বাংলাদেশের অলি আহাদ

রচনা ও সম্পাদনা

আবদুল হাই শিকদার

সূচিপত্র

চিত্রসূচি

ভূমিকা নয়

ভাষা নায়কের প্রতিকৃতি

১. সত্যনিষ্ঠ নায়কের প্রস্থান : চিরবিদ্রোহী অলি আহাদ

আবদুল হাই শিকদার

২. চির উন্নত মম শির : ভাষাবীর অলি আহাদ

আবদুল হাই শিকদার

৩. জননায়ক অলি আহাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার গ্রহণে : আবদুল গফুর ও আবদুল হাই শিকদার

৪. যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল

৫. দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের বক্তব্য ও পরামর্শকে উপেক্ষা করেই

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : আবদুল হাই শিকদার

৬. দেশ বাঁচানোর জন্য চাই পেট্রিয়ট, সৎ এবং আদর্শবাদী মানুষ

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : আবদুল হাই শিকদার

স্মৃতির ভুবন

১. আমার জেল জীবন

২.শেখ মুজিবের ৩টি দুর্লভ চিঠি

৩. আওয়ামী লীগের জন্ম : সেই সব দিন

৪. ভাষা আন্দোলন : অলি আহাদের স্মৃতিচারণ

৫. আমার স্মৃতিতে বায়ান্নর সেই দিনটি

৬. অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্জনের কথা আজো মনে পড়ে

৭. সিকিমের মত এদেশকে ভারতের অংশ করার জন্য সংবিধান

সংশোধনের পাঁয়তারা চলছে

অন্তরঙ্গ অলি আহাদ

১. পারিবারিক জীবন

২.আই অ্যাম প্রাউড অব মাই হাজব্যান্ড

৩. অলি আহাদের বই : জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫

পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট-ক

১. একগুচ্ছ ঐতিহাসিক চিঠি

ক. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, খ. শেরে বাংলা এ কে। ফজলুল হক, গ, আবুল মনসুর আহমদ, ঘ. আতাউর রহমান খান, ঙ. শেখ মুজিবুর রহমান, চ, কমরেড আবদুল হক, ছ, কমরেড। আবদুল মতিন, জ. সেলিনা বানু, ঝ, ছমির উদ্দিন আহমদ

পরিশিষ্ট-খ

১. পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতির ভাষণ

২. আমলা বিদ্রোহ : একটি ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত

৩. জাতীয় সংবর্ধনার সভায় প্রদত্ত ভাষণ

৪. বাংলাদেশ : রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা সংকট শীর্ষক

গোলটেবিলে অলি আহাদ।

পরিশিষ্ট-গ

১. জাতীয় সংবর্ধনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ।

২. অলি আহাদ সাহেবের কথা : বদরুদ্দীন উমর

৩. অগ্রজতুল্য অলি আহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি : প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ

৪. অলি আহাদ : আপোসহীন সংগ্রামী : আখতার-উল-আলম

৫. অলি আহাদকে একজন কবির শ্রদ্ধা : ফজল শাহাবুদ্দীন।

৬. ভাষাসৈনিক অলি আহাদের প্রাণনাশের হুমকি, আওয়ামী শাসনে ২৫২ কেউই নিরাপদ নয় : আবদুল গফুর

পরিশিষ্ট-ঘ

১. সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় : অলি আহাদের তিরোধান।

২. সংবাদপত্রের প্রতিবেদন : ভাষাসৈনিক বর্ষীয়ান রাজনীতিক অলি আহাদ আর নেই

৩. উপ-সম্পাদকীয় : বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা অলি আহাদ স্মরণে

৪. প্রতিবেদন : শহীদ মিনারে অলি আহাদের জানাযা নিয়ে বিতর্ক

ভূমিকা নয়

একথা এখন সর্বজনস্বীকৃত, জননেতা অলি আহাদ না হলে হয়তো ২১শে ফেব্রুয়ারির জন্মই হতো না। হয়তো ব্যবহারের দরকার ছিল না। তারপরও দরকার হলো। মতলবী ও দলীয় ক্যাডার ইতিহাসবিদদের খপ্পরে ধরাশায়ী হয়ে যারা আজও অলি আহাদকে যথার্থ সম্মান জানাতে অতিশয় কঞ্জুসপনা দেখান তারা যাতে কোনো কুতর্ক হাজির করতে না পারেন, সেইজন্য।

আমার বড় সাধ ছিল এ গ্রন্থের নাম ভাষাবীর অলি আহাদ বা ভাষা নায়ক অলি আহাদ রাখার। আসল নকল বা অর্ধনকল ভাষাসৈনিক আমাদের অনেক আছেন। সেজন্য ভাষাসৈনিক কথা অলি আহাদের বেলায় সুপ্রযুক্ত না। সেনাপতিকে সাধারণ পর্যায়ে নামিয়ে আনা কোনো কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় বহন করবে না। কিন্তু প্রকাশক জাকির হোসেন ভাই বাঁধ সাধলেন। তার স্বরের সাথে সুর মিলিয়ে আমারও মনে হলো, আমরা সবাই তো বলি, অলি আহাদ এমন এক নাম যার নামের আগে এখন আর বিশেষণ লাগে না। তিনি নিজেই এখন বিশেষণ। অথবা বিশেষণের পীড়ন অতিক্রম করে যাওয়া আমাদের জাতিরাষ্ট্র নির্মাতাদের একজন। তাহলে উপায়? জননেতা অলি আহাদ তার পুরো জীবনটাই তো ব্যয় করে গেছেন মাতৃভূমির জন্য, তার জাতির কল্যাণ সাধনায়। সে কারণে এক অর্থে অলি আহাদ আর বাংলাদেশ তো একাকার এবং অখণ্ড এক সত্তা। তো বাংলাদেশের অলি আহাদ বা অলি আহাদের বাংলাদেশ তো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সেজন্যই গ্রন্থের নাম বাংলাদেশের অলি আহাদ। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, আগুন যে আগুন তা বোঝার জন্য বিশেষ প্রজাতির সমালোচক ভাড়া করার কোনো দরকার পড়ে না। বাম হাতের কড়ে আঙ্গুলটা একটু ছোঁয়ালেই তা বোঝা যায়। অলি আহাদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। অলি আহাদ কে, কী তার অবদান, কেন তিনি প্রাতঃস্মরণীয়, কেন তাকে ছাড়া চলে না, চলবে না, সেটা বোঝার জন্য দিস্তা দিস্তা ভূমিকার বাগাড়ম্বর একেবারেই অর্থহীন। সেজন্য এটা কোনো ভূমিকাও নয়। এ হলো গ্রন্থে প্রবেশের আগে কিছু আনুষ্ঠানিকতা। এ না পড়লেও চলবে। আবার পড়লেও ক্ষতি নেই।

অলি আহাদ ভাবনা আমার অনেক দিনের। আমার পর্যবেক্ষণগুলো একত্রিত করার তাড়নাও পাচ্ছিলাম অন্তর থেকে। বিশেষ করে তার ইহলোক ত্যাগের পর থেকে। কিন্তু পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের সময় মনে হলো, এর আগে এই মহাপুরুষ সংক্রান্ত গ্রন্থ আছে মাত্র দুটি। একটি আমাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য তার জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫, অন্যটি মুন্সী আবদুল মজিদ সম্পাদিত চিরবিদ্রোহী অলি আহাদ। মুন্সী আবদুল মজিদের বইটি এখন আর পাওয়া যায় না। ফলে বিরাট বিশাল ব্যাপক বিপুল খ্যাতিমান মানুষটিকে অনুধাবন ও অনুসরণের হ্যাপা বর্তমানকে পোহাতে হচ্ছে বিস্তর। ভবিষ্যৎ তো আরও অনিশ্চিত। এই বিবেচনা মাথায় রেখে জননেতার আপন পৃথিবী স্মৃতির ভুবন, তার আপন জনদের অন্তরঙ্গ অলি আহাদ এবং দলিল দস্তাবেজ ও ইতিহাসের উপকরণগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার অভিপ্রায়ে এ গ্রন্থে সংযোজিত হলো পরিশিষ্ট ক, খ, গ ও ঘ। পরিশিষ্ট ঘ নির্মিত হয়েছে তার তিরোধানের পর সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় নিয়ে। অর্থাৎ নানাভাবে নানা মাত্রায় জননেতা অলি আহাদকে জানার, তাঁর জীবনদর্শন, তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে উপস্থাপন করাটা আমার কাছে অতীব জরুরি মনে হয়েছে। এই কর্ম করতে গিয়ে গ্রন্থের পরিসর বেড়েছে অনেক। তা হোক, বিস্তৃত ক্যানভাসে এই মহাপুরুষকে দেখার যে একটা সুযোগ সৃষ্টি হলো এও তো এক মহার্ঘ প্রাপ্তি। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম অলি আহাদের মতো সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক, নির্লোভ, আপসহীন দেশপ্রেমিক, মানবদরদী হোক। তার আলোয় হোক আলোকিত। তার জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাক ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাংলাদেশের দিকে। আর আমাদের রাজনীতি ফিরে পাক প্রত্যাশিত চরিত্র ও দ্যুতি। এ আমার অন্তরের গভীর নিবিড় আকুতি।

প্রকাশক সৈয়দ জাকির হোসাইন ভাইকে শুকনো ধন্যবাদ জানাই কি করে! তার জন্যই তো শেষ পর্যন্ত পাঠকের হাতে পৌছে গেল বাংলাদেশের অলি আহাদ। ২০১৩ সালে পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলাম। আর এখন ২০১৫-এ তা টেবিলে এল। এই যে দেরিটা এও কিন্তু আমার জন্য। মোহাম্মদ মোকসেদ, মাহফুজ খান, তরুণ কবি রফিক লিটন, মোঃ আসাদুজ্জামান সরকারের কাছেও এ গ্রন্থ ঋণী।

এ গ্রন্থকে সামনে নিয়ে জননেতা অলি আহাদ-পত্নী প্রফেসর রাশিদা বেগম এবং একমাত্র সন্তান ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার কাছে কিছু কৃতজ্ঞতা পেশ করছি। তারা আমাকে বেশ কিছু আলোকচিত্র দিয়ে সহায়তা করেছেন। এ গ্রন্থ যদি তাদের ভালো লাগে আমি বর্তে যাব।

জাতীয় প্রেসক্লাব। ঢাকা।

আবদুল হাই শিকদার

সত্যনিষ্ঠ নায়কের প্রস্থান : চিরবিদ্রোহী অলি আহাদ

আবদুল হাই শিকদার

[১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সংগ্রামশীল বাংলাদেশের অন্তরগত চেতনার প্রবল অবলম্বন, অন্যায়, অসত্য, শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে আজীবন আপসহীন, সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়নিষ্ঠ, আদর্শবাদী জননায়ক চিরবিদ্রোহী অলি আহাদ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি… রাজিউন)। এই লেখাটি ১৯শে অক্টোবর ২০১২ শুক্রবার রাতে যখন লিখি, তখনও প্রত্যাশা ছিল তিনি আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন আমাদের মধ্যে। কিন্তু শনিবার (২০শে অক্টোবর ২০১২) এলো সেই দুঃসংবাদ।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জানাযা শেষে ফিরে লেখা হয়েছিল এই নোট।]

বিষুদবার, ১৮ই অক্টোবর ২০১২। পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালের সামনে যখন দাঁড়ালাম তখন ৯টা ৩০ মিনিট। বাইরে ঝলমল করছে আলো। কিন্তু আমার ভেতরে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মেঘ। এই হাসপাতালের পাঁচতলায় আইসিইউ’র ছয় নম্বর বেডে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে চিরবিদ্রোহী জননায়ক অলি আহাদের শেষ প্রস্থান ঠেকাতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন ডা. এবিএম হারুন ও ডা. নিম্মির নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আর জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে পেণ্ডুলামের মত দুলছে তার থাকা-না থাকা।

খবরটা মিডিয়ার কল্যাণে আগের রাতেই জেনে নিয়েছিলাম। ছ্যাৎ করে উঠেছিল বুক। পঁচাশি বছর বয়সের বয়োবৃদ্ধ জননেতাকে সকালে গিয়ে জীবিত পাব তো? সারা দেশের প্রতিটি কোনায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিংস্র হাঙর-কুমির।

সেসব অন্যায় ও জুলুমের প্রতিবিধান না করে গোটা জাতিকে কূলহারা নোনা পানিতে ভাসিয়ে তিনি চলে যেতে পারেন না। এ ধরনের প্রস্থান তো দর্শন ও স্বভাববিরুদ্ধ! আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম তার আরোগ্যের জন্য।

সকালে আমার স্ত্রী কানের কাছে গুঁজে দিল রেডিও। বলল, বিবিসি-তে রুমিনের সাক্ষাৎকার প্রচার করছে, শোন। রুমিনের পুরো নাম রুমিন ফারহানা। অলি আহাদ ভাইয়ের একমাত্র সন্তান। এই ব্যারিস্টার মেয়েটি পিতার চোখের মণি। অতি আদরের।

বিবিসি জানতে চাইল, রাষ্ট্রীয়ভাবে জননেতা অলি আহাদের কোনো খোঁজখবর নেয়া হয়েছে কি?

রুমিন বলল, এখন পর্যন্ত কেউ কোনো খবর নেয়নি।

বিবিসি বলল, দেশের বাইরে উন্নততর চিকিৎসা নেয়ার ব্যাপারে কি কিছু ভাবছেন আপনারা?

রুমিনের সংক্ষিপ্ত উত্তর—আমাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই।

দু’পক্ষের মাঝখানে জায়গা নেয় নীরবতা। বিব্রতকর নীরবতা। সেই নীরবতা ভেঙে বিবিসির প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করে—আপনি কি প্রত্যাশা করেন না, ওনার মত রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত একজন ব্যক্তির চিকিৎসাভার রাষ্ট্রীয়ভাবেই নেয়া উচিত?

রুমিনের কণ্ঠে যেন দৃঢ়চেতা, আপসহীন, সব রকমের স্বার্থমুক্ত তার পিতার পরিচ্ছন্ন উপস্থিতি, দেখুন এই রাষ্ট্রের কাছে, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। যে দেশে গুণীর সম্মান হয় না, সেই দেশে গুণীর জন্মও হয় না। বাংলাদেশের ভাগ্যে অলি আহাদের মত রাজনীতিবিদ নেই। বাংলাদেশ যা করে তেমন রাজনীতিবিদরাই এখন রাজনীতি করে। এখন রাজার নীতি হল রাজনীতি।

রুমিনের বেদনা ও কষ্ট আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। যে দেশে ক্ষমতাসীনদের লালসার লালায় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে গেছে দেশ, শেয়ারবাজারকে গোরস্তান বানিয়ে পাচার করা হয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা, ব্যাংকগুলো থেকে তসরুফ হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা, মন্ত্রীদের বাড়িতে যায় টাকার বস্তা, পদ্মা সেতুর টাকা আসার আগেই ভাগ-বাটোয়ারা করে খাওয়া-দাওয়া শেষ। চুরি, দুর্নীতি, ঘুষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, গুম, খুন, ধর্ষণ নৈমিত্তিক ব্যাপার বানিয়েছে শাসকরা। আধিপত্যবাদের পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে লাখ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ—সেই দেশে নীতিনিষ্ঠ অলি আহাদের উন্নততর চিকিৎসা দেয়ার সাধ্য নেই তার পরিবারের। বাংলাদেশের চোর, দুর্নীতিবাজ, মতলববাজ, মুনাফিক, প্রতারক, জালিয়াত, দেশদ্রোহী, জাতিদ্রোহী, মিথ্যাবাদী, আত্মসর্বস্ব রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দেখে দেখে যাদের চোখ ও মন দুটোই ভাগাড়ের বিষ্ঠায় পরিণত হয়েছে, তাদের কাছে এই বিষয়টা বেমানান লাগতে পারে। লাগারই কথা। কারণ অলি আহাদকে পরিমাপ করতে হলে যে ন্যায়, নীতি, সততা, সাহস, দৃঢ়তা, আপসহীনতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম থাকতে হয়—তা। এরা কোথায় পাবে? ফলে এরা এদের নিজ নিজ বাটখারা দিয়ে হিমালয় পর্বতকে দেখতে গিয়ে, নিজেদের আবর্জনাকেই গলাধঃকরণ করে দিয়ে আসে। অলি আহাদের জন্য উন্নততর চিকিৎসার ব্যবস্থা এরা করে কীভাবে? এদের সবকিছুর মধ্যেই তো জঘন্য পাপ।

আমি শমরিতা হাসপাতালের আইসিইউ’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

দুই

অলি আহাদ। আশ্চর্য এক নাম। আমাদের রাজনৈতিক, গগনের উজ্জ্বলতম বাতিঘর। আমাদের রাজনীতির শেষ সত্যনিষ্ঠ নক্ষত্র। আমাদের অভিভাবক। আমাদের বিবেক। সত্যি তো, অলি আহাদ এখন আর কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। অলি আহাদ একটি অসাধারণ দ্যোতনাময় বিশেষণ। একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের চিরকালের আপসহীন বিদ্রোহের আগুন। এজন্যই তিনি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নন, তিনি সর্বজনীন। তাঁর নাম উচ্চারণ মাত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে এমন একটি প্রতিকৃতি যিনি আজীবন ব্যক্তির উধের্ব, দলের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন জাতীয় স্বার্থকে। কে কী ভাবল, কে কী বলবে, এ নিয়ে সামান্যতম মাথাব্যথাও তাঁর কোনোকালে ছিল না। যা তিনি বোঝেন, যা তার বক্তব্য, তা তিনি অকপটে, সরবে, সহজ-সরলভাবে উচ্চারণ করেছেন অকম্পিত কণ্ঠে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা তিনি। শুধু ভাষাসৈনিকই নন, তিনি ভাষা-নেতা, ভাষা-নায়ক। তিনি না হলে হয়তো একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাই ঘটত না। ‘৬৯ সালে তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করার কাজে হাত দিয়েছিলেন। এই অগ্রগামী জননায়ক ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি যেমন ভাষা আন্দোলনের মূল নায়ক, তেমনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেরও অন্যতম স্থপতি। তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। আবার দেশ স্বাধীনের পর তিনি আমাদের প্রথম রাজনীতিবিদ যিনি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আওয়াজ তুললেন—পিন্ডির শিকল ছিড়েছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়। তিনি বললেন, এ স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ। তিনি শুরু করলেন তার বহুল আলোচিত ‘আজাদ বাংলা কায়েমের আন্দোলন। ৩০শে জুন ক্ষিপ্ত শেখ মুজিব সরকার তাকে নিক্ষেপ করলো কারাগারে। ৪২৭ দিন কারা নির্যাতন ভোগ করে মুজিব সরকারের পতনের পর ২৪শে আগস্ট ১৯৭৫ আবার মুক্ত বাতাসের মধ্যে তার ফিরে আসা।

১৯৫৭-এর কাগমারি সম্মেলন থেকে তাকে বাদ দিলে হারিয়ে যায় লাবণ্য। ১৯৪৮-এ প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। যুবলীগের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের জনকদেরও একজন তিনি। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে বহিষ্কৃত হন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই বহিষ্কারাদেশ ৫৪ বছর পর প্রত্যাহার করে নেয় বেগম খালেদা জিয়ার সরকার।

সত্যিই তো, অলি আহাদ আমাদের অমিততেজা সংগ্রাম ও চেতনারই অন্য নাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জীবনের সূচনা, তা বিভিন্ন সময়ে হয়ে উঠেছে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার জন্য, মানবমুক্তির জন্য তিনি উৎসর্গ করে গেছেন তার পুরো জীবন। শাসক, সে যত শক্তিশালীই হোক, প্রক্ষেপ করেন নি এই মানুষটি। অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন তিনি। জাতীয় কবির একটি কবিতা সত্য হয়েছে। তার জীবনে ;

যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামী ভাই

করবো সেথায় বিদ্রোহ,

ধামা ধরা জামা ধরা

মরণ ভীতু, চুপ রহো।

পরিস্থিতি যাই হোক, পরিণাম যাই হোক, অলি আহাদ বজ্রনির্ঘোষ :

বল বীর

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!

অনন্যসাধারণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, নির্লোভ এই মহামানব তার সংগ্রামের জন্য জীবনে কারাবরণ করেছেন ১৭ বার। আইয়ুব দুঃশাসনের সময় তাকে আত্মগোপনে থাকতে হয় ৭ বছর। এরশাদের সামরিক শাসনামলে তাঁর অসাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তিনি স্লোগান তোলেন—

অলি আহাদের এক আওয়াজ

খতম কর সেনাপতি রাজ।

এজন্য তাকে গ্রেফতার করা হয় ৬ বার। বিচার করা হয় সামরিক ট্রাইব্যুনালে। কী লজ্জা! কারাভোগ করেন ৩৫৭ দিন। এরশাদ বন্ধ করে দেয় তার সম্পাদিত জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ। তবু দম্ভের কাছে, ক্ষমতার মোহের কাছে তিনি কখনোই মাথা নত করেননি। এই মহাপুরুষের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামপুর গ্রামে। পিতা ছিলেন জেলা রেজিস্ট্রার। নিজে ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় লাভ করেছিলেন প্রথম বিভাগ। ভালো ছাত্রের জন্য পেয়েছিলেন মহসিন ফান্ডের বৃত্তি। কিন্তু সে বৃত্তি তিনি গ্রহণ করেননি। বলেছেন, এটা সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য। তারপর আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে নিজে হলেন ইতিহাস। আর তার হাত দিয়ে নির্মিত হল আমাদের গর্বের ও গৌরবের ইতিহাস।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের যথেষ্ট প্রীতি তিনি লাভ করেছেন জীবনে। তিনি ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদকও। কিন্তু শাসক শেখ মুজিবের অত্যাচারকে তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেন। ১৯৫৬ সালে শেখ মুজিবের অনুরোধে তিনি শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন। শেখ মুজিবের এই অনুরোধ তিনি রাখলেও, ১৯৭২ সালে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন।

তার সর্বশেষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্র্যাটিক লীগ। এরশাদরিরোধী আন্দোলনে তিনি গঠন করেন ৬ দলীয় জোট। ১৯৯৬-এ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠন করেন। ৭ দলীয় জোট। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের নির্যাস নিয়ে রচনা করেন জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫, যা আমাদের জাতীয় রাজনীতির এক প্রামাণ্য জীবনীও বটে।

অলি আহাদ এবং বাংলাদেশ যেন একই সত্তার দুই দিক। আবার বলা যায়, অলি আহাদ এবং বাংলাদেশ যেন মিলেমিশে হয়ে উঠেছে একটা সত্তা। যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে তারা অলি আহাদকে ভালো না বেসে পারবেন না। যারা বাংলাদেশের শত্রু তারা অলি আহাদেরও শত্রু। আবার অলি আহাদকে যারা পছন্দ করেন না তারা আসলে বাংলাদেশকে পছন্দ করেন না। বাংলাদেশ আজ দুর্গতিতে পতিত বলেই তার মহান সন্তান অলি আহাদের খোজ নেয়ার কেউ নেই। যে বাংলাদেশের জন্য অলি আহাদ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে সংগ্রাম করে গেছেন, আজ সেই বাংলাদেশ থাকলে অলি আহাদ হতেন গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম। বিভিন্ন চ্যানেলে-সংবাদপত্রে ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রচারিত হত। সর্বশেষ বুলেটিন। হাসপাতালের সামনে লেগে যেত জনজট। দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই ছুটে যেতেন তার শয্যায়।

মরহুম শেখ মুজিব অলি আহাদের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। তাই তো মন্ত্রিত্বের অফার দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর তো অলি আহাদ কেন, বাংলাদেশের প্রতিও কোনো কৃতজ্ঞতা নেই। সেজন্যই তিনি অলি আহাদের কাছে। যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। রাষ্ট্র নেয়নি তার চিকিৎসার ভার। অলি আহাদ শমরিতায় পড়ে আছেন। অথচ দেশে কোথাও কোনো উদ্বেগ নেই। সবকিছু স্বাভাবিক। এই অবহেলা দিয়ে আমরা কাকে কী শিক্ষা দিচ্ছি? আমরা যত চেষ্টাই করি, আমাদের ক্ষুদ্রতা দিয়ে অলি আহাদের মহিমাকে মলিন করা যাবে না। তিনি ইতিহাসের স্রষ্টা, ইতিহাস তাকে নির্মাণ করেছে। এই পৃথিবীতে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলা ভাষায় যতদিন মানুষ কথা বলবে, ততদিন রয়ে যাবে অলি আহাদের নাম। এই অনশ্বরতা থেকে অলি আহাদকে সরায় সাধ্য কার?

তিন

অলি আহাদের অসুস্থতার শুরু আজ থেকে নয়। ২০০৩ সালে তাঁর ধানমন্ডির ল্যাবরেটরি রোডের বাসায় বাথরুমে পড়ে তিনি প্রচণ্ড আঘাত পান। ভেঙে যায় একটি পা। তারপর থেকেই শয্যাশায়ী তিনি। চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। অত্যন্ত প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন অলি আহাদ অন্যদের মত ফেরি করে বেড়ান নি তার অসুস্থতা। এর সঙ্গে হয়তো প্রচ্ছন্ন হয়েছিল তাঁর অভিমান। এই অভিমানের বিষয়টি অবশ্য আমার ধারণা। ফলে সবাই ভুলে যান তাঁকে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলে গণমাধ্যমের অশিক্ষিত সাংবাদিকরা ছুটে বেড়ান সহজলভ্য পেশাদার ভাষাসৈনিকদের কাছে। এই পেশাদার ভাষাসৈনিকরাই চোয়ালবাজি করে দখন করে রাখেন মঞ্চ ও মিডিয়া। এই কদর্য কোলাহল অলি আহাদের মত অভিজাত মানুষকে স্পর্শ করে কীভাবে? ফলে আড়ালেই চলে যান তিনি। না, এই চলে যাওয়া নিয়ে ফালতু কোনো অভিযোগ তার ছিল না। বাজে লোকদের কাছে নিজেকে ছোট করা তাঁর কর্ম নয়।

অলি আহাদের স্ত্রী প্রফেসর রাশিদা বেগম জানালেন, এবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করি ২০১২-এর ৭ই অক্টোবর রাত ২টায়। তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশি হচ্ছিল। তাঁকে ভর্তি করার পর দেখা যায়, প্রেসার অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। বাধ্য হয়ে তাকে দেয়া হতে থাকে লাইফ সাপোর্ট। এর আগে থেকেই তিনি হারিয়ে ফেলেন চৈতন্য। এখনও ফেরেনি তার জ্ঞান। বার্ধক্যজনিত সমস্যা এবং মাল্টি অরগান ফেইলুরের বিষয়টিও এখন ভাবিয়ে তুলেছে ডাক্তারদের।

রুমিনের চোখে টলমল করে পানি। আমাদের কারও কোনো সাহায্যের দরকার নেই। শমরিতার ডাক্তাররা নিজের জন্মদাতা পিতার মত সম্মান করছেন আমার আব্বকে। তারা সাধ্যমত করছেন। আপনারা দেশের মানুষকে বলবেন। দোয়া করতে।

চার নজরুল বলেছিলেন

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হত শান্ত!

কিন্তু নজরুল কথা রাখতে পারেননি। উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল রয়ে গেল। অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ মানববিশ্বকে হারিয়ে দোজখ বানিয়ে রাখলেন। এর প্রতিবিধানের আগেই নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে নজরুলের ছায়া পাওয়া যায় কেবলমাত্র অলি আহাদের মধ্যেই। সেজন্যই তাকে আমি ১৯৯৮ সালে তার বিশাল দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপানোর শিরোনামে জুড়ে দিয়েছিলাম-“চির বিদ্রোহী অলি আহাদ। আজ সবাই তাঁকে এভাবেই চিনছেন, সম্মানিত করছেন। নজরুলের মতই অসমসাহসী মানুষটি রাজনীতিতে সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। কিন্তু সেই অন্যায় ও অসত্য সমাজ থেকে উৎখাতের আগেই, নজরুলের মতই কথা না রেখে ক্লান্ত হয়ে, পরদিন সকালে, আমাদের কাউকে কিছু না বলে, নীরবে-নিঃশব্দে অনন্তের দিকে যাত্রা করলেন অলি আহাদ। আর কোনোদিন তার কণ্ঠ শুনতে পারব না আমরা। দুঃখিনী বাংলাদেশের সবচেয়ে অমিততেজা সন্তানটি চলে গেলেন। আর এই প্রস্থানের ভেতর দিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে শেষ সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তারপরও অলি আহাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় পঙক্তি

অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির

ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।

চিরকাল ধ্রুবতারকার মত আমাদের পথের দিশা দেবে। জ্বলজ্বল করবে আমাদের চেতনায়।

চির উন্নত মম শির : ভাষাবীর অলি আহাদ

আবদুল হাই শিকদার

৪ঠা জানুয়ারি ১৯৫৬, করাচির ৭ নম্বর সমারসেট হাউস থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদকে এক চিঠিতে লিখলেন,

তোমাকে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটু অনুরোধ করিতে চাই। আমার ছেলে কামাল উদ্দিনকে সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট স্কুলে এবং মেয়েকে (হাসিনা) কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল অথবা বাংলা বাজার স্কুলে ভর্তি করাইবার। জন্য দয়া করিয়া চেষ্টা করিবা। তাহাদের জন্য একজন ভালো শিক্ষক যোগাড় করিবার চেষ্টা করিবা। সব সময় তোমার ভাবীর সহিত যোগাযোগ রাখিবার চেষ্টা করিবা। সেও খুব নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছে। আমি ভালো। আমার কাছে চিঠি দিও।

পরিস্থিতি তখন এমনই যে ন্যায়নিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ, কর্তব্যকর্মে অবিচল, আদর্শবাদী অলি আহাদ ছাড়া অন্য কারও ওপর এতটা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে নির্ভর করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন নি শেখ মুজিব। অলি আহাদ তখন এতটাই অনিবার্য ও অপরিহার্য। আশ্চর্য হওয়ার মত ব্যাপার, এই সততা ও আদর্শবাদিতাই মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে শেখ মুজিবের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠল। অবশ্য এর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল আরও কয়েকটি বিষয়। খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার মোহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন অলি আহাদ। আর জীবনে কখনও অন্যায়, অসত্য ও জুলুমের সঙ্গে আপস করেননি। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তানের মসনদের লোভ তাকে নিয়ে যেতে পারেনি কোনো কপটতা ও ভণ্ডামির কাছে। ফলে ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী যখন উচ্চারণ করলেন তার ঐতিহাসিক আসসালামু আলাইকুম তও, পূর্ব বাংলাকে যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের এককেন্দ্রিক বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী শোষণ করে চলেছে, যেভাবে পূর্ব বাংলার জনগণ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকারে পরিণত হচ্ছে, তাতে এমন দিন আসতে পারে যেদিন পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম বলতে বাধ্য হবে।’ তখন তৎকালীন নেতাদের মধ্যে যে মানুষটি সব ধরনের জেল-জুলুম, ভূমকি-ধমক, মোহ, মাৎসর্য, লোভ-লালসাকে পায়ে পিষে সর্বশক্তি নিয়ে সুদৃঢ়ভাবে মওলানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন—তিনি আর কেউ নন, জননেতা অলি আহাদ।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন মওলানার পাশে না দাঁড়িয়ে তাকে ভারতের দালাল বলে গালাগাল করেছেন। পেয়ারা পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে মওলানার ফাঁসির দাবিতে ছাত্রলীগকে দিয়ে মিছিল করিয়েছেন। বইয়ে দিয়েছেন বিবৃতির ঝড়। ফাঁসির দাবিকে জোরালো করার জন্য শুরু করেছিলেন গণস্বাক্ষর সংগ্রহ। সোহরাওয়ার্দী-শেখ মুজিবের কপালের ভাজ আরও গভীর হয়ে উঠল, যখন অলি আহাদ মওলানা ভাসানীর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি, সামরিক চুক্তিবিরোধী ভূমিকাকে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সমর্থন করে প্রকাশ করেছিলেন একটি ক্ষুদ্র বই পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন। সঙ্গে সঙ্গে অলি আহাদ চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন এই দুই নেতার। শেখ সাহেবের ধারণা হল, অলি আহাদ আওয়ামী লীগে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। শত্রুর শেষ রাখতে নেই—এ বাক্যকে শিরোধার্য করে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে স্বয়ং শেখ মুজিব প্রস্তাব উত্থাপন করলেন অলি আহাদকে বহিষ্কারের। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়েই কার্যকর হয় এ বহিষ্কারাদেশ।

এভাবেই পূর্ব বাংলার মানুষের মনের মণিকোঠায় দ্বিতীয়বারের মত নায়কের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন অলি আহাদ। যে আসন তার জন্য আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিল মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।

দুই

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সংগ্রামশীল বাংলাদেশের অন্তর্গত চেতনার প্রবল অবলম্বন, অন্যায়, অসত্য, শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে আজীবন আপসহীন জননায়ক চিরবিদ্রোহী অলি আহাদকে ১৯৯৯ সালের ১২ই মার্চ জাতির তরফ থেকে দেয়া হয় এক সংবর্ধনা। এ সংবর্ধনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া। জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত এ জাতীয় সংবর্ধনা সভায় অলি আহাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে প্রধান অতিথির ভাষণে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ইতিহাসই যুগে যুগে একেকজন মহান ব্যক্তিত্বের মানুষকে সৃষ্টি করে। আবার বিরল প্রতিভা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মহানায়করা নতুন ইতিহাস রচনা করে সমাজকে বিকাশের নতুন সোপানে অধিষ্ঠিত করেন, জাতিকে সঙ্কট উত্তরণের দিকনির্দেশনা দেন এবং মানুষকে মহৎ মর্যাদা দেন। আমাদের সমকালে অলি আহাদ এমন একজন মানুষ। ৪০ দশক ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে ঘটনাবহুল এবং চূড়ান্ত বিজয়ের দশক। আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষ এবং নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দশক। অলি আহাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরু এই দশকে।

এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নিপীড়নবিরোধী লড়াই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। চূড়ান্ত বিচারে এ লড়াই-ই হচ্ছে সর্বোত্তম গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত স্বদেশ, নিপীড়ন ও ব্যঞ্জনামুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ এবং সমৃদ্ধ সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন সেদিন তাঁকে গৃহের নিরাপদ অবস্থান থেকে রাজনীতির বন্ধুর পথে টেনে এনেছিল।

৫০-এর দশক ছিল স্বপ্নভঙ্গের দশক। নিপীড়ন ও ব্যঞ্জনামুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ এলো না; আমাদের জাতিসত্তার ওপর আঘাত এলো। ৫২’র ভাষা আন্দোলন ছিল তারই বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা। ইতিহাস বিকৃতির শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ সত্যটি আজ ১২ কোটি মানুষের কাছে স্পষ্ট যে, অলি আহাদ ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা।… অলি আহাদ আমাদের রাজনীতিতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। নীতির প্রশ্নে তিনি কখনও আপস করেননি। প্রলোভন কখনও তাঁকে বশীভূত করেনি। বলা যায়, তিনি আজ ‘জাতির বিবেক’-এ পরিণত হয়েছেন।

বেগম খালেদা জিয়ার এ কথাগুলো যে জাতির বিশ্বাসের মর্মমূল থেকে উৎসারিত, তা বলাই বাহুল্য। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান প্রসঙ্গেও তার বক্তব্য যথার্থ। আওয়ামী লীগের গৃহে লালিত-পালিত খুদ-কুড়ালোভী দু-চারজন পাপিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী এবং কিছু অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত সাংবাদিক ছাড়া সবাই জানে ১৯৫২ সালে অলি আহাদ না থাকলে ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনাই ঘটত না। এজন্যই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরশীল গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘…এদের মধ্যে আবার যদি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে একজনের নাম করতে হয়, তাহলে তিনি হলেন, অলি আহাদ।… ভাষা আন্দোলনে অলি আহাদ সাহেবের ভূমিকা যারা অগ্রাহ্য করেন, উপেক্ষা করেন অথবা ছোট করে দেখতে চান, তারা প্রকারান্তরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতকরণের প্রচেষ্টাতেই লিপ্ত থাকেন। তাদের এই অপকর্ম সমর্থনযোগ্য নয়।

তিন

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত। বিস্তৃত, তিন পতাকার নিচে বেড়ে ওঠা ও প্রতিরোধ আন্দোলন এবং পরিণত পর্যায় নিয়ে যে বর্ণাঢ্য জীবন অলি আহাদ উদযাপন করে গেছেন, সে জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান নিশ্চয়ই ভাষা আন্দোলন। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল পাকিস্তানি শাসন-শোষণবিরোধী তাঁর স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম। স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের দিকে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কারণ আমরা এখন জানি, সেই ১৯৬৯ সালেই তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করার কাজে হাত দিয়েছিলেন। এই অগ্রগামী জননায়ক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি যেমন ভাষা আন্দোলনের মূল নায়ক, তেমনই স্বাধীন বাংলাদেশেরও তিনি অন্যতম স্থপতি। তার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল আজাদ বাংলা কায়েমের আন্দোলন। এ প্রসঙ্গে জননেতা অলি আহাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক সংবিধানও রচিত হল। বিমল আনন্দে বুক ভরে গেল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ভারত মিত্রের ছদ্মবেশে আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়েছে বটে, তার আসল অভিলাষ হল পিন্ডির স্থানে নিজেকে অধিষ্ঠিত করা। সেজন্য তার চাই একটি বিকলাঙ্গ, নতজানু, তাবেদার বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যেই শুরু হল হিন্দুস্থানি ফৌজদারি দেদার লুট ও ভারতে সম্পদ পাচার। দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ধস নামল। সেই সঙ্গে স্বাক্ষরিত হল দিল্লির ২৫ শালা দাসত্ব চুক্তি, সীমান্তবাণিজ্য চুক্তি ও গঙ্গার পানি ভারতের কাছে তুলে দেয়ার চুক্তি। ১৯৭৩ সালে সেই দুর্যোগময় মুহূর্তে আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদকে প্রতিহত করার জন্য আজাদ বাংলা কায়েম কর, দিল্লির দাসত্ব মানি না, মানব না শপথ নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিলাম। প্রতিবাদ জানালাম। ফল হল কারাবাস।

১৯৭৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর দিল্লির আধিপত্যবাদের শিকল থেকে দেশকে উদ্ধারের জন্য অলি আহাদ সারাদেশে ‘আজাদ বাংলা’ পালনের ডাক দেন। পল্টনের জনসভায় মুজিব দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। শেখ মুজিব নির্যাতনমূলক বিশেষ ক্ষমতা আইন জারি করলে তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭৪ সালের ১৪ই এপ্রিল তার প্রচেষ্টায় গঠিত হয়। সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট। ২৩শে এপ্রিল হয় ফ্রন্টের প্রথম জনসভা। টনক নড়ে মুজিব সরকারের। অলি আহাদের কাছে আসে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব। প্রত্যাখ্যান করে শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন গণতান্ত্রিক আচরণ করতে; দেশের স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিতে। জনসভায় জারি হল ১৪৪ ধারা। ২৫শে জুন আরেক কর্মসূচির গতিরোধ করতে ১৪৪ ধারা জারি করলে অলি আহাদ হাইকোর্টে রিট করেন। ৩০শে জুন অলি আহাদকে গ্রেফতার করে পাঠানো হল কারাগারে। মওলানা ভাসানী হলেন অন্তরীণ। এদিকে হাইকোর্টে বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী ও দেবেশ ভট্টাচার্য গঠিত বেঞ্চ ১৪৪ ধারা জারির আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করল। সরকারকে করল অর্থদণ্ড। নির্দেশ দেয়া হল অলি আহাদকে ১৫টি স্বর্ণমুদ্রা মামলার খরচ চালানো বাবদ প্রদান করতে। ১৯৭৪ সালের ১৭ই জুন শেখ মুজিবের শাসনামলে বিরোধী দলের সর্বশেষ জনসভা হয় পল্টনে; অলি আহাদের মুক্তির দাবিতে। এরপর দেশের আর কোনো রাজনৈতিক দলকে জনসভা করার অনুমতি দেয়নি মুজিবের সরকার। ১৯৭৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। ২৫শে জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয় সব রাজনৈতিক দল। ১৬ই জুন বন্ধ করে দেয়া হয় সব সংবাদপত্র। সংবিধানে নিয়ে আসা হয় চতুর্থ সংশোধনী। হত্যা করা হল গণতন্ত্রকে। চালু হল একদলীয় বাকশালি দুঃশাসন। অলি আহাদ তখন জেলে। এরই মধ্যে ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন মুজিব। ২৪শে আগস্ট কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি।

স্বাধীন বাংলাদেশে অলি আহাদকে জেলের ঘানি টানিয়েছে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারও। তিনি আবার এ মহানায়ককে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে জেল খাটিয়েছিলেন। অলি আহাদের অপরাধ (!) তিনি আওয়াজ তুলেছিলেন ‘অলি আহাদের এক আওয়াজ, খতম কর সেনাপতি রাজ। স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক আদালত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অলি আহাদকে দোষী সাব্যস্ত করে। বন্ধ করে দেয় তার অসমসাহসী সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ। এই ইত্তেহাদ ছিল অলি আহাদের চিন্তা-চেতনার মুদ্রিত নমুনা। এ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামের ওপর ছাপা হত ‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির/ভয়ে মরে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর’। এ তো আসলে অলি আহাদের জীবননিঃসৃত বাণী।

এই সামরিক আদালতে ১৯৮৪ সালের ৮ই অক্টোবর জননেতা অলি আহাদ যে জবানবন্দি দেন, তা সব বিবেচনায়ই আমাদের জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য দলিল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ : আমার বিবেক আর আজীবন রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের কাছে বিশ্বস্ত থেকে আমি বলতে চাই যে, তাত্ত্বিক কিংবা আদর্শগত কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই সামরিক আইন প্রশাসন আমার কাছে গ্রহণীয় নয়, যিনিই এটা জারি করুন না কেন; হোন তিনি জেনারেল আইয়ুব, অথবা জেনারেল ইয়াহিয়া অথবা লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান অথবা মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর কিংবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচএম এরশাদ। বিচারাসনে উপবিষ্ট হওয়া মাননীয় আদালতের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে ১৯৮২ সনের ২৪শে মার্চের মার্শাল ল প্রক্লামেশন। যেহেতু সামরিক আইন একটি বাস্তবতা; সেহেতু আমাকে মাননীয় আদালতকে মানতে হয়। আধুনিক ইতিহাস রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জেনারেলদের অধিষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের শাসন তাদের স্ব স্ব দেশ ও জনগণের জন্যে বয়ে এনেছে বিপর্যয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, নবাব সিরাজদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খান বাংলাকে দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য দায়ী। এ শৃঙ্খলের পথ ধরেই ভারত ১৯০ বছর ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সের বিপর্যয় ডেকে আনে। জার্মানির হিটলার সভ্যতাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে। গণতান্ত্রিক সিস্টেমেও জেনারেলদের শাসন আকর্ষণীয় কিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল আইসেন হাওয়ার (আইখ) সোভিয়েত রাশিয়ার আকাশে ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান পাঠিয়ে ৬০ সনে প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রপ্রধানদের শান্তি-সম্মেলন বিপর্যস্ত করে ফেলেন। জাপানের জেনারেল তোজো তার দেশকে উপহার দিয়েছেন পরাজয় আর বিপর্যয়। সাম্প্রতিক কালের সমর-নায়কদের শাসনের ইতিহাসও চরম ব্যর্থতার আলেখ্য। জেনারেল আইয়ুব, আর্জেন্টিনার জেনারেল গলতিয়ারী, বার্মার জেনারেল নে উইনের শাসন এই নির্মম বাস্তবতারই প্রমাণ বহন করে।

চার

সব বিবেচনায়ই অলি আহাদ, আমাদের এই লিলিপুট সময়ে আশ্চর্য এক নাম। আশ্চর্য এবং সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আমাদের দূষিত, বিষাক্ত, গলিত পুঁজের মত রাজনীতির প্রবল প্রতিপক্ষ তিনি। আজীবন উজান স্রোতের যাত্রী। আমাদের রাজনীতির শেষ সত্যনিষ্ঠ নক্ষত্র। এস ওয়াজেদ আলীর গ্রানাডার শেষ বীর। আমাদের নিঃসঙ্গ আবু জর গিফারী। বাংলাদেশের অপরাজেয় সত্তার সর্বশেষ আপোসহীন বিদ্রোহের আগুন। তিনি দলের নন, তিনি সার্বজনীন। স্বাধীনতার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য তিনি উৎসর্গ করে গেছেন পুরো জীবন। যতক্ষণ দেহে ছিল প্রাণ-অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে চালিয়ে গেছেন তার অনন্যসাধারণ লড়াই। ক্ষমতার লোভে, শাসকের রক্তচক্ষুর ভয়ে, জেল-জুলুমের ভয়ে কখনোই আদর্শনিষ্ঠ কর্তব্যবোধ থেকে তিনি পিছিয়ে যাননি। এজন্য তাঁকে মাশুলও দিতে হয়েছে চড়া। কিন্তু হয়ে উঠেছেন দৃষ্টান্ত। নজিরবিহীন আইকন। কে কী বলল, কে কী ভাবল, কে সঙ্গে থাকল আর কে থাকল না—এই মুদি দোকানদারমার্কা রাজনীতি অলি আহাদের নয়। তিনি আজীবন ছিলেন পরোয়াহীন। এজন্যই তিনি অলি আহাদ, আমাদের শত সর্বনাশের মধ্যেও অনুপ্রেরণার বাতিঘর।

বাংলাদেশের চোর, দুনীতিবাজ, মতলববাজ, মুনাফিক, প্রতারক, জালিয়াত, দেশদ্রোহী, জাতিদ্রোহী, মিথ্যাবাদী, আত্মসর্বস্ব রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের চোখে তিনি ‘মিস ফিট’। তাদের কাছে অলি আহাদ ‘মিস ফিট’ হতেই পারেন; কারণ তাদের চোখগুলোতো আর মানুষের চোখ নয়, সেগুলোতোলোভের লালায় গলে পচে পরিণত হয়েছে ভাগাড়ের বিষ্ঠায়। সেজন্য অলি আহাদকে পরিমাপ করতে হলে যে ন্যায়-নীতি, অঙ্গীকার, সততা, সাহস, দৃঢ়তা, আপসহীনতা, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম থাকতে হয়, তা এই ক্ষুধার্ত শকুনরা পাবে কোথায়!

নজরুলের কবিতার মত ‘চির উন্নত মম শির’ নিয়ে সেই যে চল্লিশের দশকে যাত্রা শুরু করেছিলেন অলি আহাদ, তা মৃত্যু এসে দরোজায় কড়া নাড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত একই অবস্থায় ছিল। ছিল বলেই যেখানেই দেখেছেন মিথ্যা, যেখানেই দেখেছেন ভণ্ডামি, সেখানেই বারুদের মত জ্বলে উঠেছেন। করেছেন। বিদ্রোহ। জামা ধরা, ধামা ধরা রাজনীতিবিদদের সাধ্য কোথায় এ মহিমান্বিত সততার কাছাকাছি যাওয়া?

১৯৯৯ সালের ১২ই মার্চে তাকে দেয়া নাগরিক সংবর্ধনার জবাবে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের যেসব বীরকে তিনি স্মরণ করেছিলেন, তা-ও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য :

দল ও মতের পার্থক্য সত্ত্বেও আজ আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপকার শহীদ তিতুমীর, ফকির মজনু শাহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন ফরওয়ার্ড ব্লক, নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টি, অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের আত্মত্যাগকারী নির্যাতন বরণকারী অগণিত নেতাকর্মী, কথা ও কবিতায় স্বাধীনতার প্রথম উচ্চারণকারী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রাজনৈতিক মঞ্চে ভারতের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক মওলানা হাসরত মোহানীকে। তারাই আমাদের পথপ্রদর্শক। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আমাদের ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার স্বাধীনতা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নির্যাতন বরণকারী শহীদান, নেতা ও কর্মীদের। আপনারা আমার অনুভূতি জানতে চেয়েছেন। প্রায় অর্ধশতাব্দীর আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অবিমিশ্র নয়। কখনও আনন্দ, কখনও বিষাদ, কখনওবা ক্ষোভের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে সময়। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে পদে পদে। দেখেছি ব্যক্তিস্বার্থের হীন যূপকাষ্ঠে জাতীয় স্বার্থ বর্জনের নোংরা খেলা। কপটতা ও ওয়াদা ভঙ্গের এই হীনম্মন্যতার মধ্যেও আবার দেখেছি অদম্য অনির্বাণ জীবনের দিকে অকুতোভয়ে এগিয়ে গেছে দেশপ্রেমিক জনতা।

তারা কিছুতেই পরাভব মানেনি কোথাও। এই যে জাতীয় বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং পরাভব না-মানা দেশপ্রেমিক জনতা, তারাই অলি আহাদের জীবন, প্রাণ, প্রাণের মর্মবাণী। এই মর্মবাণী তিনি পেয়েছিলেন :

অনেক মহান মহাপুরুষের একান্ত সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বাংলার স্বাধীনতার অকুতোভয় সেনাপতি, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও রেনেসার মর্মবাণীতে অবগাহিত দার্শনিক রাজনীতিবিদ ৪০-এর দশকে নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য আমার কিশোর মনে অগ্রসর ও সংগ্রামী চিন্তা-চেতনার বীজ বপন করে। বিদায় বেলায় তাই তো তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় আশা, আশাবাদ। আবার কিছুটা সূক্ষ্ম বেদনার ছিটা।

তারপরও একমাত্র অলি আহাদই বলতে পারেন :

আমার জীবনসূর্য আজ পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। কিন্তু আমি জানি জীবন কখনও থেমে থাকে না এবং সম্ভাবনার কোন শেষ নেই। ৮০ বছর বয়সে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মহাপ্রলয়ের পর মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের এক নবীন সূর্যোদয় হবে। আমার জীবনে সে সূর্যোদয় আমি দেখে যেতে পারব কি না জানি না। কিন্তু এদেশের তরুণ সমাজের কাছে আমি আবেদন জানাব, সত্য প্রতিষ্ঠায় আপনারা ব্ৰতী হউন।

হিরন্ময় আশাবাদ নিয়ে আপনারা সত্য ও সুন্দরের অভিযাত্রায় অকুতোভয়ে এগিয়ে চলুন। দেশের আজাদীর ঝাণ্ডাকে উডডীন রাখুন। কেবল মন্ত্রিত্বের জন্য রাজনীতি করবেন না, নব ইতিহাস সৃষ্টির দুর্নিবার প্রেরণায় এগিয়ে চলুন। পবিত্র হোক আপনাদের অভিযাত্রা। সুন্দর ও দীপ্ত হোক আপনাদের আত্মপ্রকাশ।

আজকের উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করব না। আমার কাছে হয়তো আপনাদের প্রত্যাশা অনেক কিন্তু সাধ্য আমার সীমিত। তবুও দৃঢ়তার সঙ্গে বলব, আমার যা দেবার দিতে আমি দ্বিধা করব না। কোনো দিন দ্বিধা করিনি। জীবনে কি পেয়েছি কি পাইনি এ হিসাব আমি কোনো দিন করিনি। যা কিছু সত্য, সুন্দর ও ন্যায় বলে জেনেছি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার জন্য করেছি সর্বস্বপণ। সেজন্য আজ যখন জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকাই, তখন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারি। না, মালিন্য কোথাও নেই। গ্লানিকর কিছু কোথাও নেই। সেজন্য আশা হয়, যখন পরম সত্তার মাঝে বিলীন হয়ে যাবে আমার অস্তিত্ব, তখন নিশ্চয় এই প্রসন্নতার ছটাটুকু লেগে থাকবে আমার অবয়বে। যদি তা থাকে, তাতেই আমি ধন্য। পরিশেষে বলি, বাংলাদেশ চিরকালের সংগ্রামের দেশ। বাংলাদেশকে জন্ম দিতে হয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বাচতেও হবে সংগ্রাম করে। সেই সংগ্রামের তরবারিতে যেন কখনও মরিচা না ধরে। আর কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন

সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের,

দেশের তরে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের।

কবির এই আহবানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যেন আপনারা অনুধাবন করতে পারেন, সেভাবে চলতে পারেন, সেটাই আমার স্বপ্ন, আমার প্রত্যাশা।

পাঁচ

চিরবিদ্রোহী অলি আহাদ নেই। গত ২০শে অক্টোবর ২০১২, তিনি চলে গেছেন। অনন্ত অসীমের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে তার আত্মা। বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তার লাশ। আমাদের চোখের সামনে তিনি নেই। কিন্তু এ কথা কে জানে, তিনি ঠাই নিয়েছেন আমাদের নয়নের মাঝখানে। আমাদের প্রাণের নিবিড়তম নির্জনতায়। তিনি যেমন আমাদের আজকের অবলম্বন, তেমন ভবিষ্যতেরও পাথেয়। আমাদের জীবনের সব কূল-উপকূল আগলে দাঁড়িয়ে আছে যে বিরক্তিকর রাজনীতি, তার পতন ঘটবেই এক সময়। তখন আবার অলি আহাদের গুরুত্ব নতুনভাবে প্রতিভাত হবে। আমাদের আজকের বিভ্রান্ত তারুণ্য আবার পথের দিশা নিতে জানু পেতে বসবে অলি আহাদের জীবন ও কর্মের কাছে। তার একমাত্র গ্রন্থ জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ তখন হয়ে উঠবে আমাদের প্রাণের মহাকাব্য।

আর আজ এ মুহূর্তে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করছি—বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে, বাংলা ভাষায় যতদিন। মানবজাতি কথা বলবে, ততদিন অলি আহাদ বরিত হবেন ভাষাবীর হিসেবে, ভাষানায়ক হিসেবে। তিনি অন্যরকম এক উচ্চতায় নিজেকে স্থাপন করে অজর, অমর হয়ে গেছেন। আমাদের নিচুতা ও ক্ষুদ্রতার সাধ্য কী তাকে মলিন করে!

জননায়ক অলি আহাদের মুখোমুখি

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: আবদুল গফুর ও আবদুল হাই শিকদার

আমাদের রাজনৈতিক গগনের প্রবীণ নক্ষত্র, এই মুহূর্তে জাতির অভিভাবক হিসেবে, বিবেক হিসেবে সবাই যাকে মনে করছি, জাতীয় নেতা অলি আহাদ সত্যিকারের অর্থে এখন আর কোনো ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়। অলি আহাদ একটি বিশেষণ। একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের চিরকালের আপোসহীন বিদ্রোহের একটি বিশেষ ধারা। এজন্য নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের একজন হয়েও তিনি সার্বজনীন। তাঁর নাম উচ্চারণ মাত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে এমন একটি প্রতিকৃতি যিনি আজীবন ব্যক্তির উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন জাতীয় স্বার্থকে। কে কি ভাববে, কে কি বলবে, এ নিয়ে অলি আহাদের তেমন একটা মাথাব্যথা কোনো কালেই ছিল বলে মনে হয় না। যা তিনি বোঝেন, যা তার বক্তব্য, তা তিনি অকপটে, সরবে, সহজ-সরলভাবে উচ্চারণ করেছেন অকম্পিত কণ্ঠে। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা অনেকটা নায়কের মত। তিনি ‘৬৯ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠনের চিন্তা করেছিলেন। ‘৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন আগরতলায়। কাগমারী সম্মেলন থেকে অলি আহাদকে বাদ দিলে লাবণ্য হারিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের জনকদেরও একজন তিনি। জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ‘৪৮-এ প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ। আওয়ামী লীগের প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক, ন্যাপের প্রথম যুগ সম্পাদক, এরপর জাতীয় লীগের সাধারণ সম্পাদক, ডিএল-এর সহসভাপতি। তার সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থান ডিএল-এর সভাপতি পদে। দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে এই টালমাটাল রাজনৈতিক সংকটে তিনি আমাদের সেই আগের মতই অনুপ্রাণিত করছেন। দিচ্ছেন নির্দেশনা। বয়সের ভারে হয়তো তিনি কিছুটা ক্লান্ত। কিন্তু অন্তরে আজও রয়ে গেছে সেই অনির্বাণ তারুণ্য। অলি আহাদ ইতিহাস। অলি আহাদ ইতিহাসের সাক্ষী। সেই সাক্ষীর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের অতীত ও বর্তমান। যার উপর দাঁড়াবে ভবিষ্যৎ। আজকের ও আগামীকালের জানা-অজানা, অনাগত পাঠকের স্বার্থে তার সকল প্রিয়-অপ্রিয় উচ্চারণ ধারণ করার জন্য দৈনিক ইনকিলাব থেকে তার বাসভবনে গিয়েছিলাম গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮। এই সাক্ষাতকার গ্রহণ ও গ্রন্থনা করেছেন ভাষাসৈনিক, ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গফুর ও বিটিভির ‘কথামালা’র উপস্থাপক কবি আবদুল হাই শিকদার। সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন ফাহিম ফিরোজ, লুৎফুল খবীর, সৈয়দ মুজাম্মেল হোসেন, ওবায়দুল হক মাশকুর, মুন্সী আবদুল মজিদ, সাইফুদ্দীন মনি ও অধ্যাপক মোমেনুল হক।

আবদুল গফুর : জনাব অলি আহাদ যে শুধু ভাষা আন্দোলনের সৈনিক বা সেনাপতি ছিলেন, তা নয়। তার একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ও উজ্জ্বল অতীত রয়েছে। আমার মনে হয় যে, আমরা প্রথমে তার উজ্জ্বল অতীত সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি।

আপনি রাজনীতিতে আসলেন কীভাবে এবং কি লক্ষ্যে?

অলি আহাদ : আমার যখন কিশোর বয়স বা কিশোর বয়সের চেয়েও বেশি বা কম, সেই বয়সে বাসায় আব্বা কয়েকটি পত্রিকা রাখতেন। এর মধ্যে সওগাত, মোহাম্মদী, আজাদ, স্টার অব ইন্ডিয়া। ঐ সব পত্রিকায় মাঝে মাঝে মোহামেডান স্পাের্টিং-এর খবর পড়তাম। এবং তার খেলা যেদিনই দেখেছি। সেদিনই মনটা উৎফুল্ল থাকত যে জিতেছে। এবং জেতার পর তারা কাপ নিয়ে গেল এবং কয়েক বছর ধরে একাধারে মোহামেডানের জয় হতে লাগল। এটা আমার মনের মধ্যে আস্তে আস্তে রেখাপাত করতে লাগল। আবার আব্বাসউদ্দীন সাহেব গায়ক। উনি কবি নজরুল ইসলামের গান বিভিন্ন সময়ে রেকর্ড করেন। ঐ সময় গ্রামোফোন চলত, গ্রামোফোনে তাঁর গান শুনতাম। নৌকা যাচ্ছে, কলের গান বাজছে। তখনকার দিনে গ্রামোফোনকে বলত কলের গান তা আমরা শুনতাম যে নৌকা যাইতেছে, গান হইতেছে। উদ্বুদ্ধ হইতাম যে আমরা মুসলমান, মুসলমানদের কথা সেখানে আসতেছে, ইসলামের কথা আসতেছে। নামায রোজার কথা আসতেছে, ঈদের কথা, রমজানের কথা আসতেছে। এর ফলে আমার মনের একটা পরিবর্তন হতে লাগল। পাশাপাশি আমি যখন স্কুলে পড়ি, আমার সাথে যে ছাত্রটি ছিল, কোনো সময় সে ফাস্ট হত কোনো সময়ে আমি। কিন্তু যে বছর আমি সেকেন্ড হয়েছি সে বছর আমি দেখেছি যে আমার নম্বরটা কোথায় যেন গোলমাল হয়েছে। এটা আমার কিশোর মনের বিশ্বাস। এর আমি কোনো প্রমাণ দিতে পারব না। কিন্তু প্রমাণ না দিতে পারলেও বোঝার মত সেই শক্তিটুকু ছিল যে, এখানে হয়তো অঙ্কে আমার এই নম্বরটুকু পাওয়া উচিত ছিল। বাংলায় হয়তো এ নম্বর পাওয়া উচিত ছিল, সেটা পাই নাই। সেকেন্ড হয়েছি। আবার কোনো কোনো বছর ফাস্ট হয়েছি। এগুলো আমার মনে কাজ করত যে আমার শিক্ষকবৃন্দ যখন এইরকম, তার মধ্যে সামাজিক অবস্থা যে, আজান দিতে গেলে, পাশে হিন্দু বাড়ি থাকলে, উলু ধ্বনি হলে পরে, আবার মোরগ রাখলে মোরগ তাদের বাড়ি গেলে, সেখানে মোরগটাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করত। কারণ, তাদের নাকি এতে শুচি থাকত না। এসব কারণে আমার মনের মধ্যে আস্তে আস্তে গভীর রেখাপাত করতে লাগল যে, মুসলমানদের এখন বোধ হয় আলাদাভাবে চলতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো পথ নাই। আবার গ্রামে যেহেতু থাকতাম। কোনো কোনো সময় গ্রামে দেখতাম যে, মহাজন, তারা আইসা বাড়ির সোহরাওয়ার্দী সাব-জিন্দাবাদ। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও রবুবিয়াতের ধারও ধারেন না। বুঝেন না। এই ছিলেন শেখ সাহেব। শেখ সাহেব পাকিস্তানের পক্ষে, মুসলমানের পক্ষে তখনকার দিনে একজন অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ছিলেন। এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি বিহারে যখন মুসলমানদের কচুকাটা করা হয় তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রাইম মিনিস্টার। তখনকার দিনে বেঙ্গলের যে মুখ্যমন্ত্রী তাকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত। প্রাইম মিনিস্টার থাকাকালে উনি বিহারেও যাতে কাজ করা যায় তার চেষ্টা করেছেন। আবার গণভোট ‘৪৭ সালে যখন হয়, সেই গণভোটেও তিনি সিলেটে কাজ করেছেন। শেখ সাহেবের অবদানের কোনো শেষ নেই। উনি সেনাপতি ছিলেন না, কিন্তু অবদান ছিল অনেক।

অধ্যাপক মোমেনুল হক : এ কথাটা বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একটা মহল বলছে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। অখণ্ড ভারতের পক্ষে ছিলেন।

অলি আহাদ : সর্বৈব মিথ্যে কথা। এ কথার যে জন্ম দিয়েছে, তাকে আমার শক্ত ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় তার বাপের…। এবং তারা দিল্লির দালাল।

আবদুল হাই শিকদার : এবং তারা শেখ মুজিবকেও ভালোবাসে না।

অলি আহাদ : শেখ মুজিবকেও ভালোবাসে না। তারা দালালী করার জন্য, শেখ সাহেবকে ব্যবহার করার জন্য যেটা দরকার, সেটা করে।

আবদুল গফুর : কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে দ্বি-জাতি তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন, যার ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন হল এবং যার ভেতরে আপনি একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন, সেখানে শেখ সাহেবকেও দেখা যায়, এ ব্যাপারে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্র সমাজের ভেতরে। তাহলে কি আমরা বলব যে, তিনিও দ্বি-জাতি তত্ত্ব বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছেন তখন? অলি আহাদ : একশ’ পারসেন্ট। একশ’ ভাগ। তিনি হানড্রেড পারসেন্ট, বরং একটা সেকুলার স্ট্যান্ড আমাদের মনের মধ্যে ছিল। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে রয়টারের রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাম্বলে যখন প্রশ্ন করলেন Well Qaid-e-Azam! Would it be a theocratic state, if Pakistan is achieved as a secular state? Qaid-e-Azam replied, it would be a secular state. আমরা এটার পক্ষে ছিলাম। শেখ সাহেব এটার পক্ষে ছিলেন। উনি সেকুলার স্টেটও বুঝতেন না, থিওক্র্যাটিক স্টেটও বুঝতেন না। এর চেয়ে নির্মম সত্য নেই। এখন কেউ যদি বানিয়ে বলেন যে, উনি বুঝতেন থিওক্র্যাটিক স্টেট, ওনারে দিয়ে মুজিববাদ লেখিয়েছেন, যেটা জীবনেও উনি লেখেন নি, এটা লিখতে জানেনও না, জানলে তো উনি লিখবেন। সুতরাং উনি থিওক্র্যাটিক স্টেট বলেন, আর ডেমোক্র্যাটিক স্টেট বলেন, সেকুলার স্টেট বলেন, পিপলস স্টেট বলেন উনি কিছুই বুঝতেন না। উনি একটা জিনিস বুঝতেন—ক্ষমতা চাই এবং ক্ষমতা পেতে হলে একটা বাহন দরকার। সেই বাহন সোহরাওয়ার্দী সাহেব। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পিছনে থাকলে ক্ষমতা পাওয়া যাবে। তিনি ফাইটিং এলিমেন্ট ছিলেন। এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ষমতাকে লক্ষ করে ফাইটিং। আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন না।

আবদুল হাই শিকদার : আচ্ছা, তাহলে আমরা একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি যে, সেদিনকার পাকিস্তান মুভমেন্টে বাংলাদেশের মুসলমানদের যে একটা বিরাট অংশগ্রহণ ছিল এটার সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ডটা কি? কেন সেই সময়ে বাংলাদেশের মুসলমানরা পাকিস্তানের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? এবং তারাই পরবর্তীকালে দেখা গেল পাকিস্তান ভাঙল। মুক্তিযুদ্ধ করল।

অলি আহাদ : প্রথম কারণ হল। বাঙালিরা, বঙ্গবাসী মুসলমানরা ধর্মভীরু ছিল। ১৯৭৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার ফলে মুসলমানরা সর্বস্বান্ত হল। মুসলমানরা জমিজমার উপরই নির্ভরশীল ছিল। জমিদার বলতেও তারাই ছিলেন, জায়গীরদার বলতেও তারাই ছিলেন, চাষী বলতেও তারাই ছিলেন। সুতরাং তাদের সেই অধিকারটা হিন্দুদের হাতে যখন চলে গেল, জমিদারী অর্থাৎ জমির মালিকানা এবং মধ্যস্বত্বভোগী যখন তারা হল, তখন মুসলমানদের উপর আস্তে আস্তে মহাজনী এবং নানাভাবে অত্যাচার আরম্ভ হয়। এতে মুসলমানদের মনে আস্তে আস্তে বিরূপ মনোভাব এসে গেল। তারা চেয়েছে যে, তাদের থেকে আমরা মুক্তি চাই। এই হল প্রথম সামাজিক কারণ। এই সামাজিক কারণে পরবর্তীকালে ইসলামের প্রতি তাদের সে বন্ধনের কারণটা হল, ইসলাম তারা গ্রহণ করেছে, ইসলাম যদি রক্ষা না পায় হিন্দুদের যে অত্যাচার হবে সে অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়া দায়। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্রের বই লেখা এবং ঐ হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার করা। আবার মুসলমান হিন্দুর বাড়িতে গেলে হুক্কাতে তামাক খাইতে না দেয়া, পানি চাইলে পরে পানি উপর থেকে ঢেলে দেয়া। আমরা হা-করে সেই পানি খেতাম। এই ধরনের অত্যাচার ছোট ছোট অত্যাচার, কিন্তু এই অত্যাচার সামাজিক অত্যাচারের অন্তর্ভুক্ত এবং এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা ছিল বলেই যখন স্লোগান উঠল মুসলমানের জন্য ইসলামী স্টেট হবে। মুসলমানের কৃষ্টি রক্ষা পাবে। মুসলমানের আবাসভূমি হবে, তাদের তাহজীব তমদ্দুন রক্ষা পাবে, মক্কা মদীনায় যেতে পারবে; এই ধরনের মনোভাব তাদের মধ্যে দৃঢ় হয়েছিল। আর চাকরি বাকরি, দেখা যেত মুসলমানরা বিএ পাস করলেও চাকরি পায় না। আর হিন্দু ম্যাট্রিক পাস না করলেও তার চাকরিটা দাদা দাদা করে হয়ে যায়। এটাও আরেকটা কারণ এবং এটা বোধ হয় মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তীকালে। এই মুখ্য কারণই গিয়ে দাঁড়ায় সব হিন্দুরা নিয়ে গেল, মুসলমানদের কিছু দিবে না এবং তার জন্য মুসলমানরা এই দাবির পিছনে সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং এরই কারণে সেই নির্বাচনে জয়ী হয়।

আবদুল গফুর : আচ্ছা অলি আহাদ ভাই, আপনি তো শেখ সাহেবের সাথে কলকাতা থেকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।

অলি আহাদ : খুব ঘনিষ্ঠ।

আবদুল গফুর : তাহলে এই যে একটা কথা বলা হয় যে, শেখ সাহেব পাকিস্তান আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না। আপাতত সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে ছিলেন এবং ‘৪৭ সাল থেকেই তিনি পাকিস্তানকে ধ্বংস করে বা এটাকে অবলুপ্ত করে একটা স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য চিন্তা করছিলেন—এ ব্যাপারে আপনার কি মতামত?

অলি আহাদ : কমুনিস্ট পার্টি, পাকিস্তান হওয়ার পর পাকিস্তানকে নিন্দা করত এ কথা বলে আরে পাকিস্তান একটা স্টেট না কি? রানাঘাট টু কলকাতা, রানাঘাট টু কলকাতা ট্রেনে যেমন চিল্লাচিল্লি হয় ঠিক এই রকম একটা স্টেট। শেখ সাহেব এই কথা শোনার পরে খুব রাগ হয়ে গেলেন। তিনি আমাকে একদিন বললেন যে, অলি আহাদ দেখছসনি, এরা কয় কি? রানাঘাট টু কলকাতা হয়। এই শুয়োরের বাচ্চাদের সঙ্গে থাকা যাবে না। তাগোরে শিক্ষা দিতে হইব। অহন তাইলে কেমনে দিবেন? তখন ময়মনসিংহে একটা মিটিং ডাকা হইছিল ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের। বললেন, চল যাই। আমি তো যাবই। আমি গিয়া ঐটা ভাইঙা দিয়া আসি এবং তিনি গেলেন সেখানে এবং ভাইঙা দিলেন ঐটাকে। ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নকে আর দাঁড়াতেই দিলেন না। শেখ সাহেব পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন না বিপক্ষে ছিলেন এটাই তার প্রমাণ।

আবদুল হাই শিকদার : বদরুদ্দিন উমর তার বইতে লেখেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ‘৪৮-এর ১৬ই ফেব্রুয়ারি শেখ সাহেব টুপি মাথায় দিয়া মিটিংএ প্রিসাইড করতে বইসা গেলেন….

অলি আহাদ : হ্যা, ১৬ই ফেব্রুয়ারি। ১লা মার্চ ও ১৬ই মার্চের সেই মিটিংয়ে তিনি প্রিসাইড করলেন এবং সেখানে তিনি পরিষ্কারভাবে বললেন, পাকিস্তান ভাঙার জন্য যেকোনো চেষ্টা হবে সেই চেষ্টা আমরা বাধা দেব। আমরা আন্দোলন করি ঠিক আছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ঠিক আছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে পাকিস্তানকে ভাঙা হবে। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে আসতেছেন আমরা এর পর আন্দোলন বন্ধ করে দেব। বন্ধ করে দিয়ে আমরা কয়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে রিসিভ করব। আমাদের নেতা, আমাদের পাকিস্তানের স্রষ্টা, পাকিস্তানের জনক। সুতরাং পাকিস্তান সম্পর্কে শেখ সাহেবের যে ধারণা এটা তো আমরা ভালো বলতে পারব। আর একটি কথা পরিষ্কার, তখনকার দিনে ‘৪৭-এর একটা কথা ছিল যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা ছিল। স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গভূমি কি? সোহরাওয়ার্দী সাহেব, আবুল হাশিম সাহেব, শরৎ বোস তারা যে Independent Bengal-এর Plan Acs19679 As a declaration of Cabinet Mission Plan, As a declaration of grouping তার বিরুদ্ধে তারা যে আওয়াজ তুলেছিলেন সেটা হল স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গদেশ। তখনকার দিনে দুইটি শ্লোগান ছিল শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যে, বঙ্গভূমিকে দুই ভাগ করে ফেলা হবে। এক ভাগ হবে পশ্চিমবঙ্গ, অন্যটি হবে পূর্ববঙ্গ। আমরা মুসলমানদের সাথে থাকব না বা যদি কেবিনেট মিশন প্লান গৃহীতও হয় এরপর যদি ভারত প্রতিষ্ঠিত হয় তথাপিও আমরা মুসলমানদের সাথে থাকব না। আমরা পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ দুই ভাগে বিভক্ত বঙ্গদেশ গড়ব। আমরা মুসলমানদের সাথে থাকব না। আবদুল গফুর : অর্থাৎ উনি বলেছিলেন বোধ হয় একটি কথা, ভারত যদি ভাগ নাও হয় তবু বাংলা ভাগ করতে হবে। কারণ তারা মুসলমানদের রাজত্বে থাকতে চায় না।

অলি আহাদ : ঐটাই বলেছিলেন। এ ব্যাপারে পণ্ডিত নেহেরু, প্যাটেল, আচার্য কৃপালিনী, গান্ধী তারা সবাই চেয়েছিলেন যে বঙ্গ বিভক্ত হোক এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনাইটেড বেঙ্গল হোক—এটা তারা চাননি। তাদের চিন্তার বিরুদ্ধে ছিল যাকে এত কথা বলা হয়, তার নাম কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়াদী সাহেবের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ঘোষণা দিলেন–বেঙ্গল ইন্ডিপেডেন্ট সভরেন এবং আমরা সেই দাবিটা সমর্থন করি। কিন্তু গান্ধীজি সেই সময় ঢাকাতে। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি তখন আসলেন মিটিং করার জন্য। সেই মিটিংটা ছিল করোনেশন পার্কে, সদরঘাটে। এবং সেই মিটিংয়ে তার দাবি ছিল বঙ্গভঙ্গ করতে হবে। যে। হিন্দুরা একবার বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ১৯০৫ সালে, সেই হিন্দুরাই শ্যামা প্রসাদের প্ররোচনায়, গান্ধীজির প্ররোচনায়, নেহেরুর প্ররোচনায়, প্যাটেলের প্ররোচনায় এবং সামগ্রিক কংগ্রেসের প্ররোচনায় (কংগ্রেসের কিছু অংশ বাদ দিয়ে) কিরণ শংকর রায়ের কথা বলি, শরৎচন্দ্র বোসের কথা বলি, এসএম দাসগুপ্ত—তাদের কথা বলি। তারা সবাই ইন্ডিপেন্ডেন্ট বেঙ্গল সভরেন বেঙ্গল-এর পক্ষে ছিলেন। কিন্তু আর বেশির ভাগ কংগ্রেস ছিল বঙ্গভঙ্গের পক্ষে। যারা নাকি বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে ছিলেন ১৯০৫ সালে তারাই পরবর্তীকালে দেখা গেল বঙ্গভঙ্গের পক্ষে এবং কলোনিয়াল লাইনে সেই বঙ্গভঙ্গ হওয়া চাই। তারা ন্যাশনালিস্ট ছিল না, সেকুলার ছিল না, তাদের কার্যকলাপে প্রমাণ আছে তারা কন্যুনাল। সে অবস্থায় যাকে কমুনাল বলা হয় কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তারা ঘোষণা করলেন আমরা সভরেন বেঙ্গল, ইউনাইটেড বেঙ্গল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বেঙ্গল চাই, সেটা আমাদের দাবি। আমরা এটা ডিভিশন চাই না। সে অবস্থায় শেখ সাহেব, আমরাও যখন পাকিস্তান হল, আমাদের মনে মনে একটা কথা ছিল, আমরা উচ্চারণও করেছি জায়গায় জায়গায় যে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আমরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট, সভরেন বেঙ্গল চাইতে গিয়ে যা যা সংগ্রাম করা দরকার সেই সংগ্রাম আমরা করব। এই একটা সাধারণ আবহাওয়া আবুল হাশিমের যারা আমরা সমর্থক ছিলাম। তা আমাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু শেখ সাহেব, ঐ, তার অংশ হিসেবে হয়তো বলতে পারে আমি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ চাই। কিন্তু তা বললে পরেও শেখ সাহেবের কার্যকলাপে পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়েছে অন্য রকম। সেটা ১৯৫৬ সালে মন্ত্রী যখন ছিলেন তখনকার অবস্থা পরবর্তীকালের অবস্থা যোগ-বিয়োগ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শেখ সাহেবের কোনো প্রকার নীতি পরিষ্কার ছিল না। উনি বঙ্গভঙ্গ চান, যদি ক্ষমতায় থাকতে পারেন। উনি বঙ্গভঙ্গ চাই না যদি ক্ষমতায় না থাকতে পারি, আর অখণ্ড বঙ্গ চাই, যদি ক্ষমতা আমার হয়। আর যদি ক্ষমতা হয় তাহলে অখণ্ড বঙ্গ হোক আর না হোক, আমার কিছু আসে যায় না। শেখ সাহেব ছিলেন এ ধরনের লোক। অর্থাৎ তার উপরে এ কথা আরোপ করা হয় যে, ‘৪৭ সাল থেকে তিনি অখণ্ড বঙ্গের পক্ষে ছিলেন, এ কথা সত্য নয়।

আবদুল হাই শিকদার : এখানে একটা কথা। ‘৪৭-এর পরবর্তীকালে আপনি বলেছেন ‘৬০-এর দশক পর্যন্ত শেখ সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশ বা স্বাধীন বঙ্গের কোনো কাজ করেন নাই।

অলি আহাদ : না, করেন নাই।

আবদুল হাই শিকদার : তাহলে এখন শেখ সাহেবের পরবর্তী ভূমিকাটা কীভাবে দেখবেন আপনি?

অলি আহাদ : পরবর্তী ভূমিকা? আবদুল হাই শিকদার : হ্যা। অলি আহাদ : আমি তো আগেই বলেছি। আবদুল হাই শিকদার : ‘৭০-পরবর্তী ভূমিকা, ‘৭১-পরবর্তী ভূমিকা।

অলি আহাদ : পাকিস্তান থাকতে যে ষড়যন্ত্র ছিল, সেনাবাহিনীর তরফ থেকে, কায়েমী স্বার্থের তরফ থেকে, পশ্চিম পাকিস্তানের তরফ থেকে সেখানে তার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। একথা তিনি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও প্রমাণ পেয়েছেন। যদিও তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খানের ভাষায়, তিনি যেহেতু হতে পারবেন না, সেহেতু বাংলা বললে পরে, বঙ্গদেশ যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, পরে তিনি চীফ মিনিস্টার হতে পারবেন এবং হয়েছেনও তাই। এইটুকু ক্যালকুলেশন শেখ সাহেবের পরিষ্কার ছিল। সেই আন্দোলনটার সময়, এর আগে নয়।

আবদুল হাই শিকদার : তাহলে ‘৭১ সালে এবং ‘৭১-পরবর্তী তার যে ভূমিকা এটাকে একটু আপনি ব্যাখ্যা করবেন…

অলি আহাদ : ‘৭১ সালে তিনি, তার স্বাধীনতা আন্দোলনে যে ভূমিকা ছয় দফা আন্দোলনের প্রবক্তা, ছয় দফার জন্য তার ত্যাগ আছে, ডিটারমিনেশন আছে, সবকিছু আছে। তো ছয় দফা আন্দোলন, যখন তিনি নির্বাচনে জয়ী হলেন তখন আসল পরীক্ষা শুরু হয়। ‘৭১ সালে যখন না-কি তিনি ছয় দফা দাবি করতে আরম্ভ করলেন, তখন কনফেডারেশন, প্রায় ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা করে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এই সবকিছু তখন তার কাছে এটাই ছিল যে, যদি এটা হয় তাহলে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হবে, স্বাধীন হলে আমি হব এটার রাষ্ট্রপতি এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সুনাম যা কিছু আছে সব আমার হয়ে যাবে এবং তাই সত্য। তিনি ‘৭১ সালে… এটাত চেয়েছেন সত্য, কিন্তু আবার বুকের মধ্যে সেই সাহসটা ছিল না। আমরা যখন ওনার সঙ্গে দেখা করে বললাম-“মুজিব ভাই, আপনি একটা কাজ করেন, ইউনাইটেড ন্যাশনস-এ বলে দেন যে, আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চাই এবং আমরা সাহায্য চাই ইউনাইটেড ন্যাশন্সের। তিনি বললেন, “পাগল না কি! কি কস তুই এইসব। এটা আমার দ্বারা হবে না। এটা সম্ভব না।” তাজউদ্দিন আহমদও ছিলেন তখন। তারাও সে কথাই বললেন যে, “এটা অতি বিপ্লবী কথা। আমরা এই অতি বিপ্লবী কথা বলেছি সত্য (তাদের ভাষায়), কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল যখন না-কি ২৫ তারিখে হামলা আসল, শেখ সাহেবকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সেনাপতি হিসেবে সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য, রক্তাক্ত যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য তিনি অনুপস্থিত রয়ে গেলেন। অর্থাৎ বাড়িতে থেকে গেলেন। কার পরামর্শে জানি না। পরামর্শ তো নিশ্চয়ই পেয়েছেন যে, বাড়িতে থাকলে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে এবং সেই গ্রেফতার করলে পরে, স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি চেয়েছিলেন এই কথাটা প্রমাণিত হবে এবং গ্রেফতার হওয়ার পর যে একটা আলাপ-আলোচনা সমঝোতা হয় সেই সমঝোতাতে এটাই দাঁড়াবে—শেখ সাহেব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন চেয়েছেন পূর্বাংশের জন্য কিন্তু স্বাধীনতা চান নাই। এটা প্রমাণ করার জন্যই স্বায়ত্তশাসন চেয়েছেন, স্বাধীনতা চান নাই। তার জন্যই তিনি আত্মসমর্পণ করলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জেলখানায় চলে গেলেন। এই হল তার ভূমিকা।

আবদুল হাই শিকদার : স্বাধীনতার ঘোষণা যেটা বলা হচ্ছে যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন চট্টগ্রামের জনৈক হান্নানের মাধ্যমে, এই স্বাধীনতার ঘোষণাটা কি? …

অলি আহাদ : এইটা গাঁজাখোরি গল্প। মিছা কথার কোন… ইয়ে হয় না। শেখ সাহেব ফিরে আসার পর তিনি ঘোষণা দিছেন তাই ছাপিয়ে দেয়া হয়। যেটা দাবি করে। আমার সাথে দেখা হল। আমি মুজিব ভাইকে বললাম-“মুজিব ভাই, আপনি এটা কি করলেন। আপনি তো কোন ঘোষণা দেন নাই। অথচ আপনার নামে একটা কাগজ বের কইরা দিছেন। আপনি জহুর আহমদ চৌধুরীকে টেলিফোন কইরা কি জানাইছেন? আমি নিজে জহুর আহমদ চৌধুরীর সাথে আগরতলায় আলোচনা করেছি। জহুর আহমদ চৌধুরী আমারে বলেছেন-“না, শেখ সাহেব আমাদের কোন ঘোষণা দেন নাই। আমরা জানি, “তো ঘোষণা দেন নাই, জহুর আহমদ চৌধুরী জানেন নাই, অথচ তার কাছে টেলিগ্রাম পাঠাইছেন, সেটা ছাপাইলেন কি করে? তো আমি তর্ক করলাম যে, মুজিব ভাই এ কথাটা, এ কাজ করাটা ঠিক না, আপনার উচিত ছিল—এটা মাইনা নেওয়া যে, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। এ কথা যদি বলেন তো আপনি ছোট হবেন না, আপনিই প্রেসিডেন্ট এখন। একথা আপনাকে বুঝতে হবে, চান। এটা আপনাকে জানতে হবে। অতএব, আপনি জিয়াউর রহমানকে যদি সেই ক্রেডিটটা দিতেন যে, আমার পক্ষ হইয়া না হোক, দেশের সেই ক্রান্তিলগ্নে জিয়াউর রহমানের মত একজন মেজর স্বাধীনতা ঘোষণা করায় মানুষের মনের ভিতর সাহস ফিরে আসে। এটা তো আপনার বলা উচিত। এটা বললে আপনি বড় হইতেন। ছোট হইতেন না। তিনি মুচকি হাসলেন। কোনো উত্তর দিলেন না।

আবদুল হাই শিকদার : আচ্ছা, এবার আমরা একটু ভাষা আন্দোলনের দিকে যাই। ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি তো ভাষা আন্দোলনের চরম মুহূর্ত। তো সেই ভাষা আন্দোলনে আপনার ভূমিকা এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন…

অলি আহাদ : আমি এ প্রসঙ্গে বলব না। সেটা আপনাদের বই পড়ে নিতে হবে।

আবদুল গফুর : আমি বরং একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই… এখন বাজারে একটা কথা একটা মহল প্রচার করছে, এবং প্রচুর পাঠ্যপুস্তকে জিনিসটা ছাত্রদের পড়ানো হচ্ছে যে-ভাষা আন্দোলন কিভাবে শুরু হল? শুরু হল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসলেন। তিনি বললেন যে, একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। এতে মানুষ ক্ষেপে গেল। এরপর থেকেই …এই যে, উনি তো আসলেন ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ। আমরা শুনি যে, ১১ই মার্চ আন্দোলন শুরু করেছেন এবং এটা আমরাও জানি। আপনি বলেছেন যে, ‘৪৭ সালেই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছে। তাহলে, ভাষা আন্দোলন আসলে শুরু হয়েছিল কবে? জিন্নাহ সাহেব আসার পর শুরু হল, না ‘৪৭-এ?

অলি আহাদ : অনেক আগে থেকে ১৯৪৭ সালে যে আন্দোলন আরম্ভ হয় তখন আন্দোলন করতাম। আবুল কাসেম সাহেব তমদ্দুন মজলিশ গঠন করেন এবং তারপর তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আরম্ভ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্থপতি যদি কাউকে বলা হয়, শুরু করেছিল যদি কাউকে বলতে হয়, উদ্যোগী যদি কাউকে বলতে হয় তাহলে প্রথম নাম বলতে হয় জনাব আবুল কাসেম সাহেবের। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম সাহেব। এবং তার অর্থ হল তার যে প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিশ। আমরা ছাত্রলীগে উনার সাথে জড়িত হয়েছিলাম। এই হল আমাদের প্রকৃত ইতিহাস। এই ইতিহাস অন্য কোনোভাবে নেয়ার কোনো অবকাশ নাই। উপায় নাই। যদি নেয় তবে তা মিথ্যা কথা। বইয়ে লেখুক আর যেখানেই লিখুক।

আবদুল গফুর : আচ্ছা, আপনি তো ছাত্রলীগের প্রথম থেকেই। এই ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা হয় বোধ হয় নতুন করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ হিসেবে ১৯৪৮ সালে। এবং আপনি তখন যতটুকু আমার মনে পড়ে ত্রিপুরা জেলার প্রতিনিধি ছিলেন?

অলি আহাদ : ঢাকা সিটির কনভেনারও ছিলাম।

আবদুল গফুর : তাহলে ‘৪৭ সাল থেকে তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে আবুল কাসেম সাহেবের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় এবং আপনারা তখন বিচ্ছিন্নভাবে এর প্রতি সমর্থন করে আসছিলেন। অলি আহাদ : একটা কথা ভুললে চলবে না। আমি অল বেঙ্গল মুসলিম লীগেও ছিলাম, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছি। তারপরে যখন এই আন্দোলন আসল, মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে আবুল কাসেম সাহেবকে আমরা সমর্থন করেছিলাম এবং মূল কথা হল, ভাষা আমরা চেয়েছি বাঙলা তার জন্য আমাদের অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন আমরা এটা করেছি। এর মধ্যে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আসার পর ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছে এটা সর্বৈব মিথ্যা কথা। ইতিহাস বিরুদ্ধ কথা। যারা বলে তাদেরকে চাবকানো দরকার, তাদের শুধু চাবকানো না, তাদের বিচার হওয়া দরকার।

অধ্যাপক মোমেনুল হক : পাকিস্তান হওয়ার পরে যে মুসলিম ছাত্রলীগ। এখানে প্রতিষ্ঠিত হল, নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তার প্রতিষ্ঠাতা নিয়েও কিন্তু এখন বিভ্রান্তি আছে। আমি যতটুকু পড়েছি তাতে আমরা জানি যে ফজলুল হক হলে এটা হয়েছিল। জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা তখন ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন। জনাব শেখ মুজিবুর রহমানকে এটার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও কোনো কোনো বইয়ে লেখা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থকার লিখেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সাংবাদিকতার কাজ করতে গিয়ে আমি বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি যে, এর কোনো দলিল পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে এর প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

অলি আহাদ : প্রতিষ্ঠাতা ছিল কথাটায় আসতেছি। নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগে যখন দেখা গেল যে, নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থক ভরা, আমরা আশা করেছিলাম, নুরুদ্দিন সাহেব যিনি বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের একটিং জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি কলকাতা থেকে এসে এখানে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। উনি আসছিলেন আমার বাড়ি। তো উনাকে অনুরোধ করেও আমরা রাখতে পারি নাই। উনি কলকাতা থেকে গেলেন। না আসার ফলে আমরা ইচ্ছা করেও পারি নাই। তখন আমাদের মাঝে চিন্তা হল আব্দুল হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালালউদ্দিন আরও আমরা যারা আতাউর রহমান চৌধুরী তার পরে আব্দুর রহমান চৌধুরী অবশ্য ভীতু, পরে ভয়ে সে সইরা গেছে। তারপর আবার আসছে। আব্দুল মতিন খান চৌধুরী ময়মনসিংহের; আমরা আলাদা আলাদা আলাপ করতে লাগলাম। আমরা তো অল বেঙ্গল মুসলিম লীগের লোক, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থক। আবুল হাশিম সাহেবের সমর্থক। সুতরাং আমরা একটা মুসলিম স্টুডেন্ট লীগ দাঁড় করাই। এটার ‘অলটা কেটে দিয়া আমরা এখানে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ দাঁড় করাই। তো বল্লাম, চলেন ইনিশিয়েটিভ নেই। ইনিশিয়েটিভ নেওয়ার মত আর কেউ আগায় না। তখন আমি, আমাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব ঢাকা কলেজের ছাত্র যারা ছিল, যারা নাকি আইসা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল, ওদেরকে বললাম, ভাই কিছু একটা করতে হবে। করার জন্য রাজি আছে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্ট লীগে যারা আছে তাদের একটা অংশ। তাদেরকে আমি বলেছি যে কাউন্সিল ডাকেন। কাউন্সিল ডাকলে যাই হোক, যতজনই হোক তাদের নিয়ে আমরা একটা সংগঠন দাঁড় করাই। কিন্তু তারা একবার রাজি হয়, একবার পিছপা হয়। অর্থাৎ তারা নির্দ্বিধায় কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতেছিল। এখন কথাটা হয়ে যায় ব্যক্তিগত মাতব্বরীর মত। আমি তাদের সাথে আলাপ করে বললাম। যে, আমরা ফজলুল হক হলে একটা মিটিং ডাকি। তোয়াহা সাহেব ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে, হল আমাদের দিবে এবং হলে আমরা সেই মিটিংটা ডাকি। তখন সেই অনুযায়ী আমি ওখানে মিটিং ডাকলাম। ডাকার পরে ফেনী কলেজের লেকচারার ছিলেন নাজমুল করিম সাহেব, পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশিওলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন। আমরা প্রিসাইড করার কাউকে পাচ্ছিলাম না, উনাকে প্রিসাইড করতে দিলাম। উনি আইসা বসে গেলেন। যদিও আমরা জানতাম, উনার সম্পর্কে ধারণা ছিল উনি কমিউনিস্ট, উনাকে করা উচিত। তথাপি আমাদের তখন উপায় ছিল না। উনাকেই বসাইছিলাম। শেখ সাহেব তখন এর কাছ দিয়াও ছিলেন না। জানতেনও না। উনি ঢাকায়ই ছিলেন না। জানবেন কি করে। আমরা মিটিং ডাকলাম ৪ঠা জানুয়ারি ‘৪৮। অতএব শেখ সাহেব প্রতিষ্ঠাতা, এটাও মিথ্যা কথা। যেমনি মিথ্যা কথা ‘৪৭ সাল থেকে তিনি চিন্তা করতেন স্বাধীন বাংলাদেশ করার জন্য, ঠিক তেমনি এটাও জাজ্বল্যমান মিথ্যা। দিনের সূর্য যেমন সত্য, আমার কথাও তেমন সত্য। নইমুদ্দিন আহমেদকে আমরা কনভেনার করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ অর্গানাইজিং কমিটিটা করি। আমার পক্ষে কনভেনার হওয়া তখন অসুবিধাজনক ছিল। কারণ তখন বয়স আমার কম এবং মাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। সুতরাং আমাকে ত্রিপুরা জেলার রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে নেওয়া হয় এবং ঢাকা সিটির কনভেনার করা হয়। আমি তাতে আমার সম্মতি দেই, এই হল সংগঠন গড়ার কাহিনী।

আবদুল গফুর : ওই কমিটিতে বোধ হয় শেখ সাহেবকে ফরিদপুর জেলার প্রতিনিধি রাখা হয়েছিল।

অলি আহাদ : হ্যা, শেখ সাহেবের অন্য ইম্পােটেন্সী আছে।

আবদুল গফুর : আচ্ছা, ১১ই মার্চে যে আপনারা একটা প্রতিবাদ দিবস পালন করেছিলেন, এটার পটভূমি কি ছিল, এটা একটু বলবেন?

অলি আহাদ : আমি কিন্তু ঢাকা সিটির মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক ছিলাম, শেখ সাহেবের দান আছে, এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। শেখ সাহেবের নামেই আমরা পরবর্তীতে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। নূরুদ্দিন ভাই রাজী হল না, তখন শেখ সাহেব দৌড়াদৌড়ি করে তার জানাশোনা যত ছেলে আছে তাদের দিয়ে দলটির কমিটির সেটআপ করতে সাহায্য করেছিলেন, এর মধ্যে সন্দেহ নেই।

আবদুল গফুর : ১১ই মার্চের এই যে আন্দোলনটা হয়, ১১ই মার্চ প্রথম যে গণবিস্ফোরণ হয় ভাষার দাবিতে এটার পটভূমিটা কী। ‘৪৮ সালের ১১ই মার্চের সেই আন্দোলনের পটভূমিটা কী? এটা ডাকা হল কেন প্রতিবাদ দিবস এবং ঐ দিনকার ঘটনা…।

অলি আহাদ : এটা তো পুরানো কথা। আগস্ট মাসের মিটিংয়ে বাংলাকে অন্যান্য ভাষার সহিত যোগ করার জন্য, বক্তৃতা করার জন্য, অধিকার দেওয়ার জন্য দাবি তোলা হয়, এ থেকে ভাষা আন্দোলন। আবুল কাসেম সাহেবের দেশপ্রেমের কারণে, আবুল কাসেম সাহেবের মাতৃভাষার প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং আনুগত্যের কারণে এই আন্দোলনটা আরম্ভ হয়।

১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি উর্দু, ইংরেজির সহিত গণপরিষদের বাংলা ভাষা ব্যবহারের সপক্ষে দাবি উত্থাপন করেন বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। এই অপরাধে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান ও অন্যান্য বক্তা অসৌজন্যমূলক ভাষায় তাকে আক্রমণ করেন। ঢাকায় পুনঃপুনঃ দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ওকালতী করেন। এর কারণেই আবুল কাসেম সাহেব তমদ্দুন মজলিশের একটা সভা ডাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে রশিদ বিল্ডিং-এর দোতলায়। সেই রশিদ বিল্ডিংয়ে দোতলার সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, আমরা একটি কমিটি অব একশন সেটআপ করব। সেই কমিটি অব একশন শামসুল আলম সাহেব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র তাকে কনভেনার করে করা হয়। আর পূর্বকার যে-সাব-কমিটি করা হয়েছিল তমদ্দুন মজলিশের, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গাইড করার জন্য তা থেকে নূরুল হক সাহেব পদত্যাগ করেন। সেই দিনই আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি ১১ই মার্চে যেহেতু পূর্ববঙ্গ এসেম্বলীর অধিবেশন, সেই অধিবেশন দিবসে প্রতিবাদ করার জন্য আমরা ১১ই মার্চকে ঘোষণা করি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে।

আবদুল গফুর : ১১ই মার্চ তো আপনি গ্রেফতার হয়েছিলেন?

অলি আহাদ : ১১ই মার্চে আমি, শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো অনেকে গ্রেফতার হয়েছিলাম।

আবদুল গফুর : ওখানে কি গোলাম আযম সাহেবের কোনো ভূমিকা ছিল?

অলি আহাদ : নিশ্চয়ই ছিল। গোলাম আযম সাহেব তখন খুব ইমপর্টেন্ট লোক। তিনি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ডাকসুর জেনারেল সেক্রেটারি এবং ফজলুল হক হলের যে নির্বাচন হয়েছিল তোয়াহা সাহেবের সাথে মিলে তিনি একই পক্ষ থেকে সেই নির্বাচন গাইড করেছিলেন। অতএব গোলাম আযম সাহেবের ডেফিনিটলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অন্যদের চেয়েও ভালো কন্ট্রিবিউশন ছিল।

আবদুল গফুর : আচ্ছা, এর পরে তো কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জন্নাহর সাথে আপনাদের আলোচনা হয়। সে আলোচনা সম্পর্কে কিছু বলুন।

অলি আহাদ : আলোচনাটা, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে আমরা দেখা করি। চীফ সেক্রেটারি ছিলেন আজিজ আহমদ সাহেব। তার বাড়িতে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অবস্থান করছিলেন, আমরা ওখানে আলাপ-আলোচনা করলাম যে, স্যার, সভায় আপনি বলেছেন, Urdu shall be the state language 9 91100 478 only state language 9 কথাতে আমরা খুব ব্যথা পেয়েছি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা মনে করি পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। আমরা মনে করি উর্দু state language হতে পারে, বাংলাও state language হতে পারে এবং দু’টোকেই করা উচিত। আর আপনার ভাষায় State language যদি উর্দুকে করা হয় অর্থাৎ বাংলাকেও তার সাথে করা হয় তাহলে পাকিস্তান থাকবে না, পাকিস্তান ভেঙে যাবে। এই কথাটির সাথে আমরা একমত নই। কারণ, বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে। একই ধর্ম, একই ভাষা—তা সত্ত্বেও তার একটা স্টেট। যেমন কানাডার কথা বলা যায়। আরব দেশের কথা বলা যায়। বিশেষ করে আরব দেশে ধর্ম এক, জাতি এক, ভাষা এক, তা সত্ত্বেও একটা স্টেট নয়। অনেকগুলো স্টেট রয়েছে। এটা আমরা প্রমাণ করেছি যে, বিভিন্ন ভাষা Multi language হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান একটা স্টেট হিসেবে দাঁড়াতে পারে এবং দাঁড়াবে। তার জন্য গণতান্ত্রিক মনোভাব থাকলে এটা সম্ভব। তা আমরা মনে করি এবং এ কারণে। দু’টো State language হওয়া উচিত। তিনি এক স্টেজে আমাদের সঙ্গে রাগ করে বসলেন। If necessary in the interest of the state, the interest of the integrated state, your language will have to be changed. Pich আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে সেখানে আমাদের দ্বিমত। দ্বিমত নয়, প্রকট Difference of opinion হয়। যদিও আমরা পরবর্তীকালে শুনেছি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এটা বলতে চাননি। কিন্তু ওনাকে দিয়ে বলানো হয়েছে। জিন্নাহ’র মত নেতাকে যদি বলাতে পারে এর চেয়ে দুঃখের আর কি হতে পারে? যেমন কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গ এসেম্বলিতে যখন এডড্রেস করতে আসলেন, মওলানা ভাসানী, তিনি তখন সদস্য ছিলেন, তিনি উঠে বললেন, “কায়েদে আযম, মুঝে এক সাওয়াল হ্যায় আপকে পাস, আপ বাতাইয়ে, হামিদুল হক চৌধুরীকে লিয়ে আপ ছে মাহিনেসে ন মাইনে কর দিয়া, ইন্তেখাব কে লিয়ে, হামলোগ কোন ক্যায়াস হ্যায়, যো এন্তেকাবি কে লিয়ে যদি কনস্টিটিউশন চেঞ্জ করা যায়, আগার ইয়ে হো সাকতা। আপকে তারা পার্লামেন্টারিয়ান, আপকে তারা কনস্টিটিউশানকো এহি কর সাকতা হ্যায়। তো ক্যায় নেহি হো সাকতা।” তিনি জবাবে বললেন, মওলানা, ম্যায় নেহি মানতা এহি বাত, মুজে বোলানেই হোগা। ম্যায়নে, কিয়া, হো গায়া।” কায়েদে আযমের এতটুকু মানসিক অবস্থা ছিল ভুলকে স্বীকার করে নেয়ার মত। এবং সেই ভুল তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এখানেও আমরা যারা পরবর্তীকালে বিভিন্ন বই থেকে পড়েছি… এর পরে কায়েদে আযম কোনোদিন উনার মৃত্যু পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে State Language Shall be the Urdu কখনোই বলেননি। এমনকি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি। এতটুকু তিনি নিজেকে সংবরণ করে নিয়েছিলেন। কায়েদে আযম যা-তা নেতা নন। কায়েদে আযমের ডিটারমিনেশন অসম্ভব ছিল। কায়েদে আযম যা সত্য মনে করতেন তা বলতে এক সেকেণ্ড দেরি করতেন না। যেমন খেলাফত আন্দোলন। খেলাফত আন্দোলনের মওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী, গান্ধিজী তারা যখন করছিলেন ক্যালকাটা কনফারেন্স চলছে, তিনি দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, খেলাফত ইয়ে হোনা নেহী চাহিয়ে He was against this movement. তার ফলে তার বক্তব্য শুনে মাওলানা শওকত আলী কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলীকে ডায়েসে মারতে গেলেন, ধরে তাকে থামানো হল। তারপর কায়েদে আযম সেখান থেকে বেরিয়ে আসলেন, বেরিয়ে এসে ট্রেনে উঠে পরিষ্কার চলে গেলেন। তারপর লন্ডন চলে গেলেন। তারপর তো রাজনীতিই ছেড়ে দিলেন। এই হল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সুতরাং উনি বুঝে ফেলেছেন আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। হয়তো একটা ক্ষতিও করে ফেলেছি। যার জন্য তিনি আর কখনো এ সম্বন্ধে, রাষ্ট্রভাষা কি হবে না হবে সে সম্পর্কে আর কিছু বলেননি।

আবদুল গফুর : আচ্ছা, তাহলে আমরা মোদাব্বের সাহেবের একটা বইতে পেয়েছি। উনি ওনার ভুলটা স্বীকার করেছিলেন ডাক্তার এলাহী বশর কাছে।

অলি আহাদ : হ্যা, এলাহী বখশর কাছে।

আবদুল গফুর : আচ্ছা একটা কথা। তাহলে কায়েদে আযম চলে যাবার পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কিন্তু খুব তীব্র আকার ধারণ করেনি কেন। হরফ নিয়ে একটা আন্দোলন হয়েছিল, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে একজাক্ট, ‘৫২-তে যেভাবে আবার জন্ম নিল, সেভাবে আর কোনো আন্দোলন হয়নি। সেটার কারণ কি?

অলি আহাদ : যেকোনো মুভমেন্টে আপস এন্ড ডাউন আছে। সেজন্যই একটা কথা মনে রাখতে হবে-কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এসে যখন বলে গেলেন। তার দ্বিমত প্রকাশ করে গেলেন। এখানকার মুসলমানরা একটু থ খেয়ে গেল। এটা না যে কায়েদে আযমের বক্তব্য গ্রহণ করেছেন কিন্তু তার একচ্ছত্র নেতা, তার প্রিয় নেতা এই বক্তব্য দিয়ে গেছে, কি করা উচিত? কিংকর্তব্যবিমূঢ় সবাই। কিন্তু ইয়ংগার জেনারেশনে যারা ছাত্র ছিল তারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে জিইয়ে রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে। কিন্তু চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি।

আবদুল গফুর : এর আগে তো আমাদের যতটুকু মনে পড়ে ১১ই মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং ১১ই মার্চ আপনারা ‘৪৮ সালেই করেছিলেন তার পরে ‘৪৯ সাল, ‘৫০ সাল, ‘৫১ সাল ১১ই মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হয়। কিন্তু এখানে একটা নতুন ধারা শুরু হল ‘৫২-তে। সংযোজন হল একটা নতুন দিগন্তের। এটার পটভূমি কি? তখন বোধ হয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন।

অলি আহাদ : খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব, ২৬শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে বক্তৃতা করলেন, কিন্তু একটি জিনিস দেখতে হবে, একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যখন চলতে থাকে যখন ‘৪৭ সাল থেকে আরম্ভ করে ‘৫২ সাল পর্যন্ত এই পিরিয়ডটাতে এই সরকার সম্বন্ধে মানুষের মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবর্তন হওয়ার পরে ১৫ই আগস্ট সমগ্র দেশবাসী সেটাকে গ্রহণ করেছিল (কয়েকজনের কথা বাদই দিলাম)। তেমনি আজকে যে অবস্থা এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা হয়তো বুঝতে পারছেন না যে, আজকে গণভোট দিলে পরে মুসলমানদের শতকরা নব্বইটি ভোট ওনার বিরুদ্ধে যাবে। যেমনি এই দেড়-দুই বৎসরে কোয়ালিটি চেঞ্জ হয়ে গেছে, তেমনি আমরা মানুষের—মাটির সাথে সম্পর্ক রাখি। মাটির আওয়াজ আমাদের কানে আসে এবং আমরা বুঝতে পারি যে, দেশের অবস্থা কী। তা না হলে রাজনীতি করে লাভ নেই। ঠিক তেমনি সেই অবস্থার সাথে তুলনা করতে হবে ১৯৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২’র সাথে। নানা কারণে সামাজিক কারণ, অর্থনৈতিক কারণ, রাজনৈতিক কারণ, এসব কিছু মিলিয়ে একটা পরিবর্তনের দিকে মানুষের হাওয়া বইছে। যেমন ৩৫টা বাই-ইলেকশন বন্ধ করেন নূরুল আমিন সাহেবের সময়। এগুলি মানুষের মনের মধ্যে দাগ কাটতে লাগল। যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যে নিউ মিডল ক্লাস গড়ে উঠল, সেই নিউ মিডল ক্লাস তারা চাইল, আমরা যে কেকটা পেয়েছি। সেই কেকটার একটা অংশ আমরা পাইনি এবং তার অর্ধেকটা, পুরোটা না পাই। আমাদের অন্তত পাইতেই হবে। তো কেক বলতে কি কি জিনিস ছিল। আর্মিতে রিক্রুটমেন্ট, সিভিল রিক্রুটমেন্ট, বিজনেস তারপর শিক্ষা-দীক্ষায়, স্কুল-কলেজ এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে হয়, পূর্ব পাকিস্তানে হয় না। এই প্রোপাগান্ডাগুলো অন্তর্শেলের মত কাজ করেছে। নাজিমুদ্দীন সাহেব এখানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় একবার সই করেছিলেন এবং সেই সইয়ের তিনি মর্যাদা রাখেননি। অর্থাৎ সেই সঙ্গে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। সেই বিশ্বাসঘাতকতা, সেই গাদ্দারী জনগণের মনের মধ্যে কাজ করতে থাকল। state language এটা হয়, তবে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, চাকরি পাওয়া যাবে না।

আবদুল গফুর : সবচেয়ে বড় কথা উনি তার আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ওয়াদা করেছিলেন, সেই আগে ১৯৪৮ সালে, তা থেকে ফিরে আসেন।

অলি আহাদ ; তখনই তিনি ফিরে আসেন। এই ফিরার পথ থেকেই এ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে দেখা গেল যে, ওনাকে বিশেষ করে ছাত্রমহল গ্রহণ করে নি। ছাত্রসমাজ গ্রহণ না করার ফলেই সেই আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়। ১১ই মার্চে যেমন পূর্ববঙ্গের লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির অধিবেশন ডাকা হয় ঠিক তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারিতে পূর্ববঙ্গ লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির অধিবেশন ডাকা হয়। আমরা এ সুযোগে মনে করলাম আন্দোলন দিতে হলে ঐ তারিখকে লক্ষ করে দিতে হবে। এবং পূর্ববঙ্গ অ্যাসেম্বলি দিয়েই, ঘোষণা করাতে হবে যে, স্টেট লেঙ্গুয়েজ অন্যতম ওয়ান অব দি স্টেট লেঙ্গুয়েজ এ প্রশ্নটা আমাদেরকে তুলতে হবে। সেজন্য এই আন্দোলন সেদিন ঘোষণা করা হয়। এর ঘোষণা করার, তারপর বাকিটা গণআন্দোলনে রূপ নেয়।

আবদুল গফুর : সে সময়ে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আলাদা ছিল। এটার ভূমিকা সম্পর্কে আপনি কাইন্ডলী বলবেন?

অলি আহাদ : রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যেটা গঠিত হয় সেটা তো গঠিত হয়েছে ওখানে যারা ছিলেন তাদের দ্বারাই। বিভিন্ন সময়ে অ্যাসেম্বলির মেম্বার পার্লামেন্টারি মেম্বার তাদিগকে মেমোরেন্ডাম দিতেন যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হউক। এটাই কন্টিনিউ করতে লাগলো। আর আমার পূর্ব পাকিস্তান ইয়ুথ লীগ, আমি তখন পূর্ব পাকিস্তান ইয়ুথ লীগের জেনারেল সেক্রেটারি।

আবদুল গফুর : আপনি তো ফাউন্ডার জেনারেল সেক্রেটারি?

অলি আহাদ : আমি ফাউন্ডার জেনারেল সেক্রেটারি। তো আমাদেরও মনে হল যে এই মতিন সাহেব যেহেতু আমাদের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের, পূর্ব পাকিস্তান ইয়ুথ লীগের অন্যতম সদস্য ছিলেন, তিনি আমাকে একদিন এসে বললেন, কিছু তো করতে হবে। আমি বলি নিশ্চয়ই করতে হবে, নাজিমুদ্দীন সাহেব এ ঘোষণা করেছেন, অতীতেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, আগামীতেও বিশ্বাসঘাতকতা করবেন। সুতরাং আমাদের দায়িত্ব হবে কিছু করার এবং চলেন আমরা একটা মিটিং ডাকি। এই থেকে সূত্রপাত।

আবদুল হাই শিকদার : এখানে যে কথাটা অধ্যাপক আবদুল গফুর বললেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে যে দেখাটা হল এবং তারপর যে বিরাট গ্যাপ গেল, গ্যাপের পরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দ্বারা এটা নতুনভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠল বায়ান্ন সালে। এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নতুন ধরনের জাগরণ ঘটল এই জাগরণটাকে একটু ব্যাখ্যা করলে আমাদের জন্য একটু ভালো হয়।

অলি আহাদ : দেখেন, তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেব পাকিস্তানে এসেছেন। বিরোধী দলের নেতৃত্বের ভার নিয়েছেন মওলানা ভাসানী। তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট মওলানা ভাসানী সমগ্র দেশে বিশেষ কইরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি মহকুমায়, এমনকি কোনো কোনো থানায় পর্যন্ত নূরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে, মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে, লিয়াকত আলী খান সরকারের বিরুদ্ধে, নাজিমুদ্দীন সরকারের বিরুদ্ধে যা যা বলা দরকার তিনি বলেছেন এবং উদ্বুদ্ধ। করেছেন। এতে জনগণ উত্তেজিত হয়েছে, মওলানা ভাসানীকে বিশ্বাসও করেছে। সে অবস্থায় ছাত্রদের আন্দোলন এবং এই দেশের স্বাভাবিকভাবেই আন্ডার ডেভেলপ কান্ট্রিতে যা হয় ছাত্রদের প্রতি লোকজনের বিশ্বাস জাগে। ছাত্ররা আবার ইনিশিয়েটিভও নেয় এবং ইনিশিয়েটিভই ছাত্ররা নিয়েছে। একদিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব পার্লামেন্টারী লিডার আর এক দিকে মওলানা ভাসানী মাসলিডার। এই দুইজনের নেতৃত্বে পাবলিক অপিনিয়ন ফর্ম হইতে লাগল। কনসুলেটেড হইতে লাগল এবং কনসুলেটেড হলও তাই। সে অবস্থায় যখন ছাত্ররা আন্দোলনের ডাক দিল সাড়া পাওয়া গেল। এটাই হল মূল কারণ এবং ছাত্ররা আন্দোলনের ডাক দেওয়ার ফলে, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডাক দেওয়ার ফলে সমগ্র স্কুল-কলেজ ও সমস্ত দেশের মধ্যে আগুন জ্বলল। কিন্তু আসল হল, ঢাকা শহর। ঢাকা ইউনিভার্সিটি। জগন্নাথ কলেজ, ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এইগুলো।

আবদুল গফুর : তো এই যে একটা রাজনৈতিক পরিবেশ, আপনি যেটা বলতে চাইলেন তাহলে এটা মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী সাহেব, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা এদিকে আপনারাও যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করে কাজ করছেন। মোটামুটিভাবে একটা রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। মুসলিম লীগ বিরোধী। আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন বা এ সংক্রান্ত অন্যান্য আন্দোলনের পটভূমি একটা সৃষ্টি হচ্ছে।

অলি আহাদ : এর সাথে অবশ্য একটা কথা যোগ করতে হবে। আপনার সাথে যে সৈনিক পত্রিকা এবং বিশেষ কইরা আবুল কাসেম সাহেবের নেতৃত্বে। তমদ্দুন মজলিশ গড়ে উঠে তাদের যে কার্যকলাপ হয় ঢাকা শহরে এটা অবিচ্ছেদ্য। এটাকে ছোট করে দেখার মত কোনো উপায় যেমন ‘৪৮ সালেরটা তোছোট করার জায়গাই নাই এবং এটাকেও ছোট করে দেখার উপায় নেই। এ পাবলিক অপিনিয়ন সব।

আবদুল গফুর : ধন্যবাদ। ১৯৫২ সালে যে একটা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ হয় এটা বোধ হয় ৩০শে জানুয়ারির কোন একটা মিটিংয়ে, না কত তারিখে যেন।

অলি আহাদ : ৩০ তারিখে। আবদুল গফুর : সেখানে কারা কারা ছিলেন?

অলি আহাদ : ব্যাপারটা হয়েছিল কি মুসলিম ছাত্রলীগের তরফ থেকে তারা আন্দোলনটা হউক এটা চায় নাই। সে না চাওয়াটা শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের জন্য। শেখ মুজিবুর রহমান সাব তখন জেলখানায়। আমি তখন যুবলীগের সেক্রেটারি হিসাবে আইসা উপস্থিত হইলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে খালেক নেওয়াজ খান জিজ্ঞাসা করলো কি করবেন? কি করতে চান অলি আহাদ সাহেব? আমি বলি করব একটা কিছু, করতে হবে তো। করার জন্যই আছি। একটা কিছু করব, আপনারাও করবেন। সবাই মিলেই করব। ইন দি মিন টাইম বোঝা গেল যে, তারা প্রিসাইড করবে। আমি সেটাতে রাজি না। মুসলিম ছাত্রলীগের কেউ প্রিসাইড করলে আন্দোলনটা বিক্রি করে দেবে। আমার ধারণা তখন তাই। এতে কিছুতেই আমি রাজি ছিলাম না। কিছু বলি নাই তাদেরকে। আমি গাজীউল হককে ডেকে বললাম যে, আপনি মুকুলকে নিয়ে সেখানে একটা টেবিল পাতাইয়া সভায় কে সভাপতিত্ব করবে ঘোষণা করে দেবেন। মুকুল তুরিত ছেলে। চট করে গিয়ে টেবিল একটা নিয়ে গিয়ে এটার উপর দাঁড়াইয়া বললেন যে, আমরা এখন এ সভায় প্রস্তাব করিতেছি যে, গাজীউল হক সাব এ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। এখনই সভা আরম্ভ। আমতলায় সভা এভাবে গড়ে উঠে।

আবদুল গফুর : এটা তো হল একুশে ফেব্রুয়ারির কথা।

অলি আহাদ : না। একুশে ফেব্রুয়ারির আগে।

আবদুল গফুর : না, একুশে ফেব্রুয়ারির ভোর বেলায় তো এটা।

অলি আহাদ : না, এটা হল দ্বিতীয় বার, একুশে ফেব্রুয়ারির এটা হল দ্বিতীয় বার। আর প্রথম বার হল ওটা। গণ্ডগোল ওখানে। কাজী গোলাম মাহবুব আইসা বলল যে, অলি আহাদ কাকে প্রিসাইড করতে বলবা আর প্রসেশন করবা? বললাম, না প্রসেশন তো করবই, করতেই হবে। আর প্রিসাইড করবে কে, এটা এখনো ঠিক করতে পারি নাই।

আবদুল গফুর : শিকদার সাহেব বোধ হয় জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, বার লাইব্রেরি হলে যে আপনাদের মিটিং হয়েছিল সেখানে কে সভাপতিত্ব করেছে?

অলি আহাদ: সেটায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী।

আবদুল গফুর : ওখানে বোধ হয় কনভেনার…

অলি আহাদ : কনভেনার কাজী গোলাম মাহবুব।

আবদুর গফুর : এবং আপনারা মেম্বার।

আবদুল হাই শিকদার : এখানে প্রশ্ন, যেহেতু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনার ছিলেন কাজী মাহবুব, কিন্তু আপনারা যখন মিটিংটা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, তখন এটা গাজীউল হক প্রিসাইড করলেন, এর রহস্যটা কি? কারণটা কি?

অলি আহাদ : রহস্যটা হইল আমরা তাহাদিগকে বিশ্বাস করি নাই। তারা বলত আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব।

আবদুল হাই শিকদার : কাজী গোলাম মাহবুবরা?

অলি আহাদ : কাজী গোলাম মাহবুবরা। তারা অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগ বলত, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব। শেখ মুজিবুর রহমান বলত। তিনি তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছিলেন। তারা বলত, আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব। শামসুল হক সাহেব ফাউন্ডার সেক্রেটারি। তিনি বলতেন, আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব। আতাউর রহমান খান বলতেন আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বলার অর্থ হল ১৪৪ ধারাকে মাইনা নেওয়া, যদি সরকার দেয়। আমরা এটা মানার পক্ষে ছিলাম। ঘোর বিরোধী ছিলাম। সেজন্যেই প্রিসাইড করতে যদি অন্য একজনকে দেই তাহলে মিটিংটা সেভাবেই নিয়ে যাবে। আর না হলে কিলাকিলি হবে। আমরা সেটা করতে চাই নাই।

আবদুল হাই শিকদার : এ মিটিংটার তারিখটা কত, যে মিটিংয়ে গাজীউল হক সভাপতিত্ব করেন?

অলি আহাদ : দুইটাতে, ৩০ তারিখও করেছে, ২১ তারিখও করেছে।

আবদুল হাই শিকদার : ৩০শে জানুয়ারি, আরেকটা হল ২১শে ফেব্রুয়ারি? দু’টা মিটিং-এ গাজীউল হক সভাপতিত্ব করেছে?

অলি আহাদ : গাজীউল হক প্রিসাইড করেছে।

আবদুল হাই শিকদার : আচ্ছা, তাহলে একটা কথা ইদানীং বলা হচ্ছে, এটা আমরা এখন একটু জানতে চাই আপনার কাছে, যে তমদ্দুন মজলিশ আন্দোলনটা দাঁড় করালো, কিন্তু একটা পর্যায়ে ‘৫২ সাল থেকে দেখা যায় তমদ্দুন মজলিশ আর এর মধ্যে নেই।

অলি আহাদ : আমাদের হাতে কোয়ালিটেটিভ চেঞ্জ হয়ে গেল। তখন তমদ্ন মজলিশ যদি তাদের সাথে সায় না দিত, ইয়ুথ লীগের সাথে সায় দিত, তাহলে আমরা তমদ্দুন মজলিশকে নিয়েই সে আন্দোলনটা আরম্ভ করতাম। আমরা তমদ্দুন মজলিশের লোকদেরই হয়তো বসাইয়া দিতাম যে, প্রিসাইড কর। যেহেতু আমরা বুঝে ফেলেছি, খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে এবং তারা মিটিং-এ দাঁড়াইয়া যখন বলে দেবে, ১৪৪ ধারা আমরা ভঙ্গ করব না। আমরা যতই বলি, একটা গ্রুপ ছাত্র-জনতা তাদের সমর্থন করবেই। আর একটা গ্রুপ আমরা করব না। তাতে হত কি? আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। এটা প্রমাণিত হত। তার জন্যই আমাদের পক্ষে তখন চিন্তা হইলো এইটা, আমাদের উপর আঘাত করার জন্য ১৪৪ ধারা দিলে পরে, নিয়ম ভঙ্গ তারা করলে, আমরাও নিয়ম ভঙ্গ করব। এই কথা যদি তমদ্দুন মজলিশ তখন ইয়াংগার জেনারেশনকে বলত, তাহলে আজকে তারা নেতৃত্ব দিত। আবদুল গফুর : আচ্ছা, এই যে ১৯৫২ সালের ৩০শে জানুয়ারি একটা সভা হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে আপনি বলছেন, এটা কি আপনার বইতে আছে?

অলি আহাদ : আছে। হয় ৩০, না হয় ৩১ পৃষ্ঠায় আছে।

আবদুল গফুর : আচ্ছা আরেকটা মিটিং যে হয়েছিল, যখন ১৪৪ ধারা হঠাৎ ১৯ তারিখ বোধ হয় জারি করল গভর্নমেন্ট।

অলি আহাদ : ২০ তারিখ সন্ধ্যার সময়।

আবদুল গফুর : ২০ তারিখ সন্ধ্যার পরেই।

অলি আহাদ : আমরা মিটিং-এ বসলাম।

আবদুল গফুর : একটা জরুরি মিটিং।

অলি আহাদ : খুব ইমার্জেন্সী মিটিং ডাকলাম, আবুল হাশিম সাহেব প্রিসাইড করলেন। ১১-আর ৪-এ ভোটাভুটি হল।

আবদুল গফুর : অধিকাংশ লোক ভোট দিল বিরুদ্ধে।

অলি আহাদ : ১১ জন ভোট দিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যাবে না। আর ৪ জন আমরা, ভাঙতে হবে। এই ৪ জনের একজন আমি, আবদুল মতিন, ফজলুল হক হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব শামসুল আলম এবং মেডিক্যাল কলেজের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব গোলাম মাওলা। তোয়াহা সাব ভোট দেয় নাই। তোয়াহা সাব ঐদিকে ছিল।

আবদুল হাই শিকদার : গাজীউল হক?

অলি আহাদ : গাজীউল হক তো মেম্বারই ছিল না। তোয়াহা সাব মেম্বার ছিলেন। ইয়ুথ লীগের তরফ থেকে আমরা দুইজন। গাজীউল হক আমাদের ইয়ুথ লীগের লোক, গাজীউল হক মেম্বার ছিলেন না। মেম্বার ছিলেন তোয়াহা সাহেব এবং আমি, আমরা দুইজন। মাহমুদ আলী সাব সিলেট থাকতেন, সেইজন্যই মাহমুদ আলী সাব হইতে পারেন নাই। মাহমুদ আলী সাব ঢাকা থাকলে তিনি মেম্বার হইতেন। আর গাজীউল হক সাহেব তো আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র।

আবদুল হাই শিকদার : এখানে কোশ্চেন হল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে আপনারা মাত্র ৪ জন পক্ষে থাকলেন, ভাঙতে হবে। আর ১১ জন থাকল বিরোধী, যে ভাঙ্গা যাবে না। কিন্তু এই কমিটির মধ্যে গাজীউল হক ছিলেন না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, ২০ তারিখের মিটিংটা গাজীউল হক প্রিসাইড করেছে

অলি আহাদ : না। আবদুল হাই শিকদার : ২১ তারিখের মিটিং-এ…

অলি আহাদ ; বিশ তারিখের মিটিং-এ আমরা প্রিসাইড করেছি। ইউনিভার্সিটির ছাত্র, এটা তো ছাত্রদের মিটিং।

আবদুল হাই শিকদার : আচ্ছা আচ্ছা।

অলি আহাদ : জনগণের মিটিং না। ছাত্র জনতা মিটিংয়ের মধ্যে তো, ছাত্রকে দেব, তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তার মধ্যে প্রমিনেন্ট।

আবদুল হাই শিকদার : তাহলে একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে যে, ভাষা আন্দোলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একটা বড় ধরনের ভূমিকা আছে।

অলি আহাদ : নিশ্চয়ই আছে। নিশ্চয়ই আছে। আগাগোড়া আছে।

আবদুল হাই শিকদর : আর একটা ব্যাপার, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এখন কথা বলতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো গ্রন্থকার যেমন মাযহারুল ইসলামের মত লেখকরা, মুনতাসির মামুন, এ জাতীয় লোকরা। এরা দেখা যাচ্ছে যে ভাষা আন্দোলনে জেলখান থেকে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিয়েছে এ রকম কথাও লিখেছে।

অলি আহাদ : এটা মিথ্যা কথা। এটার প্রশ্ন উঠে না, এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার পরও চলমান আন্দোলনে সক্রিয় হয় নাই। তার নেতৃত্বে কোনো নতুন আন্দোলনও গড়ে ওঠে নাই। ইতিহাস সাক্ষী, এসব লেখা চরম মিথ্যাচার। জাতির সাথে চরম প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। শেখ মুজিব নেতৃত্ব দিল কিভাবে? তার দল বলছে, আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব। আমরা ১৪৪ ধারা দিলে ভাঙবো না। তিনি করবেন কোথায়? তারই লোক খালেক নেওয়াজ খান, তারই লোক কাজী গোলাম মাহবুব, তারই লোক জনাব শামসুল হক, তারা বলছেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব না, জেলখানা থেকে উনি নেতৃত্ব দিবেন, নেতৃত্ব দিতে হলে তো কারো মারফত নেতৃত্ব দিতে হবে, হয় দিবে খালেক নেওয়াজ খান ছাত্রলীগের যে জেনারেল সেক্রেটারি, না হয় দিবে শামসুল হক চৌধুরী যে নাকি ছাত্রলীগের একটিং প্রেসিডেন্ট, না হয় দিবে কাজী গোলাম মাহবুব যিনি কলকাতায় তার সাথে কাজ করেছেন, না হয় দিবে উনারই জেনারেল সেক্রেটারি শামসুল হক সাব, না হয় দিবে তখনকার দিনের মুসলিম লীগের ১৫০ মোগলটুলীতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন শওকত সাহেব, তারা দিবেন। না হয় মানিক মিয়া দিবেন যে ইত্তেফাক-এর তখন এডিটর ছিলেন। তারা তো সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ছিল। অতএব তিনি নেতৃত্ব দিলেন, এটা সর্বৈব মিথ্যা কথা, মিথ্যা, মিথ্যা এবং এবসলিউটলি মিথ্যা।

আবদুল হাই শিকদার : ইদানীং আর একটা কথা বলা হচ্ছে, বিভিন্ন মহল থেকে যারা হয়ত বিকৃত করছে তারাও বলছে যারা এটা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে তারাও বলছে, যে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে, এ বিকৃতিটা কিভাবে হচ্ছে এবং কোথায় কোথায় হচ্ছে?

অলি আহাদ : প্রথম প্রধান বিকৃতি হইলো শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবে চিত্রিত করা। এরপর আর বিকৃতির কোন শেষ নাই। ভাষা আন্দোলন তো পপুলার আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ঐতিহাসিক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন বিপ্লবী আন্দোলন, বিশেষ করে ‘৫২ সালেরটা, কোয়ালিটেটিভ চেঞ্জ হয়েছে। এটার থেকে শেখ মুজিব বাদ পড়ে যাবে এটা কখনো চিন্তা করা যায় না এবং শেখ মুজিবকে বাদ যাতে না যেতে হয় তার জন্য তার ছাত্র অর্গানাইজেশন, খাইয়া না খাইয়া, তার দলের লোক খাইয়া না খাইয়া মুজিবের যারা সমর্থক তারা প্রচেষ্টা করতে লাগল যে, শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানা থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সবই মিথ্যা কথা। সর্বৈব মিথ্যা তো মিথ্যার বেসাতির সাথে দাঁড়ানো সম্ভব না।

আবদুল হাই শিকদার : আরো অন্যান্য বিকৃতির ব্যাপারে যদি একটু বলেন?

অলি আহাদ : আছে বিকৃতি, যেমন আতাউর রহমান খান। আতাউর রহমান খান যে আন্দোলনের দিন, একুশের আন্দোলনের দিন ছিলেন না। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিটি যখন হয় তাকে কনভেনার করা হয়। যেমন আমরা জেলে যাওয়ার পর তাকে কনভেনার করা হল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য। সম্মেলন করার জন্যে যে কমিটি হয়, সে কমিটিতে তাকে কনভেনার করা হয়। এখন সত্য কথা বললে তো অনেকের কাছে খারাপ লাগবে। তাহলেও আমারটা আমার বলে ফেলতেই হয়। কে কি মনে করেন সেটা চিন্তা করার ব্যাপার নয়। মওলানা ভাসানী, উনাকে আমরা বললাম, হুজুর আপনি এখন দূরে যাবেন না। ১৪৪ ধারা নুরুল আমিন যেটা দিয়েছে, সেটা ভাঙতে হবে। তিনি বললেন, না আমি দূরে যাব না, তবে আমি একটু নরসিংদী থেকে ঘুরে আসি। তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হল, কিন্তু তিনি আসলেন না। এটাই আবার অনেকে যারা নাকি কমিউনিস্ট, যারা নাকি প্রগতিশীল দাবি করে, তারা বলে বেড়ায় যে, মওলানা ভাসানী সেদিন ছিলেন।

আবদুল হাই শিকদার : কিন্তু কোনো কোনো বইয়ে দেখা যায়, গায়েবানা জানাযায় পরের দিন তিনি…

অলি আহাদ : মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা। গায়েবানা জানাযা যখন করি তখন আমার বন্ধু আমার অর্গানাইজেশনের ইয়ুথ লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন অ্যাডভোকেট এমাদুল্লাহ। এমাদুল্লাহ সেই মিটিংয়ে প্রিসাইড করেন, গায়েবানা জানাযাতে এক গায়েবানা জানাযা হয় কোথায় লেখে? সেটা বলেননি? সেটা মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাকে। কখন আর হয় কইতে পারবে? না। এই সব মিথ্যা কথার সাথে তো সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। ইতিহাসে বিকৃতি তো হবেই। তখন বেলা দশটা কি এগারোটা।

আবদুল হাই শিকদার : একুশ তারিখে। আবদুল গফুর : বাইশ তারিখে। আবদুল হাই শিকদার : বাইশ তারিখে।

অলি আহাদ : বাইশ তারিখে।

আবদুল হাই শিকদার : আন্দোলনকেন্দ্রিক যে শহীদ মিনার, শহীদ মিনারে প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন তো মওলানা ভাসানী করেছিলেন।

অলি আহাদ : মোটেই না। সেটা করেছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেব। আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেব দৈনিক আজাদের যিনি এডিটর ছিলেন এবং পূর্ববঙ্গ অ্যাসেম্বলির মেম্বার ছিলেন, যা থেকে উনি রিজাইন করেছিলেন।

আবদুল হাই শিকদার : তাহলে আমরা একটা কথা বলতে পারি। যেমন ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বা এ জাতীয় অনেককে নিয়ে আমরা কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু আবুল কালাম শামসুদ্দিনের এই যে একটি ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী কর্ম এটার জন্য তো তাকে আমরা ভাষা আন্দোলনে অন্যতম সৈনিক বা একটা বিরাট ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তি বলতেই পারি।

অলি আহাদ : নিশ্চয়ই। বিরাট ভূমিকা তো বটেই। এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। তখনকার দিনে পূর্ববঙ্গ অ্যাসেম্বলির সদস্যশীপ ছেড়ে দেওয়া একটা ইস্যুর উপরে? যে ইস্যু উনার মুসলিম লীগ সৃষ্টি করেছে। যে ইস্যু নুরুল আমিন সাহেব সৃষ্টি করেছেন। যে ইস্যু খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব সৃষ্টি করেছেন, যে ইস্যু মাওলানা আকরাম খাঁ সৃষ্টি করেছেন, সেই মাওলানা আকরাম খার পত্রিকা আজাদের এডিটর হয়ে, পদত্যাগ করা এর প্রতিবাদ করা এটা চাট্টিখানি কথা নয়।

আবদুল হাই শিকদার : আবার শেখ মুজিবের প্রসঙ্গে যাই। কোনো কোনো বইয়ে লেখা হচ্ছে যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেই বক্তৃতায় যখন বলছিলেন উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে তখন নাকি শেখ মুজিবুর রহমান নোনো করে উঠেছিলেন?

অলি আহাদ : শেখ মুজিবুর রহমানের নোনো বলার সুযোগ কোথায়? এটা তো কনভোকেশন। কনভোকেশনে শেখ মুজিবুর রহমান আসবে কোত্থেকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রই নন। তিনি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এ কনভোকেশনে তিনি কি করে যাবেন? অতএব এটা মিথ্যা কথা। এ মিথ্যাকে ভিত্তি করে মিথ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে যারা বলে তারাও জানেন মিথ্যা কথা বলছেন কিন্তু ওদের তো বলতে হবে।

আবদুল হাই শিকদার : ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক আমাদের দেশের যেসব বইপত্র আপনার চোখে পড়ছে এগুলোর মধ্যে আমরা কোষ্টাকে সবচেয়ে নির্ভরশীল বলতে পারি।

অলি আহাদ : বেশি কথা হইয়া যাইবে। নির্ভরশীল তো আমি আমারটাই মনে করি। কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক আমার কিছু আসে যায় না। আমার একটা শব্দ তাদের যদি শক্তি থাকে তারা অস্বীকার করুক।

আবদুল হাই শিকদার : বদরুদ্দীন ওমর সাহেবের যে বইটা, এটার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?

অলি আহাদ : বদরুদ্দীন ওমর সাহেবের বইকে একেবারে মিথ্যা বলা যাবে শেখ সাহেব সম্বন্ধে অন্যখানে যেভাবে যেভাবে বলা হয়েছে একেবারে মিথ্যা। সবই মিথ্যা। বিকৃত। একথা বদরুদ্দীন ওমর সম্পর্কে বলা যাবে না। দুই/একটা ফ্যাক্টর এদিক সেদিক ভুল হতে পারে। ভুল, ভুলের কারণে হইতে পারে, এটার অন্য কোনো কারণ আমি মনে করি না।

আবদুল গফুর : সেই যে একুশে ফেব্রুয়ারি শেষ হল, এরপরে আপনারা সেই রাত্রেই গোলাম মাওলা সাহেবের রুমে বসেছিলেন না?

অলি আহাদ : বসেছিলাম। গোলাম মাওলা, না আজমল।

আবদুল গফুর : যা হউক মেডিক্যালের একটা হোস্টেলে-

অলি আহাদ : সেখানে আমরা শামসুল হক সাহেবের আসার জন্য বলেছিলাম, তিনি আসেন নাই।

আবদুল গফুর : ওখানে কারা কারা উপস্থিত ছিল?

অলি আহাদ :গোলাম মাওলার কথা আমার মনে আছে। মতিন সাহেব আসেন।

আবদুল গফুর : গাজীউল হক? অলি আহাদ : গাজীউল হকের তো প্রশ্নই আসে না।

আবদুল গফুর : কেন? অলি আহাদ : গাজীউল হক চলে গেল বগুড়া।

আবদুল গফুর : কবে?

অলি আহাদ : ঐদিনই। বরঞ্চ গাজীউল হক আমাকে খবর দিল যে আমার শরীর খারাপ হয়ে গেছে। আমি একথা শুনে মেডিক্যাল কলেজ থেকে দৌড়াইয়া হন্তদন্ত হইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উনাকে দেখলাম। একটা টেবিলের উপর শুইয়া আছে।

আবদুল গফুর : একুশ তারিখে? অলি আহাদ : একুশ তারিখে।

 আবদুল গফুর : কখন?

অলি আহাদ : তখন বোধ হয় বেলা ৪টা সাড়ে ৪টা, তখন কিন্তু শীতের দিন। বেলা পড়তেছে। ৫টাও হইতে পারে। তো আমি বললাম যে, গাজীউল হক সাহেব, কি হইছে আপনার? বলে, জ্বর। বললাম, এরকম হয়, এতে কিছু আসে যায় না। আইসা পড়েন এখান থাইক্যা। এখন আমরা একটু বসবো, আপনি ইমপর্টেন্ট লোক, আপনাকে থাকতে হবে। বললেন, আচ্ছা, আসছি। কইয়া উনি আর আসলেন না। এরপরে আমি লোকশ্রুতিতে শুনলাম, তিনি বগুড়া চলে গেছেন।

আবদুল গফুর : উনি কি গ্রেফতার হননি একুশে উপলক্ষে? একুশে উপলক্ষে কারা কারা গ্রেফতার হলেন?

অলি আহাদ : না, গাজীউল হক সাহেব একুশে উপলক্ষে গ্রেফতার হননি। গুলি হওয়ার পরে উনি ছিলেন, গুলি হয় আড়াইটা কি তিনটায় এমন হবে। অপরাহ্ন বেলায়, এই হইলো কথা। গাজীউল হক সাহেবের দেখা আর পাই নাই, উনি আসেন নাই। আমরা দেখি নাই, হয়ত ছিলেন কোথাও। কোথায় ছিলেন জানি না।

আবদুল হাই শিকদার : আর একটা বিষয় একটু আমরা জানতে চাই। সেটা হল যে ভাষা আন্দোলনের একটা পর্যায়ে আপনি বলছেন যে, যদি জনক বা উদ্যোক্তা বলতে হয়, সেটা প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমকে। পরবর্তী পর্যায়ে আপনারা যখন দায়িত্ব নিলেন, সে সময়ের আপোসহীন, সত্যিকারের, নেতৃত্বদানকারীর ভূমিকায় যে ক’জন ছিলেন, তাদের মধ্যে কাদেরকে আপনি, ক’জনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?

অলি আহাদ : ২১ তারিখ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, প্রথমত কে জি মোস্তফার বরাত দিয়া নাম বলতে হয়, উনাকে রেডিও থেকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কে জি মোস্তফাকে, ভাষা আন্দোলনের নাম বললে, কার নাম বলবেন?

অলি আহাদ। ২য় নাম বললে কার নাম বলবেন? অলি আহাদ আর মতিন। এরপরে? এরপরে জানি না। এটাই বলল, সরাসরি।

আবদুল হাই শিকদার : আচ্ছা, এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ‘৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরবর্তীতে আমরা দেখলাম ২৫শে মার্চের পরে বা ২৫শে মার্চের রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করলেন এবং আওয়ামী লীগরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল চারিদিকে। কেউ পালিয়ে এদিক-সেদিক চলে গেল। এই যে আওয়ামী লীগের বিশৃঙ্খল অবস্থা, সেই সময়কার ব্যাপারটা যদি আপনি বলেন, কেন এরকম হ-য-ব-র-ল করেছিল?

অলি আহাদ ; হ-য-ব-র-ল হওয়ার কারণ হল, শেখ সাহেব কখনো কোনো আন্দোলনকে কনসোলিডেট করে দিতে পারেন নাই, ছড়াইয়া ছিটাইয়া আন্দোলন করেছেন এটা ঠিক। এবং আন্দোলন হয়েছে, এটাও সত্য। শেখ সাহেব আত্মসমর্পণ করার পরে তারা চেষ্টা সত্ত্বেও শেখ সাহেবকে যখন সেনাপতি হিসাবে মাঠে নিতে পারেন নাই, তাদের মধ্যে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব এসেছে, কি করবে? আবার এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই, তাদের মোবালাইজেশনের পিছনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটা সিংহ ভূমিকা ছিল। সেজন্য হাতছানি দিয়ে যখন দিল্লি ডাকে, তোমরা আস, কি বলে এটাকে, বাস্তুহারা হও এবং আন্দোলনের গোড়াপত্তন কর, ভারত থেকে আমরা সাহায্য করব। দিল্লি থেকে আমরা সাহায্য করব, এ হাতছানিতেও তারা, তাজউদ্দিন সাহেব তারা ছিলেন। এইজন্য তারা ভারতে যাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখলেন। এখানে কনসোলিডেট করার চেয়ে যেমন এটা আজকে অস্বীকার করবেন কিনা, করলে তো আমার কিছু আসে যায় না। আমি যেটা সত্য জানি সেটাই বলব। ২৫ তারিখের হামলার পরে। তারপরে যখন ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ তোলা হইল, ২ ঘণ্টা না কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তোলা হইল, আমি একটা বেবীটেক্সি নিয়া গেলাম। বোধ হয় ২৬ তারিখে। যে তারিখেই হউক, আমি বেবীটেক্সি নিয়া চলে গেলাম। ২৬ না ২৭ বোধ হয়। চইলা গিয়া। দেওয়ান সিরাজুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। আর সমস্ত শহরটা ঘুরে দেখলাম। আমার সাহস ছিল এজন্য যে, অবাঙালি যারা অস্ত্র চালনা করছে, তারা আমাকে চেনে না। আর চিনে যারা তারা বাঙালি। গোয়েন্দা বিভাগের লোক। সে গোয়েন্দা বিভাগের লোক আমাকে চিনবে কিন্তু ধরিয়ে দেবে না। এটা আমার একটা বিশ্বাস ছিল। সেজন্য আমি বাইর হয়ে গেলাম। ঘুরলাম। আসলাম আবার ফিরা। আবার গেলাম। সে অবস্থায় আমি আওয়ামী লীগের আ-ও দেখতে পাই নাই। আওয়ামী লীগের আ না দেখলে তো আন্দোলন করা যাবে না। আন্দোলন করতে হলে আওয়ামী লীগ লাগবে। যেমন এখন বিএনপি লাগবে। এখন আন্দোলন করতে হলে বিএনপি ছাড়া হবে না। ঠিক তেমনি তখন আওয়ামী লীগ ছাড়া এ আন্দোলন করা সম্ভব ছিলো না। আমি দৌড়াইয়া চলে গেলাম আনিসুজ্জামান সাহেবের কাছে। আজাদ-এর পরবর্তীকালের এডিটর, বর্তমানে বাসসের প্রধান। উনার এখানে গিয়া বললাম যে, কি করবেন? তো উনি বললেন, অলি আহাদ ভাই, কি করব সব আওয়ামী লীগ ভাগছে। আমি বললাম, ভাগছে তো, কোথায় ভাগছে? বলে, কলাতিয়া, বলি, কেন সেখানে? বলে, সেখান থেকে ইন্ডিয়া যাবে। তাহলে আপনি এক কাজ করেন, ওখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিল কোন হলের জানি, আমার ঠিক মনে নাই, সেই ভাইস প্রেসিডেন্টকে বললাম, তো উনি বলল যে, কি করব, আমি বললাম, আপনি যান কলাতিয়া, কলাতিয়া গিয়া আপনি তাদের সাথে আলোচনা করেন। কইরা তাদের ফেরত আনেন। আমরা এখানে রেজিস্টেন্স করব। উনি বললেন যে, ঠিক আছে। আপনার তো ভালো প্রস্তাব, আমি যাই। উনি গেলেন। গিয়া ফিরা আসলেন। পরের দিন আইসা বললেন যে, আমি কলাতিয়া গিয়া তাদের পাই নাই। তারা সব ইন্ডিয়াতে চলে গেছে। এটাই হল, তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার মূল কারণ।

আবদুল হাই শিকদার : আচ্ছা এমনকি আপনার মনে হয়, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অর্থাৎ সে সময়কার জিয়াউর রহমান যদি স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিত, তাহলে কি আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করত?

অলি আহাদ : স্বাধীনতা সংগ্রাম ইন্দিরা গান্ধী তার প্রয়োজনেই করাতো, অতএব সেখানে অলি আহাদ যাক, তাজউদ্দিন আহমদই যাক, আর মেজর জিয়াই যাক আর ভাসানীই যাক সেটা হইতই।

আবদুল হাই শিকদার : আচ্ছা এই যে তড়িঘড়ি করে মুক্তিযুদ্ধটাকে হঠাৎ করে একসময় দেখা গেল যে, ইন্ডিয়া এর মধ্যে ইনভলভ হল, সরাসরি, একদম সৈন্যসহ যুদ্ধ ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করে দিল। এই তাড়াহুড়া করার কারণটা কি ছিল? এটাকে গণযুদ্ধে রূপ না দিয়ে এভাবে মাঝপথে…।

অলি আহাদ : আমি সেটার পক্ষেই। কারণ, ভারত যদি না আসত তা হইলে পরে, মিছমার হইয়া যাইতো সব। আবার যারা নাকি গেরিলা যুদ্ধ বলতেছিল, যেমন আ স ম আবদুর রব, তারা যুদ্ধের বেলায় কিছু নাই। এলাকায় আসত না। তাদের সঙ্গে আমার কথা হইছে, আগরতলাতে। তারা থাকতো সেখানে আর গেরিলা যুদ্ধ করলেই, এটা ২০ বছর ২৫/৩০ বছরের ভিতরে, এর মধ্যে মানুষ শেষ হইয়া যাইতো। জানে, মানে, ধনে, বলে, জনে এখানকার সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যেত। এইজন্যই ইন্দিরা গান্ধীর এই হস্তক্ষেপটাকে আমি খুব সমর্থন করি। অতএব এটাকে আমি তাড়াহুড়া মনে করি না। যারা মনে করে তাদের জিজ্ঞাসা করেন।

আবদুল হাই শিকদার : আপনার এই সমর্থন করা, তাহলে, এই যে স্বাধীনতা যুদ্ধে মওলানা ভাসানীকে অন্তরীণ বা গ্রেফতার করে রেখেছিল ইন্ডিয়া, এটার ব্যাপারে আপনার বক্তব্য?

অলি আহাদ : মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করে রাখা বা অন্তরীণ করে রাখা এজন্য যে, মওলানা ভাসানী যেহেতু মওলানা ভাসানী, তাহলে তখনকার স্বাধীন বঙ্গদেশের প্রেসিডেন্ট তাকেই ঘোষণা করতে হয়। মওলানা ভাসানীকেই করতে হয়। ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়োজনে যেহেতু এই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ। তার প্রয়োজন ছিল, সেহেতু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘোষণা করা হল প্রেসিডেন্ট। আর একটিং প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলো নজরুল ইসলাম সাবকে। প্রাইম মিনিস্টার তাজউদ্দিন আহমদকে। তারা তার হাতের মধ্যে ছিল। তো মওলানা ভাসানী তার হাতের মধ্যে নয়। সেজন্য তাকে গ্রেফতার করে রাখল। তাকে হেয় করে রাখা হল। ইচ্ছা থাকলেও তিনি কিছু করতে পারলেন না।

আবদুল গফুর : কিন্তু এ পাওয়াকে কি পূর্ণ পাওয়া বলা যায়?

অলি আহাদ : পূর্ণ স্বাধীন দেশ পাইতে দেরি হইলে ধনে জনে, বলে শেষ হয়ে যাইতে হত। সুতরাং পূর্ণ স্বাধীনতা পাইতো কি পাইতো না, সেকথা বলাও কঠিন। এখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরই প্রয়োজনে। ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়োজনে। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি এবং এটা আমি মনে করি জডিসাস ডিসিশান। এই ডিসিশানের ফলে বাংলাদেশ আজকে স্বাধীন হিসাবে আমরা আছি। আমার কোনো কনফিউশান এ ব্যাপারে নাই।

আবদুল গফুর : আচ্ছা, একটা ব্যাপার দেখা যায় একটা বইতে যে, ১৯৭১ সালে যখন মুজিবনগর সরকার ওখানে ছিল, ইন্ডিয়ার সয়েলে, তখন মুজিবনগর সরকারের একটিং প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এমন একটা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ৭ দফা চুক্তি হিসাবে, যাতে বলা ছিল যে, মুক্তিবাহিনী ইন্ডিয়ান কমান্ডের অধীনে থাকবে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। তারপর এখানকার যারা ব্যুরোক্রেটস রয়েছে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছে, তাদের যারা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন নাই, তাদের রিটায়ার করিয়ে দেয়া হবে। প্রয়োজনবোধে শূন্যপদ ইন্ডিয়ান কর্মকর্তাদের নিয়ে পূরণ করা হবে, এবং পররাষ্ট্রনীতি নেয়ার সময় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সাথে যোগযোগ করা হবে। এ ধরনের অনেকগুলোই ছিল। তো এই যে চুক্তিটা স্বাক্ষর করার একটা সুযোগ পেল, এটা তো ইন্ডিয়ার মাটিতে ছিল বলেই। এবং ইন্ডিয়ার চাপ ছিল বলেই, এটা সত্য না?

অলি আহাদ : নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এখানেই তো বেশকম। যদি মওলানা ভাসানী হইতেন প্রেসিডেন্ট প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের, প্রভিশনাল রাষ্ট্রের, স্বাধীন রাষ্ট্রের, তা হইলে ইন্দিরা গান্ধী যে চুক্তি ৭ দফা সই করায়ে নিয়েছিলেন সেটা করাতে পারতেন না। সেইজন্যেই ইন্দিরার স্বার্থেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর স্বার্থেই মওলানা ভাসানীকে অন্তরীণ করা হয়েছিলো। ইন্দিরা গান্ধীর স্বার্থেই আমরা তার কাছে মাথা নত করেছি। এখানে ঐ বৃটিশের আমলে সিরাজদ্দৌলা যে ভূমিকা পালন করেছিল, মওলানা ভাসানী সে ভূমিকা পালন করেছেন। আর যে ভূমিকা মীর জাফর পালন করেছেন সে বৃটিশের আমলে, সে ভূমিকাটাই পালন করেছে তাজউদ্দিন এবং নজরুল ইসলাম তারা। সেইজন্য দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি না হলেও মোটামুটি কম্প্রোমাইজ করে নেয়া হয়েছে।

আবদুল গফুর : আচ্ছা, আর একটা প্রশ্ন, আমাদের ইতিহাসের পটভূমি যখন বিশ্লেষণ করতে দেয়া হয়, কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন; তারা বলতে চান, পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বা আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিকাশের কোনো সম্পর্ক নেই এবং যে লাহোর প্রস্তাবের কথা বলা হয়, অনেকে বলে যে, লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়েছে; লাহোর প্রস্তাবের একটা অংশ ‘৪৭ সালে বাস্তবায়ন হল পার্টিশন অব ইন্ডিয়া। আর একটা বাস্তবায়িত হল যে, ঐ দুই অংশের দুটো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে। আচ্ছা, এই যে ব্যাপারটা তারা বলতে চান যে, লাহোর প্রস্তাবের সাথে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বা বাংলাদেশ সৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নাই। এ সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

অলি আহাদ : লাহোর প্রস্তাব না হলে পাকিস্তান হত না। দিল্লি কনভেনশনের প্রস্তাব না হলে পাকিস্তান হত না। পাকিস্তান না হলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হত না। অর্থাৎ আমরা দিল্লি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতাম, অখণ্ড ভারতের অংশে থাকতাম, অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ আছে। তারা কি স্বাধীনতা পেয়েছে? নাকি স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে পারছে? আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে পেরেছি, যেহেতু পাকিস্তান হয়েছিল, সেহেতু পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়েছে। যদি আমরা পাকিস্তান না হয়ে বা পাকিস্তান হওয়ার পরও যদি ভারতের অধীনে থাকতাম অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের সাথে থাকতাম তাহলে সমস্ত বঙ্গদেশই আজকে হিন্দুস্তানের পদতলে থাকত। অতএব যে যা বলুক না কেন, এটা হল জ্ঞানপাপীদের কথা। এর মধ্যে একজন আছে শওকত ওসমান। শওকত ওসমানের কাছে আমার প্রশ্ন, জনাব, ভারত বিভক্তির পরে আপনারা সুন্দর দেশটিতে থাকলেন না কেন? আপনাদের মত এরকম বহু লোক এসেছেন এখানে। এখানকার কলাটা, মূলাটা চোষার জন্য এবং খেয়েছেন আপনারা। আবার এখন উল্টা বাক্য আওড়ান। উল্টা বাক্য যখন তো দয়া করে দিল্লিতে যান, পশ্চিমবঙ্গে যান, পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতা চান। তাহলে বুঝব ওখানের বাঙালিরা স্বাধীনতা চায়। কিন্তু ঐ বাঙালিরা স্বাধীনতা চান না। আপনারা অখণ্ড ভারত চান। আমাদের পরাধীনতা চান। এ পরাধীনতার জন্য কি আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে, ‘৪৭ থেকে আরম্ভ করে বহু ত্যাগ করেছি, বহু জেল খেটেছি, বহু কষ্ট করেছি? নিজের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সপেল করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়তে পারলাম না। বিদেশে আর পড়তে যাইতে পারলাম না। যেহেতু এখানকার এক্সপালশান আছে আমার। সেহেতু এ রেফারেন্সে সেখানে আর হয় না। বার এট ল’ পড়তে পারিনি। কিন্তু আপনারা কোনটা খাননি? কোন কলাটা, মূলাটা খান নি? পরাধীন থাকতেও আবার কলাটা, মূলাটা পাবেন। এখানে আইসা আমাদের দয়া করে জ্বালাতন না করে বাঙালি দাবি করেন, তা না করে দয়া করে পশ্চিমবঙ্গে যান, পশ্চিমবঙ্গে গিয়া ঐটাকে স্বাধীন করে আসেন। জ্যোতি বসুর সাথে কথা বলেন। আমি দেখতে চাই কেমন ব্যাটাডা হয়েছেন আপনারা। আমাকে বলেন, আমি পারব। আমি আগরতলায় আপনার মত পণ্ডিতদের বলেছিলাম যে, আমরা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। আমরা রাওয়ালপিন্ডি, করাচির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, আপনাদের এখানে আশ্রয় নিতে এসেছি যুদ্ধ করার জন্য। আপনারা এখন পশ্চিমবঙ্গের সাথে, পশ্চিমবঙ্গকে বলেন, আপনার ত্রিপুরায় বাঙালি বেশি, আপনারা বলেন, আমরা দিল্লির অংশ হিসাব থাকব না। আমরা অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে থাকব না। আমরাও স্বাধীনতা চাই, সার্বভৌমত্ব চাই, বাঙালিদের জন্য। যেমন শরৎচন্দ্র চেয়েছিল, যেমন সোহরাওয়ার্দী সাহেব চেয়েছিলেন, যেমন কিরণ শংকর রায় চেয়েছিল, যেমন এস এম দাশ গুপ্ত চেয়েছিল। আপনারা দয়া করে এটা করেন। এখন সুযোগ আছে। কিন্তু সাহেব বলে, না এটা আমরা করব না। আমরা অখণ্ড ভারতের সদস্য হিসাবে নিজেদেরকে গর্ববোধ করি।

আবদুল গফুর : আচ্ছা একটি জিনিস তাহলে দেখছি, আপনার কথায় আমরা এটা বুঝতে পারছি, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলনের সবগুলো ঘটনা একটার সাথে একটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

অলি আহাদ : নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই জড়িত।

আবদুল গফুর : তাহলে লাহোর প্রস্তাবের সাথে আমাদের বাংলাদেশের যে ইমার্জেন্স, এটার একটা অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

অলি আহাদ : নিশ্চয়ই আছে, লাহোর প্রস্তাব না হলে তো পাকিস্তানই হত। অখণ্ড ভারত থাকত। ভারত খণ্ডিত হত না। লাহোর প্রস্তাব না হলে পূর্ববাংলা স্বাধীন হত না। আমরা চেয়েছি বঙ্গদেশকে, আমরা চেয়েছি আসামকে, একত্রে মিলে লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী। কিন্তু আমরা আসাম, বেঙ্গল দুইটার কোনোটাকেই পাইনি, না পেলেও তো এইটুকু আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমার এই জায়গাটুকুতে আমি আজকে স্বাধীন। যে স্বাধীনতার ফল, আজকে ধানমন্ডিতে বসে কথা বলি, এটা একটা বাজার ছিল। ধানমন্ডি অর্থাৎ ধানের বাজার। আর চতুর্দিকে ছিল ধানক্ষেত। সে জায়গা আজকে অট্টালিকাপূর্ণ। আমার দেশে আজকে যে অবস্থা চট্টগ্রামে হয়েছে, মংলা পোর্টে হয়েছে। এমনকি দেশব্যাপী যে উন্নতি হয়েছে, এটা একটি মাত্র কারণ, পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল। লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তান হওয়ার পরে বাংলাদেশ স্বাধীন আজো আছে, যদিও নানা ষড়যন্ত্র চলছে, দিল্লির পদতলে পুরাপুরিভাবে নিয়ে নেওয়ার জন্য। আবদুল গফুর : আচ্ছা এ ধরনের কি একটা ষড়যন্ত্র আপনি মনে করেন, এই যে সম্প্রতি পার্বত্য চুক্তি একটা স্বাক্ষরিত হয়েছে আজকে একুশের মাসে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে, আপনি একুশের একজন ভাষা সংগ্রামী, আপনার দৃষ্টিতে চুক্তির সাথে একুশের চেতনার সম্পর্কটা কি?

অলি আহাদ : একুশের চেতনা স্বাধীনতার দিকে আমাদের ধাবিত করে। সার্বভৌমত্বের দিকে ধাবিত করেছে। বাঙালি এক জাতি প্রমাণ করার জন্য। আর আমাদের কাছে সে একুশের চেতনাকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে নিভিয়ে দেয়ার জন্য এই পার্বত্য চুক্তি করা হয়েছে। এ চুক্তির অর্থ আগামী দিন সেই গেট ওয়ে টু, কি বলে এটাকে?

আবদুল গফুর : সেভেন সিস্টারস।

অলি আহাদ : গেট ওয়ে টু সেভেন সিস্টারস হল পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং গেট ওয়ে চিটাগাং পোর্ট, এ বিবেচনায় গেট ওয়ে টু চিটাগাং পোর্ট বলেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে আমাদের অংশ হিসাবে দিয়েছে। আজ এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হিন্দুস্তান যাতে নাকি একটা পর্যায়ে গিয়া সার্কেল চীফ এবং যে সকল চুক্তি করা হয়েছে চুক্তিগুলি ধারা অনুযায়ী এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে যে তারা বলবে, আমরা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট ঢাকার নির্দেশ আর মানব না। তারপর তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকবে দিল্লি। দিল্লি সঙ্গে সঙ্গে তাকে রিকোগনিশন দিয়ে দিবে। মানতে হবে, তাই মানতেছে, তাদের কোনো ইন্ডিপেন্ডেন্ট, স্বাধীন কোনো ভূমিকা নাই।

আবদুল হাই শিকদার : স্বাধীন কোনো ভূমিকা নাই বলতে চাচ্ছেন, কিন্তু আপনারা যারা বিরোধী দলে আছেন, তাদের কাছ থেকেও তো আমরা কোনো কার্যকর, যেমন জনসভার কথা বলতে পারি আমরা, জনসভার ব্যাপারে কিছু প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল গভর্নমেন্ট, এখানে করতে পারবে, এখানে করতে পারবে, এখানে করতে পারবে না, রাস্তায় নামলে লাঠিপেটা এবং প্রচুর সংবাদপত্রের উপর দমন হয়েছে, দৈনিক বাংলার মত পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনেকে আমরা ছুরিকাহত হয়েছি, কাউকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এ রকম টোটাল বাংলাদেশে মানবাধিকারের উপর যুক্তরাষ্ট্রের যে পররাষ্ট্র দফতর তারাও একটা রিপোর্ট পেশ করেছে, কিন্তু ৭ দল থেকে এ রকম কার্যকর মানবাধিকারের ব্যাপারে আপনাদের ভূমিকাটা আপনি বলবেন? এগুলো প্রতিরোধের ব্যাপারে আপনারা কি করছেন?

অলি আহাদ : মন্তব্য করার সময় আসে নাই।

আবদুল হাই শিকদার : না, আমরা যেটা জানতে চাচ্ছি সেটা হল যে, টোটালী আপনারা কি করতে যাচ্ছেন; রাজনীতি, গণতন্ত্র ও দেশের জন্য।

অলি আহাদ : করতে তো চাই একুশে ফেব্রুয়ারির মত, পারছি কোথায়?

আবদুল হাই শিকদার ; তাহলে আপনি কি আশাবাদী, না হতাশ?

অলি আহাদ : আমি যখন বাচ্চাকাল থেকে বিভিন্ন আন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকা মোটামুটি রেখে আসছি, আমার তো হতাশ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

আবদুল হাই শিকদার : আচ্ছা আর একটা ব্যাপার। এই পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে যেহেতু প্রসঙ্গটা এসে গেছে, ঐ প্রসঙ্গেই কথা বলি। সেটা হল যে পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তিটাকে আপনারা বলেছেন যে এটা স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং সংবিধান বিরোধী, এখন এ চুক্তি প্রতিরোধের ব্যাপারে একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে আপনার নিজের দল এবং বিএনপি, জামায়াতসহ ৭ দলের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা আমরা দেখলাম না। আপনারা হরতাল করেছেন। অবশ্যই, কিন্তু জাতীয়ভাবে যেদিন চুক্তিটা হল সে দিন থেকে শুরু করে কথা ছিল যে, বাতিল না হওয়া পর্যন্ত চলবে, অর্থাৎ সেদিন হরতাল থাকবে। এবং ঈদের পরে কঠোর কর্মসূচি দেবেন, তো আমরা কোথাও কোনো পর্যায়ে এরকম কোনো আলামতও দেখছি না। এর মানে কি এই যে আপনারা এটা মেনে নিয়েছেন, নাকি?

অলি আহাদ : এর উপরে মন্তব্য করার সময় এখনও আসে নাই।

আবদুল হাই শিকদার : তাহলে এটা কি আমরা এটুকু আশ্বস্ত হতে পারি, এই যে, আপনারা এ চুক্তিটাকে মেনে নিচ্ছেন না, নাকি মেনে নিয়েছেন?

অলি আহাদ : মেনে নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। মেনে না নেওয়ার পরে যে ধরনের সক্রিয় কাজ অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারির মত করা সেটা হয়ত আমরা করতে পারি নাই বা করি নাই। কিন্তু মেনে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না।

আবদুল হাই শিকদার : বর্তমানে সরকারকে এ পার্বত্য চুক্তি করার পরে আপনি মানে আপনাকে যদি বলা হয়, এ ব্যাপারে টোটাল একটা মন্তব্য করেন, তো এ সরকার সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? এ চুক্তি শত বিরোধিতা সত্ত্বেও তো তারা করলো।

অলি আহাদ : দিল্লির বশংবদের পক্ষে আর কি উপায় ছিল? এ সরকার দিল্লির বশংবদ এটা মানেন কি না? এটা মানার উপর নির্ভর করবে সবকিছু। আমি মনে করি এ সরকার সেবাদাস সরকার। আমি এটা মনে করি, সেবাদাস সরকারের পক্ষে, যেমন মীর জাফরের পক্ষে সম্ভব ছিল না ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার যেমন চেষ্টা করে ওঁ আঁ করেও (মীর জাফরের জামাইটার নাম কি ভুলে গেলাম) মীর কাসেম, চেষ্টা করে ওঁ আঁ করেও শেষ পর্যন্ত মাইনা নিতে হয়েছিল। এ জন্যই শেষ পর্যন্ত মাইনা নিতে হয়েছে। টিকে নাই। আমার বক্তব্যটা হল; এখন ধরেন সিকিমে লেন্দুপ দর্জি যে অপজিশানটা বিল্ড আপ করে, তারাও পার্লামেন্টে আসে, সে পার্লামেন্ট দিয়েই সিকিমকে ভারতের অংশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। আজ এখানেও শেখ হাসিনা লেন্দুপ দর্জির যে ভূমিকা সে ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ তার পক্ষে বা দিল্লির দালালের পক্ষে অন্য কিছু চিন্তা করার কোনো স্থানই নাই।

আবদুল হাই শিকদার : এই যে পানিচুক্তি যেটা হয়ে গেল, এর আগে এই পানিচুক্তি করিডোর, ট্রানজিট এসব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, আপনার নিজের বক্তব্যও আমরা পাঠ করেছি, তা এই সবটা টোটাল বিচারে বাংলাদেশের। বর্তমান সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপারে আপনার মূল্যায়নটা আমরা জানতে চাচ্ছি।

অলি আহাদ : সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা হল, বিদেশের দালালী করা যা দিল্লি সিদ্ধান্ত করে দেবে, তা-ই তাদের দিবে এজন্য যে, দিল্লির এই চিটাগাং পোর্টের প্রয়োজন আছে। বে অব বেঙ্গলের উপর যে চিটাগাং পোর্ট এই চিটাগাং পোর্টের তাদের প্রয়োজন আছে। তাদের এই সেভেন সিস্টার-এর ৭টা রাজ্য, এই ৭টা রাজ্যের জন্য ইমপোর্ট বলা হউক, এক্সপোর্ট বলা হউক, এগুলো সম্পূর্ণ চিটাগাং পোর্টের মারফতে করতে হবে। সুতরাং চিটাগাং পোর্টকে তাদের প্রয়োজন আছে। এখন তারা একটা পর্যায়ে গিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতা পর্যন্ত দেওয়ার পরে চিটাগাং পোর্ট আমাদের ব্যবহার করতে  চট্টগ্রাম সেটা লিখে দিবে। এখানে বিগ ব্রাদার এটিচুড যেটা সে বিগ ব্রাদার এটিচুডটাই কাজ করবে যা আমাদের সমূহ ক্ষতি। বাংলাদেশকে পরাধীন করার জন্য এটা একটা সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র এবং এই ষড়যন্ত্রই কার্যকর হতে যাচ্ছে। কোশ্চেন অব টাইম, কত দিনে হবে সেটা হল বক্তব্য।

আবদুল হাই শিকদার : বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি? কি হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ, একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ? বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তের দেশের প্রবীণতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কণ্ঠে এর মূল্যায়ন কি হবে একটা ভবিষ্যদ্বাণী জানতে চাই।

অলি আহাদ : বাংলাদেশের কিছু ভবিষ্যৎ নেই। আপামর চরিত্রহীনতায় ভরা। স্বার্থপর চরিত্রহীনতা কোনো দিনও জাতিকে গড়তে দেবে না। এটা আমি জানি, আমার এ কথাতে অনেকে খুব রাগ হবে, গালাগালিও করবে, তারপরেও আমি যে অবস্থা দেখছি, চারিত্রিক পরিবর্তন না আসলে, আসবে বলে আমি দেখতেছি না, এ দেশের পরিবর্তন হবে না। হ্যা, পরিবর্তন একটা হয়েছিল, ১৫ই আগস্ট। সেই বীররা যদি, তারা বীর কি না জানি না, লেখাপড়া কতদূর জানি না। তবে ১৫ই আগস্টে যে পরিবর্তন আসছিল, সে পরিবর্তন ধরে রাখলে আজকে এ অবস্থা হত না। ১৫ই আগস্টের আগে ও পরে যে সকল সরকার আসছে, সবাই চোর ছিল এবং লুটপাটের পুরা অংশীদার ছিলেন। লুটপাটও করব, আদর্শও প্রতিষ্ঠা করব, জাতিও বাঁচাবো, সেটা কখনো হয় না। অতএব, আমার এ সকল মন্তব্য থেকে আপনারা বুঝে নেন, কি বলতে চাই আমি।

আবদুল হাই শিকদার : এখানে তাহলে একটা কথা আপনি নিজে বলেছেন যে, আপনি আজীবন আশার রাজনীতি করেছেন। কিন্তু আপনি এখন যে মন্তব্য করলেন, এটার মধ্যে আমরা আশার কোনো আলো দেখতে পাচ্ছি না।

অলি আহাদ : কারণ, আমি সেই কায়েদে আযমের নেতৃত্বও দেখি না, যে নেতৃত্বে পাকিস্তান করেছি। আমরা জয় প্রকাশের নেতৃত্বও দেখছি না, যে নেতৃত্বে চরিত্রও দেখা যায়। আমরা আবুল হাশিম সাহেবের নেতৃত্বও দেখি না, যে নেতৃত্বে আমরা আদর্শ শিখেছি। আদর্শের যে হাওয়া ছিল, সেটা পুরাপুরি বিদায় নিয়েছে। এখন রাজনীতির অর্থই হল চরিত্রহীনদের রাজনীতিক কাজ। এ হল সাধারণ লোকের ধারণা। সাধারণ লোকের ধারণা হউক আর না হউক, যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে চরিত্রহীনতা প্রকাশ পাচ্ছে। এ হল দেশের অবস্থা এ অবস্থায় দেশের কাছে কোনো পরিবর্তন আশা করাটা অন্যায়। সেই একনিষ্ঠ সংগ্রামী চরিত্র, সেই চরিত্রবান পুরুষের স্থান কোথায়? কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ থাকলে এবং এই আন্দোলন তিনি গাইড করলে পরে তাহলে হয়ত চরিত্র আমরা কিছু দেখতে পেতাম। আন্দোলন মানে পাকিস্তান হওয়ার পরও কিছুকাল যদি বেঁচে থাকতেন, শেখ সাহেব দুর্নীতির দায়ে তো তখন তারও মামলা হয়েছিল, সাজাও হয়েছিল। শেখ সাহেবের সময় ৩ পয়সার পোস্টকার্ডে দুর্নীতি দমন করা হবে, গ্রেফতার করা হবে বলা হয়েছিল, ৩ পয়সার পোস্টকার্ড বহু লেখা হয়েছিল। কোনো কিছু হয় নাই। মধ্যে থেইকা যারা চিঠি পোস্টকার্ড লিখেছিল, বরং তাদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলেন। এ রকম চরিত্রহীনতা, সেই দেশে বৈপ্লবিক চিন্তা করা, চরিত্রের কথা চিন্তা করা, আদর্শের কথা চিন্তা করা, খোলাফায়ে রাশেদিনের সমাজব্যবস্থার কথা চিন্তা করা, সে কথা কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।

আবদুল হাই শিকদার : উদ্ধারের উপায়টা কি? একটা নির্দেশনা আমরা আপনার কাছে চাই। কি রেখে গেলেন পরবর্তী নিশানবরদারদের জন্য।

অলি আহাদ : যারা জিয়াউর রহমানের সরকার করেছেন, শেখ সাবের সরকার করেছেন। উল্টিয়ে দে মা লুটেপুটে খাই, এ অবস্থা শেখ সাবের সময় হয়েছে। শেখ সাহেবের পরে জিয়াউর রহমান সাহেব। খন্দকার মোশতাকের অল্প কয়দিন, ৮৩ দিন এটা হইলো স্বর্ণযুগ। আবার সাত্তার সাবের সময়, তখন একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এসেছিল। তারপর তাকে বিদায় দেয়া হল। জিয়াউর রহমানের সময় কোনো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ছিল না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সৎ ছিলেন এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নাই। আমরা যতটুকু শুনেছি। কিন্তু অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ছিল চোর, দুর্নীতিবাজ। আবার এরশাদের সময় তো এটা প্রশ্নই উঠে না, দুর্নীতি ছাড়া তো কোনো কথাই ছিল না। সেখানে তারপরের সরকার, আমার বলার দরকার নাই, আমি না বললেও যারা বোঝার, যারা জানার তারা জানে। আমি সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করব না। তারপরে যে সরকার, একজনে তো এক মন্ত্রী ৮০০ কোটি টাকা হোয়াইট করে নিয়েছেন। কোথায় পাইলো টাকাটা? ৮০০ কোটি টাকা গেল কেমনে? উনি তো কার পোলা আমি জানি, তিনিও জানেন। কি আরম্ভ হয়েছে। বিশেষ করে গ্যাস এবং তেলের ব্যাপার নিয়া, টাকার খেলা কি জিনিস—সে জিনিসটা আর কিছু দিন পরে, সবাই জানতে পারবে। এটা জানার বোধ হয় বিশেষ বাকিও নাই বর্তমানে। বর্তমানে |সেইজন্য আমি বলেছি যে, এ সরকার গণভোট দিলে ৯০% ভোট তার বিরুদ্ধে যাবে। মুসলমানরা তার বিরুদ্ধে থাকবে। তার পক্ষে ভোট পড়বে না একটাও। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে। মাফ চেয়ে পার পাওয়া যাবে না। এর মধ্যে নির্দেশনা একটাই, এখন সেই চরিত্র চাই, কীভাবে আসবে আমি জানি না। আমি কোনো পিথ দেখি না। আর কি বলব।

আবদুল হাই শিকদার : আরেকটা কথা বলি, আপনি আজাদ বাংলার কথা বলছিলেন, দেশ স্বাধীনতার পরে। সে আজাদ বাংলার কারণ ছিল কি, ফিলোসোফিটা কি ছিল?

অলি আহাদ : আজাদ বাংলার ফিলোসোফিটা ছিল যে, হিন্দুস্তানের পদতল হতে বের করা এবং আজাদ শব্দটার একটা কনোটেশন আছে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের কনোটেশন একটা শব্দই কেরি করে। তার সাথে জীবনের মূল্যবোধ জড়িত আছে। তার সাথে আরো অন্যান্য মূল্যবোধ জড়িত। সব মিলাইয়া সামাজিক মূল্যবোধ, জীবনের মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক মূল্যবোধ, এসব কিছু মিলেই আজাদ শব্দটার আমরা ডাক দিয়েছি। আমরা তখনকার দিনে, ভারতের যে দাপট আমাদের ওপর দেখতে পেরেছি, সেই দাপটকে বাধা দেয়ার জন্য একটা স্লোগান দেয়ার দরকার ছিল। একটা অল্প শব্দে, এটা আজাদ বাংলা শব্দটাতে ডাক দিয়েছিলাম। দিল্লির দাসত্ব হতে মুক্তি চাই। দিল্লির দাসত্ব এসে গিয়েছিল বলেই আজাদ বাংলা শব্দটা এসেছিল।

আবদুল হাই শিকদার : সে প্রেক্ষাপট কি এখনো আছে বলে মনে করেন? নাকি শেষ হয়ে গেছে?

অলি আহাদ : না না, শেষ হয় নাই। শেষ হয়েছিল, ১৫ই আগস্টের পরে কিছু কাল স্থগিত ছিল। বর্তমানে পুরোপুরি আবার সেই দাসত্ব।

আবদুল হাই শিকদার : এখন কি আপনি আবার আজাদ বাংলা আন্দোলন শুরু করবেন?

অলি আহাদ : আমি তো চাই। আজাদ বাংলার ডাক আমি দিতে চাই। কিন্তু আমি ডাক দিলেই কি বিএনপি শুনবে? কারণ, তাদের টাকা আছে। এখনকার সংগঠন মানে টাকা, যার টাকা নাই সে সংগঠন করতে পারবে না। সংগঠন না করতে পারলে ডাক দেয়া যাবে না। ডাক দিলে সে ডাক কার্যকর হবে না। আমার ডাক দেয়ার খুব ইচ্ছা আছে, কিন্তু আমার দেয়ার ওপর, ইচ্ছার ওপর সবকিছু নির্ভর করে না।

আবদুল হাই শিকদার : আপনার জীবনের শেষ ইচ্ছা কি?

অলি আহাদ : জীবনের শেষ ইচ্ছা? শেষ ইচ্ছাটা হল, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই হইল আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা।

আবদুল হাই শিকদার : অবিভক্ত ভারতের ‘৪৭-এর আগে যেসব জাতীয় নেতা ছিলেন, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জহরলাল নেহরু, লিয়াকত আলী খান, গান্ধী, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী এদের মধ্যে গান্ধীজি ও কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র মধ্যে যদি তুলনা করতে বলা হয়, তাহলে কি রায় হবে আপনার?

অলি আহাদ : কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন সত্যবাদী, স্পষ্টভাষী। ধোকা কাকে বলে তা তিনি জানতেন না। গান্ধীজি, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুসহ ভারতের নামকরা প্রায় সব রাজনীতিবিদেরই জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারা ছিলেন প্রতারক। মিথ্যা কথা বলতেন হরদম। ওয়াদা করেন একটা করে আর একটা। তারা অখণ্ড ভারত চেয়েছিলেন। গান্ধীজি মাউন্ট ব্যাটেনকে বলেছিলেন, জিন্নাহকে বলার জন্য, তাকে প্রধানমন্ত্রী করলে তিনি রাজি আছেন কি না? উত্তরে জিন্নাহ বলেছিলেন, গান্ধীজিকে জিজ্ঞাসা করুন, তার নেহরু এবং প্যাটেল রাজি আছে কি না? উত্তর সেখানেই হয়ে গেল গান্ধীও যা বোঝার বুঝলেন। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অখণ্ড বঙ্গদেশ স্বাধীন সার্বভৌম চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের অংশ হতে হবে তাও তিনি বলেন নাই। কিন্তু গান্ধীজি অখণ্ড ভারত চেয়েও খণ্ড বঙ্গদেশ চেয়েছিলেন। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ১৯০৫ সাল থেকে শুরু করে বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে ১৯১১ সাল পর্যন্ত আন্দোলন করে এবং বঙ্গ বিভাগ রদ করে। অথচ সেই কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলেই পরে ‘৪৭-এ। বঙ্গভঙ্গের জন্য উঠে পড়ে লেগে গেলেন। সুতরাং কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সমস্ত অখণ্ড ভারতে একমাত্র নেতা কোনো প্রসঙ্গেই যার মধ্যে কোনো দোদুল্যমানতা ছিল না। ছিল স্পষ্টবাদিতা, ছিল সত্যবাদিতা। ধোকা কাকে বলে তা তিনি জানতেন না। আমরা তার নেতৃত্বে কাজ করেছি। কায়েদে আযমের নেতৃত্বে কাজ করে আমাদের দুঃখ যে তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আমরা কাজ করেছি, কিন্তু আমাদের মধ্যে পরবর্তীকালে সে মানের নেতৃত্ব আমরা পাইনি। ফলে যা হবার দেশের তাই হয়েছে।

আবদুল হাই শিকদার : আপনি কি নিজেকে রাজনৈতিকভাবে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক নেতার অনুসারী মনে করেন?

অলি আহাদ : একমাত্র কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুসারী আমি।

আবদুল হাই শিকদার : মওলানা ভাসানী সম্পর্কে আপনার সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন চাই।

অলি আহাদ : দেশপ্রেমিক।

আবদুল হাই শিকদার : হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

অলি আহাদ : ক্ষমতা প্রেমিক।

আবদুল হাই শিকদার : শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক?

অলি আহাদ : ক্ষমতা প্রেমিক।

আবদুল হাই শিকদার : জিয়াউর রহমান?

অলি আহাদ : জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কমেন্ট করতে হবে এটা শুনেই তো আমি আশ্চর্য হচ্ছি। তিনিও ক্ষমতা প্রেমিক।

আবদুল হাই শিকদার : বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?

অলি আহাদ : যদি আমরা বাংলাদেশে বাস করি, আর এর নাগরিক হই, তাহলে জাতীয়তাবাদ তো বাংলাদেশী হবেই। আবার আমি মনে করি বাঙালি জাতীয়তাবাদও হতে পারে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোনো কনটেস্ট আছে বলে আমি মনে করি না। এটা শেখ হাসিনা মনে করে।

আবদুল হাই শিকদার : আপনার স্নেহভাজন ভাতিজী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আপনার কোনো উপদেশ আছে কি না?

অলি আহাদ : অরণ্যে রোদন, তা হবে অরণ্যে রোদন মাত্র।

আবদুল হাই শিকদার : অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।

অলি আহাদ : আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।

১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮

যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল’ ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা ও কার্যকর করার জন্য দেশবাসীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান রক্ষার নির্ভরযোগ্য কাণ্ডারী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান স্থপতি, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ডেমোক্র্যাটিক লীগ প্রধান, চিরবিদ্রোহী আপসহীন জননেতা অলি আহাদ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর, অতি সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাবকে বক্ষ্যমাণ সাক্ষাৎকারটি দেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আবদুল হাই শিকদার।

ইনকিলাব : হঠাৎ করে দেশের অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আর এই উত্তাপ সৃষ্টি করেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ স্বয়ং। এর কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?

অলি আহাদ : হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়েছে তা নয় বরং বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীন দল তাদের নড়বড়ে অবস্থা টের পেয়ে তাদের চিরাচরিত স্বভাব মতই হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বা বিরোধী দলে যেখানেই থাকুক এমন আচরণই তাদের স্বভাব। তারা তাদের অপচিন্তার শক্তি ও উগ্র দাপট প্রকাশে অভ্যস্ত। এর ব্যতিক্রম সুশীল সমাজের ভদ্র আচরণের তালিম তারা পায়নি। প্রাক-পাকিস্তান অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে লাঠিয়াল হিসেবেই শেখ মুজিব আবির্ভূত হন। আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা হিসেবে তার ঐ চরিত্রই তার কর্মী বাহিনীর মধ্যে চিত্রিত ও বিকশিত করেছেন। ক্ষমতায় বসে তাদের অবাধ লুটপাট ও ডাণ্ডাবাজির ট্রেনিং দিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী, নীলবাহিনীর হিংস্র মারধর, প্রকাশ্য ও গুম হত্যা, পাশবিক ও দৈহিক নির্যাতন, ধর্ষণ, লাগামহীন লুটপাট যেমন জনগণ দেখেছে, আজ ২১ বছর পর তারই পুনরাবৃত্তি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ৭৩-এর মত ব্যালট লুণ্ঠনের ও মিডিয়া কুর নির্বাচনের মত আগামী নির্বাচনেও জিততেই হবে—এই মানসিকতার উগ্রমূর্তি দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছে—আগামী নির্বাচন অবধি এই অশান্ত অস্বস্তিকর, দুঃসহনীয় অবস্থা বিরাজ করছে।

ইনকিলাব : দেখা যাচ্ছে যতই দিন যাচ্ছে সরকারি দল ততই মারমুখী হয়ে উঠেছে। প্রকারান্তরে এর মোকাবিলায় বিরোধী দলগুলো যেন কিছুটা অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছে। এর কারণ কি?

অলি আহাদ: আমি আগেই বলেছি বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে তাদের পতন আঁচ করেই বড় গলায় কথা বলে তারা তাদের মন-মানসিকতার প্রকৃত ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব আড়াল করতে চাচ্ছে। তবু তাদের ভীতিপ্রসূত কাপা কণ্ঠ গোপন করতে পারছে না। বিরোধী দলগুলো অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছে, যা বিরোধী শিবিরে দৈন্যদশা সৃষ্টি হয়েছে—অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতার নিরিখে এমনটি ভাবার কোন কারণ দেখি না। আন্দোলনকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয় তবে জনরোষের উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে ১৯৪৯-৫২-৫৪ মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন, ‘৬০-এর দশকে জেনারেল আইয়ুব মোনায়েম খা গোষ্ঠী, ‘৭০-৭১-এ ইয়াহিয়া ভুট্টোর গোষ্ঠী, ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ মুজিবতাজউদ্দিন গোষ্ঠী, দিল্লির শাসক-বশংবদ, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ শাসক গোষ্ঠী তথা জালেম স্বৈরাচারীরা যেমন তলিয়ে গেছে। তেমনি ১৯৭৫ বাকশালের জন্মদাতা শেখ মুজিব-তনয়া জুলুম নির্যাতনের নিশানবরদার হিন্দুস্তানের সেবাদাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পারিষদবর্গের সমুদ্রের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া অবধারিত।

ইনকিলাব : আন্দোলনের পথ পরিহার করে নির্বাচনমুখী হাওয়ায় বিরোধী দলগুলোর কেউ কেউ পাল খাটানোর চেষ্টা করছে। এতে দেশের জনগণের লাভ হবে কতটুকু?

অলি আহাদ : রাজপথের জঙ্গী আন্দোলন-বিদ্রোহে সরকারি নির্যাতন ও অত্যাচার মোকাবিলা করেই শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রবল জনমত সৃষ্টি হয় ও সার্বজনীন গণভিত্তি নির্মিত হয়। অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন ও জনগণের সার্বজনীন শান্তিপূর্ণ রায় জালেম সরকারের প্রতিপক্ষকে জয়ের মাল্যে ভূষিত করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ১৯৫২ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ, ১৯৫৪ সালে হকভাসানী যুক্তফ্রন্টকে বিপুলভাবে জয়যুক্ত করে অত্যাচারী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতা সংগঠন মুসলিম লীগের হয় ভরাডুবি। আবার ১৯৬৬ সাল ও পরবর্তী ছয় দফার স্বাধিকার আন্দোলন, ১৯৭০-৭১ সালের সাধারণ নির্বাচন শেখ মুজিব নেতৃত্বাধীন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৬২টির মধ্যে ১৬০ আসনে বিপুলভাবে জয়যুক্ত হয়। বর্তমান গণআন্দোলনে নেতৃবৃন্দের লক্ষ্য মধ্যবর্তী নির্বাচন। আন্দোলনের মুখে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায় হলে স্বাগত জানাব। কিন্তু ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের ন্যায় নির্বাচন হতে হবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু। নতুবা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতনের আন্দোলন জয়যুক্ত করতেই হবে।

ইনকিলাব : চার দল ও সাত দলের মধ্যে কি কোনো সমস্যা আছে? না থাকলে এক মঞ্চে সবাই বসতে পারছেন না কেন?

অলি আহাদ : সাত দল ও চার দলের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি না। বরং বর্তমান চারদলীয় জোট ৭ দলেরই প্রোথিত ঐক্যের বিকশিত রূপ। এখনও যে লক্ষ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়াই এর সার্থকতা। ৭ ও ৪ দল সবারই নেত্রী দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। কাজেই এক্ষেত্রে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পরীক্ষিত ও বর্তমান আন্দোলনের পুরোধা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রজ্ঞা ও দায়িত্বশীলতার প্রতি আমি আস্থাশীল। এই মুহূর্তে জাতির সামনে সমস্যা কি এবং দেশবাসীর আশা-আকাক্ষার প্রতীক দেশনেত্রীর করণীয় কি তা তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেন বলে আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি। তবে তার সমীপে আমার অতীব স্পষ্ট বক্তব্য একই মঞ্চ হতে আন্দোলন ও নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। এটাই আধিপত্যবাদের নিশানবরদার হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয়।

ইনকিলাব : আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি আওয়ামী লীগ সরকারকে হঠানো না যায়, তাহলে কি সামনের নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব? তা না হলে বিরোধী দলগুলো কি করে স্বপ্ন দেখে ক্ষমতায় যাওয়ার?

অলি আহাদ : আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার হঠানোর অর্থ এমন নয় যে, সরকার ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাবে এবং দেশ একটা বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে নিক্ষিপ্ত হবে। বরং আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে এ জালেমশাহী সম্পর্কে সচেতন করা এবং নির্বাচনে তা মধ্যবর্তী হোক বা স্বাভাবিক পন্থার হোক জনগণ তাদের ব্যালটের মাধ্যমে তাদের সুচিন্তিত রায় দেবে। তবে আমি দিল্লির আধিপত্যবাদী শক্তির প্রতিভূ বর্তমান সরকারের জাতিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের কারণে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই এদেরকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করার পক্ষে। আওয়ামী লীগ হোণ্ডা-গুণ্ডা-ডাণ্ডা আর কোটি কোটি কালো টাকার জোরও জনতার মঞ্চের ম খা আলমগীরের মত আমলাদের তৈরি করা ছকে নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হবে। তা জেনেও নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও তা মোকাবিলা করতে হবে। এরপর ফলাফল যাই হবে সে সাপেক্ষে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইনকিলাব : সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রী, নেতা-কর্মী এবার বিচার বিভাগ ও মাননীয় বিচারকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মিটিং-মিছিল করে লাঠি মারার হুমকি দেয়াসহ নানা প্রকার উত্তেজনাকর বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছেন, নজিরবিহীন এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?

অলি আহাদ : সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীগণ যেসব মন্তব্য করেছেন বা আচরণ করেছেন তা নিশ্চিতই সংবিধানের তৃতীয় স্তম্ভের উপর হামলা। ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত একটি মাত্র আদালত বিব্রত বোধ করার কথা বলছেন। এতেই ১৩ই এপ্রিল হতে জনসভা, লাঠি মিছিল করে সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের এহেন সীমাহীন ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদ, আইনজীবীর ভূমিকা মোটেও সন্তোষজনক নয়। আবার বিচারপতিগণই বা কেন সুয়োমোটো মামলা নিলেন না তা আমার বিবেকের কাছে বিরাট প্রশ্ন। ব্যাপারটি কি এমন দাঁড়াল যে, পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে যবনের সাথে? সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে আইনী লড়াই করা যাদের দায়িত্ব তারা কি উদ্ধত লাঠির সামনে আত্মসমর্পণ করলেন? আপনাদের পত্রিকায় কলেবর ভরে যাদের লম্বা লম্বা বক্তৃতা-বিবৃতি ফলাও করে ছাপান, বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের বুকের পাটা বিচার করুন। আপনাদের কাছে নিশ্চয়ই দেশবাসী জানতে চায় তারা ‘আত্মসমর্পণ করেছে কি না। শেখ মুজিবকে জাতির জনক হিসাবে উল্লেখ করে তারা বলছে, এটা জাতির জনক হত্যা মামলা এবং গোটা জাতির আবেগের সাথে জড়িত। কিন্তু শেখ মুজিব জাতির জনক কেন? আওয়ামী লীগেরও পিতা নন। আওয়ামী লীগের জনক মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সামনে বারবার জাতির জনক জাতির জনক বলে আহাজারি করার পরও ক্লিনটন শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা বলেই আখ্যায়িত করেছেন। এতেই দেশেবিদেশে শেখ মুজিবের অবস্থান কি তা স্পষ্ট বোঝা যায়। মনে রাখতে হবে আদালত প্রাঙ্গণে ছোট-বড় বিশিষ্ট বলে কিছু নেই, আইনের চোখে সবাই সমান, যদি আইনী শাসন মানি।

ইনকিলাব : দেশের সচেতন মানুষ মনে করেন দেশের বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, মাননীয় বিচারকদের অপদস্থ ও নিরাপত্তাহীন করার মত কর্মকাণ্ডে যখন সরকারের মন্ত্রীরা সরাসরি লিপ্ত হয়ে পড়েছেন, সেই সময় বিরোধী দলগুলো বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছেন। এই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলোর এমন অবস্থা কেন?

অলি আহাদ : কেবল বিচার বিভাগ নয়, সংবিধানকেই ধ্বংস করার জন্য তারা উগ্র মূর্তি ধারণ করেছে, হিংস্রতার পথ বেছে নিয়েছে। কাপালিকের এই উগ্র মূর্তি মোকাবিলা করার জন্যই ঢাকায় ঐক্যবদ্ধ জনসমাবেশের মাধ্যমে জনরোষ প্রকাশের একান্তই প্রয়োজন রয়েছে। সে সমাবেশ থেকে সংবিধান রক্ষা করার জন্য কালবিলম্ব না করে যেমনি বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল’ কর্মসূচি ঘোষণা ও কার্যকর করার জন্য দেশবাসীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান রক্ষার নির্ভরযোগ্য কাণ্ডারী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

ইনকিলাব : শুধু বিরোধী দলগুলো নয়, আইনজীবীরাও বিচার ও বিচারকদের বিরুদ্ধে সরকারি হুমকি-ধামকির জবাব দিতে ইতস্তত করছেন। এর কারণ কি?

অলি আহাদ : এ বিষয়ে আইনজীবীগণ, বিশেষ করে সুপ্রীম কোর্ট বার সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, এটর্নী জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম ও বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে প্রশ্ন করুন। তাদের বিবেক জ্ঞান অভিজ্ঞতা কি বলে? কারণ তারাই দেশের আইনজীবীদের নির্বাচিত ও বৈধ প্রতিনিধি। এ ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বই সমধিক। অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শিরভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর’–এ আলোকেই যার অবস্থান হতে করণীয় করবে, না করলে আগামী বংশধরদের কাছে সেভাবে বিবেচিত হবে।

ইনকিলাব : সম্প্রতি আপনি-আপনারা এক বিবৃতিতে বলেছেন, দৈনিক ইনকিলাব-এ বোমা হামলা এবং বিচারব্যবস্থা ও বিচারকদের প্রতি লাঠি প্রদর্শনের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এই বিষয়টি সম্পর্কে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

অলি আহাদ : অসহিষ্ণু ও ফ্যাসিবাদী চরিত্রের শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে এমন আচরণ স্বাভাবিক। ফ্যাসিবাদের জনক ও ধারক হিটলার-মুসোলিনিও ইতিহাসের জঘন্যতম একনায়ক বাকশালের জন্মদাতা শেখ মুজিবও ১৯৭৫ সালে একই কাণ্ড করেছিল। স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ কখনও তৃতীয় ও চতুর্থ রাষ্ট্র তথা স্বাধীন বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রকে সহ্য করতে পারে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেত্রীর পিতা পার্লামেন্টারী কু্য-এর মাধ্যমে বাকশালের জনক শেখ মুজিব ‘৭৫-এ সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে নিজস্ব চোঙ্গা রেখেছিলেন। তার মধ্যে একটি চোঙ্গা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী রক্তজল করা টাকা ও অবিরাম প্রয়াসে প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাক। স্বৈরাচারের সেবাদাস মন্ত্রী আনোয়ার হোসেনের সুযোগ্য পরিচালনায় ইত্তেফাক পত্রিকাটি বর্তমানে দিল্লির সেবাদাসী হাসিনা সরকারের পদলেহনে নিয়োজিত। গণতন্ত্র হন্তা শেখ মুজিব বিচারপতি নিয়োগ ও অবসর দেয়াসহ বিচার বিভাগকে শৃঙ্খলিত করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন। কাজেই ২১ বছর পরে নির্বাচনী কু্য-এর মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তারা স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। এদের বিরুদ্ধে কি পন্থা অবলম্বন করতে হবে তা আমার আগের বক্তব্যেই বিধৃত হয়েছে।

২৯শে এপ্রিল ২০০০

অহিংস গণঅভ্যুত্থানে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে অথবা পার্লামেন্টে দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের বক্তব্য ও পরামর্শকে উপেক্ষা করেই জাতীয় গণআন্দোলনকে সফলতার স্বর্ণদ্বারে পৌছাতে হবে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আবদুল হাই শিকদার।

ইনকিলাব : বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের যে Line of Action তার জবাবে বিরোধী দল যে প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হচ্ছে, সেটাকে কি যথার্থ বলা যায়?

অলি আহাদ : পার্লামেন্টারী Cabinet form of Govt. ব্যবস্থায় পার্লামেন্টে বিরোধী দল বলতে বিএনপি, জাপা ও জামায়াতকেই বোঝায়। সংসদের ভিতরে ও বাইরে উপরোক্ত তিনটি দল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। চলমান সরকারি বিরোধী আন্দোলনে ৩টি দলীয় পার্লামেন্টারী পার্টি তাদের অবস্থান সুসংহত করে Walkout, Adjournment Motion, confidence Motion online moco সরকারকে ঐক্যবদ্ধভাবে Censure করতে হবে। এতে নিঃসন্দেহে পার্লামেন্টের বাইরে জনমত সংগঠিত হবে এবং দলীয় নেতাকর্মীরা মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে উদ্বুদ্ধ হবে। ন্যায়সঙ্গতভাবেই উপরোক্ত তিন দল উদ্যোগ নিয়ে বাকি দেশপ্রেমিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ থেকে গণআন্দোলনের আহ্বান জানায়। এই পদ্ধতিতে যথার্থভাবে দিল্লির সেবাদাস ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে মোকাবিলা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

ইনকিলাব ; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন নির্যাতনের মোকাবিলায় বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা বিদ্যমান কেন?

অলি আহাদ : আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন নির্যাতনের মোকাবিলায় গণজোয়ার সৃষ্টিই বিরোধী দলগুলোর মূল লক্ষ্য। এ অবস্থায় দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের বক্তব্য ও পরামর্শকে উপেক্ষা করেই জাতীয় আন্দোলনকে সফলতার স্বর্ণদ্বারে পৌছাতে হবে। বিগত তিন বছরে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক বিরোধী দলের, বিশেষ করে, বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর পুলিশ ও গুণ্ডাপাণ্ডাদের হামলামামলা-হত্যা, নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বিরোধী দলীয় অনেক নেতাকর্মী আজ রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় কারাগারে অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এদের অনেকের পারিবারিক জীবন আজ দারুণভাবে বিপন্ন, বিপর্যস্ত। এ ধরনের অমানবিক নিষ্ঠুর হামলা-মামলার বিরুদ্ধে রাজপথে সাহসিকতার সাথে আন্দোলনরত নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের মোকাবিলা করতে হবে। এ ধরনের ফ্যাসিবাদী হামলা মোকাবিলায় বিরোধী দলীয় আন্দোলনে ছেদ হতে পারে, ধারাবাহিকতা ব্যাহত হতে পারে। ব্রিটিশ-ভারতে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে আজাদী অর্জনের বিভিন্ন আন্দোলনরত কোনো কোনো সময়ে তেজী হয়েছে, আবার কখনও স্তিমিতও হয়েছে। আজাদী পাগল উলামায়ে কেরামগণ ব্রিটিশ-ভারতকে ১৮০৩ সালের পর ‘দারুল হরব’ঘোষণা করে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে ৮ বছরব্যাপী অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বিপ্লবী-বিদ্রোহী সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ১৮৩১ সালের ৬ই মে বালাকোটের যুদ্ধপ্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। ১৮৫৪-৫৭-এর মধ্যে ১৪ হাজার উলামায়ে কেরামকে ফাঁসি দেয়া হয়। দিল্লির চাদনীচক থেকে খায়বার পর্যন্ত এমন কোন গাছ ছিল না, যার শাখায় শাখায় উলামায়ে কেরামদের গর্দান ঝোলেনি। ১৮৫৭এর সিপাহী বিদ্রোহের পর আবার ধীরে ধীরে আন্দোলন দানা বাঁধে। এক পর্যায়ে রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের অমৃতসরে জেনারেল ডায়ারের গুলীতে আজাদী পাগলদের রক্তগঙ্গা বয়। জালেম সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষত বিদেশি হিন্দুস্থান সরকারের বশংবদ সেবাদাস আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী নিরস্ত্র জনগণের অহিংস গণজোয়ারে আপ-ডাউন হতে পারে। আন্দোলন আঁকাবাঁকা পথে যাবেই। তবে ঐক্য সুদৃঢ় রাখতে পারলে বিজয় অনিবার্য। যেমনটি দীর্ঘ ৯ বছর পর হলেও ঐক্যবদ্ধ গণজোয়ারের কাছে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। মোদ্দাকথা, নেতৃত্বের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট হলে ইনশাল্লাহ জয় অবধারিত। হতাশ-নিরাশ হলে চলবে না।

ইনকিলাব : ৭ দলীয় ঐক্যজোট থেকে ৪ দলীয় লিয়াজোঁ কমিটি গঠিত হল কিভাবে? এই লিয়াজো কমিটির সাথে আপনাদের সম্পর্কটা কিরূপ?

অলি আহাদ : ৭ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলনরত অবস্থায় ৭ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল কাজী জাকির আহমদের নেতৃত্বাধীন জাপা এবং এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাপা একীভূত অর্থাৎ Reunited হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ৭ দলীয় জোট গঠনে কাজী জাফর আহমদের অবদান অপরিসীম। এর প্রেক্ষিতে কাজী জাফর আহমদ জাতীয় পার্টির একটি কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। তিনি ৭ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দকেও এই কাউন্সিল সম্পর্কে অবহিত করেন এবং তাদেরকে এই কাউন্সিলে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানান। দুই জাপা একীভূত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই ৭ দলীয় জোট ৬ দলীয় জোটে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচন বয়কট করার প্রশ্নে স্ব স্ব দলের অবস্থান থেকে যুগপৎ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে বিএনপি, জাপা, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে ৪ দলীয় লিয়াজো কমিটি রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি নবপর্যায়ে আবির্ভূত হয়। জামায়াতে ইসলামী কখন, কিভাবে ৭ দলীয় জোট (পরবর্তীকালে বাস্তবত ৬ দলীয় জোট) থেকে বিদায় নিল বা ত্যাগ করল, তা অদ্যাবধি আমাদের নিকট রহস্যাবৃত। আবার উপরোক্ত ৪ দলের যুগপৎ সাংবাদিক সম্মেলন কখন, কিভাবে ও কোনোআলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হল, তাও বিএনপি ও জামায়াত ব্যতীত ৭ দলীয় জোটের, বাকি ৪ দল অবহিত ছিল না। অতঃপর উক্ত ৪ দলীয় জোটের প্রতিনিধি সমবায়ে ৪ দলীয় লিয়াজো কমিটি আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি নির্ধারণ করে, তাই আমরা পালন করি। যেটা পালন করা আমাদের অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটিক লীগ, জাগপা, পিএনপি ও এনডিএ’র নৈতিক দায়িত্ব। আমরা ৭ দলীয় জোটই সরকার বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করি। বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আমরা বাকি ৪ দলের প্রতিনিধিরা দেখা করে বিএনপি, জাপা, জামায়াতে ইসলামী ঐক্যজোট, ডিএল, জাগপা, পিএনপি ও এনডিএ সমবায়ে ৮ দলীয় জোট গঠনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য তাকে অনুরোধ জানাই এবং একমঞ্চ থেকে ৮ দলীয় জোটের আন্দোলন পরিচালনা করার প্রস্তাব রাখি।

ইনকিলাব : ট্রানজিট, করিডোর, এশিয়ান হাইওয়ে প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বর্তমান সরকার যেভাবে ভারতকে একের পর এক ছাড় দিয়ে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর কোনো কার্যকর আন্দোলন নেই কেন?

অলি আহাদ : হিন্দুস্থানের এজেন্ট বর্তমান সরকার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান লংঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত বিধায় হিন্দুস্থানের স্বার্থেই দিল্লি সরকারকে ট্রানজিট, এশিয়ান হাইওয়ে, করিডোর, গ্যাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে একের পর এক ছাড় দিয়ে যাচ্ছে বলেই সরকারের বিরুদ্ধে মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আওয়াজ উঠেছে। এই মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায়ই হল চলমান আন্দোলনের লক্ষ্য। তারই প্রস্তুতি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেয়া হচ্ছে। আশা করি, আকাক্ষিত মঞ্জিলে মকসুদে আমরা পৌছে যাব। বিরোধী দলগুলো তীব্র আন্দোলন করতে ব্যর্থ হলে দেশ হিন্দুস্থানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হবে। নেতৃত্ব সজাগ বলেই দেশবাসীর ধারণা।

ইনকিলাব : দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এ ব্যাপারে বিরোধী দলগুলো কার্যকর আন্দোলন বা কার্যকর গণসচেতনতা গড়ে তুলতে পারছে না কেন?

অলি আহাদ : আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হয়ে বর্তমানে খুবই নাজুক অবস্থায় পৌছেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের শহর, বন্দর, হাট-বাজারে মানুষ আজ খুবই শঙ্কিত। মাঝে মাঝে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপ্রতিরোধও গড়ে উঠছে। আর এই গণঅসন্তোষকে ধারাবাহিকভাবে কার্যকর নেতৃত্বদানই নেতৃত্বের প্রধান ও নৈতিক দায়িত্ব। সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের হাতে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় এম কে আনোয়ার, সাদেক হোসেন খোকাসহ সম্মানিত বিএনপি নেতাদের যেভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে, তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এই ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

ইনকিলাব : বিরোধী দলগুলোর ঐক্য নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কি?

অলি আহাদ : অহিংস গণঅভ্যুত্থানে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে অথবা পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে পরাজিত করে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে ৪ দল তথা সম্প্রসারিত ৮ দলীয় নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ থাকবে বলে আমি আশাবাদী।

ইনকিলাব : আপনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বর্তমানে আবার এরশাদের সাথে একমঞ্চে বসেছেন, তার চায়ের দাওয়াতে যাচ্ছেন, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?

অলি আহাদ : সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনে বিএনপিসহ ৪ দলীয় ঐক্যজোট মূল নেতৃত্ব দিচ্ছে আর ডেমোক্র্যাটিক লীগ, জাগপা, পিএনপি, এনডিএ সহায়ক শক্তি হিসেবে সক্রিয় ও সজাগ ভূমিকা রাখছে। এই পটভূমিতে বিগত ২০ জুন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের চায়ের দাওয়াতে উপস্থিত হই। জামায়াতে ইসলামী নেতা কামরুজ্জামান, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা ফজলুল হক আমিনী, আবদুল মতিন, জাপা’র কাজী জাফর আহমদ, নাজিউর রহমান, কাজী ফিরোজ রশীদ, মুসলিম লীগের জমির আলী, পিএনপি’র শওকত হোসেন নিলু এবং ডিএলএ’র পক্ষে আমি এই চা-চক্রে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু বিএনপি, জাগপা ও এনডিএ’র কোনো নেতা বা প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। এর কারণ আমার কাছে আজও অজ্ঞাত। সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মূল ৪ দলীয় জোটের তিন শরিক দলই এই চা-চক্রে উপস্থিত ছিল। বিএনপি তথা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশ ও জাতির স্বার্থে আন্দোলন পরিচালনাকারীরা আজ সময়ের দাবিতে তাদের পূর্বতন জানী বন্ধু আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অবতীর্ণ।

আলোচনা প্রসঙ্গে এ ব্যাপারে একবার আমার মতামত জানতে চাওয়া হলে আমি প্রস্তাব করেছিলাম—১. জাপা নেতা এরশাদ যেন বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ঐক্যের ভিত্তিকে দৃঢ় করেন এবং সার্বিক রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করেন। মনে রাখতে হবে, কায়েদে আযমের বোম্বের মালাবার হিল বাসভবনে মহাত্মা গান্ধী রাজনীতির স্বার্থে দেখা করেছিলেন। ২. সংসদে বিএনপি, জাপা ও জামায়াত একত্রে বিভিন্ন সময়ে যেন তাদের কার্যাবলি সমন্বয় করেন, এতে জনগণ উৎসাহিত হবে, বিভিন্ন প্রশ্নে সজাগ হবে, সংসদের বাইরের আন্দোলন জোরদার হবে। ৩. বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু যেমন—গ্যাস, এশিয়ান হাইওয়ে, রেলওয়ে তথা ভারতের এক প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যে যাওয়ার ও চীন-ভারত সশস্ত্র সংঘাতে সামরিক প্রয়োজনে করিডোর, আরবিট্রেশন ও গ্যারান্টি ক্লজ বিবর্জিত ৩০ সালা পানিচুক্তি সম্পাদন, পার্বত্য চুক্তিতে সংবিধান লংঘন, সার্কের চেতনায় নেপাল-বাংলাদেশ ট্রানজিট দিতে অস্বীকৃতি, সামরিক বিভাগের জন্য অশোক লেল্যান্ড ও সাউথ কোরিয়ান ফ্রিগেড ক্রয়, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি রক্ষার প্রয়োজনে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়া, ডিন্যাশনালাইজেশন, শেয়ার বাজারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট, পুঁজিবাজার ধ্বংস, ভারত-বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য পর্বতপ্রমাণ ঘাটতি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সন্ত্রাস, লুটপাট ইত্যাদি ইস্যুতে স্ব-স্ব পার্টির উদ্যোগে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঘনঘন জনসভার আয়োজনের কথা বলেছিলাম। এখনই নির্বাচনী ঐক্যের বক্তব্য না তুলে অহিংস গণঅভ্যুত্থানে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বিএনপি, জাপা, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, ডিএল, জাগপা, এনডিএ ও পিএনপি সমবায়ে সম্মিলিত ৮ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে এক মঞ্চ থেকে আন্দোলন পরিচালনার কথা আমি বলেছিলাম।

ইনকিলাব : সরকার-বিরোধী আন্দোলন প্রশ্নে ৪ দল মাঝে মধ্যেই পরস্পর বিরোধী কথা বলে। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?

অলি আহাদ : প্রারম্ভেই বলা দরকার যে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের প্রতিভূ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কাল হতে অদ্যাবধি আওয়ামী লীগ সর্বক্ষণ দিল্লি সরকারের সেবায় নিয়োজিত অর্থাৎ বাংলাদেশে হিন্দুস্তানের স্বার্থরক্ষায় বরকন্দাজ। এই সরকার পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর সর্বাত্মক ঐক্যই দেশবাসীর দাবি। যেকোনো যৌথ কর্মেই শরিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ, কখনওবা পথভেদও হয়ে থাকে। কিন্তু তা সাময়িক বলে প্রতীয়মান হয়। লক্ষ্যদৃষ্টি অভিন্ন হওয়ায় শরিক দলগুলোর বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ নেতৃত্বের শুভ বুদ্ধিতে সকল ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি কাটিয়ে ঐক্যের চেতনাই জয়যুক্ত হয়—এটাই ইতিহাস। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি নির্বাচনী জোট যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। পরবর্তীকালে গণতন্ত্রী দল, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রব্বানী পার্টি সহায়ক শক্তি হিসেবে যোগ দেয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন উদ্ভূত সকল মতভেদ দূরীকরণে সেতুবন্ধন। এক কথায়, তার মেধা, কর্তব্যবোধ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক জয় ও মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। তবে এটা স্বীকার্য, মুসলিম লীগের নূরুল আমিন সরকার নির্বাচনে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করেননি। অর্থাৎ সেই নির্বাচন ছিল সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এনজিও, কালো টাকা ও সরকারি কর্মচারীদের এক বিপুল অংশকে ব্যবহার করে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু হতে দেবে না। যেমন ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ‘জনতার মঞ্চে অংশগ্রহণকারী সরকারি আমলাদের পক্ষপাতিত্বের আশ্রয়েপ্রশ্রয়ে আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে ব্যাপক ভোট কারচুপির সুযোগ হয়। প্রণিধানযোগ্য, ৩০০টি আসনের মধ্যে ৪০টি নির্বাচনী কেন্দ্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ঐ ৪০টি আসনই আওয়ামী লীগের রিজার্ভ বা সংরক্ষিত। জনগণ বিশ্বাস করে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে দিল্লির বাধ্যতামূলক মৈত্রী অর্থাৎ গোলামির জিঞ্জিরে বাধার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বাংলার নেতৃত্বকে এটা উপলব্ধি করতে হবে এবং এই গোলামির জিঞ্জির ভাঙতে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

ইনকিলাব : জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করার পথ এখনো আছে কি? এক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের মধ্যকার ‘ইগোইজম’ পরিহার করার উপায় কি?

অলি আহাদ : আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অপকর্মে আজ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপিসহ ৪ দলীয় শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ বিধায় অহংসর্বস্বত্ব (Egoism) দ্বারা আক্রান্ত নয় বলেই আমার ধারণা। নেতৃত্ব দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করে যে, হিন্দুস্তানী চানক্য কুটকৌশল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রকে কজা করতে প্রায় সমর্থ হয়েছে। আমাদের মূল্যবান গ্যাসকে লুট করার জন্য, শক্তিশালী গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য Background Linkage Industry গড়তে না দেয়ার চক্রান্ত, বাংলাদেশকে হিন্দুস্তানের বাজার বানাবার লক্ষ্যে SAPTA-কে ব্যবহার, পূর্ব সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম, টেকনাফ আকিয়ার রেঙ্গুন পথ বাতিল করে ESCAFE কর্তৃক Asian Highway, Trans Asian Railway মাধ্যমে বাংলাদেশকে হিন্দুস্তানের দুই অংশের করিডোর করার চক্রান্ত, পানিচুক্তি, পার্বত্য চুক্তি ইত্যাদি এবং সর্বোপরি বাংলাদেশে আবার একদলীয় বাকশাল কায়েম করার নীল নকশা বাস্তবায়ন ও শেখ মুজিবের রাষ্ট্রীয়করণ নীতি নামাবলীতে দেশকে একটি লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করার চক্রান্ত আর Ashok leyland ক্রয়ের নামে আমাদের Defence-কে হিন্দুস্তানের ওপর নির্ভরশীল বা দয়ার পাত্র বানানো। জাতির এই চরম সংকটময় মুহূর্তে ৪ দলীয় নেতৃত্ব মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নির্বিঘ্ন করবে। দিল্লির দাসত্ববরণের পাঁয়তারা চিরতরে নির্মূল করবে বলে আশা রাখি।

ইনকিলাব : জাতীয় সংসদের বর্তমান অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ অবস্থা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? না থাকলে বিরোধী দলগুলোর কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত?

অলি আহাদ : দেশে রাজনীতি যেহেতু Transparent নয়, Clean নয়, Value-based নয়, রাজনীতি ও নির্বাচন বর্তমানে Gun, Gold ও Goon প্রভাবান্বিত, কালো টাকা ও সন্ত্রাস কবলিত। যেহেতু নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই ব্যক্তি আক্রমণে অভ্যস্ত, রাজনৈতিক শিষ্টাচার এখানে অনুপস্থিত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার স্বামী ড. ওয়াজেদের প্রকাশিত গ্রন্থে বলা হয়েছে শেখ হাসিনার কাছে মেধা ও পাণ্ডিত্য আশা করা বৃথা। তাই সংসদে ব্যক্তি আক্রমণাত্মক ভাষা, কটুক্তি এমনকি অশ্রাব্য, অশ্লীল বক্তব্য বা ইঙ্গিতই তার বক্তব্যে প্রাধান্য পায়। এমনকি বিরোধী দলীয় উপনেতাকে স্পীকার বক্তব্য দেয়ার অধিকার দিলে প্রধানমন্ত্রীর ধমকে স্পীকার তার অনুমতি প্রত্যাহার করেন। স্পীকার নিজেই জানেন না যে সংসদ পরিচালনায় তিনি Sovereign কি। জানলে প্রধানমন্ত্রীকে এই কাণ্ডজ্ঞানহীন ধমকের জন্য Censure করতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী ও স্পীকারকে জ্ঞানদান করা দরকার। ভারতীয় লোকসভার স্পীকার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে একবার দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন, স্পীকারের সাথে দেখা করা আমার কর্তব্য এবং তিনি ঠিকই স্পীকারের সাথে দেখা করার জন্য উপস্থিত হলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এমন শিষ্টাচার জানার কথা নয়। লিডার অব দি হাউসই যখন এমন চরিত্রের তখন অন্যদের ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আমি মনে করি, এই সংসদ থাকার অধিকার নেই। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংসদের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সদস্যদের উদ্যোগে হাউসে No confidence motion আগামী অধিবেশনেই আনা অবশ্য করণীয় বলে আমি মনে করি।

ইনকিলাব : এবার একটু অন্য প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ-ভারত পানিচুক্তির মূল্যায়ন আপনি কিভাবে করেন?

অলি আহাদ : বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক পানিচুক্তি হওয়া উচিত। ডিপ টিউবওয়েলের পানি পান করার কারণে যেভাবে সমগ্র বাংলাদেশে আর্সেনিক আক্রমণ দেখা দিয়েছে, তাতে আগামী ১০/১৫ বছরে মহামারীতে বাংলাদেশ বিরান হয়ে যেতে পারে। এই রোগের নাকি চিকিৎসা নেই। এর প্রতিষেধক ভূপৃষ্ঠ পানি (Surface Water) পান। অতএব গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ অপরিহার্য। বিস্ময়ের ব্যাপার, সরকার এই বাঁধ নির্মাণে বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখেনি। অপরিকল্পিতভাবে কৃষিকাজে ও শহরাঞ্চলে পানি। সরবরাহের জন্য ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং আর্সেনিকের স্তর ভেসে উঠছে। অবিলম্বে এ ধারা বন্ধ করে Surface পানির ব্যবস্থা করতে হবে।

ইনকিলাব : বর্তমান সরকারের পার্বত্য চুক্তির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

অলি আহাদ : সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিলের রায়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশকে Unitary state বলে ঘোষণা করেন এবং বলেছিলেন যে, সংবিধানের মৌলিক অংশ সংশোধন বা পরিবর্তনীয় নয়। বাঙালিদের ভোটাধিকার হরণ কি সংবিধান লঙ্ঘন নয়? তাহলে পাবর্ত্য শান্তিচুক্তি আইনে তিনি কিভাবে স্বাক্ষর করলেন? এই চুক্তি কি সংবিধান লংঘন নয়? তিনি এই সংবিধান লংঘনকারী আইনের অনুমোদনে স্বাক্ষরদানে বিরত থাকলেন না কেন? প্রয়োজনে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার্থে পদত্যাগ করলেন না কেন? প্রেসিডেন্টের আসন এতই মধুর যে, ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের কাতারেই তিনি শামিল হলেন। এতে কি ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্বে তার অর্জিত সুনাম ক্ষুন্ন হয়নি? প্রেসিডেন্ট বিগত ৩ বছরে সন্ত্রাস, শিক্ষাঙ্গন, কালো টাকা, ঋণখেলাপ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ের উপর কঠোর ভাষায় দেশবাসীকে সতর্ক ও সজাগ করতে প্রয়াস পেয়েছেন, কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। দেশবাসী আশা করে বর্তমান মহাসংকটকালে প্রেসিডেন্ট সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন।

ইনকিলাব : মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর বর্তমান সরকারের আক্রমণকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

অলি আহাদ : আমি আগেই বলেছি, ১৮০৩ থেকে ৫৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজ শাসিত ভারতে এদেশের ওলামা আলেমরা যেভাবে এ ধরনের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধের আন্দোলনকে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, বর্তমানেও ঠিক সেভাবেই আজকের ইসলাম বিরোধী সরকারের এসব কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা কেন, যেকোনো ইসলামী কার্যক্রমের ওপরই আওয়ামী লীগ আক্রমণ করবে এটা অস্বাভাবিক নয়। এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে আলেম ওলামাদের নেতৃত্বেই। বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে ভারত আশ্রিত একটি সেকুলার স্টেট বানানোর লক্ষ্যেই মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধের পায়তারা করছে। দেশের ওলামায়ে কেরামগণ কেন এখন প্রতিরোধ আন্দোলনে চূড়ান্তভাবে নামছে না?

ইনকিলাব : দেশের রেডিও-টেলিভিশনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন।

অলি আহাদ : আমাদের বিটিভি এখন এবিটিভি (আমার বাপের টিভি) হয়ে গেছে। আর এই বাপের টিভিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাক্ষণই তার পিতার স্বপ্ন প্রচার করে চলেছেন। তার পিতা নাকি সারাজীবন কেবল স্বপ্নই দেখেছেন।

আমাদের প্রশ্ন, তাহলে উনি কাজ করতেন কখন। উনি তো ছিলেন তাহলে। ইনসমনিয়ার রোগী। তিনি দেশ চালাতেন কিভাবে এবং এই কারণেই ১৫ই আগস্টের আবির্ভাব হয়েছিল।

ইনকিলাব : বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পর্বতপ্রমাণ। এ অবস্থায় বিরোধী দলগুলোর কর্তব্য কি?

অলি আহাদ : দুর্নীতির কথা আর কী বলব? এটা বলে শেষ করা যাবে না। সাম্প্রতিক প্লট বরাদ্দের ঘটনা তার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে। বিদেশি কোম্পানিকে কমিশনের বিনিময়ে কাজ দেয়ার ঘটনাও বর্ণনাতীত। শোনা যায়, সম্প্রতি ৪৮০ মিলিয়ন ডলার (৪৮ কোটি ডলার)-এর টেলিফোনের কাজ বিনা টেন্ডারে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা টাইগার কাদের সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সম্পত্তির হিসাব চেয়েছেন যথার্থই। হিসাব জনগণও চায়। প্লট বরাদ্দের ওপেন সিক্রেট কেলেংকারীর পরও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি। জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে ১১৫ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে শেখ মুজিব ও তার আত্মীয়-স্বজনের স্মৃতি রক্ষার পেছনে। এটা কি দেশের মানুষ সহ্য করবে?

দেশের সরকার ব্যবস্থায় ন্যূনতম স্বচ্ছতাও আর অবশিষ্ট নেই। বর্তমান ইন্ডিয়ান হাই কমিশন ডিক্টেট করে—কে সেক্রেটারি হবে, কে মন্ত্রী হবে। তো দেশের এই নাজুক অবস্থায় বিরোধী দলগুলোর প্রতি আমার পরামর্শ হল : বিবৃতি বিশারদ না হয়ে মাঠে থাকুন। মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করুন অব্যাহতভাবে। যেমন হরতাল, ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং, সেক্রেটারিয়েট ঘেরাও ইত্যাদি একটার পর একটা কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে পতনে বাধ্য করতে হবে। ইস্যু অনেক আছে। যেমন—দুর্নীতি, গ্যাস, ট্রানজিট, হাইওয়ে, করিডোরসহ অনেক বিষয়কে সামনে নিয়ে জোর কদমে এগিয়ে যেতে হবে। বসে থাকার আর সময় নেই। বসে থাকলে দেশের জনসাধারণ আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।

ইনকিলাব : আগামী নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও স্বচ্ছতার সম্ভাবনা কতটুকু বলে মনে করেন?

অলি আহাদ : আমি আগেই বলেছি, তেমন সম্ভাবনা দেখি না। কেননা, ‘৯৬ সালে তথাকথিত জনতার মঞ্চের যে ৩৫ জন সেক্রেটারি এবং তাদের পরিচালিত সরকারি আমলা আওয়ামী লীগের পক্ষে মোবিলাইজড হয়ে গিয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের প্রথম দায়িত্ব ছিল তাদের Service Conduct rules ১৯৭৯ মোতাবেক বিচারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু তিনি তেমন কিছু তো করেননি। উপরন্তু, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে তাদেরকে পুরস্কৃত করেছে। এর ফলে সরকারি কর্মচারীরা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে উৎসাহিত হতে পারবে না। বারবার তারা বেআইনী কাজ করবে। জনতার মঞ্চের আরোহীরা অতি উৎসাহী হয়ে মহীরুহ রূপে আবির্ভূত হবে। পরবর্তী নির্বাচনে। তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করবে পুরস্কারের আশায়। মহিউদ্দিন খান আলমগীর তো সেদিনও জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ঔদ্ধত্যের সাথে বললেন, একবার জনতার মঞ্চ করেছি, প্রয়োজনে এ ধরনের কাজ আরও করব। তাহলে বুঝুন অবস্থাটা। এই ম খা আলমগীরের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। জাতীয় সংসদে। বিমান প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে চট্টগ্রাম বন্দর নির্মাণের কাজে জাপানি কোম্পানির কাছ থেকে ১০% কমিশন নিয়েছেন তিনি। এই অভিযোগের কোনো বিচার হচ্ছে না। এমনকি মন্ত্রী তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করা হয়েছে। সেই কমিটিও আর গঠিত হয়নি।

২৬শে জুলাই ১৯৯৯

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সংখ্যা ২০০৫ : আমার দেশের সঙ্গে ভাষানায়ক দেশ বাঁচানোর জন্য চাই পেট্রিয়ট, সৎ এবং আদর্শবাদী মানুষঅলি আহাদ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আবদুল হাই শিকদার

রাজধানীর অন্য দশটা বাড়ির সঙ্গে এ বাড়ির বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। তবু ৫৫/১ ল্যাবরেটরি রোডের ‘দখিনা’র সামনে যখন দাঁড়ালাম, তখন মনে হলো এই ভবন অন্যগুলোর মতো নয়। এ আলাদা, এ স্বতন্ত্র। কারণ এই বাড়ির চারতলায় আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়, এক অগ্নিগর্ভ উপাখ্যান, এক জীবন্ত কিংবদন্তি বাস করেন। না, বাইরে থেকে দেখে সত্যি বোঝার উপায় নেই। এখানে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আপসহীন দৃঢ়তা, জাতীয় কবির চির অশান্ত ‘বিদ্রোহী’র উত্তাপ জড়িয়ে আছে এই ইট, রড, লোহা, সিমেন্টের অন্তরে। এ জন্যই শিকড় থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, আত্মানুসন্ধানে বিমুখ আজকের প্রজন্মকে মনে করিয়ে দিতে হয় অলি আহাদের কথা।

দুই

প্রতি বছরই অমর একুশকে সামনে নিয়ে আমরা দেশকে, দেশের মানুষকে, মাতৃভাষাকে ভালোবাসার নতুন করে শপথ গ্রহণ করি। নতুন করে দীপ্ত হয়ে উঠি। দীপ্র হয়ে উঠি। বিশেষ করে জাতিসংঘ একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকেই বিশ্ব বিজয়ের এক অনির্বচনীয় পুলকে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে আমাদের অস্তিত্ব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সামনে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও, মহান ভাষা আন্দোলনের নায়ক, প্রধান সিপাহসালার, ভাষা-বীর অলি আহাদের কথা আমাদের মনে থাকে না। স্রেফ রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে, তার বেপরোয়া সত্য উচ্চারণের সামনে পড়বার ভয়ে, পাছে লোকে কিছু বলে জাতীয় মানসিকতার কারণে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে ভুলে যাই আমরা। কিংবা ইতিহাস বিকৃতির যে অশুভ মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে ঈশানে, তার সামনে আমরা সবাই নতজানু কিংবা আমাদের হিসেবী খাতায় এমন নজির তো নেই যে, আমরা বীরকে বরণ করেছি—আমাদের খাতায় তো কেবল শহীদদের নাম। হয়তো এজন্যই ভাষাসৈনিক কবি হাসান হাফিজুর রহমানকে বলতে হয়:

যখন একদিন শোকসভায় উঠবো আমি,

করতালিতে নয়, অবিরাম দীর্ঘশ্বাসে

মুহূর্তেই জান্তব হয়ে যাব ফের।

তোমরা বলবে বড় প্রয়োজনীয় ছিল লোকটা।

এখন দরকারের ফর্দে আছি উদ্বাহু, ফিরেও তাকাও না।

তোমরা বলবে, অপূরণীয় ক্ষতি হলোলোকটার তিরোধানে।

এখন সকল ক্ষতি পুষিয়ে দিতে আছি একপায়ে দাঁড়িয়ে ফিরেও তাকাও না।

মড়া ছাড়া তোমাদের কিছুই রোচে না।

তোমাদেরই হিসেবী খাতায়

বীর নেই, শহীদ রয়েছে শুধু। ১২ই মার্চ ১৯৯৯, জননেতা অলি আহাদকে প্রদত্ত এ জাতির একমাত্র সংবর্ধনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘অলি আহাদ আমাদের জাতীয় রাজনীতির এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। নীতির প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি। প্রলোভন কখনো তাকে বশীভূত করেনি। বলা যায় তিনি আজ জাতির বিবেকে পরিণত হয়েছেন।’

প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এই বলে, ‘রাজনীতির অর্থ যদি কল্যাণ, দেশ ও জাতির হিতসাধন হয়, তাহলে জননেতা অলি আহাদের জীবন, সংগ্রাম ও দর্শন আমাদের চলার পথের সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তাঁর নাম চিরকাল সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এই ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়েই ১৯৭১ সালে এক গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পত্তন হয়।

রাজনীতির ক্ষেত্রে যে পথটি অত্যন্ত সহজ ও পরিচিত অর্থাৎ অর্থ ও বিত্তের আকর্ষণে পথচলা, ক্ষমতার করিডোরে রেখে দায়িত্বহীনভাবে ছুটে চলা, পদ ও পদবির আকর্ষণে চারদিককে টালমাটাল করে, সে পথ তাঁর ছিল না। ছিল না মন্ত্রিত্ব লাভের উদগ্র আকাক্ষা। আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের সমুদ্র মন্থনে যে অমৃত ওঠে এসেছিল তাতে তিনি ভাগ না বসিয়ে স্বেচ্ছায় গলাধঃকরণ করেছেন গরলকেই এবং সেই গরল পান করেই তিনি হয়েছেন নীলকণ্ঠ। হয়ে রয়েছেন কালের সাক্ষী। তার এই ভূমিকাই তাকে রাজনৈতিক মহলে করেছে সর্বজনশ্রদ্ধেয়, করেছে কালজয়ী ত্যাগী প্রাজ্ঞ রাজনীতিক। প্রফেসর আনিসুজ্জামানের ভাষায়, ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদান তার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সে সময় তিনি যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন, তা সত্যিই বিরল। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সারা প্রদেশে যুবলীগ কর্মীদের বড় ভূমিকা ছিল। সেই ভূমিকার পেছনে ছিল অলি আহাদের উদযোগ, সৎ সাহস ও যথাযথ পরিকল্পনা।

জাতীয় ইতিহাসের সেই নায়ক, জাতির বিবেক, চির অশান্ত, চির বিদ্রোহী অলি আহাদ আজ কেমন আছেন? কোথায় আছেন? কি করছেন?

সত্যি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানাকর্ম ও কোলাহলের সঙ্গে আজ আর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই তার। জাগতিক কোনো চাহিদা তো কোনোকালেই তার তেমন ছিল না। তারপরও সব সামান্যতা থেকে, সীমাবদ্ধতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ‘দখিনা’র চারতলায় রচনা করেছেন নির্জনতা। এক ধরনের নিঃসঙ্গতা। ৭৭ বছরের উত্তাল, উন্মাতাল, বিপ্লব, বিদ্রোহ, চড়াইউত্রাইয়ের পর নিজের জন্য এখন তিনি বেছে নিয়েছেন কেবল একটি সাধারণ শয্যা, কিছু বইপত্র, একটি ডাইনিং স্পেস আর অপরিসর দুটি ব্যালকনি। কেন এই গুটিয়ে নেয়া? একি কোনো স্বেচ্ছা নির্বাসন? নাকি গভীর গাঢ় কোনো অভিমান?

২০০৩ সালে এক দুর্ঘটনায় পড়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আজো তিনি ভুগছেন অসুখে। একা চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বার্ধক্যজনিত নানা উপসর্গ। উন্নত চিকিৎসা করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই তার পরিবারের। না, তারপরও জননেতা অলি আহাদের কোনো অভিযোগ নেই কারো বিরুদ্ধে। তার ক্ষোভ আদর্শহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর রাষ্ট্রঘাতী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। হয়তো এ জন্যই সহধর্মিণী প্রফেসর রাশিদা বেগমের চোখে তিনি অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব, একমাত্র সন্তান তরুণ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার কাছে তিনি ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পিতা’।

তিন লাঠিতে ভর দিয়ে শয়নকক্ষ ছেড়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসলেন জননেতা অলি আহাদ। তাঁর অবয়বে ঢাকার অপরাহ্নের ম্লান রোদ। শরীর ভেঙে গেছে অনেক। কিন্তু কণ্ঠের তেজ যে একটুও কমেনি তা বুঝলাম কথা শুরু করেই। বললেন, শোনেন কবি সাহেব, এইসব সাক্ষাৎকার দিয়া কোনো কাজ হইব না। কে শোনে কার কথা। কারো মধ্যে কোনো আদর্শবাদ নাই। সবখানে কেবল চুরি। দুর্নীতি বন্ধ করতে হইব। বোমাবাজদের ধরতে হইব। পত্রিকাগুলিও সত্য লেখে না। যার যা খুশি তাই লেখে। সবাই মিলে দেশটার বারোটা বাজাইতেছে। আমি বুড়া মানুষ, একলা আর কত কমু। কোটি কোটি টাকা খরচ কইরা গরুর দালাল সংসদে যায়। দেশের শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাটশিল্প ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। এখন ষড়যন্ত্র হচ্ছে অন্যান্য শিল্প নিয়ে।

দেশটার সবকিছু এখন ৬/৭ লাখ লোকের একটি এলিটগোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। তারাই ১৪ কোটি মানুষের দেশের সব রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সংসদ চালাচ্ছে। সরকারি অফিসারদের তো কথাই নেই। অনেকের ছেলেমেয়েরাই বিদেশে পড়ছে।

বললাম, অলি আহাদ ভাই, এসব কথা তো আপনি মাঝেমধ্যেই বলে থাকেন। আসলে আপনার কাছে আসার এই মুহূর্তে বড় কারণ, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কিছু জানা। অলি আহাদ : বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়েই বলেন।

প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই।

অলি আহাদ : সঠিক ইতিহাস বলা কঠিন। কারণ আবুল কাসেম সাহেব, প্রফেসর আবুল কাসেম সাহেব যা লিখেছেন, তা হয়তো তার দিক থেকে সঠিকই আছে। কিন্তু আমি মনে করি আরো কিছু কথা আছে। বদরুদ্দীন উমর সাহেব ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছেন। তিনি যা পেয়েছেন, যা জেনেছেন, তাই লিখেছেন। তার জন্য ওটা সঠিক। কিন্তু আমার দিক থেকে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। সব সময় সঠিক নয়। কারণ আরো কথা আছে, কাহিনি আছে। সেসব কে লিখবে? আমি আমার জানা মতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি কিছু লিখতে। আসলে ভাষা আন্দোলনের সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখার জন্য যে ধরনের রিসার্চ হওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি। যে ধরনের সঠিক পরিশ্রম করা দরকার ছিল, তা কেউ করেনি। যদি তা হতো তাহলে একটা প্রামাণ্য দলিল আমরা পেতে পারতাম।

প্রশ্ন : তারপরও, আমরা জানতে চাই আপনার কথা।

অলি আহাদ : প্রথম সমস্যা দেখা মনিঅর্ডার নিয়ে। সে সময় দেখা গেল মনিঅর্ডার ফর্ম ছাপা হচ্ছে উর্দুতে। উর্দু তো সাধারণ মানুষ বুঝে না। প্রশ্ন দেখা দিল সুপিরিয়র সার্ভিসে বাংলা থাকবে কি থাকবে না—তা নিয়ে। আর্মিতে আমাদের ছেলেদের জায়গা হয় না। অথচ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলে। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যেও সমস্যা দেখা দিতে থাকল। আমাদের দাবি উঠলো, সংখ্যা সাম্য চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। নইলে আমরা বঞ্চিত হচ্ছিলাম। আন্দোলনের সূচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর আবুল কাসেম সাহেব। ১৯৪৭ সালেই তিনি তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলন শুরু করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্থপতি যদি কাউকে বলতে হয়, গুরু যদি কাউকে বলতে হয় তাহলে প্রথম নাম বলতে হয় প্রফেসর আবুল কাসেমের। আমরা ছাত্রলীগ থেকে ওনার সঙ্গে জড়িত হয়েছিলাম। এই হলো প্রকৃত ইতিহাস।

আমি অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগেও ছিলাম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছি। তারপর এই আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে কাসেম সাহেবকে সমর্থন করেছিলাম। মূল কথা হলো, রাষ্ট্রভাষা আমরা চেয়েছি বাংলা। তার জন্য আমাদের অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, আমরা এটা চেয়েছি। যাই হোক, ওনার প্রচেষ্টায় ভাষা আন্দোলন ‘৪৮ সালে একটা পর্যায়ে চলে যায়। ১৯৪৮-এ কায়েদে আযম যখন ঢাকায় এলেন, ২১শে মার্চ রেসকোর্সে বক্তৃতা করলেন, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমার সঙ্গে দাঁড়ানো ছিল একজন লোক। ছোট ছোট দাড়ি ছিল তার গালে। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার ভাষণে যখন বললেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্ত নের রাষ্ট্রভাষা, তখন ঐ লোকটি ‘না না করতে লাগলো। তার সঙ্গে আমিও হাত নেড়ে নেড়ে না না বলতে লাগলাম। কিন্তু কায়েদে আযমের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ছিল। তারপরও বললাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ২৪শে মার্চ অনুষ্ঠিত বিশেষ কনভোকেশনে কায়েদে আজম তার ভাষণে আবারো URDU AND URDU SHALL BE THE STATE LANGUAGE বললেন, সে সময় কনভোকেশনে উপস্থিত মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি নৈমুদ্দীন সাহেব NO NO বলে মৃদু কণ্ঠে হলেও প্রতিবাদ জানান। তার সঙ্গে আরো কেউ কেউ ছিলেন। এভাবে গোড়াপত্তন হলো।

‘৪৮-এর পর থেকে ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন নানা পথ অতিক্রম করে ‘৫২ সালে উপনীত হয়। এবার ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতের কথা বলি। ২০শে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে নুরুল আমিন সরকার ঢাকা শহরে এক মাস মেয়াদি ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ-শোভাযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সরকারি ঘোষণায় বিভিন্ন হলের ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হল ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা পরদিন অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে রায় প্রদান করে।

সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের পটভূমিকায় ওইদিন রাতেই ৯৪ নবাবপুর রোডে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বৈঠক বসে। সভায় আবুল হাশিম সাহেব সভাপতিত্ব করেন। ৯৪ নবাবপুরের বাড়িটি ছিল তখন আওয়ামী মুসলিম লীগের সদর দফতর। সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, তমদ্দুন মজলিশ ও সরকার সমর্থক ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করে। আমি এই সভায় আমার বক্তৃতায় অত্যন্ত তীব্র ভাষায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করি। বলি NO OR NEVER. রাত ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উত্থাপন চললো। সবশেষে ভোটাভুটির সিদ্ধান্ত হলো। উপস্থিত ১৫ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১১ জন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ভোট দেন। আমরা মাত্র ৪ জন, একজন আমি এই গরিব বান্দা, অন্যজন আবদুল মতিন সাহেব, ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি শামসুল আলম এবং ডা.গোলাম মওলা (ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি) ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দিই। ভোটাভুটি যা-ই হোক, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। আবুল হাশিম সাহেব আমার নেতা, তিনিসহ সবাই ভাঙার বিরুদ্ধে। ফলে আমাদের কাজ বেড়ে গেল। রাতেই ঢাকা শহরের সমস্ত স্কুল, কলেজ, হোস্টেলে খবর দেয়া হলো। আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙবো। আমি তখন যুবলীগের সেক্রেটারি জেনারেল। সঙ্গত কারণেই যুবলীগের নেতাকর্মীরা সর্বশক্তি নিয়োগ করলো জমায়েত বড় করার। প্রতিবাদ সভা সফল করার। এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ডাক দেয়া হলো। ফলে মারমুখী হয়ে ওঠে সমাবেশ। আমাদের এই সিদ্ধান্তই ছিল ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। এটাই ইতিহাস। এর ফলেই সৃষ্টি হলো রক্তস্নাত ২১শে ফেব্রুয়ারির। ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন সকাল ৯টার মধ্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে যাই। আমার উপস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ সাধারণ ছাত্রকর্মীরা বিশেষত যুবলীগ নেতা ও কর্মীরা দ্বিগুণ উদ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মতিন সাহেব আবেগময় ভাষায় বক্তৃতা করেন। ছাত্ররা এগিয়ে যেতে থাকে। টিয়ারগ্যাস ছেড়ে পুলিশ। উস্কানিদাতারা ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। অত্যন্ত উত্তেজনাকর সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর ঢাকার জেলা প্রশাসক কোরাইশী অবিবেচকের মতো গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। গুলির আওয়াজে বিক্ষোভকারীরা সম্বিত ফিরে পেতে না পেতেই আবুল বরকতকে রক্তাপুত ও ভূলুণ্ঠিত অবস্থায় দেখতে পাই। দেখি, এম এ ক্লাসের ছাত্র সালাউদ্দীনর মাথার খুলি নাই। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

যা-ই হোক, এটাই ইতিহাস। আমি বাংলা একাডেমিকে স্বাধীনতা পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত আমার ১ লাখ টাকা দান করে দিয়েছি। বিদ্রোহী একুশের ওপর যথার্থ রিসার্চ করার জন্য। সঠিক ইতিহাস লেখার জন্য। এই ফেব্রুয়ারিতেই আমি এ সিদ্ধান্ত নিই।

প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে নেতৃত্ব দাবি করে অনেক লেখালেখিও করেছেন। এই দাবি-দাওয়া সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

অলি আহাদ : দাবিদারদের ব্যাপারে আমার কথা খুব সোজা, সহজ, সরল। শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে বলি, ভাষা আন্দোলনে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি সে সময় জেলে ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের নেতা ছিলেন—এটা মিছা কথা। এমনকি ২১-এর পরেও তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হননি।

তিনি ১৯৫২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পেলেন। তিনি ঢাকায় এসে আন্দোলনে শরিক হতে পারতেন। তা তিনি হননি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন গড়ে তোলার সময়ও তিনি নেতৃত্ব দিতে আসতে পারতেন। কিন্তু আসেননি। আবার ৫ই মার্চ খুনি নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে হরতালের ডাক দেয়া হয়—তাতেও অংশ নেয়ার জন্য ঢাকায় আসেননি। আরেকজন গাজীউল হক। হ্যা, একথা ঠিক তিনি মিটিং প্রিজাইড করছিলেন। কিন্তু তারপর! গুলির আগেই ঘটনা। টিয়ারগ্যাসের জন্য তিনি নাকি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। শুনলাম তিনি মেডিক্যাল কলেজের দোতলায় আছেন। ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি বসে আছেন। বললাম, এখন তো আপনি সুস্থ। এখন মিটিংয়ে চলে যান। তিনি আর মিটিংয়ে এলেন না। সোজা নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস ট্রেনে করে বগুড়ার পথে ময়মনসিংহ চলে যান জিল্লুর রহমান। সিদ্দিকীর শ্বশুরবাড়ি। ২২ তারিখ সকালে হ্যাট-স্যুট পরা গাজীউল হককে দেখে তিনি হতভম্ব। ঢাকায় গুলি চলেছে। ছাত্ররা মরেছে। সেসব ফেলে তাকে এখানে এ অবস্থায় দেখে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সত্যি হতভম্ব হন। সেখান থেকে তিনি চলে যান বগুড়া। গিয়ে দেখেন তার গায়েবানা জানাজা হচ্ছে। মৃত গাজীউল হককে জীবিত সশরীরে দেখে বগুড়ার মানুষ তো হতবাক। আরেকজন এম আর আখতার মুকুল। ২১শে ফেব্রুয়ারির আমতলার ছাত্র জমায়েতের পর পরই তিনি উধাও। চলে যান কলকাতা। শুনি সেখানে গিয়ে তিনি আনন্দবাজার না অমৃতবাজার কী পত্রিকায় চাকরি জুটিয়ে নেন। এরকম যারা পালিয়ে গেছেন, তারাই পরবর্তীকালে নানারকম সংগঠনের আনুকূল্যে নেতা সেজে বসে গেছেন। শেখ মুজিবের কথা বলি। তিনি এসেই বললেন, তিনি জেলে থেকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে চিরকুট দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বদরুদ্দীন উমর সাহেব দেখিয়েছেন এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। তারপরও তিনি নেতা! এখন কথা হলো, বেগম খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার দল অনেক বড়। তাদের লোকজন আছে। ক্ষমতাও আছে। তারা এখন যদি প্রচার শুরু করেন যে, তারাই এদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তা তারা বলতেই পারেন। তাই বলে সেটা তো আর ইতিহাস নয়।

প্রশ্ন : তাহলে ভাষা আন্দোলনে কি কোনো একক নেতৃত্ব ছিল না—নাকি ছিল গ্রুপ লিডারশিপ?

অলি আহাদ: ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে কোনো একক ব্যক্তি ছিলেন না। তবে আমরা মওলানা ভাসানীকে নেতা মানতাম। তিনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। তবে সংগঠন হিসেবে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল যুবলীগ। একমাত্র যুবলীগের কর্মীরাই ছিল আন্দোলনের চালিকাশক্তি। পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের নেতাদের মূল্যায়ন কেউ করেনি। ভাষাসৈনিক সুলতান মেডিক্যাল কলেজের করিডোরে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মরেছেন। তাকে কেউ দেখতেও যায়নি।

আমার অ্যাজমা, সিউপিটি নামে এক রোগ হয়েছে। যেকোনো সময় মরে যেতে পারি। ২০০৩ সালে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে আমার হাড়গোড় ভাঙলো। দাঁড়াতে পারি না। হাঁটতে পারি না। হাইপার এসিডিটিতে ভুগছি, কে আমার পেট ঠিক করে দেবে? চোখ দুটি খারাপ হয়ে গেছে। চিকিৎসা করাতে পারছি কারণ আমার অর্থ নেই। সত্যিকার মূল্যায়ন পায়নি ভাষাসৈনিকরা। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারাও পাননি।

প্রশ্ন : ২১শে ফেব্রুয়ারির ভয়ঙ্কর রক্তস্নাত ঘটনার প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সমাবেশ হয় লক্ষাধিক লোকের। সেই সমাবেশে একমাত্র আপনি ছাড়া অন্য কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না কেন?

অলি আহাদ : অন্য নেতারা কেউ আসেননি। অন্যরা কোথায় ছিলেন কোথায় গেলেন—এসব বলে আর কী হবে! কাজটি সম্পাদিত হয়েছে এটাই বড় কথা।

প্রশ্ন : গবেষকরা বলেন, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।

অলি আহাদ : আমি তো ভাষা আন্দোলন করেছি। আমি বিষয়টার সঙ্গে ছিলাম। আমি বলি, জাতীয়তাবাদী চেতনা আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই চেতনা সত্যিকার অর্থে শানিত হয়ে ওঠে। প্রখর হয়ে ওঠে। আসলে ভাষা আন্দোলন আমাদের দেশ, দেশের মানুষ ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।

প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলন না হলে কি মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব হতো?

অলি আহাদ : এ প্রশ্নের জবাবেও বলবো, হয়তো সম্ভব হতো। যদি পাকিস্তানি শাসকরা, বিশেষ করে পাঞ্জাবিরা সরকারে থাকত, তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যেতেই হতো। তবে হয়তো আরো বেশি সময় লাগতো।

প্রশ্ন : সংগীত, সাহিত্য—এসব চর্চা করার সময় কি পেয়েছেন?

অলি আহাদ : না, আমি সাহিত্য করিনি। সংগীতও না। তবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য, তার গান আমার ভালো লাগতো। তার কারার ঐ লৌহ কপাট’-এর মতো গান আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। তবে আব্বাসউদ্দীনের গান ভোলার কোনো উপায় নেই। মওলানা আকরম খা আজাদ, সওগাত, মোহাম্মদী আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি নির্মাণ করেছে। এসব আমাদের আদর্শবাদ, সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

প্রশ্ন : এদেশেরই দু-একজন মানুষ আজ বলতে চান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ অকার্যকর রাষ্ট্র। এরা কারা? এদের সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

অলি আহাদ : এরা কারা? এদের আপনিও চেনেন, আমিও চিনি। এসব লোক আমাদের রাষ্ট্রটিকে বিফল করতে চায়। এক্ষেত্রে তারা যে কিছুটা সাকসেসফুল হয়নি, তা আমি বলবো না। সারা জীবন শেখ মুজিব গঙ্গা বাঁধ, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ নির্মাণের কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি ভুলেও এ প্রসঙ্গে কথা বলেননি।

মওলানা ভাসানী ফারাক্কা লংমার্চ করেছেন। কিন্তু তিনি যদি জিয়াউর রহমানকে বলতেন গঙ্গা ব্যারেজ কর, তাহলে আমার সমর্থন থাকবে। কিন্তু তিনি তা করেননি। এভাবে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সময়মতো করা হয়নি। ফলে আজ মতলববাজদের সাহস বেড়ে গেছে।

প্রশ্ন : আপনার দীর্ঘ জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী?

অলি আহাদ : আমার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এগুলোই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।

প্রশ্ন : আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অহেতুক কিছু বিতর্ক আছে। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

অলি আহাদ : স্বাধীনতার ঘোষণা শেখ মুজিব করেননি। ২৭ তারিখে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। এটা সত্য। প্রথমে তিনি নিজের নামে, পরে অন বিহাফ অব শেখ মুজিব বলেছেন। সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রথম আমাকে জানান যে, মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। গাফফারই রেডিও খুলে প্রথম আমাকে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শোনান। মুক্তিযুদ্ধের কথা যদি বলেন, তাহলে তুলনামূলকভাবে শেখ মুজিবের চাইতে অনেক বড় অবদান হলো জিয়াউর রহমানের।

প্রশ্ন : অবসর কীভাবে কাটান?

অলি আহাদ : আমার ব্যারিস্টার মেয়ে, আমার সহধর্মিণী—এদের সঙ্গেই দিন চলে যায়। বাকিটা একটু কঠিন হয়। আল্লাহ রসূলের জন্য কিছু কাজ করতে হয়।

প্রশ্ন : আপনার জীবনের শেষ স্বপ্ন কী?

অলি আহাদ : বাংলাদেশকে মরুভূমি হতে না দেয়া। এর সঙ্গে করাপশন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে চাই। তবে এখন আর জনসভা করতে পারি না টাকার অভাবে। আমারে যদি কেউ কিছু টাকা আইনা দিত, তাহলে দেশের মানুষকে রক্ত দেয়া থেকে শুরু কইরা দেশ রক্ষার জন্য সবকিছু করতাম। বলেন, সংযুক্ত খাল হবে কেন? আমাদের নেতারা কি ডিম পাড়ে? নিজেরা দিনরাত ঝগড়াঝাটি করে। ইন্ডিয়া থেকে বুলেট প্রুফ গাড়ি আইনা কয় জার্মানি থাইকা আনছি। এসব করলে হবে না।

এই যে সার্ক সম্মেলনটা হইল না, এক কথায় ইন্ডিয়া হইতে দেয় নাই। এদেশের ভিতরেও তাগোলোক আছে। তারাও এই না হওয়ার জন্য দায়ী। এরা নিয়মিত বাজপেয়ি আর মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে উঠবস করে। আসলে দেশ বাঁচানোর জন্য চাই পেট্রিয়ট, সৎ এবং আদর্শবাদী মানুষ।

চার

দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বললেন জননেতা অলি আহাদ। আমার মনে হলো, তাঁর জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ যেমন আমাদের জাতীয় দলিল, তেমনি এই মানুষটিও সময়ের দর্পণ। আমাদের নিজেদের চেনার আয়না। সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন সংগ্রাম আর আন্দোলনের পথে পথে। নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন দেশ ও জাতির কল্যাণে। তারপরও আপস করেননি। হয়তো সেই কারণে আজো তার কণ্ঠ যেন মহাকালের অবিনশ্বর দ্যুতি। সে কারণেই শারীরিক বয়স তার ৭৭ হলেও ভেতরে ভেতরে আজো তিনি তরুণ। অতি তরুণ। বাইরের শীতলতা শিথিল করতে পারেনি তার অন্তরের তপ্ত লাভাকে।

প্রিয় ও অপ্রিয় ভয়কে তোয়াক্কা না করা এই মহাপুরুষের সত্যি ক্ষয় নেই। তিনি যেন অজর, অমর।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: আবদুল হাই শিকদার

২০শে ফেব্রুয়ারি ২০০৫

আমার জেল জীবন

(পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি। একই দিনে মুসলিম লীগের ঢাকা শহর শাখার আহবায়ক নিযুক্ত হন জনাব অলি আহাদ। ১৯৪৯ সালে হন বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি অব অ্যাকশন-এর আহ্বায়ক। ১৯৫১ সালের ২৭শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক পদ লাভ করেন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন ১৯৫৫ সালে।

প্রচার ও সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালে তিনি কোনো কোনো সময় শেখ মুজিবুর রহমানের স্থলে অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মওলানা ভাসানীর পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল লীগ। এর সভাপতি ছিলেন আতাউর রহমান খান। অলি আহাদ এর সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৭৫ সালে পটপরিবর্তনের পর জাতীয় লীগ, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল মিলে ডেমোক্র্যাটিক লীগের জন্ম হয়। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-প্রেসিডেন্ট। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ছিলেন ডেমোক্র্যাটিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। ১৯৮১ সালে তিনি এ দলের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮৫ সালে ডেমোক্যাটিক লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটির সভাপতি হন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আরেকটির সভাপতি হন অলি আহাদ। তিনি নিষিদ্ধ সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক ও জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ গ্রন্থের প্রণেতা। ১৯৪৮ সাল থেকে রাজপথে মিছিল মিটিং, ধর্মঘট করেছেন। সে বছর থেকে এ পর্যন্ত তিনি মোট ১৬ বার জেলে গিয়েছেন। এ ছাড়াও দু’বার আন্ডারগ্রাউন্ড ও এক বছর গ্রামের বাড়িতে বন্দী ছিলেন। কাটিয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়। তার সেই জেল জীবনের নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ ধারাবাহিকভাবে পত্রস্থ করা হল।)

১৯৪৫ সাল। আমি তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা কলেজ ইউনিটের সভাপতি। সে সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ দুটি চিন্তাধারায় বিভক্ত ছিল। তৎকালীন বঙ্গীয় সরকারের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের

সভাপতি দৈনিক আজাদ সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন একদিকে। অন্য চিন্তাধারার নেতৃত্ব দিতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (যিনি ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) এবং বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক দার্শনিক আবুল হাশিম। আমরা তরুণ মুসলিম ছাত্র সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ঘুণে ধরা সমাজের চিন্তাধারার পরিবর্তনের পক্ষের নেতৃত্ব অর্থাৎ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও দার্শনিক আবুল হাশিমের পক্ষে ছিলাম। তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ হয়ে যাওয়ার| পর পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী খাজা নাজিমুদ্দীনের নিকট পরাজিত হন। অতএব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর খাজা নাজিমুদ্দীন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রিত্বের ভার গ্রহণ করেন। আমরা যারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ছিলাম অর্থাৎ স্বাধীন, সার্বভৌম বঙ্গের পক্ষে ছিলাম, অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী একাধিক রাষ্ট্র গঠনে তারা। সাময়িকভাবে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। কারণ শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিমবঙ্গেই থেকে গেলেন। কিন্তু নেতৃত্বে না থাকলেও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রসরতার চিন্তায় উদ্বুদ্ধ ছিলাম বলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা খাজা নাজিমুদ্দীনের বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে ছাত্র সমাজের মধ্যে আবির্ভূত হই। উদাহরণস্বরূপ আমরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের গ্রুপের ছাত্র নেতৃবৃন্দ বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবির পক্ষে ছিলাম। আমাদের বক্তব্য “লিল্লাহি মাফিসসামাওয়াতি ওয়ামাফিল আরদ-” আসমান, জমিন যা কিছু-একমাত্র আল্লাহ তার মালিক। সুতরাং কোনো ব্যক্তিকে খেসারত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এর উত্তরে খাজা নাজিমুদ্দীনের বক্তব্য ছিল বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ ইসলাম বিরোধী। আমরা বলতাম, মাতৃভাষা বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হওয়াই সঠিক। খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্ব একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষ অবলম্বন করে। আমরা যেহেতু স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গের প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিলাম, সেহেতু আমাদেরকে ভারতের এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করতে তারা দ্বিধাবোধ করতেন না। এই নীতিগত পার্থক্যের কারণে আমরা বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের একটি অংশ অর্থাৎ আমরা খাজা নাজিমুদ্দীন সরকার বিরোধী শক্তিতে ক্রমে ক্রমে রূপান্তরিত হই। ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পরিষদে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করার কারণে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করি এবং আন্দোলনের ডাক দেই। ১১ই মার্চ পূর্ববঙ্গব্যাপী হরতাল ঘোষণা করি। এই হরতালেই আমার প্রথম কারাবরণ অর্থাৎ ১১ই মার্চ আমি গ্রেফতার হই। এর আগে অর্থাৎ ৪ ও ৫ই মার্চের সভায় সাধারণ হরতালকে সফল করার জন্য বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১০ই মার্চের সভায় সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করা হলে তা ভঙ্গ করা হবে কি না এ নিয়ে বিতর্ক ওঠে। আমি তখন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেই যে, আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবই’। সরকারি কোন বিধিনিষেধের নিকট আত্মসমর্পণ করে আন্দোলন প্রত্যাহার করব না। এই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেকটি ছাত্রাবাসের দেয়ালে স্বেচ্ছাসেবকের তালিকা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়। এই হরতালের সংবাদ পত্রিকায় দেখে শেখ মুজিবুর রহমান ১০ই মার্চ রাতে ঢাকায় চলে আসেন। ১১ই মার্চ সকাল ৯টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল ওয়াদুদ এবং আমি সেক্রেটারিয়েট ভবনের প্রথম গেইটে উপস্থিত হই। তখনও সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীবৃন্দ আসেননি। এর মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন তরুণ জননেতা শামসুল হক আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল ৩ জন বা ৫ জন করে সেক্রেটারিয়েটের প্রত্যেকটি গেটে পিকেটিং করব। এবং এক গ্রুপ ধরা পড়লে পরবর্তী গ্রুপ পিকেটিং করবে। সাড়ে নয়টার দিকে আমরা সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীদের বাধা দিতে শুরু করি। তখন সিটি এসপি আবদুল গফুরের হুকুমে পুলিশ তৎপর হয়ে। ওঠে। পুলিশের ডিআইজি মি, চ্যাথাম (ইংরেজ) লাঠি চার্জ করার আদেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শামসুল হক ও তার গ্রুপের কিছু কর্মী গ্রেফতার হলেন। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। পুলিশ বাহিনীর বেপরোয়া লাঠিচার্জে আবদুল ওয়াদুদ ও আমি আহত হই। পুলিশ আমাদেরকে আহত অবস্থায় জীপে করে তুলে নেয় এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করে। পুলিশের আঘাত ও তাদের সাথে ধস্তাধস্তি করার সময় আমার হাতঘড়িটি খোয়া যায়। পুলিশের লাঠিপেটায় প্রায় জ্ঞানহারা অবস্থায় চিৎকার করে কর্তব্যরত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্টকে বলেছিলাম ক্ষমতায় এলে তোমাকে দেখে নেবো। সন্ধ্যা নাগাদ আরও ৬৯ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যায়। আমাকে ও আবদুল ওয়াদুদকে জেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফার্স্ট এইডের পর আমাকে নিয়ে যায় ৬ নম্বর অ্যাসোসিয়েশন ওয়ার্ডে। আবদুল ওয়াদুদকে জখমের কারণে হাসপাতালেই রেখে দেয়া হয়। তখনকার দিনে ঢাকা জেল সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন মি. বিল (ইংরেজ)।

আমরা জেলের নিয়ম-কানুন কিছুই জানি না। ১৩ই মার্চ সন্ধ্যায় আমাদের ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করার পূর্বে জমাদার আসেন বন্দী সংখ্যা গণনা করার জন্য। কিন্তু জমাদার তিনবার গণনা করে তিনটি ভিন্ন সংখ্যা পান। তখন সে স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত হয়ে মেজাজ দেখায়। এতে উত্তেজিত হয়ে ছাত্র বন্দীরা জমাদারকে প্রহার করতে উদ্যত হলে জমাদার এক লাফে ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে সংকেত বাঁশী বাজাতেই সমগ্র জেলে পাগলাঘণ্টি পড়ে যায়। এই এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সাধারণত পাগলাঘণ্টি বাজার সঙ্গে সঙ্গে কারারক্ষী বাহিনী ও বাইরে থেকে আগত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কারাগারের অভ্যন্তরে বন্দীদের যথেচ্ছ অমানুষিক নির্যাতন করে। কিন্তু আমাদের বেলায় ঘটে অন্য ঘটনা। পাগলাঘণ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন বাঙালি টহলদার সিপাই আমাদের দ্বিতল ওয়ার্ডটি ত্বরিৎ তালাবদ্ধ করে সরে পড়েন। এক মুহূর্তেই এসে যায় কারারক্ষী বাহিনী। তখন জেল সুপার মি. বিল এসে কারারক্ষীদের চলে যেতে বলেন এবং তালা খুলে আমাদের ওয়ার্ডে আসেন। তারপর জেলে গণনার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলেন এবং আমাদেরকে তা মেনে চলার জন্য অনুরোধ করেন।

এদিকে পুলিশী নির্যাতন ও আমাদেরকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদে ঢাকা নগরী মিছিল, স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। ১৫ই মার্চ পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন চলাকালে খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকার রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। উভয় পক্ষ একটি খসড়া চুক্তি প্রণয়ন করেন। চুক্তিপত্রটি ১১ই মার্চে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের অনুমোদনের জন্য আবুল কাসেম ও কামরুদ্দিন আহমেদ কারাগারে এসে এক বৈঠকে মিলিত হন। শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক ও আমি বন্দীদের পক্ষ থেকে চুক্তিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর অনুমোদন করি। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে এতে স্বাক্ষর করেন জনাব কামরুদ্দিন আহমেদ। এই চুক্তি মোতাবেক ১৫ই মার্চ আমাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট মামলার অজুহাতে জনাব শওকত আলী ও কাজী গোলাম মাহবুব এবং কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যভুক্ত অজুহাতে রনেশ দাশ গুপ্তকে কারামুক্তির আদেশ দেওয়া হয়নি। আমরা এই বন্দীদের ছাড়া কারাগার ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালে তৎক্ষণাৎই তাদেরকে মুক্তির আদেশ দেয়া হয়। আমি দ্বিতীয়বার জেলে যাই ১৯৪৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম বেতনভুক্ত কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দাবিতে ধর্মঘট করে। ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুন গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদের আহ্বায়ক জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী আমার অনুরোধে ৫ই মার্চ কর্মচারীদের সমর্থনে ছাত্র ধর্মঘট ও সভা অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আমরা মিছিল করে ভাইস-চ্যান্সেলর ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি যাই। পরদিন অর্থাৎ ‘৪৯ সালের ১০ই মার্চ আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে দবিরুল ইসলাম ও আবদুল হালিম চৌধুরীর যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতার পর কর্মচারীরা কাজে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ ছাত্ররা অবিরাম এই ধর্মঘটকে প্রীতির চোখে দেখছিল। না। অতএব ধর্মঘট প্রত্যাহার সময়োচিত ও বাস্তবসম্মত ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের সদিচ্ছাকে ভুল বুঝেন এবং বেলা ১টার মধ্যে কাজে যোগদানের কথা ছিল এই মিথ্যা অজুহাতে ধর্মঘটী কর্মচারীদের যোগদানপত্র প্রত্যাখ্যান করেন। শুধু তাই নয়, ১১ই মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। ১২ই মার্চ আমরা এর প্রতিবাদে মিছিল করে ভিসি’র বাসভবনে যাই। কিন্তু তার সাক্ষাৎ না পেয়ে ফিরে আসি। ছাত্রাবাসগুলির ডাইনিং হল বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা ক’জন ছাত্র ছাড়া সবাই চলে যায়।

এখানেই শেষ নয়, নিম বেতনভূক কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সমর্থন করার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করে। ৪ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয় যাদের, তারা হলেন : দবিরুল ইসলাম, আবদুল হামিদ চৌধুরী, অলি আহাদ, আবদুল মান্নান, উমাপতি মিত্র ও সমীর কুমার বসু।

বিভিন্ন হল থেকে বহিষ্কৃত ছাত্ররা হলেন : আবদুর রহমান চৌধুরী, মোল্লা জালাল উদ্দিন, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুল মতিন, আবদুল মতিন চৌধুরী, আবদুর রশীদ ভূঁইয়া, হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ, আবদুল মতিন খান, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ জামাল কাদেরী, আবদুস সামাদ, সিদ্দিক আলী, আবদুল বাকী, জে পাএ নবিশ ও অরবিন্দু বসু। ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয় যাদের তাঁরা হলেন : শেখ মুজিবুর রহমান, কল্যাণ দাস গুপ্ত, নইমুদ্দিন আহমেদ, মিস নাদেরা বেগম, কবীর চৌধুরী, মুনির চৌধুরীর বোন ও আবদুল ওয়াদুদ। ১০ টাকা জরিমানা করা হয় মিস লুলু বিলকিস বানুর।

কর্তৃপক্ষের এই প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদে ও প্রতিকারের প্রয়াসে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখে অর্থাৎ, ১৭ই এপ্রিল (১৯৪৯) সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, ইতিমধ্যে নাইমুদ্দিন আহমেদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুল মতিন খান প্রমুখ ছাত্রনেতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বন্ড সই দিয়ে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। তবুও ধর্মঘট হয়। আমরা মিছিল করে ভিসি’র বাসভবনে যাই। কিন্তু তিনি সাক্ষাৎদানে অস্বীকৃতি জানালে আমরা অবস্থান ধর্মঘট করি। পরদিন আবারও আমরা মিছিল করে ভিসি’র বাসভবনে যাই। আনুমানিক বিকেল পাঁচ কি ছ’টার দিকে আবদুল হামিদ চৌধুরীর উদ্যোগে। ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান সুসাহিত্যিক অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. টি.আহমেদ, প্রফেসর আবদুল হালিম, ঢাকা হলের প্রভোস্ট ডা. পি সি চক্রবর্তী, পূর্ববঙ্গ সরকারের জয়েন্ট সেক্রেটারি মিজানুর রহমান ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. ওসমান গণি বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সাথে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে বসে আলোচনা হয় এবং তা ফলপ্রসূও হয়। কিন্তু গভীর রাতে কোনো কালো হাতের ইশারায় তা ভণ্ডুল হয়ে গেল জানি না। তখন শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সাথে আলোচনা করে অবস্থান ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নেন। ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক আবদুর রহমান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট আত্মসমর্পণ করায় আমাকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়। ২০শে এপ্রিল ঢাকা শহরের ছাত্র ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল এবং ২৫শে এপ্রিল দেশব্যাপী সাধারণ হরতাল আহবান করা হয়। ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে পুলিশ মোতায়েন করা হল। সন্ধ্যার দিকে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে আমাকে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য বললেন। ১৯শে এপ্রিল অবস্থান ধর্মঘটরত অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান সহ ক’জনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আমাদের ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। ২০শে এপ্রিল ধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে যথারীতি সভা করি। সভাস্থল থেকে মিছিল করে যাওয়ার সময় মাঠ ও ঢাকা হলের মধ্যবর্তী রাজপথে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। এক পর্যায়ে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তোপখানা রোডের ঢাকা জেলা গোয়েন্দা অফিসে, এখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যার দিকে আমাকে পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাগারের ৫ নম্বর মুজিব ভাই আমাকে বকাবকি করতে থাকেন। শান্ত হওয়ার পর তাকে বুঝিয়ে বললাম, আমার কোনো দোষই নেই। এর মধ্যেই আবদুল মতিন, নিতাই গাঙ্গুলী, এনায়েত করিম, বাহাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, আবুল হাসনাত, আবুল বরকত, খালেক নেওয়াজ খান, আতাউর রহমান, মাজহারুল ইসলাম, মফিজুল্লাহ গ্রেফতার হয়ে জেলে আসেন।

কারাগারে অধিকাংশ নিরাপত্তা বন্দীই ছিল কম্যুনিস্ট পার্টিভুক্ত। কারাগারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে ১৯৪৯ সালের ১১ই মার্চ তারা অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ২২শে মে তারা পুনরায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। মিথ্যা আশ্বাসে একাধিকবার অনশন ভঙ্গের পর পুনরায় অনশন শুরু হয় ২রা ডিসেম্বর। অনশনরত অবস্থায় শিবেন রায় ৮ই ডিসেম্বর মারা যান।

বৈচিত্র্যহীন কারা জীবনে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ঘটনার পরিবেশ আনন্দঘন হয়ে উঠত। রাজনৈতিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বাহাউদ্দিন আহমদ চৌধুরী আমার বন্ধু ছিলেন। তিনি বরিশালে বিখ্যাত উলানিয়া জমিদারের বংশধর। বাবা-মার আদরের দুলাল। তেলফটকে সাক্ষাৎকারের সময় তার মা স্বহস্তে তৈরি বরফী, মিেরকা, বিদেশি সামি বিস্কুটের টিন দিয়ে গিয়েছিলেন। এসব দেখে আমারও মনে পড়ে গেল মায়ের হাতের সুস্বাদু খাবারের কথা। বাহাউদ্দিন সাহেব খুমকাতুরে। বেশ বিলম্বেই তিনি সকালের শয্যা ত্যাগ করেন। গভীর রাতে সহবন্দীদের ঘোর দ্রিার সুযোগে রহমান নামক ডাকাতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী বন্ধুর প্ররোচনায় আমরা কয়েকজন বেশ তৃপ্তি সহকারেই সেই বরফী, মোরব্বাসহ অন্যান্য খাবার খেয়ে ফেললাম। তবে একেবারে শেষ করিনি। তাদের জন্য কিছু রেখে দেই। সকাল বেলা বাহাউদ্দিন চৌধুরী সাহেব ৯টা কি ১০টার দিকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করতে গিয়ে বোকা বনে যান। সব ভদ্রবন্দী, ওয়ার্ড তালাবদ্ধ। বাইরের কোনো দুশ্চরিত্র সাজাপ্রাপ্ত বন্দীর প্রবেশ অসম্ভব। তিনি নিজে ভূতে বিশ্বাস করেন না অথচ কাণ্ডটা ভৌতিক। মুজিব ভাইয়ের কানে ঘটনার কথা উঠল। অনুতাপ বা আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। গোল বাধালেন রহমান সাহেব। তার পেটে কোনো কথা থাকে না। অতএব চোর ধরা পড়ে গেলাম। অগত্যা স্বীকার করলাম, একটু আধটু চুপচাপ আহারাদি অন্যের অলক্ষ্যে করে থাকি। এটা আমার আশৈশব অভ্যাস। কিশোর বয়সে কালাজ্বরে রোগাক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞা ও মায়ের সতর্ক দৃষ্টিকে ফাকি দিয়ে গভীর রাতে কুপথ্য চিংড়ি মাছ চুরি করে খেয়েছিলাম। মুজিব ভাইকে বললাম, আমি একা নই, অনেকেই একযোগে এই সৎ কাজটি করেছি। ১৯৪৯ সালের জুন মাসেই এনায়েত করিম, শামসুল হুদা এবং আমি একই দিনে শুক্রবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করি।

আমি তৃতীয়বার জেলে যাই ১৯৫২ সালের ৭ই মার্চ। ২৭শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করেন যে, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। তিনি আরও বলেন, পরীক্ষামূলক একুশটি কেন্দ্রে বাংলা ভাষাকে আরবী হরফে লেখার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে ও জনগণ স্বীয় উদ্যোগে নতুন কেন্দ্র খুলছে। ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তদানীন্তন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি বেমালুম ভুলে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দীন এই ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে ৩০শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রধর্মঘট ও সভা আহ্বান করে। ছাত্রসভায় ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, ছাত্রসভা ও বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সঙ্গে ৩০শে জানুয়ারিই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, দার্শনিক, জননেতা আবুল হাশিম, শামসুল হক, অধ্যাপক আবদুল গফুর, অধ্যক্ষ আবুল কাসেম, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন আহমেদ, খয়রাত হোসেন, মিসেস আনোয়ারা খাতুন, আলমাস আলি, আবদুল আউয়াল, সৈয়দ আবদুর রহিম, মোঃ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক চৌধুরী, খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব, মীর্জা গোলাম হাফিজ, মুজিবুল হক, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, শামসুল আলম, আনোয়ারুল হক খান, গোলাম মাওলা, সৈয়দ নুরুল আলম, নুরুল হুদা, শওকত আলী, আবদুল মতিন ও আখতার উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। বার লাইব্রেরির এই সভাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত ফেব্রুয়ারি ঢাকা নগর ছাত্রধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্রার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি। এই অধিবেশনকে সামনে রেখে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এভাবেই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সাফল্যমণ্ডিত করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ৬ই ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবির অফিস ১৫০ মোগলটুলিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত বেশির ভাগ সদস্যই আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু আমি দৃঢ় মত ব্যক্ত করি ১৪৪ ধারা জারি করা হলে তা ভঙ্গ করার পক্ষে। এভাবেই চলতে থাকে আমাদের প্রস্তুতি। বিকেলে মুসলিম লীগ নুরুল আমিন সরকার ২১শের আন্দোলনকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে ১৪৪ ধারা জারি করে। এ বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনে ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ৯৪ নওয়াবপুরস্থ সদর দফতরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। তার পর ২১শে ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক দিন রচিত হয়। তারপর এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সেই এক উত্তাল তরঙ্গ। মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, হরতাল, জনসভা সব মিলিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সারা দেশ। শহীদদের গায়েবানা জানাযা হয়, ২২শে ফেব্রুয়ারি হতে ২৩শে ফেব্রুয়ারি কাটে মারাত্মক অবস্থার মধ্য দিয়ে। এর পর শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাব, নুরুল আমিনের ঘোষণা, রেলওয়ে ধর্মঘট, নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন, সরকারি অপপ্রচার—যেন মহাবিপদ সংকেত। ২৮শে ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ঢাকা গেজেটে স্বরাষ্ট্র (বিশেষ) কর্তৃক ৩০ দিনের মধ্যে কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক, আবদুল মতিন, সৈয়দ এম। নুরুল আলম, আজিজ আহমেদ, আবদুল আওয়াল, মোহাম্মদ তোয়াহা ও আমাকে জেলা প্রশাসকের নিকট হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। ৫ই মার্চ ছিল দেশব্যাপী হরতাল। কিন্তু সরকারের কঠোর দমন নীতির কারণে তা আশানুরূপভাবে সফল হতে পারেনি। এ অবস্থায় ৭ই মার্চ শুক্রবার রাতে ৮২ শান্তিনগরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভা আহ্বান করা হয়। সভায় আমি ছাড়া কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুল মতিন, মীর্জা গোলাম হাফিজ, মুজিবুল হক, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী ও মোহাম্মদ তোয়াহা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও মোঃ সাদেক খান, আবদুল লতিফ, হাসান পারভেজ ও আনিসুজ্জামান। উপস্থিত ছিলেন। আমাদের সভা সমাপ্ত প্রায়। এমন সময় পুলিশ বাহিনী আমাদের অফিস ঘেরাও করে ফেলে। সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যদের পুনঃ পুনঃ সতর্কবাণী সত্ত্বেও মোহাম্মদ তোয়াহার অতিরিক্ত বক্তব্য ও একই বক্তব্য বারবার বলার প্রচেষ্টায় সভার কাজে অনর্থক কালক্ষেপণ হচ্ছিল। তোয়াহার এই অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘায়িত বক্তব্যই এই ঘটনার জন্য দায়ী। পুলিশের পদধ্বনি পাওয়া মাত্র তাকিয়ে দেখি আমরা পুলিশ বেষ্টিত। তবুও পুলিশের গ্রেফতারী এড়ানোর জন্য কেউ চাকর সেজে, কেউবা ঘরের কোনায় লুকিয়ে থাকি। কিন্তু এই কৌশল ব্যর্থ হয়। তবে কাজী গোলাম মাহবুব ঘরের বাঁশের মাচার উপর এমনভাবে শুয়েছিলেন যে, পুলিশের শ্যেন দৃষ্টি তাকে আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে গোয়েন্দা বিভাগ কর্তৃক সংগৃহীত এই সভায় উপস্থিত সদস্যদের নামের তালিকায় তারও নাম ছিল। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পুলিশ হাসান পারভেজ ও আনিসুজ্জামানকে গ্রেফতার করেনি। অন্য একজন লোক যিনি আমাদের সঙ্গী ছিলেন না, পাতলা, লম্বা, কোট পরিহিত ও মাথা ও মুখমণ্ডল মাফলার দিয়ে আবৃত ছিল। ফলে তাকে চেনা যায়নি, তিনিই বোধ হয় গোয়েন্দা ইনফরমারদের মধ্যে একজন। বাকি সবাইকে নিয়ে কোতোয়ালী থানা হাজতে আটক রাখা হয়। খবর পাওয়ামাত্র ঢাকা পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট জনাব মাসুদ মাহমুদ হন্তদন্ত হয়ে আমাদের দেখতে আসেন। একনজর আমাদের দিকে তাকিয়ে থানা অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন, বেত্রাঘাত করেছ কি?

তারপর আমাকে ও আবদুল মতিনকে ঢাকা ওয়াইজঘাটে অবস্থিত গোয়েন্দা বিভাগের সদর দফতরে স্থানান্তর করা হয়। ৮ই মার্চ সকাল ন’টায় গোয়েন্দা বিভাগের সদর দফতরে তদানীন্তন আইজিপি জাকির হোসেন, ডিআইজি ওবায়দুল্লাহ, গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ডিআইজি হাফিজুদ্দিন ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সুপারিনটেনডেন্ট তসলিম আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমার দিকে চেয়ে মজার প্রশ্ন করেন আইজিপি জাকির হোসেন এই নাকি প্রধানমন্ত্রী তার এই মন্তব্যের অর্থ তখন বুঝিনি। পরে অবগত হলাম যে, আমরা নাকি সুইসাইড স্কোয়াড করেছি এবং আমার নেতৃত্বে নাকি অস্থায়ী বিকল্প সরকার গঠিত হয়েছে। বাহবা দিতে হয় সংবাদদাতাকে, গোয়েন্দা বিভাগ যে কাল্পনিক তথ্য সংগ্রহে কত পারদর্শী তা এ থেকেই প্রমাণিত হয়।

গোয়েন্দা বিভাগ সদর দফতরে পাঁচ দিন পাঁচ রাত আমাকে অবিরাম জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদকালে তাদের প্রশ্নের উত্তর বড় একটা দিতাম। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে নানা রকম ভয়ভীতি দেখায়, অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করে ও সময়ে-অসময়ে প্রহার করে। তাদের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এই যে, আমরা ভারতীয় অর্থ ও কারসাজিতেই এই ভয়াবহ আন্দোলন সৃষ্টি করেছি। অথচ তাদের এ অভিযোগ আদৌ সত্য নয়। অতএব, আমার জবানবন্দীতে মিথ্যা স্বীকারোক্তি কেন করতে যাব? ১২ই মার্চ সন্ধ্যারাতে এক হাওয়ালদার আমাকে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলে যায়। উদ্দেশ্য, ফৌজি ছাউনীতে দৈহিক নির্যাতন চালানো। তাহলে সকল গোপনীয় খবর প্রকাশ করে দেব। আমি মনে মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লাকে স্মরণ করে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেই। দৈহিক নির্যাতন যতোই হোক, মিথ্যা স্বীকারোক্তি করব না। যে ষড়যন্ত্রের বিন্দু বিসর্গ জানি না তার খবর বলব কোত্থেকে। যা হোক, পুলিশ সারারাত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়নি, পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার পথে কেবলই ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল গান রচনাকারী জুলিয়াস ফুচিকের অকথ্য পাশবিক অত্যাচার সহ্য করার কাহিনীই আমার মনে সাহস ও মনোবল যোগায়। ১৩ই মার্চ আমাকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এখানে পাঠানোর পূর্বে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ডিআইজি হাফিজুদ্দিনের সঙ্গে বারবার আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। কারাগারে দেওয়ানী ওয়ার্ডে আমাকে পাঠানো হয়। দেওয়ানী ওয়ার্ডে আগে থেকেই ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, মীর্জা গোলাম হাফিজ, মোহাম্মদ তোয়াহা ও অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম। তারা সবাই ভাষা আন্দোলনের শিকার। এর কিছুদিন পরই জেলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স বিভাগের প্রধান ড. পি সি চক্রবর্তী। তাকে সংগদান করতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই তাস খেলতে হত। কারণ শ্রদ্ধেয় ড, চক্রবর্তীকে সংগ দিয়ে তাকে প্রফুল্ল রাখার এক দায়িত্ব ছিল আমাদের। কয়েকদিনের মধ্যে মীর্জা গোলাম হাফিজ রাজনীতি না করার অঙ্গীকার করে জেল থেকে মুক্তি পান।

এর মধ্যে সর্বজনাব শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, সৈয়দ নুরুল আলম ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জেলা প্রশাসকের কাছে হাজিরা দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির জয়ধ্বনি করে স্বেচ্ছায় কারান্তরালে প্রবেশ করেন। এদিকে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে দেওয়ানী ওয়ার্ড থেকে ৫ নং ওয়ার্ডে স্থানান্তর করেন। ৫ নং ওয়ার্ডে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম, শামসুল হক, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, শওকত আলী, হাশিমুদ্দিন আহমেদ, আবদুল মতিন, ফজলুল করিম ও আমি একত্রে বাস করতাম। সর্বপ্রকার আশা-নিরাশার আলোছায়া খেলায় বৃদ্ধ মওলানা ভাসানী সকলের কাছে পিতৃসুলভ স্নেহ, মায়ামমতা ও সাহস, উৎসাহ ও দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, ওষুধপত্রের যেন অসুবিধা না হয় তার জন্য তিনি জেল কর্তৃপক্ষকে সুকৌশলে জয় করে রাখতেন। সোজা কথা, তার স্নেহ ও নির্ভীক মন সেই সময়ে দুর্লভ প্রেরণার উৎস ছিল। এদিকে জনাব হাশিমুদ্দিন আহমদ ময়মনসিংহ কারাগার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন। জনাব আবুল মনসুর আহমদ এক চিঠিতে হাশিমুদ্দিন সাহেবকে বন্ড সই দিয়ে মুক্তি ক্রয় করতে উপদেশ দিয়ে পাঠান। কত সামান্যের জন্যই না আমরা বিবেক বিক্রি করতে প্রস্তুত। আর নেতার চরিত্রই যদি এরকম হয়, তবে অনুসারীদের চরিত্র কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বোধ হয় নেতৃবৃন্দের মেরুদণ্ডহীন চরিত্রের কারণেই গণতান্ত্রিক রাজনীতি একনায়কত্ববাদী দর্শনে বিশ্বাসী রাজনীতির কাছে ক্রমশ পরাজয় বরণ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকে immoral বা নীতিবিগহিত বলে আমার নিন্দা করতেন। কিন্তু অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক অজিত গুহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের যারা বিরোধী, তাদের কাউকেই গ্রেফতার করা সঠিক হয়নি। তবে নির্যাতনই যে সরকারের অস্তিত্বের ভিত্তি, তাদের পক্ষে শাসনদণ্ডের বিবেক প্রসূত ও নীতিগত ব্যবহার নয়, বরং বিদ্বেষমূলক ব্যবহারই স্বাভাবিক। কেননা, মূল প্রতিবাদ্য লক্ষ্যই হল সর্বপ্রকার বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া।

ইতিমধ্যে জাস্টিস এলিস-এর নেতৃত্বে ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ কর্তৃক গুলী চালনার যথার্থতা বিবেচনার জন্য প্রকাশ্য তদন্ত শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৃত্তিকা বিভাগের প্রধান ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ড. এম. ও. গনি তদন্ত কমিশন সমীপে সাক্ষ্য দানকালে বলেন যে, তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় ‘অছাত্র’ শামসুল হক ও অলি আহাদকে দেখেছেন। ড. গনির এই সাক্ষাদানে আমাদের নাম উল্লেখ দেখে মোশতাক ভাই ঠাট্টা করে আমাকে বলতেন, উস্কানিদাতা হিসেবে মামলা দায়ের হতে পারে। কেননা, জনাব তোয়াহাও ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু তিনি যেহেতু, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেছেন, সেহেতু তার নাম উল্লেখ করা হয়নি।

বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দীদের মেলামেশা করার কোনো নিয়ম নেই। তবুও কর্তৃপক্ষের হাজার সতর্ক দৃষ্টিকে ফাকি দিয়ে বিভিন্ন পন্থায় যোগাযোগ করা হয়। যেমন, জুমার নামাজের দিনে মসজিদে আমাদের পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ হত এবং সেখানেই আমরা প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংলাপ সম্পন্ন করতাম। অথবা চিকিৎসার অজুহাতে হাসপাতালে গমন করলেই পূর্ব খবরাখবর মোতাবেক নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হত এবং রাজনৈতিক আলোচনা সেরে নিতাম। শেখ মুজিবুর রহমান এই দু’টি পন্থার কথাই অবহিত ছিলেন। তাই বোধ হয় ক্ষমতায় যাবার পর ১৯৭২ সাল থেকে কয়েদখানায় জুমার নামায আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট মসজিদটি তুলে দিয়েছিলেন এবং কারাগারে জুমার নামায বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

১৯৭৪-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে কারান্তরালে থাকাকালেই আওয়ামী লীগ সরকারের এই মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানতে পারি। ১৯৫৩ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানন্তরিত হই। কুমিল্লা কারাগারে অধ্যাপক সর্দার ফজলুল করিমের সাহচর্য লাভ করি। তিনি এক অমায়িক রাজনৈতিক কর্মী ও অমায়িক পুরুষ। সরকারি বহু প্রলোভনকে প্রত্যাখ্যান করে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টিতে যোগদান করেন।

৩০শে সেপ্টেম্বর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আমাকে মুক্তির আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু সেই সাথে আমার নিজ গ্রাম ইসলামপুরে অন্তরীণ থাকার এক বছর মেয়াদী আদেশও জারি করা হয়। এই আদেশে বলা হয় যে, আমাকে প্রতি সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় সশরীরে হাজিরা দিতে হবে। আমাকে এই আদেশপত্রটি স্বাক্ষর করতে দিলে আমি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করি। উপায়ান্তর

দেখে পুলিশ অফিসার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেইটে আদেশনামাটি টাঙ্গিয়ে দিয়ে আমার উপর প্রকাশ্য নোটিশ জারি করেন। ইংরেজ শাসনামলে কোনো রাজবন্দীকে গৃহে অন্তরীণ করলে ভরণ-পোষণের নিমিত্ত সরকার থেকে প্রয়োজনীয় মাসিক ভাতা দেয়া হত। কিন্তু স্বাধীন দেশের অঙ্গরাজ্য পূর্ব পাকিস্তানের সরকার অন্তরীণাবদ্ধ রাজবন্দীকে কোনো ভরণ-পোষণ কিংবা কোনো ভাতা দিতেন না। ফলে শুধু আমার ভরণ-পোষণই নয়, প্রতি সপ্তাহে আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাতায়াতের পূর্ণ খরচ বহন করতে হত আমার অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ পিতাকেই। কারাগারে থাকার সময় বিভিন্ন বিষয়ে যে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলাম, তা আমি পূর্ণ ব্যবহার করি এবং কয়েকটি খাতায় নোট করে রাখি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীরা কারাগার অফিস থেকে আমার খাতাগুলি নিয়ে যান। ভাবখানা এই যে, ওই খাতাগুলোতে যেন পাকিস্তান ধ্বংসের খুঁটিনাটি পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ ছিল।

কারামুক্তির দিনে কারাগারে সদর গেটের বাইরে জনাব ফয়জুল্লা ও জালাল উদ্দিন আহমদ (শানু)-এর নেতৃত্বে কুমিল্লা যুবলীগ কর্মীবৃন্দ ও সাধারণ জনতা আমাকে তাদের শুভেচ্ছাস্বরূপ মাল্যভূষিত করে ও শোভাযাত্রাসহ সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করেন। আব্বা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। গৃহে অন্তরীণ আদেশের ফলে বাপ-মায়ের স্নেহনীড়ে যেন পুনর্বার আশ্রয় পেলাম। আব্বার একান্ত কামনা ছিল আমাকে প্রতিষ্ঠিত দেখে যাওয়া। কিন্তু দেশ সেবার প্রবল আকর্ষণে তার আশা পূরণ করতে পারিনি। রাজনীতিজনিত কারাবাস আব্বার স্নেহাপুত হৃদয় ও মিনকে দারুণ ব্যথা দিত। আমি মর্মে মর্মে তার ব্যথা অনুভব করতাম। কিন্তু আমার যেকোনো উপায় ছিল না। যে পথের যাত্রী আমি, তাতে পিছপা হওয়া আমার সম্ভব নয়। গৃহে অন্তরীণ থাকাকালে সিলেট জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগ সম্পাদক জনাব নুরুর রহমান, গণতন্ত্রী নেতা দেওয়ান মাহবুব আলী, কৃষক নেতা ইয়াকুব মিঞা, বাল্যবন্ধু মফিজুল ইসলাম প্রমুখ আমার সঙ্গে দেখা করতে অাসতেন। বন্ধুবর মফিজুল ইসলাম আমার কারান্তরালে থাকাকালেই দেশের সমগ্র রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দিয়ে এক নাতিদীর্ঘ চিঠি চোরাইপথে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে তার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কথা জেনে বড়ই ব্যথিত হই। সেই ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত তাকে জীবনভর দিতে হয়েছে।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণার অপরাধে আমাকে ১৯৫৪ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি চতুর্থবারের মত গ্রেফতার করা হয়। ৮ থেকে ১২ই মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের পর সরকার আমাকে ১৯শে মার্চ কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেয়।

পুলিশ যখন আমাকে নিয়ে ট্রেনে করে কুমিল্লা যাচ্ছিল তখন জনতা সেই ট্রেনকে বাধা দেয়। আমার করজোড় অনুরোধে জনতা শেষ পর্যন্ত রেল ইঞ্জিনের অগ্রভাগের পিকেটিং প্রত্যাহার করে।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তনের স্বল্পকালের মধ্যেই আমি চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৭৭/এ, আসাদগঞ্জ ঠিকানায় চট্টগ্রাম নিবাসী ব্যবসায়ী শেখ নজমুল হকের সাথে পার্টনারশীপ ব্যবসা আরম্ভ করি। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল এম করপোরেশন। সামরিক বেসামরিক গোয়েন্দার ভয়ে আমাদের ব্যবসায়ী অফিসে ক্রেতা-বিক্রেতা আসতে দ্বিধাবোধ করত। তাতে আমার পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক কারণেই অসুবিধা হত কিন্তু তারা এতই সজ্জন ছিলেন। যে, কখনও ভুলক্রমেও ক্ষোভ প্রকাশ করতেন না। আমি কৃতজ্ঞতার সাথে তাদের স্মরণ করি। ১৯৫৮ সালে (অক্টোবর) সামরিক শাসনের প্রথম পর্যায়ে ব্যবসায়ী শ্রেণির উপর গজব নাজিল হয়। সামরিক বিভাগীয় উর্দি পরিহিত নওজোয়ান বা অফিসারের আকস্মিক সাক্ষাতেও সাধারণ লোকের আত্মারাম খাচাছাড়া হত। এই ভয়াল পরিস্থিতিতে ছাপোষা ব্যবসায়ী শেখ নজমুল হক কর্তৃক আমাকে ব্যবসায়িক পার্টনার করাটা যে ব্যতিক্রমধমী ছিল, আমি তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। এই ব্যবসা পরিচালনাকালেই সরকার বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্সবলে আমাকে ১৯৫৯ সালে আমার শ্রদ্ধেয়া জ্যেষ্ঠা ভগিনীর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে বন্দী করেন।

পূর্ব পাকিস্তান সামরিক আইন শাসনকর্তা মেজর জেনারেল ওমরাও খানের প্রাইভেট সেক্রেটারি মেজর আনিসুজ্জামান সামরিক শাসনকর্তার আদেশে চট্টগ্রাম কারাগারে আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর মেজর আনিসুজ্জামান তার প্রতিপাদ্য বিষয়ের অবতারণা করে বলেন, “সামরিক শাসন নির্দলীয় শাসন। কর্তৃপক্ষ আপনার সহযোগিতা কামনা করেন। তদুপরি তাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম, সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে সামরিক শাসন প্রবর্তন জনগণের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালের ষড়যন্ত্রেরই ফল। সুতরাং সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতার প্রশ্ন অবান্তর। তদুপরি কারারুদ্ধ অবস্থায় কোনো প্রকার আলোচনায় অংশগ্রহণ মর্যাদাহানিকর। আমার স্পষ্টোক্তিতে ক্ষুব্ধ ও নিরুৎসাহিত মেজর আনিসুজ্জামান বিষন্ন বদনে কারাগার কার্যালয় হতে বিদায় গ্রহণ করেন। অবশ্য মেজর সাহেব সহজে হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। পরদিন চট্টগ্রাম জেলা কারাগার সুপারিন্টেন্ডেন্ট কাইয়ুমুদ্দিন সাহেব আমার সাথে দেখা করে জানান, “আপনার সাথে জেল গেটে দেখা করবেন। প্রত্যুত্তরে সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেবকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলাম, “বন্দী অবস্থায় সামরিক শাসনকর্তা প্রেরিত প্রস্তাব বিবেচনা করা দূরে থাকুক, আমি শুনতেই রাজী নই।” মাসাধিক কাল পর আমি চট্টগ্রাম জেলা কারাগার থেকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত হই।

নিরাপত্তা বন্দীদের মুক্তি বিবেচনার নিমিত্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৩ই আগস্ট প্রাদেশিক পরিষদে সংশোধনী বিধি অনুযায়ী পর্যালোচনা বোর্ড গঠন করেন। পর্যালোচনা বোর্ডের ব্যক্তিগত হাজিরা দেওয়ার প্রয়োজনে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আমাকে ঢাকা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমান ও তদীয় পত্নী প্রচুর খাদ্যদ্রব্যসহ আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের সহৃদয়তায় আমি মুগ্ধ হলাম। ইতিপূর্বে রাজশাহী কারাগারে থাকাকালেই শেখ সাহেব আমাকে ১৯৬২’র সংবিধান (আইয়ুব সংবিধান) এর কপি পাঠিয়েছিলেন। মুজিব ভাই ও ভাবীর রাজনৈতিক মতবাদ ও কর্মধারার সাথে আমার প্রভূত গড়মিল থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে আমার প্রতি তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য আমাকে চিরকাল তাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে রেখেছে। যারা রাজনৈতিক মতবিরোধকে সামাজিক সম্পর্কচ্ছেদের সোপান হিসাবে ব্যবহার করেন; এই ঘটনার উল্লেখে আশা করি তাদের চক্ষু উন্মিলিত হবে। তারা অতঃপর এর অন্তর্নিহিত মূল্য ও তাৎপর্য অনুধাবনে সচেষ্ট হবেন।

যা হোক, পর্যালোচনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার ও সদস্য ছিলেন স্বরাষ্ট্র বিভাগের সেক্রেটারি আলী হাসান (সিএসপি)। পর্যালোচনাকালে বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ান্তে তার উদ্দেশ্যে 571 (1, “My Lord, My submission shall be against the head & power drunk executives & if the detaining authority Home Secretary Ali Hassan talks, I shall immediately withdraw.” অর্থাৎ “ক্ষমতামদমত্ত আমলাদের বিরুদ্ধেই আমার বক্তব্য উপস্থাপন করব। এই অবস্থায় আমাকে আটককারী স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারি আলী হাসান যদি একটি কথাও উচ্চারণ করেন, তাহলে আমি তৎক্ষণাৎ অংশগ্রহণ করা হতে বিরত থাকব।” যা হোক, বিচারপতি সাত্তারই সর্বক্ষণ একাকী বিভিন্ন প্রশ্নে আমার সাথে। আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যান। অতঃপর ৬ই ডিসেম্বর (১৯৬২) বৃহস্পতিবার আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করি।

কোলকাতার হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে ঢাকায় এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দাঙ্গা প্রতিরোধকল্পে ঢাকার সর্বস্তরের নাগরিকই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র, কর্মী, আইন পরিষদ সদস্য, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিকদের এক যৌথ সভায় “দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। গভর্নর মোনায়েম খান ও কনভেনশন মুসলিম লীগ “দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির তৎপরতাকে সুনজরে দেখেননি। দাঙ্গা কবলিতদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে প্রশাসনিক যন্ত্রের কর্মশিথিলতা আমাদেরকে মর্মাহত করত এবং কোনো কোনো স্থলে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক ও বচসা এড়ান যেত না। গরিব হিন্দু কুমারদের বসতি এলাকা রায়েরবাজার দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়েছিল। আমি, জনাব আবদুস সামাদ এবং ওজিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ওই এলাকায় সাহায্য ও পুনর্বাসন কাজে ব্যাপৃত থাকাকালে উগ্র মেজাজী প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে কথা কাটাকাটি হয়। ক্ষমতা প্রদর্শনের নেশায় উন্মত্ত উক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তার অভিলাষেই ২৭শে জানুয়ারি (১৯৬৪) প্রাদেশিক সার্কিট হাউসে অবস্থানরত আমার প্রাণপ্রতীম অনুজ মোহাম্মদ আমিরুজ্জামান, সিএসপি’র কামরা হতে নিরাপত্তা আইনে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে প্রবেশ করার পর জনাব আবদুস সামাদের গ্রেপ্তারের খবর পাই। যা হোক, আমরা উভয়েই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ সেলের বাসিন্দা হলাম। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২৮শে জানুয়ারি কুমিল্লা জেলা হতে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব সুলতান আহমদ প্রাদেশিক পরিষদে মুলতবি প্রস্তাব আনয়ন করেন। আমি ও আবদুস সামাদ দল পুনরুজ্জীবনের ঘোর বিরোধী ছিলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত যতটা নীতিভিত্তিক ছিল, ততটা বাস্তবধর্মী ছিল না। কর্মী বাহিনীর বিবর্জিত নীতি বা আদর্শের বাস্তবায়ন প্রচেষ্টা সফল হয় না। বৈঠকী রাজনীতিতে অভ্যস্ত ও অন্যান্য কর্মদক্ষতায় বিব্রত জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতারা মরহুম সোহরাওয়ার্দীর গতিশীল নেতৃত্বে সৃষ্ট সম্ভাবনায় গণ আন্দোলনের প্রতি প্রকারান্তরে বিশ্বাসঘাতকতাই করেন এবং দেশে ভবিষ্যতকে অনিবার্য। সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেন।

১৯৬৪ সালের ২৯শে জুলাই শ্রদ্ধেয় আব্বাজান ইন্তেকাল করেন। আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। আব্বাজানের অন্তিম শয্যায় তার পার্শ্বে উপস্থিত থাকার অনুমতি গভর্নর মোনায়েম খান সরকার দেননি। বিদেশি ইংরেজ সরকার আমলেও প্রিয়জনের রোগ এবং মৃত্যুশয্যা পার্শ্বে উপস্থিত থাকার জন্য প্যারোলে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হত। করাচি হতে প্রকাশিত ইংরেজী ডন পাঠে আমি মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনাটি জানতে পারি। কি দুর্বহ যাতনা, কি দুঃসহ বেদনা, ভাষায় তা ব্যক্ত করা যায় না। শুধু একমাত্র ভুক্তভোগীই তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারে। জেল জীবনের ঐ কঠিন মুহূর্তগুলিতে নিরাপত্তা বন্দী শেখ ফজলুল হক (মনি) আমার পাশে পাশেই থাকত ও আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করত। স্নেহভাজন মনির কোমল হৃদয়ের আন্তরিকতা আমার স্মৃতিকোটরে চিরসজীব থাকবে।

১৯৬৯ সালে করাচিতে আতাউর রহমান খান, ভুট্টো ও অলি আহাদ জনাব আবদুস সামাদ আমার বহু পূর্বেই কারামুক্তির ব্যবস্থা করে আমাদের নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করেন। এমতাবস্থায় জনাব মাহমুদ আলী আমার মুক্তি দাবি করে ঢাকা হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের করেন। বিচারপতি এ এম চৌধুরী ও বিচারপতি আবদুল্লাহ সমবায়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে শুনানীর প্রারম্ভেই সরকার পক্ষীয় কৌশলী সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আদালতকে জানান যে, সরকার আমাকে মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই পূর্বাহ্নে প্রাথমিক শুনানীতেই আমার পক্ষে প্রদত্ত রুল খারিজ হয়ে যায় এবং আমি ১৪ই সেপ্টেম্বর মুক্তিলাভ করি। ঐ দিনই আমার প্রাণপ্রতিম অনুজ মোহাম্মদ আমীরুজ্জামানের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। পাত্রী জনাব নুরুল আমীনের কন্যা হাসিনা। ঢাকা শহরের অবস্থার উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ৩১শে জানুয়ারি (১৯৬৯) হতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করে। প্রচণ্ড দমননীতির মুকাবিলায় আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে উঠলে সমগ্র দেশে শুরু হয় গ্রেপ্তারের হিড়িক। ৩১শে জানুয়ারি (১৯৬১) শুক্রবার আমাকে আমার ৭ নং কলেজ স্ট্রীট, ধানমন্ডি বাসভবন হতে গ্রেপ্তার করা হয় ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধিবলে বিচারে আটক করা হয়।

করাচি, লাহোর, পিণ্ডি, পেশোয়ার, হায়দরাবাদ, কোয়েটা, ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম অর্থাৎ এক কথায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি জনপদ যখন গণবিদ্রোহের জোয়ারে উত্তাল, প্রতিটি রাজপথ যখন লাখো জনতার মিছিলের পদভারে প্রকম্পিত, আত্মাধিকার আদায়ে দৃঢ়সংকল্প জনতার সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ভিসুবিয়াসের আকস্মিক বিস্ফোরণে এক ব্যক্তির শাসন রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ আধা-সামরিক বাহিনীর লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস, গুলিগোলা ও গ্রেপ্তার ইত্যাদি যখন অকেজো প্রায়, অর্থাৎ আইয়ুবশাহী মসনদ যখন টলটলায়মান সেই অবস্থায় ৫ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬১) প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রাওয়ালপিণ্ডি হতে লাহোর বিমান বন্দরে অবতরণ করে সাংবাদিকদের নিকট প্রকাশ করলেন যে, বর্তমান সমস্যাবলি সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি ১৭ই Nেয়ারি (১৯৬৯) বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাওয়ালপিণ্ডিতে এক বৈঠকে [[জবেন। সাংবাদিকদের তিনি আরো জানান যে, ইতিমধ্যে বিভিন্ন নেতাকে অ|ণ জানাবার জন্য তিনি বিরোধী দলীয় নেতা নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানকে অরোধ করেছেন। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, রাজবন্দীদের মুক্তির w|শিতে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও এগার দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে লাখ লাখ জনতার মিছিল প্রত্যহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার প্রদক্ষিণ করে। এমনি একটি দিন ৯ই ফেব্রুয়ারি। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত মরণজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত লাখো ইনসানের মিছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সদর ফটক ও বিভিন্ন পার্শ্বস্থ দেওয়াল ভাঙায় উদ্যত হলে চিরাচরিত প্রথানুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ না করে বিচক্ষণ জেইলার নির্মল বাবু। কম্পিত পদে ১০ নং সেলে উপস্থিত হন ও ভীত-শঙ্কিত কণ্ঠে সংক্ষেপে মারাত্মক পরিস্থিতি উদ্ভবের আশংকা প্রকাশ করেন এবং আমাকে জেলগেটে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। আমার সেলমেট বন্ধুবর জনাব তাজউদ্দিন আহমদ শোনামাত্র আমাকে কালক্ষেপ না করে জেলগেটে যেতে বাধ্য করেন। জেলগেটের লোহার শিকের অবলম্বনে কিছুদূর আরোহণ করে আমি প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী অনর্গল বক্তৃতাদানের ফলে সমগ্র পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে আসে। এবং কারাগার প্রাচীরে যারা আরোহণ করেছিল তারাও নেমে পড়ে। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব জেইলার নির্মল বাবু যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রার্থনা করতেন, তাহলে হাজার হাজার মিছিলকারীর রক্তে কাল পীচের রাজপথ শাব্দিক অর্থেই রক্তগঙ্গায় পরিণত হত; জেলগেট ও জেলের দেওয়াল চুরমার হয়ে যেত এবং পরিণতিতে চোর-ডাকাত সবাই জেলমুক্ত সমাজ জীবনকে বিষাক্ত করে তুলত; গোল টেবিল বৈঠকের কোনো প্রশ্নই উঠত না। নির্মল বাবুর মত এই ধরনের কর্মকর্তা বড় একটা দেখা যায় না। প্রশাসন তাকে যথাযথ পারিতোষিক দ্বারা যথোপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছে কি না জানি না। হয়ত দেয়নি। কারণ ক্ষুদ্রমনা পরশ্রীকাতর মাথাভারি প্রশাসনের পক্ষে না দেওয়াই স্বাভাবিক।

রাতে আমার কারামুক্তির আদেশ আসে। আমি মুক্তির আদেশ প্রত্যাখ্যান করি এবং আমার সঙ্গে অন্য দুইজন সদ্য কারামুক্তি আদেশপ্রাপ্ত জনাব সিরাজুল হোসেন খান এবং অ্যাডভোকেট মুজিবর রহমান আমার বক্তব্যের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। আমাদের দাবি ছিল দেশরক্ষা বিধিবলে বা নিরাপত্তা আইনে আটক সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিলেই আমরা কারামুক্তি মেনে নেব। নতুবা নয়। আমাদের অভিনব আন্দোলন পদ্ধতিতে কারাগারের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বড় বেকায়দায় পড়েন ও সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইতিমধ্যেই জাতীয় পরিষদের সদস্য জনাব আফাজউদ্দিন ফকীর জেলগেটে আমার সাথে সাক্ষাত করেন এবং স্বরাষ্ট্র সচিবের তরফ হতে সকল রাজবন্দীর মুক্তির নিশ্চয়তা দান করেন। পরিশেষে জেইলার নির্মল বাবুর কাকুতি-মিনতিতে বন্ধুবর তাজউদ্দিন আহমেদ আমাকে ১০ নং সেলে ডেকে নেন এবং মুক্তিপত্রে সই করতে বলেন। যা হোক, রাত দুইটার পর আমরা কারাগার ত্যাগ করি।

ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির প্রতিবাদে আমরা সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টের উদ্যোগে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে ২রা জুন এক সভা করি। সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সভা সমিতির সুযোগদানের নিমিত্ত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার না করলে বা মেয়াদান্তে ১৪৪ ধারা পুনঃপ্রবর্তন করলে সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট ৩০শে জুন (১৯৭৪) ১৪৪ ধারা অমান্য করবে। মুজিব সরকার স্বীয় অতীত ভূমিকা অস্বীকার করে ২৫শে জুন হতে পুনঃ ১৪৪ ধারা জারি করে প্রকাশ্য জনসভা ও শোভাযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। উক্ত অবৈধ আদেশের বিরুদ্ধে ২৮শে জুন আমি ঢাকা হাইকোর্টে রীট আবেদন করি। উল্লেখ্য যে, ৯ই সেপ্টেম্বর প্রদত্ত রায়ে মাননীয় বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও মাননীয় বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী কর্তৃক গঠিত সুপ্রিম কোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ ২৫শে জুন জারিকৃত ১৪৪ ধারা আদেশকে অবৈধ, বাতিলযোগ্য, এখতিয়ার বহির্ভূত ও সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেন এবং মাননীয় বিচারপতিদ্বয় আমাকে মামলার খরচ বাবদ ১৫ (পনের) স্বর্ণমোহর তুল্য অর্থ প্রদানের জন্যে সরকারের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন। সরকার উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপীল করে এবং রায়ের কার্যকারিতা মুলতবি রাখার আবেদন জানায়। মাননীয় বিচারপতিদ্বয় সরকারকে আপীল করার অনুমতি দেন বটে, তবে রায়ের কার্যকারিতা মুলতবির আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। মুজিব সরকারের কারাগারে আটক থাকাকালে আমি সংবাদপত্র পাঠ করি। ঐকফ্রন্টের বৈঠকে ৩০শে জুন ১৪৪ ধারা ভন্নগ করে জনসভা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে ক্ষিপ্ত মুজিব সরকার সর্বপলীয় ঐকফন্টের তের জন সদস্যের মধ্যে সর্বজনাব মশিউর রহমান ও আমাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটক করে।

শেষ পর্ব

আমরা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব চেয়েছি এবং গণতান্ত্রিক সরকার চেয়েছি। প্রথমেই আমার মনে সন্দেহ হল ২৫-শালা চুক্তি পাক-মার্কিন চুক্তি বা বাগদা চুক্তির মতই সামরিক চুক্তি। এই চুক্তির কারণেই পাকিস্তানকে আমরা সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ বলে নিন্দা করতাম। তেমনি দিল্লি-ঢাকা ২৫-শালা চুক্তি, যা ইন্দিরা-মুজিব ঢাকাতেই সই করেছেন, যা সাবসিডিয়ারী এলায়েন্স মৈত্রী (২) স্বাধীনতার পর পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু যেমন দিল্লিতে ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট করেছিল শাসনতন্ত্র পর্যন্ত। আমাদেরও দাবি ছিল শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। কিন্তু কোনোটাই হয়নি। বরং মুজিব একদলীয় সরকার করেন। অথচ মুজিব স্বাধীনতার সময় মাঠে ছিলেন না। আমরা করাচি ছেড়েছি দিল্লির পদতলে যাবার জন্য নয়। তাই আমরা আজাদ বাংলা আন্দোলন করি। এই পটভূমিতেই আমরা জাতীয় লীগকে আওয়ামী লীগ বিরোধী ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রতিজ্ঞায় অবর্তীর্ণ হই। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে নির্বাচনী জোট করি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে সর্বত্র কারচুপির ফলে গুটি কয় আসন ব্যতীত বেশির ভাগ আসনই বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালে বিনাবিচারে আটক রাখার আইন জারি করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিনাবিচারে আটক রাখার যে অভিযোগ ছিল মুজিব একই অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন। অর্থাৎ গণবিরোধ আন্দোলনকে দমাবার জন্যেই পুনরায় বিধিবদ্ধ করা হল। পূর্বে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান যে আওয়ামী কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠা হয় সেই সরকার এই আইন বাতিল করে দেয়। কিন্তু সেনাপতি শাসক আইয়ুব পুনরায় এ আইন বিধিবদ্ধ করেন। অর্থাৎ মুজিব সরকারের চরিত্র মুসলিম লীগ সরকার বা আইয়ুব সরকারের থেকে অভিন্ন কিছু ছিল না। মুজিবের ভাষায়ই তাঁর সরকার ছিল লুটতরাজের সরকার অর্থাৎ আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ সরকার। সুতরাং জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অপরিহার্য কারণে আমরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের ১৫ই এপ্রিল সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করি। আমাদের প্রচেষ্টাকে বাধা দেয়ার মানসে ২৬শে এপ্রিল ‘৭৪ তারিখে দেশব্যাপী ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ৩০শে জুন দিল্লিচুক্তির বিরুদ্ধে ‘দিবস’ ঘোষণা করি। এই দিবসকে বানচাল করার জন্য মুজিব ২৫শে জুন এক্সটেনশন করে সেকঃ ১৪৪ সিআরপিসি। এর প্রতিবাদে ২৮ তারিখে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে ১৪৪ ধারা ভাঙবোই’ বক্তৃতা করি এবং ২৭শে জুন এই ১৪৪ ধারা জারির বিরুদ্ধে ঢাকা হাইকোর্টে মাননীয় বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে রীট পিটিশন করি এবং ২৩.০৮.৭৪ এ বিচারপতিদ্বয় ১৪৪ ধারা এখতিয়ার ও সংবিধান বিরোধী ঘোষণা করেন। অতএব যে কারণে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তথাপি আমাকে মুজিবের জেলে থাকতে হয়। শুধু মিথ্যাই নয়, বিচারপতিদ্বয় ১৫ স্বর্ণমোহর ক্ষতিপূরণ প্রদানেরও নির্দেশ দেন। সুতরাং ৩০শে জুন মশিউর রহমান (যাদু মিয়া), নুরুর রহমান ও আমাকে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট-এ গ্রেফতার করে ঢাকা জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। থাকার ব্যবস্থা করা হয় ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন জনাব খাজা খায়েরউদ্দিন, জনাব ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান ও শফিউল আলম প্রধান। জেলখানায় গিয়ে জানলাম রাজবন্দী বা নিরাপত্তা বন্দীর কোনটার মর্যাদাই আমাদের নেই। আমরা হলাম বিচারাধীন বন্দী। ইতিপূর্বে অবৈধ শাসক আইয়ুবের সময় স্টেট প্রিজনার্স রুলস প্রবর্তিত হয় রাজবন্দীদের জন্য। রাজবন্দীদের সেই মান-মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা মওলানা ভাসানী থেকে আরম্ভ করে শেখ মুজিবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা পূর্ণভাবে ভোগ করেছে। নিন্দার বিষয়, সেই রাজবন্দী শেখ মুজিবই রাজবন্দীদের জন্য প্রণীত এবং প্রবর্তিত স্টেট প্রিজনার্স রুলস প্রত্যাহার করে নিয়ে বিনাদোষে বিনাকারণে বিচারাধীন আসামীর মর্যাদায় নিক্ষেপ করেন। অথচ আতাউর রহমান খানের কোয়ালিশন সরকারের সময় প্রিজনার্স রুলস প্রবর্তন করা হয়েছিল। একমাত্র হিংসাত্মক ও বিদ্বেষাত্মক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হায়েনার পক্ষেই এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা করা সম্ভব এবং তিনি নিজেই তা প্রমাণ করেছেন। সুতরাং জেলখানায় গমের আটার স্থলে তেঁতুলের বীচির আটা এবং অন্যান্য অখাদ্য পরিবেশন করা হত। ৩০.০৬.৭৪ তারিখে ১৫০ পাউণ্ড ওজন নিয়ে আমি ঢাকা জেলখানায় ঢুকি। কিন্তু ৭৪-এর ২রা অক্টোবর আমার ওজন হয় ১৩৪ পাউণ্ড, ১৯৭৫-এর মার্চ মাসে আমার ওজন হয় ১১৯ পাউণ্ড। আইয়ুব আমলের জেলের তুলনায় মুজিবের জেল ছিল নরক। ফলে চোখে পানি আমাদের চলাফেরা খাওয়ায়। তা সত্ত্বেও আমরা মাথা নত করিনি।

আমাদের মুক্তির জন্য হাইকোর্টে ড. আলিম আল রাজী রীট পিটিশন করেন। হাইকোর্টের আদেশে ১১.০৩.৭৫ তারিখে আমাদের মুক্তির আদেশ দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ১১.০৩,৭৫ তারিখে যদিও আমাদের আটকাদেশ প্রত্যাহার করা হয় কিন্তু জেলগেট থেকেই মশিউর রহমানসহ আমাকে ইমার্জেন্সী পাওয়ার রুলস ‘৭৫ এর বলে বিনাবিচারে আটক রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। সুতরাং পুনরায় বিনাবিচারে জেল জীবন শুরু হল। শেখ মুজিবের মত ফ্যাসিস্ট মনোভাবাপন ব্যক্তির সরকারের পক্ষেই এটা করা সম্ভব হয়েছে।

প্রিজনার্স রুলস প্রত্যাহার করার ফলে কাপড়-চোপড় থেকে দাঁতের মাজন পর্যন্ত আমাদের বাড়ি থেকে সরবরাহ করতে হত। মুজিবের সময় জেল ডিসিপ্লিন বলতে কিছুই ছিল না। এটা আমার পূর্বে এবং মুজিব আমলে জেল খাটা অভিজ্ঞতাপ্রসূত বক্তব্য। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের বিপ্লবের পর ২৪.০৮.৭৫ তারিখে আমি এবং মশিউর রহমান মুক্তিলাভ করি। জনাব নুরুর রহমান ১৯৭৪ সালেই মুক্তি পান।

জিয়াসা সাপ্তাহিক ইক্তেহাদ-এ মার্শাল ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে আপোসহীন লেখার কারণে আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। উপায়ান্তর না দেখে তার জনশক্তি মন্ত্রী জনাব আতাউদ্দিন খান আমাকে ৮০ সালের ৭ই আগস্ট গ্রেফতার করে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী আতাউদ্দিন খান সাহেবের মন্ত্রিত্ব যাবার পর তার দায়েরকৃত মামলার কোর্টে হাজির হতেন না। ফলে চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এ মামলাকে খারিজ বলে ঘোষণা দেন। আবার প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার ইত্তেহাদ-এ জ্বালাময়ী লেখায় হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে আমার বিরুদ্ধে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট : সেকশন-১৬ মোতাবেক মামলা দায়ের করেন। কিন্তু অবৈধ এরশাদ সরকার আমাকে ১৯৮২ সালের ১০ই মে আমার সম্পত্তি ক্রোক ও আমাকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়। সম্মানীয় সেশন জজ আমাকে পাসপোর্ট জমা রেখে ১০ হাজার টাকায় জামিন দেন। স্পেশাল ট্রাইবুনাল জজ ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে মামলা খারিজ করে দেন।

১৯৮৪ সালের ২রা মে আমরা বায়তুল মুকাররমে জনসভা করি। এতে বোমা বিস্ফোরণে একাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারান। ৫ই মে এর প্রতিবাদে আমরা সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করি। সেদিনই আমাকে ফুলবাড়িয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আমার সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় সহকর্মী সৈয়দ মাজহারুল হক, ইলিয়াস মিন্টু, আহমেদ আরজু, আজাদ, মোস্তফা জালাল ও ইলিয়াস খোকনকে। Under Section ১৭(২) iii of on ১৯৮২ অর্থাৎ সামরিক আইনে সামরিক আদালতে আমাদের বিচারের জন্য মামলা দায়ের করা হয়। এর বিরুদ্ধে ঢাকা হাইকোর্টে মাননীয় বিচারপতিদ্বয় আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী এবং আবদুল জলিল আমার সহকর্মীসহ আমাকে জামিনে মুক্তি দেয়ার আদেশ দেন ২৫শে জুন ‘৮৪ তাবিখে। মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট নিজাম উদ্দিন হায়দার, সহযোগী ছিলেন, অ্যাডভোকেট বজলুর রহমান তালুকদার, অ্যাডভোকেট আবু সৈয়দ আহমদ, অ্যাডভোকেট এস, কে আবদুল হাই ও অ্যাডভোকেট মাহবুবুল হক।

কিন্তু ‘৮৪ সালের ৩০শে জুলাই পুনরায় আমাকে সামরিক আইনে গ্রেফতার করা হয়। ৩১শে জুলাই ‘৮৪ মার্শাল ল’ কোর্টে আমাকে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়। মার্শাল ল’ কোর্টে বিচারাধীনকালে আমার শ্রদ্ধেয়া গর্ভধারিণী মা ইন্তেকাল করেন। ১৯৬৪ সালে জেলে থাকাকালে আইয়ুবের আমলে আমার জন্মদাতা পিতা ইন্তেকাল করেন। তখন জালিম মোনায়েম খান আমাকে প্যারোল দেয়নি পিতার লাশ দেখার জন্য। তবে মায়ের লাশ দেখার জন্য আমাকে প্যারোল দেয়া হয়।

স্পেশাল মার্শাল ল কোর্ট নং ৭-এ বিচারে মামলা খারিজ হয়ে যায়। ‘৮৫ সালের ১৪ই জানুয়ারি আমি মুক্তি লাভ করি। আবার ১লা মার্চ আমাকে গ্রেফতার করে, মুক্তি দেয় ২রা জুন। ১৯৮৬ সালের ৩০শে এপ্রিল আমাকে পনেরবারের মত গ্রেফতার করে। মুক্তি পাই ১১ই মে। আমাকে ষোলবারের মত গ্রেফতার করা হয় সে বছর ১২ই অক্টোবর। মুক্তি পাই ১৭ই অক্টোবর।

শেখ মুজিবের ৩টি দুর্লভ চিঠি

আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে অলি আহাদকে কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়। তখন দলীয় নেতৃবৃন্দ তাকে চিঠি লিখে সান্ত্বনা জানাতেন, খোঁজখবর নিতেন, জানতে চাইতেন কুশলাদি। মরহুম শেখ মুজিবুর রহনানও অনেক চিঠি লিখেছেন জনাব অলি আহাদের কাছে। ১৯৫৬, ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে লেখা কয়েকটি চিঠি থেকে তিনটি চিঠি পত্রস্থ করা হল। এসব চিঠিতে শেখ মুজিব রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়াও তার ব্যক্তিগত এরং পারিবারিক অনেক সমস্যার উল্লেখ করেছেন। নিচে পাঠোদ্ধারসহ চিঠিগুলোর মূল কপি ছাপা হল :

তারিখ: ২৪.০১.১৯৬১

স্নেহের অলি আহাদ

আমার ভালোবাসা নিও। তোমার কোন খোঁজখবর বহুদিন পাই না। শুনলাম তুমি কুমিল্লা কারাগারে বন্দী আছ। তোমার ভাবী তোমার জন্য খুব ব্যস্ত, কারণ তোমার কোনো খবর জানতে পারছে না। কেমন আছ এই খবরটি আমাদের দিলে খুশী হব। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তোমার হতভাগা ভাইকে লিখতে ভুলিও না। অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত আ্ছি, কারণ টাকার খুব প্রয়োজন। তোমার ভাবী প্রায় দুইমাস অসুস্থ ছিল। এখন ভালো। চিন্তা করিও না। খোদা সহায় আছে। আমার হাইকোর্টের মামলা এখনও শেষ হয় নাই। বোধহয় শীঘ্রই হতে পারে। সকলকে ছালাম দিও। ইতি-

তোমার মুজিব ভাই

০৬.১০.৬২

স্নেহের অলি আহাদ

আমার স্নেহ ও ভালোবাসা নিও। বহুদিন তোমার কোনো খবর পাই না। তোমার ভাবী সকল সময়ই তোমার কথা বলে। অনেককেই সরকার ছেড়ে দিয়েছে তোমাকে কেন ছাড়ল না বুঝতে পারলাম না। আমার দিন কোনোমতে চলছে। চিন্তা করিও না। চালিয়ে যাচ্ছি। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। সকল বন্ধু-বান্ধবদের ভালোবাসা দিও। তোমার কোনো জিনিসের প্রয়োজন হলে আমাকে অথবা তোমার ভাবীকে লিখতে পার। মনে রেখ কোন ত্যাগই বৃথা যায় না। শরীরের প্রতি যত্ন নিও।

তোমার মুজিব ভাই

৭ সমারসেট হাউস, করাচি 

৪ই জানুয়ারি, ১৯৫৬

প্রিয় অলি আহাদ, তোমার পাঠানো সংবাদ পেয়েছি। আমি জানি তুমি কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। যদিও সংবিধানের কোনো খসড়া আমাদের হাতে নেই, তবুও আমরা জানতে পেরেছি যে যদিও মৈত্রীদল একটি সূত্র নির্ধারণের জন্য সম্মত হয়েছে, তবে পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে ইউএফ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। খসড়া কপি হাতে পেলে সঙ্গে করে নিয়ে আসব অথবা আমি যদি না আসতে পারি তবে আমি তোমাকে কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করার ক্ষমতা দিয়ে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। আমি দেশে ফিরে সংবিধান সভায় আমাদের অবস্থান সম্পর্কে মওলানা সাহেবের মতামত সামগ্রিক বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য উদ্বিগ্ন। তুমি হয়ত ইতিমধ্যে ৮ শত টাকা পেয়েছ। আমি আওয়ামী লীগের জন্য আরো অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছি। পূর্ব বাংলায় আমার দলের অবস্থান ও জেলহাজতে নির্যাতিত আমাদের কর্মীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর অনুরোধ রইল। আবদুস সালাম ও দলের অন্য কর্মীদের আশু মুক্তির ব্যাপারে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো। আমি জানি তুমি একান্ত একা, কেননা এ ব্যাপারে তোমার কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করার মত খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই রয়েছে। মহকুমা কমিটির সাথে যোগাযোগ করে উদ্ভূত প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে আমাকে লিখো।

হাই বর্তমানে কোথায় আছে? তার স্ত্রী বর্তমানে কোথায় এবং তার বাড়ির ঠিকানা আমাকে পাঠাবে এবং আমার কাছে তাকে চিঠি লিখতে বলবে।

আমি তোমাকে আমার নিজস্ব বিষয়ে কিছু করার অনুরোধ করব। আমার ছেলে কামাল উদ্দিনের সেন্ট জেভিয়ার কনভেন্ট এবং কন্যাকে কামরুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অথবা বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর ব্যাপারে চেষ্টা করবে। তাদের জন্য একজন ভালো গৃহশিক্ষক রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তোমার ভাবী যে আমার অনুপস্থিতিতে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ বোধ করছেন, তার সাথে যোগাযোগ রেখো। আমি ভালো আছি। লেখার আমন্ত্রণ রইল।

তোমার মুজিব ভাই।

7. Somerset House, KARACHI

4th January, 1956

My Dear Oli Ahad Received your kind note. I know that you are very anxious about a meeting of the working committee. We have not yet got the draft of the Constitution although it has been learnt that the coalition party has agreed to some formula and also the UF have betrayed the case of East Bengal. When I get the draft either I will come with it or I will send it to you and authorise you to call the meeting of the Working Committee if I fail to come. I am very anxious to be back and to discuss with you and the Maulana Saheb about our stand in the Constituent Assembly. Perhaps you must have received the Tk 8.00/and I am still trying to get some more money for the Awami League. Please inform me about the position in East Bengal and about our workers who are in jail. Please try to meet the East Bengal Chief Minister in connection with the release of Mr. Abdus Samad and other workers of ours. I know that you are feeling lonely because very few are there to help you and co-operate with you as far as your work is concerned. Please try to contact the sub divisitional committees and write to me of your difficulties.

Where is Hai? Please tell him to write a letter to me and give his home address and where is his wife?

May I request you to do something for mefor my personal mattters. Try to get admission for my son, Kamaluddin, in St. Xavier’s Convent and for my daughter in the Quamrunnessa Girl’s High School or in the Bangla Bazar School.

Also try to get a good tutor for them and always try to keep contact with your Bhabi who too, is feeling lonely. I am O.K. Please write to me.

Yours Sincerely

Mujib Bhai

আওয়ামী লীগের জন্ম : সেই সব দিন

পহেলা জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়েই দেখি এক ভীতিকর চিত্র। পাকিস্তানি বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর কোপানলে আমাদের লোকজন। ধরপাকড়, হুলিয়া, নির্যাতনের এক ভীতিকর পরিস্থিতি। মুজিব ভাই আমাকে বারবার বলেছিলেন গ্রেফতার এড়িয়ে চলতে। আন্দোলন পরিচালনার জন্য আমাকেসহ অন্য সকলকে আন্দোলন এগিয়ে নিতে যথাসম্ভব পুলিশকে এড়িয়ে চলতে বলেছিলেন। মুজিব ভাই তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেলখানায় আমাকে দেখেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। আমাকে প্রচুর বকাবকি করলেন। মুজিব ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসির বাসভবনের সামনের অবস্থান ধর্মঘট থেকে। ‘৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম বেতনভূক কর্মচারীরা তাদের বিভিন্ন দাবিতে মিটিং, মিছিল করছিলেন। আমরা ছাত্ররা তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট শুরু করি। এই ধর্মঘটেরই এক পর্যায়ে ভিসি ড. সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেনের বাড়িতে অবস্থান ধর্মঘট করি। ধর্মঘট করার জন্য আমাদের ২৪ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ছাত্রদের বিরুদ্ধে নেয়া এই বহিষ্কারাদেশের বিরুদ্ধে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেই।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালেই আমরা টাঙ্গাইলে শামসুল হকের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার খবর পাই। সরকারের সীমাহীন প্রভাব, প্রতাপশালী জমিদার মুসলিম লীগ জনাব পন্নীকে হারিয়ে শামসুল হকের জয়লাভ ছিল এক বিশাল ব্যাপার। বিজয়ের সংবাদ শুনে জেলখানায় আমাদেরই সংবর্ধনা দেয়া হয়। ১লা জুন আমরা জেল থেকে মুক্তি পাই। মুজিব ভাই তখনও জেলের বন্দিশালায়। জেল থেকে এসেই জানলাম মুসলিম লীগ কর্মীদের এক সম্মেলন ডাকা হয়েছে ২৩শে জুন। সম্মেলনের জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে খোঁজাখুঁজি, আবেদন-নিবেদন করেও কোনো ফল হল না। কেউ জায়গা দিতে রাজী হচ্ছে না। মুসলিম লীগের নির্যাতন তাদের কোপানলে পড়ার ভয়ে কেউ রাজি হচ্ছিল না।

শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন রশীদ সাহেব সাহস করে জায়গা দিলেন। তিনি ছিলেন খন্দকার মোশতাকের হরিহর আত্মা। আমরা সেই সম্মেলনে যোগদান করি।

স্বাভাবিকভাবেই তখনকার মুসলিম লীগের অত্যাচারের ভয়ভীতি ছিল। যাদের আসার কথা ছিল তাদের অনেকেই আসেন নি। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী অ্যামবাস্যাডর হয়ে চলে যান। তোফাজ্জল আলী হলেন মন্ত্রী। সবুর খান ছিলেন খুলনায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ডান হাত। সেই সবুর খান এলেন না। রংপুরের আহমদ হোসেন ৪৬-এ সোহরাওয়ার্দীর বেঙ্গল ক্যাবিনেটের মন্ত্রী ছিলেন। তিনিও আসেন নি। ডা. মালেক যিনি একাত্তরে গভর্নর হয়েছিলেন, আসেন নি তিনিও। প্রতিনিধিত্বশীল প্রায় দেড়শ জননেতা এতে যোগ দিয়েছিলেন।

মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এই সম্মেলনের রিসিপশন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আতাউর রহমান খান। সম্মেলনে আমার পাশেই ছিলেন মরহুম ওদুধ, ফরিদপুরের নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, এমএলএ খয়রাত হোসেন, নারায়ণগঞ্জের আওয়াল ও আলমাস, নূরুর রহমান, সিলেটের অ্যাডভোকেট জসীম উদ্দিন আহমদ, ঢাকা চেম্বারের প্রেসিডেন্ট সাখাওয়াত হোসেন, আলী আমজাদ খান, ইকবাল আনসারীর মা এমএলএ আনোয়ারা বেগম (শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে মারা যান), যশোরের মশিউর রহমান (পরবর্তীতে যিনি আতাউর রহমান সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন), রংপুরের খয়রাত হোসেন ছাড়াও ডা. মোজাহার, টাঙ্গাইলের হযরত আলীর নাম অলি আহাদ স্মরণ করতে পারলেন। জানালেন মোট উপস্থিতি দেড়শ’র বেশি ছিল না।

সম্মেলনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে জেনারেল সেক্রেটারি করা হল। চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট আওয়ামী মুসলিম লীগের অপর কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন, প্রেসিডেন্ট ঢাকা চেম্বার অব কমার্স, আলী আহমদ খান এমএলএ, আলী আমজাদ খান অ্যাডভোকেট এবং আবদুস সালাম খান অ্যাডভোকেট, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও একেএম রফিকুল হোসেন সহ-সম্পাদক, ইয়ার মোহাম্মদ খান কোষাধ্যক্ষ। এই সম্মেলনে আমি, ওদুদ, নূরুল ইসলাম পাটোয়ারীসহ আমরা যুবকরাই মুজিব ভাইয়ের নাম যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব করেছিলাম। আমরাই মুজব ভাইয়ের নাম অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রস্তাব করে আমাদের দাবি গ্রহণ করার জোর দাবি জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, মুজিব ভাই জেলখানায়। তিনি যোগ্য নেতা। তাঁকেই যুগ সম্পাদক করতে হবে। নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন আমাদের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তারা আগে থেকেই মুজিব ভাইয়ের বিরোধী ছিলেন। আমরাও ততবেশি সোচ্চার হই এবং মুজিব ভাইকে যুগ্ম সম্পাদক করার জন্য আমাদের প্রস্তাব গৃহীত হয়। মুজিব ভাই-ই ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের একমাত্র যুগ্ম সম্পাদক।

রোজ গার্ডেনের এই সম্মেলনে মুসলিম লীগ বাদ দিয়ে সর্বসম্মতভাবে, বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা, হর্ষধ্বনির সাথে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। সংগঠনটি পাকিস্তানি, উর্দুভাষী শাসক শোষকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু, তাদের অত্যাচার, নির্যাতন উপেক্ষা করে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথের যাত্রা শুরু করে।

এই সম্মেলনে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের এই সরকার জালেম সরকার। ইসলাম বিরোধী সরকার। মদ, শরাব চলবে, ঘুষ চলবে—এ জন্য আমরা পাকিস্তান বানাইনি। এই জালেম সরকারকে হটানোই আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। মওলানা ভাসানী বললেন, যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সেই সোহরাওয়ার্দীকে তারা অপমান করেছে। সোহরাওয়ার্দী যদি প্রধানমন্ত্রী না হতেন, আসাম, বঙ্গদেশের নেতৃত্বে না থাকতেন তাহলে আজ পাকিস্তান হত না। লিয়াকত আলী খান, নূরুল আমিনসহ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের নামোল্লেখ করে বিষোদগার করেই বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। কঠোর ভাষায় লিয়াকত আলী খানের নাম ধরে তিনি বললেন, লিয়াকত আলী, একবার তুমি মনে কর সোহরাওয়ার্দীর মত ব্যারিস্টারের সামনে তুমি কি। তুমি তো মাইনরিটি প্রভিন্স থেকে এসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছ। নূরুল আমিন, একবার মনে কর তুমি সোহরাওয়ার্দীর কি ছিলে। ‘৪৬ সালে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নেতা কে ছিল। সোহরাওয়ার্দীর মত নেতার নেতৃত্বে নির্বাচন করে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে বঙ্গদেশে সরকার গঠন করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৩৫ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী আসাম, বাংলাকে বঙ্গদেশ বলা হত। ৪৬-এর নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী বঙ্গদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন।

মওলানা ভাসানী তাঁর তেজোদীপ্ত ভাষণে বলেছিলেন, মেজরিটি দেশের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হল না। সবটাই ষড়যন্ত্রের ফল। সেই যড়যন্ত্রে খাজা নাজিমুদ্দীন নূরুল আমিন তোমরা ছিলা। মুসলিম লীগকে তোমরা চৌধুরী খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে কুম্ষিগত করেছ। আমরা মুসলিম লীগের ছিলাম। থাকতে চেয়েছিলাম। মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের সময় সদস্য হওয়ার জন্য আমাদের রিসিপ্ট বইও দেয়া হয়নি। সুতরাং আমরা খাজা গজাদের মুসলিম লীগ চাই না। আমরা লীগ করতে চাই। খাজা গজাদের মুসলিম লীগ নয়, আমরা জনগণের মুসলিম লীগ করব। সেজন্য আমরা আওয়ামী মুসলিম লীগ করতে চাই। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমরা পাকিস্তান চেয়েছিলাম। আমরা এই পাকিস্তান চাই না। আমরা কারা? আমরা বঙ্গ আসামের মুসলমান। আমরা এই পাকিস্তান করতে চাই নাই, নেতৃত্ব অবাঙালি, উর্দুভাষীদের হাতে থাকবে। পরিপূর্ণ খোলাফারে রাশেদীনের সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলাম। সেই দাবিতেই পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসকগোষ্ঠী সর্ব পর্যায়ে ইসলাম বিরোধী কাজে লিপ্ত। ইসলাম বিরোধী কাজে সবাই ব্যাপৃত। আমরা ইসলাম, সুতরাং নামে তোমরা মুসলমান হলেও কাজেকর্মে, চলাফেরায়, সমাজজীবনের উচ্চন্তরে সর্বত্র তোমরা ইসলাম বিরোধী লোক। অতএব, আমরা যেমন লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী একাধিক রাষ্ট্র চেয়েছি, তেমন আমরা ইসলামকে রাষ্ট্রীয় জীবনে তথা খোলাফায়ে রাশেদীনের সমাজব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে প্রবর্তন এবং কার্যকর করতে চাই।

রোজ গার্ডেনের সেই ঐতিহাসিক সম্মেলনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও এসেছিলেন। বক্তৃতাও করেন। শেরে বাংলা তখন ছিলেন নূরুল আমিন সরকারের অ্যাটর্নী জেনারেল। এ কারণেই অন্যরা অনেকেই সেদিন খুবই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু আমরা ছেলেরা সেদিন শেরে বাংলার উপস্থিতিতে খুশি হইনি।

শেরে বাংলা তার বক্তৃতায় বললেন, মুসলিম লীগ দেশটা লুটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। এর বিরুদ্ধে কিছু করা দরকার। আসামের প্রেসিডেন্ট মওলানা ভাসানী আজ যে উদ্যোগ নিয়েছেন আমি তার প্রশংসা করি।

জননেতা মরহুম আতাউর রহমান খানও এই সম্মেলনে বক্তৃতা করেছিলেন। নূরুল আমিন সরকারের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রবল প্রভাবশালী প্রার্থী জমিদার পন্নীকে পরাজিত করে নবনির্বাচিত এমএলএ জনাব শামসুল হক কঠোর ভাষায় বক্তৃতা করেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা এই পাকিস্তান চাই না। আমরা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান চাই। সেই পাকিস্তান হয়নি। আমরা রবুবিয়াত দর্শনের ভিত্তিতে ইসলামকে পাকিস্তানের ভিত্তি হিসেবে মনে করি। একে কার্যকর করাই আমাদের আগামী দিনের দায়িত্ব। জনগণ খাজা গজাদের শাসন চায় না। তার প্রমাণ হল আমার মত সাধারণ লোককে নূরুল আমিন সরকারের সমস্ত মন্ত্রীদের, প্রশাসনের প্রচণ্ড প্রচার, প্রভাবের মাঝেও মুসলিম লীগ প্রার্থী জমিদার পন্নীর বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে।

সম্মেলনে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী সংগঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রস্তাব নেয়া হয় ইসলাম বিরোধী কোন আইন করা যাবে না। তবে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র কারেন্সি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। বাকি সব ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তান ও অন্যান্য প্রদেশকে দিতে হবে। মুজিব ভাই এবং আমরা যারা স্বাধীন বঙ্গদেশের সমর্থক ছিলাম তারাই আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করি।

২৪শে জুন বিকেলে সরকারি হুমকি ও হামলা উপেক্ষা করে আরমানিটোলা ময়দানে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম প্রকাশ্য সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ভাষা আন্দোলন : অলি আহাদের স্মৃতিচারণ

‘৪৭-এ দেশ বিভক্তির পরপরই পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী সকল অধিবাসীর উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার প্রয়াস শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদন্দীন নিজে ছিলেন উর্দুভাষী। তাই তাঁর আমলে, সূচনাতেই উচ্চপদস্থ উর্দুভাষী সরকারি কর্মচারীগণ প্রভুসুলভ আচরণ শুরু করেন। বাংলাভাষী সমগ্র অধিবাসীর উপর উর্দু চাপিয়ে দেবার লক্ষ্যে তদানীন্তন রেডিও প্রোগ্রামে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলা শব্দের পরিবর্তে উর্দু শব্দ যথা রাষ্ট্রপ্রধানের স্থলে সদরে রিয়াসাত, স্থিরীকৃত স্থলে মোকররার, প্রধানমন্ত্রীর স্থলে উজিরে আজম, মন্ত্রীর স্থলে উজির, প্রতিনিধির স্থলে নোমায়েন্দা, সংবাদের স্থলে এলান, ছবির স্থলে তসবির ইত্যাদি যথেচ্ছ ব্যবহার করতে শুরু করে। এমনকি মনিঅর্ডার ফরম, টেলিগ্রাম ফরম, ডাকটিকিট ও মুদ্রায় উ্দু ভাষা ব্যবহৃত হতে থাকে। এসব কারণে স্বাভাবিকভাবে বাঙালি শিক্ষিত সম্প্রদায় প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপকদ্বয় আবুল কাসেম ও নূরুল হক ভূঁইয়া ধূমায়িত এ অসত্তোষকে সাংগঠনিক রূপদান প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ গঠন করেন। এই তমদ্দুন মজলিশই মহান অক্টোবরে (১৯৪৭) পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ও তদানীত্তন পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রী, সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর সভাপতিত্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি দানের প্রথম প্রকাশ্য দাবি উত্থাপিত হয়। এরপর ‘৪৭-এর জুলাই-এ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করলে জ্ঞানতাপস ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর প্রতিবাদ করে বলেন, “যদি বিদেশি ভাষা ইংরেজী পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার কোনো যুক্তি নেই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোনো দ্বিতীয় ভাষা গ্রহণ করিতে হয় তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা উচিত।” সচেতন শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিরোধিতা সুকৌশলে এড়ানোর জন্য করাচি শাসকচক্র উর্দুকে Lingua Franca বা শিক্ষণীয় সাধারণ ভাষা রূপে গ্রহণ করানোর চেষ্টায় লিপ্ত হন।

বস্তুত করাচি থেকে ঢাকা পর্যন্ত উর্দু ভাষাভাষী ও বাংলা ভাষাভাষী মহলের উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা অথবা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণের বাদ-প্রতিবাদই পরবর্তীকালে শিক্ষাঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন অতিক্রম করে রাজনৈতিক অঙ্গনে জটিল রাজনৈতিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়।

যা হোক “বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম করিতে হইবে”—অচিরেই এ দাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাঙ্গন, সাহিত্যসেবী ও বিদগ্ধজন এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সার্বজনীন দাবিতে পরিণত হল। ঢাকার বিভিন্ন সভা ও মিছিলের মূল আওয়াজ ছিল—“পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। ক্রমশ আন্দোলন পরিচালনাকারীদের বোধােদয় হয় যে, পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বিধায় আমাদের দাবি প্রাদেশিক ভাষা করার দাবিতে পর্যবসিত হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। তখন প্রাথমিক ভুল দাবি সংশোধন করে আমাদের দাবি উত্থিত হল—“বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিতে হইবে।”

উল্লেখ্য যে, সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যসেবী, সংস্কৃতিসেবীদের গণ্ডী অতিক্রম করে সেদিন সর্বত্যাগী নির্ভয় তরুণ ছাত্র সমাজের উপরই এই সক্রিয় আন্দোলনের মূল ও গুরুদায়িত্ব বর্তেছিল। সেই দাবি পূরণের স্বার্থেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ও পুরোভাগে ছাত্রসমাজের আবির্ভাব এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় পূর্বকাল পর্যন্ত এই ধারাই অব্যাহত ছিল।

সে সময় করাচিতে অনুষ্ঠিত সরকারি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা অথবা লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা করবার প্রস্তাব করলে এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৬ই ডিসেম্বর (১৯৪৭) পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশের সেক্রেটারি অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে ছাত্রসভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভাস্থল হতে এক বিরাট মিছিল পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রী, মোহাম্মদ আফজল এবং নূরুল আমিনের বাসভবনে গমন করে। মন্ত্রীদ্বয়ের নিকট থেকে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আশ্বাস পেয়ে মিছিলযোগে আমরা অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবনে উপস্থিত হই। কিন্তু তিনি আমাদের দাবি সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর মিছিলসহ আমরা যাই মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবন বর্ধমান হাউজে। কিন্তু অসুস্থতার অজুহাতে তিনি আমাদের সাথে দেখা করেননি।

পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের পর ১৯৪৮-এর ৮ই জানুয়ারি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল করেন।

আমার স্মৃতিতে বায়ান্নর সেই দিনটি

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। ঋতু পরিক্রমায় দিনটি ছিল বসন্তের। নির্মেঘ আকাশ। ঝলমল রোদ। সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে একটি ব্যস্তভাব উচ্চকিত অসন্তোষ, ছাত্রদের ক্রস্ত পদচারণা। আসন্ন সম্ভাব্য সংঘর্ষের প্রস্তুতিপর্ব। করণীয় সম্পর্কে কিছুটা দ্বন্দ্ব, গুটিকতকের মধ্যে পিছুটান যে ছিল না, তা নয়। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল বিক্ষুল্ধ, আবেগমথিত, আপোসহীন। আজকে যেখানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি, সেখানটায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন। বর্তমান ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের খানিকটা উত্তর পার্শ্বে মধুর রেস্তোরা। রেস্তোরার খানিকটা উত্তরে একটি পুকুর। কলাভবনের প্রশস্ত আঙ্গিনার মাঝখানে আমগাছ। সে গাছের তলাতেই ছাত্রজটলা। কলাভবন ও মেডিক্যাল কলেজের মাঝখানে ছিল একটি অনুচ্চ দেয়াল। মূল মেডিক্যাল কলেজের উত্তর পার্শ্বে যেখানে আজ নার্স হোস্টেল সেখান থেকে এখনকার শহীদ মিনার সংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত ছিল মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল ও ব্যারাক। মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ঠিক উত্তর পারশ্বেই তদানীস্তন অ্যাসেম্বলি হল (আজকের জগন্নাথ হল) বর্তমান শহীদ মিনারের উল্টাদিকে ছিল বিরাট বিরাট গাছ; সেখানে ছিল বেশ কয়টি রেস্তোরা।

বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের পূর্বপার্শ্বের রাস্তার যেখানে আজও সুউচ্চ বৃক্ষরাজি দণ্ডায়মান সেখানে মোতায়েন ছিল পুলিশের গাড়ি ও অগণিত ইউনিফর্মধারী পুলিশ। সকাল ৯টার মধ্যেই আমি কলাভবন প্রাঙ্গণে যাই। আমার উপস্থিতিতে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রকর্মীবৃন্দ, বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নেতা ও কর্মীরা দ্বিগুণ উদ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে ২০ তারিখ রাতের বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা আমাকে জানান এম. আর. আখতার মুকুল। বেলা প্রায় ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকটর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, আর্টস ফ্যাকাল্টির ডীন ড. জুবেরী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ ড. নিউম্যানকে সাথে নিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল উত্তেজনা প্রশমিত করা। ছাত্ররা ভাইস-চ্যান্সেলর সাহেবকে ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করার অনুরোধ জানায়। সভাপতিত্ব করার ব্যাপারে তিনি শর্ত দেন যে, ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে না। ছাত্ররা বিনয়ের সাথে এ শর্ত মানতে অসম্মতি জানায়। বেলা প্রায় ১১-টার দিকে যুবলীগ নেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আমতলায় সাধারণ ছাত্রসভা শুরু হয়। সভাপতির নাম প্রস্তাব করেন যুবলীগ নেতা এম, আর, আখতার মুকুল, সমর্থন করেন যুবলীগ নেতা কমরুদ্দীন শহুদ। বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হাজার হাজার ছাত্রের সমাবেশ ছিল এটা। সমাবেশ চলাকালে সেখানে আসেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক ও মোঃ তোয়াহা। তাঁরা দুজনই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্যে ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান। একই বক্তব্য রাখেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান। ছাত্র সাধারণ তাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে। এ সময়ে আমি সভাস্থল থেকে কয়েক গজ দূরে মধুর ক্যান্টিনে বসা। সংগ্রামী কর্মীরা আমাকে পাল্টা শক্ত জবাব দেবার অনুরোধ জানালে আমি তাঁদের বলি যে, “আমি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে চাই।” এ বক্তব্য আমি গতকালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ অধিবেশনে রেখেছি, এ মুহূর্তে আমি কোনো বিতণ্ডা চাই না। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতেও চাই, সংগ্রাম পরিষদও অটুট রাখতে চাই। এখানে বলে। রাখা দরকার, আমি তখন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। আমতলার এই সভাতেই বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আহ্বায়ক আবদুল মতিন দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের আহ্বান জানান। সভায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রতি নিন্দা জানিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

এর পরপরই বেলা তখন প্রায় সাড়ে এগারটা-ছয়জন, আটজন, দশজনের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ ভীতিহীনচিত্তে রাজপথের দিকে এগিয়ে চলে। ছাত্রসমাজের এই দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রেক্ষিতে অপেক্ষমাণ পুলিশ বাহিনী প্রথমে হতচকিত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিক্ষিপ্ত হতে থাকে ইট-পাটকেল। সাথে সাথে পুলিশ ছাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় অংগনে জমায়েত ছাত্রদের উপর কাদানে গ্যাস। সে সময়ে বিক্ষোভকারী ছাত্ররা বারবারই বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরস্থ পুকুরের পানিতে রুমাল ভিজিয়ে চোখের জ্বালা নিবারণের চেষ্টা করে। এটাই ছিল আমার স্মৃতিতে সবচাইতে উত্তপ্ত মুহূর্ত। স্বাভাবিক কারণেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে ছাত্র সাধারণের ধ্মনীতে। উত্তেজনাময় এই মুহূর্তেই রাওলাট অ্যাকটের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত সর্বভারতীয় অহিংস আইন অমান্য আন্দোলনের বিভিন্ন লোমহর্ষক ঘটনা আমার দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্জনের কথা আজো মনে পড়ে

জীবনের স্মরণীয় কিছু স্মৃতি মানুষ মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত স্মরণ রাখে—সেটা আনন্দের ঘটনাই হোক, আর বেদনার স্মৃতিই হোক। আমার জীবনে এ ধরনের অনেক শক্তি আছে। জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ বইটিতে আমি তার কিছু শক্তি তুলে ধরেছি। কথাগুলো বললেন ডেমোক্র্যাটিক লীগের সভাপতি অলি আহাদ। তার প্রিয়-অপ্রিয় স্মৃতির সংখ্যা অনেক। কিন্তু এখানে সবগুলো তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে দু’একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হল।

১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হরতাল করা হয়। তারও আগে শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠন করা হয়। কিন্তু হরতালের আগের দিন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সেক্রেটারিয়েটের গেটে গ্রুপে গ্রুপে পিকেটিং করি। আমাদের ৬৯ জনকে পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করা হয়। আমি সেদিন পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হই। ইংরেজ ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ মি. চ্যাথাম লাঠি চালানোর নির্দেশ দেন পুলিশকে। সিটি এসপি আব্দুল গফুর তৎপর হয়ে ওঠেন। আমাদের ৬৯ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের আঘাত ও ধস্তাধস্তির সময় আমার হাতের ঘড়ি উধাও হয়ে যায়। লাঠির আঘাতে প্রায় জ্ঞানহারা হয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্জনকে লক্ষ করে বললাম, “ক্ষমতায় এলে তোমাকে দেখিয়ে দেবো।”

অলি আহাদ বলেন, ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কাগমারী সম্মেলনও আমার কাছে স্মরণীয়। এখানে একটি কথা বলা দরকার। তা হল, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন অ্যাসেম্বলি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, দৈনিক আজাদ-এর কারণে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। আর ইত্তেফাক-এর কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আর আজকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ সেদিনের আজাদ ও ইত্তেফাক-এর ভূমিকা পালন করছে দৈনিক ইনকিলাব।

যা বলছিলাম। মুজিবের শাসন আর নির্যাতনে মানুষ যখন অতিষ্ঠ, তখন জাসদ গঠন করা হয়। কিন্তু তারও আগে বন্ধুবর বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে ‘র’-এর ইস্টার্ন জোনের প্রধানের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করে। ‘র’-এর প্রধান আমাকে প্রস্তাব দেন যে, আমি মুজিবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললে তারা আমাকে অর্থের জোগান দেবে। তাদের ভাষায়—টাকা কোনো ফ্যাক্টর নয়, আপনি আন্দোলন করেন। আমি ‘র’-এর ইস্টার্ন জোনের প্রধানকে সেদিন স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি, মুজিবের স্বৈরাচারী-নীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমি আন্দোলন করব। কিন্তু ‘র’-এর টাকা নিয়ে আন্দোলন করব না। এ দেশের মানুষ আমার সঙ্গে আছে। কাজেই ‘র’-এর টাকার প্রয়োজন নেই।

সিকিমের মত এদেশকে ভারতের অংশ করার জন্য সংবিধান সংশোধনের পায়তারা চলছে

সাতদলীয় জোট নেতা ভেমোক্র্যাটিক লীগ চেয়ারম্যান অলি আহাদ বলেছেন, ১৯৪৭ সাল থেকেই ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামকে তাদের অংশ করার যে চেষ্টা করছে, শেখ হাসিনার মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র চলছে। শেখ হাসিনা সিকিমের মত সংসদের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে ভারতের অংশ করার জন্য সংবিধান সংশোধনের পায়তারা করছে। তিনি বলেন, এদেশের জনগণের প্রতি নয়, শেখ হাসিনা দিল্লির প্রতি যেসব ওয়াদা করেছেন একে একে তা পূরণ করছে।

জাতীয়তাবাদী ঐক্যের ডাক-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি বিকেলে ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অর্থনীতি সবই আজ বিপন্ন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন, সভায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের তথ্য উপদেষ্টা আনোয়ার জাহিদ বলেছেন, এ সরকার একটি প্রক্সি সরকার, সত্যিকার ক্ষমতাসীন সরকার নয়। ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এখন বাংলাদেশের জনগণের লড়াই হচ্ছে।

মোঃ হারুন-অর-রশীদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন সাত দলীয় জোট নেতা জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, জামায়াতে হসলামীর আবদুল কাদের মোল্লা, পিএনপির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলু, এনডিএ’র নূরুল হক মজুমদার, আলমগীর মজুমদার, ফজলুল হক, আবদুল মোমেন ও মশিউর রহমান ঠাকুর।

অলি আহাদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বার্থেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের সাহায্য করা দরকার। তিনি একই সাথে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে স্বাধীনতা ঘোষণার আহবান জানিয়ে বলেন, আমরা আপনাদের সমর্থন দেব। পশ্চিম বাংলার কলকাতা বন্দর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বাংলাভাষীদের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে উঠবে।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে চান। ক্ষমতায় এসেই গণতন্ত্র স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হেনেছে। সংবিধান সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম হিন্দুস্তানের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। কেনা-বেচার রাজনীতি শুরু করেছে। তিনি সরকারের এ প্রক্রিয়াকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

আনোয়ার জাহিদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন বাংলাদেশ সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে সন্তু লারমার নিয়ন্ত্রণ চলছে। ভারত চাকমা জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য তাদের সাহায্য করেনি। ভারত উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামীদের নিয়ন্ত্রণ করতে নিজেদের স্বার্থেই চাকমাদের ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এ উপমহাদেশের মানচিত্র বদল হতে বাধ্য। আর এর বদলে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামীরা জয়ী হলে তা আমাদের পক্ষে আসবে। তারা পরাজিত হলে মানচিত্রের পরিবর্তন ভিন্ন হবে – যা আমাদের বিপক্ষে যাবে।

আনোয়ার জাহিদ বলেন, ‘৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কাউকে হত্যা করা হয়নি। এ দেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে সেদিন। সরকার আজ কর্নেল ফারুকের যে বিচার করছে তা শেষ হতে যে দীর্ঘ সময় লাগবে ততদিন এ সরকার টিকে থাকবে না-এটা সরকার বুঝতে পেরেছে। যার কারণে এখন সরকার সংবিধান সংশোধন করে সামারি ট্রায়ালের মাধ্যমে আপীলের সুযোগ না দিয়ে কর্নেল ফারুককে ফাসি দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে।

অন্তরঙ্গ অলি আহাদ

পারিবারিক জীবন

বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শ্রান্ত’- যার আচরণে, মননে, কথায় এ কবিতারই প্রতিধ্বনি তিনি অলি আহাদ। ডেমোক্র্যাটিক লীগের প্রেসিডেন্ট। রাজনীতির সাথে সেই ছাত্রজীবন থেকে জড়িত। ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। বছর ঘুরে একুশ এলেই তাকে আমাদের দরকার হয়ে পড়ে স্মৃতিকথা শোনার জন্যে, সেই শহীদ মিনারের ধুয়ে মুছে সাফ করার ঘটনার মতই। তার কাছে পত্রিকার তরফ থেকে দু-একবার রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার নিতে। এবারের উদ্দেশ্য তার ব্যক্তিজীবনের টানাপড়েন। হতাশা-উচ্ছ্বাস সম্পর্কে জানতে চাওয়া। মিনিট দশেক অপেক্ষার পর ডেকে পাঠালেন। ইন্টারভিউয়ের মর্মাংশ শুনে আপত্তি করলেন কিঞিৎ। তারপর বলতে লাগলেন বিয়ে করেছেন ১৯৭৮ সালের ২১শে নভেম্বর। বিয়েটা হয়েছে একটু বেশি বয়সেই। যে বয়স আর প্রেমের জন্যে সঠিক নয়। ঘটক ছিলেন এবিএম মুসা। পাত্রী রাশেদা বেগম। দেখতে ফর্সা, লম্বা। বর্তমানে তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। স্ত্রী রাশেদা বেগম তখন ‘নীয়ার’-এ কর্মরত ছিলেন। তাঁর সাথে প্রথম কথা হয় একেবারে নির্ভাক রাজনীতিবিদদের মত করেই। আমি গরীব মানুষ আমার সাথে ঘর করতে হলে তোমাকে কষ্ট করতে হবে। কোনোদিন ভাত জুটবে তো কোনোদিন জুটবে না। আমার যে স্ত্রী হবে তার চাকরি করা চলবে না। আর সে আমাকে রাজনীতিতে বাধা দিতে পারবে না। জেলই আমার একমাত্র ঘর।

পাত্রী রাশেদা বেগম উত্তর দিয়েছিলেন-আমার টাকা-পয়সার দরকার নেই। তবে চাকরি করব কি করব না সেটা পরে বিবেচনা করা যাবে।

বিয়েটা হয়েই গেল। রাশেদা বেগম অবশ্য কথা রেখেছেন। টাকা-পয়সার বায়না কখনো ধরেন নি। তবে চাকরি করেছেন লাগাতার। পোশাকে-আশাকে ধোপদুরস্ত। অলি আহাদের প্রিয় পোশাক স্যুট-টাই। যদিও অধিকাংশ সময় তিনি শেরওয়ানী পাঞ্জাবী পরেন। সাথে থাকে ওয়েস্ট কোট। পাকিস্তানি সালোয়ার কোর্তাও পরেন। সে পোশাককে তিনি পাকিস্তানি বলেন না। বলেন আফগানিস্তানি। বিদ্রোহের প্রতীক। পোশাকে বড়মানুষী ও ব্যতিক্রমী ভাব থাকলেও জীবনযাপনে সাদাসিধে। বেশ কয়েকটি রুম নিয়ে অফিসঘরটি যদি বড়সড় তবে অনাড়ম্বর। তার বসবার ঘরটিতে একপাশে ইত্তেফাক-এর পুরনো ফাইল সাজানো। অন্য পাশে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দেয়ালে টাওানো। একপাশে কাগজ, ম্যাগাজিনের ভিড়ে প্লাস্টিকের ফুলদানি।

অলি আহাদের অবসর বলে কিছু নেই। তিনি কাজের ফাকে ফাকে প্রায়। ara Stateman Far Eastern Economic Review ও ঢাকা শহরের সব দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা পড়েন। কিছু লেখালেখিও করেন। জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ বইটি লিখেছেন। জেলখানায় বসে। স্মৃতি থেকে সাহায্য নিয়েছেন। পরে জেলের বাইরে এসে ভকুমেন্ট দেখে মিলিয়েছেন ভুলচুকগুলো। লেখালেখি ছাড়া যদি সময় পান, গান শোনেন। বাংলা, গজল, ইংলিশ জাজ সব শোনেন।

বাংলাদেশি শিল্পীদের গান শোনেন না। প্রিয় শিল্পী প্রয়াত শচীনদেব বর্মণ ও হেমেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

নিজের বাড়ি নেই। স্ত্রীর কলেজের কোয়ার্টারে থাকেন। নিজের ঘরে টিভি নেই। ফ্রিজ আছে। টিভির প্রয়োজন বোধ করেন না। তবে একমাত্র মেয়ে রুমিন ফারহানা যার জন্ম ১৯৭৯ সালে, হলিক্রসে পড়ছে, তার মন রক্ষায় কিছুদিনের মধ্যেই টিভি কিনবেন বলে ভাবছেন।

অলি আহাদের একমাত্র ভালোবাসা মেয়ে রুমিন। এছাড়া মায়ের অভাব বোধ করেন। তার স্ত্রী যেদিন সত্তানসম্ভবা হলেন তখন থেকেই তিনি আরো বেশি সন্তানের জন্য মায়ের কষ্ট অনুভব করেছেন।

স্ত্রীই একমাত্র নারী যাকে ভালোবেসেছেন।

বিয়ের আগে কোনো মেয়ের সংস্পর্শে আসেন নি। তার মতে মেয়েদের সাথে সময় কাটায় সেসব যুবক, যাদের কোনো কাজকর্ম নেই। সুদর্শন পুরুষ অলি আহাদকে ছাত্রজীবনে বলা হত Politics Personificd যিনি রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছু বুঝতেন না। অল্প বয়সে যদিও সুদর্শন ছিলেন তবু তাকে মেয়েরা প্রম নিবেদন করেনি। সহাস্যে বললেন-যদিও করা উচিত ছিল।

অলি আহাদ মেয়েদের চাকরি করার বিপক্ষে। তার মতে Over Populated দেশে মেয়েদের চাকরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। ঘর সংসার করা। স্বামীর ঘর স্বর্গ করে তোলাই মেয়েদের ধর্ম। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বলে নারী নির্যাতন হচ্ছে তিনি তা বিশ্বাস করেন না। নারী নির্যাতনের একমাত্র কারণ ভালোবাসার অভাব। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন আলগা হওয়াটাই তার একমাত্র কারণ। তাছাড়া অনুন্নত দেশে এসব হবেই। সবচেয়ে বড় কথা দর্শন বাদ দিয়ে যেমন সমাজনীতি হয় না, ভালোবাসা ছাড়া তেমনি সংসার হয় না। নারীর পেশাজীবনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। এমন একজন পিতা কি তার মেয়েকে রাজনীতিতে আসতে দেবেন? তার উত্তর, যদি তার স্বামী চায় তবে সে রাজনীতি করবে। নতুবা নয়। তবে জাতীয় পার্টি করবে না। করবে কমিউনিস্ট পার্টি।

কথা প্রসঙ্গে অলি আহাদ উত্তেজিত স্বরে বললেন, কমিউনিস্ট পার্টি নয়, আমার মতে মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।

ভাগ্যে বিশ্বাসী অলি আহাদ পাথরেও বিশ্বাস করেন। ডান হাতে পাঁচটি আংটি জৃলজ্বল করছে- হীরা, পান্না ও আকিক। পান্না গ্রহণ সম্পর্কে তার মত আমি কুসংস্কারের উর্ধ্বে নই। রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে এ সবের উর্ধ্বে যেতে পারি না। অলি আহাদ রাত তিনটায় ঘুম থেকে ওঠেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। তাহাজ্জদ-এর নামায পড়েন কি না সে সম্পর্কে বলেন, প্রকৃত মুসলমান ইবাদতের কথা বলে না।

প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ অলি আহাদ জীবন সম্পর্কে মন্তব্য করলেন নিজের অভিজ্ঞতায়, কিছু মূল্যবোধ থাকবে। জাতির ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব থাকবে। সত্যের পূজারী হবে।

আই অ্যাম প্রাউড অব মাই হাজব্যান্ড

মিসেস রাশেদা বেগম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খ্যাতিমান প্রবীণ রাজনীতিবিদ বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক লীগ সভাপতি জনাব অলি আহাদের সহধর্মিণী। নরসিংদীর মেয়ে মিসেস রাশেদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে অনার্স সহ এমএ পাস করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদের ডীন ছিলেন। এর পূর্বে তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে অধ্যাপনা, ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজেও কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ডেমোক্র্যাটিক লীগ সভাপতি জনাব অলি আহাদকে বিয়ে করেন। গত ১১ই ১৯৯০ জানুয়ারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনে তাঁর সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয়।

প্রশ্ন : আপনার স্বামীকে রাজনীতিবিদ ও স্বামী হিসেবে মূল্যায়ন করুন।

রাশেদা বেগম : আমার এই ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন। তার যে রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে, তার নিরিখে দেশের মানুষই তাকে যথার্থ মূল্যায়ন করবে। আমার পক্ষে আর কতটুকু সম্ভব হবে। তবে আমি তাকে যা দেখেছি, তার প্রেক্ষিতে বলতে পারি, তাঁর মত নিঃস্বার্থ লোক খুবই কম হয়। আমাদের দেশে এখন তো এর মূল্যায়ন হচ্ছে না। হয়ত পরে হবে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশ হলে হয়তো তিনি সেই সুনাম ও খ্যাতি পেতেন।

আর স্বামী হিসেবে বলতে পারি তিনি খুব ভালো। আমাদের দেশে সাধারণত অনেক রাজনীতিবিদই তাদের স্ত্রীদের সময় দিতে পারে না। সেক্ষেত্রে আমি বলব অলি আহাদ এর ব্যতিক্রম। তিনি শুধু আমাকে নয়, তাঁর মেয়ে, ভাইবোন এবং আত্মীয়-স্বজনদেরও যথেষ্ট সময় দেন। সহজাত স্বভাবে তিনি অত্যন্ত নীতিবান ও জেদী হলেও তার মেয়ের যেকোনো কথাই তিনি মেনে নেন।

প্রশ্ন : জনাব অলি আহাদ তো ছাত্রজীবন থেকেই একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদ। আপনি তাকে বিয়ে করলেন কেন?

রাশেদা বেগম : তাঁকে রাজনীতিবিদ জেনেই আমি বিয়ে করেছি। আমি জানতাম ‘হি ইজ এ ম্যান অব প্রিন্সিপল’ এটাই আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছে। আর আমি নিজেও টাকা-পয়সা ধন-সম্পদের লোভী নই। বোধ হয় সেটাই তার মত নিঃস্বার্থ লোকের প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করেছে বেশি।

প্রশ্ন : আপনি কি আপনার স্বামীর দল বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন?

রাশেদা বেগম : কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আমার বিশেষ সমর্থন নেই। বলতে পারেন আমি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। আমি অলি আহাদের অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনেক সময় সমালোচনাও করি। আর এজ এ পার্টি ডেমোক্র্যাটিক লীগকে আমি চিন্তাও করি না। হয়ত ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাথে জড়িত কয়েকজন লোককে চিনি, ভালো মনে করি।

প্রশ্ন : এতে পারিবারিক জীবনে আপনাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য হয় কিনা?

রাশেদা বেগম : একটুও না। কারণ অলি আহাদও চান না, আমি রাজনীতিতে এতটুকু জড়িত নই। তবে তার কর্মসূচির ব্যাপারে মাঝে মাঝে কিছুটা মতপার্থক্য হয়। যেমন কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান থাকলে সে তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকার কারণে হয়ত সেখানে যান না। এ ব্যাপারে সে খুবই জেদী। তারপরও আমার মনে হয়, সব ব্যাপারে চেষ্টা করেন সময় দেবার।

প্রশ্ন : মহিলাদের রাষ্ট্রনায়ক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

রাশেদা বেগম : যদি সত্যি সত্যি যোগ্য মহিলা নেতৃত্বে আসেন তাহলে আমি অবশ্যই তাকে ওয়েলকাম করব এবং আমি বিশ্বাস করি ছেলেদের চাইতে মেয়েদের নিষ্ঠা অনেক বেশি।

প্রশ্ন : এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু’জন প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে নেত্রী হিসেবে মূল্যায়ন করুন।

রাশেদা বেগম : এটা খুবই কঠিন প্রশ্ন। তবে আমি বলব নেত্রী হিসেবে তারা কেউ কারো চাইতে কম নন। কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে কে কতটুকু যোগ্য সেটা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে এ মুহূর্তে মূল্যায়ন করতে পারব না। আর আমার মনে হয় এ ব্যাপারে মূল্যায়ন করার সময় এখনো আসেনি।

প্রশ্ন : শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান ও এরশাদকে রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে মূল্যায়ন করুন।

রাশেদা বেগম ; তিনজনই প্রেসিডেন্ট। তিনজনেরই কিছু কিছু অবদান আছে, আবার ব্যর্থতাও আছে। তবে আমার মনে হয় তাদের তিনজনকে মূল্যায়ন করে একটি বিরাট বই-ই লেখা যায়।

প্রশ্ন : আপনার সন্তান কয়জন?

রাশেদা বেগম : আমাদের একটিই সন্তান। আমার মেয়ে রুমিন। বর্তমানে ওর বয়স ১০ বছর, হলিক্রস স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

প্রশ্ন : আপনার মেয়ে বড় হয়ে তার পিতার মত একজন বড় রাজনীতিবিদ হোক—এটা কি আপনি চান?

রাশেদা বেগম : ও বড় হয়ে যে দিকেই যায় সেটা তার ব্যাপার। ও যদি সম্মান নিয়ে ওর বাবার মত রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে তাতে আমার আপত্তি থাকবে কেন?

প্রশ্ন : আপনার স্বামী রাজনীতিবিদ না হয়ে যদি অন্য পেশার হতেন, তাহলে কেমন হত?

রাশেদা বেগম : প্রশ্নটা কেমন হাইপোথিসিসমূলক হয়ে গেল। তারপরও বলব “আই অ্যাম প্রাউড অব মাই হাজব্যান্ড।” তার সুনাম আছে, সেটা আমার গর্ববোধ করার মত। রাজনীতিবিদ না হয়ে উনি হয়তো একজন বড় অফিসার হতেন। এতে তো তার বর্তমান যে সুনাম আছে সেটা হত না। তার ভাইয়েরা সবাই বড় বড় অফিসার (একজন জাতিসংঘের বিশ্বখাদ্য সংস্থা, ফাও-এ কর্মরত)। কিন্তু তারা বিভিন্ন স্থানে অলি আহাদের নামেই পরিচিত হন। এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার আর কি হতে পারে।

প্রশ্ন : আপনার স্বামীর রাজনৈতিক দর্শন কতটুকু সঠিক?

রাশেদা বেগম : আমাদের দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া ও সংস্কৃতিতে অলি আহাদের রাজনীতি মূল্যায়নের লোকের অভাব রয়েছে। তাকে বোঝে এমন লোক খুবই কম। আমি তার রাজনৈতিক দর্শনকে সঠিক নয় বলব না, আমি মনে করি “হি ইজ কমপ্লিটলি রাইট।” কিন্তু আদর্শের সাথে তিনি নমনীয় হবেন কেন? কোন অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করবেন না, এই তাঁর দর্শন। সেজন্য আমি তার রাজনীতিকে সঠিকই বলব। তবে তিনি যেটা করছেন সেটা হয়তো আমি পারব না। তার যা ধৈর্য আছে, আমার হয়ত তা নেই। তার পক্ষে যে আদর্শের পথে টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে, এইজন্য আমি গর্ববোধ করি।

অলি আহাদের বই জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫

গোলাম ফারুক

স্পষ্টবাদী রাজনীতিবিদদের এখন দশ আঙ্গুলে গোনা যায়। দেশপ্রেমিক আদর্শ রাজনীতিকের চেয়ে পরাশ্রয়ী সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকরা বর্তমানে মাঠে ময়দানে বেশি তৎপর। ক্ষমতাসীনদের সাথে হাত মেলানো, ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা এবং হালুয়া রুটির প্রশ্নে রাজনীতিকদের সাথে এখন অন্য কারো জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে বর্তমানে যে ক’জন আপোসহীন বলিষ্ঠ রাজনীতিক আছেন তাদের মধ্যে জনাব অলি আহাদ অন্যতম। তিনি শুধু রাজনীতিবিদই নন, তিনি একজন লেখক এবং সাংবাদিকও। তাঁর বলিষ্ঠ হাত থেকে আমরা উপহার পেয়েছি জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ বইটি। তার রাজনৈতিক জীবনের ক্রমধারায় সংঘটিত নানা ঘটনাই ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠেছে বইটিতে। ব্যক্তিজীবনের স্মৃতিচারণকে কেন্দ্র করেও যে তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস রচনা করা যায় এটিই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

লেখক ঐতিহাসিক নন, রাজনীতিবিদ। ইতিহাস লেখা তাঁর কাজ নয়। কিন্তু তিনি ইতিহাসের উপাদানকে অবলোকন করেছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। তাঁর চোখের সামনেই ঘটে গেছে ইতিহাসের হাজারো ঘটনা। এসব ঘটনার সাথে কখনো তিনি প্রত্যক্ষ, কখনো বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তবে তিনি কৌণিক প্রান্তিকতার আশ্রয় গ্রহণ না করে অত্যন্ত সহজ-সরল ও বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন সমসাময়িক ঘটনাবলিকে এবং বইটি পড়ে যেকোনো পাঠকের পক্ষেই মন্তব্য করা অত্যন্ত সহজ যে, জনাব অলি আহাদ আমাদের ইতিহাসকে মিথ্যা ও বিকৃতির অভিশাপ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। বিশেষ করে একজন রাজনীতিবিদ হয়ে ইতিহাসের রাজসাক্ষী হিসাবেই তিনি বর্ণনা করেছেন সমসাময়িক ঘটনাবলিকে আমাদের জাতীয় জীবনের ঝাবিক্ষুব্ধ পর্যায়গুলোকে অত্যন্ত সাহসিকতায় উন্মোচন করে দিয়েছেন তিনি। এ ধরনের ঘটনানির্ভর তথ্যসমৃদ্ধ বই আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে শুধু জানতে সহায়তাই করবে না, বরং একজন ইতিহাসের পাঠকের সামনে তুলে ধরবে হাজারো ঘটনার মৌলিক অবস্থানকে।

বইটি শুরু হয়েছে লেখকের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি দিয়ে। শেষ হয়েছে লেখকের কাছে আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ বহু রাজনীতিবিদের চিঠি দিয়ে। তিনি কিভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত হলেন তার বর্ণনা দিতে যেয়ে বলেছেন,

তদানীন্তন ভারতীয় মুসলিম সমাজে যে অভূতপূর্ব পুনর্জাগরণ দেখা দিয়াছিল তাহার তরঙ্গাঘাত আমার তরুণ মনে দারুণ রেখাপাত করে। ..মুসলমানদের ভারতের বুকে স্বীয় ও স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি আমার কচি মনকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। তাই স্কুলজীবনেই অপরিণত বয়সে প্রস্তাবিত মুসলিম বাসভূমি পাকিস্তান দাবির সক্রিয় ছাত্রকর্মী হই।

এরপর কিভাবে তিনি ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অগ্রসর হন তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :

অবিভক্ত বঙ্গদেশে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল পাকিস্তান আন্দোলনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন। ১৯৪৪ সালে যথারীতি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই এবং কলেজে আগমনের পরই আমি ঢাকা কলেজ মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই।

কালপরিক্রমায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন প্রসঙ্গে ১৫ জন সাংগঠনিক কমিটির সদস্যের নাম উল্লেখ করে বলেছেন,

শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা ছিলেন না এবং এই সংগঠন সম্পর্কে তিনি কিছুই অবহিত ছিলেন না। …অধুনা অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া প্রচার করিতেছেন। কিন্তু ইহা ইতিহাসের বিকৃতিমাত্র।

ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন সম্পর্কে বলেছেন,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপকদ্বয়। আবুল কাসেম ও নূরুল হক ভূইয়া ধূমায়িত অসন্তোষকে সাংগঠনিক রূপদান প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ গঠন করেন। নবগঠিত তমদ্দুন মজলিশই মহান ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন

বইটির আদান-প্রদানের রাজনীতি অধ্যায়ে আছে, “শেষ পর্যন্ত নেপথ্যে দেন-দরবার ও আদান-প্রদান রাজনীতি জয়লাভ করে এবং ভাসানী-মুজিব সমঝোতা হয়।…আর এইভাবেই মার্কিন কূটনীতির নিকট আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পদক্ষেপ সংগঠনের প্রগতিশীলও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী অংশকে নিদারুণভাবে হতাশ করে এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনীতি পরাজয়। বরণ করে। …ক্ষমতার রাজনীতির সীমাবদ্ধতা এইখানেই। এইখানেই নীতি, আদর্শ, দর্শন সবকিছুই অপাঙক্তেয় বা অবান্তর।” পার্টির নেতৃত্বের সাথে নীতিগত মতভেদের আপোসরফার বর্ণনা করতে যেয়ে জনাব অলি আহাদ লিখেছেন,

শেখ সাহেব আমাকে সোভিয়েট রাশিয়া বা যুক্তরাজ্যের ট্রেড কমিশনারের পদ বা পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। …কয়েকদিন পর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী নূরুর রহমান করাচি হইতে ঢাকা আগমন করেন ও আমার সহিত দেখা করিয়া প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর পক্ষ হইতে কলকাতাস্থ ডেপুটি হাই কমিশনারের কূটনৈতিক পদ গ্রহণ করিতে অনুরোধ জানান। প্রস্তাবগুলির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ আমার নিকট সুস্পষ্ট ছিল—রাজনীতির অঙ্গন হইতে আমাকে অপসারণ। চাকরি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাইলে করাচির মন্ত্রীমহল, ঢাকার মন্ত্রীমহল ও ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক মহল আমার ওপর বেজায় খাপ্পা হয়। শুরু হয় আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা।

তিনি আরো লিখেছেন,

ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় কর্মী ও জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়াদী অনুসৃত সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে সংগঠনে গৃহীত সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তিবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান জানাইতেছিলেন। তাই মার্কিন অনুচর মন্ত্রীমহল আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়।

আওয়ামী লীগ থেকে ভাসানীর পদত্যাগ প্রসঙ্গে অলি আহাদ লিখেছেন,

আওয়ামী লীগ দ্রুত দ্বিধাবিভক্তির পথে অগ্রসর হইতে শুরু করে, একাংশ পশ্চিমা শক্তির অন্যতম দোসর প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন জানায় এবং অপরাংশ সামরিক চুক্তিবিরোধী ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রবক্তা বৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীকে সমর্থন দেয়।…আমি কাগমারীতে (সন্তোষ) সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করি। মওলানা ভাসানী সংগঠনের সভাপতি পদ হইতে ইস্তফা দানের সিদ্ধান্ত আমাকে জানান।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত অবস্থানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে অলি আহাদ লিখেছেন,

ভারত ভূমিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের দৌরাত্মে মনে হইত যে, আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নাই। আমরা সংগ্রামের প্রেরণায় ভারত ভূমিতে গিয়াছিলাম, প্রাণ বাঁচাতে যাই নাই, ব্যবসা করিতে যাই নাই, ব্যাংক লুটের টাকা সামলাইতে যাই নাই, অসৎ কর্মে লিপ্ত হইতে যাই নাই, লুটের টাকায় জীবন ভোগ করিতে যাই নাই, সর্বোপরি কাহারো সহিত ঝগড়া করিতেও যাই নাই। আমাদের ঝগড়া-বিবাদ জালেম জেনারেল ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে, অত্যাচারী পাক-বাহনীর বিরুদ্ধে।

জনাব অলি আহাদ ১৯৪৫-৭৫ পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে ইতিহাসের ছকে বাধার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন নিজের রাজনৈতিক জীবনকে। কখনো কখনো পাঠকরা বইটিকে আত্মজীবনী হিসেবে উপলব্ধি করতে পারেন, কখনো বা রাজনৈতিক ইতিহাস মনে করতে পারেন। তবে পূর্ণ ঘটনাটিকে আত্মচরিতের ধাঁচে সাজিয়ে পরিবেশন করলে পাঠকরা হয়ত অধিক তৃপ্তি পেত। বইটি আত্মকথা ও ইতিহাসের বর্ণনার একটি সূক্ষ্ম সমন্বয় সাধনের ভিন্ন স্টাইল হিসেবে লেখক উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। আমরা বইটিকে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদ হিসাবে আখ্যায়িত করতে চাই।

পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট ক

একগুচ্ছ ঐতিহাসিক চিঠি

[রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রচুর সংখ্যক চিঠি জননেতা অলি আহাদের সংগ্রহে ছিলো। ঐতিহাসিক গুরুত্ব হিসাবে সেগুলোর মূল্য অনেক। সেইসব চিঠির সামান্য কিছু এখানে সংকলিত হইল।]

টাওয়ার হোটেল

কলিকাতা

৩/৪/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ

তুমি আমার পত্র পাওয়ার পর সমস্ত জেলা, মহকুমা আওয়ামী লীগ অফিসে সার্কুলার দিয়া এই মর্মে জানাইয়া দিবে। ১। প্রত্যেক ইউনিয়নে কর্মঠ, নিঃস্বার্থ লোক লইয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ গঠন করিবে। ২। প্রত্যেক থানায় সভা সমিতি করিয়া সরকারের নিকট নিম্নলিখিত মর্মে দাবি জানাইবে। লাহোর ঐতিহাসিক প্রস্তাব অনুযায়ী প্রত্যেক ইউনিটে ফুল অটোনমী চাই। ২১ দফা দাবি নতুন শাসনতন্ত্রে সম্পূর্ণভাবে মানিয়া লইতে হইবে। সমস্ত রাজবন্দিদিগকে মুক্তি দিতে হইবে। কোন প্রকার টাল বাহানা না করিয়া সত্বর পূর্ব পাকিস্তানে পার্লামেন্টারি শাসন কায়েম করিতে হইবে। ২০ বৎসরের সময় ধার্য না করিয়া নূতন শাসনতন্ত্র কায়েম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উর্দুর সহিত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিতে হইবে।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

কলিকাতা

৩/৪/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ

আমার প্রেরিত ২১ দফা প্রত্যেক পল্লীতে কৃষক শ্রমিক সকলের নিকট যাহাতে পৌঁছিতে পারে তাহার জন্য আমেনাকে সর্ব প্রকারের সাহায্য করিয়া বুকলেট ইত্যাদি ছাপাইয়া প্রচার করিবার ব্যবস্থা করিবে। আওয়ামী লীগের সর্ব প্রকার সাহায্য ও সমর্থন যাহাতে পায় তার ব্যবস্থা করিবে। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে সমস্ত ছাপান সম্ভব হইবে না। চিটাগাং এর জনৈক আব্দুল বারী পুস্তক ব্যবসায়ীকে অনুমতি দিয়াছি। অন্যান্য জেলায় আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাগণ যদি স্বেচ্ছায় ছাপাইয়া বিক্রয় করে ভাল। অন্যথায় যে কোন লোক বা পুস্তক ব্যবসায়ী ছাপাইয়া বিক্রয় করিতে চায় তাহাকে দেওয়া উচিৎ। ভালভাবে প্রচার না হলে সংগঠন শক্তিশালী হবে না। শান্তিপূর্ণভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আওয়ামী লীগকে জোরদার না করিলে শুধু করাচি গিয়া তোয়াজ, তোষামোদ ফুলের মালা প্রদান করিয়া জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার হবে না। দুনিয়ায় ইতিহাসে কোথাও দেখা যায় নাই দরখাস্ত দিয়া হুজুর বিনীত প্রার্থনা করিয়া গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব হইয়াছে।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

কলিকাতা

১৭/8/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ

আমার দোয়া জানিও। শুধু বড় বড় নেতার কথাই শুনিওনা আমার মত বোকা লোকের কথায়ও কর্ণপাত করিও। ভাঙ্গা কুলা কাজে লাগে ছাই ফেলিবার সময়। আমার ২১ দফাগুলি অন্ততঃ সাপ্তাহিক এত্তেফাকে, সংবাদে ছাপাইতে চেষ্টা করিও। মাছ যে রকম পানিতে মিশিয়া থাকে সেইভাবে জনসাধারণের মধ্যে সেইভাবে নেতা ও কর্মীদিগকে গ্রামে গিয়া কাজ করিতে হইবে। শুধু ঢাকায় বসিয়া কাজ হইবে না। ১১ই ও ১২ই কাউন্সিল সভা অবশ্যই ডাকিবে। প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক অবশ্যই করিতে হইবে সর্বতঃভাবে চেষ্টা করিবে। সমস্ত জেলা মহকুমার কাজ জোর দিয়া আরম্ভ করিবে। আমার নিজের কাজ যদি পার তা হইলে পাঁচবিবিতে লোক পাঠাইয়া আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদিগকে ৫/৬ দিনের জন্য কলিকাতা পাঠাইবে। ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলিবে আমার বিবৃতি ও ২১ দফা বার বার সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে ছাপাইতে। অন্যথা কারণে দুঃখিত হইব।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

বীরনগর পাঁচবিবি

বগুড়া

১৩/৫/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ,

মজিবর ও সেরাজকে পত্র দিয়াছি তোমাকে জানাইতে ২২শে মে হইতে ৩০শে মে পর্যন্ত ২১ দফা পালন করিতে সমস্ত জেলা, মহাকুমা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ অফিসকে জরুরি নির্দেশ দিবে এবং সভা, শোভাযাত্রা, ২১ দফা বই বিতরণ, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, জমিদারী প্রথা বিনা খেসারতে উঠাইয়া চাষীদের মধ্যে জমি বিতরণ চাই, সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল চাই, উচ্চপদের কর্মচারীদের বেতন কমাইয়া গরীব কর্মচারী ও শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি চাই, পূর্ব পাকিস্তানে লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী স্বায়ত্তশাসন চাই ইত্যাদি স্লোগানে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়াজ তুলিতে হইবে। ছাত্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হইতে সমর্থন ও বিবৃতি দেওয়াইবে আমার নামে ও তোমরা বিভিন্ন নামে প্রত্যেক দিন বিবৃতি দিবে।

-মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

সমস্ত আওয়ামী লীগ অফিসে সার্কুলার নোটিশ দিবে কলেরা, বসন্ত রোগে কত মারা গিয়াছে এবং কত গ্রাম আক্রান্ত হইয়াছে তাহার বিবরণ পাঠাইতে।

-ভাসানী

***

কাগমারী

২৯/১২/৫৫

প্রিয় অলি আহাদ, আবদুল হাই ও

অন্যান্য আওয়ামী লীগের কর্মীগণ,

আমার এই পত্রখানা তার মনে করিয়া সারা পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন মিশ্র নির্বাচন উপলক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ করিবার জন্য আমার নামে তোমাদের নামে প্রত্যেক জেলা, মহকুমা, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের নামে বিভিন্ন জেলা হইতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করিবার জন্য অভিযান চালানোর ব্যবস্থা করিবে। সারা দেশ থেকে স্বায়ত্তশাসন এবং মিশ্র নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন নামের পত্র সংবাদপত্রে ছাপাইতে ব্যবস্থা করিবে। আগামী ৬ জানুয়ারি (১৯৫৬) প্রতিবাদ দিবস সাফল্যমণ্ডিত করিবার জন্য ভালভাবে পারলে মিটিং দিবার ব্যবস্থা করিবে।

সাড়ে চারি কোটি বাংগালীর জীবন মরণ সমস্যার সময় আওয়ামী লীগের সকল রকম চেষ্টা করিতে হইবে। আমি এই অনুরোধ বহু পূর্বেই করিয়াছিলাম। তোমরা কর্ণপাত কর না, এখন শেষ সময় যদি আমার উপদেশ শুনা উচিত মনে কর তাহা হলে সকল রকমের অসুবিধা ভিতরেও এই কাজ অবশ্যই করিবে।

মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

২৯/১২/৫৫

***

প্রিয় অলি আহাদ

বাবুকে শাসাইয়া ভর্তি করিয়া দিবে এবং ভালভাবে পড়াশুনা না করিলে বাবুর সহিত আমার কোন সংশ্রব থাকিবে না ইহা বলিয়া দিবে। মিথ্যা বলা ও ফাকী দেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করিতে বলিবে। বাহুল্য পয়সা খরচ করিতে বিশেষভাবে নিষেধ করিবে। আমার হাতে মোটেই পয়সা নাই মজিবর যদি দেয় এবং মহিবুচ্ছামাদের নিকট হইতে কিছু টাকা লইয়া সত্বর কাগমারীতে পৌঁছাইবে- কর্মীদের খাওয়ার ব্যবস্থা না করিলে চলিবে না।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।

***

প্রিয় অলি আহাদ,

গত রাত্রি হইতে হঠাৎ রক্তের চাপ অত্যধিকরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে। এরূপ অবস্থা আর কখনও হয় নাই। গত রাত্রি ভয়ানক কষ্টে গিয়াছে। অদ্যই যমুনা নদীতে যাইতেছি।

আমার এখানকার কাজকর্ম মোয়াজ্জেম কীভাবে করে তাহা তোমাকে বলিতে চাই। তোমরা ভালভাবে জান যে একটা কাজের জন্য মাহমুদ আলীর নিকট যাইতেছে, তাহার সহিত জানাশুনা নাই। তুমি নিজ দায়িত্বে কাজ নিজের মনে করিয়া মাহমুদ আলীর দ্বারা করা সম্ভব হইলে করিবে। মোয়াজ্জেম কোন ফেভার পাই নাই। আওয়ামী লীগের জন্যই সে যাইতেছে। এখানকার আওয়ামী লীগারদের দ্বারা কোন কাজ হয় নাই, হইবেও না। আপ্রাণ চেষ্টা করিয়া দেখিও তাহার কাজটা যাহাতে হয়।

আগামী ২৬শে মার্চ হইতে হয়ত অনশন আরম্ভ করিব। আল্লাহ হাফেজ।

প্রেস টেলিগ্রাম দিয়াছি। তাং ধার্য্য হয় নাই। এক ইউনিট সম্বন্ধে ২টি বিবৃতি সত্বর দিও। কিন্তু প্রস্তুত করিও জনগণের দাবি আদায়ের জন্য।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

উপনির্বাচনে এলাকায় যাওয়া সম্ভব নহে জানাইয়া দিও।

-ভাসানী

***

ময়মনসিংহ

২০/২/১৯৫৭

প্রিয় অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমদ ও

ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্য সাহেবান,

অদ্য আমি ময়মনসিংহ হইতে নালিতাবাড়ি মিটিং-এ খোদা করেন রওনা হইব। তথা হইতে আগামীকল্য ফিরিব। পরশু জ্বর উঠিয়াছিল গতকল্য জ্বর আসে নাই। আল্লা ভরসা তোমরা আগামী ওয়ার্কিং কমিটিতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টিকে নির্দেশ দিবে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সুপারিশ করতঃ প্রস্তাব আনয়ন করা বিশেষ জরুরি কাজ জানিবে। অপজিশন হইতে প্রস্তাব আসিবে আমাদের পক্ষ হইতে প্রস্তাবের নোটিশ না দিলে বা আনয়ন না করিলে জনসাধারণের নিকট মুখ দেখানো যাইবে না। অপজিশনের প্রস্তাবে বাধ্য হইয়া ভোট দিতে হইবে, বিশেষ জরুরি কাজ মনে করিতে প্রত্যেক মেম্বরকে আমার পক্ষ হইতে অনুরোধ করিবে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে নাজিমউদ্দিন সাহেব প্রস্তাব আনিয়া পূর্ব-পাক এসেম্বলিতে পাস করাইয়াছিল। নুরুল আমিন মন্ত্রী সভা পূর্বপাকের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করিয়া প্রস্তাব পাস করাইয়াছিলেন। এই সময় এবং আগামী নির্বাচনের পূর্বে জরুরি প্রস্তাব পাস না করাইলে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেহায়েত ভুল হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারের লিডারের নিকটও অনুরোধ জানাইবে, উভয় পাকিস্তানের সংহতি কায়েম করিবার জন্য পার্টি মিটিং-এ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করিতে। কাগমারী মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ খোলার পারমিশন চাহিয়া সত্বর দরখাস্ত ইউনিভার্সিটি বরাবর দিবে এবং অল্প দিনের মধ্যে যাহাতে অনুমতি পাওয়া যায় তাহার ব্যবস্থা অবশ্যই করিবে। কলেজের জন্য বিভিন্ন সাবজেক্টে পড়াইতে উপযুক্ত ও আদর্শবাদী জন প্রফেসর সংগ্রহ করিতে তোমরা সকলে চেষ্টা করিবে। ভুলিয়া যাইও না, আমার দোয়া ও সালাম জানিও। আমার শরীর খুব দুর্বল। তাই মিটিং-এ উপস্থিত হইতে পারিব না।

– আব্দুল হামিদ খান

অলি আহাদ, তাজউদ্দিন,

৫৬ নং সিম্পসন রোড, আওয়ামী লীগ অফিস

***

প্রিয় অলি আহাদ

আমার প্রেরিত ২১ দফা যাহা আমেনার কাছে আছে সংবাদে সাপ্তাহিক এক্তেফাকে ছাপাইবে। বুকলেট করিয়া ছাপাইতে পারিলে তাহাও ছাপাইয়া বিতরণ করিবে। অন্যথা না হয়। মজিবরকে পত্র দিয়াছি। ১১ই ১২ই জুন অবশ্যই পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভা ডাকিবে অন্যথা না হয়। করাচির লোভ একবারে ত্যাগ না করিলে আওয়ামী লীগ বাঁচিবে না। করাচি কিছুই করিবে না। আমি করাচির আশা কোনদিন করি নাই। আল্লাহর মর্জি কখনও করিব না। তোমরা মিটিং না ডাকিলে আমি নিজেই ডাকিব। এইবার আমার কথানুযায়ী মিটিং না ডাকিলে ও কাজ না করিলে তোমাদের সহিত সংশ্রব ত্যাগ করিতে বাধ্য হইব। করাচিতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া এবং মন্ত্রী হইবার লোভে আওয়ামী লীগ ধ্বংশ হইল। আর ধ্বংশ হইতে দিতে পারি না।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

প্রিয় অলি আহাদ

আজ পর্যন্ত কাউন্সিলারদের নোটিশ সর্বত্র পৌঁছে নাই। ময়মনসিংহ আসে নাই। সত্বর পাঠাইবে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র মেম্বরদিগের রশিদ যত বেশি সম্ভব ছাপাইয়া কাউন্সিল মিটিং এর এক সপ্তাহ পূর্বে সব আমার নিকট পাঠাইবে অন্যথা করিও না। যদি পয়সার অভাবে ছাপাইতে না পার গঠনতন্ত্রের একখানা কপি পাঠাইয়া দিবে। আমি টাঙ্গাইল হইতে কোন প্রকারে বাকী করিয়া ছাপাইয়া লইব। রশিদ বহি যত বেশি পার ছাপাইয়া আনিবে। কাউন্সিল ও কালচারাল কনফারেন্সের প্রচার খুব কম হইতেছে। ভালভাবে প্রচার করিবে। আবু জাফরকে আমার সহিত এড্রেসের নকলসহ সত্বর সাক্ষাৎ করিতে পাঠাইবে। সমস্ত প্রদেশের প্রচার ভালভাবে করিবে। কাউন্সিলের নোটিশ পাঠাইতে বিলম্ব করিলে ভয়ানক অসুবিধা হইবে। আওয়ামী লীগের- ১লা ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে লইয়া উপস্থিত হইবে। অন্যথা না হয়। ছামাদকে সত্বর পাঠাইবে। শ্রমিকদের অবস্থা ও প্রতিকারের রিপোর্ট ছাপাইতে বলিবে।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

***

প্রিয় অলি আহাদ

আজ কয়েকদিন যাবৎ অনবরত বৃষ্টি ও তুফান হওয়ায় সিরাজগঞ্জ, পূর্ব বগুড়ায় যাওয়া মোটেই সম্ভব হচ্ছে না। এখানে অনেকদিন অনুপস্থিত থাকায় প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম বন্ধ হইয়াছে। আমার শরীর খুব দুর্বল। আল্লাহ জানেন, শরীর ভালো হইবে কতদিনে। আওয়ামী লীগের কাজ তোমরা মনোযোগ দিয়া করিও, আমাকে বোধহয় ৬ মাসের জন্য সভাপতির পদ হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া বিশ্রাম লইতে হইবে এবং শেষ জীবনের প্রতিষ্ঠান গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করিতে হইবে। এখানে কাজকর্ম করিবার লোক মোটেই নাই এবং যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন, দেশের আর্থিক অবস্থা ভয়ানক খারাপ, স্থানীয় লোকের পক্ষে কোনপ্রকার সাহায্য করা সম্ভব নহে। শরীর ভালো হইলে দুই মাসের জন্য আসামে যাইবার আশা আছে। তুমি আমার জন্য যে ভাবেই পার ১০টি লিচুর কলম, ১০টি আমের কলম এবং সোফেদার কলম ৫টা, ভালো লেবুর কলম ৫টা পাঠাইলে যারপরনাই উপকৃত হইব। ঢাকা হইতে হাতেম অথবা রফিক ভূঁইয়ার নিকট ময়মনসিংহ ঠিকানায় পাঠাইলে তাহারা জি টি কোং মোটরে টাংগাইলে পাঠাইয়া দিবে। পাঠাইবার সময় লিখিয়া দিতে হইবে যে, চারাগুলি যেন কাগমারীতে পৌঁছাইয়া দিতে জি, টি, কোং ড্রাইভারকে বলে। আন্দোলনের গতি বারবার ভাটা ফেলিয়া হতাশার ভাব আর কতকাল থাকিবে জানি না। সারা দেশময় ভূখা মিছিল, সভা সমিতি নতুন উদ্যমে যখন চলিতেছিল তখন হঠাৎ তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল। ১৪৪ ধারা ব্রেক করিবার মত সাহসী ২/৪ শত কর্মী নেতা যে অর্গানাইজেশনে নাই তাহার দ্বারা ভবিষ্যতের আশা বৃথা। এখন বুঝিতেছি সকলেই কেবল গদির জন্যই ব্যস্ত।

খোদা হাফেজ

মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী

আমাদের ট্রেজারারকে বলিলে কিছু আনারসের চারা আনিয়া দিবে। কৃষি কর্ম করিতে অনেক কিছু লাগে, বিরক্ত হইবা না। বহু কৃষককে শিক্ষা দেওয়া যাইবে। গঠনমূলক কাজও করা দরকার।

– ভাসানী

ভালো আনারসের চারা সামাদকে বলিলেও সিলেট হইতে আনিয়া দিবে। ঢাকায় যাহা পাওয়া যায় তাহাই দিবে।

***

Narayanganj City Awami League

President-A.K.M. Shamsuzzoha

Secretary-Nurul Islam Mullick

Office…………..

NARAYANGANJ

Date……………

প্রিয়,

আতাউর রহমান খাঁন, মুজিবুর রহমান

উপ নির্বাচনের সমস্যা বড় জটিল হইল। এই নির্বাচনে সীট হারাইলে যারপরনাই ক্ষতি হইবে। অতএব সত্ত্বর মহকুমা আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাগণকে জানাবেন সংবাদপত্রে নোটিশ ও তার দিয়া নমিনেশন পেপার পুঃ পাক আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠাতে মহকুমা আওয়ামী লীগ সোপারেশ করিয়া জেলা আওয়ামী লীগের জরিয়তে পুঃ আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠাবে। মজিবর, ইয়ার মোহাম্মদ, অলি আহাদ এই তিনজন বাই ইলেকশনের এলাকায় সর্ট টাইমের মধ্যে ভ্রমণ করিয়া জনমত লইবে জনপ্রিয় প্রার্থী হওয়া একান্ত আবশ্যক। ২৫০, টাকা অথবা যাহা তোমরা সঙ্গত মনে কর সেই পরিমাণ টাকা জমা দিতে বলিবে গোপালগঞ্জে হিন্দু প্রার্থী ঠিক করিবে। ইলেকশনের প্রোপাগাণ্ডা ইত্যাদি কাজের জন্য ২/৩টি কমিটি করিবে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ডাকিবে। ইলেকশনের বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিবে। অবহেলা করিবে না। সিট হারালে অনুতাপ করিতে হবে- আল্লাহর উপর ভরসা করিয়া সর্বোতভাবে চেষ্টা করিবে। সহিদ সাহেব তার করিয়া জানাইবে। যাহা কিছু করা দরকার সমস্তই করিবে অঙ্গিকার পত্র ছাপাইবে।

মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

৩০/৪/৫৬

***

৩১-১২-৫৭

প্রিয় অলি আহাদ                                                                                                                  

তোমার নিকট বারবার পত্র লিখিয়াও কোন উত্তর পাই নাই। তুমি আমার নেহায়েত ভক্ত থাকা সত্ত্বেও কেন বিরূপ হইলে জানি না। খোদা হাফেজ। মফিজুল ইসলাম খুব ভাল প্রার্থী। কিন্তু অর্থ এবং সমস্ত ন্যাপ প্রতিষ্ঠানের শক্তি একযোগে ঝাঁপাইয়া পড়ে তাহা হইলে আমি তিন চারিটা মিটিং করিয়া দিব। আমার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়া যতদূর করা সম্ভব করিব। কিন্তু সমস্ত প্রদেশের শক্তি ব্যতীত কিছু সম্ভব হইবে না। খুব ভালভাবে চিন্তা করিয়া কাজ করিবে। এখানে আসিলে সুখী হইব।

-ভাসানী

***

জনাব মাওলানা সাহেব,

তসলিম বাদ আরজ- আশা করি শারীরিক কুশলে আছেন। আব্দুর রহমান ও হামিদ, হক সাহেবের পত্র নিয়া আপনার খেদমতে যাইতেছে। আমার সঙ্গে হক সাহেবের আলোচনা হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র বিবচেনায় আপনার এখানে তশরিফ আনা অত্যাবশ্যক।

আমরা আগ্রহের সহিত আপনার এন্তেজার করিতেছি।

ইতি,

আরজ গোজার

আবুল মনসুর আহমদ

***

গভর্নর শাসন প্রবর্তনের পর আত্মগোপন করি। কুমিল্লায় আত্মগোপন থাকাকালে জনাব আতাউর রহমান খান নিম্নোক্ত চিঠি লিখেন :

আতাউর রহমান খান, এডভোকেট                                                                        ফোন নং ৩৯৮৪

সদস্য, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ                                                                                 ২৫, সোয়ারীঘাট, ঢাকা

তারিখঃ ১৯-৯-৫৪

প্রিয় অলি আহাদ

আমরা ভয়ংকর বৈরী পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হইয়াছি এবং আল্লাহই কেবল জানেন, এই জটিলতা হইতে আমরা কখন মুক্ত হইব। আমাদের কর্মীরা যে নির্যাতন স্বীকার করিতেছে তাহা আমাদের সংগঠনের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করিয়াছে। কেবল নির্যাতনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করিতে এবং ইন্সিত আদর্শ বাস্তবায়ন করিতে পারিব। তোমার নাম লিষ্টে আছে কিনা বলিতে পারিব না। কারণ আমি গেজেট দেখিতে পারি নাই। আগামীকাল দেখিয়া নিব।

সহসা পার্লামেন্টারি সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইবে না, অন্ততঃ শহীদ সাহেবের ফিরা পর্যন্ত নয়। ইহার জন্য আমরা কঠিন প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইতেছি।

যদি তোমার নাম লিষ্টে দেখি তাহা হইলে আমার উপদেশ হইবে আত্মসমর্পণ করা।

অন্যরা সব ভাল। স্নেহ এবং তোমাকে প্রয়োজনীয় সাহস প্রদানের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনাসহ

তোমারই

স্বাক্ষর/ আতাউর রহমান

***

তারিখঃ ১-১০-৫৪

প্রিয় আহাদ,

তোমার চিঠি পাইয়া আনন্দিত হইয়াছি। ইহা দুর্ভাগ্যজনক যে, আমরা তোমার সম্পর্কে প্রকৃত পরিস্থিতি নিরূপণ করিতে পারি নাই। হয়ত শুনিয়াছ যে, কে এম মোশতাক তাহার গ্রামের বাড়ি হইতে গ্রেফতার হইয়াছে। সে এখানে নিরাপদ ছিল এবং ঢাকার বাহিরে না গেলে নিরাপদই থাকিত। এম এ সামাদও উদ্বেগের মধ্যে আছে। আগামী দিনে কি আসিতেছে সেটা অজানা।

আমি মাওলানা সাহেবকে (মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী) ফিরিয়া আসার জন্য অনুরোধ করিয়াছি- পরিণতি যাহাই হউক। এ সময়ে তাহার বাহিরে থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।

জি, জি-এর (গভর্নর জেনারেল) ক্ষমতাকে দারুণভাবে খর্ব করা হইয়াছে। ফলে গণপরিষদ এখন সব অবৈধ আইনকে বৈধ করিতে পারিবে এবং গণতন্ত্রের নামে সবরকম অগণতান্ত্রিক কাজ করিতে পারিবে। সুতরাং তুমি আমাদের প্রিয় পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আঁচ করিতে পার।

আমি মানকীর শরীফের পীর সাহেবের সিদ্ধান্তকে কোন গুরুত্ব দেই না। তবে শুনিতেছি তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিয়াছেন।

বর্তমান পরিস্তিতি বুঝার জন্য মানিক মিয়া ও রফিক করাচি গিয়াছেন।

আমাদেরকে অপেক্ষা করিতে হইবে, দেখা যাক কি হয়।

সবার প্রতি শুভেচ্ছাসহ

তোমারই

স্বাক্ষর/ আতাউর রহমান খান।

***

গ্রন্থাকারের নিকট করাচি হইতে শেখ মুজিবের চিঠি :

(বঙ্গানুবাদ)

৭, সমারসেট হাউস

করাচি

৪ জানুয়ারি, ১৯৫৬

প্রিয় অলি আহাদ,

তোমার চিঠি পাইয়াছি। আমি জানি, ওয়ার্কিং কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠানের জন্য তুমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমরা এখনও সংবিধানের খসড়া পাই নাই যদিও জানা গিয়াছে যে, কোয়ালিশন পার্টি মোটামুটি একটি ফর্মূলায় সম্মত হইয়াছে; ইহাও জানা গিয়াছে যে, ইউ.এফ (যুক্তফ্রন্ট) পূর্ববঙ্গের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। খসড়াটি পাইলে হয় আমি ইহা নিয়া আসিব আর যদি না আসিতে পারি তাহা হইলে তোমার কাছে পাঠাইয়া দিব এবং ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করিবার জন্য তোমাকে অথারাইজ করিব। গণপরিষদে আমরা কি অবস্থান (স্ট্যান্ড) নিব সে ব্যাপারে ফিরিয়া আসিয়া তোমার ও মাওলানা সাহেবের সহিত আলোচনা করিবার জন্য আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। সম্ভবতঃ তুমি ৮ শত টাকা পাইয়াছ। আমি আওয়ামী লীগের জন্য আরও টাকা যোগাড় করিবার চেষ্টা করিতেছি। দয়া করিয়া পূর্ববঙ্গের অবস্থা এবং জেলে আটক আমাদের কর্মী সম্পর্কে আমাকে জানাইবে। জনাব আবদুস সামাদ ও আমাদের অন্যান্য কর্মীদের মুক্তির ব্যাপারে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করিবার চেষ্টা করিবে। আমি জানি, তুমি অত্যন্ত নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছ। কারণ তোমার কাজের ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য সহযোগিতা করিবার মতো লোক খুব কম। দয়া করিয়া মহকুমা কমিটিগুলির সাথে যোগাযোগ করিবার চেষ্টা করিবে এবং আমাকে তোমার অসুবিধা সম্পর্কে জানাইবে।

হাই কোথায়? তাহাকে আমার কাছে চিঠি লিখিতে বলিবে এবং তাহার বাড়ির ঠিকানা দিবে। তার স্ত্রী কোথায়? তোমাকে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটু অনুরোধ করিতে চাই। আমার ছেলে কামাল উদ্দীনকে সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট স্কুলে এবং মেয়েকে (হাসিনা) কামরুন্নেছা গার্লস স্কুল অথবা বাংলাবাজার স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য দয়া করিয়া চেষ্টা করিবা। তাহাদের জন্য একজন ভাল শিক্ষক যোগাড় করিবার চেষ্টা করিবা। সব সময়েই তোমার ভাবীর সহিত যোগাযোগ রাখিবার চেষ্টা করিবা। সেও খুব নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছে। আমি ভালো। আমার কাছে চিঠি দিও।

তোমারই

স্বাক্ষর/ মুজিব ভাই

***

 (বঙ্গানুবাদ)

সমারসেট হাউস

করাচি

২৭শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬

প্রিয় অলি আহাদ,

তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আশা করি, গণপরিষদ হইতে আমাদের ‘ওয়াক আউট’-এর পর ২রা মার্চ ঢাকায় ফিরিব।

তোমার অসুবিধা সম্পর্কে আমি পুরাপুরি জানি ও অনুভব করি। আমাদের সংগঠনের কিছু টাকা সংগ্রহ করিবার জন্য আমি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করিতেছি।

৩রা ও ৪ঠা মার্চের প্রস্তাবিত সভা তুমি বাতিল করিয়াছ জানিয়া আমি খুশী হইয়াছি। কারণ তুমি জান যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া এমন একটি বিরাট সভা অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। অবশ্যই একটি কাউন্সিল সভা করা আমাদের দরকার। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পরই আমরা সভার সময় ও তারিখ ঘোষণা করিব।

তুমি আমাদের সংগঠনের জন্য অত্যন্ত উদ্যমের সাথে ও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করিতেছ জানিয়া আমি অত্যন্ত সুখী। এখানে আমরা গণপরিষদে আমাদের সংগ্রামের ব্যাপারে ব্যস্ত। কারণ, আমরা জানি যে, আসন্ন সংগ্রামের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকিতে হইবে। শহীদ সাহেব ছাড়া আমাদের পার্টি ভুক্ত সব সদস্যই সম্ভবতঃ ২রা ও ৩রা মার্চ অথবা কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় পৌঁছিবে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় খবর তোমাকে দিব।

দয়া করিয়া মাওলানা সাহেবকে জানাইও যে, আমি তাহার টাকা নিয়া আসিতেছি। আমাদের সকল কর্মীর প্রতি রইল আমার প্রীতি ও সালাম। আশা করি তুমি ভাল আছ।

তোমারই

স্বাক্ষর/ মুজিব ভাই

***

স্নেহের অলি আহাদ,

আমার ভালবাসা নিও। তোমার কোন খোঁজ খবর বহুদিন পাই না। শুনলাম তুমি কুমিল্লা কারাগারে বন্দি আছ। তোমার ভাবি তোমার জন্য খুব ব্যস্ত কারণ তোমার কোন খবর জানতে পারছে না। কেমন আছ এই খবরটি আমাদের দিলেই সুখী হব। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে তোমার হতভাগা ভাইকে লেখতে ভুলিও না। অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত আছি কারণ টাকার খুব প্রয়োজন। তোমার ভাবী প্রায় দুই মাস অসুস্থ ছিল, এখন একটু ভাল। চিন্তা করিও না খোদা সহায় আছেন। আমার হাইকোর্টের মামলা এখনও শেষ হয় নাই। বোধহয় শীঘ্রই হইতে পারে। সকলকে ছালাম দিও।

ইতি

তোমার মুজিব ভাই

***

১৯৫৪ সালে শেরে বাংলা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে পদচ্যুত করে পূর্ব পাকিস্তানে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার গভর্নর শাসন প্রবর্তন করে। তখন আত্মগোপন থাকাকালে গ্রন্থাকারের নিকট তাজউদ্দিন আহমদের চিঠি। চিঠিতে ছদ্মনাম ব্যবহৃত হইয়াছিল।

My dear Rahmat,

Received your letter this morning. I am really very sorry and plead guilty for not replying to your earlier note. But you may rest assured that we take interest in you though we have not been able as yet to do anything tangible for you. At my request Mr. A.R. Khan talked to the chief Secretary about your case, and at his own accord. Mr. Khan very often goes to the chief Secretary and speaks for he political prisoners in general and the Awami League in particular. He takes much interest in you and Mr. Toha.I was shown a letter of yours by Mr. Kamruddin, and your suggestion regarding the attitude of Awami League in respect of Nezam-e-Islam and Krishak Sramik party has been brought to the notice of Mr. A. R. Khan who appreciated your view point in view of the grim realities. You might have noticed the latest composition of the Flood Relief Committee. We have done our best to see that undesirable elements do not get predominance, but at the same time the solidarity of the U.F. party must not be at a jeopardy, and at least from outside no rift in the U.F. Party can be detected by interested quaters both innocent well wishers and the zealous cavaliers. Even your bad friends (I do not use “enemy”) feel the need of your presence in these days of great cataclysm.

It transpires from the talk of Mr. A. R. Khan and the authorities of the present East Bengal Govt, that the Govt. will take a lenient view in respect of the Awami League. But they will tighten their grip over the people belonging to other Organisations, namely, P.A.U.L and G. Dal whome they take rightly or wrongly to be the follow travelers of the Communists.

To your surprise you will learn that the Govt. Think that P.S.U. is the recruiting organ, the Y.L. is the elementary training phase and the G. Dal is the parliamentary front of the communist party. This is the analysis of the Home Department. Mr. Toha Awami League, but belongs to Y.L. also. Yar Mohd. Khan also falls into the same category. Therefore its is our common view that you should wait for sometime more till the eminent Govt. officials are convinced that there are more things in the heaven and earth than are reported by their over zealous promotion hunting worthless I. B. reporters. We hope better sense will soon dawn on the Govt. I realize your difficulty, but we are destined or we rather chose, the travel through the thorny path. No sufferings of patriots have ever gone in vain and undaunted spirit and unadulterated patriotism always guide the lovers of humanity as a beacon light towards the cherished goal. No amount of afflictions can deter them from the path of truth.

Moulana Sb. writes letters and like you always proposes to rush headlong into the open without caring for the consequences. But Mr. Suhrawardy puts his reign, and advises him not to come before Mr. Suhrawardy gets here in Pakistan, We discussed about you and are of opinion that you also should await Mr. Suhrawardy arrival. He had undergone a third operation a fortnight or so ago. He recovering fast. I saw a letter to Messrs A. R. Khan and Kamruddin each written by him recently. Please be at rest and wait a bit further, you had always been a tower of strength and we are quite confident that you will be able to bear up all sufferings and privations manfully and never give way to despair.

Yours sincerely,

Sd/ Tarique

N.S. : No question of surrender at this stage can at all arise.

Sd/ Tarique

বঙ্গানুবাদ

প্রিয় রহমত,

আজ সকালে তোমার চিঠি পাইয়াছি। তোমার আগের চিঠির উত্তর দিতে না পারার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত এবং নিজের দোষ স্বীকার করিতেছি। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পার যে, আমরা তোমার ব্যাপারে সচেতন যদিও এখন পর্যন্ত কার্যকর কিছু করিয়া উঠিতে পারি নাই। আমার অনুরোধে জনাব এ.আর খান (আতাউর রহমান খান) তোমার মামলার ব্যাপারে চীফ সেক্রেটারির সাথে আলাপ করিয়াছেন। জনাব খান প্রায়ই চীফ সেক্রেটারির কাছে যান এবং রাজবন্দিদের ব্যাপারে বিশেষ করিয়া আওয়ামী লীগ দলীয় রাজবন্দিদের সম্পর্কে আলাপ করেন। তিনি তোমার এবং জনাব তোয়াহার ব্যাপারে খুবই সক্রিয়/উদ্যোগী। জনাব কমরুদ্দিন তোমার একটি চিঠি আমাকে দেখান এবং নেজামে ইসলাম ও কৃষক শ্রমিক পার্টি সম্পর্কিত তোমার মতামত জনাব আতাউর রহমান খানের দৃষ্টিগোচর করা হয়। জনাব খান রূঢ় বাস্তবতার আলোকে তোমার মতামত সঠিক মনে করেন। তুমি হয়ত বন্যা ত্রাণ কমিটির সর্বশেষ কমিটির সদস্যদের নাম দেখিয়াছ। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি যাহাতে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিবর্গ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করিতে না পারে। সাথে সাথে ইহাও বিবেচনায় রাখিতে হইয়াছে যাহাতে যুক্তফ্রন্ট পার্টির সংহতি অটুট থাকে অন্তত যাহাতে বাহির হইতে সহজ-সরল শুভাকাংখীবৃন্দের কিংবা ঈর্ষাপরায়ণ শত্রুর চোখে যুক্তফ্রন্ট পার্টির কোন আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যেন ধরা না পড়ে। তোমার খারাপ বন্ধুরা (আমি ‘শত্রু’ বলিব না) বতর্মান কঠিন বিপর্যয়ের দিনগুলিতে তোমার প্রয়োজন অনুভব করে।

পূর্ববঙ্গ সরকারের বর্তমান কর্মকর্তাবৃন্দের সাথে জনাব আতাউর রহমান খানের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়া বুঝা যায় যে, সরকার আওয়ামী লীগ সদস্যদের সম্পর্কে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিবেন কিন্তু অন্যান্য দল যেম পি.এস.ইউ, ইয়ুথ লীগ এবং গণতন্ত্রী দল ভুক্তদের উপর তাহাদের বজ্রমুষ্টি আরও দৃঢ় করিবে- যাদেরকে তাহারা ভুলবশতঃ অথবা সঠিকভাবেই কমিউনিস্টদের সহযাত্রী মনে করে। তুমি জানিয়া বিস্মিত হইবে যে, সরকার পি,এস,ইউকে কমিউনিস্ট পার্টির রিক্রুটিং শাখা, ইয়ুথ লীগকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দানকারী প্রতিষ্ঠান এবং গণতন্ত্রী দল কমিউনিস্ট পার্টির পার্লামেন্টারি ফ্রন্ট হিসাবে বিবেচনা করে। ইহা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা। জনাব তোয়াহা আওয়ামী লীগ দলের কিন্তু আবার ইয়ুথ লীগেরও সদস্য। জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান একই শ্রেণিভূক্ত। সুতরাং ইহা আমাদের অভিন্ন মত যে, তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা কর যতক্ষণ পর্যন্ত না সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তারা ইহা অনুধাবন করিতে পারেন যে, তাহাদের পদোন্নতি শিকারী অকর্মন্য আই.বি রিপোর্টারদের রিপোর্টের বাহিরেও স্বর্গ মর্তে অনেক সত্য রহিয়াছে। আমরা আশা করিতেছি, শীঘ্রই সরকারের মনে শুভবুদ্ধির উদয় হইবে। আমি তোমার কষ্ট অনুভব করি কিন্তু কণ্টকাকীর্ণ পথ যাত্রা আমাদের নিয়তি এবং ইহা স্বেচ্ছায়ই আমরা বাছিয়া নিয়াছি। দেশপ্রেমিকদের কোন  ত্যাগই বৃথা যায় নাই, নির্ভীক চেতনা ও অবিমিশ্র দেশপ্রেম মানবতার পূজারীদের ইন্সিত লক্ষ্যের পানে আলোকবর্তিকার মত পথ-নির্দেশ করে। কোন দুঃখ-বেদনাই তাহাদেরকে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করিতে পারে না।

মওলানা সাহেব (মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী) চিঠিপত্র লেখেন এবং তোমার মতই পরিণতির প্রতি ভ্রক্ষেপ না করিয়াই সরাসরি মাঠে অবতীর্ণ হওয়ার পক্ষপাতি। জনাব সোহরাওয়ার্দী তাহার (মওলানার) রাশ ধরিয়া রাখিতেছেন এবং তিনি পাকিস্তানে না আসা পর্যন্ত মওলানা সাহেবকে না আসার পরামর্শ দিতেছেন। আমরা তোমার ব্যাপারে আলোচনা করিয়াছি এবং ইহা আমাদের মত যে, সোহরাওয়ার্দী না আসা পর্যন্ত তোমার অপেক্ষা করা উচিত। প্রায় এক পক্ষকাল আগে তাহার তৃতীয় অপারেশন হইয়াছে। তিনি দ্রুত আরগ্যলাভ করিতেছেন। জনাব এ.আর, খান ও জনাব কমরুদ্দীন-এর নিকট তাহার সম্প্রতি লেখা আলাদা আলাদা চিঠি আমি দেখিয়াছি। দয়া করিয়া কিছুদিন স্থির থাক এবং আরও কয়দিন অপেক্ষা কর। তুমি আগাগোড়াই সাহসিকতার একটি স্তম্ভ এবং আমরা নিশ্চিত যে, তুমি পুরুষের মত সকল নির্যাতন ও বঞ্চনা সহ্য করিতে পারিবে এবং কখনই হতাশাগ্রস্ত হইবে না।

তোমার বিশ্বস্ত

স্বাক্ষর/- তারিক

পুনশ্চঃ বর্তমান পর্যায়ে আত্মসমর্পণের কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।

স্বাক্ষর/- তারিক

***

শাহজাদপুর

১/১০/৫৬

প্রিয় আহাদ সাহেব,

সালাম জানবেন। দেশের অবস্থা যেন আয়ত্বের বাইরে। মানুষ ধুকে ধুকে মরতে বসেছে। তাদের এ অবস্থা আমরাও মনে হয় তাদের বাঁচাতে পারবো না। মানুষের হাতে পয়সা বলতে নেই। রিলিফ ও কন্ট্রোলের জিনিস শতকরা ২৫ জনের বেশি পায় না। এর মধ্যেও শতকরা ৫০ ভাগ চলে যায় মাতব্বর-মেম্বারদের নিজেদের আত্মীয় ও পেয়ারের লোকদের জন্য। গরীব লোকদের যারাও কন্ট্রোলের ধান চাল পাচ্ছে তারা এগুলি কেনার পয়সা জোগাড় করিতে পারছে না।

বাজারে ধান চালের দাম যথাক্রমে ২৪ টাকা ও ৪৫ টাকা এ এক কল্পনাতীত অবস্থা। মানুষ রবি শস্যের বীজ খেয়ে ফেলেছিল। এখন বীজের দাম চড়েছে মণকে ৪০ টাকা। গরীব কৃষকেরা পেট বাঁচাবে না বীজ কিনবে? মাঠকে মাঠ বীজের অভাবে শূন্য পড়ে আছে। এতে অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। আর আমলাতন্ত্র তো প্রকাশ্যেই আমাদের কুৎসা রটনা করে বেড়াচ্ছে। তারা এ ৯ বৎসর যে ব্যাভিচারের আস্বাদন পেয়েছিল তা থেকে তাদের বঞ্চিত করে কার সাধ্য? আশ্চর্য! এগুলি চিন্তা করছেন কি? আমাদের সংগঠন এ সকল জটিল প্রশ্নের কি জবাব দেয়?

৬ই অক্টোবর ঈশ্বরদী থানা আওয়ামী লীগ কনফারেন্স হচ্ছে সাহাপুর গ্রামে। ৭ই অক্টোবর হচ্ছে সাহজাদপুর থানা আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলন সাহজাদপুরে। এই দুটো কন্ফারেন্সেই আপনাকে আসতে হবে। মওলানা সাহেব কথা দিয়েছেন তিনি উভয় সম্মেলনেই উপস্থিত থাকবেন। তিনি না আসলে কিন্তু মহা বেইজ্জত হইবে। তাকে সঙ্গে আনবেন। অন্ততঃ একবার স্মরণ করিয়ে দেবেন।

কাগজে দেখলাম আপনি ঈশ্বরদী থানা কনফারেন্সে আসছেন। শাহজাদপুরেও আসতে হবে।

সংগঠন সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনার আছে, তা সাক্ষাতেই হবে।

জহুর ভাইকে ও ভাইদের সালাম জানাবেন।

ইতি

আব্দুল মতিন

পুনঃ 5th Oct ঈশ্বরদীতে পাবনা জেলা Food Conference হচ্ছে। আপনি উপস্থিত থাকলে ভাল হয়। কতকগুলি কাগজে একটু কষ্ট করে খবরগুলি পাঠিয়ে তাড়াতাড়ি ছাপাবার ব্যবস্থা করবেন।

ইতি- মতিন

***

গ্রন্থাকারের নিকট বগুড়া জেল হইতে নিরাপত্তা রাজবন্দি, বগুড়া জেলা যুবলীগের প্রেসিডেন্ট ছমিরউদ্দিন আহমদের চিঠি:

বগুড়া জেল

১২/8/৫৬

প্রিয় বড় ভাই,

আমার ছালাম জানবেন, পর ইত্তেফাকে প্রথম দিন বন্ধুবর ইমাদুল্যার অবস্থা আশংকাজনক সংবাদ পেয়ে মনে সন্দেহ জেগেছিল। তার পরের সংবাদ পড়ে অত্যন্ত ব্যথিত হলাম। বন্ধুবর ইমাদুল্যাকে আর আমরা আমাদের মধ্যে দেখতে পাব না। আপনে ও তার নিকটতম বন্ধু বান্ধবদের মত তার অকাল মৃত্যুতে আমিও আঘাত পেলাম এবং একজন বন্ধু হারালাম। আপনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত যুবলীগ ইমাদুল্যাকে জড়িয়ে আছে। ‘৫২ সাল হতে আপনার দায়িত্ব সে-ই গ্রহণ করেছিল। যে সময় আমাদের সমবেত নেতৃত্ব আপনাকে যুবলীগ হতে বিচ্ছিন্ন করতেছিল। সেই সময় একমাত্র বন্ধু ইমাদুল্যার মুখে কথা ছিল “ছমির মিঞা, অলি আহাদকে হারালে যুবলীগ প্রাণ হারাবে”। ঢাকায় সে-ই নিজকে জাহির করার দলের মধ্যে তার মুখে ‘৫২ সালে বাস্তবমুখী চিন্তার প্রকাশ দেখে সত্যই সেই দিন হতে তাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। ‘৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে মাতব্বরদের দরবারে যখন অপবাদ পেলাম তখন ইমাদুল্যাকে সহই অলি আহাদের গ্রুপের লোক বলে গালি সমান ভাবে গ্রহণ করিতে পেরেছিলাম। যাক এগুলি কথা খুব পুরাতন হয়েছে। অসার বলে প্রতিপন্নও হয়েছে অনেক কাজ ও কথা। অপরপক্ষে আপনে আজ সম্মানজনক স্থানে প্রতিষ্ঠিত। আপনাকে তার জন্য অভিনন্দন জানাই।

আপনেই ইমাদুল্যার প্রথম বন্ধু ও পথ প্রদর্শক নতুন যাত্রা পথের। ইমাদুল্যার পরিবারের ঠিকানা আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনার মারফতে তার শোকাকুল পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। আপনাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইমাদুল্যা স্মৃতি রক্ষা কমিটি গঠনের জন্য অভিনন্দনসহ কমিটির সাফল্য কামনা করছি। ইতি-

আঃ ছমির উদ্দিন আহমদ

-নিরাপত্তা বন্দি বগুড়া জেল।

পরিশিষ্ট-খ

পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হিসেবে জনাব অলি আহাদের অভিভাষণ

[২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে শিক্ষা সম্মেলনে অলি আহাদ সাহেব সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনের সংকটময় যে চিত্র তুলে ধরেহেন তার গুরুত্ব এবং উপযোগিতা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। সমস্যার নানা শাখা-প্রশাখা বৃদ্ধি পেয়ে আজ তা সংকটের মহীরুহে পরিণত হয়েছে।]

শিক্ষা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে এই বাংলার ছাত্র ও তরুণেরা সাম্রাজ্যবাদী আমলের শুরু থেকেই অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। একদিকে অনেক মহাত্মারি আত্মত্যাগ ও অক্লান্ত প্রচেষ্টা, অপরদিকে বহু তরুণ ও স্বদেশপ্রেমিকের আত্মবলি ও রক্তের ওপর গড়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় শিক্ষার বুনিয়াদ। জাতীয় শিক্ষার জন্য সেই সুপ্রাচীন সংগ্রাম আজও শেষ হয়নি, সেই লড়াইয়ের জের টেনে চলতে হচ্ছে। তাই প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনের প্রারম্ভেই আমি গণতান্ত্রিক শিক্ষার জন্য সেই গৌরবময় আন্দোলনের ঐতিহ্যকে স্মরণ করে পূর্বগামীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কি চেয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদ এদেশের সহযোগিতা সমাজ-ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে। তার ঔপনিবেশিক শোষণের ঘাটি। তাই এদেশে শিক্ষার প্রসার সে কোনদিন চায়নি। তার প্রয়োজন ছিল এক সংকীর্ণ শিক্ষা-ব্যবস্থার মারফত কতিপয় শিক্ষিত আমলার সৃষ্টি করা—যারা এদেশে বৃটিশ শাসনের ভিত্তি দৃঢ়তর করবে। জনসাধারণকে অজ্ঞ রাখাই ছিল সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থার গূঢ় উদ্দেশ্য-তাই সে এক ব্যয়সাধ্য আমলাতান্ত্রিক শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু করে জনগণকে শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সবরকম ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। যুদ্ধোত্তর “সারজেন্ট স্কীমের ধোকাবাজিও আজ কারো কাছে অস্পষ্ট নয়।

সাম্রাজ্যবাদ যা পারেনি। কিন্তু দেশপ্রেমিক মহাত্মাদের বহু ত্যাগ ও অনেক চেষ্টার ফলে ইংরেজের চালু করা ‘মেকলীয় শিক্ষা পদ্ধতির মোড় ফিরতে লাগল। গ্রামে, শহরে, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষালয়ে জাতীয়তার বীজমন্ত্র ঢুকতে শুরু করল। সাম্রাজ্যবাদ অনেক চেষ্টা করল এই জাতীয়তার ভাবধারার বন্যা রুখতে। কিন্তু প্রবল স্বাধীনতা আন্দোলনের সামনে তাদের সব অপচেষ্টাই ভেস্তে গেল। সজাগ ছাত্র সমাজ ও জনসাধারণ বুকের রক্ত ঢেলে একটি একটি করে তাদের শিক্ষার দাবি আদায় করে নিতে লাগিল; দিনে দিনে এও তারা বুঝল যে, সত্যিকারের স্বাধীনতা পেলে জাতীয় ও গণতান্ত্রিক শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হইতে পারে না— সাম্রাজ্যবাদ কোনো দিনই তা দেবে না। তাই দুর্বার প্রতিজ্ঞনা নিয়ে ছাত্রসমাজ। স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ‘৪৬-এর ভিয়েতনাম দিবস, রশীদ আলী দিবস তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য।

‘৪৭-এর পরে তারপর ঘোষিত হল আজাদী, ক্ষমতা হস্তান্তর হল ‘৪৭-এর ১৪ আগস্ট। জনসাধারণ ভাবল, দল্পিত পরিবর্তন এবার হবে। তাই সংগ্রামে ঢিলে দিয়ে তারা। নির্ভর করে রইল নয়া সরকারের উপর। ছাত্র ও জনসাধারণের এই অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে একটির পর একটি করে সাধারণের শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সাম্রাজ্যবাদ আড়ালে থেকে কেড়ে নিতে লাগল। এই ছুতো ঐ ছুতোর নামে জাতীয় শিক্ষার গোড়ায় সুপরিকল্পিত হামলার অধ্যায় শুরু হল।

শুরু হল নয়া রাষ্ট্রের পত্তনের নামে শিক্ষার খরচ কমানো। শুরু হল সরকারি অফিস ও উধর্বতন অফিসারদের জন্য স্কুল কলেজ বিল্ডিং রিকুইজিশন। শুরু হল এক এক করে কায়েমী বা সাময়িকভাবে স্কুল কলেজের দ্বার বন্ধ করা। অল্প বেতনের দায়ে অনন্যোপায় হয়ে অনেক শিক্ষাগত প্রাণ ভালো-মানুষ’ শিক্ষক ও শিক্ষকতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। একজন বোট অফিসার বা বর্ডার অফিসারের মাহিনাও তাদের থেকে দেড়গুণ দুগুণ বেশি। এ অবস্থায় শিক্ষকতা শুধু বিড়ম্বনা নয়, অসম্মানজনক হয়ে দাঁড়ায় না কি? জাতির শিক্ষা স্পৃহার প্রতি একি বর্বর পরিহাস!। সরকারি স্কুল কলেজগুলির সংস্কারের প্রশ্ন তুলতেই সরকার তা ধামাচাপা দিতে একটি বড় ওজর তুলেছে—“শিক্ষক পাওয়া যায় না। কিন্তু সঠিক খবর নিলে জানা যাবে যে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল কলেজগুলি থেকে অ্যালাউন্স কেটে নেওয়া, নিয়ম মোতাবেক বর্ধিত বেতন মঞ্জুর না করা ইত্যাদি পরোক্ষ শিক্ষক ছাটাই নীতির চাপে, এমনকি সরাসরি চাকরিতে জবাব পেয়ে বেকারত্ব বরণ করেছেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য নয়। সরকারি স্কুল কলেজগুলিতে অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষককেও যতদিন খুশি অস্থায়ী পদবাচ্য করে রাখা হয়েছে ও হচ্ছে। অনেক সময় তিন চার মাস ধরে গরিব শিক্ষকদের মাইনে বাকি ফেলে রাখা হয়েছে। এই অবহেলার দরুন সর্বত্র সরকারিবেসরকারি স্কুল কলেজগুলি ভেঙে পড়তে লাগল। হিন্দু শিক্ষকগণ অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেন। আর শিক্ষিত মুসলিম যুবকেরা টাকাওয়ালা সিভিল সাপ্লাই বা অন্যান্য বিভাগ ছেড়ে শিক্ষার ঘানি ঘাড়ে পেতে নিয়ে অনাহার ডেকে আনতে চাইবে কেন?

এই ব্যাপক শিক্ষাবিরোধী অভিযান যে কারো মনে প্রশ্ন জাগায়নি, তা নয়। ১৯৪৮ সালের ২ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয় প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয় “পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই আজ চরম দুরবস্থার সম্মুখীন হইয়াছে। শিক্ষার মত একটি জরুরি বিষয় লইয়া পূর্ববঙ্গে যে হেলা খেলা চলিতেছে, তাহা শুধু আপত্তিকর নয়-অত্যন্ত মারাত্মক।” একই প্রবন্ধে অন্যত্র লেখা হয় “শিক্ষা বিভাগের যাহারা কর্ণধার, তাহারা আজ পর্যন্ত শিক্ষা বিস্তারের একটা প্ল্যান তৈরি তো করলেনই না, উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদী আমলের সেই ভাঙাচোরা শিক্ষা ব্যবস্থাটাও ভাঙিতে বসিয়াছেন।” সংগ্রামের ভিতর দিয়ে আদায় করা সমস্ত অধিকারই আবার এক এক করে ছিনিয়ে নেওয়া হল। শুধু তাই নয়, এই সুযোগে এদেশের গণশিক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনের মহীরুহ সমূলে উৎপাটনের অভিসন্ধি নিয়ে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে মুছে ফেলবার চক্রান্ত আঁটা হল। তারই প্রথম ধাপ হিসাবে আক্রমণ এল বাংলা ভাষার উপর। চক্রান্ত করা হল ভবিষ্যতের বাঙালিকে মূক করে দেবার, যাতে সে মুখ ফুটে শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে না পারে, যাতে সে ভুলে যায় তার জাতীয় ও সামাজিক অস্তিত্বের মর্যাদা, ভুলে যায় তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। অনেক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী পূর্ব বাংলার বলিষ্ঠ ছাত্রসমাজ এ আক্রমণ চোখ বুজে বরদাস্ত করল না। যে ভাষা এদেশের লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাব ও ভাবনার ঐতিহাসিক পরিণতি ও ঐতিহাকে বহন। করছে; যে ভাষায় বাংলার প্রতিটি শিশুর প্রথম বুলি ও প্রথম পাঠ শিক্ষার মাধ্যম। হিসাবে, সরকারি পরিভাষা হিসাবে “আজাদ বাংলা” কেন তাকে পাবে না? চারদিকে আওয়াজ উঠল—“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।” মিছিলের মুখে তথাকথিত গদিনশীন নেতাদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার জবাবদিহি তলব করা হল। সমগ্র প্রদেশ জুড়ে পূর্ব বাংলার বৃহত্তম ছাত্র ও গণ-আন্দোলন গড়ে উঠল। কালাকানুন এখানে প্রাদেশিক সরকারের একটি গোপনীয় সার্কুলারের রহস্য উদ্ঘাটন করতে চাই।

স্পষ্টতই এই কালা নির্দেশের ভিত্তিতে ছাত্রদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সরকার ও শিক্ষা বিভাগের কর্তৃপক্ষ যথেচ্ছ চালিয়ে যেতে কসুর করেননি। শিক্ষকদের স্বাধীন গতিবিধির তো প্রশ্নই ওঠে না। কেউ তার ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া পেশ করলেই তাকে রাষ্ট্রের শত্রু, ইসলামের শত্রন আখ্যা দিয়ে দমননীতির প্রকোপে ফেলে দেওয়া হয়। এই কালা কানুনের প্রকাশ্য ও গোপন প্রকোপে জরিমানা, বহিষ্কার ও গ্রেফতারের ঝড় বয়ে গেছে ছাত্রসমাজের বুকের ওপর দিয়ে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বগুড়ার অধ্যাপক গোলাম রসুল সাহেব, গাইবান্ধা ও নড়াইলের কয়েকজন শিক্ষকের বহিষ্কার, মেডিক্যাল কলেজের জনৈক ছাত্রের বহিষ্কার, বিশিষ্ট ছাত্রকর্মীদের কারাবাসের ইতিহাস কারও অজানা নয়। এ ছাড়া কথায় কথায় স্কুল-কলেজে পুলিশ পিকেট বসিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কয়েদখানায় পরিণত করা হয়েছে। তবু ছাত্র আন্দোলন দমেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমবেতনভুক্ত কর্মচারীদের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন—দমননীতি ও ছাত্র বহিষ্কারের বিরুদ্ধে। তার পরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নয়া চক্রান্ত পাকানো হল—আরবী হরফে বাংলা লেখার চক্রান্ত। ঢাকা ও মফঃস্বলের ছাত্রদের ধ্বনি চক্রান্তকারীদের হকচকিয়ে দিয়েছিল। তারপর এল সর্বশেষ ব্যাপক আক্রমণ স্কুল-কলেজে বেতন বৃদ্ধি। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে সক্রিয় প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই আজ আমরা এই শিক্ষা সম্মেলনের দ্বারে এসে পৌছেছি।

ক. স্কুল কলেজ বিল্ডিং রিকুইজিশন

একমাত্র ঢাকাতেই ইডেন কলেজ—এখন সেক্রেটারিয়েট, কলেজিয়েট স্কুল, স্টেট ব্যাংক, জগন্নাথ হল—অ্যাসেম্বলি হাউস, ইডেন গার্লস স্কুল ও কামরুন্নেসা কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া নবকুমার হাই স্কুল, নারী শিক্ষা মন্দির, প্রিয়নাথ হাই স্কুল, সলিমুল্লাহ কলেজ, আরমানীটোলা গার্লস স্কুল ও জগন্নাথ কলেজ অনেকবার রিকুইজিশন করে মাসাধিককাল বন্ধ রাখা হয়।

সিলেট : সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা, মুরারীচাদ কলেজ হোস্টেল এবং আরো কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হুকুমদখল করা

চট্টগ্রাম : রাজশাহী ও অন্যান্য জেলাতেও নির্বিচারে হুকুমদখলের মহড়া চলেছে। এই যথেচ্ছ হুকুমদখলের বিরুদ্ধে ছাত্র প্রতিরোধের নজীর হিসাবে অল্পদিন পূর্বে সিলেটের ছাত্র-ছাত্রীর সার্থক “হুকুম দখল প্রতিবাদ ও মেয়ে কলেজ” আন্দোলন, ঢাকায় কামরুননেসা স্কুলের ছাত্রীদের আন্দোলন ও কুষ্টিয়ার হোস্টেল আন্দোলনের উল্লেখ করা যেতে পারে।

ময়মনসিংহ : সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল এবং ময়মনসিংহের ভটপুরা ও অন্যান্য কয়েকটি বিদ্যালয় আজও মিলিটারীর কবলে। এমনি করেই মিলিটারীর খাতিরে শিক্ষাকে বলি দেওয়া হচ্ছে। কতকগুলো ভাঙাচোরা বাড়িতে ঢাকা কলেজের প্রাণপ্রদীপ মিটমিট করে। জ্বলছে। ১৯৪৮ সনের নভেম্বরে উক্ত কলেজের ছাত্রদের অনশন ধর্মঘট ও প্রবল আন্দোলনের চাপে সরকার অবিলম্বে উপযুক্ত স্থানে উক্ত কলেজ স্থানান্তর করার প্রতিশ্রুতি দেন। আর্টস স্কুলের ছাত্ররা স্কুল বিল্ডিং-এর সংস্কার বা স্থান পরিবর্তনের জন্য বহুদিন ধরে আবেদন নিবেদন করে আসছে। প্রত্যুত্তরে এসব প্রশ্ন তো ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছেই, উপরন্তু ইস্পাহানীর জন্য ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল বিল্ডিং হুকুমদখলের নির্লজ্জ প্রস্তাব তোলা হচ্ছে।

(খ) প্রাইমারী স্কুল ও প্রাইমারী শিক্ষক

অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী মোয়াজ্জেম উদ্দিন সাহেব অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত কয়েকটি অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার একটি বিল রচনা করেন। দেশ বিভাগের পর সেই পরীক্ষামূলক বিলটিকেও ধামাচাপা দিয়ে নতুন স্কীমের নামে চালানো হল। প্রাথমিক শিক্ষার বিরুদ্ধে এক নির্লজ্জ অভিযান।

১৯৪৮-এর ১৫ অক্টোবর পাবনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক মওলী আহমদ হোসেন বিটি সাহেবের বিবৃতি থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করছি : নূতন স্কীম চিজটি কি তাহা খুলিয়া বলিলেই থলি হইতে বিড়াল বাহির হইয়া পড়িত ; আসলে ডিপিআই-এর নির্দেশ ছিল যে, ১৯৪১ সালে ‘আদমশুমারীর হিসাব মত প্রতি দুই হাজার লোকের জন্য একটি স্কুল রাখিয়া বাকি স্কুল উঠাইয়া দিতে হইবে। এই হিসাবমত সিরাজগঞ্জ মহকুমায় মোট স্কুলের সংখ্যা থাকিবে ৪৯৩। বর্তমানে স্কুল বোর্ড পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা ৬৪১। ইহার পর সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, বালিকা স্কুল, এম, স্কুল এবং মাদ্রাসা সংলগ্ন প্রাইমারি বিভাগের সংখ্যা মোটামুটি ১৩৭। সুতরাং সরকারি নির্দেশমত ২৭৫টি স্কুল তুলিয়া দিতে হইবে।

মোটামুটি উপরোক্ত স্কীমের দৌলতে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৪০ হইতে ৫০ ভাগ প্রাথমিক স্কুল তুলে দেয়া হয়। একমাত্র নাটোর, চট্টগ্রামেই অবলুপ্ত প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ৮৪৪। আর রাজশাহীতে একমাত্র নাটোর জেলায়। ৪ ০৩। উপরোক্ত হিসাব থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, কত হাজার প্রাইমারি শিক্ষক বেকার হয়ে পথে দাঁড়াল। অপরদিকে প্রাইমারি শিক্ষকের বেতনের হার তৃতীয় শিক্ষক- মাসিক ১৯ টাকা, দ্বিতীয় শিক্ষক মাসিক ২৭ টাকা, প্রথম শিক্ষক মাসিক ২৯ টাকা। প্রাইমারি শিক্ষকদের সরকারের এই চূড়ান্ত অবহেলার প্রত্যক্ষ ফল চট্টগ্রামের ঈদগাঁও স্কুলের শিক্ষক নাজিমুদ্দীনের অনাহারে হাসপাতালে মৃত্যু। মৃত্যুকালে তার ৩ মাসের মাহিনা বাকি ছিল। ঐ জিলাতেই আরো ৪ জন প্রাথমিক শিক্ষকের মৃত্যু। ২ জনের আত্মহত্যা। মাধ্যমিক বোর্ড-ঢাকায় ৪ জন প্রাথমিক শিক্ষক রিকশা চালকের কাজ করে।

সাধারণভাবে মাধ্যমিক শিক্ষকদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে কিছুদিন আগে ইনসাফ পত্রিকায় প্রকাশিত জনৈক ব্যক্তির লিখিত চিঠির উদ্ধৃতি দেওয়া গেল।

দেশ বিভাগের পরে যাহারা সরকারি স্কুলে নিযুক্ত হইলেন তাহাদের সকলেই এবং সমগ্র শিক্ষক সংখ্যায় ন্যূনধিক এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক গত তিন বৎসর যাবৎ, অস্থায়ীভাবে কাজ করিয়া আসিতেছেন। ইহাদের কেহ কেহ আবার বিভাগপূর্ব সময় হইতেই চাকরিতে নিযুক্ত আছেন। দেশ বিভাগের পর আজ তিন বৎসর সময়, তবু তাহারা বিভাগীয় তালিকাভুক্ত হয় নাই। ইহাদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। শতাধিকের কম হইবে না একথা এক রকম নিশ্চয় করিয়াই বলা চলে। এ পর্যন্ত বিভাগীয় তালিকায় ইহাদের নাম উঠিল না—এ কেমন কথা। সরকারি নিয়ম মোতাবেক এর ভিতরে ইহাদের চাকরি পাকা হওয়া উচিত ছিল কি পাকা হওয়া তো দূরের কথা, ইহারা যে চাকরি করিতেছেন এবং একটা সঙ্গীন মুহূর্তে সরকারের প্রয়োজনে ইহারা যে সাড়া দিয়াছেন তাহারও একটা নিশানা বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা করেন নাই। ইহা নিশ্চয়ই বিস্ময়জনক অবস্থা যাহার কথা ভাবিয়া অনেক শিক্ষকই হয়ত হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন।

গত তিন বছরের প্রবেশিকা ও আইএ পরীক্ষায় পাসের হার ক্রমহাসমান, স্কুলের ছাত্রসংখ্যা হ্রাস ইত্যাদি মাধ্যমিক শিক্ষার চরম দুর্গতির প্রত্যক্ষ নজীর।

গ, মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে ধর্মের ধূয়া এ অবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষাকেও নূতন সিলেবাস প্রবর্তনের নেশায় ইসলামী শিক্ষার ধুয়া তুলে যা চালু করছেন তা ভীতিপ্রদ, স্কুলে ছাত্রদের মাথায় চারটি ভাষা শেখার বোঝা চাপানো হয়েছে, উর্দুকে বাধ্যতামূলক করে; পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন নিয়ে শিক্ষাবোর্ডের কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রীতিমত ব্যাখ্যা শুরু করে দিয়েছেন। সত্যিকারের শিক্ষণীয় অনেক বই-ই নয়া পাকিস্তানি শিক্ষার নামে অনেক সময় ব্যক্তিগত বা দলগত ব্যবসার খাতিরে বাতিল করে দিয়ে বাজে বই বাজারে চালু করা হচ্ছে।

সিলেবাসের বোঝা সম্পর্কে নিচের উদ্ধৃতিটি যথেষ্ট :

সিলেকশন বোর্ডের বিবেচনাশূন্য সিলেবাস মনোনয়নের ফলে আগামী ৫১ সনের প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের পাস করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কেননা, উর্দু সিলেবাসে নয়টি গদ্য, তেরটি পদ, ষাটটি হেকায়েত ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হইয়াছে। বলা বাহুল্য, এত বড় কোর্স মাত্র দুই বৎসরে শেষ করা অধিকাংশ ছাত্রের পক্ষেই অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত : ইংরাজী ফাস্ট পেপারের ম্যান-ইটার্স অব কুমাউন নামক যে পুস্তকটি রহিয়াছে, উহার ভাষা এবং বিষয়বস্তু বি এ স্টান্ডার্ড-এর চাইতেও কঠিন বলিলে অত্যুক্তি হয় না। যথেষ্ট অত্যাচার করা সত্ত্বেও ছাত্রবৃন্দ যে উহা হজম করিয়া খাতার পাতায় দু’কলম চালাইয়া পাসের হার বাড়াইবে, তেমনি আশা স্বর্গের সিঁড়ির মতই অসম্ভব বলা চলে। অথচ পাসের হার কমিতে থাকিলে ছাত্র ও অভিভাবক মহলে যে নৈরাশ্য জাগিবে সম্প্রতি উহার প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়াছে, এই কারণে দিন দিন বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা কমিয়া যাইতেছে।

(২০ আগস্টের ইনসাফে প্রকাশিত জনৈক ছাত্রের চিঠির একাংশ)

সকল ব্যাপারেই মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের অব্যবস্থা চরমে উঠেছে। পরীক্ষক নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষার ফল প্রকাশে অবহেলা ও দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ প্রতিদিনকার সংবাদপত্রের “চিঠিপত্রের স্তম্ভ” খুঁজলেই মেলে। গত তিন বছর ধরে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফলাফল বের হতে প্রতিবারই সেপ্টেম্বর পেরিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ প্রায় পুরো একটা শিক্ষা বৎসর ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া বোর্ডের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অনেক তথ্যই আজকাল প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সরকারি শিক্ষাপদ্ধতির অব্যবস্থা ও ঔদাসীন্যের ফলে গত কয়েক বছরে পাসের হারের অধােগতি নিমরূপ দাঁড়িয়েছে।

১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাসের শতকরা হার ৭৩। ১৯৪৮ সালে ৫৯। ১৯৪৯ সালে ৩৫। এবার শোনা যাচ্ছে শতকরা ২০ থেকে নেমে ২৫ নাকি পাস করতে পারে। এই অগণিত হতভাগ্য যুবকদের সামনে একমাত্র ভবিষ্যৎ হিসেবে খোলা রাখা হয়েছে আনসার বাহিনী, পিএনজি, আর পি ইত্যাদি প্রতিক্রিয়াশীল যুদ্ধের বাহিনীতে যোগদানের পথ। তাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সঙ্কুল। এমনি করে পূর্ববঙ্গের তরুণদের উচচশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধে এদের কামানের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করার এ এক সুস্পষ্ট পরিকল্পনা।

ঘ, কারিগরি শিক্ষা

বিভিন্ন স্কুল কলেজের ল্যাবরেটরির অবস্থা সঙ্গীন। বার্নারের গ্যাস, এসিড ও অন্যান্য মাল-মসলার অভাবে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের হাতেকলমে কিছু দেখা শেখার কাজ প্রায় কিছুই হচ্ছে না বললে অত্যুক্তি হবে না।

গত বছর কয়লার অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগারের কাজ মাসাধিক কাল বন্ধ থাকে। মেডিক্যাল শিক্ষার ক্রমবর্ধমান তাগিদকে সরকার চোখ বুজে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। গত সেশনে মিটফোর্ডে মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রার্থী ১২০০ দরখাস্তের ভেতর মাত্র পৌনে দু’শকে অনুমোদন করা হয়। আর মেডিক্যাল কলেজে ৭৫০ খানা দরখাস্তের ভেতর ১২৫ জন ছাত্রকে ভর্তি করা হয়।

এদের ভিতরও আবার কারিকুলাম সিস্টেম, অটোমেশন সিস্টেম ইত্যাদির দৌলতে কাটছাট হয়ে বাৎসরিক ৪/৫ জনের বেশি ছাত্র ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু এ ডিগ্রিকেও সরকারি স্বীকৃতি না দেওয়ার ফলে বিদেশে উচ্চতর মেডিক্যাল শিক্ষা বা সরকারি চাকরির সম্ভাবনা এদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ঢাকাতে মেডিক্যাল শিক্ষার তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটিই মেডিক্যাল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান। সরকারি মিটফোর্ড স্কুলের এলএমএফ ডিগ্রি অনুমোদিত কিন্তু সংক্ষিপ্ত এম বি কোর্সের প্রবর্তন না করার ফলে ঐ স্কুলের ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার পথে বিরাট বাধা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। কুমিল্লাতে সরকারি মেডিক্যাল স্কুল স্থাপনের জন্য বহুদিন ধরে আবেদননিবেদন চলছে। সম্প্রতি তথাকার দুইটি বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল একত্র করে একটা করা হয়েছে—কিন্তু তার জন্যও কোনো সরকারি সাহায্য বা সহানুভূতি পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ একদিন সারা ভারতের প্রথম শ্রেণির ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ছিল। আজ তার আভ্যন্তরীণ অবস্থা বিশৃঙ্খলা ও স্বৈরাচারে জর্জরিত। শিবপুর হতে প্রত্যাগত ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের এখানে পড়া ও পরীক্ষার সুবন্দোবস্তের অভাব পীড়াদায়ক। ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে অপরদিকে সংক্ষিপ্ত বি ই কোর্স পড়ার কোনো ব্যবস্থা নাই।

ঙ. বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্দশা অকথ্য

বেয়ারার, শিক্ষক, লাইব্রেরিয়ান, কেরানী ইত্যাদির অভাব লেগেই আছে। পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধিকাংশ শিক্ষক এবার পি এ এস এ চলে যাচ্ছেন। বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর দুর্যোগ এক স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেকেন্ড ইয়ারের অনার্স প্র্যাকটিক্যাল ফিজিসের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। সায়েন্স বিল্ডিং-এ যথেষ্ট সংখ্যক রুম না থাকার ফলে অনেক সময়েই ক্লাস করতে গিয়ে বিরত হতে হয়। লাইব্রেরিতে আধুনিক প্রকাশিত মূল্যবান পুস্তকের একান্ত অভাব। দু এক কপি ‘শো’ পুস্তক কদাচিত ছাত্ররা পড়বার সুযোগ পায়। লাইব্রেরি সংক্রান্ত অভিযোগ কমিয়ে বললেও স্থান সংকুলান হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটে ১৯৪৭ সাল থেকে প্রতি বছর মঞ্জুরিকৃত সরকারি বরাদ্দের হার নির্মে দেওয়া হইল :

সেশন   ১৯৪৭-৪৮ ৮৮৭০০০/

১৯৪৮-৪৯ ৭৩৬৪০০/

১৯৪৯-৫০ ৭০৭০০০/

উপরোক্ত হিসাব অনুযায়ী ১৯৫০-৫১ সেশনের যে প্রাপ্য বরাদ্দ ছিল তা থেকেও এক লাখ টাকা কেটে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রের “বিশ্ববিদ্যালয় সাহায্য তহবিল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্য সাড়ে দশ লাখ টাকা ‘শর্তাধীন সাহায্যের ধুয়া তুলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ওদিকে বিনাশর্তে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়েছে সাড়ে দশ লাখ টাকার ভেতর হতে সাত লাখ টাকা সাহায্য (বাকি অংশ সম্ভবত শর্তাধীন রাখা হয়েছে)।

পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার উপর এই বিশেষ রাজরোষ কেন? কারণ কাচামাল উৎপাদনের ঔপনিবেশিক শোষণের ঘাটি হিসাৰে পূৰ্বৰঙ্গকে সাম্রাজ্যবাদ এখনও ব্যবহার করছে, আর সেই লুটের বখরাদারি করছে ইস্পাহানি প্রমুখ পাঞ্জাবী, সিন্ধী বৃহৎ ধনিকগোষ্ঠি। তাই এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার প্রয়াস যাতে এখানে জাতীয় শিল্প গড়ে তোলার চেতনা ও সংগ্রাম দানা বেঁধে না উঠতে পারে।

চ. মোহাজের ছাত্র সমস্যা

মোহাজের ছাত্রদের অভাব-অভিযোগের অনেক খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলির চিঠিপত্রের স্তম্ভে চোখ বুলালেই চোখে পড়ে। মোহাজের ফান্ডে টাকা তোলার এত আড়ম্বর দেখানো হচ্ছে অথচ মোহাজের ছাত্রদের থাকা, পড়া ও উপযুক্ত বৃত্তির কোনো সুবন্দোবস্তই করা হয়নি। পরীক্ষার্থী মোহাজেরদের সার্টিফিকেট ইত্যাদির ধুয়া তুলে বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করে পরীক্ষা দেওয়া অসম্ভব করে তোলা হচ্ছে।

গত বছর পুরাপুরি পরীক্ষার ফী না দিলে কোনো মোহাজের ছাত্রকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয় নি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ হঠাৎ বদান্য হয়ে উঠলেন এবং জমা দেয়া পরীক্ষার ফী রিফান্ড করা হল। এতে যারা টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারছিল না, তাদের সুবিধাটা কি হল? এবারও পরীক্ষার ফী প্রাক্তন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ছাড়া মোহাজের ছাত্রদের পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে না।

ছ, নারী শিক্ষার অবরোধ

নারী শিক্ষার প্রসার তো দূরের কথা, প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের কয়েকটি স্কুল, কলেজ তুলে দেওয়া হয়েছে। বরিশালের একমাত্র মেয়ে হোস্টেল উঠে যাওয়ায় গ্রামের মেয়েদের শহরে থেকে পড়াশোনা করার উপায় নেই। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র দুটি মেয়ে কলেজ অবশিষ্ট। তার মধ্যে সিলেটের কলেজটিকে সম্প্রতি তুলে দিয়েছিল, কিন্তু প্রবল গণবিক্ষোভের চাপে শেষ পর্যন্ত সরকারি সাহায্য মজুর করার ফলে কলেজটি অব্যাহত থাকে। ওদিকে মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষার পথ বন্ধ করতে জগন্নাথ কলেজে মেয়েদের বিজ্ঞান বিভাগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

জ, ছাত্রাবাস সমস্যা

ছাত্রাবাস সমস্যা সার্বজনীন। পাইকারিভাবে যে সমস্ত ব্যারাক তৈরি হয়েছে তারও সিট রেন্ট করা হয়েছে ৫ টাকা বা ততোধিক। এ ছাড়া নানা প্রকার আনুসঙ্গিক ফী -এর উপসর্গ তো আছেই। এক মে ৬/৭ জন করে থাকে। আর মেডিক্যাল কলেজের অনেক ছাত্রই মাথা গুজবার স্থানের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে মাখা খুড়ছে।

অপরদিকে ইস্পাহানী প্রমুখ পুঁজিপতির বাড়ি রিকুইজিশন করে দিয়ে তোষামোদ বা লেহন করতে সরকারের নিরলস উদ্যম সকলের চোখে পড়ে। ১২ লক্ষ টাকা খরচ হয় বড় বড় আমলাদের জন্য বালাখানা তৈরি করতে, সরকারি টাকায় কম পড়ে না, মন্ত্রীদের ভ্রমণবিলাস মেটাতে পাবলিকের লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ের হিসাব দেখে কে?

ঝ, বেতন বৃদ্ধি

সর্বাধুনিক ব্যাপক আক্রমণ হচ্ছে ছাত্রবেতনের বৃদ্ধি। অধিকাংশ অভিভাবকের আয়ের একটা বিরাট অংশ আসে কৃষি পণ্যদ্রব্য থেকে; কিন্তু ইস্পাহানির জুট বোর্ডের কৃপায় আজ সারা বাংলার পাট চাষী ভীষণ আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন। অপরদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বেড়ে যাচ্ছে—এদেশে বৈদেশিক পুঁজি বাজার কেঁপে উঠছে। ফলে অভিভাবকদের অবস্থা সঙ্গীন। ছাত্রজীবনের আর্থিক সংকটের প্রত্যক্ষ নজীর খবর কাগজের অফিসগুলোতে ঘুরলেই পাওয়া যায়। অনেক ছাত্র আজ খবরের কাগজে নাইট ডিউটি দিয়ে পড়াশুনোর খরচ চালাচ্ছে। কমার্স ও আর্টসের বিরাট সংখ্যক ছাত্র চাকরি বা প্রাইভেট টিউশনি করে পড়ে। অনেক ছাত্র কাগজ ফেরি করে, অনেকে রাত্রে রিকশা চালায়।

এই যখন আজকের ছাত্রদের আর্থিক দশা, তখন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্কুল-কলেজে শতকরা ২৫ জনের পড়া খতম, তা সহজেই অনুমেয়।

ভগ্নদশা বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘাটতির বোঝা পুরাবার দায়িত্ব নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ছাত্র ও অভিভাবকদের ঘাড়ে চাপাবার এক অভিনব পদ্ধতি। এতে তার একদিকে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হ্রাস ও অন্যদিকে শিক্ষা বাজেটের ব্যয় কমিয়ে মিলিটারি ও পুলিশ খাতে টাকা বাড়ানোর উভয়বিধ উদ্দেশ্য সফল হয়। এই বেতন বৃদ্ধির যাতাকলে পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে এমন বহু ছাত্রের খবর চারদিক থেকে ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছে।

ঞ. দমননীতির প্রকোপ

কালা-কানুনের মারপ্যাচে বহিস্কৃত ছাত্রের সংখ্যা একমাত্র ঢাকাতেই, মিটফোর্ড৬ জন ছাত্র। ১ জনের উপর পাকিস্তান থেকে বহিষ্কারাদেশ)

সম্প্রতি আরো ১ জন ছাত্রী বহিষ্কৃত। মেডিক্যাল কলেজ-২ জন ছাত্রী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-৬ জন (গত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে মোট ২৭ জনের উপর বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়)

ঢাকা কলেজ-৪ জন (মোট ১১ জনকে ফোর্স টিসি ইত্যাদি দ্বারা কলেজ থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়, ৯৭ জনের স্কলারশিপ স্টাইপেন্ড বাতিল করার হুমকি দেওয়া হয়, ১ জনের উপর ঢাকা থেকে বহিষ্কারাদেশ জারি করা হয়)।

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে-৫ জন

এ ছাড়া মোট জরিমানা, বাধ্যতামূলক টিসি, বৃত্তি বাতিল ইত্যাদি দৈনন্দিন ব্যাপার। ‘৪৮ সালে রাজশাহী কলেজের বিখ্যাত ছাত্রদলন-বিভীষিকার ইতিহাস ভয়াবহ। সোজা কথায় ছাত্রের বিরুদ্ধে তোড়ন, বহিঙ্কার, গ্রেপ্তারি ইত্যাদি নানা কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়।

পূর্ববঙ্গের জেলে মোট ছাত্র-বন্দীর সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। এদের মধ্যে আছেন শেখ মুজিবুর ও ১২/১৪ বছরের কয়েকজন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী।

জেলে নিহত ছাত্রনেতাদের নাম যথাক্রমে : ঢাকা জেলে-কুষ্টিয়ার শিবেন রায়। রাজশাহী জেলে-খুলনার আনোয়ার হোসেন। ছাত্র ও শিশুদের স্বাস্থ্যের প্রতি কোনো দৃকপাতই করা হয় না। ঘৃণিত চাইল্ড লেবারের সংখ্যা বিস্ময়কর অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার নজির সিলেটের চা বাগানে, সদরঘাটের হকারদের ভিড়ে, তার নজির স্টীমার ও স্টেশনের কুলি বস্তিতে, কাচ ইত্যাদির কারখানায়। এই আমাদের দেশের শিশু।

১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি পূর্ব পাকিস্তান অধ্যাপক সমিতির এক প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দেশব্যাপী শিক্ষা সংকটের কথা উল্লেখ করেন এবং এ ব্যাপারে সরকার আদৌ সচেতন কি

জিজ্ঞাসা করায় উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, শিক্ষা বিভাগের এক্সপার্টরা যে পুনি দিচ্ছেন তা ব্যয়বহুল, কিন্তু সরকারের হাতে টাকা নাই। কাজেই কিছু করা যাচ্ছে না। তখন একজন অধ্যাপক প্রশ্ন করেন যে, সরকার কেন বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ না করে জমিদারকে কোটি কোটি টাকা নগদ জোগাচ্ছেন? সরকার কেন অতিরিক্ত মুনাফাকর এবং ব্যবসার ইত্যাদি বসিয়ে ঐ সকল অর্থ জনস্বার্থে কল্যাণকর পথে, শিক্ষা সম্প্রসারণের পথে ব্যয় করছেন না? প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যান। যেকোনো প্রকার ব্যাপক গঠনমূলক পরিকল্পনা কার্যকর করতে হলেই আজ মুনাফা শিকারিদের অতিরিক্ত মুনাফায় টান পড়ে। তাই সরকার সব রকম শিক্ষা সংস্কারের পরামর্শই ধামাচাপা দিয়ে জমিদার ও মুনাফাখোরদের স্বার্থ সযত্বে রক্ষা করে চলেছে।

পূর্ব বাংলার শিক্ষাকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র

বাংলা ভাষা বিরোধী চক্রান্ত আজ চারদিক থেকে পাকিয়ে তোলা হয়েছে। ১ নম্বর- ঢাকা রেডিও ও “মাহে নও” এর মারফত মীজানুর রহমান পরিকল্পিত উর্দু মিশ্রিত এক বিকৃত বাংলার প্রচলন। এ এক অভিনব ফন্দি। বাঙালির কৃষ্টি, বাঙালির রুচিবোধকে পিষে মারতে ভাষার উপর ছুরি চালানোর এক জঘন্য অত্যাচারের অস্ত্র। ২ নম্বর— আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র। বাংলা ভাষার অস্তিত্বের গোড়াটিতে আঘাত হানতে সরকার অবিচলভাবে সুনির্দিষ্ট পথে এ ঘৃণ্য পরিকল্পনা কার্যকর করার দিকে এগিয়ে চলেছে। জনসাধারণের টাকা এভাবে অপব্যয় করে খরচ জোগানো হচ্ছে আরবি হরফে লেখার ১৭টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্রের। বিশেষজ্ঞ কমিটি ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে অবিলম্বে চালু করার যে সুপারিশ দাখিল করেছিল তাও কেন্দ্র থেকে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাদেশিক সরকারের বাজেটের চেহারা দেখলে এই আক্রমণের অর্থ আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। বাজেটের শতকরা মাত্র ৫২৬ ভাগ দেওয়া হয়েছে শিক্ষাখাতে, আর মিলিটারি ও পুলিশ খাতে গিয়েছে ৭২ ভাগ। এই বিভিন্নমুখী আক্রমণ ব্যর্থ করে শিক্ষা ও জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করতে হলে আমাদের গড়ে তুলতে হবে লৌহাঢ় ছাত্র ঐক্য এবং ছাত্র-শিক্ষক বুদ্ধিজীবী ও সকল দেশপ্রেমিক জনসাধারণের সম্মিলিত জাতীয় প্রতিরোধ দুর্গ।

আমলা-বিদ্রোহ : একটি ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত

গণতন্ত্রের আদর্শ মূল্যবোধ হচ্ছে এটাই যে, একটি নির্বাচিত ও আইনগতভাবে বৈধ সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতাসীন হবেন অর্থাৎ নির্বাচকমণ্ডলীর রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতা ত্যাগ করবেন। তবে সরকারের এই আসা-যাওয়ার মধ্যেও আমলাতন্ত্র যথাস্থানে বলবত থাকবে এবং কি যুদ্ধ, কি শান্তি—সর্বাবস্থায় লোকদৃষ্টির অন্তরালে থেকে রাজনীতির মুখাপেক্ষী না হয়ে শাসনের ধারাটি বজায় রেখে চলবেন। বিধি অনুযায়ী দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজকর্ম সম্পাদন করবেন। বিকল্প নীতি প্রদান এবং তা বাস্তবায়নের বিষয় ব্যাখ্যা করবেন। নীতিগত সিদ্ধান্ত ও আদেশসমূহ যথাসাধ্য বিশ্বস্ততা সহকারে পালন করবেন। এভাবেই একটি সরকারের শাসনকাজ গতি লাভ করবে। এক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের অবস্থান হবে পর্দার অন্তরালে। তাকে কখনোই সামনে দেখা যাবে না, তার কণ্ঠস্বরও কখনোই প্রকাশ্যে শ্রুত হবে না। নির্বাচনের মাধ্যমে যে-ই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রবেশ করুন বা সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হোন, আমলাতন্ত্র তাঁর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বিবি মোতাবেক আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদন করে যাবে।

অতি সম্প্রতিককাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র এই ধারাই মান্য করে আসছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসের শেষদিকে আমলাতন্ত্র প্রকাশ্যে যা করেছে, তা তার সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রসঙ্গক্রমেই এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করা হয় ২৫.০৩.৯৬ এবং বিলটি গৃহীত হয় ২৬.০৩, ৯৬ তারিখে। বিলটি জাতীয় সংসদে পাস হবার পরদিনই অর্থাৎ ২৭.০৩.৯৬ তারিখে সচিবরা প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ২৮,০৩.৯৬ তারিখে কাজ করা বন্ধ করে দেন, যেদিন সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেন। এরপর সংসদ বাতিল করা হয়, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেন (৩০,০৩,৯৬)।

এই ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে বিচারের ভার আমি সম্মানিত পাঠকদের ওপর ছেড়ে দেব। আমি শুধু বলব, যে সচিবালয় বেসামরিক প্রশাসনের স্নায়ুকেন্দ্র স্বরূপ, তারই ৩৫ জন সচিৰ যে অভূতপূর্ব ও অশ্রুতপূর্ব পদক্ষেপ সেদিন নিয়েছিলেন তা শুধু ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধির পরিপন্থীই নয়, ভারতের সংবিধানের স্থপতি ড, বি, আর, আম্বেদকর-এর ভাষায় এটা ‘নৈরাজ্যের ব্যাকরণ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। ১৯৯০ সালেও মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও অন্য কয়েকজন এরকম ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। আর সাম্প্রতিককালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও (সাবেক) ব্যর্থ হলেন ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।

এ প্রসঙ্গে আমরা স্মৃতি হাতড়িয়ে অতীতের দিকে দৃকপাত করতে পারি। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করলে পূর্ববাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হন। ১৯৪৯ সালের ১৬ অক্টোবর ঘাতকের বুলেটে প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান প্রাণ হারালে খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। পাকিস্তান সরকারের সচিব চৌধুরী মোহাম্মদ আলী হন নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার সদস্য। দেশ শাসনের এই আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র দেশের সচেতন ও বিবেকবান মহলকে নাড়া দেয়। তারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। যার ধারাবাহিক ফলশ্রতি ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

যাহোক, এ নিবন্ধ রচনার উদ্দেশ্য একথা তুলে ধরা যে-

ক, আমলাতন্ত্র এবং বিশেষভাবে সচিবদের পূর্বোল্লিখিত কর্মকাণ্ড গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টস কন্ডাক্ট রুলস-১৯৭৯-এর লংঘন।

খ, সচিবদের এই কাজ এমন একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল, যার মূল্য জাতিকে আরো বহুকাল দিতে হবে।

গ. সচিবদের কাছ থেকে তাদের উপরিউক্ত কাজের ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে

পারে। এবার আসা যাক গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টস কন্ডাক্ট রুলস-১৯৭৯ প্রসঙ্গে। এতে অন্যান্যের মধ্যে আছে-

ক. কোনো সরকারি চাকুরে প্রকাশ্যে এমন কোনো মতামত জ্ঞাপক বিবৃতি দিতে পারবেন না, যা সরকারের সঙ্গে জনগণ বা অন্য কোনো মহলের সম্পর্ককে নাজুক অবস্থায় নিপতিত করতে পারে।

খ. কোনো সরকারি চাকুরে দেশের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ, চাঁদা প্রদান বা অন্য কোনো উপায়ে সহযোগিতা করতে পারবেন না।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমলাতন্ত্রের সদস্যরা কোনো মনস্তাপে ভুগলে বা বিবেকের তাড়না অনুভব করলে অবশ্যই যথাস্থানে তাদের মতামত রাখতে পারেন। কিন্তু তারা তাদের প্রতিক্রিয়া বা মতামত প্রকাশ্যে ব্যক্ত করতে পারেন না। কোনো রাজনৈতিক মঞ্চ বা প্লাটফর্মে বক্তৃতা দিতে পারেন। আমাদের আমলাতন্ত্র যার পূর্বসূরি সেই ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের এটাই রীতি এবং এই রীতি ১৯৭৯ সালের গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট কন্ডাক্ট রুলস-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও।

কিন্তু ১৯৭১ সাল থেকে এ যাবতকালের বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের রাজনীতি নিরপেক্ষ হবার সমস্ত বিধি-বিধান, প্রচলিত নিয়ম ও পূর্ব দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করেও সাম্প্রতিক আমলা বিদ্রোহ উপলব্ধি করা কঠিন হবে। এ বিদ্রোহের সূচনাকারী ও নেতৃত্বদাতা সচিবরা হচ্ছে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী। এরা আমল হিসেবে অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং আশা করা স্বাভাবিক যে, এরা দেশের আইনকানুন কঠোরভাবে মান্য করে চলবেন। কিন্তু তারা এমন একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বসলেন, আগামীকাল তারাও যার শিকারে পরিণত হতে পারেন। উধর্বতনদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তাদের অধীনস্থরা কাজের টেবিল ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারে, সচিবালয়ের গেটে তালা ঝুলিয়ে দিতে পারে, সচিবালয়ের গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে, তাদের (সচিব) ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করতে পারে, তাদের জিম্মি করে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে। একবার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে গেলে তাকে অতিক্রম করে যাওয়া সহজ নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো প্রতিষ্ঠান ও ঐতিহ্য রাতারাতি গড়ে ওঠে না। এর জন্যে প্রয়োজন হয় দীর্ঘ দীর্ঘ সময়ের। কিন্তু তা ভাঙতে লাগে মুহূর্তমাত্র। যেমন বাংলাদেশে সম্প্রতি হল। আমাদের সচিবরা কি করতে যাচ্ছেন এবং তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল কি হতে পারে, সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন না—তা ভাবাই যায় না। এ প্রসঙ্গে মুক্ত কণ্ঠে প্রশংসা করতে হয় আমাদের সশস্ত্র বাহিনীসমূহ (সেনা, নৌ ও বিমান) এবং ইন্সপেক্টর পুলিশ, বিডিআর, রেডিও-টিভি’র প্রধানদের। কারণ, কায়েমী স্বার্থবাদীদের উসকানির মুখেও তারা শৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণ এবং চাকরিবিধির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে গেছেন।

এসব সচিব যা করেছেন, কেউ যদি তাদের কাছে তার ব্যাখ্যা চায়, তাহলে তাকে খুব একটা বাধাও দেয়া যাবে না। তবে ব্যাখ্যা দাবির জবাবে সংশ্লিষ্ট সচিববৃন্দ যে কথাই বলুন না কেন, এটা সত্যি যে, তারা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যা করেছেন তা হল :

ক, জনগণের সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করেছেন, যে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস (ধারা-৭, বাংলাদেশ সংবিধান)।

খ. বৈধ আইনের ধারণা অতিক্ৰমণ।

প, ১৫ই ফেব্রুয়ারির (১৯৯৬) পর গঠিত সরকারের বৈধতা সম্পর্কে

আদালত-বহির্ভূত রায় ঘোষণা, যা বৈধ আইনের সুস্পষ্ট লংঘন।

ঘ. ১৯৭৯ সালের গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট রুলস লংঘন।

ঙ. ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক একটি রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য পক্ষাবলম্বন।

চ, সরকারি চাকুরেদের শতবর্ষের প্রাচীন রাজনীতি-নিরপেক্ষতার ঐতিহ্য ধ্বংস।

ছ, অধীনস্থ কর্মচারীদের কাছে জিম্মি হওয়া বা পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার জন্যে নিজেদের অরক্ষিত করে ফেলা।

জ, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল ও অচল করে দিতে চায়, এমন সৰ ‘অদৃশ্য হাতের’ সঙ্গে সজ্ঞানে বা অসচেতনভাবে হাত মেলানো।

ঝ, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের নিরপেক্ষতাকে পঙ্গু করে দেয়া।

একটা কথা আছে তুমি যত বড়ই হও, আইন তোমারও ওপরে। কাজেই আইনের এই ছত্রছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে কেউ না কেউ আশা করতেই পারে যে, সংশ্লিষ্ট সচিব এবং বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যামূলক জবাব দেবেন। যদি তারা তা করতে অপারগ বা অনিচ্ছুক হন তাহলে তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য প্রকাশ্যে অনুতাপ ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে কিংবা পদত্যাগ করতে পারেন। এ ব্যাপারে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও কর্তব্য আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রশাসনে বিখলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। এটা তার জন্যে একটা চরম পরীক্ষা।

গত ০২.০৪.৯৬ তারিখে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা সচিব ও অন্যান্যের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন, পত্র-পত্রিকায় আমি তার বিবরণ পাঠ করেছি। তাই ‘আপনি যত বড়ই হোন, আইন আপনারও ওপরে’ এই নীতিবাত্যের প্রতি বিচারপতি হাবিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ নিতে আগ্রহ বোধ করছি। সাম্প্রতিক ভারতে এই নীতিবাক্যটি সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। আমি ঐকান্তিকভাবে আশা করি যে, মাননীয় বিচারপতি হাবিবুর রহমান জাতিকে নিরাশ করবেন না।

অনুলিখন : হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী

জাতীয় সংবর্ধনার সভায় প্রদত্ত ভাষণ

ঐক্যবদ্ধ সর্বদলীয় ফ্রন্ট গঠন করতে হবে এটাই সময়ের দাবি

[১২ মার্চ, ১৯:৯ ৯ তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত জাতীয় নেতৃবৃন্দের সংবর্ধনা সভায় জনাব অলি আহালের ভাষণ]

মাননীয় সভাপতি, জননন্দিত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সমবেত সুধীবৃন্দ ও উদ্যোক্তাবৃন্দ

আস্সালামু আলাইকুম।

আজ আপনারা আমার প্রতি যে ভালোবাসা ও সম্মান দেখিয়েছেন, তার প্রতিদান দেয়ার সাধ্য আমার নেই। আবেগ আপ্লুত আমি আজ। আপনাদের এই প্রীতির প্রতিদান আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে থাকবে চিরকাল। আমার প্রতি আপনাদের এই প্রাণঢালা ভালোবাসা প্রমাণ করে, এ জাতির হৃদয়ের ঐশ্বর্য আজও নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। আজ এখানে দাঁড়িয়ে যতবারই পেছনে ফিরে তাকাই, ততবারই বিগত দিনের অজস্র স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে উঠছে। কিশোর বয়সে, পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ স্বজাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার পিপাসা বুকে নিয়ে ‘৪০ দশকে যখন রাজনীতির দুর্গম পথের অভিযাত্রায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম, তখন সমগ্র বিশ্ব ছিল যুদ্ধ ক্লান্ত। এ উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সূর্য অস্তায়মান।

দল ও মতের পার্থক্য সত্ত্বেও আজ আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপকার শহীদ তিতুমীর, ফকির মজনু শাহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন ফরওয়ার্ড ব্লক, নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টি, অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের আত্মত্যাগকারী নির্যাতন বরণকারী অগণিত নেতাকর্মী, কথা ও কবিতায় স্বাধীনতার প্রথম উচ্চারণকারী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রাজনৈতিক মঞ্চে ভারতের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক মাওলানা হাসরত মোহানীকে। তারাই আমাদের পথপ্রদর্শক। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আমাদের ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার, স্বাধীনতা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নির্যাতন বরণকারী শহিদান, নেতা ও কর্মীদের। আপনারা আমার অনুভূতি জানতে চেয়েছেন। প্রায় অর্ধশতাব্দীর আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অবিমিশ্র নয়। কখনও আনন্দ, কখনও বিষাদ, কখনও বা ক্ষোভের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে সময়। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে পদে পদে। দেখেছি ব্যক্তি স্বার্থের হীন যূপকাষ্ঠে জাতীয় স্বার্থ বর্জনের নোংরা খেলা। কপটতা ও ওয়াদা ভঙ্গের এই হীনম্মন্যতার মধ্যেও আবার দেখেছি অদম্য অনির্বাণ জীবনের দিকে অকুতোভয়ে এগিয়ে গেছে দেশপ্রেমিক জনতা। তারা কিছুতেই পরাভব মানেনি কোথাও। ‘৪০-এর দশকে পশ্চাদপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু। সেদিন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক-সবদিক দিয়েই মুসলমানরা ছিল পশ্চাদপদ। তাই আমরা সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা ওয়াদা করেছিলেন পাকিস্তানে খোলাফায়ে রাশেদীনের রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থা কায়েম হবে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিপন্ন বিস্ময়ে দেখতে পেলাম দুর্নীতি ও ঢাকা ক্লাব কেন্দ্রিক কালচার। সে আশাভঙ্গের বেদনা বোঝাতে পারব না।

অনেক মহান পুরুষের একান্ত সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বাংলার স্বাধীনতার অকুতোভয় সেনাপতি, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও রেনেসাঁর মর্মবাণীতে অবগাহিত দার্শনিক রাজনীতবিদ ৪০-এর দশকে নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য আমার কিশোর মনে অগ্রসর ও সংগ্রামী চিন্তা চেতনার বীজ বপন করে।

১৯৪৭ সালে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলাম। নেতাজী সুভাষ বসুর অগ্রজ শরৎ বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম ছিলেন এ আন্দোলনের রূপকার। দুর্ভাগ্য গান্ধী-নেহেরু নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অর্থাৎ স্বাধীন সার্বভৌম, অখণ্ড বঙ্গীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। হিন্দু মহাসভা সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ১৯৪৭ সালের ৫ এপ্রিল তারকেশ্বর হিন্দু মহাসভা সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গ করে হিন্দুবঙ্গ-মুসলিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। গান্ধী ও নেহরু অখণ্ড বঙ্গদেশকে খণ্ড করার দাবি সমর্থন করে ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের আসন গ্রহণ করলেন। পক্ষান্তরে, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে আশীর্বাদ জানান। পরিকল্পনা ছিল স্বাধীন বঙ্গদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন মুসলমান। ১৯৪৭-এর আগস্টে ভারত বিভক্ত হল। প্রতিষ্ঠিত হল হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব মোতাবেক একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্থলে একটি রাষ্ট্র (পাকিস্তান) প্রতিষ্ঠার কারণে আমরা বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হই। ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তনের উদ্যোক্তা অধ্যাপক আবুল কাসেম ও অন্যদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বাধীন বিপুল সংখ্যক যুৰ ছাত্র মুসলিম লীগ নেতাকর্মী ঝাঁপিয়ে পড়ে।

‘৪৭ থেকে ৫৪ পর্যন্ত একটানা আন্দোলন করলাম। ক্ষমতাসীন হল যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার। ওয়াদা ভঙ্গের মহড়া, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্ব ও সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদের পদলেহন ছিল এ সরকারগুলোর বৈশিষ্ট্য। করাচি-পিন্ডি কেন্দ্রিক সমরনেতা সিপাহী-হায়েনাদের বিরুদ্ধে সংকটময় মুহূর্তে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ডাক দেন—মুক্তিযুদ্ধ হল স্বাধীন সার্বভৌম সকল প্রকার আধিপত্যবাদমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক সংবিধানও রচিত হল। বিমল আনন্দে বুক ভরে গেল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ভারত মিত্রের ছদ্মবেশে আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়েছে বটে, তার আসল অভিলাষ হল পিন্ডির স্থানে নিজেকে অধিষ্ঠিত করা। সেজন্য তার চাই একটি বিকলাঙ্গ, নতজানু, তাঁবেদার বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যেই শুরু হল হিন্দুস্তানী ফৌজীদের দেদার লুট ও ভারতে সম্পদ পাচার। দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ধস নামল। সেই সঙ্গে স্বাক্ষরিত হল দিল্লির সাথে ২৫-সালা দাসত্ব চুক্তি, সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি ও গঙ্গার পানি ভারতের কাছে তুলে দেয়ার চুক্তি। ১৯৭৩ সালে সেই দুর্যোগময় মুহুর্তে আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদকে প্রতিহত করার জন্য আজাদ বাংলা কায়েম কর, দিল্লির দাসত্ব মানি না মানবো না, শপথ নিয়ে আলোলনের ডাক দিলাম। প্রতিবাদ জানালাম। ফল হল কারাবরণ। ১৯৭৫ সালে জেলে বসেই শুনলাম মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী সংবিধানের প্রধানতম স্তম্ভ “গণতন্ত্র’ মুচড়ে ফেলে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছে। শ্লোগান উঠেছে, ‘এক নেতা একদেশ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’। অর্থাৎ, এক ব্যক্তির শাসন। জেলে বসে ক্ষোভে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আবার জেলে বসেই শুনলাম ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন। আশা ভঙ্গের বেদনা ভুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু না, আবারও সামরিক শাসন। রাজনীতির অর্থ আজ কালো টাকার বশ্যতা। হুন্ডা-গুন্ডা-ডান্ডা আর কালো টাকার দৌরাত্ম্যেই চলে নির্বাচনের মহড়া বা প্রহসন। এ রকম প্রহসনের মধ্য দিয়ে ১৯৬ নির্বাচনে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে দিল্লির সেবাদাসরা। এই সেবাদাসদের একমাত্র কাজ হল, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রহিত একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করা। সকল অগ্রগতি ও উন্নয়নের চাকাকে স্তব্ধ করে জাতিকে পরমুখাপেক্ষী হতে বাধ্য করা। মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক লক্ষ্যগুলোকে ভূলুণ্ঠিত করে, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাতির উদয়াচলকে মলিন করা। আমাদের স্বতন্ত্র ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বিনাশ করে দেশকে আরেকটি সিকিমে পরিণত করা। এজন্যই আমরা যারা দেশকে ভালোবাসি, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার জন্য, তাদের একমাত্র কাজ হল বিভেদ ও বিভ্রান্তিকে পাত্তা না দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে, দিল্লির দাসত্ব নিগড় থেকে মুক্ত করার সংকল্পে সংগ্রামী ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। যুগপৎ আন্দোলনের নামে দ্বীপে দ্বীপে আন্দোলন করার বিচ্ছিন্ন মনোভাবকে পরিহার করে বিরোধী দলগুলিকে আন্দোলনের সাফল্যের স্বার্থে এক মঞ্চে আসতে হবে। মঞ্চের নাম হতে পারে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’। নিমলিখিত কর্মসূচি হতে পারে ঐক্যের ভিত্তি ১, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাতিল; ২, ৩০-সালা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিল করে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে গঙ্গা পানি বন্টন অর্থাৎ ঢাকা-দিল্লি-কাঠমন্ডু পানি চুক্তি; ৩. ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহারকল্পে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ; ৪.নদীর তলদেশ খনন; ৫.তেল, গ্যাস, কয়লাসহ খনিজ সম্পদ আহরণে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; ৬.দেশকে বৈধ ও অবৈধ পন্থায় ভারতীয় পণ্য বাজারে পরিণত করার হীন প্রচেষ্টা রোধ; ৭. জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে সর্বশক্তি নিয়োগ; ৮, সার্ককে জোরদার করার এবং ভারতের সাতটি রাজ্যসহ উপ-আঞ্চলিক জোট তৈরির প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা; ৯, দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ; ১০. আইন-শৃঙ্খলা পুনঃ প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাস দমন, কঠোরভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ; এবং ১১, কোনো সরকারি কর্মচারী পদচ্যুত, পদত্যাগ বা স্বাভাবিকভাবে অবসর গ্রহণের পর থেকে পরবর্তী দশ বৎসর পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে আজ দাঁড়িয়ে আছি আমরা। জাতীয় অর্থনীতি উন্নত দেশগুলির তুলনায় কয়েক শতাব্দী পেছনে। মুক্তবাজার অর্থনীতির বদৌলতে ঢালাওভাবে অবাধে বিদেশি পণ্য আমদানির কারণে দেশীয় কলকারখানা ধ্বংসোনুখ, দেশীয় পুঁজি বিনিয়োগ দ্বিধান্বিত। উপরতলার গুটি কয়েক পুঁজিপতি কোটারা দুর্নীতিবাজ আমলাদের যোগসাজশে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ রোধে সংকল্পবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ রাষ্ট্র পর্যায়ে ১৯৭২-৯৮ (২৭ বৎসরে) ভারত-বাংলাদেশ মেয়াদ বৈদেশিক বাণিজ্য ভারত বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার অধিক রপ্তানি করেছে আর সীমান্ত পাচারেও সমপরিমাণে বেশি রপ্তানি করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের একচেটিয়া সংরক্ষিত বাজার। সেবাদাসীর সরকার ক্ষমতায়। এমনি ঐতিহাসিক সংকটকালে শ্রদ্ধেয়া দেশনেত্রী আপনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের মধ্যমণি। এখন একমাত্র ভরসা খালেদা জিয়া। আমি দেখি আপনিই একমাত্র ভরসা। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। আপনাকেই উদ্যোগ নিয়ে ১২ জুন, ১৯৯৬ নির্বাচনের ৬৩% ভোটারের আকাচা পূরণ করতে আগত সংগ্রামের লক্ষ্যে এক মঞ্চে সবাইকে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ সর্বদলীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করতে হবে, এটাই সময়ের দাবি।

আমি আমার বক্তব্য আর দীর্ঘায়িত করব না। আমার জীবনসূর্য আজ পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। কিন্তু আমি জানি জীবন কখনও থেমে থাকে না এবং সম্ভাবনারও কোনো শেষ নেই। ৮০ বছর বয়সে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মহাপ্রলয়ের পর মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের এক নবীন সূর্যোদয় হবে।’ আমার জীবনে সে সূর্যোদয় আমি দেখে যেতে পারব কি না জানি না। কিন্তু এদেশের তরুণ সমাজের কাছে আমি আবেদন জানাব সত্য প্রতিষ্ঠায় আপনারা ব্ৰতী হউন।

হিরন্ময় আশাবাদ নিয়ে আপনারা সত্য ও সুন্দরের অভিযাত্রায় অকুতোভয়ে এগিয়ে চলুন। দেশে আজাদীর ঝাণ্ডাকে উডউনি রাখুন। কেবল মন্ত্রিত্বের জন্য রাজনীতি করবেন না, নব ইতিহাস সৃষ্টির দুর্নিবার প্রেরণায় এগিয়ে চলুন। পবিত্র হোক আপনাদের অভিযাত্রা। সুন্দর ও দীপ্ত হোক আপনাদের আত্মপ্রকাশ। আজকের উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করব না। আমার কাছে হয়ত আপনাদের প্রত্যাশা অনেক কিন্তু সাধ্য আমার সীমিত। তবুও দৃঢ়তার সাথে বলব, আমার যা দেবার তা দিতে আমি দ্বিধা করব না। কোনোদিন দ্বিধা করিনি। জীবনে কি পেয়েছি কি পাইনি এ হিসাব আমি কোনো দিন করিনি। যা কিছু সত্য, সুন্দর ও ন্যায় বলে জেনেছি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারই জন্য করেছি সর্বস্বল্পণ। সেজন্য আজ যখন জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকাই তখন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারি। না, মালিন্য কোথাও নেই। গ্লানিকর কিছু কোথাও নেই। সেজন্য আশা হয়, যখন পরম সত্তার মাঝে বিলীন হয়ে যাবে আমার অস্তিত্ব, তখন নিশ্চয়ই এই প্রসন্নতার ছটাটুকু লেগে থাকবে আমার অবয়বে। যদি তা থাকে, তাতেই আমি ধন্য।

পরিশেষে বলি, বাংলাদেশ চিরকালের সংগ্রামের দেশ। বাংলাদেশকে জানা দিতে হয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বাচতেও হবে সংগ্রাম করে। সেই সংগ্রামের তুরবারিতে যেন কখনও মরিচা না ধরে। আর কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন-

সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের

দেশের তরে প্রাণ দিতে আজ তাক পড়েছে তাদের।

আপনাদের ধন্যবাদ। খোদা হাফেজ।

বাংলাদেশ : রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার সংকট শীর্ষক গোলটেবিলে অলি আহাদ

দেশে চরিত্র বলে কিছু নেই, দুর্নীতিবাজে দেশ ভরে গেছে

মাফ করবেন, একটু সময় নিলাম। আমার তো ক্রনিক ব্রংকাইটিস। ফলে আমার লাংস কাজ করে না, কষ্ট হয়। আজকে শ্রদ্ধেয় গুণীজন, বিজ্ঞজন আপনারা উপস্থিত। আপনাদের বক্তব্য শুনতে পেরে আমি নিজেকে এডুকেটেড ফিল করি। আমার তরফ থেকে আপনাদের দেয়ার কিছু নেই, শেখাবার মত কিছু নেই। আমার শিখবার ছিল, আমি শিখেছি। একটি কথা আজকে বলতে হয়, ইনকিলাব-আজাদী যুদ্ধে কায়েদে আযমের নেতৃত্বে যেদিন আমরা পাকিস্তান আন্দোলন করি, ছাত্র অবস্থায় তখন আজাদ ছিল সমগ্র মুসলমান বাঙালিদের একমাত্র পত্রিকা এবং সেই পত্রিকা ঘরে ঘরে আলো জ্বেলে দিয়েছিল। যে স্বাধীনতা-আজাদীর ফলে আমরা পাকিন্তান লাভ করি। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে একটি পত্রিকার আবির্ভাব হয়, তার নাম ইত্তেফাক। দৈনিক ইত্তেফাক মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা। সেই পত্রিকাও ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল এবং স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত, ৬ দফা আন্দোলন পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়ে গেছে এবং জনগণ তার বাণীকে গ্রহণ করেছে। সে অনুযায়ী একাত্তরের যুদ্ধে জয়লাভও করেছে। আজকে আবার যখন ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনবাদের বিরুদ্ধে, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ সংগ্রামে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছে তখন একটি পত্রিকার আবির্ভাব আমাদের চোখের সামনে সেটি হল দৈনিক ইনকিলাব। দৈনিক ইনকিলাব না হলে, যেভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের পত্রিকাটি দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে, এমনকি ইত্তেফাককে পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলছে, সেখানে বাংলার জনগণের কথা বলার কোনো সুযোগ থাকত না এবং সেই কথা ঘরে ঘরে পৌছাবারও কোনো সুযোগ থাকত না। সেই ইনকিলাব আজকে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় অস্তিত্ব এই প্রশ্নে একটা গোলটেবিল আজকে ডেকেছে, ইনকিলাবের কর্তৃপক্ষকে, ইনকিলাবের সাথে যারা জড়িত সেই বন্ধুদেরকে, শ্রদ্ধেয় বদ্ধুদেরকে আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই এবং ধন্যবাদও জানাই।

প্রতিপাদ্য বিষয়ে আমি যা বলব তার চেয়ে অনেক বেশি বলে ফেলেছেইন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা, আমি তো জ্ঞানী নই। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম বলে আমার নিজের ব্যক্তিগত কিছু কিছু ধ্যান-ধারণা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, একটি কথা মনে রাখতে হবে ৬ দফা আন্দোলনে যখন সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ ভোট দিয়ে সমর্থন প্রমাণ করল গণপরিষদ অর্থাৎ জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদে তাদের সদস্যদের পাঠিয়ে তখনি ৬ দফা ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। এখন এই ৬ দফাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গ্রহণ করার বাধা আসার ফলে, সামরিক জান্তাদের কারণেই পাকিস্তান ভেঙে গেল। আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়ে আমি যাই, মুক্তিযুদ্ধ যখন মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়, ৬ দফা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন জনগণের আন্দোলন সশস্ত্র যুদ্ধে পরিণত হয়, তখনি আসে ইন্দিরা গান্ধী আমাদের চোখের সামনে। হানাদার বাহিনীর ২৫ রাতে এখন আঘাত হানার পরে একে একে দেশ থেকে হিন্দুস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করা আরম্ভ করে, তার সাথে কিন্তু হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সামনে তাদের বিরুদ্ধে বৈদ্যনাথপুরের গণপরিষদের শপথনামায় সেখানে বলা হয়েছে, আমরা গণপরিষদের সদস্য যারা জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলাম এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলাম, সমন্বিতভাবে একটা গণপরিষদ গঠন করেছি। সেই গণপরিষদের শপথনামায় এই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে লেখা ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। এ কথা সর্বৈব মিথ্যা। এ কথা তিনি ঘোষণা করেননি। তা সত্ত্বেও এই মিথ্যা কথাটা ক্রমাগত প্রকাশ করা হয়। তিনি আত্মসমর্পণ করেন হানাদার বাহিনীর কাছে এবং পাকিস্তানের ভূখণ্ডে চলে গেলেন। আমাদের সামনে তখন সংগ্রামের যুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্যরা, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, আনসার বাহিনীর সদস্যরা মিলিতভাবে সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে মার্চ মাসের ৩০ তারিখে বনগাঁয়ে জনাব তাজউদ্দিন সাহেব গিয়ে উপস্থিত হলেন। খবর পাওয়া মাত্র বিএসএফ এসে  স্যালুট দিয়ে বললেন, স্যার আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর স্যারকে দিল্লির আদেশে হেলিকপ্টারে করে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ২ তারিখে মহারানী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা হয় তাঁর। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কে প্রধানমন্ত্রী হবে, প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের কে রাষ্ট্রপতি হবে। ইন্দিরা গান্ধী ভালো করেই জানতেন শেখ মুজিবুর রহমান আত্মসমর্পণ করেছে এবং পাকিস্তানে আটকে আছে, তা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী সিদ্ধান্ত দিলেন রাষ্ট্রপতি হবে শেখ মুজিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী হবেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ। কলকাতার ১ নং ক্যার্মাক স্ট্রিটে ৬৭৬ জন সদস্যের যে সভা হয়, সে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, আর বাকি ৫ জন হবে অ্যাডভাইজার। কিন্তু দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এখানে নেমে এসে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাহির করে দিলেন এবং ইন্দিরা গান্ধীর আদেশকেই ধরলেন। অর্থাৎ তিনি সিলেকটেড হয়ে গেলেন ইন্দিরা গান্ধীর দ্বারা। আমার মনে পড়ে ১৭৫৭ সালে সেই আম্রকাননে যেখানে মীর জাফর আলী খানের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার ফলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবকে পরাজিত হতে হয়। তার পরের ইতিহাস আমাদের পরাধীনতা। মীর জাফর আলী খান ছিল ক্লাইভের মনোনীত, ঠিক তেমনি ইন্দিরা গান্ধীর রক্ট্রিপতি এবং ইন্দিরা গান্ধীর মনোনীত প্রধানমন্ত্রী। তার ফল যা হবার তাই হয়েছে। তার ফল হল, আমরা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিপতি নই। বৈদ্যনাথপুরে গিয়ে যে শপথনামা নেয়া হয়, তার সেই সদস্যদের মেনে নিতে হয়, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী আর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। বাকি সব মন্ত্রী চারজন। এজন্যই আমরা যুদ্ধ করেছি, অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে আমরা সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলাম, আমাদের প্রতিপক্ষ শক্তি ছিল সশস্ত্র বাহিনীর পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ক ইয়াহিয়া খান। আর তার প্রতিভ হিসেবে এখানে ছিল জেনারেল। নিয়াজী। সেজন্যই এই মুক্তিযুদ্ধের পরে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে ঐ যে কথাটি আমি বলে আসলাম, ইন্দিরা গান্ধীর মনোনীত প্রধানমন্ত্রী। ১৬ তারিখে ঢাকায় আসেননি। তার শক্তি ছিল না এ কথা বলার। সশস্ত্র যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে জেনারেল ওসমানী, এই সর্বাধিনায়কের সাথে ১৬ তারিখের আত্মসমর্পণের যে অনুষ্ঠান, সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী আর তাদের তরফে জেনারেল নিয়াজী আর সহকারী হিসেবে জেনারেল আরোরা। জেনারেল অরোরা হল সহকারী শক্তির নেতা। ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের সাহায্য করেছে, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু সহায়ক শক্তি হিসেবে, প্রধান শক্তি হিসেবে নয়। এখানে আর হল বিড়ম্বনা। এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দিল্লিশ্বরীর পায়ে নৈবেদ্য হিসেবে দিয়ে দেয়া হয়। তারই ফল পরবর্তীকালে এসে দাঁড়ায়। ২০ তারিখে আসলেন তিনি। তাজউদ্দিন সাহেব তো দালাল। কিন্তু তার আগে জেনারেল ওসমানী সর্বাধিনায়ক, তিনি সেই আত্মসমর্পণ করার ডকুমেন্টে সই করার জন্য তার যে উপস্থিতি দরকার ছিল, তিনি তাতে আসেননি। এসেছেন জেনারেল অরোরা। অর্থাৎ এখানে আমার বলার অর্থ হল পেশিশক্তি মাসল পাওয়ার ইজ পাওয়ার উইথ মেটার। যার ফলে নৈতিক শক্তি জনগণের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সেখানে পরাজিত হয়ে যায়। জেনারেল অরোরা আসে হিন্দুস্তানের রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে এবং পাকিস্তানের রিপ্রেজেনটেটিভ জেনারেল নিয়াজীর সাথে আত্মসমর্পণের ডকুমেন্টে সই করার জন্য। এর চেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কিছু হয় না। সেই দুঃখ নিয়েই জেনারেল ওসমানী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। সেই দুঃখ নিয়ে আমরাও এখনো বেঁচে আছি। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে যখন তাজউদ্দিন সাহেব এসে ক্ষমতা নিলেন ২০ তারিখে, পহেলা জানুয়ারি প্রথম কাজটি তিনি করলেন। আমাদের মুদ্রামানকে হ্রাস করে নিলেন ৩৬% ভাগ। আর এর ফলে দাঁড়িয়েছে কি? যেখানে আমাদের টাকার মূল্য ভারতীয় টাকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল, হঠাৎ করে তা কমে গিয়ে শেষে দেখা গেল মুদ্রাস্ফীতি আমার দেশে, এই অর্থনীতি আজো গড়ে উঠে নাই। তারপরে তিনি ঘোষণা করলেন, ভুলে যান আমরা পাটের রাজা ছিলাম। হ্যা, আমরা পাটের রাজা ছিলাম—এটা তো ভুলে যেতেই হবে, দালালী নিয়ে যখন এসেছেন, প্রধান দালালী হল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারতে পাট রফতানী করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভারতকে তার মিল চালাবার জন্য ১০ থেকে ১৫ লক্ষ বেল পাট প্রতি বছর আমাদের নিকট থেকে সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে আমদানি করতে হয়েছে। সিঙ্গাপুরের মারফতে তাকে আনতে হয়েছে তার মিল চালাবার জন্য। তার মিল প্রায় সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সর্বোৎকৃষ্ট পাটের অভাবে তখনি এ ঘোষণা আসল যে, আমরা ভারতে পাট রফতানী করতে পারব। এর উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। মারোয়াডড়ি লুটেরা এসে গেল। ফলে সেখানকার পাটকলগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, দুই-তিন শিফটে সেগুলো পরিচালিত হতে লাগল। তখন আমার এখানে এমন সব লোককে দায়িত্ব দেয়া হল, যারা লুটেরা, যারা পাট বলতে পাটের কিছুই জানে না, ইন্ডাস্ট্রি জানা তো দূরের কথা। ফলে কলকারখানা ধ্বংস হয়ে গেল। তারপর তিনি ঘোষণা করলেন, ইন্দিরা গান্ধীর কথা নিয়ে আমি যাব না। আমার প্রধানমন্ত্রী আমার দেশে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, আমরা কমপ্লিমেন্টারী ইকোনমি, আমরা কোনো কমপ্লিটেন্ট ইকোনমি নয়। ভারতের সাথে পাকিস্তান জুট এক্সপোর্ট কমপিটিশনে ভারত অনেক বাজার দখল করে নিয়েছিল। সেই বাজারগুলো পুনরায় তারা উদ্ধার করে। ভারতের সাথে চামড়া আমরা রফতানী করি। তারাও রফতানী করে। সুতরাং সেটা কমপিটিটিভ মার্কেট ছিল।

বস্ত্র তৈরির জন্য যে তুলার প্রয়োজন, তুলা ভারত আমদানি করে, আমরাও আমদানি করি, সেখানে দামেও কমপিটিশনের প্রশ্ন আছে। অতএব কমপিটিটিভ ইকনোমিটাকে ধবংস করে দেয়া হল, অর্থাৎ মারোয়াড়ী আস, এই মিলগুলো দখল কর, এই মিলগুলো ধবংস কর। তারপর তাজউদ্দিন সাহেব ঘোষণা করলেন, ভারতে কোনো অস্ত যায় নাই। ঐ দালাল তো তখন জানত, অমৃতবাজার পত্রিকা অনুযায়ী দুইশত হতে আড়াইশত ওয়াগন ভরা অস্ত্রশস্ত্র, আধুনিক অস্ত্র হিন্দুস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ এই দালালেরই অন্য মন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর তখন বলে, ভারত আমাদের অস্ত্র নিয়ে গেছে। অস্ত্র এখন ফেরত দেয়ার প্রস্তাব হয়েছে। লুটেরা, ভারতীয় সেনাবাহিনী এসেছে লুট করার জন্য মনে হয়। শুধু সফরই সেদিন করে নাই, আমার মুক্তিবাহিনীকে কেবল নাকচ করে দেয় নাই। আমার জেনারেল ওসমানীকে শুধু নাকচ করে নাই। আমার জেনারেল জিয়াকে শুধু নাকচ করে নাই, আমার জেনারেল শফিউল্লাকে শুধু নাকচ করে দেয়নি। তাদেরকে অপমান করে হিন্দুস্তানের কাছে আমার স্বাধীনতাকে বিক্রি করে দেয়া হয় সেদিন। এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে পরবর্তীকালে তাজউদ্দিন সাহেব দেশটাকে সম্পূর্ণ বিক্রি করে দেয়। আসলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কি বিক্রি করল? ওই যে আমি বলেছি আমরা যে আমদানি করি বিদেশ হতে, সে আমদানিকৃত মালও ট্রাকে ভরে হিন্দুস্তানে নিয়ে গেছে। অর্থ কোথাকার? এখানকার মাল কেনার জন্য এখানকার টাকা। ঐ ৯৩,০০০ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লোক, যারা লুট করেছিল আমাদের ঘরে ঘরে, সোনা-দানা, টাকা-পয়সা সবকিছু। তাদের সেই সোনা-দানা, টাকা-পয়সা নিয়ে এরা দেখা গেল শেষ পর্যন্ত, এ টাকা দিয়ে বায়তুল মোকাররম প্রভৃতি এলাকা হতে কিনে কিনে, চট্টগ্রাম বন্দর হতে, খুলনা বন্দর হতে কিনে কিনে হিন্দুস্তানে পাঠিয়ে দেয়। এভাবে সম্পদ চলে গেল। টাকা রয়ে গেল। মুদ্রাস্ফীতি হতে বাধ্য। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে এমনকি আমার কলকারখানার মাল পর্যন্ত তখন লুট করে নিয়ে যায়, যন্ত্রপাতি পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যায়। তারপরে তারা সর্বস্তরে লুট করে দেশটাকে একটা ফোকরা দেশে পরিণত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। এবং তাই হয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে। ১০ তারিখে পাকিস্তান থেকে ফিরে এলেন জনাব শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব লন্ডন হতে কমেট বিমানে সরাসরি আমার ঢাকা না এসে দিল্লিতে নামতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী, মা দেবী, তোমাকে সালাম না করে যেতে পারি না।’ এবং মা দেবীকে সালাম করে তাকে আসতে হয়েছিল। সেখানে তাকে মন্ত্রণা দেওয়া হয়। কৃতজ্ঞ শেখ মুজিবুর রহমান, আত্মসমর্পণকারী শেখ মুজিবুর রহমানকে ইন্দিরা গান্ধী গ্রহণ করে নিয়েছে, আর বাংলাদেশের রাজত্ব যায় কোথায়? সুতরাং কৃতজ্ঞ শেখ মুজিবুর রহমান দেশেই ফিরে আসলেন। ফিরে আসার পরে তাজউদ্দিন সাহেব যে কাজগুলো করেছেন, সেগুলোর উপরে তার সীল-ছাপ্পর দিয়ে দিলেন। কিন্তু ক্ষমতার খেলা। তিনি জানেন যে, কনস্টিটিউশান করা হয়েছে। গণপরিষদের প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনে আছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা। অতএব তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য চারপাশে ঘুরতে ফিরতে আরম্ভ করলেন। কিছুতেই রাষ্ট্রপতি তিনি আর থাকবেন না। তখন জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীকে এনে রাষ্ট্রপতি করা হয়, আর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাজউদ্দিন সাহেবের হাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভার দেন। ফাইনান্স মিনিস্টার করেন। তার কাজ হল ১৯ মার্চে ২৫-সালা চুক্তি সই করা। দাসত্ব চুক্তি যাকে আমরা বলেছি। আমার মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী যাকে দাসত্ব চুক্তি বলেছেন। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিকে, সিয়াটো চুক্তিকে, সেন্টো চুক্তিকে, বাগদাদ চুক্তিকে আমরা একদিন আমেরিকার বশংবদ দালালদের এগ্রিমেন্ট মনে করতাম। সাম্রাজ্যবাদের একটা প্রতিভূ হিসাবে মনে করতাম। সেই সাম্রাজ্যবাদ যেটা করেছিল তার জন্য পাকিস্তানে বলা হয় এখন, তার যে প্রচার মন্ত্রী যিনি আছেন, তিনি এখন বলেন, ব্রডকাস্টিং এন্ড ইনফরমেশন মিনিস্টার ‘পাকিস্তান ওয়াজ রুলড বাই আমেরিকান ভাইসরয়’। অনেকে হয়ত ভাইসরয় কি তা জানেন না। ভারতবর্ষ যখন ইংরেজদের দখলে ছিল, ইংরেজদের তরফ থেকে যিনি শাসন করতে আসতেন, সমগ্র ভারতে তার নাম ছিল ভাইসরয়। পাকিস্তানেও ৪০% আর্মি চালাবার জন্য আমেরিকা দেয়ার ফলে তাকে এগ্রিমেন্ট করতে হয়েছে তার কথামত চলার। ফলে ৫৪ সালের নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। তখন থেকে আরম্ভ হয় আমাদের বিরুদ্ধে আঘাত। পরবর্তীকালে যা আছে সব তাকেই লক্ষ করে বলেছেন। পাকিস্তান ওয়াজ রুলড বাই আমেরিকান ভাইসরয়। এখানেও শেখ মুজিবুরের সময় ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার ওয়াজ দি ভাইসরয় অব দি বাংলাদেশ। ফলে তাদের কথায়, তাদের স্বার্থেই সবকিছু করতে হয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে ৭ দফা চুক্তিতে সই করে এসেছেন জনাব তাজউদ্দিন সাহেব। সেই আদলেই ২৫-সালা চুক্তিকে ১৯ মার্চে মহারানী ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিশ্বরীর সাথে শেখ মুজিবুর রহমান সই করেন।

তার পরবর্তী কিছুকাল পরেই ২৭ মার্চে বাংলাদেশ এবং ভারতীয় সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি সই করা হয়। অবাধ বাণিজ্য চুক্তি। তার ফলে যে স্মাগলিং অবারিতভাবে আমার বাংলাদেশে আসতে থাকে, তা আজো বন্ধ হয়নি। সেজন্য একটা কথা আছে আমার গ্রামে। আমি তো গ্রামের লোক। ‘হাসতে হাসতে পাগল হইলাম ভালো আর হইলাম না’ হিন্দুস্তানের কাছে এমনভাবে বিক্রি করে দিলাম আর দেশের অর্থনীতি উল্ধার করার প্রশ্নই ওঠে না। তারপর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের ২১ তারিখে সই করলেন ট্রায়াল ওপেনিং অব দ্যা ফারাক্কা বাঁধ। ইন্দিরা গান্ধীর চালে হউক, নিজের ভয়-ভীতির জন্য হউক, দালালীর কারণে হউক এই ফারাক্কা বাঁধকে ট্রায়াল ওপেন করে দেয়া হল ৩১ মে পর্যন্ত সময়ের জন্য। কিন্তু সেটা আর কোনো দিন বন্ধ হয় নাই। এর ফলশ্রুতি দাঁড়িয়েছে কি? ইতিহাসে শেখ মুজিবকে বারবার জবাব দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে মরুকরণ আরম্ভ হয়েছে। গঙ্গা বাঁধ যে তৈরি করা দরকার ছিল, নির্মাণ করা দরকার ছিল, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ করা দরকার ছিল, পাকিস্তানের সময় যে প্ল্যান করা হয়, সিক্সটিতে সেটাকে কার্যকর করা হল না। বিএম আব্বাস সাহেবের শত চেষ্টা সত্ত্বেও মধ্য থেকে মরুকরণ কেবল নয়, পানির অভাবে দেখা গেল যে এখন, ঢাকা শহরে যেখানে ১৬ থেকে ২০ ফুটের মধ্যে নলকূপ বসানোর পরে পানি পাওয়া যেত, এখন ৬০ থেকে ৭০ ফুট বসানোর পরেও পানি পাওয়া যায় না। তার অর্থ হল আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন্ড অব ওয়াটার রিসিট করে গেছে, অনেক নিচে নেমে গেছে। এর ফলে আজকে আর্সেনিকের দোষ আসছে। তাহলে প্রয়োজন কি? প্রয়োজন সার্ভিস অর্ডারকে ব্যবহার করা। সার্ভিস অর্ডারকে ব্যবহার করতে হলে কি দরকার? গঙ্গা বাঁধকে নির্মাণ করা, ব্রহ্মপুত্র বাঁধকে নির্মাণ করা, তিস্তা বাঁধকে নির্মাণ করা। গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ করার জন্য একটি মাত্র পুরুষ এ পর্যন্ত যত সরকার হয়েছে, তার মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন, যদিও সামরিক বিভাগ থেকে এসেছেন, তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি গঙ্গা বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ১৯৮৫ সালে। সেবারেই তাকে হত্যা করে ফেলা হয়। গঙ্গা বাঁধ আর হল না। গভর্নমেন্টের পরে গভর্নমেন্ট এসেছে, একটি পয়সা কেউ বাজেট হতে দেয় নাই গঙ্গা বাঁধ করার জন্য। জেনারেল জিয়াউর রহমান একমাত্র লোক, গঙ্গার পানি পাওয়ার জন্য যে প্রচেষ্টার কথা আপনারা বলেছেন তার সাথে একটু যোগ করতে হয়। তিনি পাঁচ বছরের যে চুক্তি করেছেন, তার মধ্যে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল। জেনারেল এরশাদ সেপ্টেম্বর মাসে ১৯৮২ সালে গিয়ে রেড কার্পেট অভ্যর্থনা নিলেন ইন্দিরা গান্ধী হতে এবং সেখানে পানি চুক্তি নবায়ন হয়েছে বটে। কিন্তু গ্যারান্টি ক্লজকে তুলে দিয়ে আসলেন। ফলে পানি আমরা পাই না। তারই ফলশ্রুতিতে আজকে ৩০ সালা চুক্তি এসেছে গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়া। কোন দেবদূত কি বলল আর কে সেখানে কি করেছে—এটা আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। আমার বিবেচ্য বিষয় হাসিনা সরকারের সময় যে চুক্তি সই করা হয়েছে, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সেই চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ আছে কি নাই। গ্যারান্টি ক্লজ নাই। অতএব এখানে পানি পাব না এবং পানি না পেলে অবস্থা যা হওয়ার, তা হবে। এ থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। এর একটাই মাত্র উপায়। গঙ্গা বাঁধকে অবিলম্বে নির্মাণ করা। তার পরে দেখুন, দেশের অর্থনীতি একে একে ধ্বংস করার পরে এখন দেখা গেল আমার দেশ মোটামুটিভাবে হিন্দুস্তানের খপ্পরে পড়ে গেছে। এরপর ঐ যে করিডোরের প্রশ্ন আসে। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে যে চুক্তি, আমি যদি আজকে প্রশ্ন করি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করার ফলে যদি আমার কনস্টিটিউশন ভায়োলেটও হয়ে থাকে, তাহলে আপনারা কনসিটটিউশন ভায়োলেশনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা অংশকে আগামী দিন তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার যদি দিতে পারেন, তাহলে আগামী দিনে বাংলাদেশকে তাদের হাতে তুলে দিলে নোবেল প্রাইজ দিবেন নাকি। আজকে সেই অবস্থায় দেশটাকে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি যদি পাশাপাশি একথা তুলি, সেভেন সিস্টারসের কথাটাও নিশ্চয়ই আসে। তারা আমার মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে। আমি তাদেরকে সাহায্য করতে চাই। তাদের মুক্তিযুদ্ধে আমি অংশীদার হতে চাই। বয়স আমার ৭০-এর উপরে, শরীর ভালো নয়; তো মন এখনো আমার সে দিকে আছে। আজকে আমার পাশাপাশি যদি ত্রিপুরা রাজ্যের কথা বলি। সেখানে আন্দোলন হচ্ছে। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব টিপরা। সে আন্দোলনে তারা মরেছে। তারা কোনো রিপাবলিক বলে নাই। তারা কোনো ডেমোক্র্যাসী বলে নাই। আমাদের ৪ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে বাঙালি হিন্দুদের স্থান দেয়ার জন্য। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে বাঙালি হিন্দুরা এসেছে, তাদের সংখ্যা এখন বিশ লাখ। আমাদের চার লাখ লোককে হত্যা করেছে। আজ এই হত্যার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি আমরা। যে মুক্তিযুদ্ধ তাদের, সেই মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে আপনারা কেন কার্পণ্য করছেন? ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে আমার এই প্রশ্ন, প্রশ্ন ইংল্যান্ডের কাছে। আমার এ প্রশ্ন বৃটিশদের কাছে। আমার প্রশ্ন আমেরিকানদের কাছে। আপনারা পার্বত্য চট্টগ্রামে কনস্টিটিউশনকে রেইড করার পরে ইউনাইটেড স্টেটকে ভেঙে ফেডারেল স্টেট বানাবার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হওয়ায় আগামী দিন কাজী লেনদুপের মত সিকিম যেভাবে, কাশ্মীর যেভাবে; কাশ্মীরের শেখ আবদুল্লাহ বেশি লাফালাফি করেছিল, স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। স্বাধীনতা ইন্দিরা গান্ধী তাকে দিয়েছে। জেলে রেখে দিয়েছে বারবার। ঠিক তেমনি সিকিমের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে আজকে ভারতের অংশ বানানো হয়েছে। আমার প্রশ্ন হল আগামী দিন যদি সেরকম হয়—অবশ্য দুর্জয় শক্তি জনতার আছে। একথা আমি বিশ্বাস করি। সুতরাং দেশকে রক্ষা করার জন্য, স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য জনগণের আজকে নেমে আসা প্রয়োজন।

ইন্দিরা গান্ধীর কাছে শেখ মুজিবুর রহমান বেরুবাড়ি তুলে দিলেন, আনলেন ‘নাকের বদলে নেরিন’। সেটা ৩ বিঘা। ৩ বিঘাও যখন সুপ্রীম কোর্ট শেষ পর্যন্ত আদেশ দিয়ে দিল বাংলাদেশকে হস্তান্তর করার জন্য, কিন্তু সে ৩ বিঘা হস্তান্তর করে নাই। আমার সরকাররা দয়া করে সেই ৩ বিঘা দিয়ে আসলেন কয়েক ঘন্টার মাঝে আল্টিয়ে পাল্টিয়ে এখানে আসা যাওয়ার জন্য। ওরা সিকিউরিটি বুঝে, আমরা বুঝি না। তেমনি বাংলার অর্থনীতিকে ভারত ‘৭২ সাল থেকে ‘৯৮ সাল পর্যন্ত ২৭,০০০ কোটি টাকা তারা এখানে রফতানি করেছে। সরকারিভাবে সারপ্লাস ২৭,০০০ কোটি টাকা বেসরকারিভাবে স্মাগলিং হিসাবে তাদের আর একটি হিসাব আমার কাছে আছে। ২৭,০০০ থেকে ৩০,০০০ কোটি টাকা। এর জন্য দায়ী কে। সরকার এটা বলুক। দায়ী আমাদের সরকার। সাপটা এগ্রিমেন্ট। হোয়াট ডু ইউ মিন বাই সার্ক। ফাইনান্স মিনিস্টার সাইফুর রহমান সাহেব সাপটা সই করালেন। শুল্ক ট্যারিফ যেটাকে বলা হয়, সেটাকে যে পরিমাণে আমরা কমিয়ে দিলাম, ভারত তার কাছেও যায় নাই। ফলে ভারতীয় দ্রব্য বিনা শুল্কে আসে। বিনা ট্যারিফে আসে, তার এক্সপোর্ট আমার দেশে বাড়ে, আমার এক্সপোর্ট তার দেশে বাড়ে না। এর জন্য দায়ী কে? সেজন্যই প্রশ্ন করেছিলাম। তখন মাহবুব উল্লাহ সাহেবকে। রাজনৈতিক দল যদি স্বচ্ছ না হয়, চরিত্রবান না হয়, নেতৃত্ব যদি চরিত্রবান না হয়, নেতৃত্বই মেটার করে, নেতৃত্বই দেশকে বিক্রি করে, যেমন শেখ মুজিব বিক্রি করেছে। যেমন কাজী লেন্দুপ দর্জি বিক্রি করেছে। যেমন তাজউদ্দিন আহমদ বিক্রি করেছে। সুতরাং নেতৃত্বের উপরই বড় কিছু নির্ভর করে। জনগণ নিরপরাধ, জনগণ নিরুপায়, তার নেতৃত্বের ওপর ভার দিয়ে দেয়। এখন আমার একটা প্রশ্ন এই গোলটেবিলে উপস্থাপন করা প্রয়োজন মনে করি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে, যারা নির্বাচিত হয়ে গিয়ে সরকার গঠন করেন বা অপোজিশনে যান, পার্লামেন্ট দখল করেন বা পার্লামেন্টে বিরোধী দল হিসেবে থাকেন, তারা কি দেশকে কিছু দিতে পারে? যে ৪ কোটি, ৫ কোটি, ১০ কোটি টাকা খরচ করে, সে উপার্জন করে সেই পথে এবং সেই পথেই পরবর্তীতে সবকিছু করবে দেশকে। আজকে কে শাসন করে? এদিকে কোটিপতিরা আর একদিকে সরকারি-বেসরকারি দুই আমলা মিলে। গুটি কয়েক এক্সসেপশন, যাদেরকে ব্যতিক্রম বলা হয়। ফলে হিন্দুস্তানের পক্ষে তাদেরকে কিনে নেয়া কিছু কঠিন নয়। যখন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাইয়ের জন্য রাউজানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানো হয়। দেখা যায় ১০০ মেগাওয়াটের ওপর উৎপাদন উঠতে পারে না, সেখানে ২০০ মেগাওয়াট লেখা আছে। কারণ যে টাকা জিয়াউদ্দিন বাবলু থেকে আরম্ভ করে সবাই খেয়েছে, তারা যে টাকা লুট করেছে, সেই পরিমাণে মেশিনারি খারাপ আনতে হয়েছে। আবার যেই টাকা লুট করেছে কাফকোর নামে, সেই এগ্রিমেন্ট সবাই আপনারা দেখতে পারছেন। হাজার কোটি টাকা এভাবে উপার্জন করবেন, আর দেশের অর্থনীতি সচল থাকবে—তার প্রশ্নই উঠে না। দেশের অর্থনীতি এখন নেই। অতএব আমরা নিজেরাই নিজেদের অর্থনীতি হিন্দুস্তানের হাতে তুলে দিচ্ছি। সাঙ্গুর যে এগ্রিমেন্ট হয়েছে, সেই এগ্রিমেন্টের গ্যাস আমরা সেভেনটি নাইন পার্সেন্ট পাব না। টুয়েন্টি ওয়ান পার্সেন্ট পাব এক হিসেবে, এক হিসেবে সেভেনটি সিক্স পার্সেন্ট পাবে তারা, আমরা পাব মাত্র টুয়েনটি ফোর পার্সেন্ট। আমার দেশের গ্যাস আমি উত্তোলন করি, আমরা এখানে ব্যবহার করতে পারব না, আমার টাকা লুট করে এখান থেকে নিয়ে যাবে। এভাবে অর্থনীতি চালালে পরে হিন্দুস্তানকে মুকাবিলা করার জন্য যে মানসিক শক্তি ও শারীরিক শক্তি দুটা প্রয়োজন এটা কি সম্ভব? অতএব প্রশ্ন হল আজকে এদেশে প্রেসিডেন্ট নাসের ক্ষমতা দখল করেনি, যে সুয়েজ খালের জন্য মন-প্রাণ দিয়ে জান বাজি রেখে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পাশে এসে গিয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া। সুতরাং আজকে প্রশ্ন পরিষ্কার আমি কখনো সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে ছিলাম না, এখনো না। কিন্তু কসোভো আমার। কসোভোতে যারা বাস করে তারা আমার মত, ধর্ম বাদ দিলেও তাদের প্রতি যে নির্যাতন করা হচ্ছে, বাড়ি হতে তাড়ানো হচ্ছে, মারা হচ্ছে, রেপ করা হচ্ছে, এদের পক্ষে কাউকে না কাউকে দাঁড়াতে হবে। শক্তিশালী হিসেবে আমেরিকা ন্যাটো দাঁড়ানোয় আমি খুব খুশি এবং ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কে দাঁড়িয়েছে আজকে। সোভিয়েত রাশিয়া, ভারত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় চীন। সুতরাং আন্তর্জাতিক ন্যায়নীতি কোথায় সেটা আমরা দেখতে পাই। এখানে যেমন গণতন্ত্র হয় না, কয়েকজনের লুটপাটের ব্যবস্থা হয়, ঠিক সমগ্র পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক আইনও বড়দের পক্ষেই থাকে। আজকে যদি সোভিয়েত রাশিয়া পারত তাহলে প্রেমাকভ সাহেব চুপ করে থাকতেন না। উনি শ্লোভাকদের নাম দিয়ে পরিষ্কারভাবে সৈন্য সেখানে পাঠিয়ে দিতেন। পরিষ্কারভাবে জেট বিমান পাঠিয়ে দিতেন। সেই শক্তি নেই বলে ন্যাটোর বিরুদ্ধে কিছু করতে তিনি সাহস পাচ্ছেন না। কি আনাগোনা তিনি করছেন। এ জন্যই আজকে আমার দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়-দায়িত্ব জনগণের ওপর। আবার জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আছে, অতীতে যাদের সংগ্রামী হিসেবে জেনেছি, যেমন ড. মাহবুব উল্লাহ, যেমন ড. আফতাব আহমাদ, যেমন আনোয়ার জাহিদ সাহেব, জনাব সাদেক খান সাহেব, তাদেরকে আমি নিজে দেখেছি। তাদের সাথে সংগ্রাম করার ব্যাপারটা আমার কাছে একটা আনন্দের ব্যাপার ছিল। তাদের ওপরও অনেকটা নির্ভর করে। দেশে চরিত্র বলে কিছু নেই। দুর্নীতিবাজে দেশ ভরে গেছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। রাজনীতি স্বচ্ছ কখনো হবে না। দুর্নীতি যদি দূর না হয়। কি সব মামলা দেন, গডফাদাররা সবই বেঁচে যায় আর তরিকুল ইসলাম সাহেবের মত একজন ভদ্রলোককে আসামী করা হয় রানার পত্রিকার সম্পাদক মুকুলকে হত্যা করার দায়ে। অথচ জনকণ্ঠের রিপোর্ট অনুযায়ী হাসান বলে এক লোক, গড়ফাদার পরিচালিত এক সাসা, যে হত্যা করেছে সে এখন ঢাকায় আছে। কাদের বাড়িতে আছে সেটা বের করা হোক। মন্ত্রীর বাড়িতে আছে কি না? সেক্রেটারির বাড়িতে আছে কি না? শিল্পপতির বাড়িতে আছে কি না? এগুলো ইনভেসটিগেশন করে বের করা দরকার। আলমগীর কবির একজন ভদ্রলোক এবং সংগ্রামী। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি খুন করতে যাবেন? হ্যা যুদ্ধে খুন করবেন। কিন্তু একটা লোককে গুণ্ডামী করার মানসিকতা নিয়ে হত্যা করবেন, এ প্রশ্ন তার বেলায় উঠতেই পারে না। কিন্তু তাকে আজকে জেল খাটতে হয়। পানি নিয়ে, বিদ্যৎ নিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তা থরথর করে কাপে। খারাপ বললেও আজকে একটি কথা বলতে হয়, যদি শেখ মুজিবুর রহমান আজকে এ অবস্থায় থাকতেন তখন তিনি জনসভা ডেকে দিয়ে স্ট্রাইক ঘোষণা করে দিতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত পানি পাব না, যতক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যুতের ঝামেলা যাবে না এবং না পারলে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা পদত্যাগ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আমার স্ট্রাইক চলবে। এ রকম কর্মসূচি আমরা দিতে পারি না। আমরা আসি, সুন্দর জায়গায় ফ্যানের নিচে বসি, কথা বলি, পত্রপত্রিকায় ছবি ওঠে। চলে যাই, সেরে যায়। এটা আন্দোলন নয়, এটা আন্দোলন আন্দোলন খেলা। অত্যন্ত দুঃখ লাগে ‘৪৮ সালের কথাই বলি, যেদিন আমাদেরকে কাফের বলত। হিন্দুস্তানের সন্তান বলত। সেই ‘৪৮ সালে যদি আমরা মাঠে না নামতাম, রাস্তায় না নামতাম, নাজিমুদ্দীন সাহেবের সেক্রেটারিটকে ঘেরাও না করতাম, পিটুনী সেখানে না খেতাম, জেলে না যেতাম, তাহলে আজকের অবস্থা ফিরে আসত না। ‘৫২-এর কথা তো বলার প্রয়োজনই নেই। আমি গোড়ার কথাই বলে গেলাম। তাই আজকে আমাদের কাছে প্রশ্ন সংগ্রাম করে বাঁচব, চরিত্র নিয়ে বাঁচব, চরিত্রবানদের সাথে উঠাবসা করব, নীতিনিষ্ঠ যারা তাদের সাথে উঠাবসা করব, না কি গড়ফাদারদের কাছে আত্মসমর্পণ করে তাদের নিকট থেকে টাকা নিয়ে নির্বাচন করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে তাদেরও দেব, নিজেও খাব। সেটারই কি ব্যবস্থা হবে? এ রাষ্ট্রব্যবস্থা আমি মানি না। পরিতাপের বিষয়, গত নির্বাচনে ড. কামাল হোসেন ধানমন্ডি এলাকাতে দাঁড়িয়েছিলেন। ড. কামাল হোসেনের সাথে আমার রাজনৈতিক দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু উনার লেখাপড়া সম্পর্কে আর জ্ঞান সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তিনি পরাজিত হয়েছেন। তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সেখানে কে নির্বাচিত হয়েছেন? দুর্নীতির জন্য, চোরাকারবারের জন্য, ব্লাক মার্কেটিংয়ের জন্য যার সাজা হয়েছিল, সেই মকবুল আহমদ। গ্রেফতার হয় তরিকুল ইসলাম সাহেব, গ্রেফতার হয় না মকবুল। যে না কি হত্যা করেছে সজলকে। যার মামলাও হয়েছে। গ্রেফতার হয় না বোমা রাখার জন্য, বোমা তৈরির জন্য সুনামগঞ্জের সেই সরকারি দলের সংসদ সদস্য। এ অবস্থা শেখ হাসিনা সরকার তো করবেই। শেখ হাসিনা যে অবস্থায় দেশকে আজকে নিয়ে আসছে, যেভাবে পাবনার নির্বাচন করেছে। আমরা তো আল্ডার ডেভেলপ কান্টি। চরিত্রও খারাপ। টাকা-পয়সাও নাই। আমরা চোরও। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই। কিছুই নেই। ডেভেলপড কান্ট্রিতে যা হয় না, আমাদের এখানে তাই দেখানো হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হাবিবুর রহমান সাহেব, আপনি কি লেখাপড়া মোটেই জানেন না? আমি যে তথ্য দিলাম এটা কি আপনি অস্বীকার করতে পারবেন? আপনি কি কোনো দিন বলেছেন, এ নির্বাচন আমি গ্রহণ করি না। ডেভেলপড কান্ট্রিগুলো আমার সামনে উদাহরণ। আপনার চরিত্র তো আমার জানা আছে। আপনার তকদির ভালো, আমারই ওয়ার্কার ছিলেন, সেটা বলব না, আল্লাহ মাফ করুক। একসঙ্গে কাজ করেছি সেটাই বলব। আপনি সুপ্রীম কোর্টের মেম্বার কি করে হলেন, সেটাও জেনারেল এরশাদের দয়া, একটার জায়গায় দু’টা প্রোমোশন দিয়ে আপনাকে সুপ্রীম কোর্টের মেম্বার করেছে। আপনি ভুলে যেতে পারেন, আইনকে ভুলতে পারেন, জাস্টিসকে ভুলতে পারেন। কিন্তু ভোলা ঠিক হয়নি। ‘৯৬-এর নির্বাচনও তাই, ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আমি সমর্থন করি না। আমার কাছে গিয়েছিল আমি অস্বীকার করেছি। কথা বলতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছি। কাউকে কাউকে রাজাকার বলে গালিও দিয়েছি। সে আমার সাথে তো দেখা করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তাই বলে জনাব হাবিবুর রহমান সাহেব, জাস্টিস হয়ে আপনি এই ধরনের নির্বাচন করে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে গেলেন, আপনার কি বিবেকে লাগে নাই, সার্ভিস রুল অনুযায়ী জনতার মঞ্চে মহিউদ্দিন খান আলমগীর এবং অন্যেরা যারা বক্তৃতা করেছে, আদালত করেছে, তারা এক দিনের জন্য, এমনকি এক মিনিটের জন্যও সরকারি চাকরিতে থাকতে পারে না। তাদেরকে সাসপেন্ড করা, ইনকোয়ারি করা, তারপর ব্যবস্থা গ্রহণ করা—এটাই ছিল আপনার দায়িত্ব। হাবিবুর রহমান সাহেব, সে বক্তব্যই কি আপনি পালন করেছেন? পালন করবেন না ভয়ে ডেইলী স্টারে দুইটা লেখা আমি দিয়েছিলাম। তার মধ্যে আপনার নামে পরিষ্কারভাবে সেখানে আপনাকে বলেছি, এর সাথে অবশ্য প্রশ্ন আছে জড়িত। তখনকার মন্ত্রীসভা—তাদেরও দায়িত্ব আছে। যেইমাত্র আলমগীর মহিউদ্দিন সেখানে গেল জনতার মঞ্চে, তখনই তাকে সাসপেন্ড করা উচিত ছিল। ফলে আজকে সামগ্রিকভাবে চরিত্রের ধস হয়েছে। কেবল মন্ত্রী হওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাই, মন্ত্রিত্বের ভাগ হতে লুট করতে পারলে আরো বেঁচে যাই। এর ফলটা কি দাঁড়িয়েছে? সার্বিকভাবে দেশ আজ ধ্বংস আর দেশ ধ্বংস হয় আমার মত লোক, গরিব মানুষ যে কি না পালাতে পারব না, আমাকে মরতে হবে। যুদ্ধ করার মত প্রাণশক্তি থাকা সত্ত্বেও শারীরিক শক্তি না থাকার কারণে সেটা করতে পারবে না। কিন্তু মাহবুব সাহেব উঠে দাঁড়ালে আমি তো তা পারব না। এই জন্য আমার প্রশ্ন, আমরা দেশকে রক্ষা করার জন্য যে দায়-দায়িত্ব আমরা বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ করি, সেই দায়-দায়িত্ব কি আমরা পালন করি? সুন্দর শব্দ কিছু শিখেছি। জনাবা প্রধানমন্ত্রী আপনি একাউন্ট্যাবিলিটির অর্থ বোঝেন? আপনার নকলের কথা কি আপনার মনে পড়ে? আপনি একাউন্ট্যাবিলিটির কি বোঝেন? কেউ বলে দেয়, সাথে সাথে বলা শুরু করেন। আবার ট্রান্সপারেন্সী—এ শব্দ তো আপনার পিতাও শোনে নাই। আবার ট্রান্সপারেন্সীও বলেন। সুতরাং দেশটাকে এভাবে ধ্বংস করা উচিত নয়।

আপনার বোন যখন বিচিত্রার মালিক হয়, পঞ্চাশ লক্ষ টাকার গুডউইল নিয়া কয় টাকা জমা দিয়েছেন? তখন লজ্জা করে নাই আপনার? আপনার বোন যখন বাহরাইন ব্যাংকের ডাইরেক্টর হয়, সেই টাকা কোথায় পেলেন? বাহরাইনে কি করে এ টাকা গেল? এর উত্তর কি আপনি দিতে পারবেন? আরে আমার কাছে ফিরিস্তি আছে অনেক বড়, কে কি করছেন। তারা আজকে দেশটাকে করাপশনে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে, এখন খালি টাকা চাই। স্মাগলিং চাই। গড়ফাদার চাই। মারো, লুটো এটাই একমাত্র কাজ। এর বিরুদ্ধে দরকার এক শক্তি গড়ে উঠার। কবি আবদুল হাই শিকদার সাহেব, আমার মত নগণ্য লোক আপনাকে প্রশংসা করার উপযুক্ত নই। আপনার কলমে যা বের হয়, এ শক্তিও আমার নেই। কিন্তু আমার মনটা হয়ত কাঁদে। মনটা হয়ত চায়, কিন্তু বলার মত শক্তি আমার নেই। আমি মনে করি, এ ধরনের আরো অর্গানাইজ করবেন। কিন্তু অর্গানাইজেশনটা যেন বৃথা যায় না। এখানে আসলাম, দু’কথা বলে গেলাম, পত্রিকায় ছবি উঠল, পত্রিকায় নাম ছড়ালো, সেটাই যেন একমাত্র লক্ষ্য না হয়। আজকে সবচেয়ে বেশি দরকার যুব সম্প্রদায়কে, যাদের বেরিয়ে আসতে হবে, তারা কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি বন্ধ করলে চলবে না, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির প্রফেসরকে মারলে চলবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে নকল করতে না দিলে তার জন্য যন্ত্রপাতি ভাঙতে হবে; স্ট্রাইক করতে হবে—এটা কখনো হতে দেয়া যায় না। দুঃখের বিষয়, পরিতাপের বিষয়, আমি একটি বিবৃতি পাঠিয়েছিলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর ও টিচার্সদের আপিলের জবাবে। সেই বিবৃতি কোন পত্রিকা ছাপে নাই। গুণ্ডা গুণ্ডাই—সে যে দলের হোক না কেন? আজকে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এটা আলটিমেটলি ভারতের লাভ। এটা বন্ধ করার ওদের প্রয়োজন আছে। কোনো পত্রিকা ছাপাবে না। কথা বলব কোথায়? আবার রোড ট্রান্সপোর্টের কথা বলেছেন, কলকাতা থেকে বাস আসে, কলকাতা বাস যায়। রোড ট্রান্সপোর্ট এগ্রিমেন্ট হয়, আমার তো সে শক্তি নাই। সেই অর্থের জোর নাই যে আমি বাস ভরে লোক নিয়ে আসব। আমি পল্টনে দাঁড়িয়ে বলব এই এগ্রিমেন্ট মানি না। এই এগ্রিমেন্টের বিরুদ্ধে আমি স্ট্রাইক ঘোষণা করলাম। শক্তি যাদের আছে, তারা তো করেন না। তাহলে আমাকে বলেন, আপনাদের কি জবাব আছে। এর বেশি কি আমাদের কোনো লাভ আছে? হয়ত একদিন শুনবেন আমিও বিদায় নিয়েছি। ইচ্ছাকৃতভাবে এভাবে বাঁচার কোনো দাম নেই। যে বাঁচায়, বারবার আত্মসমর্পণ করতে হয়, নিজের বিবেককে বিক্রি করতে হয়, নিজের বিবেক অনুযায়ী দাঁড়াতে পারি না, যুদ্ধ করতে পারি না, সংগ্রাম করতে পারি না, কিলাকিলি করতে পারি না। এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আমার জন্য কিছু নয়। সুতরাং আজ যারা বড় বড় দল করেন, তাদের দায়-দায়িত্ব রয়েছে, আমরাও বড় দল কোনোদিন করেছি, যেদিন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি নিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে লেগে গেল, সোহরাওয়ার্দী সাহেব ক্ষমতা দিতে চাইলেন—নিলাম না। সেদিন কিন্তু বেরিয়ে এসেছিলাম, বরং আমাকে বের করে দিয়েছিল। এবং সেটাকে স্বাগত জানিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। এভাবে বাকি সব বলে লাভ নেই। কত জনে কি দিতে চেয়েছেন, কতজনে কি অফার নিয়েছেন, সেগুলো বলে লাভ নাই। এটা হল নিজের বাগাড়ম্বর। এই বাগাড়ম্বরের মধ্যে আমি ঢুকতে চাই না। কিন্তু এটা ঠিক, দেশকে রক্ষা করার জন্য আপনাদের সাংবাদিকদের দায়-দায়িত্ব আছে। এবং কোদালকে কোদাল বলতে হবে। এটা করতে পারলেই আজকে সেভেন সিস্টারকে সাহায্য করা সম্ভব হবে। সেভেন সিস্টারও আমাদের সাহায্য করতে পারবে। আবার চট্টগ্রাম পোর্ট কিছুতেই হিন্দুস্তানের দখলে যাবে না। লিখিত-অলিখিত যে দলিলই থাকুক না কেন, যদি সেই তারিখে যে তারিখে সই করেছে, ডিসেম্বরের ২ তারিখে, ১৯৯৭ সালে আমরা যদি নেমে যেতাম চট্টগ্রামে ডাক দেবার পরে, তবে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। যখন সব স্তিমিত হয়ে যায়, মরে যায়, মনের সাহস চলে যায়, দুর্বলতা এসে যায়, তখন হঠাৎ ঘোষণা করা হয় সাধারণ ধর্মঘট। ড. মাহবুব উল্লাহ সাহেব, আপনারা তো আন্দোলন করেছেন, ড. আফতাব আপনারা তো আন্দোলন করেছেন, রক্তের বদলা রক্ত নিতে চেয়েছেন, যার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশকে টিকানো আপনাদেরও কর্তব্য। আপনাদের দায়দায়িত্ব ডিপ্লোম্যাটিক ফ্রন্টে যে রকম, পিপলস ফ্রন্টেও তেমনি। পিপলস আপনাদের পক্ষে আছে এটা হল দুর্জয় সত্য। ভারত তার সৈন্য আনুক আর যাই আনুক না কেন, আমার জনতা যখন হাটে-মাঠে, জলে-স্থলে তাকে আঘাত করতে আরম্ভ করবে, তার পক্ষে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। যেমন হয় নাই হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে। তারাও চেয়েছে তাদের চোখের সামনে ধূলা দিয়ে চলে গেছি আগরতলা। আপনারাও বারবার এসেছেন, গেছেন। কারণ পিপল ছিল আমাদের সাথে। ঘরে ঘরে আমাদের দুর্গ ছিল। সেই দুর্গ আজকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে। সে দুর্গ গড়ার উপর নির্ভর করবে আগামী দিনের সংগ্রামে আমরা বাঁচব কি বাঁচব না। হিন্দুস্তান বড় হউক, ছোট হউক, ফিজিক্যালী বড় হউক, মাসল পাওয়ার হউক, সব সত্য। কিন্তু হিন্দুস্তান শ্রীলংকাকে কি করছে? সবাই জানেন। হিন্দুস্তান ভুটানে কি করে, সেটাও আপনারা জানেন। আমি একমাত্র বলি, আপনাদেরও বলা উচিত সবাই, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি চাই পানির। পানির পলিসি ওয়ার্ল্ডে একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই কথা হচ্ছে যদি কোনো যুদ্ধ হয়, ওয়াটার ফ্রন্টে যুদ্ধ হবে। পানির জন্য যুদ্ধ হবে। দেশে-দেশে, এলাকায় এলাকায়। সেই পানি আজকে আমাদের প্রয়োজন। মরি-বাচি পানি আদায় করতে হবে। মরি-বাচি গঙ্গা বাঁধ করতে হবে। মরি-বাচি ব্রহ্মপুত্র বাঁধ করতে হবে। মরি-বাচি আজকে তিস্তা ব্যারেজকে চোরেরা কোটি কোটি টাকা লুট করে ধ্বংস করে দিতে চাইছে, সেই তিস্তা ব্যারেজকে বাঁচাতে হবে। তার জন্য যা করণীয় তা করতে হবে।

নাহলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা হবে না। দেশের অধিকার। প্রতিষ্ঠিত হবে না। অর্থনৈতিক অধিকার যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, রাজনৈতিক অধিকারের এক পয়সারও দাম নাই। রাজনৈতিক অধিকার তো সবারই আছে। যেমন আছে নেপালে। কী হয় ঐ ইন্ডিয়ান কারেন্সী চলে। রাজনৈতিক অধিকার আমাদের হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের পরে ইন্ডিয়ান কারেন্সীতে আমার দেশের মাল কিনে নিয়ে যেত। আমার নিজের চোখের দেখা, সুতরাং রাজনৈতিক অধিকারের সাথে সাথে আমাদের অর্থনৈতিক অধিকার, আর্থিক শক্তি বাড়াবার জন্য যে প্রচেষ্টা, সেটা আমার চাই। কেন জুট মিল আমার টিকবে না, কেন জুট মিল লুটেরারা লুট করে যাবে। কেন জুট মিলের মধ্যে স্ট্রাইক চলবে? কেন জুট মিল বিদেশের সাথে রফতানি বাণিজ্য করতে পারবে না। কেন পলিথিন চলবে? পলিথিন ব্যাগ বন্ধ করা হয়েছিল না? আদেশ দেয়া হয়েছিল বোধহয় ১৯৯৩ সালে যে পলিথিন ব্যাগ আর ইউজ করা যাবে না। কয়েক দিনের মধ্যে ইনশাল্লাহ, টাকা খেয়ে অর্ডার বদলিয়ে দিলেন। আজও পলিথিনের ব্যাগ হয়। অতএব এই যে ঘুষের খেলা, এই যে টাকার খেলা, এই যে ঘর বাঁধার খেলা, এই যে গাড়ি করার খেলা। সামান্য পুলিশ অফিসার কা পয়সা বেতন পায়, তার নাকি এসি, দুইটা বাড়ি, দুইটা গাড়ি, ১৫ হাজার টাকা নাকি ভাড়া, ৪ হাজার টাকা নাকি সার্ভিস চার্জ। আবার আরেক পুলিশ অফিসার, সিআইডিতে চাকরি করে। ইন্সপেক্টর। তারও দেড় কোটি টাকার বাড়ি। তারও গাড়ি, ড্রাইভার। কোথা থেকে টাকা আসে এগুলো হাসিনা দেখে না? এগুলোর জন্য এমন আইন হতে পারে না? এদের জামিন দেয়া যাবে না, ফাঁসি দেয়া হবে। কয়েকটা ফাসি দিয়ে দেখুক। দেখি আবার সন্ত্রাস হয় কি না। দেখি আবার করাপশান হয় কি না। এভাবে সার্বিকভাবে দেশটাকে একটা রাস্তায় নিয়ে আসতে হবে। গ্যাস বিক্রি করবা? তুমি আমেরিকা, তুমি গ্যাস বিক্রি কর না কেন? তোমার মজুদ গ্যাস, তোমার মজুদ পেট্রোল বিক্রি কর না কেন? তুমি কেন আরব দেশে যাও? ওখানকার পেট্রোল লুট করার জন্য? কারণ ভবিষ্যতে যে পেট্রোল ফুরিয়ে যাবে তখন তোমার এই পেট্রোলের প্রয়োজন। তোমার এ গ্যাসের প্রয়োজন। তাই আমার দেশের গ্যাস লুট করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আজকে চেষ্টা চলছে এবং সেটা ভারতকে দেয়ার জন্য। তারা এক্সপোর্ট করার কথা বলে। আমার গ্যাস আমি এক্সপোর্ট করব কি করব না, আমার গ্যাস আমার প্রয়োজন মিটাতে পারবে কি পারবে না, আমার বাপেক্স রয়েছে, আমার পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন রয়েছে, তারাই ভালো করে বলতে পারে, সেখানে কেন যাবে সেটা?

এই যে সার্বিকভাবে দেশটাকে বিক্রি করার জন্য নেতাদের কম্পিটিশন, ক্ষমতা দখলের কম্পিটিশন, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট খাওয়ার কম্পিটিশন। হংকং ব্যাংকে টাকা জমা হয়। তার বিরুদ্ধে স্বয়ং ডাইরেক্টর জেনারেল, নাম বলব না এখন, তিনি একজন সিএসপি অফিসার, এখন অবশ্য হাসিনাও তাকে এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি থেকে সেক্রেটারি কিছুতে করে না, কারণ তার পক্ষের লোক নয় সে। তিনি কারো পক্ষের লোক নন। তিনি হলেন এডমিনিস্ট্রেশনের পক্ষের লোক। তিনি তাকে প্রসিকিউট করেছেন। এভাবে তো দেশ চলতে পারে না। সেজন্য সাদেক খান সাহেব সম্পর্কে আমার বক্তব্য, একদিন আপনার সাথে আমি কাজ করেছি এবং আপনার সিনসিয়ারিটি আমি দেখেছি। আজকের কথা আমি বলতে পারি না। তখনকার সিনসিয়ারিটি আমি দেখেছি। শিক্ষা সম্মেলনে আপনার যে দান, আমি তো ‘ব’ কলম, লিখতে জানি না। আপনি লিখে দিতেন, সেগুলো আমার মনে আছে, আপনারও একটা ভূমিকা, শুধু পত্রিকায় লেখা না। অন্য জায়গাও একটু নামা দরকার হয়ে পড়েছে। আর বাঁচবেন কত? বেঁচেই বা লাভ কি? দেশই যদি না থাকে, জনতাই যদি না থাকে, লুটেরাই যদি থাকে, লুটেরাই যদি শোষণ করে। লুটেরাই যদি বাড়ি-ঘর করে, লুটেরাই যদি অত্যাচার করে, লুটেরাই যদি রেপ করে বেড়ায়। তার বিরুদ্ধেই যদি আমরা কিছু না বলতে পারি, দাঁড়াতে না পারি, দুঃখজনক হবে। তো আমি আমার বক্তব্য অনেক বড় করে ফেলেছি। বোধহয় খুব অন্যায় করে ফেলেছি। আমি আপনাদের সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমার বক্তব্য আজকে এখানেই শেষ করলাম। তো আগামী দিনে আশা করি এ ধরনের অনুষ্ঠান আরো হবে, কিন্তু অ্যাকশন প্রোগ্রাম সম্পর্কেও সবাই একটু চিন্তা করেন। এই বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি। খোদা হাফেজ।

আবদুল হাই শিকদার : অনেক দীর্ঘ এবং প্রাঞ্জল, প্রাণবন্ত, সময়োপযোগী বক্তব্যের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

পরিশিষ্ট-গ

জাতীয় সংবর্ধনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ

অলি আহাদ মহান ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা

—খালেদা জিয়া

[১২ মার্চ, ১৯৯৯ শুক্রবার বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে জননেতা অলি আহাদের জাতীয় সংবর্ধনা কমিটির সভায় প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রদত্ত ভাষণ]।

মাননীয় সভাপতি, বিদ্রোহী জননেতা অলি আহাদ ও সুধীমণ্ডলী আসসালামু আলাইকুম। আজ আমরা যে জনপদ এবং যে রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশক থেকে পরবর্তী প্রতিটি দশকের বিশাল সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। আমাদের বর্তমান সত্তা ও মননকে নির্মাণ করেছে। আর এই প্রতিটি দশকেরই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে।

প্রত্যেক জাতির জন্য ইতিহাস-বোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস-বোধ একটি জাতির আত্মােপলব্ধিকে স্বচ্ছ করে, চেতনাকে শানিত করে এবং জাতীয় প্রত্যয়কে নতুন নতুন বিজয়ে অনুপ্রাণিত করে। ইতিহাসই যুগে যুগে এক-একজন মহান ব্যক্তিত্বের মানুষকে সৃষ্টি করে। আবার বিরল প্রতিভা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মহানায়কেরা নতুন ইতিহাস রচনা করেন, সমাজকে বিকাশের নতুন সোপানে অধিষ্ঠিত করেন, জাতিকে সঙ্কট উত্তরণের দিকনির্দেশনা দেন এবং মানুষকে মহৎ মর্যাদা দেন। আমাদের সমকালে অলি আহাদ এমন একজন মানুষ।

৪০-এর দশক ছিল বৃটিশ উপনিবেশবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচাইতে ঘটনাবহুল এবং চূড়ান্ত বিজয়ের দশক। আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষ এবং নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দশক। অলি আহাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরু এই দশকে। এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক সামাজিক নিপীড়ন বিরোধী লড়াই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে তিনি ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। চূড়ান্ত বিচারে এ লড়াই-ই হচ্ছে সর্বোত্তম গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত স্বদেশ, নিপীড়ন ও বঞ্চনামুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ এবং সমৃদ্ধ সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন সেদিন তাঁকে গৃহের নিরাপদ অবস্থান থেকে রাজনীতির বন্ধুর পথে টেনে। এনেছিল।

৫০-এর দশক ছিল এই স্বপ্নভঙ্গের দশক। নিপীড়ন ও বঞ্চনামুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ এল না। আমাদের জাতিসত্তার উপর আঘাত এল। ‘৫২’র ভাষা আন্দোলন ছিল তারই বিরুদ্ধে গর্জে উঠা। ইতিহাস বিকৃতির শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ সত্যটি আজ ১২ কোটি মানুষের কাছে স্পষ্ট যে, অলি আহাদ মহান ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা। এই দশকেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং সকল মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে উঠে। এ সংগ্রামেও মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী নেতা অলি আহাদ। এই দশকেই অন্যান্য গণতন্ত্রকামী নেতা ও কর্মীদের সাথে অলি আহাদের জেল জীবনের শুরু। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে ৬০-এর দশকের পুরোটাই ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাল। এখানেও এনডিএফ গঠন থেকে সকল পর্যায়ে অলি আহাদের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

৭০-এর দশকের প্রথম পাচ বছর ছিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী কালের ভারতের পুতুল সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ফ্যাসিস্ট একদলীয় শাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অসম সাহসী লড়াই-এর বছর। রাজনৈতিক নেতা অলি আহাদ এই দুই লড়াই-এ সামনের সারিতে ছিলেন। তাঁর পত্রিকা সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ তখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রাজনীতিবিদ অলি আহাদ এবং সম্পাদক অলি আহাদকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। ইত্তেহাদ নিষিদ্ধ হয়েছিল।

৮০-র দশকে গণতন্ত্র এবং সংবিধানের উপর আবার যখন আঘাত এল অলি আহাদ রাজপথে নেমেছিলেন।

আমাদের জাতি এবং ইতিহাসের একটি দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা গণতন্ত্রের পথে, প্রগতির পথে পা যখনই বাড়িয়েছি তখনই দেশি ও বিদেশি প্রতিকূল শক্তি আঘাত হেনেছে, সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। এই দশকের প্রথম ৫ বছরে আমরা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলাম। সংবিধানকে তার মহৎ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলাম। অর্থনীতিকে জনকল্যাণমুখী বিকাশের পথে এনেছিলাম। রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে বিশ্বদরবারে সমুন্নত করেছিলাম। ৯৬-এর। সাজানো নির্বাচনের পর জাতীয় বিশ্বাসঘাতক গণতন্ত্র হত্যাকারীরা ক্ষমতা দখলের পর সবকিছু আবার তছনছ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা এবং অখণ্ডতা, সংবিধান, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, জাতীয় সংস্কৃতি এবং আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ সবকিছুই আজ আবার বিপন্ন। আজকের লড়াই তাই সর্বাত্বক।

৪০-এর দশকের তরুণ অলি আহাদ আজকের বর্ষীয়ান জননেতা অলি আহাদ আবারো সংগ্রামের প্রথম সারিতে এসে দাঁড়িয়েছেন।

অলি আহাদ আমাদের রাজনীতিতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। নীতির প্রশ্নে তিনি। কখনও আপোস করেননি। প্রলোভন কখনও তাকে বশীভূত করেনি। বলা যায় আজ জাতির বিবেক’-এ পরিণত হয়েছেন।

আজ আমরা এখানে জনাব অলি আহাদকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য সমবেত হয়েছি। তাঁকে সর্বোত্তম সম্মান আমরা কি দিতে পারি? আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান গণবিরোধী, সংবিধান লঙ্নকারী, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডত্ব এবং অস্তিত্ব বিরোধী শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঐক্য আমরা গড়ে তুলেছি তাকে আরো দৃঢ় করা এবং যে সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাচিছ তাকে সফল করাই হবে জননেতা অলি আহাদের প্রতি জাতির দেয়া সবচাইতে বড় সম্মান। স্বাধীন স্বদেশ, গণতান্ত্রিক সমাজ এবং সমৃদ্ধ সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে অলি আহাদি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। আসুন আমরা সেই স্বপ্ন বাংলাদেশে মূর্ত এবং অক্ষয় রূপ দিই।

আমি জনাব অলি আহাদের সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবনের জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে দো’আ করছি।

অলি আহাদ সাহেবের কথা

বদরুদ্দীন উমর

অলি আহাদ সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয় হয় ঢাকায়। ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে। ঐ বছরই পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন ছিল আমার আইএসসি পরীক্ষা। বর্ধমানে সে সময় পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমি ঢাকায় আসি ১২ এপ্রিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে তখন কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের পরীক্ষার্থীদের জন্য। সেই অনুযায়ী এপ্রিল-মে মাসে আমি ঢাকায় পরীক্ষা দিই। আবদুল জলিল সাহেব কলকাতায় মুসলিম লীগের একজন কর্মী ছিলেন। তিনি কলকাতায় আমাদের বাড়িতে অনেক দিন ছিলেন। বিয়ের পর ১৯৪৬ সালে অন্য বাড়িতে উঠে যান। ঢাকায় এসে আমি জলিল সাহেবের বাসায় উঠি। তাঁর স্ত্রী জয়নাব আখতার ছিলেন একজন ভালো ছাত্রী এবং সরকারি ইডেন কলেজের অধ্যাপক। যতদূর মনে হয়, জলিল সাহেবের বাসাতেই অলি আহাদ সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়।

আমার আববা আবুল হাশিম সাহেব সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন ১৯৫০ সালের ২২ এপ্রিল। জলিল সাহেব তাঁদের জন্য ২১ নং গোপীবাগ থার্ড লেনে একটি বাড়ি ভাড়া করে দেন। তারা ঢাকায় এসে সেখানেই ওঠেন। কলকাতা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দে এসে স্টীমারে তারা নারায়ণগঞ্জে আসেন। সেখান থেকে ঢাকায়। আমি পরীক্ষার জন্য নারায়ণগঞ্জ যেতে পারিনি। যারা গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অলি আহাদ সাহেব ছিলেন। ঢাকায় আসার আগে পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগের অল্প বয়স্ক নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের মধ্যে আমাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেব এবং মুন্সীগঞ্জের শামসুদ্দীন আহমদ সাহেবের সাথে। এছাড়া বরিশালের নুরুদ্দীন আহমদ সাহেব দেশবিভাগের আগে কলকাতায় ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের তথাকথিত বাম অংশের প্রধান ও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাকেও ভালোভাবে চিনতাম। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র এবং মুসলিম ছাত্রলীগের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী ছিলেন। তিনি আমাদের বাসায় আসতেন, কাজেই তাঁকেও চিনতাম। এরা সকলেই আমার বর্ধমান ও গ্রামের বাড়িতেও গেছেন।

কমরুদ্দীন আহমদ সাহেব, তোয়াহা সাহেবের সাথে ঢাকায় আসার পর অনেক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হলেও তাঁদের সাথে কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না, যেমন ছিল না অলি আহাদ সাহেবের সাথে। প্রথম দুজনের লেখাতেই দেখেছি যে, তারা আমাদের গ্রামের বাড়িতেও গেছেন। কিন্তু তখন তাদের সাথে কোনো পরিচয় হয়নি। জলিল সাহেবের বাসায় যখন অলি আহাদ সাহেবের সাথে দেখা হয় তখন তিনি আর ছাত্রলীগ বা মুসলিম লীগ করতেন না, কিন্তু অন্য কোনো সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন না, যদিও নানাপ্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা তার ছিল। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বহিষ্কার করে। যেসব ছাত্র সেই ধর্মঘটের সাথে যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। তাঁর শুধু জরিমানা হয়েছিল সামান্য টাকা, অলি আহাদ সাহেবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই ছিল সব থেকে কঠোর এর থেকে বোঝা যায় সেই ধর্মঘট আন্দোলনে তার ভূমিকাই ছিল অন্যদের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে পরে আমি জেনেছি, কিন্তু তখন আমি ঢাকায় নতুন। কাজেই সে সময় সবার সাথে পরিচয় ঠিকমত ছিল না। ১৯৫১ সালের দিকেই অলি আহাদ সাহেবের রাজনৈতিক কাজকর্মের সাথে আমার কিছুটা পরিচয় হয়। তখন যেসব রাজনৈতিক সভা-সমিতি হত সেগুলিতে মাঝে মাঝে যেতাম এবং প্রায়ই তিনি সেগুলিতে উপস্থিত থাকতেন এবং বক্তৃতা করতেন। নিজের বক্তব্য তিনি অনেক সময়ে বেশ উত্তেজিতভাবেই বলতেন।

যতদূর মনে পড়ে সে সময়ে তার একটি সাইকেল ছিল, যেমন অন্য অনেকেরও ছিল। সেই সাইকেলে চড়ে তিনি তখনকার ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতেন। আগেকার সেই সাইকেল ঢাকা শহরে আর নেই। ১৯৬৮-৬৯ সালেও আমি তোয়াহা সাহেবকে সাইকেলে চড়তে দেখেছি। আসহাবউদ্দিন সাহেবকেও দেখেছি চট্টগ্রামে সাইকেলে চড়তে। কিন্তু আজকাল কোনো রাজনৈতিক নেতা অথবা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সাইকেল চড়ে ঘুরছেন এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। এমনকি ছাত্রেরাও ঢাকায় এখন আর সাইকেলে চড়ে না।

১৯৫১ সালের প্রথম দিকে যুবলীগ গঠিত হয় এবং অলি আহাদ সাহেব তার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মনে হয় যুবলীগের সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকার সময়টাই অলি আহাদ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের সব থেকে গুরুত্ত্বপূর্ণ সময়। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার পরিচিতি সেই সময়েই গঠিত হয়।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাস থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগই ছিল এ রকম একটি রাজনৈতিক সংগঠন। রাজনৈতিক দল না হলেও এই যুব সংগঠনটি ছিল খুব রাজনীতিকৃত এবং এর ওপর কমিউনিস্ট পার্টির বাংলাদেশের অলি আহাদ প্রভাব যথেষ্ট ছিল। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে যুবলীগ গঠিত হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যেই সংগঠনটির শাখা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহর এবং অঞ্চলে গঠিত হয়। প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে যুবলীগ বেশ উৎসাহ সৃষ্টি করে, কারণ তখন তাঁরা মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বাইরে এমন একটি সংগঠনের জন্য উৎসুক ছিলেন যার মাধ্যমে তাদের চিন্তা, চেতনা ও আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি ঘটাতে পারত।

সংগঠনটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এ ক্ষেত্রে অলি আহাদ সাহেব। খুব কৃতিত্বের সাথে নিজের দায়িত্ব পালন এবং সফলতা প্রমাণ করেন। বিভিন্ন এলাকার রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে শাখা সংগঠনগুলির মধ্যে যথেষ্ট সক্রিয়তা দেখা দেয় এবং নানা ধরনের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচি তাঁরা নিয়মিতভাবে পালন করতে থাকেন।

১৯৫১ সালের ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অলি আহাদ সাহেব যে রিপোর্ট প্রদান করেন তাতে যুবলীগের নিজস্ব সাংগঠনিক কাজ কর্মের রিপোর্টিং-এর সাথে দেশের তৎকালীন পরিস্থিতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কেও অনেক তথ্য উপস্থিত করা হয়। এই রিপোর্টে তিনি যুবলীগ সম্পর্কে বলেন যে, এটি কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা বা প্লটফরম নয়। যুবলীগের এই বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ রেখেই একে সমাজের একটি সত্যিকার গণপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংগঠনের সদস্য ও কর্মীদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। মনে হয় সরকারি এবং বেসরকারি কোনো কোনো মহল থেকে যুবলীগের বিরুদ্ধে প্রচারণার কারণেই এ কথা বিশেষভাবে বলার প্রয়োজন হয়।

অলি আহাদ সাহেবের এই রিপোর্টে ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পূর্বে দেশের অবস্থার একটা সামগ্রিক চিত্র সংক্ষেপে, কিন্তু বেশ স্পষ্টভাবে, উপস্থিত করা হয়। এ দিক দিয়েও রিপোর্টটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভিক্ষ, লবণ সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কলকারখানার শ্রমিকদের মজুরি, কৃষক সমাজের দুরবস্থা, যুবকদের বেকারত্ব, পাট চাষীদের অবস্থা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি ছিল রিপোর্টটির আলোচ্য বিষয়। এ ছাড়া ভাষার প্রশ্নে সরকারের নানা বক্তব্যের বিষয়ও ছিল রিপোর্টটির অন্তর্ভুক্ত।

ভাষার দাবি এবং আন্দোলন সম্পর্কে রিপোর্টটিতে অলি আহাদ সাহেব যা বলেন তার মধ্যে শুধু তাঁর নয়, ঐ সময়ে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা যারা করতেন তাঁদের সকলেরই চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটে। ভাষার দাবি যুবলীগ পুরোপুরি সমর্থন করে এবং ভাষা আন্দোলনে যুবলীগ কর্মীরা সর্বত্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, একথার পর তিনি বলেন, “এখানে ইহা জানাইতে চাই যে, আমাদের এই দাবি অন্য কোনো ভাষার বিরুদ্ধে নয়। সমস্ত ভাষাই নিজ নিজ মর্যাদায় ও সত্তায় প্রতিষ্ঠিত হোক ইহাই আমরা চাই। আমরা ইহাও চাই যে, পূর্ববঙ্গে যে অবাঙালি জনসাধারণ বাস করিতেছেন তাহাদের জন্য তাহাদের ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা হোক।”

পঞ্চাশ বছরেরও আগে ভাষা আন্দোলনের সময় এখানকার কর্মীদের যে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসক শ্রেণির মধ্যে তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন বাংলাদেশে যে অবাঙালি উর্দুভাষীদের নিজেদের ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই শুধু তাই নয়, উর্দু প্রেসের কোনো অস্তিত্ব নেই, এমনকি তাদের সাধারণ নাগরিক অধিকার পর্যন্ত নানা প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের কবলে পড়ে অপহৃত। রিপোর্টটির শেষদিকে যুবলীগের সাংগঠনিক তৎপরতা, কাজের ঘাটতি এবং লক্ষ্য সম্পর্কে অলি আহাদ সাহেব যা বলেন সেটা উল্লেখযোগ্য। যুবলীগের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কথা বলা সত্ত্বেও তিনি বলেন, “পূর্ব বাংলায় গত ৯ মাসের যুব আন্দোলনের মধ্য দিয়া আমরা দেখিয়াছি যে, বিভিন্ন প্রশ্নে যুব সমাজ নিজেদের অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন করিয়াছেন। যুবলীগ সাধ্যমত সেই সব আন্দোলনে সাহায্য করিয়াছে। কিন্তু একটি বিষয়ে আমাদের কাজের গলদ অতীব স্পষ্ট। তাহা হইল যে, আমরা যুবলীগের কর্মীগণ যুব সমাজের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়া, যেমন বেকার সমস্যা, গরীব যুবকদের মজুরি বাড়ানোর প্রশ্ন, ছাত্রদের শিক্ষা বা বাসস্থানের সমস্যা, মেয়েদের শিক্ষার সমস্যা বিষয়গুলি নিয়া আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে বিশেষ চেষ্টা করি নাই। যুব সমাজের শরীর গঠন, খেলাধুলা প্রস্তুতির জন্য আন্দোলনও আমরা করি নাই। যে সমস্ত প্রশ্ন বা সমস্যা সাধারণভাবে সময়ে সময়ে সারা দেশ বা যুব সমাজকে আলোড়িত করিয়া তুলিয়াছে আমরা সেই বিষয় নিয়ে আন্দোলন করার ভিতরই আমাদের কর্মপ্রচেষ্টা সীমাবদ্ধ রাখিয়াছিলাম। আমাদের কাজের ধারার এই গলদ আজ দূর করা দরকার।” ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকায় এক বক্তৃতায় উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলার পরই নতুন পর্যায়ে আবার ব্যাপকভাবে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। এই আন্দোলনে যুবলীগ ও সেই সাথে তার সম্পাদক অলি আহাদ সাহেব খুব সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনকে কিছুটা সংগঠিত রূপ দিতে যুবলীগের প্রচেষ্টাই সে সময় ছিল সব থেকে উল্লেখযোগ্য। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারির পর সেটা ভঙ্গ করা হবে কি না এ প্রশ্ন ঐ দিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বৈঠকের প্রধান বা একমাত্র আলোচ্য বিষয় ছিল। সে সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্যে অলি আহাদ সাহেব নিজের বক্তব্য উত্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে ঐ বৈঠকে তিনি বলেন, “১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে জনাব শামসুল হককে সদস্য হিসাবে বক্তব্য রাখার অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে। তাঁহার সদস্যপদ চক্রান্ত করিয়া খারিজ করা হইয়াছে। এমনকি টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার অদ্যাবধি আর কোনো উপনির্বাচন দেয় নাই। শুধু তা নয়, বিনা অজুহাতে আমাদের পুনঃ পুনঃ ঘোষিত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে বানচাল করিবার অসৎ উদ্দেশ্যেই সরকার ১৪৪ ধারা জারি করিয়াছে। অতএব ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিয়া সরকারকে সমুচিত জবাব দিব।” অলি আহাদ সাহেব এবং অন্য যারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিলেন তাঁদের কৃতিত্ব এই ছিল যে, তারা সাধারণ ছাত্রদের মেজাজ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। কারও কারও ধারণা যে সে মেজাজ ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি তারা তৈরি করেছিলেন। এ ধারণা সঠিক নয়। অলি আহাদ সাহেব ও তার মত নেতৃস্থানীয় কর্মীরা আসলে সাধারণ ছাত্রদের তৎকালীন মেজাজকে সঠিকভাবে নিজেদের চিন্তায় ধারণ করতে পেরেছিলেন এবং তাদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তের মধ্যে তার অভিব্যক্তি ঘটেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে তখন অলি আহাদ সাহেবকে অনেক রকম কাজ করতে হয়েছিল। বিভিন্ন রকম যোগাযোগ, কাজের সমন্বয় সাধন, তাৎক্ষণিকভাবে অনেক প্রকার করণীয় নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি ব্যাপারে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রধান ছিল। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত থাকায় তাঁর কতকগুলি সুবিধা ছিল, যা অন্যদের ছিল না।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির এক প্রস্তাব অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪। ধারা ভঙ্গ সম্পর্কিত গৃহীত সিদ্ধান্তের বিপরীতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হলে সর্বদলীয় কমিটি বিলুপ্ত হবে এই মর্মে একট প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পর যে অভাবিতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে শুধু ছাত্রদের সংগ্রাম কমিটির পক্ষে তার মুকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। এ কারণে অলি আহাদ সাহেবসহ অন্য অনেকেই তখন উপলব্ধি করেছিলেন যে ২০ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আত্মবিলোপের প্রস্তাব সত্ত্বেও তাকে আবার পুনরুজ্জীবিত করা দরকার।

মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ভেতরে খোলা জায়গায় (বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জায়গায়) ২২ ফেব্রুয়ারি পূর্বদিন নিহত ছাত্র এবং অন্যদের গায়েবী জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সে জানাযাতে যুবলীগের নেতা ইমাদুল্লাহ সভাপতিত্ব করেন এবং বক্তৃতা করেন অলি আহাদ। অন্য কাউকে সেখানে বক্তৃতা করতে দেয়া হয়নি। ফজলুল হক সাহেব, আবুল হাশিম সাহেব জানাযায় এসেছিলেন। ফজলুল হক সাহেব সম্পর্কে অলি আহাদ সাহেব নিজেই বলেন, “ফজলুল হক যোগদান করতে এসেছিলেন কিন্তু তাকে বলতে দেওয়া হয়নি। তিনি ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি খুব রূঢ় ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করি। কারণ আমি মনে করেছিলাম যে তিনি পরোক্ষভাবে আন্দোলনকে ঘুষ দিয়ে নিজের স্বার্থে তাকে বিপ্লবী পথ থেকে অন্য দিকে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।”

অলি আহাদ সাহেবের এই ধরনের চিন্তা সঠিক ছিল বলে মনে হয় না। যে কারণে তাঁরা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে কারণেই ফজলুল হক সাহেবের মত ব্যক্তির সমর্থন ও সহযোগিতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ছিল। ভাষা আন্দোলন কোনো সংকীর্ণ বিপ্লবী আন্দোলন ছিল না। সেটা ছিল ব্যাপক জনগণের এক ধরনের অভূত্থান।

২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাধারণভাবে জনগণ যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এবং মিছিলে যেভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সরকার ও সরকার সমর্থক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে মারমুখী হয়েছিলেন তার থেকে বলা চলে যে, ঐদিন ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উচ্চ পর্যায়। তার পরও আন্দোলন কয়েকদিন অব্যাহত থাকলেও তার গতি ছিল নিম্নমুখী।

আন্দোলনের নিমগতির বিষয়টি অলি আহাদ সাহেবও উপলব্ধি করেছিলেন। এ ব্যাপারে অলি আহাদ সাহেবের নিজের কথা হল নিমরূপ, “২৩ তারিখে রাত্রে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের ৬৫ নম্বর রুমে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ গতি সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে আবুল হাশিম সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “Oli Ahad, how far do you want to go” তার জবাবে আমি বললাম, Honourable retreat। একথা বলার সময় আমি চিন্তা করেছিলাম যে আন্দোলনে ইতিমধ্যে ভাটা পড়েছে এবং আমাদের Resources খুব limited ছিল। সেজন্য মুভমেন্টকে এমন পর্যায়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া wise হবে না, যেখানে তার উপর আমরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবো।”

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয় এবং তার প্রয়োজনও নেই। অলি আহাদ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং মহত্তম অধ্যায় সম্পর্কে বলতে গিয়েই এ সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা বলার প্রয়োজন হল। ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে অনেক আবোল-তাবোল এবং মতলববাজি কথাবার্তা ১৯৭১ সালের পর থেকে শোনা যায়। প্রকৃত ইতিহাস রচনা এবং ঐতিহাসিক ঘটনার পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আবোল-তাবোল অথবা মতলববাজির স্থান নেই। কেউ সে চেষ্টা করলেও সেটা স্থায়ী হওয়ার নয়।

শেষ করার আগে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। অলি আহাদ সাহেবের বর্তমান রাজনীতি তাঁর পূর্ববর্তী রাজনীতি থেকে ভিন্ন হওয়ার কারণে ভাষা আন্দোলনের আলোচনা প্রসঙ্গে অনেকেই তার কথা তেমন কেউ বলতে চায় না। উপরন্তু অন্য অনেকের প্রান্তিক ভূমিকাকেও গৌরবান্বিত করা হয় এক ধরনের রাজনীতির সাথে তাদের সম্পর্কের কারণে। এ ধরনের প্রচেষ্টা কোনোযোগ্য ঐতিহাসিক, এমনকি কোনোযোগ্য ব্যক্তিরও উপযুক্ত নয়।

কোনো বিশেষ আন্দোলন বা ঘটনার ইতিহাস আলোচনা বা পর্যালোচনার সময় সেই আন্দোলন বা ঘটনার সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ পরবর্তীকালে কি করেছেন বা কোনো অবস্থানে আছেন, সেটা কার পছন্দ কার অপছন্দ, সেটা দিয়ে তার বা তাদের পূর্ববর্তী ভূমিকার মূল্যায়ন করতে যাওয়া একদিকে যেমন সেই ব্যক্তির প্রতি অবিচার, তেমনি সেই আন্দোলনের সঠিক চরিত্র উপলব্ধি ইতিহাস জ্ঞান সঠিকভাবে অর্জনের ক্ষেত্রে এক বিপজ্জনক প্রতিবন্ধক।

ভাষা আন্দোলনে অলি আহাদ সাহেবের ভূমিকা যারা অগ্রাহ্য করেন, উপেক্ষা করেন অথবা ছোট করে দেখতে চান তারা প্রকারান্তরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতকরণের প্রচেষ্টাতেই লিপ্ত থাকেন। তাদের এই অপকর্ম সমর্থনযোগ্য নয়।

১৮ জুন ২০০২

লেখক স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ

অগ্রজতুল্য অলি আহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ

দেশের অন্যতম বরেণ্য জননেতা অলি আহাদকে আমি চিনি আমার ছাত্রাবস্থা থেকেই। আজও মনে আছে, ১৯৫২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং ঐ দিনই ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে হলে আসি। ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হই দুটি কারণে। এক, হলটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের খুব কাছাকাছি। কাছাকাছি বলছি এজন্য যে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন ছিল আজকের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালের পূর্বাংশ। দুই, ফজলুল হক মুসলিম হল তখন ছিল প্রগতিবাদী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এমনিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর চিহ্নিত হয়েছে জনস্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার এবং ফজলুল হক মুসলিম হল ছিল তারই হৃদয়স্বরূপ। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, ফজলুল হক মুসলিম হলের সাবেক ছাত্র হিসেবে আজও আমি গর্ব অনুভব করি।

হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে জানার সুযোগ। হয়েছিল এই হলের সাবেক ছাত্রনেতাদের সম্পর্কে। জেনেছিলাম তখন ফজলুল হক মুসলিম হলের নেতৃস্থানীয় ছাত্র অলি আহাদ সম্পর্কে। তখন তাকে যে শ্রদ্ধার। চোখে দেখেছি আজও তা অব্যাহত রয়েছে। আজও তিনি আমার অগ্রজতুল্য, শ্রদ্ধেয়, পরম আকর্ষণীয় এক জাতীয় নেতা। তাঁর লেখা জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ গ্রন্থটি রিভিউ করেছিলাম ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি। বাংলাদেশে রাজনীতি সম্পর্কে, এর গতি-প্রকৃতি, রাজনীতির প্রধান লকুশলীদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, হাজারো ঘটনাক্রমের বিন্যাস সম্পর্কে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতির মর্মবাণী সম্পর্কে তাঁর যে অন্তর্দৃষ্টি তা আমাকে অভিভূত করে। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর এই গ্রন্থটিই সর্বাধিক প্রামাণ্য, সর্বাধিক বস্তুনিষ্ঠ। হাজারো টানাপড়েন ক্লিষ্ট বাংলাদেশে রাজনীতি ক্ষেত্রে এমন সব বিকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং সত্যের পথ এমনভাবে কণ্টকিত হয়েছে যে, সঠিক পটভূমিকা ব্যতীত তার যথার্থ অনুধাবন সম্ভব নয়। রাজনীতিক অলি আহাদ এই পটভূমিকা উপস্থাপন করে বাংলাদেশ রাজনীতির বিশ্লেষক ও গবেষকদের জন্যে তৈরি করেছেন উর্বরতম ক্ষেত্র।

রাজনীতি ক্ষেত্রে যে পথটি অত্যন্ত সহজ এবং পরিচিত অর্থাৎ অর্থবিত্তের আকর্ষণে পথ চলা, ক্ষমতার করিডোরে রেখে দায়িত্বহীনভাবে ছুটে চলা, পদ ও পদবির আকর্ষণে চারদিককে টালমাটাল করা, সে পথ তাঁর জানা ছিল না। ছিল না মন্ত্রিত্ব লাভের উদগ্র আকাক্সক্ষা। আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের সমুদ্র মন্থনে যে অমৃত উঠে এসেছিল তাতে তিনি ভাগ না বসিয়ে স্বেচ্ছায় গলাধঃকরণ করেছেন গরলকেই এবং সেই গরল পান করেই তিনি হয়েছেন নীলকণ্ঠ। হয়ে রয়েছেন কালের সাক্ষী। তাঁর এই ভূমিকাই তাঁকে রাজনৈতিক মহলে করেছে সর্বজনশ্রদ্ধেয়, করেছে কালজয়ী ত্যাগী প্রাজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি প্রতিনিয়ত অনুধাবন করেছেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা হল কল্যাণমুখী কতৃত্ব, প্রভাব বা বৈভব অর্জনের নয়, ক্ষমতার বলয় বৃদ্ধির মাধ্যমও নয়। ছাত্রাবস্থায় তিনি অনুভব করেছিলেন, অনগ্রসর এই জনপদের জনসমষ্টির জীবনমান উন্নয়নই মুখ্য বিষয় এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যেই তিনি ছাত্র রাজনীতিকে বেছে নিয়েছিলেন। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, চল্লিশের দশকের সমাপ্তি পর্বে এবং পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে এদেশে ছাত্র রাজনীতির যে গৌরবজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয় তার মূল ছিল অলি আহাদের মত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, প্রাজ্ঞ, একনিষ্ট, সৃজনশীল ছাত্রনেতার অবদান। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ঐতিহ্যের সৃষ্টিকর্তাদের অন্যতম হলেন অলি আহাদ। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ এবং ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা চিরস্মরণীয়। তাঁকে শুধু ভাষাসৈনিক বলা ঠিক নয়, এক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল সেনাপতির। বাংলাদেশের রাজনীতি এক খরস্রোতা স্রোতস্বিনীর মত। হাজারো দিকে বাঁক নেয়া, অসংখ্য স্রোতধারায় সমৃদ্ধ এবং জাতীয় স্বার্থের নিরিখে সূচিত আষাঢ়-শ্রাবণে দুকূল ছাপিয়ে ওঠা বৈশিষ্ট্যময় গতিময়তায় এদেশের অনেক সুসন্তান এই প্রবাহে অবদান রেখেছেন। তাঁদের কেউ হয়েছেন কালোত্তীর্ণ, কালজয়ী। কেউ কেউ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন। অলি আহাদ কিন্তু আজো দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্বল্প-উচ্চতা সম্পন্ন এই জনারণ্যে বিরাট মহীরুহের মত। কেউ কেউ তর্জনী নির্দেশ করে তার অবমূল্যায়নে প্রবৃত্ত হয় বটে, কিন্তু জনস্বার্থের সার্থক অভিভাবকরূপে, জাতীয় স্বার্থের ধারকরূপে, কল্যাণকর রাজনৈতিক লক্ষ্যের প্রবক্তারূপে, বিশেষ করে সুরুচিসম্পন্ন, পরিশীলিত। এবং সৃজনশীল কর্মপ্রবাহের সনাতন সমর্থনরূপে আজো তিনি রয়েছেন এই জনারণ্যে প্রবল প্রকাণ্ড অশ্বথের মত মাথা উঁচু করে। তার তুলনা শুধু তিনি নিজেই। জাতীয় সংকটকালে এসব ব্যক্তিত্বের বাণী সাবধানবাণীর মতই, অনেকটা বিবেকের বাণী তুল্য।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন গ্রহণের মুখে, সংশয়ে ও দ্বিায় আচ্ছন্ন। যুক্তির জোর এখন জোরের যুক্তির নিকট অবনতমস্তক। কল্যাণমূলক প্রত্যয় এখন ক্ষমতার রাজনীতির হাতে বন্দী। গণতন্ত্রের কথা সবাই জোরে শোরে উচ্চারণ করলেও সমাজ জীবনের সর্বস্তরে অগণতান্ত্রিকতা প্রবল প্রতাপে করছে। অধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকারে ক্ষমতাসীন হয়েও কোনো সরকার নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে সাফল্য লাভ করেনি। অধিকার দায়িত্ববোধের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়নি। সুশাসনের পাঁঠ এখনো আমাদের প্রশাসকদের সমাপ্ত হয়নি। স্বশাসনের দাবি এখনো আদর্শিক। এমনি দুঃসময়ে কোন দিকে তাকাবে সমাজ? এহেন অন্ধকারে আলোর দিশা কে দেবেন? আমার তো মনে হয় অলি আহাদের মত ব্যক্তিরা এখনো এ সমাজে রয়েছেন। তাদের ন্যায়নিষ্ঠতা এখনো পথ দেখাতে সক্ষম। সুশাসন ও স্বশাসনের দাবি নিভৃতে ক্রন্দনরত হলেও অলি আহাদের মত প্রাক্তন রাজনীতিকদের আদর্শ এই দুঃসময়ে হতে পারে পথের ঠিকানা। তারাই হতে পারেন এই ঘন অন্ধকারে আলোর দিশারী। আজকে তাই তাঁকেই স্মরণ করছি। স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধাভরে।

লেখক, সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অলি আহাদ : আপোসহীন সংগ্রামী

আখতার-উল-আলম

[প্রীতিভাজন মুন্সী আবদুল মজিদ দীর্ঘদিন যাবৎ প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহালের একনিষ্ঠ অনুসারী একজন ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী। তিনি যখন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ওই প্রবীণ রাজনীতিবিদের উপর কিছু লিখবার জন্য জেদ ধরে রইলেন, তখন তাকে বলেছিলাম, কিছু পয়েন্ট তে দেবেন যা দেখে শুনে কিছু লিখে দিতে পারি। সুতরাং, রচিত এই নিবন্ধের পুরা কৃতিত্ব মুন্সি সাহেবের আর যা কিছু দোষত্রুটি পুরোটাই আমার।]

অলি আহাদ সাহেবের কথা মনে হলেই মনে পড়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন :

যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামী ভাই

করবো সেথায় বিদ্রোহ,

ধামা ধরা জামা ধরা

মরণ ভীতু, চুপ রহ!

অলি আহাদকে যারা চিরবিদ্রোহী বলেন, তারা ভুল কিছু বলেন না। সেদিকের বিচারে অলি আহাদ যেন জাতীয় কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতারই মূর্ত প্রতীক : যার- “শির নেহারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!”

অলি আহাদ সাহেবের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান দশ/এগারো বছর। তারপরেও তার সাথে, তার ফ্যামিলির সাথে শুধু বন্ধুত্ব নয়, সহমর্মিতার এক অচ্ছেদ্য সম্পর্ক কেমন করে যে গড়ে উঠেছে-তার ইতিবৃত্ত অনেক দীর্ঘ। শুধু এইটুকু বলা চলে যে, তাঁর রচিত জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ পুস্তকের জন্মদাতা তিনি বটে, কিন্তু তাঁর ধাত্রীপনা করতে হয়েছিল আমাকেই। মাঝখানে বিদেশ থেকে ফিরে এসেও দেখেছি, পুস্তকটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ নিয়ে তিনি বিব্রত। খোশরোজ কিতাব মহলের অগ্রজতুল মুহীউদ্দীন আহমদকে বলতেই তিনি রাজী হয়ে গেলেন। বাজারে সেই সংস্করণও বোধ হয় এখন দুষ্প্রাপ্য। মাঝখানে কি এক খেয়ালের বশে তিনি আমাকে দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকা প্রকাশের “নো-অবজেকশন পত্র” লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে সে পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারে নাই। তবে, সে অন্য ইতিহাস। এখানে তার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক।

ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং জাতীয় রাজনীতির হাল চাল সম্পর্কে তার ক্ষোভ ও ক্ষুব্ধ স্বতঃই প্রকাশ পায়। কিন্তু নীতির প্রশ্নে অটল থাকার ব্যাপারে তার মত এদেশে আমি আর কাউকে খুঁজে পাই নাই। একদিক দিয়ে এই বিষয়টা তাঁকে যেমন অন্য অনেকের কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে, তেমনি দেশ ও জাতি পেয়েছে বিবেকের এমন এক কণ্ঠস্বর—যা এখনো যেকোনো সংকট মুহূর্তে যে কারো বিরুদ্ধে সুতীব্র উচ্চারণে ফেটে পড়তে দ্বিধা করে না। উদাহরণস্বরূপ, উপস্থিত, ভাষা আন্দোলনের ‘অজানা তথ্য সম্পর্কে তাঁর কিছু বক্তব্য হুবহু এখানে তুলে ধরতে চাই। যেমন-

ভাষা আন্দোলনের অজানা তথ্য

“মাওলানা মওদুদী, দেওবন্দী হোসেন আহমদ মাদানী, মাওলানা আজাদ গোষ্ঠীর মোল্লারা ও গান্ধী মহারাজের চেলারা আগাগোড়া হিন্দুস্তানে মুসলিম আবাসভূমির বিরুদ্ধে ছিলেন। তেমনি তাঁরা ছিলেন ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২১ ফেব্রুয়ারি-উত্তর ঢাকা নারায়ণগঞ্জের রাজপথ কাঁপানো রক্তাক্ত সংগ্রামেরও বিরুদ্ধে। মূলত উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিল তাদের অবস্থান। কৌশলে বলতেন, “আরবী হরফে বাংলা লিখতে চাই।’ একইভাবে বাংলার রক্তক্ষয়ী আজাদী সংগ্রামেও তারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী।

 “রক্তয়াত ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বদিন ২০ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে নুরুল আমীন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ধনুর্ভঙ্গ পণ। গ্রহণ করে কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃত্ব (মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী তখন ঢাকার বাইরে নরসিংদীর গ্রামাঞ্চলে জনসভায় ছিলেন) যথা আতাউর রহমান খান, জেনারেল সেক্রেটারি শামসুল হক, তদানীন্তন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সহ-সভাপতি খয়রাত হোসেন এমএলএ, মিসেস আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, তমদ্দুন মজলিশ নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেমসহ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনার কাজী গোলাম মাহবুব ও পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সহ-সভাপতি মোঃ তোয়াহা প্রমুখ অনেকেই জনাব আবুল হাশিম-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেন। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি কমিটি অব একশন কনভেনার আবদুল মতিন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন সহ-সভাপতি গোলাম মাওলা, ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি শামসুল আলম ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দেন। অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ৪ ভোট এবং বিপক্ষে ১১ ভোট পড়ে। ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল, সামনে নির্বাচন। সিদ্ধান্ত হবে হঠকারী। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের আন্দোলনে গেলে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাব। নির্বাচনে অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে যাবে।”

“একুশে ফেব্রুয়ারির আমতলার সভায় টিয়ার গ্যাস শেলে অজ্ঞান হারিয়েছিলেন জনাব গাজীউল হক। ওন ফিরে পাবার পরেপরেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। এ ঘটনার পর তাকে আর ঢাকায় দেখা যায় নাই। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে গাজীউল হক ময়মনসিংহে ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর শ্বশুর, সাবেক এমএলএ জনাব আবদুল মজিদ সাহেবের বাড়িতে স্যুট-কোট পরিহিত অবস্থায় হাজির হন বলে জানা যায়। তারপর বগুড়া শহরে ঘটে তার আবির্ভাব।”

“আরেকজন জনাব এম আর আখতার মুকুল। ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার ছাত্র জনসভার পরপরই তিনি ঢাকা হতে উধাও হন এবং কোলকাতা নগরীতে নিরাপদ আশ্রয়ে কাল কাটান। জনাব শহীদুল্লাহ কায়সারও তার দল কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন কমরেড শহীদুল্লাহ কায়সার কলকাতা হতে প্রকাশিত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতা বিক্রি করতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে আসেন। তাতে ঢাকার পুলিশের গুলির খবর ছিল। অলি আহাদ সাহেব তাঁকে পত্রিকাগুলিসহ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণ হতে বিদায় করেছিলেন। উল্লেখ্য, ভারতীয় পত্রিকা স্বাধীনতা এদেশে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে মুসলিম লীগের তরফ থেকে এ ধরনের প্রচারণা ছিল তখন এন্তার। একমাত্র মেডিক্যাল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি গোলাম মাওলা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলেই অবস্থান করেন এবং আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশেই বোধহয় ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথে ২১ ফেব্রুয়ারির রাত হতে জনাব মোঃ তোয়াহা ও আবদুল মতিনের দেখা যায় নাই। ৭ মার্চ গ্রেফতার দিবস” সন্ধ্যারাতে জনাব তোয়াহা ও আবদুল মতিন আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন এবং সেই সভাতেই সর্বজনাব সাদেক খান, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, মুজিবুল হক ও মীর্জা গোলাম হাফিজের সাথে জনাব অলি আহাদ গ্রেফতার হন। জনাব কাজী গোলাম মাহবুব সভায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়।” “যুবলীগ সহ-সভাপতি শামসুজ্জোহা, কার্যকরী কমিটির সদস্য শফি হোসেন খান, ড. মুজিবর রহমান ও আজগর হোসেনের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জে ভাষা। আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। নূরুল আমীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জবাসীকে উজ্জীবিত করেন যুবলীগের এই অতোভয় নেতা ও কর্মীরা। নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন মমতাজ বেগম। মমতাজ বেগমকে ২৯ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হলে যুবলীগ নেতা শফি হোসেন-এর নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ শহর অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়। নূরুল আমীন তাঁর গদি রক্ষার্থে ইপিআর বাহিনীর আর্মড কোর নারায়ণগঞ্জের দিকে প্রেরণ করেন। নারায়ণগঞ্জের মানুষ চাষাঢ়া হতে পাগলা পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ মাইল রাস্তায় ১৬০টি বটগাছ কেটে ফেলে ইপিআর আর্মড কোরের বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টি করে।”

“এতদসত্ত্বেও দানব শক্তির অত্যাচারে গোটা নারায়ণগঞ্জ তছনছ হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচিত এমএলএ খান সাহেব ওসমান আলীর চাষাঢ়ার দ্বিতল বাড়ি লুষ্ঠিত হয় এবং দৈহিক অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় পরিবারের সকল সদস্য। এমনকি শ্রদ্ধেয় এমএলএ খান সাহেব ওসমান আলীর ওপরেও শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে তার কোমর ভেঙে দেওয়া হয়।” “শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারামুক্তি পেলেন। কিন্তু ঢাকা নারায়ণগঞ্জের আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ঢাকায় এলেন না। নেতৃত্ব দিতে বিদ্রোহের অনলেও ঝাপ দিলেন না। এমনকি নুরুল আমীনের দানবীয় শাসনের বিরুদ্ধে ৫ মার্চ দেশব্যাপী যে হরতালের ডাক দেওয়া হয়, শেখ মুজিব সেই হরতালে অংশগ্রহণ করার জন্য ঢাকায় পর্যন্ত আসেন নাই। মারমুখো জনতাকে নেতৃত্ব দান তো দূরের কথা। বরং বাস্তব সত্য এই যে, শেখ মুজিব সে সময়ে কোটালীপাড়ায় নিজ বাড়িতে মাতা-পিতার স্নেহের আশ্রয়ে স্বস্তিতে শান্তিতে কাল কাটিয়েছেন। তারপরও মুখপোড়া আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় দালাল-চামচারা বলে যে, ১৯৫২ সালে শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ধিক তাদের এই মিথ্যাচারে!”

“ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে যারা জীবন বাজি রেখে সার্বক্ষণিক রাজপথ দখল করে রাখেন এবং আন্দোলনমুখর লাখো সংগ্রামী জনতাকে নেতৃত্ব দেন, তাঁরা হলেন মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র আজমল হোসেন, আবদুস সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোঃ সুলতান, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইমাদুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, নেয়ামাল বাসির, সাহিত্যিক হাসান হাফিজুর রহমান, কাজী আজিজুর রহমান, ডা. মঞ্জুর হোসেন, আমীর আলী প্রমুখ যুবলীগের শত শত নেতা-কর্মী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সে-দিনের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের আন্দোলন উত্তাল দিনগুলিতে আন্দোলন পরিচালনা ও নেতৃত্ব দেয় মূলত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ।”

আপোসহীন সংগ্রামী

ঔপনিবেশিক আমল থেকে পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়—সে এক সুবিস্তৃত ইতিহাস। ইতিহাসের এই ধারায় রাজনীতির পথপরিক্রমায় পরিচালিত হয়েছে বহু আন্দোলন, বহু সংগ্রাম। এই আন্দোলন ও সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে অনেকেই নানা ভূমিকা পালন করে গেছেন। কিন্তু আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, প্রতিটি সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে আপোসহীন ভূমিকা পালন করেছেন, তেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অস্তিত্ব গোটা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় খুবই বিরল। আজ এখানে তেমনি এক বিরল নেতৃত্ব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করছি। তিনি একই সঙ্গে যেমন আপোসহীন তেমনি দৃঢ়চিত্ত। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার। নাম তার অলি আহাদ।

অলি আহাদ শুধু একটি নাম নয়, অলি আহাদ একটি সংগ্রামের নাম—সংগ্রাম। ইতিহাসের এক অনন্য অভিধা। অনেকেরই হয়ত আজ অজানা যে, মুসলিম লীগের স্বেচ্ছাচারী শাসনের প্রতিবাদে প্রথম আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পরে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পিছনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে পাক-মার্কিন সিয়াটো সেন্টো চুক্তির বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথেও সৃষ্টি হয় অলি আহাদের বিভেদ। অবশ্য মওলানা ভাসানীর অবস্থানকে সমর্থন জানাতে গিয়েই অলি আহাদ সেদিন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিরোধে জড়িয়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগেই থেকে গেলেন; শেখ মুজিব মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে আবার সাধারণ সম্পাদক হলেন; আর অলি আহাদ নীতির প্রশ্নে আপোসহীন থাকার কারণে দল থেকে ছিটকে পড়লেন।

সেই থেকে শুরু হল আপোসহীনতার পথে অলি আহাদের যাত্রা। রাজনীতি সংগ্রামের দুর্গম গিরি মরুকান্তার, পেরিয়ে তাঁর সেই যাত্রা আজো অব্যাহত। আজো যেখানেই স্বৈরাচারী একনায়ক, কিংবা যেখানেই গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে-দেয়া কোন ফ্যাসিস্ট শাসক, সেখানেই তাদের গণবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে অলি আহাদের কণ্ঠ বজ্রনির্ঘোষ। তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ সকল আগাসন আধিপত্যবাদ আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছিল এক দ্রোহের বহ্নিশিখা। কিন্তু শাসকলের নগ্ন হস্ত ঐতিহ্যবাহী ইত্তেহাদ-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে মোটেও দেরি করে নাই। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো-না-কোনো সময়ে অলি আহাদকে ক্ষমতার ভাগ দেওয়ার প্রলোভনও কম দেওয়া হয় নাই। কিন্তু তিনি অবলীলায় তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেখ মুজিব তার ক্ষমতারোহণের প্রথম পর্যায়েই অলি আহাদকে মন্ত্রিত্বের পদ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার হাতছানি কোনো সময় অলি আহাদকে তার বিদ্রোহী ভূমিকা থেকে টলাতে পারে নাই। ফলস্বরূপ এমন একটি সরকার ছিল না, যে সরকার অলি আহাদকে কারাগারে আটক করে নাই।

পরিতাপের বিষয়, বঞ্চনা ও নিষ্পেষণে জর্জরিত দেশের যে কোটি কোটি মানুষের জন্য অলি আহাদ সংগ্রাম করেছেন এ আজো সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, সে খবর রাখে কয়জনে? এ ব্যাপারে অবশ্যই মূল ভূমিকা পালন করার কথা ছিল সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। কিন্তু এই সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা উচ্চকণ্ঠ—তারা তো অনেকেই বিবেক বন্ধক রেখে মহাসুখে কালাতিপাত করছেন। তাদের কল্যাণেই আজ কত নাম-না-জানা, অখ্যাত, ভুইফোড় নেতার জীবনকথার নামে কল্পকাহিনি সাজিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে ও হচেছ। প্রতিনিয়ত সাময়িকী ম্যাগাজিনে এদেশের প্রচহদ-কাহিনি ছাপা হচ্ছে কত পাতি নেতা, নর্তকী, গায়িকা ও নায়িকাকে নিয়ে। কিন্তু এ দেশের আন্দোলন সংগ্রামের এক জীবন্ত কিংবদন্তি, সৎ, নির্লোভ, আপোসহীন, প্রচারবিমুখ, দেশপ্রেমিক ও সত্যিকার একজন জাতীয়তাবাদী নেতার ভূমিকাভিত্তিক কোনো প্রচ্ছদ কাহিনি দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার কথা এ যাবত কেউ ভেবে দেখার প্রয়োজনটুকু পর্যন্ত বোধ করেন নাই। রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে অলি আহাদ শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের সকল গুণও তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। টগবগে যৌবন থেকে শুরু করে গত অর্ধশতাব্দীকাল রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারণায় নীতির প্রশ্নে অটল ও অবিচল থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ বড় কথা নয়। বড় কথা হল নীতির প্রশ্নে নিরাপোস থাকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এবং আগামী বংশধরদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ গঠনের স্বার্থে বর্তমানকে অবহেলায় বিসর্জন দেওয়া।

শৈশব, কৈশোর, যৌবন

বাংলাদেশ তথা এ উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অলি আহাদের পুস্তক এক অনবদ্য জাতীয় ইতিহাস। জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ নামক এই স্মৃতিকথামূলক পুস্তকেও তিনি আত্মপ্রচার সযত্নে পরিহার করেছেন। সেই পুস্তক পাঠ করে কেউ তার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের ঘটনাবলি জ্ঞাত হতে পারবেন না। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় যেটুকু উদ্ধার করা যায়, তা হল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর থানাধীন ইসলামপুর গ্রামের এক সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৮ সালে জনাব অলি আহাদের জন্ম। তাঁর পিতা মোঃ আব্দুল ওহাব ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। হোমনা ও কুমিল্লা জেলা স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। দাউদকান্দি হাইস্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে (তদানীন্তন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ) বিজ্ঞান বিভাগে। ঢাকা কলেজে ভর্তির পরপরই ঢাকা কলেজ মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময়ই তিনি পরিচিত হন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আল্লামা আবুল হাশিমের সাথে। মুসলিম লীগ কর্মী-শিবিরে আগত কর্মীদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত ভাষণ দিতেন আবুল হাশিম। ইসলামের নীতি ও আদর্শের ব্যাপারে, বিশেষত পবিত্র কালেমার ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনে ইসলামের মূল্যবোধের উপরে জানা আবুল হাশিমের প্রদত্ত ভাষণ অলি আহাদকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। সেই কর্মী সমাবেশেই তার সাথে পরিচয় ঘটে সর্বজনাব শামসুল হক, শামসউদ্দিন আহমদ, কমরুদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দিন আহমদ, নঈমউদ্দিন আহমদ ও শওকত আলীর সাথে। এক পর্যায়ে তিনি মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের সাথে জড়িয়ে যান।

রাজনৈতিক জীবনে জনাব অলি আহাদ পাকিস্তানের জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাবশিষ্য। এখনো কায়েদে আযমের প্রতি তার অপার শ্রদ্ধা। রাজনীতির পরিমণ্ডলে খুব কম রাজনীতিবিদকেই তিনি মনে করেন কায়েদে আযমের সমকক্ষ। জিন্নাহর সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ছাত্রজীবনেই ১৯৪৬ সালে আখাউড়া রেলস্টেশনে। ৪৬-এর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় কায়েদে আযম এসেছিলেন সেখানে। সেদিন রেলের সেলুন থেকে জানালা পথে আঙ্গুলের ইশারায় তাকে ডাকলেন কায়েদে আযম। বুকে তখন মুসলিম লীগের ব্যাজ। তিনি কাছে গেলে কায়েদে আযম তাঁর পরিচয় জেনে নিয়ে বললেন, “Young boy, remember character first. After election rejoin classes” অর্থাৎ “তরুণ বালক, স্মরণ রেখ চরিত্রই প্রথম। নির্বাচনের পর পড়াশোনায় মনোনিবেশ করবে।” কায়েদে আযমের সেই উপদেশ আজো তাঁকে প্রেরণা যোগীয়।

অথচ এহেন শ্রদ্ধার পাত্র কায়েদে আযমের মুখের উপরেও অলি আহাদ কথা বলতে ছাড়েন নাই। স্পষ্ট ভাষায় তাঁর অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদ করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কায়েদে আযমের সাথে দ্বিতীয়বার অলি আহাদের দেখা হয় মিন্টু রোডে (সাবেক গণভবনে)। তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে ছাত্র নেতারা কায়েদে আযমের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য শুনে কায়েদে আযম বলেছিলেন, “In the interest of the integrity of Pakistan, if necessary, you will have to change your mother tongue.” কায়েদে আযমের এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে অলি আহাদ বলেন, “Sir, Britain, USA, Canada, Australia and New Zealands speak the same language, preach the same religion, come of the same stock, could they form one state? Despite the same religion, Islam, same language Arabic, same Semetic blood, and same land Arab, why are there so many states on Arab land?” এক পর্যায়ে তার দিকে তর্জনি নির্দেশ করে কায়েদে আযমকে বলেছিলেন, “I know you also.” অলি আহাদও সমানতালে জবাব দিয়েছিলেন, “I also know you are the Governor General whom the Queen of England can remove on our appeal.”

জীবন্ত স্মৃতি মিনার

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৫২ সালে অলি আহাদের আপোসহীনতার মুখে ছাত্রনেতৃবর্গ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ অনেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কৃতিত্বের দাবিদার। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এই কৃতিত্বের হকদার একমাত্র অলি আহাদ। ইতিহাস আরো সাক্ষ্য দেয়, সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পরিণামে ২১ ফেব্রুয়ারি আজ হয়েছে শহীদ দিবস; সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় শহীদ মিনার। এমনকি সেই ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে আজকের স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। দুঃখের বিষয়, সেই অলি আহাদকে এ পর্যন্ত কোনো সরকারই একুশে পদক কিংবা অনুরূপ কোনো রাষ্ট্রীয় পদক সম্মানে ভূষিত করার মত মানসিক উদারতা প্রদর্শন করতে পারে নাই। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে একথাই বলতে হয় যে, সেদিনের বিদ্রোহের দাবানলে সালাম, বরকত, রফিকদের আত্মত্যাগের স্মৃতি যদি হয়ে থাকে পাথরে নির্মিত জাতীয় শহীদ মিনার, তাহলে অলি আহাদ হলেন সেই ২১ ফেব্রুয়ারির জীবন্ত স্মৃতি মিনার।

উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনে অলি আহাদের ভূমিকাভিত্তিক একটি অনুষ্ঠানের ভিডিও চিত্র ধারণের পরও তা টিভিতে প্রচার করা হয় নাই। দুঃখজনক এই ঘটনাটি ঘটেছিল বেগম খালেদা জিয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে। অবশ্য পরে বিরোধী দলের নেত্রী হিসাবে বেগম খালেদা জিয়া অলি আহাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে আসেন এবং তাঁকে ‘জাতির বিবেক’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। খালেদা জিয়া আবারও দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করেছেন। জীবন সায়াহ্নে অলি আহাদের মত সংগ্রামী নেতাকে কোনো না কোনো ভাবে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করার মত উদারতা কি খালেদা জিয়ার জোট সরকার দেখাতে পারবে?

অলি আহাদ : রাজনৈতিক সংগঠক

সমকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনে যে নৈতিক ও আদর্শিক ধস নেমেছে তাতে লাখ লাখ টাকা ছাড়া রাজনৈতিক সংগঠন চালানো দুষ্কর। টাকা ছাড়া কোনো একটা সভা-সমাবেশ তো দূরের কথা, একটি কর্মীসভাও করা সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে এখন ত্যাগ ও আদর্শের মনোভাব ও প্রভাব বলতে গেলে অনুপস্থিত। এই অবস্থায়, আজ যখন রাজনীতিতে টাকার খেলা, চাঁদাবাজি, অর্থের উৎস-চিন্তা অপরিহার্য বাস্তব, তখন প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল টিম টিম করে তার অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। সত্যি বলতে কি, অলি আহাদের নীতি আদর্শের অনুসারী কতিপয় সংগ্রামী নেতাকর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগেই আজো সংগঠনটি টিকে আছে। অলি আহাদের যে পরিচিতি এবং তার বন্ধুত্বের যে পরিধি, তাতে তিনি সেভাবে চাইলে বা যোগাযোগ করলে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান যে করতে পারেন না, তা নয়। কিন্তু নীতির প্রশ্নে অটল অলি আহাদ মনে করেন, যে শোষক ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে তিনি চিরদিন আপোসহীনভাবে লড়ে যাচ্ছেন, সেই গোষ্ঠীর কারো কাছে দলের জন্য অর্থসাহায্য চাওয়া মানেই নিজেকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা। ইতিহাস সাক্ষী, পাকিস্তানের ইস্কান্দার মীর্জা, আইয়ুব, মোনায়েম থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবী দুঃশাসনের আমলেও অলি আহাদ বারবার কারান্তরালে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। ৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ তাঁকে পরপর দু’বার জেলে নিয়ে এক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এই সময় একবার জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে অলি আহাদ আমার বাসায় এসেছেন। আমার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “আবার কবে জেলে যাচ্ছেন।” একটু থমকে গিয়ে হোহো করে হেসে উঠেছিলেন অলি আহাদ। জীবনে ১২ বছর কারাভোগ ছাড়াও বছরের পর বছর আত্মগোপনে কাটাতে হয়েছে অলি আহাদকে। জিয়াউর রহমানও তাঁকে গ্রেফতার করেছিলেন, কিন্তু পরদিনই মুক্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিব সর্বমোট ৬ বৎসর ২ দিন জেল খেটেছিলেন। অথচ তিনি নিজে দাবি করে গেছেন এবং অন্যেরাও বলে বেড়াচ্ছেন যে, তিনি নাকি মোট ১৪ বছর কারান্তরালে ছিলেন। এই দাবি মোটেও সঠিক নয়।

সামরিক ট্রাইব্যুনালে অলি আহাদ

৮২-এর পর অলি আহাদ একমাত্র রাজনৈতিক নেতা, যাকে এরশাদের সামরিক সরকার বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করেছিল। সে দিন সামরিক আদালতে দাঁড়িয়ে অলি আহাদ অকুতোভয়ে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন যেকোনো সংগ্রামী নেতা ও কর্মী সেই বিবৃতি থেকে প্রেরণা লাভ করতে পারেন। আগেই বলেছি, অলি আহাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ ছিল ছাপার অক্ষরে এক জীবন্ত দ্রোহ। এই নিবন্ধ লেখক ইত্তেফাক-এর সহকারী সম্পাদক থাকা অবস্থায়, সম্পাদকের অনুমতিক্রমে দীর্ঘকাল ইত্তেহাদ-এ সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছিলেন। উল্লেখ্য যে, ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয় কলামের উপরে ছাপা হত বিদ্রোহের সেই অগ্নিবাণী : “অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।” এই বাণী সম্পাদকীয় নিবন্ধের উপরে শুধু মুদ্রিতই থাকত না, ইত্তেহাদ-এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রতিটি ছত্রে এই ঘোষণার বাস্তব প্রতিফলন ঘটত। যাহোক, ১৯৮৪ সালের ৮ অক্টোবর ৭ নং সামরিক আদালতে প্রদত্ত অলি আহাদের সেই ঐতিহাসিক জবানবন্দীর একটি অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করা হল : ”আমার বিবেক আর আজীবন রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের কাছে বিশ্বস্ত থেকে আমি বলতে চাই যে, তাত্ত্বিক কিংবা আদর্শগত কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই সামরিক আইন প্রশাসন আমার কাছে গ্রহণীয় নয়, যিনিই এটা জারি করুন না কেন; হোক তিনি জেনারেল আইয়ুব, অথবা জেনারেল ইয়াহিয়া অথবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান অথবা মেজর জেনারেল আবুল মপুর কিংবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচএম এরশাদ। বিচারাসনে উপবিষ্ট হওয়া মাননীয় আদালতের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে ১৯৮২ সনের ২৪ মার্চের মার্শাল ল প্রত্নামেশন। যেহেতু সামরিক আইন একটি বাস্তবতা; সেহেতু আমাকে মাননীয় আদালতকে মানতে হয়। আধুনিক ইতিহাস রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জেনারেলদের অধিষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের শাসন তাদের স্ব স্ব দেশ ও জনগণের জন্যে বয়ে এনেছে বিপর্যয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খান বাংলাকে দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য দায়ী। এই শস্থলের পথ ধরেই ভারত ১৯০ বছর ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে শৃঙ্গলিত হয়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সের বিপর্যয় ডেকে আনে। জার্মানির হিটলার সভ্যতাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে। গণতান্ত্রিক সিস্টেমেও জেনারেলদের শাসন আকর্ষণীয় কিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল আইসেন হাওয়ার (আইখ) সোভিয়েত রাশিয়ার আকাশ ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান পাঠিয়ে ‘৬০ সনে প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রপ্রধানদের শান্তি সম্মেলন বিপর্যস্ত করে ফেলেন। জাপানের জেনারেল তেজো তার দেশকে উপহার দিয়েছেন পরাজয় আর বিপর্যয়। সাম্প্রতিক কালের সমরনায়কদের শাসনের ইতিহাসও চরম ব্যর্থতার আলেখ্য। জেনারেল আইয়ুব, আর্জেন্টিনার জেনারেল গলতিয়ারী, বার্মার জেনারেল নেউইনের শাসন এই নির্মম বাস্তবতারই প্রমাণ বহন করে।”

আন্দোলনের পুরোধা

অলি আহাদ মুসলিম লীগ সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনের পুরোধা কর্মী ছিলেন। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীকালে নীতির প্রশ্নে আপোসহীনতার কারণে তিনি ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। কালের পরিক্রমায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগেরই আপোসহীন সংগ্রামী ভূমিকা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বস্তুত ধাপে ধাপে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার প্রতিটি পর্যায়ে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন অলি আহাদ। সবাই জানেন, ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণায় দোদুল্যমানতা প্রদর্শন করেছিলেন। এমনকি ৭ মার্চের ভাষণেও সুস্পষ্ট কিছু বলেন নাই। অথচ ৬ মার্চ, ১৯৭১ ন্যাশনাল লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে অলি আহাদ নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের প্রতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র ঘোষণার এবং প্রয়োজনে স্বাধীনতাকামী সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানান। বাংলা ন্যাশনাল লীগের ছাত্র সংগঠন ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা চলাকালে যে প্রচারপত্র ছেড়েছিল, তাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল “আপোসের চোরাবালিতে বাংলার এ স্বাধীনতার উদিত সূর্য যেন মেঘাচ্ছন্ন না হয়।”

এ ছাড়াও ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক “তোমরা আমায় রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব” নেতাজী সুভাষ বোসের এ উক্তি সংবলিত ব্যাজ বিতরণ করে। এতেও “মুক্তিফৌজ গঠন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো” শ্লোগান উৎকীর্ণ ছিল। এর আগে ১৯৭০-এর ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীসহ বক্তৃতাকালে এবং ৫ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সমাবেশে ভাষণদান কালে অলি আহাদ স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানান। ১৯৭১-এর ৬ মার্চ পল্টনের সমাবেশে শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, “মুজিব ভাই, আপনি স্বাধীনতা ঘোষণা করুন। আমরা দেশবাসী আপনার সাথে আছি।”

অলি আহাদসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা ও দল যখন অবিলম্বে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানাচিছলেন, তখন শেখ মুজিব তাঁর দলবলসহ ইয়াহিয়া খানের সাথে শর্ত সাপেক্ষে আপোস আলোচনায় ছিলেন ব্যস্ত। কিন্তু স্বাধীনতার পরে দেখা গেল শুধু আওয়ামী লীগ একাই স্বাধীনতার সকল কৃতিত্ব দাবি করছে। শুধু তাই নয়, তাদের উপরে পাক হানাদারদের নির্যাতনের নানা কল্পিত কাহিনি প্রচার করে তারাই যে সে সময়ে দেশবাসীর একমাত্র নেতৃত্বে ছিল, শতমুখে সেই দাবি প্রচার করে চলেছে। এদিকে সিদ্দিক সালেকের Wifie5s to S24re/aader পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৫ মার্চ Operation Search Light চলাকালে যাদেরকে জীবিত বা মৃত গ্রেফতার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সেই তালিকায় অলি আহাদ ছিলেন নবম ব্যক্তি। তিনি তাঁর সহগামীদের নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের নেতৃত্ব দেন। যদিও সেই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সব সময়ই অলি আহাদ এবং তাঁর অনুসারীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে।

আজাদ বাংলা আন্দোলন

স্বাধীনতার পর ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান অলি আহাদ। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। ২৫-সালা গোলামী চুক্তির বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশের পুতুল সরকার ও আগ্রাসী ভারতের বিরুদ্ধে আজাদ। বাংলা কায়েমের ডাক দিয়ে তিনিই প্রথম আন্দোলন শুরু করেন।

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা সফর করেন এবং ১৯ মার্চ ভারত-বাংলাদেশ ২৫ বছর মেয়াদী তথাকথিত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পরদিনই ২০ মার্চ ১৯৭২ চট্টগ্রামে জেলা জাতীয় লীগের কর্মী সম্মেলনে এবং ২২ মার্চ লালদীঘি মাঠের জনসভায় অলি আহাদ এ চুক্তিকে গোলামির চুক্তি হিসাবে অভিহিত করে এই চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। কিন্তু ওই চুক্তি বাতিল না করে বরং মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই ২৭ মার্চ মুজিব সরকার ভারত-বাংলাদেশ অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির বিরুদ্ধে অলি আহাদ ১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর দেশব্যাপী ‘আজাদ বাংলা দিবস’ পালনের ডাক দেন এবং পল্টনে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু ২২ ডিসেম্বরই আসে তার জন্য এক চরম দুঃসংবাদ। তার অভিভাবকতুল্য বড়ভাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন অধ্যাপক ড. আব্দুল করিম ইন্তেকাল করেন। তাঁকে অলি আহাদের ভাই হবার অপরাধে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ না দিয়ে তাঁর জুনিয়রকে সেই পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ২৩ ডিসেম্বর অগ্রজের জানাযা পড়ে লাশ কবরে শায়িত করে বেদনাবিধুর মন নিয়েও অলি আহাদ পল্টন ময়দানে নির্ধারিত জনসভার মঞ্চে এসে হাজির হন এবং মুজিবী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখেন।

একইভাবে ১৯৭৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিরুদ্ধে তিনি তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেন এবং এই নিবর্তনমূলক আইন বাতিলের দাবি জানান। তার এই সাহসী ভূমিকাই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে আন্দোলনমুখী চেতনা জাগ্রত করতে সহায়তা করে। তার প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালের ১৪ এপ্রিল গঠিত হয় সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন বাংলা জাতীয় লীগের ৬৩, বিজয়নগরস্থ অফিসকেই সর্বদলীয় ঐকফ্রন্টের অফিস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ২৩ এপ্রিল পল্টনে অনুষ্ঠিত হয় একফ্রেন্টের জনসভা। জনসভায় বিপুল জনসমাগম হয়। এতে ক্ষমতাসীন মুজিব সরকারের টনক নড়ে। সরকার দেশের সকল বড় বড় শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে যাতে বিরোধী দল কোনো সমাবেশ করতে না পারে। ঐক্যফ্রন্ট ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় কর্মীসভা করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।

সরকারের জরিমানা : ১৫ স্বর্ণমোহর

২ জুন, ‘৭৪ ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঐকফ্রেন্টের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সরকার ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার না করলে বা মেয়াদান্তে তা পুনঃ প্রবর্তন করলে ৩০ জুন ১৪৪ ধারা অমান্য করা হবে। সরকার ২৫ জুন থেকে পুনরায় ১৪৪ ধারা বহাল করলে অলি আহাদ ২৮ জুন এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রীট আবেদন পেশ করেন। ৩০ জুন তারিখে সরকার অলি আহাদকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ দিয়ে কারাগারে পাঠায়। মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করলেও কারাগারের পরিবর্তে সন্তোষের বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখে। ৯ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের রায়ে ১৪৪ ধারা জারির আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় এবং মহামান্য আদালত আবেদনকারী অলি আহাদকে মামলার খরচ বাবদ ১৫টি স্বর্ণমোহর প্রদানের নির্দেশ দেন। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী সমস্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছিলেন। অলি আহাদ তখন কারাগারে, মওলানা ভাসানী গৃহবন্দী। এই ফাকে সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ঘোষিত ওয়াদা থেকে সরে গেলেন এবং একফ্রেন্টের ব্যানার গুটিয়ে নিজ নিজ দলের ব্যানারে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে দিলেন। ঐক্য ভেঙ্গে যাওয়ায় মুজিব সরকার হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বাংলা জাতীয় লীগ অলি আহাদসহ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে ১৭ নভেম্বর পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করে এবং এটাই ছিল মুজিব আমলের সর্বশেষ বিরোধী দলের জনসভা। এরপর পল্টনে শুধু নয়, কোথাও কোনো জনসভা হতে পারে নাই। কেননা এরপর ২৮ ডিসেম্বর, ‘৭৪ জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। আর গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সব দল ও সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেমের উত্থাপিত শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশোধনী বিল ১১ মিনিটের মধ্যে ব্রুট মেজরিটির জোরে কোনো সমালোচনার তোয়াক্কা না করেই পাস করা হয় এবং সংসদীয় সরকারের পরিবর্তে একদলীয় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। শেখ মুজিবকে ‘যেন তিনি নির্বাচিত হিসাবে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়।

কী বিচিত্র এই দেশ! সেই আওয়ামী লীগ আজ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হিসেবে নিজেদের কৃতিত্বের দাবিদার! অথচ বাকশাল ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ উল্লাহকে তারা সেদিন অপেক্ষারত একটি বিদেশি প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎকানের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় পর্যন্ত দিতে রাজী হয় নাই। এমনকি কোনো আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বঙ্গভবন কিংবা সংসদ ভবনে শপথ গ্রহণের সময় দিতে কিংবা ধৈর্য ধারণের সৌজনটুকু পর্যন্ত প্রদর্শন করতে পারে নাই। সংসদের লবীতেই শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করানো। হয়। শুরু হয় নতুন স্লোগান :“এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ”।

বাকশাল এবং অতঃপর

বাকশাল আমলে উন্মোচিত হল নীতিহীন রাজনীতিবিদ কবি সাহিত্যিক অধ্যাপক বুদ্ধিজীবীদের আর এক চরিত্র। প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খান, হাজী দানেশ সহ বহু নেতা বাকশালে যোগদানের অনুমতি চেয়ে মুজিব বন্দনার নয়া রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। ব্যতিক্রমদের তালিকায় শীর্ষে থাকলেন অলি আহাদ। জেলের ভেতরেও তাকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে ক্ষমতার প্রতি, কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়। অন্যদিকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের বুলি কপচানো কবি সাহিত্যিক অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক কলামিস্টরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন বাকশালে যোগ দিতে। মাত্র গুটিকয়েক সাংবাদিক সেদিন চরম চাপের মুখেও অনড় থেকেছেন। বাকশালে যোগদান না করে তাঁরা এদেশের সাংবাদিকতার সংগ্রামী ঐতিহ্যকেই সমুন্নত রেখে গেছেন। সেদিন যেসব সাংবাদিক, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী দল বেঁধে মুজিব বাকশালে যোগদান করেছিলেন, তাদের তালিকা অলি আহাদের জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এদেশের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই পুস্তকটি একটি বিশ্বস্ত দলিল। যাহোক, এভাবেই সেদিন মাঠে একদলীয় আওয়ামী বাকশালী স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কোনো সুযোগ রইল না, আর সাহসী কণ্ঠ অলি আহাদ তখন বন্দী হয়ে রইলেন অন্ধকার কার প্রকোষ্ঠে। গোটা দেশ জুড়ে শুরু হল খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, লুণ্ঠন আর সন্ত্রাস। শুরু হল দুর্ভিক্ষে অনাহারে মৃত আদম সন্তানের লাশের মিছিল। প্রতিবাদ করার সব গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ। সারাদেশ যেন এক ভয়াল মৃত্যুপুরী। এমনি সময়ে ১৫ আগস্টের সুবেহ সাদেকের সময়ে ইথারে ভেসে এল সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসের অমিত ক্ষমতাধর শাসক শেখ মুজিবের পতনের ঘোষণা। গোটা দেশ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠল। কারণ মুজিবের পতন যেমন ছিল অবিশ্বাস্য তেমনি দুর্ভাগ্যজনক ছিল তার পতনের প্রক্রিয়াটি। প্রচণ্ড ক্ষোভের ঘূর্ণিঝড়ে শেখ মুজিব একা নন, তার গোটা পরিবার, তাঁর বংশধারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। ১৫ আগস্টের পর অলি আহাদ সহ অন্যান্য রাজবন্দী মুক্তি পেলেন কারান্তরাল থেকে। এর পরের ইতিহাস কম বেশি সবারই জানা।

উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট ‘৭৫-এর পর বাংলাদেশ সত্যিকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্থান করে নিল বিশ্বদরবারে। একে একে মুক্ত হল সংবাদপত্রসমূহ। ইত্তেফাকসহ অন্যসব সংবাদপত্র মালিকরা ফিরে পেলেন নিজ নিজ মালিকানা। এই নিবন্ধের লেখক বাকশালে যোগদান না করায় ইত্তেফাক থেকে চাকুরিচ্যুত হয়েছিলেন। আবার তিনি ইত্তেফাক-এ অধিষ্ঠিত হলেন। বাকশাল আমলে পত্রিকা বন্ধ হওয়ার কারণে শত শত সাংবাদিক চাকরি হারিয়ে সেদিন পথে পথে ঘুরেছেন। বাকশালে যোগদান করেও তারা কেউ রেহাই পান নাই। আজও এদেশে ১৬ জুন সংবাদপত্র জগতে কালো দিবস হিসাবে পালিত হয়ে থাকে। ওই তারিখেই শেখ মুজিবের বাকশাল সরকার সংবাদপত্র কুক্ষিগত করে। যাহোক, ১৫ আগস্টের পর নিষিদ্ধ ঘোষিত সব দল নিজ নিজ ব্যানার ফিরে পেল। ৩ নভেম্বর ঘটল পাল্টা অভূত্থান। ইত্যবসরে। জেলখানায় নিহত হলেন স্বাধীনতা যুদ্ধকালের ৪ নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরল, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। ৭ নভেম্বর বন্দী সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে সিপাহী জনতা মুক্ত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করল। স্বীয় মা ভাইয়ের অতি উৎসাহের খেসারত দিয়ে প্রাণ হারালেন পাল্টা অভুত্থানের নেতা জেনারেল খালেদ মোশাররফ। বাকশালের পেট থেকে সিজারিয়ান অপারেশন করে আওয়ামী লীগকে নবজন্ম দিলেন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনাকে প্রবাস থেকে ফিরে আসার সুযোগও তিনি করে দিলেন। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলেন ১৭ এপ্রিল ‘৮১, আর জিয়া নিহত হলেন ৩০ মে চট্টগ্রামে। এরপর এরশাদ কিভাবে ক্ষমতা দখল করলেন, তা কম-বেশি সবার জানা। আজ ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের নায়করা মৃত্যুর মুখোমুখি; অথচ তাদের জানবাজির ফল ও ফসল ভোগীরা তাদের সপক্ষে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করার নৈতিক সাহস পর্যন্ত প্রদর্শন করতে পারছেন না। রাজনীতির খেলা সত্যি বড় বিচিত্র। শুরুতে জাতীয় কবির যে কবিতা দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম, সেই ধামাধরা—জামাধরাদের চির বিরোধী হচ্ছেন অলি আহাদ। ‘হতাশা’ আর “আপোস’ এ দুটি শব্দ তাঁর রাজনৈতিক অভিধানে নাই। পবিত্র হাদিসে আছে, “জালিম সরকারের মুখের উপর হক কথা বলা উত্তম জেহাদ। আমাদের তোষামোদী আর আপোসকামিতার রাজনীতিতে অলি আহাদকে যদি মর্দে মোজাহিদ’ বলি, ভুল বলা হবে না। দেখা যায়, ক্ষমতায় যে সরকারই থাকুক, সে সরকারের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যরা চুপ থাকলেও তিনি প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। শাসকগোষ্ঠীর যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া প্রকাশে তিনি আজো দ্বিধাহীন ও অকুণ্ঠ। তিনি বিশ্বাস করেন, জনতার মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবেই।

উপসংহার

ক্ষমতার রাজনীতিতে দৃশ্যত অলি আহাদ সফল নন। কিন্তু গণমানুষের কল্যাণে জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ভূমিকা বিশ্লেষণে তার সফলতা ঈর্ষণীয়। আগেই বলেছি, একজন রাষ্ট্রনায়কের যে গুণাবলি থাকার কথা তার সবটুকুই তার চরিত্র ও চিন্তায় বিদ্যমান। তার সান্নিধ্যে একঘণ্টা কাটাতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাস পাঠ নেয়ার জ্ঞান অর্জন করা যায়। তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি বাক্যেই রয়েছে অনুসন্ধিৎসু মনের চিন্তা ও সৃষ্টিশীল রচনার অবিমিশ্র উপাদান। বিশ্ব রাজনীতির প্রতিটি ঘটনা শুধু তাঁর নখদর্পণে নয়, চলমান ঘটনাবলির ব্যাপারে তার বিজ্ঞ-বিশ্লেষণও সত্যি চমৎকার। দেশীয় সংবাদপত্র পাঠের পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিন তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে নিয়মিত পাঠ করেন। জাতিকে নেতৃত্ব দিতে হলে যে জ্ঞানস্পৃহা থাকা অপরিহার্য জীবনসায়াহ্নে এসেও অলি আহাদের মধ্যে আজো সেই জ্ঞানস্পৃহা অপরিসীম। বলতে দ্বিধা ও সংকোচ দুটাই বোধ করছি যে, অলি আহাদের সাথে আমার যে সহমর্মিতা তা তাঁর রাজনীতিতে নয়, বরং তাঁর ব্যক্তিজীবনের সততা, ন্যায়নিষ্ঠা অমায়িক সৌজন্যমূলক ব্যবহারে এবং বিশেষত, এই জ্ঞানস্পৃহার ক্ষেত্রেই। আল্লাহ তার হায়াত আরো দরাজ করুন এবং জাতির বিবেক হিসাবে তাঁকে আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের তওফিক এনায়েত করুন, আমিন!

লেখক সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিশিষ্ট কলামিষ্ট

অলি আহাদকে একজন কবির শ্রদ্ধা

ফজল শাহাবুদ্দীন

উনিশশো সাতচল্লিশ সালের কিছু কিছু ঘটনার কথা এখনো আমার বিস্ময়কর ভাবে মনে আছে। আটচল্লিশ সালেরও। তখন আমি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। আটচল্লিশ সালে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। এক বিস্ময় আর মুগ্ধতার জগতে তখন আমার বসবাস। যেমনটি পৃথিবীর সকল কিশোর আর বালকের জীবনে হয়ে থাকে। ঢাকা তখন অতি ক্ষুদ্র একটি মফঃস্বল শহর মাত্র। দেড় লক্ষ থেকে দু’লক্ষ লোক ঢাকা শহরের বাসিন্দা। দোলাইখাল তখন আমাদের কাছে একটি অন্তরঙ্গ ছোট্ট নদীর মত রক্তকণিকায় বহমান আর বুড়িগঙ্গা বিশাল আকাশের এক একান্ত প্রতিনিধি। বুড়িগঙ্গার ওপারে যে গ্রাম, সেই গ্রামের শ্যামল গাছপালা আর সবুজ অবারিত মাঠ মিশে আছে গগনের আশ্চর্য ললাটে। আমরা তখন স্বপ্নহীন ছিলাম না, আশাহীন ছিলাম না এবং নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যৎবিহীনও ছিলাম না। সেই সময়কার কিছু কিছু ঘটনা আমার, আগেই বলেছি, আশ্চর্যভাবে এখনো মনে আছে। তার একটি অকুস্থল ঢাকার রমনা রেসকোর্স। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব তখন ঢাকায় এসেছিলেন। সেই একবার, প্রথমবার এবং শেষবার। ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা এসেছিলেন। আর ঢাকা রেসকোর্সে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ২১ মার্চ। এই দিন ক্ষণের হিসেব আমার মনে থাকার কথা নয়। এগুলো আমার এখনকার সংগ্রহ। আমি ২১ মার্চের সেই ঐতিহাসিক সভায় উপস্থিত ছিলাম। জিন্নাহ সাহেবকে দেখতে সেই সময় সেই রেসকোর্সে প্রায় তিন লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটেছিল। আমার জীবনে এত বড় জনসমুদ্র সেই আমার। প্রথম দেখা। সেই সময় কেমন করে যেন আমি পুরান ঢাকার দক্ষিণ মৈশল্ডি এলাকা থেকে হেটে হেটেরেসকোর্স পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। এখন তা আমার মনে নেই। তবে আমি যে আমার কলেজে পড়া এক মামার সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম সব সময় সেটা বলতে পারি। মামা বলেছিলেন এমন মিটিং দেখার সুযোগ আর হবে না কোনোদিন। আমার মামার কথার মধ্যে সম্ভবত একটি অন্তর্গত সত্য নিহিত ছিলো—যা ইতিহাসের ক্রমপরিক্রমায় এখন প্রমাণিত হয়েছে। ফিরে আসি আমার কৈশোরের সেই রেসকোর্সে।

আমি আমার মামা এবং আরো যেন কে কে—সর্বমোট চারজন ছিলাম আমরা। কেমন করে যেন মামা আমাদেরকে মঞ্চের সামনাসামনি নিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন এখান থেকে জিন্নাহ সাহেবকে স্পষ্ট দেখা যাবে।

এবং কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সেদিন মঞ্চের অপরাহের আলোতে আমরা সত্যি স্পষ্ট দেখেছিলাম। তার ভগ্নী মিস ফাতেমা জিন্নাহকেও। সেদিন শুধু শুনেছিলাম, দেখেছিলাম এবং প্রত্যক্ষ করেছিলাম। বুঝিনি। জানিনি। এখন বুঝি এবং জানিও।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেইদিন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে তাঁর সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতায় নিজেই বপন করেছিলেন পাকিস্তানের ধ্বংসৰীজ। জানি না কার পরামর্শে কোন সে ব্রীফিং-এর কারণে তার এমন ধারণা জন্মেছিল যে উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। কী সে মহৎ স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সেদিন যার কারণে তিনি প্রায় তিন লক্ষাধিক বাঙালির সামনে মঞ্চ থেকে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, অন্য কোনো ভাষাই হতে পারবে না, বলতে পেরেছিলেন, Urdu and Urdu alone shall be the state language of Pakistan, no other language can be কায়েদে আযম এমন একটি ঐতিহাসিক জনসভাকে কেন যে বাঙালিদের সামনে এই অসম্ভব একটি উচ্চারণ করার যথোপযুক্ত স্থান ভেবেছিলেন তা আজো আমার বোধের অগম্য রয়ে গেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত মাসের মাথায় কেন যে তিনি তার ধ্বংসবীজের প্রথম শস্যকণাটি নিজেই রোপণ করে গিয়েছিলেন বাংলার মাটিতে তা এখনো আমার কাছে এক পরম বিস্ময়।

মঞ্চের সামনে বেশ অনেকটা জায়গা শূন্য ছিল। সম্ভবত সিকিউরিটির কারণে। যেমনটি এ ধরনের সভায় হয়ে থাকে। তারপরই ছিল জনমানুষের স্থান। আমরা সেখানেই ছিলাম। বসেছিলাম প্রায় সামনের সারিতে।

তখনকার ঢাকা শহরের যত বাসিন্দা তার প্রায় দ্বিগুণ বাঙালির এক অচিন্তনীয় মহাসমুদ্র সেদিন প্রায় রুদ্ধশ্বাস হয়ে মুগ্ধতার এক বর্ণাঢ্য আবির মেখে চোখে শুনছিল জিন্নাহ সাহেবের ইংরেজি ভাষার বক্তৃতা। এত যে মানুষ ছুটে এসেছে এই বাংলার অসংখ্য প্রান্তদেশ থেকে তাদের আসল পরিচয় কী জানতেন জিন্নাহ সাহেব? তারা তো শুধু মুসলমান ছিল না, বাঙালিংও ছিল এবং পাকিস্তান নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার জন্যে তারা তো কোথাও এমন কোনো অঙ্গীকার করেনি যে তারা তাদের বাঙালি পরিচয়কে পরিত্যাগ করবে চিরদিনের জন্যে—তাদের মুখের ভাষাকে বিসর্জন দেবে সকল আগামীকালের সমাজ সংস্কৃতি ধর্ম প্রাত্যহিক জীবন কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল কর্মকাণ্ড থেকে। তাহলে জিন্নাহ সাহেব কেন এমন উচ্চারণ করলেন বাঙালিদের সামনে এদেশে তার প্রথম জনসভায়।

আমার মামা সত্যি বলেছিলেন এমন জনসভা সারাজীবনে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না।

জিন্নাহ সাহেবের সেই দিনের সেই উচ্চারণ সেদিন শুনেছিল বাঙালিরা। স্তম্ভিত হয়েছিল কিন্তু স্তব্ধ হয়নি।

সেই বিশাল জনসমুদ্রের এক প্রান্ত থেকে কারা যেন প্রখম পাল্টা উচ্চারণ করে উঠল শেম শেম শেম শেম। অসংখ্য অগ্নিকণার মত সেই শেম শেম ধ্বনি নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল সারা রেসকোর্স জুড়ে। মিনিট দুই-এর কম সময় নয় সেই লজ্জা লজ্জা শব্দ ধ্বনিত প্রতিধবনিত হল রমনার বিশাল বটগাছে পাতার মর্মরে ঘাসের শুকনো শরীরে। মনে হল সারা পূর্ব বাংলা যেন সমবেত এক ধিক্কারে উচ্চারণ করছে হায় একি লজ্জা এই নতুন স্বাধীনতার ; আমার মায়ের কণ্ঠে শানিত অস্ত্র চালাবার একি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এই নতুন আজাদীর?

একটু আগে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে কবি গোলাম মোস্তফার গানে মুখরিত ছিল এই রমনার মাঠ-এই রেসকোর্সের ময়দান।

হঠাৎ একি হল! এ কোন্ পতনধবনি নামল পুবের বাংলা জুড়ে! এই যে সেদিনের কথাগুলো লিখলাম এতদিন পরে। সে সময় কিন্তু ঠিক এমনি করে আমি মোটেই ভাবতে পারিনি। তবে আমার মধ্যে একটি ভীষণ খারাপ লাগা যে কাজ করছিল তখন সেটা বলতে পারি। হলফ করে বলতে পারি। এবং আমার মত সবারই খারাপ লাগছিল। সেই মাঠের সবার। জিন্নাহ সাহেবকে মাইকের সামনে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচিছলাম।

জনসমুদ্রের এই আকস্মিক বিস্ফোরণের জন্যে জিন্নাহ সাহেব নিশ্চয়ই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি কেমন যেন হয়ে গেলেন হঠাৎ। তার স্বতঃস্ফূর্ত ইংরেজি বক্তৃতায় হঠাৎ করেই যতি নামল। সামান্য বিরতি! তারপর পুনরায় কম্পােজড হলেন তিনি। তিনি পরিষ্কার উর্দুতে বললেন, অদ্ভুত এক কমান্ডিং কণ্ঠে—খামোশ রহো অওর আপনা আপূনা জাগাপে বয়ঠো। তিনি আবার ফিরে গেলেন ইংরেজিতে। এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই সভা সমাপ্ত হল। আমার মামা শুধু বললেন, কাজটা ভালো হল না। মাতৃভাষার উপর আক্রমণ কেউ মেনে নেবে না। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধবেই। আজকের মাঠই তো তার প্রমাণ। আজকের এই বিস্ফোরণের যে-ই শুরু করুক না কেন একটা সাহসের সূচনা করেছে সে। একটি নতুন জিজ্ঞাসার নতুন অনুধাবনের। বহুদিন পরে আমরা জেনেছি, অন্তত আমি জেনেছি সেই বিস্ফোরণের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন অলি আহাদ। যাকে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন অলি আহাদ আমাদের রাজনীতিতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। নীতির প্রশ্নে তিনি কখনো আপোস করেননি। প্রলোভন কখনও তাকে বশীভূত করেনি। বলা যায় তিনি আজ জাতির বিবেক-এ পরিণত হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে পড়ি। তখন আমি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলাম না, এবং এখনো নেই, তবু ভাষা আন্দোলন আমাকে কেমন ক’রে যেন জড়িয়ে ধরেছিল। এবং সেই সময় আমি প্রথম অলি আহাদের নাম শুনি। এনমে জানতে পারি অলি আহাদ সেই ব্যক্তি, যিনি ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যের প্রধান চালিকা শক্তির সবচেয়ে বড় প্রেরণা।

অলি আহাদ সাহেবের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ আরও অনেক অনেক পারে। তবে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা কখনো হয়নি। আসলে রাজনৈতিক বিশাল ব্যক্তিত্ব যারা তাদের কারো সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতার কোনো সুযোগই তখন ছিল না—আর এ সম্পর্কে আমি তেমন উৎসাহীও ছিলাম না। যদিও আমার জীবনের একটা বড় অংশই আমি কাটিয়েছি সাংবাদিকতার পেশায়। এসব সত্ত্বেও বায়ান্ন সালের পর থেকেই আমি অলি আহাদ—এই নামের যে মানুষটি তার জন্যে একটা গোপন শ্রদ্ধা সব সময়েই পোষণ করে আসছি। তার সম্পর্কে অনেক গল্পও শুনেছি-সপক্ষে এবং বিপক্ষে। বেশির ভাগই সপক্ষে। সব কিছুকে ছাপিয়ে একটি ঘটনাতে তার সম্পর্কে সবাই একমত হতেন এখনো হন। অলি আহাদ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের আধুনিক কালের সেইসব বিরল মানুষদের একজন, যাকে সত্যনিষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করা যায়। বাংলাদেশের এখনকার যিনি প্রধানমগ্ৰী সেই খালেদা জিয়া যখন বলেছেন, তিনি। আজ জাতির বিবেকে পরিণত হয়েছেন—তখন তিনি নিঃসন্দেহে কোনো অতিশয়োক্তি করেননি। জনাব অলি আহাদ তার রচিত জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ গ্রন্থটিতে অনেক দুর্লভ এবং অমূল্য তথ্য আমাদের জন্যে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত পত্রও প্রকাশ করেছেন। আমি এখানে একটি কি দুটি পত্র থেকে অংশ বিশেষ উল্লেখ করতে চাই। করাচির ৭ নম্বর সমারসেট হাউস থেকে ৪ জানুয়ারি ১৯৫৬ সালে লেখা একটি পত্রে শেখ মুজিবুর রহমান অলি আহাদকে একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিলেন,

তোমাকে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটু অনুরোধ করিতে চাই। আমার ছেলে কামালউদ্দীনকে সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট স্কুলে এবং মেয়েকে {হাসিনা) কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল অথবা বাংলা বাজার স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য দয়া করিয়া চেষ্টা করিবা। তাহাদের জন্যে একজন ভালো শিক্ষক যোগাড় করিবার চেষ্টা করি। সব সময়েই তোমার ভাবীর সহিত যোগাযোগ রাখিবার চেষ্টা করি। সে-ও খুব নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছে। আমি ভালো। আমার কাছে চিঠি দিও। তোমারই মুজিব ভাই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিঠির এ সামান্য উদ্ধৃত অংশ থেকেই বোঝা যায় অলি আহাদকে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কতটুকু ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। আর একটি চিঠিতে মুজিব লিখেছেন, “শরীরের প্রতি যত্ন নিও। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তোমার হতভাগা ভাইকে লেখতে ভুলিও না।”

আমার কাছে অলি আহাদ আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা। খালেদা জিয়াও এমন কথা বলেছেন। “ইতিহাস বিকৃতির শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ সত্যটি আজ ১২ কোটি মানুষের কাছে স্পষ্ট যে অলি আহাদ মহান ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা’–এ উক্তি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। ১৯৪৮ সালে রমনার রেসকোর্সের ময়দানে যে প্রতিবাদী কণ্ঠের ধ্বনি প্রতিধবনি আমি প্রায় বালক বয়সে শুনেছিলাম দেখেছিলাম, সেই ধ্বনি তরঙ্গের অন্যতম নির্মাতা ছিলেন অলি আহাদ। সেই ভাষা আন্দোলনই ১৯৫২ সালে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও ডাইমেনশান পেয়েছিল। পাকিস্তান জেনেছিল, সারা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করেছিল পূর্ব বাংলার মানুষ যুগপৎ বাঙালি এবং মুসলমান। জেনেছিল, বাঙালি মুসলমানরা একটি পৃথক জাতি হিসাবে বাচতে চায়। এবং পরবর্তীকালে এই মানসিক অস্তিত্ব থেকেই বাঙালিরা একদিন স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল। উনসত্তরের গণ আন্দোলনে দিয়েছিল আত্মাহুতি। ১৯৪৮ সালের সেই শেম, শেম প্রতিবাদ থেকে ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষ একটি মুক্তিযুদ্ধের পতাকাকে উত্তোলন করেছিল। এনেছিল স্বাধীনতা।

আমি কী এখন বলব যে, অলি আহাদ নামের একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষ আমাদের স্বাধীনতার প্রথম ধ্বনিটি উচ্চারণ করেছিলেন। সূত্রপাত করেছিলেন একটু নতুন সংগ্রামের। আমি একজন সামান্য কবি মাত্র। রাজনীতির সর্পিল পথ আমার জন্যে নয়। আর এ ব্যাপারে আমি কোনো শেষ কথাও বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই আমাদের রাজনীতিতে এই যে একজন সত্যিকার সত্যনিষ্ঠ সেনানী তাঁকে যেন আমরা চিরকাল শ্রদ্ধা করি, মনে রাখি। কেননা সত্যকে নির্বাসিত করা মানেই জীবনের উল্টো দিকে যাত্রা করা।

ভাষাসৈনিক অলি আহাদের প্রাণনাশের হুমকি

আওয়ামী শাসনে কেউই নিরাপদ নয়

আবদুল গফুর

সম্পাদকীয় কলাম লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে খুব সমস্যায় পড়তে হয়। মনের মত সাবজেক্ট পাওয়া যায় না। এবারে তেমনটি হয়নি। এন্তার বিষয়বস্তু ছিল সামনে। চীফ ইলেকশন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে সরকারের পাতা ফাদে বিএনপি পা প্রায় দিয়েই ফেলেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি নাগরিকদের নিয়ে সন্তু লারমাদের ষড়যন্ত্র সরকারের জন্য সৃষ্টি করেছে নাজুক অবস্থা। তারা একদিকে বাঙালিদের এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহারের দাবি অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে লক্ষাধিক ভারতীয় উপজাতিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈধতা দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে। তাছাড়া এই সপ্তাহেই ছিল মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের স্মৃতিবাহী ১৬ মে। সে উপলক্ষে ও বাংলাদেশের উপর ফারাক্কা বাধের সর্বনাশা প্রভাব এবং গঙ্গার পানিচুক্তির নামে নবতর প্রতারণা নিয়েও লেখা যেত। তাছাড়া শ্রীলংকা, সিয়েরালিয়েন প্রভৃতি বিদেশি তরতাজা বিষয় তো ছিলই। এসবের কোনো একটা নিয়ে লিখব বলেই চিন্তা করছিলাম। কিন্তু এর মধ্যেই পত্রিকায় দেখলাম, বিপ্লবী ভাষাসৈনিক প্রবীণ জননেতা অলি আহাদের অফিসে সন্ত্রাসী হামলা এবং তাঁর প্রাণনাশের হুমকির সংবাদ। আগের সকল পরিকল্পনাই আমার নিমেষে বদলে গেল।

অলি আহাদ। হ্যা, দুটি শব্দের ছোট্ট এ নামটির পেছনে রয়েছে যে ব্যক্তিত্ব, তিনি মোটেই ছোট্ট নন। আমাদের জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে হাতে গোনা যে দু’একজন ব্যক্তিকে মানুষ প্রকৃত প্রস্তাবেই শ্রদ্ধা করে থাকে, তিনি তাদের অন্যতম। অন্তত আমি আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের যে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা করি, তিনি তাদের অন্যতম। সন্ত্রাসীরা তার অফিসে চড়াও হয়েছে, তার প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে, এ খবরটি পড়ার পর আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলাম না। জনাব অলি আহাদ তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রায় অজানা একটি নাম। তারা জানে না আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তার কোনো গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আছে কি না। কারণ আমাদের রাজনীতিতে এবং রাজনীতির ইতিহাসে এখন সুবিধাবাদী চাণক্যতন্ত্রের প্রভাব যেমন প্রবল, তেমনি প্রবল ও প্রকট গোয়েবলসীদের প্রভাব। শতবার শতমুখে মিথ্যাকে সত্য বলতে বলতে তাকে সত্যে রূপান্তরিত করতে আমরা অশেষ পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়ে থাকি। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী টোপ এবং দেশি কালো টাকার প্রভাবে দেশপ্রেমমূলক রাজনীতির যেখানে দেশছাড়া হবার দশা, সেখানে অলি আহাদের মত জাতির কল্যাণকামী সৎ দেশপ্রেমিক ব্যক্তির তো অপাঙক্তেয় হবারই কথা। তাই তার নাম আজ আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রায় অজানাই রয়ে গেছে।

জনাব অলি আহাদের নাম তরণ প্রজন্মের কাছে অজানা হলেও এটুকু তাদের সকলেরই জানতে হয় যে, এই যে আজকের বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র, এর উদ্ভবের পেছনে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের বিরাট অবদান ছিল। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই এদেশে জন্ম নিয়েছিল স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন। এই স্বাধিকার চেতনা ধ্বংস করে দেবার লক্ষ্যে একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র জনগণের উপর সর্বাত্মক হামলা শুরু করলেই জনগণ অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে বাধ্য হয়। জনাব অলি আহাদ ভাষা আন্দোলনসহ আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতিটি সংগ্রামেই বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ করেছিলেন।

জনাব অলি আহাদ মূলত পরিচিত একজন ভাষাসৈনিক হিসাবে। আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ছোট-বড় অনেকেই অনেকভাবে অংশগ্রহণ করেন। তারা সবাই ভাষাসৈনিক রূপে আখ্যায়িত হবার দাবিদার। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তুমদন মজুলিশের অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। সে নিরিখে তিনি ভাষা আন্দোলনের স্থপতি হিসাবে পরিচিত। তারপর থেকে দীর্ঘ ভাষা সংগ্রামের বিভিন্ন স্তরে যারা অংশগ্রহণ করেন, তারা সবাই ভাষাসৈনিক। কিন্তু অলি আহাদকে কেবলই ভাষাসৈনিক বললে সবটুকু বলা হয় না। ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকে শুরু করে আটচল্লিশ এবং বিশেষ করে বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামে তার শুধু সৈনিকের নয়, ছিল সেনাপতির ভূমিকা। নানা বাধাবিপত্তির মুখে ভাষা আন্দোলনের দীপশিখাকে প্রজ্বলিত রাখতে এবং তা আরও জোরদার করতে তিনি যে ভূমিকা পালন করেন, তা ছিল এককথায় অনন্য।

কিন্তু না, শুধু ভাষা আন্দোলনেই নয়, সমসাময়িক কালের সকল রকম গণআন্দোলনেই তাঁর ছিল বলিষ্ঠ নিরাপোস ভূমিকা। ভাষা আন্দোলন ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আন্দোলনে, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনে, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার দায়ে তাঁকে অসংখ্যবার কারাবরণ করতে হয়েছে, পুলিশী জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হয়েও তার উচ্চশিক্ষার পথে নির্মিত হয়েছে অলঙ্ঘ বাধা।

| আজন্ম একজন সৎ, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক ও স্পষ্টভাষী মানুষ হিসাবে জনাব অলি আহাদ জীবনে নিৱাপোস সংগ্রামের পথই বেছে নিয়েছেন। ফলে দেশের প্রচলিত ধারার সুবিধাবাদী রাজনীতির অঙ্গনে রাজনীতি করে ফায়দা লোটার বা আখের গোছানোর ব্যাপারে পারঙ্গমতা দেখানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। চলতি ধারার সুবিধাবাদী রাজনীতির গভট্টালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে আখের গোছাতে না পারাটা যদি তাঁর ব্যর্থতা হয়, তবে তিনি নিঃসন্দেহে ব্যর্থ, যেমন অনেকের মতে ব্যর্থ ছিলেন এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত মানবতার কণ্ঠস্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আর প্রকৃতপক্ষে হয়ত এ কারণেই তিনি অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এলেও একমাত্র মওলানা ভাসানীকেই রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ গণ্য করেছেন। তরুণ প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে না জানলেও এদেশের অসংখ্য লোক জানে, আমাদের রাজনীতি ক্ষেত্রের এই কিংবদন্তিতুল্য বিপ্লবী রাজনীতিকের বর্ণাঢ্য সংগ্রামী ইতিহাস। চল্লিশের দশকে সে কালের রাজনীতিসচেতন ছাত্রদের মত তিনিও যোগ দিয়েছিলেন লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে গণআজাদী লীগ, পরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতি ক্ষেত্রে সক্রিয় হন। ১৯৪৮ সালে যখন ছাত্রলীগ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি ছিলের সেই ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা শহর ছাত্রলীগের আহবায়ক। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের তিনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগকে গণসংগঠনে পরিণত করতেও সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এক পর্যায়ে তিনি আতাউর রহমান খানের সাথে মিলে জাতীয় লীগ গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তিনি এক পর্যায়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের সাথে মিলে ডেমোক্র্যাটিক লীগও করেন। বর্তমানে তিনি ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জীবনে তিনি বহু দল গড়েছেন, করেছেন এবং ছেড়েছেন। কিন্তু যা ছাড়েননি, তাহল শোষিত-বঞ্চিত মানুষ ও জাতির প্রতি পবিত্র দায়িত্ববোধ। এ ক্ষেত্রেও মরহুম মওলানা ভাসানীর সাথে তাঁর জীবনের অদ্ভুত মিল।

আরেকটি ব্যাপারেও মরহুম মওলানা ভাসানীর সাথে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ। সাযুজ্য লক্ষ করা যায়। মওলানা ভাসানীর মতই জনাব অলি আহাদ বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিলেও পরবর্তীকালে প্রথম সুযোগে দুজনই নন-কম্যুনাল রাজনীতি প্রবর্তনায় উদ্যোগী হন। দুজনের রাজনীতিতেই একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় কাটে বামপন্থীদের সহযাত্রী হিসাবে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আধিপত্যবাদী অপশক্তি যখন বাংলাদেশের সার্বভৌম অস্তিত্বকে মিটিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল, উভয়ই সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী সে চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। আধিপত্যবাদী অপশক্তির সেবাদাসরা এতে কে কী বলল, তার পরোয়া করেননি তারা। এই যে সময়ের দাবির প্রতি সচেতন থাকা, এটাই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তও মওলানা ভাসানীর রাজনীতিকে জনগণের কাছে রেলিভেন্ট করে রেখেছিল।

জনাব অলি আহাদও বর্তমানে বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। কিন্তু বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হলেও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে জনগণের কাছে সমভাবে রেলিভেট রয়ে গেছে যা এদেশের বহু নেতারই বৃদ্ধ বয়সে দেখা যায়নি।

কিন্তু এই যে বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হয়েও জনাব অলি আহাদ জাতির নাড়ির স্পন্দন সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন এবং এর প্রেক্ষাপটে সাহসী বক্তব্য উচ্চারণ করতে পারছেন—সম্ভবত এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মওলানা ভাসানী বাংলাদেশ আমলে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সমালোচনা করায় তার এক কালের শিষ্যদের হাতে গৃহবন্দী হয়ে নিগ্রহ ভোগ করেন। জনাব অলি আহাদ তাঁর এককালের কিছু সহকর্মী ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের শাসনামলে শিকার হয়েছেন তাদের নিগ্রহ ও সন্ত্রাসের। জনাব অলি আহাদের অফিসে যারা হামলা চালিয়েছে এবং তার প্রাণনাশের যারা হুমকি দিয়েছে জানা গেছে, তারা শাসক দলেরই লোক। তাদের এবং তাদের আধিপত্যবাদী মনিবদের সমালোচনা করায় জনাব অলি আহাদের প্রতি তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ। এই ক্ষুব্ধতা তারা যে পন্থায় প্রকাশ করেছেন, সে পথ কতটা অবাঞ্ছিত, তা ভেবে দেখার সময় তাদের হয়েছে বলে মনে হয় না। এটাই হয়ত বর্তমান শাসক দলের বৈশিষ্ট্য। তাদের এ বৈশিষ্ট্য যে হঠাৎ সাম্প্রতিককালে তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তাও নয়। এটা মনে হয় তাদের একেবারেই নিজস্ব স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। কী সরকারে থাকুক, কী সরকারের বাইরে বিরোধী দলে থাকুক, আওয়ামী লীগ সব সময় ক্ষমতার দাপটে বিশ্বাসী। ক্ষমতাসীন থেকে আওয়ামী লীগ বর্তমানে বিএনপিসহ বিভিন্ন ছোট বড় বিরোধী দলের প্রতি যে আচরণ করছে তার দশ ভাগের এক ভাগও যদি অন্য কোনো সরকারের আমলে তাঁদের প্রতি করা হত তাহলে তারা হৈ চৈ তুলে দেশময় একটা অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলত। বর্তমানে তারা বিরোধী দলের উপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েও বিরোধী দলই যে “মহা অন্যায় করেছে, সে প্রচারণায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। হরতালের দৃষ্টান্ত বিবেচনা করলেই এ ক্ষেত্রে করুণ সত্যটি বেরিয়ে আসবে। আওয়ামী লীগ বিএনপি আমলে যতদিন হরতাল করেছে, তার সিকিভাগ হরতাল না করতেই বিএনপি হরতালের রাজনীতি ছাড়া গঠনমূলক রাজনীতি বোঝে না—এ মর্মে প্রচারণা চালানো হচেই। যদি কেউ সে আমলে আওয়ামী লীগের হরতালের ফিগার তুলে ধরে, আওয়ামী লীগের সোজা উত্তর : সে হরতালের প্রয়োজন ছিল! আওয়ামী লীগের কাছে যুক্তির কোনো মূল্য নেই, মূল্য শুধু ক্ষমতার, মূল্য দাপটের। আওয়ামী লীগ দেশের সর্ব পুরাতন রাজনৈতিক দল হিসাবে তাদের সাংগঠনিক শক্তি বেশি। তাই সাংগঠনিক শক্তির দাপটে তারা বিরোধী দলে থাকাকালে যেমন রাস্তা গরম রাখতে অভ্যস্ত, তেমনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালে প্রশাসনে চরম দলীয়করণ করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে বিরোধী দলকে ঠাণ্ডা রাখতে অভ্যস্ত। তাদের আচরণ যে স্ববিরোধিতায় পূর্ণ, তা দেখার তাদের সময় কোথায়? কারণ আওয়ামী লীগই একমাত্র দল, যারা বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যেমন হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর চলিয়েও ‘গণতান্ত্রিক থাকতে পারে তেমনি সরকারে থাকা অবস্থায় প্রশাসনে চরম দলীয়করণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়েও ‘গণতান্ত্রিক’ থাকতে পারে। মুজিব শাসনামলে যারা পত্রিকায় লিখতে পারত, ‘আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন চাই’, তারা হাসিনার শাসনামলে হাই কোর্টের সিনিয়র বিচারকদের বিরুদ্ধে লাঠিমিছিল চালিয়েও ‘গণতান্ত্রিক’ থাকবে, তাতে আর বিচিত্র কি! | জনাব অলি আহাদ প্রবীণ ভাষাসৈনিক, সৎ, দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদ—তাতে কি! তিনি যদি আওয়ামী লীগের ভুল ধরেন, সমালোচনা করেন, তাঁকে শিক্ষা দেয়া দরকার! এই শিক্ষা দিতেই তাঁর অফিসে হামলা চালানো হয়েছে। তার প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। এ খবর পড়ে আমরা যত দুঃখিত বা ব্যথিতই হই, এতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। কারণ দেশে আওয়ামী লীগের শাসন চলবে, আর চাটার দলের উৎপাত থাকবে না, দেশে আওয়ামী শাসন চলবে, আর লুটপাটতন্ত্র কায়েম হবে না, দেশে আওয়ামী লীগের শাসন। চলবে আর সন্ত্রাস চলবে না, এ তো হতে পারে না। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে যেমন সন্ত্রাস চলতে হবে, তেমনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে রাষ্ট্রীয় ছায়াতলে দলীয় সন্ত্রাস চলবে—তবেই না মানুষ আওয়ামী লীগ কী চিজ তা বুঝতে পারবে। আওয়ামী লীগ আইনের শাসন বোঝে না। আওয়ামী লীগ বোঝে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর শাসন। এই শাসনের বিরুদ্ধে জনাব অলি আহাদসহ যারাই কথা বলবেন, তারাই সন্ত্রাসের শিকার হবেন, এটাই এখন ধরে নিতে হবে। আমাদের ইতিহাসে জনাব অলি আহাদের গুরুত্ব ও অবস্থান কোথায়, এটা দেখার বিষয় আওয়ামী লীগের নয়। যারাই আজ দেশ সম্পর্কে, দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সামান্য চিন্তাভাবনা করেন, তারা সবাই আজ উদ্বিগ্ন। সবার মনে প্রশ্ন এই যে আমাদের দেশে জনাব অলি আহাদের মত প্রবীণ ভাষাসৈনিকের উপর যেখানে হামলা হতে পারে, যেখানে প্রকাশ্যে তার প্রাণনাশের হুমকি দিয়েও সন্ত্রাসীরা আইনের স্পর্শ এড়িয়ে চলতে পারে, সেখানে অন্যদের নিরাপত্তার আশা কোথায়?

পরিশিষ্ট-ঘ

সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়, ২২ অক্টোবর, ২০১২

অলি আহাদের তিরোধান

সংবাদপত্রের পাতা থেকে

জাতি একজন দেশপ্রেমিক নেতাকে হারিয়েছে

অলি আহাদ ছিলেন প্রকৃতই জাতীয় নেতা

গত ২০ অক্টোবর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রধান নায়ক ও দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা অলি আহাদ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজনীতিতেও অলি আহাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করার ওপর ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। সরকারের বিরোধিতাকে সে সময় রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হত। অমন এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও অলি আহাদ প্রগতিশীল সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক। নামে অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও যুবলীগ অনেকাংশে বিরোধী দলের ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত যুবলীগের এই ভূমিকা অব্যাহত ছিল। যুবলীগ তাজউদ্দিন আহমদ ও মোহাম্মদ তোয়াহার মত অনেক রাজনৈতিক নেতাও তৈরি করেছে। অলি আহাদের অবদান সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য বিশেষ করে ১৯৫০-এর দশকের রাজনীতি পর্যালোচনা করা দরকার। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল প্রথম বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এর সঙ্গেও শুরু থেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন অলি আহাদ। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে অলি আহাদকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। সে অধিবেশনেই শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পরপর ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ‘যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে প্রণীত ঐতিহাসিক ২১ দফা’ ছিল যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচি। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটেছিল। ২৩৭টি আসনের মধ্যে দলট মাত্র ১০টি আসনে জিততে পেরেছিল। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগ একাই জিতেছিল ১৪৩ আসনে। শেরে বাংলার কৃষক-শ্রমিক পার্টি পেয়েছিল ৪৮টি আসন। অন্য আসনগুলোতেও যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলোই জিতেছিল। কিন্তু এই বিরাট বিজয় সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার তথা অজিকের বাংলাদেশের শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটানো যায়নি। এর কারণ ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, যার শুরুটা করেছিলেন কোনো এক বিশেষ নেতা। আগে থেকে তৈরি সমঝোতার বিরুদ্ধে গিয়ে পরবর্তীকালে ‘পূজনীয় হয়ে ওঠা এই নেতা মন্ত্রী হওয়ার আবদার জানিয়ে বসেছিলেন। মওলানা ভাসানীর অনুরোধে অগত্যা তাকে মন্ত্রী বানানো হলেও যুক্তফ্রন্টে ভাঙন শুরু হয়েছিল। এরই ফায়দা নিয়েছিলেন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। শেরে বাংলার নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কলমের এক খোঁচায়।

সেই থেকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি কেবল ডাল-পালাই বিস্তার করেছে। এর ফলে একদিকে প্রদেশের শোষণ ও বঞ্চনা বেড়েছে, অন্যদিকে আদায় করা যায়নি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রধান নাৰিটিও। কথা আরও আছে। একই নেতার অপতৎপরতার কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যেও ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। তারা এমন এক সংবিধানের পক্ষ নিয়েছিলেন যে সংবিধানে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিটিই অস্বীকৃত হয়েছিল। খুবই কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হল, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে সংবিধানটি যখন পাস করা হয় তখন কিন্তু এই একই নেতা স্বায়ত্তশাসন না দেয়ার প্রতিবাদে ওয়াক আউট করেছিলেন। তিনি অবশ্য একা ছিলেন না, তারও একজন নেতা ছিলেন—যিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়ে ঘোষণা করেছিলেন, সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে নাকি ‘৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এভাবে পাকিস্তানিদের দালাল করার পরও ওই নেতার নেতা এবং নেতা নিজেও ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। মাঝখান দিয়ে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে উপলক্ষ বানিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান।১৯৫৮ সালের অক্টোবরে জারি হয়েছিল প্রথম সামরিক শাসন।

বলা দরকার, অলি আহাদের অবদান সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্যই ইতিহাসের এ অধ্যায়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ, একজন মাত্র ব্যক্তির অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য সেকালের পূর্ববাংলাকে চরমভাবে বঞ্চিত ও অসম্মানিত হতে হয়েছিল। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অলি আহাদ দাঁড়িয়েছিলেন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। হাতছানি শুধু নয়, মন্ত্রিত্বের সুযোগ অবারিত থাকা সত্ত্বেও তিনি বরং স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিলেন এবং ক্রমাগত আরও জোরদার করেছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাও বিরাট নির্ধারক ছিল। মূলত জেনারেল আইয়ুব খানের উদ্যোগে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একের পর এক সামরিক চুক্তি ও জোটে জড়িয়ে পড়েছিল। এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত না করা গেলে স্বায়ত্তশাসন আদায় করা সম্ভব ছিল না। সে কারণেই মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে গ্রথিত করেছিলেন। অলি আহাদ ছিলেন সে আন্দোলনের দুর্দান্ত সাহসী নেতা। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে অলি আহাদ দলের ভেতরে শুধু নয়, পুস্তিকা ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে জনগণের মধ্যেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। আওয়ামী লীগের এ সংক্রান্ত অনেক প্রস্তাবও ছিল। অন্যদিকে পূজনীয় হয়ে ওঠা সেই নেতার নেতৃত্বে অলি আহাদকে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য রীতিমত অভিযান শুরু হয়েছিল। একই কারণে আওয়ামী লীগ এসে গিয়েছিল ভাঙনের মুখোমুখি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল বলেই দলের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক ‘কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি। অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কাউন্সিলরদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অলি আহাদের তথা দলের ঘোষিত অবস্থানের পক্ষ নিলেও পূজনীয় সেই নেতা তার দলবল ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে স্বায়ত্তশাসনের প্রধান দাবিটিকে পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছিলেন। সব। মিলিয়ে তারা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন যখন দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীকে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন একটি দল গঠন করেছিলেন। ইতিহাসের পরিহাসও এখানে স্মরণ করা দরকার, ১৯৫০-এর দশকে ক্ষমতার লোভে যিনি পাকিস্তানিদের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করেছিলেন অনেক চপেটাঘাত খাওয়ার পর সে নেতাকেই ১৯৬০-এর দশকে এসে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষ নিতে হয়েছিল। বড় কথা, এ ব্যাপারেও প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যে কেউ যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৯ নম্বর দফার সঙ্গে আরেক ঐতিহাসিক ছয় দফা মিলিয়ে দেখতে পারেন। দেখা যাবে, ১৯ নম্বর। দফার বাক্যগুলোকেই এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয় করে ছয় দফা বানানো হয়েছে। পার্থক্য হল, মওলানা ভাসানী এবং অলি আহাদ যখন আন্দোলন করেছিলেন তখন যদি ক্ষমতার লোভে কারও কারও বিচ্যুতি না ঘটত এবং কোনো কোনো পূজনীয় নেতা যদি পাকিস্তানিদের সেবাদাসে পরিণত না হতেন তাহলে ১৯৫০-এর দশকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি আদায় করা সম্ভব হত। বাঙালি জনগোষ্ঠীকেও বঞ্চিত, শোষিত ও নির্যাতিত হতে হত না। বৈষম্যের শিকার তো বানানো যেতই না। কিন্তু ওই নেতারা তখন ‘৯৮ ভাগ’ স্বায়ত্তশাসনে দেয়ার গালগল্প শুনিয়েছেন। অন্যদিকে জাতির সে দুঃসময়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে হলেও অলি আহাদ ভূমিকা পালন করেছেন পূর্ববাংলার তথা আজকের বাংলাদেশের স্বার্থে। এখানেই ক্ষমতালোভী ‘পূজনীয় নেতাদের সঙ্গে অলি আহাদের পার্থক্য।

স্বাধীনতার প্রশ্নেও অলি আহাদ সব সময় অগ্রবর্তী অবস্থানেই থেকেছেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে ১২ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটলেও পাকিস্তান সরকার চরম উপেক্ষা দেখিয়েছিল। এর প্রতিবাদে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে অলি আহাদ জনগণের প্রতি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছিলেন। একই কারণে ১৯৭০ সালের পাকিস্তানি নির্বাচনও বর্জন করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের মার্চে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা বৈঠকের বিরুদ্ধেও অলি আহাদ সোচ্চার থেকেছেন। সমঝোতা চেষ্টার তব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, শেখ মুজিবের উচিত স্বাধীনতা ঘোষণা করা এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উচিত জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাপ্য সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দেয়া। স্বাধীনতার পক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়া সওেও আওয়ামী লীগ করতেন না বলে ভারত তাকে সুনজরে দেখেনি। যুদ্ধকালীন নেতারাও তাকে সুযোগ দেয়ার উদারতা দেখাননি। এদিকে স্বাধীনতার পরও অলি আহাদের দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহতই ছিল। ভারতের অবাধ লুণ্ঠনের তীব্র বিরোধিতা করেছেন তিনি। দেশটির আধিপত্যবাদী নীতি ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন এই দেশপ্রেমিক নেতা। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নির্যাতন এবং অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী আন্দোলনে প্রধান একজন নেতার ভূমিকা পালন করেছেন অলি আহাদ। এজন্য তাকে পুলিশের লাঠিপেটা হজম করতে হয়েছে, কারাগারেও যেতে হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিকুলতার মুখেই থেমে পড়েননি তিনি। তার এই দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্মানজনক অবস্থানে রাখার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন। মন্ত্রিত্ব কিংবা রাজনৈতিক কোনো সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চিন্তা পর্যন্ত করেন নি কখনও। তিনি বরং শিখিয়ে গেছেন, ক্ষমতায় না গিয়েও কীভাবে দেশ ও জাতির স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে হয়।

আমরা এই মহান দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করছি। সরকারের পক্ষ থেকে তার প্রতি যে অবহেলা ও অসম্মান দেখানো হয়েছে আমরা তার বিরুদ্ধেও তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই। স্বীকৃতি ও সম্মান পেতে হলো বিশেষ একটি দলাই করতে হবে এবং ওই দল না করলে এমনকি মুক্তিযোদ্ধাকেও রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হবে এ ধরনের অসভ্যতা সমর্থনযোগ্য নয়। বলা দরকার, বাংলাদেশ বুড়িগঙ্গার মত কোনো নদীতে ভাসতে ভাসতে এসে হাজির হয়নি। নৌকাও কোনো একজন মাত্র নেতাই শুধু চালাননি। দেশটিকে তৈরি করার পেছনে মওলানা ভাসানী ও অলি আহাদের মত অসংখ্য নেতারও প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। সুতরাং যথাযথ সম্মান দেখানো দরকার তাঁদের প্রতি। আমাদের বিশ্বাস, ইতিহাসকে বন্দী করে রাখা যাবে না এবং এক সময় সঠিক ইতিহাস অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। লিখিতও হবে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে। তখন নিশ্চয়ই একজন মাত্র নেতাকেই পূজার অবস্থানে রাখা যাবে না। অন্যদের সঙ্গে অলি আহাদও সম্মানিত ও আদৃত হবেন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা হিসেবে। জনগণের মধ্যে তিনি সংগ্রামের দিশারি হয়েই বেঁচে থাকবেন।

দৈনিক আমার দেশ

Death of Oli Ahad- a tremendous loss

Oli Ahad, a politician of unshakable commitment towards freedom and democracy, passed away in the city on Friday. He was 85. In the times of the reign of self-seeking politicians, Bangladesh lost a leader known for his selflessness. Oli Ahad had not been active in politics for quite some time because of his illness, on the one hand, and extremely deteriorated political culture, on the other. So he suffered illness, and died, silently, with the members of the younger generation having hardly any knowledge of what a great politician the country has lost in his death. While historians suggest that the language movement of 1952 was the prelude to the country’s successful war of national independence in 1971, Oli Ahad was a pioneering leader of the language movement that began in 1948. He was one of the people arrested on March 11, 1948, the day the erstwhile Rashtrabhasa Sangram Parishad enforced the first ever East Bengal-wide general strike to push for the demand for making Bangla a state language of the then Pakistan. Again, it was Oli Ahad who, as history suggests, displayed the guts to ask Jinnah at a meeting with the latter in Dhaka on March 24, 1948, ‘if he was not behaving like a dictator in deciding the issue of the state language which should have been done by the constituent assembly of Pakistan. Again, Oli Ahad was one of the few who asserted at the meeting of the ‘all-party committee for the state language in the night of February 20, 1952 that they must defy the government ban on rallies and processions the next day to make Bangla as a state language. It is now history that the breaking of the ban by general students, despite the majority of the leaders’ reluctance to do so, the terrible beauty of martyrdom was created on February 21, 1952 that sowed the seeds of national independence. He was the founder general secretary of the left-leaning Ganatantrik Juba League, which substantially influenced the language movement towards its secular democratic ends. Not surprisingly, the Dhaka University authorities of the day did not allow Oli Ahad to appear in M Com examinations although he stood first in the Bachelor of Commerce examinations.

Oli Ahad had always worked for democratic empowerment of people and, therefore, played leading roles in people’s struggle for democratic emancipation of people both before and after the independence of Bangladesh. In the process, he had spent large part of his life in jail, again, during the military regimes of Pakistan and Bangladesh. He never ran after personal power that many of his contemporaries did.

While Oli Ahad set an example of selfless politician throughout his life, one must admit that his brief involvement with Khandaker Mushtak Ahmed in floating Democratic League after the tragic murder of the country’s founder president Sheikh Mujibur Rahman would remain a controversial part of his glorious political life. It was good that he parted ways with Mushtak soon. However, Oli Ahad would also be remembered for his book Jatiya Rajneeti : 1945 Theke 75 (National politics : 1945-1975), which is an objective chronicle of the country’s three decades of political events and personalities.

The daily New Age

অলি আহাদের ইন্তেকাল

অকুতোভয় দেশপ্রেমিকের বিদায়

প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিক অলি আহাদ (৮৫) দীর্ঘ দিন রোগভোগ এবং কয়েক দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত শনিবার ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, কন্যা এবং অসংখ্য ভক্ত-গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আমরা দেশের এই কৃতী সন্তানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তার শোকাহত পরিজনের প্রতি আমরা জানাই গভীর সমবেদনা। অলি আহাদ ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির একজন কিংবদন্তিতুল্য সং, সাহসী, নিষ্ঠাবান ও আদর্শবাদী নেতা। তাঁর মত ত্যাগী, দেশপ্রেমিক ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা এ দেশ ও জাতির গর্ব। অলি আহাদের সংগ্রামী, বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন প্রায় ৬০ বছর বিস্তৃত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে স্বদেশ মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নিয়ে কিশোর অলি আহাদ রাজনীতির প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন। এরপর দুবার স্বাধীনতার মাধ্যমে যথাক্রমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অর্জনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও অর্জিত হয়নি জনগণের মুক্তি। অলি আহাদের সংগ্রামও তাই শেষ হয়নি। বার্ধক্যে দীর্ঘ রোগশয্যাও তাকে জাতির সঙ্কট ক্ষণেও দেশের ক্রান্তিলগ্নে সোচ্চার হওয়া থেকে নিরস্ত করতে পারেনি। যৌবনকালের সাড়া জাগানো বামপন্থী সংগঠক অলি আহাদ পরিণত বয়সে মধ্যপন্থী গণতন্ত্রী নেতা হিসেবে কয়েক দশক ধরে ভূমিকা পালন করে গেছেন। বাংলাদেশে আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ, শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী রাজনীতির যে ঐতিহ্যময় ধারা দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী জনতার ভরসা, অলি আহাদ ছিলেন এর অন্যতম অকুতোভয় অগ্রসেনানী। পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধিকার সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল। অলি আহাদ এতে নেতৃত্ব পর্যায়ে যে অবদান রেখেছিলেন, তা এক কথায় অবিস্মরণীয়। এরপর স্বায়ত্ত্বশাসন, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, মৌলিক অধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন, গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রভৃতি দাবিতে সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি বরাবরই ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। ষাটের দশকের গণ-অভ্যুত্থান এবং এরপর মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। বাংলাদেশ আমলেও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে অংশ নিয়ে জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে তিনি পিছপা হন নি কখনো। আমরা মনে করি, পরিণত বয়সে অলি আহাদ চিরবিদায় নিলেও তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতির ক্ষতি হল অপূরণীয়। অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে নিঃস্বার্থ-নিঃশঙ্ক সংগ্রামের যে চেতনা তিনি আজীবন ধারণ করেছেন, আমরাও যদি এতে উদ্বুদ্ধ হতে পারি, সেটাই হবে তাঁকে স্মরণ ও শ্রদ্ধার প্রকৃষ্ট পন্থা।

দৈনিক নয়াদিগন্ত

ভাষাসৈনিক অলি আহাদের ইন্তেকাল

তিনি ছিলেন সময়ের সাহসী সন্তান

ভাষাসৈনিক, রাজনীতিক, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সভাপতি ও ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা অলি আহাদ গত শনিবার ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। বরেণ্য এই ভাষাসৈনিক এক সপ্তাহ আগে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। প্রবীণ এই জননেতাকে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনেই বেগম খালেদা জিয়া শনিবার চীন থেকে দেশে ফেরার পর বিমান বন্দর থেকে সরাসরি হাসপাতালে ছুটে যান। শোকবাণীতে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, অলি আহাদ মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তৎকালীন স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সংগঠিত করেছিলেন ছাত্র-জনতাকে মাহ’ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে শামিল হওয়ার জন্য। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তিনি সারাজীবন স্বদেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত।

অলি আহাদের লড়াকু জীবন শুরু হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ গেটের পাশে জমায়েত হতে শুরু করে। অলি আহাদ সেখানে যান। তিনি ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত দেন। অলি আহাণই হচ্ছেন ১৪৪ ধারা ভাঙার অগ্রবর্তী সৈনিক। পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন ও আবদুল জব্বার মারা যান। গ্রেফতার হন অলি আহাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি দেশ স্বাধীন করার জন্য সংগঠিত করতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধকে। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যখন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে আসসালামু আলাইকুম দেন, তখন মজলুম জননেতার পাশে ছিলেন অলি আহাদ। স্বাধীনতার পরে মুজিব সরকার স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্তেহাদ সরকারের তীব্র সমালোচনা শুরু করে। আওয়ামী দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, আধিপত্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ইত্তেহাদকে গ্রেনেড করে ছুড়ে মারেন। ইত্তেহাদ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তিনি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। মুজিবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দেন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার বাকশাল কায়েম করলে এর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সংবিধান সংশোধন করে ভারতকে বেরুবাড়ি দেয়া হলে তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি কলম ধরেন। আন্দোলনসংগ্রামের অকুতোভয় এই লড়াকু সৈনিককে মুজিব সরকার ভয় পেতে শুরু করে। তার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে মুজিব সরকার তাকে বিশেষ আইনে গ্রেফতার করে। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে জননেতা অলি আহাদ এর প্রতিবাদ জানান। তিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন। স্বৈরাচারি এরশাদের বিরুদ্ধে আপোসহীন ভূমিকা পালন করেন। এরশাদ সরকার অলি আহাদকে গ্রেফতার করে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় তার সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্তেহাদ। কিন্তু তারপরও অলি আহাদ থেমে থাকেননি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী নীতি অনুসরণ করলে আজীবন লড়াকু সৈনিক অলি আহাদ তার প্রতিবাদ জানান। বর্তমান আওয়ামী জোট সরকার যেভাবে ভিন্নমতের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, দেশকে বিরোধী দলবিহীন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে, বর্ষীয়ান এই নেতা তারও প্রতিবাদ করেছেন। সরকারের পতন আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে তিনি বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটে যোগ দেন।

দেশের রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে অলি আহাদের প্রয়োজন অনেক বেশি। অথচ এ সময়েই তিনি চলে গেলেন। যিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে নির্ভীক সিপাহসালার। এই আজীবন সাহসী ও সংগ্রামী যোদ্ধাকে হারানোয় জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সাহসী সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অলি আহাদ যে রাজনৈতিক দর্শন দিয়ে গেছেন, তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার যে সাহস যুগিয়ে গেছেন, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নির্ভীক সিপাহসালার হওয়ার দীক্ষা দিয়ে গেছেন, লড়াই করে জাতিকে বেঁচে থাকার যে পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন, তা যদি এদেশের মানুষ অনুসরণ করে তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই এ জাতিকে পদানত করতে পারবে না। জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে সংগ্রামে এ মহান সৈনিককে আমাদের পথ ও পাথেয় করতে হবে। একজন দেশপ্রেমিক, বরেণ্য ব্যক্তি ও সত্যিকারের অভিভাবককে হারিয়ে আজ আমরা শোকাভিভূত। আমরা মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করি এবং তার শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সহমর্মিতা জানাই।

দৈনিক দিনকাল

অলি আহাদের জীবনাবসান

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চলে গেলেন ভাষাসৈনিক ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক অলি আহাদ। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ২০ অক্টোবর রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী অলি আহাদ ১৯৪৪ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৭ সালে আইএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগে। তারপর বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এম,কম পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনে যোগদানের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।

শুরুতেই অলি আহাদ প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মহান ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করলে। অলি আহাদ ন্যাপে যোগদান করেন।

বাঙালির রক্তস্নাত ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে অলি আহাদের ভূমিকা। গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের প্রথম বিক্ষোভ মিছিলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখের সঙ্গে তিনিও গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী হন। ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৯৫০ সালেও তিনি কারাভোগ করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের উত্তঙ্গ সময়ে অলি আহাদ অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের তিনি ছিলেন অগ্রণী সৈনিক। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ছাত্রদের লড়াকু মিছিল বের হলে পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়; শহীদ হন বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেও অলি আহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে তার রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল ন্যাপের আদর্শেরই অনুসারী। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অলি আহাদের দীর্ঘ বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনের আমূল পালাবদল ঘটে। তিনি এক পর্যায়ে জাতির জনকের খুনীদের সঙ্গে মিলে ডেমোক্র্যাটিক লীগ গঠন করেন এবং নিজে হন তার সহ-সভাপতি। এরশাদ আমলে অলি আহাদ তাঁর সম্পাদিত ইত্তেহাদ পত্রিকার মাধ্যমে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শক্তি যোগান। এ কারণে ইত্তেহাদ নিষিদ্ধ করা হয়। ও তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। অলি আহাদ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাবলি অবলম্বনে জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ নামক একটি বই লিখেছেন। এ অঞ্চলের দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের নানা বিষয় এ বইয়ে উঠে এসেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ভাষাসৈনিক অলি আহাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

দৈনিক জনকণ্ঠ

অতুলনীয় অলি আহাদ

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা, নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক অলি আহাদ গত শুক্রবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি… রাজিউন)। তার মহাপ্রয়াণের মাধ্যমে রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটল। অবসান হল রাজনৈতিক সততার কিংবদন্তিসম এক অধ্যায়ের। অলি আহাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ৮৫ বছর বয়সে। দীর্ঘকাল ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে কার্যত দূরে ছিলেন। তার পরও রাজনীতিতে তার অভাব প্রতিনিয়তই অনুভূত হবে। রাজনীতিতে যখন সততার সংকট বিরাজ করছে তখন অলি আহাদের মত নির্লোভ রাজনীতিকের মৃত্যু সে সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলবে।

গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ অলি আহাদ দেশের চার দশকের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতার আগে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামেও লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। সেনাপতি শাসনের স্বরূপ উন্মােচনে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন এই গণতন্ত্রবাদী নেতা। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়া, এরশাদ প্রতিটি সামরিক শাসকের আমলে তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অলি আহাদ। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মত নেতাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্যরা শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক ও মুক্তিসংগ্রামের জাতীয় বীরকে। অলি আহাদের প্রতি আমরা আমাদের শ্রদ্ধা জানাই। আল্লাহ এ ভাষাসৈনিককে জান্নাতের সুশীতল স্থানে ঠাই দিন।

দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন

চলে গেলেন জননেতা অলি আহাদ

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ, প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদ দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগভোগের পর গত শনিবার ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তির ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুকে অসময়োচিত বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু সে মৃত্যু যদি হয় অলি আহাদের মত ভাষা আন্দোলনের একজন সিপাহসালার ও সংগ্রামী নেতার, তাহলে সে মৃত্যুকে মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। মরহুম অলি আহাদকে জনগণ প্রধানত একজন ভাষা সংগ্রামী হিসাবেই জানত। ভাষাসৈনিক আরও অনেকেই ছিলেন ও আছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর ১৯৪৭ সালেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হলেও ১৯৪৮ সালেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রথম গণবিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। সে গণবিস্ফোরণে মরহুম অলি আহাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা সমর্থকদের সে দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি সম্পাদনে সে বিস্ফোরণ আপাতত প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষর যিনি করেছিলেন, তিনি চুক্তি ভঙ্গ করে বসলে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাভাষার দাবিতে যে রক্তাক্ত বিস্ফোরণ ঘটে, তার নেতৃত্বে ছিলেন অলি আহাদ। এ কারণে ভাষাসৈনিকদের মধ্যে তাকে ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার মনে করা হয়।

অলি আহাদকে শুধু একজন ভাষাসৈনিক হিসেবে স্মরণ করলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। ছাত্রজীবনেই তিন পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণীর আলোকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, সে আন্দোলনে অলি আহাদের ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি যেসব সংগঠনকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ! এই ছাত্রলীগের যে প্রথম। সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয় সে কমিটিতে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার প্রতিনিধি, আর অলি আহাদ ছিলেন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার প্রতিনিধি। অর্থাৎ তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নামে যে সংগ্রামী যুব সংগঠনের জন্ম হয়, তিনি ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। এই যুবলীগের কোনো কোনো নেতার মধ্যে বামপন্থী চিন্তাধারার প্রভাব থাকলেও মরহুম অলি আহাদ সব সময় আমাদের নিজস্ব আদর্শিক জাতিসত্তা সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। অলি আহাদ এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন এবং এর সাংগঠনিক সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি ডেমোক্র্যাটিক লীগ গঠন করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। আমাদের দেশে অলি আহাদের চাইতে কম মেধা ও প্রতিভার অনেক লোকও ক্ষমতার রাজনীতির কাছে অবলীলাক্রমে আদর্শ বিসর্জন দিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু অলি আহাদ ক্ষমতার হাতছানিকে অগ্রাহ্য করে সারাজীবন জনগণের স্বার্থে সংগ্রামের কঠিন পথ বেছে নেন। এ কারণে তাঁর জীবনের এক দীর্ঘ অংশ কাটে কারান্তরালে।

জননেতা অলি আহাদের সারা জীবনই ছিল জাতির সর্বাঙ্গীণ মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রামে নিবেদিত। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন ছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ববিরোধী যত ষড়যন্ত্র এবং দেশে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যত চক্রান্ত হয় তার বিরুদ্ধে নিরাপোস লড়াকু ভূমিকা পালন করেন অলি আহাদ। বলা চলে, এ ক্ষেত্রে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর উত্তরসূরি হিসেবেই ছিল তাঁর সংগ্রামী ভূমিকা। সে নিরিখে বলা চলে, অলি আহাদের মৃত্যুতে জাতি একজন বিশ্বস্ত অভিভাবক হারিয়েছে। আমরা জানি না, অলি আহাদের মৃত্যুতে আমাদের জাতীয় জীবনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কত দিনে পূর্ণ হবে। আমরা আল্লাহ রহমানুর রহিমের দরবারে মরহুমের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাচিচ্ছ আমাদের সমবেদনা।

দৈনিক ইনকিলাব

অলি আহাদ

এক বর্ষীয়ান নেতার প্রস্থান

মানুষ বেচে থাকে তার কর্মের মাঝে। যারা তাদের অবদান ও ত্যাগের মাধ্যমে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করে যায় তারা মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয় হয়ে থাকে। আর সহস্র মানুষের ভিড়ে এরকম মানুষ পৃথিবীতে খুব কম আসে যারা সত্যিকারের প্রেমিক, যারা মানুষকে ভালোবাসতে জানে। অলি আহাদ এমনই একজন মানুষ যিনি মানুষকে ভালোবাসার, মানুষের মুক্তির পক্ষে লড়াই করার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন আমাদের স্মৃতিতে। তিনি ছিলেন ভাষাসৈনিক, বর্ষীয়ান নেতা ও ১৮ দলীয় জোটের শরিক দল ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর যে অবদান তা এ জাতি কোনোদিন ভুলবে না। তিনি শ্রদ্ধাভরেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ দেশের মানুষের মনে। তার মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হল তা মোচন হওয়ার নয়। তিনি সেই বর্ষীয়ান নেতা যিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য যিনি সর্বপ্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি এ মহান ব্যক্তিত্ব অলি আহাদ। ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হলে অলি আহাদ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এবং বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তা ভুলে যাওয়ার নয়। বিভিন্ন। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাকে কারাগারেও থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন। দেশ যখনই এক ভয়াবহ সঙ্কটের কবলে পড়েছে সে মুহূর্তেই তাঁকে দেখা গেছে। সোচ্চার হতে। আশির দশকেও সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে। এবং ওই একই সময় তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য অলি আহাদকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদক দেয়া হয় ২০০৪ সালে। এ মহান বর্ষীয়ান নেতা গত শনিবার সকালে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন ৮৫ বছর বয়সে। তিনি ফুসফুসের সংক্রমণ ছাড়াও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। আর তার মৃত্যুতে দেশের সর্বস্তরে এবং বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি যেমন বিভিন্নভাবে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন দেশের জন্য, তা শুধু আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার সম্পাদিত পত্রিকায়ও তিনি বলিষ্ঠভাবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। যার ফলেই তা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।

ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাবধারা, এর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা তরুণ প্রজন্মকে দেশের রাজনীতিকে বুঝতে এবং ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে উপলব্ধি করতে সহযোগিতা করবে। তাই শুধু রাজপথে নয় বরং একজন কলম সৈনিক হিসেবেও তিনি ছিলেন অকুতোভয় সাহসী যোদ্ধা। প্রধানমন্ত্রীও শোকবার্তায় বলেছেন, অলি আহাদ চলে যাওয়ায় দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হল। দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে তাঁর এ চলে যাওয়া স্বাভাবিক। কেননা মৃত্যু মানুষের এক অনিবার্য নিয়তি। তবু যেন আমরা তার চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। তার আত্মার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা।

দৈনিক যায় যায় দিন

সংবাদপত্রের প্রতিবেদন : ২১ অক্টোবর ২০১২

ভাষাসৈনিক বর্ষীয়ান রাজনীতিক অলি আহাদ আর নেই

ভাষাসৈনিক, বর্ষীয়ান রাজনীতিক, ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান অলি আহাদ আর নেই। ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে থাকার পর গতকাল শনিবার সকালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহে … রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি স্ত্রী অধ্যাপিকা রাশেদা বেগম, একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাসহ অসংখ্য অনুসারী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

তার স্ত্রী জানান, তার কোনো গুরুতর রোগ ছিল না। গত মার্চ থেকে তিনি নিয়মিত অসুস্থ হতে থাকেন। মার্চ থেকে এপ্রিল তিনি টানা দুই মাস হাসপাতালে ছিলেন। মাঝে অবস্থার উন্নতি হলে বাসায় নেয়া হয়। তিনি জানান, ২০০৩ সালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে তার কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তখন থেকেই তিন মূলত বিছানায় ছিলেন। কিন্তু রবিবার হঠাৎ তিনি বুকের ব্যথা অনুভব করতে থাকলে আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি।

অলি আহাদের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেছেন।

দুপুরে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। সেখানে প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। বাদ আসর বায়তুল মোকাররম মসজিদে নামাজে জানাযা শেষে বনানী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জানাযায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, বরকত উল্লাহ বুলু, খায়রুল কবীর খোকন, চিকিৎসক নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার, কবি আবদুল হাই শিকদার, চাষী নজরুল ইসলাম, জাগপার। শফিউল আলম প্রধান, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি, শওকত হোসেন নীলু প্রমুখ।

গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামে রত অলি আহাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ইসলামপুরে। তার তিন বোন ও পাচ ভাইয়ের মধ্যে তিন বোন ও এক ভাই মারা গেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে জীবন বাজি রেখে যারা লড়াই করেছেন তাঁদের সামনের কাতারে ছিলেন। অলি আহাদ। আজীবন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন তিনি।

অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে। তাঁর পিতা আবদুল ওহাব ছিলেন। ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার চার সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কলেজ জীবনেই তিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। তিনি এ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.কম পড়ার সুযোগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। অলি আহাদ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকাকালীন প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্যে তিনি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে প্রগতিশীলদের পক্ষে যোগ দেন। সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠন করেন। তাঁর রচিত জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ নামক গ্রন্থটি এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য শাসকদের ওপর তিনি চাপ সৃষ্টি করেন। তৎকালীন সরকারের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দুঃশাসন বিরোধী এক তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমিতি বন্ধ করার প্রতিবাদ জানিয়ে অলি আহাদ ১৯৭৪ সালের ২৮ জুন হাইকোর্টে রিট করেন। এ কারণে ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন বিশেষ ক্ষমতা আইনে সরকার তাকে গ্রেফতার করে। আশির দশকে সামরিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপসহীন ভূমিকার কারণেও তাকে একাধিকবার গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়। এরশাদ সরকার সামরিক ট্রাইব্যুনালে তার বিচার করে। ওই সময় জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অলি আহাদকে স্বাধীনতা পদক সম্মানে ভূষিত করা হয়।

চীন থেকে ফিরেই হাসপাতালে যান খালেদা জিয়া

গতকাল শনিবার চীন থেকে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রাজধানীর পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে ভাষাসৈনিক অলি আহাদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বেলা ১টার দিকে তিনি সেখানে পৌছান। খালেদা জিয়া ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মরদেহের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু, মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব আবদুস সালাম খালেদা জিয়ার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।

ভাষাসৈনিক বর্ষীয়ান নেতা

এদিকে দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মৃত্যুতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করেছে। শোক প্রকাশ করে বলা হয়, অলি আহাদের মৃত্যুতে ইতিহাস ও জাতি হারালো এক বিরল ব্যক্তিত্বকে। তিনি নেই এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও সত্য যে, তিনি দেশের মানুষের নিকট চিরস্মরণীয় ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।

স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ছিলেন সময়ের সাহসী সন্তান। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য ব্যক্তিকে হারালো। তাঁর মৃত্যু দেশের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। এ ক্ষতি কোনভাবেই পূরণ হবার নয়। বাংলা ভাষা রক্ষার সংগ্রামে মহান এ সৈনিকের অবদান দেশবাসী আজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। স্পিকার মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা রক্ষার সংগ্রামে যে কয়জন সৈনিক তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন মরহুম অলি আহাদ ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ বাংলা ভাষা রক্ষার একজন অতন্দ্র প্রহরীকে হারালো। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ

তথ্যমন্ত্রীর শোক : জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, দেশের মানুষের মনে তিনি চিরস্মরণীয় ও প্রেরণার উৎস হয়ে বেঁচে থাকবেন। অলি আহাদ ছিলেন ভাষা আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনসহ এ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। গণফোরামের শোক : গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, এ মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। ইতিহাস ও জাতি হারালো এক বিরল ব্যক্তিত্বকে। তারা মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। এছাড়াও শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলজেএসডি’র সভাপতি আসম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, মুসলিম লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল হক মজুমদার ও মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের, এনপিপি’র সভাপতি শেখ শওকত হোসেন নিলু ও মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হক, স্বতন্ত্র ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, সুশীল ফোরামের সভাপতি মো. জাহিদ ও সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার হোসেন সাহেদ প্রমুখ।

দৈনিক ইত্তেফাক

অলি আহাদ আর নেই

প্রখ্যাত ভাষাসংগ্রামী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অলি আহাদ আর নেই। গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে তিনি রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি … রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে গত ৭ অক্টোবর (রোববার) তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি স্ত্রী অধ্যাপক রাশিদা বেগম, একমাত্র কন্যা ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাসহ আত্মীয়-স্বজন এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। চিরবিদ্রোহী অলি আহাদের মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমেছে শোকের ছায়া। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিলুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পৃথক শোকবার্তায় অলি আহাদকে সৎ, ত্যাগী এবং সময়ের সাহসী মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেন। অলি আহাদের মৃত্যুসংবাদে খালেদা জিয়া গতকাল টান থেকে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রাজধানীর পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে যান। এদিন দুপুরে সর্বসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য অলি আহাদের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হয়। শেষবারের মত শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে জড়াে হন দেশবরেণ্য লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ নানা শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষ। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে যান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক আবদুল মতিন, ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, আওয়ামী লীগের আইন-বিষয়ক সম্পাদক সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, প্রখ্যাত চলচিচ্চত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি, রাজনীতিক শফিউল আলম প্রধান, সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আবদুল মজিদ, ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডাব)-এর মহাসচিব ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, কবি আবদুল হাই শিকদার, শওকত হোসেন নীলু প্রমুখ। বাদ জোহর এখানেই তার প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বাদ আসর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে দ্বিতীয় জানাযা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বনানী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়। তার ইচ্ছা ছিল তাকে যেন আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদ সালাম-বরকতের পাশে কবর দেয়া হয়। কিন্তু তার সেই ইচ্ছা পূরণ করা হয়নি। এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অলি আহাদ এক সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চেতনার নাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী, ক্ষুদে নেতা থেকে শুরু করে মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর গোটা জীবনই কেটেছে সক্রিয় রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে। জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি শাসকশ্রেণির অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করেছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৭ বার কারাভোগ করেছেন। আত্মগোপনে ছিলেন ২ বার। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে রাজনৈতিক কারণে তিনি প্রায় ৭ বছর আত্মগোপনে ছিলেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে তিনি ৬ বার গ্রেফতার হন এবং ৩৫৭ দিন কারাভোগ করেন।

দীর্ঘ ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতা বা ক্ষমতার মোহ তাকে কোনো দিনই আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তাই তিনি এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন অনন্য সৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে সব শ্রেণির মানুষের কাছে সমানভাবে পরিচিত। নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাত, কর্মচাঞ্চল্য, বর্ণাঢ্য এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ তাঁর রাজনৈতিক জীবন। অত্যন্ত সমৃদ্ধ তার অভিজ্ঞতা, জাতীয় রাজনীতিতে হাজারো ঘটনা ঘটেছে তার চোখের সামনে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তিনি এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কৈশোরেই তিনি রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তদানীন্তন ভারতীয় মুসলিম সমাজে যে অভূতপূর্ব জাগরণ দেখা দেয় তা তার তরুণ মনে ভীষণভাবে রেখাপাত করে। তার বাবা দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, মাসিক মোহাম্মদী ও মাসিক সওগাত-এর নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। এসব পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র খেলার খবর-বিশেষভাবে ফুটবল খেলার মাঠে ৩৪ সাল থেকে কলকাতা মোহামেডানের ধারাবাহিক বিজয়ের সংবাদ তার কিশোর মানে তথা আবাল বৃদ্ধ বনিতা মুসলমানের মনে এক লুপ্তপ্রায় সত্ত্বার পুনর্জাগরণের আহবান ও আবেদন জানায়। এর সঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনা, গীত, গজল, আববাসউদ্দীনের কণ্ঠ আত্মজ্ঞানহারা ম্রিয়মাণ ও পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজকে আত্মসচেতন ও আত্মবলে বলীয়ান করতে বিশেষ অবদান রাখে। ফলে ভারতের বুকে মুসলমানদের স্বীয় ও স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি তাঁর হৃদয়কে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তাই স্কুলজীবনের অপরিণত বয়সে প্রস্তাবিত মুসলিম বাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে সক্রিয় হন।

অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর গ্রামে। বাবা মরহুম আবদুল ওহাবি ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। ১৯৪৪ সালে হোমনা হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এ সময় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার কারণে তিনি ১৯৪৬ সালে আইএসসি পরীক্ষা দেননি। ১৯৪৭ সালে তিনি আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি,কম ক্লাসে ভর্তি হন। আইএসসিতে ভালো রেজাল্ট করার জন্য তিনি হাজী মোহাম্মদ মহসীন ট্রাস্টের মাসিক ২০ টাকা হারে বৃত্তি লাভের জন্য নির্বাচিত হন। তবে এটি গরিব ছাত্রদের হক মনে করে এই টাকা তিনি গ্রহণ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ভাষা দিবসে তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। সেই থেকে শুরু হয় তাঁর কারাজীবনের ইতিহাস।

১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত মূলনীতি রিপোর্টে পূর্ববাংলার আঞ্চলিক অঙ্গীকার উপেক্ষিত হলে এর বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয় অলি আহাদ তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হওয়া সত্ত্বেও এ সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক না করার প্রতিবাদে তিনি সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন। পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অলি আহাদের নেতৃত্বে এই যুবলীগ এদেশে প্রগতিশীল আন্দোলনের সূচনা করে এবং ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসে এ সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ভাষা সংগ্রাম কমিটিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে তাঁর তেজোদীপ্ত সমর্থনের মধ্য দিয়ে এদেশের যুবসমাজের বিপ্লবী মনোভঙ্গি প্রতিধ্বনিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে সূচিত সংগ্রামসহ ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা নগরীর উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ ইত্যাদি ঘটনার অন্যতম প্রধান নায়ক অলি আহাদ।

১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রথমে প্রচার সম্পাদক এবং পরে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে তিনিও আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। অলি আহাদ ন্যাপের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠিত হলে তিনি এ দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম ২৫ সালা দাসত্ব চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন এবং আজাদ বাংলার ডাক দেন। এ জন্য তার পরম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। ৪২৭ দিন কারাভোগের পর ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট তিনি মুক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদ ডেমোক্র্যাটিক লীগ গঠন করলে তিনি এ দলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে অলি আহাদ প্রথম থেকেই এর প্রতিবাদ করেন। এ সময় অলি আহাদের নেতৃত্বে ৬ দল, বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ৯০-এ গণঅভূত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতন হালে বিএনপি সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের গঠনমূলক সমালোচনা করেন। ৯৬-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এলে ৯৮ সালের ১২ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল গঠন করা হয়। অলি আহাদ এই ৭ দলের অন্যতম নেতা হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরিপক্ব অভিজ্ঞতার আলোকে অতীত এবং বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক জীবনধারা ও ঘটনাবলি অত্যন্ত স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্নভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের মাধ্যমে রচনা করেছেন জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ শীর্ষক গ্রন্থ, যা এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য দলিল।

অলি আহাদের মৃত্যুসংবাদে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শমরিতা হাসপাতালে ছুটে যান। তিনি ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মরদেহের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। এ সময় বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ডা, এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু, বিএনপি’র ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার প্রমুখ উপস্থিত বিশিষ্ট রাজনীতিক অলি আহাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর শোকবার্তায় মহান ভাষা আন্দোলন ও দেশের অন্যান্য আন্দোলনে অলি আহাদের মূল্যবান অবদানের কথা স্মরণ করেন। তিনি একে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর। সমবেদনা জানান। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া শোকবাণীতে বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন ও গণতন্ত্র অর্জনের সংগ্রামে মরহুম অলি আহাদের দুঃসাহসে জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় সিপাহসালার। তাঁর মৃত্যুতে দেশবাসীর মত আমিও গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন। ভাষাসৈনিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আদর্শবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারাল। তার শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়। খালেদা জিয়া মরহুম অলি আহাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। অপর এক শোকবাণীতে স্পিকার বলেন, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ছিলেন সময়ের সাহসী সন্তান। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য। ব্যক্তিকে হারাল। তাঁর মৃত্যু দেশের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। এ ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাভাষা রক্ষার সংগ্রামে মহান এ সৈনিকের অবদান দেশবাসী আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। স্পিকার মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছেন। এরা হলেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শরিফ নুরুল আম্বিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)র চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান এমপি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি। ও মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূইয়া, সম্মিলিত সমন্বয় পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা, জিয়া সেনা কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবদুর রহমান তপন, জাতীয় মানবাধিকার সমিতির উপদেষ্টা ব্যারিস্টার হায়দার আলী, মহাসচিব মিলন মল্লিক, জিয়া ন্যাশনালিস্ট ফোরামের সভাপতি শফিকুর রহমান শফি ও সাধারণ সম্পাদক নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের সভাপতি মেজর (অব.) মেহবুব রহমান, বাংলাদেশ সচেতন যুব সমাজের সভাপতি বোরহানুজ্জামান ওমর, হৃদয়ে বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মুহাম্মদ হানিফ, জিয়া নাগরিক ফোরামের সভাপতি মিয়া মো. আনোয়ার, সাধারণ সম্পাদক কে এ জামান, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক একাডেমির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বেপারি, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোজাম্মেল হোসেন শাহীন, জাতীয়তাবাদী বাস্তুহারা দলের সভাপতি শরীফ, হাফিজুর রহমান টিপু, সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুল ইসলাম বাদল, বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরামের সভাপতি আলহাজ হাফেজ মাওলানা অধ্যাপক আসম মোস্তফা কামাল, স্বদেশ মঞ্চের চেয়ারম্যান মামুনুর রশীদ খান, চিরন্তন বাংলাদেশ-এর সভাপতি হামদুল্লাহ আল মেহেদী, সুশীল ফোরামের মো. জাহিদ হোসেন, প্রজন্ম একাডেমির সভাপতি কালাম ফয়েজী, দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি ডা.দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন, দেশপ্রেমিক ফোরাম-এর সভাপতি কমিশনার রাজিয়া আলীম, জিয়া ব্রিগেড়-এর সভাপতি সাংবাদিক জাহিদ ইকবাল, মহাসচিব আবুল হোসেন, জনতার ধবনির সভাপতি বিশিষ্ট নারী লেখক ও সংগঠক মর্জিনা আফসার রোজি, ঢাকায় বরিশাল বিভাগীয় জাতীয়তাবাদী ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. কবীর হোসেন, জিয়া স্মৃতি সংসদের সভাপতি আবদুল মান্নান জমাদ্দার, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সভাপতি শামা ওবায়েদ ইসলাম, খুলনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও ভাষাসৈনিক গাজী শহীদুল্লাহ প্রমুখ। শত নাগরিকের শোক : বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা অলি আহাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ‘শত নাগরিক জাতীয় কমিটি”। গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই শোকবার্তা জানানো হয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়—বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, শোষণ-নির্যাতন-অন্যায়-অসত্য-ভণ্ডামী-সাম্রাজ্যবাদআধিপত্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী, চিরবিদ্রোহী জননায়ক অলি আহাদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। আজীবন অবিচল আদর্শবাদ, ন্যায়নিষ্ঠতা, আপসহীন সংগ্রাম এবং ক্ষমতার প্রতি নির্মোহতা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়। তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশপ্রেমিক জনতার অনুপ্রেরণার উৎস। হয়ে। উঠেছিলেন জাতীয় অভিভাবক। তার শূন্যস্থান আর পূরণ হওয়ার নয়। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তার স্ত্রী এবং সন্তানকে জানাচ্ছি গভীর সহানুভূতি। শত নাগরিক জাতীয় কমিটির পক্ষে বিবৃতিদাতারা হলেন অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ, মোহাম্মদ আসাফ উদদৌলাহ, ড. মাহবুব উল্লাহ ও আবদুল হাই শিকদার।

পাঁচ ভাষাসৈনিকের শ্রদ্ধা

অলি আহাদ ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নায়ক

প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, ভাষাসংগ্রামী অলি আহাদের মৃত্যুতে বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনসহ গণতান্ত্রিক বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার সহযোদ্ধারা শোকস্তব্ধ। সহযোদ্ধা, সহকর্মী হারানোর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তারা গতকাল দৈনিক আমার দেশ-কে বলেন, ‘অলি আহাদ ছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গনে সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চেতনার নাম। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ও অনন্য ভূমিকা ছিল তাঁর। গোটা ভাষা আন্দোলন পরিচালনায় তাঁর মত ভূমিকা আর কারও ছিল না। তিনি ছিলেন সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নায়ক। ১৯৪৭ সাল থেকে তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করে আসছিলেন। ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। তিনি ভাষা আন্দোলনে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এছাড়া ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে পরিচালিত সব সংগ্রামসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। একজন আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি শাসক শ্রেণির অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করেছেন।

ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বলেন, অলি আহাদ ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আমাদের ভাষা আন্দোলনে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। শুধু ভাষা আন্দোলনই নয়, দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বাংলা ভাষা রক্ষার সংগ্রামে মহান এ সৈনিকের অবদান দেশবাসী আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক ও প্রখ্যাত মার্কসবাদী বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল না। আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল খুবই প্রান্তিক। আওয়ামী লীগ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল। তখন বামপন্থী যুবকদের সংগঠন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অলি আহাদ। ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তার মত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তখন আর কারও ছিল না। ১৯৪৭ সাল থেকে তিনি বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করে আসছিলেন। পঞ্চাশ দশকের প্রথমদিকে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে এ যুবলীগ এদেশে প্রগতিশীল আন্দোলনের সূচনা করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসে এ সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ভাষা সংগ্রাম কমিটিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে তাঁর তেজোদীপ্ত সমর্থনের মধ্য দিয়ে এদেশের যুবসমাজের বিপ্লবী মনোভঙ্গি প্রতিধ্বনিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে সূচিত সংগ্রামসহ ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা নগরীর উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ ইত্যাদি ঘটনার অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন অলি আহাদ। তবে পরবর্তীকালে তার মূল্যায়ন সেভাবে হয়নি। বাংলাদেশে এখন ইতিহাসচর্চা বলে নেই। ইতিহাসে কার গুরুত্ব কীভাবে দিতে হয়, সেই চর্চা নেই।’ ভাষাসৈনিক ও শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ আবদুল গফুর বলেন, অলি আহাদকে আমি অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে জানতাম। ভাষা আন্দোলনে তার যে অবদান, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শুধু ভাষা আন্দোলনে অতুলনীয় অবদানের জন্য নয়, একজন আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সত্যকে তিনি সব সময় সোচ্চার কণ্ঠে বলতে কোনো দ্বিধাবোধ করতেন না। এটা ছিল তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি তাঁর কোনো লোভ ছিল না। নিজে ছিলেন স্পষ্টবাদী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। তিনি চাইতেন সবাই যেন তার মত প্রকাশ করতে পারে। স্বাধীন মত প্রকাশের পরিবেশ যেন থাকে।’ ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু বলেন, ‘অলি আহাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই জীবনের মায়া ত্যাগ করে আমরা বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। তিনি ছিলেন সময়ের সাহসী সন্তান। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য ব্যক্তিকে হারাল। তার মৃত্যু দেশের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি।

ভাষাসৈনিক ও রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিক বলেন, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বিশিষ্ট ও অনন্য ভূমিকা ছিল অলি আহাদের। গোটা ভাষা আন্দোলন পরিচালনায় যে ক’জনের ভূমিকা ছিল, তাদের মধ্যে অলি আহাদের ভূমিকা ছিল অন্যতম। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের মূল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আমি তাঁকে বরাবরই দেখেছি।’ উল্লেখ্য, অলি আহাদ গতকাল সকালে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি … রাজিউন)। তিনি ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম নেন। রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে অতীত ও বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক জীবনধারা, ঘটনাবলী নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি লিখেছেন জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ শিরোনামে একটি বই, যা এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রামাণ্য।

দৈনিক আমার দেশ

চলে গেলেন ভাষাসৈনিক অলি আহাদ

চলে গেলেন মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ। রাজনীতিবিদ অলি আহাদ। গতকাল শনিবার ৮৪ বছর বয়সে সকাল সোয়া নয়টার দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বিকেলে তাকে বনানী কবরস্থানে রাস্ত্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে অলি আহাদ চিকিৎসাধীন ছিলেন। স্ত্রী অধ্যাপক রাশিদা বেগম এবং একমাত্র মেয়ে রুমিন ফারহানা তার পাশেই ছিলেন। কিছুদিন ধরে তার সংজ্ঞা ছিল না, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই অবস্থায় জীবনের চৌকাঠ পেরিয়ে গেলেন দেশের অন্যতম প্রবীণ এই রাজনীতিক। রাশিদা বেগম প্রথম আলোকে জানান, ৮ অক্টোবর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিল। এ ছাড়া কিডনি ঠিকমত কাজ করছিল না। ১৫ অক্টোবর শেষ কথা বলেছেন তিনি। হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন। গতকাল ফিরলেন চিরকালের বাড়িতে।

২০০৩ সালে তিনি গোসলখানায় পড়ে গিয়ে জখম হন। তারপর থেকেই শয্যাশায়ী ছিলেন। ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক লীগের সভাপতির পদে আসীন থাকলেও সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারতেন না। শেষদিকে রাজনীতির প্রতিও তার আগ্রহ ছিল না। মূলত বই-পুস্তক, পত্রপত্রিকা পড়েই সময় কাটত তার।

অলি আহাদের মৃত্যুর খবর পেয়ে সকালেই হাসপাতালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এসে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বেলা একটায় আসেন বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া। তিনি কফিনে ফুল দিয়ে এই ভাষাসৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

এরপর হাসপাতাল থেকে মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সর্বস্তরের জনসাধারণ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এখানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ও রওশান আরা বাচ্চু। এ ছাড়া শহীদ মিনার ও হাসপাতালে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, মীর্জা আব্বাস, আবদুল মতিন খসরু, বিএনপির নেতা হান্নান শাহ, মোসাদ্দেক আলী ফালুসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। মরহুমের কফিনে বিএনপি ওয়ার্কার্স পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, যুব মৈত্রী, ছাত্রলীগ, জাগপা, ন্যাপসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণেই তার প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। সেখানে বাদ আসর অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জানায়। এরপর বনানী কবরস্থানে মরহুমকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দিয়ে দান কৰা হয়। অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামপুর গ্রামের এক সন্ত্রান্ত পরিবারে। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি নেন। এরপর ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেন নি এই মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করে।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন অলি আহাদ। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার প্রস্তাব উঠলে তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষাসংগ্রামীরা মিছিল করলে পুলিশ গুলি চালায়। রচিত হয় বাঙালির ইতিহাসের এক বেদনাময় ও চির গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে অলি আহাদ নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম ছিলেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে ছিলেন। তিনি ১৭ বার কারারুদ্ধ হয়েছেন। ১৬ বছরের বেশি সময় ছিলেন কারারুদ্ধ। কোনোলোভ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার কাছে তিনি নিজের আদর্শ বিকিয়ে দেননি।

অলি আহাদ সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ নামের একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন ২০০৪ সালে।

শোক : ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ অলি আহাদের মৃত্যুতে জাতীয় সংসদের স্পিকার মো. আবদুল হামিদ ও ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী শোক প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু), জাসদ (রব), গণফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ এক বিবৃতিতে বলেছেন, তারা জোটের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দল এ ব্যবস্থা করেছে। তবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক শহীদ মিনারে জানাযার ব্যবস্থা করায় সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে জোট অংশ নেয়নি।

দৈনিক প্রথম আলো

ভাষাসৈনিক অলি আহাদ আর নেই

চলে গেলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক অলি আহাদ। কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর শনিবার সকালে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি … রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। এর আগে ১৪ অক্টোবর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অলি আহাদকে। তিনি ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন। স্ত্রী অধ্যাপক রাশিদা বেগম জানান, মার্চ থেকে বর্ষীয়ান। এই রাজনীতিক অসুস্থ ছিলেন। এপ্রিল পর্যন্ত টানা দুই মাস হাসপাতালে ছিলেন। তিনি। মাঝে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে বাসায় নেয়া হয়েছিল। পরে আবার অবনতি ঘটলে হাসপাতালে আনা হয়।

এদিকে অলি আহাদের মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে। শোকের ছায়া। পৃথক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিকল্পধারার চেয়ারম্যান অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী শোক প্রকাশ করেন। অলি আহাদের মরদেহ শেষবারের মত একনজর দেখতে শমরিতা হাসপাতালে ছুটে যান তাঁর আত্মীয়-স্বজন, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। চীন সফর শেষে দেশে ফিরেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি শমরিতা হাসপাতালে যান বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেখানে অলি আহাদের কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানান তিনি। অলি আহাদের পরিবারের সদস্যদের দেন সান্ত্বনা। এ সময় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস-চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, মোসাদ্দেক আলী ফালু, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি উপস্থিত ছিলেন। দেশের এই কৃতী সন্তানকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শনিবার দুপুরে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এ সময় ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, রওশন আরা, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা তাঁর মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাদ জোহর এখানেই প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। এখানে আরেক দফা জানাযা শেষে সন্ধ্যায় বনানী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের সূচনালগ্নেই গ্রেফতার হয়েছিলেন অলি আহাদ। এক সময় আওয়ামী লীগে থাকা এই নেতা স্বাধীনতার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের গড়া ডেমোক্র্যাটিক লীগে যোগ দেন। আজীবন রাজনীতিতে যুক্ত অলি আহাদ পরবর্তী সময় এই দলের চেয়ারম্যান হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে ছিলেন তিনি। অলি আহাদ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারিতে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য সর্বপ্রথম তিনিই গ্রেফতার হয়েছিলেন। অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে ন্যাপে যোগ দেন তিনি।

বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামে অলি আহাদ সক্রিয় ছিলেন। এজন্য জীবনের অনেকটা সময় তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। গত শতকের ‘৮০-এর দশকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখিও হয়েছিলেন অলি আহাদ। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ ওই সময় নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অলি আহাদকে ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। অলি আহাদের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ইসলামপুর গ্রামে। তার একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা হাইকোর্টের আইনজীবী।

বিভিন্ন মহলের শোক : ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব, এলডিপির চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলু, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, এনডিপির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান এএইচএম কামরুজ্জামান খান, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল মবিন, ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হক, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দীন মনি, পিপলস লীগের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট গরীবে নেওয়াজ গভীর শোক প্রকাশ করেন।

ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার অলি আহাদ আর নেই

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার ডেমোক্র্যাটিক লীগের সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিক অলি আহাদ আর নেই। দেশের রাজনীতির এই কিংবদন্তি গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। ১৯২৮ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামে সদা সক্রিয় এই ভাষাসৈনিকের প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় শহীদ মিনারে। বাদ আসর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে দ্বিতীয় জানাযা শেষে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রবীণ এই রাজনীতিকের মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। সকালে তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ছুটে যান পান্থপথস্থ শমরিতা হাসপাতালে। বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চীন থেকে দেশে ফিরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই সরাসরি পান্থপথের হাসপাতালে আসেন প্রবীণ নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সে সময় সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মরহুম অলি আহাদ মৃত্যুর কয়েক বছর আগে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাসৈনিক আবদুস সালাম, রফিক, বরকত, জববারের কবরের পাশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কি সেখানে জায়গা না পাওয়ায় বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।

বাদ জোহর তাঁর প্রথম নামাজে জানাযা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে তার লাশ রাখা হয়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, রওশন আরা, আওয়ামী লীগের পক্ষে সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু। প্রথম জানাযায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন বিএনপির সিনিয়র নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, বরকত উল্লাহ বুলু, খায়রুল কবীর খোকন, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, মুন্সি আবদুল মজিদ, খোকন চন্দ্র দাশ, অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, চিকিৎসক নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেন, কবি আবদুল হাই শিকদার, চাষী নজরুল ইসলাম, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, এনপিপির শওকত হোসেন নীলু, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোস্তফা গোলাম কুদুস, ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ, মোসাদ্দেক হোসেন ফালু, শামসুজ্জামান দুদু প্রমুখ। দ্বিতীয় নামাজে জানাযায় অন্যদের মধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মোশাররফ হোসেন এমপি, মুসলিম লীগের সভাপতি নুরুল হক মজুমদার, পিডিপির এহসানুল হক সেলিম প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা মরহুমের কফিনে ফুল দিয়ে ভাষাসৈনিকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান।

মরহুম অলি আহাদের কন্যা ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা জানান, সকাল ৯টা ২০ মিনিটে তার বাবা মারা যান। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে গত ৭ অক্টোবর তাঁকে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭২ ঘণ্টা লাইফ সাপোর্টে রাখার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। শমরিতার চিকিৎসক প্রফেসর কাজী দীন মোহাম্মদ, প্রফেসর আলি হোসেন, প্রফেসর আফজাল কায়সার, প্রফেসর এম আলম, প্রফেসর আবদুর রহমানের সমন্বয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড তার চিকিৎসার দেখভাল করেন। মৃত্যুর আগে অলি আহাদের মেয়ে ব্যারিস্টার ফারহানা ইনকিলাবকে বলেন, বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকদিন ধরে হাসপাতালে চারজন ডাক্তারের পরামর্শ নিচিছলেন আব্বা। গত রোববার নিউমোনিয়াসহ আরো কয়েকটি রোগে গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফুসফুসের সংক্রমণে (ইনফেকশনে) ভুগছিলেন। গত মার্চ থেকে এটা বেড়ে যায়। অলি আহাদের স্ত্রী প্রফেসর রাশিদা বেগম জানান, মরহুমের কোনো গুরুতর রোগ ছিল না। গত মার্চ থেকে নিয়মিত অসুস্থ হতে থাকেন। এর মধ্যে মার্চ থেকে এপ্রিল টানা দুই মাস হাসপাতালে ছিলেন। মাঝে অবস্থার উন্নতি হলে বাসায় নেয়া হয়। মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে তাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আবার বাসায় চলে যেতাম। তিনি জানান, ২০০৩ সালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে তার কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তখন থেকেই তিনি মূলত বিছানায় ছিলেন। কিন্তু রোববার হঠাৎ তিনি বুকের ব্যথা অনুভব করতে থাকলে আমরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। ভাষাসৈনিক অলি আহাদের এক মেয়ে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ইসলামপুরে। তাঁর তিন বোন ও পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিন বোন ও এক ভাই মারা গেছেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অলি আহাদকে ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ রাস্ত্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সূচনালগ্নেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এই রাজনীতিক। জীবনের অনেকটা সময় তাঁকে কারাগারেও থাকতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন। এক সময় আওয়ামী লীগে থাকা এই নেতা স্বাধীনতার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের গড়া দলে যোগ দেন। আজীবন রাজনীতিতে যুক্ত এই ব্যক্তি ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ অলি আহাদের লেখা জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ সেই সময়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মৃত্যুতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের নেতারা শোক প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, বিকল্পধারা সভাপতি সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জাসদের সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান। মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইন, বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, এনপিপির সভাপতি শেখ শওকত হোসেন নিলু, সাধারণ সম্পাদক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান ও সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান, মুসলিম লীগ সভাপতি নুরুল হক মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল খায়ের, মুসলিম লীগের অপর অংশের সভাপতি এ এইচ এম কামরুজ্জামান, মহাসচিব আতিকুল ইসলাম, এনডিপির সভাপতি গোলাম মর্তুজা, ইসলামিক পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল মোবিন, স্বতন্ত্র ফোরামের মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী মরহুমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। নেতৃবৃন্দ বলেন, অলি আহাদের মৃত্যু দেশের রাজনীতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের প্রশ্নে আপস বা সুবিধাবাদিতার গ্লানি তাকে কখনোই স্পর্শ করেনি। নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের জাতীয় অর্জনগুলোতে রেখেছেন অসামান্য অবদান। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের একজন দীপ্তিমান অভিযাত্রী। এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের নেতারা চিরবিদ্রোহী অলি আহাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে মরহুমের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

দৈনিক ইনকিলাব

চলে গেলেন ভাষাসৈনিক অলি আহাদ

ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদ আর নেই। ছয় দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গত ১৪ অক্টোবর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় অলি আহাদকে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন এবং বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক রাশিদা বেগম জানান, গত মার্চ থেকে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক অসুস্থ ছিলেন।

অলি আহাদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ও ডেপুটি স্পিকার এম শওকত আলী শোক প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া হাসপাতালে তার মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। পরে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। এ সময় তার মরদেহে শেষবারের মত শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে আসেন দীর্ঘদিনের বন্ধু ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন ও রওশন আরা বেগমসহ সর্বস্তরের জনগণ। সেখানে বাদ জোহর তার প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় অংশ নেন সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, বিএনপির সিনিয়র নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, বরকতউল্লা বুলু, খায়রুল কবীর খোকন প্রমুখ। পরে বাদ আসর তাঁর দ্বিতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রবীণ এই রাজনীতিকের শেষ ইচ্ছে ছিল আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদ সালাম ও বরকতের কবরের পাশে যেন তার অন্তিম শয়ান হয়। কিন্তু জায়গা না থাকায় বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। অলি আহাদ ছিলেন ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারিতে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি সর্বপ্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে ন্যাপে যোগ দেন তিনি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সেখানেও সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামে অলি আহাদ সব সময় সক্রিয় ছিলেন। আপসহীন এই রাজনীতিককে প্রায় ১৭ বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে। আশির দশকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠনের জন্য তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ নিষিদ্ধ করা হয় ওই সময়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। অলি আহাদের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ইসলামপুর গ্রামে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি স্ত্রী অধ্যাপক রাশিদা বেগম, একমাত্র কন্যা রুমিন ফারহানা এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

দৈনিক মানবকন্ঠ

ভাষাসৈনিক অলি আহাদ আর নেই

ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ অলি আহাদের জীবনাবসান হয়েছে। গতকাল সকালে রাজধানীর পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায়। তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি … রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী প্রফেসর রাশিদা বেগম ও একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও বায়তুল মোকাররম মসজিদে জানাযার পর গতকালই তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদসহ বিশিষ্টজনরা। গত রোববার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে তাকে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এছাড়াও তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন বলে তাঁর পরিবার এবং হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। শমরিতার চিকিৎসক প্রফেসর কাজী দীন মোহাম্মদসহ অন্য চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড তার চিকিৎসা দেখভাল করে। গত বুধবার দুপুর থেকে তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছিল। অলি আহাদের মৃত্যুসংবাদে রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। বেলা পৌনে ১টার দিকে প্রয়াত প্রবীণ রাজনীতিবিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া শমরিতা হাসপাতালে যান। এ সময় খালেদা জিয়া মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। বাদ জোহর অলি আহাদের প্রথম জানাযা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে তার মৃতদেহ রাখা হয়। এখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, রওশন আরা, আওয়ামী লীগের পক্ষে সাবেক আইনমন্ত্ৰী আবদুল মতিন খসর প্রমুখ। এরপর জানাযায় অংশ নেন বিএনপির সিনিয়র নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, বরকতউল্লা বুলু, খায়রুল কবীর খোকন, চিকিৎসক নেতা ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, কবি আবদুল হাই শিকদার, চাষী নজরুল ইসলাম, রাজনীতিক শফিউল আলম প্রধান, শওকত হোসেন নীলু প্রমুখ। এ ছাড়াও ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও জাসদ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন দল এবং সংগঠন কফিনে ফুল দিয়ে ভাষাসৈনিকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পরে অলি আহাদের মৃতদেহ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে অনুষ্ঠিত জানাযায় অন্যদের মধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, খায়রুল কবীর খোকন, মোশাররফ হোসেন এমপি, মুসলিম লীগের সভাপতি নূরুল হক মজুমদার প্রমুখ অংশ নেন। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে দফায় দফায় অসুস্থ হতে থাকেন অলি আহাদ। গত মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত টানা দুই মাস হাসপাতালে ছিলেন তিনি। মাঝে অবস্থার উন্নতি হলে বাসায় নেওয়া হয়। ২০০৩ সালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে তার কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তখন থেকেই তিনি মূলত বিছানায় ছিলেন। গত রোববার বুকে ব্যথা অনুভূত হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অলি আহাদের মেয়ে জানান।

অলি আহাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ইসলামপুরে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অলি আহাদকে ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের সূচনালগ্নেই গ্রেফতার হয়েছিলেন অলি আহাদ। এক সময় আওয়ামী লীগে থাকা এই নেতা স্বাধীনতার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের গড়া দলে যোগ দেন। আজীবন রাজনীতিতে যুক্ত এই ব্যক্তি ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। গত শতকের আশির দশকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখিও হন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠনের জন্য তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ এ সময় নিষিদ্ধ করা হয়। অলি আহাদের লেখা জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ একটি আলোচিত বই।

দৈনিক সকালের খবর

ভাষাসৈনিক অলি আহাদের ইন্তেকাল

না-ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রখ্যাত রাজনীতিক, ভাষা সৈনিক এবং স্বাধীনতা গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রামে সদা সক্রিয় অলি আহাদ। রাজধানীর একটি হাসপাতালে ক’দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গতকাল শনিবার সকালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ভাষা সৈনিকের প্রতি শেষবারের মত শ্রদ্ধা জানাতে জড়াে হন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। দু’দফা নামাযে জানাযা শেষে বিকেলে বনানী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

মৃত্যুকালে অলি আহাদের বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, সহযোদ্ধা-সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে। আজন্ম যোদ্ধা এই ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় সংসদের স্পীকার আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেটসহ বিশিষ্টজনেরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোক জানিয়ে আরো বিবৃতি দিয়েছে মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এনডিপি), বাংলাদেশ। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, যুব ন্যাপ, মহিলা ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্রদল, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ভাসানী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন। বাদ আসর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত নামাযে জানাযায় অন্যদের মধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুধ আহমেদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, খায়রুল কবীর খোকন, মোশাররফ হোসেন এমপি, মুসলিম লীগের সভাপতি নুরুল হক মজুমদার অংশ নেন। বাদ জোহর তাঁর প্রথম নামাযে জানাযা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে তাঁর লাশ রাখা হয়। প্রথম জানাযায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন বিএনপির সিনিয়র নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, বরকত উল্লাহ বুলু, চিকিৎসক নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেন, কবি আবদুল হাই শিকদার, চাষী নজরুল ইসলাম, রাজনীতিক শফিউল আলম প্রধান, শওকত হোসেন নীলু প্রমুখ।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, রওশন আরা, আওয়ামী লীগের পক্ষে সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, বিএনপির পক্ষ থেকে আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা প্রমুখ আসেন। এছাড়াও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন কফিনে ফুল দিয়ে ভাষাসৈনিকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান। দুপুর পৌনে ১টার দিকে সদ্য মরহুম ভাষাসৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খালেদা জিয়া শমরিতা হাসপাতালে যান। এ সময় তার রূহের মাগফিরাত কামনার পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী। চীন সফর শেষে ঢাকায় ফিরে হযরত শাহজালাল (র.) বিমানবন্দর থেকে সরাসরি তিনি অলি আহাদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাসপাতালে যান।

অলি আহাদের মেয়ে ব্যারিস্টার ফারহানা বলেন, “বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকদিন ধরে হাসপাতালে চারজন ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছিলেন আব্বা। গত রোববার নিউমোনিয়াসহ আরো কয়েকটি রোগে গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফুসফুসের সংক্রমণে (ইনফেকশনে) ভুগছিলেন। গত মার্চ থেকে এটা বেড়ে যায়। গত ক’দিন এ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় তাঁকে। গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

অলি আহাদের স্ত্রী প্রফেসর রাশিদা বেগম জানান, “তার কোনো গুরুতর রোগ ছিল না। গত মার্চ থেকে নিয়মিত অসুস্থ হতে থাকেন। এর মধ্যে মার্চ থেকে এপ্রিল টানা দুই মাস হাসপাতালে ছিলেন। মাঝে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে বাসায় নেয়া হয়। মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে তাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আবার বাসায় চলে যেতাম।” তিনি জানান, ২০০৩ সালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে তার কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তখন থেকেই তিনি মূলত বিছানায় ছিলেন।” স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অলি আহাদকে ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের সূচনালগ্নেই গ্রেফতার হয়েছিলেন এই রাজনীতিক। জীবনের অনেকটা সময় তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছিল। এক সময়ে আওয়ামী লীগে থাকা এই নেতা স্বাধীনতার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের গড়া দলে যোগ দেন। আজীবন রাজনীতিতে যুক্ত এই ব্যক্তি ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। গত শতকের ‘৮০-র দশকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখিও হয়েছিলেন অলি আহাদ। স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠনের জন্য তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ ওই সময় নিষিদ্ধ করা হয়। ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ অলি আহাদের লেখা জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ সেই সময়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। তাঁর একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা হাইকোর্টের আইনজীবী।

Oli Ahad dies

Historic language movement pioneer and veteran politician Oli Ahad who never ran after power during his long political career died on Saturday. He was 85.

A selfless politician Oli Ahad always fought for freedom and democracy.

He played an undeniable role in the country’s politics for decades, both before and after independence.

For several decades, he led Democratic League as its chairman DL fondly called him ‘Jana Neta’ or common people’s leader.

In his chequered political career Oli Ahad was always vocal against authoritarian rule and sectarian politics.

He was against intoduction of one-party autocratic rule of Bangladesh Krishak Sramik Awami League in 1975 and always opposed military rule.

He spent a large part of his life in prison.

In Jatiya Rajneeti 1945 Theke ’75. (National Politics : 1945-1975), the book he authored he objectively chronicled the country’s political events and personalities.

Readers cutting across Bangladesh’s political divides consider the book as an authentic documentation of the nation’s stormy political journey

Oli Ahad was on life support at Shamarita Hospital in the city since Wednesday

Doctors declared him dead at 9.15 AM on Saturday He was admitted into the hospital in a critical condition on October 7.

Ile had been suffering from lung infection and a host of other old age complications.

On hearing the news of his death, the leader of the opposition and BNP Chairperson Khaleda Zia visited Shamarita Hospital to pay her last respects to Oli Ahad.

“Oli Ahad was a dedicated politician,’ said language movement hero and contemporary personality Abdul Matin, recalling their long association since the day preceding the histoic language movement.

He would remain a beacon in the country’s hedgy political sky, he said

His life would remain an example for the politicians to follow, said Matin, better known as ‘Bhasha Matin’ or Language Matin.

He called it utterly regretable that the government failed to show honour to the heroic freedom fighters.

Former law minister and ruling Awami League leader, Abdul Matin Khasru, MP, said the sacrifice an life long struggles of Oli Ahad would continue to inspire politicians for generations.

A contemporary of Bangladesh’s founder president Sheikh Mujibur Rahman, Oli Ahad was among those who played a key role in founding East Pakistan Muslim Chhatra League on January 4, 1948. Later, renamed Chhatra League, its role in the history of the country’s student politics needs no recounting.

In 1948, the then communist leaning Ganatantrik Juba League was founded under Oli Ahad’s initiative and he became its first general secretary. Oli Ahad was the first person to be arrested for the language movement on March 11, 1948.

Oli Ahad served East Pakistan Awami League as its publicity and organizing secretary

On the eve of the Language Movement, Oli Ahad met the then chief minister Khawaja Nazimuddin on January 8. 1948 to discuss the language issue.

He was a member of the Language Movement Organising Committee that organised the hartal on March 12, 1948 demanding Bangla as one of the state languages of Pakistan in its initial years.

While picketing in front of the secretatiat, Oli Ahad was the first person to be arrested.

Shamsul Haque and Khaleque Nawaz Khan were also arrested.

On February 20, 1952, Oli Ahad played a leading role at the historic meeting at Amtala on the then Arts Faculty campus of Dhaka University, now the emergency patients department of Dhaka Medical College Hospital

He led the students’ rally and called the countrywide hartal for the next day, February 21, 1952.

Although he stood first in the Bachelor of Commerce examination of Dhaka University in 1950, the university authorities did not allow him to appear in M Com examination for his involvement in the language movement.

The expulsion order against him was withdrawn 50 years later during the last BNP-led government.

Dhaka University had expelled Oli Ahad for his leading role in the Language Movement.

He joined the National Awami Party formed by Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani at the historic Kagmari Convention in 1957.

Military ruler H M Ershad put Oli Ahad on trial by a military court in 1980.

Ershd’s military regime banned the weekly Mehad, edited by Oli Ahad, for opposing military dictatorship in the country.

The veteran politician was honoured with Swadhinata Padak, in 2004 in recognition of his contribution to independence of Bangladesh.

Oli Ahad is survived by his wife Professor Rashida Begum and only daughter Barrister Rumeen Farhana.

Born in Islampur, a village in Brahmanbaria’s Sarail upazila in 1928, Oli Ahad passed matriculation from Daudkandi Government Aided High School in 1944.

In 2007, Dhaka City Corporation named Road No 4 of Dhanmondi after Oli Ahad.

His first namaz-e-janaza at Central Shaheed Minar after the zohr prayer was followed by the second janaza at National Mosque Baitul Mukarram after the Asr prayer.

Language veterans Abdul Matin and Hosne Ara, Prof Mahbubullah, Awami League leader Abdul Matin Khasru, BNP leaders Abdullah Al Noman and Sade Hossain Khoka, Workers Party’s Anlisur Rahman and Ismail Ahmed of NAP attended the janaza prayers.

They recalled the contributions of Oli Ahad. Oli Ahad was buried at Banani Graveyard in the city.

Daily New Age

Oli Ahad no more

Language movement hero and veteran politician Oli Ahad died of old age complications at a city hospital yesterday. He was 84.

He was laid to eternal rest at Banani graveyard.

His first namaz-e-janaza was held at the Central Shaheed Minar after Zohr prayer. His body was kept there until afternoon for people of all walks of life to pay their last tributes.

The second janaza was held at Baitul Mokarram National Mosque after Asr prayers. He was buried in the evening.

He left behind daughter Rumeen Farhana, his only child, wife Prof Rashida Begum and a host of relatives and well-wishers.

Oli Ahad was admitted with pneumonia at Shamarita Hospital last Sunday. He was put on a life-support machine.

Ahad was born in 1928 at Islampur village of Brahmanbaria. He passed his matriculation exams from Daudkandi Government Aided High School in 1944.

He was one of the founders of the then East Pakistan Muslim Students’ League in 1948 and was subsequently organising secretary of the East Pakistan Awami League.

He was the chairman of a political party, the Democratic League, and editor of the weekly Inehad.

Ahad’s daughter Barrister Rumeen Farhana described her father as selfless, honest, uncompromising and outspoken. Politically, his position was diametrically opposite to what is currently in vogue

Ahad won the Independence Award in 2004. He, however, donated the prize money to Bangla Academy, said Rumeen.

Having achieved an outstanding feat in the higher secondary examination, he won a monthly scholarship of Tk 20, she said, but he refused to take it, arguing that the incentive should be given to poor students who could not afford tuition fees and books.

“He was the greatest of fathers,” she added.

Police arrested Oli Ahad first in 1948. He was present at the historic February 21 rally during the language movement at Dhaka University’s Amtala in 1952.

In a message of condolence, BNP Chairperson Khaleda Zia said, “Like the entire nation, I am deeply shocked at the death of Oli Ahad.”

Workers party of Bangladesh, Gonoforum, Bangladesh Jatiya Party, Bangladesh National Awami Party, Bangladesh Jubo Maitri, National People’s Party, Bangladesh Muslim League, Jatiya Samajtantrik Dal, Bangladesh Chhatra Maitri, Swatantra Forum, Shoto Nagorik Jatiya Committee, Sammilito Sangathan Samnnoy Parishad and Revolutionary Workers Party of Bangladesh condoled his death in separate messages.

Daily Star

Oli Ahad dead

The 85-year-old Language Movement veteran and Democratic League Chairman Oli Ahad passed away Saturday morning in a Dhaka hospital, reports bdnews24.com

He was pronounced dead by doctors around 9am after being kept on life support over the last few days, said Democratic League’s General Secretary Saifuddin Moni.

Ahad was admitted to Shamarita Hospital in a critical condition on October 14. He was suffering from lung infection.

His wife, Professor Rashida Begum said the veteran politician had been ill since March. He spent a spell in the hospital from March to April, before being taken home after his condition improved. He was brought back after it deteriorated again.

Ahad was one of the key founders of East Pakistan Muslim “Chhatra League formed on January 4, 1948.

He was also the founding General Secretary of the Ganatantrik Juba League and was the first person to be arrested in the Language Movement on March 11, 1948.

The Financial Express

চলে গেলেন অলি আহাদ

প্রবীণ রাজনীতিক ভাষাসৈনিক অলি আহাদ আর নেই। রাজধানীর পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় গতকাল শনিবার সকালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। বরেণ্য এই ভাষাসৈনিক গত রবিবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শমরিতায় ভর্তি হন। এছাড়া তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। কয়েকদিন ধরেই তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। গতকাল শনিবার সকাল ৯টা ২০ মিনিটে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়া হয় বলে জানান তার মেয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। আজীবন রাজনীতিতে যুক্ত অলি আহাদ ছিলেন ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান। তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারিতে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য সর্বপ্রথম তিনিই গ্রেফতার হয়েছিলেন। অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে ন্যাপে যোগ দেন তিনি। বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে পরিচালিত সব সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এজন্য জীবনের অনেকটা সময় তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়েছিল। ‘৮০-এর দশকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখিও হয়েছিলেন অলি আহাদ। স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠনের জন্য তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ ওই সময় নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অলি আহাদকে ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। অলি আহাদের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ইসলামপুর গ্রামে। তার একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা হাইকোর্টের আইনজীবী। দ্বিতীয় নামাজে জানাযা বাদ আসর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। দ্বিতীয় জানাযায় অন্যদের মধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, খায়রুল কবীর খোকন, মোশাররফ হোসেন এমপি, মুসলিম লীগের সভাপতি নূরুল হক মজুমদার অংশ নেন।

মরদেহে বেগম খালেদা জিয়ার শ্রদ্ধা : ভাষাসৈনিক অলি আহাদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানালেন বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল শনিবার চীন থেকে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রাজধানীর পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে যান বেগম খালেদা জিয়া। বেলা ১টার দিকে তিনি সেখানে পৌঁছান।

বেগম খালেদা জিয়া ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মরদেহের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালাম, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।

শহীদ মিনারে প্রথম জানাযা : বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামে সদা সক্রিয় ভাষাসৈনিক অলি আহাদের প্রথম নামাজে জানাযা বাদ জোহর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে তার মরদেহ রাখা হয়। বাদ আসর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তার দ্বিতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন বিএনপির সিনিয়র নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, বরকত উল্লাহ বুলু, খায়রুল কবীর খোকন, চিকিৎসক নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেন, কবি আবদুল হাই শিকদার, চাষী নজরুণ ইসলাম, রাজনীতিক শফিউল আলম প্রধান, শওকত হোসেন নীলু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি মহিদুল হাসান হিরু, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ খান পারভেজ, সাংগঠনিক সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম মিনহাজ প্রমুখ। এ সময় শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, রওশন আরা, আওয়ামী লীগের পক্ষে সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু। এছাড়াও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন কফিনে ফুল দিয়ে ভাষাসৈনিকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান। পরে লাশ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। শমরিতার চিকিৎসক প্রফেসর কাজী দীন মোহাম্মদ, প্রফেসর আলি হোসেন, প্রফেসর আফজাল কায়সার, প্রফেসর এমএ আলম, প্রফেসর আবদুর রহমানের সমন্বয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড তার চিকিৎসার দেখভাল করেন। গত বুধবার দুপুর থেকে তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন শমরিতার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. হারুন উর রশিদ। মৃত্যুর আগে অলি আহাদের মেয়ে ব্যারিস্টার ফারহানা বলেন, বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকদিন ধরে হাসপাতালে চারজন ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছিলেন আৰুৱা। গত রবিবার নিউমোনিয়াসহ আরো কয়েকটি রোগে গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফুসফুসের সংক্রমণে (ইনফেকশন) ভুগছিলেন। গত মার্চ থেকে এটা বেড়ে যায়।

অলি আহাদের স্ত্রী প্রফেসর রাশিদা বেগম জানান, তাঁর কোনো গুরুতর রোগ ছিল না। গত মার্চ থেকে নিয়মিত অসুস্থ হতে থাকেন। এর মধ্যে মার্চ থেকে এপ্রিল—টানা দুই মাস হাসপাতালে ছিলেন। মাঝে অবস্থার উন্নতি হলে বাসায় নেয়া হয়। মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে তাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আবার বাসায় চলে যেতাম। তিনি জানান, ২০০৩ সালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে তাঁর কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তখন থেকেই তিনি মূলত বিছানায় ছিলেন। কিন্তু রবিবার হঠাৎ তিনি বুকের ব্যথা অনুভব করতে থাকলে আমরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসি।

দেশ একজন বরেণ্য ব্যক্তিকে হারাল : স্পিকার

জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ দেশের বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গতকাল শনিবার এক শোকবাণীতে স্পিকার বলেন, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ছিলেন সময়ের সাহসী সন্তান। তার মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য ব্যক্তিকে হারাল। তার মৃত্যু দেশের জন্য একট বিরাট ক্ষতি। এ ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হবার নয়। বাংলা ভাষা রক্ষার সংগ্রামে মহান এ সৈনিকের অবদান দেশবাসী। আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। স্পিকার মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের শোক

বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক, স্বাধীনতা যুদ্ধের অনন্য সংগঠক, ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এক শোকবাণীতে বিএনপি চেয়ারপার্সন অলি আহাদকে মহান ভাষা আন্দোলনের একজন অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, মরহুম অলি আহাদ মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তৎকালীন স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সংগঠিত করেছিলেন ছাত্র-জনতাকে মাতৃভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে সামিল হওয়ার জন্য। মরহুম অলি আহাদ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সারা জীবন স্বদেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন নির্ভীক সিপাহসালার। মানুষের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে তিনি কখনো কোন স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুর নিকট মাথা নত করেননি। আর এজন্য তিনি স্বৈরাচারের নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত হয়েছেন, নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছেন, তবুও তাঁর নীতি ও আদর্শ থেকে কেউ তাকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি।

বেগম খালেদা জিয়া বলেন, তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে লেভি-প্রলোভনের হাতছানি কখনোই তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের প্রশ্নে আপোস বা সুবিধাবাদিতার গ্লানি তাকে কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি। নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের জাতীয় অর্জনগুলোতে রেখেছেন এক অসামান্য অবদান। তিনি আমাদের ইতিহাসে সর্বকালের একজন দীপ্তিমান অভিযাত্রী। স্বাতন্ত্র্যধর্মী ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মরহুম অলি আহাদের কর্মময় জীবন-উত্তর প্রজন্মকে সব সময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে বলে বিএনপি চেয়ারপার্সন আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন ‘অলি আহাদের মৃত্যুতে দেশবাসীর ন্যায় আমিও গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য ভাষাসৈনিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আদর্শবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারাল যার শূন্যস্থান সহজে পূরণ হবার নয়।’ বেগম খালেদা জিয়া মরহুম অলি আহাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকাহত পরিবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

অপর এক শোকবার্তায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক ও প্রখ্যাত রাজনীতিক অলি আহাদকে ভাষা আন্দোলনের বীরসেনানী এবং দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। মির্জা আলমগীর তার রূহের মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গ ও আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। অনুরূপ এক শোকবাণীতে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি নজরুল ইসলাম খান মরহুম অলি আহাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, অলি আহাদের মৃত্যুতে জাতি একজন সত্যিকার অভিভাবককে হারাল। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংকটকলীন সময়ে তাঁর ভূমিকা দেশবাসীকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। তিনি মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকাহত পরিবারের সদস্যবর্গের প্রতি গভীর সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেন।

দৈনিক দিনকাল

অলি আহাদের লড়াকু জীবন

বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি আদায় করেই তিনি থেমে ছিলেন না, পরবর্তীকালে স্বাধিকার আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁকেই প্রথম কারাগারে যেতে হয়। সক্রিয় এই রাজনীতিবিদ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। একই সঙ্গে আশির দশকের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে ২৯ মার্চ, ১৯৪৮ তৎকালীন সরকার তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার করে। তিনি বি কম সম্পন্ন করলেও তৎকালীন সরকার তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। থেকে এম.কম করতে দেয়নি। দীর্ঘ ৫৮ বছর পর ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়া ১৯৪৭-১৯৭৫ সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের শেষ ভাগে তিনি ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এছাড়া জাতীয় রাজনীতিতে তার অভিজ্ঞতা সংবলিত গ্রস্থ জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ এর প্রণেতা তিনি।

ভাষাসৈনিক অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামপুরে। তার পিতা আবদুল ওহাব ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। পড়াশোনার হতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে ১৯৪৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার চার সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের কারণে ১৯৪৬ সালে আইএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কমে ভর্তি হন। কলেজ জীবনেই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। সেখান থেকেই তাঁর রাজনীতি শুরু। ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ১৯৫২-এর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদকও তিনি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য তাঁকে প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত করে পাকিস্তানি পুলিশ। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম,কম পড়ার সুযোগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা

১৯৫২ সাল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত এবং রাজপথ ছিল উত্তাল। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে।

সকাল ১১টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক, শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিতে থাকেন এই সমাবেশের। এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সকালের দিকে ১৪৪ ধারা ভাঙার ব্যাপারে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মতনৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. এস এম। হোসেইনের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক ১৪৪ ধারা না ভাঙার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে অন্য নেতারা এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ। হন। এ অবস্থায় বাংলার দামাল ছেলেরা দমনমূল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। সংগ্রাম পরিষদের সভায় আবদুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মওলা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ভোট দেন। সেখানে অলি আহাদ ছিলেন প্রথম ১৪৪ ধারা ভাঙার অগ্রবর্তী সৈনিক। ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। শ্লোগানে স্লোগানে কেঁপে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বুলেট আর লড়াই শুরু হয়।

পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দিন ও আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়। এ ছাড়া নাম না জানা আরো অনেকের সঙ্গে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ নিরাপত্তা আইনে রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ, পুলিন দে, অধ্যাপক পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, অলি আহাদ প্রমুখকে গ্রেফতার করে তৎকালীন সরকার।

রাজনৈতিক জীবন তার রাজনীতির শুরুটা ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে প্রগতিশীলদের পক্ষে যোগ দেন। সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠন করেন। ইত্তেহাদ-এ বর্তমান সময়ের অনেক সম্পাদক লেখালেখি করতেন। তাঁর রচিত জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ নামক গ্রন্থটি এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল। স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই ভাষাসৈনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য শাসকদের ওপর তিনি চাপ সৃষ্টি করেন। তৎকালীন সরকারের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দুঃশাসন বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিশেষ ক্ষমতা আইনে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। তিনি ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সৃষ্ট একদলীয় স্বৈরশাসন। তথা বাকশালের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে পরিচালিত সকল সংগ্রামে অকুতোভয় এই লড়াকু জননায়ক আজীবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

আশির দশকে সামরিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপোসহীন ভূমিকার কারণেও তাকে একাধিকবার গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়। এরশাদ সরকার সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার করে। ওই সময় তার হাতেগড়া জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদকে নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া

দৈনিক দিনকাল

Oli Ahad is no more

An illustrious politician and language movement veteran Oli Ahad passed away suffering from pneumonia and old age complications at a city hospital on Saturday.

He breathed his last at about 9.15 am at Samorita Hospital. He was 84. He was suffering from respiratory tract infection for long compounding his old age complications.

Oli Ahad, who founded the Democratic League, was the president of the party till his death. He left behind wife, a daughter, a host of relatives and well-wishers to mourn his death. He was bom at Islampur village under Brahmanbaria district.

With tears in their eyes, thousands of mourners from all walks of life bid farewel to one of the few surviving leaders of the great language movement, placing wreaths on his flower bedecked coffin at the central Shaheed Minar premises on Saturday. The Minar was built in memoy of the fallen language heroes in police firing in 1952.

The body of Oli Ahad was taken to the central Shaheed Minar premises on Saturday afternoon for his first namaj-e-janaza where a large number of people participated to pay their last respects.

Among others, language veteran Abdul Matin and politicians from all spectrum including Awami League and BNP, also joined the moumers.

The AL leaders included Abdul Matin Khasru, BNP leaders Abdullah Al Noman, Sadeque Hossain Khoka, Barkat Ullah Bulu, Khairul Kabir Khokan, Abdul Hai Sikder, Chashi Nazrul Islam and AZM Zahid.

BNP-led 18-party alliance leaders, including Shafiul Alam Prodhan, Sheikh Shawkat Hossain Nilu also participated in the namae-janaza

He was laid to rest at Banani graveyard.

Different student organisations, including Chhatra League, Jatiyatabadi Chhatra Dal and socio-cultural organisations paid their last respect to the late leader who was the publicity and organising secretary of the Awami League in the fifties.

The second namaj-e-janaza of the late language movement hero was held at the national mosque Baitul Mukarram after Asr prayers where BNP leaders Khandakar Mosharraf Hossain, Moudud Ahmed, Rafiqul Islam Mia and others, took part

After the namaj-e-janaza, Oli Ahad was laid to eternal rest at the Banani graveyard with due respect

Soon after receiving the information of his death, President Zillur Rahman, Prime Minister Sheikh Hasina and leaders from the different political parties, including Dr Kamal Hossain, one of the architects of the constitution, expressed their profound shocks and extended their sympathy to the bereaved family members.

After arriving at Hazrat Shahjalal International Airport at about 12:06 pm from a week-long China trip, BNP chairperson and leader of the opposition, Khaleda Zia accompanied by party leaders Mirza Abbas, ASM Hannan Shah, Mosaddeque Ali and Shamsuzzaman Dudu visited Samorita Hospital to pay her last respects to the great language movement hero.

Daily The Independent

অলি আহাদ নেই

ভাষাহীনতার দেশে ভাষাসৈনিক

বাক, ব্যক্তি, গণত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামে সদা সক্রিয় ভাষাসৈনিক অলি আহাদ আর নেই। লাইফ সাপোর্টে থাকা এ ভাষাসংগ্রামী গতকাল রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি … রাজিউন)। তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দুপুরে তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। এ সময় তাঁকে গার্ড অব অনার জানানো হয়। বাদ জোহর শহীদ মিনারে প্রথম এবং বাদ আসর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে দ্বিতীয় জানাযা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। দাফনকালে বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিলুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটসহ বিশিষ্টজনেরা। অলি আহাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ইসলামপুরে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের সূচনালগ্নে গ্রেপ্তার। হয়েছিলেন এ রাজনীতিক। এক সময় আওয়ামী লীগে থাকা এ নেতা স্বাধীনতার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের গড়া দলে যোগ দেন। আজীবন রাজনীতিতে যুক্ত এ ব্যক্তি ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। আশির দশকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখিও হয়েছিলেন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠনের জন্য তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ সে সময় নিষিদ্ধ করা হয়। ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ অলি আহাদের লেখা জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ সেই সময়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।

দৈনিক আমাদের সময়

চলে গেলেন ভাষাসৈনিক অলি আহাদ

বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক অলি আহাদ আর নেই। রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর চিকিৎসকগণ গতকাল শনিবার সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন (ইন্না লিল্লাহি … রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তিনি স্ত্রী অধ্যাপক রাশিদা বেগম, মেয়ে ব্যারিস্টার ফারহানা, আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাক্ষীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া, সংসদের স্পিকার মো. আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীসহ বিশিষ্টজনেরা। তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

ভাষাসৈনিক অলি আহাদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে দুপুরে শমরিতা হাসপাতালে যান বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল চীন সফর শেষে দেশে ফিরেই তিনি তাকে দেখতে যান। তিনি মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানান। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মির্জা আব্বাস, হান্নান শাহ, চিকিৎসক নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুধু, এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু প্রমুখ। অলি আহাদের প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় বাদ জোহর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এর আগে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ রাখা হয়। শহীদ মিনারে এই ভাষা সৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, রওশন আরা বাচ্চু, আওয়ামী লীগের পক্ষে সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু। এ ছাড়াও ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান।

প্রথম জানাযায় অংশ নেন বিএনপির সিনিয়র নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, বরকত উল্লাহ বুলু, খায়রুল কবীর খোকন, চিকিৎসক নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেন, কবি আবদুল হাই শিকদার, চাষী নজরুল ইসলাম, রাজনীতিক শফিউল আলম প্রধান, শওকত হোসেন নীলু প্রমুখ। পরে লাশ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাযায় অন্যদের মধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন, মুসলিম লীগের সভাপতি নূরুল হক মজুমদার অংশ নেন। পরে তাঁকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অলি আহাদকে ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ইসলামপুর গ্রামে অলি আহাদ জন্মগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের সূচনালগ্নেই গ্রেফতার হয়েছিলেন এই রাজনীতিক। এক সময়ে আওয়ামী লীগে থাকা এই নেতা স্বাধীনতার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের গড়া দলে যোগ দেন। আজীবন রাজনীতিতে যুক্ত এই ব্যক্তি ভেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। গত শতকের ‘৮০-র দশকে সামরিক ট্রাইবুনালে বিচারের মুখোমুখিও হয়েছিলেন অলি আহাদ। স্বৈরাচারবিরোধী জনমত গঠনের জন্য তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ ওই সময় নিষিদ্ধ করা হয়।

গত রোববার নিউমোনিয়াসহ আরো কয়েকটি রোগে গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন। গত মার্চ থেকে এটা বেড়ে যায়।

দৈনিক ভোরের ডাক

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা অলি আহাদ স্মরণে

বদরুদ্দীন উমর

গত ২০ অক্টোবর ২০১২ অলি আহাদের জীবনাবসান হয়েছে। তিনি বিগত কয়েক বছর ধরেই অসুস্থ ছিলেন। অক্টোবরের প্রথম থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে ও তাকে ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার কোনো ঐতিহ্য আজ পর্যন্ত গড়ে না ওঠায় অলি আহাদের প্রধান কীর্তি বাংলা ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা এখন প্রায় বিস্মৃত। তার মৃত্যুর পর তার এ কীর্তি বিষয়ে অতিসামান্য কিছু লেখালেখি ও বিবৃতি দেখা গেলেও এটা সত্য। এ কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি এলে অনেকের কীর্তি নিয়ে আলোচনা হলেও অলি আহাদ এসব আলোচনাতে বিস্ময়করভাবে উপেক্ষিত থাকেন। অনেকের নগণ্য ভূমিকাকে বাড়িয়ে বলা, কারও ভূমিকা যে পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ তার থেকে বেশি বলা ইত্যাদি হলেও অলি আহাদের কোনো উল্লেখ ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গদগদ বক্তব্য নেওয়ালাদের কাউকে করতে দেখা যায় না। হতে পারে, অলি আহাদ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে থাকাতেই এটা ঘটে। কিন্তু এ দেশে যদি সত্যিকার ইতিহাস চর্চা থাকত তাহলে কার পরবর্তী ভূমিকা কী সেটা দিয়ে তার বিচার না করে ঘটনার সময় তার কী ভূমিকা ও গুরুত্ব ছিল তারই বিচার হত। সে কারণেই মানুষ তাকে স্মরণ করত। কিন্তু বাংলাদেশ হল ঐতিহাসিক সত্য হননের দেশ। প্রকৃত ইতিহাস চর্চা এ দেশে অপরাধতুল্য ব্যাপার। যাই হোক, অলি আহাদের কথায় ফিরে গিয়ে বলা চলে যে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে ছাত্র থাকাকালে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। মুসলিম লীগের সমর্থক হিসেবে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগে যোগ দেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি কোনো সময়ই মুসলিম ছাত্রলীগ অথবা অন্য কোনো সাম্প্রদারিক সংগঠনে যোগ দেননি। এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন কমরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখের সহযাত্রী। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন গঠিত হওয়ার সময় অলি আহাদ তার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ না হলে ওই পদে নির্বাচিত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হত না যুবলীগ গঠিত হওয়ার আগে অলি আহাদ যেসব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের সেই আন্দোলন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন হিসেবে গুরত্বপূর্ণ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিপুল সংখ্যায় এই আন্দোলনের সমর্থনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার কারণে সেটা ছিল ছাত্র আন্দোলনের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। অলি আহাদ একজন শক্তিশালী সংগঠক ছিলেন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন। সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এ কারণে আন্দোলনের শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তার মধ্যে ছিলেন অলি আহাদ। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৬ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়। এই ৬ জনের মধ্যে ছিলেন অলি আহাদ, দবিরুদ্দীন ইসলাম, উমাপতি মিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে যাদের বহিষ্কার করা হয় তার মধ্যে ছিলেন আবদুর রহমান চৌধুরী, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুস সামাদ, অরবিন্দ বসু ও জে পাত্রবিশ। পনেরো টাকা হিসেবে যাদের জরিমানা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, কল্যাণ দাসগুপ্ত ও নাদিয়া বেগম। দশ টাকা জরিমানা হয় আইন বিভাগের ছাত্রী লুলু বিলকিস বানুর (কলকাতার দৈনিক সত্যযুগ, ৪,৪,১৯৪৯; কলকাতার ‘T}fe States/pics71, ৪,৪,১৯৪৯; ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সৈনিক, ১৫.৪.১৯৪৯)। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর অলি আহাদ সংগঠনটিকে শক্তিশালী যুব সংগঠন হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য আত্মনিয়োগ করেন। এ ক্ষেত্রে তার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন এমানুল্লাহ ও মহম্মদ সুলতান। তৎকালীন এ দুই উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মীও এখন বিস্মৃত। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনার সময় ও তাঁদের নাম উচ্চারিত হতে দেখা যায় না। যুবলীগ সংগঠিত হতে থাকার সময়ই ভাষা আন্দোলন নতুনভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা শুরু হয়। পাবনার আবদুল মতিনের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ নতুনভাবে গঠিত হয়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এটা ঘোষণার পর ভাষা আন্দোলন এক নতুন মাত্রা অর্জন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার সপক্ষে উত্তাল আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ ছাড়াও ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এর সভাপতি হন মওলানা ভাসানী, সম্পাদক হন মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা গোলাম মাহবুব। সিদ্ধান্ত হয় ভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করায় আন্দোলনে এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে থাকলেও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির অধিকাংশ সদস্য ছিলেন ওঙ্গের বিরোধী। এ সময় অলি আহাদ, আবদুল মতিনসহ ৪ জন এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে তারা ছাত্রদের সংগঠিত করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন। ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী স্থানে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে বরকত, সালাম, রফিক প্রমুখ কয়েকজন ছাত্র এবং সাধারণ লোক নিহত হন। গুলিবর্ষণের পর পরিস্থিতি যা দাঁড়ায়। তাতে অলি আহাদই হয়ে দাঁড়ান আন্দোলনের সর্বপ্রধান নেতা। গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার পর আবদুল মতিন কতখানি অনুতপ্ত হন ও ভেঙে পড়েন তা আমাকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন। এরপর তাঁর আর কোনো ভূমিকা। তখনকার আন্দোলনে থাকেনি। সর্বদলীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহমুদ এরপর আন্দোলনের বিরোধিতা করে সরে দাঁড়ান। সেই অবস্থায় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অলি আহাদই আন্দোলনের হাল ধরেন। এখানে অবশ্য বলা দরকার যে, ভাষা আন্দোলন কোনো দলের দ্বারাই এককভাবে পরিচালিত হয়নি। তার কোনো দৃঢ় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। কোনো একক নেতা ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ পর্যায়ে অলি আহাদই আবির্ভূত হন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখার কোনো সুযোগ এখানে নেই, তবে ওপরের কথাগুলো বলার প্রয়োজন আছে। কারণ ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার বাংলাদেশে চালু রয়েছে।

ভাষা আন্দোলনই ছিল অলি আহাদের রাজনৈতিক জীবনের শীর্ষতম পর্যায়। অল্প বয়সে তিনি সেই শীর্ষে পৌছালেও পরবর্তী জীবনে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি সব সময়ই সরকারের নির্যাতন, ফ্যাসিস্ট আচরণ ইত্যাদির বিরোধিতা করে গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলার পক্ষে কাজ করলেও রাজনীতির মূল স্রোত থেকে সরে যাওয়ার কারণে তার মত একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠক এ দেশের রাজনীতিতে যে অবস্থান অর্জন করার কথা সেটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার পক্ষে কী সম্ভব হয়নি, তার বিচার করার চেষ্টা না করে তিনি নিজের জীবনে কী সম্ভব করেছিলেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে কী ইতিবাচক অবদান রেখেছিলেন সেটা মূল্যায়ন ও স্মরণ করা শুধু তার তিরোধান উপলক্ষেই নয়, এ দেশের রাজনীতিকে বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচারের হাত থেকে রক্ষার জন্যও আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।

দৈনিক সমকাল, ২৩ অক্টোবর ২০১২

চলে গেলেন ইতিহাসের সাক্ষী অলি আহাদ

জাতি হিসেবে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। রয়েছে গৌরব। বাঙালি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে। মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে। আবার রক্ত দিয়ে সংগ্রাম করে পরাধীনতার শিকল ভেঙে নিজেদের স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপরিচয় তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন একটি ভূখণ্ডেরও নাম লেখা হয়েছে। এসবই বাঙালির অর্জন। আর এ অর্জনের জন্যই আজ বাঙালি গর্ব করতে পারে। বাঙালির এ অর্জনের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর। আর ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ এই সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাস রচিত হয়। এসব ইতিহাসের সাক্ষী এবং ইতিহাস সৃষ্টির অন্যতম একজন লড়াকু সৈনিক অলি আহাদ। ইতিহাসের এ মহাসৈনিক গত ২০ তারিখে ইতিহাস হয়ে গেলেন। অর্থাৎ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পার্থিব জগৎ ছেড়ে অন্য এক জগতে চলে গেলেন। এ পৃথিবীতে তাকে আর সশরীরে আমরা দেখতে পাব না। আর কোন ইতিহাস সৃষ্টির নায়ক তিনি হবেন না। তবে তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন বহুকাল। কালের পরিবর্তনে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও ইতিহাস কখনো পরিবর্তন হয় না। কেননা ইতিহাস সময়কে ধারণ করে। অতীতকে যেমন স্পর্শ করা যায় না, তেমনি অতীতকে পরিবর্তনও করা যায় না। যদিও মানুষ চেষ্টা করে ইতিহাসের ওপর হস্তক্ষেপ করতে। সেটা সাময়িকভাবে সম্ভব হলেও চিরস্থায়ীভাবে সম্ভব হয়। ইতিহাস সৃষ্টির এ মহানায়ক ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড্রিয়ার ইসলামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল ওহাব ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। লেখাপড়া শুরু তার পরিবার থেকেই। ১৯৪৪ সালে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৪৬ সালে শুরু হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার চার সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে তিনি ১৯৪৬ সালে আইএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। বিকমে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজ জীবনেই তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। এ হাতেখড়ি থেকেই তাঁর বর্ণাঢ্যময় রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অলি আহাদ। শুধু তাই নয়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম। সৈনিক ও এ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তাকে প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত করে পাকিস্তানি পুলিশ।

১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। তবুও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হওয়ার কারণে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমকম পড়ার সুযোগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। দীর্ঘ ৫৮ বছর পর ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গোটা মায়ের ভাষার জন্য জীবনমরণবাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে। ‘৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের গেটের পাশে ছাত্রছাত্রীরা একত্রিত হতে শুরু করে।

সকাল ১১টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, গাজীউল হক, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ সমাবেশ চলে। এর আগে। পাকিস্তান সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে। দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকায় সব ধরনের সমাবেশ মিছিল মিটিংয়ের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সরকারের দেয়া এ ১৪৪ ধারা ভেঙে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যারা মত দিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম অলি আহাদ এবং তিনিই ছিলেন অগ্রগামী সৈনিক ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন ছাত্র-জনতা প্রাণ হারায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ নিরাপত্তা আইনে রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, পুলিন দে, অধ্যাপক পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, অলি আহাদ প্রমুখকে গ্রেফতার করে।

পরবর্তী জীবনে অলি আহাদ নিজেকে রাজনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত রাখেন। রাজনীতির শুরুটা ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে প্রগতিশীলদের পক্ষে যোগ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য সে সময়ের শাসকদের ওপর তিনি চাপ সৃষ্টি করেন এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ জন্য বিশেষ ক্ষমতা আইনে সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং জেলখানায় পাঠায়। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সৃষ্ট একদলীয় স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সব সংগ্রামে আজীবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

আশির দশকে সামরিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াকু আপসহীন ভূমিকা পালনের কারণে তাকে একাধিকবার এরশাদ সরকার গ্রেফতার করে এবং জেলখানায় আটকে রাখে। পরে সামরিক ট্রাইব্যুনালে তার বিচার করা হয়। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তার হাতে গড়া জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদকে নিষিদ্ধ করে। তিনি চিরদিনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। যে সংগ্রামে বচিত হয়েছে বাংলার ইতিহাস। সেসব ইতিহাস নিয়েই লিখেছেন জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ নামক গ্রন্থটি, যা এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল। বয়সের কারণে এক সময় এই চিরপ্রতিবাদী মানুষটি নিস্তেজ হতে থাকেন। ২০০৩ সালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙে যায়। সে থেকেই সঙ্গী। হয় তার বিছানা। মাঝে মধ্যে হাসপাতালে গেলেও তেমন আর নড়াচড়ার শক্তি তার হয়নি। দীর্ঘদিন বিছানাকে সঙ্গী করে থাকলেও কয়েকদিন আগে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। শমরিতা হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখানেই জীবনের শেষ পদচিহ্ন রেখে চলে গেলেন অনেক দূরের এক জগতে।

অলি আহাদের জীবনটা ব্যতিক্রম। তাকে ক্ষমতার লোভ কিংবা অর্থ লোভ গ্রাস করতে পারেনি। জীবনের শুরু থেকে পড়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যতদিন শক্তি-সামর্থ ছিল ততদিন এই আদর্শের বাইরে যাননি। তিনি যেমন মায়ের ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছেন, সেরকম মায়ের ভাষায় স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের জন্যও সংগ্রাম করেছেন। গণতন্ত্র রক্ষায় এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার সংগ্রাম ছিল। আমরণ। তাঁর বর্ণাঢ্যময় জীবন থেকে পরবর্তী প্রজন্ম দেশপ্রেমে আরও বেশি। উজ্জীবিত হবে। মৃত অলি আহাদও দেশের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকবেন হাজার। বছর। তাই মহান স্রষ্টার কাছে আমাদের প্রার্থনা—তাঁকে চিরশান্তিময় এক কল্যাণকর স্থানে অধিষ্ঠিত কর।

দৈনিক সংবাদ, ২২ অক্টোবর ২০১২

প্রতিবেদন

শহীদ মিনারে অলি আহাদের জানাযা নিয়ে বিতর্ক

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকা, ২১ অক্টোবর

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষাসৈনিক অলি আহাদের জানাযার নামায পড়া নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। শহীদ মিনারের মত অসাম্প্রদায়িক মিলনস্থলে জানাযার নামায পড়ার বিষয়টিকে জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন তারা। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রনায়ক ভাষাসৈনিক অলি আহাদ। শনিবার বাদ জোহর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁর প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বাদ আসর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে দ্বিতীয় জানাযা শেষে তাঁকে বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। শহীদ মিনারে অলি আহাদের জানাযার নামায পড়ার বিষয়টিকে ভালোভাবে নেন নি দেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, দেশের সরকার যখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ঠিক সেই মুহুর্তে এ ধরনের কার্যক্রম জাতীয় ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার মধ্যে হওয়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অথচ এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে থেকে কিছু জানত না বলে জানানো হয়। এ ব্যাপারে এক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কোন সভা-সমাবেশ করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। অথচ ভাষাসৈনিক অলি আহাদের মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কিছু জানানো হয়নি। সেখানে তার জানাযার নামায পড়ার বিষয়টিও আমরা অবগত ছিলাম না।

শহীদ মিনারে জানাযা অনুষ্ঠানকে জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী উল্লেখ করে ঢাবি ভিসি বলেন, শহীদ মিনার পবিত্র স্থান। অসাম্প্রদায়িক মিলনস্থল। এটি সকলের জন্য। এখানে জানাযার নামায পড়া কোনভাবেই ঠিক হয়নি।

এ ঘটনায় শহীদ মিনারের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ড, আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এ ঘটনায় শহীদ মিনারের নিরাপত্তায় কোনো ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না। এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আমি অনুরোধ করব ভবিষ্যতে কেউ যেন এমনটি না করেন।

এদিকে এ ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অভিযোগ করেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এটা নিশ্চিত যে শহীদ মিনার জানাযার জায়গা নয়। এটি সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। শহীদ মিনারের পবিত্রতা নষ্ট করতে তারা এটি ঘটিয়েছে। ভাষাসৈনিক হিসেবে অলি আহাদের জানাযা শহীদ মিনারে হওয়াকে কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে করেন—এমন প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট এ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, আমি এটিকে একেবারেই যৌক্তিক বলে মনে করছি না। এ ঘটনায় শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণ প্রশ্নের মুখে পড়ে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Dhaka Times 24.com

বিশিষ্টজনের প্রতিক্রিয়া : শহীদ মিনারে অলি আহাদের জানাযা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ইউসুফের বক্তব্য ষড়যন্ত্রমূলক

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক এবং জাতীয় রাজনীতির অন্যতম নেতা অলি আহাদের জানাযা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিতর্কের সূচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। এদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন ভাষাসৈনিক ও বিশিষ্ট নাগরিকরা। গত শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন অলি আহাদ। শনিবার বাদ জোহর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁর প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় ভাইসচ্যান্সেলর আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘শহীদ মিনারে জানাযা অনুষ্ঠান জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী।’ তিনি বলেন, শহীদ মিনার পবিত্র স্থান। অসাম্প্রদায়িক মিলনস্থল। এটি সবার জন্য, এখানে জানাযা পড়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।’ নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, এটি সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, “এটা নিশ্চিত যে শহীদ মিনার জানাযার জায়গা নয়। এখানে জানাযার আয়োজন সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। শহীদ মিনারের পবিত্রতা নষ্ট করতে তারা এটি করেছে। এদিকে এদের বক্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন ভাষাসৈনিকসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তাঁরা ভাইস-চ্যান্সেলর আরেফিন সিদ্দিক ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চর বক্তব্যকে আপত্তিকর, অজ্ঞতাপ্রসূত, দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তারা বলেন, যারা এটাকে সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্র বলছেন মূলত তারাই ষড়যন্ত্রকারী এবং তারাই জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী।

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুর গতকাল সন্ধ্যায় আমার দেশ-কে বলেন, “এদের মন্তব্য খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। ভাষা আন্দোলন করেছেন এদেশের মুসলিম সন্তানরা। জীবনও দিয়েছেন তাঁরা। ফলে ইসলামী পরিভাষার শব্দ দিয়েই ‘শহীদ মিনার নামকরণ করা হয়ছে।’ অধ্যাপক আবদুল গফুর বলেন, যারা জানাযার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পান তারা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এদের মনে রাখা উচিত বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও ইসলাম অবিচ্ছেদ্য। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ওয়াহিদুল হককে নিয়ে শহীদ মিনারে যা হয়েছে তাতে তো আমরা কেউ কিছু বলিনি। তারা কেন জানাযা নিয়ে আপত্তি করেন। সত্যিকার অর্থে তাদের মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু আমার দেশকে বলেন, “আমি বুঝতে পারছি না জানাযা কীভাবে শহীদ মিনারকে অপবিত্র করল বরং এটা তো একটা পবিত্র অনুষ্ঠান। এটা তো আমাদের ধর্মের বিধি। ধর্মের বিধি পালন করতে গেলে কীভাবে অপবিত্র হয় শহীদ মিনার।’ তিনি বলেন, ‘যারা এটাকে ষড়যন্ত্র বলছেন তারা নিজেরাই ষড়যন্ত্রকারী। আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে তারা কীভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে, অধর্মের পক্ষে কথা বলে যদি তারা ষড়যন্ত্রকারী না হয়।’ এই নামী ভাষাসৈনিক তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যারা শহীদ মিনারে জানাযা অনুষ্ঠানকে জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী বলেন, তারাই মূলত জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী।’ তিনি আক্ষেপের সুরে প্রশ্ন করেন, ‘আমরাও তো এ আন্দোলনে শহীদ হতে পারতাম। আমরা গাজী হয়ে বেচে আছি কি এরকম বক্তব্য শোনার জন্য?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, ‘অলি আহানের জানাযা পড়ে শহীদ মিনারকে অপবিত্র নয় বরং পবিত্র করা হয়েছে। অলি আহাদ কখনও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি নন, তিনি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি বলেন এদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। অলি আহাদও ছিলেন মুসলিম। তার জানাযা হবে এটাই তো স্বাভাবিক। যারা একে জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী বলে উল্লেখ করছেন মূলত তারা বাজে কথা বলেছেন। এটা অগ্রহণযোগ্য।

সাবেক সচিব, বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলা আমার দেশকে বলেন, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে মহান নেতা অলি আহাদের লাশ শহীদ মিনারে নেয়া হয়েছে এবং সেখানে তার জানাযা হয়েছে। এতে কোনো কিছুরই অপবিত্রতা হয়নি বরং আমার মনে হয় ওই অঙ্গন পবিত্র হয়েছে।’ তিনি বলেন, দেশের ৯০ ভাগ মানুষের মূল্যবোধের প্রতি যাদের কোনো শ্রদ্ধা-সম্মান নেই, তাদের সম্পর্কে আমি আর কী বলব। তাদের বক্তব্যই তাদের জন্য যথেষ্ট। তারা যে গণবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি চর্চা করেন এটা তারই নজার।

দৈনিক আমার দেশ, ২২ অক্টোবর, ২০১২

সাম্প্রদায়িকতার আওয়ামী ছোবল

ক্ষমতাসীনদের সর্বাত্মক চেষ্টা ও প্রচারণা সত্ত্বেও রামু, উখিয়া, পটিয়া ও টেকনাফসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত সহিংসতার দায়ভার বিএনপিসহ দেশপ্রেমিক শক্তির ওপর চাপানো সম্ভব হয়নি। সাম্প্রদায়িকতার ছোবল এলে কারা মেরেছিল সে কথা যেমন জানাজানি হয়েছে তেমনি জান| গেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে প্রশংসিত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়াই ছিল অন্তরালে সক্রিয় বিশেষ গোষ্ঠীর প্রকৃত উদ্দেশ্য। জনগণের প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে পিছিয়ে গেলেও একই গোষ্ঠী যে থেমে নেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে অন্য কিছু ঘটনায়। উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রথমে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রধান নায়ক ও দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা অলি আহাদের প্রতি দেখানো অসম্মানের কথা উল্লেখ করতেই হবে। গত ২০ অক্টোবর এই নেতা ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পাকিস্তান যুগের প্রাথমিক দিনগুলো থেকে জীবনের শেষ পর্যন্তও তিনি এ দেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গেছেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন এবং ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্মানজনক অবস্থানে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন। মন্ত্রিত কিংবা রাজনৈতিক কোনো সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চিন্তা পত্তি করেন নি কখনো। তিনি বরং শিখিয়ে গেছেন, ক্ষমতায় না গিয়েও কীভাবে দেশ ও জাতির স্বার্থে। ভূমিকা পালন করা যায়। অমন একজন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতাকে নিয়ে কিন্তু বাংলাদেশের প্রগতিশীল টিভি চ্যানেলগুলোকে সামান্য উচ্চবাচ্য করতেও দেখা যায়নি। কোনো কোনো চ্যানেলে ‘জাতীয় খবর হিসেবে প্রচার করা হলেও খবরটি এসেছিল পাঁচ থেকে আট-দশ নম্বরের দিকে। ক্ষমতাসীনদের কেউই হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যান নি, তার জানাযায়ও কোনো মন্ত্রী গিয়ে অংশ নেননি। এমনকি শোক প্রকাশ করেন নি ক্ষমতাসীনরা।

বলা বাহুল্য, সবকিছুর পেছনে একটি মাত্র কারণই ছিল—মরহুম অলি আহাদ আওয়ামী লীগ করতেন না। তার দেশপ্রেমিক ভূমিকা বরং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের অঘোষিত আইন হল, কাউকে সম্মান পেতে হলে আওয়ামী লীগ তো করতেই হবে, বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতাকে নিয়েও মাতামাতি না করলে চলবে না। কথা শুধু এটুকু হলেও হয়তো আপত্তি উঠত না। অন্যদিকে সরকারের সেবাদাস ও আওয়ামী চাটুকাররা। সৌজন্যের সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করেছেন। যেমন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অলি আহাদের প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেছেন, এর ফলে ‘অসাম্প্রদায়িক মিলনস্থল শহীদ মিনারের পবিত্রতা নাকি নষ্ট হয়েছে এবং এভাবে জানাযা পড়ানো নাকি ‘জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী’! সরকারের আরেক সেবাদাস নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, শহীদ মিনারে জানাযার আয়োজনের মধ্য দিয়ে নাকি ‘সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে! কথাগুলোকে অবশ্যই হালকাভাবে নেয়া যায় না। কারণ, একদিকে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর আর অন্যদিকে বলেছেন এদেশের সাংস্কৃতিক জগতের আওয়ামী “দিকপাল’ (!)। তিনিও এসেছেন “জাতীয় মূল্যবোধ’ এবং ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ সম্পর্কে জনগণকে ওয়ান দিতে! পাঠকরা বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। কারণ, মহান যে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই শহীদ মিনার, মরহুম অলি আহাদ ছিলেন সে আন্দোলনের প্রধান নেতা। বাচ্চু এবং আরেফিন সিদ্দিকদের ‘পূজনীয় নেতার মত ফরিদপুরের জেলখানায় বসে তিনি ‘চিরকুট’ পাঠিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অসত্য দাবি জানিয়ে বসেননি। সুতরাং শহীদ মিনারে ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানাযা অনুষ্ঠানের মধ্যে দোষের কিছু থাকতে পারে না। তথাকথিত “পবিত্রতা’ এবং জাতীয় মূল্যবোধের’ কথাও অচল হয়ে পড়ে। কারণ, একমাত্র শহীদ দিবস তথা একুশে ফেব্রুয়ারির উপলক্ষ ছাড়া ড্রাগ ও মদ ইত্যাদি খাওয়া। থেকে রাতের অন্ধকারে এটা-ওটা করা পর্যন্ত সারা বছর ধরে শহীদ মিনারে যা কিছু চলছে সে সবের কোনটি আরেফিন ও বাচ্চু সাহেবদের কথিত ‘পবিত্রতা এবং জাতীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এ ব্যাপারে সচিত্র বিভিন্ন তথ্য হাজির করা হলে কিন্তু তাদের লা-জবাব হতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হল, ওনারা কবির চৌধুরীর মত ঘোষিত নাস্তিককে নিয়ে শহীদ মিনারে শুইয়ে রাখলে দোষ হবে না। কিন্তু অলি আহাদের মত ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানাযা পড়ানো হলে সেটাই ‘মহা অপরাধ হয়ে যাবে!

নিবন্ধের শুরুতেই কেন এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হচ্ছে, তার কারণ জানতে হলে অন্য কিছু তথ্যও স্মরণ করতে হবে। এরকম প্রথম তথ্যটি হল, জাতীয় নেতা অলি আহাদের ইন্তেকালের দু’দিন পর ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় মারা গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা ভাষার নামকরা সাহিত্যিক ছিলেন তিনি। সুতরাং তার মৃত্যু জানানোর মত একটি খবর ছিল বটে কিন্তু সে খবরটকে নিয়েও সীমা ছাড়ানো বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। ২৩ অক্টোবর সকাল থেকে সব টিভি চ্যানেলেই বারবার দেখানো হচ্ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর। দেশপ্রেমিকদের ধাক্কা খেতে হয়েছে বিশেষ কারণে। প্রায় সব চ্যানেলেই খবরটি দেখানো হচিছল জাতীয় খবর হিসেবে। অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশের লোক ছিলেন না। ছিলেন ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক। সে কারণে তার মৃত্যু অবশ্যই জাতীয় খবর হিসেবে প্রচারিত হতে পারে না। সেটাই করে ছেড়েছে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো। এমনকি সরকার সমর্থক নয় এবং ইসলামী ধারার বলে নিজেদের যারা জাহির করে তারাও। সেটা তারা করতেই পারে, কিন্তু আপত্তির কারণ হল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে পবিত্র হজের খবরকেও কোনো কোনো টিভি চ্যানেল কম গুরুত্বপূর্ণ করে ছেড়েছে। ঘটনাক্রমে হজের দিনটিতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়েছে কলকাতার ক্যাওড়াতলা শ্মশানঘাটে। দু’একটি টিভি চ্যানেলে আগুনে লাশ পোড়ানোর সে দৃশ্যকেও দেখিয়ে ছেড়েছে। একেই সম্ভবত ‘অতি ভক্তি’ বলা হয়! শুধু এটুকু জানানোর জন্যই এত কথা বলা হচ্ছে না। আর কিছু কারণও রয়েছে। পাঠকরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, এবার হিন্দুদের দুর্গাপূজাও পড়েছিল পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাক্কালে। কয়েকদিন ধরে চলা এই পূজার নানা আনুষ্ঠানিকতা দেখানোর ব্যাপারেও আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো‘অতি ভক্তিই দেখিয়েছে। বাড়াবাড়ি করেছে। ২৩ অক্টোবর হিন্দুদের উদযাপিত নবমীর কথাই বলা যাক। ওই রাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটে গেছেন রাজধানীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপে। সঙ্গে গেছেন অন্য মন্ত্রী-উপদেষ্টারাও। এদের মধ্যে বিমান। ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের কথা উল্লেখ করতে হবে এ জন্য যে, তিনি যখন। পূজা মণ্ডপগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখনও প্রতারিত শতাধিক হজযাত্রী সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য পাগলের মত ছোটাছুটি করছিলেন। মন্ত্রী হিসেবে ফারুক খানের তখন প্রধান দায়িত্ব ছিল ওই হজযাত্রীদের পাঠানোর জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু মন্ত্রী গিয়েছিলেন হিন্দুদের মা দুর্গাকে দর্শন করতে। এতটাই ভক্তি ছিল তার!

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জরই শুনিয়েছেন। ভক্তির আতিশয্যে তিনি বলে বসেছেন, ‘দেবী দুর্গা’ এবার ফিরে যাবেন নৌকায় চড়ে। ফলে দেশ ফসলে ভরে যাবে—অর্থাৎ ফসল হবে এবার! খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু হিন্দুদের’ কিংবা হিন্দুদের উদ্দেশে বলার সময় আপনাদের দেবী দুর্গা’ বলেননি। দেবী দুর্গা’ কথাটা এমনভাবে বলেছেন যা শুনে মনে হবে যেন হিন্দুদের দেবী দুর্গা শেখ হাসিনারও ‘দেবী’! কথা শুধু এটুকুই নয়। ‘দেবী। দুর্গা’ নৌকায় চড়ে বিদায় নিলেই দেশ ফসলে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে এমন কথা প্রধানমন্ত্রীকে কে বলেছে? নৌকার সঙ্গে ফসলের সম্পর্কটাই বা কোথায়? আর ‘দেবী দুর্গা’র মতিও তো দেশে একটি মাত্র বানানো হয়নি, হয়েছিল হাজার হাজার। এসব মূর্তির মধ্যকার কোনটি কোন নদী বা খাল দিয়ে কোন্ অচিন দেশে পাড়ি জমাবে তা-ই বা জানা রয়েছে কার? দেবী দুর্গা’র ঠিকানাই বা কোথায়? প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রশ্নের ধারে কাছে যান। নি। তিনি সোজা বলে বসেছেন, দেবী দুর্গা নৌকায় চড়ে যাবেন বলেই দেশ। ফসলে ভরে যাবে। লক্ষণীয় যে, প্রধানমন্ত্রী শুধু নিজেদের দলীয় মার্কা নৌকার ব্যাপারেই জোর দিয়েছেন। ভেবে দেখেননি যে, দেশ সত্যিই যদি ফসলে ভরে ওঠে এবং সে ফসল যদি সত্যিই নৌকায় করে আনতে হয় তাহলে তো সব নৌকা বিএনপির ধানের শীষেই ভরে যাবে! তখন আর নৌকার গুরুত্ব থাকে কোথায়? গুরুত্ব তো পাবে ‘ধানের শীষ’ই!শেখ হাসিনার ‘দেবী দুর্গা’ কি তাহলে বিএনপির বিজয়বার্তাই দিয়ে গেছে?

এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উস্কানির দিকটি লক্ষ করা দরকার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা অলি আহাদের জানাযাকে ঘিরে অসভ্য প্রতিক্রিয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে দুর্গাপূজাকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকেও বিবেচনায় রাখা দরকার। সেই সঙ্গে রয়েছে অন্য একট ঘটনাও। পবিত্র ঈদুল আজহার ঠিক একদিন পর পালিত হয়েছে বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমা। এ উপলক্ষে একই শহীদ মিনারে জ্বালানো হয়েছে কয়েক হাজার মোমবাতি, সঙ্গে ছিল প্রদীপ। এগুলোকে হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতীক হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। এবার কিন্তু কোনো ‘বাচ্চু বা আরেফিন সিদ্দিককে শহীদ মিনারের পবিত্রতা নষ্টের বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার অভিযোগ করতে শোনা যায়নি। কথাগুলো বলার কারণ অবশ্যই কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নয়। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলেই ৯০ ভাগের বেশি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কেউ কখনও আপত্তি করেননি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানায় নিয়ে আপত্তি জানানোর এবং শোরগোল তোলার পর পর একই শহীদ মিনারে রীতিমত ঢাকঢােল পিটিয়ে প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসব করা হবে, সেখানে মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালানো হবে—এ কেমন ন্যায়বিচার? একেই কি আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা হিসেবে মাথায় তুলে নৃত্য করতে হবে? বলা দরকার, ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তুলে স্বাধীনতার পর থেকেই কিন্তু এমন অনেক কর্ম-অপকর্ম করা হয়েছে, যেগুলো পরোক্ষভাবে হলেও মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি হিসেবে কাজ করেছে। যেমন ঢাকা। ভার্সিটির ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নাম থেকে বেছে বেছে শুধু ‘মুসলিম’ শব্দটিকেই বাদ দিয়েছিল প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার। একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর ‘মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকেও বাদ দেয়া হয়েছিল ‘মুসলিম’ শব্দটিকেই। অথচ যে দেশটির সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এসব করা হয় সেই ভারতেই কিন্তু আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে যাদবপুর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ও! আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ পণ্ডিত নেতারা এটুকুও জানতেন না! এদিকে প্রমাণিত বিভিন্ন সত্যও কিন্তু আওয়ামী লীগকে অন্তত ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা বা স্বীকৃতি দেয় না। কারণ, প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, কথিত ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও পুরোদমেই চলছে। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি, ভাংচুর চালানো হচেচ্ছ তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে। বিগতু মাত্র কিছুদিনের মধ্যে দিনাজপুরে ৩৫টি সংখ্যালঘু পরিবারের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর এলাকা গোপালগঞ্জে চারটি মন্দিরে ভাংচুর চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। চট্টগ্রামে ১২টি মন্দির ভাংচুর করার পাশাপাশি বেশকিছু ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ আরও অনেক এলাকাতেই ‘সংখ্যালঘুরা’ হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের অসহায় শিকার। হচ্ছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে বলেই জাতীয় হিন্দু মহাজোট গভীর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু মহাজোটের নেতারা অভিযোগ করেছেন, সরকারের প্রত্যক্ষ মদদেই’ দেশব্যাপী ‘সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের এই অভিযোগ শুধু কঠিন সত্য ও গুরুতর নয়, যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ও। কথিত সংখ্যালঘুদের ওপর আসলেও আওয়ামী লীগের লোকজন সর্বাত্মক নির্যাতন চালাচেছ। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকাবাহী এ দলটি সব সময়ই সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসেছে, বিশেষ করে যখন ক্ষমতায় থেকেছে তখন তো বটেই। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, পাকিস্তান যুগে নয়, ‘সংখ্যালঘুদের বিপদ বেড়েছিল স্বাধীনতার পর। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারই সর্বতোভাবে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দিয়েছিল। ওই সরকারের সময় রাতের অন্ধকারে রমনার কালী মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সে সময় শোনা গেছে, হুকুম নাকি এসেছিল ধানমন্ডির বিখ্যাত একটি সড়কে বসবাসকারী আরও বিখ্যাত কোনো একজনের কাছ থেকে। কিন্তু দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, তাদের এমনকি চিহ্নিত করার চেষ্টাও চালায়নি সরকার। এটা একটা ঘটনা মাত্র। ওদিকে দেশ জুড়ে সে সময় অর্পিত সম্পত্তি দখলের মহাধুম পড়ে গিয়েছিল। এসব সম্পত্তি ছিল হিন্দুদের। পাকিস্তান আমলে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিতগুলোতো বটেই, যুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে আসা হিন্দুদের সম্পত্তিও দখল করেছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের সেই কর্মকাণ্ড বর্তমান সরকারের আমলেও অপ্রতিহতভাবেই চলছে। কোনো সংখ্যালঘু’ এমনকি প্রতিকার বা ন্যায়বিচার চাওয়ার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারছেন না। ফলে দুর্নাম বাড়ছে বাংলাদেশের।

ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, শুধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা জুড়ে দিলেই সাম্প্রদায়িক কোনো দল ও দেশ দলের সরকার রাতারাতি ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায় না। ওদিকে যে দেশটিকে খুশি করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার কার্ড” ব্যবহার করা হচ্ছে সে ভারতেও মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের ওপর চলছে নিষ্ঠুর নির্যাতন। তাদের শরীরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারার রেকর্ডও ভারতেই তৈরি হয়েছে! অমন কোনোরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশীদের জীবন উল্টো বিপন্নই হয়ে পড়বে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই সারাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অনুধাবন করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। হিন্দু মহাজোটের নেতারা বলেছেন বলে শুধু নয়, ঘটনাপ্রবাহেও বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার এবং দিল্লির আশীর্বাদ নিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার পুরনো কার্ডটিকে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। বলা বাহুল্য, ক্ষমতাসীনদের ভয়ঙ্কর এ খেলাকে প্রতিহত না করা গেলে দেশের সর্বনাশ ঘটবে। এমনকি স্বাধীনতা ও বিপন্ন হতে পারে। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, জনপ্রিয়। তা একেবারে শূন্যের কাছাকাছি এসে পড়ায় এবং আবারও ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন হোঁচট খাওয়ায় ক্ষমতাসীনরা দিশা তো হারিয়েছেনই, ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছেন। এ জন্যই তারা সাম্প্রদায়িকতার ‘কার্ড খেলে একদিকে ভারতকে খুশি করতে চাচ্ছেন, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের বোঝাতে চাচ্ছেন, আওয়ামী লীগই তাদের রক্ষা করতে পারে। অতি শঠতাপূর্ণ এই কৌশল অবশ্য ধরা পড়ে গেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা যে বুঝতে পেরেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে হিন্দু মহাজোটের বক্তব্যে। সে কারণে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ক্ষমতাসীনরাও বাংলাদেশের জন্য পূর্বদিকে অবস্থিত সব রাষ্ট্রের দরজা বন্ধ করার ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিয়েছেন, বাংলাদেশকে যাতে ভারতের অধীনস্থ অবস্থায় থাকতে হয়। আমরা অবশ্য মনে করি না যে, ক্ষমতাসীনদের চাওয়াটাই যথেষ্ট সব হতে পারে।

৪ নভেম্বর ২০১২, আমার দেশ

***