mr. Rehman Sobhon approaches the problem of national integration and harmony in Pakistan from an Economic’s point of view. To suggest the means to national unity, he first investigates into the the root causes of disunity. The central reason of the potentially disastrous economic conflicts of the country-Mr. Sobhan points out is the economic disparity between the Eastern and the Western Wing of Pakistan. Writting in an engaging style he pinpoints the factors that has brought into being and is sustaining this glaring disparity.

Discussing the ways of removing this gap in the economic prosperity of the two parts of the land Mr. Sobhan opines that a policy of stepped up allocation to East Pakistan to eliminate disparity may result in the creation of hostility in West Pakistan after a period of time if not immediately. Hence the only way to ensure that national harmony prevails, thinks Mr. Sobhan, “is to eliminate the main point of tension.”A logical solution, would therefore be,” to have two cakes instead of one.” With that Mr. Sobhan brings-into the picture the burning issue of the hour, the idea of two economics for Pakistan- Ed.

The Nation and its Economy

A Nation economically well-knit. How to build Pakistan into a well-knit nation is a subject which provides a good occasion to indulge in generalisations which range over the field of politics, law, sociology, economics, anthropology and even aestheitics Economics teaches us the virtues of division of labour; working on the assumption that other contributors will draw on their abundant qualifications as erstwhile politicians or practising lawyers, I propose to take refuge in my profession and approach the subject from the point of view of an economist.

When people talk of the need for an economically well knit nation one is faced with the danger of being bogged down in essentially semantic discourses without actually getting into the subject. But then what is the subject? What do we really mean by a well knit nation? Does it mean a nation with an integrated economy? We find all these issues being paraded in the course of discussion. Now we could no doubt discuss each of these aspect of the problem with equal vigour. However, for purpose of this paper it is proposed to assume that a well knit nation means one which is free of conflict over economic issues between its separate regions. As we will see this is by no means an adequate assumption but will have to do for a working hypothesis if the discussion is ever to leave the ground.

The causes of disunity. Even with our restricted assumption we are left with the question of what is a region. After all the agitation of Sindhis and Pathans about economic neglect are quite familiar to us. However, because West pakistan is (1) integrated geographical region with a (2) well developed internal transportation system and because the cultural differences are somewhat less pronounced, the prospects of both labour and capital moving from one region to another is always likely to initiate equlising tendencies. This is not to say that there are no obstacles to this mobility and that certain regions in West Pakistan have not visibly lagged behind others but that the problems are somewhat smaller compared to the mobility of labour and capital between East and West Pakistan. Now the essence of any discussion on unity lies in an analysis of the causes of disunity. It would, therefore, be appropriate to examine the nature of these controversies which have arisen between East and West Pakistan.

Historical evidence clearly indicates that the economic development of East Pakistan has lagged far behind that of the West. Both the wings inherited backward economics in the aftermath of partition. Both West and East Pakistan were economic hinterlands which provided the food and raw materials for the more developed regions of undivided India.Industry was virtually absent though we had the embryo of a textile Industry in East Pakistan and the begining of a metal industry in the West. However, in the years after partition whilst substantial economic development occured in the West, East pakistan slowly fell behind in the race. Evidence based on national income statistics indicates that East pakistan’s per capita income actually decline during the Ist 5-year plan whilst West pakistan’s income rose. No doubt these along with all other statistics in Pakistan must be accepted with reservation but these figures if nothing else indicate a trend which is apparent to the more acute observers of the economic scene. The crux of the matter for East Pakistan is that even though she has made considerable economic progress it has not been enough to keep pace with her population increase. For those who think that the fecundity of the East pakistani is the chief villain it may be mentioned that population in the last decade has increased here by 20.9% whereas it has increased by 23.7% in West Pakistan.

The glaring gap: This glaring gap has of course been a basic issue of conflict for the last decade and is only to be expected. Pakistan is not the first country where the backwardness of one region has become an explosive political issue. The United States is one of the most obvious examples with the Civil War acting as a crisis point for this conflict.Similarly, North and South Italy, North and South Belgium and the conflict between the different Indonesian Islands are some of the many conflicts which come to mind. The Congo is the most recent addition to an impressive list.

Poverty, whatever its causes, is always likely to generate tensions particularly when it occurs in juxtaposition to prosperity. No matter how one rationalises the economic progress of the West the facts of life indicate that as long as there is a gap. irrespective of its genuine origins, East Pakistanis will accumulate resentment and will do whatever they can to remedy their predicament.

Its raison d’etre. It, therefore, becomes important to examine the raison d’etre of this gap. Is it a byproduct of malafide intentions or of certain inexorable economic forces? In a country which is completely committed to free enterprise, resources tend to flow to those regions which offer the best prospects for high returns on investment. However, high returns are not created by the atmospheric conditions but are in turn the byproduct of economic forces at work in the region. The existence of good roads, electricity, water supply are all conventional factors. In addition to this, government policies about import license allocations, Credit facilities, industrial estate locations, are also important in promoting investment.

Patronage for the west. In West Pakistan which was slightly advanced in all these fields but was also blessed with the virtues of government patronage the post-partition period saw heavy investment, in what is known in our professional jargon, as social over-heads. Investment in roads power, irrigation were reinforced by liberal credit policies and import licences. This basic policy decision was reinforced by the flow of refugee capital, from india into West Pakistan, where these facilities offered by the government butterssed the cultural affinities to the region and the belief that the region was politically more stable. In turn the big government investments created the purchasing power to sustain this industrialisation. The emergence of the textile industry which became the basis of many fortunes and further industrialisation was again fostered by acts of policy in West Pakistan. Today most of the industrial giant of the west are those who had their genesis in the textile industry.

This rapid expansion in the West carried within it its own dynamics.What Professor Gunnar Myrdal has called the law of cumulative causation got to work. The essence of the law is that riches beget riches. As West Pakistan prospered and incomes increased not only was the purchasing power of the people stimulated but the existence of well developed social overhead facilities and thriving business acted as an incentive to people to me in and set up new industries. Thus acts of policy could now be supported by the claims of economic logic whence, left to himself the market forces automatically led to flow and concentration of resources in the West.

The first plan. The introduction of the First 5-year-plan was a land mark indicating that the logic of the market place was not going to be the rationale of our economic development. Conscious policy decisions were to be made with a view to promoting development. The first 5 year plan, however, saw East Pakistan getting a much smaller share of the total allocations. This was aggravated by the inability of East Pakistan to spend the money allotted to them the total expenditure during the first plan coming to about Rs.98 crores.

The low allocation of resources to East Pakistan were themselves a byproduct of the same forces with led to East Pakistan lagging behind in the past. It was agreed that investment should take place where the prospects of income generation were higher. Since West Pakistan had the advantage of social overhead and allied investment it followed that it was likely to yield a higher productivity for investment. So the fruits of man-made decisions were now used to justify further decisions.

Furthermore the low administrative potential in the East Pakistan which was another legacy of neglect was unable to work up acceptable schemes and more important to get them accepted at the centre. When the allocations came through the paucity of administrative and technical personnel led to poor implementation. Thus a further variable was introduced in limiting allocations to East Pakistan and it was not unnatural that the First plan, instead of narrowing the gap between the two wings, actually served to widen it.

And the second. The second five year plan indicates a consciousness of this problem and allocations have been substantially stepped up with the ratio working out at about Rs.800 crores, out of Rs. 1,900 crores, to be spent in East Pakistan. However, these figures are misleading in that they overlook the expenditure on the Cannel Water replacement works in West pakistan which amounts to about Rs. 500 crores if not more and a projected Rs. 400 crores expenditure to combat water logging and salinity. Even within the original allocations some of the old rational still persist, this time in the form of on going projects. Here it is urged that substantial investments were made in the West, e.g. in power and irrigations and the textile industry, further investment is necessary to complete the projects or balance them as the case may be. Similarly, foreign exchange allocations also have to be higher in order to keep these investments functioning. We thus find that no matter how well-intentioned the planners may be certain built in forces are likely to widen the development gap.

A further point of special interest arises from the peculiar geographical dispersal of the regions. The tendency for disparate rates of regional development, we have seen, existed and exists in other countries. However, over time, given a well knit communications net work, the fruits of economic progress slowly percolate down to the rest of the regions. The starting development and prosperity of the southern states of the U.S.A. are a case in point. However, given the 1,000 miles gap between East and West Pakistan it is not possible for labour to move across and participate in the development in the West. Similarly, the growing incomes in the West do not lead to a growing demand for goods in East Pakistan but either go for imported goods if available or goods manufactured in the West. It follows then that the normal movement of economic forces cannot be relied upon to make good this growing development gap and consciously motivated and radically different policies may be required to alter this trend.

Removing the gap. The purpose of this analysis has been to demonstrate that for historic and economic reasons East Pakistan has fallen behind in the race for economic development. This economic lag has been one of the paramount factors promoting conflict. This conflict has manifested itself and can in the future manifest itself in one of two ways. Firstly, that a conscious attempt be made to radically alter the distributions of development resources in favour of East Pakistan. This in itself may not be all that difficult if the will is there. The basic bottleneck to development in Pakistan has been foreign exchange. East Pakistan which has nearly always had a surplus of foreign exports over import has, in fact, subsidised the development of West Pakistan by giving her use of her exchange surplus. Furthermore, the bulk of the foreign aid allocations have been channelised into West Pakistan.This trend can be reversed by simple administrative decisions. A policy of channelising most exchange allocations to the East would lead to an influx of West Pakistan Capital to exploit these allocations. Similarly, a centrally aided policy to work out acceptable schemes would lead to a flow of aid to East Pakistan, since a good deal of the aid is also likely to be in the form of commodity surpluses under President Kennedy’s Food for Peace plan; this could be diverted independently of the on going projects. However, both policies would require emancipation from the tyranny of the on going projects-arguments or East Pakistan will find that it is always ending up with the short end of the stick.

This policy of stepped up allocations assumes an integrated economic system since the flow of West Pakistan’s capital and technical and administrative skills will have to play a strategic part in the operations. No doubt in time as incomes are generated from investment and training programme are accelerated, East Pakistani Capital and skills can be expected to come forward. In fact there is evidence that East pakistan capital is available even today on a larger scale than is popularly assumed and given the requisite governmental assistance could easily come forward. However, such a solution which really rests on the principle of diverting a bigger share of the developmental cake to East Pakistan and a smaller share to West Pakistan is likely to generate its own problems. A study of any society shows that one of the roots of tension is the income distribution question. In our case the fact that the East is now getting the plums may be tolerated for a while, but it would be most unlikely if it did not creat hostility in West Pakistan after a period of time, if not immediately. It would be grossly unnatural if they did not contest the distribution of development expenditure. We may thus visualise a stage where West Pakistan becomes the aggrieved section of Pakistan questioning the favours being given to the Eastern wing.

Two cakes in place of one. The logic of this danger leads one to the conclusion that if harmony is to prevail the main point of tension should be eliminated. In this case it is the distributional question since the problem arises out of the conflict for shares of the development cake. A logical solution would, therefore, be to have two cakes instead of one. This could be eschewed by introducing a policy of complete regional autonomy in an economic sense, with each region having full control over its resources both foreign exchange and domestic. The only expenditures left with the centre would be foreign affairs and defence. Both wings could contribute to this on the basis of their incomes and the benefits received.

Here two issues need clarification. Firstly, East Pakistan whilst having a foreign exchange surplus is also faced with an inadequacy of domestic finance. This could be offset by either a sale of foreign exchange to West Pakistan at the market price or by attracting West Pakistan capital with the lure of foreign exchange, Notwithstanding either alternative, a policy of deficit finance could creat the rupee equivalent to match the foreign exchange earned. This step may be no more inflationary than financing development in East Pakistan from savings in West Pakistan.

More important than the question of internal finance is the question of foreign aid. A glance at our plan would reveal that the total foreign exchange component is expected to be met by foreign Aid. This brings to the sobering conclusion that all discussions of more or less development in either wing are academic, since the real resources come from aid. It is here that the political wisdom, not only of the centre but more so, of the aid giving countries will have to be taken into account. If the aid givers can evaluate East Pakistan as an autonomous economic entity and visualise its problems, social, economic and political, independently they may be more conscious of the need for an accelerated aid programme. As it stands when the two units are compared in juxtaposition to one another consideration of on going projects and relative rates of return, not to mention more dynamic lobbying by West Pakistan, tends to colour decisions in their favour. However, if the aid givers could have their aid missions in East Pakistan and evaluate in the context of the requirements of the region, a substantially accelerated aid programme may not be unlikely. Given this accelerated aid a major bottleneck to development would climinate itself.

Now it may appear paradoxical that the conclusion of discussion aiming to build Pakistan into a well-knit nation leads to a case for regional autonomy. One submits that this paradox stems from the illusion that unity means conformity and physical contact. In fact true unity only emerges when the main points of conflict between the two groups have been eliminated or reduced there is greater danger in forging an artificial unity which may ultimately give way at the seams under pressure from the explosive issues inherent in the distributional questions; rather than face this a policy of leaving the regions to look after their own economic destiny from their own economic resources will lead to the emergence of a healthy relationship built up on the free intercourse of private trade and investment and common foreign policy and defense interests which can be viewed independently of the economic question.

Only one aspect of the distribution problem has thus been touched upon. The regional question has obviously formed the centre of this paper because it is an issue which is most frequently in our minds. However, even within regionally autonomous economic units fissiparous tendencies will be at work. This is because the struggle for the economic cake is an old question which has its origins in antiquity and even transcends economic systems. The conflict between agriculture and industry and labour and capital will always be with us. Socialist countries may have got round the labour and capital question in its more obvious forms but are still faced with the consumptions investment and industry-agriculture conflict which has led to explosive consequence on many occasions.

Similarly, in Pakistan these issues will be with us and will always work against a harmony of interest for many years to come. However, such conflicts are the life blood of a society. Monolithic or totalitarian societies try and eliminate these by a plea for national unity. But this plea is essentially temporary. Countries may unite against foreign aggression or for independence or other common problems but once left to themselves these issues will emerge. The point of conflict may be minimised initially by propaganda palliatives but sooner or later the questions of who gets the cake at whose expense will assert itself. In a democratic society one simply lives with these conflicts and tries to minimise their harshness by channelising them into the parliamentary process. In other societies the conflict expresses itself ultimately in explosions and revolution. Perhaps, in some future day when technology has introduced an era of such abundance that all men can have all they want, we can visualise a conflict free and well-knit society.

এই সময় পূর্ব পাকিস্তানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণের ক্রয়ক্ষমতাকে অতিক্রম করিয়া এক দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি করে। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বৈঠকে বিলাসী নেতৃবৃন্দের অপেক্ষা না করিয়া আমরা সক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার নিমিত্ত জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনের (৫০০ এ, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, সড়ক নং-৭) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সভা আহ্বান করি এবং নিন্নোক্তদের সমবায়ে সর্বদলীয় খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করিঃ

খাজা খায়ের উদ্দিন                                                               পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউঃ)

জনাব শফিকুল ইসলাম                                            পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউঃ)

মাওলানা আবদুর রহিম                                           পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী

জনাব গোলাম আযম                                              পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী

জনাব ফরিদ আহমদ                                              পাকিস্তানে নেজামে ইসলাম পার্টি

জনাব এম, আর, খান                                              পাকিস্তানে নেজামে ইসলাম পার্টি

জনাব আতাউর রহমান খান                                   জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট

জনাব অলি আহাদ                                                  জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট

জনাব ইমদাদুল্লাহ                                                থিলাফতে রাব্বানী পার্টি

মূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলন

পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিনিধিবর্গ এই সভায় খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করে বটে, তবে পার্টি সভাপতি মাওলানা ভাসানীর অনুমতির অপেক্ষায় থাকেন এবং মাওলানা ভাসানীর অনুমতি আর আসে নাই। ১৯৬৩ সালে আইউব-ভাসানী সাক্ষাৎকারের পর থেকে মাওলানা প্রকৃতপক্ষে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণে তীব্র অনীহা প্রকাশ করিতেন এবং কালক্রমে ঘটনাস্রোতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গদি রক্ষায় সহায়ক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিচক্ষণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সিদ্ধহস্ত পরিচালিত পররাষ্ট্রনীতি একই সঙ্গে দুই কমিউনিস্ট দৈত্য মহাচীন ও সোভিয়েট রাশিয়ার বন্ধুত্ব অর্জনে সমর্থ হয়। সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি ও জোট বদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যা সমাধান প্রশ্নে কমিউনিস্ট মহাচীনের প্রকাশ্য সমর্থন পায় এবং ভারতের অন্ধ বন্ধু সোভিয়েট রাশিয়াও কাশ্মীর সমস্যা প্রশ্ন পূর্বেকার কঠিন মনোভাব পরিহার করিয়া নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। পররাষ্ট্রীয় নীতির আকস্মিক গতিশীলতা ও সার্বজনীনতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে ক্ষুব্ধ করিয়া তোলে। ১৯৬৭ সালের ৮ই মে মস্কো রেডিও ইংরেজি টিকা ভাষ্যে ঘোষণা করে, “পাকিস্তান কর্তৃক মার্কিনী ফরমাবরদারী হইতে মুক্ত স্বাধীন ও বাস্তবধর্মী বৈদেশিক নীতি গ্রহণের দরুন মার্কিন সরকার নানাপ্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে। ইতিমধ্যে অকূটনীতিসুলভ কার্যকলাপের দরুন পাকিস্তান সরকার মার্কিন সরকারের নিযুক্ত মাসত খুই, ম্যাকডোনাল্ড, কিং ও জেলবার্টকে পাকিস্তান হইতে বহিষ্কার করিয়া দেন। মার্কিন সরকারের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (C.I.A.) পূর্ব পাকিস্তানের শেখ মুজিবকে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে সাহায্য করিতেছে এবং কোন একটি রাজনৈতিক দলের সহিত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করিতেছে। শুধু তাহাই নয়, ইহার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করিবার জন্য ষাট লক্ষ টাকা সাহায্য দিয়াছে।”

উল্লেখ্য যে, ১৯৬৭ সালের ১৬ই মার্চ রেডিও পিস এন্ড প্রগ্রেস, মস্কোর ঘোষণাপত্রেও অনুরূপ বক্তব্য শোনা গিয়াছিল। বলাই বাহুল্য যে, মস্কো রেডিও কথিত এই রাজনৈতিক দল ও ঘোষণাপত্র রয়েছে ছয় দফা ও শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পেশোয়ার সামরিক ঘাঁটি গুটাইয়া দেয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নারাজ হয় এবং ইহার ফলে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে উস্কানি দিতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সরকার স্ব-স্ব দৃষ্টিভঙ্গী হইতে পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নানাভাবে বিশেষ করিয়া আর্থিক সাহায্য মারফত শক্তিশালী করিবার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। পরিস্থিতির এই ক্রান্তিলগ্নে আওয়ামী লীগকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা (সি,আই,এ)-এর ফরমাবরদার আখ্যা দান করিয়া সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কোন কোন মহল স্বীয় কর্তব্য সমাধান হয়েছে মনে করিয়া আত্বতপ্তি লাভ করে এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রনীতি অভিনন্দনযোগ্য পরিবর্তনের জয়ধ্বনিতে মশগুল হইয়া পড়ে। তারপর জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন প্রকট সমস্যা সমাধানে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব না দিয়া মার্কস, লেনিন ও মাও সেতুং-এর বক্তব্যকেন্দ্রিক তর্ক-বিতর্কে অনাহূত কালক্ষেপণ করিতে থাকে এবং প্রগতির লেবাস পরিধান করিয়া গণশক্তি হইতে শত ক্রোশ দূরে থাকিয়া সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের শক্তি আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিল। বলাই বাহুল্য যে, তাহারা মূলতঃ জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার ও বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়, একদলীয় একনায়কত্ব বিশ্বাসী। তাই চীন-রাশিয়া বন্ধুত্বের ক্ষীণ-রশ্যি অবলোকনেই তাহার জনতার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের অর্জন আন্দোলনকে ছুরিকাঘাত করিয়া স্বীয় দলীয় মোঃ তোয়াহা, মোজাফফর আহমদ, আসহাব উদ্দিন প্রমুখের উপর হইতে গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার হাসিলে আত্মনিয়োগ করে। আদর্শ সংক্রান্ত সংঘাতের ইহাই স্বাভাবিক পরিণতি, বাদবাকী ব্যতিক্রম মাত্র। এই কারণেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগদান বিরত থাকা বিস্ময়কর কিছু ছিল না। উল্লেখ্য যে, এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সর্বদলীয় কোন আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করিয়া একলা চল নীতি গ্রহণ করে।

খাদ্য দাবি দিবস

এইদিকে সর্বদলীয় খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধে অংশগ্রহণ কমিটি ২২শে মে (১৯৬৬) “খাদ্য দাবি দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তদানুযায়ী ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা আহ্বান করা হয়। পূর্বেই ঘোষণা করা হয় যে, জনাব আতাউর রহমান খান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। ইতিমধ্যে ২০শে মে (১৯৬৬) পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগীয় ডেপুটি সেক্রেটারি রাওয়ালপিন্ডি হইতে এক আদেশ বলে জনাব আতাউর খানকে রাজনৈতিক দল বিধির ৮-ক ধারার ১ উপধারা (Subsection I of Section 8A of the political parties Act) মোতাবেক আদেশ প্রাপ্তির তারিখ হইতে ছয় মাস অবধি কোন জনসভা, সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণদান ও বিবৃতি দান হইতে বিরত থাকিতে বলেন। আতাউর রহমান খান ২১শে মে উক্ত আদেশ পত্রের এক কপি রাখেন। তড়িঘড়ি কমিটির সভা আহ্বান করা হয়। আদেশ লংঘন প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। অবশেষে সিদ্ধান্তের ভার আতাউর রহমান খানের উপর ন্যস্ত হয়।

২২শে মে অপরাহ্নে পল্টন ময়দানে আহূত জনসভায় বিপুল জনসমাগম হয়। আইউব মোনায়েমের অন্যায় আদেশ উপেক্ষা করিয়া সভায় সভাপতির ভাষণ দিতে আমি অনুরোধ করিলে প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তিনি ভাষণ দান করেন। পরিতাপের বিষয়, ২২শে মে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সংবাদদাতা ও সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিকে টেলিফোন যোগে তিনি ভাষণদান খবরটি বেমালুম অস্বীকার করেন। নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের খবরটি তিনি যখন আমতা আমতা করিয়া অস্বীকার করেছিলেন; আমি তখন স্বয়ং তাহার সম্মুখস্থ সেক্রেটারিয়েট টেবিলটির পার্শ্বে বসে। দুর্ভাগ্য, স্বকর্ণে তাহার ভুল তথ্য পরিবেশন শুনতে হইল। আমি মর্মাহত ও বিস্মিত হইলাম। ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, তাহার গণমুখী হইবার প্রবল আকাঙ্খা আছে কিন্তু চরম মুহূর্ত মোকাবিলা করিবার সৎ সাহস নাই। (ক) ১৯৪৯ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা অবস্থানকালে খাদ্য মিছিল পরিচালনার অপরাধে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবর্গ গ্রেফতার হইলে, তিনি শিলং অধ্যয়নরত সন্তানদের সঙ্গ দিতে ঢাকা ত্যাগ করেন, (খ) ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভয়াল রূপ দেখিবার পূর্বে মামলা সংক্রান্ত কাজে ঢাকা ত্যাগ করিয়া ময়মনসিংহ গমন করেন, (গ) ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া ১৯৭১ সালে অনুরূপ ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং (ঘ) মুজিব আমলে ১৯৭৪ সালের ৩০শে জুন সরকার বিরোধী কমিটি অব এ্যাকশনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অপরাধে আমাদের গ্রেফতার করা হইলে-তিনি কোনরূপ উচ্চবাচ্য করেন নাই। এমন কি স্বীয় প্রেস কনফারেন্সে আমাদের নামোল্লেখ করিতেও সাহস পান নাই, (ঙ) ১৯৭৫ সালে মুজিব এক দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে বাকশাল গঠন করিলে তিনি বাকশালে যোগ দিতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই।

যাহা হউক, পরবর্তী কর্মসূচী গ্রহণকল্পে কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হইল। জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবদুর রহিম বলিলেন “মন্দ আইনকে মন্দ বলিব কিন্তু আইন ভঙ্গ করিব না।” অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলীয় প্রতিনিধিবৃন্দ একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন। ফলে সভার সামগ্রিক আবহাওয়ার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। সক্রিয় গণআন্দোলনের কোন কর্মসূচি গ্রহণের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। বস্তুতঃ আলাপ-আলোচনার আসর জমাইয়া গণআন্দোলন হয় না। সরকারি ভ্রান্ত নীতির প্রতিবাদে সরকারের সহিত সংঘাত-সংঘর্ষের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। গণআন্দোলন, গণ ঐক্য, গণ প্রতিবাদই জালেম সরকারের সমুচিত জওয়াব দিতে পারে, অন্যথায় জালেম শাহী জগদ্দল পাথরের ন্যায় অনড় হইয়া স্থায়িত্ব পায়।

আমাদের শ্রমিক সমাজ

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয় দফা আদায় উদ্দেশ্যে ৭ই জুন হরতাল ঘোষণা করে। এই হরতালে শ্রমিক শ্রেণি সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় গণআন্দোলনে এক নূতন ডাইমেনশন যুক্ত হয়। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন হইতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সরকার বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ ছাত্র সমাজ ও সমস্যা জর্জরিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। স্বীয় মজুরি বৃদ্ধি, বোনাস বা ভাতা আদায় ইত্যাদি অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল; কোন ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলনে তাহাদের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা ছিল না।

প্রসঙ্গক্রমে গোটা শ্রমিক আন্দোলনের পূর্বাপর একটি সাংগঠনিক আলোকচিত্র আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞান মতে তুলিয়া ধরা প্রয়োজন বোধ করিতেছি। কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য কমরেড অনিল মুখার্জী ও কমরেড নেপাল নাগের সক্রিয় সহায়তায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডক শ্রমিক নেতা আফতাব আলী ও কলকাতার খিদিরপুর শ্রমিক নেতা এডভোকেট ফয়েজ আহমদ ১৯৪৮ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার’ গঠন করেন। জনাব আফতাব আলী ও জনাব ফয়েজ আহমদ যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে মজদুর ফেডারেশন গঠিত হয় এবং ১৯৫৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ ইহার কর্মকর্তা নির্বাচিত হন:

মোহাম্মদ তোয়াহা                                                              সভাপতি

এডভোকেট এম, এ, জব্বার (খুলনা)                      সহ-সভাপতি

এ, আর, সুন্নামাত (ঢাকা)                                       সহ-সভাপতি

হারুনুর রশিদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম)                         সহ-সভাপতি

কাজী মহিউদ্দিন আহমদ                                       সম্পাদক

হাবিবুর রহমান                                                       সাংগঠনিক সম্পাদক

১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন (ইস্ট জোন) নামে নিম্নোক্ত কর্মকর্তাসহ পুনর্গঠিত হয়:

এ, আর সুন্নামাত                                                   সভাপতি

কাজী মহিউদ্দিন                                                    সহ-সভাপতি

দেওয়ান সিরাজুল হক                                             সহ-সভাপতি

এম, এ, হাই                                                             সহ-সভাপতি

খন্দকার আব্দুল হাই                                                            সম্পাদক

আশরাফ হোসেন                                                    সহ-সম্পাদক

শাহ আবদুল হালিম                                                                 সহ-সম্পাদক

১৯৬৪ সালে পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন (ইস্ট জোন) দুই ভাগে বিভক্ত হয়। ইহার একভাগে এ,আর, সুন্নামাত ও দেওয়ান সিরাজুল হক যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক এবং আশরাফ হোসেন, রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও মোহাম্মদ এজাজ সহ-সম্পাদক ও আনিসুর রহমান সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই অংশ ‘বাংলা মজদুর ফেডারেশন’ নাম গ্রহণ করে। পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশনের (ইস্ট জোন) অন্য অংশের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে খন্দকার আবদুল হাই ও শাহ আবদুল হালিম। তাঁহারা ১৯৭১-এর মুক্তি আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন; কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সংগঠনের নাম রাখেন “বাংলাদেশ মজদুর ফেডারেশন।”

১৯৬৬ সালে মার্কসীয় দর্শন ভাবাপন্ন শ্রমিক নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করেন। জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা ও সিরাজুল হোসেন খান যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে সভাপতি মোহাম্মদ তোয়াহা ও যুগ্ম সম্পাদক হাবিবুর রহমান শ্রমিক ফেডারেশন হইতে পদত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন কমরেড কাজী জাফর আহমদ ও চট্টগ্রামের শ্রমিক নেতা কমরেড আবুল বাশারের নেতৃত্বে দ্বিধাবিভক্ত হয়। উক্ত বিভক্তির পিছনে ব্যক্তি নেতৃত্বের অভিলাষ ও মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী কমিউনিস্টদের তত্ত্বগত মতভেদ সমভাবে কাজ করিয়াছে।

শ্রমিক আন্দোলন বহুধা পথে সংগঠিত হয় বটে তবে অবস্থার বিপাকে শ্রমিক শ্রেণি ক্রমশ রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়ে। বাংলা ভাষাভাষী শ্রমিক সম্প্রদায় আওয়ামী লীগ পরিচালিত ছয় দফা তথা বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিয়া অশেষ ত্যাগ স্বীকার করে।

৭ই জুনের প্রস্তুতি

দেশের আনাচে কানাচে ছয় দফার বাণী পৌঁছাইয়া দেওয়ার প্রয়াসে শেখ মুজিবর রহমান বিভিন্ন জেলা সদরে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিতে লাগিলেন। ক্ষিপ্ত গভর্নর মোনায়েম খান বক্তৃতার কোন কোন অংশকে আপত্তিকর নির্ধারিত করিয়া পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারায় বিচারের জন্য তাহাকে গ্রেফতারের আদেশ দেন। ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে বক্তৃতার জন্য খুলনা হইতে ঢাকা আগমন পথে ২১শে এপ্রিল যশোর জেলা শহরে গ্রেফতার, যশোর দায়রা জজ কর্তৃক জামিন মঞ্জুর; ময়মনসিংহে বক্তৃতার অপরাধে পুনঃ সিলেট জেল গেটে গ্রেফতার এবং ময়মনসিংহ দায়রা জজ কর্তৃক জামিন মঞ্জুর প্রাপ্ত হন। এভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের পুনঃ পুনঃ গ্রেফতার এবং দৈনিক ইত্তেফাককে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার-অভিযান পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশ্রেণির শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি মহলে তীব্র আলোড়ন ও যুগান্তকারী আবেদন সৃষ্টি করে। ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জে আয়োজিত জনসভায় পার্শ্ববর্তী শিল্প এলাকা হইতে সহস্র সহস্র মেহনতি শ্রমিক যোগদান করে এবং ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবর রহমানকে পাটের মালায় ভূষিত করে। পাটকল শ্রমিক শ্রেণি হইতে আওয়াজ শুনা যায় আপোষহীন সংগ্রামের। নারায়ণগঞ্জ জনসভা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৬৫ সালে দেশ রক্ষা আইনের ৩৪ ধারায় ঢাকায় স্বীয় বাসভবন থেকে ৮ই মে রাত্রে শেখ মুজিবর রহমান গ্রেফতার হন। এবং ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি মুক্তির আদেশ পান বটে তবে কারাগার ফটকে তাহাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রথম ও প্রধান আসামী হিসাবে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ই মে (১৯৬৬) ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

এই দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল হক বাকী; ময়মনসিংহ জিলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান সক্রিয় কর্মসূচী নিতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে চাপ দিতে থাকেন। ফলে আওয়ামী লীগ ৭ই জুন (মঙ্গলবার) সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ হরতাল পালনের ডাক দেয়। এই সময়ে চটকল শ্রমিক ফেডারেশন, মোঃ তোয়াহার নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন; আফতাব আলী, ফয়েজ আহমদ পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার বিভিন্ন শিল্প এলাকায় হরতাল বিরোধী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ব্যতিক্রম ছিল পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন (ইস্ট জোন)। এই সংগঠন ৪ঠা জুনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে কোনপ্রকার সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিয়া “অবস্থাভেদে ব্যবস্থা গ্রহণ” নীতি অবলম্বনে শাখা কমিটিগুলি নির্দেশ দান করে। আমার ধারণা, ইহার দ্বারা ৬ দফা দাবিতে আহূত হরতাল কর্মসূচী বহুলভাবে উপকৃত হয়। মজদুর ফেডারেশন অন্তর্ভুক্ত আঞ্চলিক তেজগাঁও ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন ভূঁইয়া ৫ই জুন কার্যকরী কমিটির সভা আহ্বান করেন। শাখা সংগঠন সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান হরতাল পালনের বিরুদ্ধে রায় দিলেন। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন ভুইয়া ৬ই জুন তেজগাঁও আঞ্চলিক শাখাভুক্ত প্রত্যেক ইউনিয়ন হইতে দুইজন প্রতিনিধি সম্বলিত এক সম্প্রসারিত শ্রমিক বৈঠক আহ্বান করেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবর রহমান বিরোধী বক্তব্য রাখিলেও অবশেষে রাত্রি দেড় ঘটিকায় আইউব-মোনায়েম সরকারের জুলুম এবং কলকারখানার মালিক শ্রেণির অত্যাচারের প্রতিবাদে ৭ই জুন রোজ মঙ্গলবার হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শ্রমিকদের মুজিব বিরোধী মনোভাবের কারণ অবশ্য ছিল। ১৯৫৬-৫৭ সালে শ্রমমন্ত্রী থাকাকালীন শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমিকদের দাবিনামা গ্রহণের পরিবর্তে হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরীর শ্রমিক প্রতিনিধিসহ শ্রমিকদিগকে পুলিশ মারফত ট্রাকে করিয়া জয়দেবপুর জঙ্গলে ছাড়িয়া দিবার ব্যবস্থা করেন।

৭ই জুনের ঘটনাবলী

৭ই জুন ঢাকা শহরে হরতালের প্রথম বেলায় বিশেষ কোন সক্রিয় সাড়া জাগাইতে পারে নাই। কিন্তু সমগ্র পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়া যায় তেজগাঁও শিল্প এলাকার মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া। সকাল ৮ ঘটিকার দিকে তেজগাঁয়ে অবস্থিত কোহিনূর কেমিক্যাল। কোন (তিব্বত) ও হক ব্রাদার্স কোং সম্মুখস্থ রাজপথের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত একটি চায়ের দোকানে ধর্মঘটী শ্রমিক দল চা-নাস্তা গ্রহণকালে একজন শ্রমিক সাইকেলে তথায় আসিলে দোকানে উপবিষ্ট শ্রমিকদের একজন সাইকেলের হাওয়া ছাড়িয়া দেয়। এমনি আপোষী দৃশ্যে হাসির-কৌতুক হিল্লোল বহিয়া যায়। হঠাৎ হরিষে বিষাদ সৃষ্টি করে একটি পুলিশ জীপের আগমন। পুলিশ জীপ আগত পুলিশ শ্রমিকদিগকে লাঠিপেটা আরম্ভ করে, শুরু হয় পাল্টা শ্রমিক প্রতিরোধ। অসহিষ্ণু পুলিশের রিভলবারের গুলিতে তিনজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। উক্ত গুলিবিদ্ধ তিনজনের মধ্যে সিলেট জেলা নিবাসী বেঙ্গল বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের শ্রমিক মনু মিয়া ঘটনাস্থলে শাহাদাত বরণ করেন।

উক্ত হৃদয় বিদারক ঘটনার পর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সহস্র সহস্র শ্রমিক লাঠি হাতে মিছিল সহকারে পথে বাহির হইয়া পড়ে। মিছিল তেজগাঁও রেলওয়ে ক্রসিং অতিক্রমকালে উত্তর দিক হইতে আগত ট্রেনকে পথিমধ্যে থামাইয়া দেয়। ট্রেনটি পুনঃ চালাইবার চেষ্টা করিলে উহা লাইনচ্যুত হইয়া যায়। ঘটনা অব্যবহিত পরে পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর সশস্ত্র বাহিনী রেল লাইনের পশ্চিম দিক হইতে রেল লাইনের পূর্ব দিকে অবস্থানরত শ্রমিক মিছিল ছত্রভঙ্গ করার প্রয়াসে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে নোয়াখালী জেলা নিবাসী আজাদ এনামেল এন্ড এলুমিনিয়াম কারখানা ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের আবুল হোসেন পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। ইহাতে উত্তেজিত হইয়া আহত আবুল হোসেন বীরদর্পে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে তাহার বক্ষে গুলো করিতে আহ্বান জানায়। পুলিশ উদ্যত রাইফেলের নির্মম গুলি তাহার বক্ষকে বিদীর্ণ করে। এভাবেই ধরাশায়ী শহীদ আবুল হোসেন স্বীয় তপ্ত শোনিতে মুক্তি সংগ্রামের মৃত্যুঞ্জয়ী ডাক লিখিয়া গেলেন। এই স্থানেই পুলিশের পরবর্তী গুলীতে আরও ৫ জন শ্রমিক আহত হয়। প্রায় দুপুর ১২-৩০ মিঃ এ এই নগ্ন দমননীতি ও পাইকারী শ্রমিক-হত্যার প্রতিবাদে জারিকৃত ১৪৪ ধারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করিয়া লাঠি হস্তে অকুতোভয় শ্রমিক জনতার মিছিল ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে তেজগাঁও হইতে পাক মোটর এলাকা, হোটেল শাহবাগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, কমিশনার্স অফিস (বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) অর্থাৎ সেগুন বাগিচার মোড়ে উপস্থিত হয়। মিছিল পল্টন ময়দান মুখে অগ্রসর হইতে চেষ্টা করিলে সশস্ত্র পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনী বাধাদান করে। বাধাপ্রাপ্ত জঙ্গি মিছিল হাইকোর্ট অভিমুখে রওয়ানা হয়। সময় তখন অপরাহ্ন দুই কি আড়াইটা। মিছিলের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বেস্টনি লক্ষ্য করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ মিছিলকারীগণকে কার্জন হল প্রাঙ্গণে সমবেত হবার আহ্বান জানায়। অপরাহ্ন চার ঘটিকায় পল্টনে আহূত জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাহাকেও না দেখিয়া বিহবল, হতাশ ও উদ্বিগ্ন মনে শ্রমিকগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া স্ব-স্ব পথে তেজগাঁও অভিমুখে যাত্রা করে। প্রত্যাবর্তনকারী শ্রমিকদের ১ শত ৫০ জনকে পুলিশ রমনা থানা, পাক মোটর, হোটেল শাহবাগ ও অন্যান্য স্থান হইতে গ্রেফতার করে। পরে ৯ই জুন রাত্রে সান্ধ্য আইন জারি করিয়া তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া থেকে ৬০ জন শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়।

৭ই জুন ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব

নারায়ণগঞ্জ শহরে ৭ই জুন হরতাল উপলক্ষে কয়েক স্থলে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ ঘটে। সর্বশেষ বোস কেবিনের নিকট জনতা রেলওয়ে ওয়াগন লুট করিবার চেষ্টা নিলে পুলিশের গুলিতে ৬ জন মৃত্যুবরণ করে। ক্ষুব্ধ জনতা নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। তেজগাঁও, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলীতে নিহত হইবার সংবাদে উত্তেজিত লক্ষাধিক শ্রমিক-জনতা পোস্তগোলা, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ হইতে যাত্রাবাড়ি পৌঁছিলে সশস্ত্র পুলিশ ও ই,পি, আর বাহিনী বাধা দান করে। কর্তৃপক্ষ জনতাকে জানায় যে, ঢাকার পল্টন ময়দানে কোন জনসভা হইতেছে না। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য শ্রমিক নেতা সায়েদুল হক, নূর মোহাম্মদ ও শফিসহ ৫ জনকে ঢাকার পল্টন ময়দানে পাঠানো হয়। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ যাত্রাবাড়ি প্রত্যাবর্তন করিয়া জনশূন্য পল্টন ময়দানে রিপোর্ট দিলে শোভাযাত্রীগণ ঢাকা গমন কর্মসূচী বাতিল করেন। এইভাবে ই,পি, আর ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সময়োপযোগী পদক্ষেপ আসন্ন প্রলয় কান্ড হইতে পরিস্থিতি রক্ষা করে। উলেখ্য যে, ৭ই জুন দুপুর নাগাদ ঢাকা শহরের হরতাল ও জনসভা সম্পর্কে আলোচনা করিতে আমি স্ব উদ্যোগে পুরানা পল্টন আওয়ামী লীগ অফিসে গমন করিয়াছিলাম। তথায় মিজানুর রহমান চৌধুরী, মিসেস আমেনা বেগম, এ,কে, রফিকুল হোসেন, গাজী গোলাম মোস্তফা ও সিরাজুল আলম খানের সহিত আমার আলোচনা হয়েছিল। ৭ই জুন তেজগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিবর্ষণ সংবাদ ঢাকা শহর স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। হরতাল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। উৎসুক জনতা পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গকে দেখিতে চায়। আমি বার বার যোগাযোগ করিয়াও তাহাদিগকে পল্টন ময়দানে লইয়া যেতে সমর্থ হই নাই। বোধহয় গভর্নর মোনায়েম খানের ভয়াল মূর্তি কল্পনানেত্রে তাহাদিগকে অদৃশ্য স্থান থেকে শাসাইতেছিল। তাই ৭ই জুন সরকারি হিসাবে ১০ জন নিহত হওয়া সত্ত্বেও নেতৃবৃন্দ কোন প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেন নাই। ৬ দফা দাবি প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায় এই অভিযানের (৭ই জুনের কর্মসূচীর) সাফল্য ও গৌরব তেজগাঁও, পোস্তগোলা, নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা ও আদমজী নগর শিল্পাঞ্চলের সংগ্রামী, নির্ভীক ও সরল শ্রমিক শ্রেণির অবশ্যই প্রাপ্য। ইতিপূর্বে আর কখনো এত ব্যাপক ও সংঘবদ্ধভাবে শ্রমিক শ্রেণি রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নাই।

পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের গণতন্ত্র বিরোধী, প্রভূত্ব ব্যঞ্জক ও বাঙ্গালি বিদ্বেষী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের মনের দিগন্তে পুঞ্জীভূত রাস ধীরে ধীরে শাসক চক্রের অজান্তে ও অগোচরে প্রলয়ঙ্করী রূপ ধারণ করেছিল। ইহারই অসংগঠিত ও স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৭ই জুন। ঐতিহাসিক যুগ সন্ধিক্ষণের যুগ পরিবর্তনকারী অবশ্যম্ভাবী সগ্রামের নির্ভীক অজেয় অগ্রণী সেনা মেহনতি শ্রমিক শ্রেণি শত্রুকে চিহ্নিত করিতে সমর্থ হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে শাসক শ্রেণির বিস্তর হাঁকডাক ও দম্ভের শোচনীয় পরাজয়ের সংকেত ধ্বনি ছিল ৭ই জুনের আন্দোলন। ১৩ই মে (১৯৬৬) পল্টন ময়দানের জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহিরুদ্দিন আহমদ তাহার ভাষণে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া বলিয়াছিলেন, “মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানকল্পে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চৌদ্দ দফা প্রত্যাখ্যান করায় ভারত দ্বিখন্ডিত হয়, তদ্রুপ ৬ দফা দাবি গ্রহণে পাকিস্তানী শাসকবর্গ ব্যর্থ হলে পূর্ব পাকিস্তান এক দফা দাবি করবে।”

ইত্তেফাক বন্ধ

৬ দফা আন্দোলন প্রচারে নিয়োজিত দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন ১৫ই জুন গ্রেফতার করা হয়। ১৬ই জুন দৈনিক ইত্তেফাকের মুদ্রাযন্ত্র দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসকে বাজেয়াপ্ত এবং দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দৈনিক ইত্তেফাক বাজেয়াপ্তকরণ আদেশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় ঢাকা হাইকোর্ট সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে রায় দিলে সরকার অর্ডিন্যান্সে প্রয়োজনীয় সংশোধন করিয়া পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনে দৈনিক ইত্তেফাকের মুদ্রাযন্ত্র দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসকে পুনরায় বাজেয়াপ্ত করে। উল্লেখ্য যে, এই ৭ই জুনের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার হন। নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হবার পর মহিলা সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হয়। তাহাদের কঠোর পরিশ্রম ৬ দফাকে গণভিত্তি দিতে সমর্থ হয় এবং প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আওয়ামী লীগের পতাকা সমুন্নত থাকে।

এইদিকে এক ব্যক্তি শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হইতে সমগ্র দেশকে মুক্ত করিবার উদ্দেশ্যে ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক বাসনায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঐক্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত ৩০শে এপ্রিলের (১৯৬৭) সভায় নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গের সমবায়ে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট গঠিত হয়:

জনাব নুরুল আমিন                                                                  জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট

জনাব হামিদুল হক চৌধুরী                                                    জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট

জনাব আতাউর রহমান খান                                                   জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট

জনাব মমতাজ দৌলতানা                                                       পাকিস্তান মুসলিম লীগ

জনাব তোফাজ্জল আলী                                                        পাকিস্তান মুসলিম লীগ

সৈয়দ খাজা খায়ের উদ্দিন                                                     পাকিস্তান মুসলিম লীগ

মাওলানা তোফায়েল মোহাম্মদ                                                            জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান

মাওলানা আবদুর রহিম                                                           জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান

অধ্যাপক গোলাম আযম                                                        জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান

নওয়াবজাদা নাসুরুল্লাহ খান                                                                 পাকিস্তান আওয়ামী লীগ

আবদুস সালাম খান                                                                                 পাকিস্তান আওয়ামী লীগ

গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর                                     পাকিস্তান আওয়ামী লীগ

চৌধুরী মোহাম্মদ আলী                                                       পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি

মৌলভী ফরিদ আহমদ                                                           পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি

এম, আর, খান                                                                         পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট গঠন প্রশ্নে পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া যায়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আমেনা বেগমের (যথাক্রমে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (সভাপতি) ও রাজশাহীর মুজিবুর রহমান (সাধারণ সম্পাদক) পরিচালিত আওয়ামী লীগ যথাক্রমে ৬ দফা আওয়ামী লীগ ও আট দফা আওয়ামী লীগ নামে পরিচিতি লাভ করে। ৬ দফা পূর্বেই দেওয়া আছে। পাঠকদের সুবিধার্থে ৮ দফা নিম্নে প্রদত্ত হইলঃ

দফা কর্মসূচী

১। শাসনতন্ত্রে নিম্ন বিধান সমূহের ব্যবস্থা থাকবেঃ

ক) পার্লামেন্টারি পদ্ধতি ফেডারেল সরকার

খ) ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র মোতাবেক প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্য

গ) পূর্ণাঙ্গ মৌলিক অধিকার

ঘ) সংবাদপত্রের অবাধ আযাদী ও

ঙ) বিচার বিভাগের নিশ্চিত স্বাধীনতা

২। ফেডারেল সরকার নিম্ন বিষয়সমূহের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করিবেনঃ

ক) প্রতিরক্ষা (ডিফেন্স)

খ) বৈদেশিক বিষয়

গ) মুদ্রা ও কেন্দ্রীয় অর্থ ব্যবস্থা

ঘ) আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য এবং ঐকমত্যে নির্ধারিত অন্য যে কোন বিষয়

৩। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা হইবে এবং কেন্দ্রীয় বিষয় ছাড়া সরকারের অবশিষ্ট যাবতীয় ক্ষমতা শাসনতন্ত্র মোতাবেক স্থাপিত উভয় আঞ্চলিক সরকারের নিকটই ন্যস্ত থাকিবে।

৪। উভয় প্রদেশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ১০ বৎসরের মধ্যে দূর করা পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব হইবে:

ক) এই সময়ের মধ্যে দেশরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় ব্যয় এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বৈদেশিক ঋণসহ কেন্দ্রীয় সরকারের দেনায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত অর্থের আনুপাতিক অংশ আদায়ের পর পূর্ব পাকিস্তানে অর্জিত সম্পূর্ণ মুদ্রা নিরংকুশভাবে এই প্রদেশেই ব্যয় করা হইবে।

খ) দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রাদেশিক সরকারদ্বয়ের নিরংকুশ কতৃত্বাধীনেই থাকিবে।

গ) অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে অগ্রাধিকার প্রদান করিবেন এবং এমন আর্থিক নীতি গ্রহণ করিবেন যাহাতে পূর্ব পাকিস্তান হইতে মূলধন পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ হইয়া যায়। এই উদ্দেশ্যে ব্যাংকের মওজুদ অর্থ ও মুনাফা, বীমার প্রিমিয়াম এবং শিল্পের মুনাফা সম্পর্কে যথা সময়ে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হইবে।

৫।            ক) মুদ্রা, বৈদেশিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং

খ) আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য

গ) আন্ত আঞ্চলিক যোগাযোগ

ঘ) বৈদেশিক বাণিজ্য

উপরোক্ত বিষয় সমূহের প্রত্যেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত এক একটি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হইবে। জাতীয় পরিষদের প্রত্যেক প্রদেশ সদস্যগণ নিজ প্রদেশের জন্য উক্ত বোর্ডসমূহের সদস্যগণ নির্বাচন করিবেন।

৬। সুপ্রীম কোর্ট এবং কূটনৈতিক বিভাগসহ কেন্দ্রীয় সরকারের সকল বিভাগ ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমসংখ্যক ব্যক্তি দ্বারা গঠিত হইবে। এই সংখ্যা সাম্য অর্জনের জন্য ভবিষ্যতে এমনভাবে কর্মচারী নিয়োগ। করিতে হইবে যাহাতে ১০ বৎসরের মধ্যে তাহাদের সংখ্যা উভয় প্রদেশে সমান হইতে পারে।

৭। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কার্যকরী সামরিক শক্তি ও সমর-সজ্জার ব্যাপারে উভয় অঞ্চলের মধ্যে সমতা বিধান করা পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব হইবে। এই উদ্দেশ্যে-

ক) পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক একাডেমী, অস্ত্র নির্মাণ কারখানা, ক্যাডেট কলেজ ও স্কুল স্থাপন করিতে হইবে।

খ) দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটি বিভাগেই পূর্ব পাকিস্তান হইতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়োগ করিতে হইবে।

গ) নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করিতে হইবে।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমসংখ্যক সদস্য সম্বলিত একটি ডিফেন্স কাউন্সিল গঠন করা হইবে।

৮। এই ঘোষণায় ‘শাসনতন্ত্র’ শব্দ দ্বারা ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বুঝায় যাহা অবিলম্বে জারি করা হইবে। এই শাসনতন্ত্র চালু করার ৬ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনেই এই কর্মসূচি ২ থেকে ৭ নম্বর দফাসমূহ শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত করা হইবে।

উপরোক্ত লক্ষ্য সমূহ বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন অন্তর্ভুক্ত সকল রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান ঐক্যবদ্ধ এবং পৃথক পৃথকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ২৩শে আগস্ট (১৯৬৭) বৈঠকে নিম্নোক্তদের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এডহক কমিটি গঠন করেঃ

১। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ                  (পাবনা)                    সভাপতি

২। মশিউর রহমান                                                   (যশোর)                  সহ-সভাপতি

৩। মুজিবুর রহমান                                                  (রাজশাহী)               সাধারণ সম্পাদক

৪। নূরুল ইসলাম চৌধুরী                                         (ঢাকা)                      কোষাধ্যক্ষ

৫। আবদুস সালাম খান                                            (ফরিদপুর)               সদস্য

৬। মিয়া আবদুর রশিদ                                            (যশোর)                  সদস্য

৭। আবদুর রহমান খান                                           (কুমিল্লা)                                সদস্য

৮। মতিউর রহমান                                                  (রংপুর)                    সদস্য

৯। রওশন আলী                                                       (যশোর)                  সদস্য

১০। রহিমুদ্দি আহমদ                                            (দিনাজপুর)              সদস্য

১১। সা’দ আহমদ                                                    (কুষ্টিয়া)                 সদস্য

১২। আবদুর রউফ                                                   (কুষ্টিয়া)                 সদস্য

১৩। এ, ডব্লিও, লাকিউতুল্লাহ                                               (বরিশাল)                 সদস্য

১৪। মোমেন উদ্দিন আহমদ                                 (খুলনা)                    সদস্য

১৫। আবদুল হাই                                                     (সিলেট)                    সদস্য

১৬। জালাল উদ্দিন আহমদ                                    (সিলেট)                    সদস্য

১৭। নুরুল হক                                                          (রংপুর)                    সদস্য

১৮। আহমদ আলী                                                   (কুমিল্লা)                                সদস্য

১৯। ডাঃ সুলতান আহমদ                                         (কুমিল্লা)                                সদস্য

২০। দেওয়ান শফিউল আলম                                   (ঢাকা)                      সদস্য

২১। আবদুর রহমান চৌধুরী                                  (দিনাজপুর)              সদস্য

২২। মনসুর আলী                                                     (পাবনা)                    সদস্য

২৩। বি, এম, ইলিয়াস                                              (বগুড়া)                     সদস্য

২৪। জুলমত আলী                                                    (ময়মনসিংহ)           সদস্য

ইহার জবাবে ২৭শে আগস্ট নিম্নোক্তদের লইয়া নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক কমিটি (৬ দফা) গঠন করা হয় :

১। শেখ মুজিবুর রহমান                                          (ফরিদপুর)               সভাপতি

২। কামারুজ্জামান                                                  (রাজশাহী)               সাধারণ সম্পাদক

৩। নজরুল ইসলাম                                                   (ময়মনসিংহ)           সদস্য

৪। মিজানুর রহমান চৌধুরী                                   (কুমিল্লা)                                সদস্য

৫। খন্দকার মোশতাক আহমদ                                            (কুমিল্লা)                                সদস্য

৬। মিসেস আমেনা বেগম                                         (কুমিল্লা)                                সদস্য

৭। আমজাদ হোসেন                                               (কুমিল্লা)                                সদস্য

৮। সোহরাব হোসেন                                                             (যশোর)                  সদস্য

৯। হোসেন মনসুর                                                  (পাবনা)                    সদস্য

১০। শাহ আজিজুর রহমান                                      (কুষ্টিয়া)                 সদস্য

১১। এ, বি, এম, নূরুল ইসলাম                  (ফরিদপুর)               সদস্য

১২। অধ্যাপক ইউসুফ আলী                                    (দিনাজপুর)              সদস্য

১৩। আবদুল মালেক উকিল                                     (নোয়াখালী)            সদস্য

১৪। নুরুল হক                                                          (নোয়াখালী)            সদস্য

১৫। বাহাউদ্দিন চৌধুরী                                        (বরিশাল)                 সদস্য

১৬। শামসুল হক                                                      (ঢাকা)                      সদস্য

১৭। হাফেজ মুসা                                                      (ঢাকা)                      সদস্য

১৮। শেখ আবদুল আজিজ                                       (খুলনা)                    সদস্য

১৯। তাজউদ্দিন আহমদ                                        (ঢাকা)                      সদস্য

২০। আফজাল হোসেন                                           (যশোর)                  সদস্য

২১। জাকিরুল হক                                                    (চট্টগ্রাম)                              সদস্য

২২। মহিবুস সামাদ                                                  (সিলেট)                    সদস্য

২৩। মোহাম্মদ উল্লাহ                                         (নোয়াখালী)            সদস্য

ভুট্টোর অপসারণ

ইত্যবসরে বিনাশর্তে পাক-ভারত যুদ্ধের অবসান বিরোধী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নির্দেশে ১৯৬৬ সালের ১৮ই জুন চিকিৎসার অজুহাতে পদত্যাগ করিতে হয়। ইতিপূর্বে তাহাকে পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কনভেনশন) সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। গণভোট অনুষ্ঠান মারফত কাশ্মীর সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা ও তাসখন্দ শান্তি চুক্তি সম্পাদনের খেলাফে স্থির সংকল্প আপোষহীন বিরোধিতার ধরন জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানী জনসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হইয়া উঠেন। সোভিয়েট রাশিয়া ও কমিউনিস্ট চীনের সহিত সম্পর্কোন্নয়নের জন্য জনাব ভুট্টোর বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী উদীয়মান ও ক্রমবর্ধিষ্ণু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ হইতে অপসারিত হইবার পর ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে জনাব ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ শেষে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ধূমায়িত বিক্ষোভ আইয়ুব বিরোধী খাতে প্রবাহিত হয় এবং ইহাই রূপান্তরিত হয় ভুট্টোর রাজনৈতিক মূলধনে।

এন, ডি, এফ-এর নিস্ক্রিয়তা

ইতিমধ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), নেজামে ইসলাম পার্টি নিষ্কর্মা ক্ষমতালোভী নেতৃত্ব সর্বস্ব দলে পরিণত হয়। যুব-ছাত্র-শিক্ষক সাধারণের বিশেষ কোন সমর্থন উক্ত দলগুলির পিছনে ছিল না। তদুপরি এই দলগুলি নিজের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ডান্ডার ভয়ে নিষ্ক্রিয় হইয়া বৈঠক রাজনীতিতে মশগুল ছিল। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আইউবের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সংগঠিত করিবার ছিল বিরোধী। মোজাফফর আহমদ পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একাংশ জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন একটি কর্মী সর্বস্ব মার্কসবাদী দল হিসাবে বিরাজ করিতেছিল। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী অন্ধ ও গোঁড়া ভাবধারার ধারক ও বাহক। এই সময়ে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জন সমর্থিত, যুব ছাত্র সম্প্রদায় সমর্থিত ও সাধারণ শ্রমিক শ্রেণি সমর্থিত সংগ্রামী সংগঠনে পরিণত হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান কোটা ও প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা প্রায় সব কয়টি আসনে নির্বাচিত হন। ফলে পরিষদের অভ্যন্তরে ও বাহিরেও আওয়ামী লীগ একমাত্র সংগঠিত দল হিসেবে রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়। এইদিকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচী বিচ্ছিন্নতাবাদী, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি পরিপন্থী বলিয়া ঊর্ধ্বতন মহল উচ্চস্বরে চিকার করিতেছিল। তাই, সরকার আওয়ামী লীগকে নেক নজরে নহে বরং বিষ নজরে দেখি।

জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নিষ্ক্রিয় ভীরু ভূমিকা আমাদিগকে (আতাউর রহমান খান, নূরুর রহমান, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, মফিজুল ইসলাম, দেওয়ান সিরাজুল হক, আবুল মনসুর আহমদ এবং আমি) অত্যন্ত চিন্তিত করিয়া তোলে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত। এই কারণে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আবদুল মোমেন, রফিকউদ্দিন ভূইয়া, কে, এম, ওবায়দুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সভাপতি ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, মাজহারুল হক বাকী, সিরাজুল আলম খান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রুপে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করিতেন। তাহাদের মতে ৭ দফা অর্থাৎ দুই অর্থনীতির প্রবক্তাদের সহিত তাহাদের মূলত কোন পার্থক্য নেই। অতএব আওয়ামী লীগ মঞ্চ হইতেই ঐক্যবদ্ধভাবে সকলের কাজ করা শ্রেয় ও বিধেয়। আমাদের প্রস্তাব ছিল, প্রথমে পি, ডি, এম ভুক্ত আওয়ামী লীগ, ইহার পর পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ ও তাহার পর জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মীদের পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ ভুক্ত করা। আওয়ামী লীগের (৬ দফা) প্রস্তাব ছিল ১৯৬৪ সাল পূর্বের সাংগঠনিক রূপে ফিরিয়ে যাওয়া। উভয় প্রস্তাব তেমন কোন তফাৎ ছিল না, কিন্তু ব্যক্তি নেতৃত্ব নিশ্চয়তা না পাওয়ায় এবং কারান্তরালে যাওয়ার ভয়ে নেতা আতাউর রহমান খান সম্মত হন নাই। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত রহিয়া গেল।

ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানে নেতৃবৃন্দের সহিত কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন; কিন্তু আইউব খানের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক বা আইন অমান্য কোন প্রকার আন্দোলন করার মত মানসিকতা তাহাদের ছিল না। আইয়ুব খান তাহা জানিতেন, তাই তিনি তাহাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। এইদিকে সরকার হইতে বিতাড়িত ফজলুল কাদের চৌধুরী আমাদের সহিত রাজনৈতিক আলোচনা উদ্যোগ গ্রহণ করেন; কিন্তু কোন প্রকার কার্যকর অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন-কারণ জেল-ভীতি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র

এমনি হতবুদ্ধিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৬৭ সালের মধ্য ডিসেম্বরে ঢাকা নগরে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামো হইতে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাহার কতিপয় সহচরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সকল জল্পনা-কল্পনা ও গুজবের অবসান ঘটিয়ে সরকার ৬ই জানুয়ারি (১৯৬৮) এক প্রেসনোটে ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের প্রথম সচিবের (ফার্স্ট সেক্রেটারি) যোগসাজশে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকিবার অপরাধে ১৮ জন সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সংবাদ জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। পুনঃ ১৮ই জানুয়ারি (১৯৬৮) এক সরকারি প্রেসনোটে ঘোষণা করা হয় যে, রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রে জড়িত শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। আগেই বলিয়াছি, শেখ সাহেব ১৯৬৬ সালের ৮ই মে হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনা বিচারে আটক ছিলেন। ১৭ই জানুয়ারি (১৯৬৮) দিবাগত গভীর রাত্রে (আনুমানিক রাত ১টায়) শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়।

২১শে এপ্রিল (১৯৬৮) প্রেসিডেন্ট এক অর্ডিন্যান্স জারি করিয়া পাকিস্তান পেনাল কোডের ১২১ ক ও ১৩১ ধারায় দোষীদের বিচার করিবার নিমিত্ত বিশেষ আদালত গঠনের ব্যবস্থা করেন। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার কোন আদেশ বলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস, এ, রহমান, ইস্ট পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি মুজিবুর রহমান ও বিচারপতি মকসুমুল হাকিম সমবায়ে বিশেষ আদালত গঠন করেন এবং অন্য এক আদেশ বলে কেন্দ্রীয় সরকার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টকেই বিচারস্থল হিসাবে ঘোষণা করে। ৬ই জুন (১৯৬৮) গেজেটে ঘোষণা করা হয় যে, ১৯শে জুন ঢাকা ক্যান্টমেন্ট সিগন্যাল মেস প্রাঙ্গণে বিশেষ আদালতে বিচার আরম্ভ হইবে। মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৯শে জুন হইতে নিম্নলিখিত ৩৫ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা আরম্ভ হয়:

১। শেখ মুজিবুর রহমান, ২। লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, ৩। স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, ৪। এল, এস, সুলতান উদ্দিন আহমদ, ৫। এল, এস, সি, ডি, আই, নূর মোহাম্মদ, ৬। আহমদ ফজলুর রহমান, সি, এস, পি, ৭। ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ, ৮। প্রাক্তন কর্পোরাল আবুল বাশার মুহাম্মদ আবদুস সামাদ, ৯। প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, ১০। ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হক, ১১। খন্দকার রুহুল কুদ্স, সি, এসপি, ১২। ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, ১৩। বিধান কৃষ্ণ সেন, ১৪। সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক, ১৫। প্রাক্তন হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, ১৬। প্রাক্তন ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, ১৭। সার্জেন্ট জহুরুল হক, ১৮। প্রাক্তন, এ, টি, মোহাম্মদ খুরশীদ, ১৯। খান এম, শামসুর রহমান সি, এস, পি, ২০। হাবিলদার এ, কে, এম, শামসুল হক, ২১। হাবিলদার আজিজুল হক, ২২। এস, এ, সি, মাহফুজুল বারী, ২৩। সার্জেন্ট শামসুল হক, ২৪। মেজর শামসুল আলম, ২৫। ক্যাপ্টেন মোঃ আবদুল মোত্তালেব, ২৬। ক্যাপ্টেন এম, শওকত আলী, ২৭। ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা, ২৮। ক্যাপ্টেন এ, এন, এম, নূরুজ্জামান, ২৯। সার্জেন্ট আবদুল জলিল, ৩০। মোহাম্মদ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, ৩১। ফাস্ট লেঃ এম, এস, এম, রহমান, ৩২। প্রাক্তন সুবেদার এ, কে, এম, তাজুল ইসলাম, ৩৩। মোহাম্মদ আলী রেজা, ৩৪। ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দিন আহমদ, ৩৫। ফার্স্ট লেঃ আবদুর রউফ।

মামলার বিবরণ প্রকাশে আদালত সংবাদপত্রগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করে। শেখ মুজিবর রহমান আগরতলা মামলার প্রধান আসামী ছিলেন। প্রখ্যাত আইনজীবী আবদুস সালাম খান শেখ সাহেবের মামলা পরিচালনা করেন এবং সরকার পক্ষে পরিচালনা করেন প্রাক্তন বৈদেশিক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মনজুর কাদের, অ্যাডভোকেট টি, এইচ, খান, গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আসলাম, এডভোকেট করাচি, এ, আলীম এডভোকেট, ঢাকা ও খাকন বাবর, এডভোকেট, লাহোর।

আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে মিথ্যা মামলা বলিয়া গোড়া হইতেই কানাঘুষার আন্দোলন শুরু করে। সাংগঠনিক শক্তির বলে এই প্রচার মোটামুটি কার্যকর বলিয়া প্রতীয়মান হয়েছে। তাই, ঢাকা নগরে বিভিন্ন সভায় মিছিলে, ‘জাগো জাগো বাঙ্গালি জাগো” আওয়াজ উঠে। জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ হইতে থাকে। যুব সম্প্রদায় যখন এইভাবে মাঠে এক ব্যক্তির শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত, তখন হুক্কাসেবী বৈঠকী রাজনীতির আড্ডা পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পি, ডি, এম,) আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, অথচ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন প্রকার সক্রিয় আন্দোলন বা কর্মসূচী গ্রহণে বিরত থাকে।

নিম্নলিখিত দলিল আগরতলা মামলার বাস্তবতা প্রমাণ করে

জনাব ফয়েজ আহমদ একটি বই লিখেছেন নাম আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ’ প্রকাশক মফিজুল হক এই বইটির শেষ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত পরিশিষ্ট ৭‘ নীচে হুবহু উদ্ধৃত করা হলো

আগরতলায় শেখ মুজিব সম্পর্কে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী

১৯৬৩ ইং আমার ভাই এম এল এ শ্রী উমেশ লাল সিং সমভিব্যাহারে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে ১০ জন ত্রিপুরার পালম জেলার খোয়াই মহকুমা দিয়া আগরতলায় আমার আগরতলা বাংলায় রাত ১২ ঘটিকায় আগমন করেন। প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পর আমার বাংলা বাড়ি হইতে মাইল দেড়েক দূরে ভগ্নী হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়িতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তারপর মুজিবুর ভাইয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরুর সাথে দেখা করি। আমার সাথে ছিলেন শ্রী শ্রীরমণ, চীফ সেক্রেটারি। তাকে (শ্রীরমণকে) শ্ৰী ভাণ্ডারিয়ার বিদেশ সচিবের রুমে রাখিয়া প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। তিনি মুজিবুর রহমানকে ত্রিপুরায় থাকিয়া প্রচার করিতে সম্মত হন নাই। কারণ চীনের সাথে লড়াইয়ের পর এতো বড় ঝুঁকি নিতে রাজি হন নাই। তাই ১৫ দিন থাকার পর তিনি (শেখ মুজিব) ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। সোনামুড়া পশ্চিম ত্রিপুরারই এক মহকুমা কুমিল্লার সাথে সংলগ্ন। শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।

শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী

ত্রিপুরা

নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা

এই পরিস্থিতিতে ৮ই অক্টোবর (১৯৬৮) জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে আমরা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা) এর সৈয়দ নজরুল ইসলাম-ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, মিজানুর রহমান চৌধুরী-ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, মিসেস আমেনা বেগম মহিলা সম্পাদিকা, আবদুল মান্নান ও আবুল কালাম, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি (মস্কো) কোষাধ্যক্ষ, মহিউদ্দিন আহমদ ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের আতাউর রহমান খান, নুরুর রহমান ও আমি আগামীদিনের আন্দোলনের নীল-নকশা প্রণয়নকল্পে এক বৈঠকে মিলিত হই। আমরা পি, ডি, এম-এর সিদ্ধান্ত পুংখানুপুংখভাবে আলোচনা করি ! আমি স্পষ্ট ভাষায় পি, ডি এম এর সিদ্ধান্তের সহিত দ্বিমত প্রকাশ করি।

৯ই অক্টোবর (১৯৬৮) প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদের বাড়িতে আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি ও জনাব নুরুর রহমান ১০ই অক্টোবর টাঙ্গাইলে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিং) সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করি। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা রাজনৈতিক আলোচনায় আমরা ঐকমত্যে পৌঁছা যে, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠাকল্পে অবিলম্বে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া অপরিহার্য। দলমত নির্বিশেষে ঐক্য সকল সংগ্রামের পূর্বশর্ত। সাধারণ নির্বাচন ঘোষণার পূর্বেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে গণ আন্দোলন আরম্ভ করিবার এবং আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণের প্রস্তাব করেন মওলানা ভাসানী। খাজনা বন্ধের মতো উগ্র কর্মসূচিকে সাফল্যমণ্ডিত করিতে যে সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজন তাহা বর্তমানে নাই বিধায় সরকারি দমননীতি অংকুরেই আন্দোলনকে বানচাল করিয়া দিবে বলে মাওলানা বলেন যে, সামরিক বাহিনীতে আইয়ুব খানের পূর্ব প্রতিপত্তি নাই, এমন কি জেনারেল হামিদ ও জেনারেল ইয়াহিয়া খান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী ব্যবহারে সম্মত হইবেন না। মওলানা আরো বলেন যে, এইসব বিষয়ে তাহার যোগাযোগ আছে; সুতরাং তিনি মনে করেন, গণ আন্দোলনের পর ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে বিরোধী শিবির জয়লাভ করবে এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমাদের জয় অবধারিত।

দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সশস্ত্র বাহিনীর এক অংশের আইউব বিরোধী মনোভাবের উপর নির্ভর করিয়া মওলানা ভাসানী এখন স্বচ্ছন্দে গণ-আন্দোলনে যোগ দিতে পারেন, কেননা তাহাতে বিপদ কম। উপসংহারে ন্যাপ (মস্কো)-এর সহিত আলোচনায় বসিতে রাজী কিনা জানিতে চাইলে মওলানা বলেন যে, ঐক্যের খাতিরে সহযোগিতা করিতে তিনি প্রস্তুত আছেন।

যাহা হউক, আমাদের নিকট দেয় প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মাওলানা ভাসানী ঢাকা আসিলেন বটে; কিন্তু ১৩ অক্টোবর (১৯৬৮) জনাব সাইদুল হোসেনের বাসভবনে জনাব নুরুর রহমান, দেলদার আহমেদ ও আমার সহিত আলোচনাকালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে (মস্কো) প্রস্তাবিত সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানালেন। রাত ৯টায় জনাব আবুল মনসুর আহমদের বাসভবনে আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, নূরুর রহমান, দেলদার আহমদ, জমির উদ্দিন আহমদ ও আমি পুনরায় মওলানা ভাসানীর সহিত বৈঠকে মিলিত হই। আলোচনায় নিম্ন বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে উপনীত হই।

‘নির্বাচনী কলেজ’ নির্বাচনী সরকার গঠন পদ্ধতির উপর গণভোট হিসেবে গণ্য করা হইবে। আমরা তাই আসন্ন নির্বাচনী কলেজ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিব। ইহার পর প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ইলেকটোরাল কলেজ অংশগ্রহণ করিবে। আওয়ামী লীগ (৬ দফা) এর সহিত ঐক্যফ্রন্ট গঠনে মওলানা ভাসানী সবিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মিসেস আমেনা বেগম ও মোল্লা জালালউদ্দিন আহমদের সহিত এতদ মর্মে বৈঠকে বসার জন্য তাহাদের ঠিকানা পর্যন্ত চাহিলেন। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিলেন যে, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কো) সহিত ঐক্যফ্রন্ট গঠনে তিনি অপারগ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হইল না। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের চূড়ান্ত মুহূর্তে আমাদের কিছুই না জানিতে দিয়া মওলানা ভাসানী ঢাকা ত্যাগ করিলেন। মনে হয়, পিকিং লবী আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের সংগ্রামে সায় দিতে পারে নাই। তাই, চূড়ান্ত মুহূর্তে আমাদের সকল প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল।

কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত

১৯৫৬ সাল হইতে চীন-সোভিয়েত মতবিরোধ চলিয়া আসিতেছে। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে আহূত বিশ্ব কমিউনিস্ট পার্টি সম্মেলন খসড়া কমিটির বৈঠকের দিনই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভাঙ্গনের দিন বলিয়া কমিউনিস্ট চীন ৩০শে জুলাই লেখা এক চিঠিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানায়। ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি পিকিং গ্রুপ ও মস্কো গ্রুপে বিভক্ত হইয়া পড়ে। কমিউনিস্ট চিন্তাধারার প্রভাবান্বিত ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আহূত বার্ষিক সম্মেলনে জনাব রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিং) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ইকবাল হলের ছাদে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলনে বেগম মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো) গঠিত হয়।

মস্কো-পিকিং মতদ্বৈততার এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দ্বিখন্ডিত হয়; মস্কোপন্থী ন্যাপ নেতৃবৃন্দ কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করার দাবিতে সংগঠনের সভাপতি মওলানা ভাসানীকে রিকুইজিশন পত্র বা অধিযাচন পত্র দেয়। সভাপতি মওলানা ভাসানী রিকুইজিশন পত্রের কোন উত্তর না দিয়া রংপুরে কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠান করেন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে মস্কো সমর্থক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেনসহ অন্যান্য নেতাকে সংগঠন হইতে বহিষ্কার করেন। মস্কোপন্থী ন্যাপ নেতৃবৃন্দ ১৯৬৮ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় মোজাফফর আহমেদকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী ও খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আমার বাসভবন ৭ নং কলেজ স্ট্রিট আমার সাথে দেখা করেন এবং ন্যাপে যোগ দিতে অনুরোধ জানান। আমি উত্তরে তাহাদিগকে বলিয়াছিলাম, কমিউনিস্ট প্রভাবান্বিত সংগঠনের জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রীদের যোগ দিবার কোন ভিত্তি নাই। ইতিপূর্বে জনাব আতাউর রহমান খান ও নুরুর রহমান সাহেবকে স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছিলাম যে, ন্যাপ নেতৃবৃন্দের সহিত আমার আদর্শগত মৌলিক মতভেদ আছে, অতএব কোন ন্যাপ গ্রুপের সহিত আমার যোগ দেবার প্রশ্নই উঠে না। ভলগা-ইয়াংসি নদীতে বৃষ্টি হলে ঢাকার বুড়িগঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে আমার ছাতা খুলিবার সবিশেষ কারণ নেই। ন্যাপ এর সহিত আলোচনা সুতরাং তখনকার মত আর অগ্রসর হয় নাই।

ছাত্র শক্তির বিভক্তি

১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান ছাত্র শক্তি ঘোষণাপত্র ও আন্দোলনের কর্মসূচি সংশোধনের প্রশ্নে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে দ্বিধাবিভক্ত হয়। আনিসুর রহমানকে সভাপতি এবং মুজাফফর হোসেন পিন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করিয়া একটি কমিটি এবং ফজলুল হককে সভাপতি ও মোহাম্মদ হোসেন খানকে সম্পাদক করিয়া অপর একটি কমিটি গঠিত হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের পরিস্থিতি

পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাধারণভাবে শান্ত ছিল। তবে আকস্মিক দমকা হাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ক্ষমতার মসনদকে লণ্ডভণ্ড করিয়া তাহাকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে চিরতরে বিদায় দেয়। এক ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী ক্ষমতা লোভীদের জন্য ইহা এক জ্বলন্ত সতর্ক দৃষ্টান্ত।

উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অবস্থিত লান্ডিকোটালে ছিল বিদেশ থেকে পাচারকৃত মালের বাজার। রাওয়ালপিন্ডি গর্ডন কলেজের ৭০ জন ছাত্র কর্তৃক লান্ডিকোটাল হইতে বিদেশী মাল ক্রয় সংক্রান্ত অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া ছাত্র ও প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরোধ বাধে। উল্লেখ্য, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের ক্রয়কৃত বিদেশী মাল বাজেয়াপ্ত করিয়াছিল। এই বিরোধই অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ছাত্র-প্রতিবাদ আন্দোলন হইতে অপ্রতিরোধ্য গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সূচনা হইতে পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণের নিমিত্ত ছাত্রদের পক্ষাবলম্বন করেন। ৭ই নভেম্বর ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করে এবং পুলিশের গুলিতে রাওয়ালপিন্ডিতে আবদুল হামিদ নিহত হন। ফলে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে গণ-আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে। এমনি অবস্থায় ১০ নভেম্বর (১৯৬৮) পেশোয়ার জনসভায় ভাষণদানকালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের জীবন নাশের ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়। ইহার জওয়াবে আইয়ুব খান ১৩ নভেম্বর (১৯৬৮) জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গ্রেফতার করেন।

আন্দোলনের নতুন দিক

এই সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে ছয় দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান এমনিতেই বিক্ষুব্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানের এই ছাত্র আন্দোলনের সহিত একাত্মতা প্রকাশ করা হবে কি হবে না, এই প্রশ্নে সবাই দ্বিধান্বিত। এমনি অস্বস্তিকর সন্ধিক্ষণে মওলানা ভাসানী মঞ্চে উপস্থিত হইলেন। জনাব আবদুস সেলিমের নেতৃত্বে পরিচালিত ঢাকা বেবী ট্যাক্সি ইউনিয়ন কর্তৃক ৬ই ডিসেম্বর হরতাল দিবসের অপরাহ্নে আহূত পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন এবং জনসভার পর মওলানা ভাসানীর পরিচালনায় এক বিক্ষোভ মিছিল গভর্নর হাউসে গমন করে। বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ লাঠিচার্জ করিয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়। পুলিশী হামলার প্রতিবাদে ৭ই ডিসেম্বর (১৯৬৮) ঢাকায় ও সমগ্র পাকিস্তানে ৮ই ডিসেম্বর হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয়। ৮ই ডিসেম্বর হরতাল পালনকালে পুলিশের গুলিতে সিলেটে জনাব আবদুল হামিদ শাহাদাত বরণ করেন।

মওলানা ভাসানী কর্তৃক সৃষ্ট অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ৩০শে ডিসেম্বর (১৯৬৮) হাতিয়াদিরায় পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত হন ও নড়াইলে পুলিশ গুলী চালনা করে। এইভাবেই ক্রমে ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানে এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো), ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিং) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ এগার দফা প্রণয়ন করে এবং আন্দোলনের ডাক দেয়। আইউব-মোনায়েম সরকার সমর্থক জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) ১৯৬৮-৬৯ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংসদের নির্বাচনে তৎকালীন মুহসীন হল, জিন্নাহ হল ও ঢাকা হল সংসদের শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ এবং ফজলুল হক হল সংসদের সাধারণ সম্পাদকের আসনসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন দখল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ (ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা ডাকসুর (DUCSU) সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান (এন, এস, এফ) এগার দফা কর্মসূচীর অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। ফলে, এগার দফা কর্মসূচীকে সমর্থন জানাইয়া তাহার মুল ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন দলীয় বিভিন্ন হল সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা নগরের বিভিন্ন কলেজের ছাত্র কর্মকর্তাগণ এক যুক্ত বিবৃতি প্রচার করেন। এগার দফা ভিত্তিক দেশব্যাপী আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে ৫ই জানুয়ারি (১৯৬৯) নিম্নলিখিত এর সমবায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়:

আবদুর রউফ-                                         সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ

সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক –                  সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো)

মোস্তফা জামাল হায়দার –                    সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিং)

মাহবুব-উল-হক দুলন –                            সভাপতি, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন

খালেদ মোহাম্মদ আলী-                        সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগ

শামসুজ্জোহা –                                       সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো)

মাহবুব উল্লাহ –                                      সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিং)

ইব্রাহিম খলিল –                                    সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন

তোফায়েল আহমেদ –                             সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ

নাজিম কামরান –                                     সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ

১৪ই জানুয়ারি (১৯৬৯) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আহূত সাধারণ ছাত্র সভায় এগার দফা কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়।

এগার দফা কর্মসূচি নিম্নরূপ:

এগার দফা

১।            ক। স্বচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হবে এবং জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিকীকরণকৃত কলেজসমূহ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হইবে।

খ। শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজ সমূহকে সত্বর অনুমোদন নিতে হইবে। কারিগরি শিক্ষা প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।

গ। প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আই,এ, আই,এস,সি, আই, কম ও বি, এ, বি, এস, সি, বি, কম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এম, এ ও এম, কম ক্লাশ চালু করিতে হইবে।

ঘ। ছাত্র বেতনের শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে। স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলবে না।

ঙ। হল ও হোস্টেলের ডাইনিং হল ও কেন্টিন খরচার শতকরা ৫০ ভাগ সরকার কর্তৃক ‘সাবসিডি’ হিসেবে প্রদান করিতে হইবে।

চ। হল ও হোস্টেল সমস্যার সমাধান করিতে হইবে।

ছ। মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। অফিস আদালতে বাংলা ভাষা চালু করিতে হইবে।

জ। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করিতে হবে এবং স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দিতে হইবে।

ঝ। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে।

ঞ। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশন ভর্তি প্রথা বন্ধ, মেডিকেল কাউন্সিল বাতিল, ডেন্টাল কলেজ পূর্ণাঙ্গ কলেজ পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের দাবি মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।

ট। প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ, ১০% ও ৭৫% রুল বাতিল, রেন্টাল লাইব্রেরির ব্যবস্থা, প্রকৌশল ছাত্রদের শেষ বর্ষের ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থাসহ সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।

ঠ। পলিটেকনিক ছাত্রদের কনডেন্স কোর্সের সুযোগ দিতে হবে এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করিয়া একমাত্র সেমিষ্টার পরীক্ষার ভিত্তিতে ডিপ্লোমা দিতে হইবে। টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার, টেকনোলজি এবং আর্ট কলেজ ছাত্রদের সকল দাবি অবিলম্বে মানিয়া লইতে হইবে।

ড। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লোমা ছাত্রদের কনডেন্স কোর্সের দাবিসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।

ঢ। ট্রেনে ছাত্রদের ‘আইডেনটিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কনসেশন টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটে এই কনসেসনে দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোন স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াত শতকরা ৫০ ভাগ কনসেশন দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ কনসেশন দিতে হইবে।

ণ। চাকুরীর নিশ্চয়তা বিধান করিতে হইবে।

ত। কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করিতে হইবে।

থ। শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হবে এবং ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হইবে।

২। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।

৩। নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মানিয়া লইবে ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে।

ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হবে ফেডারেল শাসন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।

খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।

গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই অবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে; কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে, যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পরে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে, দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।

ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায় রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিল জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।

ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বহিঃবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে এবং বহি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্র সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত হার অনুযায়ী প্রদান করিবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আমদানি রফতানি চলবে এবং ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রপ্তানি করিবার অধিকার অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতন্ত্রে বিধান করিতে হইবে।

চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারী রক্ষী বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌ-বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।

৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতঃ সাব ফেডারেশন গঠন করিতে হইবে।

৫। ব্যাংক, বীমা ইনস্যুরেন্স ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে।

৬। কৃষকের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুক করিতে হইবে; সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণ প্রতি ৪০ টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হইবে।

৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও বোনাস নিতে হবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কালাকানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান করিতে।

৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

৯। জরুরি আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে। ১০। সিয়াটো, সেন্টো পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে।

১১। দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারিকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।

আন্দোলনের নূতন পটভূমি

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র আন্দোলন, জুলফিকার আলী ভুট্টোর গ্রেফতার ও পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন এয়ার মার্শাল আসগর খানের এক ব্যক্তির শাসন অবসান দাবিতে গণ-আন্দোলনে যোগদান, সমগ্র পাকিস্তানে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের নূতন পটভূমি রচনা করে। তাই সমগ্র দেশবাসী গণআন্দোলন পরিচালনার তাগিদে ৭ই ও ৮ই জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমির হোসেন শাহ, পাকিস্তান নেজাম-ই-ইসলাম পার্টির সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, পাকিস্তান জমিতে-উল উলামা-ই-ইসলামের সেক্রেটারি জেনারেল মুফতি মাহমুদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ-এর (৬ দফা) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সভাপতি জনাব নূরুল আমিন, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ভারপ্রাপ্ত আমীর তোফায়েল আহমদ, সভাপতি পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এর স্বাক্ষরে নিম্নলিখিত ৮ দফা দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়:

১। ফেডারেল পার্লামেন্টারি সরকার।

২। প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন।

৩। অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার।

৪। নাগরিক স্বাধীনতা পুনর্বহাল ও সকল কালাকানুন বাতিল বিশেষতঃ বিনাবিচারে আটক আইনসমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল।

৫। শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজনৈতিক বন্দি ও ছাত্র-শ্রমিক-সাংবাদিক বন্দিদের মুক্তি এবং কোর্ট ও ট্রাইব্যুনাল সমীপে দায়েরকৃত সকল রাজনৈতিক মামলা সংক্রান্ত সকল গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার।

৬। ১৪৪ ধারা মোতাবেক সর্বপ্রকার আদেশ প্রত্যাহার।

৭। শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার বহাল।

৮। নূতন ডিক্লারেশনসহ সংবাদপত্রের উপর আরোপিত সকল বিধি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বাজেয়াপ্ত সকল প্রেস, পত্রিকা ও সাময়িকী পুনঃবহাল অথবা ‘ইত্তেফাক’ ও ‘চাত্তান’সহ বাতিলকৃত ডিক্লারেশন পুনর্বহাল এবং আদত মালিকের নিকট প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেড পুনঃ ফেরত দান।

 ডেমোক্রেটিক কমিটি অব এ্যাকশন (সংক্ষেপে ডাক) ১৭ জানুয়ারি দেশব্যাপী দাবি দিবস পালন করার আহ্বান জানায়। ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৬৮ ইং হইতে ঢাকা শহরে বলবৎ ১৪৪ ধারা নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ না করিয়া বায়তুল মোকাররম মসজিদ হইতে জুম্মা নামাজের পর ৩ জন ৩ জন করিয়া মৌন মিছিল ঢাকা জিলা বার লাইব্রেরিতে আহূত সভায় যোগদানের কর্মসূচি ‘ডাক’-এর নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন। কিন্তু মোনায়েম খানের সরকার ইহার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে কার্পণ্য করেন না। ১৬ই জানুয়ারি (১৯৬৯) যে কোন শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকারি আদেশকে তোয়াক্কা না করিয়া পুলিশ বাহিনীর বাধা সত্ত্বেও নেতৃবৃন্দ খণ্ড খণ্ড মিছিল, শোভাযাত্রাসহ গন্তব্য স্থল ঢাকা জিলা বার লাইব্রেরি হলে গমন করেন এবং সেখানে জনাব নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত

সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অবস্থিত বটতলায় ছাত্রসভা অনুষ্ঠানের পর ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এইভাবেই সংগ্রামী ছাত্র সমাজ বিধি-নিষেধের প্রাচীর ধুলিসাৎ করিয়া স্বৈরাচারী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কাফেলা অগ্রাভিযান সূচনা ঘটায়। জালেম শাহীর রক্ষক পুলিশ বাহিনী। লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে। লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহারের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৮ই জানুয়ারি (১৯৬১) ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করে। ঐ দিন সভা অনুষ্ঠানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর হইতে মিছিল সহকারে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেট ত্যাগ করিতে উদ্যত হইল পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করিয়া ছাত্র মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে। অপরাহ্নে পুলিশ ও ই,পি, আর বাহিনী আবাসিক হল রেইড করে এবং ছাত্রদের নির্দয়ভাবে মারধর করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি পর্যন্ত ১৭ ও ১৮ই জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পুলিশের এই জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিতে বাধ্য হয়।

১৮ই জানুয়ারি ইকবাল হল প্রাঙ্গণে ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি ২ জন ছাত্রকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯শে জানুয়ারি রবিবার ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত ও তাৎক্ষণিক ধর্মঘট, ছাত্রসভা ও শোভাযাত্রা হয়। পুলিশ বাহিনী ছাত্র মিছিলে লাঠিচার্জ করে, টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে ও ৮ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস ও সলিমুল্লাহ হল হইতে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মঘটী ছাত্রদের সমর্থনে পৃথক পৃথক মিছিল বাহির হয়।

আসাদের মৃত্যু

এভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণকারী ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বিরোধী এক ব্যক্তি শাসনের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ ক্রমশ পূর্ব পাকিস্তানের রাজপথ প্রকম্পিত করিয়া তালে। ২০শে জানুয়ারি (১৯৬৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আহূত ছাত্রসভা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার ছাত্র যোগদান করে। পুলিশ ই,পি,আর বাহিনীর লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহারকে অগ্রাহ্য করিয়া মূল ছাত্র মিছিল ছত্রভঙ্গ ও খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজ পথ অবলম্বন করিয়া সমগ্র ঢাকা নগরকে বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত করে। এমনি একটি খণ্ড মিছিল মেডিকেল কলেজের সম্মুখস্থ রাজপথ ধরিয়া অগ্রসর হওয়ার পথে সশস্ত্র পুলিশ ই, পি, আর বাহিনীর সহিত ছাত্রদের ইট-পাটকেল, লাঠি ও টিয়ার গ্যাসের খণ্ড যুদ্ধ আরম্ভ হয়। চরম উত্তেজনার মুহূর্তে চর্তুদিক থেকে ছাত্র জনতা কর্তৃক আক্রান্ত ও পরিবেষ্টিত সশস্ত্র আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর গুলী ১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজের ছাত্র এ, এম, আসাদুজ্জামানের বক্ষ বিদীর্ণ করে। সমগ্র ঢাকা নগর ক্ষণিকের তরে মূহ্যমান হইয়া পড়ে। ইহার পর সম্বিত ফিরিয়া পাওয়া ঢাকা নগরবাসী সমগ্র দেশকে নতুন দিশার সন্ধান দেয়। শহীদ আসাদের তপ্ত শোণিতকণা সংগ্রামী ছাত্র আন্দোলনকে আপোষহীন গণ অভ্যুথানে রূপান্তরিত করে। এইদিন পুলিশের সহিত সংঘর্ষে আরো ৩ জন আহত হয়।

শহীদ আসাদুজ্জামানের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হইতে ছিনাইয়া নিতে ব্যর্থ হইয়া ছাত্র-জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিল্ডিং সম্মুখে শোকসভা করে, কালো পতাকা উত্তোলন করে, এক মিনিট নীরবে দন্ডায়মান হইয়া শোক প্রকাশ করে এবং ঢাকা নগরে প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধারণ হরতাল ঘোষণা করে। ২১শে জানুয়ারি অপরাহ্ন এক ঘটিকায় পল্টন ময়দানে এ, এম, আসাদুজ্জামান গায়েবানা নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ইহার পর নগ্নপদে মৌন মিছিল ঢাকার বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করিয়া শহিদ মিনারে উপস্থিত হয় এবং শহিদ মিনারে অনুষ্ঠিত শোকসভায় পুনরায় ঢাকা শহরে সাধারণ হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। উল্লেখ্য যে, ২১শে জানুয়ারি সাধারণ হরতাল পালনকালে ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজের সম্মুখে ও ঢাকা নিউ মার্কেট এলাকায় জনতার উপর পুলিশের গুলি চালায়। ২৯ জন আহত হয় এবং ৫৯ জন গ্রেফতার হয়। প্রসঙ্গতঃ ইহাও উল্লেখ্য যে, অপরাহ্ন ১ ঘটিকায় পল্টন ময়দানে শহীদ আসাদের গায়েবানা নামাজে জানাজায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিল। নামাজ আদায়ের পূর্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আসাদুজ্জামানের মৃত্যু উপলক্ষে ২২, ২৩ ও ২৪শে জানুয়ারি ‘শোককাল’ (Mourning Period) হিসেবে ঘোষণা করে। এবং এই শোককালে নিম্নোক্ত প্রোগ্রাম ঘোষণা করে:

২২শে জানুয়ারি-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে অপরাহ্ন ১২-৩০ মিনিটে গায়েবানা নামাজে জানাযা।

২৩শে জানুয়ারি-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও কালো পতাকা উত্তোলন এবং কালোব্যাজ ধারণ, সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন বটতলা হইতে মশাল মিছিল।

২৪শে জানুয়ারি-প্রদেশব্যাপী হরতাল।

পূর্ব পাকিস্তান বন্

গায়েবানা নামাজে জানাযার পর ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করিয়া জনসমুদ্রের শোক মিছিল শহরের রাজপথ প্রদক্ষিণে নির্গত হয়। শোক মিছিলে শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, খান মোহাম্মদ আলী ওয়ালী খান ও মনি সিংসহ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের গগনবিদারী ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হইয়া উঠে। দাবি ধ্বনিত হয় এগার দফা মানার।

২২শে জানুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলির প্রতিবাদে করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, হায়দারাবাদ, পেশোয়ার, মুলতান, শিয়ালকোট ও লায়ালপুরে ধর্মঘট, মিছিল, সভা ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি ২১শে জানুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৮ দফার সমর্থনে ১২ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানায়।

সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত সাধারণ হরতাল ২৪শে জানুয়ারি এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। মিছিলের পর মিছিল চলিতে থাকে। রাজধানী ঢাকার রাজপথ ছাত্র, শ্রমিক-মধ্যবিত্ত জনতার পদভারে প্রকম্পিত হইয়া উঠে। এমন একটি দুর্জয় মিছিল সেক্রেটারিয়েটের পার্শ্ববর্তী রাজপথে অগ্রসর হওয়াতে সংঘর্ষ বাধে আইয়ুব-মোনায়েম খাঁর গদি রক্ষায় নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর সহিত। তাহাদের নিষ্ঠুর বুলেটে নিহত হয় নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান মল্লিক, মকবুল, রুস্তম আলী ও অসনাক্ত একজন এবং আহত হয় ১৫ জন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইমারজেন্সী ওয়ার্ড হইতে শহীদ মকবুল ও রুস্তম আলীর মৃতদেহ বলপূর্বক ছিনাইয়া আনা হয় এবং ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করিয়া লক্ষ জনতার শোক মিছিল পল্টন ময়দানে যথারীতি নামাজে জানাযা আদায়ের পর শহীদানের লাশসহ জঙ্গি মিছিল ইকবাল হলে গমন করে। মারমুখী বিদ্রোহী জনতা সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত পাকিস্তান ট্রাস্ট সংবাদপত্র ‘দৈনিক পাকিস্তান’ ও ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। জনতার এই আপোষহীন সংগ্রামকে দমন করিবার জন্য শেষ অবলম্বন স্বরূপ সেনাবাহিনী তলব করা হয়। রাত ৮টা থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য জারি করা হয় কারফিউ। ঢাকা হইতে বহির্গামী ট্রেন সার্ভিস, অভ্যন্তরীণ বিমান সার্ভিস ও ঢাকা-করাচি টেলিকমিউনিকেশন বাতিল হইয়া যায়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট হয় অচল অবস্থা।

এভাবে জালিমশাহী খতমে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অগ্নিশপথে উজ্জীবিত বিদ্রোহী বঙ্গসন্তান গুলি-গালা ও সান্ধ্য আইনের প্রাচীরকে চুরমার করিয়া আইউবের নত মুখে বিদায় গ্রহণ অবধি দুঃশাসনের প্রতিরোধ আবেষ্টনীর আঘাতে আঘাতে বিধ্বস্ত করিয়া চলে। অজেয় জনসমুদ্রে উত্তাল তরঙ্গমালার অবিরাম আঘাতে পর্যুদস্ত আইয়ুব সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে করাচি, খুলনা, নারায়ণগঞ্জে; সান্ধ্য আইন বর্ধিত করে ঢাকা নগরীতে। সান্ধ্য আইন অমান্য করিয়া তেজগাঁও এলাকাধীন নাখালপাড়ার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক শ্রেণি সরকারি নরহত্যা অভিযানের বিরুদ্ধে ‘২৫শে জানুয়ারি জঙ্গি মিছিল বাহির করিলে সেনা বাহিনীর নির্মম গুলিতে বরিশাল নিবাসী তেজগাঁও চৌধুরী কেমিক্যাল ওয়ার্কস-এর কর্মচারী জনাব ইসহাকের সহধর্মিনী আনোয়ারা বেগম কন্যাকে স্তন্যদানকালে শাহাদাত বরণ করেন। তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আবদুল লতিফ প্রাণ দেন সেনাবাহিনীর বুলেটে; আহত হয় ১২ জন।

শোককালের কর্মসূচী

ছাত্রদের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ রবিবার (২৬-১-৬৯) হইতে তিন দিনব্যাপী শোককাল পালনের আহ্বান জানায়। সকালে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ-এর প্রোগ্রাম ঘোষণা করা হয় এবং ছাত্র সমাজ ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর আন্দোলন পরিচালনার নিমিত্ত ঘোষণা করা হয় নিম্ন নির্দেশাবলীঃ

(১) প্রত্যেক জিলা, মহকুমা, থানা, গ্রাম, মহল্লা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক এলাকায় ছাত্র সমাজের উদ্যোগে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা, শৃংখলা ও সংঘবদ্ধভাবে সংগ্রাম পরিষদগুলির মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা করা ও নিম্ন কমিটি উচ্চতর কমিটির সহিত সংযোগ রক্ষা করিয়া চলা, (২) জনগণকে সংগঠিত করা, (৩) গণ-অভ্যুত্থান গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া দেয়া, (৪) সর্বত্র সুশৃংখল সেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা, (৫) শৃংখলা রক্ষা করা, সর্বপ্রকার সরকারি উস্কানির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা, (৬) বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রের মধ্যে সৌহার্দ্য ও শান্তি বজায় রাখা এবং এইভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ায় সহায়তা করা, (৭) স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক বিজ্ঞাপন, পোস্টার, পথসভা, মাইক প্রচার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বহুল প্রচারাভিযান চালানো, (৮) কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশাবলী বিনা বাক্যব্যয়ে সর্বদাই পালন করা।

উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী দ্বারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সরকার বিরোধী গণ আন্দোলন পুরোপুরিভাবে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন আনয়ন করে। ইহা দ্বারা পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক কমিটি অব এ্যাকশন অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। তরুণের ডাক ছিল এগার দফা বাস্তবায়ন আর বয়োবৃদ্ধ নেতৃত্বের আহ্বান ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ইহাতে বয়োবৃদ্ধ নেতৃত্বের প্রতি তরুণ ছাত্র সমাজের পূর্ণ অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইহার পিছনে অপরিপক্ক তরুণ ছাত্র নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব অভিলাষ কাজ করিয়াছে। ইহার ফলে, ইতিহাসই রায় দিয়েছে, জনগণের মঙ্গল হইয়াছে, কি সর্বনাশ হয়েছে। অনুন্নত দেশগুলিতে আদর্শহীন, দুর্নীতিপরায়ণ ও গণবিরোধী নেতৃত্বে এরূপ অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। দেশপ্রেমিক, ত্যাগী ও পরিপক্ক ভারতীয় নেতৃত্ব ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা সরকার বিরোধী আন্দোলনে কীভাবে অহিংস শান্তিপূর্ণ খাতে প্রবাহিত করা গণসচেতনতা সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাহা ছাড়া ভারতের এই একই নেতৃত্ব ১৯৭৭ সালের মার্চ-এর নির্বাচনে প্রমাণ করিয়াছে, বাঞ্ছিত শান্তিপূর্ণ পথে কীভাবে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব পরিবর্তন করিতে হয়।

যাহা হউক, একদিকে পিণ্ডি, লাহোর, পেশোয়ার, হায়দরাবাদ ও করাচির বিদ্রোহানল সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে দাবানলের ন্যায় ছড়াইয়া পড়ে। গণতন্ত্রের দাবিতে একনায়কত্বের প্রতিবাদে, জুলুমের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন ক্রমশ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন মফঃস্বল শহরে ব্যাপ্তি লাভ করে। এইদিকে শোককালের কর্মসূচী পালনকালে ২৬শে জানুয়ারি (১৯৬৯) রবিবার ঢাকা, ডেমরা ও নারায়ণগঞ্জে ৪ জন নিহত হয় ও ১৬ জন আহত হয়। আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিব্রত সরকার ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও করাচিতে পুনরায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে। কিন্তু ২৭শে জানুয়ারি (সোমবার) করাচি ও লাহোর শহরে গণআন্দোলনের বৈপ্লবিক ভূমিকায় ভীত-সন্ত্রস্ত সরকার বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সেনাবাহিনী তলব করিয়া বসে।

গণবিদ্রোহের জোয়ার

করাচিতে সশস্ত্র বাহিনীর বুলেটের আঘাতে ৬ জন শাহাদাত বরণ করে। ২৭শে জানুয়ারি (১৯৬৯) জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশনে ঢাকায় সান্ধ্য আইন ও হত্যাকাণ্ডের উপরে পরিষদ সদস্য মোখলেসুজ্জামানের উত্থাপিত মুলতবী প্রস্তাব পরিষদ স্পিকার নাকচ করে দেন। এই দিন ঢাকা, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জ এবং ২৮শে জানুয়ারি (১৯৬৯) করাচি ও লাহোর পুনরায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। লাহোরে পুলিশের গাড়িতে ২ জন শাহাদাত বরণ করে এবং করাচিতে ১ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়। পেশোয়ার ও বরিশাল আন্দোলনের ঢেউ জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সংঘর্ষের রূপ পরিগ্রহ করে। আন্দোলনের চতুর্থ দিনে পেশোয়ারের জনতাকে দমন করিতে ব্যর্থ হইয়া কর্তৃপক্ষ সেখানে ২৮শে জানুয়ারি (১৯৬৯) সেনাবাহিনী তলব করে এবং বরিশালের বুকে বিপ্লবী জনতার ৯ জন পুলিশ, ই, পি, আর ও সশস্ত্র বাহিনীর বুলেটের আঘাতে আহত হয়।

২৯শে জানুয়ারি (১৯৬৯) গুজরানওয়ালা শহরে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত ও ১০ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। অবস্থা আয়ত্তে আনার প্রয়াসে কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনী তলব করে এবং সান্ধ্য আইন জারি করে। ডেরা ইসমাইল খাঁ শহরে পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে আহত হয় ৬ জন। এইদিকে পূর্ব পাকিস্তানের ঝালকাঠি বন্দর-শহরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিয়া মিছিল বাহির হয়। মিছিল ছত্রভঙ্গ করিবার চেষ্টায় পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ অতঃরপর ফাকা গুলীবর্ষণ করে। ৩০শে জানুয়ারি (১৯৬৯) ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত জাজিরা থানা সদরের পুলিশ মিছিলকারীদের উপরে গুলিবর্ষণ করে এবং সেই গুলীতে ১ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়।

ঢাকা শহরের অবস্থা উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ৩১শে জানুয়ারি (১৯৬৯) হইতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করেন। প্রচণ্ড দমননীতির মোকাবেলায় আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত হইয়া উঠিলে সমগ্র দেশে শুরু হয় গ্রেফতারের হিড়িক। ৩১শে জানুয়ারি (১৯৬৯) শুক্রবার আমাকে আমার ৭ নং কলেজ স্ট্রিট, ধানমন্ডি বাসভবন হইতে গ্রেফতার করা হয় ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধি বলে বিনাবিচারে আটক করা হয়।

করাচি, লাহোর, পি ভি, পেশোয়ার, হায়দরাবাদ, কোয়েটা, ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম অর্থাৎ এক কথায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি জনপদ যখন গণবিদ্রোহের জোয়ারে উত্তাল, প্রতিটি রাজপথ যখন লক্ষ জনতার মিছিলের পদভারে প্রকম্পিত, আত্মাধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্প জনতার সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ভিসুবিয়াসের আকস্মিক বিস্ফোরণ এক ব্যক্তির শাসন রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনীর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, গুলীগোলা ও গ্রেফতার ইত্যাদি যখন অকেজো প্রায়, অর্থাৎ আইয়ুব শাহীর মসনদ যখন টলটলায়মান সেই অবস্থায় ৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) প্রেসিডেন্ট আইউব খান রাওয়ালপিন্ডি থেকে লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণ করিয়া সাংবাদিকদের নিকট প্রকাশ করিলেন যে, বর্তমান সমস্যাবলী সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি ১৭ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের সহিত রাওয়ালপিন্ডিতে এক বৈঠকে মিলিত হবেন। সাংবাদিকদের তিনি আরো জানান যে, ইতিমধ্যে বিভিন্ন নেতাকে আমন্ত্রণ জানাবার জন্য তিনি বিরোধী দলীয় নেতা নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খানকে অনুরোধ জানিয়েছেন। নওয়াবজাদার নিকট প্রেরিত প্রেসিডেন্ট আইউবের সেই অনুরোধ পত্র ছিল নিম্নরূপ:

Nawabzada Sahib.

In the course of my broadcast on the 1st of January 1969, I said that I along with my colleagues would like to have the first opportunity to meet the representatives of the opposition parties to mutually discuss the political problems which are agitating the people’s mind & to seek their assistance in finding solutions thereto, I am therefore, requesting you convenor of Democratic Action Committee to invite on my behalf whomsoever you like to attend a conference in Rawalpindi on the 17th of February, 1969 at 10. a.m. if this is suitable & convenient to you. I am suggesting this date because before that I expect to be in East Pakistan but I shall be available to discuss any preliminaries in Dhaka should that be considered necessary by you.

I shall be very happy indeed if you & such representatives of the opposition parties as you may nominate would accept the invitation. I shall also be happy if you and your colleagues would stay in Rawalpindi as my guests during the conference.

In view of the public interest in the matter I feel that communication should be made available to the press for publication at the earliest possible opportunity.

I am sure you will have no objection to this.

With kind regards.

Yours sincerely,

Signed,

Field Marshal Mohammad Ayub Khan

নওয়াবজাদা সাহেব,

১৯৬৯ সালের ১লা জানুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আমি বলিয়াছিলাম যে, আমি ও আমার সহকর্মীবৃন্দ বিরোধী দলসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দের সহিত প্রথম সুযোগেই জনগণের মনে বিরাজমান সমস্যাবলী সম্পর্কে আলোচনাপূর্বক এইগুলি সমাধানে উপনীত হওয়ার জন্য মিলিত হইতে চাই। ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি আহ্বায়ক হিসেবে আমি আপনাকে এই মর্মে অনুরোধ জানাইতেছি যে, যদি আপনার নিকট উপযোগী বিবেচিত হয়, তাহা হইলে আগামী ১৭ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) সকাল ১০টায় রাওয়ালপিন্ডিতে এক সম্মেলনে যোগদান করার জন্য আপনার পছন্দ মাফিক ব্যক্তিবর্গকে আমার পক্ষ থেকে দাওয়াত করবেন। আমি উক্ত তারিখের কথা বলিতেছি এই কারণে যে, সম্ভবতঃ ইহার পূর্ব পর্যন্ত আমার পূর্ব পাকিস্তানে থাকার কথা। কিন্তু যদি আপনার নিকট প্রয়োজন অনুভূত হয়, তাহা হইলে আমি যে কোন প্রাথমিক আলোচনা করিবার জন্য ঢাকায় প্রস্তুত থাকিব।

যদি আপনি ও আপনার মনোনীত বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিবৃন্দ এই দাওয়াত গ্রহণ করেন, তাহা হইলে আমি অত্যন্ত সুখী হইব। আমি আরো সুখী হইব যদি আপনি ও আপনার সহকর্মীরা সম্মেলন চলাকালে আমার মেহমান হিসাবে রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থান করেন।

জনস্বার্থের খাতিরে আমি মনে করি এই পত্রখানি, যত শীঘ্র সম্ভব সংবাদপত্রে প্রেরণ করা প্রয়োজন।

আমি নিশ্চিত যে, এই প্রস্তাবে আপনার কোন আপত্তি নাই।

শ্রদ্ধান্তে

আপনার বিশ্বস্ত

স্বাঃ ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান

আলোচনার পরিবেশ

আলোচনায় অনুকূল আবহাওয়া সৃষ্টির মানসে ৬ই ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত্রি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ হইতে সৈন্য বাহিনী ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ছাত্র-পুলিশ হাংগামা রোধকল্পে লাহোর শহরে সৈন্য বাহিনী তলব করা হয়। ঢাকায় ৬ই ফেব্রুয়ারি ‘কালো দিবস’ (ব্ল্যাক ডে) পালন করা হয়। গাড়িতে, বাড়িতে, দোকানে, অফিসে, শরীরে কালো পতাকা ও কালো ব্যাজ সরকারি জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ঢাকা যেন কালো পতাকা আর কালো ব্যাজের নগরীতে পরিণত হয়। ঢাকা এবং লাহোরের ছাত্রদের বিভিন্ন দাবিতে সভা, শোভাযাত্রা নগর জীবনকে যেমনি উত্তেজনাময় করিয়া রাখে ঠিক তেমনি আবার ১৭ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক কেন্দ্র করিয়া নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী ও ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির নেতৃবৃন্দের ঢাকায় আলোচনা রাজনৈতিক মহলে স্বস্তির আবহাওয়া সৃষ্টি করে। এমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব জনিত পরিস্থিতি ৮ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) দৈনিক ইত্তেফাকের ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। রাজনৈতিক সমঝোতার পথে ইহা ছিল নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক পদক্ষেপ।

রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী গ্রেফতারের প্রতিবাদে, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করিয়া লক্ষ জনতার মিছিল প্রত্যহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার প্রদক্ষিণ করিত। এমন একটা দিন ৯ই ফেব্রুয়ারি। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত মরণজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত লক্ষ ইনসানের মিছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সদর ফটক ও বিভিন্ন পার্শ্বস্থ দেওয়াল ভাঙ্গায় উদ্যত হলে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ না করিয়া বিচক্ষণ জেলার নির্মল বাবু কম্পিত পদে ১০ নং সেলে উপস্থিত হন ও ভীত-শঙ্কিত কন্ঠে সংক্ষেপে মারাত্মক পরিস্থিতি উদ্ভবের আশঙ্কা প্রকাশ করেন এবং আমাকে জেলগেটে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করিতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। আমার সেল-মেট বন্ধুবর জনাব তাজউদ্দিন আহমদ শোনামাত্র আমাকে কালক্ষেপণ না করিয়া জেলগেটে যাইতে বাধ্য করেন। জেল গেটের লোহার শিকের অবলম্বনে কিছুদিন আরোহণ করিয়া আমি প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী অনর্গল বক্তৃতা দানের ফলে সমগ্র পরিস্থিতি আয়ত্বের মধ্যে আসে এবং কারাগার প্রাচীরের যাহারা আরোহণ করিয়াছিল তাহার নামিয়া পড়ে। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব জেলার নির্মল বাবু যদি আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা প্রার্থনা করতেন, তাহা হইলে হাজার হাজার মিছিলকারীরা রক্তে কালো পিচের রাজপথ শাব্দিক অর্থে রক্ত গঙ্গায় পরিণত হয়; জেলগেট ও জেলের দেওয়াল চুরমার হইয়া যাইত। এবং পরিণতিতে চোর-ডাকাত সবাই জেল মুক্ত হইয়া সমাজ জীবনকে বিষাক্ত করিয়া তুলিত, গোল টেবিল বৈঠকের কোন প্রশ্নই উঠিত না। নির্মল বাবুর মত এই ধরনের কর্মকর্তা বড় একটা দেখা যায় না। প্রশাসন তাহাকে যথাযথ পারিতোষিক দ্বারা যথোপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছে কিনা জানি না। হয়তো দেয় নাই। কারণ ক্ষুদ্রমনা, পরশ্রীকাতর মাথা ভারী প্রশাসনের পক্ষে না দেওয়াই স্বাভাবিক।

রাতে আমার কারামুক্তির আদেশ আসে। আমি মুক্তি আদেশ প্রত্যাখ্যান করি এবং সঙ্গে অন্য দুজন সদ্য কারামুক্তি আদেশপ্রাপ্ত জনাব সিরাজুল হোসেন খান এবং এডভোকেট মুজিবুর রহমান আমার বক্তব্যের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। আমাদের দাবি ছিল, দেশরক্ষা বিধি বলে বা নিরাপত্তা আইনে আটক সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিলেই আমরা কারামুক্তি মানিব; নতুবা নয়। আমাদের অভিনব আন্দোলন পদ্ধতিতে কারাগারের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বড় বেকায়দায় পড়েন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইতিমধ্যেই জাতীয় পরিষদের সদস্য আফাজ উদ্দিন ফকির জেলগেটে আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং স্বরাষ্ট্র সচিবের তরফ থেকে সকল রাজবন্দিদের মুক্তির নিশ্চয়তা দান করেন। পরিশেষে জেলার নির্মল বৰ কাকতি-মিনতি বন্ধুবর তাজউদ্দীন আহমদ, ওবায়দুর রহমান, ছাত্রনেতা আনিসুর রহমান ও জিয়াউদ্দীন খান আমাকে ১০ নং সেলে ডাকাইয়া নেয় এবং মুক্তিপত্র সই করিতে বলেন। তাহাদের অনুরোধে মুক্তিপত্র সই করি এবং রাত দুইটার পর আমরা কারাগার ত্যাগ করি।

১৬ই ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় দেশরক্ষা আইন তুলিয়া নেওয়ার কারণে ১৭ই ফেব্রুয়ারি দেশরক্ষা আইনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হইলেও জনাব আনিসুর রহমানকে ১৭ই ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় দেশরক্ষা আইনে আটকাদেশ হইতে মুক্তি দিয়া জেলগেটে পুনরায় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর, করাচি, পিণ্ডি ও পেশোয়ারে ছাত্র জনতার আন্দোলন সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ও নিরস্ত্র মিছিলকারীদের মধ্যে অহরহ সংঘর্ষের কারণে পরিণত হয়। রাজবন্দি জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর রীট পিটিশন শুনানীর উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট কর্তৃক বিচারপতি মুশতাক আহমেদ ও বিচারপতি মোহাম্মদ গুল দ্বারা গঠিত স্পেশাল বেঞ্চ ১০ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখের রায়ে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার অবধি লারকানায় স্বীয় বাসভবনে তাঁহাকে আটক রাখিবার নির্দেশ দান করেন। ২৪শে জানুয়ারি (১৯৬৯) ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হয়েছে তাহা ১২ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখ মুলতবি ঘোষণা করা হয়। মুলতবি দিবসে দলীয় প্রধান মওলানা ভাসানীর নির্দেশে সর্বজনাব মশিউর রহমান, আরিফ ইফতেখার (লাহোর), মুজিবুর রহমান চৌধুরী (রাজশাহী) জাতীয় পরিষদের বিদায়ী অধিবেশনে সদস্য পদ হইতে ইস্তফা দানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং সর্বজনাব এ,এইচ, এম, কামরুজ্জামান, ইউসুফ আলী, এ, বি, এম, নূরুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নিকট ইস্তফাপত্র দাখিল করেন। উদ্দেশ্য, ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি ভুক্ত অঙ্গ দলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্যগণকে একত্রে সদস্য পদ হইতে ইস্তফা দানে উদ্বুদ্ধ করা। যাহা হউক, ২৫শে মার্চ (১৯৬৯) সামরিক আইন জারি করিয়া জাতীয় পরিষদের বিলুপ্তি ঘোষণার কারণে ইস্তফাদান প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব পায় নাই।

১২ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা) ওয়ার্কিং কমিটি ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি প্রেরিত স্বীয় প্রতিনিধিবর্গ এই মর্মে নির্দেশ দেয় যে, ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি ঘোষিত ৮ দফা কর্মসূচী ৩ হইতে ৮ (অর্থাৎ ৬টি) কর্মসূচীগুলি (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার যাহার অন্তর্ভুক্ত) বাস্তবায়িত করিয়া সরকার স্বীয় আন্তরিকতা প্রমাণ করিল এই যেন ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক আহূত গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেয়, নতুবা নয়। আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিহ্বল ও দিশেহারা আইয়ুব সরকার লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল সমূহ বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবার (১৩ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি) বন্ধ ঘোষণা করে। এইদিকে বন্দি জুলফিকার আলী ভুট্টো জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের দাবিতে ১৪ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) হইতে অনশন ধর্মঘট করিবার হুমকি দেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি জনাব ভুট্টোকে বন্দিদশা হইতে মুক্তি দেয়া হয় এবং ১৭ই ফেব্রুয়ারি হইতে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

১৪ই ফেব্রুয়ারি পল্টনে সভা

ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি ৮ দফা দাবির সমর্থনে ও জুলুমের প্রতিবাদে ১৪ই ফেব্রুয়ারি সমগ্র দেশব্যাপী সাধারণ হরতালের ঘোষণা করে এবং একই দিবসে ছাত্রদের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদও ১১ দফা দাবির সমর্থনে ও জুলুমের প্রতিবাদে সাধারণ হরতাল ঘোষণা করে। সভায় সংগ্রাম পরিষদের একই হরতাল দিবসের একই কর্মসূচী ঘোষিত হয় এবং একই পল্টন ময়দানে হরতাল দিবসে উভয় গ্রুপের জনসভা আহ্বান করা হয়।

১১ দফা বনাম ৮ দফা আন্দোলনের ছদ্মাবরণে জননেতাদের প্রতি সাধারণ যুবসমাজ ও ছাত্র সমাজের অবিশ্বাস, অবজ্ঞা ও অনীহার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৪ই ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায়। অপরাহ্ন তিন ঘটিকায় বিশাল জনসমুদ্রে সভাপতিত্ব করার জন্য বৃদ্ধ নেতা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিনের নাম প্রস্তাব করিতেই সভার মঞ্চ ও সভা হইতে তরুণ শ্রেণি প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠে। কোন সুস্থ ও রাজনৈতিক বক্তব্যই শ্রবণ করিতে তরুণ সমাজ প্রস্তুত ছিল না। ধীরে ধীরে, ক্রমে ক্রমে, ধাপে ধাপে, সমগ্র আন্দোলনের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ছাত্রদের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ কবলিত হয়। উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে অঙ্গীভূত করিয়াই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা প্রণীত হয়েছিল এবং ১১ দফা দাবিকে কেন্দ্র করিয়া সমগ্র আন্দোলন ছাত্র নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। সেই সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তিও দিন দিন গগনচুম্বী হইয়া উঠিতেছে। এই ভাবেই অবশেষে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি প্রায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের দাবিতে পরিণত হয়। যাহা হউক, পল্টনের ঐ সভায় ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমদ, আওয়ামী লীগের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম, সদ্য কারামুক্ত (১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মোজাফফর আহমদ বক্তৃতা করেন। অর্থাৎ ৮ দলীয় ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির অন্য ৬ দলীয় কোন নেতাকেই সেইদিন বক্তৃতা করিতে দেওয়া হয় নাই। তবে আমার দৃঢ়মত ছাত্রনেতৃবৃন্দ ইচ্ছা করলে উক্ত সভায় ছাত্র ও জননেতৃবৃন্দের যৌথ সভায় পরিণত করিতে পারিতেন। পল্টন ময়দানে এই বিশাল বৈপ্লবিক জনসভা এর অসহিষ্ণু, ভাবাবেগ প্রসূত কার্যধারা দেশ ও দেশবাসীর কতটুকু মঙ্গল ও কল্যাণের কারণ হইয়াছে, ভবিষ্যৎ ইতিহাসে ইহার রায় দিবে। তবে এই ঘটনাপ্রবাহ আমার মত আন্দোলনমুখী মানুষকে পীড়া দিয়েছে নিঃসন্দেহে।

১৪ই ফেব্রুয়ারি সাধারণ হরতাল পালন উপলক্ষে সৃষ্ট হাংগামায় করাচিতে ২ জন ও লাহোরে ২ জন নিহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়োজনে প্রশাসন হায়দরাবাদ, করাচি ও লাহোরে সেনা বাহিনী তলব করে। ৮টি দলের সমন্বয়ে ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি সাধারণভাবে ভাসা ভাসা সমর্থনপুষ্ট ছিল কিন্তু জনসাধারণ জুলফিকার আলী ভুট্টোকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক ও গণ আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তি হিসাবে জ্ঞান করিত অর্থাৎ সরল ভাষায় একমাত্র জনপ্রিয় নেতারূপে জনাব ভুট্টো রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হন।

সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু

দেশবাসী যখন প্রাণ দিয়েছে, জখম হয়েছে, নির্বিচারে পুলিশের জুলুম মোকাবিলা করছে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি দাবি করেছে এবং দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট উত্তরণ মানসে প্রেসিডেন্ট আইউব যখন নেতৃবৃন্দের সাথে গোলটেবিল বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন ঠিক এমনি মুহূর্তে ও অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। ১৫ই ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদ্বয় ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক ও সার্জেন্ট জহুরুল হক প্রাতঃকৃত্য করিতে যাইবার পথে প্রহরারত সৈন্য প্রহরীর গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হন এবং সরকারি ঘোষণা মোতাবেক রাত ৯ টা ৫ মিনিটে সার্জেন্ট জহুরুল হক কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটালে শাহাদাত বরণ করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) ভোরবেলা সার্জেন্ট জহুরুল হকের লাশ তাহার ভাইয়ের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় লইয়া যাওয়া হয়। সহস্র সহস্র দর্শনার্থী অত্যন্ত শৃংখলার সহিত কাতারে দাঁড়াইয়া শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অপরাহ্ন ২-৩০ মিনিটে শহীদের লাশসহ শোক মিছিল শহরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণের পর পল্টন ময়দানে নামাজে জানাযা আদায় করে এবং অপরাহ্ন ৩-৩০ মিনিটে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হককে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়।

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু সংবাদে সমগ্র শহর যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। উত্তেজিত অথচ চরম মর্মাহত জনতা বিভিন্ন দিক হইতে শোক মিছিলসহ বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করিতে থাকে। এই অবস্থায় পুলিশের গুলি, লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহারের প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত জনতা বাংলা একাডেমীর পার্শ্ববর্তী গভর্নমেন্ট গেস্ট হাউস, আগা মসীহ লেনের অবস্থিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (কনভেনশন) সদর দফতর ভবন, নওয়াব হাসান আসকারী ও আইয়ুব মন্ত্রিসভার ইনফরমেশন ও ব্রডকাস্টিং মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন এর বাসভবন, ওয়ার্কার্স মন্ত্রী (প্রাদেশিক) মং শু র সরকারি বাসভবন, প্রাদেশিক মন্ত্রী সুলতান আহমদ এর সরকারি বাস ভবনে অবস্থিত মিনিয়নস কোয়ার্টার ও একটি মোটর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এবম্বিধ পরিস্থিতিতে শহরে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হয় এবং অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনিবার প্রচেষ্টায় শহরে সেনা বাহিনী তলব করা হয়। কর্তৃপক্ষ শহরে পুনরায় ১৪৪ ধারা জারি করে। অবশেষে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার জন্য সন্ধ্যা ৭টা হইতে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির অনুরোধে প্রেসিডেন্ট আইউব খান গোল টেবিল বৈঠক ১৭ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯)-এর স্থলে ১৯শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এবং গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য নিম্নলিখিতদের আমন্ত্রণ জানান :

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ), জুলফিকার আলী ভুট্টো (পিপলস পার্টি), এয়ার মার্শাল আসগর খান, লেঃ জেঃ মোহাম্মদ আজম খান, সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ (প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, ঢাকা হাইকোর্ট)। ইহা ছাড়াও ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির অংগদলগুলির পক্ষে নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে উক্ত বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয় :

মমজাত মোহাম্মদ খান দৌলতানা                      পাকিস্তান মুসলিম লীগ

খাজা খায়ের উদ্দিন                                                               পাকিস্তান মুসলিম লীগ

মুফতি মাহমুদ                                                         পাকিস্তান জমিয়াতুল উলেমায়ে ইসলাম

পীর মোহসেন উদ্দিন আহমদ দুদু মিয়া                                পাকিস্তান জমিয়াতুল উলেমায়ে ইসলাম

নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান                                  পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৮ দফা)

আবদুস সালাম খান                                                 পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৮ দফা)

চৌধুরী মোহাম্মদ আলী                                       পাকিস্তান নেজাম-ই-ইসলাম পার্টি

মৌলভী ফরিদ আহমদ                                           পাকিস্তান নেজাম-ই-ইসলাম পার্টি

আবদুল ওয়ালী খান                                                 পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

মোজাফফর আহমদ                                                              পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

নূরুল আমিন                                                            পাকিস্তান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট

হামিদুল হক চৌধুরী                                                               পাকিস্তান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট

শেখ মুজিবুর রহমান                                                               পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম                                              পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা)

মাওলানা আবুল আলা মওদুদী                                 পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী

অধ্যাপক গোলাম আযম                                        পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী

যাহা হউক, ইতিমধ্যে আন্দোলনের পরিব্যাপ্তি মফঃস্বলে ছড়াইয়া পড়ে। সর্বত্রই প্রতিহিংসার প্রতিচ্ছবি। হিংসাত্মক প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাজশাহীতেও। সোমবার দিন (১৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯) রাজশাহী মিছিলের শহরে পরিণত হয়। শোভাযাত্রা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি আইয়েন উদ্দিনের বাসভবন, পাকিস্তান কাউন্সিল লাইব্রেরি, রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ প্রিন্সিপালের ব্যক্তিগত মোটর গাড়ি ও অকট্রয় পোস্ট আক্রমণ করে ও অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার ও লাঠিচার্জের ফলে ১৩ জন আহত হয় এবং ১৮ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। চট্টগ্রাম বন্দর নগরীতেও শাসক কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বার বার অগ্নিসংযোগ করিতে প্রচেষ্টা চালায়। জেলা প্রশাসক পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখার তাগিদে ১৪৪ ধারা জারি করে ই.পি.আর বাহিনীকে তলব করেন এবং ঈদুল আজহা ও শহীদ দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার ১৮ই ফেব্রুয়ারি হইতে চট্টগ্রাম শহরের সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি ও অন্যান্য শহরে জনতার আপোষহীন সংগ্রামের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করিবার ব্যর্থ প্রয়াসে প্রশাসন কর্তপক্ষ আগ্নেয়াস্ত্রের যথেচ্ছা ব্যবহার করিয়া ২ জনকে হত্যা করেন। পরিশেষে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনিবার জন্য শহরে সেনাবাহিনীকে তলব করা হয়।

: জোহার মৃত্যু

১৭ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) পুলিশ ও মিছিলকারীদের সংঘর্ষে উদ্ভূত তিক্ত অবস্থার পুনরাবৃত্তি আশংকায় ১৮ ফেব্রুয়ারি পূর্বাহ্নে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের রিডার প্রক্টর ড শামসুজ্জোহা, কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট প্রহরা দিতে থাকেন। অপরাপর অধ্যাপক কাজলা গেটে প্রহরারত ছিলেন। উদ্দেশ্য, ছাত্রবৃন্দ যেন মিছিলসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চেষ্টা করিতে না পারে। সেনাবাহিনীর গাড়ী বা সেনা বাহিনী তলব না করিবার বিষয়ে পূর্বাহ্নেই ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত চুক্তি থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ সেনাবাহিনী পূর্ণ গাড়ি ছুটিয়া আসে এবং কোনরূপ সতর্কবাণী উচ্চারণ না করিয়াই গুলিবর্ষণ শুরু করে। দিশাহারা অবস্থায় ডঃ কসিমুদ্দিন মোল্লার সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হয় এবং ডঃ শামসুজ্জোহা বেয়নেটের আঘাতে গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নীত হইবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সরকারি প্রেসনোটের ভাষ্য অনুসারে লেফটেন্যান্টের গুলিতে ড জোহার নিহত হওয়ার কথা বলা হইয়াছিল। তাহা সত্য নয় বরং বেয়নেট চার্জের ফলে তাহাদের মৃত্যু ঘটে। এরূপ নাজুক পরিস্থিতিতে প্রশাসন কর্তৃপক্ষ যদি ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের সহিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করিতে ব্যর্থ হন, তাহা হইলে দেশ ও দশের চরম ক্ষতি হইয়া যায় এবং এই ধরনের ক্ষুদে গরম মাথাওয়ালা প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কারণেই সমগ্র সরকার জনতার ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়।

সিদ্ধান্ত ছিল, ৩ জন করিয়া মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বাহির হইবে এবং বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। গুলিবর্ষণ ও শিক্ষক হত্যার কারণে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন হয়। শুরু হয় মারমুখী জনতার মিছিল উত্তাল তরঙ্গ, লঙ্ঘিত হয় ১৪৪ ধারার সমস্ত নিষেধাজ্ঞা। প্রশাসন কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি বেগতিক দেখিয়া ১৮ই ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ন ২-৩০ মিনিটের মধ্যে রাজশাহী শহরে সান্ধ্য আইন জারি করেন। ডঃ জোহার মৃত্যুর খবরে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এক অব্যক্ত শোকের ছায়া নামিয়া আসে। নোয়াখালী ও কুষ্টিয়ায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ আয়ত্বে আনিবার প্রচেষ্টায় পুলিশ গুলি চালায়। নোয়াখালীর ৩ জন ও কুষ্টিয়ায় ১ জন নিহত হয়। কারফিউ না থাকিলে ঢাকার পরিস্থিতি সেনাবাহিনী আয়ত্বে আনতে পারি কিনা, সন্দেহ। যে অমানবিক ও বর্বরোচিত পন্থায় পাশবিক শক্তি ড জোহাকে হত্যা করিয়াছে তাহা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও বিবেকের উপরে হানিয়াছে দারুণ কশাঘাত। কোন রক্তমাংসের দেহ এই ঘটনাকে কিছুতেই বিনা প্রতিবাদে শান্তভাবে গ্রহণ করিতে পারে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ প্রায় প্রত্যেকটি জেলা শহর, মহকুমা শহর এমন কি থানা সদর পর্যন্ত বিভিন্ন পতাকাতলে ডঃ জোহার মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিবাদে মুখর হইয়া উঠে। এমতাবস্থায় বাঙ্গালির দ্বারে আঘাত হানা ত্যাগের মূর্ত প্রতীক ২১শে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস। স্বৈরাচারী শক্তির সাথে জনতার সংঘর্ষ হয় খুলনা ও পাবনা জেলাতে। রক্তরাংগা ২১শে ফেব্রুয়ারি আবার বাংগালী সন্তানের রাজ প্রার্থী হয় এবং খুলনা ও পাবনায় যথাক্রমে ৮ জন ও ২ জন শহীদের বুকের শোণিতে পুনর্বার অবগাহন করে ২১শে ফেব্রুয়ারি। এই রক্তদান বৃথা যায় নাই। এক ব্যক্তির শাসন প্রবর্তক, জনতার সার্বভৌমত্ব ছিনতাইকারী, দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন মোতাবেক দেয় ওয়াদা ভঙ্গকারী প্রেসিডেন্ট আইউব খান এই ২১শে ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী না হবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং ২২শে ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তবৃন্দ মুক্তি পান। ঢাকায় সংগ্রামী লক্ষ লক্ষ জনতা তাহাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায় অপরাহ্নে অনুষ্ঠিত পল্টন জনসভায়। লক্ষণীয় যে, শেখ মুজিবুর রহমান এই জনসভায় উপস্থিত হন নাই, অধিকন্ত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদ একক ও বিচ্ছিন্নভাবে ২৩শে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণ ২ ঘটিকায় ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে গণ-সম্বর্ধনা দানের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সদ্যমুক্ত অন্যদের সম্পর্কে কোন বক্তব্য নাই। এইভাবেই ষড়যন্ত্র মামলার সকল কৃতিত্ব ও ত্যাগ তিতিক্ষার নৈবেদ্য ও জনপ্রিয়তা সুচতুর শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মূলধনে পরিণতি হয়। মামলার প্রকৃত ত্যাগী অভিযুক্ত লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের সকল ভূমিকা একপাশে পড়িয়া রহিল- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শিরোপা এককভাবে কুক্ষিগত করলেন শেখ মুজিবুর রহমান, জন কয়েক যুব নেতার বদৌলতে তিনি ভূষিত হইলেন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। কাহার প্রাপ্য কে আত্মসাৎ করে? রাজনীতির চানক্যচাল কি ইহাকেই বলে? আসলে, লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার গোপন আন্দোলনের প্রকৃত নায়ক। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন উক্ত আন্দোলন লক্ষ্যের বন্ধু ও সমর্থক মাত্র।

গোল টেবিল বৈঠক

যাহা হউক, ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত শেখ মুজিব পূর্বাহ্নে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় ঘোষণা করিয়াছিলেন। ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির ১৬ জন প্রতিনিধি, প্রেসিডেন্ট আইউব খানের নেতৃত্বে ১৫ জন, নির্দলীয় এয়ার মার্শাল আসগর খান, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ২৬শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১০-৩০ মিনিটে রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউসে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণেকল্পে গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হন। ৪০ মিনিটব্যাপী বৈঠকের পর ঈদুল আযহা উপলক্ষে বৈঠক ১০ই মার্চ সকাল ১০ ঘটিকা পর্যন্ত মুলতবী রাখা হয়। লেঃ জেঃ আজম খান রাওয়ালপিন্ডিতে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বৈঠকে যোগ দেননি। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচির এক সভায় কিছু অসংলগ্ন উক্তি প্রসংগে প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে পদত্যাগ করিয়া জাতীয় পরিষদের স্পিকার আব্দুল জব্বার খানের নিকট দায়িত্ব বুঝাইয়া দেওয়ার আহ্বান জানান। তাহাদের প্রস্তাব মতে, জাতীয় পরিষদের স্পিকার উক্ত দায়িত্ব প্রাপ্তির পর প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন এবং নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ দেশে নতুন সংবিধান রচনা করিবে। উল্লেখ্য যে, জনাব ভুট্টো ইতিপূর্বেও বৈঠকে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে ১৮ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) করাচি প্রেসক্লাবে বক্তৃতা গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের নিমিত্ত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন এবং কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য নিজস্ব ১০ দফা দাবি ঘোষণা করিয়াছেন। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যখন ‘জ্বালাও পোড়াও’ আন্দোলনের মুখপাত্র, পিকিং-এর নির্দেশে আইউব সরকারের খুঁটি। সুতরাং গঠনমূলক কাজে সহায়তা প্রদান তাহার পক্ষে ছিল অসম্ভব। প্রকৃতপক্ষে তাহার ও তাহার দলের সরকার বিরোধী বিশেষ কোন কার্যকর ভূমিকা ছিল না, মৌখিক বুলি বা সংবাদপত্রে গা বাঁচানো বিবৃতিই ছিল তাহাদের একমাত্র অবদান।

মুলতবি গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবের ভাষণ :

১০ই মার্চ মুলতবি গোলটেবিল বৈঠকে বাংলার কণ্ঠস্বর শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ নিম্নে দেওয়া হইল।

Mr. President & Gentlemen,

The nation today is experiencing a crisis which has shaken its very foundations. For all of us who love the nation and recall the sacrifices which were made to create Pakistan, this is a time of grave anxiety. In order to resolve the crisis, it is imperative that its nature should be understood and its causes identified. Nothing would be more casstrophic than the failure to come to grips with the basic issues which underline the upheaval which has taken place in the country. These issues have been evaded for twenty one years. The moment has a arrived for us to face them squarely. I am convinced that comprehensive solution must be found for our problems, for clearly the situation is too grave for palliatives and half-measures. What is at stake is our survival.

Is is this conviction that obliges me to expound a comprehensive solution to our basic problems. If the demands that have been expressed by different sections of the people are carefully examined, it will be seen that there are three basic issues which underlie them. The first is that of deprivation of political rights and civil liberties. The second is the economic injustice suffered by vast majority of the people, comprising workers, peasants, low and middle income groups, who have had to bear the burden of the costs of development in the form of increasing inflation while the benefits of such development are increasingly concentrated in the hands of a few families, who in turn are concentrated in one region. The third is the sense of injustice felt by the people of East Pakistan, who find that under the existing constitutional arrangements their basic interests have consistently suffered in the absence of effective political power being conferred upon them. The former minority provinces of West Pakistan feel similarly aggrieved by the present constitutional arrangements.

The issue of deprivation of political rights finds expression in the 11 point programme of the Students of East Pakistan, as also in the 6-point programme of the Awami League, as a demand for the establishment of a Parliamentary Democracy, based on the principle of the supremacy of the legislature, in which there is representation of all units on the basis of population, and to which representatives are directly elected by the people on the basis of universal adult franchise.

The issue of economic injustice is reflected in the 11-point programme in the form of clearly formulated demands for re-organisation of the economic and educational system of the country. The 6-point programme of my party clearly recognises the need for radical economic reorganisation, and the demand for regional autonomy, as outlined in it, is insisted upon as an essential precondition for economic re-organisation and the implementation of effective economic programmes.

The issue of justice for the different regions and units of Pakistan is the basis of the demand for the establishment of a Federation providing for full regional autonomy, as embodied in the point programme as also in the 11 point programme, This is also the basis of the demand for dismemberment of one Unit and the establishment of a Sub-Federation in West Pakistan.

The Democratic Action Committee has held detailed deliberations regarding these grave and challenging national issues. There has always been complete unanimity in the Democratic Action Committee on the imperative necessity of effecting the following constitutional changes :

(a) The establishment of a federal parliamentary democracy.

(b) The introduction of a system of direct elections based on universal adult franchise.

A consensus has also been apparent among the members of the Committee on the following matters :

(a) The dismemberment of One Unit and the establishment of a Sub Federation in West Pakistan

(b) Full regional autonomy being granted to the regions.

The Committee further agreed that its members should be at liberty to present further proposals, which in their view were essential for achieving an effective and lasting solution of the problems that are at the root of the present crisis.

Since we are here for the very purpose of seeking to find such and effective and lasting solution. I have felt it my bounden duty to press before this Conference with all earnestness that every one sitting at this table should realise that constitutional changes to provide for representation on the basis of population in the Federal Legislature as well as for the granting of full regional autonomy, as outlined in the 6-point programme, are essential for achieving a strong, united and vigorous Pakistan.

I would like to state that the Awami League is a party of the freedom fighters for Pakistan. Its founder, Huseyn Shaheed Suhrawardy is indeed one of the founders of Pakistan. I recall with some pride that under his leadership, my colleagues and I were in the vanguard of the struggle for Pakistan. Such proposals as I am presenting before the Conference are based on the conviction that they are absolutely essential in order to preserve and indeed to strengthen Pakistan.

The demand for representation in the Federal Legislature to be on basis of population stems from the first principle of democracy, viz., “one man, one vote”. In the national forum, as envisaged in the 6-point scheme, only national issues would arise for consideration, The representatives would, therefore, be called upon to deal with matters from a national point of view and hence the voting would not be on a regional basis, Further, national political parties would be representated in the Federal Legislature, which would ensure that voting would be on a party, and not on regional basis.Indeed the experience of the lost twenty one years bears out the fact that voting in the National Assembly has invariably been on party basis. It is the principle of party in representation of each wing, which is based on the false premise that representatives in to Federal Legislature are likely to vote on a regional basis. It is thus the party principle that places and unjustified emphasis on regionalism as a factor in national politics. The entire historical experience of the last twenty one years fully bears out the facts that East Pakistan has always subordinated its regional interest to the over-riding national interest, not withstanding the fact that it had the majority of the population. It should not be necessary to recall that in the first Constituent.Assembly East Pakistan had 44 representatives as against 28 from West Pakistan; yet this majority was never used to promote any regional interest. Indeed, six West Pakistanis were elected to the Constituent Assembly from East Pakistan. Despite being a majority, East Pakistan accepted the principle of party not only in representation in the legislature but also in other organs of the State. It is painful to record that party so far as representation in the Legislature was concerned, was promptly implemented, but the benefit of party in representation in the other organs of the State, including the civil, foreign and defence services, was never extended to East Pakistan. East Pakistan had even acquiesced in the Federal Capital as well as all the Defence headquarters being located in West Pakistan. This meant that the bulk of the expenditure on defence and civil administration, amounting to about Rs. 270 crores, or over 70% of the central budget is made in West Pakistan. Should our West Pakistani brethren persist in refusing us representation on a population basis in the Federal legislature, East Pakistanis will feel constrained to insist on the shifting of the Federal Capital and the Defence headquarters to East Pakistan.

It would be a positive step toward cementing the relations between the two wings of Pakistan if our West Pakistani brethren were to affirm their confidence in their East Pakistani brethren by not opposing the demand for representation in the Federal Legislature on the basis of population. Such a step would pay rich dividend by way of building up mutual confidence and trust between the people of East and West Pakistan.

The adoption of the Federal Scheme presented in the 6-point programme is an essential pre-requisite for the achievement of a political solution for the problems of the country. I would reiterate that the spirit underlying the 6-point programme is that Pakistan should present itself to the community of the nations as one single united nation of one hundred and twenty million people. This object is served by the Federal Government being entrusted with the three subjects of Defence, Foreign Affairs and Currency. It is the same objective of having a strong and vigorous Pakistan that requires that due regard be paid to the facts of geography by granting full regional autonomy to the regions in order to enable them to have complete control in all matters relating to economic management.

I cannot too strongly emphasise the imperative necessity of removing economic injustices, if we are to put our society back on an even keel. The 11-point programme of the students for which I have expressed support contains proposals regarding the re-ordering of the economic and education system. These demands stem from the basic urge for the attainment of economic justice.

I would, however, like at this time to confine myself to outlining the constitutional changes, which are necessary for the attainment of economic justice, between man and man and between region and region.

The centralisation of economic management has steadily aggravated the existing economic injustices to the point of crisis. I need hardly dilate on the subject of the 22 families, who have already achieved considerable notoriety both at home and abroad on account of the concentration of wealth in their hands resulting from their ready access to the corridors of power.Monopolies and cartels have been created and a capitalist system has been promoted, in which the gulf between the privileged few and the suffering multitude of workers and peasants has been greatly widened. Gross injustices have also been inflicted on East Pakistan and the minority provinces of West Pakistan.

The existence of per capita income disparity between East and West Pakistan is known to all. As early as 1959-60, the Chief Economist of the Planning Commission estimated that the real per capita income disparity between East and West Pakistan was 60%. The Mid-plan Review made by the Planning Commision and other recent documents show that the disparity in real per capita income has been steadily increasing and therefore, would be much higher than 60% today. Underlying such disparity, is the disparity in general economic structure and infrastructure of the two regions, in the rates of employment, in facilities for education, and in medical and welfare services. To give just a few examples, power generating capacity in West Pakistan is 5 to 6 times higher than in East Pakistan; the number of hospital beds in 1966 in West Pakistan was estimated to be 26,200, while that in East Pakistan was estimated to be 6,900; between 1961-1966 only 18 Polytechnic Institutes were established in East Pakistan as against 48 in West Pakistan. Further, the disparity in the total availability of resources has been even higher. More than 80% of all foreign aid has been utilized in West Pakistan in addition to the net transfer of East Pakistan’s foreign exchange earnings to West Pakistan. This made it possible for West Pakistan over 20 years to import Rs. 3109 crores worth of goods against the total export earnings of Rs. 1337 crore, while during the same period East Pakistan imported Rs 1210 crore worth of goods as against its total earnings of Rs. 1650 crore. All these facts underline the gross economic injustice which has been done to East Pakistan. There has been a failure to discharge to constitutional obligation to remove disparity between the provinces in the shortest possible time. The Annual Report on disparity for the year 1968 placed before the National Assembly records that disparity has continued to increase.

The centralisation of economic management has thus failed miserably to meet the objective of attaining economic justice. It has failed to meet the constitutional obligation to remove economic disparity between region and region. Instead, therefore, of persisting in centralized economic management which has failed to deliver the goods, we should adopt a bold and imaginative solution to this challenging problem The Federal Scheme at the Six-point programme, is in my view, such a bold and imaginative solution.

It is in essence a scheme for entrusting the responsibility for economic management to the regions. The proposal is born of the conviction that this alone can effectively meet the problems, which centralised economic management has failed to overcome. This unique geography of the country, resulting in lack of labour mobility, as well as the different levels of development obtaining in the different regions, requires that economic management should not be centralised.

The specific proposal embodied in the Six-point Programme with regard to currency, foreign trade, foreign exchange earnings and taxation are all designed to give full responsibility for economic management to the regional Governments. The proposals with regard to currency are designed provent flight of capital and to secure control over monetary policy. The proposals regarding foreign trade and foreign exchange are designed to ensure that the resources of a region are available to that region and to ensure it to obtain the maximum amount of foreign exchange resources for development purposes. The proposal regarding taxation is designed to ensure control by the regional governments over fiscal policy, without in any way depriving the Federal Government of its revenue requirements.

The substance of these proposals are as follows:

(a) With regard to currency, measures should be adopted to prevent flight of capital from one region to another and to secure control over monetary policy by the regional governments. This can be done by adoption of two currencies or by having one currency with a separate Reserve Bank being set up in each region, to control monetary policy, with the State Bank retaining control over certain defined matters. Subject to the above arrangements, Currency would be a Federal subject.

(b) With regard to foreign trade and aid, the regional Governments should have power to negotiate trade and aid, within the frame work of the foreign policy of the country, which shall be the responsibility of the Federal Ministry of Foreign Affairs.

(c) The foreign exchange earnings of each region should be maintained in an account in each Regional Reserve Bank and be under the control of the regional Government; the Federal requirements from the two regional accounts on the basis of an agreed ratio.

(d) With regard to taxation, it is proposed that the power of tax levy and collection should be left to the regional Governments, but the Federal Government should be empowered to realise its revenue requirements from levies on the regional Governments. It should be clearly understood that it is not at all contemplated that the Federal Government be left at the mercy of the regional Governments for its revenue needs.

I would emphasize that there would be no difficulty in devising appropriate constitutional provisions whereby the Federal Government’s revenue requirements could be met, consistently with the objective of ensuring control over fiscal policy by the regional Governments. The scheme also envisages that there would be just representation on a population basis of persons from each part of Pakistan in all Federal services, including Defence Services.

If these principles are accepted, the detailed provisions can be worked out by a Committee consisting of experts, to be designated by both parties.

This scheme holds enormous promise of removing the canker of economic injustice from the body politic of Pakistan while at the same time removing the mistrust and frustration which centralised economic management has fostered over the years. I am confident that the people of West Pakistan would give their whole-hearted support to this scheme.

I urge the participants in this Conference to come forward with open minds and with large hearts, in spirit of fraternity and national solidarity, to adopt the Federal Scheme presented above, as the only means of overcoming what has been one of the most formidable problems conforming the country, i.e., that of the attainment of economic justice. No source had fed the current crisis more than the sense of economic injustice. Let us remove it; let us tackle problems at their source. Any attempt to avoid coming to grips with these basic problems will jeopardise our very survival.

Neither Almighty Allah nor history will forgive us if at this time of national crisis we fail to rise to the occasion to adopt bold solutions in order to restore the formidable problems which have created a national crisis. This is a great opportunity, and one which may not present itself again, to face our national problems squarely. We must, Therefore, strain every nerve to agree upon and implement the required solutions. Let us strive together to lift our beloved Pakistan out of the tragic situation in which she is placed, and to lay the constitutional foundations for a real, living, Federal Parliamentary Democracy, which will secure for the people of Pakistan full political economic and social justice. Only this can a strong and united Pakistan face the future with hope and confidence.

The 10th March, 1969.                                                                PAKISTAN ZINDABAD.

১০ই মার্চ অনুষ্ঠিত মুলতবি গোলটেবিল বৈঠকে ৮ দলীয় ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির আহ্বায়ক নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান কমিটির পক্ষ হইতে দুইটি দাবি উথাপন করেন : (১) আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ ফেডারেল পার্লামেন্ট পদ্ধতি সরকার: (২) প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে আইন পরিষদ নির্বাচন। ১০ মার্চ হইতে ১৩ মার্চ পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউসে গোল টেবিল বৈঠক চলে এবং ৪ মার্চ গোল টেবিল বৈঠকের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট আইউব খান নিম্নবর্ণিত ২ টি দাবি গ্রহণ করেন :

(১) প্রাক্ত বয়স্কদের ভোটে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন এবং (২) ফেডারেল পার্লামেন্টারি সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন।

ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির সভায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অ্যাওয়ার্ড বা রায় বিবেচনার পর কমিটির লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (৬ দফা) সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বাহ্নে ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছেন এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কো) প্রতিনিধি ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির সভায় যোগদান করেন নাই।

বৈঠকের পর

এয়ার মার্শাল আসগর খান একই দিনে ১৩ মার্চ (১৯৬৯) রাওয়ালপিন্ডিতে আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে জাস্টিস পার্টি নামে স্বীয় রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ১৩ই নভেম্বর (১৯৬৮) জুলফিকার আলী ভুট্টোর গ্রেফতারের পর গণআন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকল্পে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান ১৭ই নভেম্বর (১৯৬৮) হইতে রাজনীতিতে অবতরণ করেন। আগেই উল্লেখ করিয়াছি যে, ৭ই নভেম্বর (১৯৬৮) রাওয়ালপিণ্ডিতে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে ছাত্রদের মৃত্যুতে পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধিয়া উঠে; এবং ইহারই ক্রমব্যাপ্তি সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানকে গ্রাস করে।

শেখ মুজিবুর রহমান রাওয়ালপিণ্ডি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ গ্রহণের পর ১৪ মার্চ ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। জনতা তাহাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দান করে। বিমানবন্দরে তিনি ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ সমর্থন করিলে প্রেসিডেন্ট আইউব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ব পাকিস্তানের দাবি মানতে বাধ্য হইতেন। শেখ সাহেব আরো মন্তব্য করেন যে, সর্ব জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, ফরিদ আহমদ ও আবদুস সালাম খান অদ্যবধি বিগত ২২ বৎসর যাবৎ একই খেলায় মাতিয়া আছেন। অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্রিয়াকলাপের প্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করা বিধেয় বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন। ১১ দফা আন্দোলন পরিচালনাকারী সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন করে এবং তাহাদেরই প্রত্যক্ষ প্রয়াসের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতার মর্যাদা পান। প্রসঙ্গে ইহাও অনস্বীকার্য যে, ঘটনার আবর্তনে সমগ্র বাংগালী জনতা শেখ সাহেবকে বিনা প্রশ্নে নেতা রূপে বরণ করিয়াছিল। অতএব ব্যক্তি-আক্রোশ মিটাইবার মতলব বিমান বন্দরে লক্ষ জনতার সামনে উপরোক্ত নেতাদের নাম প্রকাশ তাহার আদৌ নেতাসুলভ কাজ হয় নাই। ইহা প্রকারান্তরে উপরোক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে জনতাকে উস্কাইয়া দেওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিমান বন্দরের বক্তৃতার ফলে গভর্নর পদ হইতে মোনায়েম খানের অপসারণ ঘটে। বোধহয় এ কারণে প্রেসিডেন্ট আইউব খান প্রফেসর নূরুল হুদাকে ২১শে মার্চ গভর্নর পদে নিয়োগ করেন এবং জনাব হুদা ২৩শে মার্চ (১৯৬৯) তারিখে গভর্নর হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ১৫ই মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান জেনারেল মুসার স্থলে জনাব ইউসুফ হারুনকে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর পদে নিযুক্ত করিয়াছেন।

বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ইতিমধ্যে দেশের এবং সমাজ জীবনের সর্বত্র জ্বালাও, পোড়াও, ঘেরাও আন্দোলন শুরু হইয়া গিয়াছিল এবং হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ধর্মঘট পর্যবসিত হয়েছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রশাসনের আইন-শৃঙ্খলা বলিয়া কিছু ছিল না; এমন কি দেশে কোন সরকার আছে বলিয়া মনে হইত না। বস্তুতঃ সেই সময়ে এই ভাবে ক্রমে ক্রমে উচ্ছৃংখলতা সমাজ জীবনের একমাত্র নিয়ামক শক্তি হইয়া পড়ে; জীবন মূল্যবোধ দ্রুত ধ্বংসের সম্মুখীন হয়; শান্তিপূর্ণ নাগরিক জীবনযাপন প্রচেষ্টা পরিণত হয় বাতুলতায়। সেক্রেটারিয়েটে হরতাল, শ্রমিকদের হরতাল, সরকারি বিভিন্ন বিভাগে হরতাল, শিক্ষক-ছাত্র হরতাল, শিল্প কারখানায় হরতাল, ট্রেনে, বাসে বিনা টিকিটে ভ্রমণ, আবার অসহিষ্ণু, দাঙ্গা-হাঙ্গামা পারদর্শী রাজনৈতিক কর্মী কর্তৃক বিপক্ষীয় দলীয় নেতা ও কর্মীদের উপর নগ্ন হামলা- ইত্যাদি অবাধে চলিতে থাকে। ১৬ মার্চ পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত শাহীওয়াল রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষারত তেজগাঁম ট্রেনে ভ্রমণকালে মওলানা ভাসানীর উপর হামলা চালান হয়। ২৩শে মার্চ (১৯৬৯) ভোরবেলা ঢাকার লালমাটিয়া নিজ বাড়ির নিকট হইতে আওয়ামী লীগ কর্মীবৃন্দ কর্তৃক স্ত্রী, কন্যার চোখের সামনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতা মাহমুদ আলীকে জোরপূর্বক অপহরণ করিয়া ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ১৯ নং সড়কে অবস্থিত এক স্টুডিওতে আটক করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু বলিবে না, তাহাকে দিয়া এক অঙ্গীকারপত্র বলপূর্বক সহি করানো হয়। এসব ঘটনায় আমার মতো আন্দোলনমুখী মানুষেরও স্নায়ুমণ্ডলী ভীষণভাবে পীড়িত হয়ে থাকে। বস্তুতঃ যে রাজনীতিবিদ তথা রাজনৈতিক দল পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কখনো তাহাদের লক্ষ্য হইতে পারে না; ক্ষমতাই হয় তাহাদের একমাত্র সর্বোচ্চ লক্ষ্য। তাহাদের নিকট দেশ ও জাতি গৌণ, ক্ষমতাই মুখ্য। ক্ষমতার জন্যই তাহাদের আদর্শের বুলি; নীতি ও আদর্শের জন্য ক্ষমতা নয়।

আইউবের পদত্যাগ

এমনি উচ্ছৃঙ্খল সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ সভ্য জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে ওঠায় জেনারেল আইয়ুব খান দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি করার মনস্থ করেন। কিন্তু তদানীন্তন সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খান তাহাকে স্পষ্ট ভাষায় জানান যে, সামরিক শাসন জারি করিতে হইলে, তাহা করিবে সেনাবাহিনী। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এই বক্তব্যের প্রচ্ছন্ন ইংগিত কি, তা আইয়ুব বুঝিতে পারিলেন। তাই জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা লিঙ্গা মিটাইবার প্রয়োজনে ক্ষমতা হস্তান্তরের অপরিহার্যতা প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খান ২৪শে মার্চ (১৯৬৯) তারিখে নিম্নলিখিত পত্রে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করার অনুরোধ জানান :

President’s House,

Rawalpindi, 24th March, 1969

My dear General Yahya,

It is with profound regret that I have come to the conclusion that all civil administration & constitutional authority in the country have become ineffective. If the situation continues to deteriorate at the present alarming rate all economy, life, indeed the civilised existence will become impossible.

I am left with no option but to step aside & leave it to the Defence Forces of Pakistan which today represent the only effective & legal instrument to take full control of the affairs of this country. They are by the grace of God in a position to retrieve the situation and to save the country from utter chaos and total destruction. They alone can restore sanity and put the country back on the road to progress in a civil and constitutional manner.

Restoration and maintenance of full democracy according to the fundamental principles of our faith and the needs of our people must remain our ultimate goal. In that lies the salvation of our people who are blessed with the highest qualities of dedication and vision and who are destined to play a glorious role in the world.

It is most tragic that while we were well on our way to happy and prosperous future, we plunged into an abyss of senseless agitation.Whatever name may have been used to glorify it, the time will show that this turmoil was deliberately created by well tutored and well backed elements. They made it impossible for the government to maintain any semblance of law and order or to protect the civil liberties, life & property of the people.

Every single instrument of administration and every medium of expression of saner public opinion was subjected to inhuman pressure. Dedicated but defenceless government functionaries were subjected to ruthless public criticism blackmail. The result is that social & ethical norms have been destroyed & instruments of Govt. have become inoperative & ineffective.

The economic life of the country has all but collapsed. Workers and labourers are being incited and urged to commit acts of lawlessness and brutality. While demands of higher wages, & amenities are being extracted under threat of violence, production is going down. There has been serious fall in exports and I am afraid the country may soon find itself in the grip of serious inflation.

All this is the result of the reckless conduct of those who acting under the cover of a mass movement struck blow at the very roots of the country during the last few months. The pity is that a large number of innocent but gullible people become victims of their evil design.

I have served my people to the best of my ability under all circumstances. Mistakes there must have been but what has been achieved and accomplished is not negligible. There are some who would like to undo all that I have done and even that which was done by the government before me. But the most tragic & heartrending thought is that there are elements at work which would like to undo even what the Quaid-E-Azam had done namely the creation of Pakistan. I have exhausted all possible civil and constitutional means to resolve the present crisis. I offered to meet all those regarded as the leaders of the people. Many of them came to a conference recently but only after I had fulfilled all their preconditions. Some declined to come for reasons best known to them. I asked these people to evolve an agreed formula. They failed to do so inspite of days of deliberations. They finally agreed on two points and I accepted both of them. I then offered that the unagreed issues should be referred to the representatives of the people after they had been elected on the basis of direct adult franchise. My argument was that the delegates in the conference who had not been elected by the people could not arrogate to themselves the authority to decide all civil and constitutional issues including those on which even they are not agreeing among themselves.

I thought I would call the National Assembly to consider the two agreed points but it soon became obvious that this would be an exercise in futility. The members of the Assembly are no longer free agents & there is no likelihood of the agreed two points faithfully adopted. Indeed members are being threatened & compelled either to boycott the session or to move such amendments as would liquidate the central government, make the maintenance of the Armed Forces impossible, divide the economy of the country and break up Pakistan into little bits and pieces. Calling the Assembly in such chaotic conditions can only aggravate the situation. How can any one deliberate coolly and dispassionately on fundamental problems under threat of instant violence?

It is your legal and constitutional responsibility to defend the country not only against external aggression but also to save it from internal disorder and chaos. The nation expects you to discharge this responsibility to preserve the security and integrity of the country and to restore normal social, economic and administrative life. Let peace and happiness be brought back to this anguished land of 120 million people. I believe you have the capacity, patriotism, dedication and imagination to deal with the formidable problems facing the country. You are the leader of a force which enjoys the respect and admiration of the whole world. Your colleagues in the Pakistan Air Force and in the Pakistan Navy–many are men of honour and know that you will always have their full support together the Armed Forces of Pakistan must save Pakistan from disintegration.

I should be grateful if you would convey to every soldier, sailor & airman that I shall always be proud of having been associated with them as their supreme Commander.

They must know in this grave hour, they have to act as the custodians of Pakistan. Their conduct and actions must be inspired by the principles of Islam and by the conviction that they are serving the interests of their people.

It has been a great honour to have served the valiant and inspired people of Pakistan for so long a period. May God guide them to move towards greater prosperity and glory.

I must also record my great appreciation of your unswerving loyalty. I know that patriotism has been a constant source of inspiration for you all your life. I pray for your success and for the welfare and happiness of my people. Khuda Hafiz

Yours sincerly

Sd/- M. A. Khan

General A. M. Yahya Khan

H. Pk. H G. C-in-C Army

General Head Quarters

(অনুবাদ)

প্রেসিডেন্ট ভবন

রাওয়ালপিন্ডি

২৪শে মার্চ, ১৯৬৯

প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া,

গভীর বেদনার সাথে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, দেশে সমস্ত বেসামরিক প্রশাসন ও শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব কার্যকারিতা হারাইয়া ফেলিয়াছে। যদি বর্তমানের আশংকাজনক গতিতে অবস্থার অবনতি ঘটিতে থাকে তাহা হইলে সভ্যভাবে জীবন ধারণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে।

ক্ষমতা ত্যাগ করিয়া দেশরক্ষা বাহিনীর কাছে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করা ছাড়া আমার কোন বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্য দেশরক্ষা বাহিনীই একমাত্র কার্যকর ও আইনানুগ প্রতিষ্ঠান। খোদা চাহেত অবস্থার পরিবর্তন সাধনপূর্বক পরিপূর্ণ বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের হাত হইতে দেশকে রক্ষা করিবার ক্ষমতা তাহাদের রহিয়াছে। একমাত্র তাহারাই দেশে সুস্থতা ফিরাইয়া আনিতে পারে এবং বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশকে অগ্রগতির পথে ফিরাইয়া নিতে পারে।

আমাদের বিশ্বাসের মৌলিক নীতিমালা এবং আমাদের জনগণের প্রয়োজন মোতাবেক পূর্ণ গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইহা বজায় রাখাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ইহার মধ্যেই আমাদের জনগণের মুক্তি নিহিত। আত্মোৎসর্গের শ্রেষ্ঠতম গুণাবলীসমৃদ্ধ আমাদের জনগণের পৃথিবীতে একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রহিয়াছে।

ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যখন আমরা সুখী ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হইতেছিলাম তখনই আমরা কান্ডজ্ঞানহীন বিক্ষোভের শিকারে পরিণত হই। ইহাকে গৌরবান্বিত করিবার জন্য যে নামই ব্যবহার করা হইয়া থাকুক না কেন, সময়ে প্রমাণিত হইবে যে, এই বিক্ষোভ ইচ্ছাকৃতভাবে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সৃষ্ট হইয়াছে যাহাদিগকে বিপুলভাবে প্রণোদিত করা হইয়াছে এবং মদদ যোগান হইয়াছে। আইন ও শৃঙ্খলার ন্যূনতম চিহ্ন বজায় রাখা কিংবা নাগরিক স্বাধীনতা এবং জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ তাহারা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে। প্রশাসনের প্রতিটি অঙ্গ এবং সুস্থ জনমত প্রকাশের প্রতিটি মাধ্যমের উপর অমানবিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। ত্যাগী মনোভাবাপন্ন অথচ নিরাপত্তাহীন সরকারি প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জনগণের ক্রুর সমালোচনা অথবা ব্ল্যাকমেইলের শিকারে পরিণত হয়। ফলে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলি বিনষ্ট হইয়া পড়ে এবং সরকারি যন্ত্র কার্যকারিতা হারাইয়া ফেলে। দেশের অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়া গিয়াছে। আইন-বহির্ভূত এবং নৃশংস কাজ করিবার জন্য কর্মচারী ও শ্রমিকদিগকে উত্তেজিত করা হইতেছে। একদিকে সন্ত্রাসের হুমকির মুখে অধিক পারিশ্রমিক, বেতন ও সুযোগ সুবিধা আদায় করা হইতেছে অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাস পাইতেছে। রফতানী ক্ষেত্রে মারাত্মক অবনতি ঘটিয়াছে এবং আমার আশংকা অতিসত্ত্বরই দেশ মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির কবলে নিপতিত হইবে।

এইসব হইতেছে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নৈরাজ্যমূলক আচরণের ফল যাহারা গত কয়েক মাস ধরিয়া গণআন্দোলনের নামে দেশের ভিত্তিমূলে একটির পর একটি আঘাত হানিতেছে। দুঃখের বিষয়, বিপুল সংখ্যক নির্দোষ লোক এই অসৎ পরিকল্পনার শিকারে পরিণত হইয়াছে।

সকল অবস্থার মধ্যে আমি আমার ক্ষমতা অনুযায়ী দেশবাসীর খেদমত করিয়াছি। অবশ্য যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রহিয়াছে কিন্তু যাহা অর্জন করা হইয়াছে তাহাও নগণ্য নয়। এমন অনেকে আছেন যাহারা আমি যাহা করিয়াছি এমনকি পূর্বতন সরকার যাহা করিয়াছে তাহাকে ব্যর্থ করিয়া দিতে চাহিবে। কিন্তু সবচাইতে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক চিন্তা হইল যে, এমন অনেকে এখন ক্রিয়াশীল রহিয়াছে যাহারা কায়েদে আযমের অবদান অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টিকেও ব্যর্থ করিয়া দিতে চাহিবে।

বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য আমি সকল বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পন্থা প্রয়োগ করিয়াছি। যাহারা জনগণের নেতা হিসাবে পরিচিত তাঁহাদের সহিত মিলিত হইবার প্রস্তাব দিয়াছি। সম্প্রতি তাঁহাদের অনেকে একটি কনফারেন্সে যোগ দিয়াছিলেন তখনই যখন আমি তাহাদের সকল পূর্বশর্ত পূরণ করিয়াছিলাম। কয়েকজন উক্ত কনফারেন্সে যোগ দিতে অস্বীকার করিয়াছেন; এই অস্বীকৃতির কারণ তাহাদেরই ভাল জানা। একটি সর্বস্বীকৃত ফর্মূলা উদ্ভাবন করিবার জন্য আমি তাহাদিগকে বলিয়াছিলাম। কয়েকদিনের আলোচনা সত্ত্বেও তাঁহারা উহা করিতে পারেন নাই। শেষ পর্যন্ত তাঁহারা দুইটি বিষয়ে একমত হইয়াছিলেন এবং আমি ঐ দুইটি বিষয়ই গ্রহণ করিয়াছিলাম। তারপরে আমি প্রস্তাব দিয়াছিলাম, যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য হয় নাই সেইগুলি প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে যখন জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হইয়া আসিবেন তখন তাহাদের বিবেচনার জন্য পেশ করা হইবে। আমার যুক্তি ছিল- এই কনফারেন্সে উপস্থিত প্রতিনিধিবৃন্দ যাহারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন নাই তাঁহারা সকল বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক বিষয় ও নিজেদের মধ্যে যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই সেইগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দাবি করিতে পারেন না।

যে দুইটি বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেইগুলি বিবেচনার জন্য জাতীয় পরিষদ আহ্বান করিবার কথা আমি চিন্তা করিয়াছিলাম কিন্তু ইহা স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে, ইহা নিরর্থক প্রচেষ্টা। পরিষদের সদস্যরা আর স্বাধীন প্রতিনিধি নন এবং যে দুইটি বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেইগুলি বিশ্বস্ততার সহিত গৃহীত হয় এমন কোন সম্ভাবনা নাই। প্রকৃতপক্ষে পরিষদ সদস্যদেরকে এই মর্মে হুমকি প্রদানেও বাধ্য করা হইতেছে যাহাতে তাহারা হয় অধিবেশন বয়কট করেন অথবা এমন সংশোধনী প্রস্তাব আনয়ন করেন যাহাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিলুপ্ত হইয়া যায়, সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হইয়া পড়ে, দেশের অর্থনীতি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ে এবং পাকিস্তান ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হইয়া পড়ে। এমন একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিষদ আহ্বান করিবার অর্থই হইতেছে পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করিয়া তোলা।

শুধু বিদেশী আগ্রাসনই নয় বরং আভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করিবার আইনগত ও শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব আপনার। জাতি আশা করে, দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা বজায় রাখা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপনি এই দায়িত্ব পালন করিবেন। ১২ কোটি মানুষের এই বিক্ষুব্ধ দেশে শান্তি ও সুখ ফিরিয়া আসুক। আমি বিশ্বাস করি, দেশের বর্তমান কঠিন সমস্যা মোকাবেলা করিবার মতো ক্ষমতা, দেশপ্রেম, ত্যাগী মনোভাব ও প্রজ্ঞা আপনার রহিয়াছে। আপনি এমন এক বাহিনীর নেতা যার সমগ্র বিশ্বে সম্মান রহিয়াছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর আপনার সহকর্মীদের অনেকেই সম্মানিত ব্যক্তি এবং আমি জানি, আপনি সর্ব সময়েই তাঁহাদের সমর্থন পাইবেন। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই বিচ্ছিন্নতার হাত হইতে পাকিস্তানকে রক্ষা করিতে হইবে।

প্রতিটি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকের নিকট আপনি এই কথা পৌঁছাইয়া দিবেন যে, তাহাদের সুপ্রীম কমান্ডার হিসাবে তাহাদের সহিত সম্পর্কিত হওয়াতে আমি গর্বিত: সেই জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব।

তাহাদের জানা উচিত, বর্তমান সংকটাপন্ন মুহূর্তে তাহাদিগকে পাকিস্তানের রক্ষক হিসাবে কাজ করিতে হইবে। তাহাদের আচরণ ও কাজ ইসলামের নীতিমালা ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার মনোবৃত্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত হইতে হইবে। দীর্ঘকাল ধরিয়া পাকিস্তানের সাহসী ও অনুপ্রাণিত জনগণের খেদমত করিতে পারিয়া আমি পরম সম্মানিত বোধ করিতেছি। আল্লাহ তাহাদিগকে অধিকতর অগ্রগতি ও গৌরবের পথে পরিচালিত করুন।

আপনার দ্বিধাহীন আনুগত্যের কথাও আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করিতেছি। আমি জানি, আপনার সমগ্র জীবনে দেশপ্রেমই হইতেছে সর্বময় প্রেরণার উৎস। আমি আপনার সাফল্য এবং আমার দেশবাসীর কল্যাণ ও সুখের জন্য দোয়া করি। খোদা হাফেজ।

আপনার বিশ্বস্ত

স্বা/- এম, এ খান

ইয়াহিয়ার আগমন

ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পত্র প্রাপ্তির পর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ (১৯৬৯) সন্ধ্যা ৭-১৫ মিনিটে সমগ্র দেশে সামরিক আইন জারি করেন; সংবিধান বাতিল করেন, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন, গভর্নর ও মন্ত্রীদের স্ব-স্ব পদ হইতে অপসারণ করেন এবং সমগ্র দেশকে দুইটি সামরিক আইন অঞ্চলে বিভক্ত করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানকে মার্শাল ল’ জোন এ’ ও পূর্ব পাকিস্তানকে মার্শাল ল’ জোন ‘বি করা হয়। লেঃ জেঃ আতিকুর রহমান ও মেজর জেনারেল মোজাফফর উদ্দিনকে যথাক্রমে জোন ‘এ’ ও জোন বি-এর সামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।

জেনারেল ইয়াহিয়া ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে, দেশবাসীকে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেন।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, ফিল্ড মার্শাল আইউব খান ইস্তফা দিলেন কেন এবং সাংবিধানিক পথে বেসামরিক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরিত করিলেন না কেন? আমার স্পষ্ট মত, প্রেসিডেন্ট আইউব খানের ক্ষমতার মূল উৎস (পাওয়ার বেস) ছিল সেনাবাহিনীর ছাউনী, জনতা নয়। অতএব উচ্চাভিলাষী সামরিক জেনারেলরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের নিকট হস্তান্তরের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ক্ষমতা পিপাসু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীদের প্রচন্ড চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে ক্ষমতা ত্যাগ করিতে হয়; এবং সামরিক জান্তার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হয়। আমার আরও অভিমত, আইউবের ক্ষমতা হস্তান্তরের পশ্চাতে নিম্নলিখিত কার্যকারণসমূহ সক্রিয় ছিল। যথা

(১) জাতীয়, আন্তর্জাতিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী বশংবদ, (২) ক্ষমতা বিলাসী সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারী, (৩) বিদেশী অর্থপুষ্ট ক্ষমতাপিপাসু রাজনীতিবিদ, (৪) পরস্পর বিবাদমান ক্ষমতা পিপাসু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং (৫) দিল্লী চক্রের বশংবদ ও অখণ্ড ভারত সমর্থকবৃন্দের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ। উহারাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভুত্বব্যঞ্জক আইয়ুব সরকারের জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশবাসীর পুঞ্জীভূত রোষের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিয়া সমগ্র দেশে অরাজকতার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। প্রেসিডেন্ট আইউব খান ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্রতী না হইয়া যদি জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ ও সরকার গঠনে প্রয়াসী হইতেন, তাহা হইলে ঘটনাপ্রবাহ নিঃসন্দেহে ভিন্ন হইতে পারিত। অন্ততঃ লেলিহান অগ্নিশিখা দেশ ও জাতিকে নিক্ষেপ করিয়া অকস্মাৎ তাহাকে বিদায় নিতে হইত না, যেই লেলিহান শিখায় পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল, সেই লেলিহান শিখায় দেশ ও জাতিকে তেমনি মর্মান্তিক পরিণতির সম্মুখীন হইতে হইত না।

৩১শে মার্চ প্রক্লামেশন (ঘোষণা) অনুযায়ী প্রধান সামরিক আইন শাসনকর্তা জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা ৭-১৫ মিঃ হইতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। যতটুকু মনে পড়ে, জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৬৮ সালে ব্যাংক সাংবাদিকের প্রশ্নোত্তরে এক অসতর্ক মুহূর্তে নিজেকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন এবং ঘটনাপ্রবাহে এইভাবেই তিনি সেই বহু আকাঙ্খিত পদে আসীন হন। এই সময়ে পরিবর্তিত নূতন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা একটি নূতন রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। গণতন্ত্র হইল এই নূতন রাজনৈতিক দলটির জীবন দর্শন বা কর্মপদ্ধতি। স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং ডান, বাম ও ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে সচেতন এইরূপ রাজনীতিকদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০শে জুলাই (১৯৬৯) ইডেন হোটেলে। জনাব খয়রাত হোসেনের সভাপতিত্বে এই সম্মেলনেই আমরা ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগ গঠন করি।

২৮শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান কতিপয় সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন যথা- (১) পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ বিলুপ্তি এবং তদস্থলে সাবেক বিলুপ্ত প্রদেশগুলি পুনর্বহাল, (২) এক ব্যক্তি এক ভোট ভিত্তিতে জনসংখ্যানুপাতে নির্বাচন অর্থাৎ সংখ্যাসাম্যনীতির বিলুপ্তি, (৩) ফেডারেল পার্লামেন্টারি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা, (৪) নূতন নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা ও সংবিধান রচনার পর গণপরিষদের জাতীয় সংসদে রূপান্তর, (৫) ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারি হইতে প্রকাশ্য রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, (৬) সংবিধান রচনা অবধি সামরিক আইন বলবৎ এবং (৭) ৫ই অক্টোবর (১৯৭০) জাতীয় পরিষদের নির্বাচন।

লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক

২৮শে মার্চ (১৯৭০) ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত অপর এক ভাষণে ২২শে অক্টোবরের মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তাহার এই বেতার ভাষণ মোতাবেক ৩০শে মার্চ (১৯৭০) আইনগত কাঠামো আদেশ (LEGAL FRAMEWORK ORDER) প্রকাশিত হয়।

আইনগত কাঠামো আদেশে জাতীয় পরিষদ সদস্য সংখ্যা জনসংখ্যাভিত্তিক নিম্নলিখিতভাবে নির্ধারিত হয় :

পূর্ব পাকিস্তানসাধারণ আসন ১৬২মহিলা আসন ৭
পাঞ্জাবসাধারণ আসন ৮২মহিলা আসন ৩
সিন্ধুসাধারণ আসন ২৭মহিলা আসন ১
বেলুচিস্তানসাধারণ আসন 8মহিলা আসন ১
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসাধারণ আসন ১৮মহিলা আসন ১
কেন্দ্রীয় শাসিত উপজাতীয় এলাকাসাধারণ আসন ৭মহিলা আসন ০
সর্বমোট ৩০০ ১৩
প্রাদেশিক পরিষদ
পূর্ব পাকিস্তানসাধারণ আসন ৩০০মহিলা আসন ১০
পাঞ্জাবসাধারণ আসন ১৮০মহিলা আসন ৬
সিন্ধুসাধারণ আসন ৬০মহিলা আসন ২
বেলুচিস্তানসাধারণ আসন ২০মহিলা আসন ১
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসাধারণ আসন ৪০মহিলা আসন ২

মহিলা সদস্যগণ স্ব-স্ব প্রদেশ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যবৃন্দ দ্বারা, এবং প্রাদেশিক পরিষদে সংরক্ষিত মহিলা আসন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।

নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনায় ব্যর্থ হইলে অথবা জাতীয় পরিষদ কর্তৃক রচিত সংবিধান প্রেসিডেন্টের অথেনটিকেশন (Authentication) না পেলে জাতীয় পরিষদ অবলুপ্ত বিবেচিত হইবে, তবে ১০০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করিতে সমর্থ হইলে এবং প্রেসিডেন্টের অথেনটিকেশন পাইলে জাতীয় পরিষদ পূর্ণ মেয়াদের জন্য কাজ করিবে।

আজগর খানের সহিত আলোচনা

জাস্টিস পার্টি গঠন করিবার পর এয়ার মার্শাল আসগর খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন এবং বিভিন্ন নেতার সহিত আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। জনাব আতাউর রহমান খানের সহিতও তাহার সামগ্রিক রাজনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক আলোচনা হয়। সন্তোষজনক প্রাথমিক আলোচনার পর এয়ার মার্শাল আসগর খান আমাদিগকে লাহোর সফরে আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণ মোতাবেক রাজনৈতিক আলোচনার উদ্দেশ্যে জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব নূরুর রহমান ও আমি ৯ই মে লাহোর গমন করি। আমরা লাহোরে জনাব মনজার বশীর সাহেবের আতিথ্য গ্রহণ করি। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও অন্যান্য ভারত বিখ্যাত নেতৃবৃন্দও অতীতে ঐ বাড়িতেই আতিথ্য গ্রহণ করিতেন।

১০ই মে জাস্টিস পার্টি নেতৃবৃন্দের সহিত দীর্ঘ বৈঠকের প্রস্তুতি হিসাবে আমাদের চিন্তার সহিত পরিচয় করাইবার প্রয়াসে ৯ই মে দিবাগত রাত্রে এয়ার মার্শাল আসগর খান ও তাঁহার সহকর্মী বন্ধুবর্গের অবগতির জন্য আমাদের তৈরি খসড়া “OUR APPROACH TO PAKISTAN’S POLITICAL PROBLEMS” a তাহাদের হাতে দেই। ১০ই মের বৈঠকে ‘দুই অর্থনীতির রাষ্ট্র’ (TWO ECONOMY STATE CONCEPT) সংক্রান্ত ধারণা ও সমাজতন্ত্র (SOCIALISM) তাঁহারা গ্রহণ করিতে মোটেই সম্মত হন নাই। দীর্ঘ আলোচনায় আমার ধারণা হইয়াছে, লাহোরের রাজনৈতিক আকাশ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডত্ব ও সংহতির প্রশ্নে অত্যন্ত মেঘাচ্ছন্ন।

লাহোরের আলোচনা অসমাপ্ত রহিল। ১১ই মে লাহোর হইতে আমরা পেশোয়ার গমন করি। পেশোয়ারে জনাব আতাউর রহমান খান ও এয়ার মার্শাল আসগর খানের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয়। বৈঠকে জনাব নূরুল আমিন ও অন্যান্যের সহিত রাজনৈতিক একাত্মতা গড়িয়া তুলিবার জন্য এয়ার মার্শাল প্রস্তাব দেন।

পেশোয়ারে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সর্দার আবদুর রশিদ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নেতা খান আবদুল ওয়ালী খানের সহিতও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মত-বিনিময় হয়।

পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিওলজীর প্রফেসর ড আহমদ হাসান দানী আমাদের সহিত আলোচনাকালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান ও বিচ্ছিন্নতা বনাম রাষ্ট্রীয় সংহতির আলোকপাত করিতে গিয়া মন্তব্য করেন যে, ইতিহাসের গতিতে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত দুটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হইবে।

সীমান্ত নেতা খান আবদুল ওয়ালী খানের সহিত বৈঠকেও ইহার একটি চমৎকার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাই যে, যেমন পাঞ্জাব কুচক্রী মহলের স্বার্থে একদিন চারটি প্রদেশের বিলুপ্তি ঘটাইয়া এক ইউনিট অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ গঠন করা হইয়াছিল, ঠিক তেমনি কোন কোন স্বার্থান্বেষী মহল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করিবার প্রয়াসে দলিল তৈরি করিতেছে। ১৩ই মে পেশোয়ার থেকে রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছি। রাওয়ালপিন্ডিতে নওয়া-ই-ওয়াকত সম্পাদক হামিদ আখতারের সহিত মতবিনিময় হয়। জাস্টিস পার্টি সদস্য অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার রাজা সকল রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার ইন্তেজাম করেন। তিনি বড় অতিথিপরায়ণ, বয়স ষাট, কিন্তু অত্যন্ত কর্মঠ।

১৪ই মে, সন্ধ্যা ৭-৩০ মিঃ পুনরায় লাহোরের এবং ১৫ মে লাহোর হইতে বিমানে করাচি পৌঁছি। ১৫ই হইতে ২০শে মে অবধি আমরা করাচি অবস্থান করি এবং করাচিতে আমরা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তনয়া মিসেস আখতার সোলায়মান; পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতা হাসান এ শেখ, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক আমজাদ আলী শাহ, জিয়ে-সিন্দ’ আন্দোলনের নেতা ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান জিএম সৈয়দ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহিত মত-বিনিময় করি। ১৭ই মে আমরা সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী হায়দরাবাদ সফরে যাই এবং জনাব কেবি জাফরের আতিথ্য গ্রহণ করি।

২০শে মে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহিত জনাব আতাউর রহমান খান ও আমার তিন ঘন্টাব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়। দুই অর্থনীতি, সমাজতন্ত্র, দেশ রক্ষানীতি, এক ইউনিট বাতিল ও করাচি ফেডারেল এলাকা ঘোষণা প্রশ্নে আমাদের মধ্যে মোটামুটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

আলোচনা প্রসঙ্গে জনাব ভুট্টো হইতে আমরা অবহিত হই যে, ১৯৬৯ সালের ১০ই মার্চ পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সহিত তাহার নিম্নোক্ত ত্রি-বিষয়ে সমঝোতা হইয়াছে :

১) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বীকৃত দাবির ভিত্তিতে জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা;

২) পাকিস্তানের আদর্শের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া সমাজতন্ত্র কায়েম এবং

৩) সর্বপ্রকার বিদেশী স্বার্থ বিলুপ্তি, সর্বপ্রকার উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদের বিরোধিতা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা, কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা ও সকল সামরিক চুক্তি থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার।

 আলোচনায় ইহাও জানিতে পারি যে, মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক কার্যকলাপের সহিত একমত হইতে না পারায় জনাব ভুট্টো উপরে বর্ণিত সমঝোতা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানীর সহিত দূরত্ব বজায় রাখিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন।

করাচিতে প্রবাসী বাঙ্গালিদের সহিত আলোচনার জন্য আমি করাচির ড্রিগ রোডে গমন করি। বাঙ্গালি প্রবাসীদের ধারণায় শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলনে আমাদের শরীক হওয়া উচিত, ইহার অন্যথা করিবার অর্থ বাঙ্গালি স্বার্থে আঘাত হানা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কুচক্রী শাসক-শোষকের হাত প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জোরদার করা।

পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানবাসীর একটি মাত্র প্রশ্ন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি বজায় থাকিবে কি থাকিবে না। অখণ্ডত্ব ও সংহতি বজায় রাখিবার খাতিরে তাহারা প্রচলিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী; অর্থাৎ শোষণ-শাসনের যন্ত্র অবিকল থাকিবে। অন্য কথায় সমগ্র দেশের অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারীদের যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হইয়াছে, সেই বাস্তব সত্যকে অম্লান বদনে স্বীকৃতি দিয়া সমস্যা-সংকট নিরসনের জন্য কুসংস্কার বর্জিত বদ্ধমূল ধারণামুক্ত জ্ঞানালোকসম্পন্ন উচ্চ চিন্তা প্রণোদিত প্রজ্ঞা প্রদর্শনে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা পুরাপুরিভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। ইহাই আমার তিক্ত ও দৃঢ় মত। বস্তুতঃ একই ভিটায় সমঝোতার সহিত দুই ভাইয়ের সহঅবস্থানের উচ্চ মন ও হৃদয় পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ছিল না।

পশ্চিম পাকিস্তানে সমগ্র সফরই জাস্টিস পার্টির নেতৃবৃন্দ ও কর্মীবৃন্দের সতর্ক ও আন্তরিক তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। করাচি জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান মিসেস সাদী জমিরের আন্তরিকতা, অতিথিপরায়ণতা ও সেবা আমাদিগকে অত্যন্ত মুগ্ধ করে। করাচিতে যেমনি দলীয় মহলে তেমনি করাচিবাসীর মধ্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।

এরপর এয়ার মার্শাল আসগর খানের নেতৃত্বে জাস্টিস পার্টির একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আগমন করেন। হোটেল শাহবাগে অবস্থান করেন, প্রাথমিক আলোচনার জন্য জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জনাব নূরুর রহমান, ইকবাল আনসারী খান, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, আনিসুর রহমান ও আমি হোটেল শাহবাগে উক্ত প্রতিনিধি দলের সহিত বৈঠকে বসি। তাহাদের সম্মানে ১৬ জুন হোটেল পূর্বাণীতে জনাব আতাউর রহমান খান এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। দুই নেতা এয়ার মার্শাল আসগর খান ও আতাউর রহমান খান আমাদিগকে অর্থাৎ সর্বজনাব মোখলেছুজ্জামান খান, নূরুর রহমান ও আমি (পূর্ব পাকিস্তান) এবং আবু সৈয়দ আনোয়ার ও মঞ্জুর বশীর (পশ্চিম পাকিস্তান)কে আলোচনার জন্য মনোনীত করেন। তদানুযায়ী আমরা ২০শে জুন জনাব মোখলেছুজ্জামান খানের বাসভবনে মিলিত হই এবং জনাব আতাউর রহমান খানের সাত দফা ও “our approach to Pakistan’s political problems”- লিখিত বক্তব্য পুংখানুপুংখরূপে আলোচনা করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয় নাই। পক্ষান্তরে আসগর খানের সাথে পি.ডি.এম নেতৃবৃন্দের মতৈক্য প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তারা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠিত হয়। অবশ্য রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ আসগর খান কনভেনশনের অব্যবহিত পরে নব গঠিত পি.ডি.পি থেকে পদত্যাগ করেন এবং এককভাবে পাকিস্তান তাহরিক এ-ইসতেকলাল পার্টি গঠন করেন।

দুঃখজনক হলেও ইহা স্বীকার করিতে হয় যে, ভারত থেকে আগত অবাঙ্গালি মোহাজের শ্রেণি স্থানীয় বাসিন্দাদের সহিত একাত্ম হইতে পারে নাই। ফলে স্থানীয়দের সহিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাহাদের তিক্ততা এত বৃদ্ধি পায় যে, অবশেষে ঢাকায় বাংলা ভাষাভাষী ও উর্দু ভাষাভাষীদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধে। রক্তাক্ত দাঙ্গা বন্ধ করিবার মানসে আমরা, তাজউদ্দিন আহমদ (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ), খন্দকার মোশতাক আহমদ (সহ- সভাপতি, ঐ), মোজাফফর আহমদ (সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি), সৈয়দ আলতাফ হোসেন (সাধারণ সম্পাদক, ঐ), পীর হাবিবুর রহমান (ঐ, ন্যাপ), নূরুর রহমান (ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগ) ও আমি (ঐ), জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে ৩রা নভেম্বর এক সভায় মিলিত হই। সভা হইতে আমরা গভর্নমেন্ট হাউসে গমন করি এবং প্রাদেশিক গভর্নর রিয়ার এডমিরাল আহসানকে শান্তি বজায় রাখিবার জন্য প্রাশসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে অনুরোধ জানাই।

উল্লেখ্য যে, এই বাঙ্গালি অবাঙ্গালি দাঙ্গার পিছনে ইন্ধন যুগিয়েছে সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করিয়া আওয়ামী লীগের একটি অতি উৎসাহী অবিবেচক অংশের রাজনীতি। তখনকার দিনে একমাত্র আওয়ামী লীগই বাঙ্গালি জনতার ব্যাপক আস্থাভাজন ছিল এবং আওয়ামী লীগের পিছনে বাঙ্গালি জনতার সার্বজনীন সমর্থনের মূলে ছিল এই অবাঙ্গালি বিদ্বেষ ও তদসম্পর্কে সর্বগ্রাসী প্রচারণা।

ইয়াহিয়া-মুজিব আঁতাত

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আঁতাতের ফলে ৩০শে মার্চ ঘোষিত আইনগত কাঠামো আদেশের বিরুদ্ধে কোন প্রকার সক্রিয় আন্দোলন সম্ভব হয় নাই। পক্ষান্তরে এই আঁতাতের দরুন সরকারও ৬ দফাভিত্তিক নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন না করিয়া স্বীয় ঘোষিত আইনগত কাঠামো আদেশের পরিপন্থী কাজ করিতে দ্বিধা করেন নাই। বস্তুতঃ এই ব্যাপারে সরকার স্পষ্টতঃ দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন। হয়তো এইভাবেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান উক্ত ছককাটা রাজপথে শেখ সাহেবের সহিত ক্ষমতা ভাগাভাগি করিবার ও ভোগ করিবারই চিন্তা করিয়াছিলেন। কেননা ইহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগের ৬ দফা’ ও আইনগত কাঠামো আদেশ ছিল পরস্পর পরিপন্থী।

ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগ

ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগ নূতন সংগঠন। সর্বস্তরে পরিচিত নয় বিধায় এই সংগঠনের মাধ্যমে একক আন্দোলন করা সম্ভব ছিল না। তাই আমি পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মওলানা ভাসানীর সহিত ২০শে এপ্রিল (১৯৭০) ঢাকায় সাক্ষাৎ করি। আলোচনার পর তিনি কয়েকদিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাইবার অভিমত প্রকাশ করেন; কিন্তু সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাইবার প্রয়োজন বাকী জীবনে বোধ করেন নাই। আমাদের অনেক নেতারই মুখ ও পেটের মধ্যে এই ধরনের গরমিল বলিয়াই কি দেশ কি জাতি পুনঃপুনঃ জুলুমের শিকার হইয়াছে; এবং দেশ ও জাতির অমানিশা বা দুঃখ রজনী কখনও কাটে নাই! এই সময়ে খুলনার খালিশপুর শিল্প এলাকার শ্রমিকদের জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা জনাব আশরাফ হোসেন ও জনাব আবদুল বাতেনকে গ্রেফতার করিয়া খুলনা জেলা কারাগারে আটক করিলে মজদুর ফেডারেশনের খুলনা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে হাজার হাজার শ্রমিক খুলনা জেলা কারাগার ঘেরাও করে। ঘেরাও ২৩ ঘন্টা অতিক্রম করিবার পর পরিস্থিতি হঠাৎ মোড় নেয় এবং ৩১শে মে ভোর রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শ্রমিকদের মধ্যে অপ্রীতিকর সংঘর্ষ হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক আহত হয়। উদ্ভুত তিক্ত পরিস্থিতি সরেজমিনে তদন্তের জন্য আমি খুলনা গমন করি। যাহা হউক, আমার উপস্থিতি শান্তরূপ ধারণে সহায়ক হয়। বেসামরিক জেলা কর্তৃপক্ষ অনেকটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করিলেও সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ব্রিগেডিয়ার সাহেব জানান যে, একমাত্র সামরিক আইন প্রশাসকই সামরিক বিধি মামলা প্রত্যাহার করিতে পারেন। শ্রমিক এলাকায় শান্ত আবহাওয়া সৃষ্টির প্রয়াসেই আমরা সামরিক, বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করিয়া নিউজপ্রিন্ট পেপার মিলস যথারীতি চালু করিতে অনুরোধ করি।

সামরিক শাসনের আওতায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পটভূমিকায় ১ ও ২রা আগস্ট (১৯৭০) ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগের জাতীয় মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন দলীয় ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র অনুমোদন করে। ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগের নাম পরিবর্তন করিয়া ন্যাশনাল লীগ রাখা হয়। জনাব আতাউর রহমান খান ও শাহ আজিজুর রহমান যথাক্রমে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং জনাব আতাউর রহমান ও আমি যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হই। কিন্তু ২রা আগস্ট বৈকালিক সমাপ্তি অধিবেশনে জনাব আতাউর রহমান খান কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই দলীয় কর্মকর্তাদের নাম প্রস্তাব করিলে সাধারণ কাউন্সিল অধিবেশনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। প্রস্তাব সমর্থনের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করিয়াই জনাব আতাউর রহমান খান তাঁহার গঠিত কর্মকর্তা তালিকা গৃহীত ঘোষণা করিয়া মঞ্চ হইতে অবতরণ করেন ও প্রস্থান করেন। একটু ধৈর্য, একটু সহনশীলতা, একটু নমনীয়তা, একটু বিচক্ষণতা ও একটু প্রজ্ঞা প্রদর্শন করিলেই সমস্যার মীমাংসা তৎক্ষণাৎ হইয়া যাইত। উত্তরকালে সংগঠনটি ছিন্নভিন্ন হইত না, দ্বিধাবিভক্ত হইত না, সংগঠনে তিক্ততা ও কোন্দল দেখা দিত না এবং দেশ অতি প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্ন রাজনীতির নেতৃত্ব পাইতে পারিত। নেতারা তাহা করিবেন কেন? সবাই আপন আপন স্তরে এক একজন ক্ষুদে হিটলার যে! আমরা বাঙ্গালি, পরশ্রীকাতরতা আমাদের বাঙ্গালি চরিত্রের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ, আমরা সর্বদাই ব্যক্তি নেতৃত্ব, ব্যক্তি প্রাধান্য ও ব্যক্তি পূজার আকাঙ্খী, তাই ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কোন্দলই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই নীতি ও আদর্শপ্রসূত কার্যক্রমের অবস্থান বহু ক্রোশ দূরে। নীতি-আদর্শের পার্থক্য মত ও পার্থক্য সৃষ্টি করে এবং ইহাই স্বাভাবিক। কেতাবে, বাক্যে, বুলিতে আমাদের মুখে নীতি আদর্শের খই ফোটে; কিন্তু ব্যক্তি জীবনে যেমন, গোষ্ঠী জীবনেও তেমনি ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ একমাত্র লক্ষ্য হইয়া থাকে। ইহা দুঃখজনক কিন্তু নির্মম সত্য।

বাংলা মজদুর ফেডারেশনের ভূমিকা

১৯৬৪ সালে জনাব এ. আর. সুন্যামত ও দেওয়ান সিরাজুল হককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, জনাব আশরাফ হোসেন, রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও এজাজ আহম্মদকে সহ-সম্পাদক এবং আনিসুর রহমানকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন ইস্ট জোন গঠন করা হয়। এই সংগঠনটি প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই সংগঠনের নেতা জনাব আশরাফ হোসেন ও আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে। খুলনায়, আবদুল বাতেন-এর নেতৃত্বে মোংলা পোর্টে, আমিনুর রহমান (মল্লিক), গোলাম মোস্তফা (বাটুল), রেজাউল হক সরকার (রানার) নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গে, জনাব রুহুল আমিন ভূঁইয়া, আনসার হোসেন (ভানু) নেতৃত্বে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে, আঃ জলিলের নেতৃত্বে ডেমরা শিল্পাঞ্চলে, দেওয়ান সিরাজুল হক, ফজলুর রহমান খ, মোঃ সেলিম হোসেন, আলী আকবর, আজিজুল হক মুক্তর নেতৃত্বে সড়ক পরিবহন শিল্পে গভর্নর মোনায়েম খানের বাড়ি ঘেরাওসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় নেতৃবৃন্দের মুক্তি আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ৭ই জুনের আন্দোলন, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন, জঙ্গী রূপ ধারণ করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে এই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ত্যাগ অপরিসীম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রশ্নে জাতীয় লীগ দ্বিধা-বিভক্ত হলে এই সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের আগ্রহে কুমিল্লা টাউন হলে জাতীয় লীগের সম্মেলনে বাংলা জাতীয় লীগ নামকরণ করা হয়। বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলা মজদুর ফেডারেশন ও ফরোয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক সমন্বয়ে বাংলা মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করে। মুক্তি ফ্রন্টের অনেক ইপিআরটিসির অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর লোকেরা অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সরকারের আহ্বানে সামরিক বাহিনীতে পুনরায় যোগদান করে। ২৫শে মার্চের রাত্রে ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্র সংগ্রহ করিতে গিয়ে ১৮ জন জোয়ান প্রাণ হারায়। কুমিল্লা মুক্তি ফ্রন্টের কর্মী শিব নারায়ণ দাসের তৈরি পতাকা ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম কুমিল্লা ইপিআরটিসির ডিপোর সামনে আবদুস সালাম, আবদুর রশিদ, আলী আজগর ও শিবনারায়ণ দাসের নেতৃত্বে উত্তোলন করে। যাহা পরবর্তীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকার পল্টন ময়দানে আ স.ম. আবদুর রব-এর নেতৃত্বে উত্তোলিত হয়। কুমিল্লা মুক্তি ফ্রন্টের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া ডিগ্রি কলেজের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন হাবিলদার জনাব আবদুস সালামের নেতৃত্বে ইউটিসির রাইফেল দ্বারা মুক্তি পাগল ছাত্র শ্রমিক যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যার ফলে ২৫শে মার্চ কাল রাত্রে ঢাকার সাথে একই সঙ্গে কুমিল্লা ইপিআরটিসি বর্তমান বিআরটিসি ডিপোতে ভিক্টোরিয়া কলেজ ডিগ্রি হোস্টেল, মজদুর ফেডারেশন আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আবদুর রশিদ এর বাসায় পাক বাহিনী হামলা করে।

এই আবদুস সালাম-এর নেতৃত্বে পলায়নরত কুমিল্লার রাজনৈতিক ছাত্র-শ্রমিক ও জনগণের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের বক্স নগর ক্যাম্পের কার্যক্রম শুরু হয়। এর প্রাথমিক অর্থ যোগান দিয়াছিল কুমিল্লা ইপিআরটিসি’র শ্রমিকরা এবং ইপিআরটিসির ডিপোতে রক্ষিত শ্রমিকদের সব পোষাক ক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেই পোষাকের অনুকরণে পরবর্তীতে মুক্তি যোদ্ধাদের জলপাই রং এর পোষাক তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটে প্রথম বাধা দিয়াছিল খুলনার মজদুর ফেডারেশনের নেতা আশরাফ হোসেনসহ মুক্তি যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ও মেজর জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে যাহা দেশবাসীর স্মরণ থাকা দরকার।

দেশ স্বাধীন হবার পর অবাঙ্গালিদের বাড়ি, গাড়ি ও কল-কারখানা দখলের হিড়িক পরে যায়। অন্যদিকে মজদুর ফেডারেশনের উদ্যোগে প্রথম শহীদ স্মরণী ট্রাস্ট গঠন করা হয়। যাহাতে মজদুর ফেডারেশনের নেতৃত্বে শ্রমিক সংগঠনগুলি অবাঙ্গালিদের সম্পদ এনে জড় করে। পরবর্তীতে সরকার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে বলেছিল, যে অবাঙ্গালিদের সকল সম্পদ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে আনা হইবে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় শহীদ স্মরণী ট্রাস্টের সম্পদ মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্টে নেওয়া হলেও আওয়ামী নেতাদের দখলকৃত সম্পদ ব্যক্তি নামেই রয়ে গেল।

অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর বুক ভরা আশা নিয়ে জাতি যাহাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়াছিল। তাহাদের প্রণীত সংবিধানে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করণ, লাল বাহিনী গঠন, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণসহ বাকশাল গঠনের প্রতিবাদ করেছিল মজদুর ফেডারেশন, যার ফলে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের সন্ত্রাসীরা ফেডারেশনের ১০৮ বিসিসি রোডের অফিস জোরপূর্বক দখল করে দেওয়ান সিরাজুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। রাষ্ট্রপতির ৯ নং আদেশ বলে প্রায় ২ শতাধিক ইপিআরটিসির শ্রমিক-কর্মচারীকে চাকুরী চ্যুত করে। ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে শতাধিক চটকল শ্রমিক ইউনিয়ন ধর্মঘট করে। উক্ত ধর্মঘটের সমর্থনে বাংলা মজদুর ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, জাতীয় শ্রমিক জোট ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মজদুর ফেডারেশন নেতা দেওয়ান সিরাজুল হকের গ্রেফতারের সংবাদে নেতৃবৃন্দগণ সভায় উপস্থিত না হয়ে বাকশালে যোগদানের প্রতিযোগিতায় নেমে পরে। দেওয়ান সিরাজুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দরা ‘৭৫-এর শেষ ভাগে মুক্তি লাভ করে।

নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়

যাহা হউক, আগস্ট মাসে বন্যা দেখা দেওয়ায় নির্বাচন তারিখ পিছাইয়া দেওয়া হয়। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন তারিখ ৫ই ও ২২শে অক্টোবরের স্থলে যথাক্রমে ৭ই ডিসেম্বর ও ১৭ ডিসেম্বর পুনঃনির্ধারিত হয়। আমরা সর্বপ্রকার তিক্ততা ভুলিয়া গিয়া সংগঠন ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হই। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিবাত্যা ও জলোচ্ছ্বাস হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা ইত্যাদি সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ২০ লক্ষ অধিবাসীর প্রাণহানি ঘটে এবং অজস্র গবাদি পশু, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, জমি-জিরাতের হানি হয়। ইতিপূর্বে ১৮৭৬-এর নভেম্বর মাসের মহাবিধ্বংসী ঘূর্ণিবাত্যা ও জলোচ্ছাসে সমুদ্র উপকূলবর্তী ২ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটিয়াছিল। মহাচীন প্রজাতন্ত্র সফরান্তে রাওয়ালপিন্ডির পথে ঢাকা আগমন করিলেও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাত্যাবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন হইতে বিরত থাকেন। এবং গভর্নর এস.এম আহসানকে কতিপয় উপদেশ দিয়া রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে ঢাকা ত্যাগ করেন। ইহাতে বাঙ্গালি মন আরও তিক্ত ও বিষাক্ত হইয়া পড়ে। আওয়ামী লীগ সুচতুরভাবে ইহাকেই নির্বাচনী প্রচারণায় অত্যন্ত দক্ষতা ও কার্যকারিতার সহিত ব্যবহার করে। উল্লেখ্য যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দলই সমন্বরে নির্বাচন পিছাইবার আওয়াজ তুলিয়াছিল। কারণ, অবশ্যই বাত্যাবিধ্বস্ত হতভাগ্য মানব সন্তানদের প্রতি দরদ ছিল না। নির্বাচনী হালে পানি পাওয়ার ব্যাপারটাই ছিল প্রকৃত কিন্তু অব্যক্ত কারণ। প্রতিকূল আবহাওয়ায় ভীত সন্ত্রস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ২৩শে নভেম্বর ঢাকায় পল্টন ময়দানে আহূত জনসভায় মওলানা ভাসানী স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ প্রকাশ্যে উত্থাপন করেন। বলাই বাহুল্য যে, ১৯৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক আহূত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গোল টেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার পর পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির হৃদয়ে শেখ মুজিবের সার্বজনীন শ্রদ্ধা, আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন এবং একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দরুন অনেকটা বেকায়দায় পতিত হইয়া ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা হাসিলের উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানী আকষ্মিকভাবে এই স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তানের দাবি তুলিয়াছিলেন অথচ এই মওলানা ভাসানী ১৯৬২ সালের কারামুক্তির পর এক ব্যক্তির শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করিয়া পাক-চীন সম্পর্কোন্নয়নের একদিক ঘেষা অন্ধ চিন্তায় প্রেসিডেন্ট আইউব খান সরকারের পিছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন যোগাইয়া গিয়াছেন। আইয়ুবের পতনের পর ইহা তাহার নয়া মূর্তি! এদিকে তিনি ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে খুলনায় অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন না পেছালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। ১২ নভেম্বর (১৯৭০) উপকূল এলাকায় ও দ্বীপাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার অজুহাতে নির্বাচন বানচাল বা স্থগিত রাখিবার উদ্দেশ্যে যাহারা সোচ্চার ছিলেন সেইসব নেতা যথা পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের ডেপুটি লীডার শাহ আজিজুর রহমান, পূর্ব পাক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-এর সভাপতি পীর মোহসীন উদ্দিন আহমদ, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রাক্তন সদস্য এ.এস.এম সোলায়মান, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৬২-৬৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের ডেপুটি লীডার মশিউর রহমান ও আরো অনেকে সাধারণ ভোট দাতাদের নিকট যথার্থই হালে পানি পাচ্ছেন না। তাহারা ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নামে ভিরমি খাইতেন। মওলানাকে কেন্দ্র করিয়া তাঁহারাই হঠাৎ বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হইলেন। তাহার মওলানা ভাসানীর স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান দাবি ছত্রছায়ায় সন্তা বাজীমাত করিবার উন্মাদনায় মওলানা ভাসানী কর্তৃক আহূত ২৩শে নভেম্বর (১৯৭০), ৪ঠা ডিসেম্বর (১৯৭০) ও ১০ জানুয়ারি পল্টন জনসভায় ও ৯ই জানুয়ারি (১৯৭১) সন্তোষ জাতীয় সম্মেলনের আসর জমাইয়াছিলেন। যখন মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়, তখন পূর্ব পাক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সাধারণ সম্পাদক জনাব মশিউর রহমান ভারত ভূমি গমন করিয়াছিলেন বটে তবে মুক্তিযুদ্ধ যখন মধ্যগগনে, বাঙ্গালিরা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন মরণপণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত, জনাব মশিউর রহমান মুক্তিযুদ্ধকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করার মানসে ভারত ভূমি হইতে চলিয়া আসে ও আগস্ট মাসে (১৯৭১) পাক হানাদার বাহিনীর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করে ও রংপুর ডিগ্রি কাউন্সিল সভায় পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে রাজনৈতিক সমাধানের আওয়াজ তুলেন। পরবর্তীকালে ৪ঠা সেপ্টেম্বর (১৯৭১) ঢাকায় শান্তিনগর বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক সমঝোতার পক্ষে ওকালতি করে পাক হানাদার বাহিনীর মনোরঞ্জনে প্রয়াসী হয় আর জনাব শাহ আজিজুর রহমান জাতিসংঘে পাক সরকার ডেলিগেশনে ডেপুটি লীডার নিযুক্ত হয়ে পাক-রাষ্ট্রীয় অখণ্ডত্ব বজায় রাখিবার পক্ষে ও বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখেন; ইহাই হইল নেতৃচরিত্র। স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করিবার লক্ষ্যে সকাল-বিকাল মত পরিবর্তন করে জাতি, রাষ্ট্র, জনগণ, আদর্শনীতি তাহাদের চিন্তা-চেতনায় কত গৌণ। ঘূর্ণিবাত্যা বিধ্বস্ত এলাকা সফরের পর শেখ মুজিব ২৬শে নভেম্বর ঢাকায় প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “আমি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানাইয়াছি, স্বাধীনতার নয়।” এইদিকে নির্বাচন বয়কটের প্রশ্নে দ্বিমত সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমি সভাপতি আতাউর রহমান খানের তাগিদে ৪ঠা ডিসেম্বর (১৯৭০) পল্টন জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম।

পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খান ২৮শে নভেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইতে স্বীয় নাম প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং ২৯শে নভেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি ন্যাশনাল লীগ মনোনীত প্রার্থীদিগকেও জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করিতে অনুরোধ জানান। আমার নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সরাইল-নাছিরনগর হইতে ২৯শে নভেম্বর ঢাকায় পৌঁছিয়া ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় দলীয় সভাপতি আতাউর রহমান খানের এই বিবৃতি পাঠে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। তৎক্ষণাৎ তাহার ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে দেখা করিয়া আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া প্রকাশকালে তাঁহাকে বলি যে, তাহার ঘোষিত সিদ্ধান্ত সংগঠনের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী, অনিয়মতান্ত্রিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। প্রথমতঃ সংগঠনের পার্লামেন্টারি বোর্ড, ওয়ার্কিং কমিটির সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ব্যতীত নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকিবার অধিকার সংগঠনের সভাপতির একার নাই; দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ মাত্র সাতদিন বাকী। সুতরাং মনোনীত প্রার্থীদের মতামত গ্রহণ ব্যতীত এইরূপ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ অন্যায়। তৃতীয়তঃ আমি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। আমার সহিত আলোচনা করা অপরিহার্য ছিল। আমি তাহাকে ইহাও বলি যে, এ ধরনের ব্যক্তি-রাজনীতির অভিশাপ সমগ্র সংগঠনকে পোহাইতে হইবে। ব্যক্তি পূজার রাজনীতি আমরা করিব না এবং একার সিদ্ধান্তই পার্টির সিদ্ধান্ত হইতে পারে না। যদিও আজ দলীয় ঐক্যের খাতিরে আমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইতে আমার নাম প্রত্যাহার করিতেছি, তবে ভবিষ্যতে সাংগঠনিক ফোরামে ব্যক্তি-প্রধান রাজনীতির সুরাহা করিতে সচেষ্ট থাকিব।

সবাই জানেন, গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলীয় ভূমিকা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন। আতাউর রহমান খানের বিবৃতিতে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন বর্জনের আহ্বান ছিল না। তাই ন্যাশনাল লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যে আর কালবিলম্ব না করিয়া আমি ঢাকা ত্যাগ করি। পরিতাপের বিষয়, সংগঠনের সভাপতি আতাউর রহমান খান ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের ১৬ই ডিসেম্বরের সংখ্যায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে, প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কোন ন্যাশনাল লীগ মনোনীত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। বলা অনাবশ্যক যে, পূর্বের মতো এই ঘোষণাও ছিল সাংগঠনিক গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ইহা ছিল বস্তুত সংগঠনকে দ্বিখন্ডিত করিবার এক প্রকাশ্য উস্কানী।

বাংলা জাতীয় লীগ

নীতিজ্ঞান বর্জিত নেতৃত্বের খপ্পর থেকে সংগঠনকে মুক্ত করার তাগিদে ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি কুমিল্লায় বাংলা ন্যাশনাল লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করি। অধিবেশন বঙ্গবাসীদের নব জাগ্রত জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ স্বাগত জানায় ও জনমানুষের নবচেতনার প্রতিধ্বনি করিয়া দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে :

“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে

  কে বাঁচিতে চায়”

এই দেশে জাতীয়তাবাদের চেতনার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিতে থাকে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর হইতেই। এবং এই জাতীয়তাবাদী চেতনার রেশ ধরিয়া পাক ভারত সশস্ত্র সংঘাত, আশীর্বাদপুষ্ট বরপুত্রদ্বয় জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলে একচ্ছত্র জনপ্রিয় ব্যক্তিসত্ত্বারূপে আবির্ভূত হন। আগেই বলিয়াছি, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি ও তাসখন্দ শান্তিচুক্তি বিরোধী প্রচণ্ড গণ-অসন্তোষই পশ্চিম পাকিস্তানে জনাব ভুট্টোর একক ব্যক্তি জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি ছিল এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালে যথোপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অবর্তমানে ও অভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায়ত্ব জনিত ক্ষোভ ও লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক স্বাধিকারের ক্রমবর্ধমান অপ্রতিরোধ্য গণদাবি নিরবচ্ছিন্ন সরব কণ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তার দৃশ্যমান কারণ ছিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ আসনে যথাক্রমে শেখ মুজিব পরিচালিত আওয়ামী লীগ ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পরিচালিত পিপলস পার্টির একচেটিয়া বিজয় ছিল উপরোক্ত বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থা ফলশ্রুতি। লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ মনোনীত কোন প্রার্থী পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পিপলস পার্টি মনোনীত কোন প্রার্থী পূর্ব পাকিস্তানের কি জাতীয় পরিষদে কি প্রাদেশিক পরিষদের কোন আসনে জয়লাভ করিতে সমর্থ হয় নাই। অর্থাৎ কোন দলই জাতীয় বা নিখিল পাকিস্তান পার্টির মর্যাদা অর্জন করিতে পারে নাই। ইহার দরুনই ক্ষমতালোভী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মুখ হইতে এই মন্তব্য উচ্চারিত হইতে পারিয়াছে যে, পূর্ব- পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক এবং কেন্দ্র সরকার গঠনের ফর্মুলা বাহির করা হউক।

আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি আসন লাভ করে। অপর দুইটি আসনে নির্বাচিত হন পি.ডি.পি প্রধান জনাব নূরুল আমিন এবং রাজা ত্রিবিদ রায়। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ ২৬৬টি আসন লাভ করে। অপর ১২টি আসনে পি ডি পি-২ নেজামে ইসলাম-১, জামায়াতে ইসলামী-১, ন্যাপ (মস্কো)-১, স্বতন্ত্র ৭টি আসনে জয়লাভ করে।

আওয়ামী লীগ ৩রা জানুয়ারি (১৯৭১) বিজয় দিবস ঘোষণা করে। বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকা রেসকোর্সে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যবৃন্দের ৬ দফা বাস্তবায়নের প্রকাশ্য শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগের সেই শপথনামা নিম্নে প্রদত্ত হইল :

In the name of Allah the merciful and Almighty. In the name of the brave martyrs and fighters who heralded our initial victory by laying down their lives and undergoing the utmost hardship and repression, in the name of the peasants workers, students, toiling masses and the people of all classes of this country, we the newly elected members of the National and Provincial assemblies do hereby take oath that we shall devote all our energy to honour the overwhelming support and instinted confidence the people of this country have reposed in the programme and the leadership of Awami League in the National General election.

That we shall remain wholeheartedly faithful to the people’s mandate on the Six point and Eleven point Programmes and that we shall strive to the best of our ability to reflect both in the constitution and in day-to-day practice the principles of autonomy based on the Six point Formula & Eleven point Programme.

That we shall remain absolutely loyal to the aims, objects and programmes of the Awami League and that we undertake to eliminate permanently extreme political, economic and social differences that exist between region & region and between man and man and struggle relentlessly to lay the foundation of a society free from exploitation so that injustices yield place to justice and fairplay.

That we shall build up a massive resistance movement against any quarter or evil force that may try to thwart our line of action behind which the people have their support & we shall remain ever prepared for an uncompromising struggle for the establishment of rights of the common man.

May Allah help us in our endeavour.

Joy Bangla-Joy Pakistan.

নিম্ন উক্ত শপথনামার বঙ্গানুবাদ দেয়া হইল :

করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার নামে, বীর শহীদান ও যোদ্ধাদের নামে যাহারা স্বীয় জীবন বিসর্জন করিয়া ও অশেষ দুঃখ ও নির্যাতন স্বীকার করিয়া আমাদের প্রাথমিক বিজয় নিশ্চিত করিয়াছে, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-মেহনতি জনতা ও এই দেশের সকল শ্রেণির মানুষের নামে আমরা নব-নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা এতদ্বারা শপথ গ্রহণ করিতেছি যে, জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও কর্মসূচীর প্রতি যে ব্যাপক সমর্থন ও অবিচল আস্থা জ্ঞাপন করিয়াছেন তাহার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আমাদের সকল শক্তি নিয়োজিত করিব।

 আমরা সর্বোতভাবে ৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচীর প্রতি, জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি বিশ্বস্ত থাকিব এবং উভয় কর্মসূচীকে শাসনতন্ত্রে প্রতিফলিত করিতে এবং ৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচীভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের নীতিমালাকে দৈনন্দিন কর্মে প্রতিফলিত করিতে আমাদের সর্বক্ষমতা নিয়োগ করিব।

আমরা আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর প্রতি পরিপূর্ণভাবে অনুগত থাকিব এবং বর্তমানে অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান রহিয়াছে তাহা দূর করিব, এবং এমন একটি শোষণমুক্ত সমাজের ভিত্তি স্থাপনে সংগ্রাম করিব যেখানে অন্যায়ের পরিবর্তে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমাদের কর্মসূচী যাহার প্রতি জনগণের সমর্থন রহিয়াছে তাহাকে বানচাল করিবার জন্য যদি কোন মহল ও দুষ্ট-শক্তি তৎপর হয়, তাহা হইলে আমরা তাহাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিব এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপোষহীন সংগ্রামের জন্য আমরা সদা প্রস্তুত থাকিব।

আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টায় সহায় হউন।

জয় বাংলা-জয় পাকিস্তান।

উল্লেখ্য যে, এই অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় ভাষণ সমাপনান্তে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় পাকিস্তান’ ধ্বনি দ্বারা বাঙালির দাবি-দাওয়া আদায়ের অঙ্গীকার ঘোষণা করেন।

ইয়াহিয়ার কালক্ষেপণ

নির্বাচনোত্তরকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সন্দেহজনক উদ্দেশ্যে পিন্ডি, ঢাকা, লারকানা পদচারণা করিয়া তাহার মূল কর্তব্য ও তাঁহার দেয়া আইনগত কাঠামোর আদেশ মোতাবেক ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে অনর্থক কালক্ষেপণ করিতেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১১ই জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন এবং ১২ ও ১৩ই জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত সাক্ষাৎ এবং ১৪ জানুয়ারি ঢাকা ত্যাগকালে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা ও ১৯৭০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর করাচিতে, ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি লারকানা, ১৯৭১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিভিতে, ২৬শে ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া-ভুট্টো পুনঃপুনঃ সাক্ষাৎ ছিল পরবর্তীকালের ঘটনারাজীকে অনভিপ্রেত খাতে প্রবাহিত করার অপপ্রয়াসমাত্র। স্বীয় উদ্যোগে ইয়াহিয়া খানের এই ব্যক্তিগত কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করিবার বিশেষ কারণ আর কিছুই ছিল না, ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট পদপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান। ক্ষমতা লোভই তদানীন্তন সামরিক বাহিনীর অধিনায়কের কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করিত, দেশপ্রেমও নয়, কর্তব্যবোধ বা নৈতিকতা বোধ নয়।

এইদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদলসহ ১৯৭১ সালের ২৭শে জানুয়ারি সাংবিধানিক বিষয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত আলোচনা করিবার নিমিত্ত ঢাকা আগমন করেন এবং ৩০শে জানুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন। পরিতাপের বিষয়, উভয় নেতার ব্যক্তিগত খামখেয়ালীপনা ও অহমিকাবোধই তাহাদের ২৭, ২৮ ও ২৯শে জানুয়ারি তিন দিবসব্যাপী আলোচনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।

ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থবাদী মহল সংবিধান প্রণয়ন বানচালে অত্যন্ত তৎপর হইয়া উঠে। সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদের সহজাত সার্বভৌম অধিকার অস্বীকার করিয়া জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো অদ্ভূত ও ইতিপূর্বে অশ্রুত এক থিওরী আকস্মিকভাবে ঘোষণা করেন এবং বলেন, “Three bastions of Power Awami League, Peoples party and Army”, অর্থাৎ ক্ষমতার তিনটি খুঁটি- আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি এবং সৈন্য বাহিনী। ইহার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, বেতনভুক সরকারি কর্মচারী, সামরিক বাহিনী সংবিধান রচনায় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিন্যাসে সংশ্লিষ্ট। এভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক গণপরিষদ অধিবেশন আহ্বানে অহেতুক কালক্ষেপণ, স্বউদ্যোগে ব্যক্তিগত কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ, জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক সংখ্যাধিক্য গণপরিষদ সদস্যদের সংবিধান গ্রহণে অস্বীকৃতি ও আকস্মিকভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যৎ সংবিধানের রূপরেখা নির্ধারণে জড়িত করিবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রস্তাব, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসন কর্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আইনগত কাঠামো আদেশের খেলাফে আওয়ামী লীগকে সাধারণ নির্বাচনে ৬ দফা দাবির উপর রায় দানে নির্বাচকমন্ডলীকে আহ্বানের সুযোগ দান, রাজনৈতিক বিবর্তনের বিভিন্ন দিক কালের ঘটনা স্রোতেরই এক নীরব সাক্ষী।

বিমান ছিনতাই

এক অনিশ্চিত ও সংকটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশ যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখনই ঘটনা প্রবাহের এক নূতন অথচ অশুভ ও সর্বনাশা দিক উন্মোচিত হইল। ১৯৭১ সালের ৩০শে জানুয়ারি গঙ্গা নামীয় এক ভারতীয় ফকার ফ্রেন্ডশীপ বিমান জম্মু বন্দরে অবতরণকালে দুইজন কাশ্মীরী স্পাই মোঃ হাশেম কোরেশী ও মোঃ আশরাফ ছিনতাই করে। তাহারা নিজেদের জম্মু ও কাশ্মীর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য বলিয়া দাবি করে এবং ছিনতাইকৃত বিমানটিকে লাহোর বিমান বন্দরে অবতরণ করিতে বাধ্য করে। ছিনতাইকারীগণ আরও দাবি করে যে, ভারত সরকার ৩৬ জন আটক কাশ্মীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তি দিলে ফকার বিমানটি ভারতকে ফেরত দেওয়া হইবে। ভারত দাবি মানিতে অস্বীকৃতি জানাইলে ছিনতাইকারীরা ২রা ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) বিমানটি লাহোর বিমান বন্দরে ডিনামাইট দ্বারা ধ্বংস করে। প্রণিধানযোগ্য ঘোষণা আসে ভারতীয় কাশ্মীর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ সাদিকের নিকট হইতে। তিনি জানান, মোহাম্মদ হাশেম কোরেশী (ছিনতাইকারীর অন্যতম একজন ডবল এজেন্ট এবং ভারতীয় কাশ্মীর সরকার কয়েক মাস পূর্বেই ছিনতাই পরিকল্পনা কোরেশীর নিকট হইতেই জ্ঞাত হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের এক এজেন্সীর আশ্রয়ে থাকায় কাশ্মীর সরকারের পক্ষে ছিনতাইকারী কোরেশীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় নাই।

৩১শে জানুয়ারি ঢাকা হইতে প্রত্যাবর্তনকালে লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণ করিয়া জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিনতাইকারী মোহাম্মদ হাশেম কোরেশীর সহিত আলোচনা করেন। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সে সময়ে জনাব ভুট্টোর এই ধরনের বাল্যসুলভ অভিনয় বিশেষ ক্ষতির কারণ হইয়া দাঁড়ায়।

উল্লেখ্য যে, ভারত তার বিমান ধ্বংসের প্রতিবাদে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ২রা ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তানের সমস্ত বেসামরিক যাত্রীবাহী বিমান ভারতীয় আকাশ পথে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াত বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। তাই অনেকের ধারণা ছিল এই যে, ছিনতাই নাটক সুপরিকল্পিত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র ধ্বংসের জন্য সযত্নে রচিত ভারতীয় বৃহত্তর ষড়যন্ত্রমূলক নাটকের অন্যতম অংশমাত্র।

ছিনতাইকারী মোহাম্মদ হাশেম কোরেশী যে একজন ডবল এজেন্ট ছিলেন, ভারতীয় কাশ্মীরের মন্ত্রী মোহাম্মদ সাদেকের সেই বক্তব্য আগে উল্লেখ করিয়াছি। ছিনতাই নাটকটিই পাকিস্তানের নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুই অঞ্চলের মধ্যে দ্রুত বিমান যোগাযোগ অবসানের অজুহাত সৃষ্টি করে। ঐদিকে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানকল্পে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থ গ্রহণের পাকিস্তানী প্রস্তাবও ভারত সরকার প্রত্যাখ্যান করে। ইহা আর যাহাই হউক, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সহায়ক ছিল না। ৩রা ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ছিনতাইকৃত বিমান ধ্বংসের ঘটনাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলিয়া আখ্যা দেন। পক্ষান্তরে পিপলস পার্টি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিনতাইকৃত বিমান ধ্বংসকে সমর্থন করেন। উভয় নেতার বিবৃতিই ছিল যথেষ্ট রহস্যপূর্ণ। আরে রহস্যপূর্ণ ছিল ভুট্টোর ১৩ই ফেব্রুয়ারির বিবৃতি। বিবৃতিতে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড হকি কাপ টুর্নামেন্টে ভারতীয় হকি টীমের অংশগ্রহণে বিরোধিতা করেন। তদুপরি ১৩ই ফেব্রুয়ারি বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী কর্তৃক এই ঘটনায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবির যথার্থতা খুঁজিয়া বাহির করিবার প্রয়াস ভারত সরকারকে সুপরিকল্পিত সুদূর লক্ষ্যমুখে অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হইতে উৎসাহিত করে।

যাহা হউক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অনেক টালবাহানা ও গড়িমসির পর এবং জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ১২ই ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) আলোচনাক্রমে এক ঘোষণায় ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহ্বান করেন। সাড়ে সাত কোটি বঙ্গবাসীর মুখপাত্র হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ইতিপূর্বেই প্রেসিডেন্টকে ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের অনুরোধ জানাইয়াছিলেন।

প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়া ক্রমশঃ উত্তপ্ত হইতে থাকে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা করেন যে, জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের পূর্বে কোন প্রকার সমঝোতা ও বোঝাপড়া না হলে পিপলস পার্টি ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দিবে না। তিনি একই সাংবাদিক সম্মেলনে আরোও ঘোষণা করেন যে, বিমান ছিনতাই প্রশ্ন পাক-ভারত যুদ্ধংদেহী অবস্থা ও ৬ দফা গ্রহণ না করিবার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পিপলস পার্টির সদস্যবর্গ ঢাকায় গমন করিলে তাহারা ডবল স্টেজে পরিণত হইবে। ১৭ই ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের পূর্বে সবার আগে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা প্রয়োজন বলিয়া পুনঃ মত প্রকাশ করেন।

এইভাবেই ক্রমে ক্রমে জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক কর্মধারায় পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত পিপলস পার্টির পিছনে সংহত হইতে থাকে। এমনি অবস্থায় ৮৮ সদস্যবিশিষ্ট পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। চতুর্দিকে যখন তুলকালাম কান্ড, তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আহ্বানে রাওয়ালপিন্ডিতে ভুট্টো-ইয়াহিয়া এক সাক্ষাৎকার হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সহিত সাক্ষাৎকারের অব্যবহিত পরেই সাংবাদিকদিগকে জনাব ভুট্টো জানান যে, মুদ্রা, বৈদেশিক বাণিজ্য ও কর সম্পর্কে প্রকৃত বা মৌলিক মীমাংসা সম্ভব হইলেই সংবিধান রচনায় পিপলস পার্টি অংশগ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছে। তিনি আরো দাবি করেন যে, পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ সমগ্র দেশের এক-অর্ধাংশের প্রতিনিধি। তিনি এই মর্মে আরো দাবি করেন যে, ভারতীয় সৈন্য সমাবেশ পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তেই হইয়াছে, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে নয়।

করাচিতে ওয়েস্ট পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ম্যানেজমেন্ট প্রাঙ্গণে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সভাপতিত্বে ২০শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পাকিস্তান পিপলস পার্টি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের দুই দিবসব্যাপী পার্লামেন্টারি কনফারেন্সের প্রথম দিবসে অধিবেশনেই ৬ দফা ভিত্তিক সংবিধান বনাম পিপলস পার্টির ভূমিকা সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রশ্নে সদস্যবৃন্দ পার্টি চেয়ারম্যানের নিকট সানন্দে পদত্যাগপত্র জমা দিতে সম্মত হন। পদত্যাগের এই হুমকির পটভূমিকায় বোধহয় ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক আদেশে আইনগত কাঠামো আদেশ (১৯৭০)কে সংশোধন করিয়া পরিষদের প্রথম অধিবেশন আরম্ভ হইবার পূর্বে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের পদত্যাগের ধারা সংযোজিত করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল, পিপলস পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ২২শে ফেব্রুয়ারি করাচির সভায় পরিষদ সদস্যদের পদত্যাগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

সংবিধান সম্পর্কে পিপলস পার্টির সুপারিশ

করাচিতে অনুষ্ঠিত পিপলস পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় দেশের ভাবী সংবিধান নিম্নবর্ণিত নীতিমালার উপর প্রণীত হওয়ার সুপারিশ করা হয়।

(১) ফেডারেল সরকার এবং কেন্দ্র প্রয়োজনীয় সংস্থা প্রত্যেকটি ফেডারেটিং ইউনিটের সমান প্রতিনিধিত্ব পাইবে।

(২) আন্তঃ ও আন্তঃআঞ্চলিক শোষণ বন্ধ করিবার নিমিত্ত সুষম মুদ্রা ও কর ব্যবস্থার প্রবর্তন হইবে।

(৩) ভায়াবল (viable) কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার প্রয়োজনে ফেডারেল সরকার কর আরোপ ও আদায় করিবে।

(৪) বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য ফেডারেল সরকারাধীন থাকিবে।

(৫) প্রদেশগুলির মধ্যে পণ্য দ্রব্য ও চলাচলের অবাধ অধিকার থাকিবে।

ভুট্টো-ইয়াহিয়া আঁতাত

২২শে ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সভাপতিত্বে প্রাদেশিক গভর্নর ও আঞ্চলিক সামরিক শাসনকর্তাদের বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দরুন সামরিক জান্তার উগ্রপন্থী জেনারেল যথা- জেনারেল হামিদ, ওমর, গুল হাসান, পীরজাদা প্রমুখের দাবিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৭ই ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভা বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।

২৬শে ফেব্রুয়ারি পিপলস পার্টি চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সহিত করাচিস্থ রাষ্ট্রপতি ভবনে চার ঘন্টাব্যাপী সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা করেন। অনুমিত হয় যে, ভুট্টো-ইয়াহিয়া এই সাক্ষাৎকারেই জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশন স্থগিত রাখিবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছিল নতুবা ২৮শে ফেব্রুয়ারি লাহোর জনসভায় জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখিবার দাবি এবং অন্যথায় ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনার সময়সীমা প্রত্যাহারের দাবি উত্থাপন করিতে পারিতেন না। তিনি এই মর্মেও হুমকি প্রদান করেন যে, নারী সদস্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবার প্রচেষ্টা চালাইলে খাইবার হইতে করাচি পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হইবে এবং পিপলস পার্টির কোন সদস্য পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিলে তাহাকে নিশ্চিহ্ন করা হইবে। উল্লেখ্য যে, জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হইলেও এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশনকে পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যবৃন্দের জন্য ‘কসাইখানা’ আখ্যা দিলেও ৩রা মার্চ ঢাকা অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত ৩৫ জন সদস্য ঢাকা আগমন করেন। স্মর্তব্য, নির্বাচন কমিশন ১৪ই ফেব্রুয়ারির এক ঘোষণায় জাতীয় পরিষদে ১৩ জন নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ২রা মার্চ ধার্য করেন এবং ১লা মার্চ ঢাকায় রিটার্নিং অফিসার সমীপে নমিনেশন পেপার জমা দেওয়ার জন্য ইচ্ছুক প্রার্থীদিগকে আহ্বান জানান।

পরিষদ অধিবেশন স্থগিত : বাংলাদেশ বিক্ষুব্ধ

১৫ এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যবৃন্দের যুক্ত সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দলীয় লক্ষ্য অর্জনে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ পার্লামেন্টারি পার্টির লীডার ও ডেপুটি লীডার নির্বাচিত করা হয়।

ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচীর রদবদলের জন্য সরাসরিভাবে দাবি উত্থাপন করে। ইহার উত্তরেই বোধহয় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ২৪শে ফেব্রুয়ারি দলীয় সদর দফতরে সাততাড়া আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, ৬ দফা প্রশ্নে কোন প্রকার রদবদল সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের উপর ৬ দফা বাধ্যতঃ গ্রহণীয়ও নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহ পারস্পরিক প্রয়োজন ও স্বার্থে যে কোন প্রকার সাংবিধানিক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করিতে পারে।

শেখ মুজিবুর রহমানের উপরোক্ত ঘোষণা ইহাই প্রমাণ করে যে, শেখ সাহেব রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় ভিত্তিতে পাকিস্তানের সামগ্রিক সাংবিধানিক সমস্যা সমাধানে আগ্রহান্বিত ছিলেন না। বলাই বাহুল্য যে, বিগত ২৩ বৎসরের ক্ষমতার লড়াই-এর ইহাই ছিল অবশ্যম্ভাবী বিষময় ফলশ্রুতি।

বোধহয়, ২৮শে ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত ভুট্টোর জনসভার দাবির প্রেক্ষিতেই ১লা মার্চ, অপরাহ্ন ১টা ৫ মিঃ-এর বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় আহ্ত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবী ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ মূলতবী ঘোষণা হতচকিত ঢাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ দর্শক কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়; ঢাকা হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশন ও ঢাকা জেলা এসোসিয়েশনের প্রতিবাদ মিছিল রাস্তায় নামে; ছাত্র সম্প্রদায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে রাজপথে নামিয়া আসে; বিভিন্ন শিল্প এলাকা হইতে শ্রমিকরা দলে দলে মিছিল সহকারে রাজধানী ঢাকা মুখে যাত্রা করে; সকল সিনেমা হল বন্ধ হইয়া যায়। এইসব বিক্ষোভ মিছিলের স্রোত হোটেল পূর্বাণীর দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। হোটেল পূর্বাণীতে তখন আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারি পার্টির সভা চলিতেছিল। মিছিলকারীরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ উঠায়, “পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন কর। বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।” শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী জনতার উদ্দেশ্যে তাহার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার প্রতিবাদে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক সাধারণ হরতাল পালনের আহ্বান জানান। এইভাবে সেদিন সারাদিন ধরিয়া মিছিলে মিছিলে ঢাকা নগরী প্রকম্পিত হয়ে থাকে; অফিস-আদালত পরিত্যক্ত হয়; আইনজীবীরা পথে নামিয়া আসেন, দোকানপাট বন্ধ, সর্বত্র বিদ্রোহ বহ্নি। পল্টন ময়দানে স্বতঃস্ফূর্ত বিরাট জনসমাগমে আগামীদিনের গণআন্দোলনের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। ২রা মার্চ ঢাকা নগরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এই ২রা মার্চেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। সবুজ জমিনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত এই পতাকা উত্তরকালে মানচিত্র বাদ দিয়া রাষ্ট্রীয় পতাকার মর্যাদা পায়।

পরিস্থিতিকে আয়ত্তে রাখিবার প্রয়োজনে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ এক আদেশ বলে প্রদেশগুলিতে নিয়োজিত সামরিক শাসনকর্তাকেই বেসামরিক গভর্নর পদে নিয়োগ করেন অর্থাৎ দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটাইয়া সামরিক বাহিনীই দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস,এম আহসান অনতিবিলম্বে সামরিক শাসন কর্তা লেঃ জেঃ সাহেবজাদা এম. ইয়াকুব খানের নিকট দায়িত্বভার দিয়া পূর্ব পাকিস্তান হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। ২রা মার্চ ঢাকায় প্রতিবাদ হরতাল পালনকালে বুলেটের আঘাতে ২ ব্যক্তি শাহাদাত বরণ করেন এবং অনেকেই আহত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ২রা মার্চ এক বিবৃতিতে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি করেন এবং নিম্ন কর্মসূচী ঘোষণা করেন। (ক) ৩রা মার্চ হইতে ৬ই মার্চ পর্যন্ত ভোর ৬টা থেকে ২ ঘটিকা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট, (খ) ৩রা মার্চ জাতীয় শোক দিবস পালন এবং (গ) ৩রা মার্চ ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠানের পর অপরাহ্ন চার ঘটিকায় পল্টন ময়দান থেকে শেখ সাহেব কর্তৃক মিছিল পরিচালনা। শেখ সাহেব আরো ঘোষণা করেন যে, রেডিও-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে আমাদের বক্তব্য প্রকাশ না করিলে বাঙ্গালি কর্মচারীরা সহযোগিতা করিতে অস্বীকৃতি জানাবে। ঘোষণা ইহাও বলা হয় যে, ৭ই মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঘোষণা করিবেন।

পরিস্থিতি মোকাবিলা করিবার প্রয়াসে সামরিক কর্তৃপক্ষ পৌরসভা এলাকায় রাত্রি ৮টা থেকে ভোর ৭ টা পর্যন্ত এবং ৩রা মার্চ সন্ধ্যা ৭টা হইতে ভোর ৭টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করেন। কিন্তু তথাপি সান্ধ্য আইন অমান্য করিয়াই মিছিল ব্যারিকেড পূর্ণোদ্যমে চলিতে থাকে; বিদ্রোহী জনতা অকাতরে প্রাণ দিতে থাকে। সান্ধ্য আইন জারির এই বিষময় ফল প্রত্যক্ষ করিয়াই কর্তৃপক্ষ ৪ঠা মার্চ হইতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করেন।

বাংলা জাতীয় লীগের প্রচেষ্টা

এদিকে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য যৌথ সংগ্রাম পরিষদের দাবিতে বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলা মজদুর ফেডারেশন ও ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের এক বিরাট জঙ্গী মিছিল ঢাকা নগরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। অবশ্য আওয়ামী লীগ কর্মীরা উক্ত যৌথ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের দাবিকে সুনজরে দেখে নাই। ৩রা মার্চ সকাল দশ ঘটিকায় দেওয়ান সিরাজুল হক ও এম,এম, আনোয়ার ও আমার সমবায়ে গঠিত এক প্রতিনিধি দল বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত তাহার ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে এক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হই। আলোচনায় জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও মনসুর আলী অংশগ্রহণ করেন। আমরা বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে শেখ সাহেবের সমীপে নিম্ন প্রস্তাবাবলী পেশ করি :

(১) জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত সংক্রান্ত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে উপেক্ষা করিয়া আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আগত সদস্যবর্গের আজই ঢাকায় সংবিধান প্রণয়নকল্পে যথারীতি অধিবেশনে মিলিত হওয়া উচিত এবং যথাশীঘ্র সংবিধান প্রণয়ন করিয়া উহা মোতাবেক জনপ্রতিনিধিগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সামরিক আইন শাসনকর্তা প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানান উচিত।

(২) প্রেসিডেন্ট এই আহ্বান অস্বীকার করিলে অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করা ও জাতিসংঘের সাহায্য প্রার্থনা করা প্রয়োজন।

(৩) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সমবায়ে কনফেডারেশন গঠন।

(৪) উপরে বর্ণিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনতার ঐক্য সুদৃঢ় করিবার মানসে সংগ্রামী জনতা মোর্চা গঠন।

জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও জনাব মনসুর আলী পরিকল্পনাটি বাস্তব নহে বলিয়া মন্তব্য করেন। শেখ সাহেব বলেন, এই প্রস্তাব অনুসারে কাজ করিলে সরকার সেনাবাহিনীর দ্বারা আন্দোলন দমাইয়া ফেলিবে। যাহা হউক, পরবর্তী ঘটনাবলীই প্রমাণ করিয়াছে যে, আমাদের প্রস্তাবসমূহ সঠিক ছিল কি-না এবং আমাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিবার পরেও সেনাবাহিনীর দমন চলাইয়াছিল কি-না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আলোচনার ফাঁকে এক পর্যায়ে ২রা মার্চ তাঁর বাসভবনে নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. ফারল্যান্ডের সাথে তার যে বৈঠক হয় সেই বৈঠকের প্রসঙ্গে মুজিব ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে কিনা? এ ব্যাপারে কোন আলোচনা হয়েছে কিনা? মুজিব ভাই উত্তরে বললেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করবে না। তবে নভেম্বরে মার্কিন সিনেটে হয়তো প্রসঙ্গটি আলোচনা হইতে পারে, সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির জন্য পটুয়াখালী অথবা সেন্ট মার্টিন যে কোন একটি দ্বীপ তারা চায়। আমি তাহাদের সরাসরি না বলে দিয়েছি।” এরকম বলা একমাত্র মুজিব ভাইয়ের মতো সাহসী লোকের পক্ষেই সম্ভব।

মুজিব ভাই কিন্তু আত্মসমর্পণ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইংগিতেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার সম্পূর্ণ গ্যারান্টি দেয়ার ফলেই তিনি নির্দ্বিধায় ২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন।

আবার গোল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব

৩রা মার্চ অপরাহ্নে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পল্টনের বিরাট জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং সরকারের নিকট (১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) সশস্ত্র বাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন ও (৩) জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর দাবি করেন। এবং ৪ঠা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান নিম্নলিখিত নির্দেশ জারি করেন :

কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের নিমিত্ত সরকারি, বেসরকারি অফিস অপরাহ্ন ২-৩০ থেকে ৪-৩০ মি পর্যন্ত খোলা থাকিবে, ১৬ শত টাকার অনূর্ধের চেক পরিশোধের জন্য ব্যাংকসমূহ অপরাহ্ন ২-৩০ মিঃ হইতে ৫-৩০ মিঃ পর্যন্ত কাজ করিবে; স্টেট ব্যাংক কর্তৃক অথবা অন্য কোন প্রকারে বাংলাদেশের বাহিরে টাকা প্রেরণ করা যাইবে না। ইহার আগের দিন অর্থাৎ ৩রা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংকট উত্তরণ প্রচেষ্টায় নিম্নলিখিত পার্লামেন্টারি পার্টি নেতৃবর্গ ঢাকায় এক গোল টেবিল বৈঠকের আহ্বান জানান :

(১) শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ; (২) জুলফিকার আলী ভুট্টো, পাকিস্তান পিপলস পার্টি; (৩) খান আবদুল কাইউম খান, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইউম); (৪) মিঞা মোহাম্মদ মমতাজ দৌলতানা, কাউন্সিল মুসলিম লীগ; (৫) মাওলানা মুফতি মাহমুদ জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (হাজারভী); (৬) খান আবদুল ওয়ালী খান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী); (৭) মাওলানা শাহ আহমদ নূরানী, জমিয়তুল উলেমায়ে পাকিস্তান; (৮) জনাব আবদুল গফুর আহমদ, জামায়াতে ইসলামী; (৯) মিঃ মোহাম্মদ জামাল কুরেকা, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন); (১০) জনাব নূরুল আমিন, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি; (১১) মেজর জেনারেল জামালদার, উপজাতীয় এলাকা থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতিনিধি; (১২) মালিক জাহাঙ্গীর খান, উপজাতীয় এলাকা থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতিনিধি।

শেখ মুজিবুর রহমান গোল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। জনাব নুরুল আমিনও গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানী সংখ্যাগুরু জনতার আস্থাভাজন নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো গোল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান।

পল্টনে বাংলা জাতীয় লীগের জনসভা

৩রা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনাকালে আমরা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও মুক্তি ফৌজ গঠনের প্রস্তাব রাখিয়াছিলাম। আমাদের প্রস্তাবের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অনীহা লক্ষ্য করিয়া, সমগ্র পরিস্থিতির আলোকে বাংলা জাতীয় লীগের দৃষ্টিভঙ্গিতে করণীয় আশু কর্তব্য নির্দেশ করিবার উদ্দেশ্যে আমরা ১৯৭১ সালের ৬ই মার্চ অপরাহ্নে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এক জনসভা আহ্বান করি। পল্টন ময়দানে আমাদের সংগঠনের নামকরণ করি বাংলা জাতীয় লীগ। এই জনসভাতে সভাপতির ভাষণদানে আমি ৭ই মার্চ রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত জনসভায় বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহ্বান জানাই এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ থেকে সর্বশক্তি নিয়োগের প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস দান করি।

গভর্নর পদে টিক্কা খান

১০ই মার্চ আহূত গোল টেবিল বৈঠকের প্রতি বাংলার নেতার অনমনীয় মনোভাব লক্ষ্য করিয়া ৬ই মার্চ এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ৭ই মার্চ অপরাহ্ন তিন ঘটিকায় লক্ষ লক্ষ লোকের পদভারে প্রকম্পিত রেসকোর্স ময়াদনে মুহুর্মুহু ধ্বনি ও করতালির মধ্যে স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভিত মঞ্চ থেকে স্বাধীন বাংলার নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

 স্মর্তব্য যে, একই দিবসে অর্থাৎ ৭ই মার্চ লেঃ জেঃ সাহেবজাদা এয়াকুবের স্থলে কঠোরমনা লেঃ জেঃ টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসন কর্তা বেসামরিক গভর্নর পদে নিযুক্ত হইয়া ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আগমনের পরই লেঃ জেঃ টিক্কা খান বিমানে রেসকোর্স ময়দানের জনারণ্য পর্যবেক্ষণ করেন। বোধহয় ভীতি প্রদর্শনের প্রয়াসে রেসকোর্সের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সশস্ত্র বাহিনীকে মোতায়েন রাখা হয়।

ইতিপূর্বে ১লা মার্চ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন সমবায়ে চার সদস্যবিশিষ্ট স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের উক্ত একক পদক্ষেপের ফলে স্বাভাবিকভাবেই ১১ দফা দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে গঠিত ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিলুপ্তি ঘটে।

শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ

“আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বোঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়া চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর আমার ভায়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এ দেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি, বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস- এই রক্তের মুমূর্ষু মানুষের করুণ আর্তনাদ, এদেশের করুণ ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।

১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইউব খার পতনের পরে ইয়াহিয়া এলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেব বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হোল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করেছিলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আমাদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সভা হইবে। আমি বললাম ঠিক আছে, আমরা এসমব্লিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনের মতেও যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা মেনে নেব।

ভুট্টো সাহেব এখানে ঢাকা এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হইবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম- আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো- সবাই আসুন, বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবে। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বার যদি আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেমব্লি। তিনি বললেন যে, যে যাবে তাহাদের মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেমব্লিতে আসে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত সব জোর করে বন্ধ করা হইবে। আমি বললাম, এসেমব্লি চলবে আর হঠাৎ মার্চের ১ তারিখ এসেমব্লি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেমব্লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাবো। ভুট্টো বললেন, যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হোল, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষের, দোষ দেওয়া হোল আমাকে। দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোল। আমি বললাম, আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র পেয়েছি বহিঃশক্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করবার জন্য, আজ সেই অস্ত্র আমার দেশের গরীব দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধে তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙ্গালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরীবের উপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, আপনি দেখুন। তিনি বললেন, আমি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকবো। আমি বলেছি, কিসের এসেমব্লি বসবে, কার সঙ্গে কথা বলবে? আপনারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলবো? পাঁচ ঘন্টার গোপন বৈঠকে সমস্ত দোষ তারা আমাদের উপর, বাংলার মানুষের ওপর দিয়েছেন। দায়ী আমরা।

২৫ তারিখে এসেমব্লি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ১০ তারিখে বলেছি, রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে, এসেমব্লি খোলা চলবে না। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইড্রো করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকের ভিতরে ঢুকাতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে তাহাদের তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, তারপর বিবেচনা করে দেখবো আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেমব্লিতে আমরা বসতে পারি না।

আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিতে চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সে জন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলো হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ী, রেল চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দফতর, ওয়াপদা- কোনকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, এরপর যদি ১টি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট, যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। সৈন্যেরা, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেহ কিছু বলবে না কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।

আর যে সমস্ত লোক শহিদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগ থেকে যদি পারি সাহায্য করিতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আওয়ামী লীগ অফিসে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর ৭ দিন হরতালে শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেক শিল্পের মালিক তাহাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে ততদিন ওয়াপদা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হোল- কেউ দেবেন না। শুনুন, মনে রাখুন, শত্ৰু পিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু, মুসলমান যারা আছে তারা আমাদের ভাই, বাঙ্গালি, অবাঙ্গালি- তাহাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনে পত্র নিতে পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বাংলাদেশের নিউজ বাইরে পাঠানো চলবে। এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে- বাঙালিরা বুঝে সুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন। এবং আমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। যখন রক্ত দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।

জয় বাংলা। জয় পাকিস্তান।

উল্লেখ্য যে, ৭ই মার্চের জনসভাতেই ২৫শে মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদান প্রসঙ্গে শেখ মুজিব নিম্নোক্ত শর্তাবলী আরোপ করেন :

(ক) সামরিক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।

(খ) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে হইবে।

(গ) হত্যার তদন্ত করিতে হইবে।

(ঘ) জনপ্রতিনিধিগণের হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হইবে।

তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানান, “উপরোক্ত শর্তাবলী পূরণ না হইলে শহীদের কঁচারক্ত মাড়াইয়া ২৫শে মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যাইব না!”

উল্লেখ্য যে, ৭ই মার্চ রবিবার এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব ৮ই মার্চ হইতে পরবর্তী সপ্তাহের নিম্নলিখিত কর্মসূচী ঘোষণা করেন :

১। কর না দেওয়ার আন্দোলন চলিবে।

২। সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, হাইকোর্ট এবং বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করিবে। এই ব্যাপারে কি কি শিথিল করা হইবে, তাহা সময়ে সময়ে জানান হইবে।

৩। রেলওয়ে ও বন্দরসমূহ কাজ চালাইয়া যাইবে। তবে জনগণের উপর অত্যাচার চালাইতে সৈন্য সমাবেশকে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারী সহযোগিতা করিবে না।

৪। বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রকে আমাদের বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করিতে হবে এবং তাহারা জনতার আন্দোলনের সংবাদ চাপিয়া যাইতে পারিবে না।

৫। কেবলমাত্র স্থানীয় ও আন্তঃজেলা ট্রাংক টেলিফোন যোগাযোগ চলিবে।

৬। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকিবে।

৭। স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোন উপায়ে কোন ব্যাংক দেশের পশ্চিম অংশে টাকা পাঠাতে পারিবে না।

৮। প্রতিদিন সমস্ত ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হইবে।

৯। অন্যান্য ক্ষেত্রে হরতাল প্রত্যাহার করা হইল। তবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে কোন মুহূর্তে পূর্ণ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষণা করা যাইতে পারে।

১০। স্থানীয় আওয়ামী লীগ শাখার নেতৃত্বে প্রত্যেক ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা এবং জেলায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হইবে।

সামরিক কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা

এভাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির আকাঙ্খার বলিষ্ঠ কণ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত্রির অন্ধকারে পাক সেনাবাহিনীর হামলার পূর্বাহ্ন অবধি পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বেসামরিক অফিস-আদালতসমূহ আওয়ামী লীগ সদর দফতর হইতে জারিকৃত প্রশাসনিক আদেশ ও ফরমান নির্বিবাদে প্রতিপালন করিয়া চলে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেসামরিক ব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ অচল ও বিকল হয়ে পড়ে।

লক্ষণীয় যে, ২২শে মার্চ সংখ্যায় ঢাকার সকল দৈনিক সংবাদপত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার ছবি সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, পাকিস্তান দিবস ২৩শে মার্চে কেবলমাত্র ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও প্রেসিডেন্ট হাউসে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পতাকা উত্তোলিত হইতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সেই দিন ঢাকার ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভা পাইতেছিল। সংক্ষেপে বলিতে গেলে, পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের সমস্ত কর্তৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে চলিয়া যায়।

এইদিকে ঘটনার স্রোত দ্রুত প্রবাহিত হইতে লাগিল। পরিস্থিতির জটিলতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাহার অঘোষিত উপদেষ্টা ও সামরিক জান্তার সদস্যবৃন্দ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, লেঃ জেঃ এস.জি.এম.এম পীরজাদা, লেঃ জেঃ আকবর খানের পরামর্শে ১৯৬৯ সালের ৫ই আগস্টে গঠিত বেসামরিক মন্ত্রিসভা ১৯৭১ সালে বিলুপ্ত করেন (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১)। ১লা মার্চ গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস.এম আহসানের স্থলে সামরিক শাসনকর্তা লেঃ জেঃ ইয়াকুব খানকে বেসামরিক গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং ৭ই মার্চ ভদ্র ও নরম মেজাজী লেঃ জেঃ ইয়াকুব খান সাহেবজাদার স্থলে কঠোরমনা লেঃ জেঃ টিক্কা খানকে যুগপৎ সামরিক শাসন কর্তা ও বেসামরিক গভর্নর পদে নিয়োগ করেন। রাজনৈতিক দিকপাল রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মন্তব্য “Politics is too serious a matter to be left with the Generals” অর্থাৎ “রাজনীতি এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, ইহা জেনারেলদের দায়িত্বে ছাড়িয়া দেওয়া যায় না”- এই স্থলে প্রণিধানযোগ্য। উক্ত মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্য যেন পাকিস্তানী সামরিক জান্তা অচিরেই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সমর দ্বন্দ্বে পরিণত করে।

উল্লেখ্য যে, এই সময়ে জনতার প্রতিরোধ-ঐক্য ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতিমন্ডলীকেও প্রভাবান্বিত করিয়াছিল। প্রধান বিচারপতি বি.এ সিদ্দিকী (বদিউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী) নবনিযুক্ত গভর্নর লেঃ জেঃ টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আওয়ামী লীগ পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনে শরীক হন।

পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক শাসনকর্তা ১৩ই মার্চ এক আদেশ বলে সামরিক বিভাগে কর্মরত বেসামরিক কর্মচারীদের ১৫ মার্চ যথারীতি কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেন। নির্দেশে ইহাও বলা হয় যে, ইহার অন্যথা হইলে অর্থাৎ কাজে যোগ না দিলে কেবল চাকুরী হইতে বরখাস্ত করা হবে না, উপরন্ত সামরিক আদালতের বিচারে সর্বোচ্চ দশ বৎসর সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হইবে।

ইহার পাল্টা জবাবে বেসামরিক প্রশাসন চালু রাখিবার স্বার্থে ১৪ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ৩৫টি নূতন বিধি জারি করেন এবং তদানুযায়ী ১৫ মার্চ হইতে পরবর্তী দিবসগুলি বেসামরিক প্রশাসনযন্ত্র তাঁহার নির্দেশিত বিধি মোতাবেক দেশের প্রশাসন কার্যপরিচালনা করিতে থাকে।

এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটে জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইবার আশঙ্কায় জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট জাতিসংঘ কর্মচারীদিগকে পূর্ব পাকিস্তান হইতে অপসারণের অনুমতি প্রদান করেন। শেখ মুজিব ১৯শে মার্চ সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতিতে ইহার প্রতিবাদ করিয়া মন্তব্য করেন যে, কর্মচারী অপসারণের মাধ্যমেই জাতিসংঘের দায়িত্ব সমাপ্ত হয় না। বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলিতেছে, তাহা জাতিসংঘের মানবাধিকার হুমকির সম্মুখীন বলিয়াও শেখ মুজিব এই বিবৃতিতে মন্তব্য করেন।

ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ঢাকা আগমন

রাজনৈতিক সংকট নিরসনকল্পে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা আগমন করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত ১৬ই মার্চ আড়াই ঘন্টা, ১৭ই মার্চ এক ঘন্টা, ১৯শে মার্চ এক ঘন্টা তিরিশ মিনিট, ২০শে মার্চ দুই ঘন্টা দশ মিনিট, ২১শে মার্চ এক ঘন্টা তিরিশ মিনিটব্যাপী কয়েক দফা রাজনৈতিক বৈঠকে মিলিত হন। মুজিব ইয়াহিয়ার আলোচনার আলোকে প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ পাইয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদলসহ ২১শে মার্চ ঢাকা আগমন করেন। এবং ২১শে মার্চ থেকে ২৪শে মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২২শে মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ঐকমত্য অনুসারে প্রেসিডেন্ট ২৫শে মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।

উল্লেখ্য যে, এই মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনায় তিন মাসের জন্যে নিম্নলিখিত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যথা :

১। সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২। বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর, ৩। জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকিবেন, ৪। দেশ রক্ষা, বৈদেশিক নীতি (বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যতীত মুদ্রা ও পুঁজি পাচার নিষিদ্ধকরণসহ) ছাড়া বাকি সর্বময় ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের হাতে থাকিবে, ৫। তিন মাস অতিক্রান্ত হলে প্রত্যেক অঞ্চলের জাতীয় পরিষদ সদস্যবর্গ সংবিধান রচনাকল্পে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গী স্থিরীকরণের নিমিত্ত পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হইবেন। তৎপর সংবিধান সমস্যাবলীর সর্বগ্রাহ্য সমাধান নির্ধারণকল্পে সদস্যবর্গ যুক্ত বৈঠকে মিলিত হইবেন।

এই সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত রূপদানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের তরফ হইতে সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে এম.এম আহমদ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, বিচারপতি এ.আর কর্নেলিয়াস, লেঃ জেঃ পীরজাদা ও লেঃ কঃ এম.এ হাসান ১৯শে মার্চ, ২৩শে মার্চ ও ২৪শে মার্চ বৈঠকে মিলিত হন। ২৫শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এতদসংক্রান্ত চূড়ান্ত ঐকমত্যের বিষয় ঘোষণার কথা ছিল!

২৫শে মার্চের কালরাত্রি

কিন্তু সকলই গরল ভেল। খুব সম্ভব পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোই ইয়াহিয়া-মুজিব প্রণীত ঐকমত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং ফলে ২৫শে মার্চ কালো রাত্রিতে জাতিকে বিভক্ত করিবার পথে এক অশুভ চক্রের পদচারণা শুরু হয়, এবং রচিত হয় এক নির্মম কালো ইতিহাস।

এই কালো ইতিহাসের জঘন্যতম ও নির্মম ভূমিকা পালনের অসৎ উদ্দেশ্যে অতিসন্তর্পণে ও সংগোপনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা অবস্থান ও আলোচনার ছদ্মাবরণে সর্বাত্মক সামরিক প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। আলোচনার ফলাফল জানার জন্য দেশবাসী যখন উদ্বিগ্নচিত্তে ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছিল, আশা নিরাশার ঠিক সেই মুহূর্তেই ২৫শে মার্চ (১৯৭১) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সহিত বৈঠকের পর ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে বলেন যে, “অবস্থা অত্যন্ত সংকটপূর্ণ”।

 প্রকাশ, সন্ধ্যার মধ্যেই নাকি শেখ মুজিব জানিতে পারেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করিয়াছেন। বস্তুতঃ জনতার নেতা ও স্বাধীন বাংলা সংগ্রামের অন্যতম অধিনায়ক হিসাবে পরিচিত শেখ মুজিব সেদিন কি নির্মমভাবেই না বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হইয়াছিলেন প্রতারক ও চানক্যরূপী সমর নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়ার কূট-কৌশলের মারপ্যাচে।

 সেদিন রাত ৯-৩০ মিনিটে বাংলা জাতীয় লীগের সদর দফতর হইতে আমি পূর্বদেশের প্রখ্যাত কলামিস্ট জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাসায় যাই। তাহার সহিত অবস্থার আলোচনা-পর্যালোচনার পর স্বীয় বাসভবন মুখে রওয়ানা হই। যাত্রাপথে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড রচনা করিতে দেখিতে পাই ভয়ার্ত অথচ সংকল্পে অটল জনতাকে। উদ্বিগ্ন ও উদ্গ্রীব জনতা স্থানে স্থানে আমার গাড়ী থামাইয়া পরিস্থিতি জানিতে চায়। আমি তখনও অনাগত হামলা সম্পর্কে কিছুই ওয়াকিফহাল ছিলাম না। পথিমধ্যে সর্বত্র ব্যারিকেড, উদ্বিগ্ন জনতার ভিড়। আঁচ করিলাম, সংঘর্ষ অত্যাসন্ন এবং বোধহয় সর্বশেষ ফল সুখের নয়।

বাসায় পৌঁছিয়াই জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীকে টেলিফোন করি এবং পথে পথে ব্যরিকেড় ও উৎকণ্ঠিত জনতার সহিত আলোচনার বিষয়বস্তু তাহাকে জানাই। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই মিরপুর রোডের উপর সাঁজোয়া বাহিনীর গাড়ীর আওয়াজ ও অহরহ গুলির শব্দ শুনিতে পাই এবং টেলিফোনে জনাব চৌধুরীকে সে খবরও জানাই। রাত ১২টার দিকে পুনরায় জনাব চৌধুরীর সহিত আলাপ করিবার নিমিত্ত টেলিফোনের রিসিভার উঠাইয়া বুঝিলাম টেলিফোন বিকল। চারিদিকে তখন মুহুর্মুহু রকেট, মর্টার, মেশিনগান ও কামানের আওয়াজ, চতুর্দিকে আগুনের লেলিহান শিখা ও গগনচুম্বি অন্ধকার ধোয়া। রাতভর কখনও বিছানায় কখনও বারান্দায়, কখনও ছাদে গভীর উৎকণ্ঠার সহিত পায়চারি করিতে থাকি। রাত্রি তিন ঘটিকার দিকে মাইকে ঘোষণা শুনিতে পাই, সামরিক শাসন কর্তা ঢাকা নগরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করিয়াছেন।

২৫শে মার্চ কালো রাত্রিতে পাক সেনাবাহিনীর নির্মম হামলায় প্রাণ হারান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দ্বিতীয় প্রধান আসামী পাক নৌ-বাহিনীর তেজস্বী অফিসার লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। আগেই বলিয়াছি, পূর্ব পাকিস্তান সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিকল্পনার পশ্চাতে মূল ব্যক্তি ছিলেন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের পর তিনি তাঁহার পরিকল্পিত স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার মানসে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেন। আমি তাহার পথের পথিক ছিলাম। আমিই কমিটির উক্ত নামকরণ করি। পাক বাহিনী লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে তাহার এলিফ্যান্ট রোডস্থ বাসভবন থেকে বলপূর্বক বাহিরে আনিয়া প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রী ও সন্তানদের দৃষ্টিসীমার স্বল্প দূরেই গুলি করিয়া হত্যা করে। শুধু তাহাকেই নয়, সেই কালো রাত্রে হত্যা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ডাঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব, প্রফেসর এম. মনিরুজ্জামান, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, সিনিয়র লেকচারার ড ফজলুর রহমান খান, সিনিয়র লেকচারার এম.এ মোকতাদির, লেকচারার অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, লেকচারার এম.আর খান খাদেম, লেকচারার শরাফত আলী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র লেকচারার ড মোহাম্মদ সাদত আলী ও সিনিয়র টিচার মোঃ সাদেককে। ইহা ছাড়াও এই কালো রাত্রি এসএম হল, জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হলের বহু সংখ্যক আবাসিক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। ব্যারিকেড রচনাকারী জনতা, রেসকোর্স মন্দিরবাসী, নিঃস্ব বস্তিবাসী কেহই এই হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে রেহাই পায় না। বস্তুতঃ সে রাত্রিতে হত্যা তান্ডব নৃত্য চলিয়াছে পাক বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে। খেলা হইয়াছে রক্তের হোলি। সংহতি রক্ষার নামে কি অদ্ভুত পাশবিক নৃশংস কর্মকান্ড! কিন্তু শুধু কি মানুষ? পাক বাহিনীর হাতে সেই রাত্রিতে অগ্নিদাহ হইয়াছে। জনতার কণ্ঠ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক গণ বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পিপলস অফিস। অগ্নিদাহ হয় নয়াবাজার বস্তি, কাঠের আড়ত।

উপরে বর্ণিত নারকীয় লোমহর্ষক ঘটনা পুনরায় ঘটে ১৪ই ডিসেম্বর (১৯৭১) তারিখ। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক ডঃ আবুল খায়ের, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, ডঃ সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ডঃ ফয়জুল মুহি, ডঃ মর্তুজা ঘাতকের হিংস্র ছোবলের শিকারে পরিণত হন এবং জাতিকে বঞ্চিত করিয়া পরপারের যাত্রা পাড়ি জমান। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকবৃন্দ যথা- ডাঃ আলীম চৌধুরী, ডাঃ ফজলে রাব্বি, প্রখ্যাত সাংবাদিকবৃন্দ যেমন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সংবাদের বার্তা সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, বিবিসি, ও পিপিআই-এর নিজামুদ্দীন আহমদ, পিপিআই-এর নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের এ.এন.এম গোলাম মোস্তফা, দৈনিক মর্নিং নিউজের আবুল বশার চৌধুরী ও খন্দকার আবু তালেব একই প্রতহিংসার বা জিঘাংসাবৃত্তির হুতাশনে প্রাণ দেন।

শেখ মুজিবের গ্রেফতারবরণ

পাকিস্তানী সামরিক শাসকবর্গ ২৫শে মার্চের অপারেশনের নাম দিয়াছিল “অপারেশন সার্চ লাইট”। তদানীন্তন ঢাকাস্থ পাকিস্তানী সামরিক হেড কোয়ার্টারের জনসংযোগ কর্মকর্তা লেঃ কঃ সিদ্দিক সালেক রচিত “Witness to surrender” নামক গ্রন্থে এই অপারেশনের পূর্ণ নীল নকশা বিবৃত হইয়াছে। উক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্ট-২ এবং ১৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছে যে, নিম্নোক্ত ১৬ জন ও অন্যান্য রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত কবিরার জন্য আর্মি হেড কোয়ার্টার তাহাদের এজেন্সীকে নির্দেশ প্রদান করে :

১) শেখ মুজিবুর রহমান          ২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম                         ৩) তাজউদ্দিন আহমদ

৪) এম.এ.জি ওসমানী              ৫) সিরাজুল আলম খান                           ৬) আবদুল মান্নান

৭) আতাউর রহমান খান         ৮) প্রফেসর মোজাফফর আহমদ         ৯) অলি আহাদ

১০) মিসেস মতিয়া চৌধুরী     ১১) ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ             ১২) ফয়জুল হক

১৩) তোফায়েল আহমদ         ১৪) নূরে আলম সিদ্দিকী                        ১৫) আবদুর রউফ

১৬) আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ

হানাদার বাহিনীর হামলার খবর পূর্বাহ্নে জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ কাল রাত্রিতে স্বীয় বাসভবনে অবস্থান করিবার মনস্থ করেন। পাক হানাদার বাহিনী তাঁহার ধানমন্ডির ৩২ নং রোডস্থ বাড়ি ঘেরাও করিলে শেখ সাহেব বিনাবাক্য ব্যয়ে ধরা দিলেন। শেখ মুজিবের মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ ছিল আপামর দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাঙ্খা। বিস্ময়-বিমূঢ় দেশবাসী শেখ সাহেবের সংকট মুহূর্তে ভিন্ন আচরণে হইল বিভ্রান্ত ও হতবাক। জেনারেল মিঠার আদেশ ছিল শেখ সাহেবকে জীবিত বন্দি করিবার এবং তাহাই হইল। উপরে উল্লেখিত অন্য কাহাকেও গ্রেফতার করিতে পাক হানাদার বাহিনী সেই কৃষ্ণ রাত্রে ব্যর্থ হয়। তাই আজও আমরা জীবিত।

গ্রেফতারের পর শেখ সাহেব আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে কালো রাত্রি যাপন করেন, ২৬শে মার্চ তাঁহাকে ফ্ল্যাগ স্ট্যাট হাউসে (Flag state House) স্থানান্তরিত করা হয় এবং ২৮শে মার্চ বিমানযোগে শেখ সাহেবকে করাচি নিয়া যাওয়া হয়।

চতুর্দিকে গুজব ছিল শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেছে। ইহা মিথ্যা প্রমাণ করিবার জন্যই ২রা এপ্রিল (১৯৭১) করাচি বিমান বন্দরে তোলা ছবি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ছাপানো হয় এবং তাহাকে মীয়নওয়ালী কারাগারের বন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দি করিয়া রাখা হয়।

এইভাবে সমঝোতার নামে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতকতা ও লজ্জাকর কাপুরুষোচিত ভূমিকায় অভিনয় করেন। পাছে এই গণহত্যা অভিযান, লোমহর্ষক ধর্ষণকাহিনী ও গৃহদাহের এবং ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী ফাঁস হইয়া যায়, তাই হোটেল ইন্টারকন্টিন্যান্টালে ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে প্রথমে আটক করা হয় এবং ২৬শে মার্চ (১৯৭১) পাঠাইয়া দেওয়া হয় বিমানযোগে ঢাকার বাহিরে।

পশ্চিম পাকিস্তানের মীয়ানওয়ালী কারাগারে আটক থাকাকালে আগস্ট মাসে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অবিরাম প্রচেষ্টা ও জাগ্রত বিশ্ববিবেকের চাপে পাক-সরকারের পক্ষে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের প্রাণনাশ করা সম্ভব হয় নাই। শেখ সাহেব নেতৃবৃন্দকে ঢাকা ত্যাগ করে গা-ঢাকা দেওয়ার পরামর্শ দিলেও আন্দোলনের খাতিরে নিজে আত্মগোপন করেন নাই কেন? ১৯৪৯ সালের অক্টোবর ব্যতীত অতীতে গণ-আন্দোলনের প্রয়োজনে শেখ সাহেব কেন আত্মগোপন করেন নাই। দেখা গিয়াছে, সকল আন্দোলনের সূচনা মুহূর্তে স্বগৃহে অবস্থান করিয়াই তিনি গ্রেফতারবরণ করিতেন। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আলোচনায় বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের উপস্থিতির অপরিহার্যতা সন্দেহের অবকাশ রাখে না। প্রকাশ, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ ফারল্যান্ড শেখ সাহেবের সহিত তাহার বাসভবনে দেখা করিয়া তাহার জীবনের নিরাপত্তায় মার্কিন সাহায্যের নিশ্চয়তা দিয়াছিলেন। উল্লেখ্য যে, ২১শে জুন এস.এস পদ্মা ও এস.এস সুন্দরবন অস্ত্র বোঝাই বিষয়ে সিনেট সাব কমিটি অন রিফিউজি’র নিকট সাক্ষাৎদানকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি এসিসট্যান্ট সেক্রেটারি মিঃ ক্রিস পারভন যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা রাজনৈতিক সমাধানকল্পে পাকিস্তানের সহিত আলোচনার ইঙ্গিত বহন করে। বোধহয় এই কারণেই বন্দি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকায় অবস্থানকারী পরিবারের ব্যয় বহনকল্পে পাক সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে প্রতি মাসে ১৫০০ (পনের শত টাকা) করিয়া মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। নিউজ উইকের সিনিয়র এডিটর আরন্ড ডি বোরচগ্রেভের (Arnand de Brochgrave) সহিত এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই মর্মে আভাস দিয়াছিলেন যে, “জাতি দাবি করিলে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিবেন।”

ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক

প্রসঙ্গত ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক সম্পর্কে দু’একটি কথা না বলিলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হইবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই ছাত্র সংগঠনটির অবদান অনস্বীকার্য নয়, অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল বটে। সরকারি অর্থানুকুল্যে প্রকাশিত ১৪ খন্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলসহ মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা অনেক গ্রন্থেও স্বাধীনতা আন্দোলনে এই ছাত্র সংগঠনটির নানাবিধ সাহসী ভূমিকার কথা উল্লেখ রহিয়াছে।

ফরোয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক প্রতিষ্ঠা লাভ করে উনিশশ একাত্তরের ১৭ই ফেব্রুয়ারি। বস্তুতঃ বাংলা ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রশক্তির একদল মেধাবী ও সপ্তাবনাময় তরুণের সমন্বয়ে গোড়াপত্তন ঘটে এ সংগঠনটির। তোপখানা রোডের দোতালায় (বর্তমান হোটেল সম্রাট) এক অনাড়ম্বর ছাত্র সমাবেশে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। সে সমাবেশে জনাব লুৎফর রহমানকে সভাপতি, জনাব সৈয়দ ওয়াজেদুল করিমকে সাধারণ সম্পাদক ও জনাব মোঃ এহসানুল হক সেলিমকে সাংগঠনিক সম্পাদক করিয়া ৩১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। অন্যান্য নির্বাহী সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সর্বজনাব সিরাজুল ইসলাম, চৌধুরী মোহাম্মদ ফারুক, ফোরকান আহমদ, সাহনেওয়াজ খান, আলতাফ হোসেন, চৌধুরী সাইদুর রেজা মানিক, মোশাররফ হোসেন খান (মালেক) ও মীর্জা সফিকুল ইসলাম প্রমুখ। ‘৭১-এর ১লা মার্চ হইতে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলিতে তাহাদের উচ্চকিত “মুক্তিফৌজ গঠন কর বাংলাদেশ স্বাধীন কর” এ বুলন্দ আওয়াজ সারা বাংলায় এক অভূতপূর্ব শিহরণ জাগায়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি লগ্নে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক যে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করে তার সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জনাব মোঃ এহসানুল হক সেলিম।

স্বাধীনতা যুদ্ধে এই সংগঠনের প্রত্যেকেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হইতেছে এই সংগঠনের সভাপতি লুৎফর রহমান ফরিদপুরে পাক বাহিনীর সহিত সম্মুখ যুদ্ধে ধৃত হইয়া নিগৃহিত হন এবং পরবর্তীতে শাহাদত বরণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কোন ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতির স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়া শহিদ হওয়ার গৌরব একমাত্র ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লকেরই। উপরন্তু ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক-এর সবাই মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোনভাবে নিগৃহিত হইয়াছেন।

স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পর ‘৭২ এর ১৪ই জানুয়ারি ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে “স্বাধীনতা বরণ উৎসব” পালন করে। বর্ণাঢ্য সেই অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এক বিশাল ছাত্র জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অংশ বিশেষ পরদিন বাংলাদেশ বেতারে প্রচার করা হয়। সেই অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় বক্তাগণ স্বাধীন বাংলার তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে দেশ থেকে অনতিবিলম্বে ভারতীয় সৈন্য ভারতে ফেরৎ পাঠানোর ব্যবস্থা করা এবং ভারতের সাথে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের কোন গোপন চুক্তি হইয়াছে কিনা, হইয়া থাকিলে তা প্রকাশের দাবি জানান। সেই সভায় বক্তাগণ সরকারের প্রতিটি ভালো কাজে সহযোগীতা এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী যে কোন কার্যক্রমের কঠোর বিরোধীতা করিবার ঘোষণা প্রদান করেন।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হইয়াছিলেন জনাব চৌধুরী মোহাম্মদ ফারুক- পরবর্তীতে ১৯৭৩ এর ডিসেম্বরে সংগঠনের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি সভাপতি ও জনাব আ.হ.ম আবদুল বাতেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একতরফাভাবে ভারত কর্তৃক ফারাক্কার পানি প্রত্যাহার, ২৫ সালা ভারত-বাংলা দাসত্ব চুক্তি, ভারতের সহিত সম্পাদিত সকল গোপন ও অসম চুক্তি বাতিলের আন্দোলনসহ মুজিব বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে এ ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ।

নেতাদের আত্মগোপন

২৭শে মার্চ সকাল ৮টায় সান্ধ্য আইন কিছুক্ষণের জন্য শিথিল হইবার পর পরেই বাংলা মজদুর ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান সিরাজুল হক ইপিআর টিসি’র গাড়ী লইয়া আমার ৭ নং কলেজ স্ট্রীট ধানমন্ডি বাসভবনে আসেন। আমি তাঁহার সহৃদয়তা বিমোহিত ও কৃতজ্ঞ। দেওয়ান সাহেবের গাড়ী লইয়াই আমি সহোদরা বোন সুফিয়া ও তাহার সন্তানদিগকে রেলওয়ে অফিসার্স বাংলো হইতে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে উর্দুভাষী মিসেস রাজিয়া বেগমের হেফাজতে পৌঁছাইয়া বিদায় গ্রহণ করি। রেলওয়ে অফিসারদের বাংলা গুলিতে বাঙ্গালি পরিবারের উপরে নামিয়া আসিয়াছে নারকীয় পরিস্থিতি। সতর্ক সাহসী ও সহৃদয়া মিসেস রাজিয়া বেগম ১৯৭১ সালের ভয়াবহ নয়টি মাস আমার বোনের পরিবারের যুবক-যুবতী ও শিশু-সন্তানদের, বোনের স্বামী রেলওয়ে অফিসার কফিলউদ্দিন আহমদ ও বোনকে আশ্রয় দান করিয়া ইজ্জত ও প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন। তাঁহার নিকট আমরা চিরকৃতজ্ঞ। ভারত হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া আমিও তাঁহার আবাসস্থলে আত্মগোপন অবস্থায় জীবন যাপন করিয়াছি।

২৭শে মার্চ ভোর ৮ ঘটিকা হইতে অপরাহ্ন ৪ ঘটিকা পর্যন্ত এবং ২৮শে মার্চ ভোর ৭টা হইতে দ্বি-প্রহর ১২টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়। পরে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনা করিয়া সান্ধ্য আইন শিথিলের মেয়াদ অপরাহ্ন ৫টা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় এবং পরবর্তী দিবসগুলিতে সান্ধ্য আইন আরো শিথিল করা হয়।

ঢাকায় বাঙ্গালি পুলিশ বাহিনী ও গোয়েন্দা কর্মচারীরা তখন পলাতক। অতএব বাঙ্গালি গোয়েন্দা কর্মচারীর অবর্তমানে সাহসী রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার সহিত যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন ছিল না। তাই আমরা শাহজাহানপুরে দেওয়ান সিরাজুল হকের বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হইয়া উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করিয়া প্রতিরোধ সংগ্রাম সংগঠিত করা এবং প্রতিরোধ শক্তি সংহত করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

বলাই বাহুল্য যে, সরকারি রোষ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপর ছিল প্রচন্ড। তাই আত্মগোপন ছাড়া তাহাদের উপায় ছিল না। সান্ধ্য-আইন শিথিল হইবার সঙ্গে সঙ্গে নগরবাসী প্রায় সকলেই পরিবার-পরিজনসহ ঢাকা ত্যাগে উদ্যোগী হন। এইসব পলায়নপর কাফেলার অন্তর্ভুক্ত নারী ও শিশু সন্তানের চরম কষ্ট স্বচক্ষে না দেখিলে অনুধাবন করা যাবে না। যানবাহন নাই, সম্বল স্বীয় পদযুগল, নিজ নিজ শিরে বাক্স পেটরা, কাঁখে দুধের শিশু। তবু চলিতে হয় জান-মাল-ইজ্জতের তাগিদে। কেহ কেহ দেশ ছাড়ার ব্রতী হয়ে ভিনদেশের অচেনা পরিবেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে। এই কাহিনী লিখা সম্ভব নয়। কারণ, তখনকার দৃশ্য বর্ণনা করিবার জন্য ভাষার উপর যে দখল থাকা দরকার, তাহা আমার নাই। এমনি কাফেলার সঙ্গী হইয়া পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি নেতা জনাব মনসুর আলীসহ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের যুবক সদস্য ডাঃ আবু হেনা নদী পাড়ি দেন এবং অপরতীরে জিঞ্জিরা পথে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব কামারুজ্জামানের সহিত তাহাদের মোলাকাত হয়। তাঁহারা একই সঙ্গে কলাতিয়ার জনাব রতন সাহেবের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। পূর্বাহ্নে ঐ বাড়িতে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং রাত্রে নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন আশ্রয়ের সন্ধানে ঐ বাড়িতে আসেন।

রাত্রির আলোচনা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সর্বজনাব মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমদ ও ডাঃ আবু হেনা ৪ঠা এপ্রিল ভারতের পথে সারিয়াকান্দি পৌঁছেন। পরিবার-পরিজনের জন্য বিচলিত মনসুর আলী স্পীডবোটযোগে সিরাজগঞ্জ যাত্রা করেন। সারিয়াকান্দি হইতে ৪ঠা এপ্রিল (১৯৭১) বগুড়া পৌঁছিয়া জীপযোগে সর্বজনাব কামরুজ্জামান, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমদ ও ডাঃ আবু হেনা পাক-হিলি সীমান্ত অতিক্রম করিয়া ভারতীয় হিলিতে প্রবেশ করেন এবং তা হইতে ৬ই এপ্রিল (১৯৭১) কলিকাতা পৌঁছেন। প্রকাশ, তাঁহারা নাকি পূর্ব ব্যবস্থা মোতাবেক ভবানীপুর এলাকার ডাঃ রাজেন্দ্র রোডের ২৬ নং বাড়িতে পৌঁছান এবং তথায় তাঁহাদের অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। ঐ বাড়িতে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শ্রী ভুজঙ্গ ভূষণ রায় এই ছদ্মনামে বরিশাল জেলা নিবাসী সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য শ্রী চিত্তরঞ্জন সুতার স্ত্রী-পুত্র ও কয়েকজন সহকর্মীসহ বাস করিতেন। প্রকাশ, তিনি ভারত সরকার ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে কাজ করিতেন এবং ভারত সরকারই তাঁহাকে ঐ বাড়ির ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন।

এই সময় কলিকাতায় খবর আসে যে, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম যথাক্রমে মোহাম্মদ আলী, রহমত আলী ছদ্মনামে দিল্লীতে অবস্থান করিতেছেন। তাঁহারা ২রা এপ্রিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সহিত আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। উল্লেখ্য যে, তাহারা উভয়েই ৩০শে মার্চ বনগাঁ পৌঁছিয়াছিলেন। তাহাদের পরিচয় পাওয়া মাত্র বিএসএফের একজন মেজর তাহাদিগকে স্যালুটদানের পর বিওপিতে (Border out post) লইয়া গিয়া যথারীতি আদর-আপ্যায়ন করেন। ইহা জনাব তাজউদ্দিন-এর ১৮ই মার্চ প্রেরিত ম্যাসেজ যথাস্থানে পৌঁছিবার ফল। ওই রাত্রিতেই দিল্লী হইতে তাহাদের উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টার পাঠান হয়। তাহারা দিল্লীর পথে যাত্রা করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭২-এর ১৪ই মার্চ সাংবাদিক সম্মেলনের এক পর্যায়ে উপরোক্ত তথ্য সরবরাহ করা হয়।

পরবর্তী তথ্য হইতে ইহা জানা যায় যে, যশোর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য মোশাররফ আলী সর্বপ্রথম দিল্লী গমন করেন ও ভারতীয় সরকারের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করেন।

অস্থায়ী সরকার

যাহা হউক, কলিকাতায় দলীয় নেতৃবৃন্দের সহিত আলোচনার পর জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম পুনঃ দিল্লী গমন করেন এবং ৫ ও ৬ই এপ্রিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দুই দিবসব্যাপী আলোচনায় ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার ভিত রচিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, জনাব তাজউদ্দিন আহমদের এই দিল্লী অবস্থানকালেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁহার অধিষ্ঠিত হইবার ঘোষণা টেপ রেকর্ডিং করা হয়। ভারত সরকার সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আনিবার জন্য ডাঃ আবু হেনাকে ময়মনসিংহ প্রেরণ করেন। ডাঃ আবু হেনা গারো এলাকাভুক্ত গারোবোদা হইয়া ময়মনসিংহ যান। ৮ই এপ্রিল জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লী হইতে কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহের অন্তর্গত গারো হিলের ঢালু হইয়া ভারতে প্রবেশ করতঃ তুরাতে অবস্থান করিতেছেন- এই খবর পাইয়া জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ও শেখ ফজলুল হক মনি শিলিগুড়ি রওয়ানা হইয়া যান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে লইয়া কলিকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। এইভাবে ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন পথে যেসব নেতা কলিকাতা পৌঁছে, তাহাদের মধ্যে সর্বজনাব মনসুর আলী, কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, মিজানুর রহমান চৌধুরী ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী উল্লেখযোগ্য। ভারত সরকার সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর বিএসএফ-এর কলিকাতা হেড অফিসে অবস্থানের ব্যবস্থা করেন। ভারত সরকারের এবম্বিধ তৎপরতার অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল স্পষ্ট অর্থাৎ যাহাতে ভারত সরকারের অভীষ্ট সিদ্ধি অর্থাৎ পাকিস্তানকে বিভক্ত করার মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া না হয়। অনেক বাক-বিতন্ডার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, কামরুজ্জামানকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করিয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়।

১নং ক্যামাক স্ট্রীটে এম.এল.এ হোস্টেলে (ব্যবস্থাপক পরিষদ সদস্য ভবন) জনাব কামারুজ্জামানের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত ৭৬ জন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে সর্বজনমান্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে উপদেষ্টা করা হয়। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সভায় উপস্থিত ছিলেন না। অধ্যাপক ইউসুফ আলী সভার কার্যবিবরণী ও প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করেন।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সহিত দিল্লীতে আলোচনাকালে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে স্বীয় নাম ঘোষণা এবং ১নং ক্যামাক স্ট্রিট এম.এল.এ হোস্টেলের এই বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাব পরস্পর বিরোধী ও সামঞ্জস্যহীন। এই বিরোধ নিরসনকল্পে সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমদ, কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, আবদুল মান্নান (সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় শ্রমিক লীগ), শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম রব, আমিরুল ইসলাম বার-এট-ল’, মিজানুর রহমান চৌধুরী এক বৈঠকে মিলিত হইয়া ঐকমত্যে পৌঁছান এবং জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে বরণ করিয়া লন। বস্তুতঃ ব্যক্তি তাজউদ্দিন আহমদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করিলে ভারত সরকারের নিকট হইতে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য প্রাপ্তি ঘোরতরভাবে ব্যাহত হবার আশঙ্কা ছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা

১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় ও ১১ই এপ্রিল জনাব তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেতার ভাষণ দেন। ১২ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ৬ সদস্যবিশিষ্ট অস্থায়ী সরকার গঠনের সংবাদ প্রচারিত হয়। ১৩ই এপ্রিল আগরতলা আশ্রয় গ্রহণকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতির আলোকে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। ১৭ই এপ্রিল অপরাহ্ন দেড় ঘটিকায় কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথপুর গ্রামের আম্রকুঞ্জে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। এভাবেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়, ১৯৭১ সালে বৈদ্যনাথপুর আম্রকাননে সেই স্বাধীনতা সূর্যের পুনঃ উদয় হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

“যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হইয়াছিল।

এবং

“যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিলেন।”

এবং

“যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন।”

এবং

“যেহেতু আহূত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন।”

এবং

“যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলোচনাকালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন।”

এবং

“যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।”

এবং

“যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছে এবং এখনও বাংলাদেশে বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে।”

এবং

“যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হইয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে।”

এবং

“যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাহাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে এবং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য- সেইহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।

এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।

রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী।

রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের ক্ষমতা থাকিবে। তাহার করধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকিবে। তাহার গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও উহা মুলতবী ঘোষণার ক্ষমতা থাকিবে। উহা দ্বারা বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতার তিনি অধিকারী হইবেন।

বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার কর্তব্য এবং প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তাইয়াছে উহা যথাযথভাবে আমরা পালন করিব।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে কার্যকরী বলিয়া গণ্য হইবে।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করিবার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করিলাম।”

স্বাক্ষরঃ- এম. ইউসুফ আলী

(বাংলাদেশ গণপরিষদের পক্ষ থেকে)।

রাজনৈতিক সমাধানের শর্তাবলী

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণার পর দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল কর্তৃক রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাবের জওয়াবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ৬ই জুন বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে প্রচারিত ভাষণে নিম্নোক্ত শর্তাধীনে রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব দেন :

১। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দান,

২। বাংলার মাটি হইতে পাক-বাহিনী প্রত্যাহার,

৩। বঙ্গবন্ধু ও ধৃত জনপ্রতিনিধিদের অবিলম্বে মুক্তিদান,

৪। আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ নির্ণয় ও ক্ষতিপূরণ দান।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৮শে জুন (১৯৭১) এক বেতার ভাষণে অনুপস্থিত, পলাতক সদস্যদের আসন শূন্য ঘোষণা করিয়া জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনগুলিতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সাধারণ্যে প্রকাশ করেন। উদ্দেশ্য জনপ্রতিনিধিদের হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর।

৫ ও ৬ই জুলাই (১৯৭১) বাংলাদেশ হইতে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের এক যুক্ত অধিবেশনে ভাষণদানকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দুইমুখী নীতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করিয়া বলেন, *…বঙ্গবন্ধুর আদেশে ও নির্দেশে আমি এবং আপনাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন সাহেব আলোচনা শুরু করিলাম। জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেবের পক্ষে ছিলেন লেঃ জেঃ পীরজাদা। … আলোচনা চলিতে থাকিল। ২৪শে মার্চ পর্যন্ত আলোচনা হইল। আমার বন্ধু তাজউদ্দিন উপস্থিত। আমি বারবার এই কথা বলিয়াছি, এই আলোচনা কোনকালেই ব্যর্থ হয় নাই। ২৪ তারিখে ডকুমেন্ট (Document) তৈরি হোল। অথচ ২৫শে মার্চ রাত্রে অতর্কিতে হামলা হইল নিরস্ত্র অপ্রস্তুত বাংগালীর উপর। তাই বিশ্বাসঘাতক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ২৮শে জুন পরিকল্পনার দাঁতভাংগা জওয়াব লড়াই-এর মাঠে দেওয়ার সংকল্প বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীত করিয়া সর্বাধিনায়ক ও কর্নেল আবদুর রবকে চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করেন। বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ১১ এপ্রিল-এর বেতার ভাষণে মেজর শফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর খালেদ মোশাররফকে যথাক্রমে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চল ও শ্রীহট্ট-কুমিল্লা অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার হিসাবে ঘোষণা করেন।

পরবর্তীতে রণাঙ্গন অর্থাৎ সমগ্র বাংলাদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এই সেক্টরগুলির নেতৃত্ব বা কমান্ডে যাহারা বিভিন্ন সময়ে ছিলেন তাহাদের নাম নিম্নে দেওয়া হইল :

সেক্টর ১।               (ক) মেজর জিয়াউর রহমান (জুন পর্যন্ত)

                (খ) ক্যাপ্টেন মোঃ রফিক (জুন হইতে ডিসেম্বর)

সেক্টর ২।               (ক) মেজর খালেদ মোশাররফ (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)

(খ) মেজর এ.টি.এম. হায়দার (সেপ্টেম্বর হইতে ডিসেম্বর)

সেক্টর ৩।              (ক) মেজর কে. এম. শফিউল্লাহ (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)

(খ) মেজর এ.এন.এম. নূরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর হইতে ডিসেম্বর)

সেক্টর ৪।               মেজর সি.আর. দত্ত

সেক্টর ৫।              মেজর মীর শওকত আলী

সেক্টর ৬।              উইং কমান্ডার এম, কে, বাশার

সেক্টর ৭।               মেজর কাজী নুরুজ্জামান।

সেক্টর ৮।              (ক) মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত)

                (খ) মেজর এম.এ. মনজুর (আগস্ট থেকে ডিসেম্বর)।

সেক্টর ৯।               (ক) মেজর এম.এ. জলিল (ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত)

(খ) মেজর জয়নাল আবেদীন (যুদ্ধের শেষ কিছুদিন)

সেক্টর ১০। হেড কোয়ার্টার পরিচালিত কমান্ড বাহিনী

সেক্টর ১১। (ক) মেজর আবু তাহের (আগস্ট হইতে নভেম্বর)

 (খ) ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম. হামিদুল্লাহ (নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর)

ইহা ছাড়া নৌ-কমান্ডাররা নির্দিষ্ট মিশনে নিয়োজিত হইলে তাহারা সংশ্লিষ্ট কমান্ডারদের অধীনে কাজে নিয়োজিত থাকিতেন।

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের প্রায় ১৪ হাজার বাঙ্গালি নওজোয়ান, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৩ হাজার নওজোয়ান ও ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ, আনসার মোজাহিদদের লইয়া পুনর্গঠিত সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়। সেক্টর কমান্ডারদের নামের ইংরেজি অধ্যাক্ষরে ‘এস (S) ফোর্স, ‘জেড (Z) ফোর্স ও কে (K) ফোর্স নামে মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্তি ও পরিচিতি লাভ করে। উল্লেখ্য যে, নিউজ উইকের সিনিয়র এডিটর আরনয়নড ডি. ব্রগ্রেডের সহিত সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রকাশ করেন যে, ৬ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য, পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস হইতে মোট ৬০ হাজার সশস্ত্র বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতেছে (পাকিস্তান টাইমস, ৭/১১/৭১)।

ঢাকা ত্যাগ

২৫শে মার্চের পর কারফিউ তুলিয়া নেওয়া হইলে আমি ঢাকা নগরে বেবী ট্যাক্সিতে সর্বত্র সকাল-সন্ধ্যা ঘোরাফেরা করিতাম। স্বচক্ষে পাক-বাহিনীর অত্যাচার, জুলুম হত্যাযজ্ঞের চিহ্নসমূহ পরিদর্শন করিতাম। সুবিধা ছিল, বাংগালীরা মর্মাহত ও ঐক্যবদ্ধ, কেহ কাহারো বিরুদ্ধে কোন সংবাদ অত্যাচারী সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষকে কর্ণগোচর করিত না। এমনি অবস্থায় সাপ্তাহিক জনতা সম্পাদক আনিসুজ্জামানের সহিত তাহার শেখ সাহেব বাজারস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করি। পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের পর জনাব আনিসুজ্জামান আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের সহিত যোগাযোগ করার জন্য কলাতিয়া যাইতে সম্মতি জানান এবং তদানুযায়ী ৩১শে মার্চ তিনি কলাতিয়ার পথে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১লা এপ্রিল কলাতিয়া হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া জনাব আনিসুজ্জামান আমাদিগকে জানান যে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁহার কলাতিয়া পৌঁছিবার পূর্বেই ভারতের পথে রওয়ানা হইয়া গিয়াছেন।

আমি জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করিতাম এবং মাঝে মাঝে তোমার অভয়দাস লেনের বাসায় রাত্রিযাপন করলাম। তাহার বাসায় রাত্রিযাপন করিতে গিয়া তাঁহারই রেডিও সেটে ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হইতে স্বাধীন বাংলা’র ঘোষণা শুনিতে পাই। চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে ‘স্বাধীন বাংলার’ ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিশাহারা, হতভম্ব, সম্বিতহারা ও মুর্ছিতপ্রাণ বাংগালী জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াই-এর সংবাদ। ফলে সর্বত্র উচ্চারিত হয় মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতনের সংকল্প, আওয়াজ উঠে- জালেমের নিকট আত্মসমর্পণ নয়, আহ্বান ধ্বনিত হইতে থাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার, প্রতিরোধ শক্তিকে সুসংহতকরণের। এইভাবেই সেদিন জাতি আত্মসম্বিৎ ফিরিয়া পায় এবং মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

যাহা হউক, জনাব আনিসুজ্জামানের রিপোর্ট শুনিবার পর আমি ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সহিত সাক্ষাতের আশা ত্যাগ করিয়া আগরতলায় যাওয়ার মনস্থির করি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত করি এবং বিভিন্ন গ্রুপে বাংলা জাতীয় লীগ কর্মীদিগকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছড়াইয়া পড়ার নির্দেশ দান করি। স্থানীয় পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করিয়া স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দিবার ও দলমত নির্বিশেষে প্রতিরোধ শক্তিকে সুসংহত করিবার আহ্বান জানাই। ঢাকা নগরীকে যোগাযোগ রক্ষার কেন্দ্রস্থল ঘোষণা করি। আমরা মুক্তি সংগ্রামের একটি দলীয় কর্মসূচী প্রণয়ন করি এবং কর্মীদের উদ্দেশ্যে উহার মাধ্যমে যথাযথ নির্দেশ দিয়া সবাইকে মুক্তি সংগ্রামের মূল প্রতিরোধ শক্তি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সহিত যোগাযোগ করিবার নির্দেশ দেই। এইভাবে সবকিছু ঠিকঠাক করিয়া দিয়া আমি ৩রা এপ্রিল আগরতলার পথে ঢাকা ত্যাগ করি। জনাব গাফফার চৌধুরীর আমাদের সহিত যাইবার কথা ছিল কিন্তু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে তিনি নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা করিতে পারেন নাই।

যাত্রা পথে দেওয়ান সিরাজুল হক ও আমি ডেমরা ও নরসিংদী অতিক্রম করিয়া নবীনগর পেছি এবং নবীনগরে আমার বড় ভাইয়ের শ্বশুর জনাব আমীর আলী খান সাহেবের বাড়িতে রাত্রিযাপন করিয়া ৪ঠা এপ্রিল ভোরে লঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই। সেখানে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য লুৎফল হাই সাচ্চুর সহিত উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হয়। মেজর খালেদ মোশাররফ তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্ত এলাকার প্রতিরক্ষা ব্যুহের সিপাহসালার।

এরপর আমি ও দেওয়ান সিরাজুল হক আখাউড়া যাই এবং আখাউড়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এম,এ, তাহেরের আতিথ্য গ্রহণ করি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হইতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য আলী আজম ভূঁইয়া আগরতলায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পক্ষ হইতে ৮ই এপ্রিল আমাদের সহিত রাজনৈতিক আলোচনা করিবার জন্য আখাউড়া আসেন এবং আমরা এম.এ. তাহেরের বাসভবনে আলোচনা বৈঠকে মিলিত হই। বৈঠকে আমরা নিম্নলিখিত ঐকমত্যে পৌঁছি :

১। ভারতীয় সৈন্যকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে না।

২। মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর ভারতীয় হিন্দু বাংগালীদের বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে না।

৩। লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী সার্বভৌম ও স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠন। পূর্ব পাকিস্তান ভারত ভুক্ত অংশ হবে না।

৪। মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর দেশে কোন ফৌজি শাসন কায়েম হইবে না।

জনাব আলী আযম ভূঁইয়া সহিত আলোচনার পর আমি পুনরায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রত্যাবর্তন করি। ১৪ই এপ্রিল অপরাহ্ন তিন ঘটিকার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান হামলা হয়। ১৫ এপ্রিল ভোরে পুনরায় পাক বিমান বাহিনীর হামলা চলিল। বিমান হামলার পর আমি ও দেওয়ান সিরাজুল হক পুনরায় আখাউড়া পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করি পরে আমরা আখাউড়া হইতে সীমান্ত গ্রাম চাঁদপুরে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং এইভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করি যাহাতে প্রয়োজন দেখা দিলে আত্মরক্ষার কারণে যেন ত্বরিত ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারি। পাক হাওয়াই হামলায় পর্যুদন্ত মুক্তিবাহিনী ও বেঙ্গল আর্মি বিনা যুদ্ধে ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গোপনাঘাট, উজানীসার ও আজমপুর হইতে পশ্চাদপসরণ করে এবং অনায়াসেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাক বাহিনীর করায়ত্ত হয়।

সীমান্ত গ্রামগুলি পাক বাহিনীর বিষমদৃষ্টি মূক্ত নয় এই আশংকায় ও সীমান্তের অপর পাড়ে সরকারের নিকট হইতে বাস্তব সাহায্যের আশায় ও মুক্তিকামী সহযোগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহিত ঐক্যবদ্ধ কর্মপন্থা নির্ধারণকল্পে আমরা পরিশেষে সীমান্ত অতিক্রম করিয়া আগরতলায় পৌঁছি।

ভারতের অভিজ্ঞতা

আগরতলায় লক্ষ্য করি, আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও সমর্থক ব্যতীত অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তবে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী দলগুলির সংকট চরম ও বর্ণনাতীত ছিল। আওয়ামী লীগ প্রকৃত জাতীয়তাবাদী দল ছিল না, ইহা ছিল বরং ক্ষমতা লিন্সু, নীতি বিবর্জিত রাজনৈতিক কর্মীদের সমাবেশ মাত্র। তাই বলিয়া আওয়ামী লীগে যে কিছুসংখ্যক আদর্শবাদী নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন না, তাহা নহে, তবে তাহারা ছিলেন ব্যতিক্রম।

কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও তাহাদের গণ-সংগঠন কর্মীদের আহার ও বাসস্থানের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কো বা পিকিং)। আমরা জাতীয়তাবাদী দলগুলো তাহাদের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা দল, সেই বোধটুকু তাহাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নাই। তাহারা ছিল আত্মস্বার্থগত প্রাণ, আত্মবিলীনগত প্রাণ নহে। মন্তব্যটি কটু শুনাইলেও নির্মম সত্য।

আগরতলায় আমি স্বল্পবেতনভুক সরকারি কর্মচারী বাবু সুধীরচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করি। মহৎপ্রাণ সুধীর বাবুর আতিথেয়তা ও অমায়িক ব্যবহার আমার স্মৃতিপটে চিরজাগরুক থাকে। তাঁরই বাসভবনে জনাব সিরাজুল আলম খান ও জনাব আ স ম আবদুর রবের সহিত মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তাঁহারা আমার সহিত নীতিগতভাবে একমত হলেও বাস্তবে ১৬ই ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের মহড়া দিয়াছেন, কিন্তু বাংলার মাটিতে দাঁড়াইয়া মাতৃভূমির মুক্তির জন্য পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েন নাই। তাহারা উভয়েই পৃথক পৃথক আলোচনায় আমাকে কলিকাতার অস্থায়ী সরকার প্রধান তাজউদ্দিন আহমদের সহিত দেখা করিবার প্রস্তাব দিলে আমি তাহাদিগকে বলি, প্রথমে আমার বুঝা দরকার, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ভারতের ক্রীড়নক শক্তি কি না, দ্বিতীয়তঃ ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হইবে, নাকি বঙ্গসন্তানরাই বঙ্গের স্বাধীনতা পরিচালনা করিবে। যদি ভারতীয় সৈন্য সশরীরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের মাটিকে পাক বাহিনীমুক্ত করে, তাহা হলে কার্যক্ষেত্রে আমরা ভারতের ক্রীড়নক রাষ্ট্রে পরিণত হইবে। তৃতীয়তঃ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বাংলা জাতীয় লীগের মতো সহযোগী স্বাধীনতা কামী দলগুলির সহিত যুক্তভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করিতে সম্মত আছে কি না? চতুর্থতঃ এখানকার অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতেছে আপনাদের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নহে। চতুর্থ মন্তব্যের উত্তরে আ স ম আবদুর রব দৃঢ়তার সহিত বলিলেন, ভারত সরকার জানেন, আমাদের শক্তি আছে কি-না। তাই “ভারত সরকার আমাদিগকে পৃথকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় বাস্তব সাহায্য দিবে, এই মর্মে আমরা (সিরাজুল আলম গ্রুপ) আশ্বাস পাইয়াছি।” কথা প্রসঙ্গে তিনি আমার সাথে এই বিষয়ে একমত হলেন যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করিতে হইবে। সিরাজুল আলম খান এখন কলিকাতা রওয়ানা হওয়ার পথে। তিনি বলিলেন যে, কলিকাতায় অবস্থানরত অস্থায়ী সরকারের সহিত আমার বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করিয়া আমাকে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এর মাধ্যমে ফলাফল জানান। সিরাজুল আলম খান কলিকাতা গেলেন বটে, তবে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কোন উত্তর আমাকে কখনও পাঠান নাই। সেদিন আমি যে আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলাম, পরবর্তীকালে হয়েছে তাহাই। ভারত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতেই পাকিস্তানের অভ্যুদয় লগ্ন হইতে পাকিস্তান ধ্বংস চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ অব্যাহত রাখিয়াছে আর আমরা আমাদের নিজস্ব প্রয়োজনে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা চাহিয়াছি। ইহা শুধু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নয়, অনুধাবনের বিষয়।

যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত বাংলা জাতীয় লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম.এম. আনোয়ারের উদ্যোগে আগরতলা এসেম্বলি মেম্বার রেস্ট হাউসে আমার ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মালেক উকিলের মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর এক দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্ত অবধি কোন নির্দেশ দান করেন নাই। এদিকে মুজিব-ইয়াহিয়ার মার্চ-এর আলোচনার সূত্র ধরিয়া কনফেডারেশন প্রস্তাবের ভিত্তিতে সমঝোতার আলোচনা চলিতেছে। জনাব মালেক উকিল আমাকে ইহাও জানান যে, তিনি এই আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে আশাবাদী। প্রসঙ্গত ইহা উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে আমি সর্বজনাব আবদুল মালেক উকিল, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল হান্নান চৌধুরী, আলী আজম, খালেদ মোহাম্মদ আলী, লুৎফুল হাই সাচ্চু প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার সহিত বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে আলোচনাকালে নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বা লক্ষ্য সম্পর্কে কোন নির্দেশ দিয়েছেন কিনা, জানিতে চাহিয়াছিলাম। তাহারা সবাই স্পষ্ট ভাষায় ও নিঃসঙ্কোচে জবাব দিলেন যে, ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর আকস্মিক অতর্কিত হামলার ফলে কোন নির্দেশ দান কিংবা পরামর্শ দান নেতার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। অথচ স্বাধীনতা উত্তরকালে বানোয়াটভাবে বলা হয় যে, তিনি পূর্বাহ্নে নির্দেশ প্রদান করিয়াছিলেন। শুধু তাই নয়, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৭ই এপ্রিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে ঘোষণা করেন যে, তিনি নির্দেশনামা জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীকে পাঠাইয়াছিলেন। কথিত সেই নির্দেশনামাটি নিম্নরূপ :

DECLARATION OF WAR OF INDEPENDENCE

BY

BANGABANDHU SK. MUJIBUR RAHMAN

A historic message from Bangabandhu Sk. Mujibur Rahman conveyed to Mr. Zahur Ahmed Chowdhury on 25th March, 1971 at 11.30 hours immediately after crackdown of Pak Army.

“Pak army suddenly attacked E.P.R. base at Pilkhana, Rajarbagh Police line and killing citizens, Streets battles are going on in every street of Dacca, Chittagong. I appeal to the nations of the World for help. Our freedom fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, E.P.R; Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight. No compromise, Victory is ours. Drive out the last enemy from the holy soil of motherland. Convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah bless you.

“Joy Bangla”

Sk. Mujibur Rahman

(This message was communicated from Teknaf to Dinajpur and to friendly countries through some vessels which were anchored at Bay of Bengal near Chittagong by Mr. Zahur Ahmed Chowdhury)

পাক বাহিনীর আক্রমণের অব্যবহিত পর রাত সাড়ে ১১টায় (২৫শে মার্চ, ১৯৭১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট প্রেরিত একটি ঐতিহাসিক বাণী : (অনুবাদ)

“পাক বাহিনী আকস্মিকভাবে পিলখানাস্থ ইপিআর বেইজ এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করিয়াছে এবং নাগরিকদের হত্যা করিতেছে। ঢাকা চট্টগ্রামে প্রতিটি রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলিতেছে। আমি সাহায্যের জন্য বিশ্বের জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর সহিত বীরের মতো যুদ্ধ করিতেছে। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার নামে দেশকে মুক্ত করিবার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আপনাদের প্রতি আবেদন জানাইতেছি এবং নির্দেশ প্রদান করিতেছি। পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং আনসারদের আমাদের পাশে দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিবার জন্য নির্দেশ প্রদান করুন। কোন আপোষ নাই, বিজয় আমাদেরই হইবে।

মাতৃভূমির পবিত্র মৃত্তিকা হইতে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপিয়াসী ব্যক্তিদের নিকট এই বাণী পৌঁছিয়ে দিবেন। আল্লাহ আপনাদের সহায় হউন।

জয় বাংলা

শেখ মুজিবুর রহমান

উপরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাক্ষ্য অনুসারেই শেখ মুজিবুর রহমানের এই দাবি যে বিতর্কের উর্ধ্বে নয়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র” গ্রন্থাবলীতে প্রকাশিত বার্তাটি হচ্ছে “এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যেখানেই আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে দখলদার বাহিনীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিরোধ করুন। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কার এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।” উপরোক্ত বক্তব্য হুবহু ভারতীয় বৈদেশিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত “বাংলাদেশ ডকুমেন্টসেও” পূর্বাহ্নে ছাপা হয়। অবশ্য একথা সত্য যে, সেইদিন আমার মতো কোটি কোটি উৎকন্ঠিত বাঙ্গালিপ্রাণ উল্লিখিত অনুরূপ একটি নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল।

শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার কোন ঘোষণা দেন নাই তার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১-এর ৬ই নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাষণ দেন সে ভাষণে। সেই ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন,

…The cry for Independence (of Bangladesh) arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He (Mujib) himself, so far as I know has not ask for Independence even now…

“স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠে (বাংলাদেশের) শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর তার আগে নয়। আমি যতদূর জানি আজো পর্যন্ত শেখ মুজিব স্বাধীনতা দাবি করেননি।”

পক্ষান্তরে সেই অন্ধকার ও সংকটময় মুহর্তে ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হইতে ভাসিয়া আসিয়াছিল একটি নির্ভয় বীরদপী বিদ্রোহী কণ্ঠ। এই কণ্ঠই সেইদিন লক্ষ কোটি বাঙ্গালিকে দিয়াছিল অভয়বানী, ডাক দিয়াছিল মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতে। কণ্ঠে বেঙ্গল আর্মি মেজর জিয়াউর রহমানের। উক্ত ঘোষণার অংশ বিশেষ হইল :

I major Ziaur Rahman head of the provisioner revolutionary Government of Bangladesh do hereby proclaim and declare the Independence of Bangladesh…. and also appeal to the all Democratic socialist and other countries of the world to immediate recognise our country Bangladesh. .. Insha Allah victory is ours.

“প্রিয় দেশবাসী, আমি মেজর জিয়া বলছি। এতদ্বারা আমি স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি… বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও অপরাপর রাষ্ট্রসমূহকে অনতিবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।… ইনশা আল্লাহ জয় আমাদের সুনিশ্চিত।”

পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংশাধিত ঘোষণা নিম্নরূপ :

I major Ziaur Rahman on behalf of our great Leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman supreme commander and head of the provisional Revolutionary Govt of Bangladesh do hereby proclaim and declare the Independence of Bangladesh…

সময়োপযোগী নেতৃত্বদানের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া নির্দেশ প্রদানের একটি ঘোষণা পত্র ছাপাইয়া সাধারণ্যে বিলি করিয়াছেন। ইহা না করিয়া তাহার উচিত ছিল সময়োপযোগী অবদানের জন্য মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতিদান, ইহা হইত নেতাসুলভ আচরণ। তাহার মানসিকতার কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাভাবিকভাবেই তাহা করিতে ব্যর্থ হন। ইহা অতীব পরিতাপ এবং দুঃখের বিষয়। যাহা হউক, মেজর জিয়ার বলিষ্ঠকণ্ঠস্বর সেইদিন বাংগালী জাতিকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল কবির সেই অভয় বাণী :

“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী

ভয় নাই ওরে ভয় নাই;

নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”

এই ভাবেই মেজর জিয়ার সেই ঘোষণা বাঙালি জাতির ধমনীতে সেইদিনের সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে জোগাইয়াছিল ঐশ্বরিক শক্তি; মনে-প্রাণে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছিল দৃঢ় প্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ। ফলকথা, সেইদিন বাঙালির নিজস্ব সত্ত্বায় আত্মস্থ ও বলীয়ান করিবার জন্যই যেন মেজর জিয়ার আবির্ভাব ঘটিয়াছিল।

শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আপামর জনতার সার্বিক গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন এবং কীভাবে তিনি বাংগালী জনতার একচ্ছত্র ও অবিসংবাদিত নেতার আসনে আসীন হয়। ২৫শে মার্চ (১৯৭১) মধ্যরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের খবর পূর্বাহ্নে জ্ঞাত হইয়াও তিনি তদমুহূর্তে জাতির মরণপণ সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় স্বীয় বাসভবনে অবস্থান করিয়া হানাদার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ইতিহাস সচেতন মাত্রই জ্ঞাত যে, ১৯৪২ সালের আগস্টের অহিংস আন্দোলনের মহাপ্রাণ মহাত্মা গান্ধী ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়’ (Quit India) আন্দোলনের ডাক দিলে কারারুদ্ধ গান্ধী পন্থী লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ ‘হাজারীবাগ’ কারাগার হইতে পলায়ন করিয়া সশরীরে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তদ্রূপ শাসক ফরাসীদের বিরুদ্ধে আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধে শরীরে নেতৃত্বদানের উদ্দীপনায় বিপ্লবী আহমদ বেনবেল্লাহ কারাগার হইতে পলায়ন করেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা জ্ঞাত হওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৬২ সালে গোপনে দেশ ত্যাগ করে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদী রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ার জন্য সভা-সমিতি করেন। এমনকি লন্ডনে জনমত গড়ার জন্য আত্মগোপন অবস্থায় তাহার বক্তব্য দিতে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। অতঃপর আত্মগোপন অবস্থায় দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। আমরা দেশবাসী পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শরীরে সেনাপতিত্ব চাহিয়াছিলাম- পাক হানাদার বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ চাই নাই। তথাপি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বিশাল সাংগঠনিক শক্তির কারণেই দেশবাসী তাহার নামেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণে কুণ্ঠাবোধ করে নাই।

প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম বেতার মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা ও মেজর জিয়া

স্বাধীনতা যুদ্ধ হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয় কিংবা হঠাৎ করে রেডিওতে ভেসে আসা কোন এক ব্যক্তির ঘোষণা সারা দেশের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লে এমনও নয়। একটি দেশের একটি জাতির, স্বাধীনতা সংগ্রাম দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিরই ফসল। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত সংঘাত-আত্মত্যাগ আর আত্মাহুতির বিনিময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট গড়ে উঠে। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, আন্দোলন-সংগ্রাম আর জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের চরম পরিণতিরই ফলশ্রুতি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হইতে পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি শাসক-শাসকগোষ্ঠী নিজেদেরকে ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে আসীন রাখার মানসে ছলে বলে কৌশলে আমাদেরকে তাহাদের পদানত রেখে কখনো ইসলামের নামে কখনো গণতন্ত্রের নামে বিভিন্নভাবে তাহাদের শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখে। আমাদের ভাষা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি উপর চালায় আগ্রাসন। এরই সূচনা হয় ১৯৪৮ সালে আমাদের মাতৃভাষার উপর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। এরপর রক্তস্নাত ‘৫২-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর নির্বাচনে এ অঞ্চলে মুসলিম লীগের ভরাডুবির মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয়, ‘৬২-এর আইউবী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ‘৬৬-এ শেখ মুজিবের ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ‘৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন তথা আইউব শাহীর বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ৬ দফার পক্ষে এদেশের মানুষের ম্যান্ডেট স্বায়ত্তশাসন, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ‘৫৫ এবং ‘৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর পাকিস্তানকে আস্সালামু আলাইকুম, -এ নির্বাচন বর্জন করে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা, ‘৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে নিয়মমাফিক ক্ষমতা হস্তান্তর না করে চক্রান্তের আশ্রয় গ্রহণ- সবকিছু মিলিয়ে ২৩ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর বেদনাই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর পাক বাহিনীর নগ্ন হামলার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সারাদেশে একই আওয়াজ- “মুক্তিফৌজ গঠন করো বাংলাদেশ স্বাধীন করে” ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে এদেশের সর্বস্তরের মানুষ তখন স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত।

অবস্থা এমন দাঁড়ায় সমস্ত বেসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে শেখ মুজিবের হাতে। সমস্ত দলমত ছাপিয়ে শেখ মুজিব হয়ে যান একচ্ছত্র নেতা। স্বাধীনতার প্রশ্নে দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী বিজয়ী দলের নেতা হিসাবে শেখ মুজিবকে মেনে নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একছত্র নেতা হিসেবে জাতীয় স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে। ২৫শে মার্চ কালো রাত্রির পর চট্টগ্রামেও সঙ্গত কারণেই বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ছিল। ২৬শে মার্চ বেলা ২টায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে একটি ঘোষণা দেয়। যে কোন কারণেই হোক সেটি অনেকের গোচরীভূত হয়নি। পরে নেতৃবৃন্দ দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে সংঘবদ্ধ করা এবং দেশবাসীর মনে সাহস সঞ্চারের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর একজন বাঙালি অফিসার দিয়ে বতারে একটি ঘোষণা প্রদানের পরিকল্পনা করে। তৎকালীন ইপিআর-এর দায়িত্বে নিয়োজিত ক্যাপটেন রফিক বাংগালীদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার হিসেবে ৮ম ইষ্ট বঙ্গেল রেজিমেন্টের মেজর জিয়ার কথা বলেন। মেজর জিয়া এতে সম্মত হবেন কিনা এ ব্যাপারে নেতৃবৃন্দের মনে সংশয় ছিল। কেননা চট্টগ্রাম বন্দরে ২৪শে মার্চ বাংগালী শ্রমিকরা করাচি হইতে আগত সোয়াত জাহাজ হইতে অস্ত্র খালাশের কাজ বন্ধ করে দিলে বন্দরের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ পরিস্থিতিতে এম. এ. হান্নান, এস.এম ইউসুফসহ কতিপয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ বন্দরে যায়। সেখানে তাহাদের সাথে মেজর জিয়ার সাক্ষাৎ হয় নেতৃবৃন্দ মেজর জিয়াকে বাংগালীর স্বাধীকারের আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে সহযোগীতা করার কথা বললে তিনি রাগান্বিত হয়ে তাহাদের বলেন- You know I am a disciplined Army. I can not take the risk of my job and life. You politicians are created the problems and make the country unstable. What do you think you will liberate the country? It is not possible. Situation will be under control within short time. I am the last man to go with you. এই যার অবস্থান তাকে দিয়ে বেতারে ঘোষণা সম্ভব কীভাবে? তবুও তারা তাহাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ২৬শে মার্চ মেজর জিয়া যথারীতি সোয়াত জাহাজ হইতে অস্ত্র খালাসের জন্য সেনানিবাস হইতে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে বের হবার পর পরই পাকবাহিনী সেনানিবাসে অবস্থানরত মেজর জিয়ার ইউনিটসহ সকল বাংগালী সৈনিকদের নিরস্ত্র করে ফেলে। এমনি অবস্থায় যে কয়জন বাইরে আসতে পেরেছেন তার মধ্যে ল্যাঃ শমসের মুবিন চৌধুরী সেনানিবাসের পরিস্থিতি মেজর জিয়াকে অবহিত করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করিতে তার সাথে যোগাযোগ করিতে বন্দর অভিমুখে ছুটে যান। টাইগার পাশ এলাকায় জিয়ার সাথে তার সাক্ষাৎ হলে গাড়ী থামিয়ে জিয়াকে সেনানিবাসের পরিস্থিতি জানান। জিয়া তার কথায় বিশ্বাস না করে তাকে ধমক দেন। শমসের মবিন তাকে সেনানিবাসে টেলিফোন করে সত্যতা যাচাই করিতে বলেন। টেলিফোনে তার ইউনিট কিংবা বাসভবনে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে শমসের মবিনের কথায় তার বিশ্বাস হয়। অতঃপর তারা সেনানিবাসে ফিরে গিয়ে অতর্কিতে তার কমান্ডার কর্নেল জানজুয়াকে হত্যা করে পরিবার পরিজনকে সেনানিবাসে ফেলে রেখে তার ইউনিটের সৈনিকদের নিয়ে সেনানিবাস ত্যাগ করেন। প্রথমে কক্সবাজার চলে যান, পরে সেখান থেকে ফিরে এসে গোমদন্তীতে আশ্রয় নেন। এদিকে ২৭শে মার্চ প্রত্যুষে কালুরঘাটে অবস্থিত চট্টগ্রাম বেতারের বিপ্লবী কর্মীরাও অদূরে বাংগালী সেনাদের অবস্থানের খবর পেয়ে তাহাদের সাথে যোগাযোগ করে। সেখানে তারা মেজর জিয়াকে বেতারে একটি ঘোষণা দিতে এবং ট্রান্সমিশন কেন্দ্র পাহারা দিতে কয়েকজন সৈনিক দেবার অনুরোধ করে। মেজর জিয়া এতে রাগান্বিত হয়ে তাহাদের ফিরিয়ে দেন। অবশ্য কিছুক্ষণ পরে তিনি কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্র পাহারার জন্য ৮ জন সৈনিক পাঠান। তারপর হঠাৎ করে নিজে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন এবং ট্রান্সমিশন কেন্দ্র থেকে নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তার এই ধরনের ঘোষণায় নেতৃবৃন্দ হতভম্ব হয়ে পড়েন। পরে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী জনাব এ.কে. খান সাহেব তার বাসভবনে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে নিজ হাতে মেজর জিয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের পক্ষে ঘোষণার জন্য সংশোধিত ঘোষণাটি লিখে দেন।

এই সংশোধিত ঘোষণাটি মেজর জিয়া সেদিনই ২৭শে মার্চ সন্ধ্যে ৭-৩০ মিঃ ইংরেজিতে পাঠ করেন এবং কিছুক্ষণ পর পর পুনঃ পুনঃ প্রচারিত হইতে থাকে। অবশ্য এর মধ্যে এই ঘোষণার বাংলা অনুবাদ প্রচারিত হইতে থাকে। ঘোষণাটি নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :

I Major Ziaur Rahman on behalf of our great leader, the supreme commander of Bangladesh Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, do hereby proclaim and declare the Independence of Bangladesh, and that the government headed by Bangabandhu Sheik Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of Seventy five million people of Bangladesh and the Government headed by him is the only legitimate government of the people of the independent sovereign state of Bangladesh which is legally and constitutionally formed and is worthy of being recognised by all the government, of the world. I therefor appeal on behalf of our great leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the Democratic, Socialist and other countries of the world specially the big powers and the Neighbouring countries to recognise the legal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. To dub out the legally elected representative of the majority of the peoples as secessionist is a crude joke and contradiction to truth which should be fool none. The guiding principle of the new state will be first Neutrality. Second peace and third friendship to all and enmity to none. May Allah help us. Joy Bangla.

এটাই হলো জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার ইতিহাস। বিভিন্ন স্থান থেকে এ ধরনের ঘোষণা এসেছে যেমন কুষ্টিয়া থেকে ইপিআর-এ দায়িত্বে নিয়োজিত ক্যাপটেন আবু ওসমান চৌধুরী, গাজীপুর থেকে তৎকালীন মেজর সফিউল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তিতাস গ্যাসের মাইক্রোওয়েভ এর মাধ্যমে মেজর খালেদ মোশাররফ। তবে ওই সব ঘোষণা ছাপিয়ে জিয়ার ঘোষণাই বেশি সাড়া জাগিয়েছে এ কারণে যে, কালুরঘাট টান্সমিশন কেন্দ্রটি ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল। এ কারণে এর ব্যপ্তি ছিল বেশী। জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি তৎকালীন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত দেশবাসীকে নতুন করে সাহস আর আত্মবিশ্বাসের অভয়বাণী শুনিয়ে ছিল এবং উদ্যোমে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার প্রেরণা যুগিয়ে ছিল। এতে কিন্তু জিয়ার কোন একক কৃতিত্ব নাই- এটা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা আর কার্যক্রমের মধ্যে একটি। পরে জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার হিসাবে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন এবং যুদ্ধোত্তর কালে বীরত্বের জন্য বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হন এবং শেখ মুজিব শাসনামল ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডিপুটি চীফ অব স্টাফ এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তার বাহিনীর নাম ছিল ‘জেড ফোর্স’। ২৫ থেকে ২৭শে মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তৎকালীন ক্যাঃ রফিক, ক্যাঃ মীর শওকত আলী, লেঃ অলি আহমদ, ল্যাঃ শমসের মুবিন চৌধুরী, ক্যাঃ সুবেদ আলী ভূঁইয়ার অবদান অনস্বীকার্য।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান

আজাদী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান ছিল বর্ণনাতীত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা করে সৈয়দ আব্দুস শাকের, মোস্তফা আনোয়ার, রেজাউল করিম চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, আবুল কাসেম (সন্দ্বীপ), আমিনুর রহমান, বেলাল আহমদ, সরফুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও কাজী হাবিবুদ্দিন বাংলা মায়ের এই দশজন দামাল ছেলে ২৬শে মার্চ কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ও রিসেপশন কেন্দ্র এবং আগ্রাবাদ ব্রড কাস্টিং স্টেশন দখল করেন। ৩০শে মার্চ কালুরঘাট বেতার ভবনে পাক বাহিনী বোমা বর্ষণ করিলে তাহারা ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারসহ গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেন। ৩রা এপ্রিল হইতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণোদ্যমে চালু হয়।

২৯শে মার্চ উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে, শেখ মুজিব মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেই আছেন, নেতৃত্ব দিতেছেন এবং সংঘর্ষে জেনারেল টিক্কা খান নিহত হয়েছে। উক্ত ঘোষণা দেশবাসীর মনে বর্ণনাতীত সাহস সঞ্চার করে। ভারত গমনকালে হাটে-মাঠে, ঘাটে সংবাদটি প্রত্যেকের মুখে মুখে আমি স্বকর্ণে শুনিয়াছি এবং পাক বেতার কেন্দ্রের বিপরীত সত্য ঘোষণা কেহ সেই দিন বিশ্বাস করে নাই। স্বজাতির বেতার কেন্দ্রের ঘোষণার প্রতি যে কি অবিচল আস্থা স্বীয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব্যতীত উহা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বাঙালি জাতির বদ্ধমূল ধারণা বিনষ্ট করিবার প্রয়াসেই পাকিস্তান সরকার করাচি বিমান বন্দরে বসা অবস্থায় বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ গ্রেফতারের খবর ২রা এপ্রিল পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশ করে। ইহাই পরে ১৫ই এপ্রিল দৈনিক পূর্বদেশে ছাপা হয়।

আগরতলায় পুলিশী হয়রানি

আগরতলা হইতে রওয়ানা হইয়া সোনামুড়া শহরে টেকসী হইতে অবতরণ করিলে আমাকে থানায় যেতে অনুরোধ জানানো হয়। থানায় জিজ্ঞাসাবাদের পর থানার অফিসার-ইন-চার্জের বাসভবনে আমার রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হয় অর্থাৎ ভদ্রভাবে পরোক্ষ ক্রিয়ায় আমাকে পুলিশী হেফাজতে আটক রাখা হয়। পরদিন ভোর ৮ ঘটিকায় ভারতীয় দেশরক্ষা বিভাগীয় সিকিউরিটি অফিসার ক্যাপ্টেন ঘোষ প্রায় দুই ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। মনে হইল, তাহাদের মনের রোগ কিছুটা প্রশমিত হইয়াছে। তবে, আমার দৃঢ় ধারণা জন্মিল যে, আমার মতো স্পষ্টভাষী স্বাধীনচেতা জাতীয়তাবাদীদের জন্য ভারত ভূমিতে কোন আশ্রয় নাই; আশ্রয় রহিয়াছে তাহাদের অর্থে পোষা মেরুদন্ডহীন আওয়ামী লীগ মার্কা জাতীয়তাবাদীদের, তাহাদের জন্যই সর্বত্র অবারিত দ্বার।

আগরতলার বাংগালী হিন্দুদিগকে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির মরণপণ সংগ্রামে উৎফুল্ল মনে হইয়াছে। ইহা সর্বদা সত্য যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে সীমান্তের ওপারের বংগভাষাভাষী হিন্দুদের নৈতিক, আর্থিক ও বাস্তব সমর্থন অর্থাৎ সর্বাত্মক সহায়তা ছিল অতুলনীয়। কিন্তু যখনই আমরা বাংলা ভাষাভাষী সকলে ঐক্যবদ্ধ হইয়া বৃহত্তর বাংগালী জাতির জন্য বৃহত্তর স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গদেশ রাষ্ট্র গঠন মর্মে প্রস্তাবের অবতারণা করিয়াছি, তখন কেহ কেহ সরাসরি প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন, কেহ অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া মূল আলোচনার মোড় ঘুরাইয়া দিয়াছেন। ঘনিষ্ঠ মেলামেশা, ভাবের গভীর আদান-প্রদান এবং সর্বোপরি বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের ফলে নিঃসন্দেহে এবং স্থির নিশ্চিত হইলাম যে, সীমান্ত পরপারের বঙ্গ ভাষাভাষী হিন্দুদের নিকট বৃহৎ ভারতীয় রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব প্রকৃতই গর্বের বস্তু।

তাহারা যতটাবা বাংগালী তাহার চাইতে অধিক ভারতীয়। ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণেই বোধহয় বঙ্গ ভাষাভাষী হিন্দুদের চিন্তা ভিন্নরূপ। অবাংগালীর শোষণ তাহারা স্বীকার করেন; কিন্তু বাঙালির সত্ত্বা বিকাশের সংগ্রামে তাহারা আগ্রহী নহেন। পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবংগ, আসাম, মেঘালয় ও পার্বত্য ত্রিপুরা এক সমৃদ্ধশালী বৃহত্তর এলাকা এবং উক্ত গোটা এলাকাই বংগ ভাষাভাষী অধ্যুষিত। ভাষা, সংস্কৃতি, রক্ত ও ভৌগোলিক অবস্থান যদি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি হয়, তাহা হইলে স্বাধীন ও সার্বভৌম বৃহত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দাবি একান্ত স্বাভাবিক। সুতরাং কালের যাত্রায় এই দাবি উথিত হইবার বিরুদ্ধে সীমান্ত পারের বাঙ্গালিদের বাস্তব ও মনস্তাত্ত্বিক বাধা কোথায়?

স্মর্তব্য, বাঙালি হিন্দু জনতাই সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হইয়া ১৯৪৭ সালে বাসে-সোহরাওয়ার্দী উত্থাপিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পরিকল্পনাকে আঁতুড় ঘরেই হত্যা করে। যে মজ্জাগত ধ্যান-ধারণায় তাহারা সেইদিন আত্মবলির রাজপথ অবলম্বন করিয়াছিল, একদিন না একদিন ভারতে অবস্থানরত বংগ ভাষাভাষী হিন্দু জনতা নিজেদের সেই ভুল উপলব্ধি করিবে এবং বৃহত্তর স্বাধীন বংগদেশ প্রতিষ্ঠায় বী হইবে, এই বিশ্বাস ও প্রীতি লইয়া সেইদিনের অপেক্ষায় রহিলাম।

ঢাকা প্রত্যাবর্তন

ভারত ভূমিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের দৌরাত্ম্যে মনে হইত যে, আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নাই। আমরা সংগ্রামের প্রেরণায় ভারত ভূমিতে গিয়াছিলাম, প্রাণ বাঁচাতে যাই নাই, ব্যবসা করিতে যাই নাই, ব্যাংক লুটের টাকা সামলাইতে যাই নাই, অসৎ কর্মে লিপ্ত হইতে যাই নাই। লুটের টাকায় জীবনভোগ করিতে যাই নাই, হোটেল রেস্তোরায় বিলাস জীবন-যাপন করিতে যাই নাই, দয়ার ভিক্ষা চাহিতে যাই নাই, সর্বোপরি কাহারো সহিত ঝগড়া করিতেও যাই নাই। আমাদের ঝগড়া-বিবাদ জালেম জেনারেল ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে, অত্যাচারী পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে। তাই পাক-বাহিনী কবলিত কোটি কোটি বাংগালীদের সহিত সমভাবে মানসিক ও প্রয়োজনবোধে দৈহিক নির্যাতন সহ্য করিবার দৃঢ় সংকল্প লইয়া আমি, সহকর্মী এহসানুল হক সেলিম ও কবিরসহ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করি এবং ঢাকায় আত্মগোপন জীবনযাপন শুরু করি। আমরা আগরতলা হইতে প্রত্যাবর্তনকালে ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজের সন্নিকটে আসিয়া দেখি যে, ব্রিজটি ভাংগা। কবিরই কিছুদিন পূর্বে ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন ও অন্যান্যের সহায়তায় ব্রিজটি বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে উড়াইয়া দিয়াছিল। উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে ঢাকার মালিবাগ মোড়ে সশস্ত্র মোকাবেলায় পাক-বাহিনীর গুলিতে কবির শাহাদাৎ বরণ করে। বলিতে ভুলিয়াছি যে, ভারতে অবস্থানরত আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলা জাতীয় লীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব দেওয়ান সিরাজুল হক, আশরাফ হোসেন, এম.এম. আনোয়ার ও পরিমল সাহা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন এবং ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম-সূচী গ্রহণের অনুরোধ জানাইয়াছিলেন, অবশ্য ফল বিশেষ কিছু হয় নাই।

দেশে অবস্থানকারী বাংগালীদের অবদান

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে ১৫ই ডিসেম্বর এই সময়টা ছিল পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাংগালীদের জন্য মহাসংকটকাল, মহাদুর্ভোগকাল ও মহাত্যাগের কাল। এই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের বাড়িঘর কোন কোন ক্ষেত্রে ভষ্মীভূত হইয়াছে, কোন কোন ক্ষেত্রে বাজেয়াপ্ত হইয়াছে। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। দেশবাসীর জান-মাল ইজ্জতের কোন প্রকার নিরাপত্তা ছিল না। যখন তখন গ্রেফতার, পাশবিক ও দৈহিক অত্যাচার ও নির্যাতন ভোগ ছিল ভাগ্যলিপি। সীমান্ত পারে ভারত ভূখন্ডে আশ্রয়প্রার্থী কয়েক লক্ষ শরণার্থী ব্যতীত বাকী সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালি ছিল কার্যতঃ সশস্ত্র হিংস্র পাক বাহিনীর হাতে বন্দি। তাহারাই পাক বাহিনীর জুলুম সহ্য করিয়াছে; তাহারাই মুক্তিযোদ্ধাকে আহার, আশ্রয় ও অন্যান্য সাহায্য দিয়াছে। তাহারা আত্মবিসর্জন দিয়াছে; কিন্তু শত্রু সেনার নিকট আত্মসমর্পণ করে নাই। ভাগ্যের কি পরিহাস, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অত্যুদয়ের পর মৃত্যুঞ্জয়ী এই জনতাই মুহূর্তের মধ্যে ভারতে আশ্রয়-প্রার্থী শরণার্থীদের দৃষ্টিতে পাক-বাহিনীর সহযোগী অভিযুক্ত হয় এবং এক পলকে পরিণত হয় এক অ্চ্ছুত শ্রেণিতে। আরো পরিতাপের বিষয়, ১৬ই ডিসেম্বরের পরে অনুষ্ঠিত অত্যাচার, অবিচার লুটপাট, খুন, রাহাজানী ও মান-ইজ্জত ও সতীত্ব হরণ ১৬ই ডিসেম্বরের আগেকার সময়ের মতই সমভাবে গ্রামজীবন ও বাংগালী জন-জীবনকে বিষাক্ত করিয়া তোলে। ভারত থেকে প্রত্যাগত মুষ্টিমেয় শরণার্থী ছিল ইহার জন্য দায়ী। ইতিহাস কি নির্মম শিক্ষা; ফরাসী বিপ্লবের কি মর্মন্ত পুনরাবৃত্তি!

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া পাক-ভারত যুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের উপর উর্দুভাষী পাক-বাহিনীর হামলা ও ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ ছিল একাধারে পাকিস্তানী উর্দুভাষী কায়েমী স্বার্থ চক্র, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী কুচক্রী মহল এবং পাক-চীন ও পাক-সোভিয়েত বন্ধুত্বের ক্ষিপ্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মহলের বহুমুখী সাঁড়াশি অভিযানের সহিংস ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও প্রতিফল।

জুলাই মাস থেকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট সহানুভূতিশীল মনোভাবপ্রসূ যে সব প্রস্তাব দিয়া আসিতেছিলেন, কূটবুদ্ধি ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতার ফলে সেগুলো ব্যর্থ হয়। ফলে জাতিসংঘের ২৬তম সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের প্রস্তাবানুযায়ী অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পাক-ভারত সীমান্ত এলাকায় জাতিসংঘ প্রহরী নিয়োগের প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে পড়ে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পরিকল্পনা মোতাবেক ২৪শে অক্টোবর (১৯৭১) যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বৃটেন ও পশ্চিম জার্মানীর সমর্থন কুড়াইবার মানসে ভ্রমণ করেন ও রাষ্ট্রনায়কদের সহিত সাক্ষাৎ করেন। পূর্বাহ্নে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে যে কোন অবস্থা মোকাবেলার চিন্তায় সোভিয়েট রাশিয়ার সহিত ৯ই আগস্ট (১৯৭১) শান্তি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি (TREATY OF PEACE, FRIENDSHIP & CO-OPERATION) নামে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২১শে নভেম্বর বয়রা এলাকায় পাক-বাহিনী সম্মিলিত ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীর নিকট পরাজয়বরণ করেন। তাহাদের তেরটি ট্যাংক ও চারটির মধ্যে তিনটি সেবর জেট ভারত ভূমিতে ধ্বংস হয়। ক্ষিপ্ত ইয়াহিয়া খান ২৩শে নভেম্বর দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ২৬শে নভেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সংকটজনক পরিস্থিতি হইতে ত্রাণ লাভের আশায় পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষের প্রস্তুতি নেন। তিনি হয়ত আশা করিয়াছিলেন যে, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ফলে ভারত কর্তৃক মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য সহায়তাদান বন্ধ হইবে। ১৯শে জুলাই লন্ডনের ফিনানসিয়াল টাইমস প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল ইয়াহিয়া খান হুমকি দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের কোন অংশ বিদ্রোহীদের ঘাটি নির্মাণকল্পে দখল করা হলে পূর্ণ যুদ্ধ ঘোষণা করা হইবে। ৪ঠা আগস্ট করাচি টেলিভিশন ঘোষণায়ও তিনি একই উক্তি করেন। উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তানকে দেখানোর ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের পদক্ষেপ সম্পর্কে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় মিঃ পিটার প্রেসটন ২৯শে মার্চ (১৯৭১) এক রিপোর্টে মন্তব্য করেছিলেন, “It is an act of a mindless sergeant Major” অর্থাৎ ইহা নির্বোধ বা ধীশক্তিহীন সার্জেন্ট মেজরের কাজ। বস্তুতঃ ঘটনাপ্রবাহ মিঃ প্রেস্টন মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে।

ভারতীয় সামরিক হামলা

ইন্দিরা গান্ধীর ভুল চাল অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর রাত্রে পাকিস্তান ভারতের উপর অতর্কিত বিমান আক্রমণ করিলে পাক-ভারত যুদ্ধ বাধে ইহা সত্য নহে। নিম্ন বক্তব্যই সত্য-Henry Broudon of the Sunday Times তাহার “The Retreat of American Power” (১৯৭৩) গ্রন্থে লিখেছেন- “The Indian Cabinet On April 28 (71) had secretly decided to prepare for the possibility of war” বক্তব্যের অকাট্য প্রমাণ সমর্থন পাওয়া যায় Major General Sukhwant Sing, তৎকালীন Deputy Director, Military Operations at Army Head Quarters কর্তৃক লিখিত ও ১৯৮০ সালে প্রকাশিত “The Liberation of Bangladesh” এর অংশ বিশেষে “The Army was asked to take over the guidance of all aspects of guerilla warfare on April 30, 1971.”

ভারতের পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনায় সর্বাধিনায়ক Field Marshal Sam Manekshaw বোম্বে এক জনসভায় ১৯৭৭ সালের ১৬ নভেম্বর প্রকাশ করেন যে, ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর ইন্দো-পাক যুদ্ধের ৯ মাস পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী CABINET MEETING-এ উপস্থিত হইতে তলব করেন। ক্যাবিনেট সভায় তাহাকে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আঘাত হানার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু Field Marshal আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে সময় প্রার্থনা করে।

International Commission of Jurists তদন্তের সিদ্ধান্ত যে, ১৯৭১ সালের ২১শে নভেম্বর ভারতীয় সাঁজোয়া বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান ভূমিখন্ডে ঢুকিয়া পড়ে সেইদিন হইতেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আরম্ভ হয়- ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর নয়। তখনি পাকিস্তান অবস্থার বিপাকে মরিয়া হইয়া ভারতের উপর বিমান হামলা করিতে বাধ্য হয়।

মাত্র কিছুদিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং ইহারই ফলে পূর্ব পাকিস্তান পাক বাহিনীর অত্যাচার হইতে মুক্ত হয়। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।

ইতিপূর্বে ৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। উল্লেখ্য যে, ১লা জুন মিঃ ফনীভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বে মিসেস নূরজাহান মুর্শেদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সমবায়ে গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল ভারতীয় পার্লামেন্ট সেন্ট্রাল হলে অনুষ্ঠিত ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় পরিষদের যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য আকুল আবেদন জানাইয়াছিলেন। কিন্তু তখন ভারত সরকার অপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করিয়া বিষয়টি এড়াইয়া গিয়াছিল। অবশ্য ইতিপূর্বে ৩১শে মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সহিত একাত্মতা ঘোষণা করিয়া সর্বপ্রকার সাহায্য দানের সংকল্প প্রকাশ করে এবং ১লা ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী পূর্ব পাকিস্তান হইতে পাক সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। প্রকাশ, মুক্তির নয় মাস সংগ্রামে ১০৪৭ জন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারায়, ৩ হাজার ৪৭ জন আহত হয় ও ৮৯ জন নিখোঁজ হয়।

বলা অনাবশ্যক যে, ভারতীয় বাহিনীর এই ত্যাগ আমরা কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করি। এবং বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতীয় বাহিনী সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ না হলে বাংলাদেশ অচিরেই ভিয়েতনামে পরিণত হয় আর মুক্তিবাহিনী কয়েক যুগ অবিরাম সংগ্রাম করিয়াও দেশকে পাক বাহিনী-মুক্ত করিতে পারি কিনা সন্দেহ। সুতরাং ইহাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে যে, ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল কালো দিনগুলিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতীয় জনগণ সম্ভাব্য ঝুঁকি সত্ত্বেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়া বাংলাদেশকে পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত করিবার চেষ্টা না করিলে অত্র এলাকার বংগভাষী মাত্রই হয়ে নগণ্য সংখ্যক উর্দু ভাষাভাষী ও তাহাদের নগণ্য সংখ্যক স্থানীয় সমর্থকদের সেবাদাসে পরিণত হইত। সুতরাং কৃতজ্ঞ বংগ ভাষাভাষী আপামর জনগণ গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে রাজধানীর রাজপথে ১৬ ডিসেম্বর ও ইহার পরবর্তী কয়েকদিন ভারতীয় নাগরিক ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যে যত্রতত্র স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক ও প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করিয়াছে তাহা বিস্ময়কর কিছু ছিল না। বাংগালী মজলুম জনগণ ১৯৭১-এর মার্চ হইতে ডিসেম্বর নয় মাসে যখন প্রায় ন্যুজ দেহ, কুজ পৃষ্ঠ, অতিমাত্রায় শ্রান্ত-ক্লান্ত ও অসহায়, বাংগালীর ফরিয়াদে যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার আরশ পর্যন্ত কাঁপিতে ছিল, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংগালী জাতির মুক্তিদাতার ভূমিকাই গ্রহণ করেন।

অবশ্য ইহা বলাও সত্যের অপলাপ হইবে যে, একমাত্র মহান পরার্থপরতা বা মানবাধিকার নীতিতে উদ্বুদ্ধ হইয়াই ভারত পাক হানাদার বাহিনী বিতাড়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিল। বরং আন্তর্জাতিক শক্তিতে পরিণত হবার প্রবল আকাংখা এবং জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে ভারত সেইদিন অস্ত্র ধরিয়াছিল। সুতরাং ইহার পরিণতি কি দাঁড়াইতে পারে, সেই চিন্তাও সেইদিন অনেকের মাথায় ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশ সরকারের মেরুদন্ড, শক্তি, দক্ষতা ও দেশপ্রেমের গভীরতার উপরই নির্ভর করিবে যে, ভারতীয় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী শ্রেণি এই দেশকে একচেটিয়া লুট পাট ও শোষণের যাতাকলে পরিণত করিতে সক্ষম হবে কি হবে না।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাক বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেঃ নিয়াজী ঢাকার রেসকোর্সে দেশরক্ষা বাহিনীর যৌথ কম্যান্ড প্রতিনিধিদ্বয় ভারতীয় সেনা বিভাগের লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরা ও বাংলাদেশ দেশরক্ষা বাহিনীর এ.কে খন্দকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাক দেশরক্ষা বাহিনীর ৭৫ হাজার ও বেসামরিক ১৮ হাজার যুদ্ধবন্দিকে ভারত ভূমিতে স্থানান্তরিত করিয়া তথায় আটক রাখা হয়।

যে দলিলের মাধ্যমে এই আত্মসমর্পণ সংঘটিত হয়েছিল তা নিম্নে দেওয়া হইল:

TEXT OF INSTRUMENT OF SURRENDER

The PAKISTAN Eastern Command agree to surrender all PAKISTAN Armed Forces in BANGLADESH to Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA, General Officer Commanding-in-Chief of the Indian and Bangladesh force in the Eastern Theatre. This surrender includes all PAKISTAN Land, Air and Naval forces as also all paramilitary forces and civil armed forces. These forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA.

The PAKISTAN Eastern Command shall come under the orders of Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA as soon as this instrument is signed. Disobedience of orders will be regarded as a breach of the surrender terms and wil be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA will be final, should any doubt arise as to the meaning or interpretation of the surrender terms. Lieutenant General Jagjit Singh Aurora gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with the dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with the provisions of the GENEVA convention and guarantees the safety and well being of all Pak Military and Paramilitary forces who surrender. Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnel of West Pakistan origin by the forces under the command of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora.

JAGJIT SINGH AURORA                  AMIR ABDULLAH KHAN NIAZI

Lieutenant General                                      Lieutenant General

General Officer Commanding in Chief           Martial Law Administrator

Indian and Bangladesh Forces                      Zone B and Commander

in the Eastern Theatre                                  Eastern Command (Pakistan)

16, December, 1971                                      16, December, 1971

অর্থাৎ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল অফিসার কমান্ডিং লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল পাকিস্তানী সৈন্যের আত্মসমর্পণ করে সম্মত হয়েছে। পাকিস্তান স্থল, বিমান ও নৌ এবং প্যারামিলিটারী ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী এই আত্মসমর্পণের অন্তর্ভুক্ত। এই বাহিনী লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার পরিচালনাধীন নিকটবর্তী সামরিক বাহিনীর নিকট অস্ত্র জমা দিবে। এই পত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার পরিচালনাধীন হইবে। এই আদেশ লঙ্ঘন আত্মসমর্পণের শর্ত লংঘন বলিয়া বিবেচিত হইবে এবং প্রতিষ্ঠিত আইন ও যুদ্ধনীতি অনুসারে ইহার বিচার হইবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ বা ব্যাখ্যার ব্যাপারে কোন সন্দেহ উত্থিত হইলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া বিবেচিত হইবে।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করেছেন যে, জেনেভা কনভেনশনের নিয়মাবলী অনুযায়ী আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের সহিত সম্মানজনক আচরণ করা হইবে এবং আত্মসমর্পণকারী সকল পাকিস্তান সামরিক প্যারামিলিটারী বাহিনী নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা হইবে। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পরিচালনাধীন বাহিনী সকল বিদেশী নাগরিক নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যক্তিবর্গের রক্ষাণাবেক্ষণ করিবে।

স্বাঃ/ জগজিৎ সিং অরোরা                                               স্বাঃ/ আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী

লেফটেন্যান্ট জেনারেল                                                          লেফটেন্যান্ট জেনারেল

জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চীফ                                    মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর

পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও                                                        জোন-বি এবং কমান্ডার

বাংলাদেশ বাহিনী                                                                    পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড (পাকিস্তান)

১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১                                                            ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ প্রশ্নে

বাংলাদেশের মাটিতে পাক সেনাবাহিনী মুক্ত করার নীতিগত কারণ ছাড়াও ভারত নিজস্ব কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রথমে ভারত দ্বিখন্ডিত হইয়া পাকিস্তানী রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে। অখণ্ড ভারত বিশ্বাসী ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কখন সাফল্যের সহিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের বিলোপ ঘটানো যায়। পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলুপ্ত না হলে বরং তাহার রাষ্ট্রীয় অংগচ্ছেদের সুবর্ণ সুযোগই ১৯৭১ সালের এক মহাক্ষণে ভারতের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়। দ্বিতীয়তঃ ১৯৬২ সালের শেষার্ধে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় চীন-ভারত যুদ্ধ প্রমাণ করিয়াছিল যে, চীন-ভারত বৈরীতা ও চীন-পাকিস্তান মৈত্রী পটভূমিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অঙ্গ পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব ভারতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি স্বরূপ। ইহার অবশ্যম্ভাবী কার্যকারণেই ভারতকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে আসাম-নেফা সীমান্তে দেশরক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে হয়। তৃতীয়তঃ আসাম, সীমান্তবর্তী নাগাভূমি, মিজোরাম প্রভৃতি ভারতীয় পার্বত্য এলাকাবাসী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। পূর্ব পাকিস্তান এই সকল পার্বত্য উপজাতীয় বিদ্রোহী গেরিলা বাহিনীর মুক্তচারণ ভূমি ও আশ্রয়স্থল। চতুর্থতঃ পূর্ব পাকিস্তানের বর্ধনশীল পাট শিল্প বিশ্ববাজারে ভারতীয় পাট শিল্পকে কোণঠাসা করিয়া ফেলিয়াছে। পঞ্চমতঃ ভারতীয় বর্ধিষ্ণু শিল্প কারখানার শিল্পজাত দ্রব্যের নিরাপদ বাজার অন্বেষণ।

উপরোক্ত কারণে ৩১ মার্চ (১৯৭১) ভারতীয় পার্লামেন্ট উভয় পক্ষের যুক্ত সভায় বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন সর্বোতভাবে সাহায্য-সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। সেইকথা আগেই বলিয়া, ইহা ছিল ২৭শে মার্চ ‘৭১-এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভারতীয় পার্লামেন্টে উদ্বেগ প্রকাশ প্রতিধ্বনি মাত্র। পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীদের অবাধে ভারত ভূমিতে আশ্রয় গ্রহণে ভারত সরকার সীমান্ত অতিক্রমণে কোন প্রকার বাধা দেয় নাই। ভারতীয় মন্ত্রীর (শ্রম ও পুনর্বাসন) লোকসভায় প্রদত্ত তথ্যানুসারে মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থীদের সাহায্যের ৩২৬ কোটি টাকা খরচের মধ্যে আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল সর্বসাকুল্যে ৩৬.৭৭ কোটি টাকা, বাকি ২৮৯.২৩ কোটি টাকা ভারত সরকার ব্যয় করে। পাক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দু সম্প্রদায় মুক্ত করার প্রচেষ্টার ফলে ১৬ আগস্টের মধ্যে ভারতে ৫৯.৭১ লক্ষ হিন্দু, ৫.৪১ লক্ষ মুসলমান ও ৪৪ হাজার অন্যান্য সম্প্রদায় ভুক্ত শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। অবশ্য পাকিস্তান সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ লক্ষ ২ হাজার ৬২৩ ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে। পাক জংগী সরকারের হয়ত ধারণা ছিল, ইহার ফলে বাস্তুত্যাগী হিন্দুরা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাংগার সূত্রপাত করিবে এবং ইহারই অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের ভারত ত্যাগ করিতে বাধ্য হইবে ও অভ্যন্তরে মুসলিম বাসিন্দারা হিন্দু ও ভারত বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করিবে আর ইহার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অঙ্কুরেই জনসমর্থন হারিয়ে ফেলিবে। অকপট মনে বলিতে হবে, ভারতীয় জনতা ব্যাপকভাবে সুস্থ রাজনৈতিক চেতনা ও মানবিকবোধের বিরল নিদর্শন স্থাপন করে। সাম্প্রদায়িক দুস্কৃতিকারীদের যে কোন অপচেষ্টা সাধারণ ভারতবাসী অত্যন্ত সতর্কতা ও ক্ষিপ্রতার সহিত স্তব্ধ করিয়া দেয়। ইহা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ মন্তব্য, কাহারো সমর্থন-অসমর্থনের অপেক্ষা রাখে না।

পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হওয়ার পশ্চাতে

বস্তুতঃ ভারতের জনসাধারণের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। ভারতীয় প্রভাবশালী উচ্চ মহলে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থে পাকিস্তান অখণ্ড বা দ্বিখন্ডিত হবার ঔচিত্যের প্রশ্নে মতভেদ ছিল। ভারতীয় ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিস এন্ড এনালাইসিস’-এর মতানুসারে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থে পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত ছিল অপরিহার্যভাবে প্রয়োজনীয়। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর অবধি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পদক্ষেপগুলি ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তিনি পাকিস্তান দ্বিখণ্ডনের পক্ষে ছিলেন। উল্লেখ্য, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিখণ্ডনের বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯৬৯-এর আগস্ট ২২ ঘন্টা মেয়াদী পাকিস্তান সফরকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে পাক সরকারকে অনুরোধ করে। ফলে পাক-মার্কিন সম্পর্কোন্নয়ন দেখা দেয়। চীন-মার্কিন বলয়ের এই প্রভাব অকার্যকর করিবার মানসেই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং ও সোভিয়েট রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁন্দ্রে গ্রোমিকো দিল্লীতে ৯ই আগস্ট (১৯৭১) ২০ সালা রুশ-ভারত “শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা” (কার্যতঃ সামরিক) চুক্তি সম্পাদন করেন। ১৯৬৯ সালের মে মাসে পাকিস্তান সফরকালে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন পাক-চীন বন্ধুত্বের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন এবং পাক-সোভিয়েত ও পাক-চীন বন্ধুত্ব সমান্তরালভাবে ও সমভাবে চলিতে পারে না বলিয়া নছিয়ত করেন। পাক সরকার অবশ্য উপরোক্ত প্রতিপাদ্য প্রতি দৃঢ়ভাবে দ্বিমত প্রকাশ করিয়াছিলেন। পাকিস্তানের দ্বিখন্ডিত হওয়াটা বোধহয় তাহারই ফল। এইদিকে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী দেশগুলির সরকারি মত প্রভাবান্বিত করার প্রয়াসে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ২০ থেকে ২১শে সেপ্টেম্বর রাশিয়া সফর করিলেন এবং ৬ই অক্টোবর হইতে ১৩ই নভেম্বর বেলজিয়াম, অষ্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী ইত্যাদি সফর করিয়া পশ্চিমা শক্তিগুলির কার্যকরি হস্তক্ষেপ বন্ধের নিশ্চয়তা বিধান করিলেন। শুধু তাই নয় সফরান্তে মিসেস গান্ধী ইহার পরেও ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন অবধি জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিক্রিয়াগুলি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে মোকাবিলা করিলেন। পাক-ভারত সীমান্ত এলাকায় উভয় রাষ্ট্র সশস্ত্র সংঘর্ষের সম্ভাবনা এড়ানোর জন্য পারস্পরিক সৈন্য প্রত্যাহার প্রস্তাবের জওয়াবে ৩০শে নভেম্বর ভারতীয় রাজ্যসভায় বক্তৃতাকালে মিসেস গান্ধী স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিলেন যে, বাংলাদেশ থেকে পাক-বাহিনী প্রত্যাহার করিলে তিনি পূর্ব সীমান্ত হইতে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করিতে সম্মত আছেন। ইহার নির্গলিতাৰ্থ বাংলাদেশ পাকিস্তানের অঙ্গ নহে। অন্যথায় ৩রা ডিসেম্বর হইতে ১৬ই ডিসেম্বর পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষ ও বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজ্যসভায় ৩০শে নভেম্বর ঘোষণার স্বতঃসিদ্ধ পরিণতি।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গচ্ছেদ অভিযান নিচ্ছিদ্র করার প্রয়াসে ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের ব্যয়ভার যথাসম্ভব নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করেন। একই উদ্দেশ্যে তিনি জনপ্রতিনিধি, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের বেতন, ভাতা ও বাসস্থানের সম্ভাব্য ব্যবস্থা করিলেন, অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ব্যয়ভার গ্রহণ করিলেন; আবার চীন সমর্থক জননেতা ও দলগুলির উপর কড়া পুলিশী নজর রাখিলেন। এভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় নাটকের সফল যবনিকাপাতের মাধ্যমে ১৯৬২ সালে মহাচীনের হস্তে পরাজয় ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের নিকট নাকানিচুবানি খাইবার কালিমা মুছিয়া ভারত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের স্বীকৃতি মোতাবেক ‘মেজর পাওয়ার’ অর্থাৎ বড় শক্তিতে উন্নীত হইল।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় : ঐতিহাসিক পটভূমি

বাংলাদেশ নিজস্ব কারণে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্রথমে ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে বংগীয় প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের প্রস্তাবক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলির সমবায়ে ভারতীয় উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে দুইটি মুসলিম প্রধান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করিবার পরিকল্পনা ছিল। ইহাই পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব হিসাবে খ্যাত হয়। দ্বিতীয়তঃ প্রাসাদচক্রের রাজনীতি ও ক্ষমতা দখলের আবর্তে পাকিস্তান গণতন্ত্রের মূল বক্তব্য জনগণের সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ জনগণের রায়ে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের নীতি বিসর্জন দেয়। তৃতীয়তঃ রাষ্ট্র পরিচালনায় অর্থাৎ শাসন ক্ষমতায় পূর্ব পাকিস্তানী বংগ ভাষাভাষীদের কার্যকর অনুপস্থিতি বাংগালী মন-প্রাণকে বিষাক্ত ও বিদ্রোহী করিয়া তোলে। পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয়, ভারত হইতে আগত মোহাজের, সরকারি সামরিক-বেসামরিক কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, পুঁজিপতি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী শ্রেণি ও বহিরাগত অর্থাৎ আফ্রিকা ইত্যাদি হইতে আগত অবাংগালী শিল্পপতি ব্যবসায়ী শ্রেণির মধ্যে আভ্যন্তরীণ স্বার্থগত কলহ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানী বাঙ্গালিদের উপর নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রাখিবার প্রয়াসে তাহারা ছিল ঐক্যবদ্ধ ও বদ্ধপরিকর। পাকিস্তান সামরিক বিভাগে বরাদ্দ অর্থের উপর সৈন্য বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের প্রশ্নাতীত একচেটিয়া সর্বময় ক্ষমতা ছিল। বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বাজেটের সিংহভাগের উপর পার্লামেন্টের বা জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কোন প্রকার অর্থপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। শাসকচক্রের স্বার্থে দেশ শাসিত হয় এবং জনগণ পরিণত হইয়া পড়িয়াছিল নেপথ্যের বস্তুতে। সংখ্যাধিক্য হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান গণ পর্যবসিত হইয়াছিল শাসিতের শ্রেণিতে। জনগণের সার্বভৌমত্ব হরণকারী এই প্রাসাদ চক্রেরই মদদগার হিসাবে যুক্ত হয় সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন শক্তি। তাই (ক) ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে একচেটিয়া জয়লাভ করিয়াও সরকার গঠনের কিছুকালের মধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হকের মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত হইতে হয়। (খ) ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ভাষণদানকালে প্রকাশ্য জনসভায় নিহত হন। (গ) ১৯৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বেআইনিভাবে বরখাস্ত হন। (ঘ) ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে বেআইনিভাবে গণপরিষদ বাতিল ঘোষিত হয়। (ক) ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর সেনাপতি জেনারেল আইউব খান সামরিক শাসন জারি ও সর্বময় ক্ষমতা দখল করেন এবং (চ) ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান ব্যাপী প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ৩১৩টি জাতীয় পরিষদে আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন দখল করা সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসিতে দেওয়া হয় নাই। তৃতীয়তঃ অনস্বীকার্য যে, ভৌগলিক অবস্থান ও ভাষা সংস্কৃতির মৌলিক প্রভেদের দরুন পাকিস্তানী জাতিবোধের দ্রুত উন্মেষ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং চতুর্থতঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈষম্য বাংগালী জীবনে হতাশার সৃষ্টি করে। সামরিক বেসামরিক বিভাগে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, লাইসেন্স-পারমিট বন্টন ইত্যাদি ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানী জনমনে গভীর অসন্তোষ ও তিক্ততার কারণ হইয়া দেখা দেয়। সংকটের গুরুত্ব তুলিয়া ধরিবার নিমিত্ত কিছু কিছু পরিসংখ্যান নিম্নে দেওয়া হইল :

শিক্ষা
 পূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তান
 ১৯৪৭-৪৮১৯৬৮-৬৯১৯৪৭-৪৮১৯৬৮-৬৯
প্রাথমিক বিদ্যালয়২৯৬৩৩২৮৩০৮৮৪১৩৩৯৪১৮
মাধ্যমিক বিদ্যালয়৩৪৮১৩৯৬৪২৫৯৮৪৫৭২
কলেজ৫০১৭৩৪০২৭১
মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কৃষি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়১৭
বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র১৬২০৮৮৩১৬৫৪১৮৭০৮

লক্ষণীয় যে, ১৯৫০-৭১ মুদ্দতে ৭২০ কোটি ডলার ঋণ-এর আশ্বাস পায়, তন্মধ্যে ৪৪০ কোটি ডলার ঋণ প্রকৃতপক্ষে খরচ হইয়াছিল। ইহার মধ্যে ৮০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ হইয়াছে এবং বাকী ৩৬০ কোটি ডলারের মধ্যে ৩৩.৪% ও ৬০.৮% যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় হইয়াছে। বাকি ৫.৮% অনির্ধারিত রহিয়াছে।

  পূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তান
১৯৪৭-১৯৬৯উন্নয়ন খাতে৩০০০ কোটি৬০০০ কোটি
১৯৪৭-১৯৬৫রপ্তানি আয়১৬২৮ কোটি১৩১৯ কোটি
১৯৬৫-১৯৬৮রপ্তানি আয়৪৭২ কোটি৪২২ কোটি
১৯৪৮-১৯৬৫আমদানি ব্যয়১২০৭ কোটি২৮৯৯.৮২ কোটি
১৯৬৫-১৯৬৮আমদানি ব্যয়৩৯৩.৭৬ কোটি৯৮৩.৮ কোটি
১৯৫৮-১৯৬৭বৈদেশিক মুদ্রা (উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ)২০%৮০%
 মার্কিন সাহায্য ব্যয়৩৩%৬৬%
 মার্কিন ব্যতীত দেশের সাহায্য ব্যয়৪%৯৬%
১৯৫০-১৯৭১মোট বৈদেশিক ঋণ৩৩.৪%৬০.৮% (অনির্ধারিত ৫.৮%)
 কেন্দ্রীয় চাকরি (বেসামরিক)১৫%৮৫%
 দেশ রক্ষা ব্যয়১০%৯০%

(অথচ ১৯৫০-৫১ হইতে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় রাজস্ব আয় ৩৭৯৬ কোটি টাকার মধ্যে ২১৩২ কোটি টাকা দেশরক্ষা বিভাগ খাতে ব্যয় হয়।)

  পূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তান
১৯৬৪-৬৮সার বিতরণ৩৭১,০০০ টন (৩৩%)৭৩৯০০০ টন (৬৬%)
১৯৬৪-৬৯উন্নত বীজ বিতরণ৪০,০০০ টন (১১%)৩৪২০০০ টন (৮৯%)
১৯৬০মাথা পিছু আয়২৬৯ টাকা৩৫৫ টাকা
১৯৭০মাথা পিছু আয়৩০৮ টাকা৪৯২ টাকা
১৯৬৪-৬৯আন্ত আঞ্চলিক বাণিজ্য রফতানী৩১৭.৪ কোটি৫২৯ কোটি

এভাবেই একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি উন্নয়নে ব্যয় হইতে থাকে এবং অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি পশ্চিম পাকিস্তানের কলকারখানা ও ক্ষেত খামারের আশ্রিত বাজারে পরিণত হয়। তাই চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বিবেচনার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মন্ডলীর প্রতিবেদনে করুণ চিত্র ফুটিয়ে উঠে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, এই যাবত পূর্ব পাকিস্তানের ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থাৎ ১২৩৮ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে পুঁজি পাচার হয়। ইহারই অবধারিত ফল গ্রাম বাংলা অধিবাসীদের ১৯৫৯-৬০ সালের বাজার দর অনুযায়ী ১৯৪৯ ৫০-১৯৫৩-৫৪ সালের মাথাপিছু আয় ২২৮ টাকা হইতে কমিয়া ১৯৬৪-৬৫, ১৯৬৭ ৬৮ সালে ১৯৮ টাকাতে দাঁড়ায়। ক্রেতা সাধারণের অবস্থা নিম্নলিখিত তুলনামূলক বাজার দর হইতে বুঝা যাইবে:

 পূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তান
প্রতিমণ চাউল৩৫.০০ টাকা২০-২৫ টাকা
প্রতিমণ আটা২৫-৩০ টাকা১৫-২০ টাকা
প্রতিসের সরিষার তৈল৫.০০ টাকা২.৫০ টাকা

১৯৭১ সালের ৯ মাস যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ পাচার হয় এবং ব্যাংক হইতে ৮৬ কোটি টাকা ঋণ লওয়া হয়। সিন্ধু অববাহিকা পরিকল্পনা, ওয়ার্কস প্রজেক্ট-তারবেলা বাঁধ, গোলাম মোহাম্মদ ব্যারাজ, জলবদ্ধতা ও লবণাক্ততা দূরীকরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়ন ও সহজ ও দ্রুততর হয়। পশ্চিম ভারতের কাথিওয়ার ও কচ্ছ এলাকা হইতে আগত বড় বড় ব্যবসায়ী, পাক পাঞ্জাবের চিনিয়ট শহরবাসী দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, ভারতীয় গুজরাট ও কাথিওয়ার হইতে আগত তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়ী বোহরা, খোজা, ইসমাইলীয়া ও খোদা ইশনাসারী সম্প্রদায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বড় বড় সামন্ত প্রভুরা পশ্চিম পাকিস্তানকে কেন্দ্র করিয়া পাকিস্তানী অর্থনীতিতে পুঁজি বিনিয়োগ করে। ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ২২টি পরিবারে কুক্ষিগত হইয়া পড়ে। শিল্প সম্পদের ৬৬%, বীমা সম্পদের ৭৫%, ব্যাংক সম্পদের ৮০% এই ২২টি পরিবারের আয়ত্বে চলিয়া যায়। এই অবাংগালী পুঁজিপতি গোষ্ঠী ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বেশীরভাগ শিল্প ব্যবসার মালিক। ইহাই বাংগালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির আক্রোশের কারণে পরিণত হয় এবং ইহাতেই আপামর বাংগালী জনতার সর্বস্তরে অভিযোগ ও বিদ্বেষের মানসিকতা জন্ম নেয়।

উপরে বর্ণিত দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ কার্যকারণসমূহ নগরে-বন্দরে, স্কুল-কলেজে, কলে-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে, সামরিক-বেসামরিক কার্যালয়ে পূর্ব পাকিস্তানী বংগ ভাষাভাষীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মূল জীবনী শক্তি হিসাবে কাজ করে এবং এই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিচালিত আন্দোলনই যুগপৎ পাকিস্তান অংগচ্ছেদের মূল শক্তিতে পরিণত হয়।

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হবার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট দিবালোকের ন্যয় স্বচ্ছ হয়ে উঠে যে, ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতায় পরিণত হইয়াছেন এবং ৮৮ আসনের অধিকারী পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমতার গদিতে আসীন হইবার চিন্তা দিবাস্বপ্ন মাত্র। তাই তিনি সময়ক্ষেপ না করিয়া ২০শে ডিসেম্বর ঘোষণা করিলেন “পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলীয় আসন গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নহে।” এমনকি ক্ষমতার গরজে ও কায়েমী স্বার্থের প্ররোচণায় তিনি দুই প্রধানমন্ত্রীর থিউরী প্রচার করিতেও কুণ্ঠিত হইলেন না। সামরিক চক্র ইহার সুযোগ গ্রহণ করে। সামরিক চক্র জনগণের নির্বাচিত আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যে পারস্পরিক রাজনৈতিক কলহের সদ্ব্যবহার করিতে এবং সেই উদ্দেশ্যে বিভিন্নভাবে কায়েমী স্বার্থবাদীদের মারফত ইন্ধন দানেও কসুর করে না। সোনার ডিম প্রাপ্তির লোভে ক্ষমতালোভী সামরিক জান্তা হাঁসের উপর এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিল- সেই হাঁস অর্থাৎ পাকিস্তান অস্তিত্ব হারাইল এবং সামরিক জান্তা শিরকুলমণি জেনারেল ইয়াহিয়া খান সোনার ডিম অর্থাৎ ক্ষমতা হারাইলেন। ভাগ্যে বন্দি জীবন। পাকিস্তান অংগচ্ছেদের বিনিময়ে ক্ষমতা পিপাসু জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা পাইলেন। ক্ষমতার সিংহভাগ ভোগী পাঞ্জাবী কায়েমী স্বার্থ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাইল। বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবের জনসংখ্যা ৫৩% অর্থাৎ সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান প্রভৃতি প্রদেশের মোট জনসংখ্যারও অধিক। সুতরাং বোধগম্য কারণেই অতঃপর পাকিস্তানে (সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান) এক ব্যক্তি এক ভোট নীতির গণতন্ত্র প্রবর্তনে পাঞ্জাবী কায়েমী স্বার্থ মহল গোঁড়া সমর্থক হইতে দ্বিধা করিবে না। বরং তাহাদের শ্লোগান হইবে যে, গণতন্ত্রই পাকিস্তানের রক্ষা কবচ- কেননা It suits them well! অর্থাৎ ইহা তাহাদের ভাল মানায়।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার এক ব্যক্তি এক ভোট গণতান্ত্রিক নীতি সংখ্যাগুরু বাংলাদেশের মোকাবিলায় পাঞ্জাবকে অত্যন্ত বেকায়দায় ফেলিয়াছিল। পাঞ্জাব বাসীদের দেশপ্রেম ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ অন্যান্য প্রদেশগুলির উপর লুণ্ঠন ও আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব, নতুবা স্বার্থের খাতিরে পাকিস্তান ও ইসলাম বিসর্জন দিতে পাঞ্জাবীদের এতটুকু বাধিতনা। স্বীয় হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করিতে সিন্ধু প্রদেশের জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ও সীমান্ত প্রদেশের জেনারেল ইয়াহিয়া খান সর্বনাশা ভূমিকা গ্রহণ করেন। ভবিষ্যৎ ইতিহাসে এই দুই ব্যক্তিই এই মর্মান্তিক কলঙ্কজনক ও বিয়োগান্তক নাটক দুরাচার নরাধম (Villain) হিসাবে চিত্রিত হইবেন।

উপনির্বাচনী প্রহসন ও শান্তি কমিটি

১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর নগরে পাকিস্তান ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগ ও অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খানের নেতৃত্বে জাস্টিস পার্টির প্রতিনিধিদের মধ্যে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাহাতে ভৌগোলিক কারণে “পাকিস্তান দুই অর্থনীতির রাষ্ট্র এই যুক্তি গ্রহণে জাস্টিস পার্টির প্রতিনিধিদল অস্বীকৃতি জানায় এবং ইহার মধ্যে তাহারা বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ আবিষ্কার করেন। জওয়াবে তখন তাহাদিগকে বলিতে বাধ্য হইয়াছিলাম যে, পাকিস্তান যদি পৃথক হইয়া যায় তাহা হইলে ক্রমশঃ পাঠান, বেলুচ ও সিন্ধীগণ স্ব-স্ব স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হইবে। ১৯৭৪-৭৫ সালে পাঠান ও বেলুচদের মুক্তি সংগ্রাম এক নির্মম সত্য ঘটনা। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হইতে পারে বটে তবে ইতিহাস নিজস্ব পথেই অগ্রসর হয়। স্মর্তব্য যে, সমগ্র বিশ্বব্যাপী পাক সেনা বাহিনীর বর্বর হামলার প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত প্রেসিডেন্টের দিল্লী হইতে প্রেরিত ২ এপ্রিল (১৯৭১) তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট লিখিত পত্র, ১১ আগস্ট (১৯৭১) ও ২৯শে সেপ্টেম্বর (১৯৭১) মস্কো থেকে প্রচারিত ভারত-সোভিয়েট দুইটি পৃথক ইশতেহার এবং এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও মহাচীনের “রাজনৈতিক সমঝোতা” প্রস্তাবেও স্বেচ্ছাচারী ইয়াহিয়া খান কর্ণপাত করেন নাই বরং তিনি দুই দুইবার ১০ই জুন (১৯৭১) ও ৫ই সেপ্টেম্বর (১৯৭১) সাধারণ ক্ষমার” প্রহসন অভিনয় করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ৭ই আগস্ট (১৯৭১) তারিখে আওয়ামী লীগ দলীয় ৭৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য (উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান ও ড. কামাল হোসেনের এন.ই ১১১ ও ১১২ নির্বাচনী এলাকা শূন্য ঘোষিত হয় নাই) এবং ১৯শে আগস্ট ‘৭১ তারিখে ১৯৪ জন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অযোগ্য ঘোষণা করিয়া তদস্থলে সেনাবাহিনীর চিত্র ছায়ায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তদানুসারে ২০শে নভেম্বর ও ১৯শে ডিসেম্বর (১৯৭১) মধ্যে উপ-নির্বাচনের নামে সদস্য বাছাই প্রহসন অনুষ্ঠিত হয় এবং ১২ই আগস্ট (১৯৭১) ড আবদুল মুত্তালিব মালিককে গভর্নর নিযুক্ত করিয়া সর্বজনাব আবুল কাসেম (কাউন্সিল মুসলিম লীগ), আখতার উদ্দীন আহমদ (কনভেনশন মুসলিম লীগ), মাওলানা এ.কে.এম ইউসুফ (জামায়াতে ইসলাম), মাওলানা ইসহাক (নেজামে ইসলামী), নওয়াজেশ আহমদ (কাউন্সিল মুসলিম লীগ), মাওলানা আব্বাস আলী খান (জামায়াতে ইসলামী), মুজিবর রহমান (কাইয়ুম মুসলিম লীগ), ওবায়দুল্লাহ মজুমদার (আওয়ামী লীগ), অধ্যাপক শামসুল হক (আওয়ামী লীগ), এ এস এম সোলায়মান (কৃষক শ্রমিক পার্টি), প্রাক্তন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান পিডিপি নেতা জসিম উদ্দিন, এ কে মোশাররফ হোসেন এমপিএ (পিডিপি), মং সুপ্রু চৌধুরী (পার্বত্য চট্টগ্রাম) সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রহসন অভিনয় নিষ্পন্ন হইয়া যায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সংহতি ও অখণ্ডতা বজায় রাখিবার তাগিদে এবং সামরিক শাসনকর্তা ও জনগণের মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় অখণ্ডত্বে বিশ্বাসী নিম্নলিখিত রাজনীতিবিদগণ সমবায়ে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি (পূর্ব পাকিস্তান) গঠন করেন :

১। সৈয়দ খাজা খয়েরুদ্দীন                                                                     আহ্বায়ক

২। মাওলানা নুরুজ্জামান                                                                         প্রচার সম্পাদক

৩। এডভোকেট নুরুল হক মজুমদার                                                       অফিস সম্পাদক

৪। এডভোকেট এ কিউ এম শফীকুল ইসলাম                                          কোষাধ্যক্ষ

কার্যকরি কমিটির সদস্যবৃন্দ হইলেন :

১। অধ্যাপক গোলাম আযম ২। মাহমুদ আলী ৩। আবদুল জব্বার খদ্দর ৪। মাওলানা সিদ্দিক আহমদ ৫। আবুল কাসেম ৬। ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) ৭। মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম ৮। আবদুল মতিন ৯। আবদুল খালেক ১০। ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন ১১। পীর মোহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া) ১২। এ.এস.এম সোলায়মান ১৩। এ.কে. রফিকুল হোসেন ১৪। আতাউল হক খান ১৫। তোয়াহা বিন হাবিব ১৬। মেজর আফসার উদ্দীন ১৭। ইয়াহিয়া বাওয়ানী ১৮। হাকিম ইরতিজাউর রহমান খান আকুন-জাদা ১৯। সাত্তার কারওয়াদিয়া ২০। আবু আহমদ শাহ এবং ২১। মোহাম্মদ ভাই।

১১৬ নং বড় মগবাজার, ঢাকা-২, শান্তি কমিটির সদর দফতর স্থাপিত হয়। শান্তি কমিটি যে কেবল মুক্তিবাহিনী বা বাংলাদেশ সমর্থকদের দমনে ব্যস্ত ছিল, তাহা নহে, পাক সেনাবাহিনীর অকথ্য পাশবিক অত্যাচার ও লুণ্ঠন হইতেও দেশবাসীকে রক্ষা করিতে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল; উভয় বাস্তবতাকে স্বীকার করা হবে সত্য ভাষণ। শেষ রক্ষা হইল না। এমনকি বিশ্ব ব্যাংক প্রতিনিধি মিঃ পিটার কারগিল কর্তৃক সরেজমিনে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমতঃ অশান্ত অবস্থা নিরসন, দ্বিতীয় ভারত থেকে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন এই শর্তদ্বয় পূরণ না হওয়া অবধি “এইড টু পাকিস্তান কনসর্টিয়াম” ২১শে জুন (১৯৭১) প্যারিস বৈঠকে কোন প্রকার সাহায্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, মূলধন নিয়োগের যথাযথ পরিস্থিতি অবিদ্যমান। অন্যদিকে দুই মহাবস্তু বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও গণপ্রজাতন্ত্রী মহাচীনের প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এবং ৭ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি ও অখণ্ডত্বের পক্ষে ১০৪ ভোট জোগাড় হইয়াছিল সত্য কিন্তু পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষের মুহূর্তে (ডিসেম্বর ১৯৭১) মহান চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাস্তব ও কার্যকর সহায়তাদানে বিরত থাকে। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১১টি ভোট বিপক্ষে যায়, ১০ টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত ছিল। মহাচীন ৬, ১১ ও ১২ই এপ্রিল (১৯৭১) এবং ৫, ১৯ ও ২৭শে নভেম্বর (১৯৭১) পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষার সংগ্রামে দৃঢ়ভাবে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেও এবং কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তান আক্রান্ত হলে হস্তক্ষেপ করার অভিমত উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করলে ডিসেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানকে একাই যুদ্ধ করতে হইয়াছে। ৫ই নভেম্বর (১৯৭১) জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধি দল মহাচীন গমন করে। তৎকালীন অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিপে ফি পাকিস্তানকে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমর্থন দানের প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আপোষ রফা পরামর্শ দেন। মহাচীন পিকিং হইতে আগাগোড়া বাস্তব সাহায্যদানের লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করিলেও, কার্যক্ষেত্রে তাহাদের সকল প্রতিশ্রুতি কথার তুবড়িতে পরিণত হয়। বাস্তবে কিছুই হয় নাই।

বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থ

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালোরাত্রিতে পাক বাহিনীর অতর্কিত হামলা ৬ দফা ভিত্তিক সাংবিধানিক দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত করে। অবস্থাদৃষ্টে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ভারতীয় সাহায্য প্রার্থনা বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে অপেক্ষমান ভারতীয় নেতৃবৃন্দের দ্বারস্থ হয়। এভাবে কালের প্রবাহে, ঘটনাস্রোতে আকস্মিক মোড় পরিবর্তনের ফলে পূর্বে বর্ণিত ভারতীয় নিজস্ব কারণ ও বাংলাদেশের নিজস্ব কারণ একই ঘটনাস্রোতে লীন হইয়া বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। আমি ভারতের অভিসন্ধি সম্বন্ধে সর্বদাই সন্দিগ্ধ ছিলাম। ভারত বৃহৎ দেশ, তাহার প্রয়োজন বৃহৎ। ছোট ছোট দেশ বড় বড় দেশের স্বার্থে উচ্ছন্নে যেতে বাধ্য হয়। কেবলমাত্র দৃঢ়চেতা সৎ সাহসী নেতা কোন ছোট দেশকে বৃহৎ দেশের ছোবল হইতে রক্ষা করিতে পারেন। সিকিম রাজ্য ও কাশ্মীর রাজ্যের দুর্বল নেতৃত্ব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ব্যর্থ হইয়া দেশ দুইটিকে বৃহৎ ভারতীয় রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতা ১৯৫৪-৫৮ সালের মধ্যে বিশেষতঃ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ইতিহাস একচেটিয়া বিজয়ের পর নিজেদের কার্যকলাপের দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন যে, নীতি, আদর্শ, সততা তাহাদের মুখের বুলি মাত্র চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ নহে, অর্থাৎ বুকের বুলি নহে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অক্টোবর মাসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্য সমঝোতা বিষয়ে ৭ দফা গোপন চুক্তি সম্পাদন করে। সুতরাং সেই গোপন চুক্তি অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ কাগজে কলমে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পাইলেও কার্যক্ষেত্রে ভারতের বশংবদ রাষ্ট্রে পরিণত হইবে, ওহা আর বিচিত্র কি! অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সরকার ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়া সত্ত্বেও ভারতের মাটি থেকে ঢাকায় পদার্পণ করেন ২০শে ডিসেম্বর। ইহা এক অভাবনীয় ও অচিন্তনীয় ঘটনা। শুধু তাই নয়, স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করিয়াই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সরকার ১লা জানুয়ারি (১৯৭২) এক আদেশ বলে বাংলাদেশের মুদ্রামান শতকরা ৬৬ ভাগ হ্রাস করেন। উল্লেখ্য যে, এই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মুদ্রামান ছিল ভারতীয় মুদ্রামান হইতে বেশী। তাজউদ্দিন সরকার এক ঘোষণায় দুই মুদ্রামানের বিনিময় হারের সমতা আনিতে চাহিয়াছিলেন বটে, কিন্তু ফল দাঁড়াইল অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি এবং জনজীবনে আকাশমুখী দ্রব্যমূল্য। দ্বিতীয়তঃ ভারতীয় ও বাংলাদেশ অর্থনীতিদ্বয় পরস্পর সম্পূরক ঘোষণা করা হয় এবং এতদিন যাবত ভারতে পাট বিক্রির উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তাজউদ্দিন সরকার ১৯৭২-এর ১লা জানুয়ারি হইতে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে।

তাজউদ্দিন সরকারের উক্ত ঘোষণা অর্থনীতির মূল সত্যকে অস্বীকার করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বিশ্ব বাজারে ভারত ও বাংলাদেশ পাট, চা, চামড়া বিক্রির ব্যাপারে পরস্পরের প্রতিযোগিতা। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ৯০ ভাগ উপার্জন ছিল কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের উপর নির্ভরশীল। আবার ভারত ও বাংলাদেশ স্ব-স্ব বস্ত্র শিল্পের প্রয়োজনে বিদেশ থেকে কাঁচামাল, তুলা আমদানী করে। উভয় রাষ্ট্রকে বিশ্ব বাজার থেকে স্ব-স্ব প্রয়োজনে খাদ্য ক্রয় করিতে হয়। মুদ্রামানের হ্রাস উহার উপরে প্রচন্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এক কথায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আত্মনাশা নীতি দেশের অর্থনীতিকে ভাংগিয়া চুরমার করে দেয়। তৃতীয়তঃ ভারতীয় সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস হইতে মুদ্রিত বাংলাদেশের নোটের সংখ্যা সরকার কর্তৃক ঘোষিত সংখ্যা হইতে অনেক অধিক বলিয়া জনসাধারণের মধ্যে একটা ধারণার সৃষ্টি হয়। তাহাদের এই ধারণা বদ্ধমূল হয় ভারতের মুদ্রিত নোট অচল বলিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মুজিব সরকারের এক অভিনব ও বিস্ময়কর ঘোষণায়। এই ঘোষণায় বলা হয় যে, ভারতে মুদ্রিত নোট দুই মাস যাবত বদল করা যাইবে। ইহার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যে কোন সাধারণ চোখে ধরা পড়িতে বাধ্য। এইভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রকট মুদ্রাস্ফীতির অভিশাপের শিকারে পরিণত হয়। চতুর্থতঃ চরম বিস্ময়কর ঘটনা পরিলক্ষিত হয় বাংলাদেশের বাজারে। কেনা-কাটায় ভারতীয় মুদ্রার অবাধ প্রচলন শুরু হয়। ভারতীয় সৈন্য, ভারতীয় ব্যবসায়ী, ভারতীয় সাধারণ নাগরিক বাংলাদেশের বাজার হইতে দুর্লভ বৈদেশিক মুদ্রায় ক্রীত বিদেশী পণ্যদ্রব্য ও দেশীয় মাছ, আলু, ডিম, মোরগ, হাঁস, রসুন, মরিচ ইত্যাদি কয়েকশত কোটি টাকার দ্রব্য ভারতীয় মুদ্রায় অবাধে ক্রয় করিয়া ভারতে লইয়া যায়। আবার বিভিন্ন কলকারখানা হইতে শত শত কোটি টাকার মেশিনপত্র ও যন্ত্রপাতির খুচরা অংশ, কাঁচামাল ভারতের মারোয়াড়ী শিল্পপতি ব্যবসায়ীরা পাচার করিয়া লইয়া যায়।

পৃথিবীর ইতিহাসে বহু রাষ্ট্র বৈদেশিক রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে; কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীয় কাগজী নোটের বিনিময়ে অর্থাৎ বিনামূল্যে সংঘবদ্ধ প্রতারণার দ্বারা লুটপাট করিয়া সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রকে এইভাবে নিঃস্ব করার নির্মম নজীর আর কোথাও নাই। বাংলার মাটির সন্তান ছিলেন তাজউদ্দিন। অথচ তাহার সরকার ভারতীয় কাগজী মুদ্রা বেআইনীভাবে চালু হইতে বাধা দেয় নাই। দেশ বিক্রি আর কাহাকে বলে? পঞ্চমতঃ ৯৩০০০ যুদ্ধ বন্দি বাংলাদেশ হইতে যে দামী দ্রব্য লুট করিয়া আত্মসাৎ করিয়াছিল ভারতীয় সেনা বাহিনী যুদ্ধ বন্দিদের নিকট হইতে সেইগুলি ছিনাইয়া লইয়াছে; আত্মসাৎ করিয়াছে ও ভারতের স্বীয় পরিবার পরিজনের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছে। তদুপরি যুদ্ধবন্দি গণ যুদ্ধের নয় মাসে (১৯৭১ মার্চ হইতে ডিসেম্বর) বাংলাদেশের নাগরিকদের নিকট হইতে যে বিপুল পরিমাণ পাকিস্তানী মুদ্রা বিভিন্নভাবে অর্জন করিয়াছিল; ভারতীয় সৈন্যরা সেই কাড়ি কাড়ি টাকা দ্বারা বাংলাদেশ থেকে মাল ক্রয় করতঃ ট্রাকে ভর্তি করিয়া স্বদেশে প্রেরণ করিয়াছে। একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের দুষ্প্রাপ্য সম্পদ বন্ধুত্বের নামাবলীর আড়ালে এইভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন সামরিক ছাউনি হইতে (Military Cantonment) ভারতে স্থানান্তরিত করার প্রতিবাদে তাজউদ্দিন সরকার টু শব্দটি পর্যন্ত করেন নাই।

ভারতীয় দৈনিক সংবাদপত্র “অমৃতবাজার”-এর ১২ মে (১৯৭৪) সংখ্যার রিপোর্ট অনুসারে ভারত সরকার দুই থেকে আড়াই শত রেলওয়ে ওয়াগন ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধক্রমে স্থানান্তরিত করিয়াছে। অথচ ১৯৭৩ সালের ১১ই জুলাই বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, ভারতে কোন অস্ত্রশ্ত্র পাচার হয় নাই; বা লইয়াও যায় নাই। ১৯৭৪ সালের ১৭ই জুন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রকাশ করেন যে, ভারতে স্থানান্তরিত অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশকে ফেরত দেওয়া শুরু হয়েছে। দুই মন্ত্রীর এই দুই বক্তব্যের মধ্যে স্ব-বিরোধিতা লক্ষণীয়। দেশ ও জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা আর কাহাকে বলে? আর কাহাকেই বা বলা হয় সাক্ষী গোপাল সরকার? স্বর্ণের ভরি ১৭১ টাকা মানে স্থানান্তরিত অস্ত্রশস্ত্র মুল্য যদি ৪৫০ কোটি টাকা হয়, তাহা হইলে স্বর্ণভরি ১০০০ টাকা মানে উক্ত অস্ত্রশস্ত্রের মূল্য প্রায় ২৭০০ কোটি টাকা হয়। তদুপরি মহাচীন কর্তৃক নির্মিত জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী থেকে অস্ত্র নির্মাণ যন্ত্রপাতি ভারতে স্থানান্তরের অভিযোগ উথিত হয়। আমরা বাংলা জাতীয় লীগ উপরোক্ত বক্তব্যগুলি জনসাধারণ্যে তুলিয়া ধরি এবং দিল্লীর দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের আকাংখায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হইয়া আজাদ বাংলা’ আন্দোলন গড়িয়া তুলি।

ভারতের সাথে গোপন চুক্তি

১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক, সামরিক, বাণিজ্যিক, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে একটি সাতদফা গোপন সমঝোতা চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তিগুলো নিম্নরূপ:

. প্রশাসনিক বিষয়ক: যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পারবে। বাকীদের শূন্য জায়গা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ।

. সামরিক বিষয়ক: বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতিবছর এ সম্পর্কে পুনরীক্ষণের জন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হইবে।

. বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনী বিষয়ক: বাংলাদেশের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী থাকবে না। অভ্যন্তরীণ আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হইবে।

. ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ বিষয়ক: সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান। এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে।

. বাণিজ্য বিষয়ক: খোলা বাজার ভিত্তিতে (open market) চলবে দু’দেশের বাণিজ্য। তবে বাণিজ্যের পরিমাণের হিসাব নিকাশ হবে বছর ওয়ারী এবং যার যা প্রাপ্য সেটা স্টার্লিং এ পরিশোধ করা হইবে।

. পররাষ্ট্র বিষয়ক: বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংগে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংগে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে এবং যতদুর পারে ভারত বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সহায়তা দেবে।

. প্রতিরক্ষা বিষয়ক: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করবে ভারত।

গোপন চুক্তি প্রসঙ্গে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

… বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের সাথে ভারতের ৭ দফা গোপন চুক্তি করে সে ব্যাপারে জনাব মাসুদুল হক রচিত “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র’ এবং সি.আই.এ” শীর্ষক গ্রন্থে মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দিল্লীতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রদত্ত জনাব চৌধুরীর-এ সাক্ষাৎকারের সংশ্লিষ্ট অংশ উক্ত গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ১৬৩ থেকে ১৬৬ পৃষ্ঠা হুবহু নীচে তুলে ধরা হলোঃ

প্রশ্নঃ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে যে গোপন সাত দফা চুক্তি করে, প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা কি সেই সাত দফার মধ্যেই একটি? রক্ষী বাহিনী কি এই প্যারামিলিশিয়া বাহিনী?

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী: ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক লিখিত চুক্তিতে প্যাক্ট নয়-এগ্রিমেন্টে আসেন। এই চুক্তি বা এগ্রিমেন্ট অনুসারে দু’পক্ষ কিছু প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক সমঝোতায় আসেন। প্রশাসনিক বিষয়ে তা হলো যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পারে। বাকীদের চাকুরীচ্যুত করা হবে এবং সেই শূন্য জায়গা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। স্বাধীনতার পর বেশ কিছু ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেও গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) এসে তাহাদেরকে বের করে দেন।

সামরিক সমঝোতা হলেঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে (কতদিন অবস্থান করবে তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় না)। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতিবছর এ সম্পর্কে পুনরীক্ষণের জন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হইবে।

বাংলাদেশের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী থাকবে না।

আভ্যন্তরীণ আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হইবে। এই লিখিত সমঝোতাই রক্ষীবাহিনীর উৎস।

আর ভারত পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধবিষয়ক সমঝোতাটি হলো ও সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন। এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে।

চুক্তির এই অনুচ্ছেদটির কথা মুক্তিবাহিনী সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে জানানো হলে তীব্র ক্ষোভে তিনি ফেটে পড়েন। এর প্রতিবাদে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকেন না।

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কোলকাতা সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ কথাবার্তার মাঝে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে বলেন ও ‘আমার দেশ থেকে আপনার সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনতে হইবে।’ শেখ মুজিব এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এত সহজভাবে তুলতে পারেন, ভাবতেও পারেননি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তার এই অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগ নিয়ে শেখ মুজিব নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আদেশই যথেষ্ট। অস্বস্তিকর অবস্থা পাশ কাটাতে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি হইতে হয় এবং জেনারেল মানেকশকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের নিদক্ষণ নির্ধারণের নির্দেশ দেন।

বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যে চুক্তি হয়, সেটা খোলা বাজার (ওপেন মার্কেট) ভিত্তিক। খোলা বাজার ভিত্তিতে চলবে দু’দেশের বাণিজ্য। তবে বাণিজ্যের পরিমাণ হিসাব নিকাশ হবে বছরওয়ারী এবং যারা যা প্রাপ্য, সেটা স্টার্লিং-এ পরিশোধ করা হইবে।

স্বাধীনতার পর পরই চুক্তি অনুসারে খোলা বাজারভিত্তিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। দুদেশের সীমান্তের তিন মাইল খুলে দেয়া হয়। শেখ মুজিব এটা বন্ধ করে দেন।

বৈদেশিক বিষয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যে চুক্তিতে আসেন-সেটা হলঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে এবং যতদূর পারে ভারত এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে।

মূলতঃ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করবে ভারত।

এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। চুক্তি স্বাক্ষরের পর মুহূর্তেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

ভারত সরকারের সঙ্গে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গৃহীত এই পুরো ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ কারণে আমি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি যে, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বাংলাদেশ পাকিস্তান সৈন্যমুক্ত হয় মাত্র। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। যেদিন শেখ মুজিব পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা আসেন। বস্তুতঃ শেখ মুজিব ছিলেন প্রকৃত সাহসী এবং খাঁটি জাতীয়তাবাদী।

(স্বাক্ষর)

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী,

২৭ ডিসেম্বর ১৯৮৯”

পরবর্তীকালে এই সাতটি চুক্তি স্বল্প-পরিমার্জিত রূপে ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকার বুকে বংগভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সালা “বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তিতে মহাসমারোহে সন্নিবেশিত করা হয়। বাংলা জাতীয় লীগ ইহাকে ‘দাসত্ব চুক্তি’ বলিয়া আখ্যায়িত করে। উপরোক্ত দেশের স্বার্থ বিরোধী ও স্বজাতিদ্রোহী নীতি অবলম্বন ও অবাধ লুটতরাজ প্রতিরোধে অনীহা প্রদর্শন একমাত্র সাক্ষীগোপাল সরকারের পক্ষে সম্ভব। দেশীয় স্বার্থ ও দেশীয় সম্পদকে বন্ধু রাষ্ট্রের ছোবল থেকে সংরক্ষণে চরম ব্যর্থতার সন্তোষজনক কোন জওয়াব তাজউদ্দিন আহমদ কিংবা শেখ মুজিবর রহমানের কূট-তর্ক ভাণ্ডারে ছিল কি?

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হইতে বিশ মাইলের মধ্যে অবস্থিত এলাকায় অবাধ বাণিজ্য প্রচলনের মানসে ২৭শে মার্চ (১৯৭২) সীমান্ত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন মুজিব সরকারের ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কময় অধ্যায়। এই চুক্তি কি সর্বনাশই না সাধন করিয়াছে জাতীয় অর্থনীতিতে। আরো ন্যাক্কারজনক অধ্যায় সংযোজিত হয় শেখ মুজিবর রহমান যখন ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লী শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বেরুবাড়ি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পদযুগলে নৈবেদ্য হিসাবে অর্পণ করেন। ইহার প্রতিবাদে যখন গণ-আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম সেই সময়ে ১৯৭৪ সালের ৩০শে জুন মুজিব সরকার আমাকে কারারুদ্ধ করে। মুজিবের অভিশপ্ত ও সর্বনাশা নেতৃত্ব হইতে বাংলাদেশ মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। এই দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হয় এক নবতর অধ্যায়। এই নবতর অধ্যায় সৃষ্টিকারী ১৫ই আগস্টের প্রকৃত নায়ক কর্নেল আবদুর রশীদ ও লেঃ কঃ ফারুকের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে। এই ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিব এবং ওই দিনই রেডিও এবং টেলিভিশন হইতে নব-নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে গোটা জাতির পক্ষ হইতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বুলন্দ আওয়াজ উচ্চারণ করেন। গোটা দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচে। নূতন করিয়া শুরু হয় নবতর পদযাত্রা।

ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার প্রসঙ্গে জে, এন. দীক্ষিতের সাফাই

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জে, এন, দীক্ষিত ৪-৭-৯৫ ইং INDIAN EXPRESS পত্রিকায় তার লিখিত নিবন্ধে প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন যে ভারতীয় সেনাবাহিনী যেন অন্ততঃ এক বৎসর বাংলাদেশে অবস্থান করে কিন্তু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা উপরোক্ত প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে নিখিল চক্রবর্তীর এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, “ভারতীয় বাহিনীর ইষ্টার্ণ হেডকোয়ার্টার ছিল কলিকাতায়। ঢাকা অভিমুখে মার্চ করার আগে আমরা ঢাকায় কতদিন থাকব সেটা নিয়ে ভাবলাম। আমি ঢাকায় আমাদের অবস্থানের সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলাম তিন মাস। আমরা ঢাকায় তিন মাস থাকব। এটা এই জন্যেই ঠিক করেছিলাম যে যদি আমরা এর বেশি থাকি আমরা আর লিবারেশন আর্মি হিসাবে অভিনন্দিত না হয়ে অকপেশন আর্মি (দখলদার বাহিনী) হিসাবে চিহ্নিত হব। তাই আমরা ৩ মাসের বেশি থাকবো না।” (দৈনিক ইনকিলাব-১২-৩-৯৪ ইং) উপরোক্ত উক্তি গুলো প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দাবি সত্য নহে। অথচ এটি নিছক ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিজেদের এবং সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিন গংদের পক্ষে সাফাই ছাড়া অন্য কিছু নয়।

যুদ্ধোত্তর পাকিস্তান

যুদ্ধ চলাকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনাব নূরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অংগচ্ছেদের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২০শে ডিসেম্বর (১৯৭১) পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু সদস্যবৃন্দের নির্বাচিত সংসদীয় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর হস্তে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জনাব নূরুল আমিন পশ্চিম পাকিস্তানে ইন্তেকাল করেন এবং করাচিতে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সমাধি পার্শ্বেই তাহাকে সমাধিস্থ করা হয়। জনাব নূরুল আমিনের পক্ষে ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয় যে, কায়েদে আযমের পাশে তিনি অন্তিম শয্যায় শায়িত আছেন।

ক্ষমতা হস্তান্তরকালে জেনারেল ইয়াহিয়া বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেয়ার পরামর্শ দেয়। উত্তরে ক্ষমতাগ্রহণকারী জুলফিকার আলী ভুট্টোর উক্তি প্রণিধানযোগ্য “If I kill Mujib, not a single West Pakistan will ever come home” অর্থাৎ “আমি মুজিবকে হত্যা করিলে একজন পশ্চিম পাকিস্তানী আর দেশে আসিতে পারিবে না।” ৯৩০০০ যুদ্ধবন্দি ও কয়েক হাজার পাকিস্তানী বেসামরিক কর্মচারীবৃন্দ বাংলাদেশে “Partition and Aftermath-Memoirs of an Ambassador by kewal singh I.C.S.-Foreign secretary-Govt. of India.

জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের কিয়ৎ কালের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার হইতে মুক্তি দিয়া এক গৃহে অন্তরীণ করেন এবং ৩রা জানুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় দেয় ভাষণ অনুসারে ৮ই জানুয়ারি (১৯৭২) শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদান করিয়া বাংলাদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জনাব ভুট্টোর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট নাকি গোপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তির পর শেখ মুজিবর রহমান ৮ই জানুয়ারি (১৯৭২) অপরাহ্ন ১২টা ৩৫ মিঃ লন্ডন বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। তথায় একদিন অবস্থানের পর ১০ই জানুয়ারি বৃটিশ সরকার প্রদত্ত রাজকীয় বিমান বাহিনীর ‘কমেট’ বিমানযোগে ঢাকার পথে ভারত সরকার কর্তৃক দিল্লীতে আয়োজিত সম্বর্ধনা উপলক্ষে শেখ মুজিব সকাল ৮-৩০ মিনিটে কয়েক ঘণ্টার জন্য পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। ভারতীয় প্রেসিডেন্ট ভি, ভি, গিরি ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাহাকে পালাম বিমান বন্দরে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহিত মতবিনিময় ও দিল্লী সম্বর্ধনা সমাপনের পর অপরাহ্ন ১টা ৪২ মিনিটে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমানে শেখ মুজিব ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। নেতার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিমান বন্দর হইতে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত দীর্ঘ পথ লোকে লোকারণ্য হয়। তেজগাঁও বিমান বন্দর হইতে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত মাত্র ৪ মাইল পথ ট্রাকযোগে অতিক্রম করিতে ২ ঘণ্টারও অধিক সময় লাগে। স্বচক্ষে অবলোকন না করিলে জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসার গভীরতা অনুধাবন করা অসম্ভব। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব; ছিল আগেবপ্রসূত; এই দৃশ্য অবিস্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক।

সেই দিন তার সম্মানে রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত সংবর্ধনা সম্ভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বলেন যে, “আমি একজন মুসলমান। মৃত্যু আমার একবারই হইবে। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ …।” তাঁর সেদিনের সেই সাহসী ও সময়োপযোগী সুস্পষ্ট উচ্চারণ বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিত্তিকে মজবুত করিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।

প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ মুজিব

১১ই জানুয়ারি (১৯৭২) টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। রিসিভার তুলিয়া একটি অতি পরিচিত কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। কণ্ঠস্বরটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের। কলেজ জীবন থেকে বন্ধুত্ব; কিন্তু কলিকাতায় প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আমাদের মত ভিন্ন দলীয় জাতীয়তাবাদীদের সহিত শোভনীয় আচরণ প্রদর্শন করেন নাই। যাহা হইক, টেলিফোনে তাজউদ্দিন কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর আমাকে বলেন, শেখ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছি ও প্রস্তাবও করিয়াছি। কারণ তিনি যে কোন পদে বহাল থাকুন না কেন, তাহার ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালিত হইবে। শেখ সাহেবের মানসিক গড়ন তুমিও জান; আমিও জানি। তিনি সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্থ। অতএব ক্ষণিকের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পার্লামেন্টারি কেবিনেট পদ্ধতির প্রশাসন প্রহসনে পরিণত হইবে। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকিলে নিয়মতান্ত্রিক নামমাত্র দায়িত্ব পালন না করিয়া মনের অজান্তে কার্যতঃ ইহাকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রশাসনে পরিণত করিবেন। এইদিকে প্রেসিডেন্ট পদে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নির্বাচনের কথা ভাবিতেছি। তোমার মত কি?

তদুত্তরে তাহাকে বলি “তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক। নামমাত্র প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালন শেখ সাহেবের শুধু চরিত্র বিরুদ্ধ হইবে না; বরং উহা হইবে অভিনয় বিশেষ। কেননা, ক্ষমতার লোভ তাহাদের সহজাত।” তাজউদ্দিন টেলিফোনের অপর প্রান্তে সশব্দে হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আমি জানিতাম, মৌলিক প্রশ্নে তোমার আমার মধ্যে মতভেদ হইবে না।”

১২ই জানুয়ারি এক ঘোষণায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করিলেন বটে; কিন্তু উত্তরকালে ঘটনা প্রবাহে বন্ধুবর তাজউদ্দিনের সদিচ্ছার শেষ রক্ষা হইল না।

ভারত-বাংলা দাসত্ব চুক্তি

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের আমন্ত্রণক্রমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৭ মার্চ (১৯৭২) ঢাকা সফরে আসেন। লক্ষ লক্ষ জনতা তাহাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানায়। ১৯শে মার্চ উভয় প্রধানমন্ত্রী যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করেন ও ২৫ বৎসর মেয়াদী “বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আমাদের বাংলা জাতীয় লীগের দৃষ্টিতে চুক্তি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব করে সামরিক চুক্তি অন্য কথায় দাসত্ব চুক্তি ছাড়া কিছুই ছিল না। ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান অনুরূপ পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করিয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সে সময়ে এই পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার পর সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবর রহমান, আতাউর রহমান খান, মানিক মিয়া (সম্পাদক, ইত্তেফাক) প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতা পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির গোড়া সমর্থকে পরিণত হন। সেই শেখ মুজিবুর রহমানই পুনরায় ক্ষমতার মোহে ভারতের সহিত ২৫ সালা দাসত্ব চুক্তি তথা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করিলেন। লক্ষণীয় যে, পুনঃ পুনঃ অভিযোগ সত্ত্বেও মুজিব-তাজউদ্দিন ভারতের সহিত গোপন চুক্তি অস্বীকার করিতেন, ঠিক যেন পার্ক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সর্বনাশা গোপন ধারাগুলি পাক-সরকার প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠে পুনঃপুনঃ অস্বীকার করিতেন।

Treaty of Friendship, Cooperation and Peace

between the People’s Republic of Bangaldesh

and the Republic of India

Inspired by common ideals of peace, secularism, democracy, socialism and nationalism.

Having struggled together for the realisation of these ideals and cemented ties of friendship through blood and sacrifices which led to the triumphant emergence of a free, sovereign and independent Bangladesh,

Determined to maintain fraternal and good neighbourly relations and transform their border into a border of eternal peace and friendship,

Adhering firmly to the basic tenets of non-alignment, peaceful coexistence, mutual co-operation, non-interference in internal affairs and respect for territorial integrity and sovereignty,

Determined to safeguard peace, stability and security and to promote progress of their respective countries through all possible avenues of mutual co-operations,

Determined further to expand and strengthen the existing relations of friendship between them,

Convinced that the further development of friendship and co operation meets the national interests of both States as well as the interests of lasting peace in Asia and the world.

Resolved to contribute to strengthening world peace and security and to make efforts to bring about a relaxation of International tension and the final elimination of vestiges of colonialism, racialism and imperialism,

Convinced that in the present-day world international problems can be solved only through co-operation and not through conflict or confrontation,

Reaffirming their determination to follow the aims and principles of the United Nations Charter,

The people’s Republic of Bangladesh, on the one hand, and the Republic of India, on the other, have decided to conclude the present Treaty,

Article: 1

The High Contracting Parties, inspired by the ideals for which their respective peoples struggled and made sacrifices together, solemnly declare that there shall be lasting peace and friendship between their two countries and their peoples. Each side shall respect the independence, sovereignty and territorial integrity of the other and refrain from interfering in the internal affairs of the other side.

The High Contracting parties shall further develop and strengthen the relations of friendship, good-neighbourliness and all-round co operation existing between them, on the basis of the above mentioned principles as well as the principles of equality and mutual benefit.

Article : 2

Being guided by their devotion to the principle of equality of all peoples and states, irrespective of race or creed, the High Contracting parties condemn colonialism and recialism in all their forms and manifestations and reaffirm their determination to strive for their final and complete elimination.

The High Contracting parties shall cooperate with other states in achieving these aims and support the just aspirations of peoples in their struggle against colonialism and racial discrimination and for their national liberation.

Article : 3

The High Contracting parties reaffirm their faith in the policy of non-alignment and peaceful co-existence, as important factors for easing tension in the world, maintaining international peace and security and strengthening national sovereignty and independence.

Article : 4

The High Contracting Parties shall maintain regular contacts with each other on major international problems affecting the interests of both States, through meetings and exchanges of views of at all levels.

Article : 5

The High Contracting Parties shall continue to strengthen and widen their mutually advantageous and all-round co-operation in the economic, scientific and technical fields. The two countries shall develop mutual co-operation in the fields of trade, transport and communications between them on the basis of the principles of equality, mutual benefit and the most favoured nation principle.

Article: 6

The High Contracting Parties further agree to make joint studies and take joint action in the fields of flood control, river basin development and the development of hydro-electric power and irrigation.

Article : 7

The High Contracting parties shall promote relations in the fields of art, literature, education, culture, sports and health.

Article: 8

In accordance with the ties of friendship existing between the two countries each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not enter into or participate in any military alliance directed against the other party.

Each of the High Contracting Parties shall refrain from any aggression against the other Party and shall not allow the use of its territory for committing an act that may cause military damage to or constitute a threat to the security of the other High Contracting Party.

Article : 9

Each of the High Contracting Parties shall refrain from giving any assistance to any third party taking part in an armed conflict against the other party. In case either Party is attacked or threatened with attack, the High Contracting Parties shall immediately enter into mutual consultations in order to take appropriate effective measures to eliminate the threat and thus ensure the peace and security of their countries.

Article: 10

Each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not undertake any commitment. secret of open, toward one or more states which may be incompatible with the present Treaty.

Article: 11

The present Treaty in signed for a term of twenty-five years, and shall be subject of renewal by mutual agreement of the High Contracting Parties.

The Treaty shall come into force with immediate effect from the date of its signature.

Article : 12

Any differences in interpreting any article articles of the present Treaty that may arise between the High Contracting Parties shall be settled on a bilateral basis by peaceful means in a spirit of mutual respect and understanding.

Done in Dhaka on the Nineteenth Day of March, Nineteen Hundred and Seventy two.

(Sheikh Mujibur Rahman)                                    (Indira Gandhi)

Prime Minister                                                                          Prime Minister

For the People’s Republic of Bangladesh         For the Republic of India.

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র মধ্যে মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি

শান্তি, ধর্মনিক্ষেপতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে,

এই আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য একযোগে সংগ্রাম এবং রক্তদান ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার ফলশ্রুতি হিসেবে মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় অভ্যুদয় ঘটিয়ে,

সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সপ্রতিবেশীসূলভ সম্পর্ক রক্ষায় এবং উভয় রাষ্ট্রের সীমান্তকে চিরস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্বের সীমান্ত হিসেবে রুপান্তরিত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে, নিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পারিক সহযোগিতা, অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান প্রদর্শনের মূলনীতিসমূহের প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল থেকে,

শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এবং সম্ভাব্য সকল প্রকারের পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে স্ব-স্ব দেশের অগ্রগতি সাধনের জন্য,

উভয় দেশের মধ্যে বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো সম্প্রসারণ ও জোরদার করার জন্য দৃঢ় সংকল্প হয়ে,

এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বের স্থায়ী শান্তির স্বার্থে এবং উভয় রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের খাতিরে বন্ধুত্ব ও পারস্পারিক সহযোগিতা আরো সম্প্রসারণের ব্যাপারে স্থিরবিশ্বাসী হয়ে,

বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমন এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদের অবশেষসমূহ চূড়ান্তভাবে নির্মল করার জন্য প্রচেষ্টা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে,

আজকের বিশ্বের আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহের সমাধান শুধুমাত্র সহযোগিতার মাধ্যমে সম্ভব, বৈরীনীতি বা সংঘাতের মাধ্যমে নয়- এ ব্যাপারে স্থিরনিশ্চিত হয়ে,

জাতিসংঘ সনদের নীতিমালা ও লক্ষ্যসমূহ অনুসরণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা পুনরুল্লেখ করে এক পক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অন্য পক্ষে ভারতীয় সাধারণতন্ত্র বর্তমান চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অনুচ্ছেদ: এক

চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ, স্ব স্ব দেশের জনগণ যে আদর্শের জন্য একযোগে সংগ্রাম এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মর্যাদার সঙ্গে ঘোষণা করছে যে, উভয় দেশ ও সেখানকার জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব বজায় থাকবে। একে অন্যের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অপরের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ উপরে উল্লেখিত নীতিমালার ভিত্তিতে এবং সমতা ও পারস্পারিক লাভজনক নীতিসমূহের ভিত্তিতে উভয় দেশের মধ্যকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সুপ্রতিবেশীসূলভ ও সার্বিক সহযোগিতার সম্পর্কের আরো উন্নয়ন ও জোরদার করবে।

অনুচ্ছেদ: দুই

জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি সমতার নীতিতে আস্থাশীল থাকার আদর্শে পরিচালিত হয়েই চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ সর্বপ্রকারের ও ধরণের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের নিন্দা করছে এবং তাকে চূড়ান্তভাবে ও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর ব্যাপারে তাহাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞার কথা পুনরুল্লেখ করছে।

চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ উপরোক্ত অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করবে এবং উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্য বিরোধী সংগ্রাম এবং জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে জনগণের ন্যায়সংগত আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থনদান করবে।

অনুচ্ছেদ: তিন

চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা জোরদার করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জোট নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রতি তাহাদের আস্থার পুনরুল্লেখ করছে।

অনুচ্ছেদ: চার

উভয় দেশের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যাবলী নিয়ে চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ সকল স্তরে বৈঠক ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রক্সা করবে।

অনুচ্ছেদ: পাঁচ

চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী ক্ষেত্রে পারস্পারিক সুবিধাজনক ও সার্বিক সহযোগিতা জোরদার ও সম্প্রসারিত করে যাবে। উভয় দেশ সমতা ও পারস্পারিক সুবিধার নীতির ভিত্তিতে এবং সর্বাধিক সুবিধাদানের নীতি অনুযায়ী (Most favoured nation policy) বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে পারস্পারিক সহযোগিতা প্রসারিত করবে।

অনুচ্ছেদ: ছয়

বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন এবং জলবিদ্যুৎ শক্তি ও সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণে চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ একমত হয়েছে।

অনুচ্ছেদঃ সাত

চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও খেলাধূলার ক্ষেত্রে সম্পর্ক প্রসারিত করবে।

অনুচ্ছেদঃ আট

দুইটি দেশের মধ্যকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুযায়ী চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষের প্রত্যেকে মর্যাদার সঙ্গে ঘোষণা করছে যে তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোন সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না বা অংশগ্রহণ করবে না।

চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ একে অন্যের উপর আক্রমণ থেকে নিবৃত্ত থাকবে এবং তাহাদের এলাকায় এমন কোন কাজ করিতে দেবে না যা চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কোন পক্ষের সামরিক ক্ষতির কারণ হইতে পারে বা কোন পক্ষের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হইতে পারে।

অনুচ্ছেদ: নয়

চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষের কোন এক পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তিকারী প্রত্যেকে এতদউল্লেখিত তৃতীয় পক্ষকে যে কোন সাহায্য প্রদানে বিরত থাকবে। এছাড়া যে কোন পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হবার ভীতি দেখা দিলে এই ধরনের ভীতি নিশ্চিহ্ন করবার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষের সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনায় মিলিত হয়ে নিজেদের দেশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং শান্তি স্থাপন সুনিশ্চিত করবে।

অনুচ্ছেদ: দশ

চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষের প্রত্যেকে মর্যাদার সংগে ঘোষণা করছে যে, এই চুক্তির সঙ্গে অসামাঞ্জস্য হইতে পারে এ ধরনের গোপন অথবা প্রকাশ্যে এক অথবা একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে কোন প্রকার অঙ্গীকার করবে না।

অনুচ্ছেদঃ এগারো

এই চুক্তি পঁচিশ বছরের মেয়াদের জন্য স্বাক্ষরিত হলো এবং চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদসম্পন্ন উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এই চুক্তি সহি হবার দিন থেকে কার্যকরী হইবে।

অনুচ্ছেদঃ বারো

এই চুক্তির কোন একটি অথবা একাধিক অনুচ্ছেদের বাস্তব অর্থ করবার সময় চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোন মত-পার্থক্য দেখা দিলে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সমঝোতার মনোভাবের উপর ভিত্তি করে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নিষ্পত্তি করিতে হইবে। ঢাকায় সম্পাদিত। তারিখ উনিশে মার্চ, উনিশ শ বাহাত্তর সাল।

(শেখ মুজিবুর রহমান)                                         (ইন্দিরা গান্ধী)

প্রধানমন্ত্রী                                                                                        প্রধানমন্ত্রী

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে                                     ভারতের সাধারণতন্ত্রের পক্ষে।

ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তির প্রকাশ্য ধারাগুলি পাঠ করলে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির ধারাগুলির কথা আমার স্মরণে আসে। তাই ২০শে মার্চ চট্টগ্রাম জিলা জাতীয় লীগ কর্মী সম্মেলনে ও ২২শে মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রাম জাতীয় লীগ কর্তৃক আহূত লালদীঘি ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় আমি উক্ত চুক্তিকে “দাসতব-চুক্তি” বলিয়া অভিহিত করি এবং ইহার বাতিল দাবি করি। ইহার কয়েক দিনের মধ্যেই ২৭শে মার্চ (১৯৭২) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি নামে আরেকটি অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমাদের আশংকাই সত্য হইল। তাই আমরা বাংলা জাতীয় লীগ দিল্লীর দাসত্ব মোচনের দাবিতে “আজাদ বাংলা” আন্দোলনের ডাক দেই। ভারতীয় শক্তি ও বাংলাদেশে ভারতীয় সেবাদাস মহল আমাদের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার অবাঞ্ছিত পন্থা গ্রহণ করে। এমনকি জীবন নাশের হুমকি প্রদর্শন করে; আমাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আজাদ বাংলা’ আন্দোলন সমগ্র দেশে ব্যাপ্তি লাভ করে। সে সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে এবং ভারতের আশ্রিত মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে জনমতকে আশা ও ভাষা দানের পরিণতি সংঘটিত হয় ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের সত্যিকার জয়যাত্রা। ফলশ্রুতিতে ২৪শে আগস্ট (১৯৭৫) আমি কারাগার হইতে মুক্তিলাভ করি। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ী ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে প্রবেশের সংগে সংগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত একাকার হইয়া যায়। বিনা অনুমতিতে বা বিনা দলিলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় জনতার পণ্যের স্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে। বাংলাদেশ বাস্তবে ভারতের বাজারে পরিণত হয়। বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ গাইট পাট অবাধে সীমান্ত পারের পাটকল গুলোর চাহিদা মেটাতে আরম্ভ করে। ভারতীয় পাটকলগুলির পূর্ণোদ্যমে দুই-তিন শিফটে কাজ চালু হয়ে যায়। এমনকি বাংলাদেশের পাট-লোপাট করিয়া ভারত নৃত্য করিয়া বিদেশে কাঁচা পাট রফতানী শুরু করিয়া দেয়। স্মর্তব্য, কাচা পাটের অভাবে ইতিপূর্বে ভারতীয় পাটকলগুলি অতিকষ্টে এক শিফটে কাজ করিত এবং ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাক-ভারত বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হইয়া যাওয়ায় ভারতকে বাধ্যতঃ সিংগাপুরের মাধ্যমে প্রতি বৎসর ১০ হইতে ১৫ লাখ বেল পাকিস্তানী উচ্চমানের পাট চড়া মূল্যে ক্রয় করিতে হইত। পাক কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-মুখর শেখ মুজিবর রহমান পাট রফতানীর মাধ্যমে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানেরই একাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয়ের বিরুদ্ধে আদা-জল খাইয়া সোচ্চার ছিলেন। অথচ তাহারই শাসনামলে ভারত অবাধে বাংলাদেশের পাট লুণ্ঠন করিয়া চলিল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশী কাঁচা পাট রফতানী দ্বারা ভারত নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করিয়া চলিল। অথচ শেখ মুজিব টু শব্দটি উচ্চারণ করিলেন না। ইহা কোন স্বার্থের বিনিময়ে কিংবা কোন্ বিশেষ কারণে? তিনি কি জ্ঞাত ছিলেন না যে, ভারতের পাট শিল্প জাত পণ্য রফতানী প্রসূত অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাত্র ১৫% থেকে ১৭%; কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি কাচা পাট ও পাট শিল্প জাত পণ্য রফতানী আয়ের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল? কি মাহেন্দ্রক্ষণেই না বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, আর কি মাহেন্দ্রক্ষণেই না ভারত অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, এই সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি ছাড়পত্র বলেই বাংলাদেশের (ক) বিদেশ হইতে সাহায্যপ্রাপ্ত পণ্দ্রব্য (খ) ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান হইতে উন্নতমানের আমদানীকৃত পণ্যদ্রব্য (গ) বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য দ্রব্য ও আমদানীকৃত চাউল ও অন্যান্য সামগ্রী (ঘ) বাংলাদেশের প্রোটিন সমৃদ্ধ ডিম, নদী নালার মাছ, জমির শাক-সবজি, তরি-তরকারী, গৃহপালিত হাঁস-মোরগ, গরু, বকরি (ঙ) সোনা-রূপা, তামা, ছোট খাট কল-কারখানা, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সীমান্তের অপর পার ভারতে অবাধে পাচার হইতে থাকে। অপরপক্ষে একই পথে ভারত হইতে আসিতে থাকে তামাক, মসলা প্রভৃতি অনাবশ্যক পণ্য। শুধু তাই নয়, একইভাবে বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে ভারতীয় শিল্পজাত পণ্য দ্রব্যের বাজারে পরিণত হয়। আর ইহারই পরিণতিতে সম্পদে ক্রম-নিঃস্ব বাংলাদেশ অবশ্যম্ভাবী ভাবেই নিপতিত হয় মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির কবলে।

একদিকে মওলানা ভাসানীর সোচ্চার কণ্ঠ এবং অন্যদিকে আমাদের বাংলা জাতীয় লীগের আন্দোলনের ফলে সমগ্র বাংলাদেশ ক্রমশঃ অবাধ বাণিজ্য চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠে। মুজিব সরকার পরিশেষে জনমতের চাপে পড়িয়াই ১৯৭৩ সালে অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত রাখিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে কালো টাকায় পরিচালিত সীমান্ত বাণিজ্য সংঘবদ্ধ চোরাচালানের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে; সর্বনাশা দুর্নীতি অনুপ্রবেশ করিয়াছে জাতীয় জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর চরিত্রহীনতা জীবনের ও জীবন যাপনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হইয়া পড়িয়াছে। সীমান্তে অবাধ চোরাচালানের সমালোচনার জওয়াবে বাংলাদেশ রাইফেলস প্রধান বিগ্রেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত অকস্মাৎ বেসামাল উক্তি করেন যে, “সীমান্ত চোরাচালান সম্পূর্ণ বন্ধ (dead stop) হইয়াছে এবং ভারত-বিরোধীরাই চোরাচালান সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা করিতেছে।” যদিও বিগ্রেডিয়ার চিত্তরঞ্জনের অন্যায় মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকা সীমান্ত চোরাচালানের উপর তথ্যমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করিয়াছে; ইত্তেফাকের কলামিষ্ট লুব্ধক-তাহার ‘স্থান-কাল-পাত্র’ কলামে বিগ্রেডিয়ার চিত্তরঞ্জনকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ প্রদান করিয়াছেন এবং এমনকি আওয়ামী লীগের কোন কোন সংসদ সদস্যও অবিচ্ছিন্ন চোরাচালানের বিরুদ্ধে সরব কণ্ঠে নিন্দমুখর হইয়া উঠিয়াছিলেন তথাপি বিগ্রেডিয়ার চিত্তের বিরুদ্ধে দিল্লীশ্বরের ভয়ে মুজিব সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নাই।

এইদিকে ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ মিল, ফ্যাক্টরি, কল-কারখানাগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ঘোষণা করা হয়। দলীয় ও অযোগ্য লোকদের পরিত্যক্ত মিল-কারখানাগুলির প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। সুযোগ পাইয়া নগণ্য সংখ্যক ব্যতিক্রম ব্যতীত সাধারণ শ্রমিক নেতা ও মাতব্বর ধরনের শ্রমিক ও মিল কারখানার প্রশাসকবৃন্দ লুটপাটের অবাধ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সর্বত্র আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি, সরকারের অমার্জনীয় মৌন সম্মতি, ক্ষেত্র বিশেষে আওয়ামী লীগারদের সহযোগিতা এবং অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রশাসকদিগকে দালাল আইনে ভীতি প্রদর্শন এবং সর্বোপরি প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা ইত্যাকার বহু কারণেই সামগ্রিক উৎপাদন ধসিয়া পড়ে। এককথায় দেশ তীব্র বেগে ধাবিত হইতে থাকে মরহুম ডঃ মাজহারুল হকের ভাষায় “রসাতলের পানে।”

জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুজিবর রহমানের কিছু ঐতিহাসিক কার্যক্রম:

১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি মুজিব ভাই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই জাতীয় স্বার্থে কতিপয় যুগান্তকারী কার্যক্রম গ্রহণ করেন যেমন-

ভারতের সাথে প্রবাসী সরকারের গোপন বাণিজ্যিক সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী স্বাধীনতার পর পরই খোলা বাজার ভিত্তিক বাণিজ্যিক কার্য্যক্রম শুরু হয়ে যায়। দু’দেশের সীমান্তের ৩ মাইল খুলে দেয়া হয়। শেখ মুজিব তা বন্ধ করে দেন।

প্রশাসনিক গোপন সমঝোতা অনুযায়ী যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা ইত্যাদি জেলায় ভারতীয় কিছু কর্মকর্তা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছিলেন ও অন্যান্য স্থানেও আসার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু মুজিব ভাই তাহাদের ফেরৎ পাঠালেন এবং অন্যদের আসা বন্ধ করলেন। দেশীয় অফিসার যাহারা ভারতে যেতে পারেননি বা যাননি এবং যাহারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন তাহাদের সকলকে বহাল রেখেই প্রশাসন চালানোর নির্দেশ দিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের এই সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক। তিনি যদি সেদিন এই সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন না করিতেন তাহলে আমাদের যে সমস্ত অফিসার ‘৭১ এ ভারতে যায়নি তারা সবাই ডিসমিস হতেন। বাঙ্গালি মুসলমানদের শতকরা ৯৫ ভাগ চাকুরী হারাতেন। শূন্যস্থান পুরণ করতো ভারতীয় অফিসাররা। তারাই আমাদের প্রশাসনের নিয়ন্তা হতো ফলশ্রুতিতে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব কতটুকু থাকতো তা সহজেই অনুমেয়। তবে আমাদের সামরিক বেসামরিক প্রশাসনের যাহারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন ইতিমধ্যে তাহাদের চাকুরীতে ২ বৎসরের জ্যেষ্ঠতা প্রদান করা হয়। যা ছিল ঘোরতর অন্যায়। কেননা যাহারা পাকবাহিনীর প্রশাসন ছেড়ে দেশ ছেড়েছিলেন তাহারা বিবেকের তাড়নায় তাহা করেছিলেন। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতেই তাহা করেছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগের আদর্শের মহিমায় তাহারা মুক্তি সংগ্রামের রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েন কোন পুরস্কার, কোন বিনিময় কিংবা প্রাপ্তি জন্য নয়। এই ত্যাগের মহিমাকে কোন কিছুর বিনিময়ে ছোট করা অন্যায় ও অনৈতিক। অথচ ২ বৎসর সিনিয়রিটির নামে এটি করে ত্যাগের মহিমায় ভাস্কর ভবিষ্যৎ ইতিহাসে ওই প্রাপ্তি নিজের কাছেই নিজেকেই ছোট করে দেয়। আর এই কাজটি করেছে দিল্লীশ্বরী ইন্দিরা গান্ধীর বংশবদ বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ফলে দেশে কোন আদর্শ বা চরিত্র নাই, লোভের হুতাশনে আজ দেশের শিক্ষা, প্রশাসন, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড।

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য অবস্থান। শেখ মুজিব ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ১০ই জানুয়ারি দেশে ফেরার প্রাক্কালে লণ্ডন হয়ে দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে অবতরণের পর দিল্লীতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহিত মতবিনিময়ের এক পর্যায়ে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেশ হইতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সময় জানতে চান এবং অনতিবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। এতে ইন্দিরা গান্ধী কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও সময় মতো প্রত্যাহার করা হবে বলে তাকে আশ্বস্ত করিতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারি মাসে কোলকাতা সফরে গিয়ে শেখ মুজিব ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনাকালে দেশ হইতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে পীড়াপিড়ি করে ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক জেনারেল মানেকশকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দিনক্ষণ ঠিক করিতে নির্দেশ প্রদানে বাধ্য করেন। এক পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী জেনারেল মানেকশকে নির্দেশ দিলেন তার বাংলাদেশ সফরের পূর্বেই যেনো সেনা প্রত্যাহারের কাজ শুরু করা হয়। সে মতো ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারের কাজ শুরু হয়। ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এটা শেখ মুজিবের মতো দৃঢ়চেতা সাহসী নেতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। এজন্য জাতি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

পাক সেনাবাহিনীর ৯৩,০০০ যুদ্ধবন্দি সেনা সদস্যের পাকিস্তানে ফেরত নিতে ভারতের সাথে পাকিস্তানের আলোচনার সময় শেখ মুজিব এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অপরাধে বিচার দাবি করেন। এবং বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া তাহাদের পাকিস্তান ফেরত পাঠানোর বিরোধীতা করেন। পাকিস্তান দাবি করে যে তাহারা ভারতীয় কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, বাংলাদেশ কমান্ডের কাছে নয়। প্রশ্নোত্তরে শেখ মুজিব বললেন ভারতীয় কমান্ড নয় যৌথ কমান্ডের কাছে।

এদিকে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদের ব্যাপারে গণচীন তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফলে বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে শিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

শেখ মুজিব ‘৭৩ সালের অক্টোবর জাপান সফরে যান। সেখানে তিনি চীন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, চীন মহান দেশ। চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক সুদীর্ঘকালের তাহাদের কাছে সৌভ্রাতৃত্ব আর সৌহার্দ্যমূলক আচরণই আমরা আশা করবো। কিন্তু বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে চাইলে আমরা মাথা নত করবো না। এই সময় চীনের সাথে আমাদের সম্পর্কোন্নয়ন অতীব জরুরি ছিল এবং দক্ষ ও সুদূর প্রসারী দুরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের মাধ্যমেই তা সম্ভব ছিল।

১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ইসলামী সম্মেলন। বাংলাদেশকে এতে অংশগ্রহণ করানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের নিতে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুরারী বুমেদীন তাঁর নিজস্ব বিমান ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন। সকলেই দ্বিধান্বিত। তখনও পর্যন্ত পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নাই। তাজউদ্দীন গং পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ইসলামী সম্মেলনে শেখ মুজিবের যোগদানে সম্মত নয়। সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সাথে কথা বলতে হয়। তাই তারা শেখ মুজিবকে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বললে-শেখ মুজিব রাগান্বিত হয়ে তাজউদ্দীনকে বললেন, “আমি কাহারো বংশবদ নই, আমার দেশের সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হইবে। আমি ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তান যাবো।” অবশেষে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর ভারতের সাথে কথা না বলেই শেখ মুজিব ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তানের লাহোরে চলে গেলেন। বাংলাদেশ ওআইসি সদস্যপদ লাভ করে। পরবর্তীতে ‘৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশ আসেন। অন্যদিকে চীন জাতিসংঘে তার প্রদত্ত ভেটো প্রত্যাহার করে নেয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এটা শেখ মুজিবের কূটনৈতিক সাফল্যেরই ফলশ্রুতি। এটা সম্ভব হয়েছে তার চরিত্রের দৃঢ়তা ও বৈপ্লবিক গুণাবলীর কারণে। তিনি যদি ইসলামী সম্মেলনে না যেতেন, পাকিস্তানের স্বীকৃতি না পেতেন, চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন না করিতেন তাহলে জাতিসংঘে চীন তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ অব্যাহত রাখতো আর বিরুদ্ধ থাকা মুসলিম দেশগুলোও আমাদের সমর্থন দিতো। জাতিসংঘে আমাদের সদস্যপদ লাভ শুধু বিলম্বিতই হতো। গোপন সমঝোতা চুক্তির বাধ্যবাধকতায় দেশ পরিচালনায় তাজুদ্দিনের সাথে তার চরম মতদ্বৈততার কারণেই তাজউদ্দিনকে তার মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন। শুধু মন্ত্রী সভাই নয় পরবর্তীতে বাকশাল গঠনেও দেখা যায় বাকশালের সদস্যপদও তাকে দেয়া হয়নি।

প্রসঙ্গ বেগম মুজিবঃ

মুজিব সহধর্মীনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাদের সম্মানিত ভাবী। তার ত্যাগ-তিতিক্ষা-প্রজ্ঞা আর কষ্ট-সহিষ্ণুতা অতুলনীয়। রাজনৈতিক কারণে মুজিব ভাই বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাগারের বাইরের জীবনও ছিল আন্দোলন সংগ্রাম আর সংগঠন নিয়ে ব্যপৃত। অন্যদিকে ভাবী সংসার চালানো, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক গতিবিধি আর দলের নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর রাখতেন। প্রয়োজনে উপদেশ দিতেন বুদ্ধি দিতেন। দুর্যোগে দুর্বিপাকে কখনো তিনি মুষড়ে পরতেন না। সাহস হারাতেন না। বুদ্ধিমতি ও সাহসী এই মহিয়সী নারী নেপথ্যে থেকে এদেশের রাজনীতিতে অনেক অবদান রেখেছেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন। অনেক দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। বিশেষ ক্ষেত্রে সংকটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নিতে মুজিব ভাইকে সহযোগিতা করেছেন। অনেক সময় তাকে প্রভাবিতও করেছেন।

আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুজিব ভাই ক্যান্টনমেন্টে বন্দি। দেশের উত্তাল-উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জেনারেল আয়ুবের মসনদ টলটলায়মান। সে সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে আয়ুব খান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত রাখার প্রস্তাব করা হলো এবং ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আতাউর রহমান খান, আবুল মুনসুর আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ আয়ুবের দেয়া প্যারোলে মুক্তি প্রস্তাব মেনে নিলেন। যদিও গণদাবি ছিল ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের। বেগম মুজিব কিন্তু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি ছুটে এলেন আমার কাছে। আমাকে তিনি বললেন যে মামলা প্রত্যাহার না হলে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোল টেবিলে যাওয়া ঠিক হবে না। তিনি সেটা চান না। তিনি এ ব্যাপারে আমার মত জানতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম আমি আপনার সাথে একমত এবং আরো বললাম যে আপনি কি মুজিব ভাইকে ক্যান্টনমেন্টে এই খবর পাঠাতে পারবেন। তিনি বললেন, পারবেন। আমি ভাবীকে বললাম আমার কাজ আমি করবো আপনি মুজিব ভাইকে একথাটি জানিয়ে দিন আর এক্ষুণি আপনি তোফায়েল আহমদসহ ছাত্রলীগের সংগ্রামরত নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করুন এবং তাহাদেরকে এ ব্যাপারে বলুন। প্রয়োজনে আপনি ইকবাল হলে চলে যান। ভাবী সে সময় এ ব্যাপারে যা যা তাঁর পক্ষে করণীয় সব কিছুই করেছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে মুজিব ভাইয়ের নিকটও যথারীতি খবর পাঠিয়ে দিলেন। এমনকি তিনি মুজিব ভাইকে এমনও বলে দিয়েছিলেন যদি প্যারোলে মুক্তিতে রাজী হন তাহলে তার সাথে চিরদিনের মতো সম্পর্ক ছিন্ন হইবে। এর পরবর্তী ইতিহাস সকলের জানা। নেপথ্যে থেকে ভাবী এমনি অনেক কঠোর ভূমিকা পালন করেছেন যা নাকি যে কোন মূল্যায়নে সঠিক ছিল। অনেক ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনে Turing point হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সন্তানসন্ততিসহ অবরুদ্ধ এই ঢাকা শহরে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দীর্ঘ নয় মাস অতিবাহিত করেন। ২৫শে মার্চ ‘৭১ রাত্রিতে দেশের পরিস্থিতি যখন দ্রুত অবনতিশীল সে সময় মুজিব ভাই ভাবীকে ডেকে বললেন, ‘শোন হাসিনার মা দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। জানি না কপালে কি আছে? আমার যদি কিছু হয় খোকা রইল সে তোমাদের দেখাশুনা করবে। মুজিব ভাই গ্রেফতার হয়ে যাবার পর মুজিব ভাইয়ের আপন ফুফাতো ভাই একমাত্র এই মুমিনুল হক খোকা সেই দুঃসহ দিনগুলোতে নিজের জীবন বাজী রেখে ভাবী ও তাঁর সন্তানদের পাশে ছিলেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য শেখ জামালের ভারতে চলে যাওয়ার কারণে তাকে বধ্যভূমিতে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে খোকা বেঁচে যান। দুঃখের দিনে সুদিনের স্বজনেরা পাশে থাকে না। এ সত্যটি ভাবী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। ২৫শে মার্চ কালো রাত্রির পর ধানমন্ডির ৩২ নং বাসা ছেড়ে সন্তানসন্ততিসহ প্রথমে মালিবাগ পরে মগবাজার এভাবে এ বাসা ও বাসা করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরমধ্যে শেখ কামাল ভারতে চলে গেলে তিনি উতলা হয়ে পড়লেন। উপায়ন্তর না দেখে তিনি কামালের খোঁজে খোকাকে ধানমন্ডিতে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাসায় পাঠান। তাতেই যত গন্ডগোল হয়ে গেলো। খোকাকে নিয়ে মঞ্জু ও তার মা বেগম মানিক মিয়াসহ মগবাজারের যে বাসায় ভাবী থাকতেন সে বাসায় হাজির। পরবর্তী অধ্যায়- মঞ্জুর বাসায় আইএসআই প্রধান মেজর জেনারেল ওমরের সাথে খোকার সাক্ষাতের ব্যবস্থা। পরিণতিতে পাক বাহিনীর ঠিক করে দেয়া ধানমন্ডীর ১৮ নং সড়কের বাসায় তাহাদের প্রহারাধীনে ভাবী তাঁর সন্তানাদিসহ ১৯৭১ এর বিজয় দিবস তৎপরবর্তী ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি মুজিব ভাই এর ঢাকা প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত সেই বাড়িতেই অন্তরীণ ছিলেন। এই যে ভাবী তার সন্তান সন্ততিসহ পাক বাহিনীর পাহারাধীন বাড়িতে নজরবন্দি অবস্থায়, শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে ছিলেন এটাই সুহৃদ মঞ্জু ও মঞ্জুর মার খেলা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৬ই ডিসেম্বর ‘৭১ বিজয় দিবসে রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও ১৮ নং সড়কে যে বাসায় ভাবী থাকতেন সে বাসা থেকে পাকিস্তানী সেনা প্রহরা প্রত্যাহার হওয়াতে ভাবীসহ পরিবারের সকলের জীবন আশংকা দেখা দেয়। এরই মধ্যে ভারতীয় সেনা বাহিনীর মেজর তারা সেখানে আসলেন এবং পাকিস্তান সৈন্যদের সেখান থেকে সরে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন ও চলে যেতে বললেন। পাক সেনারা ১ ঘণ্টা সময় চাইল। কিন্তু মুমিনুল হক খোকা তাহাদের দুরিঅভিসন্ধি আঁচ করিতে পেরে মেজর তারাকে অনুরোধ করলেন তিনি যেনো তাহাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তার ভয় ছিল যদি মেজর তারা চলে যায় সে সুযোগে পাক সেনারা তাহাদের সকলকে নিমিষে হত্যা করে ফেলবে। মেজর তারাও ব্যাপারটি বুঝতে পেরে তিনি পাক সেনাদেরকে তার উপস্থিতিতেই সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করে। মুজিব ভাই দেশে আসার পর ভাবী এ প্রসঙ্গটি তাকে বলেন এবং মেজর তারার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধে তাকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। স্বস্ত্রীক মেজর তারা বাসায় এলে ভাবী মিসেস তারাকে একটি হীরার নেকলেস উপহার দেন আর খোকা মেজর তারাকে একটি ওমেগা ঘড়ি উপহার দেন। [মুক্তিযুদ্ধকালে বেগম মুজিবের সেই দুঃসহ দিনগুলো সম্পর্কে মুমিনুল হক খোকা লিখিত অন্তরালে স্মৃতি সমুজ্জল : বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার ও আমি বইটি পড়লে বিস্তারিত জানা যাবে]

শেখ মুজিবুর রহমানের কারাজীবন

নানা বানোয়াট, ভুল, বিভ্রান্তিকর জনরব ও অতি উৎসাহীদের মিথ্যা-প্রচারণা অপমোদনের জন্য সরকারি দলিলসহ আমার জানামতে সঠিক তথ্য নিম্নে দেওয়া হইল :

Confidential

Government of the People’s Republic of Bangladesh. Office of the D.I.G. of Prisons, Dacca Division, Central Jail Dacca.

Memo No.                  SB dated                                    1974

To,

The Inspector-General of Prisons,

Bangladesh, Dacca.

Subject : Background materials on the prison life of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, the Prime Minister of Bangladesh.

Reference : Your Memo No, 258/Con-5/74 dt. 2-7-74.

In obedience to your memo, under reference I am to submit a detailed report regarding detention of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman as per records available in Dacca Central Jail.

1. He was committed to Dacca Central Jail on 1-1-1950 under section 18(2) B.P.S.O. VII of 1946.

2. Convicted on 12-9-1950 to R.I. for three months under section 147 P.P.C. and was transferred to Gopalganj Sub-Jail on 26-10-50 to answer a charge and was again readmitted to Dhaka Central Jail on 30-8-51 on transfer from Faridpur Dist. Jail as per G.O. No. 1036-H.S. dated 21-3-51 and was retransferred to Faridpur Dist. Jail on 15-2-1952.

3. He was again committed to Dhaka Central Jail on 31-5-1954 in connection with Kotwali P.S Case No 33 (3) 53 u/s 7 (1) 3 by the S.D.O. (S), Dacca and became a security prisoner on 18-8-1954 asper G.O. No. 2577-H.S dt. 12-7-1954 and under G.O. No. 3302-H.S. dt. 3-8-1954 and was released on 18-12- 1954 under G.O. No. 145 (P)/54 dated 181211954

4. Again he was committed to Dacca Central Jail on 12-10-1958 as an under trail prisoner in connection with 5A of E. Pak. Act. LXX-11/58 and u/x. 5(2) of Act II/47 by the S.D.O. (S),

Daca and became a security prisoner or 20-10-58 under Special Power Ordinance 1958 and was released on 17-12- 1959 under G.O. No. 949-H.S. dated 17-12-1959.

5. Again in the year 1962 on 7-2-62 he was committed to Dhaka Central Jail as a security prisoner as per G.O. No. 254-H.S. dated 27-2-62 and 512-H.S. dt. 31-2-62 under section E.P.S.O. 1958 and was released on 18-6-62 under G.O. No. 1159 dt. 19-6-62.

6. Again on 8-5-66 he was committed to Dacca Central Jail under rule 32 D.P.R. 1965. He was convicted on 27-4-67 to suffer S.I. for 1-3-0 months in connection with G.R. No. 189/66 under section 47(5) D.P.R. 1965 under rules 32 of 1965 by Mr, Aftabuddin Ahmed Magistrate, 1st Class, Dacca the trial of which was held inside the Jail Office and was released on bail on 1-6-67. He was confined in Dacca Central Jail upto 17-1-68 and was taken to Dacca Cantonment in connection with “Agartala Conspiracy Case” from the Jail Gate.

(K. A. AWAL)

Dy. Inspector-General of Prisons,

Dacca Division, Central Jail, Dacca.

The following informations are to be added to the above:

1. Arrested on 11th March 1948 and released on 15th March 1948.

2. Sk. Mujibur Rahman was arrested on 19th April, 1949 for his participation in the movement against expulsion of students by the authorities of Dhaka University in connection with the students support of fourth class employees of the University and (if my memory does not fail me) released on 27th June 1949.

3. Arrested on 17th January 1968 in connection with Agartala Conspiracy case and after the withdrawal of the said case released on 22nd February (1969) from Dhaka Contonment.

4. Sk. Mujibur Rahman again arrested on the night of 25th March 1971 and released from Mianwali Jail, Pakistan on 8th January 1972.

He suffered imprisonment for a period of about 8 years Since 1948 to 1972 before taking over as the President of Bangladesh.

বঙ্গানুবাদ

গোপনীয়

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

ঢাকা বিভাগীয় কারা পরিদর্শক-এর কার্যালয় ঢাকা বিভাগ,

কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা।

প্রতি

মহা কারা পরিদর্শক

ঢাকা, বাংলাদেশ

বিষয় : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাজীবন সংক্রান্ত তথ্যাবলী।

সূত্র : আপনার স্মারক নং ২৫৮/কন-৫/৭৪ তাং ২-৭-৭৪

সূত্রে বর্ণিত আপনার স্মারক মোতাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রাপ্ত রেকর্ডের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডিটেনশন সংক্রান্ত একটি বিশদ রিপোর্ট পেশ করিতেছি :

১। ১৯৪৬ সালের বি.পি.এস.ও VII ধারার সেকশন ১৩(২)-এর অধীনে ১-১- ১৯৫০ সালে তাঁহাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয়।

২। ১২-৯-১৯৫০ সালে ১৪৭ পি.পি.সি, সেকশনের অধীনে তাহাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং একটি অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য ২৬-১০ ৫০ গোপালগঞ্জ সাব জেলে বদলী করা হয় এবং ৩০-৮-৫১ তারিখে জি.ও নং ১০৩৬ এইচ.এস তাং ২১-৩-৫১ মোতাবেক ফরিদপুর ডিষ্ট্রিক্ট জেল হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয় এবং ১৫-২-১৯৫২ তারিখে আবার ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বদলী করা হয়।

৩। আবার ৩১-৫-১৯৫৪ তারিখে ৭(১)৩ ধারার অধীনে পি.এস কেইস নং ৩৩ (৩) ৫৩-এর কারণে ঢাকার মহকুমা অফিসার (সাউথ) কর্তৃক তাঁহাকে আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয় এবং জিও নং ২৫৭৭ এইচ.এস তাং ১২-৭-১৯৫৪ এবং জিও নং ৩৩০২ এইচ.এস তাং ৩-৩

১৯৫৪ অনুযায়ী নিরাপত্তা বিন্দী হন এবং জি.ও. নং ১৪৫ (পি), ৫৪ তাং ১৮-১২-১৯৫৪ অনুযায়ী ১৮-১২-১৯৫৪ তারিখে মুক্তি পান।

৪। আবার ইস্ট পাক এ্যাক্ট LXX-II/৫৮-এর ৫ক এবং এ্যাক্ট II/৪৭-এর সেকশন ৫(২)-এর অধীনে ঢাকা মহকুমা অফিসার (সাউথ) কর্তৃক ১২-১০- ১৯৫৮ তারিখে তাঁহাকে বিচারাধীন আসামী হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয় এবং ১৯৫৮ সালের স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্সের অধীনে ২০-১০-১৯৫৮ তারিখে নিরাপত্তা বন্দি হন এবং জি.ও নং ৯৪৯ এইচ.এস তাং ১৭-১২-১৯৫৯ মোতাবেক ১৭-১২-১৯৫৯ তারিখে মুক্তি লাভ করেন।

৫। আবার জি.ও নং ২৫৪ এইচ.এস তাং ২৭-২-৬২ এবং জি.ও নং ৫১২ এইচ.এস তাং ৩১-২-৬২ মোতাবেক এবং ১৯৫৮ সালের ই.পি.এ.ও এর অধীনে তাহাকে ৭-২-৬২ তারিখে নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয় এবং জি.ও নং ১১৫৯ তাং ১৮-৬-৬২ মোতাবেক ১৮-৬-৬২ তারিখে মুক্তি দেওয়া হয়।

৬। আবার ১৯৬৫ সালের ৩২ ডি.পি.আর-এর অধীনে ৮-৫-৬৬ তারিখে তাঁহাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করা হয়। ২৭-৪-৬৭ তারিখে ১৯৬৫ সালের ৪৭ (৫) ডি.পি.আর ও ১৯৬৫ সালের রুলস ৩২-এর অধীনে জি,আর নং ১৩৯৩/৬৬ অধীনে জেলখানার অভ্যন্তরে তাহার বিচার হয় এবং ঢাকার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আফতাবউদ্দীন আহমদ তাহাকে ১ মাস ৩ দিনের সাধারণ কারাগণ্ড দেন। ১-৬-১৯৬৭ তারিখে তিনি মুক্তি পান। ১৭-১-৬৮ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন এবং জেল গেট হইতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের ব্যাপারে তাঁহাকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।

স্বাক্ষর- ডি.আই.জি প্রিজন

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।

উপরে বর্ণিত তথ্যাবলী সহিত নিম্নতথ্যাবলী যোগ করিতে হইবে

১। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেফতার ও কারামুক্তি ১৫ মার্চ ১৯৪৮ইং।

২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন বেতনভুক কর্মচারী ধর্মঘট সক্রিয় সমর্থন অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ছাত্র বহিষ্কারের প্রতিবাদে আন্দোলন করিবার কারণে শেখ মুজিবর রহমান ১৯শে এপ্রিল ১৯৪৯ইং তারিখ গ্রেফতার হন ও বোধহয় (আমার স্মৃতিভ্রম যদি না হয়ে থাকে) ২৭শে জুন। (১৯৪৯) মুক্তি পান। অর্থাৎ ২ মাস ৯ দিন কারাবাস করেন।

৩। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হইয়া ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি গ্রেফতার হন এবং ঐ মামলা প্রত্যাহার করিবার পর ঢাকা সেনানিবাস হইতে ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে মুক্তি পান।

৪। শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালের দিবাগত রাত্রে পুনরায় গ্রেফতার হন এবং ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাক সরকারের মীয়ানওয়ালী কারাগার হইতে মুক্তি পান।

১৯৪৮ সাল হইতে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে সর্বমোট প্রায় ৮ বৎসর তিনি কারাজীবন ভোগ করেন।

কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্বকরণ

১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ কলমের এক খোঁচায় দেশের যাবতীয় কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করা হইল। পূর্ব হইতে কোন ইনভেন্টরী তৈয়ার না করিয়া প্রশাসকদের তত্ত্বাবধানে মিল-কলকারখানার পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হইল। অবশ্য পূর্বেই পরিত্যক্ত মিল-কলকারখানাগুলিতে প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। এইদিকে আবার রাষ্ট্রায়ত্ত করিবার পর কোন কোন মিল-কারখানার মালিকদের তাহাদের স্ব স্ব মিলের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা নামধারী শ্রমিকদের অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং সাবেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রশাসকদিগকে দালাল আখ্যা দান ও ভীতি প্রদর্শন মিল কারখানার ব্যবস্থাপনাকে প্রহসনে পরিণত করে এবং সামগ্রিক উৎপাদনসমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অধিকাংশ কলকারখানাই যোগ্য প্রশাসক ও শ্রমিক নেতৃত্বের যোগসাজশে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়। অবশ্য ইহাই ছিল স্বাভাবিক। কেননা যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং কলকারখানা ধ্বংসের জন্য ভারতীয় মারোয়াড়ী গোষ্ঠী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানাভাবে লিপ্ত, তখন শেখ মুজিব এবং তাহার সরকার ত্যাগী, সচেতন ও সজাগ দেশপ্রেমিক শক্তিকে সুসংহত ও সুসংগঠিত না করিয়া সর্বনাশা সস্তা বুলির আশ্রয়ে আসর বাজীমাৎ করিবার তালে ছিলেন। আর তাই অন্যকিছু বিবেচনা ও বাস্তবতা বিচার না করিয়াই জাতীয় শিল্প ও অর্থনীতিকে কলমের এক খোচায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে তাহারা এতটুকু কুণ্ঠিত হন নাই। ভারতীয় অভিজ্ঞ নেতৃত্ব তাহাদের শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করিবার মত সর্বনাশা পথ কেন মাড়ায় নাই, তাহা অনুধাবন করিবার মত ধীশক্তি শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামী লীগের কোন নেতার ছিল না। তদুপরি ছিল রুশপন্থীদের উস্কানি। ফলতঃ মুজিব সরকারের চরম অবিমৃষ্যকারিতা দেশের সমগ্র অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে। কথায় বলে, দেবদূতগণ যেখানে যাইতে সাহস পায় না মূর্থরা তড়িঘড়ি করিয়া সেখানে প্রবেশ করে।

জেনারেল ওসমানীই সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন

কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ নাই

গণপ্রজাতন্ত্রী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর ১২ এপ্রিল ১৯৭১-এর পূর্বাহ্ন হইতে বঙ্গবীর ওসমানীকে মুক্তিবাহিনী গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীসহ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা কমান্ডার ইন-চীফ নিযুক্ত করা হয়। চীফ অব স্টাফ বা প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার নিযুক্ত করা হয় মেজর জেনারেল (তখন লেঃ কর্নেল) এম এ রবকে। ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয় লেঃ কর্নেল এ আর চৌধুরীকে। জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবীর ওসমানীকে কর্নেল থেকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন যা ১৯৭১ সনের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে কার্যকরী করা হয়। গণপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী ১৯৭২ সনের ৭ই এপ্রিল সর্বাধিনায়কের পদ থেকে পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করার পর সর্বাধিনায়কের পদ ও যৌথ কমান্ড বিলুপ্তি ঘোষণা করেন; যে ১৯৭২ সনের ২৭শে এপ্রিল বাংলাদেশ গেজেটে নিম্নলিখিতভাবে প্রকাশিত হয়।

MINISTRY OF DEFENCE NOTIFICATIONS

NO 01/17/72 (NGO) 108 DEF/SECY-7th April. 1972 with a view to effectively participate in the proceedings of the Constituent Assembly as an MCA. General M.A.G. Osmany. p.s.c. M.C.A. resigned his appointment as C-in-C. Bangladesh Forces, and his resignation having been accepted by the president. He vacated the temporary appointment of C-in-C. Bangladesh Forces with effect from 7th April 1972 (forenoon). Accordingly he is reverted to the pension list from the same date. No. 01-31-33/72-110(3) DEF/SECY-7th April 1972 with the vacation of the appointment of Temporary C-in-C. Bangladesh Forces. The combined command of Bangladesh Forces has been abolished with effect from 7th April 1972 (forenoon) and replaced by three separate commands for the Bangladesh Army, Navy and Air Force with the following Acting Chiefs of staff with immediate effect and until further orders.

বঙ্গবীর ওসমানী ১২ই এপ্রিল ‘৭১ ইং থেকে ৭ই এপ্রিল ‘৭২ ইং পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গণপরিষদের ১৯৭২ সনের ৩১শে অক্টোবর অধিবেশন বিবরণী হইতে বঙ্গবীর ওসমানীর বক্তৃতার একটি অংশ নিয়ে প্রদত্ত হলো (সংবিধান সংশোধনের একটি প্রস্তাব দেয়ার সময় তিনি এই বক্তব্য দেন)

মাননীয় স্পীকার সাহেব

“দল, মত, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমগ্র বাঙ্গালি জাতীয় ঐক্যবদ্ধভাবে দঢ় সংকল্প আর সাহসিকতার সঙ্গে, বীরত্ব আর নিষ্ঠার সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন প্রায় হতাশাজনক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে। আর এ সংগ্রামই হল ইতিহাসে প্রথম মুক্তি সংগ্রাম, যেখানে সাংবিধানিক উপায়ে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এই সংগ্রামে আওয়ামী লীগ সরকার বাঙ্গালি জাতিকে বিজয়ের পথে, মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। এতে বাংলাদেশের সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিল। এই যুদ্ধে আমার অপ্রাপ্য সম্মান ছিল বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার।”

যুব সমাজের অধঃপতন: দেশময় নৈরাজ্য

দেশের বিভিন্ন পর্যায় ও শ্রেণির লোক মুক্তিযুদ্ধে শামিল হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ছাত্র সম্প্রদায়। “দাসত্ব বরণ অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়” এই ছিল ছাত্র সমাজের দৃঢ় পণ। দেশের স্বার্থে উৎসর্গিত প্রাণ এই ছাত্র সমাজ ১৬ই ডিসেম্বর (১৯৭১) বিজয় দিবসের পর হইতেই নেতৃত্বের চরিত্রহীনতা ও ভ্রান্তনীতির দরুণ ত্যাগের মহিমা ও দেশপ্রেমের তাৎপর্য অনুধাবন করিবার মত অনুকূল আবহাওয়া হইতে নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিবার কারণে যে ৯ মাস তাহারা পড়াশুনা করিতে পারে নাই, সেই ৯ মাস ছাত্র সম্প্রদায় কর্তৃক ত্যাগ হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত ছিল এবং পরবর্তী শিক্ষা বৎসরের নির্ধারিত পরীক্ষায় তাহাদের যথারীতি অংশগ্রহণ করিবার মধ্যেই নিহিত ছিল জাতীয় স্বার্থ। পক্ষান্তরে সংক্ষিপ্ত কোর্সে পরীক্ষা দিলে বা বিজ্ঞান পরীক্ষায় প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা ব্যতীত ডিগ্রি গ্রহণ করিলে অথবা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিবার অজুহাতে ঢালাও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার দাবি আদায় করিলে পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হারাইয়া যায় অর্থাৎ ডিগ্রি অর্থহীন হইয়া পড়ে। জ্ঞানার্জনে বা বিদ্যা শিক্ষায় কোন সংক্ষিপ্ত পন্থা নাই। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিহীনতার কারণে এবং বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও শিক্ষা বিভাগীয় সুপণ্ডিত, জ্ঞানী, গুণী বলিয়া পরিচিত মহল এই সময়ে শিক্ষাঙ্গণে, পরীক্ষা ক্ষেত্রে ও শিক্ষাদানের ব্যাপারে কলঙ্কময় অধ্যায় সংযোজন করিয়াছেন। উহাই যে তরুণ সমাজের নৈতিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ বিবেকবান মাত্রই তাহা স্বীকার না করিয়া পারিবেন না। বস্তুতঃ অস্বীকার করিবার উপায়ও নাই যে, নীতিহীন নেতৃত্ব, অস্ত্রের ঝনঝনানির নিকট শিক্ষা গুরুদের আত্মসমর্পণ, শিক্ষাঙ্গণে চরিত্রহীন, উচ্ছৃঙ্খল ও জ্ঞান অর্জন বিবর্জিত পরিবেশ সৃষ্টিতে এক শ্রেণির মতলববাজ মহলের সায় ও উৎসাহ যুব সমাজকে অধঃপতনের আবর্তে ঠেলিয়া দিয়াছিল। এবং শিক্ষাঙ্গনই যেহেতু এই দেশের নাগরিক সচেতনতার মূল কেন্দ্র, সুতরাং পরিণতিতে, দেশময় নৈরাজ্য সৃষ্টিতে দেরী হয় নাই। এই প্রসঙ্গে জগত্বরেণ্য রাষ্ট্রনীতিবিদ স্যার উইনষ্টন চার্চিলের ফরাসী-বিপ্লব মূল্যায়ন সংক্রান্ত মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য:

“Now France gave a frightful demonstration of what happens when the social forces unleashed by reformers break free from all control.”

ইহার মর্মার্থ এই যে, সামাজিক যে সব বিধি-বিধান শক্তি হিসাবে সমাজকে পরিচালিত করে-সমাজ সংস্কারকগণ নিজেরাই যখন সেইসব বিধি-বিধানকে নস্যাৎ করতঃ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন; তখন অবস্থা যে কি ভয়াবহ হইতে পারে, ফরাসী দেশ উহার জ্বলন্ত উদাহরণ। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল।

বস্তুতঃ বাংলাদেশের যে কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় ছাত্র ও শ্রমিক শ্রেণির অত্যন্ত সংঘবদ্ধ ও কার্যকর ভূমিকা বিদ্যমান। শিক্ষাঙ্গন ও শিল্পাঙ্গন দুইটিই মূলতঃ যুব শ্রেণিভুক্ত অথচ মুজিব সরকারের নীতিহীনতায় এই দুই গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি হইয়া পড়িয়াছিল ধ্বংসন্মুখ। আজাদী উত্তরকালে উভয় শক্তিকেই দেশ গঠনের যথাযথভাবে নিয়োজিত করিতে মুজিব সরকার ব্যর্থ হন মারাত্মকভাবে। জাতীয় নেতৃত্বের নীতিহীনতায় যুব সমাজে আইন অমান্য হইতে আইন ভঙ্গের প্রবণতা অত্যন্ত উৎকটভাবে দেখা দেয়। সর্বত্রই আইন-শৃঙ্খলা পরিণত হয় অতীতের বস্তুতে। অবস্থা তখন এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে, কোথাও জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বলিয়া যে কিছু আছে, তাহা মনে হইত না। শুধু মনে হইত সমাজের সর্বস্তরে অরাজকতা বিরাজমান।

অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক-সরকার কর্তৃক সংগঠিত রাজাকার, আলবদর, আলসামস ইত্যাদি বাহিনী, দুর্ধর্ষ স্বভাব অপরাধী, মার্কসীয় দর্শন অনুসারী বিভিন্ন অস্ত্রধারী বাহিনী ও সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের এক অংশ আইন-শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতির জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল। কিন্তু সব চাইতে বেশি দায়ী ছিলেন মুজিব সরকার। কেননা, সবদেশেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর অস্ত্র উদ্ধার সরকারের অবশ্য করণীয় দায়িত্বের অঙ্গীভূত। ইহার ব্যতিক্রম হইলেই সমাজ জীবনে শান্তি অতীতের কাহিনীতে পর্যবসিত হয়। পরিতাপের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান এবং তাহার আওয়ামী লীগ সরকার অস্ত্র উদ্ধার কিংবা আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত নিজস্ব বেসরকারি লালবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কিংবা ভারতের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত রক্ষীবাহিনীর যথেচ্ছ অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ দূরে থাকুক, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে উৎসাহ দান করিতে কুণ্ঠিত হইত না। এমন কি ডাকাতি, রাহাজানি, হত্যা, মারপিট, লুট, ধর্ষণ, ছিনতাই, জবর-দখল ইত্যাদি গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ও আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কিছুই করা সম্ভব হইত না। কেননা, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবর্গ ও সংসদীয় সদস্যগণের নির্দেশে আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ শুধু নয়, বরং বাংলাদেশ রাইফেলস এবং এমন কি সৈন্য বাহিনী পর্যন্ত তাহাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হইত। প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার আর কাহাকে বলে? কথায় ও কাজের গরমিলের দরুণ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান অচিরেই আস্থা হারাইয়া ফেলেন। তাই তাঁহার আবেদন সত্ত্বেও অস্ত্রধারীরা অস্ত্র জমা দেয় নাই, অনেকে স্বীয় আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই অস্ত্র লুকাইয়া করিয়াছিল। মারাত্মক মারাণাস্ত্রেরও আপন আপন বৈশিষ্ট্য আছে আর তাহা এই যে, উহা মালিককে অনেকটা বেপরোয়া করিয়া তোলে।

এইভাবে ক্ষতাসীন আওয়ামী লীগের স্বার্থে আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন এমন কি আইন-আদালত পর্যন্ত যথেচ্ছ ব্যবহৃত হইবার ফলে, আইন-কানুন ও প্রশাসনিক সদুদ্দেশ্য ও নিরপেক্ষতার উপর দেশবাসী ক্রমশঃ আস্থা হারাইয়া ফেলে। যেখানে আইনের শাসনের ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস, সেখানেই অবক্ষয়ের সূত্রপাত। আর কোথাও একবার অবক্ষয়ের সূত্রপাত হইলে তাহা সমাজের বিভিন্ন স্তরে অলক্ষ্যে বিস্তৃতি লাভ করে। শান্তি ও স্বস্তি, স্থিতি ও সমৃদ্ধি হয় অপসৃয়মান। নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে বাংলাদেশে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন, মূল্যবোধ ও চরিত্র এক কথায় সর্বস্তরে এই অবক্ষয়ের দৌরাত্ম্যে পরিলক্ষিত হইত। প্রশাসন কর্মচারীরা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সর্বক্ষণ শ্রীমান থাকেন। “রাষ্ট্রপতি আদশে ৯” সরকারি কর্মচারীদের সকল ক্ষমতা, নৈতিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্ম উদ্যোগ ও উদ্যম অপহরণ করিয়া নিয়াছিল। ফলে গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাই নতজানু প্রশাসনে পর্যবসিত হইয়া পড়িয়াছিল।

আওয়ামী লীগের অবিবেচক রাজনৈতিক পদক্ষেপ

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অশান্তি হ্রাস বা দূরীকরণ দেশ ও জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। হিন্দু মহাসভা ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিল। অতীত ভূমিকার সূত্র ধরিয়া পাকিস্তান সরকার হিন্দু মহাসভা কিংবা পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ করে নাই অথবা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা বিরোধী ভূমিকার কারণে কাহাকেও কারাগারে নিক্ষেপ করে নাই। অথচ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে অপরিণামদর্শী বাংলাদেশ সরকার মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাবিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। রাজনৈতিক মতভেদ প্রসূত অতীত ভূমিকার দরুণ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে দালাল আইনে আটক করা হয়। অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টির অভাবই উক্ত অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপের জন্য দায়ী। ভারত-ফেরতা শরণার্থী ও অস্ত্রধারীরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে অবস্থানকারী কোটি কোটি মানুষের বিরুদ্ধে দালালীর অভিযোগ আনে এবং স্বীয় ব্যক্তিগত, পরিবারগত ও গোষ্ঠীগত হীন-স্বার্থ চরিতার্থ করিবার অপপ্রয়াসে গ্রাম-গ্রামান্তরে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। ফলে জনতা হইয়া পড়ে হতোদ্যম, নিরাশ ও হতাশ।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

এদিকে জীবনযাত্রার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মুজিব সরকারের ভ্রান্ত নীতির দরুণ সাধারণ ক্রেতার আয়ত্বের বাহিরে চলিয়া যায়। এক টাকার গামছার দাম হয় সাত টাকা। পাঁচ টাকার শাড়ীর দাম হয় পয়ত্রিশ টাকা। তিন টাকার লুংগি পনের টাকা বা কুড়ি টাকা, দশ আনা বা বার আনা সেরের চাউল হয় দশ টাকা। আট আনা সেরের আটা ছয়-সাত টাকা। দুই আনা সেরের কাচা মরিচ চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। তিন-চার টাকা সেরের শুকনা মরিচ আশি-নব্বই টাকা। আট আনা সেরের লবণ চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। পাঁচ টাকা সেরের সরিষার তৈল তিরিশ-চল্লিশ টাকা। সাত টাকা সেরের নারিকেল তৈল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। এক টাকা সেরের মুসুরির ডাল আট-নয় টাকা। সাত টাকার লাঙ্গল ত্রিশ-চল্লিশ টাকা। ছয় টাকার কোদাল তিরিশ টাকা। একশত সাতচল্লিশ-দেড়শত টাকা ভরি স্বর্ণ নয়শত-এক হাজার টাকা। পনের টাকার কাফনের কাপড় আশি-নব্বই টাকা। দেড় টাকার কাপড় কাঁচা সাবান আট-নয় টাকা অর্থাৎ এক কথায় জীবনযাত্রার সার্বিক সংকট মানুষকে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করে।

মুদ্রাস্ফীতি ও কালো টাকা মুজিব সরকারের ব্যর্থতার কারণে ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়াছিল আর উহাই হইয়া দাঁড়াইয়াছিল সর্বগ্রাসী দূর্নীতির মূল। দুর্নীতি দমন আইন ও বিধি ছিল বটে; কিন্তু তাহা যেন সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মুজিব সরকারের শাসনদৃষ্টে যে কাহারও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, শাসক, শাসকের অনুগ্রহভাজন ও বিত্তবানদের জন্য একপ্রকার এবং শাসিত জনতা ও বিত্তহীনদের জন্য অন্য প্রকার-দেশে এই দুই প্রকার আইন প্রচলিত। তাই পূর্বেবর্ণিত কারণে শঙ্কিত, সর্বক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত, সংশয়াপন্ন ও আড়ষ্ট প্রশাসন ন্ত্র কালো টাকায় বিত্তবান, আওয়ামী লীগ দলীয় ব্যক্তি, সশস্ত্র বেসরকারি বাহিনী ও তাহাদের আশ্রয়পুষ্ট এবং উপর তলার আর্শিবাদপুষ্ট অথচ জঘন্য অপরাধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে ইতস্ততঃ করিত; পারতপক্ষে আইন প্রয়োগে বিরত থাকিত। ফলে আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসন যন্ত্র এমন কি আইন-আদালত পর্যন্ত অকেজো হইয়া পড়িয়াছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এই সময়ে কয়েকটি বাক্যাংশে চমৎকারভাবে এই চরম সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির ইংগিত প্রদান করিয়াছিলেন। যথা Frightening flight of capital বা ভয়াবহ মুদ্রা পাচার; Production failure বা উৎপাদান ব্যর্থতা; excessive supply of money বা অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ এবং Absence of law and order- বা আইন শৃংখলার অভাব। যাহা হউক, এই সময়ের ঘটনারাজির পর্যালোচনা স্পষ্ট ইংগিত দেয় যে, শেখ মুজিবের আমলে তদীয় সরকারের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যোদয় সত্ত্বেও অমানিশার ঘোর কাটে নাই; অবহেলায় সুবর্ণ সুযোগ অতিবাহিত হইয়াছে; একটি রক্তক্ষয়ী বিপ্লব-প্রসূত মহাত্যাগ বৃথা গিয়াছে।

কলঙ্কময় অধ্যায় ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠা

আগেই বলিয়াছি, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হইয়াছিল।

গণপরিষদ ১৯৭২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর গৃহীত সংবিধানটি সত্যায়ণ (authenticate) করে। গৃহীত এই সংবিধান মোতাবেক ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরিতাপের বিষয় নির্বাচন অবাধও হয় নাই, সুষ্ঠুও হয় নাই। নির্বাচন পরিচালনায় পূর্তগালের সালাজার, স্পেনের ফ্রাঙ্কো আর বাংলাদেশের শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে গুণগত কোন পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয় নাই।

১৯৭৩-এর মার্চের এই সাধারণ নির্বাচনে প্রশাসনিক ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহার, চরম দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ, মিডিয়া ক্যু, দলীয় বাহিনীর যথেচ্ছ আগ্নেয়ান্র ব্যবহার ও ঢালাও হুমকির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন দখল করেন। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল জঘন্য কারসাজি, কারচুপি আর মিডিয়া ক্যু এর মাধ্যমে উলট-পালট করিয়া তাহাদের অনুকূলে কজা করে। আমি যেখানে ২৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে নিশ্চিত জয়ের পথে তখন বেতার ও টেলিভিশন-এর মাধ্যমে আমাকে ১০ হাজার ভোটে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। পরে আমি ঢাকায় ফিরে এলে শেখ মুজিব টেলিফোনে আমাকে বলেন- “কিরে অলি আহাদ, ইলেকশনে পাস করলি না?” ইহা তাহার দ্বারা সাংবিধানিক গণতন্ত্র, নীতি ও আদর্শ তথা ঘোষিত রাষ্ট্রীয় আদর্শসমূহ লংঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ। ইহার ফলে, সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা সম্বন্ধে জনমনে মরাত্মক সন্দেহের উদ্রেক হয়। বস্তুতঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের সর্বগ্রাসী উদ্ভট ক্ষমতালোভ ও তজ্জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য অপব্যবহারের মানসিকতা দেশ ও জাতিকে এক চরম বিপর্যয়ের মুখে নিক্ষেপ করে। এইসব পরিদৃষ্টে দেশী পত্র-পত্রিকাগুলিতে তো বটেই ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধকালীন অবস্থায় যে সব বিদেশী পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন ছিল তাহারাও মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা ও সমালোচনামুখর তথ্যপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এবং এই সবই শাসকগোষ্ঠীর নাভিশ্বাসের কারণ হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কঠোর সমালোচনার পটভূমিকায় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাকল্পে শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী বলে দেশে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করেন এবং ২৫শে জানুয়ারি ৫ বৎসরের জন্য নিজেই একনায়কসুলভ শাসন পদ্ধতির প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। ইহার ফলাফল অবশ্যই শুভ হয় নাই। এক সামরিক অভ্যুত্থানে ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত্রে শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে পরিবার পরিজনসহ নিহত হন। এই সামগ্রিক ঘটনাবলী স্মরণ করাইয়া দেয় মধুসূদন দত্তের অমর কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’-এর সেই খেদোক্তি- “নিজ কর্মদোষে হায় মজাইলা কনকলঙ্কা, রাজা মজিলা আপনি।

ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়াস

উল্লেখ্য যে, শাসক আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সাধারণ নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার তাগিদে আমরা বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনী সমঝোতায় পৌঁছি। স্বাভাবিকভাবেই ঐক্য প্রয়াসের মূল মধ্যমণি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই সময়ে অসুস্থতার দরুণ তাহাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে অবস্থান করিতে হইতেছিল। ইহার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান একদিন তাহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। রোগমুক্তির পর মাওলানা ভাসানী হাসপাতাল ত্যাগ করিলেন বটে, তবে বিরোধী দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি আর অংশগ্রহণ করেন নাই। দু্র্জেয় রহস্যেঘেরা তাঁহার এই নির্লিপ্ততা। অবশ্য সবকিছু দেখিয়া শুনিয়া বলতে হয় যে, যদিও তিনি ছিলেন বিরোধী দলীয় রাজনীতির অন্যতম দিকপাল ও জাতীয় নেতা, তথাপি ৬০ দশকে সামরিক একনায়ক জেনারেল আইউবের প্রতি ৭০ দশকে গণতন্ত্র বিধ্বংসী শক্তি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের প্রতি তিনি যে দুর্বলতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন তাহা জনগণের সার্বভৌমত্ব তথা নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চরম ক্ষতি সাধন করিয়াছে।

প্রসঙ্গতঃ ইহাও উল্লেখ্য যে, সাধারণ নির্বাচনে যথেচ্ছ দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ ও ঢালাও কারচুপির অভিযোগে সকল রাজনৈতিক দল শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁহার সরকারকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপন করিলেও ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় কোন ভূমিকা গ্রহণ করেন নাই। আমরা বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর এম, এম, জলিল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) ভাইস চেয়ারম্যান ডঃ আলীম-আল রাজী ও সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদ এবং বাংলাদেশ জাতীয় লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খানের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রতিবাদে প্রত্যক্ষ গণআন্দোলনের প্রস্তাব করি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় নেতৃবৃন্দ নীতিগতভাবে মৌলিক একাত্মতা প্রকাশ করিলেও বাস্তবে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার সংগ্রামে গণআন্দোলন সৃষ্টির প্রস্তাব পরিপ্রেক্ষিতে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করিয়া নীরব ভূমিকা পালন করেন। যুগে যুগে রাজনৈতিক দলগুলির নীতিবিগর্হিত সচেতন নিষ্ক্রিয় ভূমিকাই দেশে দেশে ডিক্টেটরী শাসকদের পথ সুগম করে এবং ইহা ডিক্টেরদের মূলধন।

সাধারণ নির্বাচনের পর এপ্রিল মাসে (১৯৭৩) প্রাণপ্রতিম কনিষ্ঠ সহোদর আমিরুজ্জামান, সি, এস, পি’র আমন্ত্রণক্রমে আমি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু গমন করি। অনুজ আমিরুজ্জামান জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিশেষজ্ঞ। কাঠমান্ডু অবস্থানকালেই শেখ মুজিব সরকার আমার দ্বারা সম্পাদিত “সাপ্তাহিক ইত্তেহাদের বিরুদ্ধে ‘কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না’, এই মর্মে কারণ দর্শাইতে আদেশ জারি করে (১৯৭৩ সালের ২রা মে)। উক্ত খবর প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আমি ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হইবার ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং ১৬ই মে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি।

ভাসানীর অনশন এবং

ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়াই অবগত হই যে, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য হ্রাসের দাবিতে মাওলানা ভাসানী “আমরণ অনশন ধর্মঘট” শুরু করিয়াছেন। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অফিসে অনশনরত মওলানা ভাসানীর শয্যা পার্শ্বে গমন করেন বটে; তবে দাবি-দাওয়া ভিত্তিক ধর্মঘট সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করেন এবং সরকারি পর্যায়ে অনশন ভঙ্গের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হইতেও বিরত থাকেন। তাহার উদ্দেশ্যমূলক নির্লিপ্ততা সমূহ ক্ষতির কারণে পরিণত হওয়ার আশংকায় উদ্বিগ্ন না হইয়া পারি নাই।

কতিপয় সাংবাদিকের অনুরোধে মওলানা ভাসানী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত হইতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ২২শে মে অনশনরত মাওলানা ভাসানীর অবস্থার অবনতি ঘটে। আমরা কয়েকজন যেমন-জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মেজর এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রব, বাংলা জাতীয় লীগের আমি ও আনসার হোসেন ভানু, বাংলাদেশ জাতীয় লীগের মিসেস আমেনা বেগম ও জনাব ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের জনাব মোখলেসুর রহমান, কমিউনিস্ট পার্টির (লেনিনবাদী) বাবু অমল সেন ও হায়দার আকবর খান রনো এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ডঃ আলিম আল রাজি, জনাব বজলুস সাত্তার ও কাজী জাফর আহমদ, মাওলানা ভাসানীর অনশন ভঙ্গের অনুরোধ জানাই। নিম্নলিখিত শর্তে তিনি অনশন ভঙ্গ করিতে সম্মত হনঃ

১। ২২শে মে অপরাহ্নে ন্যাপ কর্তৃক আহূত জনসভাকে সর্বদলীয় জনসভায় পরিণত করিতে হবে এবং সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ উক্ত সভায় ভাষণ দিবেন।

২। ২৯শে মে (১৯৭৩) হইতে আইন-অমান্য আন্দোলন শুরু করিতে হইবে।

৩। ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হইতে হইবে।

তাহার শর্তাবলীতে সম্মতি জ্ঞাপন করিয়া আন্দোলনের কর্মসূচী নির্ধারণকল্পে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সদর দফতরে আমরা বিভিন্ন দলের প্রতিনিধির এক বৈঠকে মিলিত হই। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, কয়েক মিনিটের অনুমতি প্রার্থনা করিয়া সভাস্থল ত্যাগ করিলেও প্রায় তিন ঘণ্টা পর আ স ম আব্দুর রব সভাস্থলে প্রত্যাবর্তন করেন এবং স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বর্তমানে কোন সক্রিয় আন্দোলনে অবতীর্ন হবে না। কি চমৎকার নেতাদের চরিত্র! প্রতিশ্রুতিদান ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ যেন তাহাদের নিকট জলবৎ তরলং! তবে মুখ বাঁচানোর জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল শেষ পর্যন্ত একটি যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করিতে রাজী হয়। যুক্ত বিবৃতিটি ছিল নিম্নরূপ:

তারিখঃ ২২/৫/৭৩

“আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিবৃন্দ আজ দুপুর ২-১৫ মিঃ এর সময় অনশনরত মৃত্যু-পথযাত্রী মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেছি। মওলানা সাহেবের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের সর্বশেষ স্বাস্থ্য বুলেটিনে এই কথা বলা হয়েছে যে, তার অবস্থা অত্যন্ত আশংকাজনক এবং যে কোন মুহূর্তে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নহে। মেডিক্যাল বোর্ড আরও বলেছে যে, আজ সকাল ৯টায় তিনি কোলাপস্ করে গিয়েছিলেন, তার শরীরের তাপমাত্রা ৯৬ ডিগ্রিতে নেমে গিয়েছিল। তার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হয়েছিল। এমতাবস্থায় আমরা মওলানা ভাসানীর মতো জাতির অমূল্য সম্পদ একজন সংগ্রামী নেতার জীবনাশংকায় বিচলিত হয়ে পড়ি। আমরা মওলানা সাহেবকে গোটা জাতির পক্ষ থেকে অনশন ধর্মঘট ভঙ্গ করার জন্য অনুরোধ জানাই এবং এই প্রতিশ্রুতি তাকে প্রদান করি, যে দাবির ভিত্তিতে এবং যে লক্ষ্যকে সম্মুখে রেখে তিনি অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন সে দাবি ও লক্ষ্যকে আদায় করার জন্য আমরা আপোষহীন সংগ্রাম করে যাবো। বর্তমানে গণবিরোধী ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করার জন্য মেহনতি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবো। এবং নিম্ন-স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিবৃন্দ সর্বসম্মতিক্রমে মওলানা সাহেবের দাবি এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীকে এক আপোষহীন লড়াই-এর মাধ্যমে উৎখাত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করছি। আমরা সর্বজন শ্রদ্ধেয় মওলানা সাহেবকে উক্ত আন্দোলনের স্বার্থেই অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। জাতি তাঁর সেবা ও নেতৃত্ব চায়।”

উক্ত যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীগণ হলেনঃ

১। মেজর এম, এ, জলিল          ২। অলি আহাদ                        ৩। আমেনা বেগম

৪। দেবেন শিকদার                  ৫। আবুল বাশার                      ৬। মিসির আহমদ ভূঁইয়া

৭। মোখলেসুর রহমানের        ৮। অমল সেন                          ৯। হায়দার আকবর খান রনো

১০। আবদুস সোবহান            ১১। আ স ম আবদুর রব          ১২। আতাউর রহমান খান

১৩। সৈয়দ রিয়াজুল হোসেন।

অপরাহ্নে ন্যাপ কর্তৃক আহূত পল্টন ময়দানে জনসভার উপর আওয়ামী লীগ গুণ্ডারা হামলা করে জনসভার প্যান্ডেল তছনছ করিয়া দেয়, সভায় উদ্যোক্তা ও বক্তাদের মারধর করে। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে বিভিন্ন দলীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত না হওয়া সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী অনশন ভঙ্গ করেন।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাংগঠনিক শক্তির সঠিক ও বাস্তব মূল্যায়নে ব্যর্থতার দরুণ মওলানা ভাসানীর এই আমরণ অনশন ধর্মঘট সফল হয় নাই। মাত্র কিছুকাল পূর্বে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা শাসক আওয়ামী লীগ প্রার্থীবর্গকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে নির্বাচন বিজয়ে প্রচুর সহায়তা করিয়াছিল। সাধারণ নির্বাচনে নিজস্ব এই সন্দেহজনক ভূমিকার কারণেই হয়ত তিনি স্বীয় বিবেক দংশনে জর্জরিত হইতেছিলেন। তাই দুই মাসের মধ্যে সরকার বিরোধী ভূমিকার অভিনয়ে অবতীর্ণ হইতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু পূর্বাহ্নে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ না করিয়াই আমরণ অনশন ধর্মঘটের ন্যায় চরম সিদ্ধান্ত ঘোষণর ফলে তাঁহার সেই ভূমিকা অসম্পূর্ণ থাকিয়া গেল।

যাহা হউক, সময় গড়াইয়া যেতে থাকে। আমরাও প্রতি পদক্ষেপে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি চালাইয়া যাইতে থাকি। এবং অতঃপর ২৫ সালা ভারত-বাংলাদেশ দাসত্ব চুক্তি, সর্বপ্রকার গোপনচুক্তি ও সমঝোতা এবং অন্যান্য অসম চুক্তি বাতিল করিয়া প্রকৃত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ কায়েমের দাবিতে আমরা বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে ১৯৭৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর সমগ্র দেশব্যাপী “আজাদ বাংলা” দিবস পালনের ডাক দেই। ঠিক সেই সময়ে, আমার শ্রদ্ধেয় অগ্রজ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন ও প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ডঃ আবদুল করিম ১৯৭৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে ও অপ্রত্যাশিতভাবে পরলোকগমন করেন। তাঁহার অন্তর্ধানে কেবল অপত্য স্নেহ থেকে বঞ্চিত হইলাম না; হারাইলাম আমার কর্মজীবনের দিক-দিশারী, বিজ্ঞ-বিদগ্ধ দার্শনিক গুরুজন, স্নেহের আধার ও কড়া অভিভাবককে। আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্তি সত্ত্বেও শ্বাশত জীবন দর্শন ও মূল্যবোধই তাঁহার জীবন-যাত্রার অঙ্গীভূত বৈশিষ্ট্য ছিল। গুরুজনকে শ্রদ্ধা, কনিষ্ঠজনকে স্নেহ, বন্ধু জনকে ভালবাসা, সত্যনিষ্ঠা, স্পষ্টবাদিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, অধ্যাবসায়, পরিশ্রম, স্বহস্তে গৃহকর্ম পালন ইত্যাদি গুণ ছিল তাহাদের চারিত্রিক ভূষণ। যাহা হইক, তাহার জানাযা হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমি পল্টন ময়দানে জনসভায় যোগদান করি। উল্লেখ্য যে, ১৭ মার্চ (১৯৭৪) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে এক জঙ্গী মিছিলসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করে। মিছিলকারী ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে এবং অকুস্থলেই জাসদ সভাপতি মেজর এম,এ জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব ও অন্যান্যদের নিবর্তনমূলক আটক আইনে গ্রেফতার করা হয়। বলিতে ভুলিয়াছি, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিবর্তনমূলক আটক আইন পাসের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা বাংলা জাতীয় লীগ ২৪শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৩) এক প্রকাশ্য জনসভা অনুষ্ঠান করি এবং উহা প্রত্যাহারের দাবি করি। এভাবে দেশের থমথমে পরিবেশে আমাদের এই প্রয়াস কিছুটা সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষীণ আভাস পরিলক্ষিত হইতে থাকে। এই সময়ে দেশের সার্বিক অবস্থা মূল্যায়নের পর সমগ্র দেশব্যাপী গণআন্দোলন করার মানসে ১৪ এপ্রিল (১৯৭৪) আমরা বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল একত্রে নিম্নে বর্ণিত ৪ দফা প্রণয়ন করি এবং মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের আহ্বান জানাই। দফা ৪টি এই-

১।            (ক) রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি, রাজনৈতিক কারণে হুলিয়া, গ্রেফতারী পরোয়ানা ও মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার।

(খ) বিশেষ ক্ষমতা আইন, রক্ষীবাহিনীর আইন, রাষ্ট্রপতির ৮ ও ৯ নং আদেশ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দমন আইন ও শ্রমিক দমন আইন বাতিল।

২।            (ক) রক্ষীবাহিনী বাতিল করে উপযুক্তভাবে তাহাদের পুনর্বাসনকরণ।

(খ) দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন ও সকল নাগরিকের জানমাল ও ইজ্জতের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান।

৩।            (ক) গ্রাম ও শহরের সর্বত্র খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রয়োজনীয় রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনয়ন।

(খ) সকল প্রকার দুর্নীতি, চোরাচালান, মুনাফাখোরী, লাইসেন্স পারমিটবাজি দমন, অসদুপায়ে অর্জিত বা বে-আইনীভাবে দখলকৃত ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান। এবং

৪। বাংলাদেশের শিল্প ব্যবসাসহ সামগ্রিক অর্থনীতিকে বিদেশী আগ্রাসন ও আধিপত্য থেকে মুক্তকরণ এবং জাতীয় স্বার্থে সার্বভৌমত্ব বিরোধী সকল বৈদেশিক চুক্তি বিশেষ করে ভারতের সাথে সকল গোপন ও অসম চুক্তি বাতিলকরণ।

আমরা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করিয়া নিম্নোক্ত দলীয় প্রতিনিধিবৃন্দ সমবায়ে একটি সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করি। প্রতিনিধিবৃন্দরা হলেনঃ

জনাব মশিউর রহমান                                                             ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং)

ডঃ আলিম-আল-রাজি                                                               ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং)

জনাব নূরুর রহমান (বিকল্প সদস্য)                                     ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং)

জনাব অলি আহাদ                                                                   বাংলা জাতীয় লীগ

কাজী জওয়াহেরুল ইসলাম                                                      বাংলা জাতীয় লীগ

জনাব আনসার হোসেন ভানু (বিকল্প)                                  বাংলা জাতীয় লীগ

জনাব আতাউর রহমান খান                                                   বাংলাদেশ জাতীয় লীগ

মিসেস আমেনা বেগম                                                              বাংলাদেশ জাতীয় লীগ

হাজী মোহাম্মদ দানেশ                                                         জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন

জনাব সিরাজুল হোসেন খান                                                  জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন

জনাব আব্দুল ওয়াদুদ খন্দকার (বিকল্প)                                            জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন

খান সাইফুর রহমান                                                                               শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল

জনাব মোখলেছুর রহমান                                                      শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল

জনাব রুহুল আমিন                                                                  শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল

জনাব নাসিম আলী                                                                  বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি

জনাব মোস্তফা জামাল হায়দার                                           বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিন)

জনাব হায়দার আকবর খান রনো                                         বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিন)

বাংলা জাতীয় লীগ অফিসকে (৬৩, বিজয়নগর, ঢাকা) সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টের অফিস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

দেশবাসীর বহু আকাঙ্ক্ষিত বিরোধী দলীয় ঐক্যের এই বার্তা ও ঐক্যফ্রন্ট কর্তৃক প্রণীত ৪ দফা কর্মসূচী উপস্থাপিত করার মানসে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ২৩শে এপ্রিল (১৯৭৪) অপরাহ্নে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। জনসভার এই ডাক এত সাড়া জাগায় সে, জনসভা কার্যতঃ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। পল্টন জনসভায় লোক সমাগমে ভীত-সন্ত্রস্ত শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাহার সরকার ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা এক কথায় দেশের প্রায় সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারি করিয়া রাজনৈতিক সভা-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আমরা তাতে হতোদ্যম না হইয়া জেলায় জেলায় কর্মীসভার আয়োজন করি এবং ১৪৪ ধারার প্রত্যাহার দাবি করে থাকি।

শেখ মুজিবের দাসখত

বিরোধী দলীয় কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করার ব্যবস্থা করিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান দিল্লী গমন করেন এবং তথায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহিত ১৩ই মে হইতে ১৬ মে পর্যন্ত এক শীর্ষবৈঠকে মিলিত হন। ১৬ মে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও যুক্ত ইশতেহারে শেখ মুজিবর রহমান কার্যতঃ ভারতের নিকট দাসখত দিয়া আসেন। যেমন- (১) বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি এলাকা ভারতকে দান। (২) বৎসর শেষে বাংলাদেশের আটটি জেলার প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের চুক্তি ব্যতীতই ফারাক্কা বাঁধ চালু, পশ্চিমবঙ্গ ও আগরতলার মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগের অধিকার দান, অন্যকথায় বাংলাদেশের ভূমির উপর দিয়া করিডোর দান এবং (৩) ভারত-বাংলাদেশ যৌথ অর্থনৈতিক ভেনচার যথা যৌথ পাট কমিশন, যৌথ শিল্প উদ্যম এবং ভারতীয় পণ্যক্রয় নিমিত্ত ৩৮ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ তথা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতীয় অর্থনীতির উপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল করিবার পরিকল্পনা প্রণয়ন।

ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির প্রতিবাদে আমরা সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টের উদ্যোগে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে ২রা জুন এক সভা অনুষ্ঠান করি। সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সভা-সমিতির সুযোগ দানের নিমিত্ত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার না করিলে বা মেয়াদান্তে ১৪৪ ধারা পুনঃপ্রবর্তন করিলে সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট ৩০শে জুন (১৯৭৪) ১৪৪ ধারা অমান্য করিবে। মুজিব সরকার স্বীয় অতীত ভূমিকা অস্বীকার করতঃ ২৫শে জুন হইতে পুনঃ ১৪৪ ধারা জারি করিয়া প্রকাশ্য জনসভা ও শোভাযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। উক্ত অবৈধ আদেশের বিরুদ্ধে ২৮শে জুন আমি ঢাকা হাইকোর্টে রীট আবেদন করি। উল্লেখ্য যে, ৯ই সেপ্টেম্বর (১৯৭৪) প্রদত্ত রায়ে মাননীয় বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও মাননীয় বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী কর্তৃক গঠিত সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ ২৫শে জুন জারিকৃত ১৪৪ ধারা আদেশকে অবৈধ, বাতিলযোগ্য, এক্তিয়ার বহির্ভূত ও সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বলিয়া ঘোষণা করেন এবং মাননীয় বিচারপতিদ্বয় আমাকে মামলার খরচ বাবদ ১৫ টি স্বর্ণমোহর তুল্য অর্থ প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দান করেন। সরকার উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপীল করে এবং রায়ের কার্যকারিতা মুলতবি রাখিবার আবেদন জানায়। মাননীয় বিচারপতিদ্বয়  সরকারকে আপিল করার অনুমতি দেন বটে তবে রায়ের কার্যকারিতা “মুলতবি আবেদন” প্রত্যাখ্যান করে। মুজিব সরকারের কারাগারে আটক থাকাকালে আমি সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় উক্ত রায় পাঠ করি।

পুনরায় গ্রেফতার

আগেই উল্লেখ করিয়াছি যে, ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে ৩০শে জুন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিয়া জনসভা করিবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে ক্ষিপ্ত মুজিব সরকার সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টের ১৩ জন সদস্যের মধ্যে সর্বজনাব মশিউর রহমান, নূরুর রহমান ও আমাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করিয়া কারাগারে আটক করে এবং সর্বদলীয় ঐক্য ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে গ্রেফতার করিয়া টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাহার নিজস্ব বাসভবনে অন্তরীণাবদ্ধ করে।

১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি মওলানা ভাসানীকে সন্তোষে গৃহবন্দি করা হয়। অশীতিপর বৃদ্ধ নেতা ভাসানী গৃহবন্দি অবস্থায়ই আন্দোলনের ডাক দেন।

আমি গৃহবন্দি আন্দোলন চালাইয়া যাও

প্রিয় দেশবাসী,

হিন্দুস্তান আর রাশিয়ার চক্রান্ত এইবার নতুন মোড় নিয়েছে। শেখ মুজিবকে দিয়া আমাকে সন্তোষের ঘরে গৃহবন্দি করা হইয়াছে। ৫০০ পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করিয়া আমার স্বাধীনতা হরণ করা হইয়াছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বলিতে যতটুকু ছিল এইবার তাহাও হারাইতে বসিয়াছে।

কিন্তু হতাশ হইবার কিছু নাই যদি জালেমের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন চালাইয়া যাইতে পারেন। আমার আকুল আহ্বান দুর্বার গণআন্দোলন চালাইয়া যান। শত্রুর মোকাবিলা করুক। তাহাদের স্বপ্নসাধ চিরদিনের জন্য ধুলায় মিশাইয়া দিন। আল্লাহ আপনাদের সহায়। নিশ্চয়ই সত্যের জয় অনিবার্য।

মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী

আমাদের গ্রেফতারের পর আইন অমান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দান দূরে থাকুক, এমনকি কোন কোন নেতা সাংবাদিক সম্মেলনে আমাদের নাম উচ্চারণ করিতেও সাহস পান নাই- মুক্তির দাবির তো কথাই উঠে না। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ নেতৃবৃন্দ ও ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকভুক্ত ছাত্রবৃন্দ এই আন্দোলনে অত্যন্ত তৎপর ছিল।

আমাদের গ্রেফতারের পর সরকারি প্ররোচনায় ও স্বীয় চামড়া রক্ষার গরজে সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত অঙ্গদলগুলি অতঃপর স্ব স্ব পতাকাতলে পৃথক পৃথক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ আরম্ভ করে। এইখানেই গণধিকৃত মুজিব সরকারের জয় ও নিপীড়িত জনতার পরাজয় সূচিত হয়। ৩০শে জুন আমাকে গ্রেফতার করিবার পর বাংলা জাতীয় লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির এক জরুরি সভা ঐদিনই ৬৩, বিজয়নগরস্থ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আনিসুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করিবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে বাংলা জাতীয় লীগের উদ্যোগে ১৭ই নভেম্বর পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ থাকে যে, শেখ মুজিবের শাসনামলে এবং পল্টন ময়দানের ইতিহাসে ইহাই সর্বশেষ বিরোধী দলীয় জনসভা, ইহার পর পল্টন ময়দানে আর কোন জনসভা হইতে পারে নাই। তাই ২৮শে ডিসেম্বর জারি হয় সমগ্র দেশব্যাপী জরুরি আইন’। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সংশোধনী বিল ১১ মিনিটের মধ্যে ২৯৪ জন পার্লামেন্ট সদস্যের ভোটে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টারি কেবিনেট ফরম প্রেসিডেন্সিয়াল ফরমে রূপান্তরিত হয় এবং শেখ মুজিবর রহমান হন ৫ বৎসরের জন্য ১৯৮০ সাল অবধি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী অনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও একদলীয় রাজনীতির সর্বেসর্বা এবং ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত হইল। সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত অধিকাংশ অঙ্গদলের অদূরদর্শিতা, সংকীর্ণতা, ব্যক্তি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোন্দল এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বালসূলভ হঠকারী মনোবৃত্তিই শাসক মুজিব এবং তাহার আওয়ামী লীগকে সর্বনাশা পথে অগ্রসর হইতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উৎসাহ এবং সাহস যোগাইয়াছে এবং এই কারণে এইভাবেই এক নদী রক্তের বিনিময়ে জনগণ যে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি ও কেবিনেট ফরম ও বহুদলীয় রাজনীতির ধরন অর্জন করিয়াছিল নিরঙ্কুশ ক্ষমতালোভী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান কলমের এক খোচায় তাহা উড়াইয়া দিয়া একনায়কত্ব ও একদলীয় শাসন প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছিলেন।

বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য

সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি মাননীয় শাহাবুদ্দিন আহমেদ (১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও বিগত ২২.৭.৯৬ ইং তারিখ হইতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি) আনোয়ার হোসেনের মামলায় ৪র্থ সংশোধনী সম্পর্কে নিম্নলিখিত মন্তব্য দেশবাসীর জন্য খুবই প্রণিধানযোগ্য।

The Supreme Court in Anwar Hossain’s case has discussed this aspect. An extract from to the judgement of Shahabuddin Ahmed (as his Lordship then was) is quoted; “The trump-card of the learned Atty. Gen. is that some of the past Amendments of the Constitution destroyed its basic structures and disrupted it on several occasions. It is true that such mishaps did take place in the past. The Constitution Fourth Amendment Act, dated 25 January 1975, changed the Constitution beyond recognition in many respects and in place of a democratic Parliamentary form of Government or the basis of multiple party system a Presidential form of Government authoritarian in character on the basis of a single party was brought about overnight thereby. Fundamental rights to form free association was denied, all political parties except the Government party were banned and members of Parliament who did not join this Party lost their seats though they were elected by the people. Freedom of the press was drastically curtailed; Independence of the Judiciary was cursed by making the Judges liable to removal at the wish of the Chief Executive, appointment, control and discipline of the subordinate Judiciary along with Supreme Court’s power of superintendence and control of subordinate courts were taken away from the Supreme Court and vested in the Government, The change was so drastic and sudden; Friends were bewildered. Enemies of the Liberation had their revenge and the Critics said with glee that it is all the same whether damage to democracy is caused by democratically elected persons or by undemocratic means like military coup.

“Within a short time came the first Martial Law which lasted four years. By Martial Law Proclamation Orders the Constitution was badly mauled on 10 times. Secularism one of the Fundamental State principles, was replaced by ‘Bismillah-er-Rahman-Ar-Rahim’ in the Constitution and Socialism was given a different meaning. Supreme Court, one of the symbols of national unity was bifurcated for about two years and then was restored. All these structural changes were incorporated in and ratified, as the Constitution Fifth Amendment Act. 1979.”

In spite of these vital changes from 1975 by destroying some of the basic structures of the Constitution nobody challenged them in court after revival of the Constitution : Consequently they were accepted by the people and by their acquiescence have become part of the Constitution.”

(১৭.৩.৯১ইং তারিখে বাংলাদেশ অবজারভার-এ প্রকাশিত জনাব এন. আই. ফারুকী কর্তৃক লিখিত নিবন্ধ হইতে উদ্ধৃত)

শেখ মুজিবের ভন্ডামী

ক্ষমতালোভী শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রাশিয়া ও ভারতের সেবাদাস আওয়ামী লীগ, মস্কো ন্যাপ ও মনি সিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি সমবায়ে একদা যে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়েছিল, এইভাবেঈ তাহা ষোলকলায় পূর্ণ হয়। শেখ মুজিব ইহাকে নির্লজ্জ ভাষায় দ্বিতীয় বিপ্লব’ আখ্যা দেন। ঠিক যেমন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তান সৈনাধ্যক্ষ জেনারেল আইউব খান নিরস্ত্র দেশবাসীর বিরুদ্ধে স্বীয় ক্ষমতালাভকে বিপ্লব আখ্যা দিয়াছিলেন এবং ক্ষমতা লাভের দিবস ২৭শে অক্টোবর ‘বিপ্লব দিবস’ ঘোষণা করিয়াছিলেন। কৌতুকের বিষয় ভিয়েৎনাম দিবসে আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশকালে ন্যাপ (মস্কো) ও কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কো) সমর্থক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারি ইউএসআইএস (UNITED STATES INFORMATION SERVICE) অফিস সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে মতিউল ইসলাম ও আবদুল কাদের নামে ছাত্র ইউনিয়নের ২ জন কর্মী নিহত হয়। উক্ত নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ২রা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (Dhaka University Central Student Union-DUCSU)-এর সহ-সভাপতি ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের প্রস্তাবক্রমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে সম্বোধন না করে শুধু শেখ মুজিবুর রহমান হিসেবে ডাকার এবং শেখ মুজিবকে ‘ডাকসু’ কর্তৃক দেয় আজীবন সদস্য পদ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উপরোক্ত উত্তেজিত মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম শেখ মুজিবকে প্রদত্ত ডাকসুর আজীবন সদস্য পদের সনদপত্র ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। অন্যদিকে ৩রা জানুয়ারি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় নূরে আলম সিদ্দিকী ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে হুমকি দিয়ে বলেন যদি তারা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে উচ্চকিত কটুক্তি প্রত্যাহার না করে এবং ডাকসু আজীবন সদস্যপদ পুনর্বহাল না করে তাহলে এর সমুচিত জবাব দেয়া হইবে।

পরবর্তী ৪ জানুয়ারি টেলিভিশনে দেখা গেল শেখ মুজিবের সাথে ডাকসু সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের হাস্যোজ্জল ছবি। তারা তাহাদের সমস্ত বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাহাদের কৃতকর্মের জন্য মাফ চেয়ে ডাকসু আজীবন সদস্যপদ পুনর্বহাল করে। এই আপোসের দূতিয়ালী করেন তথাকথিত বামপন্থী কমরেড মনি সিং গং। অতীতের মতো পরবর্তী সরকারের সাথে সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করে। ভষ্যিতেও যে এরকম আপোসকামী কার্যক্রম করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?

উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২৮শে অক্টোবর (১৯৭০) জাতির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানের রেডিও-টেলিভিশনে দেয় ভাষণের নিম্নলিখিত অংশ এই প্রসঙ্গেই বিশেষ স্মরণযোগ্য ও প্রণিধানযোগ্য

“তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল (পাকিস্তান মুসলিম লীগ) সমগ্র দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, সেই হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই আমাদের মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ভাবেই আমরা পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আপোষহীন সংগ্রাম শুরু করি।” (২৯শে অক্টোবর, ১৯৭০, দৈনিক পাকিস্তান দ্রষ্টব্য)।

এই উদ্ধৃতি পর মন্তব্যের কোন প্রয়োজন আছে কি? নেতারা দেশবাসীকে শোনান এক, আর করেন আরেক, মর্মস্তুদ হইলেও ইহা নিরেট সত্য। মনে পড়ে পাকিস্তান গণপরিষদে জনাব আবুল কাসেমের প্রস্তাব ছিল বিশ বৎসরের জন্য মুসলিম লীগকে একমাত্র রাজনৈতিক দল ঘোষণা করা হোক এবং আরও মনে পড়ে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তদানীন্তন আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যের কি তীব্র প্রতিবাদ ও কী ভীষণ গলাবাজি। সবই আজ অতীত ইতিহাস। তবে কেউ ভুলে, কেউ ভুলে না।

বাকশাল গঠন

যাহা হউক, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতালোভী শেখ মুজিবুর রহমান তাহার পুতুল সংসদের সহায়তায় সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ঘোষণা করিয়া ১৯৭৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের আদেশ জারি করেন। ১৯৭৩ সালের ২৯শে মে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কো) ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠন করিয়াছিল। বাকশাল গঠনের মূল প্ররোচনা ছিল ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। তদানুযায়ী ১. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ২. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ৩. বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ৪. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ৫. জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ৬. বাংলা জাতীয় লীগ, ৭. বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস, ৮. বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ৯. জাতীয় গণতন্ত্রী দল, ১০. জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন, ১১. বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, ১২. ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, ১৩. কমিউনিস্ট পার্টি এবং ১৪. শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল বাতিল ঘোষণা করা হয়। এবং ১৯৭৫ সালের ২০শে মে বাংলা জাতীয় লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ইউনাইটেড পিপলস পার্টি অফিস তালাবদ্ধ করা হয়। শেখ সাহেব ইহাতেও ক্ষান্ত হইলেন না। নিজ শাসন পাকাপোক্ত করিবার হীন উদ্দেশ্যে তিনি সকল সংসদীয় সদস্যকে ২৫শে এপ্রিলের মধ্যে বাকশালে যোগ দিবার ফরমান জারি করেন। অন্যথায় সংসদ সদদ্যপদ বাতিল। বিরোধী সাংসদ নেতা আতাউর রহমান খান ২৫শে এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনে বাকশালে যোগদানে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিলেও আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদ্বয় জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সংসদ সদস্য পদ ত্যাগ করা শ্রেয় মনে করেন। ৬ই জুন (১৯৭৫) জারিকৃত এক ফরমান বলে প্রেসিডেন্ট নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন :

১. চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট; ২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট; ৩. প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী- সেক্রেটারি জেনারেল; ৪. আবদুল মালেক উকিল- স্পীকার; ৫. খন্দকার মোশতাক আহমেদ-মন্ত্রী; ৬. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মন্ত্রী; ৭. মোহাম্মদ উল্লাহ- মন্ত্রী; ৮. আবদুস সামাদ আজাদ মন্ত্রী। ৯. অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী মন্ত্রী; ১০. শ্ৰী ফনীভূষণ মজুমদার-মন্ত্রী; ১১. ডঃ কামাল হোসেন মন্ত্রী; ১২. মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন মন্ত্রী; ১৩, আবদুল মান্নান মন্ত্রী; ১৪. আবদুর রব সেরনিয়াবাত- মন্ত্রী; ১৫. শ্রী মনোরঞ্জন ধর। মন্ত্রী; ১৬. আবদুল মমিন- মন্ত্রী; ১৭, আসাদুজ্জামান খান- মন্ত্রী; ১৮. মোঃ কোরবান আলী-মন্ত্রী; ১৯, ডঃ আজিজুর রহমান মন্ত্রী; ২০. ডঃ মোজাফফর আহমদ- মন্ত্রী; ২১. তোফায়েল আহমদ-Special Assistant to the president; ২২. শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন-চীফ হুইপ; ২৩, আবদুল মমিন তালুকদার-প্রতিমন্ত্রী; ২৪. দেওয়ান ফরিদ গাজী- প্রতিমন্ত্রী; ২৫. প্রফেসর নূরুল ইসলাম চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী; ২৬. তাহের উদ্দিন ঠাকুর-প্রতিমন্ত্রী; ২৭. মোসলেম উদ্দিন খান- প্রতিমন্ত্রী; ২৮. মোঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর-প্রতিমন্ত্রী; ২৯. কে এম ওবায়দুর রহমান-প্রতিমন্ত্রী; ৩০. ডঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল-প্রতিমন্ত্রী; ৩১. রিয়াজুদ্দিন আহমদ- প্রতিমন্ত্রী; ৩২. মোঃ বয়তুল্লাহ-ডেপুটি স্পীকার; ৩৩. খন্দকার রুহুল কুদ্দুস-প্রেসিডেন্ট এর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি; ৩৪. জিল্লুর রহমান- সেক্রেটারি; ৩৫. মহিউদ্দিন আহমদ; ৩৬. শেখ ফজলুল হক মনি-সেক্রেটারি; ৩৭. আবদুর রাজ্জাক-সেক্রেটারি; ৩৮. শেখ শহীদুল ইসলাম; ৩৯. আনোয়ার চৌধুরী; ৪০. বেগম সাজেদা চৌধুরী এমপি; ৪১. বেগম তসলিমা আবেদ এমপি; ৪২. আবদুর রহিম এমপি, দিনাজপুর; ৪৩, আবদুল আওয়াল এমপি, রংপুর; ৪৪. লুৎফর রহমান এমপি, রংপুর; ৪৫. এ কে এম মুজিবর রহমান এমপি, বগুড়া; ৪৬, ডঃ মফিজ চৌধুরী এমপি, বগুড়া; ৪৭. ডাঃ আলাউদ্দিন এমপি, রাজশাহী; ৪৮. ডাঃ আসহাবুল হক এমপি, কুষ্টিয়া; ৪৯. আজিজুর রহমান আক্কাস এমপি, কুষ্টিয়া; ৫০. রওশন আলী এমপি, যশোর; ৫১. শেখ আবদুল আজিজ এমপি, খুলনা; ৫২. সালাউদ্দিন ইউসুফ এমপি, খুলনা; ৫৩, মাইকেল সুশীল অধিকারী, খুলনা; ৫৪, কাজী আবুল কাসেম এমপি, পটুয়াখালী; ৫৫. মোল্লা জালাল উদ্দিন আহমেদ এমপি, ফরিদপুর; ৫৬. শামসুদ্দিন মোল্লা এমপি, ফরিদপুর; ৫৭. শ্রী গৌরচন্দ্র বালা, ফরিদপুর; ৫৮. গাজী গোলাম মোস্তফা এমপি, ঢাকা নগর; ৫৯. শামসুল হক এমপি, ঢাকা; ৬০. শামসুজ্জোহা এমপি, ঢাকা; ৬১. রফিক উদ্দিন ভূইয়া এমপি, ময়মনসিংহ; ৬২. সৈয়দ আহমদ, ময়মনসিংহ; ৬৩, শামসুর রহমান খান এমপি, টাঙ্গাইল; ৬৪. নুরুল হক এমপি, নোয়াখালী ৬৫. কাজী জহিরুল কাইয়ুম এমপি, কুমিল্লা; ৬৬, ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এমপি, কুমিল্লা; ৬৭, এম.আর, সিদ্দিকী এমপি, চট্টগ্রাম; ৬৮, এম.এ ওয়াহাব এমপি, চট্টগ্রাম; ৬৯, শ্রী চিত্তরঞ্জন সুতার এমপি; ৭০. সৈয়দা রাজিয়া বানু এমপি; ৭১. আতাউর রহমান খান এমপি, ধামরাই; ৭২. খন্দকার মোঃ ইলিয়াস; ৭৩. শ্রী মং সুং (King of Manikchari : Chittagong Hill Tracts); ৭৪, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ (ন্যাপ); ৭৫, আতাউর রহমান (ন্যাপ), রাজশাহী; ৭৬. সৈয়দ আলতাফ হোসেন (ন্যাপ); ৭৭. পীর হাবিবুর রহমান (ন্যাপ); ৭৮, মোঃ ফরহাদ (সিপিবি); ৭৯, বেগম মতিয়া চৌধুরী (ন্যাপ); ৮০. হাজী মোঃ দানেশ (জাগমুই); ৮১. হোসেন তৌফিক ইমাম-সেক্রেটারি, ক্যাবিনেট এফেয়ার্স ডিভিশন; ৮২. নূরুল ইসলাম-সেক্রেটারি ফরেন ট্রেইড; ৮৩, ফয়েজউদ্দিন আহমদ-সেক্রেটারি, স্বরাষ্ট্র; ৮৪. মাহবুবুর রহমান, সেক্রেটারি এস্টাবলিশমেন্ট; ৮৫, আবদুল খালেক-Secretary to the Vice President; ৮৬. মুজিবুল হক- সেক্রেটারি দেশরক্ষা ; ৮৭. আবদুর রহিম-Secretary to the President; ৮৮, মঈনুল ইসলাম-সেক্রেটারি, Works, Housing & Urban Development; ৮৯. সৈয়দুজ্জামান- সেক্রেটারি প্ল্যানিং; ৯০, আনিসুজ্জামান-সেক্রেটারি, কৃষি; ৯১. ডঃ এ সাত্তার-Secretary to the President; ৯২. আবু তাহের সেক্রেটারি ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার; ৯৩. আল হোসাইনী-সেক্রেটারি পাওয়ার; ৯৪. এ সামাদ-সেক্রেটারি, যোগাযোগ; ৯৫, ডঃ আবুল হোসেন-সেক্রেটারি, স্বাস্থ্য; ৯৬. মতিযুর রহমান-চেয়ারম্যান, টিসিবি; ৯৭. মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ Chief of Staff. Bangladesh Army; ৯৮, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার Chief of staff. Bangladesh Air Force; ৯৯, কমোডর এম এইচ খান Chief of Staff. Bangladesh Navy; ১০০. মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান- Director General of Bangladesh Rifles; ১০১. এ কে নাজিরুদ্দিন আহমদ গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; ১০২. ডঃ আবদুল মতিন চৌধুরী ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ১০৩. ডঃ মাজহারুল ইসলাম- ভাইস চ্যান্সেলর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; ১০৪. ডঃ এনামুল হক- ভাইস চ্যান্সেলর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ১০৫. এটিএম সৈয়দ হোসেন- এ্যাডিশনাল সেক্রেটারি এস্টাবলিশমেন্ট ডিভিশন; ১০৬. নূরুল ইসলাম- আই.জি.পি; ১০৭. ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম; ১০৮, ডাঃ নূরুল ইসলাম- ডিরেক্টর পিজি হাসপাতাল; ১০৯, ওবায়দুল হক-এডিটর, বাংলাদেশ অবজারভার; ১১০. আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এডিটর, ইত্তেফাক; ১১১. মিজানুর রহমান- চীফ এডিটর বিপিআই; ১১২. মনোয়ারুল ইসলাম- Joint Secretary President’s Secretariate; ১১৩, ব্রিগেডিয়ার এ.এন.এম. নূরুজ্জামান- ডিরেক্টর, জাতীয় রক্ষী বাহিনী; ১১৪. কামরুজ্জামান সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি; ১১৫. ডাঃ মাজহার আলী কাদরী সভাপতি, বাংলাদেশ চিকিৎসক সমিতি।

নিম্নোক্ত অঙ্গ সংগঠন গঠন করা হয় :

জাতীয় কৃষক লীগ                   সাধারণ সম্পাদক                   ফণীভূষণ মজুমদার

জাতীয় শ্রমিক লীগ                                সাধারণ সম্পাদক                   অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী

জাতীয় মহিলা লীগ                   সাধারণ সম্পাদক                   বেগম সাজেদা চৌধুরী

জাতীয় যুবলীগ                        সাধারণ সম্পাদক                   তোফায়েল আহমদ

জাতীয় ছাত্রলীগ                    সাধারণ সম্পাদক                   শেখ শহীদুল ইসলাম

এবং নিম্নোক্তদের দ্বারা কার্যকরী সংসদ গঠন করেন :

১. শেখ মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান, ২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ৩, এম মনসুর আলী- সেক্রেটারি জেনারেল, ৪, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ৫. আবুল হাসনাত মোঃ কামরুজ্জামান, ৬. আবদুল মালেক উকিল, ৭. অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ৮. শ্ৰী মনোরঞ্জন ধর, ৯. ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, ১০. শেখ আবদুল আজিজ, ১১.মহিউদ্দিন আহমদ, ১২. গাজী গোলাম মোস্তফা, ১৩. জিল্লুর রহমান-সেক্রেটারি, ১৪. শেখ ফজলুল হক মনি- সেক্রেটারি, ১৫. আবদুর রাজ্জাক- সেক্রেটারি।

পক্ষান্তরে রাজনীতিবিদ, সমর নায়ক, শ্রমিক ও অন্যান্য সংগঠন ও সংস্থা, সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান এমন কি শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক মলগুলোতে বাকশালে যোগদানের হিড়িক পড়িয়া যায়। এইসব সুবিধাবাধী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পতাকা লইয়া ফুলের মালাসহ দলে দলে শেখ মুজিবের চরণ পূজা করিবার নিমিত্ত তাহার নিকট গমন করে। এমন কি এক শ্রেণির মা-বোনও বাদ যায় নাই। ইহাদের এই ব্যক্তি পূজার মানসিকতায় উৎসাহী হয়ে শেখ মুজিব একদলীয় শাসন টেকসই করিবার নিমিত্ত যে কোন ধরনের সমালোচনার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করিবার অসৎ প্রয়াসে ১৯৭৫ সালের ১৬ই জুন সংবাদপত্র (ডিক্লারেশন বাতিল) অর্ডিন্যান্স জারি করেন। এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমের চারটি দৈনিক ব্যতীত সকল দৈনিক পত্রিকা বাতিল ঘোষণা করা হয়। অর্ডিন্যান্সে ১৭ জুন (১৯৭৫) থেকে সারা বাংলাদেশে দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস- এই চারটি দৈনিক প্রকাশের কথা ঘোষণা করা হয়। জনাব নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, জনাব ওবায়দুল হক, শেখ ফজলুল হক মনি ও জনাব এহতেশাম হায়দার চৌধুরী যথাক্রমে দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ টাইমস ও দৈনিক বাংলার সম্পাদক নিযুক্ত হন।

সরকার আরো ১২২টি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার ডিক্লারেশন বহাল রাখে। আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদসহ বাদবাকী সাপ্তাহিক, মাসিক ও সাময়িকী ডিক্লারেশন বাতিল ঘোষণা করা হয়।

জন সম্পাদকের বাকশালে যোগদান

বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্যপদের জন্য যে সব সম্পাদকগণ আবেদন করিয়াছিলেন তাঁহারা হইলেন : ১. জনাব ওবায়দুল হক, সম্পাদক, বাংলাদেশ অবজারভার; ২. জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক; ৩. শামসুল হুদা, সম্পাদক, মর্নিং নিউজ; ৪. জনাব জাওয়াদুল করিম, প্রধান সম্পাদক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস); ৫. জনাব নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, সম্পাদক, দৈনিক বাংলা; ৬, জনাব এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ; ৭. জনাব শহীদুল হক, কার্যনির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ টাইমস ও দৈনিক বাংলার বাণী; ৮. জনাব বজলুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ; ৯. জনাব মিজানুর রহমান, সম্পাদক, অধুনালুপ্ত বিপিআই।

প্রথম আবেদনকারী সাংবাদিকবৃন্দ

ইকবাল সোবহান চৌধুরী, অবজারভার; শামসুল হক আলীনূর, পূর্বদেশ; হামিদুজ্জামান, বাসস; মাহবুবুর রহমান রুশো, পিপল; মোহাম্মদ মতিউর রহমান, এনা; জাহাঙ্গীর হোসেন, বাসস; শফিকুল আলম কাজল, আজাদ; খায়রুল আনাম, ইত্তেফাক; আবদুল্লাহ এম হাসান, বাংলাদেশ টাইমস; আমিনুর রহমান, মর্নিং নিউজ; মোঃ নিজামউদ্দিন, ঐ; আমিনুল ইসলাম, ঐ; মোহাম্মদ একরামুল হক লোদী, ঐ; রফিকুল হক, পূর্বদেশ; এ এইচ এম মোয়াজ্জেম হোসেন, অবজারভার; সৈয়দ ইয়াহিয়া বখত, পূর্বদেশ; আতিকুর রহমান, ও মতিউর রহমান, মর্নিং নিউজ; খোন্দকার মনিরুল আলম, বাংলাদেশ টাইমস; হোসেন কামাল, ঐ; জগলুল আহমদ চৌধুরী, বাসস; আলমগীর মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ টাইমস; ফখরুল আবেদীন দুলাল, বাংলার বাণী; সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান, পূর্বদেশ; আজমল হোসেন খাদেম, ঐ; শাহনূর খান, ঐ; খন্দকার ফজলুর রহমান, বাংলাদেশ অবজারভার; মজিদুর রহমান বিশ্বাস, পূর্বদেশ; আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী, ঐ; আবদুল মজিদ কামালী, ঐ; শহীদ এনায়েত উল্লাহ, ঐ; আবুল কাশেম, ঐ; জহিরুল হক চৌধুরী, ঐ; মোহাম্মদ আবুল কালাম, ঐ; এ এন এম গোলাম রহমান, ঐ; মোহাম্মদ আবদুল মতিন, ঐ; সালাহ উদ্দিন চৌধুরী, ঐ; সালেহ আহমদ, বাংলার বাণী; আমীন আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ টাইমস; ওয়াহিদুর রশীদ মুরাদ, বাংলার বাণী; সাদেকুল হক, ঐ; আশরাফ খান, ঐ; আবদুল মান্নান সরকার, ঐ হালিমুর রশীদ, ঐ; মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, ঐ; মওলা চৌধুরী, পূর্বদেশ; আনওয়ার আহমদ, ঐ; আমিনুল ইসলাম, ঐ; খলিলুর রহমান, অবজারভার; আনোয়ার হোসেন, ঐ; সৈয়দ এনায়েত হোসেন, চিত্রালী; অহিদুর রহমান, পূর্বদেশ; আবুল হোসেন নকিব, ঐ; লুৎফুর রহমান, ঐ; মোহাম্মদ শফিক উদ্দীন আহমদ, ঐ; আবদুল মোত্তালেব, ঐ; মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার, ঐ; আবদুল আউয়াল, দৈনিক বাংলা; এ টি এম শামসুল আলম, ঐ; ইসহাক চাখারী, ঐ; খোন্দকার মোহসিনউজ্জামান, মর্নিং নিউজ; মোঃ শামসুল হক জাহিদ, ঐ; আবুল আহসান আহমেদ আলী, ঐ; মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, বাসস; সৈয়দ মুস্তাফিজুর রহমান, ঐ; সৈয়দ মাহমুদ, ঐ; সদরুল হাসান, বাংলাদেশ টাইমস; মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, দৈনিক বাংলা; আবদুল হালিম চৌধুরী, পূর্বদেশ, রফিকুর রহমান, বাংলার বাণী; এস এম জহুরুল আলম, বাসস; মোঃ মওসানুজ্জামান, ঐ; মোজাম্মেল হোসেন, বাংলাদেশ অবজারভার; ফারুক কাজী, বাংলার বাণী; রহমান জাহাঙ্গীর, দি পিপল; ইউসুফ পাশা, পূর্বদেশ; গোলাম সারওয়ার, ইত্তেফাক, বাহাউদ্দিন আহমদ, সদস্য ডিইউজে; লাল ভাই, মর্নিং নিউজ; মুহাম্মদ জহীরুল হক, কোষাধ্যক্ষ, জাতীয় প্রেসক্লাব; এম আকিল খান, পিপল; আজিজ মিসির, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ কে এম তবিবুল ইসলাম, বাসস; সৈয়দ আহমদ জামান, ঐ; মোহাম্মদ এরশাদুল হক, ঐ; আবদুল হালিম চৌধুরী, পূর্বদেশ; এম সাজ্জাদুল করিম, ঐ; রঞ্জন কিশোর চৌধুরী, শেখ আবদুল মজিদ, পূর্বদেশ; ফরিদ উদ্দিন আহমদ, ঐ; চৌধুরী মাজহারুল হক, ঐ; সলিমুল্লাহ, ঐ; এম আবু ইউসুফ, ঐ; সাবির উদ্দিন আহমদ, ঐ; আবদুল মান্নান, ঐ; ফরহাদ হোসেন, সংবাদ; সৈয়দ আখতার ইউসুফ, ইত্তেফাক, কে জি মোস্তফা, জনপদ; শামসুল ইসলাম আলমাজী, দৈনিক বাংলা; রশীদ তালুকদার, সংবাদ; মোকাদ্দেস আলী, অবজারভার; গোলাম মাওলা, দৈনিক বাংলা; বাদল নাগ, মর্নিং নিউজ; শফিকুল করিম, বাসস; শরিফুল আলম, পিপল; বাবু আনসারী, দৈনিক বাংলা; মোহাম্মদ আশরাফ আলী, মর্নিং নিউজ, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, ঐ; নূরুদ্দিন আহমদ, ঐ; মনিরুজ্জামান, ঐ; আবু বকর সিদ্দিক, পূর্বদেশ; মোঃ খলিলুর রহমান, ঐ; কে এম জাফরুল্লাহ, ঐ; গোলাম হাক্কানী খান, ঐ; মোঃ শামসুদ্দিন ভূইয়া, ঐ; মোঃ ইউনুস মজুমদার, ঐ; জোসেফ আইজাক, অবজারভার; এস এফ মকবুল আহমদ, ঐ; মোঃ নাসিরুল আলম, ঐ; মোঃ শাহাজাহান মজুমদার, ঐ; ফজলে রশিদ, ঐ; সৈয়দ মাহবুব আলম, সংবাদ; হোসেন তওফিক চৌধুরী, পূর্বাদেশ; বুদ্ধদেব মুখার্জী, অবজারভার; মোঃ সিরাজুল ইসলাম, মর্নিং নিউজ; সৈয়দ আহমদ, ঐ; সোহরাব হোসেন, ঐ; মোঃ হাবিলউদ্দিন, ঐ; আবু-আল সাইদ, সংবাদ; এস এন এম আয়াতউল্লাহ, সংবাদ; নোমান চৌধুরী, আজাদ; সুলতান আহমদ, ঐ; আবদুল মান্নান হাওলাদার, ঐ; আতিয়ার রহমান, ঐ; মোঃ ফজলুর রহমান, ঐ; এম মহিউদ্দিন শেখ, ঐ; মোয়াজ্জেম হোসেন বুলু, অবজারভার; আবদুস সাত্তার, বাংলার বাণী; আবুল খায়ের, ঐ; মোঃ আবদুর রব, মর্নিং নিউজ, খোন্দকার এ রাজজাক, ঐ; এ এন এম লুৎফর রহমান, বাংলাদেশ টাইমস; শফিকুল কবির, ইত্তেফাক; সুব্রত বড়ুয়া, ঐ; ফিরোজ আহমদ, ঐ; খোন্দকার রফিকউদ্দিন আহমদ, ঐ; রকিবুদ্দিন, ঐ; শাজাহান রেজা, ঐ; এ টি এম শফিউল্লাহ, ঐ; জাহান আরা বেগম, বাংলার বাণী; আহমদ ফজল সিদ্দিকী, বাংলাদেশ টাইমস; এ এম মোফাজ্জল, বাংলাদেশ টাইমস; আবদুল মাজেদ চৌধুরী, বাংলার বাণী; মনজুর কাদের, বাংলাদেশ অবজারভার; আবদুল মতীন, পূর্বদেশ; ধীরেন বোস, অবজারভার; এ এস এম এ খালেক, ঐ; এলাহী বক্স, মর্নিং নিউজ; রহমত আলী, মর্নিং নিউজ; আনোয়ার আলী চৌধুরী, ঐ; মুহাম্মদ ওয়াহিদুল ইসলাম, ঐ; সুফিয়া সুলতানা, ঐ; আনওয়ারা বেগম, ঐ; সৈয়দা শাহানা বেগম, ঐ; আমিনুল ইসলাম, বাসস; এন কে আলম চৌধুরী, ঐ; এম এ মোহায়মেন, ঐ; জহুরুল ইসলাম, এনা; মুহাম্মদ তুঘলক খান, ঐ; শামসুদ্দীন আহমদ চারু, ইত্তেফাক; বজলুর রহমান, ঐ; মোহাম্মদ গাজীউর রহমান, বাসস; হাসান শাহরিয়ার, ইত্তেফাক; মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, দৈনিক বাংলা; আবদুল হাদী, ইত্তেফাক; আসফউদ্দৌলা, ঐ; এ এন এম বদরুদ্দীন, ঐ; নূরুল ইসলাম বরিন্দি, ঐ; মহিদুল ইসলাম, ঐ; জাকারিয়া মিলন, ঐ; আবু সুফিয়ান, ঐ; শরীফ আবদুল কুদ্দুস, ঐ; প্রশান্ত ঘোলাল, ঐ; আবুল কালাম আজাদ, ঐ; মীর আফতাবউদ্দীন আহমদ, ঐ: সিরাজুল হক, ঐ; রাহাত খান, ঐ; মাহফুজ আলম, বাংলাদেশ টাইমস; র ইসলাম, পূর্বদেশ; কাজী হাসান হাবিব, ঐ; মেহেরুন্নেসা, ঐ; সৈয়দ কামরুজ্জামান, মর্নিং নিউজ; নূরুজ্জামান চৌধুরী, পূর্বদেশ; শহীদুজ্জামান খান, অবজারভার; জহিরুল আলম, ইত্তেফাক; মোজাম্মেল হক, বাসস; ইহসানুল করিম হেলাল, ঐ; শামসুদ্দীন আহমদ, ঐ; জিয়াউল হক, পূর্বদেশ; গাজীউল হাসান খান, এনা; শামসুদ্দীন আহমদ, ঐ; আবদুল খালেক ভূঁইয়া, বাংলাদেশ টাইমস; মাহবুবুল আলম, ঐ; মেজবাহউদ্দীন আকন্দ, ঐ; বজল আহমদ, বাসস; এ ই বি রেজা, বাংলাদেশ টাইমস; মৃণাল কৃষ্ণ রায়, ঐ; এ বি এম রুস্তুম আলী, মর্নিং নিউজ; এ এফ এম গোলাম রাব্বানী, ঐ; আবদুল হাকিম, বাংলার বাণী, মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক, ঐ; শামসুল ইসলাম, মর্নিং নিউজ; মোহাম্মদ নওয়াব আলী, ঐ; আনিসুর রহমান, পূর্বদেশ; শাহাবউদ্দীন ভূঁইয়া, ইত্তেফাক; সুলতান আহমদ, ঐ; এ ও এম ফখরুদ্দীন, মর্নিং নিউজ; শেহাবউদ্দীন আহমদ, এনা; জাহিদুজ্জামান ফারুক, ইত্তেফাক; এ এফ এম হাবীবুর রহমান, বাসস; রোকনুজ্জামান খান, ইত্তেফাক এবং এ কে এম জামালউদ্দীন, মর্নিং নিউজ।

পরবর্তীতে যাহারা আবেদন করেন

খালেদা এদিব চৌধুরী, পূর্বদেশ; শাজাহান আলী, আজাদ; শাহ সৈয়দ রেহান উল্লাহ, ইত্তেফাক; তোফাজ্জল হোসেন, ঐ; হাবিবুর রহমান মিলন, ঐ; জি. এম. স্বপন, আজাদ, হোসনে আরা বেগম, ঐ; মিসেস সায়েদা খুদসিয়া হাসান, ইত্তেফাক, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, ঐ; সৈয়দ সিরাজুল কবির, এনা; মোহাম্মদ নূর জালাল, সংবাদ; আবদুল মোমিন, ঐ; সুদর্শন চট্টোপাধ্যায়, হাসমতুল হক, ঐ; বাবুলাল সাহা, ঐ; শহীদুল ইসলাম, ঐ; শান্তিময় বিশ্বাস, ঐ; মোহাম্মদ নূরুল আলম, ঐ; স্বপন দত্ত, ঐ; বিনোদ রঞ্জিত সেন কর্মকার, ঐ; হাবিবুল্লাহ রানা, ঐ; আবদুর রহমান, ঐ; মোহসিন খায়রুল আনাম, ঐ; হাসান আলী, ঐ; তোজাম্মেল আলী, ঐ; আবুল হাসনাত, ঐ; বাসুদেব ধর, ঐ: বেবী মওদুদ, ঐ; জীবন চৌধুরী, আবুল হাশিম, ঐ; কাজী জাফরুল ইসলাম, ঐ; রুহুল আমীন, ঐ; মোহাম্মদ আতাউর রহমান বাদল, ঐ; মজিবুর রহমান বাদল, ঐ; সুবীর চৌধুরী, ঐ; কাজী আনোয়ারুল ইসলাম, ঐ; চপল বাশার, ঐ; রেজাউল হক সরোজ, ঐ; আহসান হামিদ, ঐ; মোহাম্মদ আবদুর রব, ঐ; রওশনআরা জলি, ঐ; আমান উল্লাহ সরকার, ঐ; আবদুল মজিদ, ঐ; বিজন কুমার চক্রবর্তী, ঐ; মিজানুর রহমান, ঐ: অজয় বড়ুয়া, ঐ; কামদা প্রসাদ ভৌমিক, ঐ; জি এম ইয়াকুব, ঐ; ওয়াসিলউদ্দীন, ঐ; হাফিজউদ্দিন আহমদ, ঐ; এম. বশির আহমদ, ঐ; শ্রী সন্তোষ গুপ্ত, ঐ সৈয়দ শাজাহান, বাংলাদেশ টাইমস, মোহাম্মদ আমিনুল হক, ঐ; আশরাফুল আলম, ঐ; মোহাম্মদ বজলুল হক, ঐ; মোহাম্মদ শমসের তাবরেজ (মিস্টু), ঐ; মাহাম্মদ শাজাহান আলী, ঐ; শামিম আহমেদ নাদিম, ঐ; মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, ঐ; খন্দকার আলী আশরাফ, দৈনিক বাংলা; সৈয়দ মর্তুজা আলী, বাংলাদেশ অবজারভার; চট্টগ্রাম, আতাউর রহমান, বাসস; ওবায়দুল হক কামাল, জনপদ; মোহাম্মদ খালেদুর রহমান, দৈনিক বাংলা; এ ওয়াদুদ ফরিদী, বাংলার বাণী, আবদুল করিম, ঐ; মোঃ আবিদুর রহমান, ঐ; কাজী নজরুল ইসলাম, ঐ; মোঃ আমজাদ হোসেন, বাংলাদেশ টাইমস, মোঃ আবু তাহের, ইত্তেফাক; মোঃ নাজিমুল হক, ঐ; শাহিন রেজা নূর, ঐ; আবদুর রশিদ, ঐ; ইয়াসিন আহমদ, ঐ; এম, এ, সোবহান, ঐ; ইমদাদুল হক, ঐ; আঃ রহমান খান, জনপদ; খলিলুর রহমান শরিফ, ঐ; বদিরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, ঐ; আবদুল ওহাব, ঐ; আসাদুজ্জামান খান, বাংলাদেশ টাইমস; নাজিমউদ্দিন মানিক, বাংলার বাণী; বিনয় কুমার দাস, ঐ; মতিউর রহমান, ঐ; আবদুস সালাম, ঐ; সৈয়দ মোস্তফা হোসেন, ঐ; খন্দকার তোজাম্মেল হোসেন, ঐ; রকিব সিদ্দিকী, ঐ; মমতাজউদ্দন আহমদ, এনা; শাহ আলম, গণকণ্ঠ, ঐ; আনোয়ার হোসেন, সংবাদ; গিয়াসউদ্দিন আহমদ মজুমদার, এনা; আবদুল মান্নান, পূর্বদেশ; হাফিজ আহমদ, ঐ; নূরুল ইসলাম, ঐ; (সভাপতি সাংবাদিক ইউঃ চট্টগ্রাম); মোহাম্মদ ঈসা, মর্নিং নিউজ; মোঃ আজিজুল হক, ঐ; আব জাফর শেখ, ঐ; মোঃ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ অবজারভার; আজিজ আহমদ, ঐ; মোঃ আমির হোসেন, ঐ; মোঃ নূরুল হুদা, ঐ; মাসুকুল হক, ঐ; মোঃ মফিজুল্লাহ, ঐ; মোঃ রফিকুল ইসলাম, ঐ; কাজিমউদ্দিন আহমদ, ঐ; মোঃ আতিকুল্লাহ, ঐ; মাইকেল, ঐ; খন্দকার আবুল হাসনাত, ঐ; মাহমুদুল হক চৌধুরী, ঐ; এম রিয়াজউদ্দিন আহমদ, ঐ; মোঃ আবুল হোসেন, ঐ; শেখ শহীদুল ইসলাম, ঐ; আবদুল গোফরান, ঐ; তাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঐ; মোঃ আশরাফ আলী, ঐ; মোঃ সিদ্দিকুল্লাহ, ঐ; আঃ হাই, ঐ; ফজলুল বারী চৌধুরী, ঐ; আঃ মতিন, ঐ; মদন সাউ, ঐ; মোঃ ইউসুফ হোসেন, ঐ; মোঃ মফিজুর রহমান, বাংলার বাণী; আঃ করিম মোল্লা, ঐ; মোঃ আঃ রহমান, ঐ; কাজী রাশিদুল হক পাশা, ঐ; শেখ গোলাম মোস্তফা, ঐ; মতিউর রহমান, ঐ; ফাতেমা আনসারী, আজাদ; কাজী মোঃ বক্স, বাংলাদেশ টাইমস; আমির খসরু, বাংলার বাণী; হামিদুর রহমান, ঐ; হেদায়েত উদ্দিন খান, জনপদ; আমানুল্লাহ কবির, বাংলাদেশ টাইমস, মোঃ মোকাররম হোসেন, বাসস; হাসানুজ্জামান খান, ঐ; এম শাহরিয়ার, ঐ; হাসানুজ্জামান চৌধুরী, ঐ; মোঃ মাসুম, ঐ; আনিস আহমেদ, ঐ; কাজী মোকসুদুল হাসান, ঐ; মোঃ হাসিবুর রহমান, ঐ; শহীদুল ইসলাম, ঐ; এস এ মাকসুদ, ঐ; ডি পি বড় আ, ঐ; আ স ম হাবিবুল্লাহ, বাসস (অবৈতনিক সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব); নাজির আহমদ, বাসস, চট্টগ্রাম; সৈয়দ শফিকউদ্দিন আহমদ, দৈনিক স্বাধীনতা, চট্টগ্রাম; শেখ আফতাব উদ্দিন, দৈনিক দেশবাংলা, চট্টগ্রাম; আঃ রাজ্জাক চৌধুরী, দৈনিক পূর্বদেশ; আঃ রহিম, বাংলাদেশ অবজারভার; মোস্তফা তরিকুল আলম, বাংলাদেশ টাইমস; মোঃ মোজাফফর হোসেন, ঐ; এ বি এম কামালউদ্দিন শামীম, পূর্বদেশ; মোঃ তোয়াহা খান, সংবাদ; রণেশ দাশ গুপ্ত, ঐ; মোঃ মুটরিব, দি পিপল; নজরুল ইসলাম বুলবুল, জনপথ; জামালউদ্দিন হায়দার, গণকণ্ঠ; হারুনুর রশিদ খান, সংবাদ হোসেন নূর আলম, এনা; সৈয়দ ইকবাল, ঐ; মোঃ সিরাজউদ্দিন, ঐ; শাহাবুদ্দীন আহমদ, ঐ; কাজী নেসারউদ্দিন আহমদ, জনপদ; শাহাদৎ হোসেন বাবুল, ঐ; মোঃ আবদুল হাই, ঐ; আফতাবউদ্দিন আহমদ, ঐ; মোঃ নূরুল ইসলাম মোড়ল, বাংলার বাণী; আতাউল মালেক, জনপদ; মোঃ রমজান আলী; ফেরদৌস উদ্দিন রহমত-ই খুদা, ঐ; মোজাম্মেল হক, ঐ।

অতঃপর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাকশালে যোগদান সমগ্র জাতির জন্য এক বিষন্ন বিস্ময়।

আতাউর রহমান খানের বাকশালে যোগদান

২৫ এপ্রিল (১৯৭৫) জনাব আতাউর রহমান খান সংবাদপত্রে প্রকাশাথে নিম্নোক্ত বিবৃতির মাধ্যমে বাকশালে যোগদানের কথা দেশবাসীকে জানান :

“দেশের একমাত্র জাতীয় দল কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে আমি যোগদান করিয়াছি। আমার মনে হয়, এই ব্যাপারে দেশবাসী বিশেষতঃ আমার সহকর্মীদের নিকট একটি কৈফিয়ত দেওয়া আমার কর্তব্য। তাহাদের মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, আমি রাজনীতিতে একটি অভিনব পন্থা গ্রহণ করিয়াছি। পন্থাটি দৃশ্যতঃ অভিনব সত্য; কিন্ত এই পন্থা আমি হঠাৎ গ্রহণ করি নাই। আমি দীর্ঘদিন ভাবিয়া-চিন্তিয়া করিয়াছি। তাহা ছাড়া সহকর্মীদের অনেকের সঙ্গে আলোচনা করিয়াছি। কিন্তু সকলের সঙ্গে আলাপ করিতে পারি নাই। তাহাদের সকলকেই আমার বর্তমান চিন্তাধারার সাথী করিবার উদ্দেশ্যেই এই বিবৃতি দিতেছি।

পন্থাটি একান্তভাবেই রাজনীতিক, রাজনীতির শেষ কথা প্রথমে দেশবাসী এবং পরিণামে মানব জাতির কল্যাণ। এই কল্যাণের প্রথম কথা জনগণের আর্থিক সুখ সমৃদ্ধি। ইহা ব্যতীত জনগণের স্বাধীনতা অর্থবহ হইতে পারে না। সুখ-সমৃদ্ধির প্রথম শর্ত শান্তি ও শৃংখলা। শান্তি-শৃংখলার পূর্বশর্ত জনগণের সার্বিক ঐক্য, জনগণের ঐক্য ব্যতিরেকে শান্তি-শৃংখলা ও জনগণের উন্নতি কোন সরকারের একক চেষ্টায় সার্থক হইতে পারে না। আমাদের দেশে এই গণ ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি এই জন্য যে, আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছি। সকলেই জানেন, সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা স্বাধীনতা অর্জিত হইলে অর্থনীতি বিধ্বস্ত ও শান্তি-শৃংখলা বিপর্যস্ত হওয়া স্বাভাবিক। দেশবাসীর জমাট বাঁধা ঐক্যই কেবল দেশকে এই সংকট হইতে উদ্ধার করিতে পারে। এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন উপায়ে হইতে পারে। কিন্তু আমাদের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান একটি বিশেষ-পথ নির্দেশ করিয়াছে। জনগণের প্রত্যক্ষ নির্বাচিত সার্বভৌম পার্লামেন্ট একটি মাত্র জাতীয় দলের বিধান করিয়াছে। দেশের এই বাঞ্ছিত শান্তি-শৃঙ্খলা আনিতে হইলে জনগণকে বিশেষতঃ তাহাদের নেতৃবৃন্দকে দেশের আইন, মানিয়া চলিতে হইবে। আইন-কানুনের মধ্যে আবার সাংবিধানিক আইনই সর্বোচ্চ।

এই পরিস্থিতি লইয়া আমি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত বহুবার আলাপ করিয়াছি। আমি আরও উপলব্ধি করিয়াছি যে, তাহার এই ঐক্য প্রচেষ্টা আন্তরিক এবং এই কাজে সকল দল ও নেতার সহযোগিতা তিনি একান্তভাবে কামনা করেন। আমার আরো প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, দেশকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করিবার উদ্দেশ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিকভাবেই তিনি আগ্রহশীল। এই অবস্থায় এই কাজে প্রেসিডেন্ট-এর সহযোগিতা করা সকল দেশ-প্রেমিকের বাঞ্ছনীয়। দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে কোন সচেতন নাগরিকের পক্ষে নীরব দর্শক ও শুধুমাত্র সমালোচকের ভূমিকা পালন করা উচিত নয়। বরঞ্চ তার রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাইয়া সরকারের সহিত সক্রিয় সহযোগিতা করাই কর্তব্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই কর্তব্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছি।

আমাদের সমস্যা অনেক, তবে তাহার সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। সেই সমাধানের সন্ধানে জাতীয় ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় আমার এই শেষ বয়সে যথাশক্তি লইয়া আমি আত্মনিয়োগ করিতে চাই। জনগণকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী মর্যাদাবান এবং সম্মানিত জাতি হিসাবে দেখিয়া যাওয়াই আমার জীবনের একমাত্র কামনা। এই সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করার জন্য বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-এর সকল নেতা এবং কর্মীবৃন্দকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি। তাহাদের অনেকেই আমার প্রিয়জন ও পুরাতন সহকর্মী এবং নবাগতরা সবাই আমার স্নেহের পাত্র। আমি যে মহান উদ্দেশ্যে জাতীয় দলে যোগদান করিলাম সে উদ্দেশ্য সফল করার জন্য সকলের পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা আমার একান্তভাবে কাম্য।

উপস্থিত জাতীয় সম্মানিত সাংবাদিক প্রতিনিধিবৃন্দ এই অনুষ্ঠানে যোগদান করিবার জন্য যে কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আপনাদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা লাভ করিয়াছি। আশা করি, ভবিষ্যতেও আপনাদের সহযোগিতা আমাকে সঠিক পথে দেশের কাজ করিয়া যাইতে সহায়তা করিবে।”

এখানে উল্লেখ্য যে, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনামায় বলা হয় “জাতীয় সংসদের যে সমস্ত সদস্যবৃন্দ জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) এখনও যোগদান করেন নাই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৭ খ ধারার ৫ক উপধারা মোতাবেক প্রেসিডেন্ট তাহাদের উক্ত দলে যোগদানের শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল (১৯৭৫) ধার্য করিয়াছেন।”

প্রসংগত আরও উল্লেখ্য যে, জনাব আতাউর রহমান খান জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন।

হাজী দানেশসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বাকশালে যোগদানের আবেদন

বাকশালে যোগদানকালে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ সাবেক এমএলএ দ্বয় হাজী মোহাম্মদ দানেশ, জনাব আবদুল করিম ও জেনারেল আইউব-এর অভ্যুত্থানের যে ঠু ঠু জগন্নাথ ক্ষমতাহীন জাতীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আবদুল হক সাহেবদের বিবৃতি :

মহাননেতা বঙ্গবন্ধু,

“জাতীয় জীবনের এক সংকট সন্ধিক্ষণে আপনার দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণা দেশের জনগণের মধ্যে একটি নতুন আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়াছে, এটা এখন অত্যন্ত স্পষ্ট যে, জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তি দ্বিতীয় বিপ্লবের সঠিক বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত।

সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রয়াস গ্রহণের এই শুভলগ্নে মতামত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ সর্বাধিক প্রয়োজনীয়। আমরা একমাত্র জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে যোগদানের অনুমতি চাহিতেছি, যেহেতু আমাদের এই প্রতীতি হইয়াছে যে, আপনার দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচীর মাধ্যমেই কেবল জাতীয় আশা-আকাংখার বাস্তবায়ন সম্ভব।

 আমাদেরকে পার্টির সদস্যপদ প্রদান করিয়া আপনার মহান নেতৃত্বে জাতিকে সেবা করার অনুমতি দিয়া বাধিত করিবেন।”

জেলা গভর্নর নিয়োগ

২৩শে জুন (১৯৭৫) সারা দেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করিয়া ১৬ জুলাই তারিখে ৬১ জন গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। গভর্নরদের মধ্যে ছিল ৩৩ জন সংসদ সদস্য, ১৩ জন বেসামরিক অফিসার, ১ জন সামরিক অফিসার এবং বাকী ১৪ জনের মধ্যে ছিল জনসাধারণের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যেমন আইনজীবী, উপজাতীয় নেতা, প্রাক্তন এমসিএ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি। গভর্নরদের তালিকা নিম্নে দেয়া হইল :

১।এডভোকেট জহিরুল ইসলাম, প্রাক্তন এম সি এ                                              কক্সবাজার

২। জনাব মোহাম্মদ খালেক এমপি                                                       চট্টগ্রাম

৩। জনাব জাকিরুল হক চৌধুরী                                                             চট্টগ্রাম (উত্তর)

৪। জনাব মং সু প্রু চৌধুরী বৌমা প্রধান বান্দরবান                                         বান্দরবান

৫। জনাব মংপ্রু সুং রাজা মানিকছড়ি                                                     খাগড়াছড়ি

৬। জনাব এ এম এ কাদের জেলা প্রশাসক, পার্বত্য চট্টগ্রাম                           রাঙামাটি

৭। জনাব খাজা আহামদ এমপি                                                                ফেনী

৮। জনাব আবদুর রশিদ এমপি                                                               লক্ষ্মীপুর

৯। জনাব নূরুল হক এমপি                                                                       নোয়াখালী

১০। অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমপি                                                   কুমিল্লা

১১। জনাব আলী আজম এমপি                                                                 ব্রাহ্মণবাড়িয়া

১২। জনাব আবদুল আউয়াল এমপি                                                         চাদপুর

১৩। জনাব মোস্তফা আলী এমপি                                                          হবিগঞ্জ

১৪। জনাব নুরুল আহাদ জেলা প্রশাসক, বরিশাল                                  মৌলভীবাজার

১৫। জনাব মোহাম্মদ রশিদুল হক জেলা প্রশাসক, সিলেট                  সিলেট

১৬। জনাব আবদুল হাকিম চৌধুরী এমপি                                              সুনামগঞ্জ

১৭। জনাব আবদুস সাত্তার জেলা প্রশাসক, পটুয়াখালী                        কিশোরগঞ্জ

১৮। জনাব জুবেদ আলী এমপি                                                                নেত্রকোনা

১৯। রফিকুদ্দিন ভূঁইয়া এমপি                                                                                 ময়মনসিংহ

২০। জনাব আবদুল হাকিম এমপি                                                           জামালপুর

২১। জনাব আনিসুর রহমান এমপি                                                          শেরপুর

২২। জনাব আবদুল কাদের সিদ্দিকী                                                      টাঙ্গাইল

২৩। জনাব এম এ তাহের তৎকালীন সচিব, ভূমি সংস্কার                        ঢাকা (মেট্রো)

২৪। জনাব আশরাফ আলী চৌধুরী সাবেক এম সি এ                              ঢাকা

২৫। জনাব মোহাম্মদ শামসুল হক সাবেক এম সি এ                            বিক্রমপুর

২৬। জনাব আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া এমপি                                              নরসিংদী

২৭। জনাব এম. নুরুজ্জামান পরিবহন কমিশনার                                   মানিকগঞ্জ

২৮। জনাব শামসুদ্দীন মোল্লা এমপি                                                   ফরিদপুর

২৯। জনাব আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী                                                     রাজবাড়ি

৩০। জনাব আবিদুর রেজা খান এমপি                                                     মাদারীপুর

৩১। জনাব এ এইচ এম মোফাজ্জল করিম জেলা প্রশাসক, কুষ্টিয়া   গোপালগঞ্জ

৩২। জনাব এস আর খান, সংস্থাপন বিভাগ                                          ভোলা

৩৩। জনাব আমির হোসেন এমপি                                                          ঝালকাঠি

৩৪। জনাব আমিনুল হক চৌধুরী এডভোকেট                                       বরিশাল

৩৫। জনাব এনায়েত হোসেন খান এমপি                                               পিরোজপুর

৩৬। জনাব শাহজাদা আবদুল মালেক খান এমপি                                   পটুয়াখালী

৩৭। জনাব এম শফিকুর রহমান জেলা প্রশাসক, রাজশাহী                    বরগুনা

৩৮। জনাব আবদুল লতিফ খান এডভোকেট, সাবেক এমসিএ               বাগেরহাট

৩৯। কর্নেল মোহাম্মদ আনোয়ারউল্লাহ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী    খুলনা

৪০। কাজী মঞ্জুর-ই-মওলা, জেলা প্রশাসক, বগুড়া                                               সাতক্ষীরা

৪১। জনাব রওশন আলী এমপি                                                                যশোর

৪২। খোন্দকার আবদুল হাফিজ এমপি                                                                 নড়াইল

৪৩। জনাব কে এম এ আজিজ এমপি                                                       ঝিনাইদহ

৪৪। জনাব লুৎফুল্লাহিল মজিদ, জেলা প্রশাসক, নোয়াখালী                  মাগুরা

৪৫। জনাব আবদুর রউফ চৌধুরী এমপি                                                               কুষ্টিয়া

৪৬। জনাব এম ফাইজুর রাজ্জাক জেলা প্রশাসক, ফরিদপুর                                চুয়াডাঙ্গা

৪৭। জনাব মহিউদ্দিন আহামদ এমপি                                                   মেহেরপুর

৪৮। অধ্যাপক আবু সাঈদ এমপি                                                            পাবনা

৪৯। জনাব মোতাহার হোসেন তালুকদার                                                             সিরাজগঞ্জ

৫০। জনাব এ কে মজিবুর রহমান এমপি                                                                বগুড়া

৫১। জনাব কাসিম উদ্দিন আহমেদ এমপি                                             জয়পুরহাট

৫২। জনাব নাজিবুর রহমান এডভোকেট                                                               দিনাজপুর

৫৩। জনাব এম ফজলুল করিম এমপি                                                     ঠাকুরগাঁও

৫৪। জনাব এম আবদুর রউফ এমপি                                                      নীলফামারী

৫৫। জনাব এ.কে.এম জালালউদ্দিন জেলা প্রশাসক, ময়মনসিংহ        রংপুর

৫৬। জনাব লুৎফর রহমান, এমপি                                                            গাইবান্ধা

৫৭। জনাব শামসুল হক এমপি                                                                 কুড়িগ্রাম

৫৮। জনাব শংকর গোবিন্দ চৌধুরী প্রাক্তন এম সি এ                    নাটোর

৫৯। জনাব আতাউর রহমান                                                                   রাজশাহী

৬০। জনাব মোহাম্মদ আবদুল জলিল এমপি                                         নওগাঁ

৬১। জনাব ডঃ এ এ এম মিসবাহুল হক এমপি                                         নবাবগঞ্জ

আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সর্বব্যাপক অবাধ দুর্নীতি, রাহাজানি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুণ্ঠন, পাচার, গুম, খুন, দেশবাসীকে অতিষ্ঠ করিয়া তোলে। সরকারের ব্যর্থ প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক পলিসি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতীয় অর্থনীতির যোগানদার অর্থনীতিতে পরিণত করে, দেখা দেয় এক বিস্ময় ফল। পণ্যদ্রব্যের মূল্য ক্রেতা সাধারণের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যায়। ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায়, উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়। কলে-কারখানায় কাঁচা পাটের গুদামে শুরু হয় অগ্রি সংযোগ ও স্যাবোটেজ। সর্বত্র দেখা দেয় ভোগ্যপণ্যের তীব্র অভাব, ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যুবরণ করে অসংখ্য দেশবাসী। বিরোধী কণ্ঠকে বিনাবিচারে আটক করিবার নিমিত্ত বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন ও ইহার যথেচ্ছ ব্যবহারে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হইয়া শেখ মুজিব দেশব্যাপী ১৯৭৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং তদানুসারে জরুরি আইন প্রণয়ন করা হয়। একইভাবে নিজ বুদ্ধির দোষে, নিজকর্ম দোষে শেখ মুজিব ও তাহার আওয়ামী লীগ সমগ্র বাংগালী জনতার দুশমনে পরিণত হইতে থাকেন। যে শেখ মুজিব ১৯৬৯-৭০-৭১-৭২ সালে ছিলেন বাংগালীর নয়নমণি তিনিই ১৯৭৩-৭৪ সালে রূপান্তরিত হইলেন বাংগালীর চক্ষুশূলে। একদা যিনি ছিলেন জনতার কাতারে তিনি ক্ষমতা ও কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখিবার অদম্য স্পৃহায় ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনী সংযোজন দ্বারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া এক দলের একনেতা হিসাবে রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হইলেন। তাহার নিজস্ব ক্ষমতার লোভ, একশ্রেণির মেরুদন্ডহীন নেতা ও রাজনৈতিক কর্মী, নীতিজ্ঞানহীন বুদ্ধিজীবী ও চরিত্রহীন টেন্ডলের যোগসাজশে বাংলার সর্বত্র নগরে, বন্দরে, কলকারখানায়, গ্রামে-গঞ্জে, ক্ষেতে-খামারে দিল্লীর দাসেরা আওয়াজ উঠাইতে থাকে- ‘এক নেতা এক দেশ-বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।

১৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন

এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ ও অমানিশার অবসান ঘটে বাংলা মায়ের সাতটি সন্তানের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায়। মৃত্যু ঘন্টা বাজে মুজিবী জালেমশাহীর। উদয় হয় অরুণ রাঙ্গা প্রভাত। অকুতোভয় এই সাতটি দামাল সন্তান যেন বাংলাদেশের সাত কোটি মুক্তিপাগল বাঙ্গালির আশা-আকাংখার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। এক এক কোটির প্রতিনিধি যেন এক একজন। ইহারা হইতেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭ জন অফিসার লেঃ কর্নেল রশীদ, লেঃ কঃ ফারুক, মেজর পাশা, মেজর হুদা, মেজর মহিউদ্দিন এবং পদচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর শাহরিয়ার। সেইদিন যেমন আপামর বাংগালী জনতা তাহাদিগকে কৃতজ্ঞতাভরে হৃদয় নিংড়ানো স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানাইয়াছিল, তেমনি স্বাধীনচেতা বাঙ্গালি মাত্রই চিরকাল এই ৭ জন তরুণকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাইবে। বস্তুতঃ জাতীয় নেতৃত্বের অবিমৃষ্যকারিতা ও বিজাতীয় দাসত্বের শৃংখল হইতে মুক্তি পাওয়ার সূর্য সম্ভাবনা হিসাবেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট চিরকাল পরিগণিত হইবে। আজাদী পাগল বাংগালীর জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ১৫ আগস্ট সত্যিই এক অনন্য দিবস। ইহা ছিল কার্যতঃ দিল্লী ও দিল্লীর দাসত্বের অশুভ শৃংখল মোচনের প্রথম পদক্ষেপ ও শুভ সূচনা।

শেখ মুজিবের গৃহে প্রাপ্ত সম্পদ

৩০শে অক্টোবর (১৯৭৫) দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদ মোতাবেক সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ ৩২ নং সড়কে অবস্থিত ব্যক্তিগত বাসভবনে প্রাপ্ত সম্পদের বিবরণ:

১। হীরা, মুক্তা, প্লাটিনাম ও স্বর্ণালঙ্কার- ৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা বাংলাদেশী মুদ্রায় নগদ ৯৪ হাজার ৪ শত ৬১ টাকা,

২। ব্যক্তিগত মোটর গাড়ি- ৩টা,

৩। বৈদেশিক মুদ্রা- ১৭ হাজার ৫ শত টাকা,

৪। বিদেশী রাষ্ট্র প্রদত্ত- ১ লক্ষ টাকার উপহার,

৫। বাতিলকৃত শতকী নোট- ৬ শত ২১ খানা,

৬। ১টি ভারী মেশিনগান, ২টি হালকা মেশিনগান, ৩টি এস.এম.জি, ৪টি স্টেনগান, ৯০টি আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৬০টি গ্রেনেডসহ গোলাবারুদ ইত্যাদি।

শেখ হাসিনার দিল্লীতে আশ্রয়

নিহত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ও তার স্বামী বৈজ্ঞানিক ডঃ ওয়াজেদ আলী মিয়া ও তাহাদের সন্তানদ্বয় পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের মারফত ভারতীয় রাজধানী দিল্লীতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করিয়া ২১শে আগস্ট (১৯৭৫) চলিয়া আসে। দিল্লীতে ৭ বৎসর অবস্থানের পর ১৯৮১ সালে ১৭ই মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান হিসাবে মা-বাবা-ভাই-বোনের স্নেহঘেরা পরিবেশহারা ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে। নিষ্ঠুর রাজনৈতিক জগৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক স্নেহ-মায়া-মমতা-ভালবাসাকে সহ্য করে না ইহাই অকাট্য সত্য ও নির্মম বাস্তব।

ভাসানীর অভিনন্দন : ভারতের প্রতিক্রিয়া

১৫ই আগস্ট বিপ্লবকে মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক পদক্ষেপ আখ্যায়িত করিয়া অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন আর ভারতীয় সরকারি মুখপত্র আগস্ট পরিবর্তন সম্পর্কে বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতি ধারার প্রতিক্রিয়া আমাদের উপর না হওয়ার কোন অবকাশ নাই, কিন্তু এগুলো বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া অভিমত প্রকাশ করেন।

(১৭-৮-৭৫, বাংলাদেশ টাইমস)।

ইমাম মদিনীর ওয়ালাইকুম আসসালাম

১৫ই আগস্ট শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়কালে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের ইমাম মদিনী সাহেব বলেন যে, আমাদের প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ দেশবাসীকে আস্সালামু আলাইকুম বলেছেন আমি প্রতুত্তরে তাকে ওয়ালাইকুম আস সালাম জানাই।

অন্যদিকে দিল্লীশ্বরী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পুনরায় অস্ত্র বলে ঢাকায় ক্ষমতায় বসাইয়া দিবে প্রত্যাশায় ৪০ জনের অধিক সংসদ সদস্য ও টাংগাইলের গভর্নর কাদের সিদ্দিকী সীমান্ত অতিক্রম করিয়া ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। হায় আশা কুহুকিনী।

১৫ আগস্ট (১৯৭৫) খন্দকার মোশতাক আহমদ অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের অগ্রদূতদের অনুরোধে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং জাতীয় জীবনের সেই ঝঞাসঙ্কুল উত্তাল তরঙ্গে শক্ত ও সুনিপুণ হস্তে রাষ্ট্রীয় তরণীর হাল ধরেন।

১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের ভাষণ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

আসসালামু আলাইকুম,

প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা,

এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাংখাকে বাস্তবে রূপদানের পূত-পবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার উপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসাবে সরকারের দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মতো অকুতভয় চিত্তে এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, নৌ-বাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। এরা সবাই একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন।

৩০ লক্ষ বীর শহীদানের পূত রক্ত এবং দু’লক্ষ মা-বোনের পবিত্র ইজৃজতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বাংলার সংগ্রামী মানুষকে নতুন জীবনের আস্বাদ ও সন্ধান দেবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম দেশে সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসাবে বিশ্ব দরবারে আমরা মাথা উচিয়ে দাঁড়াবো, এই ছিলো আমাদের লক্ষ্য ও কামনা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বন্ধুদেশের অনেককেই আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। কিন্তু বিগত দীর্ঘকাল দেশের ভাগ্য উন্নয়নের কোনো চেষ্টা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা এবং সেই ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে আঁকড়ে রাখার ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করা হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দাবার চাল চালা হয়েছে এবং দেশবাসীর ভাগ্য উন্নয়নকে উপেক্ষা করে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অন্যকে বঞ্চিত করে একশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকদের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করা হয়েছে। কতিপয় ভাগ্যবানের স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টায় জনগণের জীবনে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান অগ্নিমূল্য অসহনীয় হয়ে পড়ে। দেশের শিল্প, বিশেষ করে পাটশিল্প ধ্বংসের মুখে। অর্থনৈতিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছায়, যেখানে বাংলার সর্বশ্রেণির মানুষ দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের অসহায় শিকারে পরিণত হয়।

একটি বিশেষ শাসক চক্র গড়ে তোলার লোলুপ আকাংখায় প্রচলিত মূল্যবোধের বিকাশ ও মানুষের অভাব-অভিযোগ প্রকাশের সম্মত পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় দেশবাসী একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অব্যক্ত বেদনায় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল।

দেশের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী পরমতম নিষ্ঠার সঙ্গে তাহাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশবাসীর সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মােচন করেছেন। এখন দেশবাসী সকল শ্রেণির মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্রুত নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোরতর পরিশ্রম করিতে হইবে।

সর্বপ্রকার কলুষ থেকে দেশকে মুক্ত করিতে হইবে। দেশে বিচার প্রতিষ্ঠা করিতে হবে এবং মানুষ যাতে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে সে জন্য সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।

দেশপ্রিয় সকল নাগরিককে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সর্বাবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি ও সম্প্রীতি অটুট রাখতে হইবে। সমাজের প্রতি স্তরে প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে সেই অধিকার সংরক্ষণ করিতে হইবে। শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে দেশবাসীকে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করিতে হবে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু রাখতে হইবে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সমতা ও সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও প্রত্যেক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং একে অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অব্যাহত থাকবে। সরকার জোট নিরপেক্ষ নীতি সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে যাবেন।

আমাদের সরকার জাতিসংঘ সনদ ও নীতিমালার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের সম্পর্ক নির্ধারণকারী সকল চুক্তি ও দায় সম্পর্কে সরকার মর্যাদাশীল থাকবে।

বর্ণবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদ বিরোধী আমাদের নীতি অব্যাহত থাকবে। ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ এবং জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অটুট থাকবে। এইসব মোর্চার সর্বপ্রকার তৎপরতার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও শরীকানা অব্যাহত থাকবে। বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখবো। এখনো পর্যন্ত যাহাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়নি, সেইসব দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইনশাআল্লাহ আমরা সচেষ্ট হইবে। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়’- এই নীতির রূপরেখার মধ্যে আমরা শান্তি ও প্রগতির পথে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবো।

সরকার বিশেষভাবে উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা নিচ্ছে। ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ রাষ্ট্রসমূহ, জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন ও বৃহৎ শক্তিসমূহের সঙ্গে এই সরকার ঘনিষ্ঠতর এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। সরকার ইসরাইলের কবল থেকে আরব পুণ্যভূমি পুনরুদ্ধারের জন্যে আরব ভাইদের ন্যায়সংগত সংগ্রামে ও ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানাচ্ছে।

প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দিতে চাই যে, কোনপ্রকার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা সামাজিক কলুষতার সঙ্গে এই সরকারের কোন আপোষ নাই। আমাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন এক অভূতপূর্ব সুযোগ। সেই সঙ্গে আপনাদের সামনে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ।

প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, আসুন আমরা পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে এই মোনাজাত করি, তিনি যেন আমাদের সহায় হন এবং তাঁর অপার করুণায় আমাদের সঠিক পথে চালিত করেন। খোদা হাফেজ।

মোশতাকের মন্ত্রিসভা

প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ সমবায়ে তাহার সরকার গঠন করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মোহাম্মদ উল্লাহসহ ১০ জন কেবিনেট মিনিস্টার হইলেন:

১. আবু সাঈদ চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী; ২. প্রফেসর ইউসুফ আলী, পরিকল্পনামন্ত্রী; ৩. বাবু ফনীভূষণ মজুমদার, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী; ৪. জনাব সোহরাব হোসেন, পূর্ত ও নগর উন্নয়ন; ৫. জনাব আবদুল মান্নান, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা; ৬. বাবু মনোরঞ্জন ধর, আইন, পার্লামেন্টারি বিষয়াদী ও বিচার; ৭. জনাব আবদুল মমিন, কৃষি ও খাদ্য; ৮. জনাব আসাদুজ্জামান খান, বন্দর, জাহাজ ও আভ্যন্তরীণ জলযান; ৯. ড আজিজুর রহমান মল্লিক, অর্থ; ১০. ডঃ মোজাফফর আহমদ, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক, কারিগরি গবেষণা ও আণবিক শক্তি।

১১ জন স্টেট মিনিস্টার হইলেন :

১. দেওয়ান ফরিদ গাজী, বাণিজ্য, পেট্রোলিয়াম ও খনিজ; ২. মোমেনউদ্দিন আহমদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ ৩. প্রফেসর নূরুল ইসলাম চৌধুরী, শিল্প; ৪. শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বিমান, পর্যটন, ভূমি, প্রশাসন ও সংস্কার; ৫, জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, ইনফরমেশন, ব্রডকাস্টিং, লেবার, স্যোসাল ওয়েলফোর, কালচারেল এফেয়ার্স ও স্পোর্টস; ৬. জনাব মোসলেমউদ্দিন খান, পাট; ৭. জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, যোগাযোগ ও রেলওয়ে; ৮. কে এম ওবায়দুর রহমান, ডাক, তার ও টেলিফোন; ৯. ডাঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল, সাহায্য ও পুনর্বাসন; ১০, জনাব রিয়াজউদ্দিন আহমদ, বন, মৎস্য ও পশু; ১১. সৈয়দ আলতাফ হোসেন, যোগাযোগ, রোডস, হাইওয়েজ ও রোডস ট্রান্সপোর্ট।

হাজী দানেশের অভিনন্দন

৪ঠা সেপ্টেম্বর (১৯৭৫) হাজী মোহাম্মদ দানেশ এক বিবৃতিতে দেশে যেভাবে এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হইতে চলিয়াছিল উহা নস্যাৎ করিয়া দেওয়ার জন্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি অভিনন্দন জানান।

তিনি বলেন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মূলোচ্ছেদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা এবং ঘোষিত পররাষ্ট্র নীতির জন্য খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জনগণের প্রতি সরকারি আহ্বান সমর্থন করিয়া বর্ষিয়ান নেতা সরকারের প্রতি তাহার পূর্ণ সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেন। হাজী দানেশ বলেন, সমগ্র জাতির সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমেই পর্বতপ্রমাণ সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে এবং দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ উহা সম্ভব।

উল্লেখ্য, এই হাজী মোহাম্মদ দানেশ জেঃ আইউব-এর সামরিক শাসনকালে আইউব-এর অনুরক্ত, একদলীয় বাকশালের শাসন আমলে বাকশাল সদস্য, জেঃ জিয়ার সামরিক শাসন গর্ভে জন্ম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্য, আবার লেঃ জেঃ এরশাদ-এর সামরিক শাসন গর্ভে জন্ম জাতীয় সংসদ ও বাংলাদেশে সামরিক কর্তাদের দলীয় সদস্য হইতে এতটুকু বিবেক দংশন বোধ করেন নাই। জনাব আতাউর রহমান খান একই ধারায় বাকশালে, সামরিক শাসক জেঃ জিয়ার দোসর হওয়ার কার্যক্রমে ব্রত হন এবং সামরিক শাসক জেঃ এরশাদ-এর প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন- কি বিচিত্র ও অনুকরণীয় নেতৃ চরিত্র!

অভ্যুত্থানের মূল সুর রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক ও জনজীবনে রূপদানের মহৎ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা একদলীয় রাজনীতি আইন বাতিল করেন। ইতিপূর্বে ১৯৭৫ সালের ২৮শে আগস্ট ৬১টি জেলার গভর্নর নিযুক্তি আদেশ বাতিল করেন। ২২শে আগস্ট (১৯৭৫) এক প্রশাসনিক আদেশে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতঃ মূল মালিকের নিকট হস্তান্তর করিয়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২২শে আগস্ট তিনি রাষ্ট্রপতি আদেশ ৯ (পি, ও, ৯) বাতিল করেন ও সরকারি কর্মচারীদের মনে নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস পান। সর্বোপরি ৩ অক্টোবরের বেতার ভাষণে তিনি ইহাও ঘোষণা করেন যে, আগামী ১৫ই আগস্ট (১৯৭৬) হইতে দেশব্যাপী রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শুরু হইবে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি (১৯৭৭) তারিখে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। তিনি ইহাও ঘোষণা করেন যে, সকল রাজবন্দির বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করা হইবে এবং অতঃপর রাজনৈতিক কারণে কাহারো বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হবে না। এইভাবেই বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন, বহুদলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রবর্তন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নব অধ্যায় সূচিত হয় খন্দকার মোশতাক আহমদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও সিদ্ধান্তে। বস্তুতঃ খন্দকার মোশতাক আহমদ ৩রা অক্টোবরের ঘোষণা ছিল এক কথায় ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার সুমহান আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি।

৩রা নভেম্বর

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পাল্টা জবাবে ৩রা নভেম্বর (১৯৭৫) মুক্তিযুদ্ধকালে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে দিল্লি-মস্কো আখ্যায়িত সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ সরকারের পতন ঘটায়। দিল্লী-মস্কো বশংবদ সাক্ষী গোপাল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় পাকা-পোক্তভাবে আসীন হওয়ার প্রয়াসকালেই ৬ই নভেম্বর দিবাগত রাত্রে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান হয় এবং অভ্যুত্থানকালে পলায়নের সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ পথিমধ্যে শেরেবাংলা নগরে নিহত হন।

৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতা সফল অভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশ্য ইতিপূর্বে নিহত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক-এর দায়িত্ব গ্রহণ করে ও প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করে।

৬ই নভেম্বর সায়েমের ভাষণ

“প্রিয় দেশবাসী,

আস্সালামু আলাইকুম। আজ এক সংকটময় মুহূর্তে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জনগণের সহযোগিতার উপর দৃঢ় আস্থা রাখিয়া আমি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছি।

দেশের স্বাধীনতা এবং আপামর জনসাধারণের ও আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী-সমৃদ্ধিশালী জীবন নিশ্চিত করার জন্য যে লক্ষ লক্ষ ভাই ও বোনেরা আত্মাহুতি দিয়াছেন এবং জীবন বিপন্ন করিয়াছেন, আজ সর্বান্তঃকরণে তাহাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করিতেছি। যে আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হইয়াছিলাম, স্বাধীনতার প্রায় দীর্ঘ চার বৎসর পরেও তাহার আশানুরূপ বাস্তবায়ন হয় নাই। ফলে জনসাধারণ আমি অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। তাহাদের মনে হতাশা ও নিরাপত্তাবোধের অভাব। দেশের সাধারণ মানুষের এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার ফলে রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রভূত আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ প্রতিফলিত হয় নাই।

আমরা বর্ণবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদ বিরোধী নীতি অনুসরণ করিয়া যাইব। ইসলামী সম্মেলন, জোট নিরপেক্ষ ও কমনওয়েলথ সম্মেলনের সংগে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় থাকিবে। বিশ্বশান্তি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দৃঢ়তর করিবার প্রচেষ্টায়ও আমরা সক্রিয় থাকিব। এখনো পর্যন্ত যে সব রাষ্ট্রের সহিত আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নাই, সে সব দেশের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমরা প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইব। ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়’- এই প্রতিপাদ্যই হইবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি।

আমরা উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইব। একই সাথে আমরা আমাদের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো জোরদার করার লক্ষ্যে নিষ্ঠাবান থাকিব এবং বৃহৎ শক্তিসমূহের সঙ্গে আমাদের সরকার ঘনিষ্ঠতর বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা চালাইয়া যাইবে।

ইসরাইলের কবল হইতে পবিত্র আরবভূমি পুনরুদ্ধানের জন্য এবং আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম ও ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি আমরা আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রাখিব।

পরিশেষে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়ন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমূহ সমাধানে আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করি। ইনশাআল্লাহ, আমরা সফলকাম হইব।

খোদা হাফেজ,

বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।”

খালেদ মোশাররফের পদোন্নতি ও জিয়ার পদত্যাগ

৪ঠা নভেম্বর (১৯৭৫) প্রেসিডেন্টের এক বিশেষ ঘোষণায় বলা হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম পি এস পি-কে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর পূর্বাহ্ন হইতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করিয়া চীফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ করা হইয়াছে। একই দিনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম পিএসসি পদত্যাগ করায় তিনি তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইয়াছেন।

৩রা নভেম্বর অভ্যুত্থানের নায়ক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক আটক সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা হইতে ৭ই নভেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত হইয়া পুনরায় সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

জিয়ার পদত্যাগের আদেশ বাতিল

এতদ্বারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বি.ইউ, পি.এস.সি-এর পদত্যাগ গ্রহণ সম্পর্কিত ৩রা নভেম্বর (১৯৭৫)-এর আদেশটি বাতিল করা হইল। শুক্রবার ঢাকায় সরকারিভাবে এই ঘোষণা করা হয়। ফলশ্রুতিতে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বি.ইউ.পি.এস.সি-এর চীফ অব আর্মি স্টাফ হিসাবে নিয়োগ এবং তাহার মেজর জেনারেল হিসাবে উন্নীত হওয়া সংক্রান্ত আদেশটিও বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে। ৩রা নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক নিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পুনরায় ৭ই নভেম্বর সফল সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের পরও রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত রহিলেন।

৭ই নভেম্বরে জিয়ার ভাষণ

নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে ঘোষণা করিয়া ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ ইং ভোরে রেডিও বাংলাদেশ হইতে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেন :

“প্রিয় দেশবাসী- আসসালামু আলাইকুম- আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলিতেছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমান বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার এবং অন্যান্যের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চীফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সেনা বাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে হইয়াছে। এই দায়িত্ব ইনশাল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।

আপনারা সকলে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন।

দেশের সর্বত্র অফিস-আদালত, যানবাহন, বিমানবন্দর, মিল-কালখানাগুলি পূর্ণভাবে চালু থাকিবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হউন।

খোদা হাফেজ,

বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।

* বলা দরকার ৭ই নভেম্বর এর সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেনা সদস্যরা তাঁকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করেন। তিনি বেতার ভাষণে নিজেই নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। তখনো আবু সাদত মোঃ সায়েম দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। একই দিনে প্রেসিডেন্ট সায়েম জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান এবং উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজেকে দেশের সরকার প্রধান হিসেবে উল্লেখ করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই জিয়াউর রহমানই পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিতব্য দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন এবং তাঁর মনের গহনে লালিত দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন।

৭ই নভেম্বরে মোশতাকের ভাষণ

প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা,

আসসালামু আলাইকুম।

আজ বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর বীর সৈনিকরা, বিডিআর, পুলিশ ও আনসার বাহনীর বীর সদস্যরা, জনসাধারণ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুবক সকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য যে অভূতপূর্ব বিপ্লব সংঘটিত করেছেন তা দেখে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় আমার চিত্ত আজ আবেগআপ্লুত এবং এই বীরদের প্রতি আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানাই। একমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার অনন্ত ঐশী শক্তির সফল প্রয়োগের মাধ্যমেই এই বিপ্লবের ইতিহাস রচনা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার কাছে আমি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে শুকরিয়া আদায় করি। আজকের বিপ্লবের সকল নায়কদের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করি।

এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর কাছ থেকে আমি ও আমার স্বল্পকালীন সরকার অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট থেকে ২রা নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যমান সরকার যে সহানুভূতি পেয়েছে, মানুষ হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধ প্রচষ্টার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে এর চাইতে বেশি কিছু দাবি আমার নেই। আমাদের সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য আপনাদের সবার প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।

গত ২রা নভেম্বর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি দেশে বিদ্যমান সে সম্পর্কে আপনারা ওয়াকিফহাল আছেন। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি আলোচনা করিতে চাই না। কারণ, এই পরিস্থিতি আজকের বিপ্লবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত রচনা করেছে। এবং সকলের সঙ্গে জাতীয় সত্ত্বাকে আপন মহিমায় বিধৃত করেছে। জাতীয় সত্ত্বার এই মহিমাকে কর্মে প্রয়োগের মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন শক্তিকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠন এবং সমাজকে কলুষমুক্ত করাই এই মুহূর্তের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে যেমনি জনগণের মধ্যে মতৈক্য থাকা উচিত, তেমনি জনগণ নির্ধিধায় গ্রহণ করিতে পারে সরকারের গঠনপদ্ধতি এমনি হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য আমার কাছে স্বতঃস্ফূর্ত দাবি আসা অব্যাহত রয়েছে। আপনাদের প্রাণঢালা ভালোবাসা ও বিশ্বাসের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে আজ এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন যিনি হবেন সম্পূর্ণ নির্দলীয় এবং অরাজনৈতিক। এইসব শর্তাদি পালনের জন্য দেশের প্রধান বিচারপতি বর্তমানে যেভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আছেন তাই শোভন ও সুন্দর বলে আমি মনে করি। বিচারকের বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতা দিয়ে তিনি জাতিকে তার নির্ধারিত কক্ষপথে পরিচালিত করিতে পারবেন আশা করাটা নিঃসন্দেহে অপ্রত্যাশা নয়। তাই আমি আজ তাঁকে এই জাতীয় দায়িত্ব পালন করিতে অনুরোধ জ্ঞাপন করেছি।

যে দায়িত্ব মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে দিয়েছিলেন, সে দায়িত্বের পরিমণ্ডল আমি অতিক্রম করেছি। তথাপি দেশের নগণ্য সেবক হিসেবে আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি। কর্মী হিসেবে যেখানেই প্রয়োজন থাকবে ইনশাআল্লাহ আমি নিশ্চয় কর্মের মাধ্যমে সেখানে দেশবাসীর সঙ্গে উপস্থিত থাকবো। দেশবাসীর দোয়া ও আল্লাহর রহমত ছাড়া আমার আর কিছুই কাম্য নেই।

আমার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর সংকটকালীন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পরিসমাপ্ত হয়েছে। দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী এই কর্মবীর যা করেছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা,

আমাদের দেশ ছোট কিন্তু জাতি বড়। এর প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে হায়েনার আক্রমণ থেকে রক্ষা করিতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তি ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায়। আবার এর প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করিতে হইবে। কলে-কারখানায় পেশী নিংড়ানো শ্রমে সর্বাপেক্ষা বেশি উৎপাদনও করিতে হইবে। অতঃপর পরস্পরকে সুখী ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টায় সকলকে এক জাতীয় মহাপ্রয়াসে নিয়োজিত হইতে হবে নিবেদিত চিত্তে।

আজকের বিপ্লবে যেভাবে প্রতিজন সিপাহী এবং নাগরিক সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি সামনের প্রতিটি দিনেই আপনাদের সচেতনতাকে চির সজীব রাখতে হইবে।

পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন।

খোদা হাফেজ,

বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।

৭ই নভেম্বরে সায়েমের ভাষণ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা,

আসসালামু আলাইকুম।

গতরাতে আপনাদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে কি পরিস্থিতিতে আমাকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে হয়েছে, তার কিছুটা আভাস আমি দিয়েছি। প্রেসিডেন্টের পদে খন্দকার মোশতাক আহমেদের পুনর্বহাল হওয়ার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত দাবি সত্ত্বেও তাঁরই অনুরোধক্রমে আমি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছি। খন্দকার মোশতাক আহমেদের দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা যে কোন উন্নয়নশীল দেশে বিরল এবং সেই দেশের জনগণের জন্য গর্বের বিষয়।

আমার গতরাতের ভাষণে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং সরকার পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে আমি কিছুটা আলোকপাত করেছি। দেশে আইনের শাসন, নিরপেক্ষ প্রশাসন এবং অবাধ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা সম্পর্কেও আমি গতরাতে আপনাদের অবহিত করেছি।

গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রচেষ্টার সাথে সাথে আমাদেরকে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার কার্যক্রম আরও জোরদার করিতে হইবে। কেননা, আমাদের জনগণের দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের আর কোন পথ নেই। এ জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, শৃঙ্খলার সাথে কঠোর পরিশ্রম করা, কলে কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং একই সাথে অধিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানির মাধ্যমে অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এভাবেই আমরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম

হব।

সুখী এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে আমাদের সর্বশ্রেণির জনগণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এ উদ্দেশ্যে যথাযথ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের ছাত্র এবং যুব সমাজকে গঠনমূলক কর্মোদ্যমে অনুপ্রাণিত করিতে হবে এবং তাহাদের সৃজনী প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য আমরা কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ কবে। প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দেশে সামরিক আইন প্রশাসন কাঠামো গঠন করা হয়েছে।

এই কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট স্বয়ং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন। এতে তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকবেন। তাঁরা হচ্ছেন, সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, সেনাবাহিনীর প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব। দেশের চারটি বিভাগে চারজন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক থাকবেন।

জননেতাদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হইবে। এই পরিষদ, জনগণের আশা-আকাক্ষা সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করবেন এবং পরামর্শ দিবেন।

সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বেসামরিক কর্মকর্তাদের উপর ন্যস্ত থাকবে।

আমি ঘোষণা করছি যে, শুধু রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে যে সব জননেতা আটক আছেন, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হইবে।

পরিশেষে আমি আশা করব যে, নতুন কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা সততা ও আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে যাবো, বর্তমান সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করব। শুধু এর মাধ্যমেই ন্যূনতম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা বাঞ্ছিত অগ্রগতি সাধনে সফলকাম হইতে পারি।

আপনাদের সার্বিক সহযোগিতায় ইনশাল্লাহ আমরা অচিরেই আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছুতে সক্ষম হবো বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

খোদা হাফেজ,

বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।

রাষ্ট্রপতি সায়েমের ৮ই নভেম্বর ‘৭৫ ঘোষণা (Proclamation)

GOVERNMENT OF THE PEOPLES REPUBLIC OF BANGLADESH MINISTRY OF LAW, PARLIAMENTARY AFFAIRS AND JUSTICE

(Law and Parliamentary Affairs Division).

Notification Dacca, the 8th November 1975

No. 774-Law. The following Proclamation made by the President of the People’s Republic of Bangladesh, on the 8th November, 1975 is hereby published for general information:

PRESIDENT’S SECRETARIAT PROCLAMATION

The 8th November, 1975

Where as the whole of Bangladesh has been under Martial Law since the 15th day of August, 1975; AND WHEREAS Khandaker Moshtaque Ahmed. Who placed the country under Martial Law, has made over the office of President of Bangladesh to me and I have entered upon that Office of 6th day of November, 1975.

AND WHEREAS in the interest of peace order security, progress.prosperity and development of the country. I deem it necessary to keep in force the Martial law proclaimed on the 15th August, 1975; AND WHEREAS for the effective enforcement of Martial Law it has become necessary for me to assume the powers of Chief Martial Law Administrator and to appoint Deputy Chief Martial Law Administrators and to make some modifications in the proclamation of the 20th August, 1975:

NOW, THEREFORE, I, Mr. Justice Abu Sadat Mohammad Sayem, President of Bangladesh, do hereby assume the power of Chief Martial Law Administrator and appoint the Chief of Army Staff Major General Ziaur Rahman B.U. Psc;… as Deputy Chief Martial Law Administrator and declare that-

(c) Parliament shall stand dissolved and be deemed to be so dissolved with effect from the 6th day of November, 1975 and general elections of Members of Parliament shall be held before the end of February, 1977;

(d) The persons holding office as Vice-President, Speaker, Deputy Speaker, Ministers, Ministers of State, Deputy Ministers and Whips, immediately before this Proclamation, shall be deemed to have ceased to hold office with effect from the 6th day of November, 1975.

A. M. SAYEM

President

AND

Chief Martial Law Administrator

জাসদের হঠকারিতা

১৯৭২ সালের ৩০শে অক্টোবর জেনারেল ওভানের প্ররোচণায় গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নাকি ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনীর একাংশের সহিত সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল বিধায় সামরিক বাহিনীর সহিত অভ্যুত্থানে জড়িত অতি উৎসাহী কয়েকজন ট্যাঙ্কসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আ স ম আবদুর রবসহ জাসদ নেতৃবৃন্দকে ৮ই নভেম্বর কারামুক্ত করে। তাহাদের এই হঠকারী অতি বিপ্লবী ভূমিকার কারণে জনমনে ভীতি সঞ্চার হয়। বাধ্য হইয়া সরকার ২৩শে নভেম্বর (১৯৭৫) জাসদের মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং কর্নেল তাহেরসহ নেতৃবৃন্দকে পুনঃগ্রেফতার করে ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখে। ইহার পাল্টা জবাবে জাসদ প্রেরিত এক সশস্ত্র স্কোয়াড বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে ভারতীয় হাই কমিশন অফিস প্রাঙ্গণ থেকে অপহরণ করার (Kidnap) এক দুঃসাহসিক ব্যর্থ প্রচেষ্টা নেয়।

আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করিয়া একটি বিবৃতি প্রদান করি। পত্রিকায় প্রকাশিত বিবৃতিটি নিম্নে দেওয়া হইল :

“ভারতীয় হাই কমিশনার মিঃ সমর সেন যে ঘটনায় শরীরে আঘাত পাইয়াছেন, ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনে আজ সকালে সংঘটিত উক্ত ঘটনা সম্পর্কে জানিতে পারিয়া আমরা মর্মাহত হয়েছি।”

“আমরা একদল লোকের এহেন কাপুরুষোচিত ও জঘন্য অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা করিতেছি। ঘটনাটি দৃশ্যতঃ রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির পরিচায়ক এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইহা করা হয়েছে।”

“ভারতীয় হাই কমিশনারের উপর পরিচালিত আক্রমণ প্রতিহত করিবার ক্ষেত্রে কর্তব্যরত বাংলাদেশ পুলিশ ও রক্ষীদের উপযুক্ত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আমরা প্রশংসা করি।”

“আমরা আশা করি যে, সরকার কর্তৃক গৃহীত আশু কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট সকল মহল কর্তৃক প্রশংসিত হইবে।

উপরোক্ত যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সর্বজনাব আতাউর রহমান খান, তোফাজ্জল আলী, ডঃ আলিম-আল-রাজি, মশিউর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, আসাদুজ্জামান খান, কাজী জাফর আহমদ, অলি আহাদ ও রাশেদ খান মেনন। (ইত্তেফাক ২৭/১১/৭৫)

১৫ আগস্ট দুঃসাহসিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সূর্যসেনারা ভারতীয় নাগপাশ হইতে মুক্ত হওয়ার স্বর্ণদ্বার খুলিয়া দিয়াছিল তাহারা ৩রা ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানের কারণে অধিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষ হইতে একই পারিতোষিক পেয়েছে- ভিনদেশ লিবিয়ায় নির্বাসন জীবনযাপন। কি অদ্ভুত ভাগ্যের লিখন! কি অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা জ্ঞান!

জেল হত্যা

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করিতে হয় যে, ১৫ আগস্ট এর বিপ্লবী পট-পরিবর্তনের পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রী কামরুজ্জামানসহ অন্যান্যকে গ্রেফতার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। পরিতাপের বিষয় ১৯৭৫ সালের ২রা ও ৩রা নভেম্বর মধ্যবর্তী রাতে কারাগারে নৃশংসভাবে উপরোক্ত চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ইহা সুস্থ ব্যক্তির কল্পনার অতীত- বিপ্লবী সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতারের পর পুলিশ প্রহরাধীন আটক থাকাকালে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়- এই ধরনের হত্যাকান্ড হিটলারের জার্মানিতে ও স্ট্যালিনের রাশিয়ার অহরহ হইয়াছে- সভ্য সমাজে যা চিন্তা করা যায় না।

মোশতাকের নেতৃত্ব

আমরা বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে দিল্লীর দাসত্ব মোচনের দাবিতে সমগ্র দেশে ‘আজাদ বাংলা’ আন্দোলনের সূচনা করিয়াছিলাম এবং সর্বপ্রকার প্রতিকূলতার মোকাবেলায় জেল, জুলুম, দৈহিক অত্যাচার ও প্রাণনাশের হুমকিকে তোয়াক্কা না করিয়া আজাদ বাংলা আন্দোলনকে শক্তিশালী করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ দিল্লীর দাসত্ব মোচনের যে বলিষ্ঠ ও দৃঢ়তাব্যঞ্জক অভিমত ব্যক্ত করিয়াছিলেন, তাহা আজাদ বাংলা আন্দোলনের মর্মবাণী হইতে মোটেও পৃথক নয়।

উল্লেখ্য যে, খন্দকার মোশতাকের এই দৃঢ়তা দিল্লীর মসনদে অধিষ্ঠিত শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সকল কারসাজিকেও ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে। শুধু তাই নয়, তাঁহার নেতৃত্বে ঐক্য ও ঈমানের মন্ত্রে দীক্ষিত ৭ কোটি বঙ্গ সন্তান অত্যন্ত শৃংখলার সহিত জাতীয় জীবনের সকল অমূলক, অকল্যাণ ও অশুভ প্রভাব-প্রতিপত্তিকে মুছিয়া ফেলিতে সচেষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। জাতীয় জীবনের আভ্যন্তরীণ এই কল্যাণ প্রয়াস বহির্বিশ্বেও সমভাবে অভিনন্দিত হইয়াছে। ইহার প্রত্যক্ষ সুফল, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনবহুল ও তৃতীয় বিশ্বশক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ৩০শে আগস্ট (১৯৭৫) তাহার বার্তায় বলিয়াছিলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের পক্ষ থেকে সসম্মানে আপনাকে জানাইতেছি যে, চীন সরকার আজ হইতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেছে আমি নিশ্চিত যে, আমাদের দুই দেশের জনগণের চিরাচরিত বন্ধুত্ব দৃঢ়ভাবে বৃদ্ধি পাবে

উল্লেখ্য যে, চীনের অভিযোগ ছিল, শেখ মুজিব এবং তাহার সরকার দিল্লীর পুতুলমাত্র এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। তাই মুজিব আমলে অনবরত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নাই। এইদিকে আরব জাহানের তথা মুসলিম জাহানের মধ্যমণি সৌদি আরব একই কারণে দিল্লীর দাস মুজিব সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাইয়া আসিতেছিল। কিন্তু খন্দকার মোশতাক আহমদ দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই ১৬ আগস্ট সৌদি আরবের বাদশাহ খালেদ বাংলাদেশকে কেবল স্বীকৃতিই দেন নাই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সৌদি আরবের পক্ষ হইতে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানেরও আশ্বাস দেন। স্বল্পতম সময়ের জন্য হইলেও খন্দকার মোশতাক আহমদের ঐ দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশকে দিল্লীর দাসত্ব শৃংখল হইতে মুক্ত করিবার ব্যাপারে তাহার আন্তরিক ও বলিষ্ঠ প্রচেষ্টা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে।

একগুচ্ছ ঐতিহাসিক চিঠি

[রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রচুর সংখ্যক চিঠি গ্রন্থাগারের হেফাজতে রহিয়াছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব হিসাবে যাহার মূল্য অনেক। সেই সকল চিঠির সামান্য কিছু সংকলিত হইলো। স্থানাভাবে সকল চিঠি মুদ্রণ সম্ভব হইলো না।]

টাওয়ার হোটেল

কলিকাতা

৩/৪/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ

তুমি আমার পত্র পাওয়ার পর সমস্ত জেলা, মহকুমা আওয়ামী লীগ অফিসে সার্কুলার দিয়া এই মর্মে জানাইয়া দিবে। ১। প্রত্যেক ইউনিয়নে কর্মঠ, নিঃস্বার্থ লোক লইয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ গঠন করিবে। ২। প্রত্যেক থানায় সভা সমিতি করিয়া সরকারের নিকট নিম্নলিখিত মর্মে দাবি জানাইবে। লাহোর ঐতিহাসিক প্রস্তাব অনুযায়ী প্রত্যেক ইউনিটে ফুল অটোনমী চাই। ২১ দফা দাবি নতুন শাসনতন্ত্রে সম্পূর্ণভাবে মানিয়া লইতে হইবে। সমস্ত রাজবন্দিদিগকে মুক্তি দিতে হইবে। কোন প্রকার টাল বাহানা না করিয়া সত্বর পূর্ব পাকিস্তানে পার্লামেন্টারি শাসন কায়েম করিতে হইবে। ২০ বৎসরের সময় ধার্য না করিয়া নূতন শাসনতন্ত্র কায়েম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উর্দুর সহিত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিতে হইবে।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

কলিকাতা

৩/৪/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ

আমার প্রেরিত ২১ দফা প্রত্যেক পল্লীতে কৃষক শ্রমিক সকলের নিকট যাহাতে পৌঁছিতে পারে তাহার জন্য আমেনাকে সর্ব প্রকারের সাহায্য করিয়া বুকলেট ইত্যাদি ছাপাইয়া প্রচার করিবার ব্যবস্থা করিবে। আওয়ামী লীগের সর্ব প্রকার সাহায্য ও সমর্থন যাহাতে পায় তার ব্যবস্থা করিবে। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে সমস্ত ছাপান সম্ভব হইবে না। চিটাগাং এর জনৈক আব্দুল বারী পুস্তক ব্যবসায়ীকে অনুমতি দিয়াছি। অন্যান্য জেলায় আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাগণ যদি স্বেচ্ছায় ছাপাইয়া বিক্রয় করে ভাল। অন্যথায় যে কোন লোক বা পুস্তক ব্যবসায়ী ছাপাইয়া বিক্রয় করিতে চায় তাহাকে দেওয়া উচিৎ। ভালভাবে প্রচার না হলে সংগঠন শক্তিশালী হবে না। শান্তিপূর্ণভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আওয়ামী লীগকে জোরদার না করিলে শুধু করাচি গিয়া তোয়াজ, তোষামোদ ফুলের মালা প্রদান করিয়া জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার হবে না। দুনিয়ায় ইতিহাসে কোথাও দেখা যায় নাই দরখাস্ত দিয়া হুজুর বিনীত প্রার্থনা করিয়া গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব হইয়াছে।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

কলিকাতা

১৭/8/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ

আমার দোয়া জানিও। শুধু বড় বড় নেতার কথাই শুনিওনা আমার মত বোকা লোকের কথায়ও কর্ণপাত করিও। ভাঙ্গা কুলা কাজে লাগে ছাই ফেলিবার সময়। আমার ২১ দফাগুলি অন্ততঃ সাপ্তাহিক এত্তেফাকে, সংবাদে ছাপাইতে চেষ্টা করিও। মাছ যে রকম পানিতে মিশিয়া থাকে সেইভাবে জনসাধারণের মধ্যে সেইভাবে নেতা ও কর্মীদিগকে গ্রামে গিয়া কাজ করিতে হইবে। শুধু ঢাকায় বসিয়া কাজ হইবে না। ১১ই ও ১২ই কাউন্সিল সভা অবশ্যই ডাকিবে। প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক অবশ্যই করিতে হইবে সর্বতঃভাবে চেষ্টা করিবে। সমস্ত জেলা মহকুমার কাজ জোর দিয়া আরম্ভ করিবে। আমার নিজের কাজ যদি পার তা হইলে পাঁচবিবিতে লোক পাঠাইয়া আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদিগকে ৫/৬ দিনের জন্য কলিকাতা পাঠাইবে। ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলিবে আমার বিবৃতি ও ২১ দফা বার বার সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে ছাপাইতে। অন্যথা কারণে দুঃখিত হইব।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

বীরনগর পাঁচবিবি

বগুড়া

১৩/৫/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ,

মজিবর ও সেরাজকে পত্র দিয়াছি তোমাকে জানাইতে ২২শে মে হইতে ৩০শে মে পর্যন্ত ২১ দফা পালন করিতে সমস্ত জেলা, মহাকুমা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ অফিসকে জরুরি নির্দেশ দিবে এবং সভা, শোভাযাত্রা, ২১ দফা বই বিতরণ, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, জমিদারী প্রথা বিনা খেসারতে উঠাইয়া চাষীদের মধ্যে জমি বিতরণ চাই, সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল চাই, উচ্চপদের কর্মচারীদের বেতন কমাইয়া গরীব কর্মচারী ও শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি চাই, পূর্ব পাকিস্তানে লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী স্বায়ত্তশাসন চাই ইত্যাদি স্লোগানে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়াজ তুলিতে হইবে। ছাত্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হইতে সমর্থন ও বিবৃতি দেওয়াইবে আমার নামে ও তোমরা বিভিন্ন নামে প্রত্যেক দিন বিবৃতি দিবে।

-মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

সমস্ত আওয়ামী লীগ অফিসে সার্কুলার নোটিশ দিবে কলেরা, বসন্ত রোগে কত মারা গিয়াছে এবং কত গ্রাম আক্রান্ত হইয়াছে তাহার বিবরণ পাঠাইতে।

-ভাসানী

***

কাগমারী

২৯/১২/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ, আবদুল হাই ও

অন্যান্য আওয়ামী লীগের কর্মীগণ,

আমার এই পত্রখানা তার মনে করিয়া সারা পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন মিশ্র নির্বাচন উপলক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ করিবার জন্য আমার নামে তোমাদের নামে প্রত্যেক জেলা, মহকুমা, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের নামে বিভিন্ন জেলা হইতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করিবার জন্য অভিযান চালানোর ব্যবস্থা করিবে। সারা দেশ থেকে স্বায়ত্তশাসন এবং মিশ্র নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন নামের পত্র সংবাদপত্রে ছাপাইতে ব্যবস্থা করিবে। আগামী ৬ জানুয়ারি (১৯৫৬) প্রতিবাদ দিবস সাফল্যমণ্ডিত করিবার জন্য ভালভাবে পারলে মিটিং দিবার ব্যবস্থা করিবে।

সাড়ে চারি কোটি বাংগালীর জীবন মরণ সমস্যার সময় আওয়ামী লীগের সকল রকম চেষ্টা করিতে হইবে। আমি এই অনুরোধ বহু পূর্বেই করিয়াছিলাম। তোমরা কর্ণপাত কর না, এখন শেষ সময় যদি আমার উপদেশ শুনা উচিত মনে কর তাহা হলে সকল রকমের অসুবিধা ভিতরেও এই কাজ অবশ্যই করিবে।

মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

২৯/১২/৫৫

***

প্রিয় অলি আহাদ

বাবুকে শাসাইয়া ভর্তি করিয়া দিবে এবং ভালভাবে পড়াশুনা না করিলে বাবুর সহিত আমার কোন সংশ্রব থাকিবে না ইহা বলিয়া দিবে। মিথ্যা বলা ও ফাকী দেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করিতে বলিবে। বাহুল্য পয়সা খরচ করিতে বিশেষভাবে নিষেধ করিবে। আমার হাতে মোটেই পয়সা নাই মজিবর যদি দেয় এবং মহিবুচ্ছামাদের নিকট হইতে কিছু টাকা লইয়া সত্বর কাগমারীতে পৌঁছাইবে- কর্মীদের খাওয়ার ব্যবস্থা না করিলে চলিবে না।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।

***

প্রিয় অলি আহাদ,

গত রাত্রি হইতে হঠাৎ রক্তের চাপ অত্যধিকরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে। এরূপ অবস্থা আর কখনও হয় নাই। গত রাত্রি ভয়ানক কষ্টে গিয়াছে। অদ্যই যমুনা নদীতে যাইতেছি।

আমার এখানকার কাজকর্ম মোয়াজ্জেম কীভাবে করে তাহা তোমাকে বলিতে চাই। তোমরা ভালভাবে জান যে একটা কাজের জন্য মাহমুদ আলীর নিকট যাইতেছে, তাহার সহিত জানাশুনা নাই। তুমি নিজ দায়িত্বে কাজ নিজের মনে করিয়া মাহমুদ আলীর দ্বারা করা সম্ভব হইলে করিবে। মোয়াজ্জেম কোন ফেভার পাই নাই। আওয়ামী লীগের জন্যই সে যাইতেছে। এখানকার আওয়ামী লীগারদের দ্বারা কোন কাজ হয় নাই, হইবেও না। আপ্রাণ চেষ্টা করিয়া দেখিও তাহার কাজটা যাহাতে হয়।

আগামী ২৬শে মার্চ হইতে হয়ত অনশন আরম্ভ করিব। আল্লাহ হাফেজ।

প্রেস টেলিগ্রাম দিয়াছি। তাং ধার্য্য হয় নাই। এক ইউনিট সম্বন্ধে ২টি বিবৃতি সত্বর দিও। কিন্তু প্রস্তুত করিও জনগণের দাবি আদায়ের জন্য।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

উপনির্বাচনে এলাকায় যাওয়া সম্ভব নহে জানাইয়া দিও।

-ভাসানী

***

ময়মনসিংহ

২০/২/১৯৫৭

প্রিয় অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমদ ও

ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্য সাহেবান,

অদ্য আমি ময়মনসিংহ হইতে নালিতাবাড়ি মিটিং-এ খোদা করেন রওনা হইব। তথা হইতে আগামীকল্য ফিরিব। পরশু জ্বর উঠিয়াছিল গতকল্য জ্বর আসে নাই। আল্লা ভরসা তোমরা আগামী ওয়ার্কিং কমিটিতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টিকে নির্দেশ দিবে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সুপারিশ করতঃ প্রস্তাব আনয়ন করা বিশেষ জরুরি কাজ জানিবে। অপজিশন হইতে প্রস্তাব আসিবে আমাদের পক্ষ হইতে প্রস্তাবের নোটিশ না দিলে বা আনয়ন না করিলে জনসাধারণের নিকট মুখ দেখানো যাইবে না। অপজিশনের প্রস্তাবে বাধ্য হইয়া ভোট দিতে হইবে, বিশেষ জরুরি কাজ মনে করিতে প্রত্যেক মেম্বরকে আমার পক্ষ হইতে অনুরোধ করিবে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে নাজিমউদ্দিন সাহেব প্রস্তাব আনিয়া পূর্ব-পাক এসেম্বলিতে পাস করাইয়াছিল। নুরুল আমিন মন্ত্রী সভা পূর্বপাকের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করিয়া প্রস্তাব পাস করাইয়াছিলেন। এই সময় এবং আগামী নির্বাচনের পূর্বে জরুরি প্রস্তাব পাস না করাইলে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেহায়েত ভুল হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারের লিডারের নিকটও অনুরোধ জানাইবে, উভয় পাকিস্তানের সংহতি কায়েম করিবার জন্য পার্টি মিটিং-এ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করিতে। কাগমারী মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ খোলার পারমিশন চাহিয়া সত্বর দরখাস্ত ইউনিভার্সিটি বরাবর দিবে এবং অল্প দিনের মধ্যে যাহাতে অনুমতি পাওয়া যায় তাহার ব্যবস্থা অবশ্যই করিবে। কলেজের জন্য বিভিন্ন সাবজেক্টে পড়াইতে উপযুক্ত ও আদর্শবাদী জন প্রফেসর সংগ্রহ করিতে তোমরা সকলে চেষ্টা করিবে। ভুলিয়া যাইও না, আমার দোয়া ও সালাম জানিও। আমার শরীর খুব দুর্বল। তাই মিটিং-এ উপস্থিত হইতে পারিব না।

– আব্দুল হামিদ খান

অলি আহাদ, তাজউদ্দিন,

৫৬ নং সিম্পসন রোড, আওয়ামী লীগ অফিস

***

প্রিয় অলি আহাদ

আমার প্রেরিত ২১ দফা যাহা আমেনার কাছে আছে সংবাদে সাপ্তাহিক এক্তেফাকে ছাপাইবে। বুকলেট করিয়া ছাপাইতে পারিলে তাহাও ছাপাইয়া বিতরণ করিবে। অন্যথা না হয়। মজিবরকে পত্র দিয়াছি। ১১ই ১২ই জুন অবশ্যই পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভা ডাকিবে অন্যথা না হয়। করাচির লোভ একবারে ত্যাগ না করিলে আওয়ামী লীগ বাঁচিবে না। করাচি কিছুই করিবে না। আমি করাচির আশা কোনদিন করি নাই। আল্লাহর মর্জি কখনও করিব না। তোমরা মিটিং না ডাকিলে আমি নিজেই ডাকিব। এইবার আমার কথানুযায়ী মিটিং না ডাকিলে ও কাজ না করিলে তোমাদের সহিত সংশ্রব ত্যাগ করিতে বাধ্য হইব। করাচিতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া এবং মন্ত্রী হইবার লোভে আওয়ামী লীগ ধ্বংশ হইল। আর ধ্বংশ হইতে দিতে পারি না।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

প্রিয় অলি আহাদ

আজ পর্যন্ত কাউন্সিলারদের নোটিশ সর্বত্র পৌঁছে নাই। ময়মনসিংহ আসে নাই। সত্বর পাঠাইবে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র মেম্বরদিগের রশিদ যত বেশি সম্ভব ছাপাইয়া কাউন্সিল মিটিং এর এক সপ্তাহ পূর্বে সব আমার নিকট পাঠাইবে অন্যথা করিও না। যদি পয়সার অভাবে ছাপাইতে না পার গঠনতন্ত্রের একখানা কপি পাঠাইয়া দিবে। আমি টাঙ্গাইল হইতে কোন প্রকারে বাকী করিয়া ছাপাইয়া লইব। রশিদ বহি যত বেশি পার ছাপাইয়া আনিবে। কাউন্সিল ও কালচারাল কনফারেন্সের প্রচার খুব কম হইতেছে। ভালভাবে প্রচার করিবে। আবু জাফরকে আমার সহিত এড্রেসের নকলসহ সত্বর সাক্ষাৎ করিতে পাঠাইবে। সমস্ত প্রদেশের প্রচার ভালভাবে করিবে। কাউন্সিলের নোটিশ পাঠাইতে বিলম্ব করিলে ভয়ানক অসুবিধা হইবে। আওয়ামী লীগের- ১লা ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে লইয়া উপস্থিত হইবে। অন্যথা না হয়। ছামাদকে সত্বর পাঠাইবে। শ্রমিকদের অবস্থা ও প্রতিকারের রিপোর্ট ছাপাইতে বলিবে।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

প্রিয় অলি আহাদ

আজ কয়েকদিন যাবৎ অনবরত বৃষ্টি ও তুফান হওয়ায় সিরাজগঞ্জ, পূর্ব বগুড়ায় যাওয়া মোটেই সম্ভব হচ্ছে না। এখানে অনেকদিন অনুপস্থিত থাকায় প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম বন্ধ হইয়াছে। আমার শরীর খুব দুর্বল। আল্লাহ জানেন, শরীর ভালো হইবে কতদিনে। আওয়ামী লীগের কাজ তোমরা মনোযোগ দিয়া করিও, আমাকে বোধহয় ৬ মাসের জন্য সভাপতির পদ হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া বিশ্রাম লইতে হইবে এবং শেষ জীবনের প্রতিষ্ঠান গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করিতে হইবে। এখানে কাজকর্ম করিবার লোক মোটেই নাই এবং যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন, দেশের আর্থিক অবস্থা ভয়ানক খারাপ, স্থানীয় লোকের পক্ষে কোনপ্রকার সাহায্য করা সম্ভব নহে। শরীর ভালো হইলে দুই মাসের জন্য আসামে যাইবার আশা আছে। তুমি আমার জন্য যে ভাবেই পার ১০টি লিচুর কলম, ১০টি আমের কলম এবং সোফেদার কলম ৫টা, ভালো লেবুর কলম ৫টা পাঠাইলে যারপরনাই উপকৃত হইব। ঢাকা হইতে হাতেম অথবা রফিক ভূঁইয়ার নিকট ময়মনসিংহ ঠিকানায় পাঠাইলে তাহারা জি টি কোং মোটরে টাংগাইলে পাঠাইয়া দিবে। পাঠাইবার সময় লিখিয়া দিতে হইবে যে, চারাগুলি যেন কাগমারীতে পৌঁছাইয়া দিতে জি, টি, কোং ড্রাইভারকে বলে। আন্দোলনের গতি বারবার ভাটা ফেলিয়া হতাশার ভাব আর কতকাল থাকিবে জানি না। সারা দেশময় ভূখা মিছিল, সভা সমিতি নতুন উদ্যমে যখন চলিতেছিল তখন হঠাৎ তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল। ১৪৪ ধারা ব্রেক করিবার মত সাহসী ২/৪ শত কর্মী নেতা যে অর্গানাইজেশনে নাই তাহার দ্বারা ভবিষ্যতের আশা বৃথা। এখন বুঝিতেছি সকলেই কেবল গদির জন্যই ব্যস্ত।

খোদা হাফেজ

মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী

আমাদের ট্রেজারারকে বলিলে কিছু আনারসের চারা আনিয়া দিবে। কৃষি কর্ম করিতে অনেক কিছু লাগে, বিরক্ত হইবা না। বহু কৃষককে শিক্ষা দেওয়া যাইবে। গঠনমূলক কাজও করা দরকার।

– ভাসানী

ভালো আনারসের চারা সামাদকে বলিলেও সিলেট হইতে আনিয়া দিবে। ঢাকায় যাহা পাওয়া যায় তাহাই দিবে।

***

Narayanganj City Awami League

President-A.K.M. Shamsuzzoha

Secretary-Nurul Islam Mullick

Office…………..

NARAYANGANJ

Date……………

প্রিয়,

আতাউর রহমান খাঁন, মুজিবুর রহমান

উপ নির্বাচনের সমস্যা বড় জটিল হইল। এই নির্বাচনে সীট হারাইলে যারপরনাই ক্ষতি হইবে। অতএব সত্ত্বর মহকুমা আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাগণকে জানাবেন সংবাদপত্রে নোটিশ ও তার দিয়া নমিনেশন পেপার পুঃ পাক আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠাতে মহকুমা আওয়ামী লীগ সোপারেশ করিয়া জেলা আওয়ামী লীগের জরিয়তে পুঃ আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠাবে। মজিবর, ইয়ার মোহাম্মদ, অলি আহাদ এই তিনজন বাই ইলেকশনের এলাকায় সর্ট টাইমের মধ্যে ভ্রমণ করিয়া জনমত লইবে জনপ্রিয় প্রার্থী হওয়া একান্ত আবশ্যক। ২৫০, টাকা অথবা যাহা তোমরা সঙ্গত মনে কর সেই পরিমাণ টাকা জমা দিতে বলিবে গোপালগঞ্জে হিন্দু প্রার্থী ঠিক করিবে। ইলেকশনের প্রোপাগাণ্ডা ইত্যাদি কাজের জন্য ২/৩টি কমিটি করিবে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ডাকিবে। ইলেকশনের বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিবে। অবহেলা করিবে না। সিট হারালে অনুতাপ করিতে হবে- আল্লাহর উপর ভরসা করিয়া সর্বোতভাবে চেষ্টা করিবে। সহিদ সাহেব তার করিয়া জানাইবে। যাহা কিছু করা দরকার সমস্তই করিবে অঙ্গিকার পত্র ছাপাইবে।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

৩০/৪/৫৬

***

৩১-১২-৫৭

প্রিয় অলি আহাদ                                                                                                                  

তোমার নিকট বারবার পত্র লিখিয়াও কোন উত্তর পাই নাই। তুমি আমার নেহায়েত ভক্ত থাকা সত্ত্বেও কেন বিরূপ হইলে জানি না। খোদা হাফেজ। মফিজুল ইসলাম খুব ভাল প্রার্থী। কিন্তু অর্থ এবং সমস্ত ন্যাপ প্রতিষ্ঠানের শক্তি একযোগে ঝাঁপাইয়া পড়ে তাহা হইলে আমি তিন চারিটা মিটিং করিয়া দিব। আমার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়া যতদূর করা সম্ভব করিব। কিন্তু সমস্ত প্রদেশের শক্তি ব্যতীত কিছু সম্ভব হইবে না। খুব ভালভাবে চিন্তা করিয়া কাজ করিবে। এখানে আসিলে সুখী হইব।

-ভাসানী

***

জনাব মাওলানা সাহেব,

তসলিম বাদ আরজ- আশা করি শারীরিক কুশলে আছেন। আব্দুর রহমান ও হামিদ, হক সাহেবের পত্র নিয়া আপনার খেদমতে যাইতেছে। আমার সঙ্গে হক সাহেবের আলোচনা হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র বিবচেনায় আপনার এখানে তশরিফ আনা অত্যাবশ্যক।

আমরা আগ্রহের সহিত আপনার এন্তেজার করিতেছি।

ইতি,

আরজ গোজার

আবুল মনসুর আহমদ

***

গভর্নর শাসন প্রবর্তনের পর আত্মগোপন করি। কুমিল্লায় আত্মগোপন থাকাকালে জনাব আতাউর রহমান খান নিম্নোক্ত চিঠি লিখেন :

আতাউর রহমান খান, এডভোকেট                                                                        ফোন নং ৩৯৮৪

সদস্য, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ                                                                                 ২৫, সোয়ারীঘাট, ঢাকা

তারিখঃ ১৯-৯-৫৪

প্রিয় অলি আহাদ

আমরা ভয়ংকর বৈরী পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হইয়াছি এবং আল্লাহই কেবল জানেন, এই জটিলতা হইতে আমরা কখন মুক্ত হইব। আমাদের কর্মীরা যে নির্যাতন স্বীকার করিতেছে তাহা আমাদের সংগঠনের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করিয়াছে। কেবল নির্যাতনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করিতে এবং ইন্সিত আদর্শ বাস্তবায়ন করিতে পারিব। তোমার নাম লিষ্টে আছে কিনা বলিতে পারিব না। কারণ আমি গেজেট দেখিতে পারি নাই। আগামীকাল দেখিয়া নিব।

সহসা পার্লামেন্টারি সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইবে না, অন্ততঃ শহীদ সাহেবের ফিরা পর্যন্ত নয়। ইহার জন্য আমরা কঠিন প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইতেছি।

যদি তোমার নাম লিষ্টে দেখি তাহা হইলে আমার উপদেশ হইবে আত্মসমর্পণ করা।

অন্যরা সব ভাল। স্নেহ এবং তোমাকে প্রয়োজনীয় সাহস প্রদানের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনাসহ

তোমারই

স্বাক্ষর/ আতাউর রহমান

***

তারিখঃ ১-১০-৫৪

প্রিয় আহাদ,

তোমার চিঠি পাইয়া আনন্দিত হইয়াছি। ইহা দুর্ভাগ্যজনক যে, আমরা তোমার সম্পর্কে প্রকৃত পরিস্থিতি নিরূপণ করিতে পারি নাই। হয়ত শুনিয়াছ যে, কে এম মোশতাক তাহার গ্রামের বাড়ি হইতে গ্রেফতার হইয়াছে। সে এখানে নিরাপদ ছিল এবং ঢাকার বাহিরে না গেলে নিরাপদই থাকিত। এম এ সামাদও উদ্বেগের মধ্যে আছে। আগামী দিনে কি আসিতেছে সেটা অজানা।

আমি মাওলানা সাহেবকে (মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী) ফিরিয়া আসার জন্য অনুরোধ করিয়াছি- পরিণতি যাহাই হউক। এ সময়ে তাহার বাহিরে থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।

জি, জি-এর (গভর্নর জেনারেল) ক্ষমতাকে দারুণভাবে খর্ব করা হইয়াছে। ফলে গণপরিষদ এখন সব অবৈধ আইনকে বৈধ করিতে পারিবে এবং গণতন্ত্রের নামে সবরকম অগণতান্ত্রিক কাজ করিতে পারিবে। সুতরাং তুমি আমাদের প্রিয় পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আঁচ করিতে পার।

আমি মানকীর শরীফের পীর সাহেবের সিদ্ধান্তকে কোন গুরুত্ব দেই না। তবে শুনিতেছি তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিয়াছেন।

বর্তমান পরিস্তিতি বুঝার জন্য মানিক মিয়া ও রফিক করাচি গিয়াছেন।

আমাদেরকে অপেক্ষা করিতে হইবে, দেখা যাক কি হয়।

সবার প্রতি শুভেচ্ছাসহ

তোমারই

স্বাক্ষর/ আতাউর রহমান খান।

***

গ্রন্থাকারের নিকট করাচি হইতে শেখ মুজিবের চিঠি :

(বঙ্গানুবাদ)

৭, সমারসেট হাউস

করাচি

৪ জানুয়ারি, ১৯৫৬

প্রিয় অলি আহাদ,

তোমার চিঠি পাইয়াছি। আমি জানি, ওয়ার্কিং কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠানের জন্য তুমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমরা এখনও সংবিধানের খসড়া পাই নাই যদিও জানা গিয়াছে যে, কোয়ালিশন পার্টি মোটামুটি একটি ফর্মূলায় সম্মত হইয়াছে; ইহাও জানা গিয়াছে যে, ইউ.এফ (যুক্তফ্রন্ট) পূর্ববঙ্গের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। খসড়াটি পাইলে হয় আমি ইহা নিয়া আসিব আর যদি না আসিতে পারি তাহা হইলে তোমার কাছে পাঠাইয়া দিব এবং ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করিবার জন্য তোমাকে অথারাইজ করিব। গণপরিষদে আমরা কি অবস্থান (স্ট্যান্ড) নিব সে ব্যাপারে ফিরিয়া আসিয়া তোমার ও মাওলানা সাহেবের সহিত আলোচনা করিবার জন্য আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। সম্ভবতঃ তুমি ৮ শত টাকা পাইয়াছ। আমি আওয়ামী লীগের জন্য আরও টাকা যোগাড় করিবার চেষ্টা করিতেছি। দয়া করিয়া পূর্ববঙ্গের অবস্থা এবং জেলে আটক আমাদের কর্মী সম্পর্কে আমাকে জানাইবে। জনাব আবদুস সামাদ ও আমাদের অন্যান্য কর্মীদের মুক্তির ব্যাপারে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করিবার চেষ্টা করিবে। আমি জানি, তুমি অত্যন্ত নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছ। কারণ তোমার কাজের ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য সহযোগিতা করিবার মতো লোক খুব কম। দয়া করিয়া মহকুমা কমিটিগুলির সাথে যোগাযোগ করিবার চেষ্টা করিবে এবং আমাকে তোমার অসুবিধা সম্পর্কে জানাইবে।

হাই কোথায়? তাহাকে আমার কাছে চিঠি লিখিতে বলিবে এবং তাহার বাড়ির ঠিকানা দিবে। তার স্ত্রী কোথায়? তোমাকে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটু অনুরোধ করিতে চাই। আমার ছেলে কামাল উদ্দীনকে সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট স্কুলে এবং মেয়েকে (হাসিনা) কামরুন্নেছা গার্লস স্কুল অথবা বাংলাবাজার স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য দয়া করিয়া চেষ্টা করিবা। তাহাদের জন্য একজন ভাল শিক্ষক যোগাড় করিবার চেষ্টা করিবা। সব সময়েই তোমার ভাবীর সহিত যোগাযোগ রাখিবার চেষ্টা করিবা। সেও খুব নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছে। আমি ভালো। আমার কাছে চিঠি দিও।

তোমারই

স্বাক্ষর/ মুজিব ভাই

***

 (বঙ্গানুবাদ)

সমারসেট হাউস

করাচি

২৭শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬

প্রিয় অলি আহাদ,

তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আশা করি, গণপরিষদ হইতে আমাদের ‘ওয়াক আউট’-এর পর ২রা মার্চ ঢাকায় ফিরিব।

তোমার অসুবিধা সম্পর্কে আমি পুরাপুরি জানি ও অনুভব করি। আমাদের সংগঠনের কিছু টাকা সংগ্রহ করিবার জন্য আমি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করিতেছি।

৩রা ও ৪ঠা মার্চের প্রস্তাবিত সভা তুমি বাতিল করিয়াছ জানিয়া আমি খুশী হইয়াছি। কারণ তুমি জান যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া এমন একটি বিরাট সভা অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। অবশ্যই একটি কাউন্সিল সভা করা আমাদের দরকার। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পরই আমরা সভার সময় ও তারিখ ঘোষণা করিব।

তুমি আমাদের সংগঠনের জন্য অত্যন্ত উদ্যমের সাথে ও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করিতেছ জানিয়া আমি অত্যন্ত সুখী। এখানে আমরা গণপরিষদে আমাদের সংগ্রামের ব্যাপারে ব্যস্ত। কারণ, আমরা জানি যে, আসন্ন সংগ্রামের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকিতে হইবে। শহীদ সাহেব ছাড়া আমাদের পার্টি ভুক্ত সব সদস্যই সম্ভবতঃ ২রা ও ৩রা মার্চ অথবা কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় পৌঁছিবে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় খবর তোমাকে দিব।

দয়া করিয়া মাওলানা সাহেবকে জানাইও যে, আমি তাহার টাকা নিয়া আসিতেছি। আমাদের সকল কর্মীর প্রতি রইল আমার প্রীতি ও সালাম। আশা করি তুমি ভাল আছ।

তোমারই

স্বাক্ষর/ মুজিব ভাই

***

স্নেহের অলি আহাদ,

আমার ভালবাসা নিও। তোমার কোন খোঁজ খবর বহুদিন পাই না। শুনলাম তুমি কুমিল্লা কারাগারে বন্দি আছ। তোমার ভাবি তোমার জন্য খুব ব্যস্ত কারণ তোমার কোন খবর জানতে পারছে না। কেমন আছ এই খবরটি আমাদের দিলেই সুখী হব। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে তোমার হতভাগা ভাইকে লেখতে ভুলিও না। অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত আছি কারণ টাকার খুব প্রয়োজন। তোমার ভাবী প্রায় দুই মাস অসুস্থ ছিল, এখন একটু ভাল। চিন্তা করিও না খোদা সহায় আছেন। আমার হাইকোর্টের মামলা এখনও শেষ হয় নাই। বোধহয় শীঘ্রই হইতে পারে। সকলকে ছালাম দিও।

ইতি

তোমার মুজিব ভাই

***

১৯৫৪ সালে শেরে বাংলা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে পদচ্যুত করে পূর্ব পাকিস্তানে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার গভর্নর শাসন প্রবর্তন করে। তখন আত্মগোপন থাকাকালে গ্রন্থাকারের নিকট তাজউদ্দিন আহমদের চিঠি। চিঠিতে ছদ্মনাম ব্যবহৃত হইয়াছিল।

My dear Rahmat,

Received your letter this morning. I am really very sorry and plead guilty for not replying to your earlier note. But you may rest assured that we take interest in you though we have not been able as yet to do anything tangible for you. At my request Mr. A.R. Khan talked to the chief Secretary about your case, and at his own accord. Mr. Khan very often goes to the chief Secretary and speaks for he political prisoners in general and the Awami League in particular. He takes much interest in you and Mr. Toha.I was shown a letter of yours by Mr. Kamruddin, and your suggestion regarding the attitude of Awami League in respect of Nezam-e-Islam and Krishak Sramik party has been brought to the notice of Mr. A. R. Khan who appreciated your view point in view of the grim realities. You might have noticed the latest composition of the Flood Relief Committee. We have done our best to see that undesirable elements do not get predominance, but at the same time the solidarity of the U.F. party must not be at a jeopardy, and at least from outside no rift in the U.F. Party can be detected by interested quaters both innocent well wishers and the zealous cavaliers. Even your bad friends (I do not use “enemy”) feel the need of your presence in these days of great cataclysm.

It transpires from the talk of Mr. A. R. Khan and the authorities of the present East Bengal Govt, that the Govt. will take a lenient view in respect of the Awami League. But they will tighten their grip over the people belonging to other Organisations, namely, P.A.U.L and G. Dal whome they take rightly or wrongly to be the follow travelers of the Communists.

To your surprise you will learn that the Govt. Think that P.S.U. is the recruiting organ, the Y.L. is the elementary training phase and the G. Dal is the parliamentary front of the communist party. This is the analysis of the Home Department. Mr. Toha Awami League, but belongs to Y.L. also. Yar Mohd. Khan also falls into the same category. Therefore its is our common view that you should wait for sometime more till the eminent Govt. officials are convinced that there are more things in the heaven and earth than are reported by their over zealous promotion hunting worthless I. B. reporters. We hope better sense will soon dawn on the Govt. I realize your difficulty, but we are destined or we rather chose, the travel through the thorny path. No sufferings of patriots have ever gone in vain and undaunted spirit and unadulterated patriotism always guide the lovers of humanity as a beacon light towards the cherished goal. No amount of afflictions can deter them from the path of truth.

Moulana Sb. writes letters and like you always proposes to rush headlong into the open without caring for the consequences. But Mr. Suhrawardy puts his reign, and advises him not to come before Mr. Suhrawardy gets here in Pakistan, We discussed about you and are of opinion that you also should await Mr. Suhrawardy arrival. He had undergone a third operation a fortnight or so ago. He recovering fast. I saw a letter to Messrs A. R. Khan and Kamruddin each written by him recently. Please be at rest and wait a bit further, you had always been a tower of strength and we are quite confident that you will be able to bear up all sufferings and privations manfully and never give way to despair.

Yours sincerely,

Sd/ Tarique

N.S. : No question of surrender at this stage can at all arise.

Sd/ Tarique

বঙ্গানুবাদ

প্রিয় রহমত,

আজ সকালে তোমার চিঠি পাইয়াছি। তোমার আগের চিঠির উত্তর দিতে না পারার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত এবং নিজের দোষ স্বীকার করিতেছি। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পার যে, আমরা তোমার ব্যাপারে সচেতন যদিও এখন পর্যন্ত কার্যকর কিছু করিয়া উঠিতে পারি নাই। আমার অনুরোধে জনাব এ.আর খান (আতাউর রহমান খান) তোমার মামলার ব্যাপারে চীফ সেক্রেটারির সাথে আলাপ করিয়াছেন। জনাব খান প্রায়ই চীফ সেক্রেটারির কাছে যান এবং রাজবন্দিদের ব্যাপারে বিশেষ করিয়া আওয়ামী লীগ দলীয় রাজবন্দিদের সম্পর্কে আলাপ করেন। তিনি তোমার এবং জনাব তোয়াহার ব্যাপারে খুবই সক্রিয়/উদ্যোগী। জনাব কমরুদ্দিন তোমার একটি চিঠি আমাকে দেখান এবং নেজামে ইসলাম ও কৃষক শ্রমিক পার্টি সম্পর্কিত তোমার মতামত জনাব আতাউর রহমান খানের দৃষ্টিগোচর করা হয়। জনাব খান রূঢ় বাস্তবতার আলোকে তোমার মতামত সঠিক মনে করেন। তুমি হয়ত বন্যা ত্রাণ কমিটির সর্বশেষ কমিটির সদস্যদের নাম দেখিয়াছ। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি যাহাতে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিবর্গ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করিতে না পারে। সাথে সাথে ইহাও বিবেচনায় রাখিতে হইয়াছে যাহাতে যুক্তফ্রন্ট পার্টির সংহতি অটুট থাকে অন্তত যাহাতে বাহির হইতে সহজ-সরল শুভাকাংখীবৃন্দের কিংবা ঈর্ষাপরায়ণ শত্রুর চোখে যুক্তফ্রন্ট পার্টির কোন আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যেন ধরা না পড়ে। তোমার খারাপ বন্ধুরা (আমি ‘শত্রু’ বলিব না) বতর্মান কঠিন বিপর্যয়ের দিনগুলিতে তোমার প্রয়োজন অনুভব করে।

পূর্ববঙ্গ সরকারের বর্তমান কর্মকর্তাবৃন্দের সাথে জনাব আতাউর রহমান খানের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়া বুঝা যায় যে, সরকার আওয়ামী লীগ সদস্যদের সম্পর্কে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিবেন কিন্তু অন্যান্য দল যেম পি.এস.ইউ, ইয়ুথ লীগ এবং গণতন্ত্রী দল ভুক্তদের উপর তাহাদের বজ্রমুষ্টি আরও দৃঢ় করিবে- যাদেরকে তাহারা ভুলবশতঃ অথবা সঠিকভাবেই কমিউনিস্টদের সহযাত্রী মনে করে। তুমি জানিয়া বিস্মিত হইবে যে, সরকার পি,এস,ইউকে কমিউনিস্ট পার্টির রিক্রুটিং শাখা, ইয়ুথ লীগকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দানকারী প্রতিষ্ঠান এবং গণতন্ত্রী দল কমিউনিস্ট পার্টির পার্লামেন্টারি ফ্রন্ট হিসাবে বিবেচনা করে। ইহা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা। জনাব তোয়াহা আওয়ামী লীগ দলের কিন্তু আবার ইয়ুথ লীগেরও সদস্য। জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান একই শ্রেণিভূক্ত। সুতরাং ইহা আমাদের অভিন্ন মত যে, তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা কর যতক্ষণ পর্যন্ত না সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তারা ইহা অনুধাবন করিতে পারেন যে, তাহাদের পদোন্নতি শিকারী অকর্মন্য আই.বি রিপোর্টারদের রিপোর্টের বাহিরেও স্বর্গ মর্তে অনেক সত্য রহিয়াছে। আমরা আশা করিতেছি, শীঘ্রই সরকারের মনে শুভবুদ্ধির উদয় হইবে। আমি তোমার কষ্ট অনুভব করি কিন্তু কণ্টকাকীর্ণ পথ যাত্রা আমাদের নিয়তি এবং ইহা স্বেচ্ছায়ই আমরা বাছিয়া নিয়াছি। দেশপ্রেমিকদের কোন  ত্যাগই বৃথা যায় নাই, নির্ভীক চেতনা ও অবিমিশ্র দেশপ্রেম মানবতার পূজারীদের ইন্সিত লক্ষ্যের পানে আলোকবর্তিকার মত পথ-নির্দেশ করে। কোন দুঃখ-বেদনাই তাহাদেরকে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করিতে পারে না।

মওলানা সাহেব (মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী) চিঠিপত্র লেখেন এবং তোমার মতই পরিণতির প্রতি ভ্রক্ষেপ না করিয়াই সরাসরি মাঠে অবতীর্ণ হওয়ার পক্ষপাতি। জনাব সোহরাওয়ার্দী তাহার (মওলানার) রাশ ধরিয়া রাখিতেছেন এবং তিনি পাকিস্তানে না আসা পর্যন্ত মওলানা সাহেবকে না আসার পরামর্শ দিতেছেন। আমরা তোমার ব্যাপারে আলোচনা করিয়াছি এবং ইহা আমাদের মত যে, সোহরাওয়ার্দী না আসা পর্যন্ত তোমার অপেক্ষা করা উচিত। প্রায় এক পক্ষকাল আগে তাহার তৃতীয় অপারেশন হইয়াছে। তিনি দ্রুত আরগ্যলাভ করিতেছেন। জনাব এ.আর, খান ও জনাব কমরুদ্দীন-এর নিকট তাহার সম্প্রতি লেখা আলাদা আলাদা চিঠি আমি দেখিয়াছি। দয়া করিয়া কিছুদিন স্থির থাক এবং আরও কয়দিন অপেক্ষা কর। তুমি আগাগোড়াই সাহসিকতার একটি স্তম্ভ এবং আমরা নিশ্চিত যে, তুমি পুরুষের মত সকল নির্যাতন ও বঞ্চনা সহ্য করিতে পারিবে এবং কখনই হতাশাগ্রস্ত হইবে না।

তোমার বিশ্বস্ত

স্বাক্ষর/- তারিক

পুনশ্চঃ বর্তমান পর্যায়ে আত্মসমর্পণের কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।

স্বাক্ষর/- তারিক

***

শাহজাদপুর

১/১০/৫৬

প্রিয় আহাদ সাহেব,

সালাম জানবেন। দেশের অবস্থা যেন আয়ত্বের বাইরে। মানুষ ধুকে ধুকে মরতে বসেছে। তাদের এ অবস্থা আমরাও মনে হয় তাদের বাঁচাতে পারবো না। মানুষের হাতে পয়সা বলতে নেই। রিলিফ ও কন্ট্রোলের জিনিস শতকরা ২৫ জনের বেশি পায় না। এর মধ্যেও শতকরা ৫০ ভাগ চলে যায় মাতব্বর-মেম্বারদের নিজেদের আত্মীয় ও পেয়ারের লোকদের জন্য। গরীব লোকদের যারাও কন্ট্রোলের ধান চাল পাচ্ছে তারা এগুলি কেনার পয়সা জোগাড় করিতে পারছে না।

বাজারে ধান চালের দাম যথাক্রমে ২৪ টাকা ও ৪৫ টাকা এ এক কল্পনাতীত অবস্থা। মানুষ রবি শস্যের বীজ খেয়ে ফেলেছিল। এখন বীজের দাম চড়েছে মণকে ৪০ টাকা। গরীব কৃষকেরা পেট বাঁচাবে না বীজ কিনবে? মাঠকে মাঠ বীজের অভাবে শূন্য পড়ে আছে। এতে অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। আর আমলাতন্ত্র তো প্রকাশ্যেই আমাদের কুৎসা রটনা করে বেড়াচ্ছে। তারা এ ৯ বৎসর যে ব্যাভিচারের আস্বাদন পেয়েছিল তা থেকে তাদের বঞ্চিত করে কার সাধ্য? আশ্চর্য! এগুলি চিন্তা করছেন কি? আমাদের সংগঠন এ সকল জটিল প্রশ্নের কি জবাব দেয়?

৬ই অক্টোবর ঈশ্বরদী থানা আওয়ামী লীগ কনফারেন্স হচ্ছে সাহাপুর গ্রামে। ৭ই অক্টোবর হচ্ছে সাহজাদপুর থানা আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলন সাহজাদপুরে। এই দুটো কন্ফারেন্সেই আপনাকে আসতে হবে। মওলানা সাহেব কথা দিয়েছেন তিনি উভয় সম্মেলনেই উপস্থিত থাকবেন। তিনি না আসলে কিন্তু মহা বেইজ্জত হইবে। তাকে সঙ্গে আনবেন। অন্ততঃ একবার স্মরণ করিয়ে দেবেন।

কাগজে দেখলাম আপনি ঈশ্বরদী থানা কনফারেন্সে আসছেন। শাহজাদপুরেও আসতে হবে।

সংগঠন সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনার আছে, তা সাক্ষাতেই হবে।

জহুর ভাইকে ও ভাইদের সালাম জানাবেন।

ইতি

আব্দুল মতিন

পুনঃ 5th Oct ঈশ্বরদীতে পাবনা জেলা Food Conference হচ্ছে। আপনি উপস্থিত থাকলে ভাল হয়। কতকগুলি কাগজে একটু কষ্ট করে খবরগুলি পাঠিয়ে তাড়াতাড়ি ছাপাবার ব্যবস্থা করবেন।

ইতি- মতিন

***

গ্রন্থাকারের নিকট বগুড়া জেল হইতে নিরাপত্তা রাজবন্দি, বগুড়া জেলা যুবলীগের প্রেসিডেন্ট ছমিরউদ্দিন আহমদের চিঠি:

বগুড়া জেল

১২/8/৫৬

প্রিয় বড় ভাই,

আমার ছালাম জানবেন, পর ইত্তেফাকে প্রথম দিন বন্ধুবর ইমাদুল্যার অবস্থা আশংকাজনক সংবাদ পেয়ে মনে সন্দেহ জেগেছিল। তার পরের সংবাদ পড়ে অত্যন্ত ব্যথিত হলাম। বন্ধুবর ইমাদুল্যাকে আর আমরা আমাদের মধ্যে দেখতে পাব না। আপনে ও তার নিকটতম বন্ধু বান্ধবদের মত তার অকাল মৃত্যুতে আমিও আঘাত পেলাম এবং একজন বন্ধু হারালাম। আপনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত যুবলীগ ইমাদুল্যাকে জড়িয়ে আছে। ‘৫২ সাল হতে আপনার দায়িত্ব সে-ই গ্রহণ করেছিল। যে সময় আমাদের সমবেত নেতৃত্ব আপনাকে যুবলীগ হতে বিচ্ছিন্ন করতেছিল। সেই সময় একমাত্র বন্ধু ইমাদুল্যার মুখে কথা ছিল “ছমির মিঞা, অলি আহাদকে হারালে যুবলীগ প্রাণ হারাবে”। ঢাকায় সে-ই নিজকে জাহির করার দলের মধ্যে তার মুখে ‘৫২ সালে বাস্তবমুখী চিন্তার প্রকাশ দেখে সত্যই সেই দিন হতে তাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। ‘৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে মাতব্বরদের দরবারে যখন অপবাদ পেলাম তখন ইমাদুল্যাকে সহই অলি আহাদের গ্রুপের লোক বলে গালি সমান ভাবে গ্রহণ করিতে পেরেছিলাম। যাক এগুলি কথা খুব পুরাতন হয়েছে। অসার বলে প্রতিপন্নও হয়েছে অনেক কাজ ও কথা। অপরপক্ষে আপনে আজ সম্মানজনক স্থানে প্রতিষ্ঠিত। আপনাকে তার জন্য অভিনন্দন জানাই।

আপনেই ইমাদুল্যার প্রথম বন্ধু ও পথ প্রদর্শক নতুন যাত্রা পথের। ইমাদুল্যার পরিবারের ঠিকানা আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনার মারফতে তার শোকাকুল পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। আপনাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইমাদুল্যা স্মৃতি রক্ষা কমিটি গঠনের জন্য অভিনন্দনসহ কমিটির সাফল্য কামনা করছি। ইতি-

আঃ ছমির উদ্দিন আহমদ

-নিরাপত্তা বন্দি বগুড়া জেল।