উৎসর্গ

                সারা বিশ্বের অন্যতম ক্ষণজন্মা পুরুষ কায়েদ-ই-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ও সূচনা হতে ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল, হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী, সাম্প্রদায়িক কমরেড জ্যোতি বসু এবং তাদেরই অনুসারী পাঠান কোটের মওলানা মওদুদী, দেওবন্দের মওলানা হোসেন আহমদ মাদানী, কংগ্রেস শো-বয় মওলানা আবুল কালাম আজাদ, খাকছার নেতা আল্লামা মাশরেকি প্রমুখদের তদানিন্তন বঙ্গদেশে ২৮টি জেলার মধ্যে ১৬টি মুসলিম প্রধান জেলাকে বাদ দিয়ে বাকি ১২টি হিন্দু জনসংখ্যা প্রধান জেলাকে আলাদা করে হিন্দুবঙ্গ প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠায় কায়েদ-ই-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্’র সমর্থনে বঙ্গীয় গভর্নর ফ্রেডারিক বারুজ (Frederick Burrows) এর সক্রিয় সহযোগিতায় আজাদ হিন্দ নেতা সুভাষ চন্দ্র বোস-এর অগ্রজ শরৎ চন্দ্র বোস, বঙ্গীয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গীয় লেজিস লেটিভ এসেমব্লীতে কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা বাবু কিরণ শংকর রায়, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি দার্শনিক আবুল হাসেম, বঙ্গীয় সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান গণ পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের সভাপতি বাবু যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিরা Free State of Bengale অর্থাৎ অখণ্ড সার্বভৌম বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং বঙ্গীয় গভর্নর এর কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স-এর কয়েক বারের মন্ত্রী, ইন্ডিয়ান কাউন্সিলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলেন সেই নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যিনি স্বীয় জমিদারী বন্ধক রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সিংহ ভাগ অর্থ যোগান। আমার বইয়ের এই “চতুর্থ সংস্করণ” তাদের নামে উৎসর্গ করলাম।

১ম ছবি #

মুজিবনগরে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার। বা দিক থেকে-ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ এম কামরুজ্জামান এবং পিছনে প্রধান সেনাপতি জে. ওসমানী (১৯৭১)।

২য় ছবি #

ডাকসু ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা বা থেকে আবদুল কদ্দুস মাখন, আ.স.ম. আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী স্বাধীন বাংলার অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করছেন। (১৯৭১)।

জাতীয় রাজনীতি

১৯৪৫ থেকে ৭৫

প্রকাশকের কথা

                জনাব অলি আহাদ প্রণীত “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫” কোন ইতিহাস গ্রন্থ বা ঐতিহাসিক দলিল নয়। লেখক নিজেও তা দাবি করেননি। তবুও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সমকালীন রাজনৈতিক গ্রন্থাবলীর ক্ষেত্রে এটাই বোধ হয় সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্য নির্ভর প্রয়াস।

                নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাস কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে সমকালীন ইতিহাস রচনার প্রবণতা সাম্প্রতিককালে অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। বিকৃতির সীমাহীন প্রতিযোগিতায় সত্য হারিয়ে যাচ্ছে। এখন সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্য নিরূপন করা খুবই কষ্টকর। এমনি একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে দু’টি বিপরীতধর্মী তথ্যেও মোকাবেলায় যারা অন্ততঃ অলি আহাদ সাহেবকে ব্যক্তিগতভাবে জানেন, তারা তাঁর পরিবেশিত তথ্যটি বিশ্বাস করবেন বলেই আমাদের ধারনা।

                জনাব অলি আহাদ প্রণীত “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫” সমকালীন ঘটনার উপর রচিত একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ।

                আমরা জানি জনাব অলি আহাদের স্মৃতিতে বিগত ৪০ বছরের (১৯৭৫) রাজনৈতিক ঘটনার বহু তথ্য সঞ্চিত আছে। বয়সের ভারে নুব্জ স্মৃতি বিভ্রাট হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবুও জনাব অলি আহাদের ন্যায় সত্যনিষ্ঠদের কলম একটু সচল হলে আজ যারা বড় গলায় তথ্য বিকৃতির অসৎ পেশায় সোচ্চার তারা নির্বাক না হলেও তাদের নিঃশঙ্কচিত্তে মিথ্যা রচনার গতিধারা কিছুটা স্তিমিত হবে। আমাদের ইতিহাস বিকৃতির অভিশাপ হতে কিছুটা নিষ্কৃতি পাবে। বিশেষ করে একজন প্রবীন রাজনীতিবিদদের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা পুস্তকটি সাধারণ পাঠক সমাজের নিকটও বিশেষভাবে সমাদৃত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

                রাজনৈতিক অঙ্গনের মহীরূহ, ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার জনাব অলি আহাদ দেশ ও জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এই নির্মোহ ও নির্লোভ রাজনীতিবিদ পদ পদবী ও বৈষয়িক প্রাপ্তির জন্য কখনো কক্ষ্য ও লক্ষ্যচ্যুত হয়ে নিজ আদর্শ, বিশ্বাস এবং নীতি বিসর্জন দেননি। শত বাধা বিপত্তি সত্বেও তাঁর নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাসে রয়েছেন অটল। অন্য রাজনৈতিক নেতাদের মতো যখন যেমন তখন তেমন হতে পারেননি বলেই তাঁর ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। এমনকি তাঁর রাজনৈতিক সততার খেসারত নিজ আত্মীয়-পরিজনদেরকেও দিতে হয়েছে।

আমাদের দেশে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, “ঝড়-বানে বৃষ্টি, দোষে গুণে সৃষ্টি।” এই প্রবাদটির নির্গলিতার্থ হলোঃ কেউই দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। মানুষ মাত্রেরই ভুল-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। আমাদের বর্তমান ও অতীতের অনেক স্বনামধন্য জাতীয় নেতাদেরও ভুল-ত্রুটি ছিলো। আমাদের জাতীয় জীবনে এই ভুল ত্রুটি সংশোধনের প্রয়াসে আগামী দিনে পথ চলার সুগম করতে তিনি বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি এবং গ্রন্থে যেমন নেতাদের ভুলত্রুটি তুলে ধরেছেন, ঠিক তেমনি তাঁদের প্রশংসনীয় কাজকেও সমান গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন।

                ইতিহাসে যাঁর যা পাওনা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সততা ও সাহসের সাথে দিতে তিনি কোন কার্পন্য করেননি বা হীনমন্যতায় ভোগেননি। এঁদের মধ্যে কায়েদ-ই-আযম থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাই রয়েছেন। কায়েদ-ই-আযমের সমালোচনা যেমন করেছেন, ঠিক তেমনি তাঁর যথার্থ অবদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে সম্মান জানিয়েছেন। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু’র যেমন তীব্র সমালোচনা করেছেন, ঠিক তেমনি ‘মুজিব ভাই’ বলে সম্বোধন করে তাঁর গুণকীর্তন ও প্রশংসনীয় অবদানকে যথার্থ ভাবে জাতির কাছে তুলে ধরতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এ জন্যে অনেকের কাছেই তিনি বিরাগভাজন, অপ্রিয়।

                সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে নেই। ইতিহাস হলো একটি জাতির দর্পন। ইতিহাস অসচেতন জাতি কোন দিন প্রকৃত দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হতে পারে না। আজকের বর্তমান দুর্বিষহ বিষাক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ হলো ইতিহাস বিকৃতির নির্যাস।

                রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং লেখকদের পড়ার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমানে তাঁদের মধ্যে অনেকের মাঝেই এই সংস্কৃতি বিতাড়িত। এছাড়া অধিকাংশ রাজনীতিবিদ-এর লেখালেখির অভ্যেস নেই। ফলে রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের প্রকৃত পশ্চাদপট এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না। খবরের কাগজে প্রচার মাধ্যমে যেটুকু পাওয়া যায় তাও মূল ঘটনার পার্শ্বচিত্র মাত্র। এর অন্তরালে চাপা পড়ে থাকে বিচিত্র তাৎপর্যপূর্ণ অনেক প্রেক্ষাপট।

                এই প্রেক্ষাপট বা অব্যক্ত কথাগুলো বাদ দিয়ে কোন ঘটনারই অর্থপূর্ণ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। অথচ ইতিহাসবেত্তাগণকে এ কাজটি করতে হচ্ছে। এসব ইতিহাসবেত্তাগণ নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টি থেকে ইতিহাস রচনার কারণে আমাদের জাতীয় তথা রাজনৈতিক ইতিহাস অসম্পূর্ণ অথবা বিকৃত হয়ে আছে।

                অধিকাংশ জাতীয় ঘটনার প্রকৃত তথ্য থেকে জাতি অজ্ঞাত। এর ফলে যে যার মতো করে ঘটনা সাজিয়ে জাতিকে করে বিভ্রান্ত। সৃষ্টি হয় একে অপরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস। এই সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকে সৃষ্টি হয় মতানৈক্য, সংঘাত-সংঘর্ষ এবং অশান্তি। যা আমরা সমকালীন রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ করছি।

                আনন্দের কথা এই যে, যে কয়জন রাজনীতিবিদ ব্যতিক্রমধর্মী ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ রচনায় হাত দিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ জনাব অলি আহাদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সুক্ষ্মদৃষ্টি এবং বিশ্লেষণধর্মী উদার মন নিয়ে তিনি বিভিন্ন ঘটনাবলী তথ্য ও তত্ত্বের সমাহার ও দূর্লভ ছবি সংযোজনের মাধ্যমে চিত্রিত বা গ্রথিত করেছেন তাঁর লেখনীতে।

                “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫” এই গ্রন্থে ত্রিশ বছরের ঘটনাপঞ্জী স্থান পেয়েছে। বস্তুতপক্ষে এই সময়টুকু আমাদের জাতীয় জীবনের অনেক উত্থান-পতন, সংগ্রাম-আন্দোলন, বিপর্যয়-উত্তরণের ইহিতাস।

                জনাব অলি আহাদ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ১৯৪৫ সালে সমগ্র দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ এবং ১৯৪৮ সালে প্রথম কারাবরণ করেন। ১৯৫০ সালে বি. কম. পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেও আর এগুতে পারেননি। রাজনৈতিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন।

                এরপর থেকে গোটা জীবনটাই কেটে গেছে সক্রিয় রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে। বিস্ময়কর হলেও একথা সত্য যে, দীর্ঘ ৫৯ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কোনদিন ক্ষমতা বা ক্ষমতার মোহ তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। এ কারণেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন অনন্য সৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

                রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া যদি রাজনৈতিক জীবনের উদ্দেশ্য বা সাফল্যের মাপ কাঠি হয়, তাহলে জনাব অলি আহাদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে একটি ব্যর্থ চরিত্র।

                দীর্ঘ পাঁচ দশকের কর্ম-চাঞ্চল্য পরিপূর্ণ বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্রপূর্ণ তাঁর রাজনৈতিক জীবন। অত্যন্ত সমৃদ্ধ তার অভিজ্ঞতা। রাজনৈতিক অঙ্গনের হাজারো ঘটনা ঘটে গেছে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এসব কর্মকান্ডের সঙ্গে।

                গ্রন্থকার নিজের রাজনৈতিক জীবনের পরিপক্ক অভিজ্ঞতার আলোকে অতীত ও বর্তমান কালের রাজনৈতিক জীবনধারা, ঘটনাবলী স্পষ্ট ও পুষ্টভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন “জাতীয় রাজনীতি” পুস্তকে।

                বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ এর বহু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর্থিক অসচ্ছলতা তো আছেই। তবুও জাতীয় প্রয়োজনে কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি এ ধরনের একটি পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এই মূল্যবান বইটি প্রথম প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৮২ সালে। এরপর পাঠকদের বিপুল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে। পাঠকদের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হওয়া সত্ত্বেও অনিবার্য কারণবশতঃ তৃতীয় সংস্করণ আমরা প্রকাশ করতে পারিনি। তা প্রকাশ করে খোশরোজ কিতাব মহল লিমিটেড।

                সম্প্রতি দুর্ঘটনা জনিত কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে জনাব অলি আহাদ বিগত ২৩ সেপ্টেম্বর হতে ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আজীবন আপোষহীন সংগ্রামী এই বর্ষীয়ান জননেতার স্বাস্থ্যের অবনতিতে দেশবাসীর সাথে আমরাও উদ্বিগ্ন ছিলাম।

                জননেতা অলি আহাদ শুধু রাজনীতিবিদই নন, বেগম জিয়ার ভাষায় তিনি দেশ ও জাতির বিবেক, অভিভাবক। তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেকেই পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সরকারকে সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিদেশে পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন বিশেষ করে প্রবীন রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক অবদুল মতিন, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি বদরুদ্দীন উমর, ভাষা সৈনিক এডভোকেট গাজীউল হক, এম, আর, আখতার মুকুল, সাবেক সচিব, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি বাহাউদ্দিন চৌধুরী নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রদান করেন।

“আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, মহান ভাষা আন্দোলনের সিপাহশালার, স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, ৭ দলের প্রধান, আপোষহীন প্রবীন সক্রিয় রাজনীতিবিদ জননেতা অলি আহাদ দুর্ঘটনা জনিত কারণে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে বিগত ২৩শে সেপ্টেম্বর ’০৩ হতে ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ’০৩ তাঁহার দেহে অস্ত্রোপাচার করা সত্ত্বেও তার স্বাস্থ্যের তেমন উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আজীবন সংগ্রামী জাতির বিবেক, নির্লোভ এই বর্ষীয়ান জননেতার স্বাস্থ্যের অপরিবর্তীতে আমরা গভীর ভাবে উৎকণ্ঠিত।

জননেতা অলি আহাদ শুধু রাজনীতিবিদ নন, তিনি দেশ ও জাতির সম্পদ। তাঁহার সুচিকিৎসার জন্য সরকারি উদ্যোগে তড়িৎ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিদেশে পাঠানোর জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।

আমরা আরও লক্ষ্য করছি যে, প্রবীন জননেতা অলি আহাদের দেহে অস্ত্রোপাচার হওয়া সত্ত্বেও মানবিক দৃষ্টিকোন থেকেও এখনো পর্যন্ত দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ তাঁকে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নাই। এহেন মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গী রাজনৈতিক পরিবেশ বিকাশের পরিপন্থী।”

                ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার এবং প্রবীন রাজনীতিবিদ নিজকে নিঃস্ব করে দেশ ও জাতির খেদমত করেছেন। জাতির রাজনৈতিক সংকটময় মূহূর্তে সঠিক দিক নির্দেশনা এবং সংকট উত্তরনের জন্য প্রয়াস চালিয়েছেন। জাতি তাঁর কাছে ঋণী। কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধে আমরা কিছুই করতে পারিনি। এমনকি তাঁর এই জীবন সায়াহ্নে ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগটিও আমরা তাঁকে দিতে পারিনি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যা হোক আল্লাহপাক তাঁকে সুস্থ শরীরে আমাদের কাছে ফিরিয়ে এনেছেন এ জন্যে আল্লাহ পাকের দরবারে জানাই হাজারো শোকরিয়া।

                বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ সময়ের দাবি মেটাতে এবং এই সময়ের জনগণের কাছে যথেষ্ট উপযোগী হবে মনে করে উক্ত গ্রন্থটির ৫ম সংস্করণের আঞ্জাম দিয়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছে। সঠিক ইতিহাস রচনা এবং শ্রদ্ধেয় পাঠক মহলকে আমাদের জাতীয় ইতিহাস সম্পর্কে আংশিকভাবে সচেতন করে তুলতে পারলেও আমাদের শ্রম ও আয়োজন সফল বলে মনে করবো।

                আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

(এস. এম. রইসউদ্দিন)

পরিচালক (প্রকাশনা)

বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ

চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা

                আমি রাজনীতিবিদ। ব্যস্ত মানুষ। নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বইটিকে পূর্ণাঙ্গ করার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছি। সেই লক্ষ্যে আমার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বর্তমান সংস্করণেও বেশ কিছু তথ্য সংযোজন করেছি। একবারে সম্ভব নয় বিধায় ধাপে ধাপে সংযোজনের মধ্য দিয়েই বইটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা আমার অব্যাহত থাকবে। একথা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে, আমাদের জাতীয় জীবনে ইতিহাস বিকৃতির ডামাডোলে সত্য আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যা আর বিকৃত ইতিহাসই আজ জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। খলনায়ক নায়কে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ইতিহাস একটি রূঢ় বাস্তবতা। তাকে সাময়িকভাবে হয়তো বা এদিক সেদিক করা যায়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ইতিহাস তার স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হবেই। এর ব্যতিক্রম হয় না। যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে। আর তাই অসত্যের ডামাডোলে যতই ধামা চাপা দেয়া হোক না কেন সত্য তার স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করবেই। ইতিহাস তাই বলে। বইটির তৃতীয় সংস্করণের মতো বর্তমান সংস্করণেও আরো কিছু তথ্য ও ঘটনা সংযোজন করেছি। তৎমধ্যে বাংলাকে স্বাধীন ও অখণ্ড রাখতে তৎকালীন বাংলার গভর্নর স্যার ফেডারিক বরোজের প্রচেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভারত সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত ৭ দফা গোপন সমঝোতা চুক্তি এবং এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দিল্লীতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি ও জাতীয় সংসদের স্পীকার মরহুম জনাব হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিব, বেগম মুজিব ও মেজর জিয়া প্রসঙ্গ সংযোজন করেছি। বিশেষ করে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জাতীয় স্বার্থে শেখ মুজিব কর্তৃক গৃহীত কতিপয় ঐতিহাসিক কার্যক্রম, বেগম মুজিবের ত্যাগ-তিতিক্ষার কিছু বিবরণ এবং তৎকালীন মেজর জিয়া কর্তৃক ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের প্রেক্ষিত সম্পর্কে কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছি। বইটির তৃতীয় সংস্করণে মুদ্রণ প্রমাদজনিত এবং তথ্যগত কিছু ত্রুটি ছিল-এ সংস্করণে তা সংশোধন করা হয়েছে এবং স্থানে স্থানে প্রয়োজনে সংযোজন করা হয়েছে। এটা সর্বজন বিদিত যে, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার রাজনৈতিক আদর্শগত বিরোধ চরমে পৌঁছার কারণেই আমাকে আওয়ামী লীগ হতে বহিষ্কৃত হতে হয় অথবা অন্য ভাবে বললে বলা যায় দু’জনের মত এবং পথের চরম ভিন্নতার কারণেই এক সাথে রাজনীতি করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর নিকট তাঁর ‘আত্মসমর্পন’ এর কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বশরীরে নেতৃত্ব দিতে না পারলেও বাংগালীর স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবই একচ্ছত্র নেতা এটা মেনে নিতে কোন সংশয় বা দ্বিধা নাই। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান হিসেবে তার রাষ্ট্র পরিচালনার কার্যক্রমের সঙ্গে একমত ছিলাম না। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমের তীব্র বিরোধীতা করেছি তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন সংগ্রাম করেছি, কারাবরণ করেছি। এসব কিছুই রাজনৈতিক। রাজনৈতিক বিরোধীতাকে আমি কখনো ব্যাক্তিগত বিরোধিতায় পর্যবসিত করিনি। বিশেষ করে আমার বইয়ে যা উল্লেখ করেছি এবং যেভাবে উল্লেখ করেছি তা শুধু সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরার প্রয়াসে। সে সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোই তুলে ধরেছি এবং তা যে কারও বিরুদ্ধে কিংবা পক্ষে যেতে পারে। আমার কাছে রাজনীতিটাই বড়, দেশের স্বার্থটাই বড়। ব্যক্তি স্বার্থকে আমি কখনো বড় করে দেখিনি।

                স্বাধীনতার অভূদ্যয়ে জননন্দিত ও জনমানসে প্রতিষ্ঠিত একচ্ছত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে সরকারি সামরিক কর্মচারী মেজর জিয়াউর রহমানকে পাশাপাশি দাঁড় করাবার যে কোন প্রয়াস বা চিন্তাই গর্হিত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানের ২৭শে মার্চের ঘোষণাকে প্রতিঘাত করতে ২৬শে মার্চ শেখ মুজিব কর্তৃক চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে প্রচারের জন্য প্রেরিত বলে একটি বানোয়াট স্বাধীনতার ঘোষণার গল্প তৈরি করলো- পরবর্তীতে শেখ মুজিবও এটিকে মেনে নিয়ে ইতিহাসে একটি চরম মিথ্যা সংযোজন করলেন। রাজনীতিকে আমি সব সময় সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছি। আমার বইয়ে এরই প্রতিফলন ঘটিয়েছি। যা সত্য তাই তুলে ধরেছি। কার পক্ষে বা বিপক্ষে গেল তার ভ্রুক্ষেপ আমি করিনি।

                একারণেই দেখা যাবে যে রাজনৈতিক ভাবে যাদের আমি প্রচন্ড বিরোধীতা করেছি অনেক জায়গায় তাদের মন্দ কাজের সমালোচনার পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থে ভালো কাজের প্রশংসা করতেও কুণ্ঠা বোধ করিনি। শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তাঁর ব্যর্থতা যেমনি পর্বত প্রমাণ সফলতাও তেমনি আকাশ চুম্বি। পাকিস্তান আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানেও ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবের সাথে একযোগে কাজ করেছি। একসাথে সংগঠন করেছি, আন্দোলন করেছি, কারাবরণ করেছি। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে, আন্দোলন সংগঠনে মতবিরোধ হয়েছে, মতপার্থক্য হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়েছি আবার একাত্ম হয়েছি।

বলা হয় ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান- এটা সর্বৈধ মিথ্যা। ৪ঠা বাড়ি ১৯৪৮ সালে আমরা যখন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করি তখন তিনি ঢাকায় ছিলেন না, ছিলেন নিজ বাড়ি ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে। আমরা তাঁর অনুমতি না নিয়েই আহ্বায়ক কমিটিতে তাকে সদস্যভূক্ত করি। বিশ্বাস ছিল যে তিনি এতে দ্বিমত করবেন না। তিনি তো আমাদের নেতাও ছিলেন। পরে ঢাকায় এসে তিনি পূর্ণ উদ্যোমে নব প্রতিষ্ঠিত এই ছাত্র সংগঠনকে সংগঠিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ’৫২ সালের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার গাল-গল্প ডাহামিথ্যা। ’৫২ এর সেই উত্তাল সময়ে তিনি কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারির পর সরকার কর্তৃক ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে যখন দেশ উত্তপ্ত আমাদেরকে একে একে কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে সে সময় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন এবং গোপালগঞ্জে নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন। ঢাকা-নারায়নগঞ্জের রক্তঝরা উত্তাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে তিনি আসেন নাই। যদিও এটাই ছিল তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। প্রতিটি মুহূর্তে আমি তাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলাম। ১৯৬৭ সালে তিনি বাংগালীর মুক্তি সনদ নামে অভিহিত ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন এবং ৬ দফা আন্দোলন সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে ৬ দফা-১১ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে একছত্র বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে যান এদেশের একচ্ছত্র নেতা। ৬ দফার পক্ষে তিনি এতদঅঞ্চলের মানুষের ম্যান্ডেট লাভ করেন। তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রামই তাঁকে এই স্তরে উপনীত করেছিল। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংগালী জাতীয়তাবাদের চেতনার যে স্ফুরণ ঘটেছিল, বাংগালীর স্বাধীন সত্তার বিকাশের যে উদগ্রবাসনা জেগেছিল, ৬ দফা-১১ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আর সাধারণ নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয়-তার সফলতা এনে দেয়। জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণের সেই মহালগ্নের নেতা হিসাবে শেখ মুজিবকেই বরণ করে নেয়।

                পশ্চিমা উর্দুভাষী শাসক-শোষক গোষ্ঠী নিয়মতান্ত্রিক পথে নির্বাচনে বিজয়ী নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাংগালীকে স্তব্ধ করে দিতে ট্যাংক কামান আর বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে বাংগালীরা-পাক হায়েনা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হয়। পুরো মার্চ মাসই ছিল বাংগালী জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের মানসিক প্রস্তুতির মাস। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কর্তৃক স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন, ২রা মার্চ পাকিস্তানের পতাকার স্থলে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ স্বাধীনতা আন্দোলনের সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্যোদুল্যমানতার মধ্যেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো এতবড় একটি কাজে একমাত্র পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ছিল সুসংহত, সুগঠিত ও লক্ষ্যে স্থির দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু ২৫শে মার্চ ’৭১ এর কাল রাত্রিতে বাংগালীর এই একচ্ছত্র নেতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব পাক বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করে আজাদী সংগ্রামীদের বিপদে ফেলে দিলেন। এই পরিস্থিতিতে দেশবাসী না-তাঁকে ফেলতে পারে, না তাঁকে মূর্ত সেনাপতি হিসাবে গ্রহণ করতে পারে।

                কিন্তু তাঁর ৬ দফা আন্দোলনের উত্তাল-উন্মাদনায় জাতির মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন আর আকাংখা তীব্রভাবে জেগে উঠে এবং মনোজগৎ হয়ে উঠে দুর্জয় শক্তিতে বলীয়ান। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে operation search light এ পাক হায়েনাদের কামান বন্দুকের বিরুদ্ধে দেশবাসী কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী মরনপণ সংগ্রামে রক্ত নিতে রক্ত দিতে ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হলো মরনপণ মুক্তিযুদ্ধ। মুজিব মুক্তিযুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন কি ছিলেন না, আত্মসমর্পন করেছেন কি করেন নাই এ নিয়ে ’৭১ সালে কারো মনে কোন প্রশ্নই উঠে নাই। মুজিব জাতির মনে যে ‘স্বাধীনতার’ স্বপ্ন ও আকাঙ্খা জাগিয়ে দিয়েছিলেন মানুষের মনের সে দুর্জয় সাহস ও শক্তিই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়েছে।

                পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি শুনতে পান বাংলাদেশ হিন্দুস্থানী ফৌজের দখলে- এতে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন এবং অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। তাই করাচি হতে লন্ডন, লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে দিল্লীতে মুজিব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে জানতে চান ‘বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য কবে প্রত্যাহার করবেন?’ একই কথা তিনি কলকাতা সফরের সময় ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞেস করার পর তাৎক্ষণিকভাবে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সেনা প্রধানকে ডেকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমি ঢাকা যাওয়ার পূর্বেই যেন ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ হতে প্রত্যাহার করা হয়। এতেই প্রমাণ হয় মুজিব সত্যিই স্বাধীনতার রূপকার এবং প্রাণ পুরুষ ছিলেন।

                শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭১ সালের ৬ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সে ভাষণে তিনি বলেন- “….. The cry for independence of Bangladesh arose after the arrest of Sheik Mujib, not before. He (Mujib) himself, so far as I know has not asked for Independence even now…………..” এই ভাষণই প্রমাণ করে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোণা দেননি।

                এতদসত্বেও ১৬ই ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ বিজয় অর্জন পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্বটি তাকে ঘিরেই আবর্তিত ছিল। আর স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত দেশবাসীর তিনিই ছিলেন অনুপ্রেরণার মূর্ত প্রতীক। এর পাশাপাশি পরিস্থিতির পারিপার্শ্বিকতায় মেজর জিয়ার মতো মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, এমন কি আওয়ালী লীগ নেতা এম, এ, হান্নান প্রমুখ ব্যাক্তিগণও বিভিন্ন স্থান থেকে ইথারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাই বলে বিশেষ কোন এক মেজরের ঘোষণাকেই একক ঘোষণা ধরে নিয়ে সেই মেজরকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জাতীয় বীর আখ্যায়িত করার প্রশ্ন উঠে না শেখ মুজিব -শেখ মুজিবই। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতেই শত ভুল ভ্রান্তি সত্ত্বেও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শেখ মুজিবসহ আমরা অগণিত রাজনৈতিক কর্মীর কাফেলা সামরিক-বেসামরিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক দাবি দাওয়া আদায়ে অবিরত আন্দোলনে-সংগ্রামে জেল-জুলুম নিপীড়ন আর নির্যাতন সহ্য করে আত্মত্যাগের নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পাকিস্তানে উচ্চ পদস্থ সামরিক বেসামরিক চাকুরীর ব্যবস্থা করি। এই নিরবিচ্ছন্ন আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশবাসীর মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা দেয়। মনে রাখতে হবে এদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা, অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্তি আর পি.এস.পি, সি.এস.পি মেজর, কর্ণেল, মেজর জেনারেল আমাদের মতো ত্যাগী রাজনীতিকেরই সংগ্রামের ফল। তাদের অর্জন নয়।

                দুঃখের সাথে বলতে হয় অন্যের কৃতিত্ব নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া, অন্যের কৃতিত্বকে অস্বীকার করে একক কৃতিত্বের দাবীদার বনে যাওয়ার এই প্রবণতাও শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই। যেমন শেখ মুজিব ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে উপস্থিত না থাকলেও তাঁকেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা বলে চালিয়ে দেওয়া, ’৫২ এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ না করলেও তাঁকেই ভাষা আন্দোলনের নেতা বানানোর ঘৃণ্য কারসাজি- ’৭১ এর ২৫ শে মার্চ কালো রাত্রিতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতার কোন ঘোষণা না দেওয়া সত্বেও পরবর্তীতে ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে প্রচারের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণের বানোয়াট কাহিনী প্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং শেখ মুজিব নিজেও সেই মিথ্যাটাকেই সত্য বলে চালিয়ে ছিলেন। এমনি আরো অনেক ঘটনায় অপরের কৃতিত্বকে অস্বীকার করে নিজের কৃতিত্ব বলে জাহির করেছে।

                স্বাধীনতা অর্জনে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে হিন্দুস্থানের অবদান অতুলনীয়। সামরিক বেসামরিক, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিসেবী সকল মহলের সহায়তা ও অবদান চির স্মরণীয় এবং এই অবদানের কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। বিদুষী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জগৎ জোরা অবিরাম প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে বিশ হাজার ভারতীয় সৈন্যের রক্ত মুক্তি বাহিনীর রক্তের সঙ্গে বাংলার মাটি ও পানিতে একাকার হয়ে মিশে যায়। অবশ্য চীন ও আমেরিকা বাংলার আজাদী সংগ্রামকে ধ্বংস করতে সব ধরণের প্রয়াস চালায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়।

                আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে সপ্তম নৌবহর যুদ্ধংদেহী সংহারী মুর্ত্তিতে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান নেয়ার পায়তারা করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সপ্তম নৌবহরকে বাধা দানের হুমকি দিলে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত হয়। ১৯৭১ সালে ভারত-সোভিয়েত ১৫ সালা সামরিক সহযোগিতা চুক্তি এটাও বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেশ রক্ষা পলিসির ফল।

                অবিভক্ত ভারতের আসাম প্রদেশে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদ আলী এবং আসাম রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্যার সাদ উল্লাহ। দেশ বিভাগের সময় আসাম রাজ্যের অন্তর্গত সিলেট জেলায় গণভোট অনুষ্ঠানের সময় মওলানা মওদুদী, দেওবন্দি হোসেন আহমদ মাদানী, আবুল আলাম আজাদ গোষ্ঠীর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর একক প্রচেষ্টা এবং প্রভাবে সিলেটের জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দেয়ার ম্যান্ডেট দান করে। এই সাফল্য, কৃতিত্ব এবং অবদান এককভাবে মওলানা ভাসানীর।

                এই বিশাল ব্যক্তিত্ব যখন দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন তখন জনগণকে মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্বদানের মত একটি বিরাট শূন্যস্থান পূরণ হয়। মুসলিম লীগের স্বার্থপর, সুবিধাবাদী ও ঊর্দুভাষী শাসক শোষকদের তাবেদার দালাল শ্রেণির নেতৃস্থানীয়দের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদীরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী ভাসানীর যৌথ উদ্যোগে পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ১৯৫৪ সালে এই দলের সঙ্গে শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। এর পরেই ভীত সন্ত্রস্ত উর্দুভাষী শোষক-শাসক পশ্চিমা চক্র প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর ঐক্যে ফাটল ধরাবার প্রয়াস চালায়। ইতিমধ্যে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ প্রথম গণ পরিষদ ভেঙ্গে দেয় ও ’৫৬ সালে দ্বিতীয় গণপরিষদে পাকিস্তানের সংবিধান প্রনীত হয়।

                এই বিশাল ব্যক্তিত্বই আবার ১৯৫৭ সালে সদরি ইস্পাহানীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার করাচি যাওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং করাচির Beach Luxury-তে মিলিত হয়ে তাঁরা আলাপ আলোচনা করেন। এর কিছুকালের মধ্যেই পাকিস্তানের উভয় অংশে তখনকার সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী পদ হতে প্রেসিডেন্ট ইসকান্দর মীর্জা পদচ্যুত করেন।

                প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জা ১৯৫৮ সালের ৮ই অক্টোবর পাক পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে- সমগ্র দেশে সামরিক শাসন জারী করে জেনারেল আয়ুব খানকে Martial Law Administrator পদে নিয়োগ দেন। এর কিছু দিনের মধ্যে ২৭শে অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইসকান্দর মীর্জা জেনারেল আইয়ূব খানকে প্রধানমন্ত্রী ও জেনারেল মুসাকে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দেন। জেনারেল আয়ুব খান এই ঘোষণাকে ষড়যন্ত্রের আলামত মনে করে প্রেসিডেন্ট ইসকান্দর মীর্জাকে লন্ডনে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন এবং ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সারা পাকিস্তান ব্যাপী অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনও বাতিল করে দেন।

                জেনারেল আয়ূব শাসনকালে আয়ূবী শাসনের ক্রীড়নক হয়ে মওলানা ভাসানী আয়ূব খানের প্রতিনিধি হয়ে চীন ভ্রমনে গেলেন মাও সেতুং এর দর্শনার্থী হয়ে। ১৯৫৪ সালে গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জা ডান্ডা শাসনের আওয়াজ-উঠা সত্বেও কম্যুনিষ্টদের প্ররোচনায় কম্যুনিষ্ট আয়োজিত বার্লিন শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে চলে গেলেন। উত্তরকালে এতে করে তিনি কার্যতই জিহাদী জননেতা থেকে তথাকথিত প্রগতিশীল কর্মীদের নেতাতে পরিণত হলেন।

                ’৬৯ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে গণ অভূত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনে এক চেটিয়া গণরায় পেয়ে শেখ মুজিবের অভূতপূর্ব উত্থান ঘটে এবং মুজিবেরই রাজনৈতিক নেতা ও গুরু মওলানা ভাসানী হন জন-বিচ্ছিন্ন।

                ’৭৫ পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের ক্রীড়নক হয়ে ভাসানী তাঁর অবস্থানের শেষ চিহ্ন মুছে ফেলেন। তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ জিয়ার দলের দখলে চলে যায়- এমন কি তার দলীয় কর্মীরা জিয়ার দলে যোগ দিয়ে “জনগণের নয়ন মনি, মওলানা ভাসানী” শ্লোগান বদল করে জিয়াকে জনগণের নয়নমনি বানিয়ে ফেলেন।

                জিয়ার মার্শাল ল’ চলাকালে দেশব্যাপী অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন বাতিল দাবি করে মওলানা ভাসানী কলঙ্কের ডালি মাথায় নেন- মার্শাল ’ল এডমিনিষ্ট্রেটার এর বরকান্দাজ পদে অভিষিক্ত হয়ে ধন্য বোধ করলেন। আটপৌড়ে জীবন যাপনকারী ঝুপড়িবাসী সর্বতাগী সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রাসারনবাদের ত্রাস মওলানা হলেন বরকান্দাজ আর তাঁর অনুগামীরা হলেন দালাল-অর্থে বিত্তে তালুকদার।

                বানান বিভ্রাট পাঠককে পীড়া দেয়। এ জন্যে চতুর্থ সংস্করণে অনেক বানান বিভ্রাট ও মুদ্রণ প্রমাদ নিরসনে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে। তা সত্ত্বেও একেবারে নির্ভূল বই পাঠকদের হাতে পৌঁছে দিতে পারিনি। এ ছাড়া বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের স্মৃতি শক্তিও লোপ পায়। আমার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। এই গ্রন্থে বর্ণিত কিছু ঘটনা স্মৃতি নির্ভরতার কারণে তথ্যগত ভুল-ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নয়। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় এই গ্রন্থে (পৃঃ ১৫১) ভুলবশতঃ উল্লেখিত হয়েছে শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শহিদ মিনার নির্মাণের সঠিক তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি।

                এ ধরণের তথ্যগত ত্রুটি আমাকে জানালে তা কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদের সাথে গৃহীত হবে প্রয়াস নেয়া হবে ইনশায়াল্লাহ।

                তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশকালে কঠোর পরিশ্রম করেছেন রাজনৈতিক সহকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা মুন্সি আবদুল মজিদ ও আমার দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, বিশিষ্ট রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধকালে আমার পাশে ছায়ার মত ছিলেন যে জনাব এহসানুল হক সেলিম তাঁরা উভয়ই ৪র্থ সংস্করণ প্রকাশে তদ্রুপ ভূমিকাই পালন করেছেন। তাদের প্রতি রইল আমার অশেষ অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা কিন্তু ভাষার তুবরীতে তাঁদের ছোট করবার অধিকার আমার নেই।

                “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫” বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের মতো বর্তমানের এই চতুর্থ সংস্করণেও বিভিন্ন সময় নুতন তথ্য সংযোজন ও পরিবর্ধন হেতু ছাপার কাজে ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। কিন্তু প্রেস এতে বিরক্তি প্রকাশ না করে যে বিরল সহযোগিতা প্রদান করেছে এরই ফলশ্রুতিতে বইটি মুদ্রিত আকারে প্রকাশ হতে পেরেছে। এই ধরণের বিরল সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ এর সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী ভাইদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

                বিশেষ করে, এর সভাপতি জনাব আ.জ.ম. শামসুল আলম সাহেব যার আন্তরিক উদ্যোগে বইটি প্রকাশিত হলো, তাঁকে জানাই আমার অন্তরের উষ্ণ ভালোবাসা আর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।

(অলি আহাদ)

ফেব্রুয়ারি ২০০৪

তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা

                আমি সহজাত লেখক নই। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যাবার পর বিবেকের তাড়নায় ও সুধী পাঠকদের উৎসাহ আর তাগিদে বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশে আমাকে উদ্যোগী হতে হয়েছে। কিন্তু আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য উপযুক্ত প্রকাশনা সংস্থা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চরম হতাশা যখন আমাকে গ্রাস করছিল ঠিক তখনই মহান করুণাময় আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপায় বন্ধুবর আখ্তার-উল-আলম সাহেব আবির্ভূত হলেন। তাঁর একাগ্রতায় আর মহতি উদ্যোগে খোশরোজ কিতাব মহলের স্বত্বাধিকারী জনাব মহীউদ্দিন আহমদ সাহেব এগিয়ে এলেন। তিনি দায়িত্ব নিলেন বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের। দায়মুক্ত হলাম আমি। ফলশ্রুতিতে বইটি যথাসময়ে পাঠকের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। জনাব আখ্তার-উল-আলম আর জনাব মহীউদ্দিন আহমদ সাহেবের এই মহৎ অবদান আমাকে চির কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছে। আমি তাঁদের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম। তাঁদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। তাঁদের এই অবদান আমাদের সমসাময়িক কালের ইতিহাসে স্বর্ণ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। পরম করুণাময় আল্লাহ গাফুরুর রহীম তাঁদের সহায় হোন। আমি রাজনীতিক। ব্যস্ত মানুষ। নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বইটিকে পূর্ণাঙ্গ করার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছি। সেই লক্ষ্যে আমার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বর্তমান সংস্করণে বেশ কিছু তথ্য সংযোজন করা হলো এবং ভবিষ্যৎ সংস্করণেও আরো তথ্য সংযোজন করা হবে। একবারে সম্ভব নয় বিধায় ধাপে ধাপে বিভিন্ন তথ্য সংযোজনের মধ্য দিয়ে বইটিকে পূর্ণাঙ্গ করার ইচ্ছা আমার আছে। আমাদের জাতীয় জীবনে অসত্য আর বিকৃত ইতিহাসের ডামাডোলে সত্য ইতিহাস হারিয়ে যাবার যে প্রবণতা চলে আসছে, আমার এই বইখানির বর্ধিত ৩য় সংস্করণ অনুসন্ধিৎসু সত্যান্বেষী পাঠক সমাজকে অন্ততঃ কিছুটা হলেও তৃপ্তি দান করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রসঙ্গত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সাম্প্রতিকালের সৃষ্ট বিতর্ক যেমনি অনাকাঙ্খিত তেমনি অনভিপ্রেতও বটে। মনে রাখতে হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি। ১৯৪৭ সালে গান্ধী নেহেরু’র বঙ্গভঙ্গেও সর্বনাশা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বোস-সোহরায়ার্দীর স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। ’৫২-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জাতিসত্ত্বার ক্রমবিকাশের ধারায় বিভিন্ন গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীকারের আন্দোলনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি, নৃতাত্ত্বিক আত্ম পরিচয়ের স্ককীয় সত্ত্বার সন্ধানে ব্যাপৃত বৃহত্তর বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত শোষণ আর শাসনের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটে এবং এর চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকল মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকায় যার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে তিনি হচ্ছেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। প্রাসঙ্গিকভাবে বলতেই হয় যে, ’৬০-এর দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সৃষ্ট নিউক্লিয়াসে আমার কার্যক্রম আগামী দিনের ইতিহাসে অবশ্যই লিপিবদ্ধ হবে। ’৭১-এর জনতার স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্খাই নেতৃত্বকে পেছনে ফেলে অগ্রগামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জনতার সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র থেকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার ক্ষমতা তৎকালীন কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছিল না। আর তাই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম আপন পরিণতিতে ধাবিত হয়। ’৭১-এর ২৫শে মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ইয়াহিয়ার সাথে আপোষ আলোচনা এক পাকিস্তানের ভিত্তিতেই ছিল। ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য যতই স্বাধীকারের পটভূমিতে বিশ্লেষিত হোক না কেন তাও ‘জয় বাংলা’ আর ‘জয় পাকিস্তানে’র উচ্চকিত শ্লোগানে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আপোষ মিমাংসার ধুম্রজালে আবদ্ধ ছিল। ’৭১-এর ২৫শে মার্চের আলোচনা শেষে যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালি জনতার উপর সশস্ত্র আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে ভুট্টোসহ তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে করাচির পথে ধাবমান তখন রাত ৮-৩০ মিনিটে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের সাংবাদিকদের নিকট প্রদত্ত বক্তব্য ‘আলোচনা ফলপ্রসু হয়েছে আর মাত্র ঘোষণা বাকি’-এই বক্তব্যের তাৎপর্য আর যা-ই হোক রাত ১২টায় শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার কোন প্রেক্ষাপটের সাক্ষ্য বহন করে না। তবে যা বাস্তব তা হলো ২৬শে মার্চ প্রতুষ্যে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব এম এ হান্নান কর্তৃক চট্টগ্রাম বেতার হতে কম শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান, পরবর্তীতে ২৭শে মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়ার কণ্ঠে প্রথমে এককভাবে তার নামে, পরবর্তীতে সংশোধন করে শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা জনমনে সাহস, আস্থা ও স্বস্তি এনে দেয়। সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও সেই ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয় এবং নব উদ্যমে সংগঠিত হয়। এইপ্রসঙ্গে বলা অসঙ্গত হবে না সেই সময় অবস্থা এমন ছিল যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের মত এত বড় একটা সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করার জন্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের পরিকল্পিত ও সুসংহত দ্বিধা সংকোচহীন নেতৃত্ব ছাড়া কোন সুসংহত পরিকল্পনা কিংবা নেতৃত্বেও সমন্বয় ছিল না। সেই কারণেই বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থান হতে যেমন, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মনবাড়িয়া ও জয়দেবপুর হতে যথাক্রমে তৎকালীন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, খালেদ মোশাররফ ও শফিউল্লাহ কর্তৃকও স্বাধীনতার ঘোষণা আসে। পরিস্থিতির বাস্তবতায় তা-ই স্বাভাবিক ছিল। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এসব ঘোষণা স্বাধীনতা আন্দোলনের কোন মাইল ফলক ছিল না। ছিল স্বতঃস্ফূর্ততার বহিঃপ্রকাশ। তবে একথা সত্য যে, সে সময়ে শেখ মুজিবর রহমানের ইমেজ বা জনপ্রিয়তা কিংবদন্তীতুল্য ছিল। আর জনগণ তাঁর নামকে স্বাধীনতার সমার্থক অর্থে গ্রহণ করেছিল। সেই ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি স্বাধীনতা মন্ত্রের প্রতি জনতার বিশ্বাসে কোন ফাটল ধরাতে পারেনি বরং তাঁর ‘বিতর্কিত’ অনুপস্থিতি জনগণের মনে এক ধরনের সহানুভূতির জন্ম দিয়েছিল। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের সকল মহান সংগঠক ও যোদ্ধা সকলেই এই মহান কৃতিত্বের অংশীদার। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাইল ফলক ’৫২-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ২১শে ফেব্রুয়ারিসহ সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে ডঃ আনিসুজ্জামানের লেখা একটি নিবন্ধ এই সংস্করণে সন্নিবেশিত করেছি। এমন আরো কিছু ঘটনা ও তথ্য এই সংস্করণে সংযোজিত করেছি। তন্মধ্যে হীরেন মুখার্জীর ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টে পাক-ভারত স্বাধীনতার উপর একটি লেখা, প্রফেসর রেহমান সোবহানের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুই অর্থনীতির সম্ভাব্যতার উপর লেখা একটি সারগর্ভ নিবন্ধ, শেখ মুজিবুর রহমানের গোলটেবিল বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণ এবং অতিসম্প্রতি প্রদত্ত ভারতীয় বি.এস.এফ এর সাবেক পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদার এর একটি সাক্ষাকৎকার উল্লেখযোগ্য। একটাই উদ্দেশ্য যে ইতিহাস-সচেতন পাঠক সমাজকে অসত্য আর ইতিহাস বিকৃতির ভিড়ে কিছুটা হলেও সত্য ইতিহাসের স্বাদ আস্বাদন করানো। পাঠক সমাজ তৃপ্ত হলে আমার পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করবো।               

দ্বিতীয় সংস্করণের মুদ্রণ প্রমাদের কারণে যে সকল ভুল-ত্রুটি ছিল তা সংশোধন করতে প্রয়াস নিয়েছি।  

আমার সহকর্মী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মুনসী আবদুল মজিদ গতবারের মতো এবারেও বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশে আমাকে অব্যাহত চাপের মধ্যে রাখে এবং তার এই নিরলস প্রাণান্তকর পরিশ্রমের ফলে বইটির তৃতীয় সংস্করণ পাঠকের হাতে সময়মতো তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। বইটির ছাপানো ব্যাপারে সার্বিক তত্ত্বাবধানে অক্লান্ত প্রাণান্তকর পরিশ্রম দিয়ে Final Proof থেকে শুরু করে, অঙ্গসজ্জা ও বর্ধিত অংশের সম্পাদনা সুচারুরূপে সম্পন্ন করে বর্তমান এই সংস্করণটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশ করতে আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে আগাগোড়া আমার একান্ত সাথী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ট রাজনীতিক জনাব মোঃ এহসানুল হক সেলিম সহযোগিতা করে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। গত দুই সংস্করণ প্রকাশে যে স্বজনদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কর্মকান্ডে আমাকে দায়মুক্ত রেখেছিল তাদের উদাসীনতা ও অন্যমনস্কতা আমাকে যখন বিপর্যস্ত করেছিল সেই মুহূর্তে তিনি আবির্ভূত হলেন তার সাহায্য সহায়তার অকৃত্রিম সহমর্মিতা নিয়ে, আমি অভিভূত কৃতজ্ঞ। আল্লাহ গফুরুর রাহিম তাঁর কৃপা দৃষ্টিতে তাকালেন উৎরে গেলাম আমি। আমি অভিভূত, আমি কৃতজ্ঞ, তাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে ছোট করতে চাই না। শুধু হৃদয়ের উষ্ণ অনুভূতিতেই তা ধরে রাখতে চাই। সকলের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন।

অলি আহাদ

জানুয়ারি, ১৯৯৭

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

                আমি সহজাত লেখক নই- সুধী পাঠকদের উৎসাহ ও তাগিদ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশে প্রেরণা দিয়াছে। ঘটনাপঞ্জিকে যথাসাধ্য সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করিতে চেষ্টা করিয়াছি- ভবিষ্যৎ বংশধররা যেন অসত্য তথ্যের বেড়াজালে হারাইয়া না যায়। আমার অক্ষম ও অপারগ লেখনী অধুনাবিকৃত ও অসত্য ইতিহাস পরিবেশনার প্রতিবাদ মাত্র। প্রথম সংস্করণ হইতে দ্বিতীয় সংস্করণ বই প্রকাশ সপ্রমাণ করে যে, সত্যান্বেষী পাঠক সমাজ সত্য ভাষণই চায়- যতই তিক্ত হউক না কেন।

                সময়াভাব ও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দ্বিতীয় সংস্করণ বইকে সম্পূর্ণ পূর্ণাঙ্গ করা সম্ভব হয় নাই। সক্রিয় রাজনৈতিক ও সাংসারিক জীবনে সম্ভবও নহে- একমাত্র অখণ্ড অবসরকালেই করা সম্ভব। তবে ভবিষ্যৎ সংস্করণগুলিতে পূর্ণাঙ্গ করিবার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকিবে। প্রথম সংস্করণে মুদ্রণ প্রমাদের কারণে যে সকল ভুল ছিল তাহা সংশোধন করিতে প্রয়াস নিয়াছি। প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন করিয়াছি, প্রাসঙ্গিক কিছু কিছু তথ্য সংযোজন করিয়াছি-সহৃদয় পাঠক বন্ধুগণ আনন্দিত হইবেন বলিয়াই আমার বদ্ধমুল ধারণা। পরিশিষ্টে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ালী মুসলিম লীগ পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি মজলুম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সহ-সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ, রাজবন্দি ছমিরউদ্দিন আহমদ, প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক, আবদুল মতিন, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হারুনুর রশিদের চিঠি ও অন্যান্য কয়েকটি দরকারী দলিল এবং কায়েদে আযমের সমাবর্তন উৎসবে বক্তৃতা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান ও পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে দেওয়া স্মারকলিপি, অবৈধ সেনাপতি শাসক আইউব খানের বিরুদ্ধে ৯ নেতার বিবৃতি দেওয়া হইল। প্রারম্ভেই বই সম্পর্কে সমালোচনা ও মন্তব্য ছাপানো হইল।

                আমার সহকর্মী মুন্সি আবদুল মজিদ দ্বিতীয় সংস্করণ বই ছাপাবার ব্যবস্থার জন্য চাপ দিতেছিল। আমি অর্থাভাবে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও উৎকণ্ঠিত। এমনি দুর্ভাবনা মুহূর্তে মনে হইল ঐশ্বরিক শক্তি যেন হঠাৎ আমাকে চরম দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত মানসিক অবস্থা হইতে মুক্তি দিতে অবতীর্ণ। পরম করুণাময়ের নিকট আমি কৃতজ্ঞ।

                পরম স্নেহভাজন অধ্যাপক মোমিনুল হক চিন্তাশীল বিজ্ঞজন ব্যক্তি। অগাধ পান্ডিত্যের কারণে ও চতুর্মুখী প্রতিভাধর বিধায় তিনি আমার শ্রদ্ধেয়ও বটে। তাঁহার সহজাত মেধা আমার বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে বিভিন্ন দিক হইতে সম্ভাব্য পূর্ণাঙ্গ করিতে আমাকে সর্বোতভাবে সহায়তা করিয়াছে। প্রথম সংস্করণেও অধ্যাপক মোমিনুল হকের অবদান ছিল অতুলনীয় তখনও তাঁহাকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানাইয়া ছোট করিতে প্রবৃত্ত হই নাই। এইবারও দ্বিতীয় সংস্করণে তাঁহার অবদানকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানাইয়া ছোট করিব না। তবে আমি তাঁহার নিকট ঋণী-এই ঋণ আমার হৃদয় ঐশ্বর্য্যকে সতেজ হইতে প্রেরণা দিয়াছে।

                আমার অনুজসম রেজাউল হক সরোজ দ্বিতীয় সংস্করণ বই প্রকাশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রেরণা বিশেষ ছিলেন। আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ অভিশপ্ত সামাজিক পরিবেশে সৎ জীবনযাপন আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব প্রায়- নিঃসন্দেহে স্বল্পকতক নির্লোভ কায়ক্লেশে জীবনযাপনকারীদের তিনি অন্যতম। এমতাবস্থায় দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশে বিনাস্বার্থে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা বিরল চরিত্রের ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব এবং তিনি তাই করিয়াছেন। যেহেতু অনুজসম-তাই হৃদয় নিংড়ানো নিখাঁদ স্নেহই তাহার প্রাপ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Education Faculty DEAN ও B.C.S (Gen. Education) সমিতি প্রেসিডেন্ট প্রিন্সিপাল রাশিদা বেগম যেমনি কলেজ পরিচালনায় তেমনি স্নেহময়ী ‘মা’ হিসেবে সংসার ধর্ম পালনে সর্বক্ষণ ব্যস্ততার মধ্যেও বইটি পূর্ণাঙ্গ করিতে যত কষ্টকরই হউক তার অবদান রাখিতে কুণ্ঠাবোধ করে নাই।

                সর্বোপরি আমার সহকর্মী ও সহযাত্রী কষ্ট-সহিষ্ণু মুন্সি আবদুল মজিদ পূর্বাপর বই-এর প্রকাশনার পূর্ণ দায়িত্ব স্বেচ্ছায় স্বহস্তে বিনা পারিশ্রমিকে গ্রহণ করে। দ্বিতীয় সংস্করণ বইটির বিভিন্ন তথ্যেও খুঁটিনাটির সংশোধন ও সংযোজনের জন্য রাজনৈতিক জীবনের ডামাডোলের মধ্যে তথ্যাবলীর অন্বেষণে গন্ধমাধব পাহাড়ে হনুমানের ঔষধ আহরণে গমনসম-এক একটি তথ্যের জন্য ৪/৫ ঘণ্টা ব্যয় করিতে হইয়াছে-সক্রিয় মাঠ রাজনীতিবিদদের পক্ষে সম্ভব কখনও নয়- ইহাই আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা, তথাপি দিতে হইয়াছে মজিদেরই চরম আন্তরিকতা ও ধৈর্যের কারণে। বর্তমানে সার্বিক সামাজিক, নৈতিক অবক্ষয়ের দাবানল আপামর সামাজিক জীবনকে অবাধে ক্ষত-বিক্ষত করিয়া চলিয়াছে- আমার মত দরিদ্র নিঃসহায় ব্যক্তিত্ব বহু পূর্বেই হাল ছাড়িয়া দিয়া নিরাশার অতল গহবরে হারাইয়া যাইত-বই ছাপানোর কাজ সমাধার প্রশ্নই উঠে না। মজিদ শক্তহাতে হাল ধরিয়াছে- কান্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছে-বই মুদ্রণ কৃতিত্বের সহিত সমাধা করিয়াছে। ধৈর্য, নিঃস্বার্থপরতা, কর্তব্যপরায়নতা, দায়িত্বজ্ঞান, সহৃদয়তা ও স্নেহ, মায়া-মমতার আধার মজিদ ভবিষ্যৎ দুজ্ঞেয় যাত্রা পথে জ্বলন্ত মশাল।

                 আমি সক্রিয় রাজনৈতিক মাঠকর্মী তাই আমার বইটির ২য় সংস্করণে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য সংযোজনে যখন যাহা মনে পড়িয়াছে, অগোছালোভাবে তাহাই প্রেসে পাঠাইয়াছি। প্রেস তাহা গ্রহণ করায় বইটি মুদ্রিত আকারে বাহির হইতে পারিয়াছে। এই ধরনের বিরল সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ-এর সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী ভাইদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

অলি আহাদ

মার্চ ১৯৮৯

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

মুজিব সরকার ৩০শে জুন, ১৯৭৪ইং ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনে’ আমাকে গ্রেফতার করে এবং বিনাবিচারে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখে। ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর আমি মুক্তি পাই। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হইতে পরবর্তী আড়াই যুগে তৎকালীন জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হইয়া বহুবার কারাগারে বিনাবিচারে আটক ছিলাম। সত্য বলিতে কি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিস্কার, জেল-জুলুম, পুলিশী হয়রানি, গ্রামের বাড়িতে অন্তরীণ ও আত্মগোপন জীবন এ সবই যেন আমার ভাগ্যলিপি।

                ১৯৭৪ সালেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে গিয়াই কারাবরণ করিতে হইয়াছে। সে বৎসরের জুন মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ নং সেলে পদার্পণ করিতেই বিগত ২৬/২৭ বৎসরের বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের দৃশ্যাবলী আমার স্মৃতিপটে উদয় হইতেছিল। অতীতের যে অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনার সহিত আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম, তাহাই এখানে লিপিবদ্ধ করিবার প্রয়াস পাইয়াছি। লেখনীশক্তি আমার নাই; ভাষার উপর দখলও নাই; তথাপি এক অদ্ভূত উৎসাহ ও প্রেরণা, অদম্য আকাঙ্খা ইচ্ছাশক্তি যেন আমাকে এইসব ঘটনাপঞ্জী লিপিবদ্ধ করিতে বাধ্য করিয়াছে। সর্বোপরি FAO (U.N.O) কর্মরত আমার স্নেহাষ্পদ অনুজ মোহাম্মদ আমিরুজ্জামানের (C.S.P) তাগাদার পর তাগাদা ও চাপ ছিল আমার সকল প্রেরণার উৎসমুল। সে বুঝিতে চায় না যে, আমার কলম অত্যন্ত দুর্বল, সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা আমাকে তেমন কোন লেখনীশক্তি দেন নাই। কারাগারের নির্জন কক্ষে ছোট ভাইটির স্নেহসিক্ত কোমল মুখখানি মানসপটে উদিত হইলেই লিখিবার ইচ্ছা আমার সকল অপারগতা, অক্ষমতা ও দুর্বলতাকে ছাপাইয়া উঠিত। ছোট ভাইটির চাহিদাই জয়ী হইত। এই বইখানি তাহারই ফলশ্রুতি। (১৯৫৮ সালে আমিরুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিল। ১৯৫৮ সালেই উচ্চ শিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্র গমন করে এবং সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ও ১৯৫৯ সালে C.S.P একাডেমিক ট্রেনিং গ্রহণের জন্য পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করে)।

                আমি জানি, এই বইটিতে বর্ণিত সত্য ও প্রকৃত ঘটনাবিবরণী অনেকের বিরাগের কারণ হইবে। কিন্তু উপায় নাই। আমার সবিনয় নিবেদন, আমার প্রতি বিরূপ না হইয়া নিজ নিজ বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন; দেশ ও জাতির অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার জন্য ক্ষমতায় আরোহণকারী কিংবা ক্ষমতার বাহিরে অবস্থানকারী আপনারা দায়ী কিনা? কত ওয়াদা করিয়াছেন, কত ওয়াদা ভাঙ্গিয়াছেন? আমাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করিলে কি লর্ড ম্যাকলে বর্ণিত নিম্ন-গাঙ্গেয় এলাকার বাঙ্গালি চরিত্রের অবিকল চিত্ররূপ ধরা পড়ে না? বস্তুতঃ সিংহের যেমন থাবা, গরুর যেমন শিং এবং মৌমাছির যেমন হুল, তেমনি আমাদের প্রধান অস্ত্র হইল প্রতারণা। বড় বড় অঙ্গীকার, সহজ কৈফিয়ৎ, সুবিধা বিশেষে ফুলানো-ফাঁপানো মিথ্যার ফুলঝুরি এই সবই হইতেছে আমাদের আক্রমণ ও আত্মরক্ষার অস্ত্র। আমার মতে সাধারণ লোককে নয়, সাধারণ লোকের নেতৃস্থানীয় শ্রেণিকেই ম্যাকলে সাহেব ইঙ্গিত করিয়াছেন, কারণ ম্যাকলে সাহেব নেতৃস্থানীয় লোকদেরই সাহচর্যে আসিয়াছিলেন।

                ১৯৭১ সালের ভয়াবহ ৯টি মাস মা-হারা সন্তানের ক্রন্দন, সন্তানহারা মায়ের হাহাকার, স্বামীহারা স্ত্রীর অসহায় অবস্থা, স্ত্রীহারা স্বামীর দীর্ঘশ্বাস আজও জাতির চেতনা, বিবেক ও অস্তিত্বকে বিদ্রুপ করিতেছে। পাকসেনা লক্ষ লক্ষ লোককে ভিটামাটি ছাড়া করিয়াছে, দেশান্তর করিয়াছে, প্রাণহানি ঘটাইয়াছে- সংক্ষেপে ধনে-জনে মানে বাঙ্গালি নিঃস্ব হইয়াছে। বিনিময়ে নেতৃত্ব স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে দেশ ও জাতিকে দিয়াছে আভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ ও দিল্লীর সহিত বশ্যতামূলক মৈত্রী। নব্য শাসকগোষ্ঠী পূর্বসুরীদেরই পথ অনুসারী। সুতরাং অত্যাচার ও নির্যাতন তাহাদের অমোঘ অস্ত্র। পাক শাসকদের অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করিয়াছি। কিন্তু মাথা নত করি নাই। আজও মাথা নত করিব না।

                ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জন আমার পক্ষে কখনও সম্ভব হয় নাই। রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন জটিল মুহূর্তে নীতির প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সহিত আমার মতবিরোধ ঘটিয়াছে। সবাই জানেন, নীতি ও আদর্শকে কেন্দ্র করিয়া রাজনৈতিক দল গড়িয়া উঠে এবং দলীয় নীতি ও আদর্শে মুগ্ধ হইয়াই কর্মীরা স্ব স্ব ইচ্ছানুসারে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনে যোগদান করেন। কিন্তু ক্ষমতার পূজারী নেতাদের নীতিহীনতা ও আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায় বহুক্ষেত্রেই কর্মীদের বিভ্রান্ত হইতে হয়। তখন তাহাদের পক্ষে নূতন কোন দল খুঁজিয়া নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অথচ ক্ষমতালোভী, চরিত্রহীন ও চক্রান্তকারী নেতারাই এই ধরনের সত্যানুসন্ধিৎসু ও আদর্শবাদী কর্মীদের হেয় প্রতিপন্ন করিবার জন্য দল ত্যাগের অপবাদ দেন, যদিও এইসব কর্মীদের নীতিহীন বা আদর্শত্যাগী বলিয়া আখ্যায়িত করিবার সাহস ঐসব নেতার হয় না।

                বিভিন্ন আন্দোলনে অগণিত কর্মীরা ত্যাগের মহিমা ও কর্তব্যজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ হইয়া বিনাদ্বিধায় কারা নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন; দৈহিক নির্যাতন সহ্য করিয়াছেন, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়াছেন। কেহবা সহায়-সম্পত্তি হারাইয়া হইয়াছেন সর্বস্বান্ত। আবার কেহ আত্মসম্মান ত্যাগ করিয়া অন্যের দ্বারস্খ হইতে বাধ্য হইয়াছেন। তাঁহাদের সবাইকে আমি সশ্রদ্ধচিত্তে ও সসম্ভ্রমে স্মরণ করি।

                অজস্র কর্মী বিভিন্ন আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরে উল্লেখযোগ্য ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করিয়া আন্দোলনকে ধাপে ধাপে সফলতার পর্যায়ে লইয়া গিয়াছেন। যদি এই বইতে কাহারো সেই অগ্রণী ভূমিকার উল্লেখ না হইয়া থাকে, তাহা আমার সরাসরি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভাব অথবা অজ্ঞতাপ্রসূত। কাহারো অগ্রণী ভূমিকা অস্বীকার করিবার অর্থ স্বীয় বিবেক ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রতারণা করা। উল্লেখিত ও অনুল্লেখিত কর্মীদের সমবেত ও যৌথ কর্মপ্রচেষ্টা সকল আন্দোলনের মূলভিত্তি এবং তাহাই আমার এই বইটির প্রতিপাদ্য। আশা করি, এই পটভূমিকায় সকলেই আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখিবেন।

                বইটিতে ১৯৪৫ সাল হইতে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক ঘটনারাজী সময়ানুক্রমিকভাবে (in chronological order) লিপিবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তাই কোন কোন ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় একই ঘটনার পুনরুল্লেখ থাকিতে পারে।

                এই বই লিখিতে গিয়া ইতিহাসের নিকট আমি সত্যকে সম্পূর্ণভাবে তুলিয়া ধরিবার নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করিয়াছি যদিও ইহার অধিকাংশই দুঃখজনক এবং তিক্ত। মানুষ মাত্রেই ভুল করে। রাজনীতিবিদগণও ইহার ব্যতিক্রম নহেন। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যখন যাহার চরিত্র ও কার্যাবলী আমার দৃষ্টিতে যেইভাবে পরিস্ফুটিত হইয়াছে, অবিকল তাহাই তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছি। সত্যের অপলাপ করিয়া রাজনৈতিক কোন কর্মী অথবা নেতার অহেতুক নিন্দা করি নাই। প্রত্যেকের সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া ছিল মুক্ত-বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন ও বিবেকপ্রসূত। প্রতিটি চরিত্রের ক্ষেত্রেই কথা ও কাজের যথার্থ মিল বা সঙ্গতি এবং গরমিল বা অসঙ্গতি যখন সেইভাবে পরিলক্ষিত হইয়াছে, যথাস্থানে তাহাই তুলিয়া ধরিয়াছি। সুতরাং, ইতিহাসের প্রতি আমার দায়িত্ব পালনকালে যদি কাহারও মনে সামান্যতম আঘাতও দিয়া থাকি, তবে অনিচ্ছাকৃত সেই ত্রুটির জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ভুল বা অজ্ঞতাবশতঃ কোন তথ্য বা ঘটনার উল্লেখ বাদ থাকিতে পারে। না থাকাটাই অস্বাভাবিক। আমার বিনীত অনুরোধ, গঠনমূলক মনোভাব লইয়া যে কেহ আগামী সংস্করণে বইটির তথ্যগত ও গুণগত মানোন্নয়নে সহায়তা করিলে আমি একান্ত বাধিত থাকিব।

                আমার পরম স্নেহভাজন অধ্যাপক মোমিনুল হক পান্ডুলিপি রিভাইজ করিবার সময় প্রয়োজনীয় শিরোনাম বসাইয়া, স্থানে স্থানে ভাষার ত্রুটি শুদ্ধ করিয়া বইটির উৎকর্ষ বিধানে সহায়তা করিয়াছেন। বইটি ছাপাকালে final proof দেখার কষ্টকর কাজটি সমাধা করিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন নাই। ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে তাঁহাকে ছোট করিব না। অধ্যাপক মোমিনের পরপরই আমার সহধর্মিনী অধ্যাপিকা রাশিদা বেগম বইটি সম্পূর্ণ তার নিজ হাতে গ্রহণ করে। বেচারীর একদিকে সংসারধর্ম পালন অন্যদিকে চাকুরী। রাজনীতিবিদের সংসার! একা তাহাকে কত দিক যে সামাল দিতে হয়। ইহার মধ্যে সময় করিয়া ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহমনকে বই দেখার কাজে নিয়োজিত করিতে হইয়াছে। অনুজ আমিরুজ্জামানের অনবরত তাগাদা ও দৈনিক ইত্তেফাকের বন্ধুবর আখতার-উল-আলম সাহেবের অবিরাম তাগাদায় শেষ পর্যন্ত বইটি প্রকাশিত হইতে পারিল। অর্থাভাবে বইটি প্রকাশ করা যখন অসম্ভব কল্পনায় পরিণত হয়, আখতার-উল-আলম সাহেব বইটিকে প্রেসে পাঠাইতে বাধ্য করেন এবং এমন কি আমাকে ঋণগ্রস্ত করিয়া ছাড়েন। শুধু তাহাই নহে। বইটিকে পুনঃরিভাইজ করিবার মত দায়িত্বপূর্ণ কাজটি এক প্রকার জোরপূর্বক স্বহস্তে গ্রহণ করেন। গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে সুদীর্ঘ একমাস অমানুষিক খাটুনি খাটিয়া আখতার-উল-আলম সাহেব বইটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সহায়তা করিয়াছেন। তাঁহার অকৃত্রিম সহৃদয়তা ও দরদ ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব। আমার ছোট বোনদ্বয় শেলী ও এলী এবং ছোট ভাই জিল্লুর বই কপি করিবার মত নিরানন্দময় কাজটি সমাধা করিয়াছে। সাপ্তাহিক ইত্তেহাদের জেনারেল ম্যানেজার সাঈদ হাসান বইটির জন্য কাগজ, ছাপাখানা অর্থাৎ ছাপাইবার পূর্ণ ঝুঁকি গ্রহণ করে। মাঝে মাঝে আনুষঙ্গিক প্রয়োজনের অর্থ জোগাইবার মত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটির সমাধানও সে করিয়া দেয়। ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানাইয়া তাহাদের কাহাকেও ছোট করিব না।

অলি আহাদ

মে, ১৯৮২

পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য সভাপতির অনুমোদন নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিম্নোক্ত বক্তব্য উত্থাপন করেনঃ

Mr. Dhirendranath Datta : May I speak, Sir?

Mr. President: Yes speak:

Sir, In moving this- the motion that stands in my name- I can assure the House that I do so not in a spirit of narrow Provincialism, but, Sir in the spirit that this motion receives the fullest consideration at the hands of the members. I Know, Sir, that Bengalee is a provincial language, but, so far our state is concerned, it is the language of the majority of the People of the state. So although it is a provincial language, but as it is a language of the majority of the people of the state and it stands on a different footing therefore. Out of six crores ninety lakhs of people inhabiting this State. 4 crores and 40 lakhs of people speak the Bengalee language, So, Sir, what should be the State language of the State? The State language of the state should be the language which is used by the majority of the people of the State, and for that, Sir, I consider that Bengalee language is a lingua franca of our State. It may be contended with a certain amount of force that even in our sister dominion the provincial language have not got the status of a lingua franca because in her sister dominion of India the proceedings of the constituent Assembly is conducted in the Bengalee language but so far as the Bengalee is concerned out of 30 crores of people inhabiting, that sister dominion two and a half crores speak the Bengalee language. Hindustani, Hindi or Urdu has been given and honoured place in the sister dominion because the majority of the people of the Indian Dominion speak that language. So we are to consider that in our state it is found that the majority of the People of the state do speak the Bengalee language than Bengalee should have an honoured place even in the Central Government.

I know, Sir, I voice the sentiments of the vast millions of our State. In the meantime I want to let the House know the feelings of the vastest millions of our State. Even, Sir, in the Eastern Pakistan where the People numbering four crores and forty lakhs speak the Bengalee language the common man even if he goes to a Post Office and wants to have a money order form finds that the money order is printed in Urdu language and is not printed in Bengalee language or it is printed In English. A Poor cultivator, who has got his son Sir, as a student in the Dhaka University and who wants to send money to him, goes to a village Post Office and he asked for a money order form, finds that the money order form is printed in Urdu language. He can not send the money order but shall have to rush to a distant town and have this money order form translated for him and then the money order, Sir, that is necessary for his boy can be sent. The poor cultivator, Sir, sells a certain plot of land or a poor cultivator purchases a plot of land and goes to the Stamp vendor and pays him money but cannot say whether he has received the value of the money is stamps. The value of the Stamp. Sir is written not in Bengalee but is written in Urdu and English. But he cannot say, Sir, whether he has got the real value of the stamp. These are the difficulties experienced by, the Common man of our State. The language of the state should be such which can be understood by the Common man of our State. The common man of the State numbering four crores and four millions find that the proceedings of this Assembly which is their mother of parliaments is being conduct in a language, Sir, which is unknown to them. Then, Sit, English has got an honoured place, Sir, in Rule 29. I know, Sir, English has got and honoured place because of the International Character.

But, Sir, if English can have an honoured place in Rule 29 that the proceedings of the Assembly should be conducted in Urdu or English why Bengalee, which is spoken by four crores forty lakhs of people should not have honoured place. Sir, in Rule 29 of the procedure Rules, So, Sir, I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our State and therefore Bengalee should not be treated as a Provincial Language. It should be treated as the language of the State. And therefore, Sir, I suggest that after the word English, the words `Bengalee be inserted in Rule 29. I do not wish to detain the House but I wish that the Members present here should give a consideration to the sentiments of the vast millions of over State, Sir, and should accept the amendment that has been moved by me.

Mr. President: I may read out the amendment again some Members might not have it.

Amendment moved : That in sub-rule (1) of rule 29, After the word  ‘English’ in line 2, the words ‘or Bengalee’ be inserted.”.

Mr. Prem Hari Barma (East Bengal: General): Sir, I whole-heartedly support the amendment moved by my Hon’ble and esteemed friend. Mr. Dhirendranath Datta. Sir, this amendment does not seek to oust English c Urdu altogether but it seeks only to have Bengalee as one of the media spoken in the Assembly by the members of the Assembly, So, it is not the intention of the amendment altogether to oust English or Urdu, but to have Bengalee also as the lingua franca of the State Sir, as my Honourable friend has told the House, the Majority of the people of the State of Pakistan speaks Bengalee, Therefore, Bengalee must find a place as one of the media in which the Members can address the Assembly. Another difficulty will be that if any member speaks in his mother tongue, but if it is not one of the media in which the members can address the House, the true speech will not be recorded, but only a translation of the speech in the proceedings of the House will be recorded. Therefore, it is necessary for the majority of the people of the State that the speeches which will be delivered in Bengalee should be recorded in Bengalee. With these few words I support the amendment moved by Mr. Dhirendranalh Datta.

The Hon’ble Mr. Liaquat Ali Khan (Prime Minister and Minister for Defence): Mr. President, Sir, I listened to the Speech of the Hon’ble the Mover of the amendment with very great care and attention. I wish the Hon’ble member had not moved his amendment and tried to create misunderstanding between the different parts of Pakistan. My Honourable friend has waxed eloquent and stated that Bengalee should really be the lingua franca of Pakistan. In other words, he does not want Bengalee only to be used as a medium of expression in this House, but he has raised indeed a very important question. He should realise that Pakistan has been created because of the demand of a hundred million muslims in this sub-continent and the language of a hundred million Muslims is Urdu and, therefore, it is wrong for him now to try and create the situation that as the majority of the people of Pakistan belongs to one part of Pakistan, therefore, the language which is spoken there should become the State language of Pakistan. Pakistan is a Muslim State and it must have as its lingua franca the language of the Muslim nation. My Honourable friend is displeased that Urdu should replace English. The intention is that instead of changing English as the State language which it has been so long. Urdu should be the state language, Sir, my Honourable friend never minded it, never presed for Bengalee as long as English was the state language. I never heard in the Central Assembly for years and years any voice raised by the people of Bengal that Bengalee should be the State language. I want to know why is this voice being raised today and I am sorry that he should feel it necessary to bring in this question. We do recognize the importance of Bengalee. There is no intention to oust Bengalee altogether from Bengal. As a matter of fact, it would be wrong for anyone to thrust any other language on the people of a province which is not their mother tongue, but, at the same time, we must have a State language the language which would be used between the different parts of Pakistan for inter-provincial Communications. then, Sir, it is not only the population you have to take into consideration. There are so many other factors. Urdu can be the only language which can keep the people of East Bengal or Eastern Zone and the people of Western Zone jointed together. It is necessary for a nation to have one language and that language can only be Urdu and no other language.

Therefore, Sir, I am sorry, I cannot agree to the amendment which, has-been moved. As a matter of fact, when the notice of that amendment was given, I thought that the object was an innocent one. The object to include Bengalee was that in case there are some people who are not proficient in English or Urdu might express their views in that language, but I find now that the object is not such an innocent one as I thought it was. The object of this amendment is to create a rift between it was. The object of this amendment is to take away from the Mussalmans that Unifying force that brings them together.

Mr. Dhirendranath Datta: Certainly not that is not the intention.

Mr. Liaquat All Khan : My Honourable friend may go on questioning for the rest necessary for the people of Bengal- Bengalee-speaking People to have remained united? No, because it was to be a State where Mussalmans were in a majority. Therefore, Bengal must be divided. There was no question of Bengalee language of Bengalee culture taken into consideration at that time.

The Hon’ble Sardar Abdur Rab Khan Nishtar: (Minister for Communications): The Hon’ble Member voted for division.

Mr. Liaquat Ali Khan: Anyhow I am not concerned with that part of it. I think it is wrong for my Honourable friend to raise that question. It is really that most vital question, a question of life and death for the Musa. nation, not only for Pakistan. But through out this whole subcontinent and I most strongly oppose the amendment which has been moved. I hope the House will not lend its support to such a kind of amendment.

                এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদে Sarat Bose-H.S. Suhrwahdy-Abul Hasham-Burrows- Kiron Sankar Ray-Jogendranath Mandal-এর অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের বিরুদ্ধে-গান্ধী-নেহেরু-পেটেল, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু বাংলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ফলে স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গের স্থলে হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই তাদের অসাম্প্রদায়িকতা-এটাই তাদের বাংগালীত্ব। একমাত্র বাবু কিরণ শংকর রায় ব্যতীত কমরেড জ্যোতিবোস সহ Bengal Legislative Assembly-এর সব হিন্দু সদস্যই ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক ও হিন্দু পশ্চিম বঙ্গ প্রতিষ্ঠার মূল হোতা। সাম্প্রদায়িক হিন্দু এমএলএ দের কারণে পূর্ব বাংলার ৫০/৬০ লক্ষ হিন্দু নিজ ভিটা মাটি ছেড়ে বাস্তহারা পরিচয়ে হিন্দু স্থানে হিজরত করে অমানবিক-অসামাজিক জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে।

MILESTONES ON THE ROAD TO FREEDOM

By HIREN MUKHERJEE

TODAY IS A RED-LETTER DAY IN INDIAS ANNALS. TWO DOMINIONS EMERGE-INDIA AND PAKISTAN-AS NEAR TO INDEPENDENCE AS ANY STATE, OUT SIDE THE CATEGORY OF GREAT POWERS, CAN EXPECT TO BE IN AN INTER-DEPENDENT WORLD. IT IS, THEREFORE, A HISTORIC LANDMARK, A DAY OF GOOD CHEER AND YET OF A BECOMING SOLEMNITY.

This in spite of the fact, which cannot be gainsaid, that few people in India today are in a mood of real rejoicing. To our wonted economic woes have lately been added the agonies of a senseless communal carnage that has seared India’s soul and besmirched her fair reputation.

Bengal and the Punjab, two of India’s vanguard provinces in the struggle for freedom, have had to pay cruelly for the country’s leaders’ inability to pull together, and to accept artificial bifurcation of their soil. Freedom, besides coming in today’s context more as a gift from Britain than as a yearned- for prize won by strenuous battle, carries rightly or wrongly implications that India’s militant nationalism may not find too savoury.

But for all that the governance of India today becomes the Indians’ own unhampered concern: flags of indigenous design and connotation replace the Union Jack; a stage opens when we have the opportunity t9 mould the shape of our India nearer to our heart’s desire.

On this day, then of all days, one should recall the past, pay homage to the martyrs and leaders who have gone before and re-learn whatever lessons the story of our march to independence still has for us.

Even before the foundation in 1885 of the Indian National Congress, the premier and still the most powerful organization of the Indian national movement, there were efforts made, in comparatively primitive fashion, to oust British power from this country. The Wahabis, armed with the ideology of Islamic Puritanism, conducted during a large part of the nineteenth century a religio-agrarian movement which proved a menace to Government. The working masses, from time to time, as in the Indigo Riots of 1859-60 in Bengal, made the administration in certain regions fairly impossible.

Most spectacular of all pre-1885 attempts to throw off the foreign yoke was, of course, the Mutiny of 1857, when Hindus and Muslims, united by xenophobia, fought desperately to demolish the growing structure of Britain’s empire in India. None of these were full fledged national movements, but they all, in various ways, presaged the future. By destroying in India the foundations of the old order of society, Britain had been, in Karl Marx’s words, ‘the unconscious tool of history” in the development of India, which in time was bound to “throw off the English yoke altogether.”

Birth of Congress

The history of India’s national movement is often traced back to the foundation of the Congress in 1885. Alan Octavian Hume, “Father of the Indian National Congress” and Lord Dufferin, the then viceroy, had more than a hand in the business, but the Congress would have emerged anyhow, Hume or no Hume, and since the setting up in Bengal of the British India Society in 1843 and more notably the Indian Association in 1875, indications were not wanting that educated Indians, inspired largely by British constitutional ideals, would have an all-Indian political organization. It is significant, as seen in a memorandum prepared by Hume and quoted by his biographer. Sir William Wedderburn, that in the early eighties “poor men pervaded with a sense of the hopelessness of the existing state of affairs were going to do something and stand by each other, and that something meant violence; that a ‘terrible revolution’ might ensue since a certain small number of the educated classes would join the movement, assume here and there the lead. give the outbreak cohesion and direct it as a national revolt.” (W. Wedderburn. “Alan Octavian Hume,” 1913, pp. 80-81.101).

Part of the reason, therefore, for official sponsoring of the Congress was that he desired to see it function as a sort of insurance against “revolution.” Soon enough of course the stormy potentialities of Congress began to be apparent, and Dufferin, who has helped it into being, sought to pooh-pooh it as representative only of a “microscopic minority.” It indicates, clearly, the double strandard in the role of the Congress ever since; on the one hand, it has been a safety valve against the “menace” of mass movement, and on the other, it has been the leader, ineluectably, of the masses in the national struggle.

Early Policy

There have been four main stages in India’s march towards independence; the first (1905-10) comprising what is usually called the Swadeshi movement, mainly in Bengal, Maharashtra and the Punjab, with repercussions elsewhere; the second (1919-22), when Mahatma Gandhi sent out his clarion call for non-violent non-co-operation and roused the country as never before; the third (1930-34), when again he stirred India with his programme of civil disobedience; and the fourth (1940-46)’ when the people’s militancy, risen to a new qualitative pitch and assisted by the dynamic world, achieved results that, are visible today.

Elements whose variegation was not and could not be eliminated have played their part throughout. Hindus and Muslims have fought often together but sometimes as distinguishable strands, notably since 1940, when the Muslim League declared the two-nation theory and its goal of Pakistan. A large part in the movement has been played, particularly since the late ‘twenties by the working class and still later the peasantry, growing to class consciousness and linking class objectives with the more immediate and widely shared urgency of a national democratic settlement.

Admiration of the British constitution and hope of sharing its blessings marked the early policy of the Congress but forces soon began to develop which drew sustenance from the European literature of revolt, from pride in India’s storied past and from examples of successful action against foreign domination. A self-confident militancy fortified by all that was heroic and splendid in India’s own traditions, and “romantic, mystical, aggressive” quasi-religious appeals for the restoration of the country’s self-respect, were propagated by people as diverse as Dayanand, Tilak and Aurobindo Ghose and Brahmabandhab Upadhyay.

The ideology was largely Hindu in coloration but it bore no conscious antagonism towards the Muslims. It was a declaration of war on “political mendicancy,” and when Lord Curzon decreed in 1905 the partition of Bengal, India’s largest and most advanced province, Bengal did not just groan in agony: she roared in protest meetings and demonstrations were held on an unheard-of scale, the boycott of British goods made striking strides, and the province’s pent-up patriotism found vent in the form of stirring songs unmatched before or since, songs that suggest strongly that it was “bliss in that dawn to be alive and to be young was very heaven.”

It was not till 1912 that the “settled fact” of the partition of Bengal was “unsettled,” but meanwhile, the Congress had split into “moderates” and “extremists,” a reconciliation in 1916 lasting no longer than a few years, and the latter, especially with Mahatma Gandhi’s advent, held from 1918 onwards a virtual monopoly of the organization. More notably, the terrorist movement in the offing since the nineties of the last century had reared its head. This trend, born of sheer patriotic desperation and the noble impatience which accompanies all emotional upsurge, continued as a factor in Indian politics till the early ‘thirties. Almost all ex-terrorists today have lost faith in their early creed, but terrorism was in the Indian context an inevitable phenomenon, it instilled, whatever its deficiencies ethically or politically, a new fearlessness and a whole-hogging passion for freedom. No Indian will ever pour obloquy on the terrorists; for all their mistakes, they were the salt of our Indian earth.

During World War, attempts were made to secure foreign assistance for freeing the country. Muslims and Hindus took part in them, the former “out of humour with the British Government,” in the words of the Rowlatt Committee, largely because of Britain’s attitude towards Turkey. The congress and the Muslim League (founded in 1906, with Government playing apart in its establishment very similar to that in the case of the Congress in 1885), supported the war in effusive resolutions, but the country’s temper was growing to be menacing. And when the War ended and a myriad economic problems flared up and the Russian revolution stood out as a challenge to all the powers that be, India was ripe for the inovement which Mahatma Gandhi came out in all his glory to organize and direct.

1920-22

The story of 1920-22, the Congress-Khilafat movement of non-co¬operation, cannot be told in a few words. That was the time when the Congress said goodbye to its old-time respectability and stood out as leader of the masses, the focus of a united and militant national movement. Muslims led by the Ali Brothers, Hakim Ajmal Khan, Abul Kalam Azad and many others joined in with spirit and determination. All over India, there was expectation, following on Mahatma Gandhi’s repeated prophecies, that freedom was coming before the year 1921 was rung out. The people’s strength found vent in massive hartals, notably on the occasion of the Prince of Wales’ tour, and in the peasantry’s no-tax compaigns. But all was to be in vain; 1922 came and Swaraj was nowhere in sight. Mahatma Gandhi insisted on a standard of non-violence which his militant followers found impossible, and in February 1922 the non-co-operation movement was withdrawn.

All over the country, exultation gave way to depression and for quite some time India sulked and sorrowed C.R. Das, with Motilal Nehru as his chief lieutenant, came out with scheme of entering the legislature, set up by the Montagu-Chelmsford Reforms Act of 1919 and boycotted so long by the Congress, with a programme of persistent obstruction. It injected some little life into the body politic, but not as much as was wanted.

In desperation, impatient patriots took recourse again to individual terorism. Hindus and Muslims, drawn so close together in the great days, of 1920-21, fell again apart, quarrelled over the loaves and fishes of office and with politics lacking fire communal riots came to be a  melancholy feature. Things began to look up only when all the position that mattered decided to boycott the all-white Simon Commission sent out in 1928 to judge India’s fitness for the next round of reforms. Organization of the working class, which was to he a great ally of the national movement, also went on apace, as witness the Cawnpore Bolshevik Conspiracy Case of 1924 the formation of Workers’ and Peasants’ Party, and the much more celebrated Meerut Conspiracy Case which was instituted in order first to drive a wedge between the working class and the national movement, and secondly, to decapitate the rising working-class organisation by stowing away its leaders for long term.

Not for long could India he kept in leash, however, the Congress in 1929 declared its goal of complete independence and the next year 1930 Mahatma Gandhi re-emerged with his civil disobedience movement.

Civil Disobedience

The struggle of 1930-32 remains vivid in many memories, With a short respite, when Mahatma Gandhi attended the London Round Table Conference in 1931 it raged, fairly relentlessly, for in the first round the number of civil resisters was about 90010, and in the second about SOM00. It was a distressing finale to an inspiriting drama when the Congress leadership decided in May 1934 to call it off, but it kft rich lessons, pride in our common people and determination to fight till freedom was won.

What followed has been too recent to require much elucidation, Since 1936 the Congress acquired, thanks largely to pandit Jawharlal Nehru, a new militancy and reflected, as much as a bourgeois-led organization could, the rising tempo of the working class and pensantry’s movement. The Congress Achilles heel however, was the Muslim problem; the alienation since 1922 had never really been healed, the Congress’ Contact with Muslim Masses, as Nehru admitted, was fortuitous and unsatisfactory. This cardinal defect has had to be too dearly paid for, and today, as we celebrate Indian independence, we see also regretfully the emergence of two Indian the unwillingness which one hopes and feels is only temporary of Muslims and Hindus to live and work in one proud State of their own.

During World War-11 and since its termination, one saw many examples of our people’s strength in spite of the unfortunate estrangement between large sections of the two main communities. There has been no question that on the issue of independence all were unanimous. The Muslim League had declared complete independence as its goal in 1937 and three years later defined it as Pakistan. The Congress, after its offer of co-operation with the war effort on what it considered honourable terms had been refused, experimented with individual satyagraha in 1940, and in 1942 launched the slogan of “Do or Die.”

1942 Events

The working class and the peasantry, in so far as it had a conscious class leadership, supported the war in its character of an anti-Fascist struggle with enormous potentialities for peoples liberation everywhere, but they never lagged behind in the demand for complete freedom. In March-April 1942 the British Government made a notable effort at understanding, but for varied and complex reasons, the Cripps Offer was infructuous. And so in August 1942 and subsequent months there started another and a ruthless tug-of-war between Government and the people, the latter leaderless and striking in blind. spontaneous fury.

The struggle of our people for liberation reached a higher phase in 1945-46, when it could no longer be pleaded that the exigencies of war demanded the withholding of Indian freedom. Over the issue of the release of the Indian National Army prisoners, unprecedented demonstrations were held. The mutiny in the Royal Indian navy early in 1946 showed how the spirit of revolt and impatience with subjection had permeated the Armed Forces. Enormous working class upheavals, demonstrated most spectacularly in Calcutta on July 29, 1946, extensive agrarian uprisings in different parts of India and the heroic unassisted struggle of States people from Kashmir to Travancore, underlined the same thing, The British sought agreement, held conferences at Simla (1945-46) with national leaders; sent first a Parliamentary delegation and then the Cabinet Mission. Parleyed with every important group, and ultimately, when the delary in the fruition of the people’s hopes and the failure of Congress and League leaders to come together helped to produce a calamitous situation of civil war between the communities. came out with legislation on Indian Independence. And it is in the terms of the Indian Independence Act of the British Parliament that today is being celebrated.

There is a suspicion, which cannot just be wished away, that our independence today has many a lacuna, that we have been profiered a piece of bread which might well taste like stone, that problems like that of the States and of Hindu-Muslim antagonism are the product of many and dubious machinations. Such worries there are and will be; but that is no reason why Indians should not realize that, in spite of everything, a brave new perspective is opening, that nothing can prevent us, if only we make up our mind turning formal independence into substantial that even out of its apparent wreck our hope can and will create the thing it contemplates and India before long will play, united, her rightful role in world affairs.

* This article published in the statesman on their supplement, issued on the day of the inauguration of the two new dominions of Pakistan and India. 15 Aug. 1947

বঙ্গানুবাদ

স্বাধীনতার মাইল ফলক

হীরেন মূখার্জী

আজ ভারতের ইতিহাসে ‘লাল রং-এ রঞ্জিত একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন। এই মাহেন্দ্রক্ষণে প্রাক-স্বাধীনতা পরিপূর্ণ স্বাদে সিক্ত হয়ে জন্ম নিয়েছিল দু’টি স্ব-শাসিত দেশ- ভারত ও পাকিস্তান- যা যে কোন নবজাত রাষ্ট্রের বেলায়ই অত্যুজ্জ্বল একটি ঘটনা। বৃহৎ শক্তিবর্গের দেশটি পৃথিবীর এই আত্মনির্ভরশীলতার নিরিখে অনেক কিছুই প্রত্যাশা করে। এসব দ্বিধার পরেও এটা ঐতিহাসিকভাবে চিহ্নিত একটি দিন-যেদিনে ভরাট উল্লাসের পাশাপাশি ভাবগাম্ভির্যও বজায় রাখার অবকাশ রাখে।

                এসবের পরেও ইহা অস্বীকার করা যাবে না যে, আজকের ভারতে সত্যিকার অর্থে প্রাচুর্য ভোগ করছে এমন লোক হাতে গোনার মধ্যেই রয়েছে সীমিত। আমাদের চিরচারিত দুর্বল অর্থনীতির সাথে শেষ অবধি যুক্ত হয়েছে বিবেকহীন ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ, যা ভারতের আত্মাকে করেছে বিদীর্ণ এবং সেই সাথে তার সুন্দর ভাবমূর্তিকে করেছে কলঙ্কিত। বাংলা ও পাঞ্জাব-স্বাধীনতা সংগ্রামের এই দুটি ভারতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী দেশকে নির্মমভাবে চরম খেসারত দিয়ে হয়েছিল। এক সাথে চলার পথ থেকে সরে পড়ার জন্য। এভাবে তাদের আত্মার কৃত্রিম বিভক্তি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল দেশের দুর্বল নেতৃত্বের জের হিসেবেই। তাছাড়া স্বাধীনতা-আজকের প্রেক্ষাপটে যত না তীব্র সংগ্রামের মাধ্যমে, ভালোর জনা হোক বা মন্দের জন্যে হোক, ছিনিয়ে আনা ‘বিজয়’ হিসেবে; এবং এর ফল (নিহিতার্থ) ভারতের জঙ্গী জাতীয়তাবাদী শক্তি খুব একটা মসলাদার বা স্বাদযুক্ত উপাদান, তথা সুখকর পরিস্থিতি হিসেবে মেনে নেয়নি।

                কিন্তু এতসব ঘটনার পরেও যেটা সুখের তা হচ্ছে ভারত আজ পেয়েছে নিজের দেশ নিজে শাসন করার অধিকার-তথা স্বরাজ-এর প্রতিষ্ঠিত স্বাদ, যা অনুভূতিতে নিরবিচ্ছিন্ন, নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী নকশাবিদদের দ্বারা প্রস্তুত নিজ দেশের স্বাধীন পতাকা প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছে এবং যা বাধ্য করেছে বলদর্পি প্রভুর ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা নামিয়ে ফেলতে ও মেনে নিতে কালের অমোঘ বিধান, এ স্বাধীনতা ভারতের দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছে নিজেদের দেশ নিজেরা গড়ার সুযোগ।

                এই দিনে এবং আগত এই দিনগুলোতে আমাদের স্মরণ করতে হবে সেসব অতীত দিনের কথা, শ্রদ্ধা জানাতে হবে দেশের সেইসব বরেণ্য সন্তানদের ও নেতাদের কথা, যাঁদের আত্মত্যাগে এ দেশ হয়েছে স্বাধীন এবং নতুন করে আমাদের শিখতে হবে স্বাধীনতার অগ্রযাত্রার পথে যা কিছু শিক্ষণীয় আছে সবই পাথেয় হিসেবে নিতে নিখিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-যাহার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৫ সালে এবং ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে দল ‘আদি এবং একমাত্র শক্তিশালী ও আন্দোলনে ব্রতী প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে আজও যে দল সুবিদিত, তারও আগে-এদেশ থেকে বৃটিশরাজ উৎখাতের জন্য একাধিকবার দুর্দমনীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। যদিও তুলনামূলকভাবে এসব আন্দোলন ছিল মধ্যযুগীয় ধারায় প্রভাবিত; তবুও এগুলো ছিল অকৃত্রিম দেশাত্মবোধে ভাস্বর। যেমন ‘ওহাবি’ আন্দোলন, ১৯০০ শতকের বৃহত্তর সময় ধরে ‘ওহাবিয়া’ ইসলামের পবিত্রতম আদর্শের অস্ত্রে সজ্জিত হয় ধর্মীয়- অনুশাসন ও কৃষিভিত্তিক আন্দোলন চালিয়ে বৃটিশ সরকারের যথেষ্ট পেরেশানের কারণ হতে সক্ষম হয়েছিল, এ-দেশের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী-সময়ে সময়ে বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে “বৃটিশ হঠাও” আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যেমনটি ঘটেছিল ১৮৫৯-৬০ সনে, বাংলা যাহা “ইন্ডিগো রাঅট” বা “নীল চাষের হাঙ্গামা” হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে চিরকাল। বৃটিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে নীল চাষের প্রতিবাদে শুধু নীল চাষীরাই ক্ষোভে ফেটে পড়েনি সেদিন; তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল বাংলার আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে, লেখক সম্প্রদায়ের লোকেরাও, উদাহরণ ‘নীলদর্পন’। এ আন্দোলনের খেসারত দিতে হয়েছিল বৃটিশরাজকে বাংলার বেশ কিছু অঞ্চলে নিজেদের প্রশাসন-যন্ত্রে ধস নামানোর আলামত হজম করে।

                বিদেশী শাসনের জোয়াল থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রাক ১৮৮৫-এর সকল প্রচেষ্টাকে দৃশ্যত; ম্লান করেও দেশবাসী সবাইকে নাড়া দিয়ে ১৮৫৭-এর দশকে “হিন্দু ও মুসলমান”-ভারতের এ দুটি সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী একযোগে সম্মিলিত হয়ে ও বেপরোয়াভাবে যে প্রচন্ডতম স্বাধীনতা যুদ্ধের আঘাত হেনেছিল ভারতে ক্রমবর্ধমানভাবে গড়ে ওঠে বৃটিশ সাম্রাজ্যের মূল কাঠামোর উপর তাতে ভারতের বৃটিশ সাম্রাজ্যের “ভিত”ই কেঁপে উঠেছিল থর থর করে। দুর্বল নেতৃত্ব, বিচ্ছিন্ন সমর অভিযান, বৃটিশ-পদলেহীদের সক্রিয় বিরোধিতা ও উপযোগী সমন্বয়ের অভাবের কারণে-দৃঢ়ভাবে প্রোথিত, সুশৃঙ্খল যান্ত্রিক সামরিক বাহিনী এবং ধুর্ত কুটনৈতিক-চালে এ পুষ্ট বৃটিশের রাজত্বের ভিত এ দেশের মাটি থেকে উৎখাত করা সম্ভব হল না এবারেও, এটা আমাদের পরম দুর্ভাগ্য। বস্তুতঃ এসবের কোনটাই জাতীয় পর্যায়ের ও সম্বলিত আন্দোলন ছিল না কিন্তু বিভিন্নভাবে বৃটিশের ভারত ছাড়ার এটাই ছিল “অশনি সংকেত”। ভারতের সনাতন সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে ‘বৃটেন’ কার্ল-মাক্স-এর ভাষায় “অবচেতন-ইতিহাসের হাতিয়ার” তৈরি করতেই কেবল সাহায্য করে চলেছিল ভারতের বুকে; যার ফলশ্রুতিতে নিজেদের অজ্ঞাতসারেই ভারতের মাটি থেকে পরাধীনতার “ইংরেজ জোয়াল” নিজেরাই উপড়ে ফেলে চিরতরে তথা ‘অগস্থ্য যাত্রা’ করতে বাধ্য হতে হয়েছিল ‘সুচতুর’ ইংরেজ সরকার বাহাদুরকে।

কংগ্রেসের জন্ম

                নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস আন্দোলনের ইতিহাস খুঁজতে হলে ১৮৮৫ সনে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেসের জন্মলগ্ন এর ঘটনাপঞ্জীর দিকে হাত বাড়াতে হবে। কারণ, নিখিল ভারতীয় কংগ্রেসের জনক বলে তথাকথিত খ্যাত অ্যালান অকটেভিয়ান হিউম ও তৎকালীন বড় লাট বা ভাইসরয় লর্ড ডাফেরিন-এর নাম- এদেশের কল্যাণ এর ‘চে বেশি করে নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধা আদায়ের কাজে সম্পৃক্ত রেখে কংগ্রেসের জন্মের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে ছিল জড়িত। সে যাই হোক হিউম বা হিউম ছাড়াই যে নিখিল ভারতীয় কংগ্রেসের জন্ম ১৮৮৫ সালেই হয়েছিল- এ কথা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য একই ঘটনার পরিণতিতে বাংলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ‘বৃটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’; ১৮৪৩-এর দশকে এবং এর চেয়েও সমধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৮৭৫ সনে “ইন্ডিয়া এসোসিয়েশন” এর জন্মলাভ। এসব ঘটনাবলীর আলামতে কিন্তু এটা চাওয়া হচ্ছে না যে, ভারতের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বৃটিশ সংবিধানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটিকে সমৃদ্ধ করুক। তবে হিউম প্রণীত স্মারকলিপিতে হিউমের জীবনী-প্রণেতা, স্যার উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন (Sir Welliam Wedderburn) যেভাবে ঘটনার উল্লেখ করেছেন, উহার উদ্ধৃতি এখানে সন্নিবেশিত করা হল; “দরিদ্র জনগণ চলমান আশাহীনতার প্রেক্ষাপটে হতাশা হয়ে ……… পরস্পরের সাথে হাত মিলিয়ে ‘কিছু একটা’ করতে যাচ্ছে এবং সেই ‘কিছু একটা’-ও অর্থ বুঝতে হবে- সন্ত্রাসী কার্যকলাপ- একটা ‘বিপজ্জনক বিদ্রোহ’ দানা বাঁধতে শুরু করেছে, অর্থাৎ একটা ছোট আকারে শিক্ষিত শ্রেণি এ শুরু হতে যাওয়া আন্দোলনে যোগ দিতে যাচ্ছে, অনুমান করছি, এখানে সেখানে নেতৃত্ব দিয়ে শেষমেষ এরা অটলভাবে একত্রিত হয়ে একটা জাতীয় বিদ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে। “W. wedderburn, “Alan Octavian Hume”. 1913 pp80-8, 10” এ স্মারক লিপিতে, হিউম-ভারতের রাজনৈতিক গগণে যা ঘটতে যাচ্ছে, আকার ইঙ্গিতে তার যথার্থতাই স্বীকার করেছেন এবং ইহা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা তো বটেই। সুতরাং আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করার লালিত ইচ্ছার কারণসমুহের একটি হচ্ছে- এটা দেখা যে সংগঠনটি যেন সম্তাব্য “বিদ্রোহের বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা অব্যাহত রেখে নিরাপত্ত নিশ্চিত করা। শীঘ্রই কংগ্রেসের ঝটিকা কার্যকলাপ স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করায় বড়লাট ডাফেরিন (Victory Lord Duffcrin) সংগঠনটির সার সম্যকতাবে বুঝলেন; এবং যে রাজনৈতিক দলটিকে সংগঠনকালে সাহায্য করেছিলেন তাৎক্ষণিকভাবে তিনি মত পাল্টিয়ে ঘৃণাভরে ফতোয়া জারি করলেন “দলটি আসলে ভারতের একটি ক্ষুদ্রতম অংশকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এর পর থেকেই কঙ্গগ্রেসের মধ্যে সু্স্পষ্টভাবে আবিস্কৃত হল দ্বৈতসত্তার অস্তিত্বের-এর একটি হচ্ছে জনগণের দুর্দশার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটা একটি “নিরাপদভাবে উত্তেজনা নিরসনের উপায়” বা “সেফটি ভাল্ব” অন্যটি হচ্ছে, অপরিহার্যভাবে জনগণের জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া।

পুর্বের কর্মপন্থা

স্বাধীনতা অর্জনের অগ্রযাত্রা চারটি পর্যায়ে চলমান ছিলঃ প্রথম পর্যায় (১৯০৫-১০) এ অন্তর্ভুক্ত ছিল স্বদেশী আন্দোলন, এ নামেই সচরাচর আন্দোলনটির ছিল পরিচিতি যাহা প্রধানতঃ বাংলা, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং, অন্যান্য স্থানেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৯১৯-২২) মহাত্মা গান্ধী তাহার শান্তিপুর্ণ গণঅভুথান ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের জনগণের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ রাজাদের বিরুদ্ধে যে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন তারই ক্রিয়া-কর্মকান্ডে ছিল সমৃদ্ধ। এর আগে এ ধরনের আন্দোলনের ডাক কেউ দেননি। তৃতীয়তঃ (১৯৩০-৩৪) তিনিই যখন আইন অমান্যকারী আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে পণজাগরণের জোয়ার এনেছিলেন সে সব কতকথায় পরিপূর্ণ ছিল সেদিনগুলো। এর পরে এলো চতুর্থ পর্যায় (১৯৪০-৪৬)। এ-পর্যায়ে জনগণের জঙ্গী মনোভাব নতুন উৎকর্ষতায় সমৃদ্ধ হয়ে এবং পৃথিবীর চিন্তাশীল রাষ্ট্রনায়কদের রোষদৃষ্টি একগুয়েমিডাবে বৃটিশের স্বাধীনতা-আন্দালন দালিয়ে রাখার বিরুদ্ধে বর্ষিত হল তখনই বৃটিশ সিংহ ল্যাজ গুটিয়ে পিঠ-টান দিতে বাধ্য হলেন, এবং ঘটনাটির ফল দৃশ্যতঃ আমরা সবাই এখন ভোগ করছি। বিভিন্ন উপাদান যা বিভিন্ন রঙে আচ্ছাদিত ছিল এবং যা উৎপাটন করা সম্ভব হয়নি এদ্দিন তাদের ভূমিকা শুরু হয়ে গেল এবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হিন্দু এবং মুসলমান একত্রে থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল প্রায়ই কিন্তু যখনই পৃথক রাজনৈতিক দল হিসেবে এবং পৃথক বাধীন সত্তার অংশ হিসেবে “মুসলিম লীগ” এর জন্ম দিল-দ্বিজাতিক ভিত্তিতে এখং বিশেষ করে যখন মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বাধীন আৰাসভূমি-পাকিস্তান দাবি করা হলো- তখন থেকেই শুরু হলো রাজনৈতিক ধারার ডামাডোলের ক্রিয়াকলাপ বিশেষ করে বিশ দশকের শেষের দিকে যে সব শ্রমজীবী শ্রেণির একটি বড় অংশ এ আন্দোলনে সামিল হয়েছিল তারা এখনো, কৃষকই রয়ে গেছেন, তারা শ্রেণি-সচেতন হয়ে বেড়ে উঠছে এবং সংযোগ সাধনকারী শ্রেণির উদ্দেশ্যাবলীর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে আরও বেশি, তাৎক্ষণিক ও ব্যাপক অংশীদারিত্ব আদায়ের লক্ষ্যে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক সমাধান ঢাচ্ছে, জরুরি ভিত্তিতে।

বৃটিশ সংবিধানের প্রশংসাকারীরা এবং এর অংশীদারিত্বের আশির্বাদের প্রত্যাশাকারীরাই কংগ্রেসের “পূর্বের কর্মপন্থা” প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু সংস্থাটির কর্মশক্তির বাহকবৃন্দ, অচিরেই নতুন আঙ্গিকে কর্মপন্থার মূল্যায়ন গুরু করতে শুরু করলেন, এবার তাঁরা ইউরোপের বিদ্রোহ-সংক্রান্ত সাহিত্য, ভাৱতের অতীত পর্ব এবং বিদেশী অধীনতার বিরুদ্ধে কীভাবে লড়তে হয়-এর সফল কাহিনীর উদাহরণসমূহ সংগ্রামী আত্মবিশ্বাসের বলে বলীয়ান জনগোষ্ঠী যা বীররস এবং ভারতের ঐতিহ্যে-গাঁথা চমৎকার সব কাহিনীতে ঠাসা-যেমন, কল্পকাহিনী, প্রেমোপাখ্যান, রহস্য-কাহিনী (রহস্যোপন্যাস), আগ্রাসনকারীদের কাহিনী, দেশের আত্মসম্মান পুনরুদ্ধারের আবেদন সম্বলিত প্রায় বা আধা-ধর্মীয় বার্তা, দেশের ভিন্নমতাবলম্বী নেতৃবৃন্দ, যেভাবে ঢালাও প্রচার চালিয়েছিলেন যেমন-দয়ানন্দ, তিলক ও অরবিন্দ ঘোষ এবং ব্ৰহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রভৃতির উপরে সঠিক নির্দেশনা লাভের জন্য করতে শুরু করেছিলেন।

হিন্দুরা বহুলাংশ বর্ণবাদের শিকার, কিন্তু ইহা মুসলিম জনগণের প্রতি বিবেকহীন বৈরীতা বহন করে না। যখন লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে এক ডিক্রিবলে বাংলাকে বিভক্ত করলেন তখন বাংলার জনগণ এই বিভক্তির বিরুদ্ধে প্রচণ্ডতম ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং “রাজনৈতিক ভিক্ষার” বিরুদ্ধে সমরাভিযান শুরু করে দেয়, কারণ বাংলা ছিল সবচে’ বড় এবং সবচে’ প্রগতিশীল প্রদেশ। বাংলা তখন শুধু নিদারুণ যন্ত্রণায় আর্তনাদই করেনি-বিভিন্ন সভায় ও প্রতিবাদী ক্ষোভ মিছিলে যে সিংহের মতো হুংকার ছেড়ে গর্জে উঠেছিল প্রচণ্ডতম রোষে-যা ছিল সে সময়ে অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। তখন খেকে শুরু হলো বৃটিশের সব রকমের পণা-বর্জন অতিমান, দেশাত্মবোধক পণসঙ্গীত, বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার লেখনী, তথা বৃটিশ হঠাও সংক্রান্ত সব রকমের কর্মকাণ্ড। শেষমেষ কংগ্রেস মধ্যপন্থী ও উগ্রবাদী এ দু’দলে ধরতে গেলে ভাগই হয়ে গিয়েছিল, মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাব, প্রতিষ্ঠানটিকে দৃশ্যতঃ মহাত্মাজীর একাধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল ১৯১৮ দশক ও তার পর থেকে। এবং এ দশকেই ভারতে এক ধরনের ভয়শূন্য (রাজনৈতিকতাবে ও ধর্মীয়ভাবে) সন্ত্রাসীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভারতবাসী কোনদিনই এদেশের নিমক-খাওয়া সন্তান হিসেবে উপেক্ষা করবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশ স্বাধীন করার জন্য বিদেশী সাহায্যের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েই এতে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু সুচতুর বৃটিশ সরকার ঠাট্টার ছলে তু্র্কীর কথা তুলে ব্যাপারটা তখনকার মতো ধামাচাপা দিতে সক্ষম ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে রাশিয়া ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন যোগাতে ভুল করেনি, মহাত্মাজী অবশ্য দেশের আন্দোলনের হাল ঠিকই ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯২০-২২

এ সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় কংগ্রেস- খেলাফত আন্দোলনকারীরা যে দৃষ্টান্তমূলক ঘটনার অবতারণা করেছিল তা এখানে দু-বথায় বোঝানো যাবে না। সে সময় আলী ভাইদের নেতৃত্বে, তথা, হাকিম আজমল খান এবং আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে মুসলমানগণ এবং অন্যরা একসাথে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মহাত্ম গান্ধী ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন- স্বরাজ ১৯২১-এর আগেই আসছে। ভারতের জনগণের বাপুজীর উপর ভীষণ আস্থা, খুশিতে টগৰগিয়ে তামাম ভারতবাসী আন্দোলন করলো আরও ঘনীতূত। কিন্তু সবই বৃথা প্রমাণিত হলো। প্রিন্স অৰ ওয়েলস-এর ভারত সফরও কোন কাজে এলো না। বরং আগ্লেয়গিরির লাভার মতোই ব্যাপক হরতাল ও কৃষকদের খাজনা বন্ধ আন্দোলনগুলো আরও নাজুক করলো দেশের পরিস্থিতি। সি আর দাস, মতিলাল নেহেরু এগিয়ে এলেন কিন্তু পরিস্থিতি কিছুটা চা্ঙ্গা হলেও তিমিরেই রয়ে গেল দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। যে হিন্দু মুসলমান জনগণ এতদিন একসাথে স্বধীনতা যুদ্ধ চালিয়েছিল (১৯২০-২১) আবারও পাউরুটি এবং “মাংস’কে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি সৃষ্টি করা হয়েছিল তার জের হিসেবে শুরু হয়েছিল ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এই ধ্বংসাযজ্ঞ ভারতের সার্বিক পরিস্থিতিকে একটা আঁধারের সাগরে নিমজ্জিত করেছিল। বৃটিশ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শ্রেণি-সংগ্রামে রত শক্তিশালী শ্রমজীবীরা যাতে জাতীয় আন্দোলনের সাথে আঁতাত করতে না পারে সেজন্যে তাদের দূরে সরিয়ে রাখার উদ্যোগ নিয়েছিল।

গণ-অসহযোগ

১৯৩০-৩২-এর সংগ্রাম, তখনও সবার মনে জাগরুক ছিল। তারই প্রেক্ষাপটে এবং কিছুদিন পরে মহাত্মা গান্ধী যোগ দিতে গেলেন লন্ডন ‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স’ বা গোলটেবিল বৈঠকে ১৯৩১ সালে, এ সময় বর্ণগাহীনভাবে গণ-অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে সংগ্রামকারীদের প্রথম দফায় প্রায় ৯০,০০০ এবং দ্বিতীয় দফায় এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৮০,০০০-এ। ঠিক এ সময় কংগ্রেস হঠাৎ করে এ আন্দোলন বন্ধ করে দিল। কিন্তু সংগ্রামী জনতা কংগ্রেসের এ ডাক উপেক্ষা করে শেষতক স্বাধীনতার বিজয় ছিনিয়েই এনেছিল। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে মুসলমানদের জন্য এবং হিন্দুদের জন্য যথাত্রমেঃ পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান রাষ্ট্রদ্বয়ের অভ্যুদয় ঘটলো।

১৯৪২ সালের ঘটনাবলী দেখা যায়, শ্রমজীবী ও কৃষিজীবীদের শ্রেণি সংগ্রামের কথা যার জের এখনো শেষ হয়নি। এখনো তাদের শ্রেণি-সংগ্রামের নি্ষ্ঠুরতার কাহিনী সত্যসমাজকে পীড়া দেয়। আশা করবো, এমন একটা সময় আসুক যখন শ্রেণি-সংগ্রামের সহিংসতা ভুলে আমরা একে অপরের প্রতি সহনশীল হয়ে সুখে কালাতিপাত করতে সক্ষম হবো। এছাড়া সংগ্রামের মাধ্যমেই যে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি বৃটিশরাজকে আমাদের মাটি থেকে বিতাড়িত করে সে কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। এখন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবো এ স্বাধীনতার স্বাদ যেন সত্যিকার অর্থে অর্থবহ হয়।

* ভারতের দুটি ‘ডমিনিয়ন পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের উষালগ্নে এই নিবন্ধটি স্ট্যাটসম্যান পত্রিকায় কিশেষ সংখ্যায় ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। জাতীয় রাজনীতি (১৯৪৫-৭৫) সম্পর্কে ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’তে ২৬শে আগস্ট ১৯৮৮ প্রকাশিত একটি মুল্যায়ন:

In quest of source of political soul

A book review by AFSAN CHOWDHURY

Jatiyo Rajniti (National Politics) 1945 to 75

By Oli Ahad

Slowly but confidently autobiographies are lighting up the dark sky of our political memories. The number may not be too high right now but they have already gone beyond finger counting.

These autobiographies serve not just as source materials for studying our past but often defines the source of our political soul.

Oli Ahad is by any account one of the most controversial political leader and polemicists of our time, In fact it is his role as a gadfly and uncompromising critic of martial law that has over taken his identity as a purely party politician.

This if anything heightens his stature because at least he can go on record saying that he always put his money where his mouth was.

We surely do lack people who are willing to stand by and refuse to be tempted away from their beliefs, right or wrong.

In a straight forward and simple but highly causlic tone the 575 pages of the book rolls on. Oli Ahad has no desire to mince his words as he recounts and nor does he. Writing about “Gono Azadi League” which according to many was the first political outfit to oppose the concept of Pakistan outright, Di Ahad remarks, “Sad to say Gono Azadi League could never become an anisation. Reasons are firstly, the callous inactive role, fear of jail and lack any sense of sacrifice of its convenor Kamruddin Ahmed. Secondly, intense communal feeling sweeping the country at that time and thirdly, repression of the Muslim League government.

History is summarily dismissed in half a page.

In other words, the approach is that of an opinionated man who bothers little about what one says or thinks about him. This may sound strange but in an era where duplicity in both private and public life is so common the choleric but honest tone of Oli Ahad sounds almost refreshing.

What tires the reader a bit is of course the length and meandering form of the book. One finds little reason to justify sub-chapters on Lahore resolution and large quotes from it

There is hardly a book of history which doesn’t quote the document and Oli Ahad hasn’t added anything to our understanding of the (in) famous text which has shaped our history so much.

In fact Oli Ahad’s succumbing to the temptation to go inch by inch over every major political events finds him ultimately guilty of poor editing. Oli Ahad is under the notion that all his memories are worth relating and that relating all of them is what makes a memoir, political or otherwise.

But an autobiography is not a history text book which this book sometimes sounds like.

Had he been awarc of this position he could have looped off at least one third of the pages and included a few more anecdotes, But to cram many unnecessary facts into the book he had to be perfunctory more than once. This could have been avoided had he considered editing.

Another reason why he wrote as he did so could he that Oli Ahad found it impossible not to venture an opinion on every major historical event that over took Bangludesh.

At least that is what it would seem after reading the sub-chapter on Round Table Conference of 1970 returning from which Mujib criticized all his political opponents, Oli Ahad criticizes Mujib for doing so but this is old hat and other than hearing him tick off Mujib we were none the wiser.

 These statements shouldn’t prevent the reader from relishing Oli Ahad recalling event after event, struggle after struggle. He provides corroboration of innumerable facts a number of times and more than once provides fresh evidence and insight on many political mysteries.

Even his opinions are original and because he is not trying to justify some act of his own past or prove a point they become “true” and therefore valuable.

This book without frills, a collection of memory and opinions is a major historical document because it helps us understand the political as well as emotional background of a major figure of rightist politics in Bangladesh who has won respect from all for his political sincerity and incorruptability even if that respect came grudgingly from some.

জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে সাপ্তাহিক ‘হলিডেতে প্রকাশিত একটি মূল্যায়ন:

রাজনৈতিক আত্মার উৎসের সন্ধানে

আফসান চৌধুরী

ধীরে অথচ নিশ্চিত প্রত্যয়ে আত্মজীবনীমুলক লেখাগুলো আমাদের তমসাচ্ছন্ন রাজনৈতিক স্মৃতির আকাশ আলোকিত করে তুলছে। এর সংখ্যা এই মুহূর্তে খুব বেশি নয় হয়তোবা। কিন্তু অঙ্গুলী গণনাযোগ্য সংখ্যা অতিক্রম করে গিয়েছে।

এ সমস্ত আত্মজীবনী শুধুমাত্র অতীতকে জানার রসদই জোগায় না বরং আমাদের রাজনৈতিক আত্মার উৎসকে বিশ্লেষিত করে। অলি আহাদ যে কোন হিসেবেই আমাদের কালের অন্যতম বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিতর্কমূলক রাজনৈতিক বক্তব্যের জনক। প্রকৃতপক্ষে একজন নির্ভেজাল দলীয় রাজনীতিবিদের পরিচয়কে ছাপিয়ে সামরিক শাসন বিরোধী তার আপোসহীন ভূমিকা ও সমালোচনা তাঁকে স্বনামধন্য করেছে।

যদি কোন কিছু তাঁর ব্যক্তিত্বকে গৌরবোজ্জ্বল করে থাকে তা হচ্ছে তার সদা সাহসী স্পষ্টবাদিতা।

যারা সমস্ত প্রলোভনকে জয় করে স্বীয় বিশ্বাসে নিবেদিত তা ভুল বা নির্ভুল যাই হোক না কেন, আজকের দিনে নিশ্চিতভাবেই সেই চরিত্রের লোকের সংখ্যা বিরল।

সহজ, সরল, স্পষ্টবাদী অথচ খুবই ঝাঁঝালো সংগ্রামে বাঁধা ৫৭৫ পৃষ্ঠার এই বই কটি চলন্তিকা যেন। এ স্মৃতিচারণায় মোলায়েমভাবে কথা বলার বাসনা অলি আহাদের নেই। তা তিনি করেনওনি। গণ-আজাদী লীগের প্রসঙ্গে (যা অনেকে মতানুসারে পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণা বিরোধী প্রথম সংস্থা ছিল) অলি আহাদ মন্তব্য করেন দুঃখের বিষয় গণ-আজাদী লীগ কখনই একটি সংগঠন হতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ছিল; প্রথমতঃ এর আহ্বায়ক কামরুদ্দীন আহমদের উদাসীন ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, তাঁর জেলভীতি ও ত্যাগ-তিতীক্ষার অভাব। দ্বিতীয়তঃ দেশব্যাপী বিরাজমান তীব্র সাম্প্রদায়িক মানসিকতা। তৃতীয়তঃ মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতি। আধ পৃষ্ঠায় এ ইতিহাসের সমাপ্তি।

অন্য কথায় বলা যায়, তাঁর দৃষ্টিকোণ হচ্ছে একজন একগুয়ে ব্যক্তির, যিনি লোকে কি বলবে বা ভাববে তার তোয়াক্কা করেন না। অদ্ভুত মনে হতে পারে। এ যুগে যখন ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে দ্বিচারণাই সার্বজনীন তখন অলি আহাদের ক্রুদ্ধ ও সত্যনিষ্ঠ আওয়াজ বহুলাংশে প্রেরণাদায়ক।

অবশ্যই বইটির সুদীর্ঘ পরিক্রমা পাঠকের মনে ক্লান্তি এনে দেয়। লাহোর প্রস্তাবের উপ-অধ্যায়সমূহের বিশাল উদ্ধৃতিগুলোর যৌক্তিকতা খুব সামান্যই। দলিলের উদ্ধৃতি ছাড়া ইতিহাস লেখা হয় না। অলি আহাদ তা দিয়েছেন।

কিন্তু এই (কু) সুবিখ্যাত দলিলটি যা আমাদের ইতিহাসকে এতটা রূপ দিয়েছে তার অধিকতর অনুধাবনে অলি আহাদ নতুন কিছু সংযোজন করেননি।

প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে মন্থর গতিতে পরিক্রম করার প্রলোভন অলি আহাদের বইটির সম্পাদনাকে দুর্বল করে দিয়েছে। অলি আহাদের ধারণা, সব স্মৃতিই বর্ণনাযোগ্য আর সমস্ত বর্ণনা দিয়েই রাজনৈতিক বা অন্য কোন স্মৃতি কথামালা গাঁথা। কিন্তু আত্মকথা প্রামাণিক ইতিহাস হতে পারে না যা রচনা করার প্রয়াস মাঝে মধ্যে এ বইটিতে করা হয়েছে।

উপরোক্ত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকলে তিনি অন্ততঃ এক তৃতীয়াংশ বাদ দিয়ে আরো কিছু উপাখ্যান এতে সংযোজন করতে পারতেন। কিন্তু বহু অপ্রয়োজনীয় অংশ বইটিতে ঠেসে দিয়ে লেখককে একাধিকবার ছন্নছাড়া (দায়সাড়া সম্পাদক) হতে হয়েছে। সম্পাদনার গুরুত্ব উপলন্ধি করতে পারলে উপরোক্ ত্রুটি এড়ানো যেতো।

অলি আহাদ যেভাবে লিখেছেন তার আর একটি কারণ হতে পারে, যে সমস্ত প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছিল সেগুলো সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। অন্ততঃ ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠক থেকে ফিরে গিয়ে মুজিব উক্ত বৈঠকে যোগদানকারী সমস্ত রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেছিলেন। অলি আহাদ এ প্রসঙ্গে মুজিবের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এ-তো চর্বিতচর্বন। এতে করে মুজিব বিরোধী নতুন কোন জ্ঞান আমরা পাইনি।

এই বিবৃতিগুলো অলি আহাদের ঘটনার পর ঘটনা এবং সংগ্রামের পর সংগ্রমের স্মৃতিচারণকে উপভোগ করা থেকে পাঠককে নিবৃত করে না। তিনি অসংখ্য ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন এবং একাধিক রাজনৈতিক রহসোর তাজা প্রমাণ যুগিয়েছেন ও অন্তর্দৃষ্টিপাত করেছেন।

এমনকি তাঁর মতামতসমূহও মৌলিক। এবং যেহেতু তিনি তার অতীতের কোন কাজকে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রমাণ বা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেননি, সেগুলো “সত্য” বলে সপ্রমাণিত এবং এ জন্যই সেগুলো মূল্যবান।

বহু স্মৃতিকথা ও অভিমতের সমন্বয়ে অলঙ্কার বিবর্জিত এই বইটি একটি প্রধান ঐতিহাসিক পলিল। কারণ, এটি আমাদেরকে বাংলাদেশের এমন একজন দক্ষিণ-পন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক ও আবেগিক পটভূমি বুঝতে সাহায্য করে যিনি তাঁর রাজনৈতিক সততা ও দুর্নীতিমুক্ত চরিত্রের জন্য সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন, যদিও কারো কারো কাছ থেকে এসেছে ঈর্ষামিশ্রিত শ্রদ্ধা।

সেদিনের একুশ

: আনিসুজ্জামান

আমাদের কালের অনেকের জীবনের গৌরব এই যে, তারা একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের দুই মহৎ ঘটনার ১৯৫২-সালের রাষ্ট্রতাষা-আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার অংশীদার এসবই সৌভাগ্যবানদের আমিও একজন। হঠাৎ কখনো কখনো এসব দিনের অভিজ্ঞতা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে, আনমনা করে দেয়। আবার এও বুঝি, কালের ব্যবধানে কিছু স্মৃতি হারিয়ে যায়। কিছু তারিখের গোলমাল হয়। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ মুহূর্তের ভূমিকা। অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। তবু যেটুকু মনে পড়ে, সেটুকু প্রতিভাত হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয় বলে।

১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে আমি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই। এর অল্পকাল পরে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগদান করি। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে, মূলত অলি আহাদের উদ্যোগেই, যুবলীগের অফিস সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি।

উর্দু একমাত্র রষ্ট্রভাষা হবে, এই মর্মে পল্টন ময়দানে ৩০ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পর জগন্নাথ কলেজে রষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম না, যদিও পরিষদের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছি। ৪ ফেব্রুয়ারি ও ১১ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ দিবস উপলক্ষে স্থানীয় স্কুল-কলেজে ধর্মঘট আয়োজন করা এবং ভাষা আন্দোলনের পতাকা বিক্রি করা এসৰ কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। সহপাঠিদের সঙ্গে ট্রেনে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের পথে এবং ফিরতি পথে পতাকা বিক্রি করেছি। পোগোজ স্কুল, সেন্ট গ্রেগরীজ সকুলে ধর্মঘট করতে গিয়েছি। পুলিশ এসে পড়ায় সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলের গেটে অবস্থানরত আমরা দুজন সরে পড়তে বাধ্য হই।

আমরা মূলত যুবলীগের উদ্যোগে আন্দোলন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যুবলীগের সকল ইউনিটকে কেন্দ্রীয় নির্দেশ লিখে জানাবার দায়িত্ব ছিল আমার।

আমার যতদুর মনে পড়ে, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে একটি পুস্তিকা রচনার ভার মোহাম্মদ তোয়াহাকে দেয়া হয়েছিল। এমনও হতে পারে যে, যুবলীগই এই দায়িত্ব তাকে অর্পণ করেছিল; তবে সর্বদলীয় পরিষন থেকে তার পুস্তিকা বের হবে, এমন ধারণাই আমার জন্মেহিল। তোয়াহা সাহেব লিখতে দেরি করছিলেন। তখন অলি আহাদ আমাকে যখাশীঘ্র সম্ভব একটি পুস্তিকা লিখতে বলেন। আমি লিখে দিলে অলি আহাদ তা সংশোধন করে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নামে মুদ্রণ করেন। পুস্তিকাটির নাম ছিলঃ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। সাব-টাইটেল ছিলঃ কি ও কেন? পুস্তিকায় লেখক হিসাবে কারো নাম ছিল না। এটাই সম্ভবত ফেব্রুয়ারি মাসে ছাপা ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কিত প্রথম পুস্তিকা। এরপর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের পুস্তিকা বেরিয়েছিল। আমারটার চেয়ে আরেকটু বড় ও ভালো হয়েছিল। সেটি লিখেছিলেন বদরুদ্দীন উমর।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি হওয়ার পরে রাতে আওয়ামী লীগের নবাবপুর অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে সভা হয় তাতে জগন্নাথ কলেজ সংগ্রাম পরিযদের নাম করে পর্যবেক্ষক হিসেবে সৈয়দ আহমদ হোসেন ও আমি উপস্থিত ছিলাম। তখনই আমাদের মনে হয়েছিল সভায় বদি ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিন্ধান্ত গৃহীত হয়, তা কেউ মেনে নেবে না। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে আমাদের বাসা থেকে আমরা কয়েক বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে রওনা হয়েছিলাম থমথমে আৰহাওয়ার মধ্যে। আমার মা ও বোন সকলকে পরটা-ডিম খাইয়ে দিয়েছিলাম। মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে গেলে তাদের কি করণীয় হবে।

মোটামুটি ১৪৪ ধারা বাঁচিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে যে সংখ্যক ছাত্র প্রবেশ করছিল, তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, ১৪৪ ধারা ভাঙবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত-অনুযায়ী দশজনের এক-একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে রাস্তায় বের হতে শুরু করে। আমার যতদূর মনে পড়ে, প্রথম দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী, এখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। আমার সহপাঠি ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেয়ামল বাসির ও আমীর আলী সম্ভবত দ্বিতীয় ছিল। হাসান হাফিজুর রহমান স্মৃতিভ্রমবশত লিখেছেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে গুলি চালনার পর তিনি যখন প্রচারপত্র ছাপতে যান, তখন আমীর আলী তাঁর সঙ্গে ছিল।

প্রথম দল বেরিয়ে যাওয়ার পর অলি আহাদ মধুর দোকানের সামনে আমাকে ডেকে নিয়ে যুবলীগ অফিসের চাবি দিয়ে বলেন যে, যে কোনো মুহুর্তে তাঁরা গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। অফিসের দায়িত্ব আমার থাকবে। অবস্থা বুঝে অফিসের কাগজপত্র সরিয়ে নিতে হবে এবং সকল ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ইমদাল্লাহকে বাইরে রাখার চেষ্ঠা করা হবে। তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আমি যেন কাজ করি। এই দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে বলে আমি যেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করি। আমি তার কথা অনুযায়ী কাজ করছিলাম।

১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী দল ক্রমশ বাড়তে থাকে। পুলিশ কলাভবনের গেটের সামনে মৃদু লাঠি চালনা করে। তারপর কাঁদানে গ্যাস। ছাত্ররা ইট-পাটকেল মারতে থাকে পুলিশের দিকে। এ বিষয়ে নেতাদের নিষেধ তারা মানেনি। এক পর্যায়ে ভাইস-চ্যান্সেলর ডষ্টর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনকে কলাভবনের বারান্দায় দেখি। তাকে দেখে বেশ কিছু ছাত্র দৌড়ে যায় এবং তাকে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে বলে। আমি তখন গা থেকে গেঞ্জি খুলে পুকুরে তা ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম চোখে পানি দেয়ার জন্য। আমি অন্য ছাত্রদের পিছু পিছু তাঁর দিকে গিয়েছিলাম। ভাইস-চ্যান্সেলর বলেছিলেন যে, পুলিশ তার কথা শোনেননি এবং তিনি প্রতিবাদ করবেন।

মধুর দোকানের পাশের রেলিং টপকে ততক্ষনে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সবাই সমবেত হতে শুরু করেছিল। সেখান থেকেও পুলিশের দিকে কিছু ইট ছোড়া হয়। তারপর হাসপাতালের পশ্চিম দিকের রেলিং পেরিয়ে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে সকলে জড়ো হয়। হোস্টেলের গেট দিয়ে রাস্তায় বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠি চালায় এবং হোস্টেলের মধ্যে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। গ্যাসের টিউৰ পায়ে এসে পড়ায় বছর দশেকের একটি ছেলে আহত হয়। আমরা জনতিনেক মিলে তাকে ধরে রেলিংয়ের উপর অন্যদের হতে তুলে দিই-হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

হোস্টেলের প্রাঙ্গণে যাদেরকে দেখেছিলাম, তাঁদের মধ্যে ইমাদুল্লাহ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান ও মুর্তজা বশীরও ছিলেন। এক সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ আমাকে বলেন, গুলি চালাতে পারে। তার মিনিট পনেরো পরই গুলি চলে। গুলিতে আহত একজনকে মুর্তজা বশীর ধরেছিলেন, সে কথা পরে তিনি আমাকে বলেন।

গুলি চলার পর পরই আমরা শুনতে পাই যে, আবুল বরকত, সালাম ও রফিকউদ্দিন নামে তিনজন ছাত্র মারা গেছে। এই সালামকে আমরা মেডিক্যাল কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্র (এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক) সালাম বলে ধরে নিয়েছিলাম। পরে জানা যায় যে, তিনি মারা যাননি। গুলিবর্ষণের পরে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের একটি ঘরে মাইক্রোফোন বসানো হয়। যিনি পারছিলেন তিনিই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমাকে একটা বক্তৃতা লিখে দিতে বলা হয়। কিন্তু বলার গতির সঙ্গে লেখার গতি তাল রাখতে পারছিল না। ফলে আমাকে মাইক্রোফোন নিতে বলা হয়। আমি পুলিশদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতা দিই; পুলিশ ধর্মঘটের সময়ে সরকার তাদের ওপর যে নির্যাতন চালায় তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাঙালি হিসাবে তাদেরকে আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে বলি। আমি অল্পক্ষণ বলেছিলাম। তোয়াহা সাহেবও সেখান থেকে বক্তৃতা করেন। শুলি চালানোর সংবাদ পেয়ে বেতারকর্মীরা যে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে কথাও আমি মাইকে ঘোষণা করি আরেক দফায়। পরে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ পরিষদ থেকে বেরিয়ে এখানে এসে বক্তৃতা দেন।

পরে সন্ধ্যার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে রেল লাইন ধরে আমি বাসায় ফিরে আসি।

২২ তারিখে আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজামানের সাইকেলে চেপে আমি বিশেষ করে নেয়ামল বাসিরের জামিন নেওয়ার উদ্দেশ্যে মাহতটুলীতে সৈয়দ আবদুর রহিম মোক্তারের কাছে যাই। উনি ততক্ষণে কোর্টে চলে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ কোর্টে ঘোরাফেরা করে কাউকে না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসি। ইতিমধ্যে অনেকগুলো মিছিল বেরিয়েছিল। ফেরার পথে নবাবপুরে গুলিচালনার খবর পাই। একটা ল্যাম্পপোস্টে গুলির দাগ সকলে মিলে দেখছিলাম। সংবাদ অফিস আক্রান্ত হচ্ছে, তা দূর থেকে দেখি। হাইকোর্টের সামনে গুলি চলেছে জেনে ওখান থেকেই ফিরে আসি।

২৩ তারিখে আব্বার গাড়িতে (ডাক্তার লেখা) করে লক্ষ্মীবাজারের একটা দোকান থেকে মাইক্রোফোন ভাড়া করে জগন্নাথ কলেজে নিয়ে যাই। কলেজের হোস্টেলের একটি ঘরে তা স্থাপন করে সেখান থেকে বক্তৃতা দেওয়া হয়। আমি কিছুক্ষণ বলেছিলাম। তারপর ওই উদ্যোগের সঙ্গে আর আমার যোগ ছিল না। সম্ভবত ২৫ তারিখে পুলিশ হোস্টেলে ঢুকে মাইক নিয়ে চলে যায়।

প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণের (২৩ ফেব্রুয়ারি) সময়ে আমি অল্পক্ষণ উপস্থিত ছিলাম। পরদিন আবুল কালাম শামসুদ্দিন তা উদ্বোধন করেছিলেন বলে মনে পড়ে। মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ চোট্ট বক্তৃতা দিয়ে মোনাজাত করেছিলেন। আমার আব্বা ও মা রিকশায় করে শহিদ মিনারে গিয়েছিলেন বিকেলে। সকলেই শহিদ মিনারে টাকা পয়সা দান করছিলেন। মা সৈয়দা খাতুন একটি সোনার চেন দেন। চেনটা ছিল আমার মৃত একটি ছোট বোনের। তার স্মৃতি হিসাবে মা এটি রক্ষা করেছিলেন। মুর্তজা বশীরের একটি কবিতায় এই সোনার হারটির কথা আছে। মা এটা যে মিনারে দিয়ে আসবেন, তা আমরা কেউ জানতাম মা। উনি দিয়ে এসে আমাদের বলেছিলেন।

নেতাদের নামে হুলিয়া বেরিয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে তাঁরা খানিকটা আত্মগোপন করেছিলেন। শহিদ মিনার পুলিশ যখন ভেঙে দেয়, তখন হাসপাতালের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। আমার মনে পড়ে, অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে ইমাদুল্লাহ ক্যামেরা ক্যামেরা বলে চিৎকার করছিলেন, বলছিলেন, ওরা মিনার ভাঙছে, কেউ একটা ছবি তুলে রাখো।

বাংলা বিভাগের রফিকুল ইসলাম বোধ হয় মাথার খুলি উড়ে যাওয়া রফিক উদ্দিনের ছবি তুলেছিলেন। সেটা ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সামগ্রিক ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ওই আহ্বান জানিয়ে আমি একটা প্রচারপত্র তৈরি করি। পাকিস্তান বুক ডিপোর মালিকের ছেলে মাখন (বদরুদ্দীন আহমদ, এডভোকেট) তাঁদের প্রেসে সেটা ছেপে দিয়েছিলেন। এই যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে আমাদের সিনিয়র ছাত্র আনোয়ার হোসেন (তাঁর বাবা খন্দকার আহমদ হোসেন চীফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, রাজনীতিবিদ দেওয়ান মাহবুব আলী পরে আনুর বোনকে বিয়ে করেন।) ইশতেহার ইত্যাদি অনেকে লিখতেন এবং প্রচার করতেন। মেডিক্যাল কলেজ, সলিমুল্লাহ মুসিলম হল, জগন্নাথ কলেজ এসন সংগ্রাম পরিষদ থেকে স্থানীয়ভাবেও প্রচারপত্র বের হতো।

২২ বা ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ইমাদুল্লাহ আর আমি যুবলীগ থেকে কিছু দরকারি কাগজপত্র আর টাইপরাইটারটা আমাদের বাসায় (৮৭ বামাচরণ চক্রবর্তী রোডে) নিয়ে আসি। পরে যুবলীগ অফিস পুলিশ সীল করে দেয়। কিন্তু ইউনিটগুলোর ঠিকানা আমাদের কাছে থাকায় আমরা কিছু চিঠিপত্র পাঠাতে সমর্থ হই। সেসব চিঠিপত্র ইমাদুল্লাহ সই করেন।

বোধহয় ২৫/২৬ তারিখে অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন ও ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য নেতার নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানার প্রকাশা বিজ্ঞপ্তি কাগজে বেরিয়ে আসে। তারা আত্মগোপন করেন। অলি আহাদের ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, ডঃ আবদুল করিম আমার বাসায় এসে খবর দেন যে, অলি আহাদ আত্মগোপন করেছেন। তবে চিরকুটে কেউ বিশেষ একটা শব্দ লিখে আনলে আমাকে বুঝতে হবে যে, অলি আহাদ তাকে পাঠিয়েছিলেন। আমি প্রথম বার্তা পাই চিকি্ৎসক ডাঃ এম, এ. করিমের মাধ্যমে। তিনি এককালে জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন, তখন যুবলীগে ছিলেন, পরে কিশোর মেডিকাল হল নামে নবাবপুরে একটি ফার্মেসী প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভাসানী ন্যাপে সক্রিয় হন। এই বার্তায় কিংবা তার পরে আরেকটি বার্তায় নির্দেশ ছিল একজনের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি আমার এক ক্লাশ উপরে পড়তেন বোধ হয়। যাই হোক, তার সঙ্গে সন্ধ্যায় রানকিন স্ট্রীটের উল্টোদিকে ভূতের গলিতে একটা বাসায় ঘাই। অলি আহাদ সেখানে ছিলেন। তিনি আমাকে বলেন, শান্তিনগরে ডাক্তার মোতালেবের বাসায় তাকে পৌঁছে দিতে হবে। সে বাসা আমি চিনতাম তা তিনি কোনোভাবে জেনেছিলেন। ডাক্তার মোতালেবের অনুজ আবদুল মালেকের সঙ্গে আমার এক সময়ে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল-তিনি এককালে র‍্যাডিক্যাল দলে সক্রিয় ছিলেন। আমি রিকশায় করে অলি আহাদকে সেখানে পৌঁছে দিই। তখন জেনেছিলাম যে, ভাষা-আন্দোলনের নেতারা সেখানে বৈঠকে বসবেন। আমি যেহেতু সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলাম না, সেহেতু ওই বৈঠকে আমার উপস্থিত থাকবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। অলি আহাদকে পৌঁছে দিয়েই আমি চলে আসি। পরে কাজী গোলাম মাহবুব ছাড়া সভার আর সকলেই সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। মাহবুব সাহেব পুলিশ আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মাচায় উঠে লুকিয়ে থাকেন। পরবর্তীকালে তিনি আত্মসমর্পন করেন। আন্দোলনের নেতারা সকলে বন্দি হয়ে পড়েন।

ভাষা আন্দোলনের প্রবাহে এভাবে ভাটা পড়ে। ২২ ও ২৩ তারিখে স্বতঃস্কূর্ত হরতাল হয়েছিল। ২৪ তারিখ রোববার ছিল। ২৫-এর হরতাল সফল হয়নি। ২৬ তারিখ অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তারপর নেতৃত্বের মধ্যে যোগাযোগের অভাব ঘটে। দমননীতির জন্য কর্মসূচীও ঠিকমত উপস্থিত করায় বিঘ্ন ঘটে। ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হওয়ার আগেই আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। আমার শুধু এইটুকু মনে পড়ে যে, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের সংগ্রামী ভূমিকা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রবীণ নেতারা সবটা অনুমোদন করেননি। তাছাড়া, আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সভায় যদি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত হয়, ফলে পরিষদ আপনিই ভেঙে যাবে।

সাধারণ ছাত্র-যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল তারা মার্চের মাঝামাঝি সকলেই ছাড়া পেয়ে যায়। নেতাদের বহুদিন আটকে রাখা হয়েছিল। তবে একুশের চৈতন্য ততদিনে ব্যাপ্ত হয়েছিল দেশময়।

তারপরও খুব অর্থবহভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে আমাদের জীবনে। ১৯৫৫ সালে ৯২-ক ধারার আমলে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের বিষয়টিও ছিল প্রথম একুশের ঘটনার মতোই দুঃসাহসিক অভিযানের মতো। ১৯৫৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল বিজয়োৎসবের মতো। কারণ সদ্য বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাঘার মর্যাদা পেয়েছে সংবিধানে। স্বাধীন বাংলাদেশে একুশে উদদাপনের অনুভূতি খুবই ভিন্নরকম ছিল ১৯৭২ সালে। আর এই শহিদ মিনার আবার ভাংলো, আবার গড়ে উঠলো এবং চিরকাল রয়ে গেলো আমাদের সকলের মিলনক্ষেত্র হয়ে। কিন্তু সেসৰ কথা আজ নয়।

*ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণমুলক এই লেখাটি ’৯৫ এর ২১শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজে ছাপা হয়।

*উপরোক্ত প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাবিবুর রহমান শেলী ১৪৪ ধারা ডঙ্গের প্রথম দলের নেতৃত্ব দিয়াছেন বলিয়া যে উল্লেখ আছে তাহা সঠিক নয়। প্রকৃত ঘটনা ছিল, মেডিফেল কলেজ ছাত্র আজমল হোসেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম দলের নেতৃত্ব দেন।-অলি আহাদ।

অলি আহাদকে, একজন কবির শ্রদ্ধা

উনিশশো সাতচল্লিশ সালের কিছু কিছু ঘটনার কথা এখনো আমার বিস্ময়কর ভাবে মনে আছে। আটচল্লিশ সালেরও। তখন আমি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। আটিচল্লিশ সালে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। এক বিস্ময় আর মুগ্ধতার অগতে তখন আমার বসৰাস। যেমনটি পৃথিবীর সকল কিশোর আর বালকের জীবনে হয়ে থাকে। ঢাকা তখন অতি ক্ষুদ্র একটি মফঃস্বল শহর মাত্র। দেড় লক্ষ থেকে দুলক্ষ লোক ঢাকা শহরের বাসিন্দা। দোলাইখাল তখন আমাদের কাছে একটি অন্তরঙ্গ ছো্ট নদীর মতো রক্ত কণিকায় বহমান আর বুড়িগঙ্গা বিশাল আকাশের এক একান্ত প্রতিনিধি। বুড়িগঙ্গার ওপারে যে গ্রাম-সেই গ্রামের শ্যামল গাছগালা আর সবুজ অবারিত মাঠে মিশে আছে গগণের আশ্চর্য ললাটে। আমরা তখন স্বপ্নহীন ছিলাম না আশাহীন ছিলাম না এবং নিশ্চিত ভাবেই ভবিষ্যৎ বিহীনও ছিলাম না।

সেই সময়কার কিছু কিছু ঘটনা আমার, আগেই বলেছি, আশ্চর্যভাবে এখনো মনে আছে। তার একটির অকুস্থল ঢাকার রমনা রেসকোর্স। আজকের সোহরাওয়াদী উদ্যান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব তখন ঢাকায় এসেছিলেন। সেই একবার, গ্রথম বার এবং শেষবার। ১৯শে মার্চ তিনি ঢাকা এসেছিলেন। আর ঢাকা রেসকোর্সে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ২১ মার্চ। এই দিনক্ষণের হিসেব আমার মনে থাকার কথা নয়। এগুলো আমার এখনকার সংগ্রহ। আমি ২১ মার্চের সেই ঐতিহাসিক সভায় উপস্থিত ছিলাম। জিন্নাহ সাহেবকে দেখতে সেই সময় সেই রেসকোর্সে প্রায় তিন লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটেছিলো। আমার জীবনে এতো বড় জনসমুদ্র সেই আমার প্রথম দেখা। সেই সময় কেমন করে যেন আমি পুরানা ঢাকার দক্ষিণ মৈশন্ডি এলাকা থেকে হেঁটে হেঁটে রেসকোর্স পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। এখন তা আমার মনে নেই। তবে আমি যে আমার কলেজে পড়া এক মামার সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম সব সময় সেটা বলতে পারি। মামা বলেছিলেন মিটিং দেখার এমন সুযোগ আর হবে না কোনোদিন। আমার মামার কথার মধ্যে সম্ভবতঃ একটি অন্তর্গত সত্য নিহিত ছিলো- যা ইতিহাসের ক্রম পরিত্রমায় এখন প্রমাণিত হয়েছে।

ফিরে আসি আমার কৈশোরের সেই রেসকোর্সে।

আমি আমার মামা এবং আরো যেন কে কে- সর্বমোট চারজন ছিলাম আমরা।

কেমন করে যেন মামা আমাদেরকে মঞ্চের সামনা সামনি নিয়ে এসেছিলেন।

বলেছিলেন এখান থেকে জিন্নাহ সাহেবকে স্পষ্ট দেখা যাবে।

এবং কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সেদিন মঞ্চের অপরাহ্নের আলোতে

আমরা সত্যি স্পষ্ট সেখেছিলাম। তার ভগ্নী মিস ফাতেমা জিন্নাহকেও।

সেদিন ওধু শুনেছিলাম, দেখেছিলাম এবং প্রত্যক্ষ করেছিলাম। বুঝিনি। জানিনি।

এখন বুঝি এবং জানিও।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেইদিন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে তার সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতায় নিজেই বপন কারেছিলেন পাকিস্তানের ধ্বংসবীজ। জানিনা কার পরামর্শে কোন সে ব্রীফিং এর কারণে তার এমন ধারণা জন্মেছিলো যে উর্দ্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিৎ। কী সে মহৎ স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সেদিন যার কারণে তিনি প্রায় তিন লক্ষাধিক বাঙালির সামনে মঞ্চ থেকে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, উর্দ্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, অন্য কোনো ভাষাই হতে পারবে না, বলতে পেরেছিলেন, Urdu and Urdu alone shall be the state language of Pakistan- no other language ca be কায়েদে আজম এমন একটি ঐতিহাসিক জনসভাকে কেন যে বাঙালিদের সামনে এই অসম্ভব একটি উচ্চারণ করার যথোপযুক্ত স্থান ভেবেছিলেন তা আজো আমার বোধের অগম্য রয়ে গেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত মাসের মাথায় কেন যে তিনি তার ধ্বংসবীজের প্রথম শস্যকণাটি নিজেই রোপন করে গিয়েছিলেন বাংলার মাটিতে তা এখনো আমার কাছে এক পরম বিস্ময়।

মঞ্চের সামনে বেশ অনেকটা জায়গা শূন্য ছিলো। সম্ভবতঃ সিকিউরিটির কারণে যেমনটি এ ধরনের সভায় হয়ে থাকে। তারপরই ছিলো জনমানুষের স্থান।

আমরা সেখানেই ছিলাম। বসেছিলাম প্রায় সামনের সারিতে।

তখনকার ঢাকা শহরের যত বাসিন্দা ভার প্রায় দ্বিগুণ বাঙালির এক অচিস্তনীয় মহাসমুদ্র সেদিন প্রায় রুদ্ধশ্বাস হয়ে মুগ্ধতার এক বর্ণাঢ্য আবীর মেখে চোখে শুনছিলো জিন্নাহ সাহেবের ইংরেজি ভাষার বক্তৃতা। এতোঁ যে মানুয ছুটে এসেছে এই বাংলার অসংখ্য প্রান্তদেশ থেকে তাদের আসল পরিচয় কী জানতেন জিন্নাহ সাহেব? তারা তো শুধু মুসলমান ছিলো না বাঙালিও ছিলো এবং পাকিস্তান নামক একটি নতুন বাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার জন্যে তারা তো কোথাও এমন কোনো অঙ্গীকার করেনি যে তারা তাদের বাঙালি পরিচায়কে পরিত্যাগ করবে চিরদিনের জন্যে-তাদের মুখের ভাষাকে বিসর্জন দেবে সকল আগামীকালের সমাজ সংস্কৃতি ধর্ম প্রাত্যহিক জীবন কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল কর্মকান্ড থেকে। তাহলে ডিন্নাহ সাহেব কেন এমন উচ্চারণ করলেন বাঙালিদের সামনে এদেশে তার প্রথম জনসভায়।

আমার মামা সত্যি বলেছিলেন এমন জনসভা সারাজীবনে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না।

জিন্নাহ সাহেবের সেই দিনের সেই উচ্চারণ সেদিন শুনেছিলো বাঙালিরা।

গুম্ভিত হয়েছিলো কিন্তু স্তন্ধ হয়নি।

সেই বিশাল জনসমুদ্রের এক প্রান্ত থেকে কারা যেন প্রখম পাল্টা উচ্চারণ করে উঠলো শেম শেম শেম শেম। অসংখ্য অগ্নিকণার মতো সেই শেম শেম ধ্বনি নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো সারা রোসকোর্স জুড়ে। মিনিট দুই এর কম সময় নয় সেই লজ্জা লজ্জা শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বানিত হল রমনার বিশাল বটগাছে পাতার মর্মরে যাসের শুকনো শরীরে। মনে হল সারা পূর্ব বাংলা যেন সমবেত এক ধিক্কারে উচ্চারণ করছে হায় একি লজ্জা এই নতুন স্বাধীনতারঃ আমার মায়ের কষ্ঠে শানিত অস্ত্র চালাবার একি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এই নতুন বাঙালির?

একটু আগে আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে কৰি গোলাম মোস্তফার গানে মুখরিত ছিলো এই খেলার মাঠ-এই রেসকোর্সের ময়দান।

হঠাৎ একি হল। এ কোন পতনধ্বনি নামলো পূবের বাংলা জুড়ে।

এই যে সেদিনের কথাগুলো লিখলাম এতোদিন পরে। সে সময় কিন্তু ঠিক এমনি করে আমি মোটেই ভাবতে পারিনি। তবে আমার মধ্যে একটি উীষণ খারাপ লাগা যে কাজ করছিলো তখন সেটা বলতে পারি। হলফ করে বলতে পারি। এবং আমার মতো সবারই খারাপ লাগছিলো। সেই মাঠের সবার।

জিন্নাহ সাহেবকে মাইকের সামনে আমরা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম।

জনসমুদ্রের এই আকস্মিক বিস্ফোরণের জন্যে জিন্নাহ সাহেব নিশ্চয়ই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি কেমন যেন হয়ে গেলেন হঠাৎ। তার স্বতঃস্ফূর্ত ইংরেজি বক্তৃতায় হঠাৎ ক’রেই যতি নামলো। সামান্য বিরতি! তারপর পুনরায় কম্পোলড হলেন তিনি। তিনি পরিস্কার উর্দ্দুতে বললেন, অদ্ভূত এক কমান্ডিং কষ্ঠে- খামোশ রহো অওর আপনা আপনা জাগাপে বয়ঠো। তিনি আবার ফিরে গেলেন ইংরেজিতে। এবং অল্প ক্ষণের মধ্যেই সভা সমাপ্ত হল।

আমার মামা শুধু বললেন, কাজটা ভালো হল না। মাতৃভাষার উপর আক্রমণ কেউ মেনে নেবে না। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধবেই। আজকের মাঠই তো তার প্রমাণ। আজকের এই বিশ্ফোরণের যে-ই শুরু করুক না কেন একটা সাহসের সূচনা করেছে সে। একটি নতুন জিজ্ঞাসার নতুন অনুধাবনের।

বহুদিন পরে আমরা জেনেছি, অন্তত আমি জেনেছি সেই বিপ্ফোরণের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন অলি আহাদ। যাকে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া বলেছেন “অলি আহাদ আমাদের রাজনীতিতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। নীতির প্রশ্নে কখনো আপোষ করেননি। প্রলোডন কখনও তাকে বশীভূত করেনি। বলা যায় তিনি আজ রাতির বিবেকে পরিণত হয়েছেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে পড়ি। তখন আমি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলাম না, এবং এখনো নেই, তবু ভাষা আন্দোলন আমাকে কেমন করে যেন জড়িয়ে ধরেছিলো। এবং সেই সময় আমি প্রথম অলি আহাদের নাম শুনি। ক্রমে জানতে পারি অলি আহাদ সেই ব্যক্তি যিনি ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যের প্রধান চালিকা শক্তির সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিলেন।

অলি আহাদ সাহেবের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ আরও অনেক অনেক পরে। তবে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা কখনো হয়নি। আসলে রাজনৈতিক বিশাল ব্যক্তিত্ব যারা তাদের কারো সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতার কোনো সুযোগই তখন ছিলো না- আর এ সম্পর্কে উৎসাহীও ছিলাম না। যদিও আমার জীননের একটা বড় অংশই আমি কাটিয়েছি সাংবাদিকতার পেশায়। এসব সত্ত্বেও বায়ান্ন সালের পর থেকেই আমি অলি আহাদ-এই নামের যে মানুষটি তার জন্যে একটা গোপন শ্রদ্ধা সব সময়েই পোষণ করে আসছি। তার অনেক গল্পও শুনেছি-সপক্ষে এবং বিপক্ষে। বেশির ভাগই সপক্ষে। সব কিছুকে ছাপিয়ে একটি ঘটনাতে তার সম্পর্কে সবাই একমত হতেন, এখনো হন, অলি আহাদ আমাদের ইতিহাসের আধুনিক কালের সেইসব বিরল মানুষদের একজন যাকে সত্যনিষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করা যায়। বাংলাদেশের এখনকার যিনি প্রধানমন্ত্রী সেই খালেদা জিয়া যখন বলেছেন, তিনি আজ জাতির বিবেকে পরিণত হয়েছেন- তখন তিনি নিঃসন্দেহে কোনো অতিশয়োক্তি করেননি।

জনাব অলি আহাদ তার রচিত জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ গ্রন্থটিতে অনেক দুর্লভ এবং অমূল্য তথ্য আমাদের জন্যে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত পত্রও প্রকাশ করেছেন। আমি এখানে একটি কি দুটি পত্র থেকে অংশ বিশেষ উল্লেখ করতে চাই। করাচির ৭ নম্বর সমারসেট হাউস থেকে ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৫৬ সালে লেখা একটি পত্রে শেখ মুজিবুর রহমান অলি আহাদকে একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিলেন, “তোমাকে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটু অনুরোধ করিতে চাই। আমার ছেলে কামালউদ্দীনকে সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট স্কুলে এবং মেয়েকে (হাসিনা) কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল অথবা বাংলা বাজার স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য দয়া করিয়া চেষ্ট করিবা। তাহাদের জন্যে একজন ভালো শিক্ষক যোগাড় করিবার চেষ্টা করিবা। সব সময়েই তোমার ভাবীর সহিত যোগাযোগ রাখিবার চেষ্টা করিবা। সে-ও খুব নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছে। আমি ভাল। আমার কাছে চিঠি দিও। – তোমারই মুজিব ভাই।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিঠির এ সামান্য উদ্ধৃত অংশ থেকেই বোঝা যায় অলি আহাদকে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কতটুকু ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। আর একটি চিঠিতে মুজিব লিখেছেন, “শরীরের প্রতি যত্ন নিও। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তোমার হতভাগা ভাইকে লেখতে ভুলিও না।

আমার কাছে অলি আহাদ আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা। খালেদা জিয়াও এমন কথা বলেছেন। “ইতিহাস বিকৃতির শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ সত্যটি আজ ১২ কোটি মানুষের কাছে স্পষ্ট যে অলি আহাদ মহান ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা”- এ উক্তি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার।

১৯৪৮ সালে রমনার রেসকোর্সের ময়দানে যে প্রতিবাদী কণ্ঠের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আমি প্রায় বালক বয়সে শুনেছিলাম দেখেছিলাম, সেই ধ্বনি তরঙ্গের অন্যতম নির্মাতা ছিলেন অলি আহাদ। সেই ভাষা আন্দোলনই ১৯৫২ সালে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও ডাইমেনশান পেয়েছিলো। পাকিস্তান জেনেছিলো, সারা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করেছিলো পূর্ব বাংলার মানুষ যুগগৎ বাঙালি এবং মুসলমান। জেনেছিলো, বাঙালি মুসলমানরা একটি পৃথক জাতি হিসাবে বাঁচতে চায়। এবং পরবর্তীকালে এই মানসিক অস্তিত্ব থেকেই বাঙালিরা একদিন স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলো। উনসত্তরের গণ আন্দোলনে দিয়েছিলো আত্মাহুতি। ১৯৪৮ সালের সেই শেম, শেম প্রতিবাদ থেকে ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষ একটি মুক্তিযুদ্ধের পতাকাকে উত্তোলন করেছিলো। এনেছিলো স্বাধীনতা।

আমি কী এখন বলবো যে, অলি আহাদ নামের একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষ আমাদের স্বাধীনতার প্রথম ধ্বনিটি উচ্চারণ করেছিলেন। সূত্রপাত করেছিলেন একটি নতুন সংগ্রামের।

আমি একজন সামান্য কবি মাত্র। রাজনীতির সর্পিল পথ আমার জন্যে নয়। আর এ ব্যাপারে আমি কোনো শেষ কথাও বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই আমাদের রাজনীতিতে এই যে একজন সত্যিকার সত্যনিষ্ঠ সেনানী তাকে যেন আমরা চিরকাল শ্রদ্ধা করি, মনে রাখি। কেননা সত্যকে নির্বাসিত করা মানেই জীবনের উল্টো দিকে যাত্রা করা।

জনাৰ অলি আহাদঃ আমার শ্রদ্ধাভাজন। তাঁকে নিয়ে নির্মিত বর্তমান সম্মাননা গ্রন্থটিতে এদেশের বহু গুণী মানী শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা লিখেছেন। এমন একটি গ্রন্থের ভূমিকা রচনার কোনো যোগ্যতাই আমার নেই। সুতরাং আমার এ ক্ষুদ্র লেখাটিকে কোনো ভূমিকা মনে না করে জনাৰ অলি আহাদের প্রসঙ্গে একজন কবির শ্রদ্ধার্ঘ মনে করলেই যথার্থ হবে। এ কাজের জন্যে আমাকে অনুরোধ করায় স্রেহভাজন মুন্সি আবদুল মজিল-কে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।

আমার বিশ্বাস বর্তমান বাংলাদেশকে একমাত্র আমাদের সততাই বাঁচাতে পারে।

ফজল শাহাবুদ্দীন

নিভৃতি। ১১/১ মধ্য বাসাবো, ঢাকা ১২১8। ১১.১২.২০০২ বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ থেকে প্রকাশিত “চির বিদ্রোহী অলি আহাদ” পুস্তকে বরেণ্য কবি ফজল শাহাবুদ্দিন কর্তৃক

ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে

শামসুল আলম

দৈনিক ইনকিলাবে প্রদত্ত ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ সালে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ভাষা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক সর্বদলীয় রষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রথম আহ্বায়ক, তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জনাব শামসুল আলম এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত নিম্নে উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো।

ইনকিলাবঃ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতির প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?

শামসুল আলমঃ ইতিহাস বিকৃতির প্রশ্নটি আসে গবেষণা ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বন্তনিষ্ঠতা লংঘিত হলে। বন্তুতঃ ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে- এ পর্যন্ত যতগুলো গবেষণা কর্ম, সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে- কোথাও কেউ ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যেতে পারেনি। অথচ তখন যে কয়টি রাজনৈতিক দল (মুসলিম লীগ, কমউনিস্ট পাটি, ও জামায়াত ইসলামী) ছিল, কেউই। আন্দোলন সমর্থন করেনি। ………….. অথচ এই সত্যকে পাশ কাটানোর উদ্দেশেই অনেকে ভাষা আন্দোলনকে বায়ান্নোর একটি বিএডিএস থেকে প্রকাশিত বইতে ভাষা আন্দোলনকে উপস্থাপন করা হযেছে সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভংগী থেকে। শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব দিয়ে কার্যতঃ তখন তার প্রশ্নই ছিল না। সত্যি বলতে কি ভাষা আন্দোলনের জড়িতদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। কিন্তু আমি অবাক হই প্রচারগুণে কীভাবে ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পর্কহীন ব্যক্তি এ বিষয়গুলো ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের অনেক পরিচিত নাম ও বিষয়াবলী প্রচার যন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভাবের ফলে ইতিহাসের নেপখ্যে চলে যাচ্ছে। অথচ এই পুরো প্রক্রিয়াটির সাথে জড়িত থেকেও সরকার এমনভাবে দেখাচ্ছে যে, তারা অবহিত নয়। কার্যতঃ সরকারই এসব পৃষ্ঠপোষণ করছে। ফলে নতুন প্রজন্ম একটি ইলিউশননে পড়ে গেছে। তারা দিকভ্রান্ত হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের সত্যিকার এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে ‘ইলিউশনের মাধ্যমে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। তারা জানে না “অলি আহাদ ইজ এ রিয়েল হিরো অব ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট।”

মুক্তিযুদ্ধঃ তদানীন্তন বিএসএফ প্রধান

গোলক মজুমদারের সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভারতের সামরিক বাহিনী বিএসএফ-এর মাধ্যমেই প্রাথমিক ধারণা পেয়েছিল-

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি সীমাত্ত নিরাপত্তা বাহিনী বিএসএফ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তখন বিএসএফ এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ছিলেন গোলক মজুমদার। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতায় পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিয়েছিলেন।

বিএসএফ প্রধান গোলক মজুমদার ছাড়াও আমি আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ বিএসএফ কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করি, তিনি হচ্ছেন শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বিএসএফ-এর গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। মূলধারা ৭১ গ্রন্থের লেখক মঈদুল হাসানও তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে জানার জন্য।

এই সাক্ষাৎকারে গোলক মজুমদার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর এবং তর্কসাপেক্ষ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। সাধারণভাবে বিএসএফ গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে তখন র’-এর সম্পর্ক ভাল ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সাহায্যের ধরন ও রাজনৈতিক প্রকৃতি সম্পর্কে ‘র’ এবং বিএসএফ-এর অবস্থান ছিল দুই বিপরীত মেরুতে। বিএসএফ তুলনামূলকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল ভারতের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সামরিক বাহিনীর প্রাথমিক ধারণা এবং যোগাযোগ বিএসএফ-এর মাধ্যমেই হয়েছিল।

তাজউদ্দিন আহামদের সঙ্গে শেখ মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে

কলকাতায় প্রথম সাক্ষাতকারের তারিখ সম্পর্কে মূলধারা ‘৭১-এর তাজউন্দিন আহমেদের বক্তব্য, বিএসএফ-এর শরনিন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং তৎকাণীন মুজিব বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার আলোচনা থেকে এটাই জানা গেছে যে, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতকারের আগে তাজউদ্দিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনও শীর্ষস্থানীয় নেতার দেখা বা কথা হয়নি। গোলক মজুমদার দ্ব্যর্থইীনভাবে বলেছেন শেখ মনি, আব্দুর রাজ্জাকদের সঙ্গে তাজউদ্দিনের দিল্লী যাওয়ার আগেই কথা হয়েছিল।

র’-এর উদ্যোগে মুজিব বাহিনী গঠন সম্পর্কে বিএসএফ কর্মকর্তারা যে অসম্তষ্ট ছিলেন গোলক মজুমদারের বক্তব্যে সেটি ধরা পড়েছে। তবে এ বিষয়ে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা ডি পি ধরকে প্রশ্ন করে যে উত্তর পেয়েছিলেন সেটিও প্রণিধানযোগ্য। মুজিব বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে ডি পি ধর বলেছিলেন, এক ঝুঁড়িতে সব ডিম রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ, বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এই সাক্ষাৎকারে গোলক মজুমদার বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান হিসেবে নিজের ভূমিকাকে কিছুটা বাড়িয়ে বললেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এবং বিএসএফের অবদান খাটো করে দেখার কোনও কারণ নেই। নিম্নবর্ণিত সাক্ষাতকারটি গত ১২ এপ্রিল ৯৬ গোলক মজুমদারের কলকাতাস্থ বাসভবনে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি সেখানে অবসর জীবনযাপন করছেন। সাক্ষাতকার গ্রহণে শাহরিয়ার কবির।

শা. ক. : আপনাকে আমার প্রথম প্রশ্ন-আপনি নিজে এবং বিএসএফ কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লো?

গো. ম. : একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমি যখন ১৯৫১ সালে চাকরিতে জয়েন করে এলাম সেই সময়টা ছিল পাকিস্তান এবং ভারতবর্ষের মধ্যে একটা সাংঘাতিক কনফ্রনটেশনের। পরে যার পরিণতি নেহেরু লিয়াকত প্যাক্ট-এ। সেই সময় আমাদের বর্ডারে পশ্চিমে এবং পূর্বে চতুর্দিকে মিলিটারি ছিল। ওদের দিকেও মিলিটারি ছিল পাবিস্তানের দিকে, আমাদের দিকেও মিলিটারি ছিল। এই মিলিটারি সমস্ত বর্ডারে ছড়িয়ে ছিল, তাদের লিয়াজো করার জন্যে লোক দরকার হলো। কেননা পুলিশের লোক বা সিডিল এডমিনিস্ট্রেশনের সঙ্গে মিলিটারির লিয়াজো না হলে কি করে কাজ হয়? সেই জনো আমাকে একজন লিয়াজো অফিসার বিশেষ করে মিলিটারি লিয়াজো অফিসার করা হয়। আমি তখন সবে ট্রেনিং করে এসেছি মাউন্ট আবু থেকে। আমায় পোস্ট করা হলো, আমি এই পজিশনে পাঁচ-সাত মাস ছিলাম। তখন আপনাদের ওদিকে আমাদের এদিককার বর্ডারে-বনগাঁও বর্ডার, যশোরের বর্ডার, খুলনার বর্ডার, আবার বশিরহাটের বর্ডার, নদীয়ার বর্ডার, এরকম সব পাশাপাশি-আবার ওদিকে কুষ্টিয়ার বর্ডার সবস্থানেই ছিল। ওদের দিক থেকে অনেক ভাল ভাল রেজিমেন্টস এসেছিল- পাঞ্জাব ছিল চতুর্দিকে, পাঠানরা ছিল, তারপরে বালুচ রেজিমেন্ট ছিল। আমাদের দিকেও ভাল ভাল রেজিমেন্ট ছিল। আমাদের দিকে কয়েকটা ব্রিগেড ছিল। চব্বিশ পরগণার যে বর্ডারটা সেই বর্ডারটার তিনটা ব্রিগেড ছিল। তো আমাকে তিনটা ব্রিগেডের সঙ্গে লিয়াজো করতে হতো। তখনই আমি বাংলাদেশের বিষয়ে একটু ইন্টারেস্টেড হলাম। আমি অনেক খবরাখবর পেতাম, লোকেরা আমাকে খবর দিতো, যখন আমি বর্ডারে সাইকেলে করে ঘুরে বেড়াতাম, তখনতো এত যানবাহন ছিল না-সাইকেলে করেই ঘুরে বেড়াতাম। খবর যা পেতাম সেগুলো আবার আমি ফিরে এসে ব্রিগেড কমান্ডারকে বলতাম-এই এই ঘটনা ঘটছে, এগুলো হয়েছে, তো তারা আবার সেগুলো তাদের ওপরওয়ালাদের বলতেন। আমি পুলিশকে জানাতাম, বিকজ আই এম এ পুলিশ ম্যান। তখন থেকে আমাদের যোগাযোগ ছিল। তারপরে আবার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেলো। তারপরে আমি যখন চব্বিশ পরগনার এসপি ছিলাম তখন আবার যোগাযোগ হলো। তারপর আমি যখন ত্রিপুরাতে গেলাম আইজি হয়ে সেই সময় দুটো ছেলে ত্রিপুরাতে এলো কুমিল্লা থেকে।

শা. ক. : কোন সালে?

গো, ম. : এটা হচ্ছে ১৯৬৯ সালে। তারা কুমিল্লা থেকে এলো। আমি তাদের ইন্টারভিউ করলাম। তারা বললো যে, আমাদের পাঠানো হয়েছে এখানে, কেননা আমাদের বাংলাদেশ এখন উত্তাল। বাংলাদেশে তো মুকিবুর রহমানের ট্রায়াল হয়েছে, ঐ কী কন্সপিরেসি কেস যেন, আগরতলা কন্সপিরেসি কেস-এ। মুজিবুর রহমানকে জেলে নেয়া হয়েছে। আরও কী করা হবে জানি না, তো আমরা দেখছি এইভাবে আমরা সহ্য করতে পারবো না, কাজেই আমাদের ওখানে দানা বাঁধছে বিদ্রোহের। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কারা? কি করেন আপনারা? বলে, আমরা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। তা আপনাদের নেতা কে? কে পাঠিয়েছে আপনাদের? বললো, অলি আহাদ হচ্ছেন আমাদের নেতা। অলি আহাদই আমাদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমাদের বড় নেতা হলেন গিয়ে মুজিবুরের কাকা বা মামা-নামটা ভুলে গেছি।

শা. ক. : আতাউর রহমান?

গো. ম. হ্যা আতাউর রহমান। তো আতাউর রহমান আমাদের পাঠিয়েছেন।

শা. ক. : তাঁর সঙ্গে মুজিবের কোন রিলেশন নেই?

গো. ম. মুজিব তো তখন জেলে। আতাউর রহমান পাঠিয়েছেন। তো আতাউর রহমান কি চাইছেন? অলি আহাদকে দিয়ে, আমাদের সঙ্গে আতাউর রহমানের সাক্ষাৎ কথা হয়নি। অলি আহাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। অলি আহাদ খুব ভাল লিডার এবং তিনি বেশি কথা বলেন না। তিনিই আমাদের বলেছেন আমাদের তিনটা জিনিস চাই। কী জিনিস চাই? এক হচ্ছে প্রথম বড় জিনিসটা হচ্ছে ভারতবর্ষের সহযোগিতা। আচ্ছা, আর কী চাই? আর চাই, আমাদের অস্ত্রশস্ত্র চাই। কী রকম অন্ত্রশ্? যেসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমরা ওখানে আইয়ূব খাঁর মিলিটারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবো সেরকম অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দরকার। তা আপনাদের কোন জ্ঞান আছে যে, কী রকমের অস্ত্র নিয়ে আপনারা আইয়ুব খার মিলিটারির সম্মুখীন হবেন। বলে, সেটাতো আমাদের জানা নেই। আচ্ছা আর কী চাই? ভাই অন্ত্রশস্ত্র যে আপনারা দেবেন সেই অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের আন্য প্রশিক্ষণ দরকার। আর কী চাই? বলে, আর চাই টাকাকড়ি। টাকাকড়ি না হলে তো আমরা ঠিক করতে পারবো না। আর আমাদের তো এটা আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট, কাজেই টাকাকড়ি চাই। তো আমি শুনণাম সব। শুনে আমি তাদের ব্ৰেকর্ড করে, আমি তাদের ‘র’ যেতে দিয়েছিলাম। আমাদের রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস ওয়িং ‘র’ সবে তৈরি হয়েছিল। সেটা উনিশ শ’ আটযট্টি-উনসত্তর সালে তো, তখনই ‘র’ তৈরি হয়েছিল। তো ‘র’ যেতে দিলাম। “র’ এর অফিসাররা এলো। এসে তাদের ইন্টারডিউ টিন্টারভিউ করলো। তারপরে কী হলো আমি জানি না, আমি দিল্লীতে বদলি হয়ে গেলাম। দিল্লীতে যখন বদলি হয়ে গেলাম তখন আমার কাজ ছিল-বিএসএফ-এর এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সেটআপ, সেটাকে ঠিক করা। তো আমি সেই কাজে লিপ্ত হয়ে গেলাম। এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সেটআপ ঠিক করা মানে হচ্ছে ধরুন কাশ্মীরেতে একটা ব্রিগেড তৈরি করতে হবে, ইনডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেড। তো এখানে আমাদের নতুন করে কিছু করতে হবে, তো এইসব করতে গেলে সেই সবের যে স্যাংশনকভার-হ্যা, সেই সব জিনিস করা, সেইসব আমার কাজ ছিল। তারপরে, তখন জিনিসটা, ইট ওয়াজ হটিং আপ, তখন মিস্টার রুস্তমজি (বিএসএফ প্রধান) আমায় ডাকলেন। ডেকে বললেন, তুমি চলে যাও, কলকাতায় চলে যাও, ইউ টেক চার্জ। আমি বললাম, আমি কী করে কী করবো। বললেন যে, প্রাইম মিনিস্টার চান যে তুমি চলে যাও সেখানে। তো আমি বললাম, আমি কী করবো? বললেন, কী করবে সেটা তুমি নিজে ঠিক করবে, তুমি চলে যাও। তা, আমি যদি ঠিকই করি, কতদূর অগ্রসর হবো? তো সেটাও উনি বলেছেন যে, তুমি ঠিক করবে। তোমার লিমিট তুমিই ঠিক করবে। কী উপায়ে আমি কাজ করবো? বললেন, উপায়ও তুমি ঠিক করবে। আমাকে এই রকমের একটা ব্রড কমিশন দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এখানে যখন এসে পৌঁছলাম তখন তো ওখানে আপনাদের সাংঘাতিক কাণ্ড হচ্ছে, ক্র্যাকডাউন হয়ে গেছে। ক্র্যাকডাউন হয়ে যাবার পরেই-।

[সাক্ষাতকারটি ধারাবাহিকভাবে ১৬ সেপ্টেম্বর ‘৯৬ থেকে দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছে। এখানে প্রথম অংশ মুদ্রিত হলো।]

আমার রাজনীতির কাফফারা

অগ্রজদের ও অনুজদের পদোন্নতিতে কুঠারাঘাত

সূচনা

স্মৃতি মন্থন করিয়া প্রাক-পাকিস্তান ও পাকিস্তানোত্তরকালের বিভিন্ন ঘটনাবলীর সাধারণ বিবরণ সহোদর অনুজ আমিরুজ্জামানের অনবরত তাড়ার দরুন লিপিবদ্ধ করার তাগিদ অনেকদিন যাবৎ তীব্রভাবে অনুভব করিতেছিলাম। বিভিন্ন মহল কর্তৃক ভুল, বিভ্রান্তিকর ও বানোয়াট তথ্য ছাপার অক্ষরে পরিবোশিত হওয়ার ফলে পাকিস্তানের অভ্যুদয় হইতে বাংলাদেশের সৃষ্টি অবধি সংশ্লিষ্ট প্রকৃত ঘটনারাজি বিকৃতির চরম সীমায় পৌঁছাইয়াছে। বিশেষ করিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় সত্য ঘটনাকে চাপা দিয়া কাল্পনিক ও স্বীয় মনঃপুত সম্পূর্ণ মিথ্যা অথবা অর্ধ সত্য বিবরণ সৃষ্টির দুঃখজনক অপচেষ্টা সবিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন করিয়া ঐতিহাসিক সত্যকে চাপা দেওয়ার এক নজির সৃষ্টি করা হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, পূর্বসূরীদের চিন্তা ও কর্মধারা ভবিষ্যৎ অগ্রাভিযানে উত্তরসূরীদের অন্যতম পাথেয়। এই সকল কর্মধারার সঠিক ও নিরপেক্ষ লিপিবদ্ধকরণ পূর্বসূরীদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই এই গ্রন্থে আমার নাতিদীর্ঘ কর্মজীবন বিবৃত করার মাধ্যমে আমার জানা সত্য ঘটনা পাঠক সমীপে তুলিয়া ধরিবার বিনীত প্রয়াস পাইয়াছি।

রাজনৈতিক জীবনে হাতে খড়ি

কৈশোর হইতেই আমি ব্যাপক রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়াইয়া পড়ি। তদানীন্তন ভারতীয় মুসলিম সমাজে যে অভুতপূর্ব পুনর্জাগরণ দেখা দিয়াছিল তাহার তরঙ্গাঘাত আমার তরুণ মনে দারুণ রেখাপাত করে। আব্বা দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, মাসিক মোহাম্মদী ও মাসিক সওগাতের নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। এই সকল দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকায় সচিত্র খেলার বিবরণ, বিশেষ করিয়া ফুটবল খেলার মাঠে কলিকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ১৯৩৪ সাল হইতে ১৯৩৮ সাল এবং ১৯৪০ ও ১৯৪১ সালে ক্রমাগত একটানা বিজয় সংবাদ আমার কিশোর মনে তথা আবালবৃদ্ধবনিতা মুসলমানদের মনে এক লুপ্ডপ্রায় সত্বার পুনর্জাগরণের আহ্বান ও আবেদন জানাইত। গ্রামোফোন রেকর্ডে নজরুল রচনা ও আব্বাস উদ্দিনের কষ্ঠ বাংলার মুসলমান মাত্রেরই যেন গর্বের বস্তু ছিল। অর্থাৎ নজরুলের রচনা, গীত, গজল, আব্বাস উদ্দিনের কষ্ঠ ও মোহামেডান স্পোর্টিং-এর কলিকাতার খেলার মাঠে বিজয় আত্মজ্ঞানহারা, ম্রীয়মান পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজকে আত্মস্থ, আত্মসচেতন ও আত্মবলে বলীয়ান করার মূলে বিশেষ অবদান রাখিয়াছে। ফলে মুসলমানদের ভারতের বুকে স্বীয় ও স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি আমার কঁচি মনকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। তাই স্কুল জীবনেই অপরিণত বয়সে প্রস্তাবিত মুসলিম বাসভূমি পাকিস্তান দাবির সক্রিয় ছাত্রকর্মী হই।

Jinnah and Federalism

Jinnah’s famous 14 points

These 14 points were actually accepted as the decisions of the Muslim All-Parties Conference at Delhi on December 31, 1928, under the presidency of H.H. The Aga Khan. These 14 points were also later accepted by the Muslim League Conference in March 1929 held at Delhi, and were later described as “Mr. Jinnah’s 14 points.” Of these points 1-2 and 13-14 are directly related to the federal question.

The 14 points which are as follows:(1) The government of India should be federal. (2) Residuary powers to vest in the provinces and the States. (3) Any Bill opposed by three- fourth members of any community present shall not be proceeded with. (4) Right of separate electorates of Muslims to remain intact till they themselves give it up. (5) Onc-third representation of Muslim members in the Central Legislature. (6) Retention of the present basis, of representation in the provinces where the Muslims are in a minority. (7) No majority to bc converted into minority or equality. (8) Reforms be introduced in Baluchistan and in the N.W.F.P. (9) Separation of Sind. (10) Reservation for the Muslims in the services. (11) Protection of Muslim culture, language, religion and education, personal laws and waqf. (12) Proper representation of Muslims in the Education Department of the Governement. (13) No changes in the Constitution of India to be brought about without the willing consent of the provinces. (14) No change in the Constitution of India to be brought about without the willing consent of the Indian States.

It may also be mentioned here that Mr. Jinnah accepted the Cabinet Mission Plan in 1946 which proposed three autonomous zonal states under a federal system. Since the three zones were not proposed to be independent and sovereign, the question of an Indian Confederation under the Plan did not arise. It should further be mentioned here that in spite of the Lahore Resolution and the demand for Pakistan, Jinnah agreed to “sacrifice” Pakistan and accepted the Cabinet Mission Plan which was soon bombarded by Nehru and the Congress, even after initially agreeing to the Plan. To that Jinnah reacted by declaring his Direct Action plan which meant that nothing short of partition was any longer acceptable to them.

In between the 14 points and the Cabinet Mission Plan, there were a number occasions when Mr. Jinnah talked about and demanded a federal state in India.

– By Courtesy of : BADAR UDDIN OMAR (OXON) EX Reader-Rajshahi University.

মিঃ জিন্নাহর ঐতিহাসিক ১৪ দফাঃ

মহামান্য আগা খানের সভাপতিত্বে ১৯২৮ সনের ৩১শে ডিসেম্বর দিল্লীতে সর্বদলীয় মুসলিম দলগুলোর এক সম্মেলনে এই চৌদ্দটি দফা গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯২৯ সনের মার্চে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনেও এ দফাগুলো গৃহীত হয়। এগুলোই “মিঃ জিন্নাহর চৌদ্দ দফা” হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। এ দফাগুলোর প্রথম ও দ্বিতীয়, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ দফা প্রত্যক্ষভাবে ফেডারেল পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত।

এই চৌদ্দটি দফা হচ্ছেঃ

১। ভারতের সরকার পদ্ধতি হবে ফেডারেল।

২। Residuary powers প্রদেশ এবং দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর ন্যস্ত থাকবে।

৩। যদি কোন সম্প্রদায়ের তিন চতুর্থাংশ কোন বিলের বিরোধিতা করে, তাহলে সে বিল নিয়ে আলোচনা হবে না।

8। মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচনের অধিকার অক্ষুন্ন থাকবে-যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা স্বেচ্ছায় সে অধিকার ছেড়ে না দেয়।

৫। কেন্দ্রীয় বিধান সভায় এক তৃতীয়াংশের মুসলিম সদস্যদের আসন সংরক্ষিত থাকতে হবে।

৬। মুসলমানরা যে যে প্রদেশে সংখ্যালঘু, সেখানে তাদের প্রতিনিধিত্বের বর্তমান ব্যবস্থা অক্ষুন্ন থাকবে।

৭। কোন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কোন অবস্থাতেই সংখালঘুতে বা সম-অধিকার সম্পন্ন সম্প্রদায়ে পরিণত হবে না।

৮। বেলুচিস্তান এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সংস্কার সাধন করতে হবে।

৯। সিন্ধুকে আলাদা করতে হবে।

১০। চাকুরী বাকুরীতে মুসলমানদের চাকুরীর সংখ্যা সংরক্ষণ করতে হবে।

১১। মুসলমানদের তাহজীব তমুদ্দন, ধর্মীয় অনুভূতি ও শিক্ষা, পার্সোনাল ল’ এবং ওয়াকফের বিধান সংরক্ষণ করতে হবে।

১২। সরকারের শিক্ষা বিভাগে মুসলমানদের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।

১৩। প্রদেশগুলোর স্ব-প্রণোদিত অনুমতি ব্যতিরেকে ভারতের শাসনতন্ত্রের কোন পরিবর্তন সাধন করা যাবে না।

১৪। ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোর স্ব-প্রণোদিত অনুমতি ব্যতিরেকে ভারতের শাসনতন্ত্রের কোন পরিবর্তন সাধন করা যাবে না।

লাহোর প্রস্তাব

১৯৪০ সালের ২২শে ও ২৩শে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ অধিবেশনের সমাপ্তি দিবসে অবিভক্ত ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমানের স্বকীয় জীবনধারা স্বাধীনভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র বাসভূমি কায়েমের দাবিতে অবিভক্ত বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ, কে, ফজলুল হক নিম্নোক্ত প্রস্তাব পেশ করেন। স্বতন্ত্র বাসভূমি দাবির এই প্রস্তাবই ইতিহাসে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে খ্যাত। মূল প্রস্তাবটি নিম্নরূপঃ

“That it is the considered view of this session of the All India Muslim League that no constitutional plan would be workable in this country or acceptable to the Muslims unless it is designed on the following basic principles viz, that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be constituted with such territorial readjustments as may be necessary, that the areas in which the Muslims are numerically in a majority, as in the North western & Eastern zones of India, should be grouped to constitute independent states in which the constituent Units shall be autonomous & sovereign.”

“That the adequate, effective and mandatory safeguards should be specifically provided in the constitution for minorities in the units and in the region for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them and in other parts of India where Musalmans are in minority, adequate, effective and mandatory safeguards shall be specifically provided in the constitution for them and other minorities for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them.”

This session further authorises the working committee to frame a scheme of constitution in accordance with these basic regions of all powers such as defence, extcrnal affairs, communications, customs and such other matters as may be necessary.”

অর্থাৎ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অত্র অধিবেশনের সুবিবেচিত অভিমত এই যে, এ দেশে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনাই কার্যকর কিংবা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগা হইতে পারে না, যদি না অতঃপর বর্ণিত মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে তাহা পরিকল্পিত হয়। যথা, ভৌগলিক নৈকট্য সমন্বিত, ইউনিটগুলো প্রয়োজন অনুসারে স্থানিক রদবদলপূর্বক সীমানা চিহ্নিত করিয়া অঞ্চল গঠন করিতে হইবে এবং মুসলমান। সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল যেমন, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল সমন্বয়ে অবশ্যই স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করিতে হইবে, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম হইবে।”

ইউনিট ও অঞ্চলগুলিতে সংখ্যালঘুদের সহিত পরামর্শক্রমে তাহাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের নিয়মিত সংবিধানে পর্যাপ্ত, কার্যকর ও ম্যান্ডেটরী নিরাপত্তার সুনিশ্চিত বিধান সংযোজন করিতে হইবে এবং ভারতের যে সকল অংশে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রহিয়াছে তাহাদের সহিত পরামর্শক্রমে তাহাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যও সংবিধানে পর্যাপ্ত কার্যকরী ও বাধ্যতামূলক নিরাপত্তার সুনিশ্চিত বিধান সংযোজন করিতে হইবে।

“অত্র অধিবেশন ওয়ার্কিং কমিটিকে অনুরূপ অঞ্চলগুলির যাবতীয় ক্ষমতা যেমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বৈদেশিক বিষয়, যোগাযোগ, শুল্ক এবং প্রয়োজনমত অন্যান্য বিষয়ের উপর চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রদানের উদ্দেশ্যে উল্লিখিত মূলনীতিগুলো ভিত্তিতে একটি সাংবিধানিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আরও ক্ষমতা দিতেছে।”

পরিতাপের বিষয়, “লাহোর প্রস্তাবের প্রস্তাবক বঙ্গীয় প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে মুসলিম লীগ হইতে বহিস্কৃত হইলে ১৯৪২ সালে হিন্দু মহাসভা নেতা ডঃ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর যোগসাজসে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা গঠন করেন। মাত্র ৪০ জন এম, এল, এ, মুসলিম লীগে থাকিয়া গেলেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদ (Bengal Legislative Assembly)-এর ২৫০ জন সদস্যের ২১০ জন শ্যামা-হক মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করেন; তন্মধ্যে ৮৮ জনই হিন্দু সদস্য। জনপ্রিয়তার অগ্নি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হইল কায়েদে আযমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নাটোর উপনির্বাচনে। মাওলানা আক্রাম খা সম্পাদিত ‘দৈনিক আজাদ’ই ছিল একমাত্র মুসলিম লীগ সমর্থক। বাকী কলিকাতার ১২ টি দৈনিক ও মুসলিম মুখপাত্র ‘নবযুগ’ এক সুরে মুসলিম লীগ ও কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র মুণ্ডপাত করিতেছিল।

নাটোর উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভই করে নাই বরং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। নাটোরের ভোটারগণ, তথা নাটোরের একমাত্র মুসলিম জনতা প্রমাণ করিল ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান বড়। জাতির স্বার্থ নিয়া ছিনিমিনি খেলিলে দেশবাসী যে বাংলার চাষী, বাংলার মুসলিম জনতার অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, চাকুরী-বাকুরী অঙ্গনে অগ্রযাত্রার একচ্ছত্র প্রদর্শক ও মুসলিম স্বার্থ রক্ষক শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হককেও ক্ষমা বা বরদাশত করে না, নাটোর উপ-নির্বাচন এই শিক্ষাই দিল। মুসলিম রাজনীতিতে আবার নূতন আশার সঞ্চার হইল। ইহাই ছিল ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম জনতার স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তানের দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের পূর্বাভাষ। শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা পতন হইলে ১৯৪৩ সালের ২৪শে এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গ মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা গঠিত হয়।

ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের সহিত সম্পর্ক

অবভিক্ত বঙ্গদেশে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল পাকিস্তান আন্দোলনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন। ১৯৪৪ সালে যথারীতি প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হইয়া ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই এবং কলেজে আগমনের পরই আমি ঢাকা কলেজ মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই।

ঢাকা কলেজ গভর্নমেন্ট হোস্টেল সহ-আবাসিক ও সহপাঠী জনাব আবদুল হাই (বর্তমনে ডাক্তার) ১৫০ নং মোগলটুলি মুসলিম লীগ কর্মীশিবির কার্যালয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক চিন্তানায়ক জনাব আবুল হাশিমের সহিত আমার পরিচয় করাইয়া দেন। উপস্থিত কর্মীদের উদ্দেশ্যে জনাব আবুল হাশিমের রাত্রিভর পবিত্র কালেমার ব্যাখ্যা, প্রস্তাবিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের সুস্পষ্ট রূপরেখা আমার কিশোর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাহার জ্ঞানগর্ভ তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত উক্ত কর্মী আসরেই সর্বজনাব শামসুল হক, শামসুদ্দিন আহমদ, কমরুদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজুদ্দিন আহমদ, নঈমুদ্দীন আহমদ ও শওকত আলীর সহিত আমার পরিচয় হয়। তাহারাই উক্ত কার্যালয়ের প্রাণ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ঢাকার ১৫০ নং মোগলটুলীর দ্বিতল ও ত্রিতল ছিল পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মীশিবিরের প্রাণকেন্দ্র এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ সার্বক্ষণিক ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীদের প্রধান কার্যালয়। বঙ্গীয় প্রদেশ মুসলিম লীগের প্রগতিশীল তরুণ নেতা জনাৰ শামসুল হক উপরোক্ত কার্যালয়ের কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। কালে ঘটনা বিবর্তনে আমি মুসলিম লীগের উক্ত প্রগতিশীল অশের সহিত ঘনিষ্টভাবে জড়িত হইয়া পড়ি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৪৫ সনের ১৬ নভেম্বর কলিকাতায় ৩ নং ওয়েলসলি ফাস্ট লেইন হইতে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক মিল্লাত প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাটিই ছিল মুসলিম লীগের উক্ত প্রগতিশীল অংশের চিন্তাধারার মুখপত্র।

১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন

১৯৪৫ সালের ৯ই মে জার্মানী ও ইটালীর আত্মসমর্পণের পর আফ্রো-ইউরোপীয় রণভূমিতে যুদ্ধ বন্ধ হয়। ইহার অব্যবহিত পরই গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাজ্যে (United Kingdom) ১৯৪৫ সালের ২৬শে জুলাই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং শ্রমিক দল মিঃ ক্লিমেন্ট এটলীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। অক্ষশক্তির অন্যতম অংশীদার জাপান ২রা সেপ্টেম্বর (১৯৪৫) আত্মসমর্পণ করিলে এশীয় রণভূমিতে যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। মহাযুদ্ধোত্তরকালে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন অনুধাবন করিয়া ভারতীয় জনমত যাচাই করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন এবং ভারতে নিযুক্ত তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল কর্তৃক ২৫শে জুন (১৯৪৫) আহৃত সিমলা কনফারেন্স ব্যর্থ হইলে ২৯শে আগস্ট (১৯৪৫) তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় উপমহাদেশে স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম আবাসভূমি পাকিস্তানের দাবিতে দশ কোটি ভারতীয় মুসলিম অধিবাসীর নিকট শান্তিপূর্ণ রায়দানের সুযোগ গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানান।

বঙ্গদেশে নির্বাচন পরিচালনার উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর (১৯৪৫) কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জনাব আবুল হাশিমের যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত প্রগতিশীল অংশ খাজা নাজিমুদ্দিন ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পরিচালিত রক্ষণশীল অংশকে পরাজিত করে। নির্বাচিতব্য পাঁচটি আসনেই জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জনাব আবুল হাশিম, জনাব আহমদ হোসেন, মাওলানা রাগিব আহসান ও জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী (লাল মিঞা) নির্বাচিত হন। নয় সদস্যবিশিষ্ট পালামেন্টারী বোর্ডের অপর চারজন সদস্য প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সভাপতি হিসাবে পদাধিকার বলে, বঙ্গীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যবৃন্দ কর্তৃক নির্বাচিত জনাব নুরুল আমিন ও বঙ্গীয় লেজিসলেটিভ এসেম্বলীর মুসলিম লীগ সদস্যবৃন্দ কর্তৃক নির্বাচিত জনাব ফজলুর রহমান পূর্বাহেই স্থিরীকৃত ছিলেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৩টিতে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। ২রা এপ্রিল (১৯৪৮) জলব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে মুসলিম লীগ পর্লামেন্টারি দলের সর্বসম্মত নেতা নির্বাচিত হন এবং ২২শে এপ্রিল (১৯৪৬) বঙ্গীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে পার্লামেন্টারি বোর্ড জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে সর্বক্ষণ কর্মী পরিচালিত নির্বাচনী বোর্ড স্থাপন করে। ছাত্রলীগের কার্যব্যাপদেশে কলিকাতা অৰস্থানকালে তদানীন্তন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা জনাব নুরুদ্দিন আহমদ ভারতীয় দশ কোটি মুসলমানের আবাসভূমি পাকিস্তান দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে মুসলিম ছাত্রদের আংশগ্রহণের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করিয়া চার সদস্যবিশিষ্ট ত্রিপুরা জেলা নির্বাচনী বোর্ডের অন্যতম সর্বক্ষণ কর্মী হওয়ার আহ্বান জানাইলে আমি তাহাতে সানন্দচিত্তে সম্মত হই এবং ১৯৪৬ সালে আই. এস. সি. পরীক্ষাদানে বিরত থাকি।

 কলিকাতা হইতে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া আমার শ্রদ্ধেয় অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এস.সি. শেষবর্ষের ছাত্র জনাব আব্দুল করিম (পরবর্তীকালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও ডীন) সাহেবকে আমার রাজনৈতিক অভিমত জ্ঞাপন করিয়া তাহার অনুমতি প্রার্থনা করি। আমার কাকুতি-মিনতি উপেক্ষা করিতে না পারিয়া স্নেহান্ধ তাই অগত্যা আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন এবং আব্বাজান ও বড় ভাইকে বুঝাইয়া বলিবার দায়িত্বতার গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের অনুষ্ঠিতব্য আই.এস.সি পরীক্ষায় সন্তোষজনক মলাফলের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে তাহাদের সমর্থন লাভে সক্ষম হই। আমি মধ্যবিত্ত সরকারি চাকুরে পরিবারের সন্তান। হাজারো সমস্যাসঙ্কুল পরিবার আমাকে কেন্দ্র করিয়া ভবিষ্যৎ স্বচ্ছলতার স্বপ্ন রচনা করিয়াছিল। আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও কার্যাবলীর ফলম্বরূপ আমাদের গরীব পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের নিকট হইতে অন্যায় এবং অবিচার সহ্য করিতে হইয়াছে।

 ত্রিপুরা জেলা নির্বাচনী বোর্ডে আমি ব্যতীত বাকী অপর তিনজন সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, জনাব এ,কে,এম, রফিকুল হোসেন ও জনাব সিরাজুল ইসলাম। খন্দকার মোশতাক আহমেদ জেলা নির্বাচনী বোর্ডের কর্মাধ্যক্ষ (Workers-in-Charge) ছিলেন।

 ১৯৪৬ সালের ২০শে মার্চ নির্বাচনী প্রচারণা চালাইতে বরুড়া উপস্থিত হইলে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট ও কৃষক প্রজা দলীয় কর্মীদের অতর্কিত হামলায় সর্ব জনাব নূর মিঞা, আবদুর রব, শাহ আলম, আবদুল হামিদ, রেয়াজত আলী ও আমি গুরুতরভাবে আহত হই।

 সর্বভারতীয় নির্বাচনী ফলাফল ছিল নিঃসন্দেহে পাকিস্তান দাবির পক্ষে ভারতীয় দশ কোটি মুসলমানের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের সাক্ষ্য। এই ফলাফল ছিল নিম্নরূপঃ কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের ৩০টি মুসলিম আসনের ৩০টি আসন ও প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচনে আসামে ৩৪টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৩১টি, বঙ্গদেশে ১১৯টির মধ্যে ১১৩টি, বিহারের ৪০টির মধ্যে ৩৪টি, উড়িষ্যায় ৪টির মধ্যে ৪টি, যুক্তপ্রদেশ ৬৬ টির মধ্যে ৫৫টি, পাঞ্জাবে ৮৬টির মধ্যে ৭৯টি, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ৩৮টির মধ্যে ১৭টি, সিন্ধুতে ৩৫টির মধ্যে ২৮টি, বোম্বাইতে ৩০টির মধ্যে ৩০টি, মধ্য প্রদেশে ১৪টির মধ্যে ১৪টি, মাদ্রাজে ২৯টির মধ্যে ২৯টি অর্থাৎ সর্বমোট ৫২৫টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪৬৪টি আসন লাভ।

দিল্লী কনভেনশন

 সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিল (১৯৪৬) দিল্লীতে এ্যাংলো এরাবিক কলেজে মুসলিম লীগ লেজিসলেটারস্ কনভেনশন আহ্বান করেন। উক্ত কনভেনশনে দর্শক হিসাবে আমার যোগ দিবার ঐকান্তিক ইচ্ছা সত্ত্বেও নানা কারণে আমি দিল্লী যাইতে পারি নাই।

 দিল্লী এ্যাংলো এরাবিক কলেজে অনুষ্ঠিত লেজিসলেটারস কনভেনশনের ৯ই এপ্রিল অধিবেশনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পেশকৃত নিম্নোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়ঃ

Resolved (1) That the zones comprising Bengal & Assam in the North East and the Punjab, North-west Frontier Province, Sind & Balochistan

in the North-west of India, namely Pakistan tones where the Muslims are in dominant majority, be constituted into a sovereign independent state and that an unequivocal undertaking be given to implement establishment of Pakistan without delay.

(2) That two separate Constitution making bodies be set up by people of Pakistan & Hindustan for the purpose of framing their respective constitution

(3) That the minorities in Pakistan and Hindustan be provided with safeguards on the lines of the All India Muslim League Resolution passed on 23rd March, 1940 at Lahore.

(4) That the acceptance of the Muslim League demand of Pakistan & Its implementations without delay are the sine-qua-non for Muslim League co-operation and participation in the formation of an interim government at the centre.

অর্থাৎ প্রস্তাব গ্রহণ করা হইল যে,

(১) ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বে বঙ্গদেশ ও আসাম এবং উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান অঞ্চলগুলি যাহা পাকিস্তান অঞ্চল’ নামে অভিহিত এবং যেখানে মুসলমানরা প্রধান সংখ্যাগুরু তাহাদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হউক এবং অবিলম্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কার্যকর করার নিমিত্ত দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হউক।

 (২) স্ব স্ব সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের জনগণ কর্তৃক দুইটি পৃথক সংবিধান রচনাকারী সংস্থা গঠন করা হউক।

 (৩) ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কর্তৃক লাহোরে গৃহীত প্রস্তাবানুসারে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হউক |

(8) মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির স্বীকৃতি ও অবিলম্বে ইহার বাস্তবায়নই কেন্দ্রে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনে মুসলিম লীগের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে অপরিহার্য শর্ত।

 জনাব আবুল হাশিম উপরোক্ত দিল্লী প্রস্তাবকে লাহোর প্রস্তাবের সবাসরি বরখেলাপ বলিয়া তীব্র ভাষায় বিরোধিতা করেন এবং ভিনি সঠিকভাবে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সম্মেলন যে প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে এবং ১৯৪১ সালের মাদ্রাজ অধিবেশনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ যাহাকে মূলনীতি (Creed) হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে ঐ প্রস্তাবকে বাতিল বা ইহার সংশোধনকরণ লেজিসলেটারস কনভেনশনের এক্তিয়ার বহির্ভূত। লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টির দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার ছিল। গভীর পরিতাপের বিষয়, ১৯৪৬ সালের ১ এপ্রিল দিল্লী মহানগরী এংলো এরাবিক কলেজে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ লেজিসলেটারস কনভেনশনে বঙ্গদেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবক্রমে লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী একাধিক রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে একটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নেতা সোহরাওয়ার্দীর জাতীয় রায়কে বাতিল করার প্রয়াস আমাদের তরুণ মনকে অত্যন্ত আহত করে। যে কায়েদে আজমের সভাপতিত্বে ১৯৪০ সলে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল, সেই কায়েদে আজমেরই সভাপতিত্বে ১৯৪৬ সালে দিল্লী প্রস্তাব গৃহীত হয়। নেতৃবৃন্দ বেমালুম হজম করিয়া ফেলিয়াছিলেন যে, সর্বভারতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানগণ লাহোর প্রস্তাবের পক্ষেই দ্ব্যর্থহীন রায় দিয়াছিল। কি প্রখর নীতিজ্ঞান নেতৃকূলের!

ক্যাবিনেট মিশন

ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ ক্লিমেন্ট এটলী ১৫ই মার্চ (১৯৪৬) বৃটিশ হাউস অব কমন্স-এ ঘোষণা করিলেন যে, বৃটিশ সরকার ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দানে সহায়তা করার মানসে ভারত সচিব লর্ড প্যাথিক লরেন্স, বাণিজ্য বোর্ড সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, নৌ বিভাগের প্রথম লর্ড (First Lord of admiralty) এ, ভি, আলেকজান্ডার সমবায়ে গঠিত ক্যাবিনেট মিশন ভারতে পাঠাইবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তদানুযায়ী ক্যাবিনেট মিশন ২৩শে মার্চ, (১৯৪৬) করাচি অবতরণ করে। নিম্নোক্ত কারণগুলি বোধ হয় ইংরেজ সরকারকে উপরে বর্ণিত সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেঃ

প্রথমত: ভারতব্যাপী সদ্য অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবাসী স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন (Govt. of India Act, 1935) মোতাবেক ভারতবর্ষের এগারটি প্রদেশে ভারতীয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি সরকার পরিচালনার সুযোগ ভারতবাসীকে আত্মসচেতন ও স্বাধিকার সচেতন করিয়া তুলিয়াছে। তৃতীয়তঃ প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মহাচীন, সোভিয়েত রাশিয়া ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করিতেছিল। চতুর্থতঃ (ক) দীর্ঘকাল যাবৎ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে দীক্ষিত সর্বভারতীয় বিপ্লবী সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টা, (খ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সর্বভারতীয় বিপ্লবী অগ্নিপুরুষ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সর্বাধিনায়কত্বে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক জাপান ও জার্মানীর সহায়তায় আই, এন, এ (Indian National Army) গঠন ও স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা, (গ) মহাযুদ্ধোত্তর ভারতের বোম্বাই বন্দরে ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ ইত্যাদির মধ্যে দূরদৃষ্টি ও অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন ইংরেজ রাজশক্তির একটি অংশ ভারতবাসীর মধ্যে সশস্র পথে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার অদম্য ও দুর্দমনীয় স্পৃহা লক্ষ্য করে। স্মর্তবা, ভারতকে আজাদী দান প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে ১৯৪২ সালের ১১ই মার্চ বৃটিশ সরকারের অন্যতম মন্ত্রী কূটনৈতিক স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, ১৯৪৫ সালের জুন মাসে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল আহূত সিমলা কনফারেন্স ও বৃটিশ পার্লামেন্টারি মিশন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিরাজমান মতভেদ নিরসনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মতভেদ ও মতামত যাচাই করিয়া ভারতকে স্বাধীনতা দান কল্পেই ক্যাবিনেট মিশনের ভারতে আগমন ঘটে।

বৃটিশ ক্যাবিনেট মিশন প্রায় দুই মাস ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সহিত আলাপ-আলোচনা এবং দেন-দরবারের পর ১৯৪৬ সালের ১৬ মে ভারতীয় শাসনতান্ত্রিক জটিলতা অপনোদন মানসে নিম্নোক্ত সুপারিশগুলি সাধারণ্যে প্রকাশ করে:

(1) There should be a Union of India embracing both British India & States which should deal with Foreign Affairs, Defence & Communications & should have the powers necessary to raise the finances required for the above subject.

(2) All subjects other than the Union subjects and all residuary powers should vest in the provinces.

(3) The states will retain all subjects & powers other than those added to the Union.

(4) Provinces should be free to form groups with Executives & Legislative Assembly & each group could determine the provincial subjects to be taken in common.

(5) The constitutions of the Union & of the groups should contain a provision whereby any province could by a majority votes of its legislative Assembly call for a reconsideration of the terms of the constitution after an initial period of ten years and at ten yearly intervals thereafter.

India be divided into 3 sections.

Section-A Madras, Bombay, United Provinces, Behar, Central province & Orissa with 167 general seats & 20 Muslim seats.

Section-B Punjab, North West Frontier Province, Sind with a general seats, 22 Muslim seats & 4 sikh seats.

Section-C Bengal and Assam with 34 general seats & 36 Muslim seats.

অর্থাৎ

 (১) বৃটিশ ভারত ও দেশীয় রাজাসমূহ সমন্বয়ে ভারতীয় ইউনিয়ন সংগঠিত হওয়া উচিত, যাহার বিষয়াবলী থাকিবে পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যোগাযোগ। উপরোক্ত বিষয়াবলীর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের আবশ্যকীয় ক্ষমতা থাকা উচিত

 (২) ইউনিয়ন অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি ব্যতীত সকল বিষয় এবং বাদ বাকী সক্ষমতা প্রদেশগুলির উপর ন্যস্ত হওয়া উচিত।

 (৩) কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি ব্যতীত সকল বিষয় ও ক্ষমতা দেশীয় রাজ্যসমূহের আয়ত্তাধীন থাকিবে।

(8) প্রশাসন ও আইন পরিষদসহ গ্রুপ গঠন প্রদেশগুলির এক্তিয়ারাধীন। কোন কোন প্রাদেশিক বিষয় সাধারণভাবে গ্রহণ করা হইবে তাহা প্রত্যেক গ্রুপই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে।

(৫) কেন্দ্রীয় ও এপগুলির সংবিধানে বিধান থাকা উচিত যে, প্রার্ভিক দশ বৎসর এবং তৎপরবর্তী প্রত্যেক দশ বৎসর অন্তর অন্তর যে কোন প্রদেশ স্বীয় আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংবিধানের ধারাগুলো পুনঃ বিবেচনার দাবি করতে পারবে।

ভারতবর্ষে তিন ভাগে বিভক্ত করা হোক।

সেকশন-এঃ মাদ্রাজ, বোম্বে, সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উড়িষ্যা- ১৬৭টি সাধারণ আসন ও ২০টি মুসলিম আসন।

সেকশন-বিঃ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু প্রদেশ ৯টি সাধারণ আসন, ২২টি মুসলিম আসন ও ৪টি শিখ আসন।

সেকশন-সিঃ বঙ্গদেশ ও আসাম-৩৪টি সাধারণ আসন ও ৩৬টি মুসলিম আসন।

নেহেরুর ভুলঃ হিন্দু মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টা বানচাল

২৪শে মে (১৯৪৬) নিখিল ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি “স্বাধীন, অখণ্ড ও গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের” সংবিধান প্রণয়নকল্পে প্রস্তাবিত গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

 ৬ই জুন (১৯৪৬) নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের গোপন বৈঠক ও ২৫শে জুন (১৯৪৬) নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ছয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশাবলী যথা বঙ্গদেশ, আসাম, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান সমবায়ে একটি গ্রুপ গঠনের দাবি তুলিয়া ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করিয়া গণপরিষদের যোগ দিতে সম্মত হয়। কিন্তু ১০ই জুলাই (১৯৪৬) বোম্বে শহরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে নিখিল ভারত কংগ্রেসের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু অবিবেচনা প্রসূত ঘোষণা- “কংগ্রেস গণপরিষদ কেবলমাত্র অংশগ্রহণ করতে সম্মত হইয়াছে এবং যাহা সর্বোৎকৃষ্ট মনে করে সেই মোতাবেক ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানকে পরিবর্তন বা সংশোধন করার ব্যাপারে নিজেকে স্বাধীন মনে করে-We are entirely and absolutely free to determine অর্থাৎ আমরা নির্ধারণ করার বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে ও নিঃশর্তভাবে স্বাধীন”, মুসলিম লীগ মহলকে শঙ্কিত করে এবং অখণ্ড সর্বভারতীয় কাঠামো বজায় রাখার অধিকাংশ মহলের সর্বপ্রকার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে বানচাল করে। অবশ্য নেহরুর মন্তব্যের প্রতিধ্বনি ১৯৪৭ সালের ২৫শে এপ্রিল ভারতীয় গণপরিষদের অধিবেশনে শোনা যায়। অতঃপর অখণ্ড ভারতের সংবিধান রচনার মানসে ভারতীয় গণপরিষদ যোগদান মর্মে কংগ্রেস-লীগ ঐক্যমত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গেল। বিদেশী ইংরেজ শাসকচক্র অবিভাজ্য ও অখণ্ড স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র কায়েমের প্রচেষ্টায় যখন আপ্রাণ চেষ্টায় নিয়োজিত, নিখিল ভারত কংগ্রেসের অখণ্ড ভারত দাবিদার অপরিপক্ক নেতৃবৃন্দ স্বীয় কার্যক্রম দ্বারা ভারতকে দ্বি-খণ্ডিত করার হুতাশন যজ্ঞের সর্বপ্রকার আয়োজন করিয়া ফেলিলেন। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে তখনকার দিনে ভারতবাসীর মনে যে উচ্চাশা ও প্রত্যয় নিহিত, তা অচিরেঈ ধুলিসাৎ হয় গেল। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া এক অশুভ ও অভিশপ্ত খাতে প্রবাহিত হইতে লাগিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিষবাষ্প হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক এত বিষাক্ত হইল যে, হিন্দু মুসলমানের পাশাপাশি বাড়িতে সহঅবস্থান চিন্তার অতীত হইয়া পড়িল। পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশে স্বীয় বাস্তুভিটা ত্যাগ করিয়া রিক্ত, পর্যুদন্ত ও সহায়সম্বলহীন হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ লোক ভিনদেশী যাত্রী হল ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শিকারে পরিণত হইল। সার্থপর ক্ষমতালোভী ভারতীয় নেতৃত্ব ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ঘৃণিত গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত হইবে- ইহাই আমার তখনকার তরুণ বয়সের প্রতিক্রিয়া।

মুসলিম লীগের সিদ্ধান্ত

সাংবাদিক সম্মেলনে পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু মন্তব্যের পটভূমিকায় উদ্ভুত সমগ্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার নিমিত্ত কায়েদে আজম কর্তৃক আহূত ২৭, ২৮ ও ২৯শে জুলাই (১৯৪৬) বোম্বে শহরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের তিনদিন স্থায়ী বিশেষ অধিবেশন ক্যাবিনেট মিশন প্লান গ্রহণ সম্পর্কিত পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করিয়া নিম্নোক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেঃ

Whereas the council of the All India Muslim League has resolved to reject the proposals embodied in the statement of the Cabinet Delegation & the Viceroy dated 16th May 1946 due to the intransigence of the Congress on the one hand and the breach of faith with the Muslims by British Govt on the other & whereas muslim India has exhausted without success all efforts to find a peaceful solution of the Indian problem by compromise & constitutional means & whereas the Congress is bent upon setting up Caste Hindu Raj in India with connivance of the British & whereas recent events have shown that power politics and not justice & fairplay are the deciding factors in Indian affairs, and whereas it has become abundantly clear that Muslims would not rest contented with anything less than the immediate establishment of an independent & fully sovereign state of pakistan & would resist any attempt to impose any constitution making machinery or any constitution long term or short term or the setting up of an interim Govt. at the centre without the approval or consent of the Muslim League, the council of the All India Muslim League is convinced that now time has come for the Muslim nation to resort to direct action to achieve Pakistan, to assert their just rights, to vindicate their honour & to get rid of the present British slavery & the speculated future Cysts-Hindu denominations.

“The coumcil calls upon the Muslim nation to stand as one man behind their sole representative authoritative organisation, the All India Muslim League and to be ready for every sacrifice.”

“This council directs the working committee to prepare forthwith a programme of direct action to carry out the policy enunciated above & Organise Muslims for the coming struggle to be launched as & when necessary”.

“As a protest against & in token of their deep resentment of the attitude of the British, this council calls upon the Muslims to renounce forthwith the titles conferred upon them by the Government.”

অর্থাৎ যেহেতু কংগ্রেসের জনমনীয়তা ও বৃটিশ সরকারের বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিল কেবিনেট ডেলিগেশন ও ভাইসরয়কে ১৬ই মে ১৯৯৪৬) প্রদত্ত বিবৃতিতে সন্নিবেশিত প্রস্তাবাবলী প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেহেতু সমঝোতা ও নিয়মতান্ত্রিক পথে ভারতীয় সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে মুসলিম ভারত সর্বপ্রচেষ্টা নিঃশেষ করিয়াছে, যেহেতু বৃটিশের পরোক্ষ সমর্থনে বলীয়ান হইয়া কংগ্রেস বর্ণ-হিন্দু রাজ প্রতিষ্ঠা করিতে বন্ধপরিকর, যেহেতু সাম্প্রতিক ঘটনাবলী প্রমাণ করিয়াছে যে, ভারতীয় ব্যাপারে ন্যায় বিচার ও নিরপেক্ষতা নয় বরং ক্ষমতার রাজনীতি নির্ধারণী বিষয়বস্তু; যেহেতু ইহা সবিশেষ স্পষ্ট হয়েছে যে, স্বাধীন ও পূর্ণ সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ভারতীয় মুসলমান শান্ত থাকিবে না এবং মুসলিম লীগের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতিত কোন সংবিধান রচনাকারী সংস্থা অথবা দীর্ঘ মেয়াদী কিংবা স্বল্প মেয়াদী সংবিধান অথবা কেন্দ্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের যে কোন প্রচেষ্টাকে বাধা দেবে; নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, পাকিস্তান অর্জনের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আশ্রয় গ্রহণ করার, তাহাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করার, তাহাদের সম্মান রক্ষা করার এবং বর্তমান বৃটিশ দাসত্ব ও ভবিষ্যৎ বর্ণ হিন্দু আধিপত্য ঝাড়িয়া ফেলিবার সময় মুসলিম জাতির জন্য আসিয়াছে।

“এই কাউন্সিল জাতিকে তাদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পিছনে দাঁড়াইবার ও যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুতি নিবার আহ্বান জানাইতেছে”।

“ উপরে ঘোষিত নীতিকে কার্যকর করিতে ও প্রয়োজনবোধে আশু সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য মুসলমানদিগকে সংগঠিত করিতে অবিলম্বে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য ওয়ার্কিং কমিটিকে কাউন্সিল নির্দেশ দিতেছে”।

 “ইংরেজের মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও তাহাদের গভীর ক্ষোভের প্রতীক হিসাবে সরকার প্রদত্ত সর্বপ্রকার খেতাব বর্জনের জন্য মুসলমানদের প্রতি এই কাউন্সিল আহ্বান জানাইতেছে”।

১৬ আগস্ট, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তাণ্ডবলীলা

                উপরোক্ত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ১৬ই আগস্টকে “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস” ঘোষণা করা হয় এবং খাজা নাজিমুদ্দিন, নওয়াব ইসমাইল ও চৌধুরী খালেকুজ্জামান সমবায়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি অব অ্যাকশন বা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। একদিকে ইংরেজ সরকার বিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকে ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত, অন্যদিকে খেতাব বর্জনের নির্দেশে বিচলিত খেতাবধারী স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন কলিকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া মন্তব্য করেন যে, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ইংরেজের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে। মুসলিম লীগের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনের অপব্যাখ্যা সাম্প্রদায়িক হিন্দুদিগের কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় সংগোপনে দাঙ্গা প্রস্তুতি নিতে ইন্ধন যুগিয়েছিল, সাধারণ শান্তিপ্রিয় হিন্দুকে বিভ্রান্ত করিয়াছিল। অথচ ২রা আগস্ট (১৯৪৬) মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বোম্বে নগরীতে অনুষ্ঠিত সভা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস কর্মসূচি নিম্ন প্রস্তাবাকারে ঘোষণা করেঃ

“Calls upon the Muslims of India to suspend all business on August 16, 1946 & to observe complete hartal”

অর্থাৎ “ভারতীয় মুসলমানদিগকে ১৬ই অগাস্ট (১৯৪৬) সকল কাজ-কর্ম বন্ধ রাখিতে ও পূর্ণ হরতাল পালন করিতে আহ্বান জানাইতেছে। “

২২ শে জুলাই (১৯৪৬) কেন্দ্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব জানাইয়া ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস সভাপতি যথাক্রমে কায়েদে আজম ও পণ্ডিত নেহরুকে পত্রে সহযোগিতা আহ্বান জানান। কায়েদে আজমের পত্রে লর্ড ওয়াভেল ১৬ জুন (১৯৪৬) ক্যাবিনেট মিশন ও ভাইসরয় প্রদত্ত যুক্ত ঘোষণা স্মরণ করাইয়া দেওয়া সত্ত্বেও লর্ড ওয়ভেল ১২ই আগস্ট (১৯৪৬) পত্তিত নেহরুকে অন্তবর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের দায়িত্ব দিলেন। ২রা সেপ্টেম্বর (১৯৪৬) পক্তিত নেহরু ১২ সদস্যবিশিষ্ট সরকার গঠন করেন। কেন্দ্রে একদলীয় কংগ্রেস সরকার গঠনের প্রস্তুতি দাঙ্গাবাজ সাম্প্রদায়িক হিন্দুদিগকে অত্যন্ত উৎসাহিত করে।

তদানীন্তন বঙ্গীয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কায়েদে আজম যদি সেদিন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সম্বন্ধে অপব্যাখ্যার অপরাধে স্যার নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেন তাহা হইলে ১৬ আগস্ট কলিকাতার রক্তক্ষয়ী নাঙ্গায় অনাহূত নিরীহ কলিকাতাবাসীকে প্রাণ দিতে হইত না। ধনে-জনে-মানে মুসলিম সম্প্রদায়ই সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও সমযগ্র ভারতব্যাপী এমনকি বিদেশে মুসলিম ও মুসলিম লীগ সরকার অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী সরকারকেও এই কলঙ্কময় অধ্যায়ের জন্য দায়ী হইতে  হইয়াছে। ইহার প্রতিক্রিয়ায় বিহারে নির্দোষ নিরীহ মুসলমানদের উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের হাতে কচুকাটা হইতে হইয়াছে, অবলা নারীকে সতীত্ব হারাইতে হইয়াছে, ধন-সম্পদ লুষ্ঠিত ও অগ্নিদাহ হইয়াছে। ইতিপূর্বে কলকাতায় সংগঠিত নারকীয় দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালী জেলার কতিপয় এলাকায় উগ্র সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের হাতে নিরপরাধ শান্তিপ্রিয় সাধারণ হিন্দুকে ধনে-জনে-মানে মাশুল দিতে হইয়াছে।

অথচ পাশাপাশি দৃষ্টান্ত ঢাকা শহরে ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালনকালে কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নাই, যদিও ঢাকাই ছিল হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আখড়া। ইহাই হইল ঢাকার অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা শামসুল হক ও শামসুদ্দিন আহমেদের স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন নেতৃত্বের কৃতিত্ব। জনাব হক ও জনাব আহমদ যথাক্রমে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবিরের কর্মাধ্যক্ষ ও ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিলেন।

 নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মহাত্মা গান্ধীর স্বয়ং দাঙ্গা দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে নোয়াখালীর পথে কলকাতা পৌঁছার পূর্বদিন বিহারে মুসলিম নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। অপেক্ষাকৃত শান্ত নোয়াখালীর পথে যাত্রা স্থগিত রাখিয়া সদ্য দাঙ্গা কবলিত বিহারই ছিল গান্ধীজীর উপযুক্ত কর্মস্থল। তবে, ঝানু রাজনীতিবিদ গান্ধীজী তাহা করিতে যাইবেন কেন? নোংরা রাজনীতির তাগিদে ঋষির তুল্য গান্ধীজীর কত নীচস্তরে নামিতে হইয়াছিল। গান্ধীজীর তখনকার দৃষ্টিতে সবার উপরে মানুষ সত্য ছিল না, ছিল সবার উপরে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার। এতদসত্ত্বেও বঙ্গীয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বয়ং গান্ধীজীর নোয়াখালী যাত্রা ও অবস্থানের সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা স্বীয় ব্যক্তিগত জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার মানসে গান্ধীজীর নোয়াখালী অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করিয়া অনর্থক স্থানীয় মুসলিম নেতৃত্বকে নানাভাবে পুলিশী হয়রানির শিকারে পরিণত করিয়াছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ২রা ডিসেম্বর (১৯৪৬) মহাত্মা গান্ধীকে নিম্নোক্ত ব্যক্তিগত পত্র লিখিয়াছিলেনঃ

“I appreciate very much your desire to bring about peace between the Hindus & Muslims of Bengal but Muslims feel that if you really wish to pursue your objective to establish good fellowship. Behar should be the real field. Your stay has encouraged many of your followers to manufacture evidence and to place it before you to carry on the persecution of the local Muslims, the local Muslim League Leaders, which will not possibly lead to mutual confidence in the near future.”

অর্থাৎ “বাংলার হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আপনার ইচ্ছাকে আমি অতীব মূল্যবান জ্ঞান করি। তবে, মুসলমানরা মনে করে যে, আপনি যদি পারস্পরিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার নীতি বাস্তবিকই চালাইয়া যাইতে চান, তাহা হইলে বিহারই প্রকৃত ক্ষেত্র হওয়া উচিত। আপনার অবস্থান আপনার অনুগামীদের অনেকেই বানোয়াট প্রমাণাদি উদ্ভাবন করিতে এবং স্থানীয় মুসলমান ও স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আপনার সমীপে তাহা পেশ করিতে উৎসাহিত করিয়াছে, যাহা অদূর ভবিষ্যতে পারস্পারিক আস্থা স্থাপনে সম্ভবত সহায়ক হবে না।”

২৪শে আগস্ট (১৯৪৬) কেন্দ্রে এক দলীয় কংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দান করিয়া গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বিধ্বস্ত কলিকাতা নগরী সরেজমিনে পরিদর্শন কল্পে ২৫শে আগস্ট কলকাতা আগমন করিলেন। কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী-ওয়ালে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর ৬ই সেপ্টেম্বর (১৯৪৬) কায়েদে আজমের সহিত তাহার বোম্বে ‘মালাবার হিল’ বাসভবনে সাক্ষাত করেন। কায়েদে আজমের সহিত আলোচনার পর ৮ই সেপ্টেম্বর দিল্লীতে পুনরায় সোহরাওয়ার্দী-ওয়াভেল বৈঠক হয়। সোহরাওয়ার্দী-ওয়াভেল বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ই সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম দীর্ঘক্ষণ বৈঠকের পর ১০ই সেপ্টেম্বর (১৯৪৬) ভারতীয় সমস্যা নিরসনকল্পে সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানান। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেলের আমন্ত্রণে ১৬ই এবং ১৮ই সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম-ওয়ালে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভূপালের নওয়াবের উদ্যোগে গান্ধী-জিন্নাহ-ভূপাল নওয়াব একদফা আলোচনা হয়। আলোচনার পর গান্ধী ও জিন্নাহ যুক্ত বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান। স্মর্তব্য যে, ভারতীয় সমস্যা সমাধানকল্পে ১৯৪৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর কায়েদে আজমের বোম্বে মালাবার হিল বাসভবনে গান্ধী-জিন্নাহ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বটে; তবে ভারতের মেঘাচ্ছন্ন ভাগ্যাকাশে সূর্যোদয়ের কোন পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। বরং অনাগত ভবিষ্যত ভারতবাসীর জনা বহিয়া আনে দুর্বিষহ দুঃখ ও যাতনা।

 ৪ঠা ও ৭ই অক্টোবর (১৯৪৬) দিল্লীস্থ ভূপাল হাউজে জিন্নাহ-নেহরু বৈঠক হয়। ১২ই ও ১৩ অক্টোবর কায়েদে আজম-ওয়াভেল বৈঠকে ফলপ্রসূ আলোচনা হয় এবং ১৩ই অক্টোবর নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদানের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তদানুযায়ী ২০শে নভেম্বর (১৯৪৬) জনাব লিয়াকত আলী খান (অর্থ), জনাব আই, আই, চুন্দ্রীগড় (বাণিজ্য), সরদার আবদুর রব নিশতার (যোগাযোগ), রাজা গজনফর আলী খান (স্বাস্থ্য) ও বাবু যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল (আইন) অর্ন্তবর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দেন। বাবু যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল পরিচালিত সিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের সর্বসময় মুসলিম লীগ সংগঠনের প্রতি ভ্রাতৃসুলভ সহানুভূতি ছিল। তাই মুসলিম লীগ শ্রী মন্ডলকে কেন্দ্রীয় সরকারের সদস্য হিসাবে মনোনীত করে। উক্ত সফল পরিণতির একক কৃতিত্ব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন জনাব সোহরাওয়ার্দীর।

আমাদের মত ক্ষুদ্র কর্মীদের তরুণ মন তখনকার নেতাদের আচরণে আশা-নিরাশায় দুলিতেছে। দলমত নির্বিশেষে আমরা অতি আন্তরিকভাবেই ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের শুভ পরিণতি চাহিতেছিলাম। কিন্তু তাহাতো হইবার নহে। নেতাদের আত্মস্বার্থ তাহা হইতে দিবে কেন? তথাপি শেষরক্ষার কামনায় আল্লাহ আল্লাহ করিতে লাগিলাম। অনভিপ্রেতের সূত্রপাত হইল। ৯ই ডিসেম্বর (১৯৪৬) অনুষ্ঠিত ভারতীয় গণপরিষদের অধিবেশনে যোগদান করা হইতে মুসলিম লীগ বিরত রহিল।

বৃটিশ গভর্নমেন্ট ২০শে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৭) ঘোষণা করিলেন যে, ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে বৃটিশ সরকার বন্ধপরিকর। ২২শে মার্চ (১৯৪৭) লর্ড মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল এর স্থলাভিষিক্ত হইয়াই ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সহিত ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। তাহারই প্রচেষ্টায় পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু ঘোষণা করিলেন যে, অনিচ্ছুক অংশ বাদ দিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় কংগ্রেসের কোন আপত্তি নাই। ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস-লীগ নেতৃবৃন্দের সহিত সবিশেষ বিস্তারিত আলোচনার পর ৩রা জুন (১৯৪৭) ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করিলেন। ইহাই বিখ্যাত “৩রা জুন পরিকল্পনা” নামে অভিহিত।

বঙ্গ ভঙ্গের দাবি

                ভারত বিভাগ সম্ভাবনা আঁচ করিতে পারিয়া ভারতীয় হিন্দু মহাসভা নেতা বঙ্গ সন্তান ডঃ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ২৩শে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৭) এক বিবৃতিতে বঙ্গ ভঙ্গের দাবি করেন এবং তদনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ৫ই এপ্রিল তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসম্মেলনে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর সমবায়ে হিন্দু বঙ্গ প্রদেশ গঠন করার দাবি উত্থাপন করেন। উক্ত দাবির ভিত্তিতেই নিখিল ভারত কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালনী বঙ্গভঙ্গ দাবির সমর্থনে মার্চ মাসে (১৯৪৭) প্রকাশ্য বিবৃতি দান করেন।

স্বাধীন বঙ্গের দাবি

উগ্র সাম্প্রদায়িক সর্বনাশা দাবির বিরুদ্ধে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সভাপতি শ্রী সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ, বঙ্গীয় কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টি নেতা শ্রী কিরণ শঙ্কর রায়, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অগ্রজ শ্রী শরৎ চন্দ্র বসু, জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জনাব আবুল হাশিম এমন কি খাজা নাজিমুদ্দিন ও জনাব ফজলুর রহমান স্বাধীন বঙ্গের আওয়াজ তুলিয়াছিলেন। জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭শে এপ্রিল নয়াদিল্লীতে জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গ প্রস্তাব দেশবাসীর সমীপে পেশ করেন। একই তারিখে খাজা নাজিমুদ্দিনও স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গদেশের দাবি উত্থাপন করে বিবৃতি দান করেন। জনাব আবুল হাশিম ৩০শে এপ্রিল (১৯৪৭) এক বিবৃতিতে সার্বভৌম অখণ্ড বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠাবিরোধী শক্তির সকল যুক্তি খণ্ডন করিয়া বঙ্গবাসীর প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানান। ১১ই মে (১৯৪৭) জনাব আবুল হাশিম ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎ চন্দ্র বসু সোদপুর আশ্রমে গান্ধীজীর সহিত সার্বভৌম অখণ্ড বঙ্গদেশ প্রস্তাব আলোচনার জন্য এক বৈঠকে মিলিত হন। ১২ই মে (১৯৪৭) জনাব সোহওয়ার্দী তদীয় মন্ত্রীসভার সদস্য জনাব ফজলুর রহমানসহ চাঁদপুর আশ্রমে মহাত্মা গান্ধীর সহিত পুনঃসাক্ষাত করেন। স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গদেশ প্রচেষ্টার অগ্রগতি অবহিত করার জন্য কায়েদে আজমের সহিত জনাব সোহরাওয়ার্দী দিল্লী ১৫ মে এক বৈঠকে মিলিত হন। ইতিপূর্বে ২৮শে এপ্রিল দিল্লী হইতে কলিকাতা প্রত্যাবর্তনের পর প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন, আবুল হাশিম, বঙ্গীয় মন্ত্রীসভার সদস্য ফজলুর রহমান এবং ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা শরৎ চন্দ্র বসু ও ২৯শে এপ্রিল মুসলিম লীগ সাব কমিটির সদস্যবৃন্দ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নূরুল আমিন, ফজলুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী ও ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা শরৎ চন্দ্র বসু এবং ৩০শে এপ্রিল মুসলিম লীগ সাব কমিটির সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও তদীয় মন্ত্রীসভার সদস্য ফজলুর রহমান, শরৎ চন্দ্র বসু ও কিরণ শঙ্কর রায় পৃথক পৃথকভাবে কয়েক দফা বৈঠকে নিম্নোক্ত প্রস্তাবাবলী আলোচনা করিয়াছিলেন:

 ১। বঙ্গদেশ একটি সার্বভৌম স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হইবে। সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রই ভারতের অন্যান্য অংশের সহিত সম্পর্ক নির্ধারণ করিবে।

২। সংবিধান রচনা ও চালু করার পর বঙ্গীয় আইন পরিষদ প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারে যুক্ত নির্বাচন ভিত্তিতে নির্বাচিত হইবে।

৩। উভয় পক্ষ কর্তৃক ১ম ও ২য় প্যারা গৃহীত হইলেও বৃটিশ সরকার (এইচ,এম,জি) বঙ্গদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করিলে, বর্তমান মন্ত্রীসভা ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইবে এবং প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত সমসংখ্যক মুসলমান ও হিন্দু (তফসিলী হিন্দুসহ) সমবায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হইবে ও প্রধানমন্ত্রী মুসলমান হইবে।

৪। অন্তর্বর্তী সরকার তফসিলী জাতিসহ হিন্দু ও মুসলমানকে চাকুরীতে সমহারে নিয়োগ করিবে।

৫। ১৯৪৮ এর জুন বা তৎপূর্বে বৃটিশ সরকার বঙ্গীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

৬। সংবিধান রচনা করিতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস যথাক্রমে ১৬ জন মুসলমান ও ১৪ জন হিন্দু একুণে ৩০ জন সদস্য বিশিষ্ট অস্থায়ী সংবিধান রচনাকারী সংস্থা গঠন করিবে।

বাংলাকে স্বাধীন ও অখণ্ড রাখতে গভর্নর বরোজের প্রচেষ্টাঃ

Burrows efforts to keep Bengal independent

Sir Frederick Burrows, the Governor of Bengal, made a herculean effort to keep Bengal united and independent, Jinnah and the League had given wholehearted support to the idea. He was also supported by London but all his efforts were rendered fruitless. It was the machination of Patel, Nehru and Gandhi that frustrated this magnificent initiative-Writes. K.Z. Islam.

On 17 May. 1947. the Secretary of State for India Lord Listowel circulated a memorandum of Draft Statement Policy for consideration on Mountbatten’s arrival, a revised version of the Viceroy’s latest draft.

Among other points noted:

“4(a) The arguments for giving an option to Bengal to remain united are:

i) With or without Sylhet, Bengal is large enough to form an independent state.

ii) In any event Bengal, if it does not adhere to Hindustan, will be in affect a separate state even though politically linked with Northwestern Pakistan. To give the option in this case does not therefore open us to the charge of balkanization.

iii) Partition would be most damaging to the inhabitants of Bengal owing to the economic consequences of separating a large part of the hinterland from Calcutta.”

It appears that at the highest level of the British Government there still prevailed some enlightened appreciation of the Bengal situation as compared to Mountbatten’s anti independent Bengal stance. Just before his departure for his final round of discussions with the British Cabinet Mountbatten wrote to Sir Frederick Burrows, Governor of Bengal:

“My talks with Nehru at Simla led me to believe that it is extremely unlikely that the Congress High Command will nccept an independent Bengal or allow their followers to support such a proposal, as their view is that Bengal has no future except in Hindustan; but I do not mean by this meet I should wish Suhrawardy to abandon his efforts for unity.”

In the crucial meeting of the India and Burma Committee held on 19 May, 1947, chaired by Prime Minister Attlee in which Mountbatten was present, Bengal was discussed. Mountbatten informed the meeting that the Bengal Governor was anxious that the Province should not be partitioned, Suhrawardy thought that it might be kept united on the basis of joint electorates and a Coalition Government. Jinnah considered that.with its Muslim majority, an independent Bengal would be a sort of subsidiary Pakistan and was therefore to agree to Suhrawardy plan. Congress might also agree, but only on condition that Bengal did not form part of Pakistan and that special arrangements, which were unlikely to be acceptable to the Muslims, were made with the Central Government of Hindustan. They were opposed to Jinnah’s proposal that Calcutta should become a free city as they believed that without Calcutta, Eastem Bengal might well, within 2 or 3 years, rejoin western part of the Province. Mountbatten had informed the parties that if, before 2 June, 1947 they were able to reach some agreement between themselves as to the future of the Province, he would embody such an agreement in the statement.

On 19 May, 1947. Governor of Bengal Sir Frederick Burrows cabled to Mountbatten in London.

The gist of his cable was that it contained a memorandum by Congress and League on Independent Bengal:

Burrows reported that the trend of Discussions among the League and Congress leaders was satisfactory and there was agreement in which Sarat Bose agreed to drop the proposed name ‘Socialist Republic of Bengal’ in favour of The Free State of Bengal.

Burrows was impressed by the urgency of an immediate agreement if the British Government was to avoid reference to a possibility of partition of Bengal in proposals to be laid before Indian leaders on June 2nd and he had therefore discussed with Suhrawardy and Kiran Sankar Roy separately a new approach, namely, that their present attempts to settle the broad outlines of future constitution of Bengal and its links, if any, with rest. India as basis of a coalition should be reversed and that immediate steps be taken to form a coalition for bengal at once. Before content and text of Viceroy’s paper of June 2nd are irrevocably settled, leaving these matters to be thrashed out in the coalition of the Bengal Constituent Assembly later. Burrows believed that when faced with formation of such a coalition in Bengal the high command of Congress could not repudiate it and that there were advantages in setting out to frame a constitution for a free state of Bengal untrammeled by conditions such as those set out in Sarat Bose list of points. Suhrawardy agreed and said though he could persuade his part and Jinnah to accept this solution. Kiran Sankar Roy also gave Burrows his personal but very cordial agreement both as regards the line of action and to proposition that nothing else would avert bloodshed now or at all events, after the British left. Kiran Sankar Roy was meeting representatives of his party and Sarat Bose that evening and would put the matter to them. Suhrawardy had made it plain to Burrows that the success of proposal, from his point of view, depended entirely on his ability to assure his party that formation of a coalition then would avert any reference to partition of Bengal in statement of June 2nd.

As a result of his talks with the Governor Suhrawardy had great hopes of forming a Coalition Ministry. If that could be assured in time he hoped it would be possible for H.M. Government.

(i) to omit any reference in the statement to be made on June 2nd to the possibility that Bengal may be partitioned and

(11) to omit any reference to ultimate or constitutional connections of future Bengal, tacitly leaving these to Bengal Constituent Assembly when Coalition Cabinet would get elected.

Mountbatten in his letter of 16 May, 1947, to Burrows had remarked that “Bengal is going to be a difficult case to fit into the new plan.” Burrows hoped that solution on lines described above might assist but in any case he advocated it on its own merit and as a means, perhaps the only means, of averting grave disorders in Bengal. Burrows was not aware of the form the statement of june 2nd may then take but if reference to Bengal could be restricted to something on the following lines, it would meet wishes of leaders he had consulted and avoid immediate risks of a conflagration. The formula he suggested was “In Bengal where two major parties have recently agreed to form a Coalition Ministry a separate Constituent Assembly will be elected to draft the future constitution.”

The memorandum that the League and Congress leaders submitted said:

1. Bengal is to be a free independent State. The Free State of Bengal will decide its relations with the rest of India.

2. It is agreed that constitution of Bengal will provide for elections to Bengal Legislature on the basis of joint electorate with reservation of seats proportionate to the population among the Hindus and the Moslems. (The seats as between the Hindus and the Scheduled Castes will be distributed among them in order to give to the Scheduled Castes their existing proportion). The constituencies will be multiple constituencies and votes will be distributive and not cumulative. A candidate who gets majority of votes of his own community and 25 per cent of votes of other communities cast during the elections will be declared elected. If no candidate satisfies these conditions, that candidate who gets largest number of votes of his own community will be elected. The franchise should be as wide as possible and should ultimately be adult franchise. In the case of women the franchise will be restricted on property qualification basis, as at present, for the next 10 years.

3. On the announcement that the proposal of Free State of Bengal has been accepted and that Bengal will not be partitioned, the present Bengal Ministry will be dissolved and a new Ministry brought into being consisting of an equal number of Moslems and Hindus (including Scheduled Caste Hindus) but excluding the Chief. In this Ministry, the Chief Minister will be a Moslem and the Home Minister a Hindu.

4. Pending the final emergence of a Legislature and a Ministry under a new constitution the Hindus (including the Scheduled Caste Hindus) and the Moslems will have an equal share in the Services including military and police. The Services will be manned by Bengalis.

5. A Constituent Assembly composed of 30 persons, 16 Moslems and 14 Hindus, will be elected by the Moslem and non-Moslem members of Legislature or by the Muslim League and the Congress respectively. Power will be transferred to this Constituent Assembly on or before June 1948. Alternatively, the persons already elected to the Constituent Assembly from Bengal Legislature will form the Constituent Assembly of the Free State of Bengal.

It can be seen that Sir Frederick Burrows, the Governor of Bengal made a Herculean effort to keep Bengal united and independent Jinnah and the League had given wholehearted support to the idea. Burrows had a very intimate and close appreciation of the situation prevailing in Bengal from the British point of view. He was supported by London but all his efforts were rendered fruitless. It was the machinations of Patel, Nehru and Gandhi that frustrated this magnificent initiative. Whether the people of Bengal would have been better off within an independent Bengal instead of being partitioned and becoming parts of two states still remains a question.

বাংলাকে স্বাধীন ও অখণ্ড রাখতে

গভর্নর বরোজের প্রচেষ্টা পণ্ড

বঙ্গের গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক বারোজ বঙ্গদেশকে অখণ্ড ও স্বাধীন রাখার জন্য প্রচন্ড চেষ্টা করেছিলেন, জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ এ প্রয়াসের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেন। তিনি লন্ডনের সমর্থনও পেয়েছিলেন কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। এই মহান উদ্যোগকে ভন্ডুল করে দেয় প্যাটেল, নেহরু এবং গান্ধী।

১৯৪৭ সনের মে মাসে ভারত সংক্রান্ত সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড লিস্টওময়েল মাউন্ট বেটনের সর্বশেষ খসড়া পূর্ণবিবেচনার জন্য একটি নীতি নির্ধারক স্মারক প্রেরণ করেন। এতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নিম্নোক্তগুলো উল্লেখযোগ্য:

 ক) বঙ্গদেশ অখণ্ড রাখার পক্ষে যুক্তিগুলো হচ্ছে-

 ১) সিলেট সহ কিংবা সিলেট ব্যতিরেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ভূখন্ডের দিক দিয়ে বেশ বড়।

২) যদি বঙ্গদেশ হিন্দুস্থানের সাথে যুক্ত না থাকে, তাহলে কার্যতঃ এটা একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রই হবে যদিও উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে এ রাষ্ট্রের সম্পর্ক থাকতে পারে। শুধুমাত্র এ সংযোগের আশঙ্কা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবকে দেশকে খণ্ড বিখণ্ড করার প্রয়াস হিসেবে গণ্য করা যায় না।

 ৩) বঙ্গবিভাগ এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে বিশেষতঃ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কারণ কলিকাতার একটি বিশাল পশ্চাদভূমি আলাদা হয়ে যাবে।

বৃটিশ সরকারের উচ্চ মহলে বঙ্গদেশ সম্পর্কে উদার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। মাউন্টম্যান্টেনের স্বাধীন বঙ্গ দেশ বিরোধী মনোভঙ্গির বিপরীতে।

 বৃটিশ মন্ত্রীসভার সাথে সর্বশেষ আলোচনার জন্য যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গের গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বরোজকে লর্ড মাউন্টব্যাটান এক চিঠিতে লেখেন-

“শিমলায় নেহেরুর সাথে আমার আলোচনার প্রেক্ষিতে বলতে পারি একটি স্বাধীন বঙ্গদেশ কংগ্রেস হাই কম্যান্ড যেমন মেনে নেবে না তেমনি তাদের অনুসারীদেরকেও এ ধরনের প্রস্তাব সমর্থন করতে দেবে না, তাদের ধারনা হচ্ছে হিন্দুস্থান ছাড়া বঙ্গের কোন ভবিষ্যত নেই। কিন্তু আমি এটা বোঝাতে চাচ্ছি না সোহরাওয়ার্দী তাঁর অথন্ড বঙ্গদেশ গঠনের উদ্যোগ থেকে নিবৃত্ত হন।

বৃটিশ সরকারের ভারত ও বার্মা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ সনের ১৯শে মে। মাউন্টব্যাটেন এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এটলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বঙ্গদেশ প্রশ্নটি আলোচিত হয়। মাউন্টব্যাটেন প্রধানমন্ত্রীকে জানান যে বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবিভাগের ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। সোহরাওয়ার্দীর ধারণা ছিল এটাকে যুক্ত নির্বাচন এবং কোয়ালিশন সরকারের মাধ্যমে অখণ্ড রাখা যায়। জিন্নাহ ভেবেছিলেন মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ সম্পন্ন স্বাধীন বঙ্গদেশ এক ধরনের সাবসিডিয়ারী পাকিস্তানের মত হবে এবং সেজন্য সোহরাওয়ার্দীর পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। কংগ্রেস হয়ত রাজী হত কিন্তু এ শর্তে যে বঙ্গদেশ যেন পাকিস্তানের অংশে পরিণত না হয় এবং হিন্দুস্থানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে যা নাকি কোন অবস্থাতেই মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হত না।

জিন্নাহ কলিকাতাকে “ফ্রি সিটি” বা অবাধ নগরী হিসাবে চেয়েছিলেন যার বিরোধিতা করে কংগ্রেস কারণ তারা মনে করে কলিকাতা ছাড়া, পূর্ববঙ্গ দুই তিন বছরের মধ্যে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে পূণর্বার যুক্ত হয়ে যেতে পারে। মাউন্টব্যাটেন রাজনৈতিক দলগুলোকে জানান যে প্রদেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে, যদি তারা ১৯৪৭ সনের ২রা জুনের আগে কোনরকম সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে তাহলে তিনি তা তাঁর বিবৃতিতে সংযোজন করবেন।

১৯৪৭ সনের ১৯শে মে বঙ্গের গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বরোজ মাউন্টব্যাটেনকে এক তার বার্তা প্রেরণ করেন। |

তাঁর তার বার্তায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের স্বাধীন বঙ্গদেশ সম্পর্কে তাদের স্ব স্ব স্মারক সন্নিবেশিত ছিল।

বরোজ জানালেন যে লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে তা সন্তোষজনক। এবং এমন একটি চুক্তি হয়েছে যার ফলে শরৎ বসু তার প্রস্তাবিত “সমাজতান্ত্রিক বঙ্গদেশ প্রজাতন্ত্র” নামের পরিবর্তে “স্বাধীন বঙ্গ দেশের” নাম রাখতে সম্মত হয়েছেন। ২রা জুন বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত ভারত সরকারের প্রস্তাব ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে বৃটিশ সরকারের প্রস্তাব পেশ করার কথা ছিল-এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই যাতে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব পেশ করা না হয় সেজন্য গভর্নর বরেজ একটি আশু সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং এ প্রেক্ষিতেই তিনি সোহরাওয়ার্দী এবং কিরণ শংকর রায়ের সাথে আলাদা আলাদাভাবে এক নতুন আলোকে আলোচনা করেন। তার নতুন প্রস্তাবের মধ্যে ছিল ভারতের অন্য যে কোন অংশের সাথে সম্ভাব্য সম্পর্ক সম্পর্কে তাদের পূর্বতন অবস্থানের পরিবর্তন সাধন করে কালবিলম্ব না করে বঙ্গদেশের জন্য একটি কোয়ালিশন প্রস্তাব গ্রহণের আশু পদক্ষেপ নেয়া অত্যাবশ্যক। ভাইসরয়ের ২রা জুনের প্রস্তাবনা বিতর্কাতীত ভাবে গৃহীত হওয়ার আগেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। অন্যান্য বিষয় বঙ্গীয় কোয়ালিশন সরকারের আইন সভায় আলোচনা করে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করা যাবে। বরোজের বিশ্বাস ছিল বঙ্গে এমন একটি কোয়ালিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা কংগ্রেস হাই কমান্ড করতে পারবে না এবং স্বাধীন বঙ্গ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে অনেক সুবিধা রয়েছে যদি এতে শরৎ বসুর শর্তাবলীগুলো না থাকে। সোহরওয়ার্দী এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান, তিনি বিশ্বাস করতেন যে এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনি জিন্নাহ ও তার দলকে রাজী করাতে পারবেন। কিরণ শংকর রায়ও বরোজের প্রস্তাবকে এবং এ ব্যাপারে প্রস্তাবিত পদক্ষেপের প্রতি তার আন্তরিক সমর্থন স্থাপন করেন-যে পদক্ষেপে বৃটিশ থাকাকালে অথবা তাদের চলে যাওয়ার পরে রক্তপাত এড়ানো যাবে। কিরণ শংকর রায়ের সেদিন সন্ধ্যায় তার দলের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং শরৎ বসুর সাথে সাক্ষাৎকার কথা। সোহরাওয়ার্দী অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে, প্রস্তাবটির সাফল্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ২রা জুনের বিবৃতিতে বঙ্গ বিভাগ সম্পর্কিত কোন প্রস্তাব থাকবে না এ মর্মে তার দলকে নিশ্চিত করার উপর।

গভর্নরের সাথে আলোচনার পর একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের সাফল্য সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দী প্রচন্ডভাবে আশান্বিত ছিলেন। যদি এটা নিশ্চিত করা যেত তাহলে বৃটিশ সরকারের পক্ষে

 ১) ২রা জুনের বিবৃতিতে বঙ্গ বিভাগ সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ না করা। এবং

 ২) ভবিষ্যত বঙ্গদেশের শাসনতান্ত্রিক সম্পর্কজনিত কোন প্রকার উল্লেখ না করে কৌশলে ভবিষ্যতের নির্বাচিত দ্য কোয়ালিশন মন্ত্রী সভার উপর ন্যস্ত করা।

মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সনের ১৬ই মে বরোজকে যে চিঠি লেখেন তাতে মন্তব্য করেন “বর্তমান পরিকল্পনায় বঙ্গকে সন্নিবেশিত করা কঠিন ব্যাপার।”

বরোজ মনে করেছিলেন যে উপরে বর্ণিত প্রস্তাব বঙ্গ সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে। কিন্তু প্রচন্ড নৈরাজ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি বর্ণিত সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে উত্থাপন করেন। ২রা জুনের বিবৃতিতে কি থাকবে সে সম্পর্কে বরোজের কোন ধারনা ছিল না। তিনি যে ফর্মুলা দিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল “বঙ্গে দুটো প্রধান দল রয়েছে-সম্প্রতি তারা একটি কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠনে সম্মত হয়েছেন এবং ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য একটি আলাদা বিধান সভা নির্বাচিত হবে। লীগ এবং কংগ্রেস নেতারা তাদের স্মারকে যে উল্লেখ করেছিলেন তা নিম্নরূপঃ

ক) বঙ্গদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। এ স্বাধীন দেশ ভারতের অন্য অংশের সাথে সম্পর্ক নির্ধারণ করবে।

খ) এ ব্যাপারে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বঙ্গদেশের শাসনতন্ত্রে বঙ্গের আইন সভার নির্বাচন যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে হবে, এতে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে আসন সংরক্ষিত থাকবে। সিডিউল কাস্ট সম্প্রদায়ের এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আসন এমনভাবে সংরক্ষিত থাকবে যাতে সিডিউল কাস্ট সম্প্রদায়ের জন্য তাদের বর্তমান হারের আসন সংরক্ষিত থাকে।

নির্বাচনী এলাকা একটি হবে না অর্থাৎ ভোট পূর্ণভোটের ভিত্তিতে (cumulative) হয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠী থেকে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে গণনা হবে। একজন প্রার্থী যদি তার নিজস্ব সম্প্রদায়ের মেজরিটি ভোট এবং অন্য সম্প্রদায়ের ভোটারদের ২৫ শতাংশ ভোট পায় তাহলে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। যদি কোন প্রার্থীর ক্ষেত্রে এ সব শর্তাবলী পূরণ না হয় তাহলে স্বীয় সম্প্রদায়ের সর্বাধিক ভোট থেকে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। ভোটাধিকার যত বেশি সম্ভব ব্যাপক করা হবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন হবে। বর্তমানে চালু পদ্ধতি অনুযায়ী সম্পদের ভিত্তিতে ভোটাধিকার থেকে মহিলাদের ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা হবে।

গ) স্বাধীন বঙ্গদেশ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে এবং বঙ্গ ভঙ্গ হবে না মর্মে ঘোষণা দেয়া হলে বর্তমানের বঙ্গীয় মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়া হবে এবং একটি নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করা হবে। সে মন্ত্রী সভায় মুসলমান ও হিন্দু (তফসিলী জাতিসহ) সমান সংখ্যক মন্ত্রী থাকবে কিন্তু এটা প্রধানমন্ত্রীর বেলায় প্রযোজ নয়। প্রধানমন্ত্রী হবেন মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হবেন হিন্দু।

ঘ) নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে একটি আইন সভা ও মন্ত্রী পরিষদ গঠন হওয়া পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায় (তফসিলি জাতি সহ) এবং মুসলিম সম্প্রদায় চাকুরী বাকুরীতে সম সংখ্যক হবেন।

ঙ) গণ-পরিষদ সদস্য সংখ্যা হবে ৩০, ১৬ জন মুসলমান, ১৪ জন হিন্দু। তারা মুসলমান ও হিন্দু অথবা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। ১৯৪৮ সনের জুন মাসের আগে অথবা ঐ তারিখেই ক্ষমতা এ গণপরিষদে ন্যস্ত করতে হবে। বিকল্পভাবে, বঙ্গীয় আইন সভায় যারা ইতিমধ্যে বঙ্গীয় আইন সভা থেকে গণপরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সমন্বয়ে স্বাধীন বঙ্গ রাষ্ট্রের গণপরিষদ গঠিত হবে।

বঙ্গ-ভঙ্গ বনাম স্বাধীন বঙ্গ

বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গ-আন্দোলন প্রয়াসে লিপ্ত থাকাকালীন অবাঙ্গালি হিন্দু নেতা আচার্য কৃপালনী, পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভা নেতা বঙ্গসন্তান শ্রী শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী সৃষ্ট বঙ্গ-ভঙ্গ দাবিকে সর্বভারতীয় প্রবল হিন্দু দাবিতে পরিণত করিয়াছিলেন। পরিহাস ও পরিতাপের বিষয়, যে হিন্দু সম্প্রদায় ১৯০৫ সালে বঙ্গ-ভঙ্গ রদ করার উদ্দেশ্যে ভারতে ও ভারতের বাহিরে এক অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন করিয়া সম্রাট পঞ্চম জর্জকে ১৯১১ সালে বঙ্গ-ভঙ্গ রদ ঘোষণা করিতে বাধ্য করাইয়াছিল, সেই হিন্দু সন্তানরাই ১৯৪৭ সালে বঙ্গ-ভঙ্গ দাবিতে সমগ্র হিন্দু-ভারতকেই প্রকম্পিত করিয়া তুলিল। তাহাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইল, ইংরেজ রাজের কুটিল সহায়তায় বঙ্গ-ভঙ্গ হইয়া গেল। বঙ্গীয় হিন্দু-মুসলিম নেতারা বাঙ্গালি জাতিকে সুসংঘবন্ধ করার নিমিত্ত হিন্দু-মুসলিম সমস্যাকে বাস্তব দৃষ্টিতে মোকাবিলা করতে স্বতঃই প্রয়াস পাইতেছিলেন। দূরদর্শী বিচক্ষণ বাঙ্গালি রাজনীতিজ্ঞ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ২৩শে এপ্রিল (১৯২৪) বেঙ্গল প্যাক্ট করেন। কিন্তু অবস্থা বৈগুণ্যে বিভ্রান্ত হইয়া তদীয় অনুগামী সুভাষ চন্দ্র বসু নিজ সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কৃষ্ণনগর কনফারেন্সে (১৯২৯) বেঙ্গল প্যাক্ট বা বঙ্গ চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে নেতাজী এই ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা সফল হইল না- ত্রিপুরী কংগ্রেস সম্মেলনে দ্বিতীয়বারের জন্য কায়েমী স্বার্থের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হলেন বটে, তবে বাঙালি উর্ধ্বতন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কারসাজিতে অচিরেই পদত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন। স্পষ্ট হইয়া গেল যে, অবাঙ্গালিরা কখনই বাঙ্গালি নেতৃত্বকে বরদাশত করিতে রাজী ছিল না। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু স্বীয় ভ্রম উপলব্ধি করিলেন ও তাহার রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া স্থানীয় সমঝোতার মাধ্যমে কলিকাতা মুসলিম লীগ নেতা আব্দুর রহমান সিদ্দিকীকে কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র মনোনীত ও নির্বাচিত করেন। এইবারও বাঙ্গালি জাতির সঙ্কট মুহূর্তে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ, কিরণ শঙ্কর রায় ও শরৎ চন্দ্র বসু এবং মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম মিলিতভাবে হিন্দু-মুসলমানের স্বাধীন ও সার্বভৌম বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে আত্মনিয়োগ করিলেন। তাহারা মহাত্মা গান্ধী ও কায়েদে আজমকে উপরে বর্ণিত খসড়া চুক্তির মর্ম অবহিত রাখিয়া চলিলেন। কিন্তু সর্বভারতীয় শীর্ঘ নেতৃদ্ধয় স্ব স্ব অহমিকা ও কর্তৃত্বের বশবর্তী হইয়া বঙ্গ-ভঙ্গ অপরিহার্য করিয়া তুলিলেন। আর সেই মুহূর্তেই বাঙ্গালি হিন্দু ও বাঙ্গালি মুসলমান উগ্র সাম্প্রদায়িকতার সর্বনাশা বিষপানে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। বঙ্গীয় কংগ্রেস-লীগ খসড়া চুক্তির কপিসহ ২৩শে মে (১৯৪৭) শ্ৰী শরৎ চন্দ্র বসু কর্তৃক লিখিত পত্রান্তরে গান্ধীজীর ৮ই জুনের লিখিত জবাবের কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিলাম:

“I have gone through your draft. I have now discussed the scheme roughly with pandit Nehru and Sardar Patel. Both of them are dead against the proposal……. you should give up the struggle for Unity of Bengal & cease to disturb the atmosphere that has been created for the partition of Bengal.”

অর্থাৎ “আপনার খসড়া আমি সম্পূর্ণ পাঠ করিয়াছি। পণ্ডিত নেহরু ও সর্দার প্যাটেলের সহিত স্কীমটি মোটামুটি আলোচনা করিয়াছি। তাহারা উভয়েই প্রস্তাবটির ঘোর বিরোধী। অখণ্ড বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আপনার ত্যাগ করা উচিত এবং বঙ্গভঙ্গের পক্ষে সৃষ্ট পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বিনষ্ট করা হতে বিরত হোন।”

কত কৌশলই না জানেন নেতারা। পূর্বাহ্নে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানকে বানচাল করার জন্য বঙ্গ-আসাম গ্রুপিংয়ের বিরুদ্ধে আসাম প্রদেশের সাম্প্রদায়িক প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদৌলির নেতৃত্বে পরিচালিত প্রতিবাদের ঝড়কে কতই না উৎসাহ দিয়াছেন মহাত্মাজী! শ্রদ্ধাভাজন নেতারা বারবার সংকীর্ণ স্বার্থপ্রণোদিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আর দেশবাসী ও আমাদের মত তরুণ কর্মীরা হই তাহাদের হুতাশন-যজ্ঞের কাঠ খড়ি। আফসোসের বিষয়, এতদসত্বেও বাঙ্গালি হিন্দুদের নিকট সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদই গৃহীত হইল-বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ নহে। আমার ধারণা, বর্তমান রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও রাষ্ট্রীয় সীমারেখা যাহাই হউক না কেন, ঐতিহাসিক অগ্রগতির এক পর্যায়ে লাহোর প্রস্তাবের সার্থক বাস্তবায়ন হইবে ও বৃহত্তর বঙ্গদেশ রাষ্ট্র গঠিত হইবে। ইহা ইংগিত রাখিয়া গিয়াছেন শরৎ চন্দ্র বসু ও আবুল হাশিম। এই নেতৃদ্বয় ফেব্রুয়ারি মাসে (১৯৪৭) এক গোপন দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় বাংলা ভাষাভাষী বৃহত্তর বঙ্গদেশ গঠনের খসড়া প্রণয়ন করেন। প্রণীত খসড়া অনুযায়ী বিহার প্রদেশের বাংলা ভাষাভাষী পূর্ণিয়া জেলা ও বঙ্গদেশের বর্ধমান ডিভিশনভুক্ত জেলাগুলি সমবায়ে পশ্চিম বঙ্গ প্রদেশ, প্রেসিডেন্সী ডিভিশন, রাজশাহী ডিভিশন, ঢাকা ডিভিশন, চট্টগ্রাম ডিভিশন ও শ্রীহট্ট জেলা সমবায়ে মধ্যপ্রদেশ এবং শ্রীহট্ট জেলা ব্যাতিরেকে আসাম প্রদেশের জেলা সমবায়ে পূর্ববঙ্গ প্রদেশ গঠিত হইবে। আর এই প্রদেশগুলির সমবায়ে গঠিত হইবে বৃহত্তর বঙ্গদেশ রাষ্ট্র।

মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিম নেতৃত্বাধীন অংশ ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট direct action day পালন দিবসে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় অখণ্ড বাংলার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার ৪০ নং থিয়েটার রোডস্থ বাসভবনে এক প্রতিনিধিত্ব মূলক সভা আহ্বান করেন। উক্ত সভায় জনাব আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রী সভায় তফসিলী সম্প্রদায়ের মন্ত্রী শ্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, দৈনিক ইত্তেহাদের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা, অল বেঙ্গল স্টুডেস্টস লীগের প্রাক্তন জেনারেল সেক্রেটারি নুরুদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্ব বঙ্গ মুসলিম লীগের কর্মী শিবির নেতা পরবর্তীতে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল সেক্রেটারি জনাব শামসুল হক, ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ সম্পাদক সামসুদ্দিন আহমদ সহ অনেকেই যোগ দেন।

আমরা ঢাকায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনমত গড়িয়া তুলিবার প্রচেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োজিত করিলাম। ছাত্র মহলই ছিল আমাদের কর্মক্ষেত্র। স্বাধীন ও সার্বভৌম অথণ্ড বঙ্গদেশ পরিকল্পনা সমর্থনে হিন্দু-মুসলিম ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা পরিচালনাকালে ছাত্রনেতা শ্রী সরোজ দাস ও শ্রী অজিত কুমার হাজরার সহিত আমার হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। তখনকার উগ্র সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত হাওয়ায় দেশ জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও সংকল্প ও আদর্শের মিল আমাদিগকে ভ্রাতৃত্বের রাখী বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছিল।

পূর্বসূরী শরৎ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভার উত্তরসূরী বংশধর এর উপর ন্যস্ত।

রাজা গোপাল আচারীর প্রস্তাব:

১৯৪২ সালে বৃটিশ কূটনীতিক ও মন্ত্রী-স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতে আসেন। তিনি মুসলিম লীগ নেতা কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলোচনা করেন।

কংগ্রেসের অখণ্ড ভারতের দাবি থাকলেও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা রাজা গোপাল আচারী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এর কাছে এই মর্মে প্রস্তাব রাখেন যে- যে সমস্ত জেলাসমূহ ও নিকটবর্তী জেলা সমূহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট সেগুলো একত্রে মুসলিম জোন এবং যে সমস্ত জেলা সমূহ ও নিকটবর্তী জেলা সমূহ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলি একত্রে হিন্দু জোন গঠিত হইবে। ফলশ্রুতিতে পাঞ্জাব ও বেঙ্গল বিভক্ত হয়।

অন্যদিকে বাংলার গভর্নর মিঃ বরোজ এর প্রস্তাব ছিল গণভোটের।

মুসলিম লীগ কর্তৃক ৩রা জুন পরিকল্পনা গ্রহণ:

নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিল ৫ই জুন (১৯৪৭) অধিবেশনে ইংরেজ সরকার ঘোষিত ভারত বিভাগজনিত ৩রা জুন পরিকল্পনা ৪০০-৮ তোটে গ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, নিখিল ভারত কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় নেতা রাজা গোপালাচারী ১৯৪৩ সালে ক্রিপস মিশন ভারতে অবস্থানকালে কায়েদে আজমের সহিত আলোচনার সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলির সমবায়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দিয়াছিলেন। “৩রা জুন পরিকল্পনা” রাজা গোপালাগারীর প্রস্তাবের প্রায় অভিন্নরূপ। লাভের মধ্যে হইল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের চরম অবনতি, ব্যাপক হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, লুট, রাহাজানী, অগ্নিসংযোগ ও মেয়েদের সতীত্ব হরণ। নেতাদের রহস্য সত্যি বুঝা দায়।

১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম অধ্যুষিত সীমান্ত প্রদেশে খান আবদুল গফফার খান ও ডাঃ খান সাহেব ভ্রাতৃম্বয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত কংগ্রেস প্রার্থীরা মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিপুলভাবে জয়লাভ করে। তাই ৩রা জুন ঘোষণা মোতাবেক উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশবাসীদের মতামত যাচাইয়ের জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে সীমান্ত প্রদেশবাসী পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগদানের রায় দেয়। তদনুরূপ আসাম প্রদেশ ভুক্ত শ্রীহট্ট জেলায় ৬ই ও ৭ই জুলাই (১৯৪৭) অনুষ্ঠিত গণভোটে শ্রীহট্ট জেলা পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেয়। আমি কতিপয় বন্ধুসহ শ্রীহট্টে অনুষ্ঠিত গণভোটে অংশগ্রহণ করিয়াছিলাম।

পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম

যথাক্রমে ১৪ই ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হইল। ভারতবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল ভারত হইল বিভক্ত; পাঞ্জাব বিভক্ত হইল; বঙ্গদেশ বিভক্ত হইল; আসাম বিভক্ত হইল। লক্ষ লোকের কাফেলা বাস্তভিটা ত্যাগ করিয়া ভিন দেশ পানে যাত্রা করিল। যাত্রাপথে কেউ প্রাণ হারাইল, কেউ স্বদেশেই পলকের মধ্যে বিদেশী হইল ও রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায় ভূষিত হইল, কেউ মুহূর্তের মধ্যে কাঙ্গাল ভিক্ষুকেও পরিণত হইল, কেউ গৃহহারা ও বাস্তুহারা হইল। সমৃদ্ধশালী অতীত যেন অট্টহাসি হাসিতে লাগিল। একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীই ইহার নিদারুণ মর্মব্যথা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে, অন্য কেউ নয়। স্বচক্ষে দেখিয়াছি, ব্যথায় জর্জরিত হইয়াছি, কিন্তু প্রতিকার করার ক্ষমতা ছিল না; বিষাক্ত পারিপার্শ্বিকতা অসহায় করিয়া রাখিয়াছিল; মনুষ্যত্ববোধ, বিবেক, শিক্ষাদীক্ষা বিফল ছিল। নারকীয় আচার বাহবা কুড়াইত, পশুত্ব প্রদর্শনই ছিল বীরত্ব।

স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রি সভা:

১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট নিম্নলিখিত নেতৃবৃন্দদের নিয়ে পাকিস্তানের প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভা গঠিত হয়-

১) নওয়াব জাদা লিয়াকত আলী খান- প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষা মন্ত্রী

২) স্যার জাফরুল্লাহ খান (আহম্মদীয়া সম্প্রদায়) -পররাষ্ট্র মন্ত্রী

৩) গোলাম মোহাম্মদ (আমলা) – অর্থ মন্ত্রী

৪) সরদার আবদুর রব নিশতার (সীমান্ত প্রদেশ)- যোগাযোগ মন্ত্রী

৫) শ্ৰী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল তফসিলী সম্প্রদায়, পূর্ব পাকিস্তান।

৬) ফজলুর রহমান (পূঃপাক) শিক্ষা ও শিল্প।

৭) পীরজাদা আবদুস সাত্তার (সিন্দু প্রদেশ) খাদ্য

৮) খাজা শাহাবুদ্দিন (পূর্ব পাকিস্তান) তথ্য।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক সূচনা

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব না, ১৯৪৬ সালের দিল্লী প্রস্তাব মোতাবেক ভারত খণ্ডিত হইয়া একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম হইল। ২৭শে জুন (১৯৪৭) বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ঢাকা পূর্ববঙ্গের রাজধানী করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৫ই আগস্ট (১৯৪৭) পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি বৈঠকে খাজা নাজিমুদ্দীন ৭৫-৩৯ ভোটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পরাজিত করিয়া পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত হইলেন।

আমি ঢাকা গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজ হইতে ১৯৪৭ সালের ইন্টারমিডিয়েট বিজ্ঞান (Intermediate Science) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.কম. ক্লাসে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসাবে ভর্তি হইলাম।

অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও অবিভক্ত বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করায় আমরা (শহীদ-হাশিম গ্রুপ কর্মীবৃন্দ) পূর্ব পাকিস্তান রাজনীতিতে নেতৃত্বহীন হইয়া পড়িলাম।

বিভাগোত্তর সাম্প্রদায়িক কলহ

দেশ বিভাগোত্তরকালে সাম্প্রদায়িক কলহু ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর চরম আঘাত হানিল। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাঞ্জাব হইতে হিন্দু জনতা এবং পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব পাঞ্জাব হইতে মুসলিম জনতা স্ব স্ব বাস্তভিটা ত্যাগ করিয়া বিদেশে আশ্রয় গ্রহণ করিল। মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে ব্রতী হইলেন এবং মহানগরী কলকাতা কেন্দ্র করিয়া পাক-ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শান্তিস্থাপন মিশনে আত্মনিয়োগ করিলেন। জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মহাত্মাজীর সহচর হিসাবে যোগদান করেন। বিভাগোত্তর কালে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মাজীর প্রচেষ্টাকে উগ্র সাম্প্রদায়িক ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ অত্যন্ত বিষ নজরে দেখিত। অবশেষে সেবক সংঘেরই অন্যতম সদস্য নাথুরাম গডসের পিস্তলের গুলীতে ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ মহাত্মাজী দিল্লির প্রার্থনা সভায় প্রাণ হারাইলেন। সাম্প্রদায়িক শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মাজীর নৈতিক দায়িত্ববোধ কর্মযোগ মানব কূলে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। গান্ধীজীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর কায়েদে আজমের উক্তি ‘‘A great Hindu Leader” বা “এক মহান হিন্দু নেতা” কার্যতঃ সত্য হইলেও অনেককেই মর্মাহত করিয়াছিল। কলিকাতা ও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত মুসলিম নিধন বন্ধ করার দাবিতে মহাত্মা গান্ধীর অনশন ব্রত পালনের ফলেই দাঙ্গা প্রশমিত হয় এবং উল্লেখ্য যে, গান্ধীজী ৪ঠা সেপ্টেম্বর জনাব সোহরাওয়ার্দীর হস্তে কমলালেবুর রস গ্রহণ করিয়া অনশন ভঙ্গ করেন। গান্ধীজী তাহার সহজাত শুভবুদ্ধিতে উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে, পাক-ভারত সরকার ঘরের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হইলেই হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সৌহার্দা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাই ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নির্দেশক্রমে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকে পাকিস্তানকে দেয় ৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করিতে অস্বীকৃতি জানাইলে মহাত্মা গান্ধী পাকিস্তানকে দেয় টাকা পরিশোধের দাবিতে ও দিল্লীতে মুসলিম নিধনের প্রতিবাদে পুনঃ অনশন ধর্মঘট ঘোষণা করেন। ধর্মান্ধ উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের নির্মমভাবে গান্ধীজীর প্রাণ সংহার করিয়া এই মহান প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।

সোহরাওয়ার্দীর কলিকাতা অবস্থানঃ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার প্রাণপণ প্রচেষ্টা

কায়েদে আজম কর্তৃক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত ইত্যাদি পদে নিয়োগ প্রদান সত্বেও জনাব সোহরাওয়ার্দী বিভাগোত্তর ভারতে অবস্থানকারী চার কোটি মুসলমানের জান-মাল ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধানের মহান দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হইয়া ভারত বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নেতাদের ন্যায় পাকিস্তান অভিমুখে রওয়ানা হন নাই। তিনি প্রাণভয় তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া উভয় রাষ্ট্রের হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক স্বাভাবিক ও মানবিকরণ প্রয়াসে সংখ্যালঘু সনদ তৈয়ারি করিয়া দিল্লী ও করাচি সরকারের নিকট ধর্না দিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গ গভর্নর ডঃ কৈলাশ নাথ কাটজু ও মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ প্রযুল্প চন্দ্র ঘোষকে পূর্ব বঙ্গ শুভেচ্ছা সফরে উদ্ধুদ্ধ করিয়াছেন, কলিকাতা শান্তি সেনা গঠন করিয়াছেন, স্বয়ং ৩রা জুন ১৯৪৮ শান্তি মিশনে ঢাকা আগমন করিয়াছেন-যদিও খাজা নাজিমুদ্দিন সরকার শহীদ মিশন নিয়া ঢাকা আসিবার অর্থ বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের উপর কলঙ্ক আরোপ ইত্যাদি অপব্যাখ্যা ও অপবাদ দিয়া পূর্ব বঙ্গ হইতে বহিঃস্কার করিয়া দিয়াছিলেন। আমরা যত উৎসাহের সহিত শহীদ সাহেবকে বরণ করিয়াছিলাম, তাহ্যর লক্ষগুণ মলিন বদনে তাহাকে ঢাকা ত্যাগ কালে বিদায় দিয়াছিলাম।

বিভাগোত্তর যুগে ভারতীয় মুসলমানদের মনে সাহস ও বলদানের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী সাহেব কলিকাতায় থিয়েটার রোডস্থ স্বীয় বাসভবনে ৯ই ও ১০ই নভেম্বর (১৯৪৭) ভারতীয় মুসলিম কনভেনশন অনুষ্ঠান করিলেন এবং তথা হইতে সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেমে সন্দেহ প্রকাশ না করিতে ও “সংখ্যালঘু সনদ” গ্রহণ করিতে পাক-ভারত সরকারন্বয়ের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাইলেন।

পাকিস্তান ও পূর্ববঙ্গ নেতৃত্বের প্রতি প্রগতিশীল কর্মীদের বীতশ্রদ্ধা

জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জনাব আবুল হাশিমের নেতৃত্বে আমরা যাহারা মুসলিম লীগ বা মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনের কর্মী ছিলাম, তাহারা ভারত ও বঙ্গ বিভাগের পর পাকিস্তান ও পূর্ববঙ্গ নেতৃত্বের উপর নিম্নোক্ত কারণে বীতশ্রদ্ধ ছিলামঃ

প্রথমতঃ ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চে গৃহীত “লাহোর প্রস্তাব”কে সংশোধন করিয়া ১৯৪৬ সালের ৯ই এপ্রিল লেজিসলেটারস কনভেনশনে অন্যায় ও অবৈধভাবে উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে দুইটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্থলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনমর্মে ‘দিল্লী প্রস্তাব ভারতীয় মুসলিম জনতার উপর চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছিল।

দ্বিতীয়তঃ জনাব সোহরাওয়ার্দী কলিকাতা ও দার্জিলিং শহরময় বার্লিনের ন্যায় মুক্ত শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা করিয়াছিলেন। পরিতাপের বিষয়, শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত প্রখ্যাত ও বিখ্যাত, আইনজীবিদিগকে নিয়োগ না করিয়া কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব বিহারের এক অবাঙ্গালি অখ্যাত আইনজীবি জনাব ওয়াসিমকে ‘বাউন্ডারী কমিশনের’ সামনে ওকালতির জন্য নিযুক্ত করিল। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ২৭শে জুনের সভায় এক প্রস্তাবে ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের অস্থায়ী রাজধানী করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আকরম-নাজিম চক্রের ভয় ছিল শেরে বাংলা সোহরাওয়ার্দীর যুগপৎ ক্ষুরধার সওয়াল-জওয়াবে যদি সাফল্য অর্জিত হয়, তাহা হইলে মুসলিম বাংলার হৃদয়ে তাহারা স্থায়ী আসন পাইয়া যাইবেন এবং পাকিস্তান রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠা লাভ করিবেন। তাই লিয়াকত-নাজিম চক্র নবগঠিত রাষ্ট্রের স্বার্থ হানিকর কার্য সজ্ঞানে করিতে এতটুকু বিবেক দংশনবোধ করে নাই। ক্ষমতার কুটিল অভিযানে সবই হয়!

তৃতীয়তঃ দায়-সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করিবার জনা বেঙ্গল পার্টিশান কাউন্সিলে মুসলিম লীগ প্রতিনিধি ছিলেন জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিন এবং কংগ্রেস প্রতিনিধিদ্বয় ছিলেন বাবু নলিনী রঞ্জন সরকার ও বাবু ধীরেন মুখোপাধ্যায়। গভর্নর আর, জি, কেসী ছিলেন চেয়ারম্যান। কেন্দ্রীয় পার্টিশান কাউন্সিলে মুসলিম লীগ প্রতিনিধি ছিলেন নওয়াবজাদা, লিয়াকত আলী খান ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং কংগ্রেস প্রতিনিধিদ্বয় ছিলেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ও আই, এম, প্যাটেল। গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন স্বয়ং চেয়ারম্যান ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব দালান-কোঠা, ইমারত, স্থাবর সম্পত্তি ইত্যাদি মার্কেট ভেন্যুতে মুল্যায়ন দাবি করিলে কংগ্রেস প্রতিনিধি বুক ভেন্যু মুল্যায়ন প্রস্তাব করেন। বেঙ্গল পার্টিশন কাউন্সিল একমত হইতে না পারায় কেন্দ্রীয় পার্টিশান কাউন্সিলে সিদ্ধান্তের জন্য পাঠান হইল। পার্টিশান কাউন্সিল নীতিগতভাবে সম্পত্তির মূল্যায়ন করিল বুক ভেল্যু অনুসারে। এইরূপে বিনা ক্ষতিপূরণে কলিকাতা ছাড়িয়া দেওয়া হইল। অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তান পাইল লাহোর, করাচি, পেশোয়ার ও কোয়েটা শহরসমূহ এক প্রকার বিনা অর্থব্যয়ে। এভাবে শুরুতেই পূর্ববঙ্গ বঞ্চিত হইতে লাগিল।

পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগের জন্ম

পূর্বে বলিয়াছি, জনাব সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের ভারত অবস্থান হেতু তাহাদের অনুসারী ও সমর্থকবৃন্দ পূর্ববঙ্গে সবিশেষ হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়েন। স্মরণীয় যে, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি পদ হইতে ইস্তফা দিলে, উক্ত শূন্য আসন নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানিস্তন সাধারণ সম্পাদক জনাব আবুল হাশিম এবং আকরম-নাজিম চক্রের সমর্থনপুষ্ট শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালে বঙ্গীয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রত্যক্ষভাবে জনাব আবুল হাশিমকে সমর্থন জানান নাই এবং ১৯৪৭ সালের ৫ই আগস্ট পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি নেতা নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে জনাব সোহরাওয়ার্দীকে আবুল হাশিম সক্রিয় সমর্থন না দেওয়াতে কার্যতঃ সোহরাওয়ার্দী-হাশিম জোট সমর্থকবৃন্দ দ্বিধা-বিভক্ত হইয়া গেলেন। এমতাবস্থায় কর্মীদের স্তিমিত সাহস ও উদ্যম পুনর্জাগরণ প্রয়াসে তরুণ নেতা শামসুল হক সাহেব ১৫০ নং মোগলটুলীতে (ঢাকা) কর্মীসভা আহ্বান করিয়া বিভাগোক্তর রাজনীতিতে ভূমিকা নির্ধারণকল্পে যুব সম্মেলন আহ্বানের প্রস্তাব করেন। জনাব কফিল উদ্দিন চৌধুরী সভাপতি ও জনাব শামসুল হককে সম্পাদক নিয়োগ করিয়া একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হইল। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাতের বেচারাম দেউড়ীস্থ বাসভবনের হল কামরায় ৬ই ও ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ মহাউৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইল। জনাৰ সাদেক আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ২৫সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগ (Pakistan Democratic youth League) গঠিত হয়। সদ্য আজাদী প্রাপ্ত পাকিস্তানের মাটিতে উজীরে আলা নাজিমুদ্দিন ও আকরম খাঁ পরিচালিত ধর্মান্ধ রক্ষণশীল মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সম্মেলন বিরোধী ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করিয়া ও মুসলিম লীগের জনসমর্থিত দোর্দণ্ডপ্রতাপকে বৃদ্ধাঙ্গু্লি প্রদর্শনপূর্বক সম্মেলনের জন্য তাহার বাসভবনকে ব্যবহার করিতে দিয়া এবং সম্মেলনের উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিতে গিয়া জনাব আবুল হাসনাত যে সাহসিকতা, সহৃদয়তা ও দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়াছিলেন, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা তাহা আমৃত্যু কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করিবেন। ট্রাকে ট্রাকে মুসলিম লীগ বাহিনীর সম্মেলন বিরোধী অসৌজন্যমূলক শ্লোগানসহ ঢাকা নগর প্রদক্ষিণ ও সম্মেলন সম্পর্কে ঢাকাবাসীর বিরূপ মনোভাব ভুলিবার নহে। আমরা সেদিন ঢাকাবাসীদের দৃষ্টিতে ভারত কর্তৃক নিয়োজিত পাকিস্তান বিধ্বংসী ভারতীয় চর বিশেষ ছিলাম। তবে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জনগণ এই চেনা মুখগুলিকেই মাঠে ময়দানে ও পুরোভাগে দেখিয়াছে, তাই কিছুটা সংশয়ও তাহাদের মনের কোণে ছিল বৈকি।

গণ আজাদী লীগ

লাহোর প্রস্তাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া এক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, ৩রা জুন (১৯৪৭) প্ল্যান ঘোষণা অনুযায়ী ভারত বিভাগকালে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ কর্তৃক অবাঙ্গালি নেতৃত্বে বাউন্ডারী কমিশন গঠন ও পার্টিশান কাউন্সিলে পূর্ববঙ্গকে হৃদয়হীনভাবে বঞ্চিত করিবার তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণে রাখিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুকালের মধ্যে আমি ও সর্বজনাব কমরুদ্দিন আহমদ, তাজুদ্দিন আহমদ, নইমুদ্দিন আহমদ ও মোঃ তোয়াহা ধারাবাহিক আলোচনার প্রেক্ষিতে জনাব কমরুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করিয়া গণ আজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করি। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কল্পনায় আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি ভিন্ন রাষ্ট্রজ্ঞান করিয়া পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক মোষণা পত্র জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছিলাম। যতটা ছিল সংকল্প, তাহার চাইতে বহুগণ বেশি ছিল বাঙ্গালি বিদ্বেষী কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আক্রোশ ও রাগের অভিব্যক্তি। দুঃখের বিষয়, গণ আজাদী লীগ গণ-সংগঠনে পরিণত হইতে পারে নাই। ইহার কারণ, প্রথমতঃ আহ্বায়ক কমরুদ্দিন আহমদের কর্ম-বিমুখ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, কারাগার ভীতি ও ত্যাগী মনোভাবের অভাব, দ্বিতীয়তঃ সমগ্র দেশে উৎকট সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত আবহাওয়া, তৃতীয়তঃ তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকারের কঠোর দমননীতি।

নাজিমুদ্দিনের এক চোখা নীতিঃ মওলানা ভাসানীর আগমন

খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ সোহরাওয়ার্দী সমর্থক কাহাকেও তাহার মন্ত্রী সভায় গ্রহণ করেন না এমনকি অবিভক্ত বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী কেবিনেটের সদস্যগণ সর্বজনাব মোহাম্মদ আলী চৌধুরী (বগুড়া), আহমদ হোসেন (রংপুর), আবদুল গোফরান (নোয়াখালী) পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পান নাই। ডাঃ আবদুল মালেক, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের ডেপুটি স্পীকার তফাজ্জল আলী, আবদুস সবুর খান ও জনাব আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি অবস্থাদৃষ্টে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। এমনি জটিল হতাশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতিতে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এদেশে আসিলেন এবং সরকার বিরোধী শক্তিকে সংগঠিত করার ভার স্বহস্তে গ্রহণ করিলেন।

উল্লেখ্য যে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ইস্ট হাউজের দক্ষিণ দিকের মাঠে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বপ্রথম ভাষণদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন হলের আবাসিক ছাত্র আবদুর রহমান চৌধুরী। মওলানার তেজোদৃণ্ড ভাষণের মধ্য দিয়া এই সভায়ই সরকার বিরোধী ছাত্র শক্তি ও জননেতার মধ্যে যোগসুত্রের সূচনা হয়। আমরা বৃদ্ধ নেতার মধ্যে আগামী দিনের সম্ভাব্য নেতৃত্বের আভাস পাই, যাহা আমরা ইতিপূর্বে পাঞ্জাবের মি ইফতেখার উদ্দিন কিংবা সিন্ধুর পীরজাদা আবদুস সাত্তারের বক্তৃতায় পাই নাই।

আজাদী উত্তর ছাত্র অসন্তোষ

প্রশাসনিক অব্যবস্থার দরুণ ঢাকায় পর্বত প্রমাণ ছাত্র সমস্যা দেখা দেয়। নাজিমুদ্দিন সরকার সমর্থক শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াসে ব্যতিব্যস্ত থাকার দরুন ছাত্র অসন্তোষ ধুমায়িত হইতে থাকে। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে বর্তমান স্থান হইতে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে স্থানান্তরিত করিবার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এবং ঢাকা মিটফোর্ড স্কুল ছাত্রদের কনডেন্সড এম,বি.বি,এস, কোর্স ও আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ছাত্রদের কনডেন্সড ডিগ্রী কোর্স প্রবর্তন করিবার দাবিতে ঢাকা শহরের ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে। সমগ্র শহরে পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়, সভা হয়, মিছিল হয় এবং মিছিল সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এ (ইডেন বিল্ডিং) গমন করে। ইডেন বিল্ডিং-এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া মিছিল জমায়েতে আমি দীর্ঘ সময় বক্তৃতা করি এবং আমাদের দাবি মানার জন্য নাজিমুদ্দিন সরকারের নিকট আবেদন জানাই। সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীবৃন্দ স্বীয় কাজ ফেলিয়া, সর্বপ্রকার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিয়া আমাদের সভায় যোগ দেয়। যাহা হউক, অবস্থা বেগতিক দেখিয়া প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন স্বয়ং দ্বিতল ব্যালকনিতে আসিয়া আমাদের দাবি মানার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আমরা হৃষ্টটিত্তে স্থান ত্যাগ করি। ছাত্র আন্দোলনের প্রারম্ভিক বিজয় আমার মনে নূতন সাহস ও উদ্যমের সঞ্চার করিল। শাহ আজিজুর রহমান পরিচালিত নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ ছাত্র-সাধারণ হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে লাপিল এবং সোহরাওয়ার্দী-হাশিম জোট সমর্থক ছাত্র কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি পাইতে শুরু করিল। অতঃপর আমরা প্রতিটি ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব নিতে লাগিলাম। ছাত্র নেতা জনাব নুরুদ্দিন আহমাদ কলিকাতা হইতে ঢাকা না আসিলেও তদীয় গ্রুপের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যথা আবদুর রহমান চৌধুরী ও শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইলেন। জনাব আবদুল মতিন খান চৌধুরী (বর্তমান হাইকোর্ট জজ) পূর্ব হইতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ছিলেন। তাহাদেরই সহায়তায় ছাত্র সমাজে ক্রমশঃ আমাদের প্রতাপ প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। স্মরণীয় সে, ৩১শে আগস্ট, (১৯৪৭) জনাব আজিজ আহমদের সভাপতিত্বে ফজলুল হক হল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভা ভীত সন্ত্রস্ত সরকার সমর্থক ছাত্ররা গুন্ডামির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া বানচাল করিয়া দেয়।

সরকার বিরোধী মনোভাবের সূচনা

বাঙ্গালি উঠতি মধ্যবিত্ত, সরকারি নিম্ন বেতন ভুক কর্মচারী সম্প্রদায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিল। কলিকাতা হইতে ঢাকা সেক্রেটারিয়েটে ও অন্যান্য অফিসে কাজে যোগদানের পর সরকারি কর্মচারীগণ নানা সমস্যায় যথা-বাসস্থান ইত্যাদিতে জর্জরিত হইয়া পড়িল। বিভাগীয় শহর ঢাকা সদ্য আজাদী প্রাপ্ত দেশের পূর্বাঞ্চলের রাজধানীতে পরিণত হওয়ায় বাসস্থান সমস্যা নিরসনকল্পে সরকারকে অতিদ্রুত পলাশী ব্যারাক, নীলক্ষেত ব্যারাক নির্মাণ করিতে হয়। স্বাভাবিক বোধগম্য কারণেই পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও অন্যান্য দৈনন্দিন জীবন যাপনের নিত্যাবশ্যকীয় সরবরাহ অহরহ বিঘ্নিত হইতে পাকে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসেই নীলক্ষেত ব্যারাকবাসী নিম্ন বেতন ভুক কর্মচারীগণ পানির অভাবে অতিষ্ঠ হইয়া ভোর বেলা লোটা-বদনাসহ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে পানির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলসহ উপস্থিত হয়। এইভাবেই সরকার বিরোধী মনোভাব সমাজের বিভিন্ন স্তরে খণ্ড ভাবে দানা বাধিতে থাকে।

নাজিমুদ্দিনের স্থবিরতা ও উর্দুভাষীদের দৌরাত্ম

প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন স্থবির ও অত্যন্ত পশ্চাদমুখী চিন্তাধারার নেতা ছিলেন। পূর্ববঙ্গের মত স্পর্শকাতর এলাকার শাসনতার চালাইবার মত মানসিক গড়ন তাহার ছিল না। তিনি নিজে উর্দুভাষী পরিবারের সন্তান এবং বাংলা ভাষায় তাহার কোন দখল ছিল না। তার পরিবার কাশ্মীর হইতে ঢাকায় আসেন। সুতরাং পূর্ববঙ্গের জলবায়ু ও মাটির সন্তানদের সহিত তাহার নাড়ীর সম্পর্ক ছিল না। ভাষায়, সংস্কৃতিতে, চলাফেরায় তিনি মুলতঃ আপনজন ছিলেন না। ভাগ্যান্বেষণে তাহার পূর্বপুরুষগণ পূর্ববঙ্গে আসিয়াছিলেন এবং ইংরেজের অনুগ্রহে এদেশে সমস্ত প্রভুশ্রেণিভুক্ত হইয়াছিলেন। সুতরাং শোষণই  ছিল তাহাদের মূল পেশা, পূর্ববঙ্গবাসীর সহিত আত্মিক সম্বন্ধ তাহাদের হয় নাই। তাই তাহার আমলে, সূচনাতেই উচ্চপদস্থ উর্দুভাষী সরকারি কর্মচারীগণ প্রভুসুলভ আচরণ শুরু করেন। তাহাদের মুখের ভাষাকে বাংলা ভাষাভাষী সমগ্র অধিবাসীদের উপর চাপাইয়া দেওয়ার প্রয়াসে রেডিও প্রোগ্রামে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলা শব্দের পরিবর্তে উর্দু শব্দ যথা- রাষ্ট্র প্রধানের স্থলে সদরে রিয়াসাত, স্থিরীকৃত স্থলে মোকরার, প্রধানমন্ত্রীর স্থলে উজীরে আজম, মুখ্যমন্ত্রীর হলে উজির আলা, মন্ত্রীর স্থলে উজির, প্রতিনিধির স্থলে নোমায়েন্দা, সংবাদের স্থলে এলান, ছবির স্থলে তসবির ইত্যাদি যথেচ্ছ ব্যবহার করতে শুরু করে। এমনকি মনিঅর্ডার ফরম, টেলিগ্রাম ফরম, ডাক টিকিট ও মুদ্রায় উর্দু ভাষা ব্যবহৃত হইতে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই ১৯৪৭ সালের ১৮ই মে মজলিসে-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের উদ্যোগে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে যুক্ত প্রদেশ মুসলিম লীগ নেতারা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হইবে বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন। উপরোক্ত বক্তৃতাংশে উর্দুভাষী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের প্রকৃত মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় এবং আজাদী-উত্তর পাকিস্তানের প্রশাসনে উর্দুভাষী সরকারি চাকুরেদের মধ্যে ইহার বাস্তবরূপ তাহাদের কার্যকলাপে প্রতিফলিত হয়।

মহান ভাষা আন্দোলনের গোড়া পত্তন

উপরে বর্ণিত কারণেই স্বাভাবিকভাবে বাঙ্গালি শিক্ষিত সম্প্রদায় প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম ও নূরুল হক ভূঁইয়া ধুমায়িত অসন্তোষ সাংগঠনিক রূপদান প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস গঠন করেন। নব গঠিত তমদ্দুন মজলিসই মহান ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে। অক্টোবরে (১৯৪৭) পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ও পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রী, সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর সভাপতিত্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে স্বীকৃতি দানের প্রথম প্রকাশ্য দাবি উত্থাপিত হয়।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সুপারিশ করেন। জ্ঞান তাপস ভাষাবিদ ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর প্রতিবাদে বলেন, ‘যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন দ্বিতীয় ভাষা গ্রহণ করিতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা উচিত।” সচেতন শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিরোধিতা সুকৌশলে এড়াইবার মানসে করাচি শাসক-চক্র উর্দুকে Lingua franca বা ব্যবহৃত সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণ করাইবার চেষ্টায় লিপ্ত হন।

বস্তুতঃ করাচি থেকে ঢাকা পর্যন্ত উর্দু ভাষা-ভাষী ও বাংলা ভাষা-ভাষী মহলের উর্দুকেই রাষ্ট্র ভাষা অথবা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণের বান-প্রতিবাদই পরবর্তীকালে শিক্ষাঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন অতিক্রম করিয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে জটিল রাজনৈতিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়।

যাহা হউক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাঙ্গন এবং সাহিত্য সেবক বিদগ্ধজনের দ্রুত সমর্থনপুষ্ট দাবি “বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম করিতে হইবে” অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সার্বজনীন দাবিতে পরিণত হইল। ঢাকার বিভিন্ন সভা ও মিছিলের মূল আওয়াজ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। ক্রমশঃ আন্দোলন পরিচালনাকারীদের বোধোদয় হয় যে, পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বিধায় আমাদের দাবি প্রাদেশিক ভাষা করিবার দাবিতে পর্যবসিত হইয়া পড়িবার আশঙ্কা রহিয়াছে। অতএব প্রাথমিক ভুল দাবি সংশোধন করিয়া আমাদের দাবি উথিত হইল, “বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিতে হইবে।” রাজধানী ঢাকার রাজপথে মিছিলে শুনা গেল “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”, “উর্দু বাংলায় বিরোধ নাই”, “উর্দু-বাংলা ভাই ভাই,” “উর্দুর পাশে বাংলা চাই”। উল্লেখ্য যে, নির্দয় সরকারি হামলা রুখিয়া দাঁড়াইবার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্য সেবক, সংস্কৃতিসেবীদের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া সেইদিন সর্বত্যাগী নির্ভয় তরুণ ছাত্র সমাজের উপরেই এই সক্রিয় আন্দোলনের মূল ও গুরু দায়িত্ব পাঠিয়েছিল। সেই দাবি পূরণের স্বার্থেই রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে পুরোভাগে ছাত্র সমাজের আবির্ভাব এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় পূর্বকাল পর্যন্ত এই ধারাই অব্যাহত ছিল। বলাই বাহুল্য যে, ইহা ছিল দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই ফলশ্রতি। তাই উত্তরকালে বাঙ্গালি জনতাকে দিতে হইয়াছে চরম মূল্য ও পোহাইতে হইয়াছে নজীরবিহীন দুর্ভোগ।

করাচিতে অনুষ্ঠিত সরকারি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা অথবা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা করিবার প্রস্তাবের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৬ই ডিসেম্বর (১৯৪৭) পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের সেক্রেটারি অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে ছাত্র সভায় বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভাস্থল হইতে এক বিরাট মিছিল পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রী মোহাম্মদ আফজল এবং মন্ত্রী নুরুল আমিনের বাসভবনে গমন করেন। মন্ত্রীষ্বয়ের নিকট হইতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার আশ্বাস পাইয়া এই মিছিলযোগে আমরা অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবনে উপস্থিত হই। মন্ত্রী মহোদয় আমাদের দাবি সমর্থন করিতে অস্বীকৃতি জানান। তথা হইতে আমরা মিছিলসহ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবন বর্ধমান হাউজে উপস্থিত হই। কিন্তু অসুস্থতার অজুহাতে খাজা সাহেব আমাদের সহিত সাক্ষাৎ করেন নাই।

এমনি অস্বস্তিকর পরিস্থিতে বাস ট্রাক ভর্তি একদল উচ্ছৃঙ্খল মুসলিম লীগ সমর্থক ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের ও পলাশী ব্যারাক নিবাসী সরকারি কর্মচারীদের উপর অসৌজন্যমূলক হামলা চালায়। এই গুণ্ডামীর প্রতিবাদে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রাঙ্গণে সভা অনুষ্ঠানের পর মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল অপরাহ্ন বেলা আনুমানিক সাড়ে তিন ঘটিকার সময় শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের গনি রোডস্থ বাসভবনে গমন করে। শিক্ষামন্ত্রী লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় উপর তলা হইতে নিচে মিছিলকারীদের নিকট আসেন। তিনি মিছিলকারীদের দাবির সহিত একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং একটি কাগজে তাহা লিখিয়াও দেন। এই বিরাট বিক্ষোভ মিছিলটি অতঃপর মন্ত্রী মহোদয়সহ সেক্রেটারিয়েট ভবনমুখে অগ্রসর হয়। সেক্রেটারিয়েটের প্রধান ফটক বন্ধ থাকার দরুন মিছিলের অগ্রভাবে অবস্থানরত আমরা কয়েকজন দেওয়াল টপকাইয়া ভিতৱে প্রবেশ করি এবং ফটক খুলিয়া দেই। মিছিলের গগনবিদারী আওয়াজে মন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল স্বীয় দফতর হইতে বাহির হইয়া মিছিলকারীদের মাঝখানে আগমন করেন। তিনিও আমাদের দাবি লিখিতভাবে স্বীকার করেন। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও অন্যান্য মন্ত্রী ১৫ই ও ১৬ই ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায় যোগ দিতে ইতিমধ্যে ঢাকা ত্যাগ করিয়াছিলেন। অকপটে স্বীকার করিতে হইবে যে, মিছিলকারীদের কেহ কেহ মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতি উগ্র আচরণ করিতে ছাড়ে নাই। তবুও এমনকি অশাোভন দৈহিক হামলা পরিচালনা সত্ত্বেও মন্ত্রীদ্বয় নেতৃসুলভ ধৈর্যের পরিচয় দেন এবং মিছিলকারীদের সহিত অত্যন্ত ভদ্রোচিত ব্যবহার করেন। আমাদের কাহারো কাহারো অভদ্রজনিত ব্যবহারকে উপেক্ষা করিয়াই কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল মিছিলকারীদের দাবি অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে গমন করেন। গুণ্ডামীর চিহ্ন স্বচক্ষে দেখার পর মিছিলসহ সরকারি কর্মচারীদের আবাসস্থল পলাশী ব্যারাকেও যান এবং তথায় মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। তিনি এই স্থলে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত জেলা প্রশাসক এস, রহমতুল্লাহ ও পুলিশের ডি,আই,জি, সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহকে প্রতিকার গ্রহণের নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য যে, কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা উপরোক্ত আচরণ সম্ভব, কোন মিলিটারি ক্যু কিংবা কোন টোটালিটারিয়ান ডিক্টেটরদের দেশে ইহা অকল্পনীয়।

কিন্তু অবস্থাগতিতে উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিল। একই দিন বিকাল বেলা কোর্টের উল্টো দিকে অবস্থিত ও, কে, রেষ্টুরেন্ট (বর্তমানে মাইরেন্ডার) হইতে বাহির হইবার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবিরের (১৫০ নং মোগলটুলী, ঢাকা) অন্যতম নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈমুদ্দিন আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ও উত্তরকালে ঢাকা হাইকোর্ট বার সেক্রেটারি) গুপ্তা বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত ও প্রহৃত হন। মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলের ছাত্রদের একটি মিছিলও রায় সাহেব বাজারে গুণ্ডা কবলিত হয়। শিক্ষিত সম্প্রদায় উক্ত ঘটনাবলীকে খুব একটা সহজভাবে নিতে পারেন নাই। ইহার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করেন। সরকার প্রত্যুত্তরে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করিয়া ১৫ দিনের জন্য সভা, মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে কায়েমের আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা যতই তীব্র হইতে লাগিল, অর্থপূর্ণ ও সাংগঠনিক শক্তিতে বলীয়ান ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের অপরিহার্যতা ততই আমাদের কাছে বড় হইয়া দেখা দিল। সাংগঠনিক শক্তি ব্যতিরেকে বৃহত্তর জাতীয় পর্যায়ে ছাত্র আন্দোলন কার্যকরী ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় না। সরকার বিরোধী ছাত্র শক্তিকে সংগঠিত করার জনা কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ছাত্র ফেডারেশন ছিল তখনকার দিনে একমাত্র সক্রিয় ছাত্র প্রতিষ্ঠান। মুসলমান ছাত্র সমাজের একটি অংশ উক্ত সংগঠনকে বিদেশী শক্তির তন্ত্র বাহক বলিয়া সন্দেহের চোখে দেখিত। এহেন সাংগঠনিক শূন্যতা নিরসনকল্পে আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং সর্বজনাব আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, আবদুল হামিদ চৌধুরী, ও মোল্লা জালাল উদ্দিনের সহিত আলাপ আলোচনা চালাইতে থাকি। আমি তাহাদিগকে ঢাকায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ কাউন্সিলের তলবী সভা আহ্বান করিবার উদ্দেশ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ জানাই। আমার যুক্তি ছিল এই যে, এই পদ্ধতিতেই মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সরকারের তল্পীবাহক শাহ আজিজুর রহমানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অপসারিত করা যাইবে ও কাউন্সিলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নৃতন কমিটি নির্বাচন করিয়া ছাত্র আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হইবে; কিন্তু তাহারা আমার প্রস্তাবে বিশেষ উৎসাহ প্রদর্শন করেন নাই। বোধহয় কাউন্সিলে সংখ্যা গরিষ্ঠের সমর্থন সম্বন্ধে তাহারা সন্দিহান ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান তখনও স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করিতেন না। তখন পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সহিত তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না।

মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার ঢাকার ছাত্র মহল হইতে যত বিচ্ছিন্ন হইতেছিল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থকবৃন্দের মর্যাদা ছাত্র মহলে ততই বৃদ্ধি পাইতেছিল। এই সময়ে আমি জাতীয় ছাত্র সমস্যা নিরসনের ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই নতুন ছাত্র সংগঠন গঠন করিবার তাগিদ তীব্রভাবে বোধ করিতেছিলাম। তাই একমনা ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহিত প্রাথমিক আলোচনা করিয়া ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি অপরাহ্নে ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক ছাত্র কর্মীসভা আহ্বান করি। সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নাজমুল করিম উপস্থিত ছিলেন। আমরা তাহাকেই সভাপতি করিয়া সভার কাজ আরদ্ভ করি। সভায় নূতন ছাত্র সংগঠন সাম্প্রদায়িক না অসাম্প্রদায়িক হইবে এই প্রশ্নে উপস্থিত অনেকের সহিত আমার মতানৈক্য দেখা দেয়। আমি সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক নামের পক্ষে ছিলাম। যাহা হউক, অধিকাংশের মতের পক্ষে স্বীয় প্রস্তাব প্রত্যাহার করিয়া অবশেষে আমরা সর্বসম্মতিক্রমে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করি। জনাব নঈমুদ্দিন আহমেদকে ও আমাকে আহ্বায়ক করিয়া যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান ও ঢাকা শহর কমিটি গঠন করা হয় এবং নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের সদস্য করিয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়:

 (১) নঈমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী) আহ্বায়ক, (২) আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), (৩) শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), (৪) অলি আহাদ (কুমিল্লা), আহ্বায়ক ঢাকা শহর কমিটি (৫) আজিজ আহমেদ (নোয়াখালী), (৬) আবদুল মতিন (পাবনা), (৭) দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর), (১) শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা), (১০) নওয়াব আলী (ঢাকা), (১১) নূরুল কবির (ঢাকা সিটি), (১২) আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), (১৩) সৈয়দ নুরুল আলম (ময়মনসিংহ), (১৪) আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী (চট্টগ্রাম)।

শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা ছিলেন না এবং এই সংগঠন সম্পর্কে তিনি কিছুই অবহিত ছিলেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, সাংগঠনিক কমিটিতে তাহার অন্তর্ভুক্তি তিনি সানন্দেই গ্রহণ করিবেন। এবং তিনি সত্যই কোন দ্বিধাদ্বন্দ বা অনীহা প্রকাশ না করিয়া বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিলেন। উল্লেখ্য যে, অধুনা অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া প্রচার করেছেন। কিন্তু ইহা ইতিহাসের বিকৃতিমাত্র।

জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা ছাত্র ফেডারেশনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ খুব একটা উৎসাহের চোখে দেখেন নাই। কিন্তু আমাদের সহিত অতীত সাহচর্যের দুর্বলতার জন্যই তিনি সংগঠনের অগ্রগতিতে কোন বাধাও দেন নাই।

ছাত্র মহল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে উদ্বুদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে প্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে ছাত্রলীগ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করিয়াছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক দাবিদার এই ছাত্র সংগঠন। ভাবীকালে এই সংগঠন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপায়ন ও পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনেই জনাব দবিরুল ইসলাম সভাপতি ও জনাব খালেদ নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। জনাব দবিরুল ইসলামের পর জনাব শামসুল হক চৌধুরী ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল অধিবেশন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক করিবার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নাম পরিবর্তন করিয়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম রাখে। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলামের (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজিং কমিটির সভায় আমি পুনরায় এই সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক নামকরণের প্রস্তাব করিয়াছিলাম; কিন্তু প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ার প্রতিবাদে আমি পদত্যাগ করি। যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা বিভিন্ন সময়ে পালন করিয়াছে, তাই বিভিন্নকালের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম নিম্নে লিপিবদ্ধ করিলামঃ

১৯৪৮                                     নঈমুদ্দিন আহমদ                                  আহ্বায়ক

১৯৪৯-৫৩                               দবিরুল ইসলাম                                        সভাপতি

খালেক নেওয়াজ খান                              সাধারণ সম্পাদক

১৯৫৩-৫৪                              কামরুজ্জামান                                        সভাপতি

এম, আবদুল ওয়াদুদ                               সাধারণ সম্পাদক

১৯৫৪-৫৫                              আবদুল মমিন তালুকদার                        সভাপতি

                                                এম, আবদুল ওয়াদুদ                               সাধারণ সম্পাদক

১৯৫৫-৫৬-৫৭                        আবদুল মমিন তালুকদার                        সভাপতি

আবদুল আউয়াল                                     সাধারণ সম্পাদক

১৯৫৭-৬০                               রফিকুল্লাহ চৌধুরী                                               সভাপতি

১৯৫৭-৫৮                               কাজী আজহারুল ইসলাম                         সাধারণ সম্পাদক

১৯৫৮-৫৯-৬০                        শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন                     সাধারণ সম্পাদক

১৯৬০-৬৩                              শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন                     সভাপতি

শেখ ফজলুল হক মনি                              সাধারণ সম্পাদক

১৯৬৩-৬৫                              কে, এম, ওবায়দুর রহমান                      সভাপতি

সিরাজুল আলম খান                                                সাধারণ সম্পাদক

১৯৬৫-৬৬-৬৭                        মাজহারুল হক বাকী                                সভাপতি

                আবদুর রাজ্জাক                                    সাধারণ সম্পাদক

 ১৯৬৭-৬৮                              ফেরদৌস আহমদ কোরেশী                  সভাপতি

আবদুর রাজ্জাক                                    সাধারণ সম্পাদক

১৯৬৮-৬৯                              আবদুর রউফ                                          সভাপতি

খালেদ মোহাম্মদ আলী                         সাধারণ সম্পাদক

১৯৬৯-৭০                               তোফায়েল আহমেদ                                               সভাপতি

আ,স,ম, আবদুর রব                                সাধারণ সম্পাদক

১৯৭০-৭২                                নূরে আলম সিদ্দিকী                                               সভাপতি

শাজাহান সিরাজ                                      সাধারণ সম্পাদক

ভাষা আন্দোলনের আরেক পর্যায়

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের অব্যবহিত পরই ৮ জানুয়ারি (১৯৪৮) সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের সহ-সভাপতি শফিউল আজম, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, মোঃ তোয়াহা ও আমি ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা, মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সহিত তাহার বাসভবন বর্ধমান হাউসে সাক্ষাৎ করি। এই বৈঠকে পূর্ববঙ্গ সরকারের শিক্ষা দফতরের সচিব এফ,এ, করিম উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার সহিত বাংলা ভাষার ইতিহাস ও তত্ত্ব নিয়া তর্ক-বিতর্কে শফিউল আজম সাহেব বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করিয়া ছাড়িলেন। উল্লেখ্য যে, ভারত বিভাগের পর পর ঢাকায় আসার পর হতে জনাব ফজলে করিম (শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারি) সলিমুল্লাহ হল মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য আসিতেন এবং মোনাজাতের পর ইসলামী তাহজীব ও তমদ্দুন বিষয়ে উর্দু ভাষায় সবিস্তারে ব্যাখ্যা করিতেন। এই ধরনের এক শ্রেণির বাঙ্গালি উর্দুভাষী বাঙ্গালি মুসলমানদিগকে ইসলামী তাহজীব ও তমদ্দুন শিক্ষা দিবার ব্যাপারে অত্যুৎসাহ প্রদর্শন করিতেন। তাহাদের প্রভূসুলভ আচরণ ও নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করিবার অতিগরজী মানসিকতাই বাংলা ভাষা-ভাষী মধ্যবিত্ত মুসলমান শ্রেণির অসন্তুষ্টি ও বিরাগের অন্যতম কারণ। যাহা হউক, সেইদিন আমাদের প্রতিনিধি দলকে খাজা নাজিমুদ্দিন এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছেন যে, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম ও কেন্দ্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা করা হইবে।

কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ডাক টিকিট, মনিঅর্ডার ফরম, মুদ্রা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন, সেনা বিভাগ, নৌ-বিভাগ ও বিমান বিভাগের পরীক্ষায় উর্দুর যথেচ্ছ ব্যবহার এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সম্পূর্ণ অনুল্লেখ ছাত্র সমাজকে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ করিয়া তুলিল। এই তপ্ত হাওয়ায় অনুষ্ঠিত সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমরা সরকার বিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমেই সরকার সমর্থক নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের পরিবর্তিত নাম) প্রার্থী রেজাউর রহমানকে পরাজিত করিয়া সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বিপুল ভোটে হল সংসদ সহ-সভাপতি পদে জয়যুক্ত করি। পরিতাপের বিষয়, নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারি রক্তচক্ষু ও সরকারি কোপানলে পতিত হওয়ার ভয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সক্রিয়ভাবে কোন আন্দোলনে আমাদিগকে সাহায্য-সহায়তা করেন নাই; উপরন্ত তিনি পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করিয়া সরকারের আয়কর অফিসার (Income Tax Officer) পদে যোগ দিয়াছিলেন। অবশ্য পরবর্তীকালে চাকুরী ত্যাগ করিয়া আইন ব্যবসায় যোগদান করেন এবং উত্তরকালে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। নব নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে ২রা ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) ভাষণ দানকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুভাষী ভাইস চ্যান্সেলর ডাঃ মাহমুদ হাসান বাংলায় শিক্ষার মাধ্যম করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তাহার উক্ত অভিনন্দনযোগ্য মন্তব্যে আমাদের মনোবল দ্বিগুণ হইল।

ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সরকার বিরোধী প্রগতিশীল নেতা মোঃ তোয়াহা তাহার মনোনীত কেবিনেটসহ বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যথাক্রমে বাৰু অরবিন্দ ঘোষ ও জনাব গোলাম আযম নির্বাচিত হন।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হইবার পর হইতে সংগঠনটিকে নেতৃস্থানীয় সংগঠনে পরিণত করিবার মানসে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করি। তাই ২৬শে ফেব্রুয়ারি হইতে ৬ই মার্চ অবধি কলিকাতায় আহূত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় যুব সম্মেলনে নিম্ন-শর্তাধীনে প্রাথমিকভাবে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি:

প্রথমতঃ খাজা নাজিমুদ্দিন সরকার সমর্থক শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ (উত্তরকালে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পাইলে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সম্মেলনে অশহণ করিবে না; দ্বিতীয়তঃ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ মনোনীত প্রতিনিধি সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতা হইবেন। শর্ত পরিপূরিত হইল। তদনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটির সদস্য আবদুর রহমান চৌধুরী পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দান করিলেন। ইহাতে আমাদের সংগঠনের মর্যাদা বৃদ্ধি পাইল এবং ইহই ছিল আমাদের কাম্য। প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্য ছিলেন, জনাব শামসুল হক (পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ), শহীদুল্লাহ কায়সার (পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন), মিসেস লিলি খান ও মিসূ লুলু বিলকিস বানু (মহিলা অবজার্ভার) এবং মিস লায়লা আরজুমান্দ বানু (আমন্ত্রিত)।

১১ মার্চের (১৯৪৮) হরতাল

গণপরিষদের অধিবেশনে ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি উর্দু ও ইংরেজির সহিত গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসাবে ব্যবহারের স্বপক্ষে দাবি উথাপন করেন বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। এই অপরাধে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান ও অন্যান্য বক্তা অসৌজন্যমূলক ভাষায় তাহাকে আক্রমণ করেন। ঢাকায় পুনঃপুনঃ দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়া পূর্ববঙ্গের উজীরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিন গণপরিষদ অধিবেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ওকালতি করেন। ইহার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ৪০ লক্ষ অধিবাসীর মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সংকল্পবন্ধ তরুণ ছাত্র সমাজ বিভিন্ন শিক্ষায়তন হইতে ২৬শে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে অভিনন্দন জানায়। শুধু তাই নয়, খাজা নাজিমুদ্দিনের এই উক্তির প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপদান করিবার প্রয়োজনে ২৭শে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) তমদ্দুন মজলিসের রশিদ বিল্ডিংস্থ অফিসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র জনাব শামসুল আলমকে আহ্বায়ক নিয়োগ করিয়া আমরা Committee of Action for state Language অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠন করি। ইতিপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। একই বৈঠকে ১১ই মার্চ হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে সমগ্র দেশব্যাপী “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস” ঘোষণা করা হয়।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ব্যাপক প্রতিনিধিত্বশীল করিবার নিমিত্ত ২রা মার্চ (১৯৪৮) ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সভায় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণ-আজাদী লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক ইয়ুথলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ছাত্র সংসদ এবং কলেজ প্রতিনিধিবৃন্দকে লইয়া পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধিত্বশীল কমিটি গঠন করা হয়। পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সোহরাওয়ার্দী সমর্থক মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যদের তরফ হইতে জনাব তফাজ্জল আলী, জনাব আলী আহমদ খান ও মিসেস আনোয়ারা খাতুন কমিটির সহিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তবে, একমাত্র মিসেস আনোয়ারা খাতুন ১১ই মার্চের হরতাল সাফল্যমন্ডিত করার জন্য সর্বোতভাবে সহায়তা করিয়াছেন। ১১ মার্চ আয়োজিত সাধারণ ধর্মঘট সাফল্যমন্ডিত করার আহ্বান জানাইয়া ৩রা মার্চ ঢাকা হইতে নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ এক বিবৃতি দেন। উহা কলিকাতার ইংরেজি দৈনিক অমৃতবাজারে প্রকাশিত হয়। এই বিবৃতি দানকারী হলেন, জনাব শামসুল আলম, আহ্বায়ক, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ; অধ্যাপক এম এ, কাসেম, সেক্রেটারি, তমদ্দুন মজলিস; জনাব নঈমুদ্দিন আহমদ, আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ; জনাব তফাজ্জল আলী এম এল এ, মিসেস আনোয়ারা খাতুন এম এল এ, সম্পাদিকা, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি; জনাব আলী আহমদ খান এম এল এ, জনাব কমরুদ্দিন আহমদ, প্রাক্তন অফিস সম্পাদক, ঢাকা জিলা মুসলিম লীগ; জনাব শামসুল হক, সংগঠক, মুসলিম লীগ (পূর্ববঙ্গ); জনাব এ, সালাম, সম্পাদক, দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান; জনাব এস, এম, বজলুল হক, সম্পাদক, কাফেলা; জনাৰ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল; জনাব মোঃ তোয়াহা, সহ সভাপতি ফজলুল হক মুসলিম হল; জনাব অলি আহাদ, আহ্বায়ক, ঢাকা নগর মুসলিম ছাত্রলীগ; জনাব আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, সম্পাদক ইনসান। বিবৃতির কিয়দংশ নিম্নে দেওয়া হইলঃ

“For some time past considerable agitation is going on to make Bengali as the i) official language of East pakistan, (ii) as one of the State Languages of the Central Pakistan, (iii) as one of the languages of Pakistan consembly”.

“Bengali is the mother tongue of the two third population of the whole of Pakistan. It is a matter of shame that agitation has become necessary to establish this language in the life of the state ….To record a protest against these, the East Pakistan Muslim Students League & the Tamaddun Majlish have declared a general strike on Thursday, March 11. We appeal to all political cultural and educational institutions & all students & citizens irrespective of cast & creed of East Pakistan to observe this strike according to the programme of this joint State Language sub-committee peacefully & with discipline…Our agitation should not be mistaken in Central Pakistan & in the consembly. We believe that if instead of treading down this democratic demand, the Bengali Language is conceded, it will be the basis of Unity of East & West Pakistan”.

অর্থাৎ “(১) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ভাষা, (২) কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও (৩) পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবিতে কিছুকাল যাবৎ ব্যাপক আন্দোলন চলিতেছে।

“বাংলা সমগ্র পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা। লজ্জার বিষয় যে, এই ভাষাকে রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিতে আন্দোলনের প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে………….ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার জন্যই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস ১১ মার্চ রোজ বৃহস্পতিবার সাধারণ হরতাল ঘোষণা করিয়াছে। সংযুক্ত রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটির কর্মসূচী অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে ও শৃঙ্খলার সহিত ধর্মঘট পালন করিবার জন্য আমরা সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাঙ্গন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল ছাত্র ও নাগরিকদের প্রতি আবেদন জানাইয়াছি। …. কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও গণপরিষদে আমাদের আন্দোলনকে ভুল বুঝা উচিত হইবে না। এই গণতান্ত্রিক দাবিকে দমন না করিয়া বাংলা ভাষাকে মানিয়া লইলে, আমরা বিশ্বাস করি ইহাই হইৰে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একতার ভিত্তি।”

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৪ঠা ও ৫ই মার্চের সভায় ১১ই মার্চ সাধারণ হরতালকে সফল করার জন্য বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। ১০ই মার্চের সভায় সরকার ১৪৪ ধারা জারি করা হইলে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হইবে কি হইবে না ইহা লইয়া বিতর্ক উঠিলে, আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিয়াছিলাম যে, আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিবই, সরকারি কোন বিধি-নিষেধের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া আন্দোলন প্রত্যাহার করিব না। সেই সভায় আমি ইহাও বলিয়াছিলাম যে, যারা নিয়নত্যন্ত্রিক রাজনীতি বা আন্দোলনের দোহাই পাড়েন, তাহাদিগকে পুনর্বিবেচনা করিতে আমি অনুরোধ জানাই।” এই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেকটি ছাত্রাবাসের (হল) দেওয়ালে দেওয়ালে স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা টাঙ্গাইয়া দেওয়া হইল। ১১ই মার্চ সাধারণ হরতাল আহ্বানের সংবাদ পত্রিকায় পাঠ করিয়া আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিবার নিমিত্ত শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ হইতে ১০ই মার্চ রাত্রে ঢাকায় আসেন।

সকাল নয়টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুল ওয়াদুদ এবং আমি সেক্রেটারিয়েট ভবনের প্রথম গেটে উপস্থিত হই। তখন সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীবৃন্দ আসেন নাই। ইতিমধ্যে তরুণ জননেতা জনাব শামসুল হক কয়েকজন কর্মীসহ আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, তিন হইতে পাঁচজন সেক্রেটারিয়েটের গেটগুলির প্রত্যেকটিতে পিকেটিং করিব এবং এক গ্রুপ ধরা পড়িলে অপর গ্রুপ পিকেটিং করিবে। পূর্বাহ্ন বেলা ৯-৩০ মিনিট হইতে ১০ টার মধ্যে সেক্রেটারিয়েটগামী কর্মচারীদিগকে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বাধা দিতে শুরু করিলাম। সিটি এস, পি, আবদুল গফুরের হুকুমে পুলিশ তৎপর হইয়া উঠিল। ইংরেজ ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ মি: চ্যাথাম লাঠি চালনার আদেশ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে শামসুল হক ও তাঁহার গ্রুপের কতিপয় কর্মী গ্রেফতার হইলেন। ইহার পর শেখ মুজিবুর রহমান আর এক গ্রুপসহ গ্রেফতার হইলেন। পুলিশ বাহিনী অধৈর্য হইয়া উঠিল এবং বেপরোয়া লাঠি চালনা আরম্ভ করিল। জনাব আবদুল ওয়াদুদ ও আমি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হই। পুলিশ আমাদের আহত অবস্থায়ই জীপে বস্তাবন্দি করিয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়া তথাকার হাসপাতালে ভর্তি করাইল। পুলিশের আঘাত ও ধস্তাধস্তির সময় আমার হাত ঘড়ি উধাও হইয়া গিয়াছিল। পুলিশের লাঠি-পিটায় প্রায় জ্ঞানহারা অবস্থায় উত্তেজিত কণ্ঠে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্জেন্টকে লক্ষ্য করিয়া শাসাইয়া বলিয়াছিলাম “ক্ষমতায় আসিলে তোমাকে দেখাইয়া দিব। প্রত্যুত্তরে সার্জেন্টটি বলিল, “Whats of that to me whether Nazimuddin stays or Suhrawardy comes. Whatever the Govt. I shall carry on.” সন্ধ্যা নাগাদ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করিয়া সরকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করিল।

কারাগার একটি ভিন্ন জগত। যত অসৎ চরিত্র ব্যক্তিরাই কারাগারবাসী। আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন ও দুঃসাধ্য। কারাগারে আগন্তকদের প্রথমে ‘ফাইল-গাইল-ডাইল সমস্যার ধাক্কায় মুর্চ্ছা যাইবার উপত্রম হইতে হয়। ১৩ই মার্চ সন্ধায় আমাদের ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করিবার পূর্বে বন্দি সংখ্যা গুণিবার বিধি অনুযায়ী জমাদার আমাদিগকে শৃঙ্খলার সহিত ফাইলে বসিতে অনুরোধ জানাইল। তরুণ ছাত্র বন্দিদের অত ঝামেলা পোহাইবার মত মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। জমাদার তিন তিনবার গুণিয়া তিনটি ভিন্ন সংখ্যা পায়। সে স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত হইয়া মেজাজ দেখায়। ইহাতে উত্তেজিত ছাত্রবন্দিগণ তাহাকে প্রহার করিতে উদ্যত হইল জমাদার এক লাফে ওয়ার্ডের বাইরে গিয়া সংকেত বাঁশি বাজাইতেই সমগ্র জেলে পাগলা ঘন্টি পড়ে। ইহা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সাধারণত পাগলা ঘন্টি বাজার সঙ্গে সঙ্গে কারাগার রক্ষী বাহিনী ও বাহির হইতে আগত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কারাগার অভ্যন্তরের সংক্ষুব্ধ এলাকায় বন্দিদের যথেচ্ছ অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। কোন কোন সময় নিরস্ত্র বন্দিদের উপর গুলী চালনা করা হয়। পাগলা ঘন্টি পড়িবার সাথে সাথে তাই দরদী ও বুদ্ধিমান কার্যরত টহলদার সিপাহীটি আমাদের দ্বিতলস্থ ওয়ার্ডটি তড়িৎ তালাবদ্ধ করিয়া অকুস্থল হইতে অন্যত্র সরিয়া পড়িয়াছিল। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার সুপারিন্টেনডেন্ট ইংরেজ সন্তান মিঃ বিল আগত উন্মত্ত বাহিনীকে স্বস্ব স্থানে ফিরিবার আদেশ দান করিয়া আমাদের কামরায় প্রবেশ করিলেন। মিঃ বিল বন্দি সংখ্যা গণনার প্রয়োজনীয়তা আমাদিগকে ব্যাখ্যা করিয়া কারাগার আইন-কানুন পালনের গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের বিনয়ের সহিত অবহিত করিলেন। কারাধ্যক্ষ মিঃ বিল যদি বিচক্ষণতার সহিত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন না করিতেন, তাহা হইলে আমাদের বন্দিশালায় সেইদিন লঙ্কাকান্ড ঘটিত এবং ছাত্র বন্দিদের উপর নির্যাতনের কোন ইয়ত্তা থাকিত না।

১২ই মার্চের পত্রিকা পাঠে অবগত হইলাম যে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১১ই মার্চ পুলিশি হামলার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ হইতে পদত্যাগের আহ্বান জানাইয়াছেন। কিন্তু কৌতুকের বিষয়, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া অবধি নিজেই পদত্যাগ করেন নাই। এই ধরনের বহু ঘটনা জীবনে বহুজনের ব্যাপারে বহু বারই প্রত্যক্ষ করিয়াছি। দেখিয়াছি, একশ্রেণির নেতা গদীর অন্বেষণে বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে দেশবাসীকে প্রতারিত করেন এবং স্বীয় উদশ্যে চরিতার্থ করার প্রয়াস পান।

১১ মার্চ, পুলিশের নির্যাতন ও আমাদের কারান্তরালে নিক্ষেপের ফলে সমগ্র ঢাকা নগরীর রাজপথ মিছিলে মিছিলে, বিভিন্ন ধ্বনি ও প্রতিধ্বনিতে প্রকম্পিত হইয়া উঠে। ১৫ই মার্চ পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন চলাকালে ভীত সন্ত্রস্ত খাজা নাজিমুদ্দিন সরকার রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সদস্যদের সহিত এক বৈঠকে মিলিত হন। উভয়পক্ষ এক খসড়া চুক্তি প্রণয়ন করেন। চুক্তি পত্রটি ১১ মার্চ ধৃত বন্দিগণ কর্তৃক অনুমোদনের জন্য অধ্যাপক আবুল কাসেম ও জনাৰ কমরুদ্দিন আহমদ কারান্তরালে আমাদের সহিত বৈঠকে মিলিত হইলেন। জনাব শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও আমি জনগণের পক্ষ হইতে খসড়া চুক্তির শর্তাবলী পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নাজিমুদ্দিন ও রাষ্ট্রভাষা পরিষদের পক্ষ হইতে জনাব কমরুদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেন। নিম্নে চুক্তিনামাটি দেওয়া হইলঃ

১। ২৯শে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে, তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে।

২। পুলিশের অত্যাচারের অভিযোগ সম্বন্ধে উজীরে আলা স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এই বিষয়ে বিবৃতি দিবেন।

৩। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে বেসরকারি আলোচনার জন্য নির্ধারিত তারিখে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং ইহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় চাকুরি পরীক্ষা দিতে Central services Examination উর্দুর সম-মর্যাদা দানের নিমিত্ত একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।

৪। পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে এপ্রিল মাসে একটি প্রস্তাব তোলা হইবে যে, প্রদেশের অফিস-আদালতের ভাষা ইংরেজি এর স্থলে বাংলা হবে।

৫। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কাহারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।

৬। সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।

৭। ২৯শে ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ববঙ্গের যে সকল অংশে ভাষা আন্দোলনের কারণে ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে, তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।

৮। সংগ্রাম পরিষদের সহিত আলোচনার পর আমি এই ব্যাপারে, নিঃসন্দেহ হইইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের স্বারা অনুপ্রাণিত নয়।

চুক্তি মোতাবেক ঐদিন (১৫ মার্চ) অপরাহ্নেই আমাদের মুক্তির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট মামলার অজুহাতে জনাব শওকত আলী ও কাজী গোলাম মাহবুব এবং কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যভুক্ত অজুহাতে বাবু রনেশ গুপ্তকে কারামুক্তির আদেশ নেওয়া হয় নাই। আমরা উপরোক্ত বন্দিগণ ব্যতীত কারামুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানাইলে, সরকার কালবিলম্ব না করিয়া তাহাদিগকেও আমাদের সহিত মুক্তিলাভের আদেশ জেল গেটে পাঠাইয়া দেন। মুক্তির পর ফজলুল হক হলে আমাদিগকে সংবর্ধনা দানকালে কতিপয় ছাত্রের মধ্যে এক চাপা অসন্তোষ লক্ষ্য করিলাম। তাহারা ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী-আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য কর্মী। তাহাদের পার্টির দায়িত্বই ছিল আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে বিভেদ, ভুল বুঝাবুঝি ও কলহের বীজ বপন করা। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মধ্যে বা বিরুদ্ধে বিভেদ সৃষ্টি করিতে পারিলেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাধারণ জনতাকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করিয়া ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে প্ররোচিত করা সহজ হয়। আন্দোলনে যাহাতে ফাটল বা অনৈক্য সৃষ্টি হইতে না পারে, সেই জন্য আমরা ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেলতলায় এক সাধারণ ছাত্রসভা আহ্বান করি। সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেন। পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম ও কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন কর্মীবৃন্দ এই সাধারণ ছাত্র সভাকে বানচাল করিতে নানাভাবে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু সাধারণ ছাত্রের সচেতন সংগ্রামী চেতনা উপরোক্ত প্রয়াসকে ব্যর্থ করিয়া দেয়। যাহা হউক, উক্ত সভায় পুলিশের জুলুম তদন্তের জন্য তদন্ত কমিশন গঠন, চুক্তিনামার ৩ ও ৪ ধারা কার্যকর করিবার জন্য আইন পরিষদ অধিবেশনে নির্দিষ্ট তারিখ ধার্য ও পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্যবর্গের ও পূর্ববঙ্গের মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবগুলি পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের হস্তে প্রদান করিবার জন্য সভার অপর এক প্রস্তাবে আমার উপরে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই মর্মে আমি উক্ত প্রস্তাবগুলি যথাসময়ে মুখ্যমন্ত্রীর নিকট প্রদান করি।

উল্লেখ্য যে, এই সভা হইতে এক বিক্ষোভ মিছিলসহ আমরা পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভবন (জগন্নাথ হল মিলনায়তন) অভিমুখে যাত্রা করিয়াছিলাম। মিছিলের ধ্বনি ছিল “পাকিস্তান-জিন্দাবাদ” “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই “উর্দু-বাংলা ভাই ভাই” “বাংলার সহিত উর্দুর বিরোধ নাই। যাহা হউক, পরিষদ ভবন গেটে আমরা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সাক্ষাৎ প্রার্থী হইলে কয়েক মিনিটের মধ্যে স্থান পরিত্যাগ করিতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া পুলিশ বাহিনী হিংস্র মূর্তি ধারণ করে ও আমাদের উপর লাঠিচার্জ আরম্ভ করিয়া দেয়। লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করিবার অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিল ঘেরাওকৃত আইন পরিষদ সদস্যদের মুক্ত করা, মন্ত্রীদের বাড়ি যাইবার পথ সুগম করা। মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হইয়া কিছু অংশ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এবং কিছু অংশ সলিমুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের মধ্যবর্তী মাঠে জমায়েত হয়। সন্ধ্যার পর পুনরায় কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করিলে আমরা ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়ি ও পূর্ববঙ্গে তদানীন্তন জি, ও, সি, আইয়ুব খানের (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট) জবানীতে জানতে পারি, উজিরে আলা পরিষদ ভবন ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। অর্থাৎ সেই দিনের সেই অবস্থা হইতে পরিত্রাণের নিমিত্ত ভীত মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সৈন্য বাহিনীও তলব করিয়াছিলেন।

নাজিমুদ্দিন সরকারকে সমালোচনা করিবার কারণে সোহরাওয়ার্দী প্রতিষ্ঠিত ও কলিকাতা হইতে প্রকাশিত জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেহাদের পূর্ববঙ্গে প্রবেশ ১৯৪৭ সালেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হইয়াছিল। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে দৈনিক ইত্তেহাদের অনন্য অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে। এই প্রসঙ্গে কলিকাতা হইতে প্রকাশিত দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক স্বাধীনতার বলিষ্ঠ ভূমিকাও পূর্ববঙ্গ সরকারের  রোষের কারণ হওয়ায় এবং ১০ই মার্চ সৈনিক অমৃতবাজার, সৈনিক আনন্দবাজার ও দৈনিক স্বাধীনতা পূর্ববঙ্গে প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। যুগান্তর ইতিপূর্বেই সরকারি কোপানলে পতিত হইয়াছিল।

১৬ই মার্চ পরিষদ ভবনে বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে ১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বেলতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের আহ্বায়ক নইমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভার আয়োজন করা হয়। প্রারম্ভেই পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য নেতা অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম কতিপয় সমর্থকদের সহায়তায় গোলযোগ সৃষ্টির প্রাণপণ চেষ্টা করেন। ইহা নাকি তাহাদের বিপ্লবের স্বার্থে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কর্মসূচিভুক্ত। তাহারা সংগ্রাম পরিষদ এর প্রতিনিধিত্ব দাবি করিতেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ বিপ্লবের নেশার ঘোরে গণ-বিপ্লব দ্বারা সরকারের উৎখতের প্রয়োজনে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দাবি করিতেছিলেন। তরুণ নেতা শামসুল হক ও কাজী গোলাম মাহবুব এর বক্তৃতার পর শেখ মুজিবুর রহমান ও আবদুর রহমান চৌধুরীর পীড়াপীড়িতে সভাপতির আহ্বানে বক্তৃতা দিতে হইয়াছিল। সেই দিনের সেই সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সৃষ্টি প্রয়াসকে শক্ত ভাষায় আক্রমণ করিয়া বলিয়াছিলন, “যাহারা কলিকাতায় সদ্য অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কাগ্রেসে অংশ গ্রহণ করিয়া বিপ্লবের অলীক স্বপ্নের বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন এবং ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ বলিয়া প্রকাশো পণনবিদযারী আওয়াজ তুলিতেছেন, তাহারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। সুতরাং ‘কমিটি অব অ্যাকশন’ বা কর্ম পরিষদে তাহাদের কাহাকেও গ্রহণের প্রশ্নই উঠে না। আমরা মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন করি, ছাত্র সমস্যা সমাধানের আন্দোলন করি, সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াই, কিন্তু দেশের আজাদীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করি না।”

আমার বক্তৃতার সমর্থনে সাধারণ ছাত্রদের একাত্মতা লক্ষ্য করিয়া গোলযোগ প্রিয় কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক সভা হইতে বিষন্ন দিনে পিছটান দিলেন। সভায় ১৬ তারিখ অপরাহ্নে পরিষদ ভবন সম্মুখে পুলিশী জুলুমে আহতদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়া পুলিশী জুলুমকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করা হয়। জাতির জনক কায়েদে আযমের আসন্ন পূর্ববঙ্গ সফরকে স্বাগত জানাইয়া তাহাকে যথাযথ সম্বর্ধনা দানের আহ্বানের মধ্য দিয়া সভাপতি সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে পরলোকগত সাংবাদিক সাপ্তাহিক ইনসানের সম্পাদক মরহুম আবদুল ওয়াহেদের ভূমিকা লিপিবদ্ধ করা আমার পবিত্র দায়িত্ব বলিয়া আমি মনে করি। কারণ, অনেকেই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করিয়াও অধুনা ননাভাবে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ইতিহাসে চিহ্নিত থাকার লোভে বিভিন্ন বন্ধুবান্ধবের কলমের আঁচরে আনুকুল্য কুড়াইতেছেন। করাচির কুচক্রী ও তাহাদের দোসর বঙ্গ সন্তানদের ন্যাক্কারজনক প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার মরণপণ সংগ্রামে সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করিয়া সর্বপ্রকার অত্যাচার, নির্যাতন তুচ্ছজ্ঞান করিয়া তরুণ সমাজকে ঝাঁপাইয়া পড়িতে জনাব ওয়াহেদ বলিষ্ঠ তেজোদীপ্ত সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে উদাত্ত আহ্বান জানাইতেন।  তাহার সম্পাদকীয় সংগ্রামী ও সচেতন তরুণ ছাত্র সমাজকে আত্মত্যাগের মন্ত্রে দারুণভাবে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান দিবস ৮ই মার্চ, খেলাধুলা প্রতিযোগিতার ফাঁকে ফাঁকে সমবেত ছাত্র, শিক্ষক ও দর্শকদিগকে ১১ই মার্চ রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন দিবসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করি এবং সংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতে অনুপ্রাণিত করিবার মানসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম মাঠে মাইকের মাধ্যমে জনাব ওয়াহেদ কর্তৃক লিখিত সম্পাদকীয় পুনঃ পুনঃ পাঠ করিয়া শুনাইয়াছিলাম। সম্পাদক ওয়াহেদ সাহেব স্বয়ং জিমনেসিয়াম খেলার মাঠে আমাদের সাথে ছিলেন। অতি তরুণ বয়সেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করিয়া পরপারে পাড়ি জমাইয়াছেন। আজও ব্যথাবিধুর হৃদয়ে তাহাকে স্মরণ করি।

ভাষা আন্দোলনের প্রতি ঢাকার আদিবাসীদের মনোভাব

ঢাকা শহরের আদিবাসীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিল। তাহাদের দৃষ্টিতে আমাদের আন্দোলন ছিল মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকারী ও হিন্দুদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। পাকিস্তান শিশু রাষ্ট্র ও পাকিস্তানকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করিবার অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হইয়া ভারতীয় পঞ্চম বাহিনী মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন ছলছুতার সুযোগে বিভেদ সৃষ্টির জনা সদা সচেষ্ট। আমরা অসতর্ক মুহূর্তে ভাবাবেগবশতঃ উক্ত খপ্পরে পতিত হইয়াছি। তাই আমাদের ছাত্রাবাসের বাবুর্চি মৌলভীবাজার, বেগমবাজার ও চকবাজার কেনাকাটা করিতে গেলে আদিবাসীরা কটুক্তি করিত, মারধর করিত, এমনকি তাহার নিকট সওদা পর্যন্ত বিক্রি করিত না। তাহাদের ধারনা, পূর্ববঙ্গে এক কোটির মত হিন্দু আছে এবং তাহারা সবাই পাকিস্তান ধ্বংসের কারসাজিতে সক্রিয়ভাবে লিপ্ত।

একচেটিয়া শাসন-শোষণ ও লুটপাট পূর্ণোদ্যমে বজায় রাখার অপপ্রয়াসেই আজাদী উত্তর রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতা, অনগ্রসর সামন্ত অর্থনীতি, বন্ধ্যা শিক্ষানীতি ও স্থবির আমলাতান্ত্রিক প্রথাকে সুচতুরভাবে চালু রাখিয়াছিল। ইহাতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ হয়তবা চরিতার্থ হইয়াছে, কিন্তু দেশ ও জনগণকে দিতে হইয়াছে চরম মূল্য।

কায়েদে আযমের পূর্ববঙ্গ সফর

                স্বাধীনতার পর কায়েদে আযম প্রথম পূর্ববঙ্গ সফর উপলক্ষে ১৯শে মার্চ ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করিলে তাহাকে অশ্রুপূর্ব ও স্বতঃস্ফূর্ত ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। ঢাকা বিমান বন্দর হইতে রেসকোর্স পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য ছিল, তিল ধারণের স্থান ছিল না। হর্ষোৎফুল্ল জনতার এই ঢল দেখিয়া কে বলিবে, মাত্র দুই দিন পুর্বেও ঢাকা শহরে সরকার বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ ঢাকার কর্তাব্যক্তিদের মসনদ টলটলায়মান করিয়া তুলিয়াছিল। দেশবাসীর কি অকৃত্রিম ভালবাসাই না ছিল রাষ্ট্রের জনকের প্রতি। অতি পরিতাপের বিষয়, কায়েদে আযম ২১শে মার্চ রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে ভাষণদানকালে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করিলেন যে, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হইবে এবং ভাষা আন্দোলন বিদেশী চক্রান্ত বিশেষ।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তিন লক্ষ লোকের সমাবেশে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণঃ (অনুবাদ)

আসসালামু আলাইকুম

আমি প্রথমে সম্বর্ধনা আয়োজন কমিটির চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ঢাকাবাসী এবং প্রদেশের সবাইর নিকট, আমাকে এই সম্মান জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পূর্ব বাংলায় আমার এই সফর, আমার জন্য বড় আনন্দদায়ক মনে হচ্ছে। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ অংশে পৃথিবীর এক বিরাট সংখ্যক মুসলমান, একটা নির্দিষ্ট জায়গার ভিতরেই, অবিচ্ছিন্নভাবে বাস করছে। এই অঞ্চল সফর করার প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ কারণে, আমার সফরের কিছুটা দেরী হয়ে গেছে।

আপনারা অবশ্যই কতগুলি জরুরি বিষয় জানেন যে, ভারত ভাগের সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবে কী ঘটনা ঘটে গেছে। পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লী এবং এর নিকটবর্তী এলাকাগুলি থেকে, ওখানে বসবাসরত লাখ লাখ মুসলমানদেরকে, তাদের জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ভাগ্যহত মুসলমানদের বাঁচিয়ে রাখা, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা এবং পুনর্বাসনের জনা পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে, এরূপ ঘটনা খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে যে, একটি নতুন রাষ্ট্রকে এত বড় কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আল্লাহর মেহেরবানীতে, সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের পক্ষে, এই বিরাট এবং কঠিন সমস্যা অত্যন্ত যোগ্যতা ও সাহসের সাথে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দুশমনদের মনের বাসনা ছিল, পাকিস্তান জন্মের সাথে সাথেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। শক্রদের কামনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে, তাদের চাপিয়ে দেওয়া কঠিন সমস্যা সমাধানে পাকিস্তান সক্ষম হয়েছে এবং পাকিস্তান দিনের পর দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই এসেছে এবং যে উদ্দেশ্য নিয়ে এদেশটির জন্ম হয়েছে, আমরা সেই লক্ষ্যপানে কাজ করে যাব।

এই সম্বর্ধনা সভায় যে সব বক্তৃতা হলো, তাতে আপনারা বলেছেন যে, বিপুল সম্ভাবনাময় এই প্রদেশের কৃষিখাত এবং শিল্পখাতকে জোরদার করে তুলতে হবে। প্রদেশের সকল তরুণ, যুবক এবং নারীদের যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের সশস্ত্রবাহিনীতে এ অঞ্চলবাসী যেন যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে, সে অবস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নের কথা বলেছেন। পাকিস্তানের সাথে এই প্রদেশের যোগাযোগ সহজ এবং সুগম করার কথা বলেছেন। শিক্ষা বিস্তারের কথা বলেছেন। সবশেষে আপনারা জোর দিয়ে বলেছেন যে, পাকিস্তানের এই পূর্ব অংশের প্রতিটি নাগরিক তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে যেন কোনভাবেই বঞ্জিত না হয় এবং সরকারের প্রতিটি স্তরে তাদের ন্যায্য হিসাব নিশ্চিত করা হয়।

                আমি এখনই আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনাদের উদ্বেগ নিরসন এবং ন্যায্য দাবিসমূহ কীভাবে এবং কত তাড়াতাড়ি পুরণ করা যায়, আমার সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা সহকারে উল্লিখিত আপনাদের দাবিসমূহের অনেকগুলি বাস্তবায়নের কাজ ইতিমধ্যে হাতে তুলে নিয়েছে এবং কোন রকম শিথিলতা ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছে। বিষয়গুলি ভেবে দেখা হবে, এরকমের সময় নষ্ট করারও অবকাশ থাকবে না। পাকিস্তানের এই অংশ, তার ন্যায্য ও পূর্ণ পাওনা যত দ্রুত সম্ভব লাভ করবে। এই অঞ্চলের অতীত ইতিহাস বলে, পূর্ব বাংলার মানুষেরা শৌর্যে, বীর্যে, পরিশ্রমে এবং মেধায় অনেক যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে। সরকার এ প্রদেশের তরুণ ও যুবাদের জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য তাদেরকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং প্রদানের কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সরকার এদেশের যুবকদের তাদের নিজ দেশের সশস্ত্রবাহিনী এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডে যথাযোগ্য ভূমিকা পালনের পথ খুলে দিয়েছে এবং খোলা থাকবে। আমি একথা জোর দিয়ে বলে যাচ্ছি, দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ববাংলার তরুণেরা সকল সুযোগ সদ্ব্যবহার করে, নিজ দেশকে দুশমনদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জীবন বিলিয়ে দেবার অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারবে না।

এবার আমি এদেশের অন্য আরো কিছু নিয়ে কথা বলবো। সে কথা বলার আগে আমি পূর্ব বাংলার অধিবাসী এবং সরকারকে আরেকবার মোবারকবাদ জানাতে চাই এজন্য যে, গত সাত মাসে আপনারা দেশ গড়ার কাজে বহু কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ভারত ভাগ হওয়ার পরপরই যে অব্যবস্থা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে পড়েছিল, তার ঢেউ ঢাকার ওপরেও পড়েছে। সে অব্যবস্থাকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে এখানকার অনুগত ও ত্যাগী প্রশাসন যে পরিশ্রম, দক্ষতা ও মেধার পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য তাদেরকে জানাই আমার শ্রদ্ধা এবং সালাম। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে ঢাকার সরকার নিজ দেশের মধ্যে যেন পরবাসী ছিল। ভারত থেকে চলে আসা হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এখানে মাথা গোজার মত কোন স্থানের ব্যবস্থা ছিল না। গত বছরের (১৯৪৭) ১৫ আগস্টের আগে ঢাকা ছিল একটি মফস্বল টাউন মাত্র। সুশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারেনি, এমন একটি নবগঠিত প্রশাসনের নিকট বিরাট মাথা ব্যথার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ভারতের রেলওয়ে সহ অন্যান্য প্রায় ৭০ হাজার কর্মচারীদের পরিবার পরিজনদের আশ্রয় এবং পুনর্বাসন করা। ভারত বিভক্তির কারণে সৃষ্ট গোলযোগ, হুমকি এবং অনেকটা ভয়ের মুখে এসব লোকেরা কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে জীবন বাঁচাবার জন্য এখানে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

একইভাবে এখান থেকে হিন্দুরা পাইকারীভাবে দেশ ত্যাগ করার ফলে প্রশাসনে হঠাৎ শূন্যতা সৃষ্ট হয়ে যায়। প্রশাসন, যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। এই সময়ে প্রশাসনের সবচেয়ে জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়ায়, কত দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রশাসন ব্যবস্থাকে সংগঠিত ও সচল করে তুলে প্রদেশকে অকল্পনীয় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থেকে বাঁচিয়ে তোলা। আমাদের এই নতুন প্রশাসন কঠিন পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে, সীমাহীন ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জাতিকে রক্ষা করেছেন। প্রশাসন সকল বাধা সরিয়ে ফেলে মানুষের জীবন যাত্রাকে স্বাভাবিক এবং সুগম বেখেছেন। আরেকটি মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রশাসন কেবল নিজেদের সংগঠিত করে তুলেনি; প্রশাসনের অব্যবস্থার সুযোগে যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তাকেও মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। নতুন প্রশাসন আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার সুমহান দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেছে।

একই সাথে এসব ব্যাপারগুলি সমাধানের অন্য জনগণ বিপুল উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন। আপনাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির প্রতি। তারা এ রাষ্ট্র গঠনে এবং পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারত বিভক্তির পরবর্তী কয়েকটি মাসে, লাগাতারভাবে, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর যে নারকীয় তান্ডব, জুলুম এবং হত্যা নেমে এসেছিল, এতসব উস্কানীর মুখেও এদেশবাসী চরম সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। এত ভয়াবহ অবস্থা ঘটে যাওয়া স্বত্বেও পূর্ববাংলায় এবারের পূজার সময় হিন্দু ভাইয়েরা প্রায় ৪০ হাজার মিছিল বের করেছেন। এসব মিছিলে কোন অশান্তির ঘটনা ঘটেনি এবং উৎসব পালনে কোন নির্যাতনের বা বাধার খবর আমার কাছে আসেনি।

যে কোন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক আমার সাথে একমত হবেন যে, গত কয়েক মাসে সারা ভারত জুড়ে যে মহাতান্ডব ঘটে গেল, তার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানে কিছুই ঘটেনি। বরং পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের জানমাল নিরাপত্তায়, কঠোর নজর রাখা হয়েছিল। আপনারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, পাকিস্তান আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম। কেবল ঢাকার সংখ্যালঘুরা নয়, সারা পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা অনেক দেশের চেয়ে এখানে অধিক নিরাপদ এবং জীবনহানি ঘটনার কোন শংকায় শঙ্কিত নন। আমরা যে কোন মূলো, কঠোর হাতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবো এবং শান্তি বিঘ্নিত হতে দেবো না। আমার সরকার কোনরূপ গণরাজত্ব অথবা বন্য গণআদালত সৃষ্টি হতে দেবে না।

আমি আবারও একই কথা উল্লেখ করছি, সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি দেশে, ত্যাগ স্বীকারকারী একটি প্রশাসন গড়ে তোলা, অবশ্যাম্ভাবী দুর্ভিক্ষ এড়ানোর জন্য প্রায় ৪ কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান এবং শান্তি বজায় রাখা আমার সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেকে প্রশাসনের এসব বিষয়কে বিবেচনায় আনতে চান না। এগুলি যে অতি সহজ সাধারণ ব্যাপার, তা ধারণা করাও মোটেই উচিত হবে না। সমালোচনা অতি সহজ। দোষ বের করা আরো সহজ। মানুষের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয় জনতা অতি তাড়াতাড়ি সেসব ভুলে যায় এবং যেসব কাজ হাতে নেওয়া হবে এবং বাস্তবায়ন করা হবে তাও ভুলে যাবে। অথচ পাকিস্তানের আজাদীর সংগ্রামে আমাদেরকে কত পরীক্ষা, বিষাদ, মুসিবত এবং খুন ঝরাতে হয়েছে এবং পাকিস্তান লাভের পর গত কয়টি মাসের কঠিন সমস্যাগুলি সমাধান করতে কী সব দিন কেটে গেছে তা কী জনতার মনে পড়ছে? মনে আছে কী?

প্রশাসনের কথা বার বার এসে যাচ্ছে। আমি জানি, আমরা যা যা আকাঙ্ক্ষা করছি তা পুরোটা বর্তমান প্রশাসন মিটাতে পারছে না অথবা এ শাসন ব্যবস্থায় অনেক খুঁত রয়ে গেছে। আমি বলি না যে, এই অবস্থাকে উন্নত করা সম্ভব নয়। এমনটাও নয় যে, একজন দেশপ্রেমিকের সমালোচনা গ্রহণ করা যাবে না। বরং সৎ সমালোচনাকারীদের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দিতে সাহায্য করুন। কিন্তু আমি যখন দেখি, কিছু কিছু মহল কেবল অভিযোগের পর অভিযোগ করে যাচ্ছেন এবং আমাদের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন; যেসব ভাল কাজ করা হয়েছে তার সামান্য প্রশংসা বা স্বীকৃতি দিতে বড় কুন্ঠাবোধ করেন, তখন সরকারে যারা আছেন এবং প্রশাসনের নিবেদিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ যারা দেশের জন্য দিনরাত অক্লান্ত খেটে মরছেন তাদের মাঝে নেমে আসে গভীর হতাশা। আর এজন্য স্বাভাবিকভাবেই আমিই বেশি কষ্ট পাই।

ভাইদের বলবো, আমরা যেসব ভাল কাজ করেছি তার প্রশংসা না করতে পারুন তবে না করুন। অযথা অভিযোগ এবং সমালোচনা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না। একটা দেশের বিরাট প্রশাসনের মধ্যে অবশ্যই ভুলক্রটি কিছু না কিছু ঘটতে পারে বা ঘটেছে। মানুষের পক্ষে শতকরা একশত ভাগ নির্ভুল ও সুবিচারপূর্ণ প্রশাসন নিশ্চিত করা সত্যি সম্ভব নয়। এতদসত্ত্বেও আমাদের লক্ষ্য থাকবে, পাকিস্তানের প্রশাসনকে যতটা সম্ভব অন্যায় ও ত্রুটিমুক্ত রেখে সৎ, দক্ষ, গতিশীল, উপকারী এবং ন্যায় বিচারবোধ সম্পন্ন একটি কর্মচঞ্চল প্রশাসন হিসেবে গড়ে তোলা।

আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন কীভাবে এ ব্যবস্থা অর্জন করা যেতে পারে? হ্যা, সরকারের উদ্দেশ্যকে সামনে এনে সে ব্যবস্থা অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেটা হলো সরকার কীভাবে জনগণের সেবা করতে চায়, সরকার কী কী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কী কী কর্মসূচী হাতে নিয়েছে তা জনগণকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে রাখতে হবে।

আপনারা জেনে রাখুন, সরকার বদলের ক্ষমতা এখন আপনাদেরই হাতে। আপনাদের যত দিন ইচ্ছা এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে পারেন এবং যখনই অপছন্দ হবে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দিতে পারবেন। ক্ষমতার এই পরিবর্তন অনিয়মতান্ত্রিক পথ ধরে করা যাবে না। আপনাদের হাতে যে ক্ষমতা এসেছে, সেই অধিকারকে নিয়ম মোতাবেক প্রয়োগ করার চর্চাকে অনুশীলন করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার এবং পরিবর্তনের নিয়মগুলি রপ্ত করে নিতে হবে। শাসনতান্ত্রিক নিয়মের ভিত্তিতেই, এক সরকারের বদলে অন্য সরকার আসবে এবং যাবে।

অতএব, সরকার বদলের ক্ষমতা এখন আপনাদের হাতে। আমি আপনাদের কাছে আকুল আরজ করবেন, আপনারা আরো অধিক ধৈর্যের পরিচয় দিন। বর্তমানে যারা সরকারের হাল ধরে আছে তাদেরকে সমর্থন দিন। তাদের সাথী হোন। তারা যে, অসুবিধা, সীমাবদ্ধতা এবং দুরবস্থার মধ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছন, তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করুন এবং তাদের পক্ষে আপনাদের সকল সমস্যা রাতারাতি পূরণ করা যে অনেকটা অসম্ভব, সেটাও উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। আপনার সহযোগিতার হাত আরো বাড়িয়ে দিলে, আমাদের দেশের সমস্যা শুধু একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠার।

                আমার সবিনয় প্রশ্ন এই লক্ষ জনতার কাছে, আপনারা কী আপনাদের এবং আপনাদের পূর্ব পুরুষদের বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশটিকে রক্ষা করবেন নাকি আমাদের বোকামীর জন্য দেশটিকে ধ্বংস করে দেবেন? আপনারা কী চান এই দেশটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক? আমি জানি, আপনারা নিজ দেশের ধ্বংস চাইবেন না বরং জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে দেশটিকে রক্ষা করবেন। এরজন্য দরকার একটি কাজের। সেটি হলো আমাদের সকলের মধ্যে শীসার প্রাচীরের মত ঐক্য এবং সংহতি। আপনারা জেনে রাখুন, আমাদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত দেশটির মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে আমাদের দুশমনেরা বসে নেই। আমাদের মধ্য থেকে, আমাদের মানুষকে বেছে নিয়ে, অর্থ দিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের সকল স্বপ্নকে ধ্বংস করে দিতে তারা ইতিমধ্যে উদ্যত হয়েছে। আমার আকুল আহ্বান, আপনারা এসব যড়যন্ত্র সম্বন্ধে সতর্ক থাকেন। এদের মনভুলানো এবং আকর্ষনীয় শ্লোগানের মায়াজাল থেকে নিজেদেরকে হেফাজত করুন।

এরা বলা শুরু করেছে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ববাংলার প্রাদেশিক সরকার তাদের মাতৃভাষা বাংলা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হাতে নিয়েছে। এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না। আমি সুস্পষ্টভাবে এবং পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই, আমাদের ঐতিহাসিক দুশমনদের এজেন্ট এবং অনেক কমিউনিস্ট আমাদের মাঝে ঢুকে পড়েছে। আপনারা যদি এদের ব্যাপারে সজাগ না থাকেন তবে এরাই আপনাদের ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। আমি বিশ্বাস করি, ভারত থেকে পূর্ববাংলা বেরিয়ে আসাকে এরা মেনে নিতে পারেনি। এরা পূর্ব বাংলাকে ভারতের সাথে মিশিয়ে দেখতে চায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ষড়যন্ত্রকারীরা দিবাস্বপ্ন দেখছে। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা কখনও তাদের দেশকে ভারতে মিশিয়ে নেবে না এবং মিশতে দেবে না। আমাকে জানানো হয়েছে যে, প্রদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহুলোক দেশ ত্যাগ করেছে। ভারতের পত্রিকাগুলি দেশ ত্যাগের সংখ্যাকে দশ লক্ষেরও বেশি বলে মিথ্যা সংবাদ ছাপছে। আমাদের সরকারের হিসাব মতে এই সংখ্যা বেশি করে ধরলেও দুই লাখের উপরে যাবে না। এতে আমি একটা স্বস্তিবোধ করছি এজন্য যে, সংখ্যালঘু যেসব ভাইরা দেশ ত্যাগ করেছেন তারা কিন্তু মূলত সংখাগরিষ্ঠ সমাজের নির্যাতনের ফলে দেশ ত্যাগ করছেন না। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুরা যে স্বাধীনতা এখানে ভোগ করছেন এবং নিজেদের সহায় সম্পত্তি সংরক্ষণের যে গ্যারান্টি পাচ্ছেন ঠিক একই অধিকার ভারতের সংখ্যালঘুরা পাচ্ছেন না। তাদের দেশ ত্যাগের কারণগুলি তালাশ করলে দেখতে পাওয়া যাবে ভারতের সাম্প্রদায়িক ও যুদ্ধবাজ নেতাদের বেফাস কথাবার্তা একটি অন্যতম কারণ। তারা গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে পাকিস্তান ভারতের মধ্যে শীঘ্রই যুদ্ধ বেধে যাবে। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার এবং নির্যাতন চলছে তার প্রতিক্রিয়া এখানেও দেখা দিবে। অমূলক এই ভয় এবং নির্যাতনের আশংকায় অনেক হিন্দু দেশ ত্যাগ করছেন। তাছাড়া ভারতের কতিপয় পত্রিকায় হিন্দুদেরকে পাকিস্তান ছেড়ে আসার জন্য অবিরতভাবে লেখালেখি চলছে। এদের লেখাগুলির মধ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতনের মনগড়া ও মিথ্যা কাহিনীকে তুলে ধরা হচ্ছ। ভারতের হিন্দু মহাসভা এদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এতদ মিথ্যা প্রচারণা সত্ত্বেও এদেশে প্রায় সোয়া কোটি সংখ্যালঘু সমাজ শান্তিতে তাদের নিজ জন্মভূমিতে বসবাস করছে এবং অন্যদেশে যাওয়ার চিন্তা প্রত্যাখ্যান করছে। আমি আবার উল্লেখ করতে চাই, আমরা পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করার প্রশ্নে কোন শৈথিল্য বা দ্বিধার সুযোগ রাখবো না। ভারতের চাইতে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জানমালের হেফাজত সুরক্ষিত রাখার প্রশ্নে আমরা কঠিন সংকল্পবদ্ধ। পাকিস্তানের আইন, শৃঙ্খলা, শান্তি এবং প্রতিটি মানুষের পূর্ণ নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে অমরা কোন সম্প্রদায়, শ্রেণি এবং জাতির বিভেদকে বরদাস্ত করবো না।

ভাল বলছি কী মন্দ বলছি জানি না। সবার কাছে প্রীতিকর নাও হতে পারে। আমি কিছু নাজুক কথা এখন বলবো। আমাকে জানানো হয়েছে যে, এখানে আসা অবাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন কোন মহল স্থানীয় মুসলমানদের দিয়ে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর পথ বেছে নিয়েছে। একই সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার জন্য ভবিষ্যৎ সিন্ধান্তের অপেক্ষাধীন, উর্দু কী বাংলা ভাষা হবে, তা নিয়ে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস চলছে। আমি এও জানতে পারলাম যে, সুযোগ সন্ধানীরা তাদের দুরভিসন্ধিকে অর্জন করার লক্ষ্যে এবং প্রশাসনকে বিব্রত করে তোলার জন্য ঢাকার ছাত্র সমাজকে ব্যবহার করা জরু করেছে। এই সভায় উপস্থিত আমার যুবক এবং ছাত্র বন্ধুরা, আমি তোমাদেরই একজন, যে কিনা তোমাদের জাতির ভালবাসার এবং তোমাদের বিকশিত জীবন গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় গত দশটি বছর আরামকে হারাম করে দিয়েছি। ঈমানদারী এবং বিশ্বস্ততাকে বুকের ভিতরে চেপে ধরে জীবনের এ সময়গুলিকে ব্যয় করেছি। এরকমের একটি লোকের মুখ থেকে তোমাদেরকে সাবধান হওয়ার কথা শুনাতে চাই; তোমরা যদি কোন রাজনৈতিক দলের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তবে যে ভুল ঘটে যাবে, তা হয়তো আর কোন দিন শোধরানো সম্ভব হবে না। তোমরা মনে রেখ, যে দেশটি এখন আমাদের, এটি একটি বিপ্লবের ফসল। বর্তমান সরকারতো আমাদের নিজেদের সরকার। আমরা তো এখন আর গোলাম জাতি নই। আমরা এখন একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিক। আমাদের দেশকে আমরা কীভাবে চালাবো তা আমরাই ঠিক করে নেব। স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিকের মতই আমাদের আচরণ হতে হবে। কারো রাজত্বের অধীনে বা কোন বিদেশী কলোনীর মধ্যে আমরা এখন আর বাস করছি না। আমরা গোলামীর শিকল ছিড়ে ফেলেছি, উপড়ে ফেলেছি। আমার যুবক বন্ধুরা, আমার স্বপ্নের পাকিস্তানের তোমরাই নির্মাতা। তোমাদের কাছে আমার আকুল মিনতি, তোমরা বিভ্রান্ত হয়ো না। কারো চক্রান্তের শিকার হয়ো না। তোমরা নিজেদের মধ্যে সুমহান ঐক্য এবং সংহতি গড়ে তোল। যুবকরাই সকল কিছু বদলে দিতে পারে এমন নজির গড়ে তোল। তোমাদের আসল কাজ নিজেদের প্রতি সুবিচার করা। অর্থাৎ নিজেদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। পিতা-মাতাকে সম্মান করা আর স্বদেশ, স্বজাতির কল্যাণে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে রাখা। তোমরা যদি শিক্ষায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে পার তবে দেশ শিক্ষিত হয়ে উঠবে। শিক্ষিত দেশই কেবল শক্তিশালী দেশ হতে পারে। আমি তোমাদেরকে লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়ার জন্য আকুল আহ্বান জানিয়ে গেলাম। তোমাদের শক্তি, প্রতিভাকে যদি অপচয় করে ফেল তাহলে তোমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং গভীর মনস্তাপে সারাটা জীবন দুঃখময় হয়ে যাবে। তোমরা কলেজ ইউনিভার্সিটির পড়াশুনা শেষ করে, পূর্ণ বিবেচনা করার শক্তির অধিকারী হয়ে, দেশকে গড়ে তোলার জন্য সত্যিকারের অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এতগুলি কথার মধ্য দিয়ে, আমি তোমাদেরকে পুনরায় হুশিয়ার করে জানিয়ে রাখতেই চাইঃ পাকিস্তান এবং পূর্ববাংলার যে বিপদসমূহের কথা আগে বলেছি, তা আমাদের উপর থেকে এখনও কেটে যায়নি। আমাদের ঐতিহাসিক দুশমনেরা পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধে শত চেষ্টা করে বিফল হয়েছে। তারা এখনও বসে নেই। এখন তারা তাদের কৌশল বদলিয়েছে। তারা এখন আমাদের দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা খুঁজছে। আর তারা ভাল করেই জানে, আমাদের মধ্যে প্রাদেশিকতা, আঞ্চলিকতা জাগিয়ে তুলতে পারলে, আমরা বিভক্ত হয়ে যাব এবং তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে। আর আমরা যতক্ষণ না আঞ্চলিকতা এবং প্রাদেশিকতাকে আমাদের মন থেকে, চিন্তা থেকে এবং রাজনীতি থেকে ছুঁড়ে ফেলতে না পারবো, ততদিন পর্যন্ত আমরা একটি শক্তিশালী ও আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত এবং গড়ে তুলতে পারবো না। আমরা কী এই পরিচয়ে পাকিস্তান করেছি যে, আমরা বাঙালি, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচী, পাঠান, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এগুলো অবশ্যই আমাদের জাতিসত্তার এক একটি ইউনিট। আমি আপনাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে চাই তেরশত বছর আগে আমাদের কাছে যে হেদায়েত এসেছে, সে কথা কী আমরা ভুলে গেছি।

আমি ইতিহাসের সত্য কথাটি বলতে চাই, এই পাকিস্তানে আমরা যে যেখানেই বাস করছি, আমরা সকলেই বহিরাগত। এই বাংলায় যারা বাস করছেন, তারা কেউই এখানের আদি অধিবাসী নন। সুতরাং আমরা বাঙালি, আমরা পাঠান, আমরা পাঞ্জাবী বলে কী লাভ? আমাদের সকলের প্রথম পরিচয় আমরা মুসলমান।

ইসলাম আমাদেরকে এই কথাই শিক্ষা দিয়েছে। আমি মনে করি তোমরা আমার সাথে একমত হবে যে, আগে আমরা কি ছিলাম বা না ছিলাম, কীভাবে এখানে আসলাম, এসবের প্রাসঙ্গিকতার চেয়ে, বর্তমানে আমাদের প্রধান পরিচয় আমরা মুসলিম। প্রিয় ছাত্রবন্ধুরা, তোমাদের একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে। এটা ছোট্ট একফালি জমির দেশ নয়। এখন একটি বিরাট ভু-খণ্ড তোমাদের হয়েছে, এই ভু-খণ্ডটির মালিক কোন পাঞ্জাবির, কোন সিদ্ধির, কোন বেলুচির, কোন পাঠানের বা কোন বাঙগালীর নয়। এটি আমাদের, তোমাদের সবার। তোমরা একটা কেন্দ্রীয় সরকার পেয়েছে, যেখানে সকল ইউনিটের প্রতিনিধি রয়েছে। তাই বলতে চাই, তোমরা যদি একটি শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে দুনিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাও, তবে আল্লাহর কসম দিয়ে তোমাদের কাছে আরজ করছি, তোমরা প্রাদেশিক হিংসা, আঞ্চলিক ক্ষুদ্রতাকে ঝেড়ে ফেলে দাও। আঞ্চলিকতা এবং প্রাদেশিকতা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ। বিভেদের আরো যেসব রয়েছে, শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব এসবকেও দূরে সরিয়ে রাখ।

এ ধরনের বিরাজিত অবস্থা নিয়ে, পরাধীন আমলের সরকারগুলির মাথা ব্যথা ছিল না। তারা এরূপ অবস্থায় অস্বস্তিবোধ করে না। তাদের লক্ষ্য ছিল বাণিজোর দিকে। ভারতবর্ষকে যেভাবে এবং যতভাবে শোষণ করা যায়, তাকে নিরুপদ্রব রাখতেই আইন-শৃঙ্খলার প্রতি নজর রাখতো। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছে। আপনাদেরকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি, বর্তমান আমেরিকার কথা ধরুন, তারা যখন ব্রিটিশদের তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে নিজেরা স্বাধীনতা ঘোষণা করলো, তখন তাদের দেশে এত জাতি-গোষ্ঠী ছিল যার বর্ণনার শেষ করা যাবে না। স্পেনীয়, ফরাসী, জার্মান, ইতালিয়ান, ইংরেজ, ওলন্দাজ, ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের নিজেদের ভিতর জাতিগত সমস্যা ছাড়াও, শত সমস্যা নিয়ে তারা সেখানে বাস করতো। লক্ষ্য করুন, এতসব নিজেদের সমস্যাকে কাটিয়ে পৃথিবীর একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়েছে। আর আমাদের ভিতর এ ধরনের কোন জটিল সমস্যার অস্তিত্বই নেই। তাছাড়া, আমরা সবেমাত্র পাকিস্তান হাসিল করেছি। মনে করুন, আমেরিকায় ফরাসী বংশোদ্ভূত কেউ একজন যদি বলে, আমি একজন ফরাসি, আমি পৃথিবীর অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ জাতির সদস্য, আমার এই এই গৌরব রয়েছে, অন্যরাও যদি অনুরূপ কথা বলতো, তাহলে পরিস্থিতি বা কী দাঁড়াতো? তাদের মধ্যে তাদের নিজেদের সমস্যা উপলব্ধি করার যথেষ্ট শক্তি ছিল এবং এর ফলে অতি অল্প সময়ে তারা, তাদের ভিতরকার সমস্যাগুলি মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে এবং স্ব-স্ব জাতি, গোষ্ঠীর বিভেদের দেওয়ালকে সরিয়ে ফেলতে পেরেছে। তারা নিজেদের জার্মান, ফরাসী, ইংরেজ, স্পেনীয় পরিচয় মুছে দিয়ে আমেরিকান হিসাবে পরিচয় দিতে কোন কুণ্ঠাবোধ করেনি। তাদের ভিতর নিজ দেশের জাতিগত চেতনা, এত শক্তিশালী হয়েছে যে, তারা এখন গর্বভরে বলে থাকে আমি একজন আমেরিকান অথবা আমরা আমেরিকান। সুতরাং এরকম করেই কী আমরা নিজেদের চিন্তা করতে পারি না? আমরা সবাই কী আমাদের দেশ পাকিস্তান, আমি, আপনি এবং আমরা সবাই পাকিস্তানী, এই ধারণাকে আমাদের হৃদয়ের ভিতরে প্রবশে করিয়ে দিতে পারি না? আমি আবারও আপনাদের কাছে অনুরোধ করে যাচ্ছি আপনারা প্রাদেশিকতা এবং আঞ্চলিকতা থেকে নিজেদের মুক্ত করে ফেলুন। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা রাজনীতিতে যদি প্রাদেশিকতার বিষ ঢুকে যায়, আপনারা কখনও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হবেন না। পাকিস্তানকে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার যে সংকল্প পোষণ করি, তা অর্জিত হবে না। আপনারা মনে করবেন না, আমি আপনাদের পরিচরে অমর্যাদা করছি। এরকম অবস্থার মধ্য দিয়েই ধ্বংসকামী দুষ্টচক্র জন্ম নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। এরা এভাবে বলে থাকে পাঞ্জাবীরা বড় অহঙ্কারী আবার অবাঙ্গালি বা পাঞ্জাবীরা বলে থাকবে বাঙ্গালিরা এমন, এমন। এরা আমাদের পছন্দ করে না, তারা আমাদেরকে এদেশ থেকে বের করে দিতে চায়। এরকমের পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই দুশমনদের কৌশল এবং চক্রান্তের বিষাক্ত জাল। এ ধরনের অবিশ্বাস ও সন্দেহ আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেলে সেটা সমাধান করা কারো পক্ষে সম্ভব হবে বলে, আমার মনে হয় না। দেশপ্রেমিক ভাইদের প্রতি আহ্বান জানাই, এসবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না।

ভাষাকে ইস্যু করে, যা কিনা আমি আগেও বললাম, মুসলমানদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা চলছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে আমি সন্তুষ্ট। তিনি বলেছেন, এ বিষয়কে ইস্যু করে কোন নৈরাজ্যবাদী রাজনৈতিক মহল, দুশমনদের অর্থপুষ্ট কোন এজেন্ট যদি প্রদেশের শান্তি শৃঙ্খলা বা উন্নতিকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালায় তবে তা কঠোর হাতে দমনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই প্রদেশের অফিসিয়াল ভাষা যদি বাংলা করতে হয় তবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ এক্তিয়ার নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধিদের রয়েছে। এবং তারাই তা নির্ধারণ করবেন। আমি বিশ্বাস করি, এই সমস্যার সমাধান অবশাই এই প্রদেশের অধিবাসীদের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যথা সময়ে নিস্পত্তি ঘটবে। আমি পরিষ্কার ভাষায় একথা আপনাদের জানিয়ে রাখতে চাই বাংলা ভাষার প্রশ্ন নিয়ে এই প্রদেশীর দৈনন্দিন জীবন-যাপনে, চাকরি-বাকরিতে কোনরূপ হতাশা, উদ্বেগ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ ঘটবে না। আবারও বলছি এ প্রদেশের অধিবাসীরাই তাদের প্রাদেশিক ভাষা যথা সময়ে নির্ধারণ করে নিতে পারবেন। কিন্তু, আমি আপনাদের কাছে এ কথাটি পরিস্কার করে আনিয়ে রাখতে চাই, নিখিল পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হতে হবে। কোন প্রাদেশিক ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হতে পারে না। আর এ ব্যাপারে আপনাদেরকে যারা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে তারা অবশ্যই পাকিস্তানের জানি দুশমন। রাষ্ট্রের যদি একটি রাষ্ট্র ভাষা না করা যায়, তাহলে সে রষ্ট্রটিকে একটি শক্তিশালী ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করা যাবে না। পৃথিবীর ইতিহাস এবং বড় বড় দেশগুলির দিকে আপনাদের তাকাতে বলবো। সেসব দেশসমূহে রাষ্ট্রভাষা কয়টি এবং অধিকাংশের বোধগম্য ভাষাকে কী রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে নির্বাচন করা হয়নি? সুতরাং, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দুই হওয়া দরকার। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার বিষয়টিও এ মুহূর্তের কোন বিষয় নয়। সময়ের প্রয়োজনের সাথে মিলিয়ে, রাষ্ট্র ভাষার বিষয়টির সুরাহা করা হবে।

বক্তৃতায় আমি বারবার যে কথা বলছি, তা হলো, প্রিয় দেশবাসী আপনারা পাকিস্তানের দুশমনদের মিষ্টি কথার ফাঁদে পা দিবেন না। এসব দুশমনরা স্বদেশের এবং স্বজাতির বিরুদ্ধে কাজ করছে। এরা পঞ্চম বাহিনী। আমি দুঃখিত এবং ব্যথিত যে, এদের পরিচয়ে রয়েছে মুসলিম নাম। আমার এসব ভাইয়েরা সর্বনাশা ভূলের পথে পা বাড়িয়েছে।

আমরা কোন দেশদ্রোহমূলক তৎপরতাকে বরদাশত করবে না। আমরা পাকিস্তানের দুশমনদের সহ্য করবো না। আমাদের দেশে কোন বিশ্বাসঘাতকদের দেখতে চাই না। এসব পঞ্চম বাহিনীর সদস্যরা তাদের অপতৎপরতা এখনই বন্ধ না করলে আমার বিশ্বাস প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার এসব নাশকতামূলক কাজ বন্ধ করতে কঠিন পথ বেছে নিবে। এরা জাতির জন্য বিষ।

আমি ভিন্নমত পোষণ করার অধিকারের বিষয়টি বুঝি এবং মানি। এদিক ওদিকে কেউ কেউ বলছেন, আমাদেরকে কেনো একটি মাত্র পার্টিতে থাকতে হবে? অন্যটিতে নয় কেনো? এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য হলো এবং আশা করছি আপনারাও একমত হবেন যে, আমাদের অক্লান্ত মেহনত এবং সংগ্রামের ফসল হিসাবে, সবেমাত্র ৭ মাস হলো আমরা পাকিস্তানকে হাসিল করেছি। আর মুসলিম লীগের মাধ্যমেই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। এদেশের অনেক মুসলমানের কথা বলবো, তারা আমাদের আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহীতো নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছেন বা উদাসীন ছিলেন। কেউ কেউ ভীত ছিলেন যে, পাকিস্তান হয়ে গেলে, তারা সে সময়ে যে সুযোগ-সুবিধা বা কায়েমী স্বার্থ ভোগ করছিলেন, সেগুলিকে হারিয়ে ফেলবেন। এদের অনেকে আমাদের শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। আল্লাহর অসীম মেহেরবানীতে সকল ষড়যন্ত্র, ক্রোধ এবং বিরোধিতার বিরুদ্ধে প্রাণপন সংগ্রাম করে আমরা পাকিস্তানকে অর্জন করে এনেছি। সারা দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে আমাদের এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করেছে। এজন্য মুসলিম লীগ আমাদের কাছে একটি পবিত্র আমানত। দেশবাসীর কল্যাণের লক্ষ্যে এবং দেশকে রক্ষা করার অতন্ত্রপ্রহরী হিসেবে আমাদের এই বিশ্বস্ত দলটিকে সুসংগঠিত করা দরকার নয় কী? নাকি হঠাৎ গজিয়ে উঠা দলসমূহ, যাদের নেতৃত্বে রয়েছে এমন সব লোকজন যাদের অতীত নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। তাদের হাতে পাকিস্তানের নেতৃত্ব তুলে দিলে তারা বহু ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দেশটির বিনাশ ঘটাবে না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?

সমবেত জনতা আমি আপনাদের প্রশ্ন করতে চাই আপনারা কি পাকিস্তান টিকে থাকুক তা চান কিনা? (জনতা উত্তর দিল চাই) আপনারা পাকিস্তান অর্জন করেছেন তার জন্য কি বেজার না খুশী। (জনতার উত্তর খুশী খুশী) আপনারা পাকিস্তানের অংশ স্বাধীন পূর্ব বাংলা ইন্ডিয়ার সাথে মিশে যাবে তা কি চান? (জনতার উত্তর না না)। আমি আশ্বস্ত হলাম। আমি খুশী হলাম। আপনারা তাহলে পাকিস্তানকে গড়ে তোলার জিহাদে নেমে পড়ুন। পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে সমৃদ্ধ করে তুলতে এ সময়ের দাবি হলো আপনারা মুসলিম লীগে শরীক হোন এবং দেশের খেদমতে নেমে পড়ুন। নতুন গড়ে ওঠা দলগুলির নেতাদের অতীতকে জানুন। এই মুহূর্তে আমাদের বিভক্ত হওয়া উচিত হবে না। আমি এসব দল সমূহের বিরুদ্ধে কোন মনোভাব পোষণ করি না বা হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্য আপনাদের আরো যদি দুঃখ, কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয় এমনকি জীবন কুরবানী দিতে হয় এসবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমার এ দাবীটি জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করতে চাই। একটা জাতির কল্যাণের জন্য একটা দেশকে গড়ে তোলার পেছনে আপনাদের মেহনত বৃথা যাবে না। এই পথ বেয়েই আমরা পৃথিবীতে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং সম্মানিত জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে পারবো। শুধু জনসংখ্যার হিসেবে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম দেশ হয়ে থাকতে চাই না, শক্তি সমৃদ্ধির সাথেই আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এবং জাতিগুলি থেকে শ্রদ্ধা সম্মান অর্জন করে নিতে চাই। এ কথাগুলি বলেই আমি মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি এবং আমাদের তৌফিক দানের জন্য মুনাজাত করছি।

২১ শে মার্চের ভাষনে কায়েদে আযমের মন্তব্য ছাত্র সমাজকে মর্মাহত করিল এবং যত ক্ষীণ কষ্টে হউক, ইহার প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটিল ২৪শে মার্চ কায়েদে আযমের সম্মানার্থে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে।

১৯৪৮ সালের ২৪শে মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ‘র ভাষণঃ

STUDENT’S ROLE IN NATION-BUILDING

Mr. Chancellor, Ladies and Gentlemen,

When I was approached by your Vice-Chancellor with a request to deliver the convocation Address, I made it clear to him that there were so many calls on me that I could not possibly prepare formal convocation address on an academic level with regard to the great subjects with which this University deals, such as Arts, History, Philosophy, Science, Law and so on. I did, however, promise to say a few words to the students on this occasion. And it is in fulfillment of that promise that I will address you now.

First of all, let me thank the Vice-Chancellor for the flattering terms in which he referred to me. Mr. Vice-Chancellor, whatever I am, and whatever I have been able to do, I have done it merely as a measure of duty which is incumbent upon every Mussalman to serve his people honestly and selflessly.

In addressing you I am not here speaking to you as Head of the state, but as a friend and as one who has always held you in affection. Many of you have today got your diplomas and degrees and I congratulate you.Just as you have won the laurels in your University and qualified yourselves, so I wish you all success in the wider and larger world that you will enter. Many of you have come to the end of your scholastic cancer and stand at the threshold of life. Unlike your predecessors, you fortunately leave this University to enter life under a sovereign, independent state of your own. It is necessary that you and your other fellow students fully understand the implications of the revolutionary change that took place on the birth of Pakistan. We have broken the shackles of slavery, we are now a free people. Our state is our own state.Our Government is our own Government of the people, responsible to the people of the state and working for the good of the state. Freedom, however, does not mean licence. It does not mean that you can now behave just as you please and do what you like, irrespective of the interests of other people or of the state. A great responsibility rests on you and, on the contrary, now more than ever, it is necessary for us to work as a united disciplined nation. What is now required of us all is constructive spirit and not the militant spirit of the days when we were fighting for our freedom. It is far more difficult to construct than to have a militant spirit for the attainment of freedom. It is easier to go to jail or fight for freedom than to run a Government. Let me tell you something of the difficulties that we have overcome and of the dangers that still lie ahead. Thwarted in their desire to prevent the establishment of Pakistan, our enemies turned their attention to finding ways and means to weaken and destroy us. Thus hardly had the new state come into being when came the Punjab and Delhi holocaust. Thousands of men, women and children were mercilessly butchered and millions were uprooted from their homes.Over fifty lakhs of these arrived in the Punjab within a matter of weeks.The care and rehabilitation of these unfortunate refugees, stricken in body and in soul, presented problems which might well have destroyed many a well-established state. But those of our enemies who had hoped to kill Pakistan at its very inception by these men were disappointed.Not only has Pakistan survived the shock of that upheaval, but it has emerged stronger, more chastened and better equipped than ever.

There followed in rapid succession other difficulties, such as withholding by India of our cash balances, of our share of military equipment and lately, the institution of an almost complete economic blockade of your province. I have no doubt that all right-thinking men in the Indian Dominion deplore these happenings and I am sure the attitude of the mind that has been responsible for them will change, but it is essential that you should take note of these developments. They stress the importance of continued vigilance on our part. Of late, the attack on your province, particularly, has taken a subtler form. Our Enemies, among whom I regret to say, there are still some Muslims, have set about actively encouraging provincialism in the hope of weakening Pakistan and thereby facilitating the reabsorption of this province into the Indian Dominion.Those who are playing this game are living in a Fool’s paradise, but this does not prevent them from trying A flood of false propaganda is being daily put forth with the object of undermining the solidarity of the Mussalmans of this state and inciting the people to commit acts of lawlessness. The recent language controversy, in which I am sorry to make note, some of you allowed yourselves to get involved even after your Prime Minister had clarified the poison is only one of the many subtle ways whereby the position of provincialism is being sedulously injected into this province. Does it not strike you rather odd that certain sections of the Indian press to whom the very name of Pakistan is anathema, should in the matter of language controversy set themselves up as the champion of what they call your “Just rights”? It is not significant that the very persons who in the past have betrayed the Mussalmans or fought against Pakistan, which is after all merely the embodiment of your fundamental right of self-determination, should now suddenly pose as the saviours of your just rights and incite you to defy the Government on the question of language? I must warn you to beware of these fifth columnists. Let me restate my views on the question of a state language for Pakistan. For official use in this province, the people of the province can choose any language they wish. This question will be decided solely in accordance with the wishes of the people of this province alone, as freely expressed through their accredited representatives at the appropriate time and after full and dispassionate consideration. There can, however, be only one lingua faranca, that is, the language for inter communication between the various provinces of the state, and that language should be Urdu and can not be any other.The state language, therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million of Muslims of this sub continent, a language understood through out the length and breadth of pakistan and above all, a language which, more than any other provincial language embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries. It is not without significance that Urdu has been driven out of the Indian Union and that even the official use of the Urdu script has been disallowed. These facts are fully known to the people who are trying to exploit the language controversy in order to stir up trouble. There was no justification for agitation but it did not suit their purpose to admit this. Their sole object in exploiting this controversy is to create split among the Muslims of this state, as indeed they have made no secret of their efforts to incite hatred against non-Bengali Mussalmans. Realising however, that the statement that your Prime Minister made on the language controversy on return from Karachi, left no room for agitation, in so far as it conceded the right of the people of this province to choose Bengali as their official language if they so wished. These persons changed their tactics. They started demanding that Bengali should be the state language of the Pakistan Centre and since they could not overlook the obvious claims of Urdu as the official language of Muslim State, they proceeded to demand that both Bengali and Urdu, should be the State languages of Pakistan. Make no mistake about it. There can be only one State language if the component parts of this State are to march forward in unison and that language, in my opinion, can only be Urdu I have spoken at some length on this subject so as to wam you of the kind of tactics adopted by the enemies of Pakistan and certain opportunist politicians to try to disrupt this state or to discredit the Government. Those of you who are about to enter life, be on your guard against these people. Those of you who have still to continue your studies for some time, do not allow yourselves to be exploited by any political party or self-seeking politician. As I said the other day, your main occupation should be in fairness to yourselves, in fairness to your parents and indeed in fairness to the State, to devote your attention solely to your studies. It is only thus that you can equip yourselves for the battle of life that lies ahead of you. Only thus will you be an asset and a source of strength and of pride to your state. Only thus.can you assist it in solving the great social and economic problems that

confront it and enable it to reach its destined goal among the most progressive and strongest nations of the world.

My young friends. I would, therefore, like to tell you a few points about which you should be vigilant and beware. Firstly, beware of the fifth columnists among ourselves. Secondly, guard against and weed out selfish people who only wish to exploit you so that they may swim.Thirdly, learn to judge who are really true and really honest and unselfish servants of the States who wish to serve the people with heart and soul and support them. Fourthly, Consolidate the Muslim League Party which will serve and build up a really and truly great and glorious Pakistan. Fifthly, the Muslim League has won and established Pakistan and it is the muslim League whose duty is now, as custodian of the sacred trust, to construct Pakistan. Sixthly, there may be many who did not lift their little fingers to help us in our struggle, many even opposed us and put every obstacle in our great struggle openly and not a few worked in our enemy’s camp against us, who may now come forward and put their own attractive slogans catch-words, ideals and programmes before you.But they have yet to prove their bonafides or that there has really been an honest change of heart in them, by supporting and joining the League and working and pressing their views within the League Party organisation and not by starting mushroom parties, at this juncture of very great and grave emergency when you know that we are facing external dangers and are called upon to deal with internal complex problems of a far-reaching character affecting the future of seventy millions of people. All these demands complete solidarity, unity and discipline I assure you. “Divided you fall. United you stand.”

There is another matter that I would like to refer to. My young friends, hitherto, you have been following the rut. You get your degrees and when you are thrown out of this University in thousands, all that you think and hanker for is Government service. As your Vice-Chancellor has rightly stated the main object of the old system of education and the system of Government existing, hitherto, was really to have well-trained, well-equipped clerks. Of course, some of them went higher and found their level, but the whole idea was to get well qualified clerks, Civil Service was mainly staffed by the Britons and the Indian element was

 introduced later on and it went up progressively. Well, the whole principle was to create a mentality, a psychology, a state of mind, that an average man, when he passed his B.A. or M.A. was to look for some job in Government. If he had it he thought he had reached his height. I know and you all know what has been really the result of this. Our experience has shown that an M. A earns less than a taxi driver, and most of the 50 called Government servants are living in a more miserable manner than many menial servants who are employed by well-to do people. Now I want to get out of that rut and that mentality and specially now that we are in free Pakistan. Government cannot absorb thousands, Impossible.But in the competition to get Government service most of you get demoralised. Government can take only a certain number and the rest cannot settle down to anything else and being disgruntled are always ready to be exploited by persons who have their own axes to grind. Now I want that you must divert your mind, your attention, your aims and ambition to other channels and other avenues and fields that are open to you and will increasingly become so. There is no shame in doing manual work and labour. There is an immense scope in technical education for we want technically qualified people very badly. You can leam banking, commerce, trade, law etc., which provide so many opportunities now.Already you find that new industries are being started, new banks, new insurances companies, new commercial firms are opening and they will grow as you of them go on. Now there are avenues and fields open to you. Think and divert your attention to them, and believe me, you will thereby benefit yourselves more than by merely going in for Government Service and remaining there, in what should say, a circle of clerkship, working there from morning till evening, in most dingy and uncomfortable conditions. You will be far more happy and far more prosperous with far more opportunities to rise if you take to commerce and industry and will thus be helping not only yourselves but also your state. I can give you one instance, I know a young man who was in Government service.Four years ago he went into a banking corporation on two hundred rupees.because he had studied the subject of banking and today he is Manager in one of their firms and drawing fifteen hundred rupees a month in just

 four years. There are the opportunities to have and I do impress upon you now to think in these terms.

Finally, I thank you again Mr. Chancellor and particularly you Mr.Vice Chancellor for the warm welcome you have given me and the very flattering personal references made by you. I hope, may I am confident that the East Bengal youth will not fail us.

কায়েদ আযমের ভাষণে “Urdu & Urdu shall be the state Language” এই মন্তব্যের সাথে সাথে সমাবর্তন উৎসবে উপস্থিত ছাত্রদের একাংশ No No অর্থাৎ “না না’ বলিয়া প্রতিবাদ জানালো। ২০শে মার্চ কায়েদে আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদ সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল ছাত্র সংসদ সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদিগকে সাক্ষাৎ দান করেন।

২২শে মার্চ কায়েদে আযম নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দলের সহিত সাক্ষাৎ দান করেন। অতঃপর ২৩শে মার্চ নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ (উত্তরকালে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) প্রতিনিধি শাহ আজিজুর রহমান ও মাজহারুল হক কুদ্দুস এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ ও মোঃ তোয়াহা এক যুক্ত বৈঠকে কায়েদে আযমের সহিত মিলিত হন। উভয়পক্ষের বক্তব্য শ্রবণের পর ২৪শে মার্চ কায়েদে আযম পুনরায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিনিধি শাহ আজিজুর রহমান ও মাজহারুল হক কুদ্দুস এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সাংগঠনিক কমিটির সদস্য আবদুর রহমান চৌধুরী ও মোহাম্মদ তোয়াহার সহিত এক বৈঠকে মিলিত হইলেন। ধৈর্য সহকারে আদ্যোপান্ত শুনিয়া তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগকে মৃত ঘোষণা করিয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে যোগ দিতে নির্দেশ দিলেন। ছাত্রনেতৃবৃন্দ লিখিতভাবে এক অঙ্গীকার পত্রে সহি করিলেন যে, তাহারা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে একযোগে কাজ করিবেন। কায়েদে আযম নব গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে আশীর্বাদ জানাইয়া একটি বাণী দিলেন; কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সাপেক্ষে উহা প্রকাশ করতে নিষেধ করিলেন। ইতিমধ্যে অদৃশ্য হস্তের কারসাজিতে কায়েদে আযম স্বীয় মত পাল্টাইলেন এবং ২৭শে মার্চ তিনি শাহ আজিজুর রহমান ও মাজহারুল হক কুদ্দুসের সহিত পৃথকভাবে আলোচনার পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিনিধিদ্বয় আবদুর রহমান চৌধুরী ও মোঃ তোয়াহার সহিত সাক্ষাতের প্রয়োজনই আর বোধ করিলেন না। কায়েদে আযমের আচরণে মর্মাহত হইয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া আবদুর রহমান চৌধুরী সংবাদপত্রে বিবৃতি মারফত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উপর কায়েদে আযমের আশীর্বাদ বাণী সাধারণ ছাত্রদের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করিতে বাধ্য হইলেন।

কায়েদে আযমের আমন্ত্রণে ২৪শে মার্চ অপরাহ্নে সর্বজনাব শামসুল হক, মইনুদ্দিন আহমদ, কামরুদ্দিন আহমদ, আজিজ আহমেদ, শামসুল আলম, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক আবুল কাসেম, মোঃ তোয়াহা এবং আমি রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হইতে তাহার সহিত পূর্ব বঙ্গ সরকারের চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের বাসভবনে (পরবর্তীকালে মিন্টু রোডস্থ গণভবন) এক বৈঠকে মিলিত হই। পরস্পর শুতেচ্ছা বিনিময়ের পর কায়েদে আজমের সহিত আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার প্রারম্ভেই কায়েদে আযম মন্তব্য করেন যে, একাধিক রাষ্ট্র ভাষা রাষ্ট্রীয় সংহতির পক্ষে ক্ষতিকর। ইহার জবাবে কামরুদ্দিন আহমদ বলেন যে, সুইজারল্যান্ড ও কানাডায় একাধিক রাষ্ট্র ভাষা জাতীয় সঙ্গহতি বৃদ্ধি করিয়াছে। কায়েদে আযম তদুত্তরে অসহিষ্ণু স্বরে বলেন যে, তাহাকে ইতিহাস শিখাইতে হইবে না, তিনি ইতিহাস জানেন। অবচেতনভাবে আমি প্রতিউত্তরে কলিয়া ফেলিলাম সে, ইতিহাস নিশ্চয়ই আপনি জানেন, তবে রাষ্ট্র ভাষার বিষয়ে ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করিতেছেন। অতঃপর কায়েদে আযম ধীরস্থির শাস্তকণ্ঠে পাকিস্তান সংগ্রামের ইতিবৃত্ত চিম্বক ভাষায় বিবৃত করিয়া আবেগের মুহূর্তে আমাদের ইংরেজিতে বলিলেন, In the interest of the integrity of Pakistan, if necessary, you will have to change your mother tongue” অর্থাৎ “পাকিস্তানের সংহতির খাতিরে প্রয়োজনবোধে তোমাদিগকে মাতৃভাষা পরিবর্তন করিতে হবে।” কায়েদে আযমের উক্ত বিস্ময়কর মন্তব্য সকলকেই বিষ্মিত, বিমূঢ় ও হতবাক করিয়া ফেলিল। এই কি যুক্তিবাদী কায়েদে আযম কথা বলিতেছেন, না আর কেহ? বেসামাল অবস্থা কিছুটা সামলাইয়া লইরা পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করিবার মধ্যেই আমি অতিষ্ঠভাবে বলিয়া উঠিলাম, “Sir, Britain, U.S.A., Canada, Australia & New Zealand speak the same language, preach the same religion, come of the same stock, could they form one state? Despite the same religion Islam, same language Arabic, same semitic blood, one same land Arab, why are there so many states on Arab land?”

অর্থাৎ “স্যার, বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড একই ভাষা, একই ধর্ম, একই বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও তাহারা একই রাষ্ট্র গঠন করিতে সক্ষম হইয়াছে কি? একই ধর্ম ইসলাম, একই ভাষা আরবী, একই সেমেটিক রক্ত ও একই আরব ভূমি সত্ত্বেও আরব জগতে এতগুলি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কেন?” বেশ বুঝিতেছিলাম যে, কায়েনে আযম আমার উত্তর হজম করিতে বেগ পাইতেছেন, কিন্তু জবাবে তার বলিবার কিছু ছিল না। এমন সময় জনাব শামসুল হক মাগরিবের নামাজের সময় হইয়াছে স্মরণ করাইয়া দিয়া মাগরিবের নামাজ আদায়ের অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। কায়েদে আযম নামাজ আদায়ের অনুমতি দেওয়া সত্ত্বেও শামসুল হক সাহেব নামাজের জনা সভাকক্ষ তাগ করেন নাই বরং আলোচনায় অংশগ্রহণে ব্যাপৃত রহিলেন। অতঃপর তিনি আবার নামাজের অনুমতি প্রার্থনা করিলেন, কায়েদে আযম বিরক্তির সহিত বলিলেন, “Why don’t you go out & say prayer’ অর্থাৎ “বাহিরে যাইয়া নামাজ আদায় কর না কেন?” কায়েদে আযম নামাজের সময় নামাজের বিরতি না দিয়া আলোচনা করিতেছেন বিধায় জনাব শামসুল হক ইচ্ছাকৃতভাবেই সবার নিকট কায়েদে আজমকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করইতেছেন, ইহাই বোধহয় কায়েদে আযমের ধারণা জন্মেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা জমিতেছিল না এবং মোটামুটি একটি তিক্ত আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। কায়েদে আযমের অনা সাক্ষাৎকারের কর্মসূচী মিলিটারী সেক্রেটারি স্মরণ করাইয়া দিলে প্রস্থানকালে বিদায় সম্ভাষণের সময় লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখ মাত্র তিনি জনাব শামসুল হকের পানে অংগুলী নির্দেশ করিয়া রাগতস্বরে বলিলেন, “I know you” অর্থাৎ “তোমাকে চিনি”। ইহা বলার অর্থ বোধহয় এই যে, জনাব আবুল হাশিমের সহিত জনাব শামসুল হক “লাহোর প্রস্তাব” সংশোধন করিয়া দিল্লী প্রস্তাব গ্রহণের তীব্র বিরোধিতা করিয়াছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে কায়েদে আযমের অতীত স্মৃতি তাহাকে ক্ষিপ্ত করিয়া তুলিয়াছিল। রাগত মুখে হঠাৎ আমার পানে তাকাইয়া আমাকে তর্জনী নির্দেশে মন্তব্য করিলেন, “I know you also” অর্থাৎ “তোমাকেও আমি চিনি”। রসনা সংযত করিতে ব্যর্থ হইয়া আমিও তদুত্তরে বলিয়া ফেলিলাম, I also know you are the Governor General whom the Queen of England can remove on our appeal.” অর্থাৎ “আমিও জানি যে, আপনি সেই গভর্নর জেনারেল, যাহাকে ইংল্যান্ডের রাণী আমাদের আবেদনক্রমে পদচ্যুত করিতে পারেন”।

বিদায় গ্রহণকালে রাষ্ট্র ভাষা কমিটির তরফ হইতে ইংরেজি ভাষায় নিম্নোক্ত স্মারকলিপিটি কায়েদে আযমের নিকট হস্তান্তর করা হয়ঃ যাহা বাংলায় নিম্নরূপ:

সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সংগঠনের মুসলমান যুবকদের দ্বারা গঠিত। সংগ্রাম পরিষদের মত-বঙ্গ ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করা হোক।

কারণ, প্রথমতঃ উহা পাকিস্তানের লোক সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের ভাষা ও পাকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র বিধায় সংখ্যাগুরু অধিবাসীর দাবি গ্রহণ করা বিধেয়।

দ্বিতীয়তঃ আধুনিককালে কোন কোন রাষ্ট্র একাধিক রাষ্ট্র ভাষা গ্রহণ করিয়াছে। উদাহরণ স্বরূপ নিম্নোক্ত কয়টি দেশের নাম উল্লেখ করা যায়, বেলজিয়াম (প্লমিং ও ফরাসী ভাষা), কানাডা (ইংরেজি ও ফরাসী ভাষা), সুইজারল্যান্ড (ফরাসী, জার্মান ও ইতালীয় ভাষা), সাউথ আফ্রিকা (ইংরেজি ও আফ্রিকার ভাষা), মিসর (ফরাসী ও আরবী ভাষা), থাইল্যান্ড (থাই ও ইংরেজি ভাষা); ইহা ছাড়াও সোভিয়েট রাশিয়ায় ১৭টি রাষ্ট্র ভাষা চালু রহিয়াছে।

তৃতীয়তঃ সম্পদের দিক হইতে বাংলা ভাষা পৃথিবীতে সপ্তম ভাষারূপে স্বীকৃত বিধায় এই রাষ্ট্রে একমাত্র বাংলা ভাষা অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার তুলনায় রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার উপযুক্ত।

চতুর্থতঃ আলাওল, নজরুল ইসলাম, কায়কোবাদ, সৈয়দ ইমাদাদ আলী, ওয়াজেদ আলী ও আরো অনেক মুসলিম কবি ও সাহিত্যিক তাহাদের রচনা সম্ভারে বাংলা ভাষাকে সম্পদশালী করিয়াছেন।

পঞ্চমত: বাংলার সুলতান হোসেন শাহ সংস্কৃত ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও উক্ত ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করিয়াছিলেন। এই ভাষার শব্দ সম্ভারের শতকরা ৫০ ভাগ আরবী ও ফরাসী ভাষা হইতে উদ্ভূত।

পরিশেষে আমরা পেশ করিতে চাই যে, যে কোন পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক নাগরিকের কতকগুলি মৌলিক অধিকার আছে। সুতরাং আমাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া অবধি বঙ্গ ভাষার আন্দোলন চলিতে থাকিবে।

উল্লেখযোগ্য যে, কায়েদে আযমের সহিত ইহা আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনী সফরে আসাম যাইবার পথে আখাউড়া রেলওয়ে জংশনে সুদীর্ঘ কয়েক ঘন্টাকাল কায়েদে আযমের সাহচর্য ভোগ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কলিকাতা হইতে ট্রেনযোগে আসিবার সময় পথিমধ্যে লক্ষ লক্ষ জনতার সংবর্ধনার কারণে আখাউড়া জংশনে পৌঁছিবার পূর্বেই আসামগামী মেইল ট্রেন আখাউড়া ত্যাগ করে। তাই কায়েদে আযমের সেলুনকে আখাউড়ায় পরবর্তী ট্রেনের অপেক্ষায় কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করিতে হইয়াছিল। কায়েদে আযমের সফরসূচী পূর্বাহ্নে জ্ঞাত ছিলাম। আমরা ত্রিপুরা জেলা ইলেকশন বোর্ডের তরফ হইতে তাহাকে সম্বর্ধনা দিতে আখাউড়া গিয়াছিলাম। লক্ষ লোকের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনায় আমার বিশেষ কিছু করার ছিল না। মাঝে মাঝে মাইকে ভাসিয়া উঠিতেছিল বিভিন্ন ধ্বনি “পাকিস্তান-জিন্দাবাদ” “কায়েদে আযম-জিন্দাবাদ” “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ইত্যাদি ও শৃঙ্খলা রক্ষার আবেদন। কায়েদে আযম সংক্ষিপ্ত ভাষণে ঐক্য, ঈমান, শৃঙ্খলার পরিচয় দিতে ও আগামী নির্বাচনে মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থীকে হারিকেন লণ্ঠনে ভোট দিয়া পাকিস্তানের পক্ষে রায় দিতে উদাত্ত আহ্বান জানাইলেন। দুই এক ঘন্টার মধ্যে জনতার ভিড় হালকা হইয়া উঠিলে কায়েদে আযম অংগুলী ইশারায় আমাকে তাহার নিকট ডাকিলেন। ইহার কারণ বোধ হয় আমার পরিধানে মুসলিম লীগ ব্যাজ ছিল। ভয়, থিধা সংকোচে জড়সড় হইয়া তাহার জানালার নিকট উপস্থিত হইলে আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। পরিচয় শুনিবার পর স্নেহের সুরে বলিলেন, “Young boy, remember character first, after election rejoin the classes” অর্থাৎ “তরুণ বালক, স্মরণ রাখিও চরিত্রই প্রথম। নির্বাচনের পর পড়াগুনায় পুনঃমনোনিবেশ করিও।”

কায়েদে আযমের নির্দেশ ও উপদেশ আজও আমার মধ্যে অনুপ্রেরণার সঞ্চার করে। যাহা হউক, কায়েদে আযমের সহিত দ্বিতীয় বৈঠকের কথা বলিতেছিলাম। কায়েদে আযমের অদ্যকার ভূমিকা আমার সামগ্রিক সত্ত্বার উপর এক প্রচণ্ড আঘাত হানিয়াছে, আমি হতভম্ব ও দিশেহারা। মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠাকল্পে তর্ক-বিতর্ক স্থলে ও দায়িত্বের খাতিরে কায়েদে আযমের প্রতি কঠিন মন্তব্য করিতে বাধ্য হইলেও তাহার নেতৃত্ব ও অবদানের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। গণতান্ত্রিক জীবনে বিভিন্ন প্রশ্নে মতভেদ অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরিতাপের বিষয়, বঙ্গ ভাষা ও বাঙালি চরিত্র সম্বন্ধে কেহ তাহাকে সঠিক ধারণা দেয় নাই বরং ভুল তথ্য তাহাকে বোধহয় পরিবেশন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বঙ্গ সাহিত্য লেখক শ্ৰী দীনেশ চন্দ্র সেন অকপট মনেই লিখিয়াছেন, “মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই বঙ্গ সাহিত্য শ্রীবৃদ্ধির কারণ।” আরাকান বৌদ্ধ রাজসভা ও ত্রিপুরা মহারাজ সভায় মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণ বঙ্গ ভাষাতেই কবিতা ও সাহিত্য রচনা করিতেন। ষষ্ঠ হইতে দশম শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে সংস্কৃত ভাষার হামলার বিরুদ্ধে বৌদ্ধ সম্প্রদায় স্থানীয় বঙ্গ ভাষায় চর্যাপদ রচনা করেন। ইহার পর মুসলমান নৃপতিদের বাংলা আগমন এবং তাহাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধিত হয়। মিথ্যা জাল বোনার হীন স্বার্থেই এই নিরেট ঐতিহাসিক সত্যকে চাপা দেওয়া হয় এবং এতদ্বারা রাষ্ট্রীয় ঐক্যে বিরাট ফাটল সৃষ্টি হয়।

কায়েদে আযমের ব্যক্তিত্বের পিছনে একচেটিয়া গণসমর্থন ছিল। তাই তাহার পূর্ব বঙ্গ সফরের পর ভাষা আন্দোলনে ভাটা দেখা দেয়। কায়েদে আযমের নির্দেশে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কার্যতঃ ত্রিনেতা, মোহাম্মদ আলী চৌধুরীকে (প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী) ব্ৰহ্মদেশে রাষ্ট্রদূত করা হইল এবং তোফাজ্জল আলী (প্রাক্তন ডেপুটি স্পীকার, বঙ্গীয় আইন পরিষদ) ও ডাঃ আবদুল মোতালেব মালিক (শ্রমিক নেতা) নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করিলেন। ফলে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সোহরাওয়ার্দী সমর্থক সদস্যদের কেন্দ্র করিয়া কালের গতিতে ঘটনার বিবর্তনে পরিষদ অভ্যন্তরে যে অর্থপূর্ণ বিরোধী দল গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাহা বিনষ্ট হইল। এমন কি, তৎসঙ্গে আইন পরিষদের বাহিরে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও ১৫০ নং মোগলটুলী কর্মী শিবিরের প্রভাবে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক মত সংগঠিত হওয়ার যে সুযোগ দেখা গিয়াছিল, তাহাও আপাততঃ তিরোহিত হইল। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর জনাব লবিবউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকীর বেগম বাজারস্থ বলিয়াদি হাউসে ও ২২শে ডিসেম্বর জনাব তোফাজ্জল আলীর জয়নাগ রোডস্থ বাস ভবনে অনুষ্ঠিত সোহরাওয়ার্দী সমর্থক পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদ সদস্যদের সভায় তরুণ নেতা শামসুল হক, শওকত আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, কামরুদ্দিন আহমদ ও আমি সহ অন্যান্য কর্মীরা অংশগ্রহণ করি। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডাঃ আবদুল মুত্তালিব মালিক ও সিরাজুল ইসলামকে কলিকাতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া ঢাকার কর্মীদের মনোভাব তাহার গোচরীভূত করিয়া তাহাকে ঢাকা আসিবার আবেদন জানাইবার জন্য অনুরোধ করা হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকা আসিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিলে মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডাঃ মালিক পরিচালিত গ্রুপের একটি অংশ হতোদ্যম হইয়া পড়ে। পরে তাদের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের সুযোগে কায়েদে আযমের আদেশে রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী পদ গ্রহণ করিয়া সরকার বিরোধী রাজনৈতিক ভূমিকা ত্যাগ করেন। ইহাতে পার্লামেন্টারি রাজনীতি অশেষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

নাজিম উদ্দিনের নূতন রূপ

এই মাহেন্দ্রক্ষণে উজীরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ স্বাক্ষরিত ৮ দফা চুক্তির ৩ ধারা শর্ত অবলীলাক্রমে হজম করিয়া ৬ই এপ্রিল পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদে বাংলাকে পূর্ব বঙ্গের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং ৮ই এপ্রিল নিম্নোক্ত প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয়:

(ক) পূর্ব বঙ্গ প্রদেশে ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা রূপে গ্রহণ করা হইবে এবং যতশীঘ্র সম্ভব বাস্তব অসুবিধাগুলি অপসারণ করা যায় ততশীঘ্র তাহা কার্যকর করা হইবে।

(খ) পূর্ব বঙ্গের শিক্ষায়তন সমূহের শিক্ষার মাধ্যম যথাসন্তব বঙ্গ ভাষা হইবে, কেননা ইহা অধিকাংশ বিদ্যার্থীর মাতৃভাষা।

ভাষা আন্দোলনের ভাটা

আমরা গ্রেফতার হওয়ার পর সংগ্রাম পরিষদে নানা কারণে অনৈক্য দেখা দেয়। কর্মপরিষদের আহ্বায়ক শামসুল আলমের পদত্যাগের পর জনাব আজিজ আহমেদ কিছুকাল আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ক্রমশঃ আন্দোলন তীব্রতা হারাইয়া ফেলে এবং ইহার ফলে সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্ব হাস পায়। এইদিকে ১৫০ নং মোগলটুলীস্থ ঢাকা কর্মী শিবিরের কতিপয় সদস্যের উপস্থিতিতে আয়োজিত এক সভায় জনাব আবদুল মান্নানের উপর আহ্বায়কের দায়িত্ব চাপাইয়া দেওয়া হয়। আর এইভাবেই সংগ্রাম পরিষদ স্বাভাবিক মুত্যবরণ করার প্রাক্কালে এক কাগুজে সংস্থায় পরিণত হইয়া পড়ে।

১১ মার্চ রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে তিন শ্রেণির অন্দোলনকারীর সমাবেশ লক্ষ্য করিয়াছিঃ

(ক) অতি বিপ্লবী বাক্যবাগীশ। ইহারা কথায় কথায় সরকার উৎখাত চায়; সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তনের বড় বড় বুলি আওড়ায়; কিন্তু জনতার সঙ্গে পুলিশ মিলিটারির জুলুম ভোগ করিতে নারাজ। কারাবরণে ইহাদের অনীহা, আন্দোলনে বাস্তব ও সক্রিয় অংশগ্রহণে তাহারা বিমুখ।

(খ) চতুর সুবিধাবাদী ভীরু ফোঁপর দালাল শ্রেণি। ইহারা মুখে মুখে আন্দোলনের সক্রিয় ও খাঁটি সংগঠকদের সহিত বন্ধুত্ব ও অন্তরঙ্গতা সৃষ্টিতে তৎপর; শুধু তাই নয়, ইহারা এইভাবে ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলে যে, দেখিলে মনে হয় ধরি মাছ না ছুই পানি ইহাদের আদর্শ; আন্দোলনে নেই এই অপবাদ ইহারা নিতে রাজী নয়, আবার সরকারি কর্তৃপক্ষের কোপানলেও পড়িতে নারাজ। ইহারা একনিকে আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠকদের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখে অন্যদিকে আন্দোলনে নিজেদের অশীদারিত্বের প্রামাণিক দলিল ভবিষ্যৎ ইতিহাস লেখকদের নিকট হস্তান্তর করে। দেখিয়াছি সর্বত্রই এই ধরনের ফাঁকিবাজ অতি বুদ্ধিমানদের পোয়াবারো। কারাবরণ করিতে হয় না, সময়-সুযোগ মত তরুণ বয়সেই বিরোধী দলের জনপ্রিয়তার আনুকূল্যে আইন সভার সদস্য হওয়া যায়- কি মজা।

(গ) একনিষ্ঠ, সক্রিয় ও সহকর্মী। সরকার বা কর্তৃপক্ষ বিরোধী আন্দোলনের প্রাথমিক কাজ পোস্টার লেখা হইতে আরম্ভ করিয়া অর্থ যোগান, পুলিশী জুলুম ভোগ, কারাবরণ, প্রতিকূল অবস্থাকে পরোয়া না করিয়া সভা সমিতির আয়োজন অর্থাৎ কোন লোভ-লালসার বশবর্তী না হইয়া আন্দোলনের সফলতার জন্য সর্বক্ষণ নিরলস। এই শ্রেণির আন্দোলনকারীর সংখ্যা অতি নগণ্য বটে, তবে তাহারাই মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথিকৃৎ, তাহারাই সভ্যতার পিলসুজ।

কুচক্রীদের নূতন পায়তারা

সম্মুখ রণে বাংলা ভাষা আন্দোলন বানচাল করিতে ব্যর্থ হইয়া প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ভিন্ন পথ গ্রহণ করিল। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বঙ্গ সন্তান ফজলুর রহমান করাচিতে ১৯৪৮ সালের ২৭শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনে আরবী হরফ প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। শুধু তাই নয়, ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের এক সভায় এই কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী আরবী হরফ প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যাও করিলেন।

১৯৪৯ সালের ১৪, ১৫ এবং ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশনে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড কর্তৃক আরবী হরফ প্রবর্তনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার সন্ভাবনার খবরে বিচলিত ও শঙ্কিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমাজ প্রতিবাদের জন্য কর্মচঞ্চল হইয়া উঠিল। তদুদ্দেশ্যে ৭ই ডিসেম্বর (১৯৪৯) রাত্রে এম, এ, ওয়াদুদ ও মোর তাহা ৪৩/১, যোগীনগরে আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করিবার পর আমি তখন ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিতব্য বি,কম, পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করিতেছিলাম।

যাহা হউক, নেতৃদ্বয়ের অনুরোধে পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম পরিষদ বৈঠকে যোগ দেই। সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আমরা বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সাধারণ সভায় আরবী হরফ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিতে সরকারের নিকট আহ্বান জানাই এবং সরকারকে সতর্ক করিয়া দেই যে, আরবী হরফ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলে ছাত্র সমাজ দেশব্যাপী সক্রিয় আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে বাধ্য হইবে। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হইল। আরবী হরফ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত বাতিল হইয়া গেল।

পরবর্তীকালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ও অর্থানুকূলে আরবী হরফে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের কয়েকটি নিষ্ফল প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। এই কার্যে দেওবন্দের মওলানা হোসেন আহমদ মাদানীর চেলা মওলানা আতাহার আলী প্রমুখ আরবী শিক্ষিত ধর্মান্ধ অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু সাধারণ দেশবাসীর সহজাত বুদ্ধি তাঁহাদের ভ্রান্ত প্রচেষ্টাকে যথাসময়ে ব্যর্থ করিয়া দেয়।

উল্লেখ্য যে, ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মত জ্ঞানতাপস বিশ্ববিখ্যাত ভাষাবিদ আরবীকে রাষ্ট্র ভাষা করিবার দাবি করিয়াছিলেন। তবে, পাকিস্তানের কোন অংশে সমর্থন না থাকায় আরবীকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদ গঠন

ঢাকায় ছাত্র আন্দোলনে আমাদের ভূমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের আশার সঞ্চার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, প্রমোশন, স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব, স্বল্প বেতন ও অবসর গ্রহণ ইত্যাদি সমস্যা অবহিত করার জন্য ১৫ জুন (১৯৪৮) কতিপয় অধ্যাপক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সাংগঠনিক কমিটির সভায় যোগদান করেন। তথায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারীদের বিবিধ সমস্যা আলোচিত হয়। স্থির হয় যে, ৩০শে জুন (১৯৪৮) বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সাধারণ ছাত্রসভা আহ্বান করা হইবে। যখাসময় সেই সভা অনুষ্ঠিত হইয়াছিল এবং এই সভায় বিভিন্ন সমস্যার ভিত্তিতে আন্দোলন করিবার জন্য জনাব আবদুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদ গঠিত হয়।

সরকারি হিংস্রতার একটি নজির

আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকিবার কারণে নিয়মিত ক্লাসে যোগ দিতে না পারায় পড়াশুনা কৱিবার প্রয়োজনীয়তায় আমি রমজানের ছুটিতে বাড়ি না গিয়া হলেই থাকিবার সিদ্ধান্ত নেই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কম. ক্লাসে ভর্তি হইয়াছিলাম। কমার্সের সবকিছুই ছিল আমার নিকট নূতন। তাই ছুটির সময় পড়ার ক্ষতি পূরণ করিবার তাগিদে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সুযোগ গ্রহণ করিবার নিমিত্ত বাড়ি যাই নাই। এমনি একদিন রমজানের বোধহয় ২৭ তারিখ অর্থাৎ ১৪ জুলাই অপরাহ্নে আমার ১৭৭ নং রুমের জানালার নিকট বসিয়া কাজ করিবার সময় দেখিলাম, সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ পার্শস্থ রাজপথ বাহিয়া সেনাবাহিনী ভর্তি গাড়ী লালবাগ অভিমুখে দ্রুত ছুটিয়া যাইতেছে। ইহার প্রায় ৩০ কি ৪৫ মিনিট সময়কালের মধ্যে অনবরত গুলীর আওয়াজ শুনিতে পেলাম। প্রকাশ, ধর্মঘটী পুলিশদের দখল হইতে লালবাগ থানার অস্ত্রাগার মুক্ত করার প্রয়াসে নাকি সেনাবাহিনী সেইদিন গুলী চালাইয়াছিল। লালবাগ থানার অস্ত্রাগারের পার্শে রক্তসিক্ত স্থান ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিবার কালে আমাকে গ্রেফতার করা হয় এবং থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২৪ ঘন্টা আটক রাখা হয়। সেইদিন সেই শুলীতে কতজন ধর্মঘটী পুলিশ কনস্টেবল নিহত হইয়াছেন, কেহ সঠিক সংখ্যা বলিতে পারেন নাই। গুলীর পর পরিস্থিতি আয়ত্তে আসিলে যথেচ্ছ গ্রেফতার ও মামলা রুজু শুরু হয়। ধর্মভীরু বলিয়া কথিত উজীরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিনের কি চমৎকার প্রশাসনিক দাওয়া! আমি দৃঢ় প্রত্যয়ের সহিত বলিতে পারি ধর্মঘটী পুলিশ কনস্টেবল কেহই রষ্ট্রদোহী ছিলেন না; কোন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপও ছিল তাহাদের কল্পনাতীত। কিছু বেতন বৃদ্ধি ও ছোট খাট অবশ্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি ন্যূনতম দাবিই ছিল তাহাদের সেই দিনের ধর্মঘটের উদ্দেশ্য।

এই ন্যূনতম দাবি পূরণ সরকারের পক্ষে অতি সহজ ছিল। কিন্তু কথিত ধর্মভীরু খাজা নাজিমুদ্দিন রমজান মাসে রোজাদার স্বল্প বেতনভোগী পুলিশ কনস্টেবল এর উপর সৈন্য বাহিনী লেলাইয়া দিয়া হত্যা করিতে বুকে এতটুকু কম্পন বোধ করেন নাই। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকাকালে এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করিবার অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কতিপয় পুলিশ কনস্টেবলের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। তাহাদের জবানীতে পূর্ণ কাহিনিটি অবগত হই। বন্দি পুলিশ কনস্টেবলদের নিকট হইতে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনিবার পর আমার মনে হইয়াছে, বহুল প্রচারিত পরহেজগার খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকারের এই নিষ্ঠুরতা নজিরবিহীন।

কায়েদেআযমেরতিরোধান

দেশকে সংবিধান দেওয়ার পূর্বেই রাষ্ট্রের জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দেশবাসীকে শোক সাগরে ভাসাইয়া ১১ই সেপ্টেম্বর (১৯৪৮) পরলোকগমন করিলেন। তাঁহার তিরোধানে জাতির ও গণতন্ত্রের যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হইয়াছে, তাহারই মাশুল উত্তরকালে দিতে হয়েছে পাকিস্তানকে।

কায়েদে আযম ন্যাশনস্টেট ও ডেমোক্রেটিক মাল্টিপার্টি স্টেট বা গণতান্ত্রিক বহুদলীয় রাষ্ট্র গঠনে প্রয়াসী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপদান করিতে চাহিয়াছিলেন। মৃত্যুর মাত্র এক বৎসর আগে সভাপতি হিসাবে ১০ই আগস্ট (১৯৪৭) তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই উদ্বোধনী ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পাকিস্তান জাতির গোড়াপত্তনের উদাত্ত আহ্বান জানান: “you may belong to any religion, or caste or creed: that has nothing to do with the business of the state: Incourse of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims not in the religious sense because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the State”.

অর্থাৎ “আপনি যে কোন ধর্ম, জাতি ও বিশ্বাসভুক্ত হইতে পারেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের সহিত তাহার কোন সম্পর্ক নাই। কালের গতিতে হিন্দু আর হিন্দু থাকিবে না, মুসলমান আর মুসলমান থাকিবে না, ধর্মীয় অর্থে নহে- কারণ, উহা প্রত্যেক ব্যক্তির বিশ্বাস- ইহা হইবে রাষ্ট্রীয় নাগরিক হিসাবে, রাজনৈতিক অর্থে।

একই বক্তৃতায় কায়েদে আযম আরও বলেন, “আজ হইতে আমরা আর হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান জাতি নই, আমরা সকলে এক পাকিস্তানী জাতি”।

বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ১৯৪৭ এর ১০ই আগস্ট ভাষনে বাবু যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের সভাপতিত্বেই পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রারম্ভিক মুসলমানদের নাজুক সাম্প্রদায়িক ধ্যা-ধারণা পরিবর্তনের ব্যাপারে কায়েদে আযমের প্রথম সুকৌশল মনস্তাত্বিক পদক্ষেপ।

উল্লেখ্য যে পাকিস্তান গণ পরিষদের উক্ত উদ্বোধনী অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান হইতে নিম্ন বর্ণিত হিন্দু সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন- সর্বশ্রী কিরন শংকর রায়, শরৎ চ্যাটার্জী, কামিনী কুমার দত্ত, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী, ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত, প্রেম হরি রমন, বিরাট চন্দ্র মন্ডল, ধনঞ্জয় রায়, অক্ষয় কুমার দাস প্রমুখ।

কায়েদে আযম বহু দলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তদুদ্দেশ্যেই ১৯৪৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সভার পর গভর্নর জেনারেলের বাসভবন হইতে ২৫ শে ফেব্রুয়ারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তিনি ঘোষণা করেন, মুসলিম লীগ এতকাল ভারতের সমস্ত মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করিয়াছে। দেশ ভাগের পর মুসলিম লীগ এখন হইতে একটি দল হিসাবে কাজ করিবে; পূর্বের ন্যায় সমগ্র মুসলমান জাতির প্রতিনিধিত্ব করিবে না”।

আমি দৃঢ় মত পোষণ করি যে, কায়েদে আযমের মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় কোন রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ না করিলে সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও শোভন হইত। অগত্যা যখন রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণই করিলেন, তখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তাহারই গ্রহণ করা একান্ত সমীচীন ছিল। তাহা হইলে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শক্তি সঞ্চারিত হইত; ঘোষিত নীতি, আদর্শ ও বাস্তব কর্মকান্ডের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ঘটিত না এবং পাকিস্তানের যাত্রাপথে অশুভ ভবিষ্যতের সূচনা হইত না। রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় জীবনে পূর্বসূরীদের নীতিনিষ্ঠ বাস্তব কর্মকাণ্ডই জাতির অগ্রাভিযান ও অগ্রগতিতে উত্তরসুরীদের প্রেরণার মূলভিত্তি। প্রেরণার অভাব হলে জাতি উদ্দেশ্যবিহীন জাতিতে পরিণত হয়। শুরু হয় জাতীয় জীবনে অবক্ষয় ও অধঃপতন। ইতিহাসের পাতায় পাকিস্তান ইহার এক জুলন্ত দৃষ্টান্ত।

কায়েদে আযমের ইহধাম ত্যাগ অব্যবহিত পরই পূর্ববঙ্গের উজীরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হইলেন।

নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের পূর্ববঙ্গ সফর

প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের ১৯৪৮ সালের ১৮ই নভেম্বর পূর্ববঙ্গ সফরকালে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন দাবি সম্বলিত আন্দোলনে ঢাকা নগর প্রকম্পিত ছিল। ২৭শে নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক গোলাম আজম পঠিত মানপত্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক গোলাম আজম কর্তৃক পঠিত মানপত্রঃ

AN ADDRESS OF WELCOME
TO THE HON’BLE NAWAB LIAQUAT ALI KHAN
PRIME MINISTER OF PAKISTAN.

Sir,

It is with a heart throbbing with joy and emotion that, we, the students of the University of Dhaka, welcome you in our midst as the first Prime Minister of our new free and sovereign State of Pakistan. Even in the midst of these joyful surroundings our thoughts naturally go back to the day when only a few months back we had the honour and privilege of welcoming the beloved Quaid-e-Azam in our midst. Though he is no more with us his message and his work are our most precious heritage which shall continue to guide and inspire us in future. The most fitting homage that we can pay to his memory is to build up our State in accordance with the Islamic ideals of equality, brotherhood and justice.

Sir, with the dawn of independence a great responsibility has devolved on us. We can assure you that, we, who have contributed our mite to the national cause, are quite alive to the fact that the future well being and stability of the state rest on us. Hence the task of building up those who will build up the state should be given the utmost importance. We must revolutionise our outlook and reconstruct our thoughts to shape ourselves in the new order of life. The present system of education, which was introduced by the Britishers to suit their requirements should be thoroughly reorganised in the light of the altered circumstances. The lamentable failure of our Provincial Government to give any lead in the matter till now and the present pitiable plight of primary, secondary and University education in our province have compelled us to draw your kind attention to the matter. The exodus of non-Muslim teachers who formed the bank of the teaching staff in pre-partition period in the secondary and the University stages. coupled with the dearth of efficient substitutes has been a serious blow. The technical branches of education, viz, the Engineering, the Medical and the Agricultural which should be given the utmost care are also badly suffering for want of efficient teachers and technical equipment. Steps should be taken to secure efficient teachers and technical equipment, if necessary, from abroad, and more students from East pakistan should be sent overseas for higher education and training. Female education is another subject which is also not receiving its due attention. More facilities and encouragements should be given to our sisters who are now coming forward in increasing number to avail themselves of every opportunity of education and serving the country. We also urge on you sir, to introduce compulsory free military training in all the colleges and the Universities with facilities for our sisters too. The problem of accommodation is getting more and more acute since the partition. Both students and teachers are greatly suffering on this account and the authorities are also experiencing great difficulties in accommodating the growing number of students in different educational institutions. We therefore appeal to you to use your good office to remedy the present deplorable state of affairs affecting the growth and future wellbeing of the nation.

Sir, the magnificent efforts that you are making to strengthen the defence of Pakistan has evoked the admiration of all. We however beg to impress upon you with all the emphasis at our command that to encourage our youth to join the armed forces we need Army, Naval and Air academics in this province. The only cause for this other slow response from our youth is not lack of enthusiasm or determination on their part but the absence of these facilities in this province. We pledge our whole hearted support and can assure you that given proper facilities you shall have from amongst us the best in every branch of the armed forces.

Sir, the food problem is causing us a great concern. The price of essential commodities and cloth have gone beyond the purchasing power of the average citizen and perhaps the cost of living here in Enst Pakistan is the highest in the world except in China. Steps should be taken to increase our food production to make ourselves self-sufficient. This can only be made possible by abolishing the permanent settlement without compensation and thoroughly re-organising our land tenure system and by the introduction of co-operative farming on a scientific basis.

Let us tell you, Sir, that we greatly appreciate your determination to ruthlessly deal with corruption and black-marketing. Here in East Pakistan the anti-corruption department was doing splendid work. But unfortunately the department has been amalgamated with another department and the work has alarmingly slowed down through the corruption here is still as rampant as ever. We hope you will kindly see that the work and efficiency of the department is not allowed to be hampered by interested individuals however big they may be.

Sir, there can not be any economic progress in the country unless it is industrialised. We hope, Sir, that in any industrial planning of the country. East Pakistan would legitimately get a major share.

Sir, though the two parts of our state happen to be separated by nearly two thousand miles we are one with our brethren of West Pakistan in their joys and sorrows, happiness and tribulations. Provincialism is 4 word unknown to us and quite foreign to our sentiment. We take this opportunity of conveying through you our best wishes and most sincere greetings to our brethren in West Pakistan and the youth in particular.

Sir, the policy of the Britishers to impart education through the medium of a foreign language accounts for the poor percentage of literacy amongst our people. The best way to impart education is through the medium of the mother tongue, and we are glad that our Provincial Government has already accepted this principle. The introduction of Bengali as the medium of instruction and as the official language has opened before us a great opportunity of educating our people and developing ourselves according to our own genius. We are happy to note that our Central Government under your wise guidance has given Bengali an honoured place. This is a step in the right direction which shall go a long way to further strengh-then our cultural ties, with our brethren in West Pakistan. Interchange of thoughts and ideas and mutual understanding are essential if we have to develop a homogeneous and healthy national outlook. We have accepted Urdu as our Lingua Franca but we also feel very strongly that Bengali, by virtue of its being the official language of the premier province and also the language of the 62% of the population of the state, should be given its rightful place as one of the state languages together with Urdu. Otherwise we in East Pakistan shall always be under a permanent handicap and disadvantage.Thus alone we shall have full scope of development and forge closer affinity with our brethren of the other part and march forward hand in hand.

Sir, you are aware of the pitiable plight of the people of East Bengal and Muslims in particular, who were victims of the worst kind of political oppression and economic exploitation. We are confident, Sir, that our legitimate claim in our Armed Forces and the Central Services on the basis of population percentage shall be given effect immediately.

Sir, we appreciate the tremendous odds that you had to surmount and we are also alive to the difficulties that face us to-day. We would however take this opportunity of requesting you most earnestly to see that the framing of our constitution is not delayed any further. The last general elections were in fact a plebiscite on the issue of Pakistan and now that we need more able men and fresh blood to come in and shoulder responsibility. We beg to impress upon you the necessity of having an carly general election on a wider basis.

Sir, we have been watching with increasing grief and concern the repressions to which our students friends most of whom are tried Muslim League workers with admirable record of service and sacrifice, are being subjected. Many of us are being harassed and even put under detention without trial in our attempt to fight out corruption and injustice and bring them to the notice of the Government. The bogey of communism is raised to justify those injustices but we assure you most sincerely that all other “isms” accepting Islamic messages of peace, equality and social justice are quite foreign to our outlook.

We hope Sir, and we are confident that the points we have raised shall recieve your earnest attention and sympathetic consideration.

Sir, we are afraid that we have taxed you long enough but we could not help expressing your feelings. So, we have been franc to you even at the risk of being misunderstood only out of our sincere and intense love for the future well-being of the State. We are happy that the reins of administration of our State are in the able hands of one who enjoys the full confidence and love of all the Pakistanis. We have watched with admiration and regard your services and sacrifice to the cause of the nation. We pray to the Almighty for your sound health and long life to enable you to lead us through the critical times ahead. We thank you most cordially for the honour you have done to us in consenting to come and address us.

Dacca                                                        We beg to subscribe ourselves,

Pakistan Zindabad                     The students of the University of Dacca

The 27th November, 1948

প্রধানমন্ত্রী স্বীয় ভাষণ দানকালে সুকৌশলে এই দাবি এড়িয়ে যান। বেগম রানা লিয়াকত আলী মিটফোর্ড স্কুল ও হাসপাতাল পরিদর্শনকালে ছাত্র বিক্ষোভ সৃষ্টির অভিযোগে মিটফোর্ড স্কুলের ছাত্র ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা জনাব আলী আহমদকে কর্তৃপক্ষ মিটফোর্ড স্কুল হতে বহিস্কার করেন।

২১শে নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের রাজশাহী সফরকালেও ছাত্র বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। এই অপরাধে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অপর নেতা গোলাম রহমানকে রাজশাহী হইতে বহিষ্কার করা হয় এবং সাধারণ ছাত্র-কর্মীদের উপর চলে পুলিশী অত্যাচার ও নির্যাতন।

জুলুম প্রতিরোধ দিবস

উপরে বর্ণিত ছাত্র দলন ও দমননীতি, ছাত্র নির্যাতন ও গ্রেফতার এবং পুলিশ ও মুসলিম লীগের গুণ্ডামীকে নীরবে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। তাই আমরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সাংগঠনিক কমিটি ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বরের বৈঠকে ১৯৪৯ সলের ৮ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী শিক্ষায়তনগুলিতে ছাত্র ধর্মঘট, ছাত্র সভা অনুষ্ঠান মারফত “জুলুম প্রতিরোধ দিবস” পালনের আহ্বান জানাই। যথারীতি ধর্মঘট পালনের পর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দলে দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম মাঠে জমায়েত হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সভার কার্য শুরু হয়। জনাব শেখ মুজিবর রহমান, জনাব দবিরুল ইসলাম ও আমি বক্তৃতা করি। সরকারকে অবিলম্বে জুলুম বন্ধ করিবার আহ্বান জানাইয়া এক মাসের মধ্যে প্রয়োজনবোধে কর্মসূচী ঘোষণা করিবার প্রস্তাবও গৃহীত হয়। দিনাজপুরে অপ্রতিরোধ্য ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হইলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নেতা দবিরুল ইসলাম, নূরুল হুদা কাদের বখস ও এম, আর, আখতার (মুকুল) কারারুদ্ধ হন। কারাগারে তাহাদিগকে দিনাজপুর কারারক্ষী বাহিনী বেদম প্রহার করে। শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল হামিদ চৌধুরী, আবদুল আজিজ দিনাজপুর পদার্পণ করেন, জিলা প্রশাসক ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাহাদিগকে দিনাজপুর ত্যাগের নির্দেশ দেন।

ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত করার চেষ্টা

ইতিমধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সমন্বিত সহ-সভাপতি পদপ্রার্থী জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী ও তাহার কেবিনেট বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বিভিন্ন জাতীয় সমস্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে ছাত্রদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনে পরিণত হয়। সলিমুল্লাহ হলের ১২ নং কামরায় ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজিং কমিটির সভায় আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন করার জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে সকল ছাত্রকেই ইহার সদস্য হওয়ার অধিকার প্রদানের দাবিতে প্রস্তাব পেশ করি। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রহমান চৌধুরী ও নঈমুদ্দিন আহমদের তীব্র বিরোধিতার মুখে আমার প্রস্তাব বাতিল হইয়া যায়। ঐ বৈঠকেই আমার পদত্যাগপত্র দাখিল করিলে, শেখ মুজিবুর রহমান আমার সেই ইস্তফাপত্র ছিড়িয়া ফেলেন। তাহার গভীর ভালবাসা, দুর্বলতা ও দরদকে অন্বীকার করিবার মত মানসিক শক্তি আমার ছিল না। আমার পদত্যাগের সংবাদ প্রচারিত হইয়া পড়িলে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার এবং বাহাউদ্দিন চৌধুরী আমাকে কমিউনিস্ট ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দিতে বলিলে প্রত্যুত্তরে তাহাদিগকে বলিয়াছিলাম যে, ছাত্রলীগ সংগঠন হইতে পদত্যাগ করিলেও আমি ছাত্রলীগের সহযোগী হিসাবেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করব।

পাকিস্তান স্টুডেন্টস র‍্যালির আহ্বায়ক জনাব গোলাম কিবরিয়ার সহিত আলোচনায় আমি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চরিত্রের জন্য স্টুডেন্টস র‍্যালীর প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন করিলেও তাহাকে বলিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পরীক্ষিত সহকর্মী বন্ধুদিগের সহিত আমি সহযোগী হিসেবে ছাত্র আন্দোলনে থাকিব।

বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের ধর্মঘট

বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের ধর্মঘট সমর্থনে আমরা ৩রা মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহানুভূতি সূচক ছাত্র ধর্মঘট করি। ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুন গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদের আহ্বায়ক জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী আমার অনুরোধে ৫ই মার্চ কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে পুনরায় ছাত্র ধর্মঘট ও সভা অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। যথারীতি ছাত্র ধর্মঘটের পর আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় ধর্মঘটী নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের দাবি না মানা পর্যন্ত অবিরাম ছাত্র ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভাশেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল সহকারে আমরা ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসভবনে গমন করি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নানা হুমকি উপেক্ষা করিয়া ছাত্র ধর্মঘট অব্যাহত রাখিলাম। সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য কর্মপরিষদের আহ্বায়ক আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভা চলাকালে ধর্মঘটী নিম্ন বেতনভূক কর্মচারীদের দাবিগুলি সহানুভূতি সহকারে বিবেচনার জন্য অনুরোধ করিতে আমরা সভা হইতে মিছিল করিয়া দ্বিতীয়বার ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি যাই। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যদের মৌখিক আশ্বাসে আশান্বিত হইয়া রাত নয়টার দিকে স্থান ত্যাগ করি। পরদিন অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ১০ই মার্চ জনাব আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জানাব দবিরুল ইসলাম ও জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরীর যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতার পর ধর্মঘটী নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীবৃন্দ কাজে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ ছাত্রগণ অবিরাম ধর্মঘট খুব প্রীতির চোখে দেখিতেছিল না। ইহাই আমাদিগকে ভাবাইয়া তুলিয়াছিল। অতএব ধর্মঘট প্রত্যাহার সময়োচিত ও বাস্তবসম্মত ছিল।

পরিতাপের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের সদিচ্ছাকে ভুল বুঝিলেন এবং বেলা ১ টার মধ্যে কর্মে যোগদানের কথা ছিল এই মিথ্যা অভিযোগ ও অজুহাতে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে ধর্মঘটী কর্মচারীদের যোগদান পত্র তাহারা প্রত্যাখান করেন। শুধু তাই নয়, ১১ই মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হইল।

কর্তৃপক্ষের অযৌক্তিক নির্দেশের বিরুদ্ধে ১২ই মার্চ সকাল বেলা মিছিল সহকারে আমরা ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনে গমন করি, কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলরের সাক্ষাৎ না পাওয়ার দরুন মিছিল শহরের বিভিন্ন এলাকা যেমন চকবাজার, মিটফোর্ড, ইসলামপুর, সদরঘাট, নওয়াবপুর প্রদক্ষিণ করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে জমায়েত হয় ও যথারীতি প্রস্তাব গ্রহণের পর সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

ছাত্রাবাসগুলির ডাইনিং হল বন্ধ করিয়া দেওয়ায় আমরা কতিপয় ছাত্র ব্যতীত অন্যান্য আবাসিক ছাত্ররা হল ত্যাগ করে।

বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালে ২১ মার্চ (১৯৪৮) এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল নিম্নলিখিত ২৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ছাত্রদের অপরাধ তাহারা নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিয়াছিল।

(ক) ৪ বৎসরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার

(১) দবিরুল ইসলাম (আইন ছাত্র), ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, (২) আবদুল হামিদ চৌধুরী (এম.এ ক্লাস), (৩) অলি আহাদ (বি,কম, দ্বিতীয় বর্ষ), (৪) আবদুল মান্নান (বি.এ.ক্লাস), (৫) উমাপতি মিত্র (এম,এস, সি. পরীক্ষার্থী), (৬) সমীর কুমার বসু (এম.এ.স)।

(খ) বিভিন্ন হল হইতে বহিস্কার।

(১) আবদুর রহমান চৌধুরী (আইন ছাত্র), সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র। সংসদ, (২) মোল্লা জালালউদ্দিন আহমদ (এম,এ, ক্লাস), (৩) দেওয়ান মাহবুব আলী (আইন ছাত্র), (৪) আবদুল মতিন (এম.এ. ক্লাস), (৫) আবদুল মতিন খান চৌধুরী (আইন ছাত্র), (৬) অবদুর রশিদ ভুঁইয়া (এম.এ. ক্লাস), (৭) হেমায়েত উদ্দিন আহমদ (বি.এ.ক্লাস), (৮) আবদুল মতিন খান (এম,এ, পরীক্ষার্থী), (৯) নুরুল ইসলাম চৌধুরী (এম,এ, ক্লাস), (১০) সৈয়দ জামাল কাদেরী (এম,এস,সি ক্লাস), (১১) আবদুস সামাদ (এম.কম, ক্লাস), (১২) সিদ্দীক আলী (এম.এ. ক্লাস) ১৩) আবদুল বাকী (বি.এ. ক্লাস), (১৪) জে, পাত্রনবিশ (এম.এস.সি ক্লাস) (১৫) অরবিন্দ বসু (আইন ছাত্র), সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ।

(গ) পনেরো টাকা জরিমানা

(১) শেখ মুজিবুর রহমান (আইন ছাত্র), (২) কল্যাণ দাস গুপ্ত, (এম.এ.ক্লাস) সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল ছাত্র সংসদ, (৩) নঈমুদ্দিন আহমদ, (এম.এ.ও ল’র ছাত্র) আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (৪) মিস নাদেরা বেগম (এম.এ. ক্লাস), (৫) আবদুল ওয়াদুদ (বি.এ. ক্লাস)।

(ঘ) দশ টাকা জরিমানা

মিস লুলু বিলকিস বানু (আইন ছাত্রী)।

বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ৪ বৎসরের জন্য বহিষ্কৃত আমরা ছয়জন ছাত্র ব্যতীত বিভিন্ন সাজাপ্রাপ্ত বাকী একুশ জনকে ১৭ এপ্রিলের মধ্যে লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট মুচলেকা দাখিল করিবার নির্দেশ জারি করা হয়।

ইংরেজ সাম্রাজ্য রক্ষার প্রয়োজনে প্রবর্তিত ও আমলাতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অর্জিত বিকৃত মূল্যবোধসম্পন্ন উচ্চশিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভূক্ত, অধভুক্ত, স্বল্প বেতনভুক কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জঘন্য ও হিংস্র সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করিয়াছিল। ১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন চলাকালে ঢাকা নগরে ছাত্র আন্দোলনের যে তিক্ত-অভিজ্ঞতা সরকারের হইয়াছিল ইহার প্রেক্ষিতে ভীতসন্ত্রস্ত নুরুল আমিন সরকার ১৯৪৯ সালের ১১ই মার্চ আহূত বাজেট অধিবেশনকালে ছাত্র বিক্ষোভ এড়াইবার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার পরামর্শ দান করেন। কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন। তাই হইল। ইহার পর ছাত্র আন্দোলন দমনের নিমিত্ত নুরুল আমিন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ অবস্থায়ই আমরা সাতাশ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে উপরোক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

কর্তৃপক্ষের প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থাযর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিকারের প্রয়াসে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখে অর্থাৎ ১৭ই এপ্রিল (১৯৪৯) সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করে। পরিতাপের বিষয়, ইতিমধ্যে জনাব নঈমুন্দিন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী প্রমুখ ছত্রনেতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক মুচলেকা বা বন্ড স্বাক্ষর করিয়া স্বীয় অতীত কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত বলিয়া ক্ষমাপ্রার্থী হইয়াছিলেন। তাহাদের নীতিহীন ভূমিকা স্বত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয়, ছাত্র সভা হয় ও ছাত্র সভাস্থল হইতে নিছিল সহকারে আমরা ছাত্র বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবিতে ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসভবনে গমন করি। ভাইস চ্যান্সেলর সাক্ষাৎ দিতে অস্বীকৃতি জানাইলে রাত্রি ১০টা পর্যন্ত অবস্থান ধর্মঘট পালন করি। পরদিন পুনরায় ছাত্র ধর্মঘট এ ছাত্র সভ্যর পর আমরা আবারো মিছিল সহকারে ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনে গমন করি। আনুমানিক অপরাহ্ন পাঁচ-ছয় ঘটিকার দিকে জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরীর উদ্যোগে ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সুসাহিত্যিক অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ টি, আহমদ, প্রফেসর আবদুল হালিম, ঢাকা হলের প্রভোষ্ট ড. পি.সি, চক্রবর্তী, পূর্ববঙ্গ সরকারের জয়েন্ট সেক্রেটারি মিজানুর রহমান ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোষ্ট প্রফেসর ডঃ ওসমান গনি প্রমুখ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যের সহিত ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনেই আমাদের আশাব্যঞ্জক আলাপ-আলোচনা হয়। কিন্তু গভীর রাত্রিতে পর্দার অন্তরালে অদৃশ্য হন্তের খেলায় সবকিছুই তল হইয়া গেল। অবস্থাদৃষ্টে শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সহিত আলোচনা করিয়া অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক আবদুর রহমান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট আত্মসমর্পণ করায় আমাকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করিয়া ছাত্র কর্মপরিষদ পুনর্গঠিত হইল। ২০শে এপ্রিল ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট, সভা, বিক্ষোভ মিছিল ২৫শে এপ্রিল দেশব্যাপী সাধারণ হরতাল আহ্বান করা হইল। ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের আহ্বানে ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনে সশস্ত্র ও লাঠিধারী পুলিশ মোতায়েন হয়। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীগণও অবস্থান ধর্মঘটের সংবাদে আমাদের চারিদিকে আনাগোনা আরম্ভ করে। সন্ধ্যার দিকে গ্রেফতার হইবার কিছু পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে আন্দোলন পরিচালনার স্বার্থে গ্রেফতার এড়াইবার নির্দেশ দিলেন। আমি তদনুযায়ী ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন পরিত্যাগ করি। এই ১৯শে এপ্রিলই অবস্থান ধর্মঘট পালন অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করিয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয়। কিন্তু আমাদের ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। ২০শে এপ্রিল ধর্মমটের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম মাঠে যথারীতি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাস্থল হইতে মিছিলসহকারে আগাইয়া যাওয়ার সময় জিমনেসিয়াম মাঠ এবং ঢাকা হলের মধ্যবর্তী রাজপথে পুলিশ বাহিনীর সহিত সংঘর্ষ ঘটে। শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ করিবার নিমিত্ত পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। পুলিশের সহিত এক পর্যায়ে হাতাহাতি-ধস্তাধস্তি চলাকালে আমাকে গ্রেফতার করিয়া ঢাকা জিলা গোয়েন্দা বিভাগ অফিসে লইয়া যাওয়া হয়। তথায় কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যা ৬ ঘটিকার দিকে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করে। কেন্দ্রীয় কারাগারের ৫ নং ওয়ার্ডে ঢোকামাত্রই মুজিব ভাই আমাকে বকাবকি করিতে লাগিলেন। শান্ত হইলে বুঝাইয়া বলিলাম, আমার কোন দোষ নেই। গোয়েন্দা কর্মচারীবৃন্দ কম সতর্ক ছিল না, তাই আমাকে মিছিল হইতেই পাকড়াও করিতে পারিয়াছে। ইতিমধ্যে জনাব আবদুল মতিন, নিতাই গাংগুলি, এনায়েত করিম, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, আবুল হাসনাত, আবুল বরকত (শহীদ বরকত নয়), খালেক নেওয়াজ খান, আতাউর রহমান, মাজহারুল ইসলাম, মফিজুল্লাহ প্রমুখ গ্রেফতার হইয়া জেলখানায় নীত হন। আমরা গ্রেফতার হইবার পর আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই ভাটা পড়ে। পত্রিকাপাঠে মনে হইল ২৫শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত সাধরণ হরতালের ডাক সম্পূর্ণভাবে সাফল্যমন্ডিত হয় নাই। ইহারই অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে ২৭শে এপ্রিল হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস চলিতে থাকে।

টাংগাইল উপনির্বাচন

আসাম হইতে আগত আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দক্ষিণ টাংগাইল নির্বাচনী কেন্দ্র হইতে করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নী ও অপর দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করিয়া পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হইয়াছিলেন। নির্বাচনী ত্রুটির অপরাধে গভর্নরের এক আদেশ বলে মওলানা ভাসানী, খুররম খান পন্নী ও অন্যান্য প্রার্থীকে ১৯৫০ সাল অবধি নির্বাচন প্রার্থী হইবার অযোগ্য বলিয়া ঘোষণা করা হয়। উপরোক্ত শূন্য আসন পূর্ণ করিবার প্রয়োজনে সরকার ২৬শে এপ্রিল (১৯৪৯) উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করে। এইবার মুসলিম লীগ সরকার স্বীয় স্বার্থেই খুররম খান পন্নীর পূর্ব ঘোষিত অযোগ্যতার বাতিল করে এবং তিনি অনুষ্ঠিতব্য উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধী দল জন্ম না নিলেও মুসলিম লীগ সরকার বিরোধী মনোভাবের অন্তঃসলিলা প্রবাহের সক্রিয়া নেত্রত্বে ছিল ঢাকার ১৫০ নং মোগলটুলীতে অবস্থিত পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মীশিবির। তরুণ নেতা জনাব শামসুল হক উক্ত কর্মী শিবিরের নেতা ছিলেন। তিনিই এই উপনির্বাচনে সরকারি প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দিতায় অবতীর্ণ হইলেন।

খন্দকার মোশতাক আহমদ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, আজিজ আহমেদ, জনাব শওকত আলী, জনাব হজরত আলীর পরিচালনায় তরুণ কর্মীবৃন্দ সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় এমনকি জীবনের ঝুঁকি লইয়াও গরীব-নিঃস্ব প্রার্থী শামসুল হকের পক্ষে নির্বাচন প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করেন। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ও পরাক্রমশালী মুসলিম লীগ সংগঠনের সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সরকার মনোনীত প্রার্থী জমিদার খুররম খান পন্নী সর্বত্যাগী, নিঃস্ব ও আদর্শস্থানীয় নেতা শামসুল হকের নিকট পরাজয়বরণ করেন। ইহার পর নুরুল আমিন সরকার ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত ৩৫টি শূন্য আসনে কোন উপনির্বাচন হইতে দেন চাই। ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকিবার কি মারাত্মক মানসিক প্রবণতা। জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়ায় মুসলিম লীগ সরকার উপনির্বাচনে জনগণকে মোকাবিলা করার সাহস হারাইয়া ফেলিয়াছিল। এইভাবেই এইদেশে গণতন্ত্র হত্যার গোড়াপত্তন করিলেন নূরুল আমিন সরকার। যাহা হউক এই উপনির্বাচনে আইন পরিষদ সদস্য শামসুল হকের বিরুদ্ধে নির্বাচনী মামলা দায়ের করেন। বিচারপতি আমিনুদ্দিন, জেলা জজ ইনায়েতুর রহমান ও শহরুদ্দিন সমবায়ে গঠিত নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ১৯৫০ সালে জনাব শামসুল হকের নির্বাচন নাকচ করিয়া দেন। মওলানা ভাসানী তাহার মুরিদানের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসাম গেলে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে আসাম কংগ্রেস সরকার তাহাকে গ্রেফতার করিয়া ধুবড়ী কারাগারে আটক করে। জনাব হজরত আলী ধুবড়ী কারাগারে বন্দি মওলানা ভাসানীর স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র জনাব শামসুল হকের স্বপক্ষে ভোটদানের জন্য প্রকাশ করেন। আবেদনপত্রে ধুবড়ী কারাগারের কোন সীলমোহর ছিল না। তাই ট্রাইব্যুনাল উক্ত আবেদন পত্রকে জাল বলিয়া নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন।

জনাব শামসুল হকের বিজয় কারাগারে আমাদের মনোবলকে বর্ণনাতীত-ভাবে বৃদ্ধি করে। আমরা টাংগাইল উপনির্বাচনে উল্লসিত ও আত্মহারা হইয়া পড়ি। ৮ই মে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মীশিবির নব নির্বাচিত পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য জননেতা শামসুল হককে ঢাকা নগর বাসীর পক্ষ হইতে ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রাণঢালা গণসম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে।

কারাগার-তখন এবং এখন

নুরুল আমিন সরকারের কারাগার মন্ত্রী জনাব মফিজুদ্দিন আহমদ কারাগার পরিদর্শনকালে আমাদের ৫নং ওয়ার্ডে দেখা করিতে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান বন্দিদের পক্ষে খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কিত অসুবিধার প্রতিকারের অনুরোধ করেন। মন্ত্রীমহোদয় মুজিব ভাই-এর অনুরোধ মোতাবেক রাজবন্দিদের প্রথম শ্রেণির কয়েদির মর্যাদা দান ছাড়াও রাজবন্দিদিগকে অন্যান্য সম্ভাব্য বিশেষ সুবিধা দানের নির্দেশ দেন। অতীব দুঃখের সহিত লিখতে হয়, ১৯৭৪-৭৫ সালে মুজিব আমলে রাজবন্দি হিসাবে আমি প্রায়শঃ অর্ধাহারে কাল কাটাইয়আছি। কি শীত কি গ্রীষ্ম সবসময়ই বস্ত্র, তৈল, সাবান, তোয়ালে, পাদুকা, খবরের কাগজ ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য এমন কি রোগে ঔষধ থেকে বঞ্চিত হইয়াছি। মুজিব সরকার নিজস্ব বাড়ি হইতে রন্ধন করা খাদ্য দুরে থাকুক এমন কি কাঁচা ডিম  পর্যন্ত কারাগারে সরবরাহ বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। ১৯৪৮ সাল হইতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বছরের পর বছর কারাজীবন কাটাইয়াছি। এমন অমানুষিক দুঃসহ দৈহিক ও মানসিক কষ্ট আর কখনও পাই নাই। ক্ষমতা একজনকে কত অমানুষ করিতে পারে, শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসে ইহারই একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। জেনারেল আইউবের শাসন আমলে চার বছরের বেশি কারাজীবন কাটাইয়াছি। শেখ সাহেবের তুলনায় আইউব ফেরেশতা ছিলেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সালে সরকার পূর্ববঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স জারি করিয়া বিনাবিচারে আটকের ব্যবস্থা করিলেও নিরাপত্তা বন্দিদের জন্য কোন বিধি প্রণয়ন হয় নাই। ইংরেজ আমলে ১৯৪০ সালে নিরাপত্তা বন্দিবিধি (সিকিউরিটি প্রিজোনারস রুল) মোতাবেক রাজবন্দির কতিপয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হইত এবং মুসলিম লীগ সরকারের নির্দেশে কারাগারে রাজবন্দিদিগকে বিচারাধীন বন্দিদের পর্যায়ে ফেলা হয়, বেশির ভাগ রাজবন্দিদের তৃতীয় শ্রেণির বিচারাধীন আসামী হিসাবে গণ্য করা হয়; ফলে অখাদ্য-কুখাদ্য খাইয়া জীবনধারণ একপ্রকার অসম্ভব হইয়া উঠে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের পদাংক অনুসরণ করিয়া রাজবন্দিদের কারাগারে আসামির মর্যাদা দানের সরকারি নির্দেশ দেন। অত্যাচারীদের চেহারা অভিন্ন।

কারাগারে অনশন ধর্মঘট ও কমিউনিস্ট পার্টির হঠকারিতা

কারাগারে অধিকাংশ নিরাপত্তা বন্দীই ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ভুক্ত। ১৯৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস সশস্ত্র বিপ্লবের মারফত সরকার উৎথাতের ডাক দেয়। সদ্য আজাদীপ্রাপ্ত পাক-ভারত রাষ্ট্রদ্বয়ের সরকারের পিছনে অকুষ্ঠ গণ-সমর্থন ছিল এবং ইহাতে প্রশ্নের কোন অবকাশ ছিল না। প্রায় দুই শত বৎসর অবর্ণনীয় ক্লেশ ও ত্যাগ স্বীকার করিয়া ইংরেজদের তাড়াইয়া স্বাধীনতা অর্জন করা হইয়াছে। এমনি বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক জনগণের নিকট উন্মাদ বিশেষের প্রলাপ মনে হইবে, তাহাতে আর বিচিত্র কি। এই অবাস্তব নীতির দরুনই কমিউনিস্ট পার্টিকে ১৯৪৮-৫০ এই তিন বৎসর উভয় সরকারে প্রচন্ড দমননীতির দুর্বিষহ স্টিমরোলার সহ্য করিতে হয়। পার্টির এই বাস্তব বিবর্জিত, অসার, অলীক ও ভুল নির্দেশকে বৃহত্তর কর্মকাণ্ডের অংশ হিসাবে মানিয়া লইয়া আটক নিরস্ত্র, অসহায়, সম্বলহীন কমিউনিস্ট রাজবন্দিগণ কারান্তরালে সংগ্রামের পথ বাছিয়া লইলেন এবং কারাগারে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে ১৯৪৯ সালের ১১ই মার্চ অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করেন। দাবি গৃহীত বা আলোচিত হইবার পূর্বেই অনশনরত বন্দিগণ ঢাকা কারাগারে চার দিনের মধ্যে এবং রাজশাহী কারাগারে আট ত্রিশ দিনের মধ্যে অনশন ধর্মঘট ভঙ্গ করেন।

১৯৪৯ সালের ২২শে মে তাহারা পুনরায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের মৌখিক প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাসে অনশনরত কমিউনিস্ট বন্দিগণ ঢাকা কারাগারে মে-জুন মাসে চব্বিশ দিন পর এবং রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে একচল্লিশ দিন পর অনশন ভঙ্গ করেন। তাহাদের অনশনকালে আমরাও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে আবদ্ধ ছিলাম। আমাদের সঙ্গে অনশন বিষয়ে তাহারা কোন যোগাযোগ করেন নাই। পর পর দুইটি অনশন ধর্মঘট ব্যর্থ হয়। তথাপি জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন ক্রিয়াকলাপ তাহারা পরিত্যাগ করে নাই। ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাহাৱা পুনরায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এবার কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনরত কমিউনিস্ট রাজবন্দিগণ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চল্লিশ দিন পর ও রাজশাহী কারাগারের বন্দিগণ পয়তাল্লিশ দিন পর অনশন ধর্মঘট ত্যাগ করেন। কর্তৃপক্ষের মিথ্যা আশ্বাসে বিভ্রান্ত হইয়া অনশন ধর্মঘট পুনঃ পুনঃ প্রত্যাহার সত্বেও বাস্তবে কোন ফলাফল না হওয়ায় কমিউনিস্ট রাজবন্দিগণ ১৯৪৯ সালের ২রা ডিসেম্বর পুনঃ অনশন ধর্মঘটের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনরত বাবু শিবেন রায় ৮ই ডিসেম্বর দিবাগত রাত্রে প্রাণ ত্যাগ করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনরত কমিউনিস্ট রাজবন্দি ও সরকারের মধ্যে আপোষ-আলোচনা চুক্তি মোতাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনরত রাজবন্দিগণ যথাক্রমে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে আটান্ন দিন ও একষট্টি দিন পর অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। চুক্তিপত্র নিম্নরূপঃ

(১) বন্দিগণকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিভূক্ত করা,

(২) প্রতি সপ্তাহে একটি চিঠি লিখিবার অধিকার,

(৩) প্রতি পনের দিনে আত্মীয়স্বজনের সহিত সাক্ষাৎ করান,

(৪) খেলাধুলার সুযোগ, কাপড়-চোপড়, সাবান, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট ইত্যাদি সরবরাহ।

উল্লেখ্য যে, রাজবন্দির এই মর্যাদা অর্জনকল্পে এগার মাসের মধ্যে কমিউনিস্ট রাজবন্দিগণকে সর্বমোট ৪টি ধর্মঘটে ঢাকা কারাগারে একশত সাতাশ দিন ও রাজশাহী কারাগারে একশত পঁচাশি দিন অনশন ধর্মঘট করিতে হয়।

অনশনরত বন্দিদের দাবি ছিল নিম্নরূপঃ

(১) সকল নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বন্দিকে বিনাশর্তে অবিলম্বে মুক্তিদয়ান; অন্যথায়-

(ক) দৈনিক খাদ্য বাবদ তিন/চার টাকা

(খ) খাট, তোষক, হাঁড়ি, বাসন, আসবাবপত্র ও দুইশত পঞ্চাশ টাকা প্রাথমিক ভাতা।

(গ) ব্যক্তিগত ভাতা মাসিক পঞ্চাশ টাকা,

(ঘ) পারিবারিক ভাতা মাসিক একশত টাকা,

(ঙ) প্রতিমাসে চারটি চিঠি বাহিরে পাঠান, দুই সপ্তাহ অন্তর দেখা, উপযুক্ত থাকার হান, খেলাধুলার ব্যবস্থা,

(চ) হাজত ও অন্যান্য বিচারাধীন রাজবন্দিদিগকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান,

(ছ) অন্য সকল রাজনৈতিক বন্দির জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দান,

(জ) উন্নত খাদ্য ব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, দৈনিক খবরের কাগজ, পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা চালু, উন্নততর জীবন-যাপন, সরকারি খরচায় ধূমপানের ব্যবস্থা, ‘এ’ ওয়ার্ডে রেডিও বসান এবং নির্দেশিত সমস্ত খবরের কাগজ ও পত্র-পত্রিকা সেন্সর না করিয়া দেওয়া এবং সেলে রেডিও স্থাপন।

                ১৯৫০ সালের ৫ই এপ্রিল কমিউনিস্ট বন্দিনের প্রেরণায় কতিপয় দাবির ভিত্তিতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সাধারণ কয়েদিগণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ইহা কমিউনিট্ট বন্দিদের সবাক সর্বাত্মক কর্মধারার একটি নিক। কারা বহির্ভাগে সমগ্র দেশবাসী যখন তাহাদের সশস্ত্র বিপ্লবের ডাকে কোনোপ্রকার আমলই দেয় নাই, তাহাদের ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যয়, লাখো ইনলান ভূখা হ্যায়’ মুখরোচক আওয়াজকে কতিপয় বিভ্রান্ত আদম সন্তানের মতিভ্রম বলিয়া জ্ঞান কারিয়ছে, তখন তাহারা কারান্তরালেই সরকার উৎবযতের বৈপ্লবিক প্রেরণায় সাধারণ কয়েদিগণকে প্ররোচিত করেন। একাত্মতা প্রকাশের নাম করিয়া কমিউনিস্ট বন্দিগন ৭ই এপ্রিল হইতে অনশনরত সাধারণ বন্দিদের দাবির সমর্থনে অনশন ধর্মঘট শরু করেন। সরকারের সহিত আপেষ-মীমাসায় ছির হয় যে, কয়েদীরা নিজের পয়সায় কারান্তরালে ধূমপান করিতে পারিবে, দ্বিতীয়তঃ কয়েদীগণকে দিয়া ঘানি টানানো হইবে না; তৃতীয়তঃ কয়েদিগণকে অযথা প্রহার কর হইকে না। দাবী মানিয়া লইবার পর ১৫ এপ্রিল কয়েদীগণ অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন।

রাজশাহী জেলার হত্যাকাণ্ড

উপরোক্ত ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে ১৯৫০ সালের ২৪শে এপ্রিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এক হদয়-বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা যটিয়া গেল। ঐ দিন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে সুপারিনটেন্ডেন্ট মিঃ বিল কারগার পরিদর্শনকালে কারান্তরালে ‘খাপড়া’ নামক ওয়ার্ডে গমন করিলে ওয়ার্ড প্রতিনিধি জনাব আবদুল হক বিভিন্ন সমস্যা আলোচনাকালে তর্ক বিতর্কের সময় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বন্দিগণ মিঃ বিল ও ২ জন ডেপুটি জেলারকে বলপূর্বক ঐ ওয়ার্ডের ভেতরে লইয়া যান। মিঃ বিল কোন প্রকারে দৈহিক শক্তির দ্বারা বাইরে চলিয়া আসেন। ইতিমধ্যে জেলার মান্নান পাগলা ঘন্টি দেওয়ার জন্য সংকেত বাঁশি বাজান। পাগলা ঘন্টি বাজে, সঙ্গে সঙ্গে কারাগার রক্ষীবাহিনী খাপড়া ওয়ার্ডে ধাবিত হয় ও অবাধ গুলি চালায়। গুলিতে ওয়ার্ড অভ্যন্তরেই খুলনার ছাত্র-কর্মী আনোয়ার হোসেন, শ্রমিক নেতা হানিফ শেখ, মোঃ দেলওয়ার, সুধীন ধর ও সুখেন ভট্টাচার্য প্রাণ হারান। দিনাজপুর জেল হাসপাতালে স্থানান্তরিত আহত দিনাজপুর কৃষক নেতা কম্পরাম সিং ও বিজন সেন মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদের মধ্যে জনাব আবদুল হক (যশোর), আমিনুল হক বাদশ (পাবনা), মনসুর হাবিব (বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ), অমূল্য লাহিড়ী (পাবন), আবদুস শহীদ, বাবর আলী, নুরুন নবী চৌধুর ভুজেন পালিত একং ওয়ার্ডে আটক ২ জন ডেপুটি জেলারের মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ হইয়া আহত হন। ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে আমি রাজশাহী কারাগারে বন্দি থাকাকালে উপরে বর্ণিত খাপড়া ওয়ার্ডটি আগ্রহ ভরে দেখি এবং পূর্ণ কাহিনীটি অবগত হই |

কারাগারে হইতেছে সর্বদেশের সর্বকালের জালেম সরকারের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত দুর্গ। দুর্গান্তরালে নিরন্ত্র বন্দিদের পক্ষে কোন প্রকার বিদ্রোহআত্মক ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আত্মঘাতী। জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কারান্তরালে ন্যূনতম সংগ্রামও সম্ভব নয়। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫১ সালে সন্ত্রাসবাদী উন্মাদ পরিকল্পনা পরিহার করার পরই তারাষরলে কমিউনিস্ট রাজবন্দিগণ মানসিক ভারসাম্য পুনঃ লাভ করিয়া প্রকৃতিস্থ হইয়াছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার হইয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকাকালে কারান্তরালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের এই হঠকারী পদক্ষেপগুলি অবগত হইবার সুযোগ পাই।

সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ঢাকা আগমন

১৯৪৯ সালে কারাগারে আটক থাকাকালে পত্রিকাপাঠে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঢাকা আগমন বার্তা আমরা জানিতে পারি। তিনি ঢাকায় আসিয়াছিলেন দিনাজপুর কারাগারে আটক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কর্পাস মামলা পরিচালনার জন্য। ১৯৪৯ সালের ১১ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জল ছুটি ঘোষণা করিলে জনাব দবিরুল ইসলাম নিজ জিলা দিনাজপুরে চলিয়া যান। সেখানে তাহাকে পূর্ববঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স বলে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ সরকারি মুসলিম লীগ কর্তা ব্যক্তিদের ইংগিতেই জনাব দবিরুল ইসলামের উপর কয়েদখানায় অকথ্য দৈহিক নির্যাতন চালায়। দবির ভাই শারীরিকভাবে শক্তিহীন হইয়া পড়েন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে অতি তরুণ বয়সেই হৃদরোগ ও অন্যান্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।

উল্লেখ্য যে, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দবির ভাই যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে পূর্ব পাকিস্তান লেজিসলেটিভ এসেম্বলীতে সদস্য নির্বাচিত হইয়াছিলেন; পূর্বে বর্ণিত পুলিশী জুলুমের পরিণতিতে তাঁহার দেহ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল বিধায় কয়েক বৎসরের মধ্যে অতি তরুণ বয়সে তিনি ইহলোক হইতে বিদায় গ্রহণ করেন।

কারা জীবনে বৈচিত্র্য

বৈচিত্র্যহীন কারাজীবন মাঝে মাঝে বিভিন্ন ঘটনারাজীর সমাবেশে কিছুটা আনন্দদায়ক ও কৌতুকময় হইয়া উঠে। রাজনৈতিক মতভেদ সত্বেও জনাব বাহাউদ্দিন চৌধুরী আমার বন্ধু ছিলেন। তিনি বরিশালের বিখ্যাত উলানিয়া জমিদার পরিবার তনয়। মা-বাবার আদরের দুলাল। জেল ফটকে সাক্ষাৎকারের সময় তাহাকে স্নেহময়ী মা স্বহস্তে তৈরি বরফী, মোরব্বা সমেত কিছু বিদেশী বিস্কুটের টিন দিয়া গিয়াছিলেন। আমার মায়ের স্বহস্তে তৈরি নানা সুস্বাদু দ্ৰব্য আমার মনে পড়িল। বাহাউদ্দিন সাহেব ঘুম-কাতর। সকালে বেশ বিলম্বেই তিনি শয্যা ত্যাগ করেন। গভীর রাত্রের অন্য সহবন্দিদের ঘোর নিদ্রার সুযোগে রহমান সাহেব নামক সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী বন্ধুর প্ররোচনায় আমরা কয়েকজন বেশ আরামে তাহার মায়ের দেওয়া উপাদেয় বরফী, মোরব্বা, বিদেশী বিস্কুটগুলি সংযোগে রসনা তৃপ্ত করিলাম। তবে একেবারে নিঃশেষ করি নাই। বেশ কিছু অংশ নিদ্রামগ্নদের প্রাতরাশের নিমিত্ত রাখিয়া দিলাম। সকাল বেলা চৌধুরী সাহেব অভ্যাস মত ৯-৩০ মিঃ কি ১০ ঘটিকার দিকে নাস্তা করিতে বসিয়াই বোকা ও হতভম্ব হইয়া গেলেন। সব ভদ্রবন্দি, ওয়ার্ড তালাবন্ধ। বাহিরের অন্য কোন দুশ্চরিত্র সাজাপ্রাপ্ত বন্দির প্রবেশ অসম্ভব। তিনি নিজে ভূতে বিশ্বাস করেন না অথচ কাওটা ভৌতিক। মুজিব ভাইয়ের কানে ঘটনাটি উঠিল। মুখ চাওয়া-চাওয়ি, “তাইতো কি করিয়া হইল” ইত্যাদি অনুতাপ-আক্ষেপ ও মন্তব্য ছাড়া কাহারো কিছু বলিবার ছিল না। গোল বাঁধাইলেন রহমান সাহেব। তাহার পেটে কোন কথা থাকে না। অতএব চোর ধরা পড়িলাম। অগত্যা স্বীকার করিলাম, একটু আধটু-চুপিচাপি আহারাদি অন্যের অলক্ষ্যে করিয়া থাকি। ইহা আমার আশৈশব প্রশিক্ষণ বা অভ্যাস’। কিশোর বয়সে কালাজুর রোগাক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞা ও মায়ের সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়া গভীর রাত্রে কুপথ্য চিংড়ি মাছ চুরি করিয়া খাইতাম- মা অবশ্য বমাল ধরিয়া ফেলিয়াছিলেন। মুজিব ভাইকে বলিলাম, আমি একা নই, অনেকেই একযোগে এই সৎ কাজটি করিয়াছি। একঘেঁয়ে কারা জীবনে বৈচিত্রের স্বাদ সবাইকেই দিলাম, তাই ধন্যবাদ আমাদেরই প্রাপ্য। উল্লেখ্য যে জনাব বাহাউদ্দিন চৌধুরী ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে ৬ দফা আন্দোলনে দেশ যখন উথাল-পাতাল ও প্রকম্পিত তখন তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে ঢাকা নগরের আয়ূব মোনায়েম বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। পরবর্তীতে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সরকারের তথ্য সচিব ছিলেন।

রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের পটভূমিকা

১৯৪৯ সালের জুন মাসে এনায়েত করিম, শাসসুল হুদা এবং আমি একই দিন শুক্রবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে মুক্তি লাভ করি। কারা মুক্তির পরই পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবির অফিস ১৫০ নং মোগলটুলীতে জনাব শওকত আলীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া নেতা শামসুল হক সাহেবের টাঙ্গাইলে উপনির্বাচনের বিজয় কাহিনী গর্বের সহিত তুলিলাম। তাহার নিকট এসে অবগত হইলাম যে, আগামী ২৩শে ও ২৪শে জুন ঢাকায় মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করা হইয়াছে ও তদুপলক্ষে মওলানা আবদুল হামিদ খানকে (ভাসানী) সভাপতি ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করিয়া একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হইয়াছে। ১৫০ নং মোগলটুলী, ঢাকা, ১৯৪৪ সাল হইতে মুসলিম বাংলার রাজনীতিতে প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রাণকেন্দ্র। ১৯৪৩ সালের ৬ই নভেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায় জনাব আবুল হাশিম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে নূতন যুগের সূচনা হয়। তিনি অনাগত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক রূপরেখা ইসলামী জীবনের দর্শনের আলোকে খুবই সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্নভাবে সাধারণ্যে তুলিয়া ধরিলেন। তাঁহার দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় বুদ্ধিজীবী ও তরুণ মুসলিম ছাত্র সমাজ উদ্বুদ্ধ হইলেও ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ ভূস্বামী, সুদখোর মহাজন ও ধর্মান্ধ শ্রেণির লোকেরা দার্শনিক নেতা আবুল হাশিমের উপর খড়গহস্ত হইয়া উঠিল। যাহা হউক, আবুল হাশেম সাহেবের সাংগঠনিক শক্তির দ্বারাই পাকিস্তান হাসেল সম্ভব হয় এবং ইহার দ্বারা প্রতিক্রিয়াশীল ইংরেজি সাম্রাজ্যবাদের খুঁটি নওয়াব, স্যার, খান বাহাদুর ও খান সাহেবদের অশুভ প্রভাব হইতে মুসলিম লীগকে মুক্ত কয়া সম্ভব হয়। সাংগঠনিক তৎপরতার অন্যতম পদক্ষেপ হিসাবে তিনি ১৯৪৪ সালের ১২ এপ্রিল তরুণ নেতা শামসুল হকের সুযোগ্য কর্তৃত্বাধীনে ঢাকায় ১৫০ নং মোগলটুলীর থ্বিতল ও ত্রিতলে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবির প্রতিষ্ঠা করেন। ইহাতে সার্বক্ষণিক কর্মীদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল।

ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ ঢাকা নওয়াব বাড়ির কুক্ষিগত ছিল। রক্ষণশীলতার দুর্গ ঢাকায় নওয়াৰ বাড়িতে ১৯৪৪ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ নির্বাচনে কর্মী শিবির মনোনীত প্রার্থী মানিকগঞ্জের আওলাদ হোসেন বিশ্বাস ও মুন্সীগঞ্জের কপর্দকহীন তরুণ নেতা শামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা নওয়াব বাড়ি মনোনীত প্রার্থীগণের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হইয়া নূতন চিন্তাধারার জয়যাত্রা সূচনা করেন। দ্বিতীয়তঃ ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসের সাধারণ নির্বাচনে মনোনয়ন দানকল্পে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই উপলক্ষে কলিকাতার মুসলিম ইনষ্টিটিউট হলে লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়; উহাতে হাসান ইস্পাহানীর ইংরেজি দৈনিক স্টার অব ইন্ডিয়া, খাজা নূরুদ্দিনের ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ ও মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর বাংলা দৈনিক আজাদ প্রভূতি পত্রিকার একচেটিয়া বিরোধিতা সত্ত্বেও দার্শনিক আবুল হাশিমের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ তরুণ সম্প্রদায়ের একান্ত প্রচেষ্টায় পাঁচটি আসনে শহীদ-হাশিম জোট জয়লাভ করে। ভারতবর্ষ ও বঙ্গদেশ বিভক্তির পর খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববঙ্গে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পূর্ববঙ্গ আগমনের পর সাবেক প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটির পূর্ববংগীয় সদস্যবর্গ ও আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সিলেট জেলার সদস্যবৃন্দ সহযোগে পূর্ববঙ্গ লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়। ইহাতে আসাম প্রদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান (ভাসানী), সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ও দেওয়ান বাসেত সদস্য নিযুক্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু ব্যাপার বিশেষ সুবিধাজনক মনে না হওয়ায় পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ভাঙ্গিয়া দিয়া মওলানা আকরম খাঁ চেয়ারম্যান, জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী ও জনাব আসাদুল্লাহকে যুগ্ম আহ্বায়ক, ডা আব্দুল মোতালেব মালিক ও সর্বজনাব আহমদ হোসেন (রংপুর), নুরুল আমিন, মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও সিলেটের মনোয়ার আলীকে সদস্য করিয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি পুনর্গঠন হইল। ইতিমধ্যে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ই ডিসেম্বর রাতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পাকিস্তান এলাকাভুক্ত কাউন্সিল সদস্যদের সমন্বয়ে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠিত হয়।

শহীদ হাশিম জোট সমর্থক মুসলিম লীগ ও ছাত্র কর্মীবৃন্দ কলিকাতা ও অন্যান্য স্থান হইতে ঢাকায় আসিয়া ১৫০ নং মোগলটুলীস্থ পূর্ববংগ মুসলিম লীগ কর্মী শিবিরের শক্তি বৃদ্ধি ও ইহাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে লাগিলেন। উজীরে আলা খাজা নাজিম-আকরম খাঁ জোট ১৫০ নং মোগলটুলী কর্ম শিবির বা ওয়ার্কার্স ক্যাম্প মুসলিম লীগের রাজনৈতিক অংগন হইতে বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাই বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড নায়েব সালারে সুবা জহির উদ্দিন আহমদকে উজীরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিন প্রথমে কারাগারে প্রেরণ ও পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গ হইতে বহিষ্কার করিলেন। রাজনীতি আর কাহাকে বলে! ওয়ার্কারস ক্যাম্পের তরফ হইতে কর্মী শিবিরের তরুণ নেতৃবর্গ যথা শামসুল হক, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুস সবুর খান, আতাউর রহমান খান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, শেখ মুজিবর রহমান, কামরুদ্দিন আহমদ ও মিসেস আনোয়ারা খাতুন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কমিটি চেয়ারম্যানের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ রসিদ বই সরবরাহ করতে অনুরোধ জানাইলেন। মাওলানা আকরম খাঁ অনুরোধ রক্ষা করিতে অস্বীকৃতি জানাইলে নারায়ণগঞ্জ রহমতুল্লাহ ইনষ্টিটিউটে মুসলিম লীগ কর্মীদের সম্মেলন আহ্বান করা হয়। খান সাহেব ওসমান আলী এম,এল,এ,-কে সভাপতি নির্বাচিত করিয়া একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। রহমতুল্লাহ ইনষ্টিটিউট ব্যবহারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হইলে সম্মেলন পাইকপাড়া ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে স্থির হয় যে, সর্ব জনাব আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, খয়রাত হোসেন এম,এল,এ, ও মিসেস আনোয়ারা খাতুন করাচি মুসলিম লীগ প্রধান চৌধুরী খালেকুজ্জামানের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। প্রকৃতপক্ষে জনাব আতাউর রহমান খান ও আনোয়ারা খাতুন করাচি গেলেন; চৌধুরী খালেকুজ্জামান প্রতিনিধিদ্বয়ের বক্তব্য আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করিলেন বটে তবে প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহে রসিদ বই সরবরাহ করিবার ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করিতে অস্বীকৃতি জানাইলেন। মুসলিম লীগ আকরম খাঁ-নাজিম চক্রের কুক্ষিগত হইল। এইভাবেই নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল যুব সম্প্রদায় মুসলিম লীগ সংগঠনে অপাংক্তেয় ও অবাঞ্ছিত হইয়া পড়িলেন। বলিতে ভুলিয়াছি, ইতিমধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৯শে অক্টোবর মাওলানা আকরম খাঁ সাহেবের নিজস্ব দৈনিক আজাদ পত্রিকা ঢাকায় স্থানান্তরিত ও প্রকাশিত হইয়াছিল এবং আজাদ উহার নিজস্ব ধারায় প্রচারকার্য চালাইয়া যাইতেছিল। যদিও দৈনিক আজাদ ব্যক্তি মালিকানাধীন পত্রিকা তথাপি আজাদ কর্তৃপক্ষ পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে জমিজমাসহ সকল প্রকার সরকারি মদদ লাভ করিয়াছিলেন। এটাই আমাদের চরিত্রের নমুনা।

রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনে যোগদান

যাহা হউক, এই সম্মেলনকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য জনাব শওকত আলীর আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল অতুলনীয়। মুসলিম লীগ সরকারের ভয়-ভীতি, ত্রাস ও নির্যাতনকে উপেক্ষা করিয়া সম্মেলনে সহযোগিতা করিতে অনেক সহৃদয় ঢাকাবাসী সক্রিয়ভাবে অগ্রসর হইতে সাহস পান নাই। এমনকি সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য কোন পাবলিক হল পর্যন্ত ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় নাই। জনাব কে, এম, বশীর তাহার কে,এম,দাস লেনস্থ বাসভবন রোজ গার্ডেনের হল কামরায় সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুমতি দানের সৎসাহস প্রদর্শন করেন। তিনি সরকারি ভ্রুকুটী উপেক্ষা করিয়া আগাইয়া না আসিলে সরকারি লীগ পান্ডাদের হামলায় সম্মলন হয়ত বা তছনছ হইয়া যাইত। তদানীন্তন বিরাজমান স্বৈরাচারী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশের স্মৃতি যতই মানসপটে আসিয়া উঠে ততই তখনকার মত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য জনাব বশীরকে কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করি।

                ২৩শে জুন (১৯৪৯) যথারীতি রোজগার্ডেন’ হল কামরায় সম্মেলন শুরু হয়। প্রায় ২৫০ হইতে ৩০০ জন ডেলিগেট ইহাতে যোগ দেন। অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান মওলানা আবদুল হামিদ খান (ভাসানী)-এর লিখিত ভাষণ পাঠের পর সম্মেলনের মূল সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সম্মেলনে শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হকও যোগ দেন এবং কয়েক মিনিট বক্তৃতা দিয়া সম্মেলনকক্ষ ত্যাগ করেন। হয়ত তাহার ভয় ছিল, পাছে না সরকারি আনুকুল্য হইতে বঞ্চিত হইয়া পড়েন অর্থাৎ উজীরে আলা নূরুল আমিন সরকারের এডভোকেট জেনারেল পদ হারাতে হয়।

পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন

সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করিবার প্রস্তাব উত্থাপিত হইলে আমি জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল নাগরিকের প্রবেশাধিকার দিয়া সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন করিবার প্রস্তাব করি। নারায়ণগঞ্জের তরুণ নেতৃদ্বয় সর্বজনাব আলমাস আলী ও আবদুল আওয়াল প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়া আমার উপর রোষে ফাটিয়া পড়েন। দেখা গেল, আমরা কতিপয় ছাত্র ব্যতীত আর সকলেই আওয়ামী মুসলিম লীগ নামকরণের ঘোর পক্ষপাতী। তাঁহাদের যুক্তি, আমরা সকলেই আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মী। আকরাম খাঁ, নূরুল আমিন, চৌধুরী খালেকুজ্জামান ও লিয়াকত আলী পরিচালিত মুসলিম লীগ হইল সরকারি মুসলিম লীগ এবং আমাদেরটি হইবে আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ। ঢাকা হাইকোর্টে জনাব দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কর্পাস মামলা পরিচালনার জন্য জনাব সোহরাওয়ার্দী যখন ঢাকায় আসিয়াছিলেন, তখনই তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নেতা মানকী শরীফের পীর সাহেবের অনুকরণে সংগঠনের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ রাখার পরামর্শ দিয়াছিলেন। স্মর্তব্য যে, জনাব সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তান গণপরিষদে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য। বিরোধবশতঃ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান স্বয়ং উদ্যোগী হইয়া ১৯৪৮ সালের শেষার্ধে জনাব সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল ঘোষণা করেন। অথচ এই দিকে ভারত সরকার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবশতঃ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নিকট ৬৭ লক্ষ টাকা আয়কর দাবি করিয়াছিলেন। ভারতে তাহার ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্ট বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। এমন তাহার মোটর গাড়ি পর্যন্ত ছিনাইয়া লওয়া হইয়াছিল। এইভাবেই বাস্তহারা সোহরাওয়ার্দীকে ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে ভারত ভূমি ত্যাগ করিয়া কপর্দকহীন অবস্থায় লাহোর আসিতে হইয়াছিল। যাহা হউক, জনাব সোহরাওয়ার্দীর আসনে উপনির্বাচন ঘোষণা করা হইল এবং এই উপনির্বাচনে জনাব সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিবাসী জনাব শহীদুল হকের নিকট পরাজয় বরণ করেন। উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের মুসলিম লীগ সদস্যগণই ছিলেন এই উপনির্বাচনের নির্বাচক মন্ডলী। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার এতকাল যাবৎ সরকার বিরোধী রাজনীতিতে যে সংগঠনিক শূন্যতা বিরাজ করিতেছিল, তাহা বিদূরিত হইল। বিশেষ করিয়া বিভাগ পূর্ব আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান (ভাসানী) ও টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে সদ্য নির্বাচিত তরুণ নেতা জনাব শামসুল হক যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করায় আপামর জনতার মধ্যে আস্থার ভাব পরিলক্ষিত হইল। সর্বোপরি, এই নব গঠিত সংগঠনের সহিত জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একাত্মতা তাহাকে মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের বিকল্প সর্ব-পাকিস্তানী নেতারূপে উপস্থাপিত করিল।

এই দিকে জনাব সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে মানকী শরীফের পীরের নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সহিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যোগসূত্র সৃষ্টির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ায়, সংগঠন নিখিল পাকিস্তানী চরিত্র ও মর্যাদা লাভ করিতে শুরু করিল। এই বাস্তব পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক নামের জন্য যদিও আমি আওয়ামী মুসলিম লীগের সদস্য হইতে অস্বীকৃতি জানাইয়াছিলাম তথাপি ইহার সহযোগী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক রুপে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিটি কর্মসূচীকে সফল করতে সর্বপ্রকার সক্রিয় সহযোগিতা করিয়াছি।

যাহা হউক, সম্মেলনে নিম্নলিখিত নেতৃবর্গসহ চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট অর্গানাইজিং কমিটি গঠিত হইল:

মওলানা আবদুল হামিদ খান (ভাসানী)                                                    সভাপতি

আতাউর রহমান খান, এডভোকেট                                                        সহ-সভাপতি

সাখাওয়াত হোসেন, প্রেসিডেন্ট, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স                               সহ-সভাপতি

আলী আহমদ খান, এম.এল,এ.                                                                সহ-সভাপতি

আলী আমজাদ খান, এডভোকেট                                                            সহ-সভাপতি

আবদুস সালাম খান, এডভোকেট                                                           সহ-সভাপতি

শামসুল হক                                                                                             সাধারণ সম্পাদক

শেখ মুজিবুর রহমান                                                                               যুগ্ম সম্পাদক

খন্দকার মোশতাক আহমদ                                                                  সহ-সম্পাদক

এ,কে,এম, রফিকুল হোসেন                                                                   সহ-সম্পাদক

ইয়ার মোহাম্মদ খান                                                                            কোষাধ্যক্ষ

উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবর রহমান কারাগারে আটক থাকার দরুন উক্ত সম্মেলনে যোগদান করিতে পারেন নাই। আমরা জনকয়েক সদ্য কারামুক্ত ছাত্রের প্রস্তাবেই তাহাকে একমাত্র যুগ্ম সম্পাদক করা হইয়াছিল।

২৪শে জুন অপরাহ্নে সরকারি লীগের হুমকি ও হামলা উপেক্ষা করিয়া আরমানিটোলা ময়দানে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে নব গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম প্রকাশ্য সভা অনুষ্ঠিত হয়।

জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে আজাদী লাভের পর জাতীয় কংগ্রেস পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ও পাকিস্তান গণপরিষদের বিরোধী দলীয় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পরিষদের বাহিরে অবস্থার বিপাকে পড়িয়াই কংগ্রেস হিন্দু সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষায় জড়িত হয়ে পড়ে। কংগ্রেসে নেতৃত্ব ও কাঠামো স্বাভাবিকভাবেই ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। এইদিকে ভারত বিভাগ জনিত কারণে পাক-ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গুণগত যে পরিবর্তন দেখা দেয়, উহার ফলে সেই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করিয়া পাকিস্তানের মাটিতে, তাহাদের পক্ষে প্রকাশ্যে কার্যকর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা যে একরূপ অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল, তাহা স্বীকার করিতে হইবে।

কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা ছিল কিছুটা ভিন্ন। সাধারণ সম্পাদক পূরণ চন্দ্র যোশীর (পি,সি, যোশী) পরিচালনায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আজাদী লাভের পর অর্থাৎ ইংরেজ কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তরের পর পাক-ভারত উভয় সরকারকে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমর্থনদানের নীতি ঘোষণা করে। সরকারের সহিত সহযোগিতার নীতির আড়ালে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত হইতে কমরেড ভবানী সেন ঢাকা আগমন করেন এবং কোন মহল হইতে বাধাপ্রাপ্ত না হইয়াই ঢাকার সদরঘাটস্থ করনেশন পার্কের এক জনসভায় বক্তৃতা দেন। এমন কি কমরেড মোজাফফর আহমদ কলকাতা হইতে আসিয়া ঢাকার রথ-খোলার ন্যাশনাল বুক এজেন্সীর দ্বারোদঘাটন করেন। গোল বাধিল কলকাতায় ১৯৪৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের পর। এই অধিবেশনেই কমরেড ভালচন্দ্র ত্রিথৃক রনদিভের (ভি,টি, রনদিভ) তত্ত্ব অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টি সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদের মূলোচ্ছেদ, ইংগ-মার্কিন সরকারথয়ের দোসর ধনিক-বণিক, ভূস্বামী প্রতিভু পাক-ভারত সরকারকে উচ্ছেদ করার প্রয়োজনে সমাজতান্ত্রিক সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠনের আহ্বান জানায়।

এই দিকে ভারতীয় উত্তর প্রদেশবাসী কমরেড সাজ্জাদ জহিরকে সম্পাদক নিযুক্ত করিয়া পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। কমিউনিস্টদের নবদীক্ষা “ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনছান ভূখা হ্যায়” পাক-ভারত সরকারদ্বয়কে ক্ষিপ্ত করিয়া তুলে। ইহারই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ঢাকায় ১১ মার্চ (১৯৪৮) কমিউনিস্ট পার্টি কাপ্তানবাজারে অবস্থিত কেন্দ্রীয় দফতর ও কোর্ট হাউস স্ট্রিটে অবস্থিত ঢাকা নগর দফতরের উপর জনতার আক্রমণে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন, ছাত্র ফেডারেশন, শ্রমিক সংগঠন, রেল রোড ওয়ার্কাস ইউনিয়ন ও কৃষক সংগঠন এবং কিযাণ সভার বহ কর্মী সশস্ত্র পথে সরকার উৎখাত করিবার নীতির প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুন অপরাহ্নে সদরঘাটস্থ করনেশন পার্কে সুসাহিত্যিক মুনির চৌধুরীর সভাপতিত্বে কমিউনিস্ট পার্টি আহুত জনসভা অনুষ্ঠিত হয়; কিন্তু জনতার আক্রমণে ভীত সন্ত্রস্ত কমিউনিস্ট কর্মী স্ব স্ব-প্রাণ বাঁচাইবার প্রয়াসে সভাস্থল থেকে উর্ধ্বশ্বাসে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন। সরকার সমর্থক মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান বীরদর্পে ৰক্তৃতা মঞ্চে আরোহণ করিয়া জনতার উদ্দেশে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দান করেন। এইভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক বলিয়া অভিযুক্ত কমিউনিস্ট পার্টি কর্মীবৃন্দ ধীরে ধীরে প্রকাশ্য কর্মসূচী বর্জন করিয়া গোপন সংগঠনের দিকে মনোনিবেশ করে।

আত্মগোপন অবস্থায় কমরেড মনি সিংহ ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার অন্তর্গত দুর্গাপুর অমুসলমান হাজং এলাকায়, কমরেড ইলা মিত্র রাজশাহী জেলার নওয়াবগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত মুসলমান সাঁওতাল সম্প্রদায় অধ্যুষিত নাচোল এলাকার, কমরেড সুব্রত পাল সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার অন্তর্গত অমুসলমান, নমঃশূদ্র ও দাস সম্প্রদায় অধ্যুষিত সানেশ্বর এলাকায়, পার্টি নেতৃত্ব খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও মুসলমান নমঃশূদ্র প্রধান ধানমুনিয়া এলাকায়, যশোর জেলার সদর মহকুমা ও নড়াইল মহকুমা ভুক্ত বামাপাড়া ও নড়াইল থানা অন্তর্গত জামদিয়া, সেখাটি, তুলারামপুর, নড়াইল ও কলোরা ইউনিয়নগুলির মুসলমান নমঃশূদ্র এলাকায় সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থান ঘটায়। এই ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক অন্ধ পাকিস্তান বিদ্বেষকে মূলধন করিয়া পার্টি কমরেডগণ শ্রেণি সংগ্রামের ভাওতা ও দোহাই দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটাইবার বহু চেষ্টা করিয়াছে। রূঢ় হইলেও বাস্তব সত্য এই যে, কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা আশি হইতে পঁচাশি জন মুসলিম অধিবাসীর বিন্দুমাত্র আস্থা অর্জন করিতে পারে নাই।

উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক কমরেড সাজ্জাদ জহির সশস্ত্র বিপ্লবের কদর্য করিয়া সরকার উৎখাতের উন্মুক্ততায় সামরিক বাহিনীতে উচ্চাভিলাষী সমর নেতাদের চক্রান্তের সহিত জড়াইয়া পড়েন এবং মেজর জেনারেল আকবর খানের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাইবার চেষ্টা করেন; জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন এই ধরনের উগ্র ও বিকৃত মানসিকতা দেখা দেওয়া মোটেও বিচিত্র নয়। এইভাবে ভুল কর্মসূচী গ্রহণের ফলে সম্ভাবনাময় কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন গণসংগঠন যদিও ভাঙ্গিয়া চুরমার হইয়া গেল তবুও তাহাদের সংগ্রামের ফলে সৃষ্ট সাধারণ সরকার বিরোধী মনোভাব আওয়ামী লীগ সংগঠনকে অগ্রযাত্রায় বহুলভাবে সহায়তা করিয়াছিল।

ইলা মিত্রের জবানবন্দি

তখনকার দিনে ধৃত কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠন, কর্মী ও সমর্থকদের উপর কিরূপ পাশবিক দৈহিক নির্যাতন করা হইত। নাচোল এলাকার সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহের নেত্রী কমরেড ইলা মিত্রের উপর অকথ্য দৈহিক নির্যাতন উহার একটি লোমহর্ষক নিদর্শন। ১৯৫০ সালের ৫ই জানুয়ারি সাঁওতাল কৃষক ও পুলিশ সংঘর্ষে তিনজন মুসলমান ও একজন হিন্দু পুলিশ নিহত হয়। ঐ কারণেই ৭ই জানুয়ারি রোহনপুর স্টেশনে ইলা মিত্র গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর পুলিশ ইলা মিত্রের উপর অকথ্য অত্যাচার করে। স্পর্শকাতর ও ক্ষুব্ধ মনের তাড়নায় আমি সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে ইলা মিত্রের রাজশাহী কোর্টে দেযইয়া জবানবন্দিটি ঢাকার ঠাটারীবাজার মনমোহন প্রেস হইতে অতি গোপনে ইস্তেহার আকারে ছাপাইয়া সম্ভর্পণে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র বিলির ব্যবস্থা করি। মূল জবানবন্দি ইংরেজি ছিল। ইংরেজি ও উহার বঙ্গানুবাদ আমি উক্ত প্রেস হইতেই ছাপাই। অন্য কোন প্রেস মালিক মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ে ইহা ছাপাইতে রাজী হয় নাই। মনোমোহন বাবু সর্বপ্রকার ঝুঁকি লইয়াই কাজটি করিয়াছিলেন। তিনি তখনকার মত পরিস্থিতিতে যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়াছেন, আমি অদ্যাবধি কৃতজ্ঞতার সহিত তাহা স্মরণ করি।

ইস্তেহারটির বিবরণ

“কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিগত ৭-১-৫০ তারিখে আমি রোহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোলে লইয়া যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধর করে এবং তাহার পর আমাকে একটি সেলের মধ্যে লইয়া যাওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার না করিলে আমাকে উলঙ্গ করিয়া দেওয়া হইবে এই বলিয়া এস,আই, আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলিবার মত কিছু ছিল না, কাজেই তাহারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলিয়া নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গতাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করিয়া রাখে।

আমাকে কোন খাবার দেওয়া হয় নাই, একবিন্দু জল পর্যন্তও না। সেইদিন সন্ধ্যা বেলাতে এস,আই-এর উপস্থিতিতে সিপাইরা তাহাদের বন্দুকের বাট দিয়া আমার মাথায় আঘাত করিতে শুরু করে। সেই সময় আমার নাক দিয়া প্রচুর রক্ত পড়িতে থাকে। ইহার পর আমার কাপড়-চোপড় আমাকে ফেরত দেওয়া হয় এবং রাত্রি প্রায় বারোটার সময় সেল হইতে আমাকে বাহির করিয়া সম্ভবতঃ এস,আই-এর কোয়ার্টারে লইয়া যাওয়া হয়। তবে এই ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম না।

যে কামরাটিতে আমাকে লইয়া যাওয়া হইল, সেইখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তাহারা নানারকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালাইল। দুইটি লাঠির মধ্যে আমার পা দুইটি ঢুকাইয়া চাপ দেওয়া হইতেছিল এবং সেই সময় আমার চারি ধারে যাহারা দাঁড়াইয়াছিল তাহারা বলিতেছিল যে, আমাকে “পাকিস্তানি ইনজেকশন দেওয়া হইতেছে। এই নির্যাতন চলিবার সময় তাহারা একটি রুমাল দিয়া আমার মুখ বাঁধিয়া দিয়াছিল। জোর করিয়া আমাকে কিছু বলাইতে না পারিয়া তাহারা আমার চুলও উপড়াইয়া ফেলিয়াছিল। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করিয়া সেলে ফিরাইয়া লইয়া গেল, কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব ছিল না। সেলের মধ্যে আবার এস,আই, সিপাইদিগকে চারটি গরম সিদ্ধ ডিম আনিবার হুকুম দিল এবং বলিল “এইবার সে কথা বলিবে।” তাহার পর চার পাঁচজন সিপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরিয়া চিৎ করিয়া শোয়াইয়া রাখিল এবং একজন আমার যৌন অঙ্গের মধ্যে একটি গরম সিদন্ধ ডিম ঢুকাইয়া দিল। আমার মনে হইতেছিল, আমি যেন আগুনে পুড়িয়া যাইতেছি, ইহার পর আমি জ্ঞান হইয়া পড়ি।

৯-১-৫০ তারিখের সকালে যখন আমার জান হইল, তখন উপরোক এস,আই, এবং কয়েকজন সিপাই আমার সেলে আসিয়া তাহাদের বুট দ্বারা আমার পেটে লাথি মারিতে শুরু করিল। ইহার পর আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে পেরেক ফুটাইয়া দেওয়া হইল। সেই সময় আধা অচেতন অবস্থায় পড়িয়া থাকিয়া আমি এস,আই,কে বিড় বিড় করিয়া বলিতে শুনিলাম, ‘আমরা আবার রাত্রে আসিতেছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করে তাহা হইলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করিবে। গভীর রাত্রিতে এস,আই, এবং সিপাইরা ফিরিয়া আসিল এবং পুনরায় সেই হুমকি দিল। কিন্তু আমি যেহেতু তখনো কিছু বলিতে রাজী হইলাম না, তখন তিন-চারজন আমাকে ধরিয়া রাখিল এবং একজন সিপাই সত্যি সত্যি আমাকে ধর্ষণ করিতে শুরু করিল। ইহার অল্পক্ষণ পরই আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম।

পরদিন ১০-১-৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরিয়া আসিল তখন আমি দেখিলাম যে, আমার দেহ হইতে দারুণভাবে রক্ত ঝরিতেছে এবং আমার কাপড়-চোপড় রক্তে সম্পূর্ণ ভিজিয়া গিয়াছে। সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল হইতে নবাবগঞ্জ লইয়া যাওয়া হইল। নবাবগঞ্জ জেলগেটের সিপাইরা জোরে ঘুষি মারিয়া আমাকে অভ্যর্থনা জানাইল।

সেই সময় আমি একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলাম। কাজেই কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন সিপাই আমাকে একটি সেলের মধ্যে বহন করিয়া লইয়া গেল। তখনও আমার রক্তপাত হইতেছিল এবং বেশ জ্বর ছিল। সম্ভবতঃ নবাবগঞ্জ সরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তার সেই সময় জ্বর দেখিয়াছিলেন ১০৫ ডিগ্রী। যখন তিনি আমার কাছে আমার দারুণ রক্তপাতের কথা শুনিলেন, তখন তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, একজন মহিলা নার্সের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হইবে। আমাকে কিছু ঔষধ এবং কয়েক টুকরা কম্বল দেওয়া হইল।

১১-১-৫০ তারিখে সরকারি হাসপাতালে নার্স আমাকে পরীক্ষা করিলেন। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়াছিলেন, সেইটি আমি জানি না। তিনি আসিবার পর আমার পরণে যে রক্তমাখা কাপড় ছিল তাহা পরিবর্তন করিয়া একটি পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হইল। এই সময়টিতে আমি নবাবগঞ্জ জেলের একটি সেলে একজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব জ্বর ছিল। তখনো আমার দারুণ রক্তপাত হইতেছিল এবং মাঝে মাঝে আমি অজ্ঞান হইয়া যাইতেছিলাম।

১৬-১-৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটি স্ট্রেচার লইয়া আসা হইল এবং আমাকে বলা হইল যে, পরীক্ষার জনা আমাকে অন্য জায়গায় যাইতে হইবে। খুব বেশি শরীর খারাপ থাকিবার জনা আমার পক্ষে নড়াচড়া করা সম্ভব নয়, এই কথা বলায় লাঠি দিয়া আমাকে আঘাত করা হইল এবং স্ট্রেচারে উঠিতে আমি বাধ্য হইলাম। ইহার পর আমাকে অন্য এক বাড়িতে লইয়া যাওয়া হইল। আমি সেইখানে কিছুই বলি নাই, কিন্তু সিপাইরা জোর করিয়া একটি সাদা কাগজে আমার সই আদায় করিল। তখন আমি অর্ধচেতন অবস্থায় খুব বেশি জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু আমার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাইতেছিল সেইজন্য পরদিন আমাকে নবাবগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হইল। ইহার পর যখন আমার শরীরের অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হইল, তখন আমাকে ২১-১-৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ হইতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আনিয়া সেইখানকার জেল হাসপাতালে ভর্তি করিয়া দেওয়া হইল।

কোন অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলি নাই এবং উপরে যাহা বলিয়াছি তাহার বেশি আমার আর বলিবার কিছু নাই।”

ইলা মিত্রের জবানবন্দি এখানেই শেষ। উল্লেখ্য যে, ৫ই জানুয়ারি (১৯৫০) সাঁওতাল চাষীরা জোরপূর্বক জোতদারদের জমির ধান কাটিতে গেলে স্থানীয় নাচোল থানার এ,এস,আই, তফিজুদ্দিন আহমদ কয়েকজন কনেস্টেবলসহ অকুস্থলে গমন করেন। সংঘর্ষের পরিণামে সাঁওতাল ঢাষীরা সশস্ত্র বিপ্লবের বিভিন্ন ধ্বনি দিতে দিতে এ,এস,আই, তফিজুদ্দিন ও তিনজন কনেষ্টেবলকে আক্রমণ করে। সাঁওতাল চাষিরা রাইফেল কাড়িয়া লইয়া তাহাদিগকে হত্যা করিয়া মাটির নীচে পুঁতিয়া রাখে। ঘটনার পরই কমরেড ইলা মিত্রের স্বামী কমরেড হাবুল মিত্র সীমান্ত পার হইয়া পশ্চিমবঙ্গ পলায়ন করেন এবং ৭ই জানুয়ারি (১৯৫০) সাঁওতাল বেশে রোহনপুর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকাকালে কমরেড ইলা মিত্র গ্রেফতার হন।

উপরে বর্ণিত অত্যাচার ও নির্যাতন হইতেই প্রতীয়মান হয় যে, তখনকার দিনে কমিউনিস্ট পার্টি কর্মী বা সমর্থক হওয়া কত বড় ঝুঁকি ছিল। আগেই বলিয়াছি, ইহা ছিল নেতৃত্বের হঠকারী নীতির ফল। ইহার দরুন কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমশ দুর্বল ও নিস্তেজ হইয়া পড়িল। ১৯৫১ সালে পার্টি পলিসি পরিবর্তিত হইলেও পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি পূর্বদ্যোমে প্রকাশ্য রাজনীতি ও সংগঠন কখনো করিতে পারে নাই। তবে ইহা অনস্বীকার্য যে, কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃবর্গ অতি সীমিত শক্তি সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রগতিশীল গণআন্দোলনে সক্রিয় অবদান রাখিয়াছেন এবং এই ধরনের প্রতিটি গণআন্দোলনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করিয়াছেন।

ইয়ার মোহাম্মদের অবদান

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ অফিস ৯৪ নং নবাবপুর রোডে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান এর বাড়ি ১৮ নং কারকুন বাড়ি লেনেই নব গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সদর দফতর ছিল। সংগঠনের প্রাণ ও সভাপতি মওলানা ভাসানী স্বয়ং ইয়ার মোহাম্মদ খান সাহেবের গৃহেই তাঁর পরিবারের অন্যতম শ্রদ্ধাভাজন সদস্য হিসাবেই বসবাস করিতেন। ইয়ার ভাইয়ের স্ত্রী বৃদ্ধ মওলানা ভাসানীর সর্বপ্রকার পরিচর্যা করেছেন। দ্বিতলে সর্বক্ষণ অগণিত নেতা, কর্মী ও দর্শকদের আসা যাওয়ার ফলে ইয়ার ভাইয়ের পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। এইগুলি স্বচক্ষে দেখিয়াছি ও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিয়াছি; সেই যুগে ঢাকাবাসীদের পর্দানশীন অন্দরে পর-পুরুষের প্রবেশ কল্পনার অতীত। ইয়ার ভাই, তাহার স্ত্রী ও সন্তানেরা সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করিয়া যে উচ্চমন ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়াছেন, দেশ ও জাতি সম্মানের সহিত তাহাদের সেই ঐতিহাসিক অবদানকে স্বীকার করিবে। যে সমাজ ও যে জাতি পূর্বসূরীদের দান বেমালুম ভূলিয়া যায়, বা তাহাদের অবদান সম্পর্কে সচেতনতার পরিচয় দিতে পারে না, সেই জাতি সৌভাগ্য সোপানে আরোহণের উপযুক্ততাই হারাইয়া ফেলে এবং জাতি হিসাবেও বিশ্বসমাজে কখনও সম্মান পায় না। অতীত অগ্রযাত্রার পথে উৎসাহ জাগায় না। ইয়ার মোহাম্মদ খান অর্থ বিস্তশালী রাজনীতিবিদ। আর্থিক শক্তির অভাবে অনেক সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক আন্দোলন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান সাধ্যানুযায়ী আর্থিক সাহায্য দানে আওয়ামী লীগকে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচুর সাহায্য ও সহায়তা করিয়াছেন।

ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা

তদানীন্তন দৈনিক পত্রিকাগুলি কদাচিৎ সরকার বিরোধী সংগঠনের সংবাদ প্রকাশ করে এমনকি জনগণের বিভিন্ন সমস্যাও দৈনিক পত্রিকাগুলির পৃষ্ঠায় স্থান পাইত না। তাই, মওলানা ভাসানী সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ প্রকাশের অনুমতি নিলেন। জনাব আছগর হোসেন এম.এল.এ-এর ঢাকাস্থ ৭৭ নং মালিটোলা বাসস্থানে অবস্থিত ছাপাখানা হইতে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ১৫ আগস্ট (১৯৪৯) প্রকাশিত হয়। কিছুকাল পর ঢাকার কলতাবাজারে অবস্থিত করিম প্রিন্টিং প্রেস হইতে প্রকাশিত হইতে থাকে কিন্তু সরকারি হামলার ভয়ে মুদ্রণালয়গুলি সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ছাপাইতে অস্বীকার করিল। সুতরাং অনুমতি প্রার্থনাকালে মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর স্থলে জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান অত্র সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের প্রকাশক ও মুদ্রাকর হইলেন। ৯ নং হাটখোলা রোডে অবস্থিত প্যারামাউন্ট প্রেস হতে মুদ্রিত ও ৯৪ নং নবাবপুর রোড হইতে তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া)-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হইতে থাকে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ইয়ার মোহাম্মদ খান এই সরকার বিরোধী পত্রিকা ও আওয়ামী লীগের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের অর্থ যোগান দিতেন। সাপ্তাহিক ও দৈনিক ইত্তেফাকের আর্থিক সমস্যা মোকাবিলায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তদানীন্তন সেক্রেটারি (সচিব) জনাব আজগর আলী শাহ (আই,সি,এস, বা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস)-এর অবদান অপরিসীম। জনাব তফাজ্জল হোসেন কলিকাতা হইতে ঢাকা আগমন করিবার পর জনাব খয়রাত হোসেনকে সঙ্গে লইয়া ইয়ার মোহাম্মদ খানের সহিত দেখা করেন ও ইত্তেফাক পত্রিকার সমস্যাবলী সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। যেহেতু জনাৰ তফাজ্জল হোসেন পূর্বে কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন, সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাও উহার আছে; তদুপরি তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের গোঁড়া সমর্থক; সেহেতু আলোচনায় স্থির হয় যে, জনাব তফাজ্জল হোসেন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করিবেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান লিখিতভাবেই জনাব তফাজ্জল হোসেনকে উক্ত ক্ষমতা দান করেন। মওলানা ভাসানী ইহার প্রতিষ্ঠাতা ও জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশক ও মুদ্রাকর রহিয়া গেলেন। এইভাবে ১৯৫১ সালের ১৪ই আগস্ট জনাব তফাজ্জল হোসেন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক সম্পাদনার সর্বময় ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। অতঃপর তাহার সুযোগ্য সম্পাদনায় ও পরিচালনায় এবং সর্বজনাব আবদুল ওয়াদুদ, আবদুল আউয়াল ও নূরুল ইসলামের সক্রিয় সহায়তায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক জনপ্রিয় পত্রিকায় পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া এই জনপ্রিয় সাপ্তাহিক দৈনিক করিবার ব্যবস্থা গৃহীত হয় এবং সেই অনুযায়ী ১৯৫৩ সালের ২৪শে ডিসেম্বর ইত্তেফাক দৈনিক পত্রিকা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। মোজাম্মেল হক ও আবদুল কাদের দৈনিক ইত্তেফাকের জন্মলগ্ন হইতে তাহাদের অক্লান্ত শ্রমে ইহাকে দাঁড় করান। এই সময় প্যারামাউন্ট প্রেসের মালিক জনাব হাবিবুর রহমান তার নিজের কামড়াখানিও দৈনিক ইত্তেফাকের কাজের জন্য ছাড়িয়া দেন। উপরোক্ত ব্যবস্থাপনা অটুট থাকে। অর্থাৎ মওলানা ভাসানী ইহার প্রতিষ্ঠাতা, ইয়ার মোহাম্মদ খান ইহার নির্বাচনের অব্যবহিত পরই বোধহয় কোন কোন অবাঞ্ছিত মহলের প্ররোচনায় দৈনিক ইতেফাকের পৃষ্ঠায় প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু হয়। জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান এই অপতৎপরতার প্রতি সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেন এর দুষ্টি আকর্ষণ করেন। মওলানা ভাসানীর সংগ্রামী বিবৃতি ও বক্তৃতা যুক্তফ্রন্টের অনেকেরই চক্ষুশূল ছিল। তাই স্বার্থাম্বেণী গোষ্ঠার প্ররোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন উজিরে আলা (এপ্রিল-মে ১৯৫৪) শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নির্দেশে ঢাকা জিলার তনানীন্তন প্রশাসক সিলেট নিবাসী ইয়াহিয়া চৌধুরী ১৯৫৪ সালের ১৪ই মে গভীর রাত্রে অন্যায়ভাবে ইয়ার মোহাম্মদ খানের অজ্ঞাতসারেই সম্পাদক জনাব তফাজজল হোসেনকে ইত্তেফাকের প্রিন্টার ও পাবলিশার করিবার ব্যবস্থা করেন। ইহার পর হইতেই দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম মওলানা ভাসানী আর ‘প্রতিষ্ঠাতা’ রপে নয় বরং পৃষ্ঠপোষক হিসাবে স্থান পাইতে থাকেন। উল্লেখ্য যে, সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে মওলানা ভাসানী ও জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান ইত্তেফাকের উপর নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করেন নাই। এইদিকে কালের করালগ্রাসে দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম হইতে পৃষ্ঠপোষক মওলানা ভাসানীর নাম চিরতরে উধাও বা তিরোহিত হইয়া গেল। মওলানা ভাসানীর মত জনপ্রিয় দেশবরেণ্য নেতাকেই যখন নোংরা রাজনীতির চোরাগোপ্তা মায়ের নিকট হার মানিতে হয়, তখন দেশের সাধারণ মানুষ অর্থাৎ যারা ইত্তেফাকেরই ‘লুব্ধকের’ ভাষায় ‘আকালু শেখ’, তারা কোন ছার!

মওলানা ভাসানী, শামসুল হক এবং শেখ মুজিবের গ্রেফতার

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান (ভাসানী) ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হকের সুযোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের দোষত্রুটি জনসমক্ষে তুলিয়া ধরিবার কার্যে আত্মনিয়োগ করিল। খাদ্যাভাব দেখা দিলে, বাজারে খাদ্য দ্রব্যের চড়া দামের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা আরমানিটোলা ময়দানে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান সফরে ঢাকা আসিয়াছিলেন এবং ঢাকা গভর্নমেন্ট হাউসে অবস্থান করিতেছিলেন। লিয়াকত আলী খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার নিমিত্ত মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সভা হইতে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল গভর্নমেন্ট হাউস অভিমুখে রওয়ানা হয়। মাগরিবের নামাজের সময় মিছিলটি ঢাকা (ফুলবাড়িয়া) রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী নাজিরা বাজার রেলওয়ে ক্রসিং-এর নিকটবর্তী হইলে পুলিশ বাহিনী বাধা দান করে এবং কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি ব্যবহার করে। ঘটনাস্থলেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জনাব শামসুল হক ও আরো অনেকেই গ্রেফতার হইয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবদ্ধ হন। পুলিশের লাঠিচার্জে জনাব ওয়াদুদ ও জগন্নাখ কলেজের ছাত্র মফিজুল্লাহ গুরুতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে নীত হন। শেখ মুজিবুর রহমান ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের চোখে ধূলা দিয়া কাটিয়া পড়িলেন এবং গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকায় আত্মগোপন করিলেন। আত্মগোপনাবস্থায় সর্বজনাব আবদুল হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালাল উদ্দিন ও আমার সহিত মায়া সাহেবের খাজে দেওয়ান আস্তানায় তাহার রাজনৈতিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর জনাব সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশ গ্রহণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর পৌঁছান এবং তথায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক অবস্থা বয়ান করেন। উল্লেখ্য যে, লাহোর হইতে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান আত্মগোপনাবস্থায় পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। তাহাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে আটক রাখা হয়।

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে আতঙ্কিত হইয়া আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন ও সহ-সম্পাদক এ,কে,এম, রফিকুল হোসেন সংবাদপত্রে (দৈনিক আজাদে) বিবৃতি দিয়া আওয়ামী লীগ হইতে পদত্যাগ করেন। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অগ্রণী হইয়া আসা দূরে থাকুক বরং আওয়ামী মুসলিম লীগ সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান অধ্যয়নরত সম্তানদের দেখার অজুহাতে ঢাকা ত্যাগ করিয়া ভারতীয় আসাম প্রদেশের রাজধানী শিলং চলিয়া যান।

সাম্প্রদায়িক কলহ

ভারত বিভাগ হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক মনোভাব তিরোহিত করিতে ব্যর্থ হয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরই উভয় পাঞ্জাব রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর পূর্ব পাঞ্জাব হইতে মুসলমান জনতা ও পশ্চিম পাঞ্জাব হইতে হিন্দু জনতা স্ব-স্ব ভিটা-বাড়ি, জোতজমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও মান-ইজ্জত হারাইয়া যথাক্রমে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানে হিজরত করে। তদ্রুপ পূর্ববঙ্গ হইতে লক্ষ লক্ষ হিন্দু অধিবাসীও সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে এবং বাস্তহারা পরিচয়ে পরিচিত হয়। তেমনি বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য হইতে হাজার হাজার মুসলমান স্বীয় বাস্তভিটা ত্যাগ করিয়া পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। পাকিস্তান হিজরতকারী মোহাজের নামে পরিচিত হয়।

১৯৫০ সালে কলকাতায় ভারতীয় ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের আপত্তি ও উস্কানিমূলক বক্তৃতার পর পরই কলিকাতাসহ পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারী হারে মুসলিম নিধনযজ্ঞ আরম্ভ হয়। ইহারই প্রতিক্রিয়ায় ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় নারকীয় কাণ্ড-কাৱখানা শুরু হইয়া যায়। স্বচক্ষে দেখিয়াছি, হিন্দু-দরদী সাজিয়া হিন্দুদের সোনা-গহনা হিরা-জহরত, খাট-পালংক, ড্রেসিং টেবিল ও অন্যান্য মূল্যবান অস্থাবর সম্পত্তি কীভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে; কীভাবে স্থাবর সম্পত্তি জলের দরে বা ফাঁকির জালে একশ্রেণির মানুষের করায়ত্ত হইয়াছে। এই শ্রেণির মানুষের অনেকেই আবার প্রগতিশীল। পক্ষান্তরে উভয় দেশের রাজনৈতিক দল, নেতা ও কর্মীরা এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ও প্রতারণার জন্য দায়ী।

 বিভাগোত্তর সংখ্যালঘু সমস্যা

আমরা স্বল্প সংথ্যক তরুণ সাম্প্রদায়িক হত্যা বন্ধ করিবার প্রতীক্ষায় ১৯৫০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি সুপারিন্টেন্ড ইঞ্জিনিয়ার বাবু জে,সি, দাসের ৮ নং র‍্যাংকিন স্ট্রীটস্থ বাসভবনের সম্মুখ চত্বরে মহৎপ্রাণ নাগরিকদের এক সভা আহ্বান করি। উক্ত সভায় নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের সমম্বয়ে ঢাকা শান্তি রিলিফ কমিটি গঠিত হয়:

জনাব মোশাররফ হোসেন বি,সি,এস,                                                   সভাপতি

শ্ৰী জে,সি,দাস, সুপারিন্টেন্ড ইঞ্জিনিয়ার                                                          সহ-সভাপতি

জনাব মীর্জা আব্বাস, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট                                                         সহ-সভাপতি

(সাবেক ক্যাপটেন, কলিকাতা মোহামেডান স্পর্টিং)

জনাব হামিদুর রসুল, ট্যাক্সেশন কমিশনার                                          সহ-সভাপতি

জনাব অলি আহাদ                                                                                   সাধারণ সম্পাদক

উক্ত সভাতেই এই কমিটির একটি এক্সিকিউটিভ বডিও গঠিত হয়- ইহার সদস্য ছিল ১৩ জন। আমরা পশ্চিমবঙ্গ হইতে আগত উদ্বাস্তু পরীক্ষার্থী ছাত্রদের পরীক্ষার ব্যবস্থার জনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহিত সাক্ষাৎ করি। কর্তৃপক্ষ আমাদের উপরোক্ত দাবির যৌক্তিকতা মানিয়া নেন। সরেজমিনে অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে ভারত হইতে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ ও নিখিল ভারত কংগ্রেসের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদিকা মিস মৃদুলা সরাভাই এক শুভেচ্ছা মিশনে ঢাকা আগমন করেন। গুলিস্থানস্থ ঢাকা রেস্ট হাউসে আমরা ঢাকা শান্তি কমিটির তরফ হইতে তাহাদের সহিত এক সৌজন্য ও শুভেচ্ছা বৈঠকে মিলিত হই। মত বিনিময়কালে ডক্টর প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ আমাদের সান্ত্বনা ও উৎসাহ দানকল্পে বলেন “Determined minority rules the world’.

আমার সংঘাত ও ঝঞ্জাজর্জরিত জীবনে তাঁহার এই মন্তব্যটি আজও প্রতিনিয়ত আমার মনে সাহস ও ভরসা যোগায়। ইহাই বোধহয় মহৎ ও সৎ চরিত্রের যাদুকরী শক্তি। ডক্টর প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কালোবাজারী, মুনাফাখোর, বণিক শ্রেণি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারি দন্ড কঠোরভাবে ব্যবহার করিবার অপরাধে ধনিক বণিক ও অসৎ রাজনীতিবিদদের চক্রান্তে তাহাকে ১৯৪৮ সালের ১৫ই জানুয়ারি পদত্যাগ করিতে হয়। কায়েমী স্বার্থের যুপকাষ্ঠে সৎ শাসকদের যে কীভাবে বলী হইতে হয় ইহাই তাহার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বিচলিত লিয়াকত আলী খান সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠিয়া অর্থহীন মান-মর্যাদার প্রশ্ন ভুলিয়া স্বীয় উদ্যোগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সহিত বৈঠকে মিলিত হইতে দিল্লী গমন করেন। বৈঠকে উভয় দেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষাকল্পে লিয়াকত নেহেরু প্যাকট স্বাক্ষরিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের স্বার্থে ও দিল্লীর মুসলমানদের জানমাল ইজ্জত বাঁচাইবার জন্য মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৮ সালের ১লা জানুয়ারি হইতে ১৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত নেহরু সরকার ও হিন্দু দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে একটানা অনশন করিয়া স্বীয় দাবি আদায় করেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে মহাত্মাজী ও লিয়াকত আলী খানের এই উদ্যোগ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। গান্ধীজীর মত মহৎ প্রাণ ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি প্রার্থনা সভায় ধর্মান্ধ আততায়ীর হন্তে গুলীবিদ্ধ হইয়া প্রাণত্যাগ করেন। লিয়াকত আলী খানও নিহত হইয়াছিলেন ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে। এইভাবে যুগে যুগে বহু মহৎ প্রাণকে ধরাধাম ত্যাগ করিতে হইয়াছে।

১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিস্কৃত হইবার পর হইতেই আমার অগ্রজ ভ্রাতৃদ্বয় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য চাপ দিতেছিলেন। লন্ডনে “একচুয়ারী” পড়িতেও তাহারা পরামর্শ দিতেছিলেন। যে ভাই আমাকে রাজনীতি করিতে বাধা দিতেন না, সেই ভাই ডঃ এ, করিম তখন পি,এইচ,ডি করিতে বিদেশে অবস্থান করিতেছিলেন। ভাইদের পরামর্শ গ্রহণ করা আমার পক্ষে সদ্ভব হইল না। তাই অন্যায়ের প্রতিকার করিবার উদ্দেশ্যে রাজনীতি করিবার সংকল্প লইয়াই অবশেষে গৃহত্যাগ করি এবং অগ্রজসম তোয়াহা ভাইয়ের ঢাকার যোগীনগরস্থ বাসায় আশ্রয় লই। তোয়াহা সাহেবের স্ত্রী আমার প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও স্নেহ পরায়ণা ছিলেন। তাহার স্নেহের ঋণ শোধ করা আমার পক্ষে কথনো সম্ভব হইবে না।

দারুণ আর্থিক সংকটে বি.কম পরীক্ষা

বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হইলে ১৯৫০ সালে আমি বি,কম, পরীক্ষা দিবার সিদ্ধান্ত নিলাম। লজ্জায় কাহাকেও আর্থিক অনটনের কথা বলিতে পারি না। অবিভক্ত বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা জনাব এম,এ, জলিল আমার পরীক্ষার ফী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান দেন। মামুলী প্রশংসা স্তুতি বাক্য ব্যবহার করিয়া আজ তাহাকে আমি ছোট করিব না। ভারত বিভাগ পূর্ব বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের দার্শনিক বিপ্লবী নেতা আবুল হাশিম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও সুসাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস কর্তৃক সম্পাদিত সাপ্তাহিক মিল্লাত কলকাতার ওয়েলসলি ৩ নং স্ট্রীটস্থ ইস্টার্ন পাকিস্তান প্রিন্টিং প্রেস হইতে জনাব এম,এ,জলিল কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইত। মুসলিম লীগের বিপ্লবী প্রগতিশীল অংশের মুখপত্র ছিল সাপ্তাহিক মিল্লাত। সেইদিনকার মত সংকটাপন্ন সময়ে তাহার আর্থিক সাহায্য না পাইলে আমার বি.কম. পরীক্ষা বোধহয় দেওয়া সম্ভব হইত না। তিনি বলিতেন, রাজনৈতিক জীবনে পর্বত-প্রমাণ বাধা-বিপত্তি আসে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই রাজনৈতিক জীবনে অগ্রযাত্রা সম্ভব। তিনি আমাকে সর্বদাই সান্ত্বনা দিতেন; বলিতেন, ইহা দান নহে, ইহার দ্বারা আমি আমার রাজনৈতিক দায়িত্বই পালন করিতেছি।

কিছুকালের মধ্যেই আরেক সমস্যা দেখা দিল। তোয়াহা ভাই ও ভাবী আমার পরীক্ষার মাত্র কিছুকাল আগে তাঁহাদের গ্রামের বাড়িতে গেলেন। তাহাদের অনুপস্থিতিতে আমাকে অনেক দিন শুধু ছাতু ভিজাইয়া সেই ছাতুর নাড়ু খাইয়াই পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে হইয়াছে। পাশ্ববর্তী বাড়িতেই আবুল হাসনাত ও আবুল বরকত ভ্রাতৃদ্বয় থাকিতেন। তাহারা আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু; কিন্তু তাহাদের নিকট ইহা প্রকাশ করা আমার চরিত্রবিরুদ্ধ। বোধহয় আবুল বরকত কিছুটা আঁচ করে এবং আমাকে তাহার সহিত আহার করিতে অনুরোধ জানায়। আমি নানা কথার ফাঁকে তাহা এড়াইয়া যাই।

পরীক্ষার পড়াশোনা ব্যাপৃত। এমনি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ত্যাগী নেতা এম,এ,ওয়াদুদ ও ইব্রাহীম তাহা বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের সরকারি অপচেষ্টা বাধা দানকল্পে কর্মসূচী গ্রহণের জন্য আলোচনা করিতে আমার নিকট আসেন। আলোচনা মোতাবেক পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়া মধুর ক্যান্টিনে চা পানকালে শুনিতে পাই যে, বি.কম, পরীক্ষার তারিখ পিছাইবার জন্য একদল আড্ডাবাজ পরীক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করিতেছে এবং কর্তৃপক্ষও তাহাদের চাপে নতি স্বীকারের মনোভাব দেখাইতে শুরু করিয়াছেন। আমি মধুর ক্যান্টিন হইতে তৎক্ষণাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার জনাব আবদুল হাদী তালুকদারের সহিত সাক্ষাৎ করি এবং পূর্ব নির্ধারিত তারিখে পরীক্ষা গ্রহণ করিতে অনুরোধ জানাই। আমার যুক্তি ছিল; অধিকাংশ পরীক্ষায় ছাত্রকে গরীব বাপ-মায়ের অতি কষ্টে অর্জিত অর্থে পরীক্ষার কারণে ঢাকায় থাকিতে হয়। রেজিস্ট্রার হাদী সাহেব আমার মত সর্বক্ষণ আন্দোলনমুখী ছাত্রের এই অনুরোধ প্রথমে সহজভাবে নিতে পারেন নাই, অর্থাৎ বিশ্বাসই করেন নাই। যাহা হউক, আমার কয়েকটি যুক্তি শ্রবণ করিয়ে তিনি তার মুখে কঠোর ভাষায় বলিলেন, “যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহাকে কেন্দ্র করিয়া হট্টগোল হয়, তবে তাহার দায়িত্বও তোমাকেই বহন করিতে হইবে।”

পরদিন মধুর ক্যান্টিনে আড্ডাবাজ পরীক্ষার্থী ছাত্ররা আমাকে ঘিরিয়া ধরিল। তাহারা আমার নিকট হইতে পরীক্ষার তারিখ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিলে আমি অতি সহজ কষ্টেই জবাব দিলাম, আন্দোলন করি, জেল খাটি, শিক্ষালয় হইতে বহিস্কৃত হই, ক্ষতিটা সর্বাংশে আমার হয়। অতএব পরীক্ষা পিছাইবার দাবি করাটা আমার পক্ষেই স্বাভাবিক। আমার মত অধিকাংশ পরীক্ষার্থী ছাত্র পরীক্ষা নির্ধারিত তারিখে দিতে চায়। কারণ, প্রথমতঃ পরীক্ষা পিছাইবার কারণে গরীব ছাত্রদের বাপ-মায়ের স্বল্প আয়ের উপর বাড়তি বোঝা বর্তায়, দ্বিতীয়তঃ মেধাবী পরীক্ষার্থী ছাত্রদের সময়ের অপচয় হয়, তৃতীয়তঃ অনেকেই পরীক্ষার পর পরই পরিবারের প্রয়োজনে জীবিকার অন্বেষণে আত্মনিয়োগ করে। তাহারা আমার উক্তি ও যুক্তি শুনিয়া অস্বস্তিবোধ করিতেছে এবং নির্বাক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকাইতেছিল। যাহা হউক, পরীক্ষা পূর্ব নির্ধারিত তারিখেই যথারীতি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হইল। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর দেখিয়াছি মুজিবী শাসনামলে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার নামে কী জঘন্য ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। দুঃখের সাথেই অনুভব করিয়াছি, ভবিষ্যতে এইসব অশিক্ষিত ডিগ্রীধারী তৈরির জন্য জাতিকে অকল্পনীয় খেসারত দিতে হইবে। ইহাই ভবিতব্য, ইহার ব্যতিক্রম কোন কারণেই ঘটিবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আবুল ফজল সেই সময়ে বিবেককে বিক্রি না করিয়া দেশ ও জাতির স্বার্থে স্বীয় জীবনের ঝুঁকি লইয়াও শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ও শিক্ষার পরিবেশ ফিরাইয়া আনিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। শিক্ষাঙ্গনের সাধারণ একজন কর্ণধার হইয়াও সেই সময়ে মুজিব সরকারের সর্বনাশা মত ও নীতির বিরুদ্ধে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করিয়াছেন, জাতির অগ্রযাত্রায় তাহা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঢাকা আগমনঃ ১৪৪ ধারা জারি

আগেই বলিয়াছি, ১৯৪৯ সালে আরমানিটোলা জনসভা হইতে মিছিল সহকারে অগ্রসর হইবার কালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হকসহ অন্যান্য কর্মীরা গ্রেফতার হন। ইহার পর কিছুকালের জন্য রাজনৈতিক তৎপরতা স্তিমিত হইয়া আসে। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ বিরোধী দলীয় নেতাদের সর্বদা অশালীন ভাষায় আক্রমণ অব্যাহত রাখায় সক্রিয় বিরোধী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিতে কেহই সাহস পাইতেছিল না। একমাত্র ভরসা সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের পৃষ্ঠা। অর্থমন্ত্রী জনাব হামিদুল হক চৌধুরী ও উজীরে আলা নুরুল আমিন সাহেবের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ১৯৪৯ সালে ১৮, ১৯ ও ২০শে জুন কার্জন হলে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে উজীরে আলা নুরুল আমিনের বিরোধী গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়া উঠে। ইহারই কারণে দুর্নীতির অভিযোগে, পাবলিক অফিস (Public office Disqualification ordinance) ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডিন্যান্স বলে পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভা হইতে অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর অপসারণ ঘটে। ১৯৫০ সালে মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় হাতাহাতি ও মারামারির পর সংখ্যাগুরু নূরুল আমিন গ্রুপ জনাব হামিদুল হক চৌধুরী ও তাহার অদ্ধভক্ত জনাব মহিউদ্দিন আহমদকে মুসলিম লীগ সংগঠন হইতে বহিষ্কার করিয়া দেয়। ইহারই ফলে জনাব হামিদুল হক চৌধুরীর ইংরেজি দৈনিক “পাকিস্তান অবজার্ভার” (বর্তমানে বাংলাদেশ অবজার্ভার) সরকার বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

জনাব মহিউদ্দিন আহমদকে গ্রেফতার করিয়া কারাগারে আটক করা হয় এবং আপত্তিকর সম্পাদকীয় লেখার অভিযোগে ১৯৫২ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভারের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বিরোধী রাজনীতিকদের দেশপ্রেমের প্রতি কটাক্ষ করাই পাকিস্তানের সরকারি রাজনীতিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। তাই ক্ষমতা হইতে অপসারিত হইবার পর ১৯৬৭ সালে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের প্রকাশ্য মন্তব্য শুনিতে হইল যে, তিনি পাকিস্তানের নাগরিক নহেন। সরকারি দলের সৃষ্ট এই ধরনের ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই জনাব শামসুল হকের কারামুক্তি ঘটে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মীদের মনে নব বলের সঞ্চার হয়।

নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে জনাব শামসুল হকের পক্ষে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের মামলা পরিচালনার জন্য জনাব সোহরাওয়ার্দী ১৯ শে জুলাই (১৯৫০) ঢাকা আগমন করেন। বিমানবন্দর হইতে বিখ্যাত ব্যবসায়ী আরফান খানের তাঁতীবাজারের বাসভবনে পৌঁছিবার পরই মালপত্র রাখিয়া কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা জনাব সোহরাওয়ার্দীর সমভিব্যাহারে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে আয়োজিত জনসভায় যোগ দিতে উপস্থিত হই। এই সময়ে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ১৪৪ ধারা জারির আদেশ জনাব সোহরাওয়ার্দীকে দেখাইলেন। ফলে সমবেত লক্ষাধিক লোককে আশাহত হইয়া বাড়ি ফিরিতে হইল। জনাব সোহরাওয়া্দী জীপে আরমানিটোলা ময়দানে চতুর্দিকে ঘুরিয়া জনতার অভিনন্দন গ্রহণ করিলেন এবং জনতাকে এই মর্মে আশ্বাস দিলেন যে, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হইলে তিনি পুনরায় ঢাকা আসিবেন ও জনসভায় বক্তৃতা করিবেন। সেই মর্মস্পর্শী দৃশ্য আমার চোখে আজও সজীব। চিন্তা করুন, তখনকার দিনে বিরোধী দলীয় রাজনীতি কত কঠিন ছিল। নূরুল আমিন সরকার জনাব সোহরাওয়ার্দীর উপর ১৯৫০ সালের ১৯শে জুলাই এই মর্মে নোটিশ জারি করিলেন যে, আইন পেশাগত কার্য বহির্ভূত কোন রাজনৈতিক ক্রিয়াকাজে যেন তিনি অংশগ্রহণ না করেন এবং ২৮শে জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচনী মামলার কাজ শেষ হইবামাত্র তাহাকে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করিতে হইবে। তদানীন্তন লীগ শাহীর দাপটে জনাব সোহরাওয়ার্দী যখন এমনি অবস্থা, তখন আমাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

শিক্ষা সম্মেলন

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র বেতন বৃদ্ধির পরিকল্পনা, ১৯৪১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী প্রতি দুই হাজার লোকের জন্য ১টি প্রাইমারী স্কুল, বিভিন্ন বিদ্যাভবন হইতে ছাত্র বহিস্কার, বাংলা ভাষায় আরবী হরফ চালু করার নিমিত্ত সরকারি উদ্যোগ ও খরচে সতেরটি কেন্দ্র চালু, পূর্ববঙ্গ সরকারের জয়েন্ট সেক্রেটারি মিজানুর রহমান কর্তৃক প্রবর্তিত উর্দু বাংলা সংমিশ্রিত ভাষা সৃষ্টির উদ্ভট প্রচেষ্টা ইত্যাদির বিরুদ্ধে অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বন্ধ্যা শিক্ষানীতির ব্যাপারে সরকারকে সচেতন করার মানষেই আমরা ১৯৫০ সালের ১৫ ও ১৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন আহ্বান করি। আত্মগোপনকারী পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশন ও নিরপেক্ষ কর্মীরা এক বৈঠকে সম্মেলন উদযাপনের উদ্দেশ্যে আমাকে সভাপতি ও জনাব রুহুল আমিনকে সম্পাদক নির্বাচিত করিয়া একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করে। এমনি নুরুল আমিন সরকার সমর্থক নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সভাপতি জনাব আবদুস সামাদও এই অভ্যর্থনা কমিটিতে যোগ দেন। শিক্ষা সম্মেলনের সাফল্য কামনা করিয়া ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার’ সম্পাদক জনাব আবদুস সালাম, বাংলা দৈনিক ইনসাফ’ সম্পাদক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির (East Pakistan Journalists Association) সম্পাদক জনাব জহুর হোসেন চৌধুরী, সাপ্তাহিক সৈনিক সম্পাদক জনাব শাহেদ আলী ও দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার এর বার্তা সম্পাদক সৈয়দ নুরুদ্দিন আহমদ ১৯৫০ সালের ২৮শে আগস্ট এক যুক্ত বিবৃতি দেন। ১৫ই সেপ্টেম্বর অপরাহ্ন বেলা ২টা ৫০ মিনিটে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন আরম্ভ হয়। জনাব কামরুদ্দিন আহমদ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। সরকার সমর্থক কতিপয় ছাত্র সম্মেলনের উপর হামলা করে এবং পুলিশ বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে। যাহা হউক, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে আমরা পরদিন সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন সন্ধ্যা সাড়ে সাত ঘটিকায় ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে পুনরারম্ভ করি। সম্মেলনে চারশত প্রতিনিধি যোগদান করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবাবলীর ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনা করিবার নিমিত্ত এই সম্মেলনে গণশিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। এই গণশিক্ষা পরিষদ সেক্রেটারিয়েটের আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয় আমাকেই।

এম.কম. ক্লাসে ভর্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান

বি.কম, পরীক্ষার ফল প্রকাশ হইবার পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম,কম, ক্লাশে অধ্যয়নের অনুমতি চাহিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার অনুমতি প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে। সমগ্র দেশের শিক্ষিত শ্রেণি ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন। এমন কি প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার’ ব্ল্যাক মেইল’, (Blackmail) শিরোনামে দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে,

“A Student who has taken a rather prominent part in battle of the scripts and also in the B.P.C. movement has been denied admission into the University. That is tantamount to denying the possibility of acquiring high academic distinction to this boy who stood first in the examination leading to his graduation.”

অর্থাৎ “বর্ণমালার সংগ্রাম ও বি.পি.সি, আন্দোলনে যে শিক্ষার্থী বস্তুতঃ বিশিষ্ট অংশগ্রহণ করিয়াছে তাহাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইতে দেওয়া হয় নাই। ইহা গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করিয়াছে, এমন একজন তরুণকে উচ্চ শিক্ষালাভের সুযোগ হইতে বঞ্চিত করিবারই শামিল”

চট্টগ্রাম হইতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আওয়াজের ৬ই পৌষ (১৩৫৭), ইংরেজি ২২শে ডিসেম্বর (১৯৫০), সংখ্যায়, “প্রতিটি মানুষের শিক্ষার মৌলিক অধিকার আছে কি?” শিরোনামে যে প্রতিবাদ বাহির হয়, তার কিছু অংশ ছিল নিম্নরূপ:

“বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা কোনদিন গাঁজাখোরের আড্ডার সঙ্গে তুলনা করতে রাজী নই। কিন্তু যখন দেখি যে, দেশকে যে ছেলে ভালবাসে, নিজের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে যে শ্রদ্ধা করে, অধ্যয়ন ও জ্ঞান চর্চার দ্বারা যে ছেলে মনীষার পরিচয় দেয়, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় চেপে মারার আয়োজন করে, তখন একে গাজাখোরের আড্ডা বলতে ইতস্তত করার কি আছে? বিগত ভাষা আন্দোলনের সময়ে এবং অধুনা জনাব অলি আহাদের ভর্তি নাকচ করার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ফ্যাসিস্ট নীতি অবলম্বন করেছে তার থেকে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছি যে, গণতন্ত্রকে ভালবাসলে, নিজের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে বাঁচাবার চেষ্টা করলে এবং ভাল ছাত্র হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে চেপে দেয়। জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, জ্ঞান সাধনার তীর্থভূমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি এই।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ড এম,ও, গণির সহিত সাক্ষাৎ করিলে তিনি আমাকে দেশরক্ষা বিভাগে সৈন্য বাহিনীতে অফিসার পদে যোগ দিতে উপদেশ দেন এবং ইহার জন্য সরকারি তরফ হইতে মদদ দানের নিশ্চয়তা দিতে চান। তাহার প্রস্তাব আমি শ্রদ্ধার সাথে প্রত্যাখ্যান করি। ইহার পর অত্যল্পকালের মম্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক চিঠিতে জানাইলেন, “Mr. Olif Ahad be not admitted into the University of Dacca,” অর্থাৎ জনাব অলি আহাদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হবে না।” এভাবে আমার উচ্চশিক্ষা লাভের সকল আশা নির্মূল হইয়া গেল।

মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট

১৯৫০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ভিত্তি হিসাবে “মূলনীতি কমিটি” সুপারিশাবলী প্রকাশ করিলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন রাজনৈতিক অংশ এমন কি খোদ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। আমরা মূলনীতি কমিটি রিপোর্টের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন করিবার নিমিত্ত ঢাকা চেম্বার অব কমার্স সভাপতি এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের গৃহে এক কথায় মিলিত হই এবং (১) আতাউর রহমান খান, (২) কামরুদ্দিন আহমেদ (আহ্বায়ক), (৩) সাখাওয়াত হোসেন, (৪) পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম, (৫) অলি আহাদ প্রমুখ ব্যক্তির সমন্বয়ে Committee of Action for Democratic Constitution গঠন করি।

উক্ত সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় আমরা মূলনীতি কমিটির সুপারিশাবলী বাতিল করার দাবি জানাই। সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫০ সালের ৪ঠা ও ৫ই নভেম্বর ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে মহাজাতীয় সম্মেলন (Grand National Convention) আহ্বান করে। জনাব আতাউর রহমান খান উক্ত মহাজাতীয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মূলনীতি কমিটির সদস্য ছিলেন এবং তিনি মূলনীতি কমিটির সুপারিশাবলীর অন্যতম প্রণয়নকারী ও স্বাক্ষরকারী ছিলেন। সম্মেলনে তাহার উপস্থিতিকে তরুণ সমাজ খুব একটা উৎসাহের সহিত অভিনন্দন জানায় নাই। এক প্রশ্নোত্তরে শেরেবাংলা তরল হাসাকৌতুকের মাধ্যমে উত্তর দেন যে, “আংগুর রস পান করাইয়া তাহার নিকট হইতে মূলনীতি কমিটির সুপারিশাবালীতে সহি নিয়াছে।” বাঙালি নেতারা যে করাচির আবহাওয়ায় বাঙ্গালির স্বার্থ হানিকর কাজ করিতে কোন দ্বিধাবোধ করেন না, তাহা বাঙালিদের বুঝা দায়। কিন্তু ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিলেই বাঙালিদের মনোভাবের প্রতিধ্বনি করিয়া ভিন্নরূপ ধারণ করিতেও তাহারা মোটেই কুষ্ঠিত হন না। যাহা হউক, দুইদিনব্যাপী অধিবেশনে একটি বিকল্প মূলনীতি রচনা করা হয় এবং এই বিকল্প মূলনীতির ভিত্তিতে “সংবিধান রচনা আন্দোলন” পরিচালনা করিবার নিমিত্ত কাউন্সিল ফর ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মনোভাব লক্ষ্য করিয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট সংশোধন দাবি সম্বলিত কতিপয় সুপারিশ করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সংশোধনাবলী অত্যন্ত সতর্কতার সহিত বিবেচনা করিয়া কাউন্সিল ফর ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন ১৯৫১ সালের ২০শে জানুয়ারির সভায় নিম্নোক্ত প্রতিবাদ প্রস্তাব গ্রহণ করেঃ অত্র সভা মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের উপর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সাব কমিটির গৃহীত প্রস্তাবাবলীর যেমন দ্বিকক্ষ আইন পরিষদ, ব্যবসা-বাণিজ্যের, আমদানি-রপ্তানি বিষয়াবলীতে প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারকে দান, লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা না করিয়া সামান্য প্রাদেশিক মর্যাদা দান, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ না করাকে তীব্রভাবে নিন্দা করিতেছে।

 শান্তি কমিটি

১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জাপানের হিরোশিমা ও ৯ই আগস্ট নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার ধ্বংসলীলায় পারমাণবিক অস্ত্রের মানব সভ্যতা বিধ্বংসী ভয়াবহ শক্তি সম্পর্কে সমগ্র বিশ্ববাসী আতংকগ্রস্ত হইয়া উঠে। সকল মহলে এই আশংকা বৃদ্ধি পায় যে, সভ্যতা ও সৃষ্টিবিধ্বংসী আণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা ও অন্যান্য মারাত্মক আণবিক অস্ত্রশস্ত্র হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাতিয়ার। সমর উপকরণ উৎপাদনে উন্নত দেশগুলি হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করিতেছে অথচ অনুন্নত ও আজাদীপ্রাপ্ত দরিদ্র দেশগুলির মানবগোষ্ঠী অর্ধাহারে-অনাহারে রহিয়াছে। শোষক শ্রেণি বিশ্বব্যাপী শোষণের জাল বিস্তার করিয়া শোষণ অব্যাহত রাখিবার তাগিদে স্রষ্টার প্রিয় সৃষ্টিকেই ধ্বংস করিতে উদ্যত। ইহারই প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিবেক জাতি-ধর্ম-স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষ সর্বনাশা মারণাস্ত্র উৎপাদন ও সমর প্রস্তুতির বিরুদ্ধে সকল মানুষকে এক কাতারবন্দি হইবার নৈতিক আহ্বান জানায়। পূর্ব পাকিস্তানকে শান্তি আন্দোলনের শক্তিশালী অংশীদার করিবার প্রয়াসে নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ ১০ই সেপ্টেম্বর (১৯৫০) ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে সমবেত হইবার জন্য ৯ই সেপ্টেম্বরের দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার এর মাধ্যমে এক আবেদন জানানঃ সর্বজনাব আবদুস সালাম, সম্পাদক, ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’, কাজী মুহাম্মদ ইদরিস, শাহাদাত উল্লাহ, সম্পাদক, প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশন’, মহিউদ্দিন আহমদ, সম্পাদক, দৈনিক ‘ইনসাফ’, মোস্তফা নূরুল ইসলাম, মাহবুব জামাল জাহেদী, আশরাফ সিদ্দিকী, বজলুল হক জিন্দেগী, নজরুল ইসলাম, সভাপতি, প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশন, অলি আহাদ, সভাপতি, অভ্যর্থনা কমিটি, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন, এম,এ, আওয়াল, আহ্বায়ক, সিভিল লিবার্টি লীগ, কেজি মোস্তফা, দৈনিক ইনসাফ, আনিস চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ ইউসুফ হাসান, সাধারণ সম্পাদক উর্দু প্রগেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশন, মোহাম্মদ আলী, আবদুল হক, দৈনিক আজাদ, সরলানন্দ সেন, দৈনিক আজাদ, এহতেশাম আহমদ, এডভোকেট মোহাম্মদ আলী, জহুর হোসেন চৌধুরী, জয়েন্ট এডিটর, ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার, মিসেস এফ, সামাদ, এডিটার ‘মিনার’।

 ১০ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সভায় আমরা জনাব মোঃ তোয়াহাকে সম্পাদক করিয়া শান্তি কমিটি গঠন করি। পূর্ব পাকিস্তানের শান্তি আন্দোলন হইতেছে আত্ম-নিধন-ধর্মী-বিশ্বযজ্ঞ মহাসমারোহের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। ১৯৫০ সালের মত ভয়াবহ দিনগুলিতে রাষ্ট্রদ্রোহী ও কমিউনিস্ট আখ্যাকে অগ্রাহ্য করিয়া সাম্রাজ্যবাদী মহলের অনুচর মুসলিম লীগ সরকারের রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করিয়া যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে শাস্তি আন্দোলনের গোড়াপত্তন করিতে পারিয়া গর্ববোধ করছি। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে কারাগারে আটক থাকাকালে মহা চীনের রাজধানী পিকিং-এ ২রা অক্টোবর এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন শুরু হয়। উক্ত সম্মেলনে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা মানকী শরীফের পীরের নেতৃত্বে সর্বজনাব আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মিঞা ইফতেখার উদ্দিন, ইংরেজি দৈনিক ‘পাকিস্তান টাইমস’-এর সম্পাদক মাজহার আলী ও তার স্ত্রী বেগম তাহেরা মাজহার ও খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস যোগদান করেন। সম্মেলনে ৩৭টি দেশের তিনশত সাতষট্টি জন প্রতিনিধি কর্তৃক ১২ অক্টোবর নিম্নোক্ত ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়:

“এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জনগণ যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে বদ্ধপরিকর। তাহারা এই মর্মে দৃঢ়প্রত্যয়ী যে, শুভেচ্ছাপূর্ব সকল লোকের সহিত সহযোগিতায় তাহারা সেই ভীতিপ্রদ শোচনীয় পরিণামকে নিবৃত করিতে, যুদ্ধের অন্ধকার মেঘকে দূরীভূত করিতে এবং সার্বজনীন বন্ধুত্বের মানব দিগন্তকে মেঘমুক্ত করিয়া স্থায়ী শান্তির অভ্যূদয় সম্ভব করিয়া তুলিতে সক্ষম হইবে।”

স্বার্থ-সংঘাত ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ বিশ্বে পারমাণবিক যুদ্ধ আজ মানুষের দ্বারা উপস্থিত। নিম্নে বর্ণিত তথ্যাবলীই প্রমাণ করে, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মানবসভ্যতা বিধ্বংসী পারমাণবিক ও অপারমাণবিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বের মনীষীবৃন্দের সোচ্চার কণ্ঠ এবং শান্তি আন্দোলনের যথার্থতা ও অপরিহার্যতা। যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণ সংস্থার (United States Arms Control & Disarmament Agency) এক সমীক্ষানুসারে ১৯৭৩ সালে একশত ছত্রিশটি দেশ সামরিক নিরাপত্তা খাতে ২৫০০০ কোটি ডলার ব্যয় করিয়াছে, ইহার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নর্থ-আটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজেশন (North Atlantic Treaty Organisation-NATO) ১১০০০ কোটি ডলার এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে ওয়ারশ প্যাক্ট (Warsaw pact) ৯৪০০ কোটি ডলার ব্যয় করিয়াছে। শুধু ইহাই নয়, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের মতে ১৯৭৪ সালে শিল্পোন্নত আমেরিকান ও ইউরোপীয় দেশসমূহ অনুন্নত দেশসমুহে ১৮০০ কোটি ডলারের মারণাস্ত্র সরবরাহ করে। ১৯৫০-১৯৭৪ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৮৬০০ কোটি ডলার মূল্যের ও সোভিয়েট রাশিয়া ৩৯০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রয় করে। বৃহৎ শক্তিধারী দেশসমূহ নিজ নিজ প্রভাব বলয় সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিস্তারের স্বার্থে অস্ত্র উৎপাদন ও সমর সজ্জার সর্বনাশা প্রতিযোগিতায় সবিশেষ ব্যস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট রাশিয়ার উস্কানি ও কূটনৈতিক চালের শিকার অনুন্নত দেশগুলো কীভাবে অলীক সংঘাতের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার অজুহাতে মার্চেন্ট অব ডেথস’ বা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে সমরোপকরণ ক্রয় করিয়া আত্মনিধনের বিশ্বযজ্ঞে তৎপর হইয়া উঠিয়াছে, উহার সরস বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে বিশ্ব বিখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ এর ‘মেজর বারবারা নাটকে। একশতটি উন্নয়নকামী দেশে ২০০ কোটি বাসিন্দার মধ্যে চরম দারিদ্র পীড়িত ৮০ কোটি লোককে অর্ধাহারে-অনাহারে নিশ্চিত মৃত্যুকবল হইতে রক্ষাকল্পে ১৯৪৭ সালের শেষ ভাগ হইতে ১৯৭৫ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ১ কোটি টন খাদ্য সাহায্য যোগাতে জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ডহেইম ও বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক ডক্টর বোয়েরমাকে রীতিমত গলদঘর্ম হইতে হয়। বিশ্ব মনীষীরা তাই সমরাস্ত্র উৎপাদনের বিরুদ্ধে শান্তি তথা প্রগতির পক্ষে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন এবং মানব সভ্যতা ও কৃষ্টি সংহারক যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী দুর্জয় শান্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। উপরোল্লিখিত ঘটনা স্রোত থেকে অনুমিত হয় যে, বিশ্বের বুক থেকে শান্তি যেন ক্রমশ অপসূয়মান, যদিও বৃহৎ শক্তিবর্গ বিশেষতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট রাশিয়া, মহাচীন ইত্যাদি শক্তি দ্বিপক্ষীয় ও বহু পক্ষীয় চুক্তি মারফত পারস্পরিক সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য নিরন্তর প্রয়াসী। তাই, আক্ষেপের সহিত বলতে হয় peace is the dream of wise and war is the history of man অর্থাৎ শাস্তি মনীষীদের স্বপ্ন আর যুদ্ধ মানবের ইতিহাস।

যুব সম্মেলন

যাহা হউক, এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের যুব সম্প্রদায়কে সংগঠিত করিবার মহৎ উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হইয়া নিখিল ভারত মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সহ-সভাপতি মাহমুদ নূরুল হুনা ও বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাক্তন সম্পাদক আনোয়ার হোসেন এক প্রতিনিধিত্বমূলক যুব কর্মিসভায় যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হইয়া যুব সম্মেলন আহ্বানের উদ্দেশ্যে একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করেন। যুব সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করিয়া তুলিবার প্রয়াসে আমরা প্রাণপণ পরিশ্রম করি। আমরা কায়েদে আযমের সহোদরা মাদারে মিল্লাত মিস ফাতেমা জিন্নাহ ও পাঞ্জাবের প্রগতিশীল জনপ্রিয় নেতা মিঞা ইফতেখার উদ্দিনকে ২৭ ও ২৮শে মার্চ (১৯৫১) ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য পাকিস্তান যুব সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ ও অনুরোধপত্র পাঠাই। ক্ষমতাসীন নূরুল আমিন সরকার যুব সম্মেলনকে নেকনজরে দেখেন নাই। তাই, সম্মেলনের তারিখ যতই নিকটবর্তী হইতে থাকে, গণবিরোধী সরকার ততই তৎপর হইয়া উঠিতে শুরু করে।

পাঞ্জাব আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কিছুকালের মধ্যেই মেজর জেনারেল আকবর খান এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের সরকারকে উচ্ছেদের প্রচেষ্টা নেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র ফাঁস হইয়া পড়ায় মেজর জেনারেল আকবর খান ও তদীয় স্ত্রী, পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি সম্পাদক সাজ্জাদ জহীর, দৈনিক পাকিস্তান টাইমস সম্পাদক উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, বিমান বাহিনীর কমোডর জানজুয়া, মেজর ইসহাক ও আরো অনেকে গ্রেফতার হন। ইহা বিখ্যাত রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিতি লাভ করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনজীবী হিসাবে ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী পক্ষ সমর্থনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এমনিতেই ক্ষমতালোভী অসহিষ্ণু মুসলিম লীগ সরকার যন্ত্র তন্ত্র সর্বজনে রাষ্ট্রবিরোধী ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ আবিষ্কাৱে ঘর্মাক্ত কলেবর। তদুপরি প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের মাটিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পদার্পণকে খুব একটা নেক নজরে দেখিতেছিলেন না। পাকিস্তানের মাটিতে পদার্পণ করিয়াই শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় বিরোধী দল নেতৃবর্গ ছিলেন, (“Dogs let loose by India’“)-ৰা “ভারতের লেলায়িত কুকুরসমূহ” মানকী শরীফের পীর, মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের নেতৃত্বে পরিচালিত বিরোধী দলীয় কর্মী বাহিনীর প্রতি লক্ষ্য করিয়া প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান হুমকির সুরে এই সতর্ক বাণীও উচ্চারণ করিতেন যে, “ছের কুচাল দেংগে”, অর্থাৎ শিরশ্ছেদ করিব এমনি হিটলার-স্ট্যালিন-মাও মেজাজে যখন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান অন্যের শিরশ্ছেদের কল্পনায় মশগুল, সেই মুহূর্তে খোদ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান কার্যালয় রাওয়ালপিন্ডি সেনানিবাসে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র অনাবৃত হয়। এমনি ভয়াবহ অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জাতির জনক কায়েদে আযমের ভগ্নি মুহতারিমা ফাতেমা জিন্নাহ ও পাঞ্জাবের আজান পাকিস্তান পার্টি প্রধান মিঞা ইফতেখার উদ্দিন আমাদের আহুত যুব সম্মেলনে যোগদানের অক্ষমতা তারযোগে আমাদিগকে জানাইয়া দেন। এতদসত্ত্বেও আমরা মনোবল হারাই নাই। নির্ধারিত তারিখে যুবসম্মেলন অনুষ্ঠানে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। পাকিস্তান অবজারভারের সহকারী সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র উদঘাটনের কারণে সৃষ্ট উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে যুব সম্মেলনে তারিখ পিছাইয়া দেওয়ার পরামর্শ দেন। আমরা সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি ত্যাগ না করিয়া অবস্থার উপর কড়া দৃষ্টি রাখিতে লাগিলাম। বাজারের জোর গুজব, যুব সম্মেলন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হইবে, ঢাকা বার লাইব্রেরি হলসহ সমগ্র শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হইবে।

যাহা হউক, যে কোন প্রকার অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করিবার মত মনোবল আমাদের অটুট ছিল। তদানীন্তন পাকিস্তান অবজার্ভারের স্টাফ রিপোর্টার ও বিভাগপূর্ব আসাম মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের নেতা জনাব তসাদ্দক আহমদ চৌধুরীর সক্রিয় সাহায্য-সহায়তা ও সময়োপযোগী পরামর্শে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে সম্মেলন অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর তীরে ভাসমান গ্রীনবোটে যথারীতি যুব সম্মেলন অনুষ্ঠান করি। বুড়িগঙ্গা নদীর উপর ১৪৪ ধারা জারি করিয়া কোন নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন করা হয় নাই বলিয়াই আমরা এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলাম। সন্ধ্যা-রাত্রি হইতে হ্যাজাক লাইট জ্বালাইয়া গভীর রাত্রি পর্যন্ত সম্মেলন চলে। অবিভক্ত আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে বিভিন্ন সমস্যা, সরকারি নির্যাতন, ঢাকা নগরে ১৪৪ ধারা জারি, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভাঙ্গিয়া দিয়া ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে নতুন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠন করা হয়ঃ

সভাপতি                                   :               জনাব মাহমুদ আলী

সহ-সভাপতি                            :               সর্বজনাব খাজা আহমদ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, শামসুদ্দোহা

(টাঙ্গাইল), আবদুল মজিদ এবং মিসেস দৌলতুন্নেসা

সাধারণ সম্পাদক                   :               জনাব অলি আহাদ

যুগ্ম সম্পাদক                        :               সর্বজনাব আবদুল মতিন ও রুহুল আমীন

কোষাধ্যক্ষ                          :               জনাব তাসাদ্দুক আহমদ চৌধুরী

কার্যকরী সংসদ-সদস্যবর্গ :               সর্বজনাব মাহমুদ নূরুল হুদা, মোঃ তোয়াহা, মতিউর রহমান (রংপুর), আবদুল হালিম (ঢাকা), আবদুস সামাদ (সিলেট), মকসুদ আহমদ, কে,জি, মোস্তফা, কবির আহমদ (চট্টগ্রাম), এম,এ, ওয়াদুদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রাণেশ সমাদ্দার, তাজউদ্দিন আহমদ, আকমল হোসেন, মোতাহার হোসেন, মিস রোকেয়া খাতুন।

২৮শে মার্চ (১৯৫১) সন্ধ্যাকালে তেজগাঁও স্টেশনের নিকটবর্তী জঙ্গলের ছায়াঘেরা পরিবেশে বিভিন্ন জেলা হইতে আগত কালচারাল গ্রুপ এক মনোরম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। তারুণ্যের বেপরোয়া মনোভাবের ইহাই বহিঃপ্রকাশ।

আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ১৯৪৯ সালের শেষার্থে কারাবন্দি হইবার পর হইতে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করিতেছিল। উক্ত বিশেষ পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগকে জন্মলগ্ন হইতে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িত হইতে হইয়াছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সর্বক্ষণ কর্মী হিসাবে ত্বরিতগতিতে কাজ করিবার জন্য সহৃদয় রউফ ভাই আমাকে একটি বিদেশী নতুন ‘সানবীম’ সাইকেলের ব্যবস্থা করিয়া দেন। ফলে, কার্যক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। রউফ ভাই তখন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সেক্রেটারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল মিলনায়তন ও বিভিন্ন আবাসিক হলের মিলনায়তনগুলি একমাত্র সরকারি মুসলিম লীগ ব্যতীত আর অন্য কোন সংগঠনকে ব্যবহার করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতেন না।১৮-৯-৫১ তারিখে ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে মোহাজেরদের উপর পুলিশী লাঠিপেটা, লিয়াকত সরকার কর্তৃক মাদারে মিল্লাতের সেপ্টেম্বর (১৯৫১) এর বেতার ভাষণের কিয়দংশের মাঝখানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা, অক্টোবর মাসে (১৯৫১) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বিরোধী দলীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগকে সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করিতে হইয়াছে। শুধু তাই নয়, লবণের মত অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্য অত্যাধিক বৃদ্ধি পাইয়া ১৬ টাকা সেৱ দরে বিক্রি হইতে থাকে। ইহার বিরুদ্ধে ৩রা নভেম্বর (১৯৫১) অপরাহ্ন ৪ ঘটিকায় আরমানিটোলা পার্কে সর্বজনাব আতাউর রহমান খান ও কামরুদ্দিন আহমদ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সক্রিয় সহায়তা এক প্রতিবাদ সভার আহ্বান করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে প্রধানমত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেই এলাকাভেদে লবণ প্রতি সের ৪৮ টাকা হইতে উর্ধ্বে ৯৬ টাকায় বিক্রি হইয়াছে। কিন্তু লবণ কেলেংকারী হোতাদের কোন প্রকার শাস্তি ভোগ করিতে হয় নাই বরং ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খন্দকার আবদুস সাত্তার লবণের মূল্যের উর্ধ্বগতির কারণ সর্বসাধারণ্যে বিবৃতি মারফত প্রকাশ করিবার অপরাধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার হইয়া কারারুদ্ধ হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্য বন্ধু জানা সাত্তারের সত্য উদঘাটন করিবার অধিকার সে সময় ছিল না। এসব দেখিয়া-শুনিয়া স্বীকার করিতেই হয় যে, মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের শাসনামল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে মূলতঃ কোন পার্থক্যই ছিল না।

পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাংগঠনিক কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন ২৭ ও ২৮শে মে (১৯৫১) ঢাকা জেলার অন্তর্গত নরসিংদী বন্দরে অনুষ্ঠিত হয়। তথায় মুসলিম লীগ আমাদের উপর হামলা চালাইতে কোন প্রকার কসুর করে নাই। কিন্তু অত্যর্থনা কমিটির সভাপতি জনাব আবদুল মজিদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তির দরুন আমরা দুঃখজনক অঘটন এড়াইতে সক্ষম হই। ১৯৫১ সালের ৩০ ও ৩১শে ডিসেম্বর বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠান উপলক্ষে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী সরকারের গণবিরোধী ভূমিকা বিরুদ্ধে যুব সমাজকে সচেতন করাই ছিল আমাদের কর্তব্য। আমাদের বক্তব্য ছিল এই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূলে যুব সমাজের দান অপরিসীম, সুতরাং যুব সমাজকে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করিতে হইবে। আমাদের আহ্বানে বিভিন্ন জেলায় যুবকর্মীরা যেভাবে সাড়া দেয়, তাহাতে আমরা অভিভূত হইয়া পড়ি। এই সময়ে এডভোকেট ইমাদুল্লাহ ও আমি ১৬ নভেম্বর সিলেট পৌঁছি এবং ১৮ ই নভেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জে আহত সিলেট জেলা ছাত্র সম্মেলনে যোগদান করি। ছাত্র সম্মেলন উদ্বোধনের দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়। এই সম্মেলনেই পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে এক নূতন ছাত্র সমিতি গঠন করা হয়। উত্তরকালে ইহাই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক সত্য লিপিবদ্ধ করিবার প্রয়োজনেই ছাত্র ইউনিয়নের এই জন্ম ইতিকথা উল্লেখ করিলাম। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর ঐ একই সালের ২৬শে এপ্রিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল ছাত্র কর্মীরা উক্ত নামেই পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করেন এবং ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে এই সংগঠনের নাম রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন।

যাহা হউক, অশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য যথাসময়ে অর্থাৎ ৩০ ও ৩১শে ডিসেম্বর (১৯৫১) যুব সম্বেলনের দুই দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে ১৯৫২-৫৩ সালের জন্য নিম্নোক্ত কর্মকর্তা নির্বাচিত হন:

সভাপতি                   :               জনাব মাহমুদ আলী

সহ-সভাপতি            :               মীর্জা গোলাম হাফিজ, খাজা আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, ইয়ার

মোহাম্মদ খান, শামসুজ্জোহা

সাধারণ সম্পাদক   :               জনাব অলি আহাদ

যুগ্ম সম্পাদক        :               মোঃ সুলতান ও ইমাদুল্লাহ

কোষাধ্যক্ষ          :               মাহবুব জামাল জাহেদী

কার্যকরী সংসদ-সদস্যবর্গ :               আবদুল হালিম, আবদুল মতিন, এ,বি,এম, মুসা, মাহমুদ

নুরুল হুদা, আনোয়ার হোসেন, এস,এ, বারী এটি, সালাহউদ্দিন, আবদুল ওয়াদুদ, শফি খান, আলী আশরাফ, আবদুর রহমান সিদ্দিকী, মোতাহার হোসেন, নূরুর রহমান, জিয়াউল হক, মতিউর রহমান, মফিজুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুল কাদের ও প্রাণেশ সমাদ্দার।

 আওয়ামী মুসলিম লীগের নব পর্যায়

১৯৫১ সালে কারামুক্তির পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক দেশবাসীকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করিবার নিমিত্ত সমগ্র দেশব্যাপী অবিরাম কর্মিসভা, জনসভা ইত্যাদি করিয়া যাইতেছিলেন। মুসলিম লীগ ও মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সরকার কোথাও ১৪৪ ধারা জারি করিয়া আবার কোথাও গুণ্ডামির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচী পালনে সর্বপ্রকার ব্যাঘাত সৃষ্টি করিতে থাকে। কিন্তু জনতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অবিচল আস্থা জ্ঞাপন করিয়া ক্রমশঃ আওয়ামী মুসলিম লীগের পতাকাতলে কাতারবন্দি হইতে শুরু করে। পরিতাপের বিষয-এই সময়ে কোন কাগজী ও ভীতু নেতাকে কোর্ট-কাছারী, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার-পরিজনবেষ্টিত সুখী জীবন ত্যাগ করিয়া বৃদ্ধ মওলানা ভাসানীর সহিত সফরে যাইতে কখনও দেখা যায় না। শৌর্য, বীর্য ও ত্যাগের মূর্ত প্রতীক অক্লান্ত পরিশ্রমী মওলানা ভাসানী একাই আহার, নিদ্রা বিশ্রাম ও আরামকে হারাম জ্ঞান করিয়া উল্কার মত সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সফর করিয়া বেড়াইয়াছেন। জনতাকে মুসলিম লীগের কুশাসনের বিরুদ্ধে সচেতন করিয়া তুলিতে আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের তরুণ ছাত্র কর্মীরাই ছিল অগ্রনায়ক মওলানা ভাসানীর সহচর। নামসর্বস্ব নেতারা দুটি পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন নাই। কোন কোন সময়ে অর্থের অভাবে বৃদ্ধ নেতাকে রেলের তৃতীয় শ্রেণিতে ভ্রমণ করিতে হইয়াছে। এইভাবে তাঁহার একক পরিশ্রম ও ত্যাগে পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে ঘরে আওয়ামী মুসলিম লীগের বাণী পৌঁছে। ইহাই ঐতিহাসিক সত্য এবং এই সত্যকে অস্বীকার করিবার অর্থই হইল মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ ও ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতির অপচেষ্টা। স্মর্তব্য যে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচি থেকে মাঝে মাঝে ঢাকার বিভিন্ন মামলা পরিচালনায় আসিতেন ও ফি বাবদ অর্জিত অর্থ আওয়ামী মুসলিম লীগ সংগঠনের জন্য ব্যয় করিতেন।

এই সময়ে মুসলিম লীগ সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন ও বিরোধী সমালোচকদের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার নিমিত্ত নাগরিক স্বাধীনতা লীগ (Civil Liberties League) গঠন করি। সিভিল লিবার্টিস লীগ ৫ই নভেম্বর (১৯৫১) ৩/১, জনসন রোডে অবস্থিত অবজার্ভার পত্রিকার অফিসে সম্পাদক জনাব আবদুস সালামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মুখ্যমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত এক প্রতিনিধি দল গঠন করে। এই প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন সর্বজনাব আবদুস সালাম, আতাউর রহমান খান, কফিলউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, কামরুদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, মির্জা গোলাম হাফিজ, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), আব্দুল বারী, আব্দুল আওয়াল, আবদুল ওয়াদুদ, শামসুল হক চৌধুরী ও মীর্জা গোলাম কাদের।

সভার অন্য এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা মুসলিম লীগ দলভুক্ত আইন পরিষদের সদস্যবর্গকে কালাকানুন জননিরাপত্তা আইন (বিনা বিচারে আটক রাখার আইন) বাতিল করার জন্য অনুরোধ জানাই। ইতিপূর্বে জুন মাস (১৯৫১) থেকে লাহোর ও করাচিতে সাংবাদিকদের গ্রেফতার, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রগতিশীল লেখকদের গ্রেফতার, সিন্ধু প্রদেশে হারি কমিটির নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার, লাহোরে আজান পাকিস্তান পার্টি অফিসে পুলিশী তল্লাশী, সীমান্ত প্রদেশে জনপ্রিয় নেতৃবর্গের গ্রেফতার ও জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ আহ্বায়ক শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সীমান্ত প্রদেশে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি ঘটনা ঘটিতেছিল। বলাই বাহুল্য যে, এগুলো ছিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রের মৃত্যু বাঁশি বাজাইবার পূর্বাভাস মাত্র। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গণতন্ত্র কণ্ঠরোধের এই সরকারি প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সদা সর্বদা অত্যন্ত সজাগভাবে সংগ্রাম করিয়া গিয়াছে এবং প্রতিটি প্রতিরোধ প্রচেষ্টাকে সর্বতোভাবে সহায়তা দিয়াছে।

প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আইন পরিষদের ৩৮টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ মাত্র ১৭টি আসন দখলে নিতে সমর্থ হয়েছে, বাকী ২১টি আসন লাভ করিয়াছিল অখণ্ড ভারত সমর্থক খান আবদুল গফফার খানের পার্টি। গাফফার খানের ভ্রাতা ডাঃ খান সাহেবের নেতৃত্বেই সীমান্ত প্রদেশের সরকার গঠিত হইয়াছিল। হিন্দুস্তান-পাকিস্তানে যোগদান প্রশ্নে সীমান্ত প্রদেশে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং মানকী শরীফের পীর ও জাকোরী শরীফের পীরের অন্ত-প্রচারণা ও প্রচেষ্টায় সীমান্ত প্রদেশবাসীর রায় পাকিস্তানের পক্ষে যায়। জনাব সোহরাওয়ার্দী লাহোর আগমনের পরই সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু প্রদেশ ও পাঞ্জাব প্রদেশের নেতৃবর্গ তাহার নেতৃত্বে পাকিস্তানে বিরোধীদলের গোড়াপত্তন করিতে উৎসাহিত হইয়া উঠেন। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে পাঞ্জাবের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে পাঞ্জাবের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী খান ইফতেখার হোসেন খান (মামদো নওয়াব, যিনি ইতিপূর্বে জিন্নাহ মুসলিম লীগ গঠন করেন) যৌথভাবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হবার ইচ্ছায় সোহরাওয়ার্দীর সাথে জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ পাঞ্জাবের সাধারণ নির্বাচনে ১৯৭টি আসনের মধ্যে ৩২টি আসন দখল করে। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সীমান্ত প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী খান আবদুল কাইয়ুম খান অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও বিরোধী দল ৯৭টি আসনের মধ্যে ৪টি আসন ও ১৯৫৩ সালে সিন্ধু প্রদেশের সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী ঐক্যফ্রন্ট ৪০টি আসনের মধ্যে ৭টি আসন দখল করে। এইভাবে ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী শাসকচক্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করিয়া সরকার বিরোধী গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রসার লাভ করে।

মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, সীমান্ত প্রদেশে মানকী শরীফের পীরের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী মুসলিম লীগ ও সোহরাওয়ার্দী মামদো পরিচালিত জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ সংগঠনগুলির বক্তব্য ও ম্যানিফেস্টোর মধ্যে মিলের চাইতে গরমিল ছিল অত্যাধিক এবং কোন কোন বিষয় ছিল পরস্পর বিরোধী। জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ছিলেন আস্থাশীল। তিনি উপরে বর্ণিত সরকার বিরোধী রাজনৈতিক সহযাত্রীদলগুলির মধ্যে সক্রিয় যোগসূত্র ছিলেন।

১৯৫৩ সালে নিখিল পাকিস্তান সাংগঠনিক রূপদানের উদ্দেশ্যে লাহোরে জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের এক প্রতিনিধি দল সম্মেলনে যোগদান করে। নীতিগত প্রশ্ন মতভেদ প্রকট আকার ধারণ করিলে জিন্নাহ মুসলিম লীগের সংগঠক পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মামদোর নওয়াব ইফতেখার হোসেন খানকে বহি্কার করা হয় এবং জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন।

১৯৫১ সালের মার্চ মাসে মেজর জেনারেল আকবর খান নিয়মতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের যে বীজ বপণ করেন ও প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান ক্ষমতার দাপটে বিরোধী দলীয় নেতৃবর্গের প্রতি অসহিষ্ণুতা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তাহাই ক্রমশঃ পল্পবিত হইয়া উঠে। জনসাধারণকে ক্ষমতা লাভের নিয়ামক শক্তি না ধরিয়া চক্রান্তের চোরাগোপ্তা গলি ও পন্থাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের একমাত্র অবলম্বনে পরিণত করে। ইহারই ফলশ্রতি হল ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর সামরিক বাহিনীর সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের প্রকাশ্য দিবালোকে আততায়ীর গুলীতে শাহাদৎ বরণ, অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙ্গিয়া দুই টুকরা হওয়ার পরও এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের হোতাদের কোন প্রকার বিচার হয় নাই। ক্ষমতাসীন চক্রের এমন সততা ও সাহস ছিল না যে, লিয়াকত হত্যা তদন্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করে। পর্দার অন্তরালে লুক্কায়িত নাটকের অভিনেতাদের বিচার কল্পনাই ছিল অলীক স্বপ্ন এবং তাই বেগম রানা লিয়াকত আলীর পুনঃপুনঃ প্রকাশ্য দাবি সত্ত্বেও পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন চক্র উহার প্রতি কোন প্রকার কর্ণপাতই করে নেই। অনেকের ধারণা, লিয়াকত আলী খানকে হত্যার অন্তরালে উচ্চাভিলাষী পাঞ্জাবী প্রাসাদ কুচক্রীদলই দায়ী। লিয়াকত হত্যার পর পাঞ্জাব নিবাসী আমলা প্রতিনিধি গোলাম মোহাম্মদ ও সরকারি চাকুরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী যথাক্রমে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ও অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পূর্ববঙ্গের খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হইলেন বটে, তবে তিনি পাঞ্জাবী চক্রের পুতুলবিশেষ ছিলেন। লিয়াকত হত্যার ষড়যন্ত্র এত নিখুঁত ছিল যে, আততায়ী আকবর খানকে অকুস্থলেই পরিকল্পনা মোতাবেক ধরাধাম হইতে বিদায় দেওয়া হয়। কারণ আততায়ীর স্বীকারোক্তিতে ষড়যন্ত্রকারীদের গর্হিত চেহারা জনসমক্ষে প্রকাশ হইয়া পড়িতে পারিত। ইহাতেই প্রমাণিত হয় যে, ইহা সামরিক বেসামরিক উচ্চ শাসকমহলের সংঘবদ্ধ জঘন্য চক্রান্তের ফল। অতঃপের প্রাসাদ চক্রান্তই ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতাচ্যুতির চাবিকাঠিতে পর্যবসিত হয় এবং জনগণ পরিণত হয় নেপথ্য শক্তিতে। সরকার পরিবর্তনে জনগণের সার্বভৌমত্ব কার্যতঃ অস্বীকৃত হওয়ায় যুবসমাজের প্রতিটি সরকারি অত্যাচার, নির্যাতন খাদ্য সংকট, লবণ সংকট, বেকার সমস্যা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়িযা তোলা ব্যতীত গত্যন্তর ছিল না। সংগ্রামের সংকটময় মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের অধিকাংশ নেতার আন্দোলন বিরোধী মনোভাব সংগ্রামী যুব সমাজকে হতাশ ও নিরাশ করে। তাই নির্যাতন ও দুর্বল নেতৃত্বের মুখোমুখি দাঁড়াইয়া সংগ্রামী যুব কর্মীদিগকে ঐক্যবদ্ধ করিবার অপরিহার্য প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগকে ব্যাপকভাবে সংগঠিত করতে হয়। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সংকটময় মুহূর্তে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দুর্বলতায় সদস্যরা যখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দোহাই দিয়া সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণে পশ্চাদপসরণ করে, তখন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নেতা ও কর্মীরাই সরকারি হামলার বিরুদ্ধে জীবন বাজী রাখিয়া সফল নেতৃত্ব দান করেন এবং সগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করেন।

নাজিমুদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতা

১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি অপরাহ্নে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন দ্ব্যর্থহীন কষ্ঠে ঘোষণা করেন যে, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। তিনি আরো বলেন, পরীক্ষামূলক একুশটি কেন্দ্রে বাংলা ভাষাকে আরবী হরফে লিখার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে, জনগণ স্বীয় উদ্যোগে নতুন কেন্দ্র খুলিতেছে।

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের নিকট নতি স্বীকার করিয়া ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তদানীন্তন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সহিত স্বাক্ষরিত চুক্তি বেমালুম ভুলিয়া গিয়া প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন জনসভায় উপরোক্ত উক্তি করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জিয়াইয়া রাখিবার কারণে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের কতিপয় উৎসাহী সংগ্রামী ছাত্র এক কর্মীসভা আহ্বান করে। এই সভায় যুবলীগের প্রাক্তন যুগ্ম সম্পাদক জনাব আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করিয়া “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” বা “Dacca University State Language Committee of Action” গঠন করা হয়। সংগ্রামে যখন ভাটা পড়ে তখন এইভাবেই গুটিকয়েক সচেতন মন অগ্রগামীর ভূমিকা গ্রহণ করে। জনাব মতিন একটি ইংরেজি স্মারকলিপি তৈয়ার করেন এবং উক্ত স্মারকলিপি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনসহ পাকিস্তান গণপরিষদের সকল সদস্যের নিকট প্রেরণ করেন।

[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ১৯৫১ সালের ১১ই এপ্রিল এই স্মারকলিপি পাকিস্তান গণপরিষদের সকল সদস্যদের কাছে ও পাকিস্তানের সকল দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় পাঠাইয়াছিল]

To…………….

Member, Constituent Assembly

Karachi, Pakistan.

Sir,

We, the students of Dhaka University, who initiated the language movement in East Bengal three years ago, who are now more determined than ever to secure for Bengali the status of state language of Pakistan, will take this opportunity, while you are all assembled at Karachi, to press once more our legitimate claim.

The movement is going to be pretty old and it is unfortunate that while our whole energy should be harnessed in nation building activities, the Central Government in refusing to accept Bengali as a prospective state language has created distrust and apprehension in the minds of the Majority of Pakistani People.

The apprehension is legitimate and until and unless it is removed it is sure to alienate a people without whose whole-hearted co-operation the dreams of unity and solidarity will never materialise.

Out of the Principle of self-determination came Pakistan and the young state is still struggling to achieve freedom in the real sense of the term. To be completely free, materially and intellectually, a long way is still to be s one traversed and as one of its first obstacles the formidable weight of English language is to be lifted to make room for languages of the people. No free people can afford to neglect its mother tongue which alone is efficient to help develop the intellectual faculties inherent in every man. The domination of an alien language is the worst kind of domination and most efficient to keep a people servile; and the British knew this when they ousted Persian and introduced English in the early part of the nineteenth Century.

In the early months of independence the official circles in Karachi were talking of Urdu in terms of the future state language of Pakistan. People in this wing of Pakistan were scandalised when they found how completely the Centre forgot about Bengali. There rose a immediate uproar of protest from the nooks and corners of East Bengal in schools and colleges in the Press and the University. The whole Province rose in protest against the highhanded decision. There were meetings, students paraded the streets and went to the jails. Every conceivable means was adopted by the Government to terrorise the youths of East Bengal and still the battle was half won when Khawja Nazimuddin, the then Chief Minister of the Province had to stop and assure the people that so far as the Province was concerned Bengali was to be the official language and the medium of instruction; and he also promised that his Government will put the case of Bengali in the Centre so that it may have its place side by side with Urdu.

The Central Government is still to declare its policy clearly and categorically. It will be committing the greatest mistake if. in selecting the state language, it goes against the principles of democracy.

                When the state has only one language the problem is simple. When it has many, the question of preference arises. If the language spoken by the majority is also sufficiently developed and has a good literature it can without hesitation be accepted as the state language. If the linguistic, minorities are clamorous we have several state languages, as in Canada and Switzerland.

In the case of Pakistan the obvious choice is of course Bengali. It is the language of the majority (56%) of Pakistan’s population are Bengali speaking) and it is the richest language not only of Pakistan but of the whole Indo Pakistan subcontinent. It has a history over thousand years old and it has a wonderful vitality to develop and absorb foreign influence. In the last hundred years its development has been phenomenal and it draws its nourishment from the sap of the soil. Not only that, it has its intricate roots of connection with Sanskrit, Hindustani, Urdu and persian. It is also the language which has most completely absorbed the spirit of Western literature. Basically eastern in or in origin, it is of all the languages of the sub-continent the most modern and western in outlook.

Urdu, which is being favoured by the Centre, perhaps because some of the important men in the Ministry and in the Secretariat happen to be Urdu speaking, offers a poor contrast to Bengali. It is not the mother tongue of any of the provinces of pakistan and is equally alien to Bengali, Punjabi, Sindhi, Baloch and Frontier men. Urdu is a symbol of dying culture. It has hardly any foothold and it is doubtful whether it could survive without princely patronages. Even Iqbal, the dreamer of Pakistan and the great Urdu poet of the century found it inadequate for his difficult thoughts. In writing his great philosophical poem “Asrar-i-Khudi” he had to discard Urdu in favour of Persian and he frankly admits.

Because of the loftiness of my thought

Persian alone is suitable to them.

(Secrets of the Self. P. 15. lines 183-184).

Such a language whose efficacy as the state language is very much .doubted from political and linguistic points of view and which presents formidable obstacles in the way of printing cannot be the state language of Pakistan.

Several points are urged in favour of Urdu from interested quarters. It is claimed to be an Islamic language. We refuse to believe that any language under heaven can be Islamic or Christian or Heathen. If Urdu is Islamic, Benglai is equally so. Nay, it is more Islamic as a larger number of Muslims speak Bengali. Secondly, Urdu is urged to be the uniting factor between the different provinces of Pakistan. If this is to mean that Urdu can serve as the lingua franca between the multilingual provinces then nothing could be more absurd as it is equally foreign to all the parts of Pakistan. A lingua franca is always a natural historical growth: it is never the artificial creation of a government.

Thus neither as an Islamic language which is absurd nor as the lingua franca which is fictitious, can Urdu claim to be the state language of Pakistan.

In spite of all this if Urdu is accepted as the only state language, it is sure to give rise to serious problems. (1) I will create privileged class in the same way as English did because it will not be possible for the vast majority who do not speak Urdu to master it overnight. This will facilitate the way of exploitation of the many by the few. (2) It will nourish disaffection among Pakistanis in general and Bengalees in particular, and it will strike at the root of national integrity without which there is no future for our country. Third and lastly the material and intellectual development which all go to enrich the national culture will be jeopardised. A people must learn and think in its own language. To deny one one’s natural language is to deny everything. And to rob a people of its language is to render freedom a myth.

Lastly, we have only to repeat what we have made clear time and again. If Pakistan is to have only one state language it must be Bengali, if more than one, Bengali must be one of them. We are at a loss how this simple logic fails to penetrate the brains of our leaders. There must be something wrong somewhere. Otherwise this unjust and step motherly attitude of the Centre towards the Province of the golden fibre is difficult to explain.

The dreamers of Karachi deaf to the groan of the straving primary school teachers of East Bengal are squandering thousands of rupees over Arabic Centres in the province. They are lending every possible suppon to Urdu with the fond hope that someday it will replace English and are playing the mischievous game of imposing Arabic script over Bengali. We the students of Dhaka University, claiming the immediate implementation of the provincial policy in the matter of language and demanding Bengali to be the state language of Pakistan have given tough fight and are prepared to fight to the last. We shall never accept Urdu as the only state language. We are sworn to expose the great conspiracy which aims at reducing East Bengal to the state of a colony.

We remind them and the peoples representatives who are at the helm of the affairs that until and unless the claim of Bengali is fully established in the province as well as in the Centre, the students of Dhaka University shall not rest.

Sd/M.A. Matin

Convenor, Dhaka University

State Language Committee of Action

Date 11th April, 1951

স্মারকলিপির উত্তরেই বোধহয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকার পল্টন ময়দানে সভায় উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দানের সংকল্প ঘোষণা করিয়াছেন। ইহাতে হিতে বিপরীত হইল। ইহার প্রতিবাদেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০শে জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট ও সভ্য আহ্বান করে। ছাত্রসভায় ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট, ছাত্রসভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ৩০শে জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরিতে মজলুম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অপর এক সভায় নিচ্রোক্ত ব্যক্তিদের সমবায়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

১। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী  :              

সভাপতি, পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ

২। জনাব আবুল হাশিম                            :              

খেলাফতে রাব্বানী পার্টি

৩। জনাব শামসুল হক                             :              

সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ

৪। জনাব আবদুল গফুর                          :              

সম্পাদক, সাপ্তাহিক সৈনিক

৫। অধ্যাপক আবুল কাশেম                    :              

তমদ্দুন মজলিশ

৬। জনাব আতাউর রহমান খান              :              

আওয়ামী মুসলিম লীগ

৭। জনাব কামরুদ্দিন আহমদ                :              

সভাপতি, লেবার ফেডারেশন

৮। জনাব খয়রাত হোসেন                    :              

সদস্য, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ

৯। আনেয়াা খাতুন                                  :              

সদস্য, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ

১০। জনাব আলমাস আলী                        :             

নারাণগঞ্জ আওয়ামী মুসলিম লীগ

১১। জনাব আবদুল আওয়াল                   :             

নারাণগঞ্জ আওয়ামী মুসলিম লীগ

১২। সৈয়দ আবদুর রহিম                        :             

সভাপতি, রিকশা ইউনিয়ন

১৩। জনাব মোঃ তোয়াহা                      :             

সহ-সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ

১৪। জনাব অলি আহাদ                           :              

সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ

১৫। জনাব শামসুল হক চৌধুরী             :              

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ

১৬। জনাব খালেক নেওয়াজ খান            :             

সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ

১৭। জনাব কাজী গোলাম মাহবুব           :             

আহ্বায়ক, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ

১৮। জনাব মির্জা গোলাম হাফিজ         :             

সিভিল লিবার্টি কমিটি

১৯। জনাব মজিবুল হক                           :              

সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ

২০। জনাব হেদায়েত হোসেন চৌধুরী   :             

সাধারণ সম্পাদক, সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ

২১। জনাব শামসুল আলম                        :             

সহ-সভাপতি, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদ

২২। জনাব আনোয়ারুল হক খান           :             

সাধারণ সম্পাদক, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদ

২৩। জনাব গোলাম মাওলা                     :             

সহ-সভাপতি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ

২৪। সৈয়দ নূরুল আলম                           :             

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ

২৫। জনাব মোহাম্মদ নুরুল হুদা           :             

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ

২৬। জনাব শওকত আলী                        :             

পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবির, ১৫০ মোগলটুলী, ঢাকা

২৭। জনাব আব্দুল মতিন                       :             

আহ্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ

২৮। জনাব আখতার উদ্দিন আহমদ     :             

নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ

একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের সিদ্ধান্ত

বার লাইব্রেরি এই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা নগরে ছাত্র ধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্রার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান হয় এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন (ব্যবস্থাপক) পরিষদ অধিবেশন তারিখ বিধায় ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী সাধারণ হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোস্তফা রওশন আখতারের প্রস্তাবক্রমে যুবলীগ নেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কলা বিভাগ প্রাঙ্গনে এক বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন বিদ্যায়তন হইতে ধর্মঘটী যাত্রা দলে দলে মিছিল সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জমায়েত হয়। উক্ত সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচী যথা হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ-মিছিল সাফল্যমণ্ডিত করিবার অঙ্গীকার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল কতিপয় রাজপথ পরিভ্রমণ করিয়া বিভিন্ন নিতে সংগ্রামের ডাক দেয় ও শপথ ঘোষণা করে।

৬ই ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ কর্মীশিবির অফিস ১৫০ নং মোগলটুলীতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন ১১ ও ১৩ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে পতাকা দিবস পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করে ও জনসাধারণকে সাধ্যানুসারে অর্থ সাহায্য দ্বারা আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় সহায়তা করিতে আহ্বান জানায়। সরকার যদি ১৪৪ ধারা ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহা হইলে আইন ভঙ্গ করা হইবে কি হইবে না সভায় তাহাও আলোচিত হয়। বেশির ভাগ উপস্থিত সদস্যই আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে মত জ্ঞাপন করেন। কিন্তু আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করি।

বৃদ্ধ মওলানা ভাসানী সভাপতির আসন হইতে আমার বক্তব্যের সমর্থনে জোরালো ভাষায় ঘোষণা করিয়া বলেন, যেই সরকার আমাদের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বানচাল করিবার জন্য অন্যায়ভাবে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে, সেই সরকার কর্তৃক জারিকৃত নিষেধাজ্ঞাকে মাথা নত করিয়া গ্রহণ করিবার অর্থ স্বৈরাচারের নিকট আত্মসমর্পণ। যাহা হউক, কোনরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ব্যতীতই সেই দিনকার মত সভা মূলতবী হইয়া যায়।

সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহ্বান করিয়াছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যে, আহূত বাজেট অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের তরফ হইতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক এবং এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে যথাযথ চাপ সৃষ্টি করুক।

সরকারি ত্রাস ও সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক

এইভাবে ৩০শে জানুয়ারি, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এবং ১১ই ও ১৩ই ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠান ও মিছিলের ফলে ঢাকার সাধারণ গণমানস সজাগ ও সচেতন হইয়া উঠে। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছিল যে, বিভিন্ন মহল প্রতিরোধের সক্রিয় কর্মসূচীই সংগ্রাম কমিটির নিকট হইতে আশা করতেছিল। জনমনে ত্রাস ও ভীতি সৃষ্টি করার চিরাচরিত পন্থাই সরকার গ্রহণ করিল। ২০শে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে নুরুল আমিন সরকার ঢাকা শহরে এক মাস মেয়াদী ১৪৪ ধারা জারি করিয়া সভা ও শোভাযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঐ তারিখ সন্ধ্যা ৭ ঘটিকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ৯৪নং নবাবপুর রোডস্থ অফিসে এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়। ইতিমধ্যে সরকারি ঘোষণায় বিভিন্ন হলের ছাত্রবৃন্দ বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠে। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র এস,এ, বারী এটি নিজস্ব উদ্যোগে আহুত সলিমুলাহ মুসলিম হল। বাসিন্দা ছাত্রদের এক বৈঠকে সরকার কর্তৃক ঘোষিত ১৪৪ ধারা জনিত নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অনুরূপ ভাবে ফজলুল হক মুসলিম হল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সভাও ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে রায় প্রদান করে।

প্রসঙ্গতঃ এইস্থলে অগ্রজ প্রতীম জহুর হোসেন চৌধুরীর কয়েকটি সতর্কবাণী উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করিতেছি। জহুর ভাই আমার রাজনৈতিক জীবনকে বিভিন্ন দিক হইতে বিভিন্নভাবে প্রভাবান্বিত করিয়াছেন। সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীরাও রক্ত-মাংসের মানুষ। শত অভাব, অনটন, মিথ্যা, নিন্দা ও অপবাদের উর্ধ্বে উঠা তাহাদের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না, হইলেও হৃদয়মন থাকে বেদনার্ত ও রক্তাপ্লুত। জহুর ভাই মোহাবিষ্ট পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া অগ্রযাত্রায় আমাকে সবসময় উৎসাহিত করিতেন বটে কিন্তু তাই বলিয়া নীতির প্রশ্নে তিনি নির্মম কঠোর ভাষা ব্যবহার করিতেও সামান্যতম দ্বিধা করিতেন না। যেহেতু তিনি মুসলিম লীগ সরকারের বাংলা মুখপত্র দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন, সেহেতু সরকারি উচ্চ মহলে তাহার আনাগোনা ও উঠাবসা ছিল অবাধ। এই সুবাদেই ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচীর প্রতি সরকারি মহলের কঠোর মনোভাব তিনি অবগত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যতই নিকটবর্তী হইতেছিল, জহুর ভাই ততই আমাকে আইন ভঙ্গ করিবার চিন্তা পরিহার করিবার জন্য চাপ দিতেছিলেন। ১৯শে ফেব্রুয়ারি তাহার বাসভবনে আলোচনাকালে তিনি আমাকে সতর্ক করিয়া দিয়া বলিলেন যে, তাহার খবর অনুযায়ী আন্দোলন দমন করিতে সরকার প্রয়োজনবোধে সৈন্য বাহিনী ও ট্যাংক ব্যবহার করতে পারে। আমি তাহাকে বিনয়ের সহিত উত্তর দিয়াছিলাম Better dead than slave অর্থাৎ দাসত্বের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। কেননা নিরস্ত্র সংঘবদ্ধ গণশক্তির বিরুদ্ধে সরকারি দমনমূলক ব্যবস্থা পরাডব স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। ইহাই ইতিহাস। উল্লেখ্য যে, জহুর ডাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গোড়া সমর্থক ছিলেন। তাঁহার আশংকা ছিল যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন দমনের উছিলায় সরকারি নির্মম আঘাত হয়তো গণতান্ত্রিক শক্তিকেই নির্মূল করিয়া ফেলিবে এবং অদূর ভবিষ্যতে আর কোন সরকারবিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়া উঠিতে পারিবে না।

উল্লিখিত সম্ভাব্য সংঘর্ষের পটভূমিকায় ২০শে ফেব্রুয়ারি রাত্রে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সদর দফতরে (৯৪ নবাবপুর রোড) সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব আবুল হাশিম। বৈঠকে মওলানা ভাসানীর উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি ছিল। পূর্বাহ্নে আমি তাহাকে ২০ ও ২১শে ফেব্রুয়ারির মফঃস্বল সফরসূচী বাতিল করিতে অনুরোধ করি এবং সম্ভাব্য জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করিবার জন্য তাহার ঢাকা উপস্থিতি অপরিহার্য বলিয়া জানাই। কিন্তু মওলানা ভাসানী তাহার সফরসূচী বাতিল না করায় এবং জনাব আতাউর রহমান খান আইন ব্যবসার প্রয়োজনে ময়মনসিংহ কোর্টে মক্কেলের মামলা পরিচালনায় ব্যাপৃত থাকায় উভয়ই ২০ ও ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুপস্থিত ছিলেন। যাহা হউক, উক্ত সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস, সরকার সমর্থক বিভিন্ন হল ছাত্র সংসদের প্রায় সবাই ১৪৪ ভঙ্গের কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেন। সভায় তাহাদের পক্ষ থেকে পূর্ব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক যুক্তির অবতারণা করেন:

প্রথমঃ আওয়ামী মুসলিম লীগ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, দ্বিতীয়তঃ গোলোযোগের সুযোগ গ্রহণ করিয়া সরকার প্রস্তাবিত সাধারণ নির্বাচন অনিশ্চয়তার গর্ভে নিক্ষেপ করিবে, এবং তৃতীয়তঃ রাষ্ট্র বিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়া উঠিবে।

সভাপতির অনুমতিক্রমে আমি আমার বক্তব্য পেশ করিতে উঠি। বক্তৃতাকালে শামসুল বর্ণিত যুক্তিগুলোর প্রয়োজনীয় অংশের উত্তর দানের পর বললাম, সালে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ আইন জনাব শামসুল হককে সদস্য হিসেবে কর্তব্য পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হইয়াছে, সদস্যপদ চক্রান্ত করিয়া খারিজ করা হইয়াছে। এমন কি টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে পরাজিত হইবার পর মুসলিম লীগ সরকার অদ্যাবধি আর কোন উপনির্বাচন দেয় নাই। শুধু তাই নয়, অজুহাতে আমাদের পুনঃপুনঃ ঘোষিত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে বানচাল করার অসদ উদ্দেশ্যেই সরকার ১৪৪ ধারা জারি করিয়াছে। অতএব ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিয়া সরকারকে সমুচিত জবাব দিব। Come what may যাহা হয় হইবে। ইহাতে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ নাই। এইবার যদি সরকারের জালিম ও হটকারী মনোভাব রুখিতে না পারি, তবে ভবিষ্যতে সামান্যতম প্রতিবাদও করিতে পারিব না। গত অর্থাৎ ১৯৫১ সালের মার্চে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করিয়া ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে যুব সম্মেলনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিল। এই মুহূর্তে সম্মিলিত গণশক্তি যদি সরকারের অন্যায় আদেশ প্রতিরোধ করিতে ব্যর্থ হয়, তাহা হইলে আর কখনো প্রতিরোধ করিতে পারিবে না সুতরাং “Now or Never”.

উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সহ-সভাপতি জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা স্বীয় মত আমার মতের প্রতিধ্বনি না করিয়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। রাত প্রায় ১টা ৩০ মিনিটে জনাব শামসুল হক সংগ্রাম পরিষদের এই সভায় বিবেচনার জন্য নিম্নোক্ত প্রস্তাব পেশ করেন:

“Resolved that in view of the promulgation of the section 144 cr, p.c. the programmes of the 21st February are with drawn & if any member of the all party committee of Action for State Language defies the decision, the committee will ipso facto stand dissolved.

উপরোক্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আমি তৎক্ষণাৎ উচ্চস্বরে ‘No’, ‘No’ অর্থাৎ ‘না’ ‘না’ বলিয়া প্রতিবাদ করিলাম। প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে ভোট গ্রহণ করা হইলে আমার সহিত সর্বজনাব শামসুল আলম, সহ-সভাপতি, ফজলুল হক মুসলিম হল, আবদুল মতিন, আহ্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ, গোলাম মাওলা, সহ-সভাপতি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ প্রস্তাবের বিপক্ষে অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দান করেন।

ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত

পূর্বাহ্নে বর্ণিত ফজলুল হক হল ছাত্রসভা, সলিমুল্লাহ হল ছাত্রসভা ও মেডিকেল কলেজ ছাত্র সভা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে গৃহীত সিদ্ধান্ত ফজলুল হক হলের ছাত্র আবদুল মমিন ও মেডিকেল কলেজের ছাত্র জনাব এম,এ, আজমল আমাকে সতা ঢলাকালেই সভাকক্ষের বাহিরে ডাকিয়া জ্ঞাত করান এবং আমি বিশ্বস্ততার সহিত তাহাদের দেয়া বার্তা সভার সদস্যবৃন্দের বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত করি। মেডিকেল কলেজের ছাত্র জনাব আজমল হোসেনই ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হইতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত প্রথম দলটির নেতৃত্ব দান করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় সদর দরজা সংলগ্ন পূর্বদিক রাজপথে অপেক্ষমান পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। এইভাবে জনাব আজমল হোসেন ২১শে ফেব্রুয়ারি অবিস্মরণীয় ইতিহাস রচনার প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়া ২০শে ফেব্রুয়ারি রাত্রে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ সভায় মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের বিদ্রোহাত্মক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এর অন্তর্নিহিত গুরুদায়িত্বের প্রতি স্বীয় সচেতনতা, পরিচ্ছন্ন আন্তরিকতা ও সততার স্বাক্ষর রাখেন। ভুল ও মিথ্যা ইতিহাস বর্ণনার ফাঁদে তিনি আজ হারাইয়া গিয়াছেন, যদিও বাস্তবে একুশের ইতিহাস রচনাকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এই রূঢ় সত্য একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনে সর্বক্ষণ প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর পক্ষেই লিপিবদ্ধ করা সম্ভব। অপরের জবানী বা বয়ান হইতে শুনিয়া এবং অনুমানকে অবলম্বন করিয়া ইতিহাস রচনার প্রয়াস অন্ধের হস্তী দর্শনের ন্যায়।

যাহা হউক, সবশেষে সভাকক্ষ হইতে বিমর্ষ মনে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিষ্ক্রান্ত হইয়াই নবাবপুর রোডে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ও যুবলীগ কর্মী নিয়ামুল বশীরের সহিত সাক্ষাত হয়। নিয়ামুল ও তাহার সংগীগণ আমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ছিল। তাহাদিগকে খুবই সুশৃঙ্খলভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগ প্রাঙ্গনে উপস্থিত হইতে নিদের্শ দিলাম। গভীর রাত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক ও অনাবাসিক যুবলীগ কর্মীবৃন্দ সদর দফতর ৪৩/১, যোগীনগরে আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। ইতিমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নির্ভীক স্থির প্রতিজ্ঞ দৃঢ়চেতা তরুণ যুবলীগ কর্মীবৃন্দ আলোচনায় যোগ দেন। তাহারা আসিয়াছেন, যুবলীগের নির্দেশ জানিতে, তাঁহারা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ। তাহাদের সহিত আলোচনায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচী গ্রহণ করি। বস্তুতঃই সাহসী, অকুতোভয়, সরলপ্রাণ যুবলীগ কর্মীরাই ২১শে ফেব্রুয়ারির অগ্নিপরীক্ষায় স্বীয় জীবন তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া ১৪৪ ধারা জনিত নিষেধাজ্ঞাকে ভঙ্গ করিয়াছেন এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য স্থাপন করিয়া গিয়াছেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেই দিনকার চরম সন্ধিক্ষণে যুবলীগ কর্মীদের এই নিঃস্বার্থ কর্মধারা ও নির্ভুল নেতৃত্বই পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের রাজনীতির আমুল পরিবর্তনের সূচনা করে। ইহাই ছিল পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ এবং দৃঢ় ভিত্তিপ্রস্তর।

শেখ মুজিবর রহমান ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি হইতে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। চিকিৎসার কারণে সরকার তাহাকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছানান্তরিত করেন। প্রহরী পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযোগ গ্রহণ করে আমরা তাহার সহিত হাসপাতালেই কয়েক দফা দেখা করি। তিনি ও নিরাপত্তা বন্দি মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ই ফেব্রুয়ারি হইতে মুক্তির দাবিতে অনশন ধর্মঘট করিবেন, সেই কথা শেখ সাহেবই আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন। উল্লেখ্য যে, বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ নেতা হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবের গ্রুপভুক্ত ছিলেন। তাহা ছাড়াও ছিলেন ১৯৫০ সালে বরিশালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্যতম প্রধান অংশগ্রহণকারী বলিয়া পরিচিত। এই কারণে আমি তাহার প্রতি কোন প্রকার সহানুভূতি প্রদর্শন করিতে কুন্ঠাবোধ করেছিলাম। তবে আমরা নীতিগতভাবে যে কাহাকেও বিনা বিচারে আটক রাখার বিরোধী ছিলাম। তাই জনাব মহিউদ্দিনের মুক্তি দাবি জানাতে আমরা সম্মত হই। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবর রহমানের ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয় এবং এই ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হতে ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন নারায়ণগঞ্জ নেতৃবৃন্দের সহিত শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ ঘটে। কথোপকথনকালে তিনি যুবলীগ নেতৃদ্বয় জনাব শামসুজ্জোহা ও শফি হোসেন খানকে জানান যে, পথিমধ্যে স্টীমারেই ১৫ই ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টার পর নিজ মুক্তির দাবিতে তিনি আমরণ অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিবেন। এই অনশন ধর্মঘট এবং আমাদের আন্দোলনের ফলেই সরকার ১৯শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে কারামুক্তি দেয়। উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে ফরিদপুর কারাগার হইতে তাহাকে গোপালগঞ্জ জেলে স্থানান্তর করা হয় এবং ২৬শে ফেব্রুয়ারি ৫২ কারামুক্তির পর তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার অবস্থান করিতেছিলেন।

২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা

২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার মধ্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গনে যাই। আমার উপস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ সাধারণ ছাত্র কর্মীবৃন্দ বিশেষতঃ যুবলীগ নেতা ও কর্মীরা দ্বিগুণ উদ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে অনুষ্ঠিত ২০ তারিখ রাত্রির বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছিল এম,আর, আখতার মুকুল সেইকথা আমাকে জানান। এই সভায় যাহারা উপস্থিত ছিলেন তাঁহারা হইলেনঃ ১। গাজীউল হক (বিশিষ্ট আইনজীবী), ২। হাবিকুর রহমান শেলী (বিচারপতি) ৩। মোহাম্মদ সুলতান (বামপন্থী নেতা, মরহুম) ৪। এম, আর, আখতার মুকুল (লেখক), ৫। জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগ নেতা), ৬। আবদুল মোমিন (আওয়ামী লীগ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী), ৭। এস,এ, বারী এ টি (বিএনপি সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী, মরহুম), ৮। সৈয়দ কমরুদীন শহুদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক), ৯। আনোয়ারুল হক খান (মুজিব নগর সরকারের তথ্য সচিব), ১০। মঞ্জুর হোসেন (ডাক্তার, মরহুম), ১১। আনোয়ার হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা কাজী গোলাম মাহবুব এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে প্রবল ছাত্রমত তাহাদিগকে হতাশাগ্রস্ত করিয়া ফেলে। পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিব কিনা, আমার নিকট জানিতে চাহিলে আমি বলিলাম, “উহা সাধারণ ছাত্রসভায় স্থির হইবে।” এই কথা বলিবার পর তাহাকে কোনপ্রকার বচসা বা বাক-বিতন্ডার সুযোগ না দিয়াই আমি দ্রুত অন্যদিকে চলিয়া যাই। কারণ, ২০শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত্রির সংগ্রাম পরিষদ সভায় কাজী গোলাম মাহবুব ও আমি পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রাখিয়াছিলাম। অর্থাৎ কাজী গোলাম মাহবুব ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে দৃঢ়মত প্রকাশ করিয়াছিলেন আর আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে স্পষ্ট বক্তব্য পেশ করি।

ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, আর্টস ফ্যাকালটির ডিন ডঃ জুবেরী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ নিউম্যানকে লইয়া ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আগমন করিলে ছাত্ররা ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবকে ছাত্র সভায় সভাপতিত্ব করিতে অনুরোধ জানায়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিবে না শর্তে তিনি সভাপতিত্ব করিতে সম্মত আছেন বলিয়া জানান। সাধারণ ছাত্রবৃন্দ বিনয়ের সহিত তাহার শর্ত গ্রহণ করিতে অসম্মতি জানায়।

যুবলীগ নেতা এম, আর আখতার (মুকুল) এর প্রস্তাবক্রমে ও যুবলীগ কর্মী কমরউদ্দীন শহুদের সমর্থনে যুবলীগ নেতা জনাব গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বেলা ১২টার দিকে সাধারণ ছাত্রসভা শুরু হয়। পরিতাপের বিষয়, ২১শে ফেব্রুয়ারির পর আন্দোলনের দুর্যোগময় দিনগুলিতে এম,আর, আখতার মুকুল গা ঢাকা দিয়াছিলেন। শুধু তাই নয়, ২৭শে ফেব্রুয়ারি তিনি কলিকাতায় পাড়ি জমান। যাহা হউক, সভা চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক সভায় উপস্থিত হন। তিনি এবং জনাব মোঃ তোয়াহা উক্ত সভায় কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করিতে ছাত্র সাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খানও বক্তৃতায় অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেন। এই সময়ে আমি সভা হইতে কয়েক গজ দূরে অবস্থিত মধুর ক্যান্টিনে বসা ছিলাম। সংগ্রামী কর্মীরা বক্তৃতা করিয়া পাল্টা শক্ত জবাব দিবার অনুরোধ জানাইলে আমি তাহাদিগকে বুঝাইয়া বলি যে, আমি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গিতে চাই। কিন্তু সেই সঙ্গে ইহাও চাই যে, সংগ্রাম পরিষদ অটুট থাকুক। এই মুহূর্তে আমি কোন বিতন্ডা চাই না। তাহাছাড়া আগামী দিনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনার স্বার্থেই আমার পক্ষে প্রকাশ্য সভায় সংগ্রাম কমিটির প্রতি কোন প্রকার প্রকাশ্য অনাস্থা দেখানো ভুল হইবে। পরবর্তী ঘটনাবলী প্রমাণ করে যে, আমার এই সিদ্ধান্ত নির্ভুল ছিল। উল্লেখ্য যে, এই সভাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন প্রত্যয়বাঞ্জক দৃঢ়তার সহিত তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “জালেম সরকারের নিষেধাজ্ঞা ১৪৪ ধারাকে প্রতিরোধ করা না হইলে, অনাগত দিনে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারও অবশিষ্ট থাকিবে না। সভায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সীদ্ধান্তের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করিয়া সংগ্রাম পরিষদকে লুপ্ত ঘোষণা পূর্বক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অতঃপর ৬ জন, ৮ জন ও ১০ জনের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করিবার দৃঢ় সংকল্পে স্বেচ্ছায় রাজপথে অপেক্ষমান পুলিশ বাহিনীর হস্তে গ্রেফতার হবার জন্য ভীতিহীন চিত্তে অগ্রসর হইতে থাকে। আত্মপ্রত্যয় উজ্জীবিত যুব সমাজের শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল আইন ভঙ্গ আন্দোলনে পুলিশ বাহিনী হতচকিত হইয়া পড়ে। কিন্তু তাই বলিয়া সরকারি গোয়েন্দা বিভাগ কর্তৃক নিয়োজিত নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী উস্কানিদাতাদের উপস্থিতি যে ছিল না, তাহা নহে। শান্তিপূর্ণ মিছিলকে উচ্ছৃঙ্খল করিয়া তুলিবার অপপ্রয়াসে এই উস্কানিদাত্যদল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন হইতে পুলিশ বাহিনীর উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করিতে শুরু করিয়া দেয়। জবাবে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত ছাত্রদের উপর কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অল্পক্ষণের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের শাস্ত-সুশৃঙ্খল আবহাওয়া উত্তপ্ত হইয়া উঠে। স্বাভাবিক কারণেই বিদ্রোহের আগুন জলিয়া উঠে ছাত্র সাধারণের ধমনীতে। উত্তেজনার এই মুহূর্তে রাওলাট এ্যাক্টের (১৯১৯) বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত সর্বভারতীয় অহিংস আইন অমান্য আন্দোলনের বিভিন্ন লোমহর্ষক ও রোমাঞ্চকর ঘটনাবলী আমার মনের দিগন্তে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। দেহ মনে এক অপূর্ব নৈতিক সাহস ও আত্মপ্রত্যয় সঞ্চারিত হইল। কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন ন্যায় ও সত্যের এই লড়াইয়ের দুর্গম ও বন্ধুর পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখিবার উৎসাহ ও উদ্যম জোগাইল। উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতেই অবশেষে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করে। পুলিশী হামলার মুখে ছাত্র সাধারণ ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়ে। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল হোস্টেলের প্রধান ফটকের নিকট আবার জমায়েত হই এবং সেখান হইতেই পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের ভবনগামী পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে আমাদের দাবি পেশ করিতে থাকি। ইহা ছিল ১৪৪ ধারা জনিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আমাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের অংশ। উল্লেখ্য যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল তখনকার পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের ভবনের (জগন্নাথ হল মিলনায়তন) অতি সন্নিকটে বর্তমান শহিদ মিনার সংলগ্ন পিছনের বিস্তৃত এলাকায় অবস্থিত ছিল। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের প্রধান ফটকে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে একজন ছাত্র কর্মীর মারফত জানিলাম যে, ছাত্র সভার সভাপতি জনাব গাজীউল হক কলা ভবনের দ্বিতলে হঠাৎ করিয়া জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িয়াছেন। তাহাকে দেখিতে যাওয়া প্রয়োজন। আমি কালবিলম্ব না করিয়া তাহার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম। তাঁহাকে সাহস হারাইতে মানা করিলাম। বলিলাম, আপনি এখন সুস্থ হইয়া উঠিয়াছেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়া মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে আসুন। এই বলিয়া আমি মেডিকেল কলেজ হোস্টেল চলিয়া আসি। সেই চরম সংকটাপন্ন সময়ে তাহার অনুপস্থিতি আমাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু তাহার উপস্থিতি সংগ্রামের মুহুর্তে এত কাম্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি আন্দোলনের স্নায়ুকেন্দ্র মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এলাকায় উপস্থিত হইতে পারেন নাই। এমনকি, ৭ই মার্চ আমার গ্রেফতার হওয়া অবধি জনাব গাজীউল হকের সহিত আমাদের আর দেখা হয় নাই। হয়ত বা গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়া, পর্বতপ্রমাণ দুর্লংঘনীয় বাধা অতিক্রম করিয়া আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছিবার সকল প্রচেষ্টাই তাহার ব্যর্থ হইয়াছিল।

এইদিকে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ও সংগ্রামী ছাত্র বিক্ষোভকারীদের পারস্পরিক ইট-পাটকেল বর্ষণের ফলে অবস্থা ক্রমশঃ আয়ত্বের বাইরে চলিয়া যায়। এমনি ঘোলাটে পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় ধৈর্য, সহনশীলতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় না দিয়া জেলা প্রশাসক কোরাইশী গুলী চালাইবার নির্দেশ দেন। হোস্টেল গেট সংলগ্ন ১১ নং ব্যারাকের পার্শ্বে অবস্থানরত রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের এম, এ, ক্লাসের ছাত্র আবুল বরকত বুলেটবিদ্ধ হইয়া ভুতলে পতিত হন। গুলীর আওয়াজে হতচকিত বিক্ষোভকারীরা সম্বিত ফিরিয়া পাইতে না পাইতেই আমরা সাদা শার্ট ও পায়জামা পরিহিত আবুল বরকতকে রক্তপাত ও ভূলুণ্ঠিত অবস্থায় দেখিতে পাই। তাহাকে ধরাধরি করিয়া হাসপাতালের উত্তরদিক প্রবেশদ্বার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া হোস্টেল অভিমুখে রওয়ানা দিতেই দেখিতে পাই যে, সংগ্রামী বন্ধুরা আর একটি লাশ পাঁজাকোল করিয়া আনিতেছে। নিকটবর্তী হইয়া মাথার দিকের কাপড় তুলিতেই দেখিতে পাইলাম ছাত্র বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম,এ, ক্লাসের ছাত্র সালাহউদ্দীনের মাথার খুলি নাই। কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য। কেবলমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীর পক্ষেই এই দৃশ্য অনুভব করা সম্ভব। ইহার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আমার দুর্বল লেখনীর সাধ্যাতীত।

প্রতিক্রিয়া

পুলিশের গুলী শুরু হয় আনুমানিক তিন ঘটিকার পর। নিহত হন আবুল বরকত, সালাহউদ্দীন, জব্বার, শফিউর রহমান ও নাম না জানা আরও কয়েকজন। ছাত্র হত্যার খবর দাবানলের মত ছাড়াইয়া পড়ে। ঢাকা শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস-আদালত এবং যানবাহন ধর্মঘটে নামিয়া আসে। পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ মুলতবি প্রস্তাব আনয়ন করেন এবং জনাব খায়রাত হোসেন ও বেগম আনোয়ারা খাতুন উক্ত প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানান। গুলী চালনার স্বপক্ষে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন কর্তৃক সাফাই গাহিবার প্রতিবাদে মাওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, বেগম আনোয়ারা খাতুন ও কংগ্রেস দলীয় সদস্যবৃন্দ আইন পরিষদ অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ পার্লামেন্টারি পার্টি হইতে পদত্যাগ করিয়া লীগ সদস্যদের মধ্যে প্রথম বিরোধী দল গঠন করেন, আজাদ সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রথমতঃ পার্লামেন্টারি পার্টি হইতে ও পর দিবস অর্থাৎ ২২শে ফেব্রুয়ারি পরিষদ সদস্য পদ হইতে ইস্তফা দেন।

পূর্ববঙ্গ গভর্নর ও পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের স্পিকার বরাবর লিখিত ইস্তফা পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ “বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদের আমার সদস্য পদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নূরুল আমিন সরকারের আমিও একজন সমর্থক, এই ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এতদুর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।”

ছাত্র হত্যার প্রেক্ষিতে মুহূর্তের মধ্যে ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করায় সরকার ভীত, সন্ত্রস্ত ও দিশাহারা হইয়া কান্ডজ্ঞানহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকা শহরে সান্ধা আইন জারি ও সেনাবাহিনী তলব করা হয়। গভীর রাত্রিতে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘেরাও করে ও মর্গ হইতে নিহত ছাত্রদের লাশ অন্যত্র অপসারিত করে। তাই, নিহতের মোট সংখ্যা সম্পর্কে দেশবাসীর মনে অনন্তকাল ধরিয়া একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন জাগিয়া থাকিবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা মাত্র চারজন, প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে প্রচুর সংশয় রহিয়াছে। হাসপাতালে ভর্তিকৃত ২০ জন আহতের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত ও আব্দুল জব্বার এবং বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র রফিক উদ্দিন আহমদ (২৭) প্রাণ ত্যাগ করেন। বাকী ১৭ জনের অবস্থাই আশংকাজনক ছিল।

শামসুল হকের আগমন

গুলির কিছুক্ষণ পর আনুমানিক অপরাহ্ন চার ঘটিকার দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক খবর পাঠাইলে আমি সেই শোকাভিভূত মুহূর্তে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল হইতে হাসপাতাল ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডের গেটের সম্মুখের চত্বরে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি। সদ্য সংঘটিত মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডে আমরা উভয়েই মর্মাহত। হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি আমাদের উভয়েরই বাকশক্তি যেন হরণ করিয়া নিয়েছিল। প্রকৃতিস্থ হইবার পর অত্যন্ত ধীর ও শান্ত কষ্টে উদ্ভূত পরিস্থিতির মূল্যায়নে নিবিষ্ট হইলাম। জনাব শামসুল হকের প্রশ্নোত্তরে আমি নিবেদন করিলাম যে, সর্বপ্রকার মতবিরোধ ও দ্বিধাদ্বন্দদ্ব পরিহার করিয়া এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা সঠিক হইয়াছে কি না, সেই অবাস্তর প্রসঙ্গ উত্থাপন না করিয়া পরবর্তী কর্মসূচী গ্রহণপূর্বক ঐক্যবদ্ধভাবে হত্যাকারী জালেম সরকারের সমুচিত জওয়াব দিতে হইবে। আমি আরো বলিলাম যে, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হইবে। অবশ্য জনাব হকের বক্তব্য ছিল যে, ২০শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত্রির বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে গৃহীত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করিবার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করিবার ফলে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের বিলুপ্তি ঘটিয়াছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির পটভূমিকায় আমি তাহার সহিত দ্বিমত ব্যক্ত করিলাম এবং তাঁহাকে দৃঢ়ভাবে বলিলাম যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করাকে অপরাধ বিবেচনা না করিয়া আমাদের আশু কর্তব্য ও নৈতিক দায়িত্ব হইতেছে, সাগ্রাম কমিটির নামে সঠিক ও বীরোচিত নেতৃত্ব দান। তদুত্তরে জনাব শামসুল হক দোষারোপ করিয়া মন্তব্য করিলেন, “তুমি ও তোমার পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ কর্মীরাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী”। তাহার সহিত আলোচনা বৃথা বুঝিতে পারিয়া অযথা কালক্ষেপন না করিয়া তাহাকে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে আসার অনুরোধ জানাইয়া বিদায় গ্রহণ করি। তিনি আমার অনুরোধের কোন জওয়াব না দিয়া কাজী গোলাম মাহবুব ও মোঃ তোয়াহার অবস্থান সম্পর্কে জানিতে চাহেন। তাহাকে জানাই যে, গোলাম মাহবুব ও মোঃ তোয়াহা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে তখনও আসেন নাই। আমি আরও বলি যে, হয়ত সময় এবং সুযোগ মত তাঁহারা আসিবেন। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় সবার সহিত দেখা হইবে এই আশা প্রকাশ করিয়া আমি ছাত্রাবাস অভিমুখে প্রস্থান করি।

পরবর্তী কর্মসূচী

ছাত্র হত্যাজনিত বিশেষ পরিস্থিতিতে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলটি আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল। মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের উত্তরদিকস্থ বটবৃক্ষে মাইকের হর্ণ বাঁধিয়া ২০ নং ব্যারাক হইতে আন্দোলন সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘোষণা ও আহ্বান জনতার উদ্দেশ্যে অবিরাম প্রচার করা হইতেছিল। মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং যুবলীগের নেতৃস্থানীয় সক্রিয় ব্যক্তিবর্গের যৌথ সভায় আমরা নিম্নলিখিত কর্মসূচী ঘোষণা করিঃ

(ক) ২২শে ফেব্রুয়ারি ভোর ৭টায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে গণ-গায়েবী জানাযা এবং (খ) গায়েৰী জানাযা সমাপনের পর জনসভা ও জঙ্গী মিছিল। মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের কন্ট্রোল রুম হইতে জনতার জ্ঞাতার্থে কর্মসূচী মাইকে বারবার ঘোষণা করা হইল।

নেতৃবর্গের ভূমিকা

এইদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলার তাগিদে আমাকেই উদ্যোগ গ্রহণ করিয়া ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত্রি ৯ ঘটিকায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলস্থ ৪ নং ব্যারাকের ৩ নং রুমে সাহসী ও উৎসাহী কর্মীদের এক সভা আহ্বান করিতে হয়। উক্ত বৈঠকে মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য জনাব গোলাম মাওলাকে অন্তর্বর্তীকালের জন্য অস্থায়ী আহ্বায়ক নিযুক্ত করিয়া আন্দোলনকে সঠিক নেতৃত্বদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যের অনুপস্থিতিতে আমাকে ও জনাব গোলাম মাওলাকে উক্ত বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হয়। সর্বজনাব শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, আবুল হাশিম, আবুল কাসেম, খয়রাত হোসেন, শামসুল আলম (ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি), মুজিবুল হক (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি), হেদায়েত হোসেন চৌধুরী (সাধারণ সম্পাদক, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) ও অন্যান্য সবাই গা ঢাকা দিয়াছিলেন। ফলে ২১শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর আন্দোলনের দারুণ সংকটময় ও বিপজ্জনক মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নেতৃবর্গ ও সাধারণ কর্মীদের উপর আন্দোলন পরিচালনার সমগ্র গুরুদায়িত্ব বর্তাইয়াছিল। বলাই বাহুল্য যে, এই আন্দোলনে জনতা ও নিঃস্বার্থ কর্মীরা অপূর্ব সংগ্রামী চেতনার পরিচয় দিয়াছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে ইহাই ছিল প্রকৃত পরিস্থিতি। বিভিন্ন মহল বিভিন্ন সময়ে ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলীকে এবং উহার সত্যকে বার বার বিকৃত করিয়াছে। এই প্রবণতা এখনও অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ও তাহাদের খয়েরখাগণ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে চরমভাবে বিকৃত করিয়া সুবিধামত ব্যবহার করিয়াছে।

২২শে ফেব্রুয়ারি ঘটনা

২২শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৮ ঘটিকায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে শহীদদের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত গায়েবী জানাজায় লক্ষাধিক লোক যোগদান করেন। শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করিয়া আল্লাহর দরবারে মোনাজাত সমাপনের পর পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক এডভোকেট ইমাদুল্লাহর সভাপতিত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির আহ্বানে আমাকে ২১শের সংযমের তাৎপর্য ও শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমার উপর বক্তৃতা করিতে হয়। উল্লেখ্য যে, আন্দোলনের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সেইদিন একা আমাকে বক্তৃতা করিতে হইয়াছিল। উক্ত বক্তৃতায় আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়প্রত্যয়ী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রামী জনতাকে বৈপ্লবিক অভিনন্দন জানাইয়া এক পর্যায়ে বলিয়াছিলাম, “শহীদদের জন্য ক্রন্দন করিব না, বরং ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণ করিব। সাদ্দাদ, নমরুদ ও ফেরাউনের পদাংক অনুসরণকারী খুনী উজীরে আলা নুরুল আমিন সরকারের হত্যার জবাব দিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মারফত, মাতৃভাষা বাংলাকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার দ্বারা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দের যাহারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করিয়াছেন, তাহাদের প্রতি নিবেদন, “ছাত্র হত্যার পর আন্দোলনে নূতন অধ্যায় সূচিত হইয়াছে; সর্বপ্রকার মতভেদ পরিহার করিয়া চলুন, ঐক্যবন্ধভাবে আন্দোলন পরিচালনা করি এবং খুনীকে সমুচিত জবাব দিই। হিম্মতে মর্দান মদদে খোদা।” আমার বক্তৃতার পর সভাপতি জনাব ইমাদুল্লাহ তাহার ভাষণে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।

এখানে উল্লেখ্য যে, জনাব ইমানুল্লাহ পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হইয়াছিলেন; জি গভীর পরিতাপের বিষয়, দূরারোগ্য বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া তিনি ১৯৫৬ সালের ৬ই এপ্রিল ইহধাম ত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন বাংলার রাজনৈতিক গগনের এক উজ্জল জ্যোতিষ্ক। তাহার অকাল মৃত্যুতে এ দেশের যুব আন্দোলন সবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে।

জঙ্গী মিছিল

যাহা হউক, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী আমরা লক্ষাধিক জনতার জঙ্গী মিছিলসহ রাজপথে বাহির হইয়া পড়ি। এই বিপ্লবী জনতার বিদ্রোহী কাফেলার পদভারে রাজধানীর রাজপথ প্রকম্পিত হয়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। অবর্ণনীয়! ৩ধু হৃদয়ংগম করা যায় অভিজ্ঞতার কোটরে রাখা যায়, কিছু ভাষায় রূপ দেওয়া যায় না।

“নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবর”, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”, “উর্দু-বাংলা বিরোধ মাই”, “খুনী নূরুল আমিনের বিচার চাই” খুনের বদলা খুন চাই ইত্যাদি গগনবিদারী ধ্বনি দিতে দিতে দৃপ্ত পদক্ষেপে মিছিল হাইকোর্ট ও কার্জন হল মধ্যস্থিত রাজপথ বাহিয়া আবদুল গণি রোডের দিকে মোড় নেয়। সেক্রেটারিয়েট-ইডেন বিল্ডিং আক্রমণ হওয়ার অহেতুক সংশয়ে ভীত পুলিশ বাহিনী মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করিবার প্রয়াসে লাঠিচার্জ শুরু করে ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এই অবস্থায় মিছিলের একটি অংশ কার্জন হল, ফজলুল হক হল ও ঢাকা হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। আমরা আপ্রাণ প্রচেষ্টায় তাহাদিগকে পুনঃসংগঠিত করি। আপোষহীন শপথের স্বাক্ষর বহনকারী ৬০/৭০ হাজার লোকের এই জঙ্গী মিছিলটি অতপর ঢাকা হলের পশ্চিম দিকের গেট দিয়া ধীর পদক্ষেপে নাজিমুদ্দিন রোড, চকবাজার, মোগলটুলী, ইসলামপুর ও পাটুয়াটুলীর উপর দিয়া সদরঘাট অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। সশস্ত্র সামরিক বাহিনী ভর্তি অসংখ্য ট্রাক পুরান ঢাকা শহরের রাজপথগুলিতে অবিরত টহল দিতেছিল। সুদীর্ঘ পথ অতিক্রমকালে রাস্তার উভয় পার্শ্বে অবস্থিত বাড়ির ছাদ, দ্বিতল ত্রিতল বারান্দা হইতে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, কিশোর-কিশোরী ও পুরবাসিনী সজল নয়নে কোথাও হাত নাড়িয়া, কোথাও পুষ্প বর্ষণ করিয়া, কোথাওবা দেশাত্মবোধক শ্লোগান দ্বারা আমাদিগকে অভিনন্দন জানাইতে ও উৎসাহ দিতে থাকে। যাহা হউক, মিছিলটি সদরঘাট মোড় হইতে ভিক্টোরিয়া পার্ক (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক) অভিমুখে রওয়ানা হইয়া জগন্নাথ কলেজের পুর্ব দিকস্থ গেটের নিকটবর্তী হইতেই পুলিশ বাধা প্রদান করে। কর্ডন ভাঙ্গিতে চেষ্টা করিতেই পুলিশ মিছিলকারীদের বেদম প্রহার শুরু করে ও বেপরোয়া কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করিতে থাকে। অবিরাম লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপে টিকিতে না পারিয়া আমাদের মিছিল ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়ে। আমি প্রথমে ড্রেনের ঢাকনীর নিচে ও পরে জগন্নাথ কলেজ অভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করি। জগন্নাথ কলেজের দারোয়ানের নিকট হইতে অবগত হই যে, পূর্বাহ্নে সদরঘাট এলাকা হইতে সংগঠিত একটি মিছিল ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ অফিসে অগ্নি সংযোগ করে। তাই পুলিশ কোন মিছিলকে অগ্রসর হইতে দিতেছে না।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ভারতীয় চর ও হিন্দু দ্বারা পরিচালিত, মর্নিং নিউজ এই নামে এক মিথ্যা, বানোয়াট ও অমর্যাদাকর সংবাদ পরিবেশন করায় অত্র এলাকায় ছাত্র জনতা ক্রোধান্বিত হইয়া বাঙালি-বিদ্বেষী পত্রিকাটির জুবিলী প্রেস অগ্নিদগ্ধ করে। জগন্নাথ কলেজের পার্শ্ববর্তী বাড়ির মালিকের অনুমতি গ্রহণপূর্বক সহকর্মী বন্ধুরা আমাকে কিছুক্ষণ ঐ বাড়িতে লুকাইয়া রাখে। অবস্থা কিছুটা শাস্তভাব ধারণ করিলে দৃঢ়চিত্ত, সদা সচেতন ও জাগ্রত সহকর্মী বন্ধুদের কড়া পাহারাবেষ্টিত হইয়া চোরা রাস্তা ও অলিগলি বাহিয়া অতি সন্তর্পণে ও সাবধানতার সহিত আন্দোলন পরিচালনা কেন্দ্র মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের পথে রওয়ানা দেই। সহকর্মী বন্ধুদের সতর্কতা অবলম্বনের কারণ এই ছিল যে, পাছে গোয়েন্দা বাহিনী কিংবা মুসলিম লীগ দালালদের কবলে পড়ি। তাহাদের এই অকৃত্রিম ভালবাসা, দরদ ও স্নেহ আমার স্মৃতিপটে অমূল্যনিধি হিসেবে আমৃত্যু বিরাজ করিবে। যাহা হউক, এই সন্তর্পণ প্রস্থানের পথেই কায়েৎটুলী মোড়ে রেলওয়ে ক্রসিং অর্থাৎ ঢাকা মিউজিয়ামের দক্ষিণ দিকস্থ রাজপথের দক্ষিণ দিকের রাস্তায় পৌঁছিলে সাইকেলে গমনরত বন্ধুবর জনাব তাজুদ্দিন আহমদের সাক্ষাৎ ঘটে। সে আমাকে অনুযোগ ও ধমকের সুরে শীঘ্র সাইকেলে উঠিবার নির্দেশ দিয়া বলে “এই ভাবে চলিলে যে কোন মুহূর্তে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করিয়া লইয়া যাইবে।” আমি কোন বাক্যব্যয় না করিয়া তাহার সাইকেলের সিট ও হ্যান্ডেলবারের মধ্যবর্তী ডান্ডায় বসিয়া পড়ি। তাজুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে আমাকে নামাইয়া প্রস্থানোদ্যত হইলে আমি তাহাকে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যোগ দিতে বলি। প্রত্যুত্তরে কিছু না বলিয়া সে মুহূর্তের মধ্যে অন্তর্ধান হইয়া যায়। কোন সংকটজনক পরিস্থিতিতে পড়লে কোন প্রকার উচ্চবাচ্য না করিয়া হাসিয়া অন্য প্রশ্নের অবতারণা করা ছিল তাহার স্বভাব। সরকার ও সরকার বিরোধী তথ্য কর্তৃপক্ষ ও কর্তৃপক্ষ বিরোধী শক্তিদ্বয়ের সংঘাতে ছাত্র জীবনে সবসময় সে গা বাঁচিয়ে চলিত। তাই ছাত্রজীবনে তাহার গায়ে কর্তৃপক্ষের সামান্যতম আঁচড়ও লাগে নাই।

ভাষা আন্দোলনের না বলা কিছু ঘটনা

গাদ্দারে কওম খাকছার পার্টির নেতা আল্লামা মাশরেকী, মাওলানা মওদুদী, দেওবন্দি হোসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা আজাদ গোষ্ঠীর মোল্লারা যথা গান্ধী মহারাজের চেলারা যেমনি হিন্দুস্তান মুসলিম আবাসভূমির প্রবক্তা কায়েদে আজমকে’ কাফেরে আজম বলে, তারা আদাজল খেয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছিল। আল্লামা মাশরেকী কায়েদে আজমকে হত্যার জন্য তার বোম্বের মালাবারহিল বাসভবনে এক খাকছার-কে পাঠায়, সেই থাকছারই ছুরিকাঘাতে কায়েদে আজমকে আহত করে। তেমনি ১৯৫২ সালে বিদ্রোহী ২১শে ফেব্রুয়ারি ও ২১শে ফেব্রুয়ারি উত্তর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রাজপথ কাঁপানো রক্তাক্ত সংগ্রামের বিরুদ্ধে ছিল। মুলত উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিল তাদের অবস্থান। কৌশলে বলত “আরবি হরফে বাংলা লিখতে চাই। একইভাবে বাংলার রক্তক্ষয়ী আজাদী সংগ্রামে তারা ছিল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আলবদর আল-শামস” রাজাকার ও খুনী বাহিনীর সংগঠক।

রক্তস্নাত বিদ্রোহী ২১শে ফেব্রুয়ারির পূর্বদিন ২০শে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে খুনী নূরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ধনুর্ভঙ্গ পণে, কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃত্ব (মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী ঢাকার বাহিরে নরসিংদীর গ্রামাঞ্চলে জনসভায় ছিলেন) যথা আতাউর রহমান খান, জেনারেল সেক্রেটারি শামসুল হক, তদানীন্তন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সহ-সভাপতি খয়রাত হোসেন এম, এল, এ, মিসেস আনোয়ারা খাতুন এম, এল, এ, তমদ্দুন মজলিশ নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেমসহ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান, তাদের সহনেতা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর কাজী গোলাম মাহবুব ও পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সহ-সভাপতি মোঃ তোয়াহা প্রমুখ অনেকেই জনাব আবুল হাশিম-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারিতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী ছিল। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি কমিটি অব একশন কনভেনর আবদুল মতিন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন সহ-সভাপতি গোলাম মাওলা, ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি শামসুল আলম ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দেন। অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ৪ ভোট এবং বিপক্ষে ১১ ভোট পড়ে। ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল সামনে নির্বাচন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হবে হঠকারী। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের আন্দোলনে গেলে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাব। নির্বাচনে অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে যাবে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নূরুল আমিনের মুখ্য মন্ত্রিত্বকালে সাধারণ নির্বাচন হয়। এবং বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ বিরোধীরাই যুক্তফ্রন্টের পতাকাতলে নির্বাচিত হয় ও মন্ত্রী মেম্বার-প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হয়-বাড়ি গাড়ি অবৈধ অর্থের কুমীর হয়। মওলানা ভাসানী বা ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী কেউই মন্ত্রী-মেম্বার হয় নাই বা অবৈধ বাড়ি-গাড়ির মালিকও হয় নাই- ইহাই ইতিহাস কেউ মানোক আর না মানোক। মোঃ সুলতান ১৪৪ ধারা ভংগকারীদের একজন। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় বিনা চিকিৎসায় তাকে মরতে হয়েছে। বেতের টুপি আর লুঙ্গীওয়ালা মওলানা ভাসানীর ইত্তেফাক পত্রিকা অন্যায়ভাবে তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) স্বীয় নামে সরকারি প্রভাবে হস্তান্তর করে নেয়। সর্বজন বরেণ্য মওলানা ভাসানীর মত নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের ইহাই যদি অদৃষ্ট হয়, তাহলে সৎ নিষ্ঠ সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীদের ভাগ্য হবে রাস্তাঘাটে দিন গুজরান।

সুফিয়া খান এশিয়ার প্রাচীনতম মহিলা কলেজ Lady Hardinge college for women হতে বি,এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নিবাস চামেলী হাউসে রেসিডেন্ট ছাত্রী হিসেবে এম,এ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সাল হইতে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অত্যন্ত বিদ্রোহী ছাত্রী নেত্রী হিসেবে আত্ম প্রকাশ করেন। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা লগ্নে যেমনি, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভূক কর্মচারী আন্দোলনে ও ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত মারমুখী। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাক যুবলীগ গঠনের সম্মেলনে তিনি একজন উৎসাহী সংগঠক ছিলেন। পরিতাপের বিষয় ৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন থেকে রক্তক্ষরা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গন কোথাও তিনি আমার নজরে পড়েন নাই।

একুশে ফেব্রুয়ারির আমতলার সভায় টিয়ার গ্যাস সেলে জ্ঞান হারানোর দাবিদার গাজীউল হক জ্ঞান ফিরে পাবার পর রাতেই নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস ট্রেনে করে ২২শে ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি ময়মনসিংহে নেমে ডঃ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও অবিভক্ত বাংলার শেরে বাংলার নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টির নির্বাচিত বেঙ্গল লেজেসলিটিভ এসেম্বলীর সাবেক সদস্য (এম,এল,এ) জনাব আব্দুল মজিদ সাহেবের বাড়িতে হাজির হলে ডঃ সিদ্দিকী হতভম্ব হয়ে গেলেন। আর পূর্ব প্রচারিত গাজীউল হকের মৃত দেহের পরিবর্তে জীবিত গাজীউল হককে সশরীরে বগুড়ায় দেখে স্তম্ভিত ও হতবাক বগুড়া রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক ও বগুড়া যুবলীগ সম্পাদক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ।

আরেকজন জনাব এম, আর, আখতার মুকুল ঐতিহাসিক রক্তস্নাত ২১শে ফেব্রুয়ারি আমতলার ছাত্র জনসভার পর পরই ঢাকা হতে উধাও হন এবং কোলকাতা নগরীতে নিরাপদ আশ্রয়ে কাল কাটান। জনাব শহীদুল্লাহ কায়সারও তার দল কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন কমরেড শহিদুল্লাহ কায়সার কলিকাতা হতে প্রকাশিত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতা বিক্রি করতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল আসেন। তাতে ঢাকার পুলিশের গুলির খবর ছিল। আমি তাঁকে পত্রিকাগুলিসহ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণ হতে বিদায় করেছিলাম। উল্লেখ্য, ভারতীয় পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’ এদেশে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে মুসলিম লীগের তরফ থেকে এ ধরনের প্রচারণা ছিল তখন এন্তার। একমাত্র মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি গোলাম মাওলা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলেই অবস্থান করেন এবং আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশেই বোধ হয় ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথে ২১শে ফেব্রুয়ারির রাত হতে জনাব মোঃ তোয়াহা ও আবদুল মতিনকে দেখা যায় নাই। ৭ মার্চ “গ্রেফতার দিবস” সন্ধ্যা রাতে জনাব তোয়াহা ও আব্দুল মতিন আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন এবং সেই সভাতেই সর্বজনাব সাদেক খান, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, মুজিবুল হক ও মীর্জা গোলাম হাফিজের সাথে আমি গ্রেফতার হই। স্বীয় বুদ্ধিমত্তার কারণেই জনাব কাজী গোলাম মাহবুব সভায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি কারামুক্তি পেলেন। কিন্তু ঢাকা নারায়ণগঞ্জ আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ঢাকায় এলেন না নেতৃত্বে দিতে, বিদ্রোহের অনলেও ঝাঁপ দিলেন না। এমন কি খুনী শাসক নূরুল আমীনের বিরুদ্ধে ৫ই মার্চ দেশব্যাপী যে হরতালের ডাক দেওয়া হয় শেখ মুজিব তাতে অংশগ্রহণ করে মারমুখো জনতাকে নেতৃত্ব দিতে ঢাকায় আসেন নাই। তারপরও মুখপোড়া আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় দালাল চামচারা বলে ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবর নাকি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ধিক তাদেরকে।

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে যারা জীবন বাজী রেখে রক্তঝরা দিনগুলোতে সর্বক্ষণ রাজপথ দখল করে রাখে, উত্তপ্ত রাখে এবং আন্দোলন মুখর লাখো সগ্রামী জনতাকে নেতৃত্ব দেয় জাতির সাচ্চা সন্তান হিসাবে তারা হলেন মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র আজমল, আবদুস সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোঃ সুলতান, পূর্ব-পাকিস্তান যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক এডআেকেট মোঃ ইমদাদুল্লাহ, সাহিত্যিক, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, প্রফেসর কাজী আজিজুর রহমান, আনিসুজ্জামান, নিয়ামুল বশির, ডাঃ মন্জুর হোসেন, আমীর আলী প্রমুখ যুবলীগের শত শত নেতাকর্মী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সেদিনের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের আন্দোলন উত্তালমুখর দিনগুলোতে আন্দোলন যারা গড়ে তুলেছিলেন তাদের অনেকের মধ্যে যাদের নাম মনে পড়ে তারা হলেন নারায়ণগঞ্জ মর্গান গার্লস স্কুলের হেড মিস্ট্রেস অকোতভয় অগ্নিকন্যা মমতাজ বেগম, পূর্ব পাক যুবলীগ সহ-সভাপতি সামসুজ্জোহা, পূর্ব পাক যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সফি হোসেন খান ছাড়াও ডাঃ মুজিবুর রহমান, যুবলীগ নেতা কর্মীবৃন্দ সর্বজনাব মোস্তফা সরওয়ার, জামির, আলহাজ্ব আজগর হোসান ভূঁইয়া, ৯ বৎসরের বালক মোসলেউদ্দিন, গোলাম মোর্শেদ, আলহাজ জানে আলম, মফিজ আহমেদ, বজলুর রহমান, সুলতান মাহমুদ মল্লিক, জালাল উদ্দিন আহমেদ, বিচারপতি বদরুদ্দোজা, রহিছ উদ্দিন, মশিউর রহমান, মজিবুর রহমান, নাজির মুক্তার, নাসির উল্লাহ, মোতালেব, হাবিবুর রহমান, নুরুল ইসলাম মল্লিক, ওয়াকিল মিয়া, খাজা জহিরুল হক, বশির উদ্দিন আহম্মেদ, নাসির উদ্দিন আহম্মেদ, আমীর আলী মিয়া, মোস্তফা মনোয়ার, সাহাবুদ্দিন, নিখিল ও শামসুর রহমান প্রমুখ।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি দার্শনিক বিপ্লবী আবুল হাশেম কর্তৃক সম্পাদিত ৩নং ওয়েলেশলী ট্রাস্ট হইতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক উপন্যাসিক জনাব কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস। বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে কার্য্যব্যপোদেশে কলিকাতা গমন করিলে ৩নং ওয়েলেসলী স্ট্রিট অবস্থান করিতাম। তথায় জনাব কাজী মোহাম্মদ ইদ্রীসের সাথে দেখা ও পরিচয় হয়। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গার কারণে তিনি ঢাকা চলে আসেন। ১৯৫১ সালে ওজিরে আলা নুরুল আমীনের মালিকানায় দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন নুরুল আমীনের আত্মীয় খায়রুল কবির ও সহ সম্পাদক ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী। ইদ্রিস ভাই দৈনিক সংবাদে সম্পাদকীয় লিখতেন। ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ইদ্রীস ভাই ২২শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিলেন কিন্তু সম্পাদক জনাব খায়রুল কবির ও সহ-সম্পাদক জনাব জহুর হোসেন চৌধুরী প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন, ফলে তিনি সংবাদ অফিস ছেড়ে চলে গেলেন। আদর্শ পুরুষেরা এরূপই করে- বিবেকের তাড়নায়- আত্মসম্পর্কে অগ্রাধিকার দেয় না- আজকাল সংবাদপত্র জগতে এটা দেখা যায় না।

নিহতদের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে

ইতিপূর্বে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসে আক্রান্ত মিছিলের অপর অংশ কার্জন হল, ফজলুল হক হল সংলগ্ন পূর্বদিকস্থ রাজপথ দিয়া অগ্রসর হইতে থাকে। মিছিলটি অতঃপর রেলওয়ে হাসপাতালের দক্ষিণ দিকস্থ রাজপথ বাহিয়া নওয়াবপুর রোড দিয়া সদরঘাট অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। পথে বংশাল রোডে অবস্থিত মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বাংলা দৈনিক সংবাদ অফিস আক্রমণ করে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী প্রথমে লাঠিচার্জ, কাদানে গ্যাস ব্যবহার করে এবং অবশেষে গুলী চালায়। গুলীতে অকুস্থলেই আবদুস সালাম নামক একজন রিক্সাচালক প্রাণত্যাগ করে। মেহনতি জনতার প্রতিভূ আবদুস সালাম এইভাবে মাতৃভাষার বিরুদ্ধাচারণকারী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিয়া এবং স্বীয় পরিবার পরিজনকে অভাব-অনটনের অকূল সাগরে ভাসাইয়া সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করিয়া গিয়াছেন যে, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম কেবলমাত্র ছাত্রদের সংগ্রাম নহে, বরং এই সংগ্রাম মেহনতি আপামর বাংলা ভাষাভাষী সকলের। তাঁহার এই আত্মোৎসর্গের দৃষ্টান্ত দেশবাসীর স্মৃতিতে চিরকাল দেদীপ্যমান থাকিবে। ছত্রভঙ্গ শোভাযাত্রীরা পুনরায় সদরঘাটের পথে রওয়ানা দিলে নওয়াবপুর রোডে অবস্থিত অধুনালুপ্ত ‘খাসমহল রেস্টুরেন্টের’ সন্নিকটে পুনরায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সহিত তাহাদের সংঘর্ষ ঘটে। এই সংঘর্ষেই হাইকোর্ট কর্মচারী শফিউর রহমান পুলিশের গুলীতে গুরুতরভাবে আহত হন এবং পরবর্তীকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া মাতৃভাষার মান রক্ষার সংগ্রামে অকাতরে প্রাণ দেওয়ার মত চরম ত্যাগের আহ্বান রাখিয়া যান। ২২শে ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্কের পার্শবর্তী এলাকায় এবং নওয়াবপুর রোড ও বংশাল রোডে সংগ্রামী জনতার উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের ফলে কতজন শাহাদৎ বরণ করিয়াছেন তাহা আমাদের কেহই সঠিকভাবে বলিতে পারি না। অবশ্য ‘দৈনিক আজাদী ২৩শে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ২২শে ফেব্রুয়ারি গুলীবর্ষণে চারজন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার সংবাদ পরিবেশন করিয়াছিল। নিহতের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার অন্যতম কারণ হইতেছে এই যে, জালেম সরকার শহীদদের লাশ গুম করিয়া ফেলিত। তদুপরি ছিল আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। ইহার কারণে সঠিক খবর আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছায় না। আমি যতটুকু জানি, ততটুকুই লিপিবদ্ধ করিতেছি। তবে হাইকোর্টের সম্মুখস্থ রাজপথে মিছিলকারীদের উপর কোন গুলী চালনা করা হয় নাই। অতএব সেইখানে হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমানের নিহত হওয়ার যে দাবি তাহা সঠিক নহে। আমি স্বয়ং উক্ত মিছিল পরিচালনা করিতেছিলাম। শফিউর রহমান নিহত হন নওয়াবপুর রোডের গুলীবর্ষণে। প্রসঙ্গতঃ আরও উল্লেখ্য যে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গায়েবী জানাযায় যোগ দেন নাই এবং জানাযার পর মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণ হইতে বহির্গত মিছিলের কোন পর্যায়েই তিনি অংশগ্রহণ করেন নাই। যুবলীগ নেতৃবর্গ এবং সাধারণ ছাত্র কর্মীরাই সেইদিনকার সেই দুঃসাহসিক জঙ্গী মিছিল পরিচালনা করিয়াছিলেন। অনা কোন নেতারই সাক্ষাৎ সেইদিন মিলে নাই; বরং কোন কোন স্বনামধন্য ব্যক্তি নাগরিক কমিটির নামে আন্দোলনকে পিছন হইতে ছুরিকাঘাত করিয়া সরকারি আনুকুল্য কুড়াইবার চেষ্টা করিয়াছেন। শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক, কামরুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ উক্ত নাগরিক কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।

২৩শে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট

ঐদিনই অর্থাৎ ২২ শে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে আমি মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে আন্দোলনের চরম মুহূর্তের সহযোগী সর্বজনাব গোলাম মাওলা, মোঃ সুলতান (যুগ্ম সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ) জনাব মোঃ ইমাদুল্লাহ ও অন্যান্য নিঃস্বার্থ সক্রিয় কর্মীবৃন্দের সহিত এক সভায় মিলিত হই। সেই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৩শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ হরতাল পালনের আহ্বান জানাই। ইতিমম্যে সগ্রামী ছাত্রদের উদ্যোগে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ফজলুল হক হলে আন্দোলনের স্বার্থে কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয় এবং এই কন্ট্রোল রুমগুলি হইতে মাইকযোগে প্রচারকার্য অব্যাহত থাকে। আমাদের গৃহীত সাধারণ হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত উপরে বর্ণিত হলগুলির কন্ট্রোল রুম ও মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের কন্ট্রোল রুম হইতে প্রচারিত হইতে থাকে। এইভাবেই ছাত্রদের সীমাবদ্ধ আন্দোলন দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।

 শহিদ মিনার

সেই দিনই অর্থাৎ ২২শে ফেব্রুয়ারি সূর্যাস্তের সময় মোঃ সুলতান কয়েকজন যুবলীগ কর্মীসহ আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং যেখানে পরবর্তী দিবসে (২১শে ফেব্রুয়ারি) প্রথম শুলী চালনা করা হইয়াছে সেইখানে শহিদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাব রাখেন। নিহত সহযোগী ভাইদের প্রতি প্রাণচঞ্চল কর্মীদের অকৃত্রিম মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি আমাকে অভিভূত করে। ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলী সম্পর্কে আজ যাহারা দলীয় বা বাক্তি স্বার্থে অসত্য বক্তব্য রাখিতেছেন, তাহাদের কেহই সেই আন্দোলনে কিংবা আবেগঘন ঐতিহাসিক লগ্নে উপস্থিত ছিলেন না। সরল ও সর্বস্বত্যাগে প্রস্তুত দুঃসাহসী কর্মীদের হৃদয়ের অনুভূতি তাহারা বুঝিবেন না। মিথ্যার ফুলঝুরি রচনায় তাই তাহাদের বিন্দুমাত্র কৃষ্ঠা জাগে না। মাতৃভাষা ও দেশমাতৃকার জন্য প্রথম আত্মোৎসর্গকে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবার প্রস্তাবে আমি সানন্দে সম্মতি দিলাম। কোথা হইতে ইট, সুরকি, সিমেন্ট ও অন্যান্য মাল যোগাড় হইল জানি না। তবে এই প্রাণচঞ্চল তরুণরাই সারারাত ধরিয়া অমানুষিক পরিশ্রমে মেডিকেল কলেজের সিনিয়র ছাত্র বদিউল আলম কর্তৃক অঙ্কিত নকশা মোতাবেক প্রধম শহিদ মিনার নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করেন। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে যিনি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যপদ হইতে ইস্তফা দিয়াছিলেন, দৈনিক আজাদ সম্পাদক সেই আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২৩শে ফেব্রুয়ারি শহিদ স্মৃতিস্তুটি উদ্বোধন করিয়া একদিকে যুব ছাত্র জনতার কৃতজ্ঞতা কৃতজ্ঞতাভাজন ও অন্যদিকে জালেম সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হন। রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় প্রশ্নে তাহার সহিত আমাদের মৌলিক পার্থক্য থাকা সক্ত্বেও শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্বীকার করিতেই হয় যে, তাহার সাহিত্যিক মন সঠিক মুহূর্তেই বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছিল এবং সর্বপ্রকার আত্ম্বস্বার্থের উর্ধ্বে উঠিয়া তিনি এই সংগ্রামী চেতনার সহিত একাত্ম হইয়া গিয়াছিলেন। সত্যাশ্রয়ী ও হৃদয়বান মানুষেরা এইভাবেই ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় নিজেদের অবদান রাখেন।

২১শে ফেব্রুয়ারির শোকাহত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন ঢাকা কলেজের ছাত্র বর্তমানের প্রথিতযশা সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” এই কালজয়ী কবিতাটি লিখেন। প্রথমে এর সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ, পরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুরারোপ করেন। বর্তমানে যে সুরে গানটি গাওয়া হয় এবং যে সুরে এই কবিতাটির পক্তিমালা এদেশের মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে সেটি আলতাফ মাহমুদেরই করা সুর।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি

                                আমি কি ভুলিতে পারি।।

জাগো নাগিনীরা জাগো জাগো কালবোশেষীরা

শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,

আমার দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি

দিন বদলের ক্রান্তি লগনে তবু তোরা পার পাবি?

না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি

সেদিনো এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে

রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;

পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেনো,

এমন সময় ঝড় এলো এক, ঝড় এলো ক্ষ্যাপা বুনো।

সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,

তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা

ওরা গুলি ছোড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবিকে রেখে

ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই বাংলার বুকে

ওরা এদেশের নয়,

দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়

ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি

আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী

আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে

জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে

দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

এখানে উল্লখ্যে যে, ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাত্রে পুলিশ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া দেয়। এই প্রথম শহিদ মিনার ভাঙ্গিয়া দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্স ক্লাসের ছাত্র আলাউদ্দিন আল আজাদ ইকবাল হলে বসিয়া নিম্নোক্ত কবিতা রচনা করেন:

স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো  

চার কোটি পরিবার।

খাড়া রোয়েছিতো যে ভীত কখনো রাজন্য

পারেনি ভাঙ্গতে

হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা, খোলা তলোয়ার

সুরের ঝটিকা ধুলায় চূর্ণ যে পদপ্রান্তে

যারা বুনি ধান

গুন টানি আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই

সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।

ইটের মিনার

ভেঙ্গেছে ভাঙ্গুক। ভয় কি বন্ধু দেখ একবার আমরা জাগরী

চার কোটি পরিবার।

এ কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,

শিয়রে যাহার উঠে না কান্না, ঝরে না অশ্রু?

হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং

সম বেদনা হয়ে উঠে এর পতাকার রং;

এ কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,

বিরহে যে গানে নেই হাহাকার? কেবল সে তার

হ’য় এবার মোহনীয় ধারা, অনেক কথার

পদাতিক ঋতু কলমের দেয় কবিতার কাল?

ইটের মিনার ভেঙ্গেছে ভাঙ্গুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা

চার কোটি কারিগর

বেহালার সুরে রাঙ্গা হল এর বর্ণ লেখায়

পলাশের আর

রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়

দ্বীপ হয়ে তাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই

শহীদের নাম

এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নামে।

তাই আমাদের

হাজার মুঠির বন শিখরে সূর্যের মতো জলে শুধু এক

শপথের ভাস্কর।।

যাহা হউক, ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এককভাবে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক প্রণীত নির্বাচনী ওয়াদায় ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ওয়াদা ছিল। ১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জনাব আবু হোসেন সরকার শহিদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করিবার পর জনাব আতাউর রহমান খান শহিদ মিনারের প্রিন্ট ও ডিজাইন তৈরির জন্য প্রখ্যাত স্থপতি হামিদুর রহমানকে নিযুক্ত করেন। শহিদ মিনারের অঙ্গশোভা পরিকল্পনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও শিল্পী কামরুল হাসান। স্থপতি হামিদুর রহমানের মূল নকশা ছিল নিম্নরূপ:

১। স্তম্ভগুলির সামনের চত্বরের মধ্যস্থলে একটি সরোবর

২। সরোবরে রক্তকমল শাপলা।।

৩। স্তম্ভগুলির অবনত মাথার ছায়া।

৪। স্তম্ভগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকে ফাঁকে শিক।

৫। মূল শহিদবেদীর দুই পার্শ্বে দুইটি সবুজ কামরা। একটি পাঠাগার, অন্যটি যাদুঘর।

৬। মূল চত্বরের বাহিরে একটি বেদী। উঁচুবের্দী হইবে সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের স্থান।

স্থপতির ব্যাখ্যা:

১। মূল বেদী জন্মভূমি

২। অবনত মাথা, স্তম্ভগুলি ও পাশের স্তম্ভগুলি জনতা।

৩। স্বচ্ছজলঃ শহিদের আত্মা।

৪। রক্তকমল শাপলাঃ আত্মদানের প্রতীক।

৫। সরোবরে অবনত শিরে ছায়া শহিদদের আত্মদানের প্রতি দেশবাসীর কৃতজ্ঞতা

আতাউর রহমান খানের সরকার পরিকল্পনা প্রণয়ণে দক্ষতার পরিচয় দিলেও দুই বৎসরাধিক ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও স্থপতির ঐকান্তিক চেষ্টায় অঙ্কিত নকশা মোতাবেক শহিদ মিনার নির্মাণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন উর্দুভাষী গভর্নর লেঃ জেঃ আযম খান বর্তমান শহিদ মিনার নির্মাণের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ বরকতের মা উক্ত মিনারটির উদ্বোধন করেন। বলাই বাহুল্য যে, লেঃ জেঃ আযম খান নির্মিত শহিদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রহমান কর্তৃক অঙ্কিত নকশার আংশিক বাস্তবায়ন মাত্র।

নুরুল আমিনের ঘোষণা: দেন-দরবার

২২শে ফেব্রুয়ারি ভীতসন্ত্রস্ত নুরুল আমিন সরকার কর্তৃক বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার প্রস্তাবক্রমে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদ কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট উক্ত মর্মে সুপারিশ করে। আন্দোলনের ভয়াবহ রূপ অবলোকন করিয়া ২৪শে ফেব্রুয়ারি সরকার পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ বাজেট অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবী ঘোষণা করে। এইদিকে আন্দোলনের বৈপ্লবিক রূপদূষ্টে আরাম কেদারার রাজনীতিবিদ ও বৈঠক খানার বৈঠকী রাজনীতিবিদদের আঁতে ঘা লাগে। তাহারা Citizens Committee বা নাগরিক পরিষদ গঠন করেন এবং ঐ কমিটির তরফ হইতে জনাব কামরুদ্দিন আহমদ সমঝোতা আনয়নের জনা আমাদের ও মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সরকারের মধ্যে বৈঠকের প্রস্তাব দেন। বৈঠকের এই প্রস্তাবাবলী মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে আমাদের নিকট পাঠান হয়। আমরা নাগরিক পরিষদের নেতৃবর্গের প্রতি যথারীতি শ্রদ্ধার সহিত নিবেদন করি, ঢাকার রাজপথে মিছিলে নেতৃত্ব দিন ও জনতার কাতারে শামিল হউন। ইহার বিকল্প যে কোন প্রচেষ্টাকে দেশবাসী বিশ্বাসঘাতকতা বলিয়া চিহ্নিত করিবে।

এই সময়ে শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সদর দরজায় উপস্থিত হইয়া ৫০০/ (পাঁচশত টাকা) চাঁদা দিতে চাহেন এবং আমাকে তাহার সহিত দেখা করিতে খবর পাঠান। সর্বজনমান্য শেরে বাংলা উপরোল্লিখিত নাগরিক কমিটির (Citizens Committee) অন্যতম নেতা এবং তিনি তখনও ঢাকা হাইকোর্টে নুরুল আমিন সরকার কর্তৃক নিযুক্ত সরকারি বেতনভুক্ত এডভোকেট জেনারেল। তাই তাহার সহিত আন্দোলনের এই সংকটময় মুহূর্তে দেখা না করাই শ্রেয় মনে করি।

রেলওয়ে ধর্মঘট

ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মোঃ সুলতান, কাজী আজিজুর রহমান এবং কতিপয় উৎসাহী ও সাহসী যুবলীগ কর্মীসহ আমার নিকট রেলওয়ে ধর্মঘট তথা রেলের চাকা বন্ধ করিবার প্রস্তাব নিয়া আসে এবং এই ব্যাপারে আমার মতামত জানিতে চায়। আমি সর্বাত্মক ধর্মঘটের পক্ষে আছি এবং ইহা ছাড়া সরকারকে নতজানু করা সম্ভব হইবে না বলিয়া তাহাদের জানাই। তাঁহারা নানা কৌশলে রেলের চাকা কার্যতঃ বন্ধ করিতে সমর্থ হয়; কিন্তু ইহার ফলে নাজিরাবাজার ও ঢাকা ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশ লাঠিচার্জ করে।

২৩ শে ফেব্রুয়ারির বৈঠক

কতিপয় সৎ, সাহসী ও উদ্যোগী কর্মীর প্রচেষ্টায় ২৩শে ফেব্রুয়ারি শনিবার বিকাল তিনটায় সেই সময়ে কারারুদ্ধ কর্মী আজমল হোসেনের মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে কামরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক বৈঠক হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জনাব আবুল হাশিম। সভাপতির আসন হইতে জনাব আবুল হাশিম আমাকে লক্ষ্য করিয়া প্রশ্ন করেন, “অলি আহাদ, আন্দোলনকে আর কত দূর নিতে চাও এবং আর সামনে নেওয়া সম্ভব কিনা?” সভাপতির প্রশ্নের জবাবে আমি বলি যে, “স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন সম্ভাব্য চরম সীমায় পৌঁছিয়াছে এবং আন্দোলনে ভাটার চিহ্ন দেখা দিয়াছে। তদুপরি অবিরাম আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার মত সাংগঠনিক শক্তি এই পর্যায়ে আমাদের নাই। সুতরাং honourable retreat বা সম্মানজনক পশ্চাদপসরণই আমার দৃঢ় মত।”

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কেহ কেহ এই বৈঠকের আহ্বায়করূপে কাজী গোলাম মাহবুবের স্থলে জনাব আতাউর রহমান খানের নাম উল্লেখ করেন। ইহা সর্বৈব ভুল। ৭ই মার্চ রাত্রে আমরা গ্রেফতার হওয়ায় আন্দোলন প্রশমিত হইয়া পরিস্থিতি শান্তভাব ধারণ করিলে পরবর্তী সময়ে আতাউর রহমান খানকে কর্মপরিষদের আহ্বায়ক করা হয়। ২৪শে ফেব্রুয়ারি রবিবার বিধায় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হইতে আমরা ২৫শে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ সোমবার ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট ও ৫ই মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী হরতাল ঘোষণা করি।

 সরকারি জুলুমের আরেক পর্যায়ে

২৩শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত্রিতে জনাব আবুল হাশিম, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং জনাব খয়রাত হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রষ্টর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত গুহ নিরাপত্তা আইনে কারারুদ্ধ করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ও অন্যান্য ছাত্রাবাসের কন্ট্রোল রুম হইতে সরকারের সশস্ত্র বাহিনী মাইক ছিনাইয়া লইয়া যায় এবং নৱনির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি চুরমার করিয়া দেয়। সরকার শুধু ইহাতেই ক্ষান্ত হয় নাই।

অবস্থা আয়ত্বাধীন নহে অজুহাতে এবং শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট সভা শোভাযাত্রা বলপ্রয়োগে দমাইয়া দেওয়ার অশুভ চিন্তা হইতেই সরকার আকস্মিকভাবে ২৪শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট সেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবী ঘোষণা করেন। জ্ঞানতাপস ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সরকারের চন্ডনীতির বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করিলে আকস্মিকভাবেই ২৫শে ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয় এবং আবাসিক ছাত্র দিগকে ছাত্রাবাস ত্যাগ করিতে বাধ্য করা হয়। পুলিশ বাহিনী দুইঘন্টাকালব্যাপী সলিমুল্লাহ হলে তল্লাশি চালায়। একই সঙ্গে হলের হাউস টিউটর অধ্যাপক ডঃ মফিজুদ্দিনকে আটক এবং তাহার সহিত ৩৯ জন ছাত্রকেও গ্রেফতার করে।

কিন্তু সরকারের শত কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন সত্ত্বেও ২৫শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। উল্লেখ্য যে, ঢাকার কোন প্রেস নগদ পয়সাতেও ২৫শের হরতাল পালন সংক্রান্ত ইশতেহার ছাপাইতে স্বীকৃত না হওয়ায় যুবলীগ যুগ্ম সম্পাদক জনাব মোঃ সুলতান ও কাজী আজিজুর রহমান নরসিংদী বা ভৈরব হইতে বিজ্ঞাপন ছাপাইয়া আনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। যদিও সেই মুহূর্তে ঢাকা শহরে সামরিক বাহিনী, সশস্ত্র ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী এক বিভীষিকার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, তথাপি ২৪শে ফেব্রুয়ারি দ্বিপ্রহরের মধ্যে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে বিলি করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ কর্মীদের অকৃত্রিম দেশপ্রেম, ত্যাগী চরিত্র, সুনিপুণ কর্মকৌশল, কঠোর পরিশ্রম, অদম্য সাহস ও উদ্যোগ, কর্তব্যনিষ্ঠা, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, সর্বোপরি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দৃঢ়চিত্ত ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ভীরু ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আন্দোলন পরিচালনায় আপোষমূলক নিন্দনীয় ভূমিকার বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য ভরসাস্থল। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র রক্তক্ষরণের পর ভাষা আন্দোলনের মূল সাংগঠনিক শক্তিতে পরিণত হয় এবং সাধারণ ছাত্র কর্মী সহায়ক শক্তিরূপে নজীরবিহীন আত্মসচেতনতার সাক্ষ্য বহন করে। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর ভবিষ্যদ্বাণী, মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ গর্বের সহিত বলেন যে, উর্দুই বাঙ্গালি মুসলমানের ভাষা কিন্তু আমার প্রত্যয় যে, একদিন বাঙ্গালির সহজ শুভবুদ্ধি প্রমাণ করিবে যে, বাংলা হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মাতৃভাষা। কবি রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি কত নিখুঁত ছিল, ২১ ফেব্রুয়ারি উহার রক্ত স্বাক্ষর।

নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন

২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার পর বিদ্রোবহ্নি দাবানলের ন্যায় সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে। রাজপথে, জনপদে, নগরে, গঞ্জে, গ্রামে, কোটি কোটি বাঙ্গালির শিরায়-উপশিরায়, ধমনীতে, রক্তকণায় প্রজ্জ্বলিত হয় মুক্তির প্রদীপ্ত মশাল, যার চরম সীমাপ্রাপ্তি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে।

যাহা হউক, পুর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী মোতাবেক নারায়ণগঞ্জ রহমতুল্লাহ ইনস্টিটিউশনে আহুত জনসভায় যোগদানের জন্য জনাব আবুল হাশিম নারায়ণগঞ্জ গমন করেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা পুলিশের গুলীতে ঢাকার ছাত্র হত্যার বিস্তৃত বিবরণ পেশ করেন। সভাশেষে বিরাট মিছিল পুলিশের গুলীর প্রতিবাদে সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে। ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা নগত্রে জালেম সরকারের ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে খণ্ড খণ্ড মিছিলে ২৩শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ হরতাল পালনের আহ্বান জানান হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র নারায়ণগঞ্জ শহর ও শিল্প এলাকায় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ সহ-সভাপতি শামসুজ্জোহা, নারায়ণগঞ্জ যুবলীগ নেতা সফী হোসেন খান, ডাঃ মজিবর রহমান ও অন্যান্য যুবলীগ নেতা আন্দোলন বিমুখ আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা আলমাস আলী ও আবদুল আওয়ালের শত বাধাকে উপেক্ষা করিয়া পূর্ণ হরতাল পালনে নেতৃত্ব দেন। হরতাল শেষে ইস্ট পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবারের সভাপতি জনাব ফয়েজ আহমদের সভাপতিত্বে তুলারাম কলেজ প্রাঙ্গণে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। করাচির ইংরেজি দৈনিক সম্পাদক জেড, এইচ, সুলেরী এই সভায় বক্তৃতা করেন এবং বাংলাকে অন্যতম রষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। উল্লেখ্য, ২২শে ফেব্রুয়ারি হইতে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বিচক্ষণ এস,ডি,ও, অবাঙ্গালি জনাব ইমতিয়াজীর প্রশাসন কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা বা হস্তক্ষেপ করে নাই।

নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মমতাজ বেগম ছিলেন নারায়ণগঞ্জ ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। সরকার ও সমাজের সর্বপ্রকার রক্তচক্ষুকে অবজ্ঞার সহিত উপেক্ষা করিয়া এই অপ্রতিরোধ্য তেজস্বিনী নেত্রী যুবলীগ নেতা শামসুজ্জোহা, সফি হোসেন খান ও ডাঃ মুজিবর রহমানের সহিত হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া শহীদদের রক্ত-শপথে নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে উজ্জীবিত করেন। অধুনা পথে-ঘাটে অগ্নিকন্যা দাবীভূষিত বহু নেত্রীর নাম শুনা যায়; কিন্তু তাহারা কেহ কি মিসেস মমতাজ বেগমের ন্যায় অগ্নি অতিক্রম করিয়া জনতার চেতনায় স্বীয় ত্যাগ ও কর্মোদ্যম দ্বারা এবং জানমাল ইজ্জতের পূর্ণ কুঁকি নিয়া আন্দোলনের আগুন ছড়াইতে কখনও সক্ষম হইয়াছেন? সরকার মমতাজ বেগমের এই সাংগঠনিক শক্তি ও সাহস লক্ষ্য করিয়াছিল। তাই ২৯শে ফেব্রুয়ারি, মর্গান স্কুল হইতে যুবলীগ নেতা শামসুজ্জোহা বাড়ি ‘হীরা মহল’ গমনকালে পথিমধ্যে পঁচিশ হাজার টাকা তহবিল তসরুফের মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগে পুলিশ বাহিনী মিসেস মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার করে। তাহাকে নারায়ণগঞ্জ কোর্টে লইয়া যাওয়া হয় ও তাহার পক্ষে জামিন প্রার্থনা করা হইলে, উহা না-মঞ্জুর হয়। এমনকি ভাষা আন্দোলন সমর্থক কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তি নগদ দশ হাজার টাকা, মহামান্য আদালতের নিকট জামিন হিসাবে তৎক্ষণাৎ জমা দিতে যাওয়া সত্বেও মিসেস মমতাজ বেগমকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় নাই। ইতিমধ্যে তাহার গ্রেফতারে উৎকষ্ঠিত ও উত্তেজিত হাজার হাজার জনতা কোর্ট ঘেরাও করিয়া ফেলে এবং মমতাজ বেগমকে লইয়া পুলিশ বাহিনী ঢাকার পথে অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিলে ক্ষুব্ধ জনতা সরকারি কারসাজির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়া রখিয়া দাঁড়ায়। বিদ্রোহী জনসমুদ্রের অটল অবিচল দৃঢ়তা উপেক্ষা করিয়া পুলিশ ভ্যান জনতার উপর দিয়া অগ্রসর হইতে ব্যর্থ হয়। ক্রোধান্বিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ অবশেষে পশুশক্তি প্রয়োগের আদেশ দেয়। পুলিশ জনতাকে বেদম প্রহার শুরু করিলে জনতা সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়ে এবং সেই সুযোগে বন্দি মমতাজ বেগমকে নিয়া পুলিশ ভ্যান ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হয়। কিন্তু চাষাড়া রেলওয়ে ক্রসিং-এ বিক্ষুদ্ধ জনতা রেলওয়ে গেট ফেলিয়া দিয়া পুলিশ ভ্যানের গতিরোধ করে। এইস্থলে জনতা ও পুলিশের আরেক দফা সংঘর্ষ বাধে। জজকোর্টে মমতাজ বেগমের জামিনের জন্য জনাব শামসুজ্জোহা ও ডাঃ মুজিবর রহমান ঢাকায় চলিয়া আসায় যুবলীগ নেতা সফি হোসেন খানকেই সেইদিনকার সেই সংকটময় মুহূর্তে নেতৃত্ব দিতে হয়। পুলিশের আক্রমণে নিরত্র বিদ্রোহী জনতা এক পর্যায়ে রেলওয়ে রাস্তার পাথর খণ্ডগুলিকে পুলিশের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার শুরু করে। পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে নারায়ণগঞ্জ মহকুমা পুলিশ অফিসার জনাব দেলওয়ার হোসেন আহত হন। ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রাজপথের উভয় পার্শ্বস্থ গ্রামগুলি থেকে হাজার হাজার জনতা আন্দোলনে শরীক হয়। তাহারা চাষাড়া হইতে পাগলা পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ মাইল রাস্তায় একশত ষাটটি বটগাছ কাটিয়া ঢাকামুখী পথকে অবরুদ্ধ করিয়া ফেলে। বেগতিক অবস্থাকে আয়ত্তে আনিবার নিমিত্ত কর্তৃপক্ষ শেষমেষ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে তলব করে। পুর্ববঙ্গ আইন পরিষদ সদস্য খান সাহেব ওসমান আলীর বাসস্থান বায়তুল আমান খানা তল্লাশি করা হয়। খানা তল্লাশীকালে বায়তুল আমানের বহু টাকা পয়সা ও সোনাগহনা লুট হয়, বাড়ি ঘরেরও বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় এবং শুধু থান সাহেব ওসমান আলীকেই নহে, পুলিশ তাঁহার পুত্র মোস্তফা সারওয়ারকেও গ্রেফতার করে। সেই আন্দোলনের মূল কর্ণধার যুবলীগ নেতা শফি হোসেন খান, মিস্ত্রী ইলা বকশী ও ছাত্রী বেলুও গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃত অপর বন্দি কমরুদ্দীন দবিরকে পুলিশ বেদম প্রহার করে। দিন কয়েকের মধ্যেই শামসুজ্জোহা, জামিল, লুৎফর রহমান এবং সাত বৎসর বয়স্ক বালক মেসবাহউদ্দীন কারারুদ্ধ হন। ২৯শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা কোতয়ালী থানায় জিজ্ঞাসাবাদের পর ১লা মার্চ বন্দিদিগকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চালান দেওয়া হয়। অপরিণামদর্শী নূরুল আমিন সরকার ক্ষিপ্ত হইয়া পাঁচজন আইন পরিষদ সদস্য যথা মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, গোবিন্দ লাল ব্যানার্জী ও মাদার বক্সকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার কারণে অনেককেই গুরুতর মাশুল দিতে হইয়াছে। কারাগার হইতে বন্ড সহি করিয়া মুক্তি ক্রয় করিতে অস্বীকার করিলে মিসেস মমতাজ বেগমকে তাহার স্বামী তালাক দেন। এইভাবেই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে যোগ দেয়ার অপরাধে নারায়ণগঞ্জ মর্গান গার্লস হাইস্কুলের হেড মিসট্রেস মোমতাজ বেগমের সংসার তছনছ হইয়া যায়। তাহার এই ত্যাগ আমরা মূল্যায়ন করিতে সক্ষম হইয়াছি কি? এবং সেই অনুযায়ী জাতির কর্ণধার তাহাকে যথোপয়ক্ত সম্মান দেখাইয়াছেন কি?

চট্টগ্রাম বন্দর নগরীতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন স্তরের সংবেদনশীল ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন দলের সমবায়ে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। চট্টগ্রাম জেলা যুবলীগ আহ্বায়ক এবং মুক্ত হাওয়ায় মুক্ত চিন্তার বাহন ‘সীমান্ত’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক জনাব মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ঢাকায় পুলিশের গুলীতে আহত নিহতদের খবর পাওয়ার পর সন্ধ্যা ৭টায় রোগশয্যা হইতে এই বিদগ্ধ কবি “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” কবিতাটি রচনা করেন। জনাব মাহবুল-উল-আলম চৌধুরী রচিত কবিতাটি নিম্নে দেওয়া হইলঃ

কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি

মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী

ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ

কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়

ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য বাংলার জন্য

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে

একটি দেশের সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য

আলাওলের ঐতিহ্য

রবীন্দ্রনাথ, কায়কোবাদ, নজরুলের

সাহিত্য ও কবিতার জন্য।

যারা প্রাণ দিয়েছে

ভাটিয়ালী, বাউল, কীর্তন, গজল

নজরুলের “খাটি সোনার চেয়ে খাঁটি

আমার দেশের মাটি”

এই দুইটি লাইনের জন্য।

রমনার মাঠের সেই মাটিতে

কৃষ্ণচূড়ার ঝরা পাপড়ির মতো

চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর

অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে

আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত

রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত

                বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোন

ছেলের বুকের রক্ত।

আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা

রমনার সবুজ ঘাসের উপর

আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে

এক একটি জীবের টুকুরোর মত

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন

বেঁচে থাকলে যারা হতো

পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ

যাদের মধ্যে লিংকন রল্যা

আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল

যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল

শতাব্দীর সভ্যতার

সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ

সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে

আমরা এখানে কাঁদতে আসিনি।

যারা গুলী ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে

যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে

আমরা তাদের কাছে

ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ

আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।

আমরা জানি তাদের হত্যা করা হয়েছে

নির্দয়ভাবে তাদের গুলী করা হয়েছে।

ওদের কারো নাম তোমার মত ‘ওসমান’

কারো বাবা তোমারই বাবার মতো

হয়তো কেরানী, কিংবা পূর্ব বাংলার

নিভৃত কোন গায়ে কারো বাবা

মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়

হয়তো কারো বাবা কোন

সরকারি চাকুরে।

তোমার আমার মতো

যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে পারতো

আমারই মতো তাদের কোন একজনের

হয়তো বিয়ের দিন পর্যন্ত ধার্য হয়েছিল

                তোমারই মতো তাদের কোন একজনের হয়তো

মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়ার আশায়

টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল

এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে

জালিমের গুলীতে প্রাণ দিল

সেইসব মৃত্যুর নামে

আমি ফাঁসির দাবি করছি।

যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে

চেয়েছে তাদের জন্য

আমি ফাঁসির দাবি করছি।

যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্য

ফাঁসি দাবি করছি।

যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে

ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে

সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্য

আমি ওদের বিচার দেখতে চাই

খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে

শাস্তি প্রাপ্তদের গুলীবিদ্ধ অবস্থায়

আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।

পাকিস্তানের প্রথম শহীদ

সেই চল্লিশটি রত্ন

দেশের চল্লিশজন সেরা ছেলে

মা, বাবা, বৌ আর ছেলে নিয়ে

এই পৃথিবীর কোলে এক একটি

সংসার গড়া যাদের

স্বপ্ন ছিল

যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে

আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার

যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের

কীভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়

তার সাধনা করার

বাঁশিওয়ালার চেয়েও সুন্দর

একটি কবিতা রচনা করার।

সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার

                যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়াছ

যেখানে হাজার বছর পরেও

সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন

মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোন পদক্ষেপ

যদিও অসংখ্য মিছিল অস্পষ্ট নিস্তন্ধভাবকে ভঙ্গ করছে

তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘন্টাধ্বনি

প্রতিদিন আমাদের মৃত্যুক্ষণ

ঘোষণা করবে

যদিও আগামীতে কোন ঝঞ্ঝা ঝড় বিশ্ববিদ্যালয়ের

ভিত্তি পর্যন্ত নড়িয়ে দিতে পারে

তবুও তোমাদের শহীদ নামের উজ্জ্বল্য

কিছুতেই মুছে যাবে না।

খুনি জালিমের নিপীড়নকারীদের কঠিন হাত

কোনদিনও চেপে দিতে পারবে না

তোমাদের সেই লক্ষ দিনের আশাকে

যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব

ন্যায়-নীতির দিন।

হে আমার মৃত ভায়েরা

সেই নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে

তোমার কণ্ঠস্বর

স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার

ভেসে আসবে

সেইদিন আমাদের দেশের জনতা

খুনী জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে

ঝুলাবেই ঝুলাবে

তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে

প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।

(চট্টগ্রাম। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, রাত ৭টা

মুল কবিতার প্রথমাংশ)।

জনাব মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী রোগশয্যায় পুলিশ প্রহরাধীন থাকিবার কারণে চট্টগ্রাম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব বর্তায় চট্টগ্রাম হইতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আওয়াজ সম্পাদক বিপ্লবী জননেতা চৌধুরী হারুন-উর-রশীদের স্কন্ধে। আন্দোলনের সক্রিয় নেতৃত্ব দানের কারণে তিনি পূর্বপাক জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হইয়া বিনাবিচারে রাজবন্দি জীবন-যাপন করেন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার তাগিদে নিম্নলিখিত ১৭ সদস্য বিশিষ্ট বগুড়া জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদ সদস্যবৃন্দ হইলেন:

বগুড়া যুবলীগ সম্পাদক জনাব ছমিরুদ্দিন মন্ডল, সম্পাদক জনাব গোলাম মহিউদ্দিন ও শেখ হারুনুর রশীদ, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিরুদ্দিন আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক এ.কে মুজিবর রহমান, কবিরাজ শেখ আবদুল আজিজ, সিরাজুল ইসলাম, বগুড়া ছাত্রলীগ নেতা আবদুস শহীদ, নূরুল হোসেন মোল্লা, মোটর শ্রমিক নেতা কমরেড সুবোধ লাহিড়ী, বিড়ি শ্রমিক নেতা শাহ আহমদ হোসেন, রিকশা শ্রমিক নেতা মোখলেসুর রহমান, কৃষক নেতা ফজলুর রহমান, তমন্দুন মজলিস নেতা খন্দকার রুত্তম আলী ও লুংফর রহমান, কৃষক প্রজা পার্টির কবিরাজ মোফাজ্জল বারী। আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মজিরুদ্দিন আহমদ ও যুবলীগ নেতা জনাব গেলাম মহিউদ্দিনকে যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও কনভেনর নির্বাচিত করা হয়।

আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে ২৯শে ফেব্রুয়ারি সর্বজনাব গোলাম মহিউদ্দিন, শেখ হারুনুর রশীদ, ছমিরুদ্দিন মন্ডল, নূর হোসেন মোল্লা, আবদুল মতিন ও বাবু সুবোধ লাহিড়ীকে পূর্বক নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে ও বগুড়া জেলা কারাগারে বিনাবিচারে আটক রাখে।

ভাষা আন্দোলনে চুয়াডাঙ্গার ভূমিকা

অন্যান্য জাতীয় আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলনে চুয়াডাঙ্গা পিছিয়ে থাকেনি, বরং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চুয়াডাঙ্গায় প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৪৮ সালের ১৫ই আগস্ট। তরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আজি হতে শতবর্ষ পরে নাটকটি স্থানীয় শ্রীমন্ত টাউন হলে মঞ্চস্থ হয়। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত এই নাটকে অভিনয় করেন-মির্জা সুলতান রাজা, আবদুল কাদির, মোহাম্মদ শাহজাহান প্রমুখ।

২১ ফেব্রুয়ারি ৫২ তারিখে ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটায় চুয়াডাঙ্গার নীলমনিগঞ্জের পরিমল বোসের বাড়িতে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম প্রণেতা এন এন সাহা। বক্তব্য রাখেন পরিমল বোস, হাবু ঘোষ, তারাপদ মৈত্র, অমূল্য ঘোষ, জব্বার খান, সৈয়দ আলী, আতিয়ার রহমান ও অমৃত লাহিড়ী প্রমুখ। সভায় গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আন্দোলন বেগবান করতে শপথ নেয়া হয়। সভা শেষে এক মিছিল বের হয়। কিন্তু সভার কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। ফলে ঐ রাতেই পুলিশ প্রত্যেকের বাড়ি হানা দেয়। ঐ রাতেই পরিমল বোস প্রথম গ্রেফতার হন। অন্যরা আন্দোলনের স্বার্থে গা ঢাকা দেন।

এন এন সাহা ঐ রাতেই গোপনে পরিমল বোসের প্রেফতারের সংবাদ চুয়াড়াঙ্গাত পৌঁছান। নেতৃবৃন্দ পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ৫২ তারিখে বেলা এগারোটা চুয়াডাঙ্গা ভি জে স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় পরিমল বোসের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ রহিম বক্স। বক্তব্য রাখেন ডা আশাবুল হক, ওবায়দুর রহমান, ওহিদ হোসেন, মুজিবুর রহমান ও রফাতুল্লাহ। তুখোড় ছাত্রনেতা ওহিদ হোসেনকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচন করা হয়। এছাড়া উপস্থিত সবাইকে সদস্য অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি ‘৫২ তারিখে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্কৃ্তভাবে আহ্বানে সাড়া দেয়। প্রখ্যাত ছাত্রনেতা মোহাম্মদ শাহজাহানের যোগ্য নেতৃত্বে বিশাল মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে আলী হোসেন মিয়ার আমবাগানে সভা হয়। সভাপতিত্ব করেন এডভোকেট আবুল হাশেম। বক্তব্য রাখেন মোহাম্মদ শাহজাহান, উষা চ্যাটার্জী, ইলা হক, শশধর চট্টোপাধ্যায়, বেলা ও সুধীন সরকার।

মিছিল-মিটিং এ তৎকালীন সরকার ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠে এবং আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি ও সমস্ত শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ফলে নেতারা আত্মগোপন করেন।

১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য চুয়াডাঙ্গা শহরে এ্যাডভোকেট তৈয়বুর রহমান ও এ্যাডভোকেট আজগার আলীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে এ্যাডভোকেট আজগর আলী প্রথম গুলিবিদ্ধ হন। তারিখটা ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি ’৫২।

২৬ ফেব্রুয়ারি ৫২ তারিখে বেলা ১২টায় কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এম এল হক চুয়াডাঙ্গার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের তার সম্মেলন কক্ষে ডাকেন। পুলিশ সুপার অভিযোগ করে বলেন, “হিন্দুস্থানের হিন্দুরা এদেশে ভাষা আন্দোলনের নামে উস্কানি দিয়ে পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়।” এডভোকেট ইউসুফ আলী সাথে সাথে এর প্রতিবাদ জানান। এক পর্যায়ে চরম কথা কাটাকাটির ফলে সভা ভন্ডুল হয়ে যায়।

৫২-এর ভাষা আন্দোলনে নোয়াখালী

৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকার আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের গুলি বর্ষণে হতাহতের খবর বৃহত্তর নোয়াখালীর সর্বস্তরের মানুষ প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তৎকালীন নোয়াখালী জেলা যুবলীগের সভাপতি খাজা আহমদ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ এম সি এ), সাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমান, নোয়াখালী সদর মহকুমা যুব লীগেৱ বজলুর রহমান, নোয়াখালী সদর মহকুমা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রইস উদ্দীন আহমদ এর নেতৃত্বে নোয়াখালীতে ভাষার দাবিতে প্রচন্ড আন্দোলন সৃষ্টি হয়। এ সময় তাদের সাথে এ আন্দোলনে যে তিন জন ছাত্র নেতা সক্রিয় অংশ নেন তারা হলেন নুরুল হক চৌধুরী (কমরেড মেহেদী), কাজী মেজবাহ উদ্দীন ও নিখিল দাশ গুপ্ত।

সেসময় সেখানে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সিরাজ উদ্দীন যে নাকি মুসলীম লীগ সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কর্মী, ঢাকায় গুলি বর্ষনে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে যখন এলাকার মানুষ চরম ক্ষুব্ধ তখন তিনি তাদের মাঝে একাত্ম হয়ে আন্দোলনে যোগ দেন এবং স্কুল সমূহে ছাত্র ধর্মঘট সফল করতে বিরাট ভূমিকা রাখেন।

ভাষা আন্দোলনের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে ফেনী হতে খাজা আহমদ, শামসুল হুদা, স্কুল ছাত্র কাজী মেসবাহ উদ্দীন, নিখিল কান্তি দাশ গুপ্ত, মাইজদীতে আবুল কাসেম, চৌমুহনীতে গ্রেফতার হন রইস উদ্দীন আহমদ, ফজলুল করিম, ডাঃ রাস বিহারী দাস, চিত্তরঞ্জন শাহ (পুঁথিঘর) ও নুরুল হক। নুরুল হক চৌধুরীর (কমরেড মেহেদী) বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী হলেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। সেসময় মাইজদী শহরে জননেতা চুন্নু মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তৎকালীন এম এল এ জনাব মজিবর রহমান এম,এল, এ পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি পদত্যাগ করেননি।

সরকারি অপপ্রচার  

সরকার আন্দোলন পরিচালনাকারীদিগকে ভারতীয় অর্থে পুষ্ট ভারতীয় অনুচর বলিয়া অপবাদ দিতে সামান্যতম কসুর করে নাই। নারায়ণগঞ্জ-কালিবাজার আততায়ীর গুলীতে নিহত প্রহরারত কনস্টেবল সৈয়দ জোবায়েদ ও আহত আনসার খলিল আহমদের পরিবারদ্বয়কে যথাক্রমে ১০ হাজার টাকা ও ২ হাজার টাকা এককালীন ক্ষতিপূরণ দান করা হয়। জনমন বিষাইয়া তোলার উদ্দেশ্যেই উক্ত ক্ষতিপূরণ দানের সিদ্ধান্ত ঘোষণাকালে ২রা মার্চ মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বলেন যে, ভারতীয় অনুচরেরাই উক্ত নির্মম হত্যাকান্ডের সহিত জড়িত। কিন্তু আপামর দেশবাসী নুরুল আমিন সরকারের এই অভিযোগকে অবজ্ঞার সহিত উপেক্ষা করে। শুধু তাই নয়, শহিদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হইলে কেবল নগদ অর্থই নহে, বহু লোকই উক্ত স্মৃতিস্তম্ভ বেদীতে সোনা-দানা দিয়া তাহাদের ব্যথিত হৃদয়ের অর্থ রাখিয়া গিয়াছেন। কোন কোন মহিলা নিজ গলার পরিহিত সোনার হার স্বীয় হস্তে স্মৃতিস্তম্ভ বেদীতে অর্পণ করিয়াছেন। এই সমস্ত অমূল্যদান আমি মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের নিকট জমা রাখিতে বলি এবং আমরা সমবেতভাবে এই মর্মে সিন্ধান্ত লই যে, আন্দোলনের বিভিন্ন খরচা তথা হইতে নির্বাহ করা হইবে।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হল কেন্দ্রে সংগৃহীত অর্থ জনাব আখতার উদ্দিন আহমদের নিকট জমা ছিল। সুতরাং সরকারি অভিযোগ বা কুৎসা অনুযায়ী বিদেশী অর্থের কোন খবর অন্ততঃ আমরা যাহারা চরম সংকটময় মুহূর্তে আন্দোলন পরিচালনা করিয়াছি, জানিতাম না। সরকার হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিত হইয়া আমাদের অনর্থক হিন্দুস্থানের দালাল বলিয়া দেশে বিদেশে প্রচার করিয়াছে।

আন্দোলনে ভাটা

স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন স্বাভাবিক নিয়মেই গতিশীলতা হারাইয়া ফেলে। আন্দোলনে ভাটা দেখা দেয়। সাংগঠনিক শক্তির অভাবে এই ভাষা আন্দোলনকে বৈপ্লবিক কোন আন্দোলনে রুপান্তরিত করা তখনকার দিনে সম্ভব ছিল না। তদুপরি সরকারি তৎপরতা ও দমননীতির দরুন আন্দোলনের অভ্যন্তরেও বিশ্বাসঘাতকতা মাথাচাড়া দিয়া উঠিতে শুরু করিয়াছিল। অতি বিশ্বাসভাজন বাক্তিও অর্থ প্রলোভনে পড়িয়া বা কারা নির্যাতনের ভয়ে আমাদের আশেপাশে অবস্থান করিয়াই আমাদের কর্মতৎপরতা ও অবস্থান সম্পর্কে সরকারি গোয়েন্দা বিভাগে নিয়মিত রিপোর্ট করতে থাকে। সেই অগ্নিঝরা দিনগুলিতে আন্দোলনের স্বার্থেই আমাকে আন্দোলনের কেন্দ্র মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে অবস্থান করিতে হয়েছে। মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে ৭ নম্বর ব্যারাকের ৫ নম্বর রুমে আমার বাল্যবন্ধু আলী আজগর, নজরুল ইসলাম ও কাসেদুল হক থাকিত। আমি তাহাদের সহিত রাত্রি যাপন করিতাম এবং আমার সবকিছুই তাহারা অত্যন্ত দরদের সহিত দেখাশোনা করিত। আমার নিরাপত্তার প্রতি তাহারা সজাগ ছিল। ইহা কেবলমাত্র বন্ধুত্বের নিদর্শন নহে; ইহা অকৃত্রিম দেশপ্রেমের অকাট্য প্রমাণ বটে।

হোম (স্পেশাল) ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র (কিশেষ) বিভাগ কর্তৃক ২৮শে ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত ঢাকা গেজেটে (এক্সট্রা অর্ডিনারী) গভর্নর নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি হইতে ৩০ দিনের মধ্যে স্ব-স্ব জিলা প্রশাসকের নিকট হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।

কাজী গোলাম মাহবুব, আহ্বায়ক, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, বরিশাল; খালেক নেওয়াজ খান, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ময়মনসিংহ; শামসুল হক, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, ময়মনসিংহ; অলি আহাদ, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, ত্রিপুরা: আবদুল মতিন, আহ্বায়ক, বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, পাবনা; সৈয়দ এম, নুরুল আলম, পাবনা; আজিজ আহমদ নোয়াখালী; আবদুল আওয়াল, ত্রিপুরা; মোঃ তোয়াহা, সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটি, নোয়াখালী।

২৯শে ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ মর্গান গার্লস হাই স্কুলের হেড মিস্ট্রেস মিসেস মমতাজ বেগমকে গ্রেফতারের ফলে নারায়ণগঞ্জে যে গণঅভ্যুত্থান দেখা দিয়াছিল এবং তাহা দমাইতে সরকার যে কি পাশবিক শক্তি ব্যবহার করিয়াছিল, সেই নজীরবিহীন ঘটনার উল্লেখ পূর্বেই করিয়াছি। সেই সময়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে যে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করা হইয়াছিল, সেই সান্ধ্য আইন ৭ই মার্চ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এই সময়ের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ হইতে দুইজন স্থাত্রীসহ মোট একশত পনেরজনকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়। আমি আত্মগোপন অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ অভ্যুত্থানের নায়কদের অন্যতম পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ সহ-সভাপতি শামসুজ্জোহা ও ডাঃ মুজিবর রহমানের সহিত ঢাকাস্থ মদনমোহন বসাক রোডের (বর্তমান টিপু সুলতান রোড) জনাব আবদুল জলিলের বাসভবন STEP-IN এ সাক্ষাৎ করিতাম এবং আন্দোলনের বিভিন্ন করণীয় দিক নিয়া বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা ও পর্যালোচনা করিতাম।

গ্রেফতার

৫ই মার্চ আহূত সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ হরতাল, মিছিল ও সভা সরকারি কঠোর দমননীতির জন্য আশানুরূপভাবে সফল হইতে পারে নাই। এমতাবস্থায় কর্তব্য নির্ধারণকল্পে ৭ই মার্চ শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় ৮২ নং শান্তিনগরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভ্য আহ্বান করা হয়। ৮২ নং শান্তিনগর যাওয়ার পথে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র যুবলীগ কর্মী আনিসুজ্জামান আমার পথ প্রদর্শক ছিলেন। সভায় আমি বাতীত কাজী গোলাম মাহবুব, জনাব আবদুল মতিন, মীর্জা গোলাম হাফিজ, জনাব মুজিবুল হক (সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ), হেদায়েত হোসেন চৌধুরী (সাধারণ সম্পাদক, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ) এবং মোঃ তোয়াহা উপস্থিত ছিলেন। ইহা ব্যতীত মোঃ সাদেক খান ও আবদুল লতিফ, হাসান পারভেজ ও আনিসুজ্জামান উত্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের সভা সমাপ্ত প্রায়, এমন সময়ে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ৮২ নং শান্তিনগর ঘেরাও করে। অংশগ্রহণকারী সদস্যদের পুনঃপুনঃ সতর্কবাণী সত্ত্বেও জনাব মোঃ তোয়াহার অতিরিক্ত বক্তব্য ও একই বক্তব্য বারবার বলার প্রচেষ্টায় সভার কাজে অনর্থক কালক্ষেপণ হইতেছিল। জনাব তোয়াহার অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘায়িত বক্তব্যই এই দুর্ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী। পুলিশের পদধ্বনি পাওয়ামাত্র তাকাইয়া দেখি আমরা পুলিশ পরিবেষ্টিত। তথাপি পুলিশের গ্রেফতারী এড়াইবার চেষ্টায় কেহ চাকর সাজিয়া কেহ বা ঘরের কোণায় গৃহবাসী হইয়া পুলিশকে ফাঁকি দিতে চাই। কিন্তু কিছুই হয় নাই। তবে কাজী গোলাম মাহবুব ঘরের বাঁশের মাচার উপর এমনভাবে শয়ন করিয়াছিলেন যে, পুলিশের শ্যেনদৃষ্টিো তাহাকে আবিষ্কার করিতে পারে নাই; যদিও সংবাদদাতার তালিকায় কাজী গোলাম মাহবুব এর নাম ছিল। হাসান পারভেজ ও আনিসুজ্জামান (পরবর্তীকালে ডক্টরেট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) গ্রেফতার হয় নাই। আমাদের বৈঠকের স্থানের সামনে দিয়া লম্বা ছিপছিপে একটি লোক সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করিতেছিল। গলা হইতে মুখমন্ডলের দুই পাশের দুই কানসহ মাথার উপর দিয়া গরম কমফার্টার বাঁধা থাকায় তাহাকে চেনা দুষ্কর ছিল। হয়তো বা গোয়েন্দা বিভাগের সহিত সম্পর্কিত লোকও হইতে পারে।

যাহা হউক, গ্রেফতারকৃত সবাইকে নিয়া কোতোয়ালী থানা হাজতে আটক রাখা হয়। খবর পাওয়ামাত্র ঢাকা সিটি পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট জনাব মাসুদ মাহমুদ হন্তদন্ত হইয়া আমাদিগকে দেখিতে আসিলেন। এক নজর আমাদের দিকে তাকাইয়া তিনি থানা অফিসারকে জিজ্ঞাসা করিলেন Have you linched them?” “অর্থাৎ বেত্রাঘাত করিয়াছ কি?” তাহার প্রশ্নে আমরা ক্ষোভে, অপমানে ও ক্রোধে গড়গড় করিতেছিলাম।

ঢাকার ওয়াইজঘাটে অবস্থিত গোয়েন্দা বিভাগের সদর দফতরে আমাকে ও আবদুল মতিনকে স্থানান্তরিত করা হয়। ৮ই মার্চ সকাল নয়টায় গোয়েন্দা বিভাগের সদর দফতরে তদানীন্তন আই,জি,পি, জাকির হোসেন, ডি,আই,জি, ওবায়দুল্লাহ, গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ডি,আই,জি, হাফিজুদ্দিন ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সুপারিন্টেন্ডেন্ট তসলিম আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমার দিকে চাহিয়া মজার প্রশ্ন করেন আই,জি,পি, জাকির হোসেন, এই নাকি প্রধানমন্ত্রী?”উক্ত মন্তব্যের নিগুঢ় অর্থ অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হইয়া হতচকিতভাবে তাঁহার দিকে তাকাইলাম। পরবর্তীকালে অবগত হই যে, আমরা নাকি সুইসাইড স্কোয়াড করিয়াছি এবং আমার নেতৃত্বে নাকি অস্থায়ী বিকল্প সরকারও গঠিত হইয়াছে। বাহবা দিতে হয় সংবাদদাতাগণকে। গোয়েন্দা বিভাগ যে কাল্পনিক তথ্য সংগ্রহে কত পারদর্শী, উপরে বর্ণিত তথ্যাবলী হইতেই উহার প্রমাণ পাওয়া যায়।

গোয়েন্দা বিভাগ সদর দফতরে পাঁচদিন পাঁচ রাত্রি আমাকে অবিরাম জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদকালে তাহাদের প্রশ্নের উত্তর বড় একটা দিতাম না। ইহাতে ক্ষিপ্ত হইয়া তাহারা নানারকম ভয়ভীতি দেখাইত, অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করিত ও সময়ে সময়ে প্রহার করিত। তাহাদের প্রতিপাদা বিষয় ছিল এই যে, আমরা ভারতীয় অর্থ ও কারসাজিতেই এই ভয়াবহ গণআন্দোলন সৃষ্টি করিয়াছি। অথচ তাহাদের এই অভিযোগ আদৌ সত্য নহে। ইহ্য মিথ্যা ও বানোয়াট। ইহা আমরা স্বপ্নেও চিন্তা করি নাই। সুতরাং আমার জবানীতে মিথ্যা স্বীকারোক্তি কেন করিতে যাইব? ১২ই মার্চ সন্ধ্যা রাতে এক হাওয়ালদার আমাকে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি লইতে খবর দিয়া গেল। উদ্দেশা ফৌজি ছাউনিতে দৈহিক নির্যাতন চালান। তাহা হইলেই সকল গোপনীয় খবর প্রকাশ করিয়া দিব। আমি মনে মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করিয়া মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। দৈহিক নির্যাতন যতই হউক মিথ্যা স্বীকারোক্তি করিব না। যে যড়যন্ত্রের বিন্দুবিসর্গও জানি না, তাহার খবর বলিব কোথা হইতে? যাহা হউক, পুলিশ রাত্রিতে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহারা আমাকে ক্যান্টনমেন্টে লইয়া যায় নাই। পথ হইতেই ফিরাইয়া আনিয়াছিল। ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার পথে কবুল “ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল গান’ রচনাকারী জুলিয়াস ফুঁচিকের অকথ্য পাশবিক অত্যাচার সহ্য করিবার কাহিনীই আমার মনে সাহস ও মনোবল যোগাইত।

১৩ মার্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাইবার পূর্বক্ষণে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ডি,আই,জি, হাফিজুদ্দিন আহমদের সহিত আমার পুনঃপুনঃ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। কারাগারের দেওয়ানী ওয়ার্ডে আমাকে পাঠানো হয়। দেওয়ানী ওয়ার্ডে খন্দকার মোশতাক আহমদ, মির্জা গোলাম হাফিজ, মোঃ তোয়াহা, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম পূর্ব হইতেই ছিলেন। উল্লেখ্য, “দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার” ১২ই ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় CRYPTO FASCISM শিরোনামে এক সম্পাদকীয় লেখার কারণে ১৩ই ফেব্রুয়ারি এক সরকারি আদেশে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। তাঁহারা সবাই ভাষা আন্দোলনের শিকার। কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল বিভাগ প্রধান ও রীডার ডঃ পি,সি, চক্রবর্তী আমাদের সহিত যোগ দেন। ডঃ চক্রবর্তীকে সঙ্গদান প্রয়োজনে দেওয়ানী ওয়ার্ডে বেশির ভাগ সময় তাস (ব্রিজ) খেলিতে হইত। কারণ, শ্রদ্ধেয় ডঃ চক্রবর্তীকে প্রফুল্লচিত্ত রাখার নিমিত্ত সঙ্গদান আমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে মুচলেকা সহি করিয়া, রাজনীতি করিব না অঙ্গীকার করিয়া মীর্জা গোলাম হাফিজ কয়েদখানা হইতে মুক্তি ক্রয় করিলেন।

 ইতিমধ্যে সর্বজনাব শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, সৈয়দ নুরুল আলম ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জেলা প্রশাসকের নিকট হাজিরা দিয়া নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির জয়ধ্বনি করিয়া স্বেচ্ছায় কারান্তরালে প্রবেশ করিলেন। জেলা কর্তৃপক্ষ আমাদিগকে দেওয়ানী ওয়ার্ড হইতে ৫ নং ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করিল। ৫ নং ওয়ার্ডে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম, শামসুল হক, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, খায়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, আজিজ আহমদ, মোঃ তোয়াহা, শওকত আলী, হ্যশিমুদ্দিন আহমদ, আবদুল মতিন, ফজলুল করিম ও আমি একত্রে বাস করিতাম। সর্বপ্রকার আশা-নিরাশার আলো ছায়া খেলায় বৃদ্ধ মওলানা ভাসানী সকলের নিকট পিতৃসুলভ স্নেহ, মায়া, মমতা এবং সাহস, উৎসাহ ও দৃঢ়তার মূর্তপ্রতীক ছিলেন। আমাদের খাওয়া-দাওয়া ও ওষুধপত্রে যাহাতে অসুবিধা না হয় তাহার জন্য তিনি জেল কর্তৃপক্ষকে সুকৌশলে জয় করিয়া রাখিতেন। মোদ্দাকথা, তাহার অপত্য স্নেহ ও নির্ভীক মন সেই সময় দুর্লভ প্রেরণার উৎস ছিল।

ভীরু নেতারা মন্ত্রী, মেম্বার, সমাজে গণ্যমান্য হইবার খায়েশ রাখেন কিন্তু সরকারি লাঠিপেটা খাইতে প্রস্তুত নহেন। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগ সম্পাদক জনাব হাশিম উদ্দিন আহমেদ ময়মনসিংহ জেলা কারাগার হইতে স্থানান্তরিত হইয়া ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আসেন। জনাব আবুল মনসুর আহমদ ময়মনসিংহ হইতে এক চিঠিতে হাশিমুদ্দিন সাহেবকে বন্ড সহি করিয়া মুক্তি ক্রয় করিতে উপদেশ দিয়া পাঠান। কত সামান্যের জন্যই আমাদের বিবেক বিক্রয় হইতে প্রস্তুত। আর নেতার চরিত্রই যখন এইরূপ, তখন অনুসারীদের চরিত্র উচ্চমানের হওয়ার সুযোগ কোথায়? বোধহয় নেত্রবৃন্দের মেরুদন্ডহীন চরিত্রের কারণেই গণতান্ত্রিক রাজনীতি একনায়কত্ববাদী দর্শনে বিশ্বাসী রাজনীতির নিকট ক্রমশঃ পরাজয়বরণ করিতেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অমান্য করিয়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গ Immoral বা নীতি বিহর্গিত বলিয়া আমার নিন্দা করিতেন; কিন্তু অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক অজিত গুহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তের উচ্ছসিত প্রশংসা করিতেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের যাহারা বিরোধী তাহাদের কাহাকেও গ্রেফতার করা ন্যায়তঃ সঠিক হয় নাই, তবে নির্যাতনই যে সরকারের অস্তিত্বের ভিত্তি, তাহাদের পক্ষে শাসন দণ্ড বিবেক প্রসূত ও নীতিগত ব্যবহার নহে বরং বিদ্বেষমূলক ব্যবহারই স্বাভাবিক, কেননা মূল প্রতিপাদ্য লক্ষ্যই হইল সর্বপ্রকার বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করিয়া দেওয়া।

ইতিমধ্যে জাষ্টিস এলিস-এর নেতৃত্বে ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ কর্তৃক গুলী চালনার যথার্থতা বিবেচনার জন্য প্রকাশ্য তদন্ত শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৃত্তিকা বিভাগের প্রধান ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ডঃ এম, ও গণি তদন্ত কমিশন সমীপে সাক্ষ্য দানকালে বলেন যে, তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় মাত্র দুইজন ছাত্র জনাৰ শামসুল হক (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) ও অলি আহাদকে দেখিয়াছেন। ডঃ গনির এই সাক্ষ্যদানে আমার নামোল্লেখ দেখিয়া মোশতাক ভাই বলিতেন যে, উস্কানিদাতা হিসাবে আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হইতে পারে। কেননা জনাব শামসুল হক ও জনাব তোয়াহাও ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু তাহারা যেহেতু ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করিয়াছেন সেইহেতু তাহাদের নাম উল্লেখ হউক বা না হউক তাহাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের মামলার প্রশ্নই উঠে না।

আমাদের গ্রেফতারের কিছুদিনের মধ্যেই জনাব আতাউর রহমান খানকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করিয়া সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত করা হয়। ইহারই ফলশ্রুতি ১৯৫২ সালের ২৭শে এপ্রিল ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে সমগ্র দেশ হইতে আগত ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৫০০ শত সংগ্রামী সৈনিক এক সম্মেলনে সমবেত হন। জনাব আতাউর রহমান খান সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সম্মেলনে মফস্বল জেলাসমূহের প্রতিনিধিদের মধ্য হইতে একজন করিয়া বক্তৃতা দেন। যাহারা বক্তৃতা দেন তাহারা হলেনঃ

সর্বজনাব শামসুল হক (রাজশাহী), আবদুল গফুর (খুলনা), আবুল হোসেন (ফরিদপুর), আবুল হাশেম (বরিশাল), আজিজুর রহমান (চট্টগ্রাম), হাতেম আলী তালুকদার (ময়মনসিংহ), হাবিবুর রহমান (সিলেট), শফিকুল হক (কুমিল্লা), এস হোসেন (রংপুর), আবদুস সাম্তার বি.এল (বগুড়া), আবদুল বারী বি.এল. (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মোহাম্মদ আলী (দিনাজপুর), আবদুল মোনেম (পাবনা), সাইদুর রহমান (কুষ্টিয়া), আলমগীর সিদ্দীকী (যশোর), আনিসুর রহমান (নোয়াখালী)। তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ হইতে মিঃ ফকরুজ্জামান খান, ইসলামিক ভ্রাতুসংঘের পক্ষ হইতে জনাব ইব্রাহীম তাহা, উর্দু লেখক সংঘের পক্ষে জনাব হাসান পারভেজ, পূর্ব পাক যুবলীগের সভাপতি জনাব মাহমুদ আলী, পূর্বপাক ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব কামরুজ্জামান, ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের পক্ষে জনাব ওবায়দুল্লাহ, মেয়েদের পক্ষ হইতে মিস হালিমা খাতুন (মেডিকেল স্কুল ২য় বর্ষ), মিস হালিমা খাতুন (মেডিকেল স্কুল ৪র্থ বর্ষ), জগন্নাথ কলেজের জনাব আজহারুল ইসলাম, পূর্বপাক আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে ফেব্রুয়ারি কারামুক্তি পান। প্রত্যাশা ছিল ঢাকা আসবেন, আন্দোলনকে জোরদার করবেন। তিনি তাহা করলেন না। ইহা অদ্যাবধি রহস্যাবৃত। সম্মেলনে গৃহীত নিম্নোক্ত প্রস্তাবাবলী সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের ৫ই মে (১৯৫২) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়:

১। কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিবৃন্দের এই সম্মেলন যে সকল শহীদ বুলেট, অমানুষিক অত্যাচার, দমননীতি এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দমাইয়া রাখিবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মুখে চরম ত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাঁহাদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি গভীর সম্মান প্রদর্শন করিতেছে।

এই সম্মেলন জনসাধারণকে এই মর্মে আশ্বাস দান করিতেছে যে, শহীদদের লহু বৃথাই প্রবাহিত হয় নাই এবং যতদিন পর্যন্ত না বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষারূপে তাহার ন্যায় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত না হয়, ততদিন পর্যন্ত দেশের কোন প্রকৃত দেশভক্ত লোকই নিশ্চেষ্ট হইবে না।

২। গণপরিষদের কতিপয় ভুয়া যুক্তি সৃষ্টি করিয়া রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থাগিত রাখিবার বিষয় বিবেচনা করিয়া সম্মেলন এই মত পোষণ করিতেছে যে, ইহা গড়িমসি নীতির দ্বারা জনগণের দাবিকে পাশ কাটাইয়া যাইবার জন্য গদিতে আসীন দলের আর একটি প্রচেষ্টা মাত্র।

ভাষার দাবিতে সমগ্র জনমত জাগরিক হওয়ার এবং কতিপয় যুবক শাহাদৎ বরণ করিবার পরও রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে তাড়াহুড়া করার কোন প্রয়োজন নাই বলিয়া সরকার যে হাস্যকর যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন, এই সম্মেলন তাহার তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে।

৩। সকল বাস্তব প্রয়োজনের জন্যই ইংরেজি অন্ততঃ আরও ২০ বত্সর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার আসনে আসীন থাকিবে বলিয়া মুসলিম লীগ নেতৃবর্গ এবং তাহাদের সরকার যে মন্তব্য করিয়াছেন, এই সম্মেলন তাহাতে গভীর আশংকা প্রকাশ করিতেছে। এই সম্মেলন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিতেছে যে, রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে পাশ কাটাইয়া যাইবার জন্য ইহা আর একটি অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচেষ্টা।

৪। এই সম্মেলন মনে করে যে, গত ৫ বৎসর কালের মধ্যে গণপরিষদ যে কেবলমাত্র একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে তাহা নহে, বরঞ্চ জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলীর একটিরও সমাধান করিতে তাহারা সক্ষম হন নাই। কাজেই এই সম্মেলন অবিলম্বে গণপরিষদ ভাঙ্গিয়া দিয়া তাহার স্থলে বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের দ্বারা নূতন একটি পরিষদ গঠনের দাবি জানাইতেছে।

৫। ভাষা আন্দোলনের বহু কর্মী ও নেতাকে আটক রাখিবার জন্য এই সম্মেলন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের মনোভাবের তীব্র নিন্দা করিতেছে এবং অবিলম্বে তাহাদের বিনা শর্তে মুক্তি দাবি করিতেছে।

৬। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারসমূহ যেইভাবে নিরাপত্তা ও সিকিউরিটি আইনের বলে শাসনকার্য চালাচ্ছে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সমূহ পদদলিত করিতেছে, তাহাতে উদ্বেগ ও ঘৃণা প্রকাশ করিয়া এই সম্মেলন সকল অগণতান্ত্রিক, অমানুষিক ও গণবিরোধী আইন সমূহের অবিলম্বে প্রত্যাহার দাবি করেছে এবং এই সকল “কালা-কানুনে ধৃত সকল বন্ধুদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেছে।

৭। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও এই আন্দোলনের সহিত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ ও তাহার সরকার অবিরাম যে সকল হীন প্রচারণা চালাইয়া যাইতেছে, এই সম্মেলন তাহাতে ঘৃণা প্রকাশ করিতেছে।

৮। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সহিত সংশ্লিষ্টদের উপর পুলিশী গুলীবর্ষণ এবং অন্যান্য জুলুমের ফলে শহীদদের পরিবারবর্গ ও আহতদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের জন্য এই সম্মেলন সরকারের নিকট দাবি জানাইতেছে।

৯। এই সম্মেলন সকল নিরাপত্তা বন্দির পরিবারবর্গের ভাতা দানের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানাইতেছে এবং অন্যান্য সভ্যদেশের রাজনৈতিক বন্দিদের ন্যায় এই সকল রাজনৈতিক বন্দিদিগকে সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা দান করিয়া প্রথম শ্রেণিভুক্ত বন্দি করিবার দাবি জানিয়েছে।

১০। এই সম্মেলন নারায়ণগঞ্জে রাইফেলের গুলীতে নিহত কনস্টেবলের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করিয়া সরকারের নিকট দাবি জানাইতেছে যে, গুলীর আঘাতের সংশ্লিষ্ট ঘটনা রহস্যাবৃত থাকিয়া যাওয়ায় দুইজন হাইকোর্টের বিচারপতি এবং একজন জনপ্রতিনিধি কর্তৃক উক্ত ঘটনার বিস্তৃত ও প্রকাশ্য তদন্ত করা হউক।

১১। এই সম্মেলন মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রসমূহের স্বাধীনতা হরণের তীব্র নিন্দা করিতেছে।

১২। এই সম্মেলন পাক প্রধানমন্ত্রীর নিকট আত্মীয়ের সংবাদপত্র মর্নিং নিউজের জনস্বার্থবিরোধী, ভিত্তিহীন, মিথ্যা, ঘৃণ্য দুরভিসন্ধি ও উদ্দেশ্যমূলক ভূমিকার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করিতেছে।

১৩। কোন প্রমাণ্য যুক্তি ব্যতিরেকেই এবং সকল প্রকার গণতান্ত্রিক নীতির খেলাফ করিয়া সরকার পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার উপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছেন, এই সম্মেলন তাহার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করিতেছে। কোন স্বার্থ প্রণোদিত গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সাধন এবং বিরোধী দলের ও জনসাধারণের কণ্ঠরোধের জন্যই উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হইয়াছে বলিয়া এই সম্মেলন মনে করে এবং অনতিবিলম্বে উক্ত পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

১৪। এই সম্মেলন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে প্রীতি ও সৌহার্দ্যভাব স্থাপনের উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের স্কুলসমূহে বাংলাকে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসাবে গ্রহণ করিবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের সরকারসমূহকে অনুরোধ জানাইতেছে এবং যতদিন এই পন্থা অবলম্বন করা না হয় ততদিন উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের স্কুলসমূহের স্বেচ্ছাধীন ভাষা হিসাবে রাখিবার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

১৫। এই সম্মেলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করিতে এবং বিভিন্ন ভাষার লিখিত পুস্তকাবলী বাংলা ভাষায় অনুবাদ করিতে একটি ব্যুরো স্থাপন করিবার জন্য এবং তজ্জন্য অন্তত সাড়ে চারি লক্ষ টাকা মঞ্জুর করিবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করতেছি।

আন্দোলন যখন সার্বজনীন রূপ ধারণ করে সংগ্রামী জনতা তখন মাঠে হোমরা-চোমরা নেতাদের মুখ-নিঃসৃত বাক্যের অপেক্ষায় থাকে না। আন্দোলনের আগে বহুনেতা, উপনেতা, তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও মেকী দেশসেবক আসর জমাইবার সার্বিক প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। উদ্দেশ্য কিছু ফায়দা লুটা যায় কি না; অথবা ফটকাবাজারীতে ফাঁকতালে জনতার নেতা হওয়া যায় কিনা। আন্দোলন যতই ভয়ালরূপ ধারণ করে, অগ্নি পরীক্ষা ততই নিকটবর্তী হয়- মোনাফেক, কাপুরুষ, স্বার্থান্বেষী নেতৃবৃন্দ জনতাকে অসহায় অবস্থায় আগ্নেয়গিরি উদগারিত উত্তপ্ত লাভার উত্তাল তরঙ্গে ফেলিয়া দিয়া স্বীয় প্রাণ লইয়া দৃশ্যপট হইতে হাওয়া হইয়া যায়। আন্দোলন যখন সফলতা অর্জন করে ও আন্দোলনকাল উত্তীর্ণ হইয়া পরিস্থিতি শান্তভাব ধারণ করে, তখনই ঐ সকল বিশ্বাসঘাতক, সুযোগসন্ধানী, অতি চতুর ব্যক্তি সময়োপযোগী মুখোশ পরিধান করিয়া সংগ্রামী, জনদরদী ও দেশদরদীর লেবাসে সর্বত্র বুক ফুলাইয়া পায়তারা করিতে থাকে। বর্ণিত বক্তব্য তিক্ত বটে কিন্তু নিরেট সত্য ও আমার নির্মম অভিজ্ঞতা প্রসূত। কেহ কেহ আন্দোলন সম্পর্কিত বই লিখেন, খবরের কাগজে প্রবন্ধ ছাপেন, রেডিও-টেলিভিশনে আন্দোলনের কাহিনী বিবৃত করেন, অথচ আন্দোলনের অগ্নিক্ষরা সন্ধিক্ষণ মুহুর্তে তাহাদের অনেকের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায় না। কেহ কেহ আবার আন্দোলনে স্বীয় ন্যক্কারজনক ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়া নিজ নিজ বিবেকের নিকট লজ্জাবোধ দূরে থাকুক, বেমালুম প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী বলিয়া দাবি করিয়া বিকৃত ইতিহাস বয়ান করিতে থাকেন। ইহাদের পক্ষে প্রকাশ্যে কিছু বয়ান করিবার পূর্বে আয়নায় স্বীয় চেহারাটা দেখা বোধহয় দোষের হবে না। যাহা হউক, কারাগারের কথা বলিতেছিলাম। বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দিদের মেলামেশা করার কোন নিয়ম নাই। তবুও কর্তৃপক্ষের হাজার সতর্ত দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন পন্থায় যোগাযোগ করা হয়, যেমন-জুম্মার নামাজের দিন মনজিদে আমাদের পরস্পরের দেখা সাক্ষাৎ হইত ও সেখানেই আমরা প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংলাপ সম্পন্ন করিয়া লইতাম। অথবা চিকিৎসার অজুহাতে হাসপাতালে গমন করিলেই পূর্ব খবরাখবর মোতাবেক নির্দিষ্ট ব্যক্তির সহিত দেখা হইত ও পূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা হইত। শেখ মুজিবুর রহমান এই দুইটি পন্থার কথাই অবহিত ছিলেন। তাই বোধহয় ক্ষমতাসীন হইবার পর ১৯৭২ সাল হইতে কয়েদখানায় জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট মসজিদটি তুলিয়া দিয়াছিলেন এবং কারাগারে জুম্মার নামাজ বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে শেখ মুজিবর রহমানের শাসনামলে কারান্তরালে থাকাকালেই দুঃখের সহিত আওয়ামী লীগ সরকারের এই মর্মান্তিক সিদ্ধান্তটি অবগত হই।

আন্দোলন পরবর্তী ঘটনাবলী

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরই পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাবক্রমে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে অবাধ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পাসপোর্ট ভিসা প্রথা প্রবর্তন করা হয়। পাসপোর্ট-ভিসা প্রবর্তনের পূর্ব মুহূর্তে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট রাজবন্দিদের নিকট সরকারের তরফ হইতে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, যাহারা পাকিস্তান ত্যাগ করিয়া ভারত গমনে প্রস্তুত তাহাদের কারা মুক্তির প্রশ্ন সরকার গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করিবেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে কমরেড অমর চক্রবর্তী, বেনু ধর, শিবানী আচার্য, সুশীল সেন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে কমরেড মনসুর হাবিব, সুবোধ রায়, কৃষ্ণ বিনোদ রায় ও অন্য কয়েকজন বন্দি মাতৃভূমি ত্যাগ করিয়া নিরাপত্তার অন্বেষণে ভারতভূমি মুখে পাড়ি দিলেন। এইভাবেই প্রায় পনের হাজার কমিউনিস্ট পার্টি নেতা ও কর্মী দেশ বিভাগের পর মাতৃভূমি ত্যাগ করে।

রমজান মাসে দ্বিপ্রহরে রান্না করা ভাত-তরকারী আগরাত ও সেহরীর জন্য একই সঙ্গে অপরাহ্ন ৪টা হইতে কারা নিবাসীদের সরবরাহ করা হইত। ভোর রাত ৪টার দিকে ঐ ভাত-তরকারী গরমের কারণে পঁচিয়া অখাদ্যে পরিণত হয়। ইংরেজ আমল হইতে প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতিবাদে মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী আমরাসহ বন্দিদের নিয়া ২৭শে মে (১৯৫২) সন্ধ্যা হইতে না খাইয়া রোজা পালন আরম্ভ করেন। এই প্রতিবাদের ফলেই উত্তরকালে কারাবন্দিরা সেহরির সময় গরম ভাত-তরকারী খাওয়ার ব্যবস্থা ভোগ করিয়াছেন।

রাজবন্দির মুক্তি ও অন্যান্য দাবিতে মওলানা ভাসানী লেবুরস পানে রোজা রাখিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমরা বন্দিমুক্তি ও কতিপয় দাবির ভিত্তিতে পূর্ণ অনশন ধর্মঘটের পরিবর্তে ২৭শে মার্চ (১৯৫৩) মওলানা ভাসানীর পরামর্শ মত ৩৫ দিন অনুরূপ রোজা রাখি।

মজলুম নেতা রেজা আন্দোলনে অংশগ্রহণকল্পে আমি পূর্বপাক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নিকট নিম্নোক্ত পত্র প্রেরণ করি:

To

The Premier

Govt. of East Bengal, Dacca

Sir.

In sympathy with Maulana Abdul Hamid Khan (Bhasani) now detained in the Dacca Central Jail we too are on fast since the 27th of March 1953 on the following demands:

(a) Immediate Release of All political prisoners

(b) Abolition of East Bengal Public Safety Act

(c) Recognition of Bengali as one of the State Languages of Pakistan

Yours faithfully

Sd/-Oli Ahad

বঙ্গানুবাদ

বরাবর,

প্রধানমন্ত্রী

পূর্ববঙ্গ সরকার

ঢাকা,

জনাব

বর্তমানে ঢাকা কারাগারে আটক মওলানা হামিদ খান (ভাসানী)-এর সহিত সমমর্মিতা প্রদর্শন করিয়া আমরাও নিম্রোক্ত দাবিসমূহের ভিত্তিতে ২৭শে মার্চ (১৯৫৩) হইতে রোজা পালন করিয়া আসিতেছি:

১। অবিলম্বে সকল রাজবন্দির মুক্তি দান।

২। পূর্ববঙ্গ জননিরাপত্তা আইন বাতিল করা

৩। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতিদান

আপনারই বিশ্বস্ত

স্বাঃ অলি আহাদ

কারাগারে রোজাব্রত পালনকালে মজলুমম নেতাকে জেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। জেল হাসপাতাল হইতে তিনি আমাকে একটি চিঠি লেখেন। আমি কারাগারের ৫ নং এসোসিয়েশন ওয়ার্ডে অবস্থানকালে বাইরের ঘটমান পরিস্থিতিতে তাঁহার মন কতটা বৃক্ষ হইয়া উঠিয়াছিল চিঠিটিতে তাহার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। চিঠিটি নীচে দেওয়া হইলঃ

প্রিয় অলি আহাদ

আমি তোমাদের কথায় মোটেই রাগ করি নাই এবং তোমাদের কথা বহুলাংশে সত্য তাহাও চিন্তা করিয়াছি। কিন্তু কয়েকদিন যাবং বাহিরে থাকা হইতেছে তাহাতে মনে বিশেষ দুঃখ পাইয়াছি। নিজের জীবন তুচ্ছ মনে হইতেছে। আমার সঙ্গে কথা ছিল বন্দিমুক্তি ও রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায় করিতে বিরোধী দল যে মত বা পথেরই হউক না কেন, সকলে একত্র হইয়া আন্দোলন চালাইয়া যাইবে। কোনপ্রকার দলাদলি করিলে আত্মহত্যার তুল্য হইবে। সকলেই আমার নিকট পাক্কা ওয়াদা দিয়াছিল কিন্তু এখন দেখিতেছি মূল আদর্শ হইতে দূরে গিয়া আগামী নির্বাচনের মূল আদর্শ গ্রহণ করিতে নেতৃত্বের কোন্দল আরম্ভ করিয়াছে। এমতাবস্থায় আমার একমাত্র সম্বল জীবন দেওয়া ছাড়া আর কি উপায় আছে, আমার মুক্তির সময় নাকি শীঘ্রই আসিতেছে। তাহাতে মন আরও বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছে। আদর্শহারা অবস্থায় আর কেনা-বেচার কাজ করিবার প্রবৃত্তি নাই। তুমি ভালভাবে চিন্তা করিয়া যাহা দেশের ও জাতির জন্য কল্যাণ মনে কর তাহাই জানাইও। তোমরা যে সিদ্ধান্ত করিবে সে সমস্ত দাবি আদায় করিতে যখন যাহা সঙ্গত মনে কর তাহাই গ্রহণ করিতে আমার কোন আপত্তি থাকিবে না। যদি তারিখ পরিবর্তন করিয়া পরে করা যুক্তিসঙ্গত মনে কর তাহাতে আমার কোন আপত্তি নাই। রেগে ও বাহিরের স্বার্থপরতার তাড়নায় মাথা ঠিক নাই।

মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী

ইতিপূর্বে আমরা কারারুদ্ধ থাকাকালে রাজনৈতিক আকাশে কিছু শুভ ও কিছু অশুভ ঘটনা ঘটে। মাটির সন্তানকে কেন্দ্র করিয়া ও সাম্প্রদায়িকতা সযত্নে পরিহার করতঃ রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনেকেই দারুণভাবে অনুভব করিতেছিলাম। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে জনাব মাহমুদ আলীর প্রচেষ্টায় ‘পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল’ গঠিত হয়। গণৎন্ত্রীদল গঠনকালে আহূত সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আজান পাকিস্তান পাটির দুই নেতা মিঞা ইফতেখার উদ্দিন ও শওকত হায়াত খান যোগদান করেন। এই সম্মেলনেই হাজী মোঃ দানেশকে সভাপতি ও জনাব মাহমুদ আলীকে সাধারণ সম্পাদক (সেক্রেটারি জেনারেল) নির্বাচিত করিয়া পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল গঠন করা হয়।

কায়েদে আযমের তিরোধানের পর হইতেই পাকিস্তানে ক্ষমতার লড়াই প্রকটভাবে দেখা দিয়াছিল। সে সময়ে ক্ষমতায় আসীন থাকিবার জন্য কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করিবার জন্য যে কেহ যে কোন নোংরা কৌশল অবলম্বন করিতে কখনও দ্বিধাবোধ করে নাই। খাতামুন্নাবী অর্থ ও ব্যাখ্যা প্রশ্ন ধর্মান্ধ ও অসহিষ্ণু ভাবধারার ধারক ও বাহক মোল্লা সম্প্রদায়ের পৈশাচিক ভ্রাতৃহত্যা, ধনসম্পদ লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অবাধ নারী ধর্ষণকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মমতাজ মোহাম্মদ খান দওলাতানা পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দিয়াছিলেন। বাধ্য হইয়াই কেন্দ্রীয় সরকারকে পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি করিতে হইয়াছিল। সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেঃ আযম খান অত্যন্ত কঠোর হস্তে এই দাঙ্গা দমন করেন। উক্ত দাঙ্গার হোতা অখও ভারত সমর্থক মওলানা মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তাহাকে ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেন। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মমতাজ দৌলতানাকে বরখাস্ত করিয়া পাঞ্জাবে গভর্নর শাসন প্রবর্তন করেন। পরবর্তীকালে পুর্ববঙ্গের গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নূন মমতাজ দওলাতানার স্থলে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব বঙ্গের গভর্নর থাকাকালে ফিরোজ খান নুনক এই মর্মে এক অসত্য ও অশোভন মন্তব্য করেন যে, বাংগালী মুসলমানের খৎনা করায় না। এক শ্রেণির নেতার এই ধরনের বানোয়াট হীন-উদ্দেশ্য প্রণোদিত বাংগালী-বিঘেষী মন্তব্য-বক্তব্য ও আচার-আচরণের জন্যই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হইয়াছে।

কারান্তরালে থাকাকালে ৬ই মার্চের পত্রিকায় জানিতে পারি যে, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার ডিক্টেটর জোসেফ স্টালিন দীর্ঘ তিরিশ বৎসরকাল অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে শাসনভার পরিচালনার পর (১৯৫৩ সালের ৫ই মার্চ) প্রাণ ত্যাগ করিয়াছেন। তাহার মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। বিশেষ করিয়া কমিউনিস্ট বিশ্বের উপর সোভিয়েট রাশিয়ার একাধিপত্যের দ্রুত অবসান ঘটে এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের Mono Centrism বা এককেন্দ্রিকতার স্থলে Poly-Centrism অর্থাৎ বহু কেন্দ্রীকতার সূচনা হয়।

প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অভ্যুদয়

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডির সামরিক ছাউনিতে বক্তৃতারত অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন তড়িঘড়ি প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু কালের গতিতে সেই উন্মুক্ত সদর দরজা পথেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এই বরপুত্রকে ক্ষমতার আসন হইতে বিদায় লইতে হয়। যড়যন্ত্রের এই বীজ কালক্রমে বিষবৃক্ষে পরিণত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে খাদ্য সংকট মোকাবেলা করিবার নিমিত্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাত লক্ষ টন খাদ্য শস্য আমদানী চূড়ান্ত করার অজুহাতে রাষ্ট্রদূত বগুড়া নিবাসী মোহাম্মদ আলী রাজধানী করাচিতে আগমন করেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ছিলেন বৃটিশ ঘেষা। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীয় বশংবদ মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাইবার প্রয়াস পাইতেছিল। খাদ্য সংকটের মোক্ষম সুযোগ সদ্ব্যবহার করিয়া গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ও প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইউব খান সামরিক বেসামরিক অফিসার চক্রের সহায়তায় এক অবৈধ আদেশ জারি করিয়া ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে গদিচ্যুত করেন। এইভাবেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলের নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয় এবং জনগণ নেপথ্য শক্তিতে পর্যবসিত হয়। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তরকালে প্রণীত ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা আইন মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার এক্তিয়ার বা ক্ষমতা বা অধিকার গভর্নর জেনারেলের ছিল না। বরং মন্ত্রীসভাই ছিল গভর্নর জেনারেল নিয়োগ ও অপসারণ করার একমাত্র আইনগত সংস্থা। কিন্তু ষড়যন্ত্রের বিচিত্র গতির মারপ্যাচে পড়িয়া উপরোক্ত বিধান সম্পূর্ণ অর্থহীন হইয়া পড়ে। ১৯৪৭ সাল হইতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত যে দেশের সরকার সংবিধান রচনা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হইয়াছে, গণরায়ে ক্ষমতাসীন হইয়াও পুনরায় গণরায়ের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিমুখ রহিয়াছে, সেই দেশে অনিয়মই যে নিয়ম হইবে এবং ষড়যন্ত্রই যে মুখ্য নিয়ামক শক্তি হইবে, ইহা বিস্ময়কর কিছু নহে। ১৭ই এপ্রিল (১৯৫৩) ঢাকার পল্টন ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক খাজা নাজিমুদ্দিনের এই অন্যায় ও অবৈধ পদচ্যুতির আদেশকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। পক্ষান্তরে সদ্য কারামুক্ত মজলুম নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী খাজা নাজিমুদ্দিনের এই পদচ্যুতির জন্য গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন এবং এই আদেশ সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ বলিয়া রায় দেন। একজন আইনজ্ঞ রাজনীতিক, আর অন্য একজন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চের ভাষায় ‘লুংগি সর্বস্ব মাওলানা’ রাজনীতির এই দুই দিকপালের মধ্যে কাহার বক্তব্যে ভবিষ্যৎ মঙ্গল নিহিত ছিল, পরবর্তী ঘটনারাজিই ইহার নির্ভুল উত্তর দিয়াছে। পদলোভী ও ভীরু খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের এই বেআইনি ও অবৈধ পদচ্যুত বেমালুম হজম করে দেশ ও জাতির মহাসর্বনাশ সাধন করিয়া গিয়াছেন। জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন দুর্নীতিবাজ ও মেরুদণ্ডহীন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ সাহস করিয়া গভর্নর জেনারেলের আদেশের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদ উচ্চারণ করেন নাই। জনভিত্তি হারাইয়া ফেলিলে এমনি অবস্থা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক বিয়োগান্তক নাটকের খবরে আপামর জনগণ উল্লাসে যে কিরূপ আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছিল, তাহা কাহারও অজানা নাই।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব

পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিন ২০শে ও ২১শে এপ্রিল সর্বজনাব মসিউর রহমান, ইমরান আলী, শাহ আজিজুর রহমান, এ,টি,এম, মোস্তফা, আজিজুর রহমান (কুমিল্লা), ফজলুল বারী (বগুড়া), গাজী লতিফ (যশোহর), কামাল আহমদ (চট্টগ্রাম)-এর নিকট মোহাম্মদ আলীর প্রধানমন্ত্রীত্ব সমর্থন না করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। কিন্তু গদির নিরাপত্তার আশ্বাস পাওয়া মাত্র তিনি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীকে সমর্থন দানের জন্য ওয়াদাবদ্ধ হইয়া ২৪শে এপ্রিল (১৯৫৩) ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন এবং ৯ই মে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায় অবৈধ পন্থায় অধিষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী সরকারকে সমর্থন দান করেন। এইভাবেই পাকিস্তান সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ এর শিরোপা লাভ করে এবং ইহার পর থেকে দেশ ও জাতি ক্রমশঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালের মে মাসের ১৯ তারিখে করাচিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স কেনেথ ইমারসন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করিয়া দেশবাসীর উপর দাসতু-শৃঙ্খল চাপাইয়া দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন ঘোষণার পর নির্বাচন প্রস্তুতিকল্পে ১৯৫৩ সালের ১৪ ও ১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে আহুত কাউন্সিল সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করিয়াছিল। এবং একই সঙ্গে মোহাম্মদ আলী সরকারকে আমেরিকার সহিত কোন সামরিক চুক্তি সম্পাদন না করিতে আহ্বান জানিয়েছেন। এই পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি প্রথম পরিচ্ছেদের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছিল “যে উদ্দেশ্যে এই সাহায্য দেওয়া হইতেছে, পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সহিত পুর্বাহ্নে চুক্তিবদ্ধ না হইয়া অপর কোন উদ্দেশ্যে উহা ব্যবহার করিতে পারিবে না।” প্রসঙ্গতঃ বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, অপ্রকাশিত ধারা অনুসারে পাক সৈন্য বাহিনীর চল্লিশ হাজার সৈন্যের যাবতীয় ব্যয়ভার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহন করিত এবং ইহার পরিবর্তে পেশওয়ারের সন্নিকটে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হইয়াছিল। ইহারই ব্যাখ্যা দিতে গিয়া ১৯৫৪ সালে পাক-ভারত সফর সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেস স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তান মার্কিন প্রদত্ত অস্ত্র ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করিতে পারিবে না অর্থাৎ পাকিস্তান মার্কিন অস্ত্র গুদামজাত করিয়া রাখিবে কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে মার্কিন অনুমোদন ব্যতীত ইহা ব্যবহার করতে পারবে না।

পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির চতুর্থ পরিচ্ছেদের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছিল, “পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিকট হইতে যে সব কর্মচারী পাইবেন, তাহারা চুক্তি অনুসারে পাকিস্তানে থাকিয়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব পালন করিবেন এবং চুক্তি অনুযায়ী প্রদত্ত সাহায্য কীভাবে ব্যবহৃত হইতেছে তাহা পর্যবেক্ষণ করিবার কর্তৃত্ব ও প্রযোজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাইবেন।” এই চুক্তি অনুযায়ী কর্মচারীরূপে পাকিস্তানে আগত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকগণ পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের অংশ বলিয়া পরিগণিত হবে এবং তাহার কূটনৈতিক মিশনের ডিরেক্টরের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নির্দেশে পাকিস্তান সরকার উচ্চপদস্থ মার্কিন নৌ, বিমান ও স্থলবাহিনীর উপদেষ্টাদিগকে কূটনৈতিক মর্যাদা দান করিবে। ইহার নির্গলিতাৰ্থ একটাই, বিদেশী সামরিক অফিসারগণ কূটনৈতিক মর্যাদা ভোগ করবে বিধায় আমাদের সেনাবাহিনীর উপর বিদেশী প্রভাব বিস্তারিত হইবে।

পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি পঞ্চম পরিচ্ছেদ ২(ক) অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছিল “পারস্পরিক সাহায্যের নীতি অনুসারে পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনে এমন সব কাচা মাল বা আংশিকভাবে নির্মিত দ্রব্যাদির উৎপাদন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি বা যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হস্তান্তর করিবে যাহা পাকিস্তানে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব।” ইহার পরিস্কার অর্থ হইলঃ পাকিস্তানের স্বীয় অর্থনীতির স্বাধীনতা নস্যাৎ হওয়া এবং এই দেশের অর্থনীতির উপর যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কায়েম।

পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে বর্ণিত হইয়াছিল, “পারস্পরিক নিরাপত্তার প্রয়োজনে বিশ্ব-শান্তির পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ এমন সব রাষ্ট্রের সহিত বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সহিত সহযোগিতা করিবে।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি অনুসারে চীন ও রাশিয়ার বলয় ভুক্ত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বিশ্ব শান্তির পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ। অতএব বিশ্বের এক অতি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সহিত গরীব পাকিস্তান রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতীত কোন প্রকার বাণিজ্যিক লেনদেন করতে পারবে না।

পরবর্তীকালে পাকিস্তান বাগদাদ ও সিয়াটো চুক্তিভুক্ত হয়। শর্ত মোতাবেক চুক্তিভুক্ত কোন দেশ যদি “আভ্যন্তরীণ ধ্বংসাত্মক কার্যাবলীর” দ্বারা বিপদাপন্ন হয়, তবে চুক্তিভুক্ত অন্যান্য দেশ বিপদাপন্ন মিত্রদেশে পুলিশ ও ফৌজ পাঠাইয়া সাহায্য করিবে। এই চুক্তিভুক্ত দেশগুলির অন্যতম ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ও ফ্রান্স। আভ্যন্তরীণ সরকার যতই গণবিরোধী, জালেম, শাসক ও একনায়কত্ববাদীই হোক না কেন, জনসাধারণ স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে কোন প্রকার প্রতিবাদ করতে পারে না। তাই দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসের প্রথমার্ধে পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা ৩রা এপ্রিল শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছিল কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত মোহাম্মদ আলী সরকার ৩০শে মে মামুলী এক অজুহাতে কলমের এক খোঁচায় উহাকে নাকচ করে ও গভর্নরী শাসন কায়েম করে। শুধু তাই নয়, ইহার বিরুদ্ধে জনসমষ্টির প্রতিবাদকেও আভ্যন্তরীণ ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী বলিয়াই আখ্যা দেওয়া হয়।

আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়া

১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩শে অক্টোবর তারিখে ঢাকা রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের প্রস্তাবে বলা হয়, “এই কাউন্সিল অধিবেশনের বিশ্বাস করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, পাকিস্তান সরকার গত কয়েক বৎসর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমনসব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যে সকল চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়েছে।” ১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০শে মে ঢাকা নগরীতে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের প্রস্তাব পুনর্বার সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়, “কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের লেজুড় হিসাবে না থাকিয়া আমাদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী হইতে হইবে এবং আমরা বিশ্বাস করি, কেবলমাত্র এই নীতিই পাকিস্তানকে পৃথিবীর বুকে সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে পারে।” উক্ত ঘোষণায় আরো বলা হয়, “বিভিন্ন সামরিক চুক্তি বিশেষতঃ বাগদাদ চুক্তিতে অংশগ্রহণ করিয়া পাকিস্তান মুসলিম জাহানের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সহানুভূতি হারাইয়াছে। অতএব কাউন্সিল এই প্রকারের সকল সামরিক চুক্তির নিন্দা ও বিরোধিতা করিতেছে।” ১৯৫৪ সালের নির্বাচন উত্তরকালের সর্বজনাব আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মাহমুদ আলী, হাজী মোঃ দানেশ, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রমুখ ১৬৭ জন সদস্য নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদ সদস্য ২১ এপ্রিল (১৯৫৪) এক যুক্ত বিবৃতিতে কঠোর ভাষায় পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিকে নিন্দা করেন ও উহা বাতিলের দাবি জানান অথচ ১৯৫৬ সালে ক্ষমতাসীন হইবার পর গদির মোহে পড়িয়া জনাব আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি সদস্যই প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশিত পথে সংগঠনের বৈদেশিক নীতির বরখেলাপ পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি ও সিয়াটো চুক্তির গোঁড়া সমর্থক পরিণত হন। ইহার প্রমাণ ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারী (টাঙ্গাইল জেলা) অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও তাঁহার মন্ত্রীবর্গ, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান ও তাঁহার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যরা সংগঠনের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধাচরণ করেন। সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোট বিরোধী নীতির প্রতি তাঁহাদের এই বিরোধিতা ও অশ্রদ্ধা আমাদের চরমভাবে মর্মাহত করে। ১৯৫৬ সালের ৯ই ডিসেম্বর সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সভায় পাক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রকাশ্যভাবে সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোটের পক্ষে ওকালতি করিয়াছিলেন। তবে ইহা অনস্বীকার্য যে, জনাব সোহরাওয়ার্দী আগাগোড়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত বৈদেশিক নীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন।

পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির প্রধান সমর্থক এই শেখ মুজিবুর রহমানই আবার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিলেন। একচ্ছত্র নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ রাজধানী ঢাকায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সহিত শান্তি ও মৈত্রীর নামে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি নামক পঁচিশ বৎসর মেয়াদী এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। শুধু তাহাই নয়, তিনিই অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দের ভারত অবস্থানকালে প্রকাশ্যে গোপন চুক্তির অনুমোদন দান করিয়া বাংলাদেশকে ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্র পরিণত করেন। ইহা ছিল শেখ সাহেবের ১৯৫৬-৫৭-৫৮ সালের ন্যাক্কারজনক ভূমিকারই পুনরাবৃত্তি মাত্র। বস্তুতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাঁটি অনুচর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একই পদার্থের তৈরি। ক্ষমতার লোভে দেশ ও জাতিকে বিকিয়ে দিতে তাদের উভয়ই বিবেকের সামান্যতম দংশনও বোধ করে নাই।

 ভারত বিভাগের মূল বাস্তবতা অস্বীকার করতে শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরবাসীদের স্বাধীন মতামত দানের সুযোগ না দিয়ে কাশ্মীরকে ভারতীয় রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত করিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তবে কিছুকালের মধ্যে তাহার মোহ ভঙ্গ হলে স্বাভাবিক কারণেই দিল্লী সরকার ও শ্রীনগর সরকারের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। ১৯৫৩ সালে শেখ আবদুল্লাহ কেবল পদচ্যুত হন নাই, কারাগারেও নিক্ষিপ্ত হন। বস্তুতঃ হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় ও মানভাদর দখল করিয়া পাক-ভারত ক্ষমতা হস্তান্তর বিধিকে লংঘন করিতে ভারত মোটেও কুষ্ঠাবোধ করে নাই। তাই, উপরে বর্ণিত নীতির সূত্র ধরিয়াই নেহরুজীর সুযোগ্য কন্যা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পররাজ্য গ্রাস লালসায় ১৯৭৪ সালে সিকিম রাজ্যের স্বাধীনতা নির্লজ্জের মতো অত্যন্ত সুচারুরূপে হরণ করিয়া ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ভুক্ত করিতে পারিয়াছিলেন। তবে নেপালের উপর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ লোভাতুর দৃষ্টি পুনঃপুনঃ পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতীয়দের সুচতুর খেলা কাহারও দৃষ্টি এড়ানোর নহে। তবে বাংলার জনগণ আজ সম্পূর্ণ সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ।

কারামুক্তি ও অন্তরীণাদেশ

১৯৫৩ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর হয়। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের সাহচর্য লাভ করি। তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী ও অমায়িক পুরুষ। সরকারি বহু প্রলোভনকে প্রত্যাখ্যান করিয়া দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করিয়াছেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টিতে যোগদান করেন। কিন্তু আজীবন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের পুরোভাগে থাকা সত্বেও রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে পড়িয়া প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর মার্কিন ঘেঁষা বৈদেশিক নীতি এবং সামরিক চুক্তি ও জোটের সমর্থনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ সদস্যদের সহিত একত্রে ভোট দেন। তাহার মত ত্যাগী রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের উপরোক্ত ভূমিকা আমাদের বিস্মিত ও মর্মাহত করিয়াছে।

৩০শে সেপ্টেম্বর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে আমাকে মুক্তির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সাথে আমার নিজ গ্রাম ইসলামপুরে অন্তরীণ থাকিবার এক বৎসর মেয়াদী আদেশ জারি করা হয়। উক্ত আদেশে ইহা বলা হয় যে, আমাকে প্রতি সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় সশরীরে হাজিরা দিতে হইবে। আমাকে এই আদেশপত্রটি স্বাক্ষর করিতে দিলে আমি ঘৃণাভরে সরকারি কর্মচারীর আবদার প্রত্যাখ্যান করি। উপায়ন্তর না দেখিয়া পুলিশ অফিসার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে আদেশনামাটি টাঙ্গাইয়া দিয়া আমার উপর প্রকাশ্য নোটিশ জারি করেন। ইংরেজ শাসনামলে কোন রাজবন্দিকে গৃহান্তরীণ করিলে ভরণপোষণের নিমিত্ত সরকার হইতে প্রয়োজনীয় মাসিক ভাতা দেয়া হইত। ইংরেজ বিদেশী শাসক কিন্তু জাতি হিসাবে সুসভ্য ছিল। যাহা হউক, স্বাধীন দেশের অঙ্গরাজ্য পূর্ব পাকিস্তানের সরকার অন্তরীণাবদ্ধ রাজবন্দিকে কোন ভরণপোষণ কিংবা কোন ভাতা দিবেন না। ফলে কেবল আমার ভরণ-পোষণ নহে, প্রতি সপ্তাহে আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাতায়াতের পূর্ণ রাস্তাখরচও চাকুরী হইতে অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ পিতাকেই বহন করিতে হইত। অর্থাৎ বোঝার উপর শাকের আঁটি আর কি! কারাগারে থাকিবার সময় বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করিবার যে সুযোগ পেয়েছিলাম, তাহা আমি পূর্ণ ব্যবহার করি এবং কয়েকটি খাতায় নোট গ্রহণ করি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী কারাগার অফিস থেকে আমার ঐ খাতাগুলি নিয়ে যায়। ভাবখানা যেন এই যে, পাকিস্তান ধ্বংসের সকল খুঁটিনাটি পরিকল্পনা এই কথাগুলোয় লিপিবদ্ধ ছিল। যাহা হউক, কারামুক্তির দিনে কারাগার সদর গেটের বাহিরে জনাব ফয়জুল্লাহ ও জালালউদ্দিন আহমদের (শান্ত) নেতৃত্বে কুমিল্লা যুবলীগ কর্মীবৃন্দ ও সাধারণ জনতা আমাকে তাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা নিদর্শনস্বরূপ বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করে ও শোভাযাত্রা সহ সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে। শোভাযাত্রার পর কুমিল্লা টাউন হলের উন্মুক্ত ময়দানে সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া রওয়ানা হবার আগে কুমিল্লায় দুই দিন অবস্থানের অনুমতি প্রার্থনা করিয়া জেলা প্রশাসক মেজর নাসেরকে টেলিফোন করি কিন্তু তিনি সম্মত হইলেন না। একে মেজর, তারপর আবার শাসক সম্প্রদায়ভুক্ত উর্দুভাষী। পাকিস্তান রক্ষার দায়িত্ব যেন তারই। তাহাদের ভাষায়, আমরা ভারতের চর ছাড়া কিছুই নই।

যদিও ব্রাহ্মণবাড়িয়া আমার থানা ও মহকুমা সদর, তথাপি এই শহরের সহিত কি ছাত্রজীবনে, কি কর্মজীবনে অথবা কি রাজনৈতিক জীবনে আমার যোগাযোগ ছিল খুবই ক্ষীণ। প্রথম যে দুই ব্যক্তি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানান, তাহারা হইলেন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আবদুল মালেক ও রইস মিয়া।

আব্বা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিকট রেজিস্ট্রার। গৃহ-অন্তরীণ আদেশের ফলে বাপ মায়ের স্নেহ-নীড়ে যেন পুনর্বার আশ্রয় পাইলাম। বাবার একান্ত কামনা ছিল, জীবদ্দশায় আমাকে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া যাওয়া। দেশসেবার প্রবল আকর্ষণে তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারি নাই। রাজনীতিজনিত কারাবাস আব্বার স্নেহাপ্লুত হৃদয় ও মনকে দারুণ ব্যথা দিত। আমি মর্মে মর্মে তাঁহার ব্যথায় ব্যথিত হইতাম, কিন্তু আমার যে উপায় ছিল না! যে পথের যাত্রী আমি, তাহাতে আমার পিছপা হওয়া সম্ভব নয়। গৃহান্তরীণ থাকাকালে সিলেট জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগ সম্পাদক জনাব নুরুর রহমান, গণতন্ত্রী দলনেতা দেওয়ান মাহবুব আলী, কৃষক নেতা জনাব ইয়াকুব মিঞা, বাল্যবন্ধু মফিজুল ইসলাম প্রমুখ আমার সহিত দেখা করতে আসেন। বন্ধুবর মফিজুল ইসলাম আমার কারান্তরালে থাকাকালেই দেশের সমগ্র রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দিয়া এক নাতিদীর্ঘ চিঠি চোরাইপথে আমার নিকট পাঠিয়েছে। চিঠিতে তাহার ভিন্নধর্মী নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কথা জানিতে পারিয়া বড়ই ব্যথিত হইয়াছি। সেই ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত তাহাকে জীবনভর দিতে হইয়াছে।

আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান ও যুক্তফ্রন্ট

খুব সম্ভব ২১শে অক্টোবর (১৯৫৩) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ও আবদুল হামিদ চৌধুরী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার সহিত দেখা করেন এবং পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক আলোচনার পর আমরা একই সংগঠনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করিবার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছি। অন্য কথায়, আমি একমাত্র সংগঠিত রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করি। ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৫৩ সালের ২৭শে জুলাই শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রধান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক ১৯৫৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফতে রাব্বানী পার্টির সহযোগিতায় “যুক্তফ্রন্ট” গঠন করেন। ঐক্যবদ্ধভাবে আসন্ন নির্বাচনে মোকাবেলা করাই ছিল এই ফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্য। যাহা হউক, ইতিপূর্বে মজুলুম নেতা মাওলানা ভাসানীর সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার উদ্দেশ্যে আমি পুলিশের কড়া নজর ফাঁকি দিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া হইতে নারায়ণগঞ্জে গমন করি এবং আমার আশৈশবের রাজনৈতিক সাথী জনাব শামসুজ্জোহার “হীরামহল” বাসভবনে আতিথ্য গ্রহণ করি। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সহকর্মী বন্ধুদের সহিত দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনার পর আমার অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল করিমের (এম.এস.সি; পি.এইচ.ডি) ২১/১, কৃষ্ণমোহন দাস লেন, টিকাটুলীস্থ বাসস্থানে মজলুম নেতার সহিত বৈঠকে মিলিত হই। আমি ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করিবার বিরুদ্ধে আমার দৃঢ়মত প্রকাশ করি। আমার মত ছিল যে, চরিত্রহীন, অলস, লুটপাট সমিতির সদস্য ও দুর্নীতিবাজরা যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন লাভের জন্য সর্ব-কলাকৌশল প্রয়োগ করবে এবং সৎ, চরিত্রবান, গণতন্ত্রমনা, দেশপ্রেমিক বন্ধুরা আইন সভার মারফত দেশসেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হইবে। আলোচনাকালে মজলুম জননেতা আমরা সহিত একমত হয়েছেন, কিন্তু তিনি শেষ রক্ষা করিতে পারেন নাই। বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াই তাহাকে ২১ দফার ভিত্তিতে শেরে বাংলার সহিত যুক্তফ্রন্ট গঠন করিতে হয়।

যুক্তফ্রন্টের বহুল আলোচিত ২১ দফা ছিল নিম্নরূপ:

নীতি: কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না। এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।

১। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।

২। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভুমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে। উচ্চহারের খাজনা ন্যায়সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সার্টিফিকেটযোগে আদায়ের প্রথা রহিত করা হবে।

৩। পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীন আনয়ন করিয়া পাট চাষীদের পাটের ন্যায্য মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইবে এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা আমলের পাট কেলেঙ্কারী তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায় অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।

৪। কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হইবে এবং সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে।

৫। পূর্ব পাকিস্তানকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য সমুদ্র উপকূলে কুটির শিল্প ও বৃহৎ শিল্পের লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন করা হবে এবং লবণ কেলেঙ্কারীর জন্য দায়ী মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে।

৬। খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের হাত হইতে রক্ষা করা হইবে।

৭। পূর্ব পাকিস্তানকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়ন করিয়া ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করিয়া শিল্প ও খাদ্য স্বাবলম্বী করা হইবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রভৃতি সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হইবে।

৮। শিল্পী ও কারিগর মোহাজেরদের কাজের আশু ব্যবস্থা করা হবে।

৯। দেশে একযোগে প্রাথমিক, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইবে। এবং শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।

১০। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক ও কার্যকরী করিয়া কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে এবং বেসরকারি স্কুল সমূহের বর্তমান প্রভেদ দূর করিয়া একই পর্যায়ভুক্ত করিয়া সকল স্কুল সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।

১১। ‘ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কালাকানুন বাতিল ও রহিতপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া শিক্ষাকে সহজলভ্য করা হইবে এবং ছাত্রাবাসে অল্প ব্যয়সাধ্য ও সুবিধাজনক ব্যবস্থা করা হইবে।

১২। শাসনব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করতে হবে এবং এতদুদ্দেশ্যে উচ্চ বেতনভোগী সমস্ত সরকারি কর্মচারীর বেতন কমাইয়া ও নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের বেতন বাড়াইয়া তাহাদের আয়ের একটি সুসংগত সামঞ্জস্য বিধান করা হইবে। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীরা এক হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ করতে পারবে না।

১৩। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ-রিসাওয়াত বন্ধ করিবার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে এবং এতদুদ্দেশ্যে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি পদাধিকারী ও ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত মুদ্দতের আয়-বায়ের হিসাব নিকাশ নেওয়া হইবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে না পারিলে তাহার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।

১৪। জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন বাতিল ও রহিত করতঃ বিনা বিচারে আটক সমস্ত বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা সমিতি করিবার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে।

১৫। বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগকে পৃথক করা হইবে।

১৬। যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাততঃ ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে।

১৭। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যাহারা মুসলিম লীগ সরকারের গুলীতে শহিদ হইয়াছেন, তাহাদের পবিত্র স্মৃতি চিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করা হইবে এবং তাহাদের পরিবারবর্গের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হইবে।

১৮। ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করিয়া দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হইবে।

১৯। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বশাসিত ও ‘সভেরন’ করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যবস্থা ব্যতীত অন্য সমস্ত বিষয় অবশিষ্টাত্মক (Residuary Power) ক্ষমতাসহ পূর্ব পাকিস্তানে নৌ-বাহিনীর হেড কোয়ার্টার স্থাপন এবং অস্ত্র তৈরির কারখানা নির্মাণ করতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।

২০। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভা কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের মেয়াদ বাড়াইবে না। আইন পরিষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া নির্বাচন কমিশন মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবে।

২১। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার আমলে পরিষদের কোন সদস্য পদ খালি হলে তিন মাসের মধ্যে তাহা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করিবে এবং পর পর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছা পদত্যাগ করবেন।

নির্বাচনী ফলাফল

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণার ‘অপরাধে’ আমাকে ২৫শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ৮ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের পর সরকার ১৯শে মার্চ আমাকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে মুক্তিদান করেন। উল্লেখ্য যে, পুলিশ যে ট্রেনে আমাকে বাড়ি থেকে কুমিল্লা লইয়া যাইতেছিল, জনতা সেই ট্রেনকে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পথে বাধা দেয়। আমার করজোড় অনুরোধের ফলে জনতা শেষ পর্যন্ত রেল ইঞ্জিনের অগ্রভাগের পিকেটিং প্রত্যাহার করে। ফলে এক সম্ভাব্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হইতে রক্ষা পাওয়া যায়।

১৯৫৪-এর নির্বাচন স্বতন্ত্র নির্বাচনী প্রথায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় যুক্তফ্রন্ট দুইশত সাইত্রিশটি মুসলিম নির্বাচনী কেন্দ্রে দুইশত তেইশটি আসন লাভ করে। মুসলিম লীগ পায় মাত্র নয়টি আসন। বাকি পাঁচটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন। বাহাত্তরটি সাধারণ নির্বাচনী কেন্দ্র অর্থাৎ অমুসলিম আসনের মধ্যে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস পঁচিশটি, সিডিউল কাষ্ট ফেডারেশন সাতাশটি, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট তেরটি, কমিউনিস্ট পার্টি চারটি ও গণতন্ত্রী দল তিনটি আসনে জয়লাভ করে।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল ‘নৌকা’। প্রতীকটি হক-ভাসানীর প্রতীক হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ফলে ‘নৌকা’ প্রতীক প্রাপ্তির বদৌলতে যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক মনোনীত প্রার্থী না হওয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্রীদল সদস্য দেওয়ান মাহবুব আলী ও আওয়ামী মুসলিম লীগ দলীয় একে, রফিকুল হোসেন বিপুল ভোটাধিক্যে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। এই কেন্দ্র দুটি ছিল যথাক্রমে সরাইল নাসিরনগর এবং নবীনগর বাঞ্ছারামপুর। উল্লেখ্য যে, যুক্তফ্রন্ট মনোনয়ন, বাছাই ও প্রত্যাহারের সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পর মাওলানা তাজুল ইসলাম ও মাওলানা মোসলেমউদ্দিন আহমদকে এই দুটি কেন্দ্র হইতে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করায়। ফলে তাহাদের ভাগ্যে এই পরাজয় অনিবার্য হইয়া দেখা দেয়।

নির্বাচিত পাঁচজন স্বতন্ত্র সদস্য যুক্তফ্রন্টের প্রতি আনুগত্য জানাইয়া প্রকাশ্য বিবৃতি দেন। কিন্তু তাহারা এই মর্মে পূর্বে অঙ্গীকারপত্র স্বাক্ষর করিয়াছেন যে, যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন না পেলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না অথচ ইহারাই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়াছেন, স্বীয় অঙ্গীকার বরখেলাপ করিয়াছেন, আবার নির্বাচিত হইয়া যুক্তফ্রন্টের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপনে কুণ্ঠিত হন নাই। দুইমুখি নীতি আর কাহাকে বলে! নীতির রাজনীতি নয়, এই দেশে বস্তুতঃ রাজনীতি ক্ষেত্রে এই দুইমুখী নীতির প্রবর্তন ঘটিয়াছে এবং অদ্যাবধি দুমুখো নীতি জাতির রাজনৈতিক জীবনের অভিশাপ হিসাবে প্রাধান্য লাভ করিয়া আসিতেছে। আর ইহাই জাতীয় জীবনকে করিয়া তুলিয়াছে বিষাক্ত।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত দুইশত আটাশ জন সদস্যদের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট অংগ দল যথা-পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান নেজামে ইসলামী পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফতে রাব্বানী পার্টি হইতে যথাক্রমে একশত তেতাল্লিশ, আটচল্লিশ, বাইশ, তের ও দুইজন সদস্য নির্বাচিত হন।

জনাব সোহরাওয়ার্দীর সাংগঠনিক ক্ষমতা ও একাগ্র প্রচেষ্টা এবং শেরে বাংলা ও মাওলানা ভাসানীর বিপুল জনপ্রিয়তার ফসল যুক্তফ্রন্টের এই অপূর্ব রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সাফল্য। জনাব সোহরাওয়ার্দী সম্যকভাবে সচেতন ছিলেন যে, যে কোন রাজনৈতিক অভিযানের সাফল্য পরিশ্রমী ও সৎ কর্মী বাহিনীর উপর নির্ভরশীল এবং তিনি নির্দ্বিধায় সৎ কর্মীদের দেয়া অভিমত ও রিপোর্ট বিশ্বাস করিতেন। আমার প্রেরিত রিপোর্টের উপর ভিত্তি করিয়াই তিনি কুমিল্লা-সিলেট মহিলা আসনের জন্য পূর্বাহ্নে যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক মনোনীত প্রার্থী মিসেস রাজিয়া বেগমের মনোনয়ন বাতিল করিয়া এক অজানা, অপরিচিত মিসেস আমেনা বেগমকে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন দান করেন। ঘটনার আকস্মিকতা ও নাটকীয় মোড় অভিভূতা মিসেস আমেনা বেগম একটি পোস্টকার্ডের কয়েকটি ছত্রে স্বীয় মনোভাব প্রকাশ করিয়া আমাকে লিখিয়াছিলেন, “আপনার চিঠি মন্ত্রমুগ্ধের মত কাজ করিয়াছে। শহীদ সাহেব পত্রপাঠ মাত্র আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন।” কিন্তু ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্তৃক গৃহীত ও অনুসৃত সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বাতিল নীতির স্বপক্ষে দৃঢ়মত পোষণের অপরাধে ওয়ার্কিং কমিটির ৩০শে মার্চ (১৯৫৭) তারিখের সভায় আমাকে যখন সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ হইতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়, তখন এই মিসেস আমেনা বেগম আমার বহিস্কারের পক্ষে ছিলেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৯ সালে এই আমেনা বেগমকে আবার শেখ মুজিব কর্তৃক দল হইতে অপমানিত অবস্থায় বিদায় হইতে হইয়াছিল।

জনাব সোহরাওয়াদী ছিলেন অপর দুই শীর্ষ নেতা শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ও মজলুম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে সেতুবন্ধন। মান-অপমান জ্ঞান তুচ্ছ করিয়া সোহরাওয়ার্দী সাহেব যদি যুক্তফ্রন্টের ৫৬ নং সিম্পসন রোডস্থ দ্বিতল অফিসে বসিয়া রাতদিন পরিশ্রম না করিতেন, তাহা হইলে আঁতুড় ঘরেই যুক্তফ্রন্টের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইত।

মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের মূল কারণ খোলাফায়ে রাশেদীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া ইসলামী অনুশাসন মোতাবেক রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রূপায়িত করার ওয়াদার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। মুসলিম লীগ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের যোগসাজশে সমগ্র দেশকে বিভিন্ন পন্থায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অবিচার, মোনাফেকী ও চরিত্রহীনতার অতল পঙ্কে নিমজ্জিত করেন। বৃটিশ ভারতে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১২ জানুয়ারি তদানীন্তন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের সভাপতিত্বে গফরগাঁয়ে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনের লক্ষাধিক লোকের প্রকাশ্য সভায় সুসাহিত্যিক ও এককালের প্রজা আন্দোলনের প্রাণ আবুল মনসুর আহমদ “বিনা খেসারি জমিদারী উচ্ছেদ” প্রস্তাব করিলে উহা বিপুল করতালি ও উৎসাহের সহিত গৃহীত হয়। ক্ষমতায় আসীন হইবার পর প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন গফরগাঁয়ে গৃহীত প্রস্তাব বেমালুম হজম করিয়া “বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদের” প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে ইসলামের নামে জেহাদ ঘোষণা করিলেন। ইহাই নেতা চরিত্র। তাহাদের নিকট ইসলাম ছিল ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার ও জমিদারী রক্ষা ছিল শ্রেণি স্বার্থ। মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠী ও নেতৃত্বের চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগে দুই-একজন সম্মানজনক ব্যতিক্রম ব্যতীত সরকারি কর্মচারী অবৈধ লুটপাট আরম্ভ করে। ফলে এই সকল স্বল্প সংখ্যক চরিত্রহীন সুবিধাভোগী শ্রেণি ব্যতীত ভাগ্যহত সাধারণ লোক হতবাক ও বিভ্রান্ত না হইয়া পারে নাই। এই কারণেই ক্রমে ক্রমে চাপা অসন্তোষ সর্বত্র পুঞ্জীভূত হইতে শুরু করে। ইহারই বহিঃপ্রকাশ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠীর ভরাডুবি।

অবস্থা মোকাবেলার প্রয়াসে Public and Representative office Disqualification ordinance জারি করা হলেও এই অস্ত্র সমাজদেহে বা রাজনৈতিক জীবন থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্য জারি করা হয় নাই বরং ইহার যথেচ্ছ প্রয়োগ হইয়াছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল প্রচেষ্টায় আদর্শ ও নীতির বুলি-কপচানো অতি সহজ কিন্তু আদর্শ ও নীতি বাস্তব জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনের রূপায়িত করিতে হইলে নেতৃত্বে আসীন ব্যক্তির চরিত্র প্রথম ও সর্বপ্রধান উপাদান। চরিত্র হইতে হইবে নিষ্কলুষ, নির্লোভ, পক্ষপাতিত্বহীন, হিংসা-দ্বেষ এর উর্ধ্বে, মানব দরদী, সত্যাশ্রয়ী ও নীতিনিষ্ঠ। ইহার ব্যতিক্রমের অর্থ অবধারিতভাবে জনগণের ভাগ্যাকাশে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের কশাঘাত ও ভাগ্যাহত জনগণের জীবনের অসহনীয় দুর্ভোগ অমানিশা।

পাকিস্তান ও ভারত চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে স্বাধীনতা অর্জন করিলেও ভারত স্বীয় সংবিধান রচনা করিয়া সংবিধানের প্রাসঙ্গিক বিধান অনুসারে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এবং সাংবিধানিক সরকার আইন সভা প্রতিষ্ঠা করে। অথচ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গণপরিষদে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকা সত্তেও মুসলিম লীগ সরকার দেশকে সংবিধান দিতে ব্যর্থ হয়। তদুপরি গণপরিষদকে ব্যবহার করিয়া সকল প্রকার অপকর্ম অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানকে নির্বাসন দিতে আরম্ভ করেন। যেমন ১৯৪৮ সালে পূর্ব বংগের অর্থমন্ত্রী জনাব হামিদুল হক চৌধুরী আইন অনুসারে ছয় মাসের মধ্যে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হইতে ব্যর্থ হইলে ছয় মাসের মেয়াদকে দশ মাসে বৃদ্ধি করা হয়। কেহ কেহ যেমন, গণপরিষদে মুসলিম লীগ ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করিবার দাবি জানান। অন্যদিকে জনাব সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদ সদস্য পদ বাতিল ঘোষণা করিয়া সম্ভাব্য নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীতার দ্বার বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানে তেত্রিশটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠান না করিবার মত অগণতান্ত্রিক বিধান ও রীতিনীতিও গণপরিষদ বেমালুম অনুমোদন দেয়। ফলে সমগ্র দেশে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রবর্তিত না হওয়ার আশঙ্কায় শিক্ষিত সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। অবস্থার এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়বরণ আশ্চর্যের কিছুই ছিল না।

ঢাকা আগমন

কারামুক্তির পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া হইতে আমার কর্মস্থল রাজধানী ঢাকায় আগমন করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করি। ১লা এপ্রিল ১৮ নং কারকুন বাড়ি লেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কার্যকরী সংসদের সভায় শৃঙ্খলা ভংগের দায়ে বহিস্কৃত প্রচার সম্পাদক আবদুর রহমানের স্থলে সভাপতির প্রস্তাবানুযায়ী আমাকে নির্বাচিত করা হয়।

এপ্রিল মাসেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সদর দফতর ৫৬ নং সিম্পসন রোডস্থ অট্টালিকার দ্বিতলে স্থানান্তরিত হয়। ১৪ই এপ্রিল (১৯৫৪) ঢাকার লায়ন সিনেমা হলে যুক্তফ্রন্টের মহা বিজয়ের পর ফ্রন্টের কর্মী শিবিরের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। তাহার বক্তব্যের মূল সুর ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হানিকর সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে। তিনি যে কোন ধরনের সামরিক চুক্তিবদ্ধ হওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন এবং সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানের সহিত সামরিক চুক্তি করিবার ঘৃণ্য প্রয়াসের বিরুদ্ধে কর্মী বাহিনীকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জেহাদে অবতীর্ণ হবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান।

কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণদানকালে সামরিক চুক্তি সম্বন্ধে কিছু বলতে অনুরোধ করিলে জনাব সোহরাওয়ার্দী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মন্তব্য করেন যে, তিনি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বৈদেশিক সম্পর্ক গদিনশীন সরকারই নির্ধারণ করেন। ক্ষমতাসীন সরকারই সম্যক অবগত যে, কি কি কারণে বিভিন্ন দেশের সহিত তাহারা কি কি চুক্তি করিবেন। এই সকল চুক্তি দেশের সার্বিক স্বার্থে সম্পাদিত হয়। ইহার অধিক কোন প্রকার মন্তব্য করিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

জনাব সোহরাওয়ার্দীর স্পষ্ট উক্তিতে কর্মীমিহল নিশ্চুপ হয়ে গেল বটে তবে সম্ভষ্ট হয়। নাই। যদিও পরবর্তী বৎসরগুলিতে আওয়ামী লীগ সংগঠনগতভাবে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাগদাদ চুক্তি সংস্থার সদস্যপদ প্রত্যাহার পুনঃ পুনঃ দাবি করেছিল, কিন্তু সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের সহিত কখনও একমত ছিলেন না এবং সংগঠনের সহিত বরাবর অনমনীয় ভিন্ন মত প্রকাশ করিতেন। ইহা তাহার চারিত্রিক দৃঢ়তার একটি দিক। সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য তিনি কখনও গা ভাসাইয়া দিতেন না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৪৮ সালে মার্কিন সরকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে আমেরিকা সফরে আমন্ত্রণ জানায় এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানকে আমন্ত্রণ জানায় সোভিয়েট রাশিয়া। পরিতাপের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সোভিয়েত রাশিয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েট রাশিয়া যান নাই। পরন্তু পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণ পাওয়ামাত্র নেহরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমন করেন। বিশ্বের অপর শক্তিকেন্দ্র সোভিয়েট রাশিয়ার আমন্ত্রণ অনুসারে রাষ্ট্রীয় সফরে না যাওয়াই ছিল অবিবেচনা প্রসূত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের সীমিত জ্ঞানই তাহার এই দায়িত্বহীন আচরণের কারণ। তৎপরবর্তীকালে ঘটনার বিবর্তনে পাকিস্তান কীভাবে যে বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খেলার পুতুলে পরিণত হয় তাহা সকলের জানা আছে।

১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একতরফা জয়ে হতভম্ব কেন্দ্রীয় সরকার ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহল প্রমাদ গণিল। তাই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানাতে বেশ কিছু টালবাহানা করা হইল। পরিশেষে ২৫শে মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরকার গঠনের অধিকার স্বীকার করিয়া নিলেন। তবে, অতীব পরিতাপের বিষয় যে, ইহার আগেই কায়েমী স্বার্থপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল চক্র পূর্ববংগে অরাজকতা সৃষ্টি দ্বারা ফায়দা লুটার জন্য ২৩শে মার্চ চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী পেপার মিলে বাংগালী-অবাংগালী মেহনতি শ্রমিকদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী দাংগা সংগঠিত করে। ইহার ফল পাকিস্তানের জন্য শুভ হয় নাই।

ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে ২রা এপ্রিল (১৯৫৪) পূর্ব বংগ আইন পরিষদে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সদস্যদের পার্লামেন্টারি সভায় শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হককে আনুষ্ঠানিকভাবে নেতা নির্বাচন করা হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভায় সভাপতিত্ব করেন। ৩রা এপ্রিল শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। শেরে বাংলার সহিত জনাব আবু হোসেন সরকার, জনাব আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী ও শেরে বাংলার ভাগিনা সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া শপথ গ্রহণ করেন। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে নির্বাচন যুদ্ধে সোচ্চার থাকা সত্ত্বেও সরকার গঠনের প্রথম পদক্ষেপ এই ভাগিনা সৈয়দ আজিজুল হককে মন্ত্রীসভার সদস্য করিয়া শেরে বাংলা ২১ দফা ওয়াদার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন। দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ অংগ দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ হইতে কাহাকেও মন্ত্রীসভায় গ্রহণ করেন নাই। ফলে অনৈক্য সৃষ্টি হইল। কেন্দ্রীয় শাসকচক্র ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহল অতি সন্তর্পণে ইহারই অপেক্ষায় ওঁৎ পাতিয়াছিল। মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলার উল্লিখিত কার্যক্রম দুইটি ছিল যুক্তফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের প্রতি ভাগ্যাহত জনগণের উচ্চাশা ও অবিচল আস্থার উপর অপ্রত্যাশিত ও নির্মম কষাঘাত। নেতার অদূরদর্শিতাপূর্ণ কার্যাবলী এইভাবেই দেশ ও জাতিকে বিভ্রান্ত করে। শেরে বাংলার আচরণে বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শেরে বাংলার সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সুযোগ অন্বেষণে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে। মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক কলিকাতা সফরকালে ৩০শে এপ্রিল এক সম্বর্ধনা সভায় ভাষণ দানকালে আবেগপ্রসূত মুহূর্তে বলেন, “রাজনৈতিক কারণে বাংলাকে বিভক্ত করা যেতে পারে, কিন্তু বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি আর বাংগালীত্বকে কোন শক্তিই কোনদিন ভাগ করিতে পারিবে না। দুই বাংলার বাংগালী চিরকাল বাংগালীই থাকিবে।” শেরে বাংলার উক্তিতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি অগ্নিশর্মা হইয়া উঠে। আওয়ামী মুসলিম লীগ শেরে বাংলার উক্তি কদর্য করিয়া রাজনৈতিক অংগনে তাহাকে ঘায়েল করিবার জন্য সচেষ্ট হয়। এই দিকে ২রা মে (১৯৫৪) বা ১লা রমজান অপরাহ্ণে এক অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সম্মুখে সশস্ত্র পুলিশের গুলিতে ৬/৭ বছরের এক কিশোর বালক প্রাণ হারায়। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপঃ

চকবাজারের এক পানের দোকানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কারারক্ষী (Jail. Warder) মকবুল হোসেন ‘বাকী’ খরিদ বাবদ বার আনা বা পঁচাত্তর পয়সা ঋণী ছিল। মকবুল হোসেন পুনরায় বাকী খরিদ করিতে চাহিলে দোকানি বাকী বিক্রি করিতে অস্বীকৃতি জানায় ও পূর্বের বাকী পঁচাত্তর পয়সা পরিশোধ করতে বলে। ইহা লইয়া উভয়ের মধ্যে বচসার সূত্রপাত হয় ও ঘটনা ক্রমান্বয়ে হাতাহাতি ও মারামারির রূপ গ্রহণ করে। এই তুচ্ছ ঘটনাটি অচিরে জনতা ও কারারক্ষীদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক ফায়দা লুটার মতলবে খবর পাওয়ামাত্র পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান এক উশৃঙ্খল জনতার কাফেলাকে নেতৃত্ব দিয়া জেল গেট আক্রমণ করেন। উশৃঙ্খল জনতা জেল গেট সন্নিকটবর্তী সশস্ত্র পুলিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অগ্রসর হলে, আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তা অপরিহার্য কারণে জেল গেটে প্রহরারত সশস্ত্র পুলিশ গুলিবর্ষণ করতে বাধ্য হয়। আই, জি, পি, শামসুদ্দোহা সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ও আক্রমণকারী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার প্রচেষ্টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেন কিন্তু পর মুহর্তেই আবার তাহাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ঘটনা অতি সামান্য, অতি তুচ্ছ এবং অনুল্লেখযোগ্য অথচ ইহার ফলশ্রুতিতে একটি নির্দোষ নিষ্পাপ কিশোরকে পুলিশের গুলিতে আত্মাহুতি দিতে হইল। অকারণেই খালি হইল মায়ের বুক। সস্তা জনপ্রিয়তাকামী শেখ মুজিবর রহমানের নিকট ঘটনার যথার্থতা বা গুণাগুণ বিচার অবান্তর। উল্লেখ্য যে, আমাদের অনুরোধে নেহায়েত অনিচ্ছাকৃতভাবে জনাব সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় গ্রহণের জন্য শেরে বাংলাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন; কিন্তু শেরে বাংলা শেখ সাহেবকে মন্ত্রীসভায় নিতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানান। ফলে গোটা আওয়ামী লীগের আর কাহাকেও মন্ত্রীসভায় নেওয়া হয় নাই। ইহাই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণ আর ইহারই পরিণাম ফল সদ্য গঠিত ফজলুল হক সরকারের বিরুদ্ধে তাঁহার এই অভিযান।

এইদিকে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠানের তৎপরতা চলিল। আমি মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর সহিত সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরিয়া এইসব কর্মী সম্মেলন ও জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম। এসব সভায় অবিলম্বে নবনির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন ডাকার দাবি উত্থাপন করিয়া আমরা মুখ্যমন্ত্রী হক সাহেবের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে শুরু করিলাম।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও আমি আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে যোগদানের জন্য ঢাকা থেকে ৮ই এপ্রিল টাঙ্গাইল পৌঁছে। ৯ই এপ্রিল সকাল বেলায় প্রথম অধিবেশনে যোগদানের পর টাঙ্গাইল জেনারেল ট্রান্সপোর্ট অফিসের দ্বিতলে বিশ্রাম নিতেছিলাম। এই সময়ে ঢাকা থেকে শেরে বাংলার ভাগিনা ব্যারিস্টার মাহবুব মোর্শেদসহ জনাব আতাউর রহমান খান সেখানে উপস্থিত হন। তাহারা জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা আওয়ামী লীগসহ অন্য অংশ দলগুলি হইতে সদস্য গ্রহণ করিয়া মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণ করিতে খুবই আগ্রহী। শেরে বাংলার প্রেরিত প্রস্তাব মওলানা ভাসানীর সম্মতি লাভের পর ব্যারিষ্টার মাহবুব মোর্শেদ ঢাকা ফেরত আসিলেন।

১০ই মে আওয়ামী লীগ আহূত পল্টনের বিরাট জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা অকস্মাৎ বিনা আমন্ত্রণে হাজির হইলেন। পল্টন সভামঞ্চে যুক্তফ্রন্টের দুই কর্ণধার মওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলার একসংগে উপস্থিতি জনসমুদ্রে এক নব আশা ও আস্থার সঞ্চার করিল। সভায় শেরে বাংলা আবেগপ্রবণ ভাষায় ঘোষণা করিলেন যে, তিনি মাওলানা ভাসানীর নির্দেশেই দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। এইভাবেই করাচি শাসক চক্রের প্ররোচনায় যুক্তফ্রন্টে যে অনৈক্যের বীজ বপনের চেষ্টা চলিতেছিল, কুচক্রীদের সেই প্রচেষ্টা আপাততঃ ব্যর্থ হইল। ১৫ই মে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা সম্প্রসারিত হইল। আওয়ামী লীগের তরফ হইতে আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, শেখ মুজিবুর রহমান, হাশিম উদ্দিন আহমদ মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। সম্প্রসারিত মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণকালেই আদমজী পাটকলে বাংগালী-অবাংগালী শ্রমিকে শ্রমিকে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হয়। দাংগায় পনের শত আদম সন্তান বিনা কারণে প্রাণ হারায়। যুক্তফ্রন্টের বিজয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নেক নজরে দেখে নাই। তাই তাল সামলাইতে না পারিয়া বেসামাল মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিলথে খুবই অযাচিতভাবে ও সর্বপ্রকার কূটনৈতিক শালীনতা ঝাড়িয়া ফেলিয়া মন্তব্য করিলেন যে, “পূর্ববঙ্গের নির্বাচনের ফলাফলের দরুন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি এর কোন পরিবর্তন হবে না।” ইতিপূর্বে ২৩শে মার্চ কর্ণফুলী পেপার মিলে বাংগালী-অবাংগালী শ্রমিকের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয় তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৫ মে আদমজী পাটকলে। নিউইয়র্ক টাহমস সংবাদদাতা কালাহান মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলার সহিত সাক্ষাতকারের বিবরণীতে বিচ্ছিন্নতাবাদের আভাষ দান করেন। মিঃ কালাহানের এক প্রশ্নোত্তরে শেরে বাংলা নাকি বলিয়াছিলেন, “পূর্ববঙ্গ স্বাধীনতা ঘোষণা করবে।” কেন্দ্রীয় শাসকচক্র ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহল এবং সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন বশংবদ গোষ্ঠীর মধ্যে হৈ চৈ পড়িয়া গেল। তাহাদের মহলে দাবী উঠিল, দেশদ্রোহী শেরে বাংলাকে পদচ্যুত করিয়া পূর্ববংগে কেন্দ্রীয় শাসন চালু কর। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের সহিত বোঝাপড়া করিবার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা করাচি গেলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের অশুভ মতিগতিতে আতঙ্কিত হয়ে করাচিতে অবস্থানরত জনাব সোহরাওয়ার্দী ঢাকা হইতে কতিপয় মন্ত্রীকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হইল না।

১২-ক ধারা

৩০শে মে গভর্নর জেনারেলের ভাষায় ‘কমিউনিস্ট বিশৃঙ্খলা দমনে’ ব্যর্থ শেরে বাংলার মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করা হয় অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে ৯২-ক ধারা প্রবর্তন করিয়া জারি করা হয় কেন্দ্রীয় শাসন। গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামানের স্থলে দেশরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে গভর্নর পদে ও জনাব এম, এ, ইসহাকের স্থলে জনাব এন,এম, খানকে চীফ সেক্রেটারি পদে নিয়োগ করা হয়। একই সঙ্গে পূর্ব বাংলা সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশীপ আদেশ জারি এবং যুক্তফ্রন্ট কর্মীদেরকে গ্রেফতারের হুকুম জারি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ পঁয়ত্রিশ জন পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যসহ প্রায় হাজারের উপর লোক গ্রেফতার হন। আমরা আত্মগোপন করলাম।

কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন আচরণে প্রথম হইতেই গভর্নরের শাসন প্রবর্তন হওয়ার আশঙ্কা আমাদের মনের কোণে নানাভাবে উঁকি-ঝুঁকি মারতেছিল। এরূপ অস্বস্তিকর রাজনৈতিক পরিবেশে কমিউনিস্ট বন্ধুদের প্ররোচনায় মওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য বার্লিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। আমাদের কোন আপত্তি, কোন যুক্তি, কোন বাধা মওলানা ভাসানীর বিদেশ গমনের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন করতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আসন্ন নিশ্চিত হামলার সুস্পষ্ট ও অর্থবহ ইঙ্গিত উপেক্ষা করিয়া মজলুম নেতার এই দেশ ত্যাগ পরোক্ষ ও তাহার অলক্ষ্যে স্বৈরাচারী কেন্দ্রীয় সরকারের হাতকেই শক্তিশালী করিয়াছিল। তাই ইস্কান্দার মীর্জা দম্ভোক্তি করিয়া হুঙ্কার ছাড়িতে পারিয়াছিলেন, “মাওলানা ভাসানীর মত রাষ্ট্রদ্রোহী প্রত্যাবর্তন করিলে, তাহাকে গুলী করিয়া হত্যা করা হবে।” প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী ১৫ জুন বেতার ভাষণে দাবি করেন, শেরে বাংলা নাকি নিজেই তাহার বিরুদ্ধে আনীত ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ অভিযোগের ‘স্বীকারোক্তি” দিয়াছেন। নবগঠিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার বরখাস্ত ও ৯২-ক ধারা প্রবর্তনজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করিবার নিমিত্ত ১লা জুন (১৯৫৪) অপরাহ্ন দুই ঘটিকায় সদরঘাটস্থ ৫৬ নং সিম্পসন রোডে যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পার্টির এক সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু নুতন গভর্নরের নির্দেশে পুলিশ পূর্বাহ্নে ৫৬ নং সিম্পসন রোডস্থ দ্বিতল তালাবদ্ধ করিয়া দেয়। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী জনাব আবু হোসেন সরকারের সরকারি বাসভবনে নেজামে ইসলামী পার্টির নেতা আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেরে বাংলা মন্ত্রীসভার সকল সদস্য ও যুক্তফ্রন্টভুক্ত আইন পরিষদ সদস্যবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। সভা ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের বিরোধিতা ও নিন্দা করিয়া, শেরেবাংলাকে নজরবন্দি ও শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করিয়া প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং সদস্যবৃন্দ প্রয়োজনবোধে কারাবরণ করিবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কারাবরণ তো দূরের কথা এই বীর পুরুষগণ পুলিশের ছায়া দেখিয়াই সভাস্থল হইতে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করিতে করিতে রণে ভঙ্গ দেন; এবং খুব সম্ভব ভালোয় ভালোয় ঘরের ছেলে ঘরে প্রত্যাবর্তন করিতে পারিয়া আল্লাহ তায়ালার দরবারে শোকরানা নামাজ আদায় করেন। ভাবখানা যেন এই যে, তাহারা আইন পরিষদের সদস্য হইয়াছিলেন মান, মর্যাদা, প্রতিপত্তি, মন্ত্রীত্ব ইত্যাদির খাতিরে, জনগণের সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হইবার কারণে জেল জুলুম ভোগ করিবার এবং স্ত্রী-পুত্র কন্যাকে অশেষ বেকায়দায় ফেলার জন্য নয়। সংগ্রাম করিবে, আইন অমান্য করিবে, কারাবরণ করিবে, পুলিশি অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করিবে যুক্তফ্রন্ট কর্মীরা ও জনগণ। নেতারা আরাম আয়েসে টু পাইস কামাই করিবেন, কর্মীরা জিন্দাবাদ দিবে সময়কালে- ইহাই ছিল তাদের মনোভাব।

এদিকে গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জার আধা সামরিক শাসনে যে নাভিশ্বাস দেখা দেয়, তন্মুহূর্তে যুক্তফ্রন্টের ত্রিপ্রধান নেতার অনুপস্থিতি পরিস্থিতি আরো শূন্যতার গর্ভে নিক্ষেপ করে। শেরে বাংলা অন্তরীণ অবস্থায় ২৩শে জুলাই (১৯৫৪) রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া প্রকাশ্য বিবৃতি দিলেন। মওলানা ভাসানী লন্ডনে দিন গুজরান করিতেছিলেন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী পেটের ফোড়া অপারেশনকল্পে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ হাসপাতালে ভর্তি হলেন। অথচ এই তিন প্রধান ঢাকার মাটিতে দাঁড়াইয়া কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক জারিকৃত গভর্নরী শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে ডাক দিলে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভাকে পুনর্বহাল করা ব্যতীত কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য কোন উপায় থাকিত না। নেতৃত্বের দুর্বলতা জনতার প্রতিরোধ চেতনা ও শক্তিকে যে কীভাবে স্তিমিত করিয়া ফেলে, ইহা তাহারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শেরে বাংলা মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান নিজ গ্রেফতারের পূর্বে ৩০শে মে করাচি হইতে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া অপরাহ্নে তাঁহার সরকারি বাসভবনে আমাদের (অর্থাৎ আবদুল হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালাল উদ্দিন, হাতেম আলী তালুকদার ও আমি) সহিত এক বৈঠকে মিলিত হইয়া প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ার পরামর্শ দিয়াছিলেন। আমি তদুত্তরে তাহাকে বলিয়াছিলাম যে, প্রতিরোধ আন্দোলন করিবার প্রয়োজনে শেখ সাহেবকে আত্মগোপন করতে হবে এবং তাদের গ্রেফতার বরণ করা সমীচীন হবে না। কিন্তু আমাদের পরামর্শের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শেখ সাহেব সরকারি বাস ভবনে রাত্রি যাপন করিলেন এবং তথা হইতেই গ্রেফতার হইলেন ও নির্ঝঞ্জাট কালযাপনের জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আশ্রয় হইলেন।

আমি অত্যন্ত হতোদ্যম হইয়া পড়িয়াছিলাম এবং প্রায় দুই মাস কাল আত্মগোপন করিয়া থাকিবার পর মেডিকেল কলেজের ছাত্র বন্ধুবর আলী আসগর, নজরুল ইসলাম ও রাশেদুল হকের সহায়তায় নৌকাযোগে দাউদকান্দি গমন করি এবং আলী আসগরের শ্রদ্ধেয় পিতা লাল মিয়া সরকার সাহেবের বাড়ি কুমিল্লা গিয়া বন্ধুবর মফিজুল ইসলামের বাসভবনে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণ করি। কুমিল্লায় আমি আমার শ্রদ্ধেয় মামা কাজী সুলতান মাহমুদের ও আমার অগ্রজ আজিজুর রহমান সাহেবের শ্বশুর বাড়িতে বেশ কিছুকাল আত্মগোপনে কাটাই। কিন্তু আমার কুমিল্লা অবস্থান গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীদের গোচরীভূত হয়। তাই আমি কালবিলম্ব না করিয়া কমিউনিস্ট পার্টি কর্মীদের সহায়তায় আগরতলা গমন করি। আগরতলায় বাবু সত্য রায়, নরেশ রায় ও ঠাকুর ভাই-এর বাস্তব সাহায্য ও সহায়তা ভুলিবার নয়। বিদেশ বিরাজ্য আগরতলায় তাহারাই ছিলেন আমার স্বজন ও আশ্রয়দাতা। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর আমি আগরতলা কলেজে ভর্তি হতে গিয়াছিলাম; কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প তিষ্টিতে না পারিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আবার ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর হামলার মুখে বাধ্য হইয়া আমাকে আগরতলায় আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইয়াছিল।

৯২-ক ধারা বলবৎ থাকাকালে পাকিস্তান সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভুমন্ডলীয় স্বার্থে কমিউনিস্ট বিরোধী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (South East Asia Treaty Organization) ও বাগদাদ চুক্তি (Baghdad Pact) সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করে। মে মাস থেকে স্বল্প কয়েক মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদী চক্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সামরিক চুক্তির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী সরকার পাকিস্তানকে পশ্চিমা শক্তিজোটের লেজুড়ে পরিণত করেন। ১৯৫৪ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় এক সভায় পাকিস্তান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও নিউজিল্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (SEATO) গঠন করে; আর ১৯৫৫ সালের ১লা জুলাই পাকিস্তান, ইরাক, তুরস্ক, ইরান ও গ্রেট ব্রিটেন বাগদাদ চুক্তি সংস্থা গঠন করে। ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে ব্রিগেডিয়ার করিম কাসেমের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ইরাকের সরকার পরিবর্তন হয় ও সাম্রাজ্যবাদী চুক্তি সদস্যপদ প্রত্যাহার করায় বাগদাদ চুক্তি সংস্থার অন্যান্য সদস্যবৃন্দ CENTO- CENTRAL TREATY ORGANISATION নামে নূতন নামকরণ করিয়া তুরস্কের আঙ্কারায় সদর দপ্তর স্থানান্তরিত করে। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা আয়ত্বাধীন হইবার পর ২০, ২১ ও ২২ সেপ্টেম্বর (১৯৫৪) পাকিস্তান গণপরিষদ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১০ ধারা বিলুপ্ত করিয়া গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হ্রাস করে ও ১৯৪৯ সালের পাবলিক এন্ড রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডিন্যান্স বাতিল করিয়া সংবিধানের মূলনীতি কমিটি রিপোর্ট গ্রহণ করে। প্রণীত শাসনতন্ত্র বিল চূড়ান্ত বিবেচনার্থে গণপরিষদে উপস্থাপিত করিয়া দিয়া প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই অনুপস্থিতির সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিয়া গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সশস্ত্র বাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের সহায়তায় গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হরণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ সংকল্পে ২৩শে অক্টোবর (১৯৫৪) পাকিস্তান গণপরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন ও সমগ্র দেশে জরুরি অবস্থা জারি করিয়া গণপরিষদের সংবিধান রচনার উপর এক চরম প্রত্যাঘাত হানেন। সফররত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী গভর্নর জেনারেলের জরুরি বার্তা পাইয়া যুক্তরাষ্ট্র সফর সংক্ষিপ্ত করিয়া ২৪শে অক্টোবর মধ্যরাত্রে করাচি বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। বিমান বন্দর হইতেই সরাসরি তাহাকে গভর্নর জেনারেলের বাসভবন যাইতে হয়। গভর্নর জেনারেলের নির্দেশ মত তাকেই পুনঃমন্ত্রীসভা গঠন করিতে হয়। মোহাম্মদ আলীর ভাষায় এই সভা হইল “মিনিস্ট্রি অব ট্যালেন্ট”। ইহার সদস্যরা হইলেন সেনাধ্যক্ষ জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খান, প্রাক্তন দেশরক্ষা সচিব ও পূর্ববঙ্গের গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা, ডা খান সাহেব, এম, এইচ, ইস্পাহানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবু হোসেন সরকার, মোঃ শোয়েব, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, মীর গোলাম আলী তালপুর।

পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী করাচি হইতে ও জনাব আতাউর রহমান খান ঢাকা হইতে প্রকাশ্য বিবৃতি দ্বারা এবং জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা সেন্ট্রাল জেল হইতে গেলাম মোহাম্মদকে টেলিগ্রাম যোগে ফরমান বলে পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যায় ও অবৈধ বিলুপ্তিকে স্বাগত জানান। এমনকি গোলাম মোহাম্মদের এই বিধি-বহির্ভুত অন্যায় ফরমানের পক্ষে সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে করাচি হইতে মাহমুদুল হক ওসমানী এবং ঢাকা হইতে আতাউর রহমান খান বিদেশে চিকিৎসারত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও লন্ডনে অবস্থানরত স্বেচ্ছা নির্বাসন জীবনযাপনকারী মওলানা ভাসানী সমীপে গমন করেন। গণপরিষদ এর বিলুপ্তি ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের জন্য অপরিহার্য প্রয়োজনীয় সংবিধান হাওয়া হইয়া গেল। ক্ষমতালোভী নেতাদের যেন আর তর সহিল না। তাদের প্রায় সবাই স্বৈরাচারী গোলাম মোহাম্মদের গণতন্ত্র বিরোধী জঘন্য কারসাজির দোসর বনিয়া গেলেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত মুখ্যমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিন পর্যন্ত গণপরিষদের সদস্য পদ হতে ইস্তফা দানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গের নব নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক স্বীয় গণপরিষদ সদস্যপদ ত্যাগ করিবার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেন নাই অথবা নূতন গণপরিষদ গঠনের কোন দাবি জানান নাই।

১৪ নভেম্বর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের ঢাকা আগমন উপলক্ষে পদচ্যুত মুখ্যমন্ত্রী ও রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের সুস্পষ্ট ঘোষণাকারী শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক পুনরায় কর্মচঞ্চল হইয়া উঠিলেন। মন্ত্রীত্বের টোপ জাদুকরী প্রভাবে শেরে বাংলা ও আতাউর রহমান খান ঢাকা বিমান বন্দরে স্বৈরাচারী গভর্নর জেনারেলকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হইলেন। বিমানবন্দরে কে তাহাকে প্রথমে মাল্যভূষিত করিবেন এই সমস্যায় জর্জরিত দুই নেতাকে উদ্ধার করিলেন গভর্নর জেনারেল স্বয়ং। অর্থাৎ তিনি শেরে বাংলা ও আতাউর রহমান খানের দুই হাত একত্রিত করিয়া যুগপৎ মাল্যদানের সুযোগ করিয়া দিয়া উভয়েরই ধন্যবাদার্হ হইলেন, জনপ্রতিনিধিদের এই কর্মকাণ্ডে অবাক গোলাম মোহাম্মদ নিশ্চয়ই তাহাদের অলক্ষ্যে ক্রুর হাসি হাসিলেন এবং মনে মনে বোধ হয় আওড়াইয়াছিলেন, “আসিলাম, দেখিলাম এবং জয় করলাম”। ৯২-ক ধারার গভর্নরী শাসনের যাতাকলে পূর্ব বঙ্গবাসীর যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, তখন তাহাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই ন্যাক্কারজনক কুৎসিৎ চেহারা ও ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা দেশবাসীকে সম্ভিত না করিয়া পারে নাই।

রোগমুক্তির পর জুরিখ হাসপাতাল ত্যাগ করিয়া লন্ডন আগমন করিলে সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে জনাব সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করেন যে, পাকিস্তানের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মন্ত্রীসভায় যোগদানের বিষয়ে মনস্থির করিতে সময় লাগিবে। তাহার এই মন্তব্যের ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক দৃষ্টি আকর্ষণকারী প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মীর্জা গর্বভরে বলিয়াছিলেন, “পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনের পর দশ দিনের অধিক সময় লাগিবে না।” জনাব সোহরাওয়ার্দী ১১ ডিসেম্বর (১৯৫৪) করাচি প্রত্যাবর্তন করেন ও তাহার করাচি রোডস্থ বাসভবনে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবর্গের সহিত এক বৈঠকে মিলিত হইলেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও জনাব সোহরাওয়ার্দী ২০শে ডিসেম্বর মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রীসভায় আইনমন্ত্রী পদে যোগদান করলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মীর্জার দম্ভোক্তি সত্য হল। রাজনীতির অপার মহিমায় কি না হয়! ১৯৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দীর বঙ্গীয় মন্ত্রীসভায় যে মোহাম্মদ আলী অর্থমন্ত্রী ছিলেন, ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে সেই মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভা জনাব সোহরাওয়ার্দী হইলেন আইনমন্ত্রী। আবার অঘটন ঘটন পটিয়সী রাজনীতির বদৌলতে যে শেরে বাংলা পাঞ্জাবী চক্রের হোতা চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রীসভায় যোগদান করিয়া সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। যে ফজলুল হক ১৯৫৪ সালের মে-জুন মাস পাক সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায় ভূষিত হয়েছিলেন, সেই ফজলুল হক ১৯৫৫-৫৬ সালে পাকিস্তানের নিরাপত্তা মন্ত্রী পদ অলঙ্কৃত করেন। এই নীতি জ্ঞানহীন রাজনীতি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। ইহারই বিষবাষ্প অচিরেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অঙ্গচ্ছেদ এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতি চালাক ও অতি লোভ যে জাতীয় ঐক্যকে রক্ষা করিতে পারে না, ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয়।

ইতিমধ্যে শহীদ সাহেবের প্রচেষ্টায় শেখ মুজিবর রহমান ১৮ই ডিসেম্বর (১৯৫৪) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হতে মুক্তিলাভ করেন। গোলাম মোহাম্মদ শেরে বাংলার মনোনীত জনাব আবু হোসেন সরকারকে ৪ জানুয়ারি (১৯৫৫) মন্ত্রীসভার সদস্য করলেন। শহীদ সাহেব গোলাম মোহাম্মদ চক্রের গোলক ধাঁধাঁয় এতই দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছিল যে, মন্ত্রী বনাম সাংগঠনিক মতবিরোধ সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জওয়াবে মন্তব্য করেন, “আওয়ামী লীগ আবার কি? আমিই আওয়ামী লীগ”। অন্য এক প্রশ্নের জওয়াবে তিনি বিস্ময়করভাবে অবলীলাক্রমে বলেন, “আমিই আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো।” বলাই বাহুল্য যে, গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলিয়া খ্যাত বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ শহীদ সাহেবের এইসব উঁক্তি আওয়ামী লীগের অসংখ্য নির্যাতিত, ত্যাগী, নীতিনিষ্ঠ ও নিবেদিত প্রাণ কর্মীকে হতাশ ও নিরাশ করে। তদবধি ব্যক্তিপূজার রাজনীতি আওয়ামী লীগে ক্রমশঃ প্রাধান্য বিস্তার করিতে থাকে এবং ইহা দেশ ও জাতির অচিন্তনীয় ক্ষতি সাধন করে। শহীদ সাহেবের অন্য এক উক্তি যুক্তফ্রন্ট কতকগুলি দলের স্তুপ বা সংগ্রহ মাত্র”- যুক্তফ্রন্টের জীবনীশক্তি অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হইয়া দেখা দেয়। এই উক্তি আওয়ামী লীগ মহলকে চরমভাবে বিভ্রান্ত করে। শহীদ সাহেবের সব উক্তি ও বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যাপারে গণতন্ত্রপ্রিয় জনমনে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া গোলাম মোহাম্মদ চক্রের শ্যেন দৃষ্টি এড়ায় না। তাই শহীদ সাহেব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ প্রধান মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীকে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপন করিতে হইতেছে। যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের বহু সংখ্যক নেতা ও কর্মী কারান্তরালে ধুঁকিতেছিলেন। তাহাদের অনেকেই গ্রেফতারি পরোয়ানা বা হুলিয়ার দাপটে বনে-জঙ্গলে কাল কাটাচ্ছিলেন; এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মীর্জা সর্বজন শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ মওলানা ভাসানীর জীবননাশের (গুলী করিয়া হত্যা) হুমকি পর্যন্ত দিয়াছিলেন। এইভাবে চক্রান্তের রাজনীতি স্বাভাবিক পথেই পল্লবিত হইতেছিল। শেরে বাংলার মনোনীত প্রতিনিধি হিসাবে জনাব আবু হোসেন সরকারের কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদান ছিল বর্ণিত চক্রান্তেরই অন্যতম পরিণতি।

ঢাকা প্রত্যাবর্তন

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগরতলা থেকে দেশের মাটিতে আমার প্রত্যাবর্তন অতি তীব্রভাবে অনুভব করেছিলাম। তাই আত্মগোপন অবস্থায় ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি এবং ২রা নভেম্বর (১৯৫৪) দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার প্রকাশিত বিবৃতি মারফত দৈনিক ইত্তেফাকের উপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানাই; শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজবন্দির মুক্তি ও রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে জারিকৃত হুলিয়া প্রত্যাহার এবং সার্বজনীন ভোটে অবিলম্বে নূতন গণপরিষদ গঠনের দাবি উত্থাপন করেন।

১৮ই ডিসেম্বর কারামুক্তির অব্যাহতি পর শেখ মুজিবুর রহমান বিভেদের রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন এবং যুক্তফ্রন্ট নেতা শেরে বাংলার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়নের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করেন। ওয়ার্কিং কমিটি শেরে বাংলার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থনের জন্য আওয়ামী লীগ ভুক্ত পরিষদ সদস্যদের উপর নির্দেশ জারি করে। আমার উপরে তখনও গ্রেফতারী পরওয়ানা ছিল বিধায় আমি আওয়ামী লীগ সদর দপ্তর ৫৬ নং সিম্পসন রোডের উক্ত সভায় যোগ দিতে পারি নাই।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া অন্ধকার ঘনীভূত হইলেই আমি সাইকেলযোগে আওয়ামী লীগ অফিসের গাড়ী বারান্দায় পৌঁছানো মাত্রই শেখ সাহেব ও অন্যদের সহিত দেখা হয়। শেখ সাহেব আমাকে সভার কার্যবিবরণী জানান এবং কার্যবিবরণী খাতায় আমার সহি গ্রহণ করিয়া সভার কোরাম আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ করেন। দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন ও আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি সুসাহিত্যিক ও প্রখ্যাত লেখক আবুল মনসুর আহমদের ঘোর বিরোধিতা ও আপত্তি এবং মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর লন্ডন হইতে যুক্তফ্রন্ট ভঙ্গের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও আতাউর রহমান খান ১৭ই ফেব্রুয়ারি (১৯৫৫) শেরে বাংলাকে নেতৃত্ব হইতে অপসারণকল্পে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন ও নূতন নেতা নির্বাচনের কর্মসূচী বাস্তবায়নে সর্বক্ষণ ব্যাপৃত রহিলেন। অনাস্থা প্রস্তাব সভায় শেরে বাংলা ১১৯ ও আতাউর রহমান ১০৫ সদস্যের সমর্থন পান। শেরে বাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন উক্তি এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক যুক্তফ্রন্টকে কতগুলি দলের জগাখিচুড়ি (Conglomeration of parties) আখ্যাদানের মধ্যেই নিহিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের মূল মানসিক শক্তি। যুক্তফ্রন্ট ভাঙন সৃষ্টির এই প্রয়াসে ইন্ধন জুগিয়ে ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুচর করাচি প্রাসাদ চক্রের অন্যতম অনুগত সহচর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চিফ সেক্রেটারি নিয়াজ মোহাম্মদ খান। অনাস্থা প্রস্তাব সম্পর্কিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একমাত্র শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন, যাহার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যুক্তফ্রন্টভুক্ত বিভিন্ন অঙ্গদল ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব ছিল। জনাব সোহরাওয়ার্দী অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে যুক্তফ্রন্টের বিজয় সুনিশ্চিত করিয়াছিলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুচরদের প্ররোচনায়, বুদ্ধিনাশ অবস্থায় তিনি স্বয়ং জনগণের ঐক্যের এই হাতিয়ার যুক্তফ্রন্টের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। উপরোল্লিখিত ঘটনারাজির ধারায় জনগণের লক্ষ্যে ও নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যক্তি সর্বস্ব, ব্যক্তি প্রাধান্য ও ব্যক্তিপূজা আশ্রয়ী রাজনীতির ক্রমবিকাশ ঘটে এবং নীতি, আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মসূচি ভ্রষ্ট রাজনীতি অভিশাপ দেশবাসীর ঘাড়ে চাপিয়া বসে। যাহা হউক, এভাবেই যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গিয়া গেল এবং এদিকে শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে রহিল কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও গণতন্ত্রী দল, জনাব আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশ (২০জন) যুক্তফ্রন্টভুক্ত রহিল, এবং জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বৃহত্তর অংশ সংগঠিত হইল। লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগের ১৯ জন পরিষদ সদস্য এই অবস্থায় শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করেন।

১৯৫৫ সালের ২৭ শে জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় সরকার কর্তৃক আমার বিরুদ্ধে জারিকৃত গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হয়।

গণপরিষদের সভাপতি জনাব তমিজউদ্দিন খান গভর্নর জেনারেলের গণপরিষদ বিলুপ্ত আদেশের বিরুদ্ধে সিন্ধুর চীফ কোর্টে মামলা দায়ের করেন। ১৯৫৪ সালের ৭ই নভেম্বর সিন্ধু চীফ কোর্ট গণপরিষদ বিলুপ্ত আদেশকে অবৈধ ও এখতিয়ার বহির্ভূত বলিয়া রায় দেন। ১৯৫৪ সালের ১০ই নভেম্বর গভর্নর জেনারেল সিন্ধু চীফ কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আবেদন জানান। ১০ই মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত কৌসুলি মিঃ ডিপলক সরকারের নির্দেশ মোতাবেক আদালতের নিকট নিবেদন করেন যে, গভর্নর জেনারেল বর্তমানে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোর মাধ্যমে নির্বাচনের সাহায্যে একটি নূতন গণপরিষদ গঠন করতে ইচ্ছুক রহিয়াছে। ২১শে মার্চ (১৯৫৫) সুপ্রীম কোর্ট সিন্ধু চীফ কোর্টের রায়কে নাকচ করিয়া গভর্নর জেনারেল কর্তৃক গণপরিষদ বিলুপ্তির আদেশকে বৈধ বলিয়া ঘোষণা করেন বটে তবে অবিলম্বে একটি সংবিধান প্রণয়ন সংস্থা গঠনের আদেশ দেন। তদানুযায়ী গভর্নর জেনারেল ১৫ই এপ্রিল (১৯৫৫) Constitution Convention Order অর্থাৎ সংবিধান কনভেনশন আদেশ জারি করেন।

এবম্বিধ অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী কলকাতার পথে লন্ডন থেকে ৫ জানুয়ারি (১৯৫৫) বোম্বাই পৌঁছেন। ২৮ শে মার্চ (১৯৫৫) আমাকে নিম্ন পত্রটি লিখেনঃ

প্রিয় অলি আহাদ,

আশা করি ভাল আছো। পাসপোর্ট সংগ্রহ করিতে পারিলে সত্বর আসিবে। পূর্ব পাকিস্তান টু আসাম, কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে লোক আসিতেছে, তাহাতে আমরা সত্বরই সংখ্যালঘু হইয়া পড়িব এবং উহার দরুন হিন্দুস্তানে সংখ্যালঘুদের মনেও আতঙ্ক বৃদ্ধি পাইবে। আশা করি, আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে প্রত্যেক জেলায় বিজ্ঞাপন বিতরণ ও সভা সমিতি করিয়া যাহাতে লোক আসা বন্ধ হয়, তাহার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিবে। আমার দোয়া-সালাম সকলকে জানাইও। উভয় পাকিস্তানের মিলন আওয়ামী লীগের সংগঠনের দ্বারাই হইবে।

গণ আন্দোলন ভালভাবে করিতে চেষ্টা করিবে।

স্বাক্ষর মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী

২৮-৩-৫৫

সোহরাওয়ার্দীর প্রতিশ্রুতি

৩০শে মার্চ (১৯৫৫) রোজ বুধবার সকালের দিকে কলকাতার টাওয়ার হোটেলে অবস্থানরত মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর সহিত টেলিফোনযোগে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে আমার আলোচনা হয়। মজলুম নেতা আমাকে কলিকাতায় দেখা করিতে আদেশ দেন; কিন্তু সরকার পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে কলকাতায় যাইতে আমি অনুরোধ জানাই। মজলুম নেতার উপর আরোপিত বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার, ৯২-ক ধারা প্রত্যাহার ও রাজবন্দি মুক্তির দাবিতে ১৫ এপ্রিল (১৯৫৫) আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দী ও ইস্কান্দার মীর্জা আওয়ামী লীগ ও ফজলুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত যুক্তফ্রন্ট সংবিধান কনভেনশনে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ঢাকা আগমন করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে ২০শে এপ্রিল সকাল ছয় ঘটিকায় গভর্নমেন্ট হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ও আওয়ামী লীগ দলীয় আইন পরিষদ সদস্যবৃন্দের এক যৌথ বৈঠকে সংবিধান কনভেনশনে যোগদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রবর্তিত সংখ্যাসাম্য নীতি এবং পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও খয়েরপুর সমবায়ে পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট গঠন পরিকল্পনার আমি তীব্র বিরোধিতা করি। কিন্তু আমার বিরোধিতা অরণ্যরোদনে পর্যবসিত হয়। কেননা তখন সকলকেই মন্ত্রীত্বের লোভ ও ক্ষমতার লোভে পাইয়া বসিয়াছিল। এইদিকে শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সংবিধান কনভেনশন আদেশ প্রত্যাখান করে। জনাব সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় পাকিস্তান সরকার মওলানা ভাসানীর উপর হইতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার পর মওলানা ভাসানী ২৫ শে এপ্রিল (১৯৫৫) রোজ সোমবার অপরাহ্নে কলিকাতা হইতে ঢাকা আগমন করেন। ২৬শে এপ্রিল আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সংবিধান কনভেনশন গৃহীত হয়। তবে, জনাব সোহরাওয়ার্দী নিম্নে বর্ণিত লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর মওলানা ভাসানী ওয়ার্কিং কমিটি Constitution Convention-এ যোগদানের সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছেন “I hereby declare that I shall try my utmost to get the 21-point programmes and joint electorate by the Constitution Convention so far as the proposal affects the constitution. On failure to do so I shall resign from the Ministry”.

Sd-H.S.Suharwardy

26.4.55

অর্থাৎ “আমি এতদ্বারা ঘোষণা করিতেছি যে, ২১ দফা ও মুক্ত নির্বাচন প্রস্তাবাবলী কনস্টিটিউশন কনভেনশন কর্তৃক গ্রহণ করার লক্ষ্যে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব যতদূর পর্যন্ত প্রস্তাবগুলি সংবিধানের সহিত সম্পর্কিত। ব্যর্থ হলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করিব।”

স্বাঃ এইচ,এস, সোহরাওয়ার্দী

২৬-৪-৫৫

২৭ শে এপ্রিল সর্বজনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), ইয়ার মোহাম্মদ খান ও আমি মনোনয়নপত্র দাখিল করি। মুসলিম আসনের জন্য মোট পঞ্চাশটি মনোনয়নপত্র ও সংখ্যালঘু আসনের জন্য মোট আটটি মনোনয়নপত্র দাখিল হয়। পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জনাব সোহরাওয়ার্দীর নিকট হইতে লিখিত প্রতিশ্রুতি পত্র পাওয়ার পর কনস্টিটিউশন কনভেনশনের বিরুদ্ধে সোচ্চার মওলানা ভাসানী কনস্টিটিউশন কনভেনশন গ্রহণ করেন। দুঃখের সহিত উল্লেখ করিতে হয় যে, গণতন্ত্রের মানসপুত্র আখ্যায়িত জনাব সোহরাওয়ার্দীর এই সময়ের ভূমিকা দেশকে এক সর্বনাশা ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলিয়া দিতেছিল।

সংখ্যাসাম্য, এক ইউনিট ও কনস্টিটিউশন কনভেনশনের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বিচলিত আইনমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর উপরে বর্ণিত পদক্ষেপগুলি দেশবাসী গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানাইলে বিকল্প পন্থায় যথা প্রয়োজনবোধে সামরিক বিধানের মাধ্যমে দেশের সংবিধান জারি করা হইবে বলিয়া ঘোষণা করেন। সোহরাওয়ার্দীর উক্ত অবাঞ্ছিত উক্তি পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক মহলকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করিয়া তোলে। ১৯৫৫ সালের ৩রা এপ্রিল ফেডারেল কোর্ট রায় দেয় যে, অর্ডিন্যান্স বলে সংবিধান (constitution) জারি করা যাবে না, গণপরিষদই কেবল সংবিধান রচনার এক্তিয়ার রাখে।

১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল এক আদেশ বলে গভর্নর জেনারেল কনস্টিটিউশন কনভেনশন (constitution convention) গঠন করার ও ১০মে (১৯৫৫)-এ কনভেনশন বসার ঘোষণা প্রদান করেন। ১০ই মে (১৯৫৫) প্যাটেলের মামলার রায় দানকালে ফেডারেল কোর্ট কনস্টিটিউশন কনভেনশন নয় বরং কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির অর্থাৎ গণপরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। তদানুযায়ী গভর্নর জেনারেল ২৮শে মে (১৯৫৫) আশি জন সদস্য বিশিষ্ট গণপরিষদ গঠনের আদেশ জারি করেন। তার মধ্যে চল্লিশ জন পূর্ব পাকিস্তান ও চল্লিশজন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হবেন। স্বতন্ত্র নির্বাচন বিদায় পূর্ব পাকিস্তান হইতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয় একত্রিশজন মুসলমান ও নয়জন অমুসলমান।

দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী জনাব সোহরাওয়ার্দীর প্রতিটি পদক্ষেপকে প্রাসাদ চক্রান্ত প্রসূত মনে করেন ও তিনি দেশী-বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী চক্রের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় আমাদিগকে সজাগ রাখিতে আপ্রাণ চেষ্টা করিতেন। তাঁহার ও আমার মধ্যে মতভেদ কখনও কখনও মতান্তরে গড়াইত। মাঝে মাঝে তাহার ব্যথাবিধুর মুখপানে চাহিয়া আমি নিজেই অপ্রস্তুত হইয়া পড়িতাম। এই যে, পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত গূঢ় রহস্য অনুধাবন করিতে আমি ব্যর্থ হই কেন? ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে ৯২-ক ধারা জারির অব্যবহিত পূর্বে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানকল্পে মওলানা ভাসানীর দেশত্যাগ আমি সহজভাবে গ্রহণ করিতে পারি নাই। বিশেষ কোন গোষ্ঠীর প্ররোচনায় জনগণকে হায়নার খপ্পরে ফেলিয়া সংকট মুহূর্তে বিদেশ গমন তাহার বিদেশ অবস্থান ও বিদেশে তাহার বিভিন্ন কার্যাবলী আমার নিকট বাস্তব-বিবর্জিত ও জাতীয়স্বার্থ হানিকর বলিয়া প্রতীয়মান হইত। যুক্তফ্রন্ট শীর্ষ নেতৃবৃন্দ শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনৈক্য জনগণের সার্বভৌমত্ব হরণকারী, গণতন্ত্র বিরোধী, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সামন্তবাদ, উঠতি পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকেই শুধু উস্কাইয়া দেয় নাই- এই সবের যারা দোসর সেই প্রাসাদ রাজনীতির শিরকুলমণিদের ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতিকেও দেশের মাটিতে মূল বিস্তার করিতে ও জীবনরস আহরণ করিতে বিপুলভাবে সহায়তা করিয়াছে।

গভর্নর জেনারেলের ২৮শে মে’র (১৯৫৫) গণপরিষদ আদেশ মোতাবেক পূর্ববঙ্গ হইতে নির্বাচিতব্য একত্রিশ জন মুসলিম সদস্যের মধ্যে ছিলেন যুক্তফ্রন্ট হইতে ষোলজন, আওয়ামী লীগ হইতে বারজন, মুসলিম লীগ হইতে একজন এবং স্বতন্ত্র একজন। পক্ষান্তরে নয়জন হিন্দু সদস্য যথাক্রমে পাকিস্তান কংগ্রেস, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি ও সিডিউন্ড কাস্ট ফেডারেশন ভুক্ত ছিলেন। প্রথম পাক গণপরিষদের বাহাত্তর জন সদস্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান হইতে নির্বাচিতদের সংখ্যা ছিল চুয়াল্লিশ জন। তন্মধ্যে ছয়জন সদস্য ছিলেন অবাঙ্গালি। স্বাধীনতার পর ভারত হইতে পশ্চিম পাকিস্তানে আশি লক্ষ মোহাজের স্থায়ীভাবে বসবাস করিতে আসে। গণপরিষদে তাহাদের প্রতিনিধিত্ব দান করা হয় এবং তদানুযায়ী কতজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ফলে গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা বাহাত্তর হইতে বৃদ্ধি পাইয়া উনাশিতে উপনীত হয়।

৯২-ক ধারা প্রত্যাহার

অসুস্থ গভর্নর জেনারেল চিকিত্সার কারণে সুইজারল্যান্ড অবস্থানকালে আইনমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কতিপয় সাংবিধানিক বিষয় আলোচনার প্রয়োজনে তাঁহার নিকট গমন করেন। তাহাদের উভয়ের অনুপস্থিতির সুযোগে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী শেরে বাংলার সহিত আঁতাত করেন ও শেরে বাংলার পরামর্শে ৩রা জুন পূর্ববঙ্গে আরোপিত ৯২-ক ধারা প্রত্যাহার করেন এবং ৬ই জুন (১৯৫৫) যুক্তফ্রন্ট সদস্য ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জনাব আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ববঙ্গ মন্ত্রীসভার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। অবশ্য পূর্ববঙ্গের গভর্নরের শাসন প্রত্যাহার করিয়া জনপ্রতিনিধিদের সরকার গঠনের দাবিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ সর্বত্র জনসভা অনুষ্ঠান করেছিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরকার গঠনের অপ্রতিরোধ্য গণদাবি ছিল ৯২-ক ধারা প্রত্যাহারের অন্যতম কারণ।

 ১৭ই জুন অপরাহ্নে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ও মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় ২১ দফা মোতাবেক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত সংবিধান রচনার দাবি জানানো হয়। জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ২৩ জনের সভায় পূর্ববঙ্গের জন্য ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’ আদায় করিতে ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ দলীয় গণপরিষদ সদস্যবর্গকে পদত্যাগ করিতে বলা হয়। যদিও ১৯৫৬ সালের সংবিধানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন গৃহীত হয় নাই; তথাপি ১৯৫৬ সালেই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠন করে এবং ১৯৫৭ সালের ১৪ই জুন ঢাকার পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। জনাব সোহরাওয়ার্দীর গোড়া সমর্থক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর খান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান লজ্জার মাথা খাইয়া সোহরাওয়ার্দীর এই উক্তিকে সহাস্যবদনে গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁহারাই আবার স্বায়ত্তশাসনের সব চাইতে বড় দাবিদার বলিয়াছিলেন। যাহা হউক, ৭ই জুলাই (১৯৫৫) প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও স্বাস্থ্যশৈল নিবাস মারীতে দ্বিতীয় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। জনাব মোস্তাক আহমদ গুরমানী অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন। স্বল্পকালীন অধিবেশনের পর গণপরিষদ অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়। গণপরিষদের পরবর্তী অধিবেশন ৮ই আগস্ট (১৯৫৫) থেকে সংবিধান রচনা পর্যন্ত করাচিতে অনুষ্ঠিত হয়। ১২ই আগস্ট বরিশালের জনাব আবদুল ওয়াহাব পাকিস্তান গণপরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন।

অসুস্থতার কারণে ৫ই আগস্ট (১৯৫৫) গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ছুটি গ্রহণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মীর্জা স্থায়ী গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন এবং গোলাম মোহাম্মদের মৃত্যুর পর ইস্কান্দার মীর্জা ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন।

১০ই আগস্ট কেন্দ্রে মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ-যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক যদিও এককালে প্রাসাদ রাজনীতির নায়কদের দ্বারা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন, তবু ষড়যন্ত্রকারী ক্ষমতাসীনদের প্রয়োজনের তাগিদে তাহাদের দ্বারা তিনিই আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হইয়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে কি না হয়? সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আইয়ুব খান পুনরায় ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে সরকারি মর্যাদা পাবেন। ইহাই ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইন পরিষদের বিরোধী দলের প্রথম সরকারি মর্যাদা। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের পদে নিযুক্ত হইলেন।

মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রীত্বকালে কতিপয় দাবির ভিত্তিতে পুলিশ ধর্মঘট হয়। পুলিশ ধর্মঘটের সহিত জড়িত থাকার সন্দেহে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়। বিনাবিচারে আটক নেতাহাদের মুক্তির দাবিতে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আগত পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী, সিন্ধু আওয়ামী মোহাজের নেতা জি, এম, সৈয়দ, লায়ালপুর আওয়ামী লীগ নেতা জামাল উদ্দিন কাটাও, ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি আবদুর রশীদ সরকার ও আমি ১২ ডিসেম্বর (১৯৫৫) রোজ সোমবার মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের সহিত সাক্ষাৎ করি। কথোপকথনে প্রতীয়মান হয়েছে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নয়, আমলারাই স্বরাষ্ট্র বিভাগ পরিচালনা করেন। জনপ্রতিনিধিদের শক্তি জনতা। জনতা হইতে বিচ্ছিন্ন হলে আমলাদের হাতের পুতুল হইতে হয়। ক্ষমতালাভ এইভাবে জনপ্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও আইন পরিষদ সদস্যগণকে আমলাদের দয়ার পাত্র পরিণত করে।

আওয়ামী মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িকীকরণ

১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩শে অক্টোবর ঢাকার সদরঘাট অবস্থিত ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন দিবসব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনের সুদূর প্রসারী গুরুত্বপূর্ণ অবদান হইল, সংগঠনের দ্বিজাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা। পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রধান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসাম্প্রদায়িকীকরণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। পক্ষান্তরে সংগঠনের সাম্প্রদায়িক চরিত্র পরিবর্তনের প্রবক্তা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান জনাব সোহরাওয়ার্দী অন্ধ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী ও রাজনীতি সচেতন কর্মী সমাজের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচারণ করিতে ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। সংগঠনের কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় শেখ সাহেবের অবস্থা ছিল শ্যাম রাখি না কুল রাখি। যাহা হউক, ২২শে অক্টোবর রাত্রি প্রায় ৪টার দিকে জনাব সোহরাওয়ার্দী তাহার আপত্তি প্রত্যাহার করলে প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক করিবার স্থির হয়। উক্ত সুদূরপ্রসারী ও গভীর সম্ভাবনাময় সিদ্ধান্তের ফলে অনাগত ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এক শুভ মৌলিক গণতান্ত্রিক সৌভ্রাতৃমূলক পরিবেশ সৃষ্টির গোড়াপত্তন ঘটে।

ইহা অনস্বীকার্য যে, কোন রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান প্রয়াসে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী মতান্তরে মতান্তর নিরসনে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন একমাত্র সেতুবন্ধন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনতন্ত্রে সন্নিবেশিত অন্যতম ধারা ছিল, “এই প্রতিষ্ঠান ইহার গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক শাখা হিসাবে গণ্য হইবে।” তাই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ প্রধান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারবার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ সুস্পষ্ট বক্তব্যকে হজম করিতে হইয়াছে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যৌথ নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বই ছিল সংগঠনের গণভিত্তি ও সাংগঠনিক শক্তির মূল কারণ। কোন কোন বিষয়ে তাঁহাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য উপেক্ষা করিয়া সাধারণ কর্মী বাহিনী ও নেতৃবর্গ তাহাদের যৌথ নেতৃত্বের আকাঙ্খা ছিলেন।

১৯৫৩ সালে ঢাকা ‘মুকুল’ সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায় নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ নির্বাচিত হয়েছিলেন:

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী                                       সভাপতি

আতাউর রহমান খান                                                              সহ-সভাপতি

আবুল মনসুর আহমদ                                                             সহ-সভাপতি

আবদুস সালাম খান                                                                                 সহ-সভাপতি

খয়রাত হোসেন                                                                     সহ-সভাপতি

শেখ মুজিবুর রহমান                                                               সাধারণ সম্পাদক

কোরবান আলী                                                                       সাংগঠনিক সম্পাদক

আব্দুর রহমান                                                                       প্রচার সম্পাদক

মোহাম্মদ উল্লাহ                                                                                 অফিস সম্পাদক

ইয়ার মোহাম্মদ খান                                                            কোষাধ্যক্ষ

১৯৫৪ সালের ১লা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সংগঠন থেকে বহিষ্কার জনাব আব্দুর রহমানের স্থলে আমি প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হই।

১৯৫৩ সালে সভাপতি মওলানা ভাসানী কর্তৃক মনোনীত ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যবৃন্দ ছিলেনঃ

১। মুজিবর রহমান, রাজশাহী, ২। শামসুল হক, রাজশাহী, ৩। মশিউর রহমান, যশোর, ৪। আবদুল খালেক, যশোহর, ৫। ডা: আজহার উদ্দিন আহমদ, রংপুর, ৬। রহিমুদ্দিন আহমদ, দিনাজপুর, ৭। মজিবর রহমান, বগুড়া, ৮। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, পাবনা, ৯। সৈয়দ আকবর আলী, পাবনা, ১০। জহুর আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম, ১১। আবদুল আজিজ, চট্টগ্রাম, ১২। আবদুর রহমান খান, কুমিল্লা, ১৩। আবদুল বারী, কুমিল্লা, ১৪। জসিম উদ্দিন আহমদ, সিলেট, ১৫। সিরাজ উদ্দিন আহমদ, নোয়াখালী, ১৬। এ, ডব্লিউ লাকিতুল্লাহ, বরিশাল, ১৭। আবদুল মালেক, বরিশাল, ১৮। আবদুল হামিদ, ময়মনসিংহ, ১৯। আছমত আলী খান, ফরিদপুর, ২০। খোদাবক্স, টাঙ্গাইল, ২১। আকবর হোসেন আকন্দ, বগুড়া ২২। আবদুল হাই, যশোর, ২৩। শেখ আব্দুল আজিজ, খুলনা।

১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩শে অক্টোবর দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে নিম্নলিখিত কর্মকর্তাগণ নির্বাচিত হন:

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী                                       সভাপতি

আতাউর রহমান খান                                                              সহ-সভাপতি

আবুল মনসুর আহমদ                                                             সহ-সভাপতি

খয়রাত হোসেন                                                                     সহ-সভাপতি

শেখ মুজিবুর রহমান                                                               সাধারণ সম্পাদক

অলি আহাদ                                                                             সাংগঠনিক সম্পাদক

অধ্যাপক আবদুল হাই                                                            প্রচার সম্পাদক

আবদুস সামাদ                                                                         শ্রম সম্পাদক

তাজউদ্দিন আহমদ                                                                                সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক

মিসেস সেলিনা বানু                                                                  মহিলা সম্পাদিকা

মোহাম্মদ উল্লাহ                                                                                 অফিস সম্পাদক

ইয়ার মোহাম্মদ খান                                                            কোষাধ্যক্ষ

সভাপতি মওলানা ভাসানী নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য রূপে মনোনয়ন দান করেনঃ

১। জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ২। জনাব আবদুল আজিজ, চট্টগ্রাম ৩। অধ্যাপক আহসাব উদ্দিন আহমদ, চট্টগ্রাম ৪। জনাব আবদুল জব্বার খদ্দর, নোয়াখালী ৫। জনাব আব্দুল বারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৬। রফিক উদ্দিন ভূইয়া, ময়মনসিংহ ৭। হাতেম আলী খান, টাঙ্গাইল ৮। আবদুল হামিদ চৌধুরী, ফরিদপুর ৯। সৈয়দ আকবর আলী, সিরাজগঞ্জ ১০। শেখ আবদুল আজিজ, খুলনা ১১। মোমিন উদ্দিন আহমেদ খুলনা ১২। মশিউর রহমান, যশোর ১৩। সাদ আহমেদ, কুষ্টিয়া ১৪। জহুর আহমেদ, চৌধুরী, রাজশাহী ১৫। কাজী গোলাম মাহবুব, বরিশাল ১৬। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, পাবনার ১৭। আমজাদ হোসেন, পাবনা ১৮। ডাঃ মজহার উদ্দিন আহমদ, রংপুর ১৯। মাওলানা আলতাফ হোসেন, ময়মনসিংহ ২০। রহিমউদ্দিন আহমদ, দিনাজপুর ২১। আমিনুল হক চৌধুরী, বরিশাল ২২। আকবর হোসেন আকন্দ, বগুড়া ২৩। দবির উদ্দিন আহমদ, নীলফামারী ২৪। পীর হাবিবুর রহমান, সিলেট ২৫। কামরুদ্দিন আহমদ, ঢাকা।

সর্বদলীয় কর্মপরিষদ গঠন

পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নকল্পে প্রচারিত খসড়া পূর্ববঙ্গের জনমতকে বিক্ষুব্ধ করিয়া তোলে। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তপ্ত হইয়া উঠে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রী সংসদ সমবায়ে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় প্রতিনিধি সভায় মওলানা ভাসানী ও আমাকে যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি নির্বাচিত করিয়া সর্বদলীয় কর্মপরিষদ গঠন করা হয় এবং ২৯শে জানুয়ারি (১৯৫৬) সমগ্র দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ধর্মঘট, মিছিল ও জনসভার মাধ্যমে দেশবাসী ২৯শে জানুয়ারি প্রতিরোধ দিবসে অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। কর্মপরিষদের ৩রা ফেব্রুয়ারি বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের আহ্বান করিয়া সংবিধান প্রশ্নে স্পষ্ট মতামত জ্ঞাপন করিতে আহ্বান জানানো হয় এবং মিসেস আমেনা বেগম, প্রাণেশ সমাদ্দার, মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল আউয়াল, আবদুস সাত্তার ও আমি কর্মপরিষদের পক্ষ হইতে মুখ্যমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ আহ্বানের অনুরোধ জ্ঞাপন করছি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার আইন পরিষদ বৈঠক ডাকিতে অস্বীকৃতি জানান। তাহার এই অস্বীকৃতির প্রতিবাদে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ১২ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ‘পরিষদ আহ্বান দিবস’ পালন করে। এতদুপলক্ষে ঢাকার পল্টন ময়দানে আমার সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বলিতে ভুলিয়াছি, ইতিপূর্বেই ৮ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত সংবিধানের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশে প্রতিরোধ সপ্তাহ ঘোষিত হয়েছিল।

ক্লার্ক রিপোর্ট

প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী অংশীদার হিসেবে শেরে বাংলার নেতৃত্বে আস্থাশীল যুক্তফ্রন্ট সংবিধান রচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। ২১ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সহায়তা দানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মুজাফফর আহমদ চৌধুরী ও অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে পাকিস্তান গণপরিষদের উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষাকালে জনৈক বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রণীত রিপোর্ট তাহাদের নজরে পড়ে। অর্থনীতিবিদ কলিন ক্লার্ক ১৯৫২ সালে তাহাদের রিপোর্টে বিস্তীর্ণ ভূমি এলাকা পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষির উপর এবং ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্প ভূমির এলাকা পূর্ব পাকিস্তানে কলকারখানা স্থাপনের ওপর জোর দেওয়ার সুপারিশ করেন।

 নিম্নে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত হলোঃ

“For some years at least West Pakistan will get richer as East Pakistan gets poorer until it becomes possible to make a Further construction of industry in East Pakistan or else for some of the population to migrate elsewhere.”

অর্থাৎ “যতদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত না হইবে কিংবা এর অধিবাসীদের এক অংশের অন্য কোথাও চলিয়া যাওয়া সম্ভব না হয়, ততদিন পর্যন্ত কয়েক বৎসর পশ্চিম পাকিস্তান সম্পদশালী হইতে থাকিবে।” কলিন ক্লার্কের উপরোক্ত মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাই ১৯৫৫ সালে আমি পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের যৌক্তিকতা দেশবাসীর সামনে তুলিয়া ধরিবার উদ্দেশ্যে “পূর্ববঙ্গ শ্মশান কেন?” পুস্তিকাটি রচনা করি। উল্লেখ্য যে, পুস্তিকাটি বহুলভাবে প্রচারিত হয়েছিল।

অর্থনীতিবিদ কলিন ক্লার্কের সুপারিশ মোতাবেক পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করিবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দূরে থাকুক, এমনকি ১৯৫৭ সালে মার্কিন সাহায্য আই,সি, এ, (International co-operation Administration) ১ কোটি ডলার পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প সম্প্রসারণ ও আধুনিকরণের মানসে সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক বরাদ্দকরণ, পূর্ব পাকিস্তান দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় ২৮ লক্ষ টন খাদ্য ক্রয়ে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাকরণ, বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চলের মধ্যে সমবন্টন নীতি গ্রহণ এবং পুর্ব পাকিস্তান ও অন্যান্য অনুন্নত প্রদেশে নূতন আমদানীকারক নীতি নির্ধারণের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও বণিক শ্ৰেণী অত্যন্ত বেসামাল হইয়া উঠে। তাই তাহার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে ক্ষমতাচ্যুত করার অপচেষ্টায় সর্বপ্রকার চক্রান্ত প্রচারণায় লিপ্ত হল। ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি বার্ষিক ভোজ সভায় প্রধান অতিথি রাষ্ট্র প্রধান ইস্কান্দার মীর্জাকে অভিনন্দনপত্রে সোহরাওয়ার্দী সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগারকালে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেন:

“Parity in the political sphere may be a workable compromise but its application to economic planning without considering other important economic factors may lead us into blind alleys from where there may be no way out.”

অর্থাৎ “রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্য কাজ চালানো গোছের অনেক মীমাংসা দিতে পারে, কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক যথার্থতা বিবেচনা না করিয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় সমবন্টন বা সংখ্যাসাম্য প্রয়োগ আমাদেরকে এমন এক কানাগলিতে নিয়া যাইবে, যেখান হইতে নিষ্ক্রমণের কোন পথই থাকবে না।” ইহার ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী মাত্র তের মাস সরকার পরিচালনার পর ১৬ই অক্টোবর (১৯৫৭) পদত্যাগ করিতে বাধ্য জন। অর্থনীতিবিদ কলিন ক্লার্কের সুপারিশ অনুযায়ী সর্বাত্মক শিল্পায়নে বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ করা দূরে থাকুক, কেবলমাত্র সমান সমান বৈদেশিক মুদ্রার বরাদ্দ নীতি পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থ ও করাচির অবাঙ্গালি শাসকরা সহ্য করিতে পারেন নাই।

দাবি দিবস

এমনিতর মানসিক পটভূমিকায় পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছিল। শাসনতন্ত্র পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও যুক্ত নির্বাচন সন্নিবেশিত করার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান করাচি থেকে তারযোগে আমাকে ১৬ মার্চ ‘দাবি দিবস’ ঘোষণা করার নির্দেশ দেন। তাঁহার করাচি অবস্থানকালে আমি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলাম। ১৬ই মার্চ ‘দাবি দিবস’ উপলক্ষে পল্টন ময়দানে জনসভা আহ্বান করি। মোহাজের নেতা মাওলানা রাগিব হাসানও ১৬ই মার্চ (১৯৫৬) অপরাহ্নে পল্টন ময়দানে জনসভা আহ্বান করেন। অনিবার্য সংঘর্ষ এড়াইবার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও আমি মাওলানা রাগিব হাসানের সহিত তাহার বাসস্থানে দেখা করি। আমরা আলোচনায় ঐকমত্যে পৌঁছা যে, অপরাহ্ন ৪ ঘটিকা পর্যন্ত মাওলানা রাগিব হাসান সভা পরিচালনা করিবেন এবং উহার পর আমরা সভার কাজ আরম্ভ করিব। অতীব পরিতাপের বিষয়, অপরাহ্ন ৪-৩০ মিনিট উত্তীর্ণ হইলেও এবং পুনঃপুনঃ অনুরোধ সত্ত্বেও সভার সভাপতি মাওলানা রাগিব হাসান কর্তৃক সভার সমাপ্তি ঘোষণার কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত ছিল না। আমাদের অনুরোধে কর্ণপাত না করায় আওয়ামী লীগ কর্মী ও জনগণের ধৈর্যচ্যুতি দেখা দিল। সভামঞ্চে দাঁড়াইয়া আমাদের একনিষ্ঠ তরুণ কমী মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম “মাইক্রোফোন টেস্টিং” বলা মাত্র মোহাজের সমাবেশের একাংশ ক্ষিপ্ত হইয়া আমাদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে ও সভামঞ্চ তছনছ করিয়া ফেলে। লঙ্কাকান্ড ঘটিয়া যাইবার কিছুক্ষণের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে উপস্থিত হইয়া হতভম্ব হইয়া পড়িলেন বটে, তবে, ক্ষণিকের মধ্যেই স্বীয় কর্তব্য স্থির করিয়া নিজ হাতে একটি লাঠি ও আমার হাতে একটি লাঠি দিয়া রণক্ষেত্রের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে রওয়ানা হইলেন। আমাদের সহকর্মীরা তখনও এদিক-ওদিক অর্থাৎ নিরাপদ দূরত্ব হইতে উঁকি-ঝুঁকি মারিতেছিলেন। সভাস্থলে আমাদের পদার্পণ মাত্র জনতা চতুর্দিক হইতে সভামঞ্চের দিকে ধাবিত হইল এবং নিমিষের মধ্যে নিজেদের উদ্যোগে সভামঞ্চ পুনরায় নির্মাণ করিয়া ফেলিল। মাওলানা রাগিব হাসান আমাদের উভয়েরই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। কারণ, তিনি ছিলেন ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডে হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপভুক্ত অন্যতম নির্বাচিত সদস্য। স্বাধীনতার পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে হিজরত করেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে মূল রাজনীতির ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং করাচিস্থ অবাঙ্গালি শাসকদের ক্রীড়নক পরিণত হন। সেদিন অপরাহ্নে জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রচণ্ডতা ও কার্যকারিতা আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় সম্যক উপলব্ধি করি। পরিতাপের বিষয়, কায়েমী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চক্র সর্বহারা মোহাজের শ্রেণিকে পূর্ব বাংলার গণদাবির বিরুদ্ধে ব্যবহার করিয়া স্থানীয় বাংলা ভাষাভাষী ও উর্দু ভাষাভাষীদের মধ্যে বিদ্যমান স্বাভাবিক হৃদ্যতাপূর্ণ বন্ধন ছিন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। সত্য বলিতে কি, ইহাদের চক্রান্তেই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততার বীজ বপিত হয়। কালের অমোঘ গতিতে উর্দু ভাষাভাষী প্রভুত্বকারী সামরিক বেসামরিক প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সর্বনাশা আত্মঘাতী প্রচেষ্টাই বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি তিক্ততার বীজ হইতে উথিত কচি চারা সযত্নে মহীরুহে পরিণত করে। ভারত থেকে আগত উর্দু ভাষী মোহাজের সম্প্রদায় স্থানীয় বঙ্গ ভাষাভাষী সমাজে অঙ্গীভূত, একাত্ম ও একাকার হইয়া বাংলার মাটিকে মহামানবের মিলন ক্ষেত্রে পরিণত করিতে ব্যর্থ হয়। তাহাদের দৃষ্টিতে সুদূর করাচি, লাহোর, পিন্ডির উর্দু ভাষীরাই প্রতিবেশী বঙ্গ ভাষাভাষীদের চেয়ে বহুগুণে ও সর্বদিক হইতে পরমাত্মীয়। তাহাদের মানসিক জগতে প্রতিবেশী বাঙ্গালিরা বহুজন দূরবর্তী, আত্মীয়, বিদেশী। পরাধীন ভারতে বসবাসকারী Anglo Indian সন্তানগণ কি আমলা কি ব্যবসায়ী সবাই যেমন প্রতিবেশী ভারতবাসী হইতে সুদূর ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ইংরেজদিগকে নিজেদের সুখ-দুঃখের সমভাগী মনে করিত, তেমনি পূর্ববঙ্গে বসবাসকারী উর্দু ভাষী মুহাজিরগন পশ্চিম পাকিস্তানকে তদ্রুপ জ্ঞান করিত। গণবিরোধী শাসক-শোষক শ্রেণির প্ররোচনায় উর্দু ভাষী মুহাজিরদের মধ্যে প্রভুসুলভ ও অনাত্মীয়তার মানসিকতা ক্রমশঃ মারাত্মক ব্যাধির ন্যায় প্রসার লাভ করে। উত্তরকালে ইহার অশুভ পরিণতি যে সর্বনাশা অভিশপ্ত পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল, তাহারই হুতাশন যজ্ঞে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ প্রাণীর আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল, লক্ষ পরিবারকে ভিক্ষার ঝুলি হস্তে পরমুখাপেক্ষী হইতে হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ নারীকে হারাতে হয়েছিল অমূল্য রত্ন সতীত্ব।

সংবিধান রচনা

পূর্ববঙ্গের প্রতিবাদের ঝড় উপেক্ষা করিয়া ভোটাধিক্যের জোরে গণ পরিষদের সংবিধান গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগ, শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত যুক্তফ্রন্টভুক্ত কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (আবদুস সালাম খান পরিচালিত), সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন, পাকিস্তান কংগ্রেস, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি ও গণতন্ত্রী দলভুক্ত সদস্যবৃন্দের সমবেত ভোটে সংবিধান গৃহীত হয়। কিন্তু জনাব সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সদস্যবৃন্দ প্রতিবাদে গণপরিষদ হল থেকে “ওয়াকআউট” ও চূড়ান্তভাবে গৃহীত শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর দানে বিরত থাকে। পরবর্তীকালে জনাব সোহরাওয়ার্দী সংবিধানে স্বাক্ষর দান করেন বটে, তবে আওয়ামী লীগ সদস্যবৃন্দ তাহাদের অনুসৃত পথ গ্রহণ করিতে অস্বীকার করেন। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্নে নেতা ও অনুসারীদের কার্যে এহেন প্রকাশ্যে গরমিল দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল দল গঠনের স্পষ্ট অন্তরায়। এই ধরনের অবস্থা রাজনীতির অসুস্থতারই স্বাক্ষর বহন করে।

প্রজাতন্ত্র দিবস

সংবিধান রচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী সরকার ২৩শে মার্চকে প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা করেন এবং এই ২৩শে মার্চ হইতে শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের সিদ্মান্ত গ্রহণ করেন। ১৭ মার্চ (১৯৫৬) ৫৬, সিম্পসন রোডে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কর্মপরিষদের সভা প্রজাতন্ত্র দিবসে সরকার কর্তৃক আয়োজিত আনন্দোৎসবে যোগদান না করার আহ্বান জানানো হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ উপরোক্ত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রজাতন্ত্র দিবসের আনন্দোৎসবে অংশগ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানায়। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিচলিত হইয়া মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও আমাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য এক জরুরি তারবার্তা পাঠান। জনাব সোহরাওয়ার্দী ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ ও সুদক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। দেশের সংবিধানের কতিপয় ধারার সাথে দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু সংবিধান সংশোধনের বিধানও শাসনতন্ত্রের আছে। সুতরাং সংবিধান প্রবর্তনে বাধা সৃষ্টির অর্থ ব্যক্তি বিশেষের খেয়ালখুশীকে শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা দানের শামিল। তাই বিজ্ঞ সোহরাওয়ার্দীর ভবিষ্যৎ পরিণতি তাঁহার দিব্যচক্ষু অবলোকন করিয়া নিম্নোক্ত জরুরি তারবার্তা প্রেরণ করেন:

Oli Ahad

12/1, K.M. Das Lane, Dhaka

“I am deeply grieved and astounded at resolution not to participate on Republic Day which is Pakistan Day (stop) Resentment against constitution should not be carried to extent of dissociation from Pakistan Day. These two matters quite independent. (Stop) Pakistan Republic Day will be observed throughout world, special delegations from over forty countries arriving here to participate (stop) East Pakistan dissociation will damage Pakistan cause your resolution will seriously damage cause of party. Don’t damage permanent cause for temporary advance (stop). Power is not Pakistan it is temporary agent (Stop) Republic Day is state and National function and not party function, your dissociation is creating grave misunderstanding and being construed as opposition to Republic inspite of words to the contrary as action more important than words, constitution can be ammended (stop) Republic Day is National Day and will be observed every year. Unilateral decision on such important matter most unfortunate. I appeal to you as true patriots to observe Republic Day as Birthday of Republic of Pakistan. (Stop) Earnestly request you to reconsider and issue directives to participate in celebrations where you can stress your resentment against constitution (Stop) Everything at Stake on this issue.

Republic Day celebrations are state functions and not party functions.This a good ground for reversing decision.”

Karachi Sadar Night Post 17.3.56 Oli Ahad,

Awami League, Simpson Rd.

“Suhrawardy”

অলি আহাদ

১২/১, কে, এম, দাস লেন, ঢাকা।

“প্রজাতন্ত্র দিবস যাহা নাকি পাকিস্তান দিবস তাহাতে অংশ গ্রহণ না করার প্রস্তাবে আমি মর্মাহত ও বিস্মিত। সংবিধানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে পাকিস্তান দিবসে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার পর্যায়ে পর্যন্ত টানিয়া দেওয়া সমীচীন নয়। এই দুইটি ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। পাকিস্তান দিবস সারা বিশ্বে পালিত হইবে। চল্লিশটিরও অধিক সংখ্যক দেশ হইতে এই দিবসে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিনিধিবর্গ এখানে আসিতেছে। এই অনুষ্ঠান হইতে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার পাকিস্তানের আদর্শ বিপর্যস্ত করিবে। তোমাদের প্রস্তাব পার্টির লক্ষ্যকেও বিপর্যস্ত করিবে। সাময়িক সুবিধার জন্য স্থায়ী আদর্শকে বিনষ্ট করিও না। ক্ষমতাই পাকিস্তান নয়, ইহা সাময়িক ব্যাপার। প্রজাতন্ত্র দিবস হইতেছে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠান- পার্টির অনুষ্ঠান নয়। এই অনুষ্ঠান হইতে তোমাদের বিরত থাকাটা মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করিতেছে এবং ইহাকে প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা হিসাবে চিহ্নিত করা হইতেছে যদিও প্রকৃত ক্ষেত্রে কথার চাইতে কাজই বড়। সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। প্রজাতন্ত্র দিবস একটি জাতীয় দিবস যা প্রতি বৎসর উদযাপিত হইবে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ দুঃখজনক। প্রজাতন্ত্র দিবসকে এই প্রজাতন্ত্রের জন্মদিবস হিসাবে পালন করার জন্য সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে তোমাদের প্রতি আমার আবেদন রইল। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য এবং এই দিবস উদযাপনে নির্দেশ জারি করার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানাই- উদযাপনকালে সংবিধানের বিরুদ্ধে তোমাদের বিক্ষোভ জোরের সাথে প্রকাশ করিতে পার। এই বিষয়ে সবকিছুই এখন ঝুঁকির মুখে।

প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন হইতেছে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে-দলীয় অনুষ্ঠান নয়। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য ইহা এক উত্তম যুক্তি হইতে পারে।”

করাচি সদর নাইট পোস্ট ১৭-৩-৫৬, অলি আহাদ,

আওয়ামী লীগ, সিম্পসন রোড।

“সোহরাওয়ার্দী”

অম্লান বদনে স্বীকার করিতে হবে, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাত্র ৬ মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণীত ও গৃহীত হইয়াছিল এবং ১০ বৎসরে দেশ সর্বপ্রথম সংবিধান পাইয়াছিল। সংবিধান মোতাবেক গণপরিষদ অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় পরিষদে রূপান্তরিত হয়। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক এক বিবৃতিতে গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে “খাঁটি বাঙালি” সার্টিফিকেট দিয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করেন ও বিনিময়ে তিনি উর্দু ভাষী রাষ্ট্রপ্রধান ইস্কান্দার মীর্জা কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। অথচ ইহা কাহার অজানা যে, শেরে বাংলার মত বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্য গভর্নর পদ ছিল তুচ্ছ।

পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সংকট

পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যাভাবজনিত দুর্ভিক্ষ রোধকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট হইতে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে মওলানা ভাসানী ৭ই মে (১৯৫৬) হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বসন্ত কুমার দাস ৭ই মে (১৯৫৬) নিম্নোক্ত লিপিতে মওলানা ভাসানীর অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান:

বসন্ত কুমার দাস এম,এল,এ, এম,পি

এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট অব পাকিস্তান,

ঢাকা হাইকোর্ট

ঢাকা-৭/৫/৫৬ ইং

আদাব পর নিবেদন এই,

মৌলানা সাহেব, আপনি অনশনব্রত গ্রহণ করিয়াছেন জানিতে পারিয়া খুবই উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছি। আপনি যে মহান উদ্দেশ্য নিয়া এই কঠিন ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন, আমার সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও আমি মনে করি যে, জাতির এই সংকট মুহূর্তে আপনার এই মূল্যবান জীবনকে এইভাবে বিপন্ন করিয়া জাতির ভবিষ্যতকেই বিপন্ন করিতেছেন। সেই জন্য আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি এই অনশন থেকে বিরত হোন। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, আমাকে আগামীকাল সকালে অন্যত্র যাইতে হইতেছে। নতুবা আমি আপনার নিকট উপস্থিত হইয়া আপনাকে এই ঐকান্তিক অনুরোধ জ্ঞাপন করিতাম।

ইতিঃ

নিবেদক

বসন্ত কুমার দাস।                                                                  মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সংকট ক্রমশঃই দুর্ভিক্ষের রূপ ধারণ করিতে থাকে। চতুর্দিকে ভূখা মিছিল। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ১৯ ও ২০শে মে (১৯৫৬) ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমবায়ে ঐক্যবদ্ধ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করার প্রস্তাবের প্রশ্নে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত আমার প্রত্যক্ষ মতভেদ দেখা দেয় এবং শেখ সাহেবের তীব্র বিরোধিতার কারণে সর্বদলীয় খাদ্য আন্দোলন প্রস্তাব কাউন্সিল কর্তৃক বাতিল হয়ে যায়। অবশ্য পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ও বাগদাদ চুক্তি সংস্থা হইতে সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবিতে পেশকৃত আমার প্রস্তাব কাউন্সিল গ্রহণ করে। নেতা শহীদ সোহরাওয়াদী ইহাতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং আমাকে তলব করিয়া আমার নিকট হইতে কৈফিয়ৎ চান। আমি তাহার নিকট সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তজাত সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৯৫৩ সালের ময়মনসিংহ কাউন্সিল অধিবেশন হইতে পূর্বাপর ধারাবাহিক বিরোধী ভূমিকা উল্লেখ করিয়া নতশিরে দাঁড়াইয়া রহিলাম। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বিদগ্ধ ব্যক্তি, আমার গুরুজন। সুতরাং তাহার কটু মন্তব্য হজম করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

সাংবিধানিক বিধান মোতাবেক মার্চ-এপ্রিল-এর স্থলে আর্থিক বৎসর জুন-জুলাই হইতে প্রবর্তিত হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে গভর্নর এর সাটিফিকেটক্রমে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারই বাজেট বরাদ্দ পাস করাইয়া আর্থিক দায়-দায়িত্ব সমাধা করিতেছিলেন। অবশেষে রাষ্ট্রপ্রধান ইস্কান্দার মির্জা ও প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী গভর্নর শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হককে ৩০শে আগস্ট এর মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান নির্দেশ দান করেন। বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাবের ভয়ে ভীত ও শংকিত মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ৩০শে আগস্ট (১৯৫৬) গভর্নর সমীপে তাঁহার ও তাহার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টায় প্রতিরাতেই ভুখা মিছিল চলিতেছিল। জনতা দিন দিন হইয়া উঠিতেছিল মারমুখি। বিস্ফোরন্মুখ এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ৪ঠা আগস্ট জিনজিরা এলাকা হইতে আগত এক বিরাট ভুখা মিছিল নদী অতিক্রম করিয়া ঢাকার চকবাজারে প্রবেশ করিলে, পুলিশ ভুখা জনতার উপর গুলি চালনা করে এবং পুলিশের গুলিতে অকুস্থলে তিনজন নিহত হয়। বাজেট পেশ করিবার জন্য আহূত ১৩ আগস্ট পরিষদের অধিবেশন গভর্নর শেরে বাংলা অত্যন্ত অযৌক্তিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন। শেরে বাংলা তদীয় দল কৃষক শ্রমিক পার্টি নেতা আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দল আওয়ামী লীগের অনাস্থা প্রস্তাবের মুখে অবধারিত পরাজয় হইতে রক্ষা করিবার জন্যই যে এই অন্যায় পদক্ষেপটি গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা না বলিলেও চলে। ইহার দরুনই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৭ আগস্ট ঢাকায় অবস্থানকালে শাসক মহলের উদ্দেশে এই মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছিলেন যে, “History records that it is an axiom that unconstitutional conduct on the part of the rulers breeds unconstitutional reaction on the part of the people, If for the rulers there is dictatorship, for the people there is civil disobedience.” অর্থাৎ “ইতিহাসের সাক্ষ্য, ইহা একটি স্বতঃপ্রতীয়মান সত্য যে, শাসক মহলের অনিয়মতান্ত্রিক আচরণই জনতা কর্তৃক অনিয়মতান্ত্রিক পথে প্রতিহিংসা গ্রহণের কারণ। শাসক মহলের মন্ত্র একনায়কত্ববাদী হলে, তদুত্তরে জনতার মন্ত্র হইবে আইন অমান্য।” সোহরাওয়ার্দীর উচ্চারিত সতর্কবাণীর অব্যবহিত পরপরই ২২শে আগস্ট রাষ্ট্রপ্রধান কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রীকে ৩০শে আগস্ট এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকার নির্দেশ দেন।

৪ঠা সেপ্টেম্বর গভর্নর শেরে বাংলার সরকার ভুখা মিছিলের উপর গুলি বর্ষণ করে এবং পুলিশের গুলিতে চারজনকে প্রাণ দিতে হয়। বিচলিত গভর্নর শেরে বাংলা বাধ্য হইয়া প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানকে সরকার গঠনে আহ্বান করেন। নিহতদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপনের জনা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৫ই সেপ্টেম্বর এক বিরাট জঙ্গী মিছিল সমগ্র ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি বৈঠক গভর্নর কর্তৃক সরকার গঠনের আমন্ত্রণ আলোচিত হয়। সংগঠনের সভাপতি মাওলানা ভাসানীকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণে অনুরোধ জানানো হলে, তিনি সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতা আতাউর রহমান খানকে দায়িত্ব দেন। ৬ই সেপ্টেম্বর জনাব আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রীদল, কৃষক শ্রমিক পার্টি (কফিল উদ্দিন চৌধুরী উপদল) সমবায়ে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি ও (ধীরেন দত্ত গ্রুপ) আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেয়।

ভাসানীর অবদান: শেখ মুজিবের সাধারণ সম্পাদক পদ

মাওলানা ভাসানীর বর্ণনাতীত ও অপরিসীম ত্যাগ এবং কঠোর পরিশ্রমই আওয়ামী লীগকে পুর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখলে সক্ষম করে। অত্যাচারী জালেম মুসলিম লীগ সরকারের আমলে শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক সরকারি চাকুরী এডভোকেট জেনারেল পদ গ্রহণ করেন। জনাব আতাউর রহমান খান স্বীয় ওকালতি পেশায় অধিকাংশ সময়ই মগ্ন ও স্বীয় পরিবার-পরিজনদের তত্ত্বাবধানে ব্যস্ত ছিলেন। অবসর মুহুর্তে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিতেন। ফলে, সরকারি অত্যাচার, নির্যাতন, জেল-জুলুম, আর্থিক কষ্ট ভোগ সব কিছু সহ্য করিতে হইত সর্বত্যাগী মওলানা ভাসানীকে। মজলুম নেতার উপযুক্ত পার্শ্বচর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তরুণ নেতা শামসুল হক ও যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকাবস্থায় জনাব শামসুল হক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ও মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থায় কারামুক্তি লাভ করেন। জনাব শামসুল হক ১৯৫২ সালে কারান্তরালে থাকা বিধায় যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। কারামুক্তির পরও মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়া না আসায় ১৯৫৩ সালে ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতি মাওলানা ভাসানীর অনুরোধক্রমে জনাব শামসুল হকের স্থলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। মানসিক ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ না করায় রাজনৈতিক গগন হইতে জনাব হকের মত একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র খসিয়া পড়ে। ১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সরকারের হীন কারসাজি জনাব শামসুল হককে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য পদ হইতে বঞ্চিত করিয়াছেন। অতঃপর ঘন ঘন কারা নির্যাতন তাহার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করিতে থাকে এবং এভাবেই একদিন মানসিক বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলাইয়া যান। অথচ এই তরুণ নেতা শামসুল হক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর ১৯৪৭ সালে যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করিবার মহান দায়িত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক ইউথ লীগ গঠন করিয়াছিলেন। অতঃপর তিনি বিরোধী দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা মওলানা ভাসানীর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে সর্বোতভাবে সক্রিয় সহযোগিতা দান করেন। ইহা অনস্বীকার্য যে, মজলুম নেতা পূর্বপাক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করিলে বলিষ্ঠ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের অভাবে মুসলিম লীগের চন্ডনীতির আঘাতে সংগঠনের সকল প্রচেষ্টাই বোধহয় দারুণভাবে অপমৃত্যু বরণ করিত। মাওলানা ভাসানী ছিলেন রাজনৈতিক দিগন্তে এক দিক নির্দেশক ধ্রুবতারা’। পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এমন কোন শক্তি বা দল বা ব্যক্তি নাই, যিনি বা যারা কোন না কোন সময় মজলুম নেতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন নাই। সংকটময় প্রতিকূল পরিস্থিতি ও আবহাওয়ায় মজলুম নেতা- মওলানা ভাসানী সকল মত ও পথাবলম্বী রাজনীতিকদের একমাত্র নিরাপদ ও নির্ভরশীল আশ্রয়স্থান ছিলেন বটে, তবে কেহই তাহার নির্দেশিত পথ বা নেতৃত্ব গ্রহণ করেন নাই। স্বীয় মত ও পথের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হইলেই তাঁহারা অত্যন্ত নগ্নভাবে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করিতেন। যদিও খর রৌদ্র তাপে উত্যক্ত পথিকজন সুশীতল ছায়া ভোগ করে, তবুও স্বীয় স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত ছায়াভোগী মানব সন্তানই ছায়া প্রদানকারী বটবৃক্ষ কর্তনে মোটেও ইতস্ততঃ করেন না। জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় গ্রহীতাহাদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হইতে হইয়াছিল।

বন্দি মুক্তির নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত

জনাব আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াই কোন প্রকার টালবাহানা ছাড়াই ২১ দফা ওয়াদা মোতাবেক ‘জননিরাপত্তা আইন’ বাতিল ঘোষণা করেন এবং বিনাবিচারে আটক সকল রাজবন্দির মুক্তির আদেশ দেন। শুধু তাই নয়, ৮ই সেপ্টেম্বর (১৯৫৬) তিনি তাঁহার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ সমভিব্যাহারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ফটকে উপস্থিত হয়ে ৫৯ জন রাজবন্দিকে মুক্তি দান করিয়া তাহাদিগকে মুক্ত আবহাওয়ায় অভ্যর্থনা জানান। ইহা একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত এবং এই ঘটনা বন্দি মুক্তির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে।

কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার

প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াসে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার ইঙ্গিতে সীমান্ত প্রদেশের কংগ্রেস নেতা ডাঃ খান সাহেবের প্রচেষ্টায় রিপাবলিকান পার্টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির অধিকাংশ সদস্যই রিপালিকান পার্টিতে যোগদান করেন। মুসলিম লীগ সদস্যদের অদ্ভুত আচরণে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করিতে নেজামে ইসলাম পার্টিতে যোগদানের কথা ঘোষণা করেন।

চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পদত্যাগ করিলে কেন্দ্রে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রিপাবলিকান কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং ১২ই সেপ্টেম্বর জনাব সোহরাওয়ার্দী ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দীর তুরিত ব্যবস্থার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সরবরাহ ত্বরান্বিত হয়। ইহার ফলেই পুর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সংকট তথা দুর্ভিক্ষ অবস্থা কৃতিত্বের সহিত মোকাবেলা করা সম্ভব হয়। আবু হোসেন সরকার দলীয় সদস্যবর্গ ক্ষমতার উচ্ছিষ্টে গাড়ি, বাড়ি, পারমিট, লাইসেন্স, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি খাস জমিজমা ইত্যাদি কাজ করার মত জঘন্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল বিধায় দুর্ভিক্ষাবস্থা মোকাবেলার দায়িত্ব বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছিল। অতীব পরিতাপের বিষয় এই যে, মন্ত্রী মেম্বার হইবার পর পরই ঢাকার অভিজাত এলাকায় তাঁহাদের বাড়ি ঘর হয়। স্বোপার্জিত আর্থিক সঙ্গতি থাকিলে মন্ত্রী-মেম্বার হবার পূর্বে এই পর্বটি সমাধা হইতে বাধা কোথায়?

মুসলিম লীগ আমলে আমলারা যেইভাবে অবাধ লুটপাট চালিয়েছে, তেমনি ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গগনবিদারী আওয়াজ উত্তোলনকারী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার আমলে আমলারা পূর্ণোদ্যমে ও দ্বিগুণ উৎসাহে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে। কালের গতির সহিত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির এই অভিশাপই জনতার দুঃখভার দ্বিগুণ হারে বর্ধিত করে। ২১ দফার ওয়াদা মন্ত্রী-মেম্বারদের কৃতকর্মে কাগজী-ওয়াদায় পর্যবসিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ধারা অনুযায়ী মন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর সর্বজনাব আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ ও খয়রাত হোসেন সংগঠনের সহ-সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করলেন, মন্ত্রী পদ গ্রহণ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অথচ কতিপয় সাংগঠনিক প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেওয়ায় তিনি ১৯৫৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদে ইস্তফা দিয়া নিম্নলিখিত পত্র দাখিল করেন:

Phone 3221/134

The East Pakistan Awami League

(Central office)

56, Simpson Rd, Sadarghat

Dacca 5-9-1956

To

The President,

East Pakistan Awami League

Sir,

With due respect I want to inform you that I cannot continue as general Secretary of your organization for my ill health.

I hope that you will treat this letter as my resignation and to accept it as soon as possible otherwise the organization will suffer.

yours sincerely

Sheikh Mujibur Rahman

General Secretary

E.P.A.L.

ফোন ৩২২১/১৩৪

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ

কেন্দ্রীয় অফিস

৫৬, সিম্পসন রোড, সদরঘাট,

ঢাকা ৫-৯-১৯৫৬

বরাবর

সভাপতি

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ

জনাব,

যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আপনাকে জানাইতেছি, অসুস্থতার কারণে আমার পক্ষে আপনার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়। আশাকরি, এই পত্রখানিকে আপনি আমার পদত্যাগপত্র হিসেবে বিবেচনা করিয়া যতশীঘ্র সম্ভব গ্রহণ করিবেন, অন্যথায় সংগঠনের ক্ষতি হইবে।

আপনার বিশ্বস্ত

স্বা: শেখ মুজিবুর রহমান

সাধারণ সম্পাদক

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।

যেহেতু অন্যায়ের মানসিকতা লইয়াই মন্ত্রীত্বের গদিতে আসীন হয়েছেন সেহেতু শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কর্মীদিগকে অন্যায় প্রশ্রয় দিতে সামান্যতম বিবেকের দংশনবোধ করিতেন না। নেতা কর্তৃক অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ ও প্রশ্রয়দানের সচ্চরিত্র আদর্শবাদী একনিষ্ঠ কর্মীকুল কালের বিবর্তনে হতাশা ও নিরাশার শিকারে পরিণত হন। শুধু তাই নয়-পরিশেষে তাহারা ঘুণেধরা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংস্কার ও ব্যবস্থা প্রবর্তনের দৃঢ় সংকল্প পরিহার করিতে বাধ্য হন। এইভাবেই নৈতিক, চারিত্রিক ও মানসিক শক্তি হারাইয়া সরল প্রাণ কর্মীদের সামগ্রিক অবস্থার বিপাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া পড়তে হয় এবং অনেক কর্মী লোভ-লালসার বশবর্তী হইয়া সরকারি আনুকূল্যে সহজ পথে অর্থোপার্জনে আত্মনিয়োগ করেন। দুর্নীতির বিষফনার ছোবলে সমগ্র সমাজদেহে বিষে জর্জরিত হয়ে উঠে। অথচ দুর্নীতি দমনে মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই হুঙ্কার ছাড়লেন যে, তিন পয়সার পোস্টকার্ডে লিখিয়া জানালে তিনি দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। হুঙ্কারের তুবড়িতে দুর্নীতি কতটুকু মূলোৎপাটন হয়েছে, দেশবাসী উত্তমভাবে তাহা অবগত আছেন। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ৩২ নং রোডে নির্মিত তাহার তেতলা বাড়িটি দুর্নীতি দমন প্রচেষ্টার এক দুর্বোধ্য ও বিচিত্র নজীর।

চীনের সহিত সম্পর্ক

জনাব সোহরাওয়ার্দী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরপরই বিশ্বের অন্যতম মহাশক্তি মহাচীনের সহিত সম্পর্কোন্নয়ন মানসে ২২শে অক্টোবর (১৯৫৬) সরকারি সফরে মহাচীন গমন করেন। ফলে সৌহার্দপূর্ণ পাক-চীন সম্পর্ক গড়িয়া উঠে। মহাচীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী আমন্ত্রণে পাকিস্তান সফর করেন। পাকিস্তান সফরকালে চৌ-এন-লাই পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। আমরা পাক চীন মৈত্রী সমিতির তরফ হইতে ২৯শে ডিসেম্বর (১৯৫৬) ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলে মহা চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই-এর সংবর্ধনা দান উপলক্ষে এক মনোজ্ঞ বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করি। সেই সুযোগে এই অনুষ্ঠানে প্রমাণমন্ত্রী চৌ-এন-লাই-এর সহিত আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়। অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা, আমন্ত্রণ ইত্যাদির মোটামুটি দায়িত্ব পাক-চীন মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী আমার উপর ন্যস্ত করিয়াছিলেন। সুতরাং সকল প্রকার অপ্রিয় কাজকর্মগুলো আমাকে সমাধান করিতে হইয়াছিল। গুলিস্তান হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এর জন্য পূর্ব হইতে আসন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব হায়দার তাহার প্রভুসুলভ মানসিকতা নিয়ে বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিদের নির্ধারিত আসনে বসিয়া পড়েন। তাঁহাকে বারকয়েক বিনীত অনুরোধ জানাই; কিন্তু দাম্ভিকতার দরুন তিনি আসন ত্যাগ করিতে সম্মত হন না। তখন বাধ্য হইয়াই বেশ কড়া মেজাজে তাঁহাকে আসন ত্যাগ করিতে আদেশ দেই। এইবার ভিজা বিড়ালের ন্যায় তাহাকে সেই আদেশ পালন করিতে হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পাক-চীন মৈত্রী সংস্থা (Pak-China Friendship Society) ১৯৫৬ সালের ২রা নভেম্বর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হলে এক সভার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান ও সম্পাদক ছিলেন জনাব জহুর হোসেন চৌধুরী। সংস্থার প্রথম সভা বাংলা একাডেমি (বর্ধমান হাউস) ১৯৫৬ সালের ১৩ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।

সুয়েজ খাল জাতীয়করণ

২৬শে জুলাই (১৯৫৬) মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অর্থনীতির প্রয়োজনে নীল নদের ওপর আসোয়ান বাঁধ নির্মাণের ব্যয় নির্বাহের কারণেই তাহাকে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করিতে হইয়াছিল। পূর্বাহ্নে স্বীকৃত হইয়াও পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক আসোয়ান হাই ড্যাম নির্মাণকল্পে পুঁজি বিনিয়োগে অস্বীকৃতি জানালে বাধ্য হইয়া প্রেসিডেন্ট নাসের উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, একশত তিন মাইল দীর্ঘ সুয়েজ খালটি ফরাসি নাগরিক ফার্ডিন্যান্ড দ্যা লেসেপস ১৮৫৯ সালের ১লা এপ্রিল খনন শুরু করেন ও ১৮৬৯ সালের ১৭ই নভেম্বর উক্ত খালে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। ১৮৭৫ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজরেইলি মিশরের শাসনকর্তা খেদিব ইসমাইল হইতে চল্লিশ লক্ষ স্টারলিং পাউন্ড মূল্য সুয়েজ খালের শেয়ার ক্রয় করিয়া ইঙ্গ-ফরাসী যৌথ মালিকানার সূত্রপাত করেন। তাই ব্রিটিশ ও ফরাসি সরকার ইসরায়েলের সহায়তায় আন্তর্জাতিক নদীপথ সুয়েজ খাল এর আয়ের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব রক্ষার বদমতলবে সুয়েজ খাল কোম্পানী জাতীয়করণের তিন মাসের মধ্যে মিসরের উপর সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে। ইসরাইল ২৯শে অক্টোবর (১৯৫৬) সিনাই উপদ্বীপ দখল করে; বৃটেন ও ফ্রান্স ৩১শে অক্টোবর (১৯৫৬) মিসরের রাজধানী কায়রোতে বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণ করে। মিশরের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী হামলার প্রতিবাদে ঢাকা শহর বিক্ষোভ মিছিলের শহরে পরিণত হয়। এমনকি ৩রা নভেম্বর (১৯৫৬) এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত জনতা পুরানো পল্টনস্থ বৃটিশ ইনফরমেশন সার্ভিস ভবনটি অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করিয়া দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্দার অন্তরাল হইতে ইংগ-ফরাসী শক্তিদায়ক সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে তাহাদের কঠোর মনোভাব জানিয়ে দেয় এবং সোভিয়েট রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ প্রকাশ্য চরমপত্রে ঘোষণা করেন যে, সশস্ত্র আক্রমণ বন্ধ না করিলে রাশিয়া পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইবে। বিশ্বজনমত ও এই দুই মহাশক্তিদ্বয়ের কঠোর মনোভাবের নিকট ইংগ-ফরাসি সরকারদ্বয় নতি স্বীকার করিয়া ১২ নভেম্বর (১৯৫৬) সশস্ত্র হামলা প্রত্যাহার করিতে বাধা হয়। সংকটময় এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী এক অস্পষ্ট, অপরিচ্ছন্ন ও দ্ব্যর্থবোধক ভূমিকা গ্রহণ করেন। এমনকি সুয়েজ সমস্যার উপর ১২ নভেম্বর দিল্লীতে আহূত কলম্বাস শক্তিসমূহের (Colombo Powers) সম্মেলনে আমন্ত্রণ গ্রহণ করা সত্ত্বেও ইরানের রাজধানী তেহরানে আহূত বাগদাদ প্যাক্ট কাউন্সিল সভায় যোগদানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাসহ তিনি তেহরান গমন করেন। ফলে জাতিসংঘ কর্তৃক সুয়েজ খাল এলাকায় প্রেরিতব্য আন্তর্জাতিক পুলিশ ফোর্সে পাকিস্তান সৈন্য পাঠাতে চাইলে মিশর পাকিস্তানী সৈন্য গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী কায়রো সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করলে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত নীতি বস্তুতঃ আরব জাহানে পাকিস্তানকে বিরাগভাজন রাষ্ট্রে পরিণত করে। এদিকে দিল্লীতে আহূত কলম্বাস পাওয়ার সম্মেলনে যোগদান না করায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তান একঘরে হইয়া পড়ে। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর বিস্ময়কর এই ভূমিকা অগ্রাহ্য করিয়াই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান প্রকাশ্য বিবৃতির দ্বারা মিসরের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। মওলানা ভাসানী ৯ই নভেম্বরকে ‘মিসর দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন ও আওয়ামী লীগ সরকার ‘মিসর দিবস’কে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা জারি করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করা সত্ত্বেও অবস্থার চাপে উল্লিখিত কর্মসূচীর বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকেন।

আওয়ামী লীগ ভাঙ্গনের সূচনা

বৈদেশিক নীতিকে কেন্দ্র করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ক্রমশ দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ে। গদিতে আসীন হইবার পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা বিস্মৃত হইয়া মন্ত্রীবর্গ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করিতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রচার সম্পাদক যথাক্রমে মওলানা ভাসানী, আমি ও অধ্যাপক আবদুল হাই ১৯৫৩ সাল হইতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত ‘সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরোধী’ পররাষ্ট্র নীতির প্রতি অবিচল ও অটলভাবে অনুগত রহিলাম। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শ্রম সম্পাদক ও পরিষদ সদস্য আবদুস সামাদ তাঁহার স্বভাবসুলভ দোদুল্যচিত্ততার কারণে কখনও মন্ত্রীদের কাতারে, কখনও সংগঠনের কাতারে ছিলেন।

উপ নির্বাচন

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের শূন্য ৩৫টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান না করিয়া গণতন্ত্রের অঙ্কুরোদগমনকালেই কুঠারাঘাত হানিয়া সর্বনাশের সূচনা করিয়া যান। তাই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি ২১ দফা ওয়াদা অন্তর্ভুক্ত করে। তদানুযায়ী ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াই আওয়ামী লীগ উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। উপনির্বাচন প্রাক্কালে খাদ্য সংকট নিরসনে ব্যর্থ হইয়া যুক্তফ্রন্ট মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার পদত্যাগ করে, তদস্থলে আতাউর রহমান খান দুর্ভিক্ষাবস্থায় ক্ষমতা গ্রহণ করেন ও প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সহায়তায় অত্যন্ত দক্ষতার সহিত খাদ্য সংকট মোকাবেলা করেন। আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার কর্তৃক সফল খাদ্য সংকট সমাধানই ১০ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপুল ভোটাধিক্যে জয়ের অন্যতম কারণ। সংগঠন সভাপতি মাওলানা ভাসানী ৭টি উপনির্বাচন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়নের জন্য জনমত যাচাই করিবার নিমিত্ত শেখ মুজিবুর রহমান, ইয়ার মোহাম্মদ খান ও আমাকে লইয়া তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করিয়া দিয়াছিলেন। উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করার প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং এভাবে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদল হিসাবে তাহাদের দেয়া ২১ দফা ওয়াদা ২১ তম ওয়াদাকে রক্ষা করে।

যুব উৎসব

১৯৫৭ সালের ৪ঠা হইতে ৭ই জানুয়ারি রংপুর শহরে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ যুব উৎসব উদযাপন করে। উক্ত যুব উৎসবে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রীসভার সদস্যত্রয় সর্বজনাব খয়রাত হোসেন, মশিউর রহমান ও মাহমুদ আলী অংশগ্রহণ করিয়া যুব সমাজের অনন্য প্রচেষ্টাকে উৎসাহদান করেন। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমিও যুব উৎসবে যোগ দেই। বিভিন্ন এলাকা হইতে আগত অসংখ্য যুব প্রতিনিধির সমাবেশ ও প্রাণচাঞ্চল্য আমাকে অভিভূত ও আত্মহারা করে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না যে, ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ আমাকে কারান্তরালে থাকা অবস্থায় ‘ইউথ স্টার’ সম্মানে ভূষিত করিয়াছিল। এই ধরনের উৎসব যুবকদের মন ও মানসিকতার উন্নতি ঘটায়, নির্মল করে ও তাহাদের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করে। এতদ্বারা তাহারা নীতি ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, স্বীয় কর্মক্ষমতার প্রতি প্রত্যয় ও পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ শিক্ষা লাভ করে।

পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ১৯৫১ সালের ২৭শে ও ২৮শে মার্চ ঢাকায় দুই দিনব্যাপী অধিবেশনের মাধ্যমে গঠিত হয়। জন্মলগ্ন হইতেই পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নিভীক সচ্চরিত্র, আত্মত্যাগী, আদর্শ নিষ্ঠা ও সংগ্রামী যুব সংগঠনের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। দলমত নির্বিশেষে যুব সমাজ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের গণতান্ত্রিক মঞ্চে ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ হইতে থাকে। এই ভাবে আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ, মুসলিম লীগ, ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির নির্দলীয় যুব কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের পতাকা তলে সমবেত হয়। উপরোল্লিখিত সংগঠনগুলির যুবকর্মী শ্রেণি স্ব স্ব সংগঠনের নেতৃত্বের সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী ও কোন কোন স্থলে কায়েমী স্বার্থ প্রভাবান্বিত কার্যক্রমকে স্ব স্ব ধ্যান-ধারণা পরিপন্থী জ্ঞান করিত এবং প্রায়শঃ স্বীয় বিবেক ও নীতিজ্ঞানকে দলীয় শৃঙ্খলার যুপকাষ্ঠে বলি দিয়া দেশ ও জাতির চরম ক্ষতির কারণ হইতো। উপরোক্ত কারণে যুবকর্মী শ্রেণি মর্মপীড়া ও বিবেকের দংশনে হতোদ্যম হইয়া পড়িতে ও প্রখর গণতান্ত্রিক চেতনা হারাইয়া ফেলিতেছিল। এহেন সংকটময় মুহূর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’ এক নব আশার সঞ্চার করে। ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস ও আওয়ামী লীগ প্রভাবান্বিত গণসংগঠনের নেতারা আপোষকামিতা ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন, তদাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ২১শে ফেব্রুয়ারি ও তদপরবর্তী দিনগুলিতে নির্ভীক, সংগ্রামী ও সচেতন নেতৃত্ব না দিলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করিত না বরং করাচি শাসক চক্রের জয় সূচিত হইত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কারণেই বাঙালি মন ও মানসিকতার স্বকীয় সত্ত্বাবোধ পুরাপুরি জাগ্রত হয়। বলাই বাহুল্য যে, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে জাগ্রত এই সত্ত্বাবোধই হইল বাংলাদেশের সৃষ্টির সূচনা এবং নব জাতীয়তার মৌলিক ভিত্তি।

পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগকে আপামর জনসাধারণের যুব সংগঠনে পরিণত করার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কারারুদ্ধ হওয়ায় অতীব দুঃখের সহিত স্বীকার করিতে হয় যে, আমার সেই স্বপ্ন সফল হয় নাই। তাহাছাড়া তদানীন্তন আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক যুবলীগের উপরে তাহাদের নেতৃত্ব, কর্মসূচী ও সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দিবার অযৌক্তিক প্রবণতা ও প্রচেষ্টা সাধারণ যুবশ্রেণির মধ্যে ভীতি ও সন্দেহের উদ্রেক করিয়াছিল। ফলে, ক্রমশ আপামর যুব সাধারণের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনের পরিণত হবার সুযোগ ও শক্তি যুবলীগ হারাইয়া ফেলে। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে যুবলীগ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের হাতিয়ারে পরিণত হয় ও আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশাবলী পালনের মুখপাত্র সংগঠনে পর্যবসিত হয়। তাই কারামুক্তির পর আমি কার্যতঃ যুবলীগের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করি। কেননা, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ইহার জন্মলগ্ন হইতেই আমি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক যুব সমাজকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টায় ব্রত হয়েছিলাম বটে কিন্তু এতদ প্রয়াসে কোন আন্তর্জাতিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করিবার আমি ঘোর বিরোধী ছিলাম।

কাগমারী সম্মেলন

সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কাগমারীতে ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৫৭) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও পুর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন ছিল বিধায় উল্লেখিত অধিবেশনটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তদুপরি এই সময়ে বৈদেশিক নীতি বিশেষ করিয়া পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদন ও সামরিক চুক্তি সম্পাদনসমূহ যথা ‘দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া সামরিক চুক্তি সংস্থা’ ও ‘বাগদাদ চুক্তি সংস্থা’র সদস্যভুক্তির প্রশ্নে মাওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর মতদ্বৈততা চরম আকার ধারণ করিয়াছে বিধায় এই অধিবেশনের বিশেষ গুরুত্ব দেখা দিয়াছিল। ইতিপূর্বে ৯ই ডিসেম্বর (১৯৫৬) সলিমুল্লাহ মুসলিম হল মিলনায়তনে এক ছাত্র সভায় প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সামরিক চুক্তির স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন। ইহা ছিল আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরোধী ভূমিকার পরিপন্থী। সোহরাওয়ার্দীর বাগদাদ চুক্তি সমর্থনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী তীব্র প্রতিবাদ জানাইলে জনাব সোহরাওয়ার্দী তাহাকে (ইসলামী) পদত্যাগের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এক সভা আহ্বান করা হয় এবং জনাব সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশের পাল্টা জওয়াবে বাগদাদ চুক্তি সংস্থা থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করার জন্য উক্ত সভা পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। ১৩ই নভেম্বর (১৯৫৬) অনুষ্ঠিত সভায় পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি বাগদাদ চুক্তিভুক্ত শক্তিবর্গের তেহরান সম্মেলনের সিদ্ধান্ত কঠোর সমালোচনা করে এবং ১৯শে জানুয়ারি (১৯৫৭) করাচি আওয়ামী লীগ সম্পাদক বি,এম,কুটী পদত্যাগ করেন। এই সমস্ত ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে সংগঠন আওয়ামী লীগ কতখানি সোচ্চার ছিল। অবশ্য অকুণ্ঠ চিত্তে ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, জনাব সোহরাওয়ার্দীর অনবদ্য কূটনীতির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সমর্থনে ২৪শে জানুয়ারি (১৯৫৭) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের আহ্বান জানায়। এই কূটনৈতিক সাফল্যের দরুনই জনাব সোহরাওয়ার্দী দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন পাইতেছিলেন।

নানাবিধ কারণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মী, সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আস্থা হারাইয়া ফেলিতেছইল। প্রথম প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত মার্কিন ঘেষা পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক জোটের লেজুড়বৃত্তি ছিল সংগঠনের সাধারণ কর্মীবৃন্দের মর্মপীড়ার কারণ। দ্বিতীয়ৎঃ ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত সংবিধানের ২১ দফা বর্ণিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ধারা সংযোজিত না হওয়া। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা সচেতন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও ছাত্র-যুব সমাজ খুবই আগ্রহের সহিত লক্ষ্য করিতেছিল। তৃতীয়তঃ ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত গঠনতন্ত্রের ৬৬ ধারা মোতাবেক শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী পদ গ্রহণ করায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদ ত্যাগ করা তাহার জন্য অবশ্য পালনীয় ছিল। উক্ত ধারায় সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল যে, অন্যথায় এক মাস পরে উক্ত কর্মকর্তার পদ শূন্য বলিয়া অবশ্য গণ্য হইবে। উপরে বর্ণিত তিনটি বিষয় প্রধানতঃ সংগঠনের নিষ্ঠাবান কর্মীদিগকে বিচলিত করিয়া তুলিয়াছিল। তদুপরি ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে গদিতে আসীন হওয়ার পর হইতেই ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগের দুর্দমনীয় লালসায় মন্ত্রীবর্গ স্বল্প সময়ের মধ্যে সংগঠনের গঠনতন্ত্র, সিদ্ধান্ত, নীতি ও আদর্শকে বিসর্জন দিয়া আওয়ামী লীগকে স্বেচ্ছাচারী মন্ত্রীচক্রের লেজুড়ে পরিণত করিবার যে কুটিল পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাতে কর্মী সমাজ উদ্বিগ্ন না হইয়া পারে নাই। সুতরাং কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের ইহাই বিবেচ্য বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল যে, কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রীসভার নির্দেশে আওয়ামী লীগ সংগঠন পরিচালিত হইবে কি না অর্থাৎ সংগঠন ক্রমশ মন্ত্রী আওয়ামী লীগে পরিণত হবে, না আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র সিদ্ধান্ত, নীতি ও আদর্শের প্রতি অটল আনুগত্য প্রদর্শন করিয়া মন্ত্রীসভা আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভায় পরিণত হইবে।

শেখ মুজিবের আক্রোশ

এহেন পরিস্থিতিতে ৬ই ফেব্রুয়ারি (১৯৫৭) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সন্তোষ মহারাজের নাটমন্দিরে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে। মওলানা ভাসানীর বিশেষ আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ওয়ার্কিং কমিটির এই সভায় যোগদান করেন। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ও বাগদাদ চুক্তি সংস্থার সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবিতে ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিল অধিবেশনে প্রস্তাব গ্রহণ করা হইবে কি হইবে না- এই প্রশ্ন ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৩৫-১ ভোটে কোন প্রকার প্রস্তাব আনয়ন না করিবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কেবলমাত্র আমি সামরিক চুক্তি বাতিল, সামরিক চুক্তি সংস্থা সমূহের সদস্যপদ প্রত্যাহার ও প্রয়োজনবোধে সংগঠনের সিদ্ধান্তের স্বার্থে মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণের দৃঢ় মত প্রকাশ করি এবং ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমি একা ভোট দান করি। সংবাদটি মার্কিন ঘেঁষা দৈনিক ইত্তেফাক ৮ই ফেব্রুয়ারি (১৯৫৭) সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠার ফলাও করিয়া ছাপানো হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে লক্ষ্য করিয়া “পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ ও বৈদেশিক নীতি” নামে একটি ক্ষুদ্রাকার পুস্তিকা প্রকাশ করি। তন্মধ্যে ১৯৫৩ সালের ১৪ ও ১৫ই নভেম্বর ময়মনসিংহে, ১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩শে অক্টোবর ঢাকায় ও ১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০শে মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সামরিক চুক্তি বিরোধী প্রস্তাবাবলী সন্নিবেশিত করে। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক সংগঠনের গৃহীত সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত ও সজাগ হবার আহ্বান জানাই। অতীব পরিতাপের বিষয়, সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বৈঠক মওলানা ভাসানী পররাষ্ট্র বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে কোন প্রস্তাব আনয়নে বিরত থাকার শর্তে সমঝোতা করেন। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে মওলানা ভাসানীর দ্ব্যর্থবোধক ভূমিকাই ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সাধারণ কর্মী ও সমর্থকবৃন্দের নিকট উচ্চস্থানীয় নেতৃবৃন্দের লীলাখেলা অনুধাবন কষ্টকর। ফলশ্রুতিতে বহু ক্ষেত্রে তাহাদের রাজনৈতিক জীবনের ঘটে অপমৃত্যু আর দেশবাসীর হয় হাড়ির হাল। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ইহা দিবালোকের মত প্রতিভাত ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তিগুলো চীন-রাশিয়া প্রভৃতি কমিউনিস্ট দেশগুলোর বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হেফাজতের স্বার্থে নয়। কিন্তু ক্ষমতার নেশায় আত্মহারা মন্ত্রী-মেম্বারগণ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী ত্বকে যে কোন মূল্যে রক্ষার জন্য যেন বদ্ধপরিকর ছিলেন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত প্রশ্ন ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ সম্পাদক পদ ত্যাগে অনীহা সমগ্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সক্রিয় করিয়া তোলে। জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল ও আদর্শনিষ্ঠ কর্মীর বিপুলাংশ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সদস্য। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খুঁটার ভূমিকায় অবতীর্ণ শেখ মুজিবুর রহমানের ক্রোধ স্বাভাবিকভাবেই তাহাদের উপরে নিপতিত হয়। তাই তিনি প্রস্তাব আনয়ন করিলেন যে, কোন সদস্য আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের যুগপৎ সদস্য থাকিতে পারিবে না। মওলানা ভাসানী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করিয়া তেজস্বিনী ভাষায় কয়েক ঘন্টা বক্তৃতা করিলেন বটে, তবে প্রস্তাব গ্রহণ হইতে প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রী-সমর্থকদের বিরত করিতে পারেন নাই।

ভাসানীর আসসালামু আলাইকুম

৬ই ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির সভায় মাওলানা সাহেব জনাব সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্ব রক্ষার প্রয়োজনে সংগঠন প্রতিষ্ঠিত পররাষ্ট্রনীতি বলি দেয়া সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি নীতি গ্রহণ করিয়াছিলেন বটে, তবে পরদিন ৭ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সিয়াটো চুক্তি সংস্থা (SEATO) ও বাগদাদ চুক্তিসংস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কয়েক ঘন্টা জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। কিন্তু ফল কিছুই হয় নাই। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে ও সামরিক-বেসামরিক চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সংখ্যাসাম্য নীতি পালিত না হলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে। স্মর্তব্য যে, ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন রোজ শুক্রবার অপরাহ্নে ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভায় সভাপতির ভাষণদানকালে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়া ঘোষণা করেন যে, শোষণ-শাসনের মনোবৃত্তি ত্যাগ না করলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতে বাধ্য হবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাবে। উক্ত মন্তব্য সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচিতে এক বিরূপ আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল।

আদান-প্রদানের রাজনীতি

‘বিজয় নির্বাচনী কমিটি’ সভায় সভাপতির আসন থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ জানিতে চাহেন যে, ‘কাউন্সিল অধিবেশনে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আমার প্রস্তাব আমি উত্থপন করিতে চাহি কি না? তদুত্তরে আমি বলি যে, “ওয়ার্কিং কমিটি ও বিষয় কমিটিতে আমার প্রস্তাবাবলীর পক্ষে দ্বিতীয় কোন সদস্যের সমর্থন অর্জন করিতে ব্যর্থ হইয়াছি, অতএব নিছক শক্তি পরীক্ষার জেদের বশবর্তী হয়ে কাউন্সিল অধিবেশনে আমি আমার প্রস্তাবাবলী উত্থাপন করিব না। আমার এই বক্তব্যের কারণ এই ছিল যে, আমি জানতাম, মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর অব্যবস্থিত চিত্ত দ্ব্যর্থবোধক ভূমিকা ও পলায়নী মনোবৃত্তির কারণে এবং মন্ত্রীবর্গের ঐক্যবদ্ধ জোটের বিরুদ্ধে কাউন্সিল সভায় উপস্থিত সদস্যবৃন্দকে প্রস্তাবের পক্ষে প্রভাবান্বিত করার ব্যাপারে আমার একক প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইতে বাধ্য। অকপট মনে সাধারণ্যে স্বীকার করিতে হবে যে, আত্মগোপন অবস্থায় কমিউনিস্ট নেতৃবর্গ কমরেড মনি সিংহ, কমরেড খোকা রায় ও কমরেড সালাম জাতির সংকটময় মুহূর্তে নীতি-নির্ধারণে ও নীতি-নিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সংগঠনে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে প্রকৃত সহায়তা করিয়াছে।

যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত নেপথ্যে দেন-দরবার ও আদান-প্রদান রাজনীতি জয়লাভ করে এবং ভাসানী-মুজিব সমঝোতা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীর সংগঠন প্রশ্নে অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদক পদে মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বহাল রাখিবার মত গঠনতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপ সংগঠনের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অংশকে দারুণভাবে হতাশ করে। আর এভাবেই মার্কিন কূটনীতির নিকট আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পদক্ষেপ সংগঠনের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী অংশকে নিদারুণভাবে হতাশ করে এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক পরাজয় বরণ করে। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী রণপাঁয়তারার বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালে মহাচীনে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনের সক্রিয় অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও এবং ১৯৫৩-৫৬ ইং সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোট বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ সত্ত্বেও কোন ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ যে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হইতে পারেন তাহার জ্বলন্ত উদাহরণ মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। এই বিষয়ে মন্ত্রী শেখ মুজিবকে সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ চীনের চিয়াং কাইশেক, দক্ষিণ কোরিয়ার সিং ম্যানরী, থাইল্যান্ডের সরিৎ থানারত ও ইরাকের নূরী আসসাঈদের মন্ত্র শিষ্য বলিলেও ভুল বলা হইবে না। ক্ষমতার রাজনীতির সীমাবদ্ধতা এইখানেই। এইখানেই নীতি, আদর্শ, দর্শন সবকিছুই অপাংক্তেয় বা অবান্তর।

ভাসানীর হাঁ-না

৮ই ফেব্রুয়ারি সমাপ্ত কাউন্সিল অধিবেশনান্তে আমি টাঙ্গাইল বড় বোনের বাড়িতে চলিয়া যাই। সন্ধ্যার একটু পূর্বে আমি সন্তোষ (কাগমারী) আসি। দেখামাত্র শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে লোকের ভিড় হইতে এক পাশে ফুলবাগানের মধ্যে নির্জনস্থানে লইয়া একান্তে প্রশ্ন করেন, “অলি আহাদ, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কোন প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে কি?” আমি তদুত্তরে গম্ভীরভাবে বলি, “না”। কথা প্রসঙ্গে অত্যন্ত বিচলিত ও উদ্বিগ্ন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের জবানীতে অবগত হই যে, সংগঠনের সভাপতি মওলানা ভাসানী সাংবাদিকদের নিকট এক বিবৃতিতে ঘোষণা করিয়াছেন যে, কাউন্সিল অধিবেশন ১৯৫৬-এর ‘মে অধিবেশনে গৃহীত বৈদেশিক নীতিকে পুনরায় প্রস্তাবকে সমর্থন দিয়েছে এবং মন্ত্রী হউক বা পার্লামেন্ট সদস্যই হউক বা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হউক কেহ প্রস্তাবের খেলাফ কাজ করিলে তাহার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার ক্ষমতা কাউন্সিল তাহাকে দিয়াছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, মাওলানা ভাসানী উপরোক্ত মর্মে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছেন বটে, তবে তিনি বা অন্য কেহ আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রস্তাব কাউন্সিল অধিবেশনে উত্থাপন করেন নাই। আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতভাবে তাহার এই অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ আমাকে বিস্মিত, বিমূঢ় ও হতবাক করিয়াছিল। বোধহয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে স্বীয় ভূমিকার গ্লানি মওলানা ভাসানীকে দংশন করিতেছে এবং উহা তাহার প্রায়শ্চিত্তেরই ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। অথচ মুহূর্তের জন্যও তাহার চেতনায় উদিত হয় নাই যে, সংবাদপত্র পাঠক হয়ত তাহার বক্তব্যকে বিশ্বাস না করিলেও সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করবে না। কিন্তু কাউন্সিল অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী ৮৯৬ জন সদস্যের পক্ষে তাঁহার দেয়া এই খবর বা বিবৃতিকে সত্য মনে করিবার বাস্তব কোন হেতু নাই। ফলে, তাঁহার বিশাল ব্যক্তিত্বের মর্যাদা কি সদস্যদের নিকট ক্ষুন্ন হইবে না? সজ্ঞানে তিনি ইহা করিয়া থাকিলে দায়িত্ব তাঁহার, তবে অন্যের প্ররোচনায় করিয়া থাকিলে পরামর্শদানকারীগণ সংগঠনের অথবা দেশের যে কল্যাণকামী নহে, তাহা দিবালোকের মত স্পষ্ট।

শেখ মুজিবুর রহমানের রিপোর্ট শ্রবণে আমার ইন্দ্রিয়ানুভূতি যেন লোপ পাইতেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহল মওলানা ভাসানীর প্রায়শ্চিত্তানুভূতির সুযোগ গ্রহণ করিয়া সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই বৃদ্ধ নেতাকে এইভাবে অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়তো প্ররোচিত করিয়াছে। কে না জানেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ও কেন্দ্রীয় সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও শক্তিতে ভীত সন্ত্রস্ত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা তাহার একান্ত বশংবদ শিল্পপতি সদরি ইস্পাহানী চক্র মারফত সোহরাওয়ার্দীর গণভিত্তির মূল ঘাঁটি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দ্বিধাবিভক্ত ও শহীদ-ভাসানীর নীতিগত মত-পার্থক্যের সুযোগে তাহাকে তাহার রাজনৈতিক দোসর মাওলানা ভাসানী থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টায় রত রহিয়াছে। যাহা হউক, মজলুম নেতার নাটকীয় আচরণের আলোচনা শেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাব বলে আমাকে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সহিত আপোষ আলোচনার উদ্দেশ্যে তাহার সহিত করাচি যাইতে অনুরোধ জানান। আমি তাহাদের প্রস্তাবের উত্তর ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর দিব বলিয়া তখনকার মত বিদায় নিলাম।

চাকুরীর টোপ

পরবর্তীকালে মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আবদুল গণি রোডস্থ সরকারি বাসভবনে আমি ও খুলনার মবিন উদ্দিন আহমদ তাহার সহিত আলোচনাকালে শেখ সাহেব আমাকে সোভিয়েট রাশিয়া বা যুক্তরাজ্যের ট্রেড কমিশনারের পদ বা পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র শিল্প (East Pakistan Small Industry Corporation or EPSIC) এর চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। আমি সবিনয়ে তাহার প্রস্তাব গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানাই। ঈদের কয়েকদিন পর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী নুরুর রহমান করাচি হইতে ঢাকা আগমন করেন ও আমার সহিত দেখা করিয়া প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর পক্ষ হইতে কলকাতাস্থ ডেপুটি হাইকমিশনারের কূটনৈতিক পদ গ্রহণ করিতে অনুরোধ জানান। প্রস্তাবগুলোর অন্তর্নিহিত মর্মার্থ আমার নিকট স্পষ্ট ছিল-রাজনীতির অঙ্গন থেকে আমাকে অপসারণ। চাকরি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাইলে করাচির মন্ত্রীমহল, ঢাকার মন্ত্রীমহল ও ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক মহল আমার উপর বেজায় খাপপা হয়। শুরু হয় আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা। প্রচার চলিতে থাকে যে, আমি ভারত সরকারের এজেন্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে জড়িত। সুতরাং আমার বিচার হওয়া উচিত। তদুত্তরে সংশ্লিষ্ট কুচক্রী মহলকে পরিষ্কার ভাষায় জানাইয়া দিয়াছিলাম যে, মুসলিম লীগের নির্যাতনে আত্মসমর্পণ করি নাই। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর ধমকে শির নত করিবার কোন কারণ দেখা দেয় নাই।

কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন

১৯৫৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে আফ্রো-এশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ডঃ কুদরত-ই খুদা, ডঃ এস, হেদায়েত উল্লাহ, ডঃ ওসমান গণি, ডঃ শামসুদ্দিন আহমদ, ডঃ নূরুল হুদা, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন, প্রফেসর এ,বি,এ, হালিম (ভাইস চ্যান্সেলর, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়), ডঃ মাহমুদ হোসেন, ডঃ হাসান হাবাসী, ড মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও জনাব ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ভারত হইতে আগত ভারতীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রফেসর হুমায়ুন কবীর, মিঃ তারা শংকর বন্দোপাধ্যায়, মিঃ প্রবোধ সান্যাল, মিসেস রাধারাণী দেবী, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মিসেস সুফিয়া ওয়াদিয়া অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলন উপলক্ষে কায়েদে আযম, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু’, হাকিম আজমল খান, ও আরও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের নামে টাঙ্গাইল থেকে কাগমারী পর্যন্ত তোরণ নির্মাণ করা হয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি সমর্থন না করায় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে নীতিগত মতভেদ দেখা দেওয়ায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রী মহল এবং ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়া বেসামাল ও জঘন্য ভাষায় ইত্তেফাকের পৃষ্ঠায় বিশেষতঃ তদীয় লিখিত রাজনৈতিক মঞ্চে আমাদের আক্রমণ করেন।

ভাসানীর পদত্যাগ

কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের পর বিভেদের মেঘ আকাশে ক্রমশ ঘনীভূত হইতে থাকে। আওয়ামী লীগ দ্রুত দ্বিধাবিভক্তির পথে অগ্রসর হইতে শুরু করে, একাংশ পশ্চিমা শক্তির অন্যতম দোসর প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন জানায় ও অপরাংশ সামরিক চুক্তি বিরোধী ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির প্রবক্তা বৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীকে সমর্থন দেয়। সংগঠনের নির্ধারিত বক্তব্যের প্রতি দেশবাসী ও কর্মীবাহিনীর সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার উদ্দেশ্যে আমি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় জনসভা ও কর্মীসভায় যোগ দিতে শুরু করি। উক্ত কর্মসূচি মোতাবেক ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত বারহাট্টা, বৈখরহাটি, নেত্রকোনায় ও আটপাড়ায় যথাক্রমে ৬, ৮, ১০ ও ১৭ মার্চ আওয়ামী লীগ কর্মীসভা ও জনসভায় বক্তৃতা দেই। ১৮ই মার্চ আমি কাগমারী (সন্তোষ) সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করি। মওলানা ভাসানী সংগঠনের সভাপতি পদ হইতে ইস্তফা দানের সিদ্ধান্ত আমাকে জানান। তিনি আমার কোন যুক্তিই শ্রবণ করিতে রাজী হন নাই। বরং তাঁহার পদত্যাগপত্রটি দৈনিক সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীর নিকট পৌঁছাইয়া দেওয়ার জন্য আমাকে আদেশ দেন। পদত্যাগ পত্রটি নিম্নরূপঃ

জনাব পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি সাহেব,

ঢাকা।

আরজ এই যে, আমার শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছে এবং কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবার খুলতে হইবে, তদুপরি আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার লিডার সদস্যদের নিকট আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব ২১ দফা ওয়াদা অনুযায়ী জুয়া, ঘোড়দৌড়, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি হারামী কাজ বন্ধ করিতে, সামাজিক ও ধর্মীয় বিবাহ বন্ধনের উপর ট্যাক্স ধার্য করা, জনমত অনুযায়ী বাতিল করিতে আবেদন জানাইয়া ব্যর্থ হইয়াছি। ভয়াবহ খাদ্য সংকটেরও কোন প্রতিকার দেখিতেছি না। ২১ দফা দাবির অন্যান্য দফা যাহাতে অর্থব্যয় খুব কমই হইবে তাহাও কার্যকরী করিবার নমুনা না দেখিয়া আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ হইতে পদত্যাগ করিলাম। আমার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করিয়া বাধিত করিবেন।

ইতি

স্বা-মোঃ আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

কাগমারী ১৮/৩/৫৭

মারি অরি পারি যে কৌশলে

যদিও আদেশ অনুযায়ী পদত্যাগপত্রটি দৈনিক সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীর নিকট পৌঁছাইয়া দিয়াছিলাম। তবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বিষয়টি জানাই। শেখ সাহেব আমাকে ভুল বুঝলেন ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় কর্মী ও জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে সংগঠনের গৃহীত সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরোধী পররাষ্ট্রনীতি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান জানাইতেছিলাম। তাই মার্কিন অনুচর মন্ত্রীমহল আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সম্পাদক ফজলুর রহমান এবং সফরউদ্দিন শেখ মুজিবুর রহমানের প্ররোচনায় আমার বিরুদ্ধে এক দরখাস্ত তাঁহার নিকট দাখিল কারেন। দরখাস্তে বর্ণিত অভিযোগ শেখ সাহেব ৩০শে মার্চ (১৯৫৭) পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ সদর দফতরে (৫৬ সিম্পসন রোড) আহূত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বিবেচনার জন্য পেশ করেন। অভিযোগের জবাবে আমি শেখ সাহেবকে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী মন্ডলীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ জনসমক্ষে খন্ডাতে আহ্বান জানাই ও আওয়ামী লীগ মন্ত্রীমন্ডলী কর্তৃক সংগঠনের গৃহীত পররাষ্ট্র বিষয়ক ও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবির বরখেলাফ নীতি অনুসরণ পরিহার করিতে বলি। সকাল দশ ঘটিকার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। কোন প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিয়াই সভা মুলতবী রাখা হয়। সন্ধ্যা আট ঘটিকায় পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে মুখ্যমন্ত্রীর কক্ষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব আবুল মনসুর আহমদের সভাপতিত্বে ওয়ার্কিং কমিটির মুলতবী সভা আরম্ভ হয়। মজার ব্যাপার এই যে, এই সময়ে অসুস্থতা বিধায় আবুল মনসুর আহমদ দফতরে সরকারি কাজ করিতে যাইতে পারিতেন না এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজনে অবস্থান করিতেছিলেন, তথাপি আমাকে সংগঠন হইতে বহিষ্কার করিবার জন্য কার্যকরী সংসদের সভায় যোগ দিতে বা সভাপতিত্ব করিতে কোন অসুবিধা বোধ করেন নাই। গরজ বড় বালাই! চতুর মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ পূর্বাহ্নে সমস্ত রিপোর্ট অবগত হইয়া বুঝিয়েছেন যে, সকাল বেলার অধিবেশনে আনিত অভিযোগ বলে আমাকে বহিষ্কার করা সম্ভব নয়। সুতরাং তিনি ভিন্নপথ অবলম্বন করিলেন। দেখা গেল, ক্ষমতাসীনদের নিকট ন্যায়-অন্যায়, প্রাসঙ্গিক-অপ্রসঙ্গিক ও বৈধ-অবৈধ কোন কিছুই বিবেচ্য নয়। পথের কাঁটা দূর করিতেই হইবে সুতরাং ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’। বলাই বাহুল্য যে, এইভাবে একপ্রকার গায়ের জোরেই আমাকে সংগঠন হইতে বরখাস্ত করা হইল। সভায় সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ আমাকে প্রশ্ন করেন, “মওলানা ভাসানীর পদত্যাগপত্র সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীর নিকট দিলেন কেন?” কাগমারীতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থার সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল কি?” প্রত্যুত্তরে আমি বলিয়া ছিলাম যে, উভয় প্রশ্নের সঠিক উত্তর কাগমারীতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভার সভাপতি মওলানা ভাসানী দিতে পারেন। তজ্জন্য সভা মুলতবি রাখতে হয় এবং পরবর্তী সভায় মওলানা ভাসানীর উপস্থিতি নিশ্চিত করিতে হয়। প্রশ্নোত্তরে বেকায়দায় পতিত হলেও নব্য মার্কিন দোসর মন্ত্রীশ্রেণির প্রতিনিধি আবুল মনসুর আহমদ হাল ছাড়ার পাত্র নহেন। হাল ছাড়লে মার্কিন অনুচর মহলে মর্যাদা ক্ষুন্ন হইবে যে! তাই জওয়াব শুনিবার পর কালবিলম্ব না করিয়া সভাপতির আসন থেকে স্বয়ং আবুল মনসুর আহমদ প্রস্তাব করেন যে, So “Mr Oli Ahad be suspended from the post of the Organising Secreatry”

অর্থাৎ অতএব “মোঃ অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হোক।” সর্বমোট ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে আমি সহ ৩০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলাম। ৩০ জনের মধ্যে ১৪ জন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন এবং নিম্নলিখিত ৯ জন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন ও প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।

১। ইয়ার মোহাম্মদ খান, এম,পি,এ, কোষাধ্যক্ষ, ২। আবদুল হাই, প্রচার সম্পাদক, ৩। জনাব আবদুস সামাদ, এম,পি,এ, শ্রম সম্পাদক, ৪। সেলিনা বানু, এম,পি,এ, মহিলা সম্পাদক, ৫। দবির উদ্দিন আহমেদ, এম,পি,এ, সভাপতি, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ, ৬। হাবিবুর রহমান, এম.পি,এ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ, ৭। হাতেম আলী খান, এম পি,এ. ৮। অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ, এম,পি,এ, ৯। আকবর হোসেন আখন্দ, এম.পি, সভাপতি, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ।

রাত ১-৩০ মিনিটে সভা ভঙ্গ হওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুজ্জোহা সভাস্থলে আসিয়া ফতুল্লা ঘাটে মওলানা ভাসানীর নৌকায় অবস্থানের খবর আমাদিগকে জানান। আমরা কাল বিলম্ব না করিয়া মওলানা ভাসানীর সহিত দেখা করিতে ঘাট মুখে রওয়ানা হই। মওলানা ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ ও আলোচনার পর শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্থানের পর মওলানা ভাসানী নারায়ণগঞ্জ নগর আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ৩১শে মার্চ রোজ রবিবার জনসভা আহ্বান করিবার আদেশ দান করেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে মওলানা ভাসানীর মুখপানে তাকাইয়া রহিলাম। আমি তাঁহাকে ওয়ার্কিং কমিটির সভা পুনঃ আহ্বান করিতে পরামর্শ দান করি এবং ওয়ার্কিং কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রী মহলের কারসাজিকে মোকাবেলা করিবার অনুরোধ জানাই। কিন্তু গঠনতান্ত্রিক পথে সমস্যার সমাধান না করিয়া তিনি নারায়ণগঞ্জ জনসভার মাধ্যমে সাংগঠনিক অন্যায় কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার মত অদ্ভুত মানসিকতার পরিচয় দিলেন। ইহার সারমর্ম হইল, সংগঠনের ঐক্যের পথ পরিহার করিয়া বিভেদের দ্বার উন্মুক্ত করা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইহাই চাহিয়াছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারাই জয়ী হইল। মওলানা ভাসানী সংগঠনের সভাপতি। তিনি স্বয়ং ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করিয়া সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে পারিতেন। কি চমৎকার! বিচারক নিজেই বিচারপ্রার্থী। মওলানা ভাসানী সুস্থ নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হইলেন। চরম সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী সবসময় পলায়নী মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়াছেন। ফলে দেশ, জাতি ও জনতা বঞ্চিত হইয়াছে তাহার সঠিক নেতৃত্বের সুফল হইতে।

শো-কজ-নোটিশ

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ক্রমশ মন্ত্রী মহলের কুক্ষিগত হয়। মাওলানা ভাসানী উপায়ন্তর না দেখিয়া ১৮ ও ১৯শে মে বগুড়ায় কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন এবং খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১লা জুন হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তদানুযায়ী ১লা জুন হইতে ৭ই জুন অবধি “আত্মশুদ্ধির” নামে অনশনও পালন করেন। মাওলানা ভাসানী অনশন পালন কালে ৩রা জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আমাকে সংগঠন থেকে তিন বৎসরের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ৩০শে মার্চ ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পদত্যাগী ৯ জন সদস্যের স্থলে নূতন ৯ জন সদস্য কো-অপট করিবার ব্যবস্থা হয়।

৩০শে মার্চ দিবাগত রাত্রে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গৃহীত প্রস্তাব ছিল নিম্নরূপঃ

“Whereas the general Secretary Sheikh Mujibur Rahman has brought certain-charges of indiscipline and disruptive activities against Mr. Oli Ahad, Organizing Secretary and whereas after long deliberations has come to the conclusion that a prima facie case has been made out that he has neglected to perform his duties and responsibilities as the organizing Secretary, this committee hereby resolves that a notice to show-cause within 15 days why he will not be expelled from the organization or otherwise dealt with. The notice will be sent to Mr. Oli Ahad by registered post. In the meantime Mr. Oli Ahad will remain under suspension as the Organizing Secretary of the party with immediate effect.

অর্থাৎ “যেহেতু সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান জনাব অলি আহাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও বিভেদাত্মক কার্যকলাপের কতিপয় অভিযোগ আনিয়াছে, এবং যেহেতু দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল যে, জনাব অলি আহাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগ (কেস) নির্ণীত হইয়াছে এবং যেহেতু ইহাতে নির্ণীত হইয়াছে যে, সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে তিনি স্বীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিয়াছেন; সুতরাং এই কমিটি এতদ্বারা প্রস্তাব করিতেছে যে, তাহাকে কেন সংগঠন হইতে বহিষ্কার করা হইবে না বা অন্যভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না এই মর্মে পনের দিনের মধ্যে কারণ দর্শাইবার জন্য নোটিশ দেওয়া হউক। নোটিশ রেজিস্টার্ড ডাকে জনাব অলি আহাদকে পাঠাতে হইবে। ইতিমধ্যে সাংগঠনিক পদ হইতে তাৎক্ষণিক কার্যকারিতার সহিত জনাব অলি আহাদ সাময়িকভাবে কর্মচ্যুত থাকবে।”

ইতিপূর্বে ২১শে মে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পদত্যাগী ৯ জন সদস্যের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় এবং ৩রা জুন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নিম্নলিখিত সদস্যবর্গকে কো-অপট করা হয়। যথাঃ

জসিম উদ্দিন আহমেদ সভাপতি, সিলেট আওয়ামী লীগ; আমজাদ হোসেন, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ; মুজিবুর রহমান, সভাপতি, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ; দেওয়ান মহিউদ্দিন আহমদ, বগুড়া, রওশন আলী, সম্পাদক, যশোর জেলা আওয়ামী লীগ ও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান, শামসুল হক, ঢাকা; আজিজ আহমেদ, নোয়াখালী এবং মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। ইহা ছাড়াও বৈঠকে নিম্নলিখিত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। যথা-

আবদুল হামিদ চৌধুরী                           –                              সাংগঠনিক সম্পাদক

জহুর আহমদ চৌধুরী                             –                              শ্রম সম্পাদক

অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমান          –                              প্রচার সম্পাদক

মিসেস মেহেরুন্নেসা খাতুন                      –                              মহিলা সম্পাদিকা

৫ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে শত অনুরোধ সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী প্রধানমন্ত্রীর সোহরাওয়ার্দীর সহিত অর্থপূর্ণ আলোচনা না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার অস্বীকৃতি জানান। এবং আলোচনাকালে তিনি ১৯৫৫ সালের ২৬শে এপ্রিল আইন মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক লিখিত ও দস্তখত কৃত অঙ্গীকারপত্রের কথা “আমি এতদ্বারা ঘোষণা করিতেছি যে, আমি যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবি ও যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা কনস্টিটিউশন কনভেনশন মারফত শাসনতন্ত্রে স্বীকৃতির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করব। যদি তাতে সক্ষম না হই, তবে মন্ত্রীত্ব হইতে পদত্যাগ করিব” স্মরণ করাইয়া দেন। মিনিট বুকে এই বৈঠকের বিবরণী লিপিবদ্ধ করা হয় নিম্নভাবেঃ

“Maulana Bhashani has informed the working committee that he will withdraw his resignation letter after a discussion with Mr. Suhrawardy on different subject. Therefore the working committee defers decision on this matter and the meeting is adjourned. The General secretary is authorised to fix the date of the next meeting.”

অর্থাৎ ‘মওলানা ভাসানী ওয়ার্কিং কমিটিকে এই মর্মে অবহিত করেন যে, জনাব সোহরাওয়ার্দীর সহিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পর তিনি তাঁহার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিয়া নিবেন। সুতরাং ওয়ার্কিং কমিটি এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে এবং সভা মূলতবী করা হয়। পরবর্তী সভার তারিখ ধার্য করিবার জন্য সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।”

সংগঠন থেকে আমার বহিষ্কার, পদত্যাগী ৯ জন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ও কর্মকর্তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ, সংগঠনের সভাপতি পদ হইতে মওলানা ভাসানীর পদত্যাগ, পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, ৩১শে মে মন্ত্রী পদ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পদত্যাগ, ১লা জুন মওলানা ভাসানীর অনশন, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট শাসন সেপ্টেম্বর অবধি বলবৎ রাখার সিদ্ধান্ত এবং ৩রা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে মুদ্রা, পররাষ্ট্র বিষয়াদি, দেশরক্ষা কেন্দ্রীয় বিষয়ভুক্ত করিয়া পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবির প্রস্তাব গ্রহণের পটভূমিকায় ১৩ ও ১৪ই জুন ঢাকায় সাবিস্তান (পিকচার প্যালেস) ও গুলিস্তান সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী স্বীয় বক্তব্য পেশ করিবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অধিবেশন হল ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরোধী ঐতিহ্য বিস্মৃত হইয়া সংগঠনের পূর্ব সিদ্ধান্ত নাকচ করতঃ জনাব সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী থাকার প্রয়োজনে যুদ্ধ জোটে জড়িত হওয়ার পররাষ্ট্রনীতি অনুমোদন করে। কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের পর মার্কিন মহলে প্রধানমন্ত্রী বেকায়দায় পতিত হয়েছিলেন। তাহা হইতে উদ্ধার লাভের জন্যই আওয়ামী লীগকে স্বীয় অতীত নীতি বিসর্জন দিতে হইল। আর এভাবেই আওয়ামী লীগ পরিণত হইল নেতা সর্বস্ব দলে। দ্বিতীয়তঃ এইবার এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল যে, কেহ একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সদস্য হইতে পারিবে না। সর্বপরি ১৪ই জুন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। মওলানা ভাসানী ও বহুসংখ্যক ত্যাগী কর্মীদের অতি কষ্টে গড়া আওয়ামী লীগে এভাবে নীতি জ্ঞানহীন রাজনীতির জয়যাত্রা সূচিত হইল।

পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসন বিষয়ে মতানৈক্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দ্বিখন্ডিত করে। কাউন্সিল সভায় মওলানা ভাসানীর নীতির পরাজয়ই চরম উপসংহার নয়, যেমন কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের পর সংগঠনের সভাপতির ঘোষণা আওয়ামী লীগ রাজনীতির শেষ কথা ছিল না। ষড়যন্ত্রের রাজনীতির গুরু ঠাকুর ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বশংবদ প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার দাবার চালে দুই নেতাকে পরাভব স্বীকার করিতে হয়। আওয়ামী লীগ হয় দ্বিধাবিভক্ত।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্ম

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নেতৃবৃন্দের ১৩ ও ১৬ই জুন দুই দিনব্যাপী ঢাকা বৈঠকে জাতীয় ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তদানুযায়ী মওলানা ভাসানী ১৭ই জুন ঘোষণা করেন যে, আগামী ২৫ ও ২৬শে জুলাই (১৯৫৭) ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইবে। ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণকল্পে ১লা জুলাই ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের সভাপতিত্বে জেলা বোর্ড হলে অনুষ্ঠিত কর্মীসভায় জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান চেয়ারম্যান ও জনাব মহিউদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করিয়া ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট এক অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম সদস্য রাজস্বমন্ত্রী জনাব মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে পরিচালিত পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ২১, ২২ ও ২৩শে জুলাই (১৯৫৭) তিনদিনব্যাপী বরিশাল টাউন হলে অনুষ্ঠিত সুপ্রীম (সর্বোচ্চ) কাউন্সিলের অধিবেশনে ঢাকায় আহূত নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকা রূপমহল সিনেমা হলে ২৫ জুলাই সম্মেলন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত আরম্ভ হয়। পশ্চিম পাকিস্তান হইতে পাক-ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপকথার নায়ক সীমান্ত প্রদেশের লালকোর্তা নেতা, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফার খান, পাঞ্জাবের জননেতা মিঞা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ, সিন্ধুর জননেতা ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান জি,এম, সৈয়দ, বেলুচিস্তানের ইংরেজ শাসকদের ত্রাস খান আবদুস সামাদ অ্যাচাকজাঁই, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী ও অন্যান্য জন বরেণ্য নেতা এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁহারা সকলে ন্যাশনাল পার্টির সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে এই ন্যাশনাল পার্টির পঁচিশজন সদস্য ছিলেন এবং জি,এম, সৈয়দ ছিলেন উক্ত পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা। সম্মেলনের বানচাল করিবার ব্যর্থ প্রয়াসে সরকারি শাসনতন্ত্রের প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে চিরাচরিত হীন পন্থায় আওয়ামী লীগ ভাড়াটিয়া গুন্ডা বাহিনী ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগের গুন্ডামীতে হতোদ্যমে ও নিরুৎহিত না হইয়া সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশ প্রেমিক বন্ধুগণ আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, আরও সচেতন এবং আরও সজাগ হন। তাই শত বাধা-বিপত্তির ঝড় ও ঝঞাকে উপেক্ষা করিয়া সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সম্মেলনেই গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধানতঃ পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল পার্টি, পূর্ব পাকিস্তানের মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আস্থাশীল আওয়ামী লীগ অংশ ও পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল সমবায়ে গঠিত পাকিস্তান ব্যাপী জাতীয় রাজনৈতিক দল।

সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তুষ্টি বিধানের তাগিদে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও আতাউর রহমান সরকার পাকিস্তানের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে অপরাহ্নে পল্টন ময়দানে আহূত জনসভার উদ্যোক্তাদের উপর হিটলারের ঝটিকা বাহিনীকে লেলাইয়া দিয়া পাকিস্তান ধ্বংসের প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার মহৎ কর্মে সমাধা করেন। দেশপ্রেমের এত বড় অগ্নি পরীক্ষার মুহূর্তে কোন দেশপ্রেমিক পিছপা হয়? আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান আদর্শ দেশপ্রেমিক বটে। উভয়ের যুগল প্রচেষ্টায় পাকিস্তান সেইদিন নিশ্চিত ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পায়! বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার ব্যাপারে তাহাদের উভয়েরই এই জ্বেহাদীপ্রেম নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যৎ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকিবে।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল কাগমারী (সন্তোষ) অধিবেশনে পররাষ্ট্রনীতি কেন্দ্র করিয়া উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আত্মগোপনকারী ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির গোপন (আন্ডার গ্রাউন্ড) নেতৃত্ব কমরেড মনি সিংহ, কমরেড খোকা রায়, কমরেড আবদুস সালাম ও অন্যান্যকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তোলে। দীর্ঘকালের সংগ্রামী রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা প্রসূত প্রজ্ঞা ও ব্যাপক থিওরিটিকাল জ্ঞান বলে তাহাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাহারা তখনকার ত্বরিত গতিতে প্রবাহিত ঘটনা স্রোতের উপর তীক্ষ্ণ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখিতেছিলেন। বোধহয় দিব্যচক্ষে অবলোকন করিতেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দ্বিখন্ডিত করিয়া সংগ্রামী, সমাজ সচেতন, দেশপ্রেমিক, সৎ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অংশকে সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হইতেছে এবং সেইমতে সামন্তবাদ, উঠতি পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অনুচর শ্রেণির সুপরিকল্পিত সংকল্প ও চক্রান্ত বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে সুচারুভাবে সমাধা হইতে যাইতেছে। অর্থাৎ গণমুখী আওয়ামী লীগ গণবিরোধী ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি আন্ডার গ্রাউন্ড নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বিধাবিভক্তি রাধে করিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু তাহাদের সে চেষ্টা সফল হয় নাই। কমিউনিস্ট পার্টির (ওভার গ্রাউন্ড) সহযোগী নেতা ও কর্মীদের ব্যক্তিগত কোন্দল ও প্রাধান্য লাভের প্রচেষ্টা, ঘূণ্য ও পরোক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নানা সন্দেহজনক উচ্চমহল হইতে আনুকূল্য লাভের লোভ, আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির সৎ ও অমূল্য পরামর্শ দানের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। পররাষ্ট্র নীতিকে কেন্দ্র করিয়া ক্রমশ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মতভেদ চরম আকার ধারণ করে এবং সর্বশেষে মতভেদ পথভেদের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই মতভেদ ও পথভেদেরই ফসল।

উল্লেখ্য যে, এই সময়ে মওলানা ভাসানী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ উভয়েই ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসারত ছিলেন। সেখানে আপোষ-আলোচনার কিছুটা সূত্রপাত হয়। আবুল মনসুর আহমদ আমার বিরুদ্ধে গৃহীত সাংগঠনিক শাস্তিমূলক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও পদত্যাগী ৯ জন নেতাকে পুনর্বহাল করার ব্যাপারে একটি আপোষ-রফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সাংগঠনিক দিক থেকে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হউক, ইহা কখনও আমার কাম্য ছিল না। মওলানা ভাসানী ইহা জানিতেন। তাই আপোষ-রক্ষা প্রস্তাবাবলী আমার নিকট হইতে সযত্নে লুকাইয়া রাখেন। সেই সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর প্রতি এত ক্রোধান্বিত ছিলেন যে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জালেম ইস্কান্দার মীর্জার প্রেমে নিমজ্জিত হইয়া পড়েন এবং ইহার ফলে যে কোন সর্বনাশা পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে ইতস্ততঃ করেন না। ইহারই ফলশ্রুতি হলো আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন।

দৈনিক ইত্তেফাক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আবির্ভাবকে বিষ নজরে দেখিতে লাগিল। গায়ের জ্বালা মেটানোর প্রয়াসে মালিক-সম্পাদক জনগণের ভারত বিরোধী মনোভাবের সুযোগ নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ইংরেজি সংক্ষিপ্ত নাম এন,এ,পি, কে বিকৃত করিয়া Nehru Aided party অর্থাৎ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সাহায্যপ্রাপ্ত পার্টি সংক্ষেপে ন্যাপ আখ্যা দিয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে জনগণের নিকট হেয় প্রতিপন্ন করিতে সচেষ্ট হইয়া উঠিলেন। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর জিরো থিওরি গোড়া প্রচারক ইত্তেফাকের নিকট পরমতসহিষ্ণুতা ছিল অবিদিত ও অবাঞ্ছিত। তবে স্বীকার করিতেই হবে যে, বিরোধী দলীয় মুখপত্রের ভূমিকায় ইত্তেফাক একদা অত্যন্ত সাহসের পরিচয় রাখিয়াছিল। যত বিপত্তি ক্ষমতাসীন হলে! জিরো থিওরির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, ক্ষুদ্র ও অনুন্নত দেশগুলির বিশেষতঃ আরব জাহানের বন্ধুত্ব পাকিস্তানের রক্ষাকবচ নয়; একমাত্র মার্কিন বন্ধুত্বই ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান দিতে পারে। অতএব দৈনিক ইত্তেফাকের মতে সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোট বিরোধী বক্তব্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বনাশের সূচনা করিবে।

সোহরাওয়ার্দীর পদত্যাগ: যুক্ত ও পৃথক নির্বাচন

প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দক্ষতার সহিত পাশ্চাত্য জগতের সমর্থন অর্জন করিতে সক্ষম হন। কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত পাশ্চাত্য জগতের মোড়ল শক্তিসমূহের সমর্থন হারাইয়া ফেলে এবং একমাত্র সোভিয়েট রাশিয়ার ভেটো শক্তির আশ্রয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আত্মরক্ষা করিতে থাকে। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর জনপ্রিয়তা অর্জন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার ঈর্ষা ও ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় ভীত সন্ত্রস্ত ইস্কান্দার মীর্জা ক্ষমতা হারাইবার ভয়ে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার শুরু করেন। রিপাবলিকান পার্টি ইস্কান্দার মীর্জার ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের উপর হইতে সমর্থন প্রত্যাহার করে। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন নাই, এই অজুহাতে প্রেসিডেন্ট মীর্জা প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে পদত্যাগ করিতে আহ্বান জানান। প্রথমে সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করিতে অস্বীকার করেন ও প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংসদ অধিবেশন আহ্বান করে অনুরোধ জানান। কিন্তু ইস্কান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। ঝামেলা এড়ানোর উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী ১১ অক্টোবর (১৯৫৭) পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। স্মর্তব্য যে, ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে একইভাবে বরখাস্ত করিয়াছিলেন। পরিতাপের বিষয়, সেই দিন আইনজ্ঞ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় গভর্নর জেনারেলের এক্তিয়ার বহির্ভুত অন্যায় ও অবৈধ আদেশকে প্রকাশ্যে সমর্থন দান করিতে কুণ্ঠিত হন নাই! সেই গোলাম মোহাম্মদ এর উত্তরাধিকারী ইস্কান্দার মীর্জার নিকট অনুরূপ আচরণই প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে পাইতে হইল। ইহাকেই বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। নীতি জ্ঞানহীন রাজনীতির ফল জাতির জন্য কখনও শুভ হইতে পারে না এবং হয়ও নাই। অতঃপর মুসলিম লীগ নেতা আই, আই, চুন্দ্রিগড় প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি হইলেন পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী।

অবস্থার চাপে পাকিস্তান মুসলিম লীগ ১১ই অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতিকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে এবং এই মর্মে শঙ্কা প্রকাশ করে যে, পাকিস্তান মুসলিম জাহানে বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করিবার জন্য কেতাদূরস্ত মার্কিন বশংবদে পরিণত হয়েছে। এদিকে পৃথক নির্বাচন প্রথায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে রিপাবলিকান পার্টি চুক্তিবদ্ধ হওয়ায়, মুসলিম লীগ তাহাদের সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করিতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইহার ফল শুভ হইবে না। উপলব্ধি করিতে পারিয়া রিপাবলিকান পাটি নির্বাচন প্রথার উপর জনমত যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং একটি তথ্য নিরূপণ কমিটি (Fact Finding Committee) গঠন করে। তথ্য নিরূপণ কমিটির সদস্যরা ২রা ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে আগমন করেন। আওয়ামী লীগ একই তারিখে অর্থাৎ ২রা ডিসেম্বর যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও ৫ই ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে যুক্ত নির্বাচনের দাবিতে বিরাট জনসভার আয়োজন করে। একই তারিখে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে প্রাক্তন মন্ত্রী শামসুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি (আবু হোসেন সরকার গ্রুপ), পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস ও পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সভায় নিম্নলিখিত এর সমন্বয়ে সর্বদলীয় যুক্ত নির্বাচন সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়:

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী), শামসুদ্দিন আহমদ, মাহমুদ আলী, অলি আহাদ, আবদুস সালাম (সম্পাদক, পাকিস্তান অবজারভার), জহুর হোসেন চৌধুরী (সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ), কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস (সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেহাদ)।

১১ ডিসেম্বর (১৯৫৭) চুন্দ্রিগড় সরকার জাতীয় পরিষদে পৃথক নির্বাচনী বিল উত্থাপনের উদ্যোগ নেয়। সর্বদলীয় যুক্ত নির্বাচন সংগ্রাম পরিষদ ১১ ডিসেম্বর যুক্ত নির্বাচন দিবস পালন করে। জনমতের প্রবল চাপে রিপাবলিকান পার্টি যুক্ত নির্বাচন সমর্থন করিতে বাধ্য হয়। মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী পৃথক নির্বাচন প্রথার সমর্থক বিধায় প্রধানমন্ত্রীর পদ হইতে পদত্যাগ করেন এবং তদস্থলে মালিক ফিরোজ খান নূন নূতন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

পশ্চিমপাকিস্তানসফর

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় যোগ দিতে পেশোয়ারের পথে আমরা লাহোর যাত্রা করি এবং দলীয় নেতা মিঞা ইফতেখার উদ্দিনের আতিথ্য গ্রহণ করি। ৩রা নভেম্বর (১৯৫৭) মাওলানা ভাসানী লাহোরের মুচিগেটে এক জনসভায় ভাষণ দান করেন। পেশওয়ারে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জাতীয় কমিটির সভায় পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলুপ্ত করিয়া সাবেক চারটি প্রদেশ পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশ অবিলম্বে পুনর্বহাল না করিলে আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব করেন সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফার খান। স্মর্তব্য যে, ১৭ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে এক ইউনিট বিলুপ্তির প্রস্তাব গৃহীত হয়। পাঞ্জাবের মিঞা ইফতেখার উদ্দিন ও সংগঠনের সভাপতি মাওলানা ভাসানী স্বয়ং আইন অমান্য আন্দোলনের বিরোধিতা করিয়াছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোজাফফর আহমদ ও মোঃ তোয়াহা পাঞ্জাবের মিঞা ইফতেখার উদ্দিন এর সহিত কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আইন অমান্য আন্দোলন সময়োচিত নহে বলিয়া রায় দেন। তাহারা দাবি করেন যে, আইন অমান্য আন্দোলনের অজুহাতে সাধারণ নির্বাচন বানচাল করা হইবে এবং দেশে সামরিক শাসনের প্রবর্তন হইবে। আমি আইন অমান্য আন্দোলনের প্রতি জোর সমর্থন জানাই এবং মন্তব্য করি যে, জনতা আন্দোলনমুখর না হলে ক্ষমতা বিলাসী উচ্চ মহল সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের সহায়তায় দেশে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেবে। মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য লোকের অনুরোধে খান আবদুল গফফার খান আমাকে আইন অমান্য আন্দোলন দাবি আপাততঃ স্থগিত রাখিবার অনুরোধ করে। প্রস্তাবক স্বয়ং প্রস্তাব প্রত্যাহার করায় আমার নিশ্চুপ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। পাঠান নেতা সরল বিশ্বাসে তাহাদের আশ্বাসে বিশ্বাস করিয়াছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে নেতৃবৃন্দ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন কিন্তু সেই অদূর ভবিষ্যৎ’ আর কখনও আসে নাই। শুধু তাই নয়, দলের শীর্ষ নেতা ঘটনাপ্রবাহে ইস্কান্দার মীর্জার ষড়যন্ত্র জালের ইচ্ছুক শিকারে পরিণত হন ও দেশের জন্য সর্বনাশা ভবিষ্যৎ ডাকিয়া আনেন।

ন্যাপ প্রার্থীদের পরাজয়বরণ

পশ্চিম পাকিস্তান সফরান্তে ঢাকা পৌঁছিয়াই সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত বুড়িচং, কসবা ও রংপুর জেলার অন্তর্গত মিঠাপুকুর-পীরগাছা উপনির্বাচনে যথাক্রমে আমাদের প্রার্থী তমিজুল ইসলাম, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম ও আবদুল জলিলকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে শাসক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ভোটাধিক্যে পরাজয়বরণ করিতে হয়। পরাজয়বরণ করিবার কারণ, জনগণ আওয়ামী লীগের প্রচারণায় বিশ্বাস করিয়াছিল যে, আমরা আল্লাহ বিরোধী কমিউনিস্ট প্রভাবান্বিত ভোট প্রার্থী দল এবং হিন্দুস্থানের দালাল হিসাবে পাকিস্তান ধ্বংসের ভূমিকায় অবতীর্ণ।

সীমান্তে পাচার বিরোধী অভিযান

সীমান্তে অস্বাভাবিক পাচারের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাইতে থাকে। জাতীয় অর্থনীতির প্রয়োজন সীমান্তে পাচার বন্ধ করিবার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োজিত করা হয়। এই ব্যবস্থা ক্লোজ ডোর অপারেশন (Close Door Operation) নামে পরিচিতি লাভ করে। পাচার বন্ধ করিবার মহৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হইয়াই সরকার কতিপয় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ বর্ডার অফিসার স্বীয় দায়িত্বজ্ঞান হারাইয়া লোভ-লালসার শিকারে পরিণত হয়। ভূত তাড়ানোর নিমিত্ত ব্যবহৃত সরিষাই ভূতের আস্তানায় পরিণত হওয়ার বহুল প্রচলিত গ্রাম্য প্রবচনটিই আওয়ামী লীগ কর্মীদের ব্যাপারে নির্মম সত্যের রূপ নেয়। তবে ইহার ব্যতিক্রমও ছিল। আমার জানার মধ্যে আখাউড়া-সীমান্তে কর্মরত নোয়াখালী আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালাম সর্বপ্রকার লোভ লালসার উর্ধ্বে থাকিয়াও প্রাণহানির চক্রান্ত উপেক্ষা করিয়া স্বীয় নির্মল চরিত্রের সাক্ষর রাখিয়া গিয়াছেন। তাহার আপ্রাণ চেষ্টায় সীমান্ত এলাকায় পাচার প্রায় বন্ধ হইয়া যায়। এদিকে সেনাবাহিনীর পাচার বিরোধী কঠোর অভিযান সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের কঠোর সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। ইহা দুঃখজনক কিন্তু সত্য। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তোষণপ্রিয়তার কারণে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় নগণ্য সংখ্যক প্রতিনিধি ও স্বীয় জ্ঞাত ও অজ্ঞাত স্বার্থে পাচার বিরোধী কঠোর ব্যবস্থাকে প্রকাশ্য সমালোচনা করিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নাই।

শাহেদ আলীর মৃত্যু

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে বাড়ি-গাড়িসহ মোটা ভাতা নির্দিষ্ট করিয়া পাকিস্তান টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন এমনকি তিনি শেখ সাহেবকে দামি লিমুজিন গাড়ীও উপহার দেন। শুধু তাই নয়, তাঁহাকে শান্ত করিবার মানসে বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া শেখ সাহেবকে উক্ত মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানাইলে শেখ সাহেব জাতীয় পরিষদ সদস্য রূপে রাশিয়া মুখে রওয়ানা হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হইতে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পদত্যাগের পর পরই পাকিস্তান সরকার শেখ সাহেবকে জেনেভা থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দান করেন।

নানা কারণ ও অজুহাতে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন পার্লামেন্টারি পার্টির একাংশ আওয়ামী লীগ দলীয় মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের বিরুদ্ধে উপদল গঠন করিবার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। মিঃ রসরাজ মন্ডলের নেতৃত্বে ‘সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন ভুক্ত’ কতিপয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, দ্বিতীয়তঃ উত্তরবঙ্গ প্রদেশের দাবিতে আওয়ামী লীগ দলীয় কতিপয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, তৃতীয়তঃ ক্লোজডোর অপারেশন’ (Closed door Operation) -এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কংগ্রেস দলীয় কতিপয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আতাউর রহমান খান সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য উম্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা ভাসানী ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশের আতাউর রহমান খান মন্ত্রী সভার বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপনের পক্ষপাতি ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা লক্ষ্য করিয়া দ্বিধাবিভক্ত কৃষক-শ্রমিক পার্টি অভ্যন্তরীণ কোন্দল ভুলিয়া ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সৈয়দ আজিজুল হক স্বীয় নেতৃত্বের দাবি ত্যাগ করিয়া পার্লামেন্টারি নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে আস্থা জ্ঞাপন করেন।

বিরোধী দলসমূহের ঐক্যবদ্ধ চাপ ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান নিকট ভবিষ্যতে ভরাডুবির আশঙ্কায় ৩০শে মার্চ গভর্নর শেরে বাংলাকে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন মুলতবি রাখিবার আহ্বান জানান। বৈরী গভর্নর মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান সরকারের প্রতি অধিকাংশ অর্থাৎ সংখ্যাগুরু সদস্যের আস্থা নাই অজুহাতে তাহাকে পদচ্যুত করেন ও আবু হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান। নতুন মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করিবার অব্যবহিত পরেই তাহার পরামর্শে গভর্নর প্রাদেশিক পরিষদ মুলতবি ঘোষণা করেন। এই দিকে জনাব সোহরাওয়ার্দীর অনুরোধে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূন ৩১শে মার্চ শেরে বাংলাকে গভর্নর পদ হইতে অপসারণ করেন এবং ১লা এপ্রিল প্রদেশের চিফ সেক্রেটারি অস্থায়ী গভর্নরের দায়িত্বভার গ্রহণ করিবার এক ঘন্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারকে পদচ্যুত করেন। পুনর্বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জনাব আতাউর রহমান খান ৯ সদস্যবিশিষ্ট সরকার গঠন করেন। নীতিজ্ঞান বিবর্জিত ও ক্ষমতার লালসায় সর্বস্ব এই রাজনীতির খেলা দেশবাসীকে হতবাক ও বিক্ষুব্ধ করে। ফলশ্রুতিতে সামরিক অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়। দর্শকদের জন্য খেলা এইখানেই শেষ হয় বটে, কিন্তু পর্দার অন্তরালে খেলা অব্যাহত থাকে। আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রচেষ্টায় পুনঃ দেশব্যাপী অবাঙ্গালি বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ৪ঠা জুন (১৯৫৮) করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ, কেন্দ্রীয় সামরিক-বেসামরিক চাকুরীতে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চনার ঘোরতর ও গভীর অভিযোগ প্রকাশ্যে আনয়ন করেন। এভাবে ১৯৫৯ সালের মার্চে সাধারণ নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কড়ি অগ্রভাগেই আদায় করিয়া রাখিবার প্রয়াস পান। সত্যই ক্ষমতার রাজনীতির গতি কি বিচিত্র।

১৮ জুন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে তেত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট ন্যাপ নিরপেক্ষ থাকিবার দরুন আতাউর রহমান খান সরকার সংখ্যাধিক্য হারাইয়া ফেলেন এবং ১৯শে জুন আবু হোসেন সরকার পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু ২২শে জুন অনাস্থা ভোটে আবু হোসেন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। কেননা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ভুক্ত পরিষদ সদস্যবর্গ মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ২৫শে জুন (১৯৫৮) পূর্ব পাকিস্তানে পুনরায় প্রেসিডেন্ট শাসন প্রবর্তিত হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিরোধী জনমত এত প্রবল ছিল যে, কেন্দ্রীয় সরকার এই ব্যাপারে তদন্তের জন্য আখতার হোসেনের নেতৃত্বে একটি ইনকোয়ারি কমিটি গঠন করিতে বাধ্য হন। ইনকোয়ারি কমিটি পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগের পরামর্শ দেন। লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দল এক ইউনিট বিলাপ করিয়া সাবেক প্রদেশ গঠন করিবার দাবি করিতেছিল।

পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক কমিটি ৩০ ও ৩১শে মে (১৯৫৮) করাচিতে অনুষ্ঠিত সভায় ১৯৫৯ সালের প্রথমার্ধে সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দান কল্পে পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করে। কমিটি পূর্ব পাকিস্তানের আতাউর রহমান খান সরকারকে সমর্থন দানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ সদস্যদের কঠোর সমালোচনাও করে। বৈঠকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড ঢাকা অধিবেশনে এই বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দিবে। কেন্দ্রীয় রাজস্বে নির্মিত রাজধানী করাচিকে পশ্চিম পাকিস্তান ভুক্তির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সভায় আমি একটি প্রস্তাব পেশ করি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটি প্রস্তাব সুচতুরভাবে এড়িয়ে যায়। ইহারই প্রতিবাদে ১লা জুন (১৯৫৮) আমি উক্ত কমিটি হইতে পদত্যাগ করি।

কিছুকালের মধ্যেই মাওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের নিমিত্ত স্টকহোম গমন করেন। স্টকহোম অবস্থানকালে মিশরের রাষ্ট্রদূত মাওলানা ভাসানীকে মিশর সফরের আমন্ত্রণ জানান। তদানুযায়ী মাওলানা ভাসানী মিসর গমন করেন ও প্রেসিডেন্ট নাসেরের সহিত আলোচনাকালে তিনি তাহাকে সমগ্র জনতার অকুণ্ঠ সমর্থনের বার্তা পৌঁছাইয়া দেন। প্রায় দুই মাস পর মাওলানা ভাসানী ১১ই সেপ্টেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিমধ্যে ২২শে জুলাই আতাউর রহমান খান পুনরায় মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের নবম সরকার গঠন করিয়াছিলেন।

সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখ প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহূত হয়। সরকারদলীয় স্পিকার আবদুল হাকিমের সহিত মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে পরিষদের কার্য পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার মানসে স্পীকার আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে দেওয়ান মাহবুব আলী (ন্যাপ সদস্য) অনাস্থা প্রস্তাব আনয়নে অনাস্থা প্রস্তাব সংখ্যাধিক্য ভোটে গৃহীত হইয়াছে বলিয়া দাবি করেন। মজার ব্যাপার, পরক্ষণেই সরকারি দলভুক্ত পিটার পল গোমেজ (কংগ্রেস) স্পীকার আবদুল হাকিম ‘পাগল’ ঘোষণা করিয়া একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং উক্ত প্রস্তাব গৃহীতও হয়। দেখিয়া শুনিয়া মনে হচ্ছিল যেন পাগলামী প্রতিযোগিতায় সবাই অবতীর্ণ; দেশ ও জাতি গৌণ। ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল পরিষদ অভ্যন্তরে দাঙ্গা। ২৩শে সেপ্টেম্বর দেশবাসী অধিবেশন নাটকের উপসংহার অবলোকন করেন, ভারপ্রাপ্ত স্পিকার শাহেদ আলী পরিষদ অভ্যন্তরেই মারাত্মকভাবে আহত হন এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর (১৯৫৮) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয় এবং ইহার যবনিকাপাত ঘটে ৭ই অক্টোবর দেশব্যাপী সামরিক শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে।

ইস্কান্দার মীর্জার অপসারণ

আওয়ামী লীগ ১৯৫৯ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাকাপাকি বোঝাপড়ার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূনের কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। তদানুযায়ী ১৫ই ফেব্রুয়ারি (১৯৫৯) সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ধার্য হয়। ক্ষমতা পিপাসু আওয়ামী লীগ ২রা অক্টোবর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় যোগ দেয় এবং দফতর বন্টন বিষয়ে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ মন্ত্রীবর্গ ৭ই অক্টোবর (১৯৫৮) পদত্যাগ করে। ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা স্বীয় করাচি বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী নূন ও তাহার মন্ত্রীদের মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গ এক পার্টিতে আমন্ত্রণ জানান। উপস্থিত আমন্ত্রিত মন্ত্রীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় মন্ত্রীবর্গ ছিলেন। ৭ই অক্টোবর মধ্যরাত্রিতে ইস্কান্দার মীর্জা বিশেষ ঘোষণায় সমগ্র দেশব্যাপী সামরিক আইন ঘোষণা করেন; কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করেন, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিল করেন, সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করেন ও সংবিধান রহিত করেন এবং সেনাধ্যক্ষ জেনারেল মোঃ আইউব খানকে প্রধান সামরিক শাসনকর্তা নিয়োগ করেন।

সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে সোহরাওয়ার্দী-গুরমানী সমঝোতা বা আঁতাত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে শঙ্কিত করিয়া তুলিয়াছেন। তাই প্রেসিডেন্ট মীর্জা নির্বাচন বানচাল করিবার ফিকিরে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ ব্রহ্মদেশে সেনাপতি জেনারেল নে উইনের সামরিক ক্ষমতা দখল প্রেসিডেন্ট মির্জাকে অভীষ্ট সিদ্ধির সহজ পথটি বাতলাইয়া দেয়। কালাত রাজ্যের শাসক মীর আহমদ ইয়ার খান কর্তৃক পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেওয়ার ঘটনাকে অস্বীকার করিয়া কালাতের স্বাধীনতা ঘোষণা, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলাকালে পরিষদে মারামারি ও হাতাহাতি এবং পরিষদের ভারপ্রাপ্ত স্পিকার পরিষদ মিলনায়তনে আঘাত জনিত কারণে হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ, পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ ভাঙ্গিয়া সাবেক প্রদেশগুলোর পুনর্বহালের জোর আন্দোলন ও প্রচেষ্টা, প্রাদেশিক পরিষদগুলিতে মন্ত্রীত্ব লোভে সীমাহীন নির্লজ্জ তৎপরতা, জাতীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা এবং তদসমর্থক পরিষদ সদস্য ও দলীয় কর্মীদের বলগাহীন দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ, ১৯৫৭ সালের ৯ই মে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে ডাঃ খান সাহেবের মৃত্যুবরণ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্তৃক সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত ইত্যাকার ঘটনা সমগ্র দেশে এক উশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রাসাদ চক্রান্ত রাজনীতির পাকা খেলোয়াড় প্রেসিডেন্ট মীর্জা ইহারই পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। বলাই বাহুল্য, দেশে সামরিক শাসন জারি করিয়া স্বীয় ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠার জঘন্য পদক্ষেপ গ্রহণ ছিল তাহার পূর্ব পরিকল্পিত। কেননা, প্রেসিডেন্ট মির্জা উপরোল্লিখিত ঘটনাবলীর নেপথ্য নায়ক। কিন্তু ইহা ভাগ্যেরই নিমর্ম পরিহাস বলিতে হইবে যে, শেষ পর্যন্ত এই প্রেসিডেন্ট মীর্জাকেই ২৭শে অক্টোবর (১৯৫৮) জেনারেল আইয়ুব খানের নিকট সমগ্র দায়িত্ব অর্পণ করিয়া দেশত্যাগী হইতে হয়। কে জানিত যে, রাজনীতিবিদদের দিকে নজর রাখিয়া একদা তিনি যে ‘While the going is good’ অর্থাৎ দেশত্যাগই শ্রেয়ঃ বলিয়া বক্রোক্তি করিয়াছিলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে তাহা তাঁহার বেলায় প্রযোজ্য হইবে। ষড়যন্ত্রের শিরোমণিকে পাল্টা ষড়যন্ত্রই চরম আঘাত হানে। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দানকালে বিরোধী দলীয় নেতা সরদার বাহাদুর খান এই চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করিয়াছিলেন যে, “মার্কিন সরকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দেশে সামরিক আইন জারি করিতে বাধ্য করে।” অথচ ইস্কান্দার মীর্জার পদচ্যুতির সময় মার্কিন সরকার নীরব দর্শক ছিলেন মাত্র। আবার সাধারণ নির্বাচন বানচাল করার ব্যাপারে ইস্কান্দার মীর্জার প্রয়াসে মদদ জোগাইয়া সোহরাওয়ার্দীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করিতে মার্কিন সরকার সামান্যতম ইতস্ততঃ করেন না। ইহাকেই বলে “বড়র পিরীতি বালির বাঁধ!” বিশ্বাসঘাতকতা ও হতাশাই অসম প্রেমকে ক্ষতবিক্ষত করে। মান যায়, জাতি যায়, কুল যায় কিন্তু আরাধ্যজনের কৃপার দেখা পাওয়া যায় না। সহজ সরল চিরন্তন সত্য নেতা সোহরাওয়ার্দী অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন। মার্কিন প্রেমে মশগুল হয়ে সোহরাওয়ার্দী আরব জাহান, মুসলিম জাহান ও তৃতীয় বিশ্বের কঠোর সমালোচনার পাত্রে পরিণত হইতেও দ্বিধা করে নাই। এমনকি স্বীয় জনগণের নিকটও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খুঁটি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। অদৃষ্টের আরো নির্মম পরিহাস এই সঙ্গে লক্ষণীয়, তোমার হাতে গড়া শেখ মুজিবুর রহমানকেও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নায়ক হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় সরকারের সাক্ষীগোপাল নায়কের অবাঞ্ছিত পরিচয় লইয়াই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে ধরাধাম হইতে বিদায় নিতে হইয়াছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ

প্রশ্ন উঠতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপরোল্লিখিত মারাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণে কেন উৎসাহিত হয়েছিল? প্রথমে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রকাশ্য ভূমিকা ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলুপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্য এবং গাফফার খান, কাইয়ুম খান, মমতাজ দৌলতানা, মিঞা ইফতেখার উদ্দীন, আইউব খুরো, জি, এম, সৈয়দ নেতৃত্বের সমঝোতার ফলে ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বদলে মার্কিন বিরোধী শক্তি কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থাৎ সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দ্বিতীয়তঃ যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হওয়ায় ভারতবিরোধী ভূমিকার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরিচালিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। উপরে বর্ণিত বাস্তব তথ্যাবলী, এই বিশ্লেষণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীয় স্বার্থে ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। তাই জননেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেয়ে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রতিভু জেনারেল আইয়ুব খান ও ইস্কান্দার মীর্জাই মার্কিন স্বার্থে অধিক প্রিয় হইয়া উঠিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে জনাব সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত পথ কন্টাকাপূর্ণ ও বিপজ্জনক ছিল। মার্কিন প্রভুর এই অভিপ্রায় ছাড়াও সেনাপতি মোঃ আইউব খান ও প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার ক্ষমতা দখলের ব্যক্তিগত অভিলাষ কি ছিল না? স্বার্থান্ধ, দুর্নীতিপরায়ণ ও দুর্বলচিত্ত নেতৃত্ব এইভাবে দেশ ও জাতিকে বৈদেশিক শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত করে। অর্থাৎ দেশ ও জাতি স্বনির্ভর না হইয়া পরনির্ভর হয়।

আগেই বলিয়াছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক চুক্তি মোতাবেক পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছে। ভূমণ্ডলীয় সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বার্থে এবং চীন-সোভিয়েট রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক শক্তি খর্ব করিবার প্রয়াসে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তাবেদার প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের আনুকূল্য মার্কিন শক্তি এভাবে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। তদানুসারে পেশওয়ারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মিত হয়। সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী এই সামরিক চুক্তি বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করলে মার্কিন সরকারের ভূমন্ডলীয় পরিকল্পনা পাকিস্তানের মাটিতে প্রচন্ড মার খাইবার আশংকা ছিল। এই ব্যাপারে বিশেষভাবে শঙ্কিত মার্কিন কূটনীতি পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন বানচালের ভূমিকা গ্রহণ করে এবং তাহাদের বশংবদ ইস্কান্দার মীর্জা ও সেনাপতি আইউব খানকে সক্রিয় সহায়তার দ্বারা সামরিক আইন প্রবর্তন করিতে প্ররোচিত করে।

৪৭-৫৭ দশকের দুর্নীতি

১৯৪৭ হইতে ১৯৫৭ এই এক দশকের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার, আধা সামরিক সরকার ইত্যাদি জগাখিচুড়ী উত্থান-পতনের অবসান ঘটে ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর মধ্যরাত্রির সামরিক অভ্যুত্থানে। প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের আস্থাশীল কায়েদে আযমের ইহলোক ত্যাগ অব্যবহিত পর হইতেই পাকিস্তানের ক্ষমতা দ্বন্দ্ব প্রসূত প্রাসাদ রাজনীতির উদ্ভব হয়। ১৯৫১ সালে মেজর জেনারেল আকবর খানের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান উচ্চাভিলাষী গোষ্ঠীর সম্মুখে ক্ষমতা দখল ও কুক্ষিগত করার নতুন দ্বার উন্মোচন করে। সামরিক-বেসামরিক আমলা সম্প্রদায় ও কায়েমী স্বার্থের রক্ষক প্রাসাদ রাজনীতিবিদ চক্র ক্রমশঃ বিদেশী শক্তির সাহায্য সহযোগিতায় ক্ষমতা লাভের বিনিময়ে সামরিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিদেশী শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীনে তুলিয়া দিতে থাকে। ঘটনার বিবর্তনে এবং ক্ষমতাসীনদের উত্থান-পতনে জনসাধারণ সরকার-বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে এবং অসহায় নীরব দর্শকে পরিণত হয়। শাসন-শোষণই ছিল রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের মূলমন্ত্র। দুর্নীতি ছিল মন্ত্ৰী, মেম্বার ও সরকারি আমলাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাহারা অবৈধ পথে প্রচুর ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করিয়া যোগ্যতা ও সততার কি অমূল্য নিদর্শন না ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন।

মুসলিম লীগ, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-মেম্বার, নেতা-উপনেতা দেশসেবার বদৌলতে ঢাকায় স্ব-স্ব বাড়ি-ঘর নির্মাণে অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দেন। ধানমন্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগ সদস্যদের নির্মিত ঘরবাড়ি সমূহ আওয়ামী লীগ করেনি আখ্যা পায়। ইহা আওয়ামী লীগ সরকারের অকৃত্রিম জনসেবার অতুলনীয় স্বাক্ষর বটে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নির্লজ্জ আচরণ সেক্রেটারিয়েটের মহাজন আমাদেরকে তাহাদের অবাঞ্ছিত পদাংক অনুসরণ করিতে উৎসাহিত করে এবং আমলা গোষ্ঠী সংখ্যাধিক্য বিধায় লুটপাটের সিংহভাগ তাহারা পায়। পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিস ভুক্ত সিভিল সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস, ফাইন্যান্স সার্ভিস ইত্যাদির অন্তর্গত কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের শতকরা ৯৫ জন ছিলেন দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাহারা চাকুরীর প্রথম জীবনে ছিলেন ৩ শত থেকে ৫ শত টাকা বেতনভুক্ত কর্মচারী। অথচ প্রশাসনিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার দ্বারা স্বীয় জীবন ভোগের উদগ্র বাসনায় চরম অসদুপায় অবলম্বনে তাহারা কোন সময়ই কুণ্ঠিত হন নাই এবং বিপুল অর্থোপার্জনের মাধ্যমে এই দেশে তাহারাই রামরাজত্ব কায়েম করিয়াছিলেন। ৩, ৪ অথবা ৫ বৎসরের চাকুরী জীবনে রাজধানী ঢাকা অথবা বন্দর শহর চট্টগ্রাম বা খুলনার বুকে সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ বা ক্রয়, শহরে, গ্রামে গঞ্জে জোত জমি ক্রয়, স্বীয় ব্যবহারের জন্য গাড়ি ক্রয়, ঠাঁট বজায় রাখিবার অতিরিক্ত জিনিসপত্র যথাঃ রেফ্রিজারেটর, দামি কার্পেট, ড্রইং রুম সেট, ডাইনিং হল সেট, সহধর্মিনীর শাড়ি-গহনা ক্রয়, দেশে-বিদেশে স্বনামে-বেনামে ব্যাংক ব্যালান্সের মোহ তাহাদের পাইয়া বসিয়াছিল। ৩ শত, ৫ শত এমন কি হাজার, দুই হাজার টাকা বেতনভোগী সরকারি কর্মচারীদের জীবনে এসব ছিল রূপকথার কাহিনী ন্যায়। পিতৃ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নগণ্য সংখ্যক সরকারি কর্মচারী ব্যতীত অধিকাংশের বেলায়ই ইহা ছিল অকাট্য সত্য। জীবন ও যৌবন ভোগের উন্মত্ত নেশায় তাহাদের সচেতন অপরাধ প্রবণতা জাতিকে দুর্নীতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে। এতদ বর্ণিত জাতিদ্রোহী, সমাজ দ্রোহী, জীবশ্রেণির বিরুদ্ধে যাহারা কণ্ঠকে সোচ্চার রাখিয়াছিলেন, তাহাদিগকে প্রশাসনিক ক্ষমতার দাপট এর শিকার হইতে হইত ও পুনঃ পুনঃ কারাবরণ ছিল তাহাদের জন্য অবধারিত। মাওলানা ভাসানীর বিশাল ব্যক্তিত্বকেও কি বার বার কারা নির্যাতনের ভোগ করিতে হইয়াছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের ইসলামী জীবনবোধ ও মূল্যবোধ বাস্তবায়নের স্বর্ণযুগ ছিল। মাওলানা ভাসানী সেই যুগের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি শাসন দন্ডের নায়কবৃন্দ যথা নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান, গোলাম মোহাম্মদ, ইস্কান্দার মীর্জা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ ইসলামী জীবন দর্শন নির্দেশিত জীবনবোধ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন পর্বতপ্রমাণ বাঁধা। তাহাদের বক্তৃতা-ভাষণ একদিকে ইসলামী জীবন দর্শনের গভীর তাৎপর্য ও ব্যবহারিক জীবনে উহার রূপায়নের খই ফুটিত এবং অন্যদিকে তাঁহারাই আবার মাওলানাকে ‘লুঙ্গি সর্বস্ব’, ‘ইসলামের শত্রু’, ‘পাকিস্তানি শত্রু’, ‘ভারতের চর’ ইত্যাদি হীন আখ্যায়িত করিতে সামান্যতম ক্লেশ বোধ করেন নাই।

জাতীয় চরিত্রের অবক্ষয়কালে জনগণ আদর্শচ্যুত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া আত্মশক্তি হারাইয়া ফেলে ও বহিঃশক্তির নিকট অবচেতন অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে। আত্মিক শক্তি পরাভব ও বিলুপ্তির এই সন্ধিক্ষণে ইস্কান্দার মীর্জা আইয়ুব খানের অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানান এবং এভাবে জনগণের সার্বভৌমত্বের অস্বীকৃতির উপর জেনারেল আইয়ুব খানের একনায়কত্বের ভিত রচিত হয়।

‘৫৮ সালের সামরিক শাসন

গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সর্বপ্রথম রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অভিযান ঘোষণা করিয়াছিলেন। তাহারই পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা, সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আইয়ুব খান ৭ অক্টোবর (১৯৫৮) দিবাগত মধ্যরাত্রিতে সর্বময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। জেনারেল আইয়ুব খান প্রধান সামরিক শাসনকর্তার দায়িত্বভার গ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান সফরে ঢাকা আগমন করেন ও ঢাকা স্টেডিয়ামে এক বিশাল জনসভায় ভাষণদান করেন। অনস্বীকার্য যে, দুর্নীতির দরুন লোকচোখে হেয় রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় দেওয়ার কারণে সামরিক অভ্যুত্থানে জনগণ সেই সময় আনন্দিত হয়েছিল এবং জেনারেল আইয়ুব খান সাধারণ লোকের প্রাণঢালা সমর্থনও লাভ করিয়াছেন। জেনারেল আইয়ুব খান ঢাকা অবস্থানকালেই ২৪শে অক্টোবর (১৯৫৮) প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা জেনারেল আইউব খানকে ১২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেন এবং লেঃ জেঃ মুসাকে জেনারেল পদে উন্নীত করিয়া প্রধান সেনাপতির পদ দান করেন। ২৭শে অক্টোবর সকাল ১০টায় জেনারেল আইউব খান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। দিবা অবসানের কিয়ৎকালের মধ্যে লেঃ জেঃ আজম খান, লেঃ জেঃ কে, এম, শেখ, লেঃ জেঃ ডবলিউ, এ, বাকী প্রেসিডেন্ট মীর্জার সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাহাকে পদত্যাগ পত্র সহি করিতে বাধ্য করেন। পদত্যাগপত্র সহি করিয়া সস্ত্রীক লন্ডনের পথে রওয়ানা হবার পূর্ব কাল পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ কোয়াটা সার্কিট হাউসে ইস্কান্দার মীর্জা কালযাপন করিতে বাধ্য হন।

সামরিক শাসন প্রবর্তিত হবার অব্যবহিত পরেই গভর্নর সুলতান উদ্দিন আহমদ এর স্থলে পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ জাকির হোসেন গভর্নরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং কালাবাগের নওয়াব পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন।

সামরিক শাসন জারির কিছুকালের মধ্যে জাতীয় নেতা মাওলানা ভাসানীসহ শত শত দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হন। ১২ অক্টোবর (১৯৫৮) মওলানা ভাসানী কারারুদ্ধ হইলেন এবং ১৯৫৯ সালের ৬ই অক্টোবর হইতে ১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় সরকারি ভাড়া বাড়িতে অন্তরীণ রহিলেন। তাহার স্ত্রী ও সন্তানগণ সরকারি খরচে তাহার সহিত অবস্থান করিতেন। সাবেক দুর্নীতি দমনমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ১৯৫৮ সালের East Pakistan Act L X X II/38 -এর VA ও Act II/47 এর 5 (2) ইত্যাদি দুর্নীতি দমন ধারা বলে ১২ই অক্টোবর (১৯৫৮) গ্রেফতার হন এবং ২০শে অক্টোবর কারান্তরালে অবস্থানকালেই বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্সের বলে তাঁহাকে নিরাপত্তা বন্দি করা হয়। তিনি ১৯৫৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিলাভ করেন। যদিও নিম্ন আদালত তাহার বিরুদ্ধে আনীত ৯টি মামলার মধ্যে ৮টি বাতিল করিয়া দিয়াছিল; তবুও ঢাকা জেলা ও সেসন জজ (পদাধিকার বলে সিনিয়র স্পেশাল জজ) এ, মওদুদ সাহেব ১২ই সেপ্টেম্বর (১৯৬০) তাঁহার দেয় রায়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত শেখ মুজিবর রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া দুই বৎসর বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ৫০০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাস অতিরিক্ত কারাদন্ড প্রদান করেন। উক্ত সাজার বিরুদ্ধে আপিল করিলে ঢাকা হাইকোর্ট ‘সন্দেহের অবকাশ আছে’ যুক্তিতে বিশেষ আদালতের রায়কে নাকচ ঘোষণা করে।

সামরিক শাসন প্রবর্তনের স্বল্পকালের মধ্যেই আমি চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৭৭/এ, আসাদগঞ্জ ঠিকানায় চট্টগ্রাম নিবাসী ব্যবসায়ী শেখ নজমুল হকের সহিত পার্টনারশীপ ব্যবসা আরম্ভ করি। আমাদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল এম, কর্পোরেশন, সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দার ভয়ে আমাদের ব্যবসায়ী অফিসে ক্রেতা-বিক্রেতা আসিতে দ্বিধাবোধ করিত। আমার পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক কারণে অসুবিধা হইত কিন্তু তাহারা এতই সজ্জন ছিলেন যে, কখনও ভুলক্রমেও ক্ষোভ প্রকাশ করিতেন না। আমি কৃতজ্ঞতার সহিত তাহাদের স্মরণ করি। ১৯৫৮ সালের (অক্টোবর) সামরিক শাসনের প্রথম পর্যায়ে ব্যবসায়ী শ্রেণির উপর গজব নাজেল হইতে শুরু করে। সামরিক বিভাগীয় উর্দি পরিহিত নওজোয়ান বা অফিসারের আকস্মিক সাক্ষাৎ-এ সাধারণ লোকের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়। এই ভয়াল পরিস্থিতিতে ছাপোষা ব্যবসায়ী শেখ নাজমুল হক কর্তৃক আমাকে ব্যবসায়িক পার্টনার করাটা যে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল আমি তাহা কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করি। এই ব্যবসা পরিচালনাকালেই সরকার বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স বলে আমাকে ১৯৫৯ সালে আমার শ্রদ্ধেয়া জ্যেষ্ঠা ভগ্নির বাসা হইতে গ্রেফতার করিয়া চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে বন্দি করে।

পূর্ব পাকিস্তান সামরিক আইন শাসনকর্তা মেজর জেনারেল ওমরাও খানের প্রাইভেট সেক্রেটারি মেজর আনিসুজ্জামান সামরিক শাসনকর্তার আদেশে চট্টগ্রাম কারাগারে আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর মেজর আনিসুজ্জামান তাহার প্রতিপাদ্য বিষয়ের অবতারণা করিয়া বলেন, সামরিক শাসন নির্দলীয় শাসন। কর্তৃপক্ষ আপনার সহযোগিতা কামনা করেন। তদুত্তরে তাহাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম, সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে সামরিক শাসন প্রবর্তন জনগণের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালের ষড়যন্ত্রের ফল। সুতরাং সামরিক কর্তৃপক্ষের সহিত সহযোগিতার প্রশ্ন অবান্তর। তদুপরি কারারুদ্ধ অবস্থায় কোন প্রকার আলোচনায় অংশগ্রহণ মর্যাদা হানিকর। আমার স্পষ্টোক্তিতে ক্ষুব্ধ ও নিরুৎসাহিত মেজর আনিসুজ্জামান বিষন্ন বদনে কারাগার কার্যালয় হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। অবশ্য মেজর সাহেব সহজে হাল ছাড়িবার পাত্র ছিলেন না। পরদিন চট্টগ্রাম জেলা কারাগার সুপারিনটেনডেন্ট কাইয়ুম উদ্দিন সাহেব আমার সহিত দেখা করিয়া জানান, “আপনি আলোচনা করিতে সম্মত হইলে মেজর আনিসুজ্জামান পুনরায় আপনার সহিত জেল গেটে দেখা করবেন।” প্রত্যুত্তরে সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছিলাম, “বন্দি অবস্থায় সামরিক শাসনকর্তা প্রেরিত প্রস্তাব বিবেচনা করা দূরে থাকুক, আমি শুনিতেই রাজী নই।”

মাসাধিককাল পর আমি চট্টগ্রাম জেলা কারাগার হইতে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত হই।

আইউবের স্টিম-রোলার

জনগণের সার্বিক সার্বভৌম অধিকার হরণ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবী কৃতিত্বে অনুচর ও পরিষদবর্গ এতবেশি বিমুগ্ধ ও বিমোহিত হইয়া পড়িয়াছিল যে, মন্ত্রীসভার সহযোগিতায় তাহারা কিছুকালের মধ্যেই জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খানকে ফিল্ড মার্শাল পদে অভিষিক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনী ছিল আইউবের ক্ষমতার মূল উৎস এবং সেনাবাহিনীর সহিত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখিবার উপরই নির্ভরশীল ছিল তাহার প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্য। পদাধিকার বলেই একজন ফিল্ড মার্শাল সেনাবাহিনীর সহিত আমৃত্যু সম্পর্ক রাখিতে পারেন। কালবিলম্ব না করিয়া ফিল্ড মার্শাল পদ গ্রহণের পূঢ় রহস্য সহজেই অনুধাবনীয়।

 ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই দুনীতি, কর্মবিমুখতা, অদক্ষতা ও শৃঙ্খলা বিরোধী আচরণের অজুহাতে আইয়ুব খান সরকার পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের ১২ জন অফিসার, ৮৪ জন উচ্চপদস্থ প্রথম শ্রেণির চাকুরে ও আড়াই হাজার নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করেন। তদুপরি পাবলিক অফিস ডিস কোয়ালিফিকেশন অর্ডিন্যান্স (PO.D.O.) জারি করিয়া মন্ত্রী ও আইন পরিষদ সদস্যদের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। উল্লিখিত অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বিচারে যদি কেহ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হন তাহা হইলে ইলেকটিভ বডিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী অপরাধী ব্যক্তি ১৯৬৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন নির্বাচনে প্রার্থী হইতে পারিবেন না। স্মর্তব্য যে, বিচারপতি আকরমের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সর্বজনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবু হোসেন সরকার সকল অভিযোগ অস্বীকার করা সত্ত্বেও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা হইতে বঞ্চিত হন এবং জনাব আতাউর রহমান খান অর্ডিন্যান্সের শর্ত অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ মানিয়া লইয়া ট্রাইব্যুনাল মোকাবিলা করা হইতে অব্যাহতি লাভ করেন।

আগেই বলিয়াছি, সামরিক শাসন জারি হওয়ার সাথে সাথে কয়েক হাজার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী কারাগারে নীত হইয়াছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে গ্রেফতারকৃত রাজবন্দিদের উপর চালান হয় অকথ্য নির্যাতন। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির দফতর সম্পাদক জনাব হাসান নাসিরকে ১৯৬০ সালের ৮ই আগস্ট করাচি কারাগারে আটক করা হয়। নির্মমতম দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় লাহোর দুর্গে ১৯৬০ সালের ১৩ই নভেম্বরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সীমান্ত প্রদেশে প্রায় তিন হাজার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী কারাবরণ করেন এবং রাজবন্দিদের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়। কোয়েটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ৪শত জন বেলুচীকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পায়ে দড়ি বাধিয়া টাঙ্গাইয়া রাখা হয় ও মাঝে মাঝে তাহাদের তড়িতাঘাত করা হয়। সিন্ধু প্রদেশের হায়দারাবাদ কারাগারে ৭ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

আইউব খান আয়কর ফাঁকিদাতা, বৈদেশিক মুদ্রা পাচারকারী ও সীমান্ত পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন; ফলে এক কোটি ষাট লক্ষ স্টার্লিং বৈদেশিক মুদ্রা ও সমুদ্র তীর হইতে দুই টন স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ভুমি ব্যবস্থা সংস্কার করিয়া জলসেচ সুবিধাপ্রাপ্ত জমির ক্ষেত্রে পাঁচশত একর ও জল সেচ ব্যবস্থা হীন জমির ক্ষেত্রে এক হাজার একর সর্বোচ্চ জমি মালিকানা নির্ধারণ করিয়া দেওয়া হয়। সরকারি বন্ডের বিনিময়ে জমিদারী উচ্ছেদ ও বিনা খেসারতে জায়গাসমূহের বিলুপ্তি ঘটানো হয়।

রাজধানী স্থানান্তর, আস্থা ভোট গ্রহণ

প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রাখার প্রয়াসে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী করাচি থেকে সেনাবাহিনীর সাধারণ সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডি স্থানান্তরিত করেন। তাহাদের ক্ষমতা গ্রহণের পিছনে জনসাধারণের অনুমোদন আছে, ইহা বিশ্বকে বুঝাইবার নিমিত্ত প্রেসিডেন্ট ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সমগ্র পাকিস্তানে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং নির্বাচিত ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যদের নিকট হইতে ১৯৬০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ‘আস্থা’ ভোট গ্রহণ করেন। সামরিক আইনবিধি অনুযায়ী ভোট দাতাগণের ‘হ্যা’ বা ‘না’ বলার ক্ষমতা ছিল মাত্র এবং প্রেসিডেন্ট আইউব উক্ত ব্যবস্থাপনায় বিপুল হ্যা সূচক আস্তাভোট আদায় করিতে সমর্থ হন।

“হ্যা” ভোট প্রাপ্তির পর ১৯৬০ সালে ১৭ই ফেব্রুয়ারি দেশের সংবিধান প্রণয়নকল্পে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে কনস্টিটিউশন কমিশন গঠন করা হয়। পূর্ব পাক হাইকোর্টের এডঃ জেনারেল জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী (পরবর্তীতে হাইকোর্ট বিচারপতি ও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) ও চট্টগ্রামের ও, আর, নিজাম উক্ত কমিশনের অন্যতম সদস্যবৃন্দ ছিলেন। কনস্টিটিউশন কমিশন ১৯৬১ সালের মে মাসে রিপোর্ট দাখিল করেন। সেই রিপোর্ট মোতাবেক দেখা যায়, কমিশন ৬২৬৯ প্রশ্নোত্তর পায় ও ৫৬৫ জনের ইন্টারভিউ নেয়। সরকার পদ্ধতি, পার্লামেন্টারি পদ্ধতির পক্ষে শতকরা ২১.৩, গুরুতরভাবে সংশোধিত পার্লামেন্টারি পদ্ধতির পক্ষে শতকরা ২৯.৩, প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির পক্ষে শতকরা ৪৭.৪ আর খিলাফত পদ্ধতির পক্ষে শতকরা ২, রাষ্ট্রকে ফেডারেল করিবার পক্ষে শতকরা ৬৫.৫ ও ইউনিটারী করিবার পক্ষে শতকরা ৩৪.৫, শক্তিশালী কেন্দ্র (Strong Center) পক্ষে শতকরা ৬১.৫ ও দেশরক্ষা, বিদেশনীতি, মুদ্রা তিন বিষয় (Strong Center) পক্ষে শতকরা ৬১.৫ ও দেশরক্ষা, বিদেশনীতি, মুদ্রা তিন বিষয় কেন্দ্রীয় সরকার পক্ষে শতকরা ৩৮.৫, কমিশন রিপোর্ট অদুযায়ী ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ এক প্রভুত্বব্যঞ্জক সংবিধান দেশ ও জাতির উপর চাপাইয়া দেওয়া হয়।

আইউবের উন্নয়নমূলক কাজ

প্রেসিডেন্ট আইউব স্বীয় শাসন আমলে ভোটাধিকার প্রশ্নে মতামত দানের জন্য ফ্রেঞ্চাইজ কমিশন, খাদ্য ও কৃষি সম্বন্ধে সুপারিশ করিবার জন্য ফুড এন্ড এগ্রিকালচার কমিশন, ভূমি ব্যবস্থার জন্য ল্যান্ড রিফরম কমিশন, শিক্ষা বিষয়ে এডুকেশন কমিশন, চিকিৎসা সম্পর্কে মেডিকেল রিফরমস কমিশন, বিজ্ঞান বিষয়ে সাইন্টিফিক কমিশন, সংবাদপত্র বিষয়ে প্রেস কমিশন, ব্যাংক বিষয়ে ক্রেডিট ইনকোয়ারী কমিশন, বিবাহ ও পারিবারিক বিষয়ে মেরিজ এন্ড ফ্যামিলী ল’জ কমিশন, সরকারি চাকুরী বিষয়ে পে এন্ড সার্ভিসেস কমিশন, সামাজিক বিষয়ে সোশ্যাল ইভিলস ইন্ডিকেশন কমিশন, ফেডারেল রাজধানী সম্পর্কে ফেডারেল ক্যাপিটাল কমিশন’, দ্রব্য মূল্য বিষয়ে প্রাইস কমিশন, সমুদ্র বাণিজ্য বিষয়ে মেরিটাইম কমিশন, বস্ত্র শিল্প বিষয়ে টেক্সটাইল কমিশন, পাট বিষয়ে জুট ইনকোয়ারী কমিশন, জাতীয় আয় বিষয়ে ন্যাশনাল ইনকাম কমিশন, খেলাধুলা ইত্যাদি সম্পর্কে স্পোর্টস, কালচারাল, ইয়ুথ মুভমেন্ট এন্ড আর্টস ইনকোয়ারি কমিটি, সিনেমা বিষয়ক ফিল্ম ইনকোয়ারী কমিটি, আইন বিষয়ে ‘ল’ রিফরমস কমিশন, ইত্যাদি বিভিন্ন কমিশন ও কমিটি গঠন করেন এবং এই সবের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রকট সমস্যার সমাধান নির্ণয় মানসে দেশীয় ও বিদেশী মেধার সহায়তা গ্রহণ করেন। এইভাবে তাহার দ্বারাই দেশব্যাপী উন্নয়নের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ক্রমবিকাশের দ্বার উন্মুক্ত হয়।

ইত্তেফাকের ঐতিহাসিক ভূমিকা

রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ছিল বিধায় জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও সমস্যাবলী তুলিয়া ধরিবার মাধ্যম ছিল সংবাদপত্র। কিন্তু সামরিক শাসনকর্তাদের হামলার ভয়ে কোন পত্রিকা অবাধে সংবাদ ও মতামত প্রকাশ করিত না। এমনি নাজুক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দৈনিক ইত্তেফাক দুঃসাহসের উপর ভর করিয়া সামরিক শাসনকে লেখার মারপ্যাচে সমালোচনা করিতে শুরু করে। অন্যান্য দৈনিক সংবাদপত্রগুলো সযত্নে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা এড়িয়ে চলিত। দৈনিক সংবাদ এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর আহমাদুল কবির স্বীয় স্বভাবসুলভ পথেই সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের বশংবদ পাত্রে পরিণত হন এবং গভর্নর জাকির হোসেন কর্তৃক গঠিত শিল্প উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যপদ গ্রহণ করিয়া স্বীয় তরক্কির রাজপথ খোলাসা করিয়া লন। ইত্তেফাকের সমালোচনার আঁচড় সহ্য করিতে না পারিয়া সামরিক শাসনকর্তা সেই অন্ধকার যুগে আশার আলোকবর্তিকা ইত্তেফাক সম্পাদক নির্ভিক তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়াকে ১৯৫৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করেন এবং সামরিক আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারে তাহাকে দণ্ডাদেশ দেন। ভবিষ্যতে লেখনীতে সতর্কতা অবলম্বন করবে এই মর্মে লিখিত আশ্বাস দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নির্দেশে সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ইহা সর্বজনবিদিত যে, কারামুক্তির পরও মুসাফিরের লেখনীতে বিশেষ কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় নাই। ছদ্মনাম ‘মোসাফির’ লিখিত পোস্ট এডিটোরিয়াল ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ জেল রাজবন্দিদের জন্য সঞ্জীবনী সুধাবৎ ছিল। ইহা স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কত্ববাদীর বিরুদ্ধে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সংগ্রামের অন্যতম দৃষ্টান্ত ছিল। উক্ত প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য প্রেরণায় উৎস হইয়া থাকিবে।

গভর্নর পদে আজম খান

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রধান এবং বেসামরিক গভর্নর-এর মধ্যে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগে জটিলতা ও দ্বন্দ্ব নিরসনকল্পে জাকির হোসেনের স্থলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক উন্নয়নে গভর্নর লেঃ জেঃ আজম খানের আন্তরিকতা ও গতিশীল নেতৃত্ব বাঙ্গালি হৃদয়কে মুগ্ধ ও অভিভূত করে। আজম খানের বিদায় গ্রহণকালে তার কর্মক্ষমতা, সততা ও আন্তরিকতা বিমুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ বাঙ্গালি জাতি অশ্রুসিক্ত নয়নে ও ব্যথা বিধুর হৃদয়ে তাহাকে বিদায় দেয়। ইহা এক মর্মস্পর্শী মুহূর্ত। উর্দুভাষী আজম খানের খাটি দেশপ্রেম ও বাঙ্গালি জাতির মহত্ব একই প্রস্রবণ হইতে উৎসারিত। মানবীয় গুণাবলীর ফল্লুধারা একই স্রোতস্বিনীর শাশ্বত স্রোতধারায় প্রবাহিত হইয়া একই মহামানবের সাগরে লীন হইয়াছে। ইহাই সত্য, ইহাই সনাতন। ব্যতিক্রম মনুষ্য চরিত্রের বিকৃত রূপমাত্র।

১৯৬০ সালের ১০ই ও ৩১শে অক্টোবর উপর্যুপরি দুইটি ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে বন্দর নগর চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ ধ্বংসস্তৃপে পরিণত হয়। উক্ত দুর্যোগ মুহূর্তে ত্রাণ তৎপরতায় গভর্নর আজম খানের কর্মদক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততা বাঙ্গালি মনেপ্রাণে বিস্ময়করভাবে অভিভূত করে।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণ

ভারত-পাকিস্তান তিক্ত সম্পর্ক জন্মলগ্ন হতেই বিদ্যমান ছিল। কাশ্মীর সমস্যা উক্ত তিক্ত সম্পর্কে সহজতর হইতে দেয় নাই। ইহার সহিত যুক্ত সিন্ধুনদ পানি সমস্যা। পাকিস্তানে প্রবাহিত পানির উৎস ছিল ভারতভুক্ত কাশ্মীরে। পাকিস্তানে পানি সরবরাহ অব্যাহত রাখিবার উদ্দেশ্যে বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬০ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর করাচিতে ‘দি ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি’ বা সিন্ধুনদ পানি চুক্তি স্বাক্ষর করিয়া ভারত-পাকিস্তান সম্ভাব্য সংঘর্ষের একটি জটিল কারণ নিরসন ঘটাইতে সমর্থ হন। উক্ত একই পথে পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতীয় সীমান্তে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ তথা ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানি প্রত্যাহার জনিত মারাত্মক সমস্যার সমাধান করা হয়তো সম্ভব ছিল অথচ তাহা হয় নাই। ইহা না হইবার একমাত্র কারণ ছিল যে, তদানীন্তন শাসকবর্গের চোখে পশ্চিম পাকিস্তান পাকিস্তান বলিয়া বিবেচিত হইত। অতএব তাহাদের নিকট পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলী সমাধান অগ্রাধিকার পাইত। পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষি উৎপাদন রক্ষা ও বৃদ্ধিকল্পে জলবদ্ধতা ও লবণাক্ততা মোকাবেলা করিবার প্রয়োজনে পাকিস্তান সরকার মার্কিন কারিগরি সাহায্যসহ পাঁচ শত নব্বই কোটি টাকা ব্যয় করেন কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণের তেমন কোন ব্যবস্থা তাহারা গ্রহণ করে না। বৈমাত্রেয় সুলভ ব্যবহার আর কাহাকে বলে।

আইউবের বৈদেশিক নীতি

বৈদেশিক নীতি এর ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জোটে অঙ্গীভূত থাকিয়াও প্রেসিডেন্ট আইউব কমিউনিস্ট রাশিয়ার সহিত ১৯৬১ সালের ৩রা এপ্রিল তৈলানুসন্ধান চুক্তি সম্পাদন করেন এবং ১৯৬১ সালের ৩রা মে কমিউনিস্ট চীনের পাক-চীন সীমান্ত নির্ধারণ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এমন কি ১৯৬২ সালের ২৩শে মে কমিউনিস্ট চীনের অর্থনৈতিক সাহায্যদানের প্রস্তাবও পাকিস্তান সানন্দে গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী দুই বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত রাশিয়া ও মহাচীনের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস সত্ত্বেও পাকিস্তানের মাটিতে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশোয়ারের নিকট কারবেটে স্থাপিত মার্কিন সামরিক বিমান ঘাঁটি বিদ্যমান ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত মার্কিন ইউ-২ বিমান ১৯৬০ সালের ১লা মে এই ঘাঁটি হইতে উড্ডয়ন করে এবং সোভিয়েট ভূমিতেই সোভিয়েট সামরিক শক্তি কর্তৃক ভূপাতিত হয়। ইহার ফলে রাশিয়ার সহিত পশ্চিমা শক্তির সম্পর্ক এতই তিক্ত হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৬ মে (১৯৬০) প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রপ্রধান চতুষ্টয়ের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার, সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমিলান ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দ্য গলে) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। সোভিয়েট রাশিয়া প্রেসিডেন্ট আইউব খান সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেয় যে, দ্বিতীয়বার পাকিস্তানের মাটি থেকে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে বিশ্ব মানচিত্র থেকে পাকিস্তানকে চিরতরে মুছে দেওয়া হইবে। কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করিয়া বিশেষতঃ ১৯৬০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি মনোনীত বিজয়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন, এফ, কেনেডি কর্তৃক ভারত ঘেঁষা নীতি অবলম্বনের আশঙ্কায় শঙ্কিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পররাষ্ট্র নীতিতে অত্যন্ত সতর্কতার সহিত ও অতি ধীরে মার্কিন তাবেদারী হইতে মুক্ত হইবার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে; এতদসত্ত্বেও ১৯৬১ সালের ১১, ১২ ও ১৩ জুলাই প্রেসিডেন্ট আইউবের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারে ১৯৫৯ সালের ৫ই মার্চ স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ঘোষিত পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিহিত বক্তব্যের পুনরুল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানকল্পে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংয়ের মধ্যে কয়েক দফা ব্যর্থ আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

যাহা হউক, সামরিক শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জোটবদ্ধ হইতে উৎসাহিত করে। প্রভূত্ব ব্যঞ্জক সরকারের অবসানের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দীর ঐক্য প্রচেষ্টায় ভীত হইয়া প্রেসিডেন্ট আইউব খান ১৯৬২ সালের ৩০শে জানুয়ারি করাচিতে তাহাকে গ্রেফতার করেন। ১৯৬২ সালের ১৯শে আগস্ট জনাব সোহরাওয়ার্দী বন্দিশালা থেকে মুক্তি লাভ করেন।

ছাত্র বিক্ষোভ

জনাব সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১লা ফেব্রুয়ারি (১৯৬২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৬ ও ৭ই ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভের মুখে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। ৬ই ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনকে (মানিক মিয়া) আবার কারারুদ্ধ করা হয় এবং ৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। তাহারা ছাড়াও জনাব আবুল মনসুর আহমদ (প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী) বন্দি হন। ছাত্র আন্দোলন দাবানলের ন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে। আইউব বিরোধী ছাত্র বিক্ষোভ প্রশমিত করিবার জন্য অসংখ্য ছাত্র, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালে আমি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালে অসুস্থ ছিলাম। দুঃখের হলেও বলতে হয়, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছাত্র কর্মীরা সামরিক সরকারের নিকট মুচলেকা সহি করিয়া কারামুক্তি গ্রহণ করে। উক্ত গর্হিত কাজের অন্যতম প্ররোচক ছিলেন রাজশাহী মোক্তার বার সদস্য ও ১৯৫৪ সালে নির্বাচিত আইন পরিষদ সদস্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা আতাউর রহমান। প্রসঙ্গতঃ ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন প্রবর্তন কারী প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক এই আতাউর রহমান রাজশাহী জেলার গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, জনাব আতাউর রহমান নিজেই ১৯৫১ সালে তদানীন্তন নুরুল আমিন সরকারের আমলে বন্ড বা মুচলেকা সহি করিয়া কারামুক্তি লাভ করিয়াছিলেন।

নতুন সংবিধান: নির্বাচন

ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ কিছুটা স্তিমিত হইতেই ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান নতুন সংবিধান জারি করেন এবং সংবিধান মোতাবেক এপ্রিল মাসের ২৮ তারিখ জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ও মে মাসের ৬ তারিখ প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রদের চাপে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হইতে বিরত থাকেন অর্থাৎ নেতৃত্বদানের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হন। ইহাতে আর যাহাই থাকুক, রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় যে ছিল না ইহা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। পক্ষান্তরে রাজনীতিবিদদের অপর একটি অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায়; প্রত্যক্ষ ক্ষমতাহীন জাতীয় পরিষদ মঞ্চ হইতেও দেশবাসীর বক্তব্য যথার্থভাবে উপস্থিত করা যে সম্ভব হইয়াছে, তাহা এক ঐতিহাসিক সত্য। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সভাপতি তমিজ উদ্দিন খান, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া), মশিউর রহমান, পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী রমিজ উদ্দিন আহমদ, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুস সবুর খান, আবদুল মোনায়েম খান, পশ্চিম পাকিস্তানের সরদার বাহাদুর খান, সিন্ধুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীদ্বয় গোলাম আলী তালপুর ও কাজী ফজলুল্লাহ প্রমুখ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাত নেতা যথা-পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন, আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, মাহমুদ আলী, পীর মোহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিঞা) ১৪ এপ্রিল (১৯৬২) আইউব সংবিধান ও তৎকালীন নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করিয়া সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করেন। ২৮শে এপ্রিল যথারীতি জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ৮ই জুন রাওয়ালপিন্ডিতে নব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসে। বিরোধী দলীয় সদস্য জনাব তমিজউদ্দিন খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার এবং জনাব আফজাল চীমা ও আবুল কাশেম ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। পাক পিপলস গ্রুপ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও কতিপয় স্বতন্ত্র জাতীয় পরিষদ সদস্য ২৪শে নভেম্বর (১৯৬২) রাওয়ালপিন্ডিতে এক সভায় ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় পরিষদে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬শে নভেম্বর সভায় পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) নেতা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সর্দার বাহাদুর খান সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ৩রা আগস্ট (১৯৬২) অনুষ্ঠিত সভায় এডভোকেট আফসার উদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করিয়া এগার সদস্যবিশিষ্ট সাব কমিটি গঠন করা হয়। ৪ঠা আগস্ট জনাব আফসার উদ্দিন আহমদকে নেতা নির্বাচিত করিয়া পরিষদে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক গ্রুপ গঠন করা হয়। একই তারিখে আইয়ুব সরকারের সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পিপলস ডেমোক্রেটিক গ্রুপ গঠিত হয়।

প্রেসিডেন্ট আইউবের জারিকৃত সংবিধান অগ্রহণীয় ঘোষণা করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ৯ জন নেতা ২৪শে জুন (১৯৬২) নিম্নলিখিত এক যৌথ বিবৃতিতে সার্বজনীন ভোটাধিকারে নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নের আহ্বান জানান:

1. Rule by Martial Law has at last been ended. The political gloom that enveloped the country for long 45 months has been partially lifted. Door of progress towards a democratic system to be in the process of opening; but democracy has yet to come. The Constitution promulgated by Field Marshal Ayub Khan only holds out a hope but does not usher it.

2. The main subject that agitates public mind deeply today is again the Constitution of the country. This was the main topic during the recent elections though the election was limited to a small section of the people. Practically every candidate pledged his support for getting a democratic Constitution. During the last weeks since election the volume of opinion for a workable Constitution has increased considerably.

3. We will be failing in our duty if we do not express ourselves on this vital question through the only means available to us; we believe, in this, we share the opinion held by most in the country,

4. The country can make real and abiding progress through the method of evolution and by changes peacefully brought about. This can happen only where free debate and free discussion are fully assured.

A durable and abiding Constitution is the pre-condition for national consolidation and stability.

5. We are convinced that no durable constitution can be adopted unless it is framed by the direct Representatives of the people.

WE SAY SO BECAUSE

6. Whatever type of Constitution is drawn up, it has to be democratic both in form and spirit. In a democracy, sovereignty belongs to the people. All authority must emanate from the people. Anything to be stable and enduring must in the first place by the expression of the will of the people.That will must be a collective will, an organised will, and such as is freely expressed without any let or hindrance, direct or indirect.

7. A Constitution is framed with a view that it endures the vicissitudes of time, for as long as human intelligence and foresight can see, capable of meeting all situations and contingencies as can be predicted. Each and every Constitution must have such basic qualities as would make it permanent. Such basic laws cease to be basic if there are stresses and strains within it which in time are bound to blow it to pieces.

8. To have the character and quality of permanence it has to be the expression of the will and judgement of the entire community. A set of laws possessing such character alone can evoke the emotional loyalty of this generation and generations to come. Such loyalty and emotion are its strongest buttres and its impregnable defence. A document which depends on external forces other than the will of the people will have no chance of popular support, when in jeopardy.

9. The present Constitution, lacks the basic strength stated above viz, popular consensus enshrined in basic laws framed by the peoples, Representatives entrusted with that mandate and this without reference to its other merits.

10. Besides, the present document is framed on a distrust of popular will, whatever be the justification put forward for that. A body of eighty thousand electors have been provided for as base of the system in a population of more than eighty million. The Assemblies created on the Vote of these electors have practically been given no power to decide anything. Nothing can be done by these bodies unless the President agrees. Whereas the President, after the initial start, can rule without any – agreement of the assembly, both in the legislative and in the executive fields. Experiences of barley 3 weeks working have already demonstrated that the present scheme is unworkable unless it is radically remodelled and changed. It is impossible to expect any genuine co-operate on between the Government and the Assemblies on the present basis. The members will only be tempted to demonstrate their usefulness by turning to acute and extreme criticism of the Government as they have neither any power of shaping directly the policy of the Government nor its activities. The distrust will spread into the country rendering Government more unpopular, Men of ability and independance will hardly be attracted to join such Government, and Administration will completely pass into the dead and soulless hands of bureaucracy.

11. We therefore, urge that steps be taken to have special body elected as soon as possible to give the country a Constitution to make its acceptance unquestioned by the people.

With all the materials on the subject that have accumulated during the last 15 years, a Constitution can be hammered out as will be suitable and will meet the peculiar problems of this country, in the course of 6 months at the longest.

12. In the circumstances of the above recommendations we purposely do not enter into the question as to whether the Constitution to be so framed should be of the Presidential type or Parliamentary type. We are conscious that by far the largest volume of opinion is for the parliamentary form. The reasons are historical; our long association and experiences of the working of this system predisposes us to it.

13. Similarly we need hardly say much over question whether it should be federal for unitary in-character. This question is not very controversial either. More or less it is accepted by all shades or opinion, that has to be federal with a majority of subjects being with the units particularly in view of our peculiar Geography,

14. The other buring topic to be dealt with is the growing imbalance in the economic progress in the two wings. We believe that there is not want of good will in the people of West pakistan and East pakistan for each other. Public men once entrusted with real responsibility is bound to rise above all narrowness and are sure to concentrate on developing the economy of the country as a whole giving greater attention to the backward areas wherever they are.

15. All narrow and parochial interest that are responsible for the unequal progress of the two wings had free play as the people had very little say in the policy making of the state so long. Once public opinion can assert itself through their elected representatives all reactionary forces and vested interests will be in the retreat. Much of the disparities between the wings have arisen out of the fact that East Pakistan had rarely shared effective political power in the country’s policy making particularly on economic affairs and searely has or had a say in the executive organisations, responsible for carrying out these economic policy into practice. In fact since independence all political powers were concentrated into the hands of a small group of permanent services, here having been not one single general election in the country by which the people could have a say in the country’s affairs.

16. The next important for consideration is what needs be done during the interim period.

17. The good will generated by the lifting of the Martial Law needs to be further strengthened by further statesman like acts. The distance between the people and the organs of administration should not be allowed to grow. It is a great responsibility for the President Ayub and we have every hope that it is fully appreciated.

18. Pending the adoption of a permanent Constitution by the method proposed by us, the Government of the Country has to be carried to be on.

19. But even in the interim period some essential changes need be made in the document under which the Government is being carried on.

20. It is necessary that Fundamental Rights as enumerated in the 1956 Constitution be incorporated as such in the present Constitution, and made justiciable, instead of enumerating them as principles of ‘law- making’ as in the present document.

21. These can be easily incorporated in the present document either by Presidential Order or through the Legislative process as provided for in the Constitution. What is more necessary is that the executive should trust the Assemblies brought under existence under this Constitution. All temptation to fill the house with persons holding office of profit should be checked. Otherwise whatever little freedom the houses have, will vanish. We should not forget that trust begets trust.

22. All political prisoners detained without trial should be set at liberty to restore an atmosphere of confidence in the country and all penal actions regarding politicians should be done away with

23. Political parties are the very breath of representative democracies. As life without breath is unthinkable so this elective system without the disciplined parties is unworkable Party means discipline. No representative body can function with a large body of individuals without any kind of ties binding them and controlling their conduct behaviour within and without. No obligation except that of self-interest will influence members of partyless houses. Finally regular periodic elections are a must in as much as it is the ultimate check on individuals as on parties against irresponsible conducts. So all obstacles against the growth of party should be done away with.

Till democracy is ushered in however, we must think in terms of the National issues now facing the country as a whole. People from all walks of life, be a private citizen, a member of the profession or of the services must make their contributions jointly to its solution.

24. Finally, we feel duty-bound to say that we are passing through very trying and unsettled times. It is not peculiar to us alone. We need all the organs of the state and the Nation to act in harmony, in full understanding and co-operation as a united people to be able to face all the unforeseen contingencies. Those in whose hands destiny has placed the fate of the country shoulder the greatest responsibility to bring about that unity and to lay the foundation of a Nation united on a firm and sound footing. Let us complete the task of Constitution making as quickly as posible and free ourselves from this controversy and concentrate on the nation building tasks as a united people determined to fulfil the destiny which is ours.

Sd-1. Nurul Amin                                                       6. Yousuf Ali Chowdhury

 2. Ataur Rahman Khan                                              7. Mahmood Ali

 3. Hamidul Hoq Chowdhury                       8. Syed Azizul Hoq

 4. Abu Hossain Sarker                                                9. Maulana Pir Mohsen Uddin Ahmed

 5. Sheikh Mujibur Rahman

অর্থাৎঃ

“অবশেষে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়াছে। দেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে দীর্ঘ ৪৫ মাস কাল যে তমসা বিরাজ করিতেছে, আজ তাহা আংশিক অপসারিত হইয়াছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পথে অগ্রগতির দ্বার উন্মুক্ত হইতে চলিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে; কিন্তু সত্যিকারের গণতন্ত্র এখনও অনেক দূরে। ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইউব খান যে শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করিয়াছেন, তাহাতে আশার আভাস থাকিলেও উহার বাস্তব রূপায়নে কোন লক্ষণ নেই। যে বিষয়টি আজ গণমনকে গভীরভাবে আলোড়িত করিতেছে, তাহা হইল- শাসনতন্ত্র। সমগ্র জনসংখ্যার সামান্য অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেো সাম্প্রতিক নির্বাচনের সময় এই শাসনতন্ত্রই ছিল সকলের মূল আলোচ্য বিষয়। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রত্যেক প্রার্থীই একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কায়েমের পক্ষে তাহাদের নির্বাচনী ওয়াদা দিয়েছিলেন। নির্বাচনের পরবর্তী বিগত ৬ সপ্তাহে কার্যোপযোগী একটি শাসনতন্ত্রের পক্ষে জনমত আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। এমতাবস্থায় এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আমরা আমাদের মতামত ব্যক্ত না করিলে কর্তব্যের খেলাফ করা হইবে বলিয়া মনে করি এবং বিশ্বাস করি, এই মতামত ব্যক্ত করিতে গিয়া আমরা দেশবাসীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আশা-আকাংক্ষার প্রতিধ্বনি করিতেছি। বিবর্তন এবং শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমেই কেবলমাত্র দেশের সত্যিকার ও সুষ্ঠু অগ্রগতি সাধিত হইতে পারে। অবাধ বিতর্ক ও আলোচনার পূর্ণ নিশ্চয়তা যেখানে আছে, কেবল সেখানেই তাহা সম্ভব।

এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্থায়ী ও সহজে কার্যক্ষম শাসনতন্ত্রই জাতীয় সংহতি ও স্থায়িত্বের পূর্বশর্ত। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সত্যিকার জনপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক প্রণীত না হলে কোন শাসনতন্ত্র টেকসই হইতে পারে না।

আমাদের এই বক্তব্যের কারণ হচ্ছে এই যে, যে ধরনের শাসনতন্ত্র প্রণীত হউক না কেন, পদ্ধতিগত ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্টের দিক দিয়া উহাকে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হইতে হইবে। জনগণ দেশের সার্বভৌমত্বের অধিকারী ইহাই গণতন্ত্রের সার কথা। জনগণই হইবে সকল ক্ষমতার উৎস। এমতাবস্থায় কোন কিছুকে স্থায়ী ও সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপযোগী করিতে হলে সর্বপ্রথম উহাকে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী রূপ দিতে হইবে। এই ইচ্ছা হইবে সমষ্টিগত ও সুসংহত ইচ্ছা। এই ইচ্ছার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য চাই প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ সব রকমের প্রতিবন্ধকতা মুক্ত অবাধ পরিবেশ।

শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় নেতাদের লক্ষ্য থাকে, যাহাতে ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করিয়া সে শাসনতন্ত্র টিকিয়া থাকিতে পারে এবং মানুষের চিন্তা ও দূরদৃষ্টির সীমানার মধ্যে যা কিছু বাধা বিপত্তি ও সঙ্কট আসিয়া দাঁড়ায়, তাহার মোকাবেলায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করিতে পারে। সুতরাং স্থায়িত্ব অর্জনের জন্য যা কিছু মৌলিক গুণের প্রয়োজন, প্রত্যেক শাসনতন্ত্রতেই সেগুলি থাকিতে হইবে। এই মৌলিক গুণগুলি আর মৌলিক থাকে না- যদি আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কালক্রমে সেগুলো লণ্ডভণ্ড হবার সম্ভাবনা থাকে।

শাসনতন্ত্র স্থায়িত্বের বৈশিষ্ট্য ও গুণ সম্পন্ন হইতে হইলে উহার অবশ্যই সমগ্র জাতির ইচ্ছা ও বিচারবুদ্ধির প্রতিফলন হইতে হইবে। কেবলমাত্র এই পদ্ধতিতে গ্রণীত বিধানাবলী আমাদের বর্তমান ও অনাগতকালের ভাবি বংশধর এর মনে অকৃত্রিম আনুগত্য ও আবেগ জাগাতে পারে। এই আনুগত্য ও আবেগ শাসনতন্ত্রের প্রধান অবলম্বন ও দুর্ভেদ্য কর্মবিশেষ। অপরপক্ষে, জনমতের ইচ্ছার উপর নির্ভর না করিয়া বাহির হইতে চাপানো কোন শাসনতন্ত্র বিপর্যয়ের মুখে কোন জনসমর্থন লাভ করিতে পারে না একই উদ্দেশ্যে জনগণের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক জনগণের ইচ্ছামাফিক প্রণীত না হওয়ায় বর্তমান শাসনতন্ত্রে উপরোল্লিখিত অন্তর্নিহিত মৌলিক শক্তিগুলো অবর্তমান।

তাহা ছাড়া সংশ্লিষ্ট মহল হইতে যে কৈফিয়ত দেওয়া হোক না কেন, এইকথা সত্য যে, জনমতের প্রতি অবিশ্বাস এর ভিত্তিতে নয়া শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়েছে। দেশের জনসংখ্যা যেখানে ৮ কোটিরও বেশি সেখানে ভোটারধিকার দেওয়া হইয়াছে মাত্র ৮০ হাজার লোককে। এবং তাহারই ভিত্তিতে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি এই নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে যে সব পরিষদ গঠন করা হয়েছে, সেগুলোকে বাস্তব ক্ষেত্রে কোন ক্ষমতাই দেওয়া হয় নাই। প্রেসিডেন্ট সম্মতি না দিলে এইসব পরিষদের কোন কিছুই করিবার ক্ষমতা নাই। অথচ, আইন প্রণয়ন ও শাসনক্ষেত্রে পরিষদের মতামত অগ্রাহ্য করিয়া বা তাহাদের সহিত একমত না হইয়াই প্রেসিডেন্ট দেশ শাসন করিয়া যাইতে পারেন। মাত্র ৩ সপ্তাহের অভিজ্ঞতা হইতে এই কথাই প্রমাণিত হইয়াছে যে, আমূল পুনর্বিন্যাস ও পরিবর্তন ব্যতিরেকে নয়া শাসনতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে কাজের অনুপযোগী। এমতাবস্থায় বর্তমান ব্যবস্থার ভিত্তিতে সরকার ও পরিষদের মধ্যে সত্যিকারের সহযোগিতার আশা বাতুলতা মাত্র।

প্রত্যক্ষভাবে সরকারি নীতি অথবা ইহার কার্যকলাপ নির্ধারণের কোন ক্ষমতা না থাকায় সদস্যরা শুধুমাত্র সরকারের তীব্র ও চরম সমালোচনার মারফত নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করিতে প্রলুব্ধ হইবে। অবিশ্বাস দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে সরকারকে অধিকতর অপ্রিয় করিয়া তুলিবে। যোগ্য ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিরা এই ধরনের সরকারে যোগ দিতে আগ্রহবোধ করিবেন না। আর উহার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিষ্প্রাণ আমলাতন্ত্রের হস্তে ন্যস্ত হইবে।

.               সুতরাং দেশবাসী বিনাদ্বিধায় গ্রহণ করিবে- এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিবার জন্য যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিশেষ সংস্থা গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা আহ্বান জানাইতেছি।

প্রত্যেক শাসনতন্ত্রে সেগুলো থাকিতে হইবে। এই মৌলিক গুণগুলো আর মৌলিক থাকে না যদি আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কালক্রমে সেগুলো লণ্ডভণ্ড হবার সম্ভাবনা থাকে।

দীর্ঘ ১৫ বৎসর যাবত শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে যা কিছু তথ্য সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা দ্বারা উর্ধ্বপক্ষে ৬ মাসের মধ্যেই এদেশের বিশেষ সমস্যার মোকাবেলা করিতে সক্ষম এমন একটি উপযুক্ত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা একান্তই অপরিহার্য।

উপরিউক্ত সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্সিয়াল না পার্লামেন্টারি ধরনের হইবে, সে প্রশ্ন উত্থাপন হইতে আমরা ইচ্ছা করিয়াই বিরত থাকিতেছি। তবে এই ব্যাপারে আমরা সচেতন যে, জনমতের বৃহত্তম অংশ পার্লামেন্টারি ধরনের সরকার পক্ষপাতী। ইহার কারণ ঐতিহাসিক। কেননা, পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকারের সহিত তাহাদের দীর্ঘদিনের পরিচয় ও উহার রূপায়ণে বহুদিনের অভিজ্ঞতাই আমাদের উহার অনুকূল করিয়া তুলিয়াছে। অনুরূপভাবে শাসনতন্ত্র ফেডারেল ধর্মী হবে, না ইউনিটারী-সে প্রশ্নেও বেশি কিছু বলিবার প্রয়োজন করে না, বস্তুতঃ এই প্রশ্নটি তেমন একটা বিতর্কমূলক কিছু নহে। দেশের সর্ববাদীসম্মত অভিমত হলো, দেশের বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ বিষয় ইউনিটের হাতে রাখার ব্যবস্থাসহ ফেডারেল শাসনতন্ত্র কায়েমের পক্ষে।

আর যে একটি জ্বলন্ত সমস্যার প্রতিকারের ব্যবস্থা করিতে হইবে তাহা হইল অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে দেশের দুই অংশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। আমরা বিশ্বাস করি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সদিচ্ছার কোন অভাব নাই। জনপ্রতিনিধিগণকে একবার সত্যিকার দায়িত্ব দেওয়া হইলে সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠিতে তাহারা যে বাধ্য এবং সেই অবস্থায় দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করিয়া তাহারা সে দেশের অনুন্নত অঞ্চল গুলোর প্রতি অধিকতর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিবেন, তাহা সুনিশ্চিত।

বলাবাহুল্য, এতদিন ধরিয়া রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে জনসাধারণের কোন কথা বলিবার সুযোগ না থাকায় সংকীর্ণ ও শ্রেণি স্বার্থের হাতে দেশের দুই অংশের মধ্যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হইতে পারিয়াছে। এক্ষণে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মারফত একবার যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনমত প্রতিষ্ঠা পায়, তাহা হইলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও কায়েমী স্বার্থের দিন যে ফুরাইয়া আসিবে- ইহাও সুনিশ্চিত। ইতিপূর্বে দেশের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে বিশেষ করিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুর্ব পাকিস্তান সত্যিকার রাজনৈতিক ক্ষমতায় শরীক হওয়ার সুযোগ কচিৎ পেয়েছে। এমন কি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের নীতি বাস্তাবায়নের দায়িত্ব যাহাদের হাতে, সেই সব প্রশাসনিক সংস্থার কার্য পরিচালনার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগও পূর্ব পাকিস্তানের ছিল না। বস্তুতঃ এই সবই হইল দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির প্রধানতম কারণ। স্বাধীনতা উত্তর যুগে প্রকৃত প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক ক্ষমতারই সমাবেশ ঘটিয়াছিল মুষ্টিমেয় সরকারি অফিসারদের হাতে। তদুপরি আজ পর্যন্ত দেশে একটিও সাধারণ নির্বাচন না হওয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে জনসাধারণ কথা বলার কোন সুযোগ পায় নাই।

এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন কি করণীয়, তাহাই হইল পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এই প্রশ্নে আমরা বলিতে চাই, সামরিক শাসন প্রত্যাহৃত হওয়ার ফলে দেশে যে সদিচ্ছার সৃষ্টি হইয়াছে তাহাকে আরও জোরদার করার জন্য প্রয়োজন রাজনীতিসুলভ প্রকার। দেশবাসী, সাধারণ ও সরকারি শাসনতন্ত্রের মধ্যে ব্যবধান প্রাচীর গড়িয়া উঠিতে দেওয়া আর চলিবে না। এই ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট আইউবের দায়িত্ব অপরিসীম এবং আমরা আশা করি, তিনি ইহার সারবত্তা সম্যক উপলব্ধি করিবেন। আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতি মতে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়া সাপেক্ষে দেশের সরকার পরিচালনার কাজও চালাইয়া যাইতে হইবে।

তদুপরি যে দলিলের বলে বর্তমান সরকারি কার্যাদি পরিচালিত হইতেছে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য তাহার কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করিতে হইবে।

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অংশটিকে বর্তমান শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশ করিয়া জনসাধারণের মৌলিক অধিকার আদালতের একতিয়ারভুক্ত করিতে হইবে।

বস্তুতঃ এই মৌলিক অধিকারগুলি প্রেসিডেন্ট ফরমান বলে অথবা শাসনতন্ত্রের বিধান মাফিক জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে সহজেই বর্তমান শাসনতন্ত্র সন্নিবেশ করা যেতে পারে। সর্বোপরি যাহা প্রয়োজন তাহা হইল, বর্তমান শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী যে পরিষদ গঠিত হইয়াছে প্রতি শাসক কর্তৃপক্ষকে আস্থাশীল হইতে হইবে।

তদুপরি লাভজনক নপদ বন্টন করিয়া ভাগ্যবান সদস্যদের দ্বারা পরিষদ গৃহ ভরাট করিবার আসক্তি বর্জন করিতে হইবে। অন্যথায় পরিষদের যেটুকুবা স্বাধীনতা আছে, তাহাও লুপ্ত হইবে। ভুলিলে চলিবে না যে, বিশ্বাসেই বিশ্বাস বাড়ে। দেশে আস্থার ভাব যাহাতে ফিরিয়া আসে তজ্জন্য বিনা বিচারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে হইবে এবং রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে গৃহীত যাবতীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটাইতে হইবে।

রাজনৈতিক দলই হইল প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু। প্রাণবায়ু ব্যতীত যেমন জীবনের অস্তিত্বে কল্পনা হইতে পারে না, তেমনি শৃঙ্খলামুক্ত রাজনৈতিক দল ব্যতীত নির্বাচন পদ্ধতিও কর্মক্ষম হইতে পারে না। বিরাট কোন মানব গোষ্ঠীর সহিত কোন প্রকার সম্পর্কসূত্র থাকিলে কোন প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনই চালু থাকিতে পারে না। রাজনৈতিক দল-বর্জিত পরিষদেও স্বার্থশিকার ব্যতীত অন্য কোন দায়িত্ববোধ সদস্যদের প্রভাবিত করিতে পারে না। এবম্বিধ পদ্ধতিতে নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচিত সদস্যের উপর নির্বাচকমণ্ডলীর আর কোন প্রভাবও থাকে না। এমতাবস্থায় দেশে রাজনৈতিক দল গড়িয়া উঠার পথে যা কিছু অন্তরায়, উহার অবসান ঘটাইতে হইবে।

দেশে যতক্ষণ না সত্যিকার গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটিতেছে, ততক্ষণ আমাদিগকে সামগ্রিকভাবে দেশের সব ধরনের সমস্যাকে জাতীয় দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করিতে হইবে। জীবনের সর্বস্তর হইতে তাহা তিনি সাধারণ নাগরিকই ইউন, আর বুদ্ধিজীবী বা চাকুরীজীবীই হউন-সকলকে আজ সমবেতভাবে আগাইয়া আসিতে হইবে এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য।

উপসংহারে আমরা বলিতে চাই যে, আজ এক বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন; স্থিরতাহীনতার মধ্য দিয়া সে আগাইয়া চলিয়াছে। এই ব্যবস্থা কেবল যে আমাদের নিকটই বিচিত্র ঠেকিতেছে, তাহা নহে।

রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে আজ প্রয়োজন গভীর সম্প্রীতি, পূর্ণ সমঝোতা ও সহযোগিতা-যাহাতে সংঘবদ্ধ একটি জাতি হিসাবে যেকোন অভাবিতপূর্ণ জরুরি অবস্থারও আমরা মোকাবেলা করিতে পারি। যাহাদের হস্তে আজ দেশের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব বৰ্তাইয়াছে, এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি সুষ্ঠ ও সুনিশ্চিত ভিত্তির উপর একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়িয়া তুলিবার এই বিরাট দায়িত্ব আজ তাহাদেরকে বহন করিতে হইবে।

আসুন, যতশীঘ্র সম্ভব আমরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ শেষ করিয়া এই বিতর্কের হাত হইতে নিজদিগকে মুক্ত করিয়া অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার দুর্জয় সংকল্প লইয়া একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে গঠনমূলক কাজে মনোনিবেশ করি।” বিবৃতিতে যাহারা স্বাক্ষর করেন তাহারা হইতেছেনঃ নূরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, শেখ মুজিবর রহমান, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), মাহমুদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক ও মোহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া)।

(ঢাকা, ২৪শে জুন, ১৯৬২)।

৮ই জুলাই (১৯৬২) ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় ৯ নেতা সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনগণ কর্তৃক গণপরিষদ নির্বাচন এবং দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দ যথা শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফর খান, আবদুস সামাদ খান আচাক জাই, আল্লামা মাশরেকীসহ বিনাবিচারে আটক সকল রাজবন্দির অবিলম্বে মুক্তিদানের দাবি জানান।

পূর্ব পাকিস্তানে জনমতের ঢেউ এবং জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ অভ্যন্তরে বিরোধী দলীয় সদস্যদের ভূমিকা সমগ্র পাকিস্তানে রাজনৈতিক শূন্যতা অবসানের অপ্রতিরোধ্য আবেদন সৃষ্টি করে এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইস্পাত দৃঢ় ঐক্যের শুভ সূচনা ঘটায়। ঢাকা ও করাচি হইতে ন্যাশনাল ফ্রন্ট গঠনের আওয়াজ উঠে। ৯ই মে (১৯৬২) প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক জারিকৃত পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স রাজনীতিবিদদের ঐক্যে আরও দৃঢ় হইতে সহায়তা করে। রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের ঐক্যে ভীত সন্ত্রস্ত প্রেসিডেন্ট আইউব খান জনতার ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করিবার মানসে ১৯৬২ সালের ১৪ই জুলাই ‘রাজনৈতিক দল বিধি’ (Political parties Act) প্রণয়ন করেন। সেপ্টেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কনভেনশনে নির্দলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট আইউব খান স্বয়ং চৌধুরী খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) গঠন করেন ও উত্তরকালে ইহার নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন।

সোহরাওয়ার্দীর কারামুক্তি

পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম স্রষ্টা ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মান্যবর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে (৩০শে জানুয়ারি ১৯৬২ গ্রেফতার) ১৯শে আগস্ট ১৯৬২ কারামুক্তিকালে নিম্নলিখিত প্রেসনোটে অবৈধ সেনাপতিরাজের জঘন্য চেহারা প্রতিভাত হয়। কারামুক্তির পর জনবরেণ্য নেতার সরকারি প্রেসনোটের প্রতিবাদে দেয় উত্তরও নিম্নে দেওয়া হইলঃ

The press Note of January 30 explaining the reasons of his arrest had said in part:

“It is already well known that Mr. Suhrawardy ever since the inception of pakistan had been for reasons of personal aggrandisement, indulging in activities which were of a highly prejudicial nature and it would not be unfair to say that in a large measure, he along with several others, was responsible for the predicament in which Pakistan found itself in the latter half of 1958. The role played by Mr. Suhrawardy and people of his ilk had virtually brought the country to the brink of major disaster and led to the revolution. With the consummation of the revolution the rot that had set in was stemmed-not only was it stemmed but positive gains were achieved in the course of the last three years and more. Throughout this period it has been the avowed policy of the Government not to victimise or punish any one for his past misdeeds even though they bordered on the criminal. And it was for this reason that even the politicians whose conduct had been scrutinised by EBDO tribunals were treated generously. Mr. Suhrawardy was one of such persons.

But Mr. Suhrawardy misunderstood this generosity and as his ambitions knew no bounds be continued to indulge in activities prejudicial to the integrity and safety of Pakistan. It is a sad thought that a man of his intelligence and experience, instead of serving the country in the manner of a good patriot has taken it upon himself to play a destructive role. Even after the revolution Mr. Suhrawardy has openly associated with anti-Pakistan elements both within and out side the country.”

“It was in these circumstances that the Government have been reluctantly compelled to order the detention of Mr. Suhrawardy whose activities in the recent past have been fraught with such danger to the security and safety to Pakistan that one could fairly describe them as being treasonable.”

Following is the text of the Press Note issued by the ministry of Home Affairs:

Mr. H.S. Suhrawardy was detained under the Security of Pakistan Act, 1952 on January 30, 1962 as such a step was then considered necessary to prevent him from acting in a manner prejudicial to the security of Pakistan.

“The Government is now satisfied that Mr. Suhrawardy will not henceforth participate in any disruptive activities.”

“It has, therefore, been decided to release him forthwith and an order of his release was accordingly been issued today August 19, 1962”.

Following is the text of the statement issued by former Prime Minister, Mr. H.S. Suhrawardy, on his release from Karachi Central Jail after over six months of detention:

After giving praise to Allah and the holy Prophet (Peace be on him), I wish to thank all those people, who have been demanding my release, within the legislatures and outside particularly those, who had not believed the charges, that were levelled against me.

I hardly think it necessary to deny that I was attempting to disrupt East pakistan and thereafter planned to disrupt West pakistan, that I was not above taking money from enemy sources or that I was indulging in treasonable activities for those who know me and who know the services that I have rendere in the creation of Pakistan and perhaps the services which I rendered during the time I was the prime Minister of this country can not possibly be given credence to this.

Incidentally these allegations, which were published against me, had nothing to do, whatsoever, to the reasons given to me by the Central Government for my detention. These were entirely different and I need hardly to discuss them.

I thank my friends all the more because I had never the chance to deny these charges and yet from the very kind words that have been expressed on my behalf, it would appear that it was not necessary for me to do so and the charges have not been believed.

During my detention, other people, too, were let loose to make foul charges against me. Thanks to the protection of Allah and his prophet (peace be on Him), my forefathers and respected parents, none of these appear to have been believed.

I was to thank particularly my student friends. May Allay bless them and keep them on the right path and may they always serve the cause of truth and justice. I hug them and embrace them.

It is a foul charge against them that they are the tools of Subversive elements. The students know their own mind very well and there is no need for any body outside their category to influence them.

At present, do not feel strong enough to make a long statement and deal with controversial matters which have arisen during the last few months. But I would like to say one thing just now, which I should expand later.

Please stop the campaign of Vilification and abusive language against the discredited” politician. For four years there has been a campaign to discredit us. At the end of four years, it is those “discredited” politicians that the country is looking forward for a lead.

What is the point in carrying on this campaign further. As a matter of fact we have noticed that this campaign is backfiring. Let us now, if we want to serve the country start with constructive thinking instead of vitiating the atmosphere by vilification and abusive language.

In conclusion Mr. Suhrawardy hoped that other political workers now detained in Jail would also be released by the Government.

সমগ্র দেশব্যাপী রাজবন্দি মুক্তি আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ১৯৬২ সালের ১৯শে আগস্ট মুক্তি দান করেন। কারামুক্তির পর চিকিৎসার জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতাল ত্যাগের পর জনাব সোহরাওয়ার্দী ৮ই সেপ্টেম্বর ঢাকা আগমন করেন। ঢাকা বিমান বন্দরে লক্ষ লোকের জনসমুদ্র সোহরাওয়ার্দীকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন।